০৭. নয়নতারা রাজবাড়ির পালকিতে

সপ্তম পরিচ্ছেদ

০১.

সুতরাং একদিন পরেই নয়নতারা রাজবাড়ির পালকিতে ফরাসডাঙা চলেছিলো। তখন শীতের আরামদায়ক উষ্ণতার মধ্যাহ্ন। যোগাযোগের ফলে নয়নতারার পালকিতে হেডমাস্টারের স্ত্রী ক্যাথরিন, কেট। পালকির পাশে, কখনো কিছু আগে, রাজকুমার রাজচন্দ্র তার খয়েরি কালো প্রকাণ্ড ঘোটকীতে। পালকির কিছু আগে হাওদাদার হাতি, পায়ে পায়ে কয়েকজন বরকন্দাজ, পালকির পিছনে আর কয়েকজন বরকন্দাজের আগে আগে রূপচাঁদ। একটা চোখ ধাঁধানো শোভাযাত্রা।

যোগাযোগটা এই রকম। নয়নতারা আহারদি শেষে বন্দোবস্ত মতো নিজের বাড়ি থেকে রাজবাড়ির পালকিতে রওনা হয়েছিলো, পালকির সঙ্গে একজন বরকন্দাজ থাকেই। রাজুর তা জানার কথা নয়। আহারাদি শেষে দুপুরের রোদ ঝুলবারান্দায় যেখানে আরামদায়ক সেখানে দাঁড়িয়ে সে অন্যমনস্ক হয়ে নিচে কাছারি চত্বরে হাওদাদার হাতি, রূপচাঁদ,বরকন্দাজ প্রভৃতি দেখছিলো। কে যেন বললো, এরা কুতঘাটে যাবে। কুতঘাট বর্তমানে ফরাসডাঙা ঘেঁষে পড়েছে। তাতে রাজুর মনে হলো সেও ফরাসডাঙা যাওয়ার কথা ভাবছে। এই দুপুরটা তা যাওয়ার মতোই। সুতরাং সে আস্তাবল থেকে নতুন ঘোটকটাকে আনিয়ে রওনা হয়েছিলো।

রাজচন্দ্রর ঘোড়া যখন হেডমাস্টারের বাড়ির কাছে, সে দেখতে পেয়েছিলো গেটের বাইরে টপহ্যাট মাথায় ছাতা হাতে বাগচী, গেটের ভিতরে কিন্তু গেটের উপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে কেট। সে সুতরাং লাগাম টেনে সেখানকার রোদে দাঁড়িয়ে গল্পে জমেছিলো।

রূপচাঁদ গঞ্জের পথে উঠেই রাজবাড়ির সেই ঝালরদার আট বেহারার পালকি দেখে মাহুতকে হাতি ধীরে নিতে বলে পালকির দিকে নিজে এগিয়েছিলো। পালকির কাছে যেইমাত্র বুঝেছে পালকিতে নয়নতারা, তখনই অদূরে হেডমাস্টারের গেটের সামনের দৃশ্যটাও দেখতে পেলো। বললো, রাজকুমারকে দেখছি।

রূপচাঁদের কথায় পালকির দরজা আর একটু মেলে নয়নতারাও রাজকুমারকে দেখতে পেয়ে পালকি থামিয়েছিলো।

নিজেদের অজ্ঞাতসারে পালকি, হাতি, রূপচাঁদ এবং বরকন্দাজেরা যে শোভাযাত্রা তৈরী করেছিলো তা নিঃশব্দও নয়। বেহারাদের হুমহাম,হাতির গলার ঘণ্টা তো ছিলোই। পালকির ঝালরে, হাতির জামায়, বরকন্দাজদের পাগড়িতে তা রংদারও বটে।

নয়নতারা স্পষ্ট কিন্তু নিচু গলায় বললো–বেশ একটা ছবিই যেন। তার বক্তব্য ছিলো কেট, বাগচী ও রাজকুমারের সংযোগকে উদ্দিষ্ট করে।

রাজচন্দ্র মুখ ফিরিয়ে নয়নতারাকে দেখে হেসে বললো–কোথায় চলেছছ? দ্যাখো, দ্যাখো কেট, কবরেজমশায়ের রোগী দেখতে যাওয়া কাকে বলে।

নয়নতারা বললো, প্রজাদের নানা উপজীবিকা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সামনে পিছনে চেয়ে সেই জৌলুস চোখে পড়ায় সেও বিস্মিত এবং লজ্জিত হলো। উপরন্তু বাগচীও তাকে বিস্মিত হয়ে দেখছে, আর বাগচীর সঙ্গে ছদ্ম ব্যবহারও চলে না। নয়নতারা একেবারে সহজ হয়ে বলনোক্যাথরিন, ফরাসডাঙার মন্দির দেখতে যাচ্ছি। তুমিও এসো না। এতক্ষণে তোমাদের লাঞ্চে নিশ্চয় শেষ হয়েছে।

কেট না-যাওয়ার অজুহাত হিসাবে বললে হাসিমুখে–জৌলুস থামিয়ে তো পোশাক করা যায় না, আর পোশাক না করে জৌলুসেও যাওয়া যায় না।

নয়নতারা সুবিধা পেয়ে বললো–যে পোশাকে রাজকুমারের সঙ্গে দেখা করা চলে সে পোশাকে তার রাজ্যে সর্বত্রই মুখ উঁচু করে চলা যায়। এসো এসো।

বাগচী হেসে বললো–যুক্তিতে হারলে কেট। অন্য কহ আর। কিংবা যাও না রোদটা গায়ে লাগাতে!

রাজকুমার বললো–গেট ইন, গেট ইন।

নয়নতারা বললো–ওমা, ইংরেজি বলছেন যে! শিগগির পালিয়ে এসো।

বাকিটা অবশ্যই তরুণী মনের রঙ্গমুখিনতা।

পালকির কাছাকাছিদলপতি রূপদ থেমে দাঁড়ানোর ফলে মাহুত তার হাতিকে খানিকটা এগিয়ে পথের ধারে দাঁড় করিয়েছিলো, রূপচাঁদের সঙ্গের বরকন্দাজেরা পালকির কিছু পিছনে। তাদের গন্তব্য যাই হোক রাজকুমারকে ডিঙিয়ে চলে যেতে কোনোরকমের একটা ইশারা চাই।

কেট পালকিতে উঠলে, পালকি কাহারদের কাঁধেউঠলে,নয়নতারা মুখ বাড়িয়ে বললো, আগে আগে চলুন রাজকুমার। রাজচন্দ্র বরং দ্বিধা করলো। ফরাসডাঙায় সে যেজন্য যাচ্ছে তা কি নয়নতারাদের সঙ্গে গেলে সার্থক হয়? তখন নয়নতারা হেসে কেট আর রাজচন্দ্র যাতে শোনে শুধু এমন গলায় বললো–দ্যাখো কেট, তোমাকে বলেছিলাম, হিন্দুদের অমন যে সদাশিব তারও বর দিতে কত বায়নাক্কা। কেট সম্ভবত নয়নতারা কবে এরকম বলেছিলো কী অর্থে তা ভেবে দেখতে গেলে, ফলে সে নয়নতারার জ্বর জ্যামুক্ত তীরটাকে দেখতে পেলো না।

সুতরাং তাদের গন্তব্য যাই হোক, হাতি, হাতির পরে তার খয়েরি কালো ঘোটকীতে রাজকুমার, পরে সেই জরির ঝালরদার পালকি, তারপর ছুটন্তবরকন্দাজদের নিয়ে রূপচাঁদ, এইভাবে সেই জৌলুসটাকে এগিয়ে যেতে দেখলে বাগচী। সে ভাবলো, কী এমন ব্যাপার আবার রাণীমার শিবমন্দিরে যে আজ এমন উজ্জ্বল শোভাযাত্রা!

কিন্তু কেট এভাবে চলে যাওয়ায় তার কর্তব্য দেখা দিলো। কেট কখন ফিরবে কে জানে, সেও সন্ধ্যার আগে ফিরবে না। তার কুঠিতে ঝি-চাকর বলতে সবেধন এক সহিস। সুতরাং তাকে ডেকে ফাঁকা বাসার দিকে চোখ রাখতে এবং মেমসাহেবের ফিরতে দেরি হলে সন্ধ্যার আগে আগে সহিস যেন কয়েকটা বাতি জ্বালায় এমন নির্দেশ দিলো সে। এইসময়ে তার মনে হলো তাদের কুঠিতে ঝি, চাকর, আয়া, খিদমদগার বলতে কেউ নেই।

এখন আর দ্বিধা হয় না। কিন্তু কেট তার স্ত্রী হওয়ার পরে মনে হতো বৈকি বাগচীর, কেটের মতো ইওরোপীয় কোনো মহিলার কুঠিতে এদেশে অন্তত, কাজ থাক আর নাথাক, সহিস ছাড়াও একজন ফুটম্যান, একজন বাবুর্চি, অন্তত চার-পাঁচজন ঝি-চাকর থাকে। কেটের বাবা ফাদার অ্যানড্রজের সেন্ট্রাল প্রভিন্সের মিশন-বাংলোতেও তা থাকতো। প্রথম যখন এখানে তারা এসেছিলো দেওয়ানজি নিজে থেকেই ঝি-চাকর ঠিক করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। বাগচীর মনে আছে, সে নিজে বলেছিলো দুজনের ছোট্ট একটা সংসার, সেলফ হেল্পই ভালো হবে। কেট হেসে বলেছিলো, আমাদের দেশে মধ্যবিত্তদের পরিবারে ঝি চাকর তেমন থাকে না। এদেশে থেকে যারা টাকাপয়সা করে তাদের কথা আলাদা। পরে কেট তাকে বলেছিলো, এদেশে সমাজ কোথায় যে মান রাখতে ঝি-চাকর রাখতে হবে?

এটা কিন্তু বাগচী হালকা মনে তার স্কুলের দিকে যেতে যেতে ভাবলো, সেলফ-হেল্প ভালো, আর সমাজে মান রাখার প্রয়োজনের অভাব কি দুরকম কথা নয়? এইসময়ে বাগচী তার চোখের উপরেই যেন কেট ও নয়নতারার সেই উজ্জ্বল শোভাযাত্রাটাকে দেখতে পেলো। কী যেন? নিজের মনে এই প্রশ্ন করলো বাগচী হাসি হাসি মুখে। মনে পড়ায় সে হাসলো। এখানে আসার পরে মনে মনে সে বললো, তোমার মনে পড়বে কেট, পালকি চড়া নিয়ে সে বেশ একটা ব্যাপার হয়েছিলো। দেওয়ানজি কুতঘাটে পালকি রেখেছিলো। এখানে সমাজের উচ্চতর অংশের তাই তো স্বাভাবিক যানবাহন। সেদিন কিন্তু সে কিংবা কেট প্রথম দিনেই পালকিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো, এমনকী সে নিজে মানুষের ঘাড়ে চেপে স্বর্গে যাওয়ার চেষ্টা করে নহুশের দুর্গতির গল্পটা বলেছিলো। এসব ব্যাপারে কি মন আগে থেকেই তৈরী হতে থাকে? কেটের পৈত্রিক মিশন হাউস, যা অবশ্য তারও একমাত্র আশ্রয় ছিলো আবাল্য, তা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে আরো অনাড়ম্বর জীবনের দিকে ঝোঁক দেখা দিয়েছিলো তাদের? তা অবশ্য বাস্তবিক, কারণ তখন তো স্কুলমাস্টারের বেতনই তাদের উপজীবিকা।

বাগচী লঘু মনে হাসলো।

বাস্তব পরিস্থিতি আর নীতিতে বেশ মিল তোর কিন্তু না, এটা নিয়ে হাসাহাসি নয়। আজ লাঞ্চে হাসাহাসিটা হয়েছিলো অন্য ব্যাপারে। রোসো, কেটের পালকি চড়া নিয়ে আজ সন্ধ্যায় ক্ষেপিয়ে তোলা যাবে। কী গো, এ কি ডু অ্যাজ দ্যা রোম্যান ডাজ! বেশ তো পালকিতে চড়লে!

কয়েক পা গিয়ে তার মনে হলো এটা ঠিক তার হাসির ব্যাপার নয়। আজ লাঞ্চে বসে বেশ হাসাহাসিই হয়েছিলো, এমনকী রাজকুমার এসে পড়ার আগেও সেব্যাপারটা নিয়ে তারা রঙ্গ করছিলো। বলতে পারো অন্যত্র যাই হোক একজন পাদরির বাড়িতে তা বেশ গম্ভীর বিষয় হওয়া উচিত। কথাটা বোধ হয় স্কুলে বিজ্ঞানের দিকে ঝোঁক দেওয়ার কথা থেকে কেট তুলেছিলো। আত্মা আর মন নিয়ে কথা উঠেছিলো। এক সময়ে হাসতে হাসতে কেট বলেছিলো, মনের চোখ, কান, নাক এসব, বুদ্ধি, চেতনা এসব আছে, বেচারা আত্মার? নাকি সে দশশালার জমিদার যে মনের উপরে ম্যানেজারি ছেড়ে দিয়ে নিজে মজা নিয়ে আছে। বাগচী বলেছিলো তাহলে কান্টকে আনতে হয়। কেট কপট আশঙ্কায় বলেছিলো, না না, এখন লাঞ্চ। কিন্তু কম দুষ্টু ভেবেছো? –ভাবলো বাগচী, কিছুক্ষণ পরেই আবার বলেছিলো, আচ্ছা, চেহারা, স্বভাব, গলার স্বর, পশুপাখি থেকে মানুষ, সকলেই অনেক পরিমাণে পিতামাতার কাছে পায়, কিন্তু আত্মা? তা কি দুই আত্মার থেকে কিছু কিছু নিয়ে তৃতীয় একটি বাগচী মনে মনে হাসলো। তো, সেও বেশ একটা লাগসই কথা বলেছিলো; হিন্দুদের বেশ একটা ধারণা আছে, আত্মার জাতি নেই, পুরুষ আত্মা, স্ত্রী আত্মা, ইহুদি আত্মা, মুসলমান আত্মা এরকম নাকি হয়না। যদি থাকে তাহলে তার সমাজই বা কি? ভালোমর বিচারও বারো আনা চলে যায়।

এখন বাগচী ভাবলো, একটা কথা কিন্তু ভাববার মতো। আত্মার চোখ কান না থাক তার একটা প্রজ্ঞা আছে যাকে স্বজ্ঞাও বলা যায়। মনই বরং অনেক বুদ্ধি বিবেচনা করে চলে। কিন্তু তাতে চালাকিও থাকেনাকি? যেমন মন ভদ্রতার খাতিরে সমাজের সঙ্গে মানিয়ে চলতে যা সে চাইছে না তা করে, বলে। ফাঁক থেকে যায় না?

কিন্তু এটা তার চিন্তার বিষয় নয়। তার মনে তলায় তলায় যে চিন্তা চলেছিলো তা প্রকাশ পেতেই সে অবাক হলো। এই গ্রামের সমাজ, কি আশ্চর্য, আজকার এই শোভাযাত্রা, যেমন জোনাথন গাই বলতো, দশশালা বন্দোবস্তের ফল? অর্থাৎ নিজেদের ধন উৎপাদনের শ্রম করতে হয় না এমন এক শ্রেণীর ব্যসন? কিন্তু ওদিকে আবার গাইলস, যেনাকি মতবাদে মিলকে অনুসরণ করে, নিজেকে প্রকাশ্যে ইউটিলিটেরিয়ান বলে, বলে বৃটিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ভারতকে উন্নত করার জন্যই, সে নিজেই স্বীকার করেছিলো কর্নওয়ালিশ কতগুলো দালাল সৃষ্টি করেনি, ইংল্যান্ডের ভূমি-আভিজাত্যই অনেকটা এখানে প্রবর্তন করতে এসেছিলো। স্বীকার করেছিলো ইংল্যান্ডের তারাও শ্রম করে খায় না এবং ব্যসনও যথেষ্ট। দশশালার আগেকার জায়গীরদার প্রথাতে রায়তের অবস্থা ভালো না হয়ে বরং আরো খারাপ ছিলো নাকি।

গাইলস এখন, ভাবলো বাগচী, চাকরিটা ভালো পেয়েছে। সেন্ট্রাল স্টেটস এজেন্সির অধ্যক্ষ। এজেন্সিটা কি আগেই ছিলো, নাকি সিপাহী বিদ্রোহের পরে হয়েছে? তখন, তারা যখন মধ্যপ্রদেশে, সে নাগপুরে রেসিডেন্ট ছিলো বটে।

ভাবলো বাগচী, লাঞ্চে আজ আলাপের প্রথম বিষয় ছিলো ডাকে আসা গাইলসের চিঠিটাকে নিয়ে। প্রথমে অবাক লেগেছিলো, গাই তাদের ঠিকানা পেলো কী করে! কেট বলেছিলো, গত ক্রিস্টমাসে তাদের সেই অরফানেজে একসময়ে মানুষ হয়েছিলো এমন কয়েকজনকে কার্ড পাঠিয়েছিলো তাতে এখানকার ঠিকানা ছিলো।

এবার বাগচী চলতে চলতে গাইলসের চিঠিটার কথা ভাবতে লাগলো। আকস্মিক ব্যাপারই বটে। ভাবা যায়নি গাইলস চিঠি লিখে বসবে। ও, গাইলস তার চিঠিতে তাদের ছেড়ে আসা মধ্যপ্রদেশের সেই মিশন হাউস সম্বন্ধে লিখেছে। আঃ কতদূর! নস্ট্যালজিয়া আছে বৈকি! জীবনের ত্রিশ বছর কেটেছিলো যেখানে। কিন্তু শোক করেও লাভ নেই। সে জানতোই বস্তারী আদিবাসীদের গ্রামের সেই ছোটো সুন্দর মিশন হাউস, তার সংলগ্ন অরফানেজ সবই তার শ্বশুরের টাকায় তৈরী, কিন্তু নীতির প্রশ্ন উঠলে জবাব দেওয়া কঠিন।

লন্ডন মিশনের সেই পাদরিকেই যেন সে দেখতে পেলো আবার। গাইলসকে সঙ্গে করেই সে এসেছিলো। গাইলস নাকি মধ্যস্থতা করবে। তো, সেবারই ইউটিলিটেরিয়ান কথাবার্তা বলেছিলো গাইলস। তখন কিন্তু গাইলস তাদের সমর্থন করে একটা কথাও বলেনি, যদিও এ চিঠিটার সুর অন্য রকম। এ চিঠিটা একটা বড়ো ঘটনা বৈকি? সেটাও বেশ বড়ো ঘটনা ছিলো। লন্ডন মিশনের সেই পাদরি যুক্তি দিয়েছিলো কেটের পিতা ফাদার অ্যান্ড্রুজ যে টাকাই জমিয়ে থাকুন তা তো লন্ডন মিশন তাকে যে স্টাইপেন্ড দিতো তা থেকেই, অন্য কোনো উপার্জনই ছিলো না। তিনি যখন অ্যাংলিকান ধর্ম ছেড়ে দিয়েছিলেন তখন নীতিগতভাবে সেই স্টাইপেন্ডের কোনো অংশেই, তা তিনি যত কষ্ট করেই জমিয়ে থাকুন, তার উপরে তার অধিকার জন্মায় কি? সেই পাদরির আসল উদ্দেশ্য ছিলো মিশন হাউসটা যত কমে সম্ভব কেটের কাছ থেকে কিনে নিয়ে ফাদার অ্যান্ড্রুজ, ইউনিটেরিয়ান মত প্রচার করে যে ক্ষতি করেছিলেন তা শোধরাতে। ক্ষতিটা খৃস্টধর্মের। দুদিন ধরে এসব শোনার পরে কেট বিবর্ণ কিন্তু কঠিন মুখে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর কাছে এসে হাত চেপে ধরে বলেছিলো, ফাদার বাগচী, তুমি একটা সংসার চালাতে পারো? পারো? তবে নিজেদের পোশাক ছাড়া আর কিছু নয়। তারা পরের দিনই প্রায় সে রকমই চিরদিনের জন্য মিশন হাউস ত্যাগ করেছিলো। মৃত পিতার পক্ষ হয়ে তার ধর্মমত ভারতে কিংবা ইংল্যান্ডে মামলা চালানোর ইচ্ছা ছিলো না কেটের। এখন বোঝা যায়, গাই তখনই ইউনিটেরিয়ান মত ছেড়ে দিয়েছিলো।

গাইলস একরকম মামলার কথাই যেন কিছু লিখেছে চিঠিতে। সে অবশ্য বিরক্ত হয়ে চিঠির সেই লম্বা প্যারাগ্রাফটাকে বাদ দিয়েছিলো। বটে? এই বলে বাগচী অন্য দিকে ভাবলো। আত্মা সম্বন্ধে সেই আলাপগুলো করতে গিয়ে আত্মাকে দশশালার জমিদার বলার। কারণ কী গাইলসের সেই বিতর্ক মনে হওয়া কেটের, কিংবা সে যে আত্মার জাতি না থাকার কথা তুলেছিলো তার কারণও কি গাইলসের চিঠির কোনো কথা? তার মন আবার কৌতুকের দিকে ফিরলো।

অনেকসময়ে যেমন হয়, বিরক্তিতে যা দেখিনি বা শুনিনি মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে তা এমন যে ভাবতে গেলে দেখা যায়, তার অনেকটাই মনে ঢুকে গিয়েছে; গাইলসের চিঠির সেই লম্বা প্যারাগ্রাফটার অনেক কথাই বাগচীর মনে আসতে লাগলো। গাইলস লিখেছে : অরফানেজে যারা মানুষ হয়েছিলো তারা তো বটেই মধ্যপ্রদেশে এখানে ওখানে যারাই কোনো না কোনো দিক দিয়ে ইংরেজ রক্তে সংশ্লিষ্ট তাদের এখন ভাবার সময় এসেছে। পিতা ইংরেজ, আইরিশ কিংবা স্কচ, মাতা মুসলমানী গোয়ানীজ, অথবা ভারতীয় আদিবাসী খৃস্টান হোক, পিতার ধর্ম প্রটেস্ট্যান্ট, ক্যাথলিক, প্রেসবাইটেরিয়ান যাই হোক, তাদের এখন এক হতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে, কি ভারতের সরকার, কি ইংল্যান্ডের সরকার কেউই তাদের ইংরেজ বলে স্বীকৃতি দিতে চায় না আর। এক কথায়, ভারতীয় ও ইউরোপীয় মিশ্র রক্তের লোকদের কোনো ভবিষ্যই দেখা যাচ্ছে নানা এদেশে,না ইংল্যান্ডে। কিছুদিন হয় এরকম দশ হাজার অফিসার ও আদার র‍্যাঙ্কস আর্মি থেকে ছাঁটাই হতে চলেছিলো। সিপাহী যুদ্ধে তাদের শৌর্য, ত্যাগ ইত্যাদি মনে রাখা হয়নি। তাদের অপরাধ তারা ইংল্যান্ড থেকে আগত অফিসার ও আদার র‍্যাঙ্কসের সমান সুযোগ সুবিধা চেয়েছিলো। এমনকী তিন পুরুষ বৃটিশ রক্তের যোগও হয়েছে যাদের তাদেরও সমস্যার মুখেই পড়তে হবে। এদেশের প্রবাদ অনুসারে না ঘরকা, না ঘাটকা। তোমাদেরও সন্তানের ভবিষ্যৎ ভাবতে হয়। এদেশের সমাজ যা থেকে আমরা শিক্ষা, দীক্ষা, রুচি,নীতি,কালচার, ধর্মে এত পৃথক সেখানে আমরা মিশতে পারি না, অন্যদিকে ইংল্যান্ডই আমাদের দেশ তাই বা বলার সুযোগ কোথায়?

বাগচীর ভ্রু কুঁচকে গেলো। একবার সে ভাবলো, চিঠিটা কেটকে লেখা, সে-ই বুঝবে তা নিয়ে কী করা উচিত। যদি বলল, আমি নিজেকে ইংরেজ বলতে গেলাম কেন? তাতে কিন্তু সমস্যাটা যায় না। জাতিতে ভারতীয় কিন্তু ধর্মে ক্রিশ্চিয়ান বললেও কিন্তু কোণঠাসা হয়ে পড়তে হয়, যদি ইংরেজ বিশেষ স্বীকৃতি তুলে নেয়।

বাগচী নিজেকে বললো–এসব ভাবতে চাই না। মধ্যপ্রদেশে যেমন সমাজ এখানে গ্রামে তেমন একটা সমাজ আছে। এ সমাজ অবশ্যই আমাদের অন্তরঙ্গ করে নেয়নি। নিতে কে পারে? কিন্তু একেবারে কি দূরে রেখেছে? তাছাড়া আমাদের সন্তান কোথায়? বাগচী যে আত্মায় বিশ্বাস করতো তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মনকে অবিশ্বাস করতো তাও বলা যায় না। মন ততবুদ্ধিরই দুর্গ। সে ভাবলো, কেট বেশ বুদ্ধিমতী। সে অনায়াসে চিঠিটাকে পুড়িয়ে দিতে পারবে। সে অবশ্য খুব জেদীমানুষ। দ্যাখো, কিছু দেবো না, বলতে সে মিশন হাউস থেকে তার সখের জিনিসগুলোও আনেনি। আসবাবপত্র এমনকী নিত্য সন্ধ্যার সঙ্গী অর্গানটার দিকেও ফিরে চায়নি।

.

০২.

কাহাররা আস্তে চলতে জানে না। যেন যত তাড়াতাড়ি পারে গন্তব্যে পৌঁছে বোঝাটাকে নামানো চাই। চাপা হু-হুঁ করে আটজন ছুটছে। এক হাত পালকির দাঁড়ায়, অন্য হাত ভাঁজ করে বুকের কাছে নেওয়া, সেটা সে অবস্থায় হুঁ-কারের তাল রাখছে। পিছনে,কখনো সামনে, সরু সরু লম্বা পায়ের সেই কালো ঘোটকী, যার নিতম্ব ছাড়া সর্বত্র হালকা হরিণের ভাব, সামনের দুপায়ে দু থোপা সাদা চুল থাকায় রূপার মল পরেছে বলে ভুল হতে পারে, মাথা উঁচু করে ঘাড় বাড়িয়ে চলেছে,যাকে অ্যালিং বলে। রূপচাঁদ আর বরকন্দাজের দল হাসি হাসি মুখে ছুটতে ছুটতে পিছিয়ে পড়ছে।

পথে একবার পালকি আর ঘোড়ায় ছাড়াছাড়ি হলো। ঘোটকী ক্যান্টারে নাচতে নাচতে এগিয়ে গেলো। আর সেই সময়ে এই অধ্যায়ে যা প্রক্ষিপ্ত এমন একটা ব্যাপার ঘটলো। পথের পাশে সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে একজন গ্রামবাসী আনত হয়ে রাজকুমারকে নমস্কার করলো। তার ভঙ্গিটা এমন যেন সে কিছু বলতে চায়। রায়ত হলেও বিশিষ্ট হবে, গায়ে মেরজাই, পাকানো চাদর, পায়ে চীনা জুতা। রাজচন্দ্রর অনুমান হলো মানুষটিকে সে কোথাও দেখেছে। রাজচন্দ্র লাগাম টানলো, পালকি এসে পার হয়ে গেলো। হাতিটাও ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে কাছে এসে পড়লো। লোকটি তাড়াতাড়ি পথের ধারে একটা পাত ঝরান্যাড়া-জিওল গাছের নিচে সরে দাঁড়ালো। সেই গাছ আর সে যেন সমান বিষণ্ণ।

রাজু বললো–কিছু বলবে?

আজ্ঞে? লোকটি যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলো, যেন রাজকুমারকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে চেষ্টা করলো। তাই কি এই যে রাজকুমার নিজের বুদ্ধিতে চলার মতো বড় হয়েছেন কিনা?

রাজু জিজ্ঞাসা করলো–তোমার নাম কী?

-আমি চরণ দাস। গ্রামের পোস্টামাস্টার। আমি–আমরা খুব বিপন্ন।

–বিপন্ন? কেন? তুমি কি এ বিষয়ে নায়েবমশায়কে বলেছো?

তিনি জানেন, নতুন করে তাঁকে বলা হয়নি।

চরণ দাস দ্বিধা করতে লাগলো। ভাবলো, কেনই বা হঠাৎ শুরু করলো এই আলাপ? ডানকানের ব্যাপারে কী-বা করবেন রাজকুমার? ডানকান অঘ্রাণের ধান কাটার আগে যে ঢিলে মরসুম সেই সুযোগে টাকা বিলোচ্ছে মরেলগঞ্জের বাইরে এসে, তাতে রাজকুমারের কী করার থাকবে?

রাজচন্দ্রর মনে হলো এমন হতে পারে খাজনার গোলমাল করে লোকটি বিপন্ন। সে বলতে গেলে, তুমি তোমার অসুবিধা জানিয়ে রানীমার কাছেও দরখাস্ত করতে পারো।

চরণ দাস ভাবলো, কাজটা ভুলই হয়েছে। সেদিনের লাঞ্চে রাজকুমার ছিলেন না, আর সেদিন রাজবাড়ি থেকে ডানকানের সড়ক কেটে দেওয়া হয়েছে মনে মনে এ দুটোকে যোগ করে রাজকুমারকে কিছু বলতে যাওয়ার কোনো যুক্তি নেই। সে তো জানেই রাজবাড়ির খাজনা দেওয়ার জন্যও কেউ টাকা ধার করে, আর মনোহর সিং সেই সুযোগও নিয়ে থাকে দাদন দিতে।

রাজকুমার লাগাম ঢিল দিয়ে ঘোড়ার পিঠে তা দিয়ে মৃদু আঘাত করলো। ঘোড়াটা চলতে শুরু করলো। কিন্তু দুপা যেতে না যেতে সে লাগাম টানলো, জিনের উপরেই ফিরে পিছনে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলোরোসো, তুমি সেই চরণ নয় যে পোস্টমাস্টার গোবরা অর্থাৎ গোবর্ধনের বন্ধু ছিলে?

চরণ এক পা এগিয়ে সমর্থন করলো।

রাজচন্দ্রর মুখটা গম্ভীর হলো, বললো–আচ্ছা চরণ, জন্মোৎসবের পরপরই তুমি রাজবাড়িতে যেয়ো। যে কোনো সন্ধ্যাতেই আমাকে সেখানে পাবে।

জুলুসটা থাকার কথা নয়, ফরাসডাঙায় ঢুকবার মুখেই কুতঘাটের পথ, তা পেতেই রূপচাঁদ তার হাতি ও বরকন্দাজদের নিয়ে চলে গেলো। পিয়েত্রোর হাওয়াঘরের ভিতেই তো মন্দির, তা তখনো এক রশি। নয়নতারা পালকি থামিয়ে নামলো, রাজচন্দ্রকে বললো– রাজকুমার, ঘোড়াটাকে বরকন্দাজকে ধরতে দিলে হয় না? রাজচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলো নয়নতারা এত দূরে নামলো কেন? নয়নতারা বললো–প্রাণ আছে না? তার কথাও আছে?

কাহার বরকন্দাজদের কবল থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে মন্দিরের কাছে পৌঁছলো তারা। এ কখনো ঠিক নয়, রাজকুমার তেমন সন্দেহ প্রকাশ করলেও, যে। নয়নতারা তত্ত্বাবধানে আসেনি বলে মিস্ত্রিরা কাজে ঢিল দিয়েছে। মন্দিরটা শেষ হয়নি, ইতিমধ্যে তার মাথা যেন মেঘে। যাকে মন্দিরের শিখর বলা হবে, নিচ থেকে আন্দাজ হয়, তার কাছে কাজ হচ্ছে। চত্বরের নিচে অর্থাৎ পিয়েত্রোর সেই হাওয়াঘরের ভিতের গোড়া থেকে মিস্ত্রিদের পুতুলের মতো ছোটো দেখাচ্ছে। তাদের ডান দিকে নদী, পাড়টা বাঁধানো, মনে হচ্ছে আকাশটা বাঁধের ওদিকটায় নেমে পড়েছে।

কেট এই বিরাটত্বের বিস্ময়টা প্রকাশ করে ফেললো।

 উজ্জ্বল মুখে নয়নতারা বললো–এসো এস, আজ আমরা মন্দিরটাকে ভালো করো দেখবো চলল।

কেট বললো–আমিও আসবো?

চত্বরের সিঁড়ির দুএক ধাপইতিমধ্যে উঠেছেনয়নতারা। বললো–ডানকানরা উঠেছিলো ভেবে দেখো।

উঠে পড়ো। তাছাড়া তোমাকেই বরং সাবধানে চলতে হয়। তোমার চাপার কলি আঙুলগুলো দেখে না ফেলেন। চার-চারটি থাকতেও উনি এমনকী কুচনী পেলে ছাড়েন না।

ক্যাথরিন কিছু সঙ্কুচিত হলো। এইসব মিথোলজি!মনে মনে এই বলে সময়ের উপযুক্ত কথা খুঁজে বললো–উনি কি তা হলে কুলীন হলেন?

নয়নতারা বললো–কাপও হতে পারেন। একজন মাথায় চড়ে, বকবকানিতে কান ঝালাপালা, একজন বুকে গলায় জড়িয়ে থেকেও ফোঁসফোঁস করছে, কাউকে ঠাণ্ডা রাখতে তার পায়ে লুটোচ্ছেন, একজন তো শরীরের আধখানাই জুড়ে আছেন। এসো এসো,স্ত্রীলোক হলেই হলো, ওঁর আবার জাতি কী!

দ্রষ্টব্য বিষয় যদি আকারে প্রকারে বিপুল হয়, তবে তার পাশে একাদড়ানো আর অনেক মানুষের ভিড়ে দাঁড়ানো এক নয়। মন্দিরের কাঁধে উঠে শিখরের গোড়ায় ইট গাঁথা চলেছে এখনো, নিচেও, বলা যায় মন্দিরের কোমরের কাছে হচ্ছে আন্তরের। ইট গাঁথবার সময় খাঁজ রেখে গিয়েছে, এখন মশালের সাহায্যে টালি বসানো হচ্ছে। নিচে তো সেজন্য একটা টালির কারখানা বসেছে। কাঁচামাটির তাল কাঠের ছাঁচে চেপে টালি করে তা রোদে শুকোচ্ছে। ওদিকে পোয়াল ধোঁয়াচ্ছে। সেখানে টালিগুলো পুড়ে লাল হয়। টালিগুলো এক মাপের নয়। বড়ো বড়ো গুলোতে একটা একটা পুরো দৃশ্য–বেলতলায় তপস্বী, অন্নপাত্র হাতে সীমন্তিনী, পাশাপাশি বসালে এক পৌরাণিক গল্প হবে। ছোটোগুলোর কোনটিতে একটি হাতি আর মাহুত, কোথাও একটা ধুমসোককুদ ষাঁড়। সে রকম একসারি টালি চার দেয়াল ঘুরে বসানো শেষ হওয়ায় মনে হচ্ছে তা এক শোভাযাত্রার দৃশ্য। হাতি ঘোড়া মানুষ, শিং-এর কারুকার্য ষাঁড়, রামশিঙা নিয়ে পাগড়িবাঁধা মানুষ, ঢোল নিয়ে তেমন মানুষ।

কেট বললো–এদের আকৃতিতে কিন্তু নতুনত্ব আছে।

নয়নতারা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো, বললো–যেমন চোখে দেখি তেমন নয়, তাই। বলছো না?

কেট বললো–মনে হচ্ছে না যে হাতিটা যেমন অসাধারণ ঘোড়াটাও ঠিক তাই? বেশিও নয়, কমও নয়।

রাজচন্দ্র বললো–অর্থাৎ সবই সমান অবস্তু।

নয়নতারা কিন্তু ওদের রাজ্যের হিসাব মানি, যদি সকলেই মানানসই। রামশিঙাটা মানুষের সমান কারণ তা বাজছে; ঘোড়াটা খুব কায়দা করে গলা বেঁকিয়েছে, সেজন্যই গলায় অত অলঙ্কার; হাতিটা পিঠের সওয়ারের জন্য খুব দাম্ভিক, সেজন্য চোখ অত বড়ো আর কানের দুপাশে বাঁধা ঝুমকি ঝুলে মাটি ছুঁয়েছে। এমন সুন্দর হয় না।

হঠাৎ কেট হেসে বললো–এদিকে দেখুন তবে।

-আ রে, এ যে দেখছি আমাদের বন্ধু, একেবারে টুপিসমেত। খিলখিল করে হাসলো নয়নতারা।

রাজু বললো–তা আমার একটা তুলনা মনে আসছে। এসবই যেন আমাদের কেটের মুখের বাংলা। ঠিক স্পষ্ট নয় উচ্চারণ, ঠিক আমাদের মতো ব্যাকরণ নয়, কিন্তু মিষ্টি শব্দ শুনে তার উৎস লাল ঠোঁটদুটিকে দেখতে হয়, যেন তা লোভনীয় ফুলের মতো ফুটে ফুটে উঠছে।

কেটের মুখ লাল হয়ে উঠলো, নয়নতারা ঝিকিমিকি হেসে বললো–ধন্যবাদ, এজন্যই তো রাজকুমার।

টালির গায়ে হাতির পিঠে শিকারীর ছবি, হাওদায় ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সে বাঘ শিকার করছে। বাঘটি চেহারায় দুর্গার সিংহ, আকারে হাতির অর্ধেক অন্তত। রাজু নিজের সেই সম্ভাব্য ব্যঞ্জনায় হা হা করে হেসে উঠলো। কিন্তু পরে বললো, ছবি হিসাবে বেমানান হলো, ওই রামশিঙা আর ককুদ্বান বৃষের পাশে বন্দুক-টুপিধারী শিকারী মানায় না।

-কেন? বললো– নয়নতারা। এই বলে সে একটু ভেবে নিয়ে বললো, আকবর বাদশার সময়ে কি রামশিঙা বাজতোনা? কিংবা তখন কি বলদের শিঙে সোনারূপার গহনা দেওয়া হতো না, অথবা ঘোড়ার পিঠে সোনারূপার কাজ করা মাটি ছোঁয়া কিংখাবের জামা?

হয়তো,হয়তো।

–আকবর বাদশার সময়ে, শুনেছি কিংবা রানীমার ঘরে তসবীরে দেখে থাকবো, বন্দুকে গাধা কিংবা সিংহ শিকারের ব্যবস্থা ছিলো। এখানেও বন্দুকের গায়ে কত কারুকাজ। তেমন বন্দুকই।

–তাহলে, কেট বললো, বন্দুক সত্ত্বেও এই শোভাযাত্রা দু-তিনশো বছরের পুরনো?

–অর্থাৎ আমাকে, রাজু বললো, তুমি আকবর বাদশাহের সময় থেকে উঠে আসা একজন মনে করো? হা ঈশ্বর!

নয়নতারা বললো–হলোই বা, কী লোকসান তাতে? কিন্তু দেখুন এদিকে, টালিগুলোর উপর-পাড় বরাবর নক্সাটা যেন আধখানা বাঁশের। আস্ত বাঁশকে লম্বায় চিরলে যেমন হয়। রোসো হয়েছে। তাহলে উপরের টালির থাকের নিচ-পাড়ে বাঁশের বাকি আধখানা পাওয়া যাবে।

রাজচন্দ্ৰ হেসে বললো–তাতে কি হবে? বাঁশ কি এমন দুপ্রাপ্য বিষয়?

-তখন, আমার মনে হচ্ছে, নয়নতারা ভাবতে ভাবতে বললো, এই শোভাযাত্রার দৃশ্যগুলোর উপর দিয়ে গোটা মন্দিরটা ঘিরে একটা বাঁশগিরে রুলির নক্সা ফুটবে।

না কেট,না রাজু বাঙালিনীর অতি প্রিয় এই রুলি-অলঙ্কার সম্বন্ধে কল্পনা উদ্দীপ্ত হওয়ার কিছু পেলো না। কিন্তু নয়নতারার সুন্দরের দৃষ্টিতে যেন স্বপ্নের ঘোর লাগলো। ভাবলো সে, কোনো এক রমণীর বলয়ের ঘেরের মধ্যে মন্দির? নিজের দুখানা বাহুতে ঘেরা কিংবা হৃদয় দিয়ে ঢাকা, ছবিতে এমন ফুটানো যায় না বলেই যেন নিজের বলয় দিয়ে ঘেরা। কিন্তু কার বলয়?

ততক্ষণে কেট ও রাজকুমার এগিয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি চলে তাদের পাশে গিয়ে। নয়নতারা বললো, রাজকুমার কি এখনো আকবর বাদশার যুগের কথা ভাবছেন?

-কই না।

কথাটা বোধ হয় নয়নতারার নিজের চিন্তাকে টাঙিয়ে দেবার খিল। সে হেসে বললো, অন্যভাবেও এটাকে দেখা যায়, রাজকুমার। মন্দিরটা মহাকালের তত। তার চোখে শিঙে সোনার-টোপর-পরা বলদ, কিংখাবের জামা-পরা ঘোড়ার সেকাল আর কারো বন্দুক দাগা সোলার টুপি-পরা আধুনিকতায় সময়ের এমন তফাত নেই যে এক শোভাযাত্রায় মানায় না।

–অর্থাৎ এই সব আধুনিকতা প্রাচীন থেকে এমন কিছু পৃথক নয়? এ তো দারুণ কথা!

রাজু এক সমস্যার অভিনয় করলো।

ন্যাতারা গলা নিচু করে বললো–লোকগুলি কাছে থেকে আমাদের আলাপ শুনতে চাইছে, ভয়ে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। কাহাতক আর কষ্ট দেবেন? ডেকে কথা বলুন। দরকারের কথাও আছে।

রাজু শোনো মিস্ত্রি বলে ডাকতেই যে এগিয়ে এলো সে প্রবীণ, বোধ হয় নিজের হাতে এখন কাজ করে না আর। নয়নতারার ইঙ্গিতে রাজু তাকে জিজ্ঞাসা করলোতোর্মাদের সব কাজ শেষ হতে আর কতদিন লাগতে পারে?

সে-ই প্রধান মিস্ত্রি, বললো–এখন তো কাজ ভালোই চলেছে–হুঁজুর, শীতের বাদলে যদি দকে না যাই, বর্ষার মুখে কাজ শেষ করে, বড়োপূজার আগে রঙের কাজ ধরবো। ততদিনে নাটমন্দিরে খিলান গাঁথা শেষ হবে।

রাজচন্দ্ৰ হেসে বললো, আরো ন-দশ মাস তো বটেই। বর্ষায় কাজ অনেকদিন বন্ধ থাকলে এক বছরও হতে পারে। দ্যাখো, মুশকিল!

শেষ কথাটা লঘু স্বরে নয়নতারাকে বলা।

নয়নতারা বললো–তাহলে এবার শিবচতুর্দশীতে কি পূজা হবে না?

–হুজুরাইন, চেষ্টাই হচ্ছে যাতে হয়। সেজন্য উপরের ছাতিতে দেখুন, সব লোক লেগেছে। এখন একমাস ওই কাজ। পদ্মটা বসিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্দি, তখন ভিতরে পূজা, বাইরে কাঁধত টালি বসানো চলবে। শিবের মাথায় দাঁড়াতে সাহস নেই যে আজ্ঞা।

নয়নতারা উপরে চাইলো। দড়ির জালে আটকানো অনেকগুলো শাখামৃগ যেন। প্রকৃতপক্ষে বাঁশের ভারা বেঁধে মিস্ত্রিরা কাজ করছে।

এই কথাই বলে মিস্ত্রিকে বিদায় দিলো নয়নতারা। তারা তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো। কিছুদূরে যেখানে কুমোরেরা টালি গড়ছে সেখানে যেতে চাইলো কেট।

হো হো করে রাজু হাসলোদেখলে, হুজুরাইনকে ঠিক চিনেছে।

ঠিক এরকম সময়ে মনে হলোনয়নতারার, রানীমা জানতে চেয়েছিলেন মন্দিরটা কেমন দেখায় তার চোখে। এখন তো আকারটা স্পষ্টই হয়ে উঠছে। বাইরের দেয়ালটা যতদূর মানায় টালির কারুকার্যে অপূর্ব রকমে সুন্দর দেখাবে; চত্বরসমেত রথটার বিরাট আকারও দ্যাখো; যেন সৌন্দর্যে গাম্ভীর্যে সংযুক্ত। নয়নতারার মনে হলো, রানীমার এরকম নির্দেশের অর্থ কি এই হতে পারে যে তিনি নিতান্ত উৎসুক মন্দির সম্বন্ধে? আর তা স্বাভাবিকও। সেই রক্তচন্দনের পাত্রে যা ছিলো তা বুকের রক্ত, বুকটা অনেকখানি চিরে না দিলে ফেঁটায় ফোঁটায় অতটা রক্ত জমে না। অন্যদিকে চলো দেখে আসি, বলে সে ভাবলো, তবে কি মন্দির শেষ হওয়ার আগে দেখতে আসাটা লঘুতা হবে বোধ করছেন? কৌতুকের এই দোটানা? একটুপরেই নয়নতারা অনুভব করলো, এমনটাই রানীদের মানায়।

টালিকারখানার কৌতূহল মিটলে তারা চকচকে মুখে ঘুরে দাঁড়ালো আর তখন আবার তারা অন্যকিছুতে আকৃষ্ট হলো। বাঁধের নিচে নদীর খাত। আকাশরেখা বাঁধের কাঁধে। সেই আকাশে ইতিমধ্যে রং জমতে শুরু করেছে। যথেষ্ট আলো, কিন্তু তা যেন রঙিন। তারা পায়ে পায়ে বাঁধের দিকে এগিয়ে গেলো। কিন্তু ততদূরে যাওয়ার আগে চত্বরে উঠবার সিঁড়ির একটা অংশ কমলা-আলোয় রঙানো মনে হলো।

আমরা কি এখানে বসবো? –এই বলে রাজচন্দ্র সেই সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। নিজেই বসলো। বললো–তোমরা? কিংবা সে আমার ভাবনা নয়। অনুমতি করো, পাইপ ধরাই।

কেট বললো–ধুলো নয়?

রাজু বললো–যথেষ্ট, এবং শুকনো পাতাও কয়েকটি। সে নিচের সিঁড়িতে বসে উপরেরটিতে, যেন আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে, পাউচ পাইপ বার করলো।

রাজু-আবার কী দৃশ্য পেলে?

কেট বলতে গিয়ে কম বললেন।

রাজু-কী? সে প্রথমে একটু অবাক, পরক্ষণেই সে নিজেই তাদের আলোচনার বিষয় বুঝে হো হো করে হেসে উঠলো। কী যেন কেট, বাগচী তোমার কথায় হেসে বলেছিলো? কাপিটাল! কিংবা—রোসো, আলো থেকে সরে বসি, রোদটা লাগছে বটে।

কিন্তু নয়নতারাই নিজের কথায় লজ্জা পেয়ে সরে গেলো, বললো–রাজকুমার, এখনো রাজকার্য বাকি। শিবপূজায় যথেষ্ট জল লাগে। তার তো ব্যবস্থা দেখছি না।

নদীর ধারেই আকণ্ঠ তৃষ্ণা! বসো, উজিরাইন, খোঁজখবর নিই।

রাজু পাইপে তামাক ভরে উঠে দাঁড়ালো। দূরে দাঁড়ানো বেহারাদের দিকে হাত তুলে ইশারা করলো। বরকন্দাজ দৌড়ে এলে, সে তাকে পুরোহিত-ঠাকুরকে ডেকে দিতে বললো।

লোকটি চলে যেতেই নয়নতারার দিকে ফিরে বললো–কেমন ব্যবস্থা হলো,উজিরাইন! তুমি অন্তত, কেট, পাশে বসে রাজকুমারের বুদ্ধির মূল্য দাও।

হেসে নয়নতারা রাজচন্দ্রের পাশে বসলো, কেটকে বসালো মাঝখানে। সিঁড়িটা যথেষ্ট চওড়া, ঘেঁষাঘেঁষি হলো না।

নদীর এত কাছে কিছুক্ষণ পরেই আকাশে যে রং বদলের খেলা শুরু হবে এখন যেন তার মহড়া হচ্ছে। আলো কমছে, বাড়ছে। এখানে সব শান্তনয়, নতুবা সিঁড়িতে এত শুকনো পাতা কী করে আসবে? তেমন একটা হাওয়া হালকা-ধুলোর ঝাপটা দিয়ে গেলো। রাজচন্দ্র হেসে, মুখের পাইপ সরিয়ে, রুমালে নাক-মুখ মুছলো।

নয়নতারা হাসলো ধুলোর দুষ্টুমিতে। কিন্তু ভাবলো, এই পাইপেতামাকটা নতুন, যেমন নতুন এই দাড়ি। এটা ভারি মজার যেন যে রাজু পাইপ টানছে! কী আছে ওতে? অর্থাৎ রাজকুমার এখন পুরুষ। তার যেন এক বিস্ময় লাগলো, পাইপ-পাউচ আর তার পাশে রাখা বিলেতি দেশলাই-পাতা দেখে।

একটা সুন্দর কবোষ্ণ অনুভূতির অবসর। নয়নতারার কর্তব্য, অন্তত যা তাকে এনেছে, সে তো প্রায় সমাধাই হয়েছে। ঝরঝরে আলোর দিন। আর রঙিন আলোটা তো থেকে থেকে এখন তিনজনের গায়েই যেন পড়ছে। নয়নতারা কেটের ডান হাতখানা নিজের হাতে তুলে নিয়ে অন্যমনস্কের মতো তার আঙুল নিয়ে খেলতে খেলতে সামনের দিকে চেয়ে ছিলো। সামনে তো কয়েকটা ছোটো ঝোপ ছাড়া অবারিত ঘাসে ঢাকা একটা মাঠই, যার প্রান্তে একটামাত্র গাছ। গাছটা বিলিতি।

ফুট তিনেক উপর থেকে কাণ্ডটা যেন দুভাগে দুটো গাছ হয়ে আবার কয়েক ফুট উপরে এক হওয়ার চেষ্টা করছে। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতেইনয়নতারা দেখলো, একটা ছোট্ট ঘূর্ণি বাতাস একটা খরগোস বা কোনো বড়ো পাখির মতো মাটির উপরে ছুটোছুটি করছে। সেটা একবার পাতাটাতা ঘুরিয়ে পাঁচ-ছ আঙুল ব্যাসের শুড়ের চেহারা নিয়ে উপরে উঠলো। তাদের দিকে এগিয়ে আসতে মুখ থুবড়ে পড়লো।

আর তখন মনে হলোনয়নতারার, আশ্চর্য, এটাই কি সেই গাছ যাতে পিয়েত্রোর ছোটো হাতিটা বাঁধা ছিলো। হাতিটাও কেন যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো। তাই বলে এটা কখনো কি সত্য হতে পারে, সেই মূক প্রাণী বুঝেছিলো সেই বাদলের সন্ধ্যায় পিয়েত্রোর মরদেহ ঘিরে তখন তার চাকর বাবুর্চিরা হাহাকার করছে। সে নিজে বাংলোর বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলো রাজুর অপেক্ষায়। রানীমা আগেই নিঃশব্দে চলে গিয়েছিলেন।

ঘূর্ণিটা এবার যেন ফণা তুলে নাচতে নাচতে এগিয়ে এসে তাদের পায়ের কাছাকাছি ভাঙলো। কয়েকটা পাতা সরসর শব্দ করলো। নয়নতারা মাঠটার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসিমুখে বললো–আচ্ছা, কেট, তুমি কখনো দাবা খেলেছো, ঘোড়ায় চড়েছো?

রাজচন্দ্র বললো–কেন, কেট, দাবা তো তোমাদের দেশেও আছে। বাগচী তার প্রমাণ। আমাকে মাঝে মাঝে মাৎ করেন।

কেট হেসে বললো, কিন্তু আমি তো পাদরির মেয়ে, পাদরির স্ত্রী।

রাজচন্দ্র বললো–আর আমি তোমার কাছে শুনেছি তোমার ঘোড়া ছিলো। এমনকী তোমাদের সেই সেন্ট্রাল প্রভিন্সের মিশন হাউসেসহিসের ছেলেই তোমারবাল্যপ্রেমিক ছিলো।

কিন্তু নয়নতারার মনে যে-গল্পটা আসছিলো তা যতই ঝকঝকে, রঙিন, আলোকোজ্জ্বল হোক, তা কাছে এলেই শঙ্কার চেহারা নিলো। তার অনুমান হচ্ছিলো, এই মাঠেই হয়তো বরকন্দাজদের নিয়ে রাজকুমার আর বুজরুক শতরঞ্জ খেলেছিলো, সে শতরঞ্জের চাল দিতে নাকি মাঠের চারদিকে ঘোড়ায় চড়ে ছুটতে হয়েছিলো তাদের। আর, রাজবাড়ির আর পিয়েত্রোর বরকন্দাজেরা ছিলো খুঁটি। কারণ সে খেলা তো ছিলো প্রকৃতপক্ষে তরোয়াল নিয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা ও আত্মরক্ষার কৌশল অভ্যাস করা। সেই গল্প বলেছিলো রাজু নয়নকে, আর তা শুনে নয়নতারা তারও ঘোড়া চড়া দরকার হতে পারে এরকম বলে হাসাহাসি করেছিলো। কিন্তু শঙ্কারই তো বিষয়। সেই বরকন্দাজরা বুজরুকের সঙ্গে সিপাহী বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলো, খুব কমই ফিরেছে। এই গল্প উঠলে রাজু যদি এখন সেসব কথা কেটের সামনে বলে? নয়নতারার মুখ আশঙ্কায় বিবর্ণ হলো। কীকরে গল্পটা ঢেকে অন্যদিকে আলাপ নেয় এখন?

কেট রাজুর কথার উত্তর না-দেওয়ায় নয়নতারার ঘোড়া আর দাবার গল্প থিতিয়ে গেলো।

রাজচন্দ্র ভাবলো, সময় নিয়েই কিন্তু আজ অনেকবার কথা হয়েছে। সেই আকবর বাদশাহের যুগের কথা। খুব বলেছে কথাটা নয়নতারা, ওখানে ওই মন্দিরে একাল থেকে ওকালের তফাত এক আঙুলও নয়। কিন্তু, সে মনে মনে হাসলো, এখানে এই চত্বরের সিঁড়িতে? যেন সে বর্তমানে ফিরতে যত্ন নিলো। হেসে বললো–বাবা, কী সুন্দর! তোমাদের দুজনের এমন করে বসা!

দুজনেই একসঙ্গে চোখ তুলেছিলো। এরকম প্রশংসা শুনে একসঙ্গেই চোখ নামালো তারা।

রাজচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলোহা, কেট, তোমাদের দেশে কালো চুল, কালো চোখ কি হতে নেই? তাতে কি তোমাদের পুরুষরা বশ থাকে না? তারা কি শুধু মণিমাণিক আর সোনাই খোঁজে? যেজন্য তোমার চোখ দুটিকে গোমেদ আর চুলকে সোনা করতে হয়েছে?

প্রশংসা বিরত কেট কিছু বলার আগেই বরকন্দাজ ফিরে এলো। জানালো-পুরোহিত নদীতে স্নান করতে গিয়েছে।

আচ্ছা যাও, বলে তাকে বিদায় দিয়ে রাজচন্দ্র বললো–এখন তাহলে অপেক্ষা করতে হবে?

নয়নতারা বললো–তা কেন? পূজার্থিনীরাও যদি নদীতেই স্নান করতে চায়? চলুন আমরা নদীটাকেও দেখে আসি। বাঁধ থেকে কী করে নদীতে নামা যায় বুঝতে হবে না?

কিন্তু, সে ভাবলো, এখন তোমার কেট আর হৈমীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তাই বলে। তাদের কাছেপিয়েত্রো বুজরুকের সঙ্গে কাটানো সময়ের কথা বলা ভালো হয় না। কথাগুলো ছড়ালে অনেকেই বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে।

তার সিঁথির নিচে কপালটাকে ম্লান দেখালো।

তারা একেবারে বাঁধের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালো। এই বাঁধ ফরাসীরা করে থাকবে। নদীর খাত থেকে দশ-পনেরো হাত ইট দিয়ে গেঁথে তোলা নদীর খাতে দাঁড়ালে মনে হবে কেল্লার প্রাচীর। কোনো কোনো জায়গায় এমন খাড়া, উপর থেকে দেখতে গেলে গা শিরশির করে। কিন্তু নদী?

নয়নতারা ভাবলো, তখন কিন্তু নদী বাঁধ বরাবর চলতো। নয়তো হাওয়াঘরে দাঁড়িয়ে সুলুপের পালে রাজকুমার বন্দুকের নিশানা করতে পারতো না। এখন বাঁধের নিচে বালুচর। আর বালুচর কেমন যেন দুঃখের মতো ব্যাপার। বালিই কিংবা পলি গুড়ো হলে যেমন হয় সাদা মিহি-মাটি। জলে ভেসে আসা বালিতে অর্ধেক পোঁতা একটা গাছের কঙ্কাল।

সে নিজের মন থেকে সরতে গেলে তার চোখ দুটি চঞ্চল হলো। সে বললো, রাজকুমার, আপনাদের দেশের পুরুষরা বুঝি শুধু অসীমকে খোঁজে, তাই কালো চোখের মণি, কালো চুল।

রাজচন্দ্র বললো–ও, সেই কথা। এ বিষয়ে আমি একটা গল্প বলতে পারি। কেটের দেশেও কালো চুলের কালো মণির মানুষ আছে। প্রমাণ বাগচীমশাই। তবে এরকম কুংসস্কারও আছে, আবার বাগচীই প্রমাণ, পুরুষরা তাদের সংস্পর্শে এলে ফল ভালো হয় না। আর সভ্য দেশে থেকেও তারা নাকি অসভ্য। চাকা লাগানো বাড়িতে কিংবা ছোটো ছোটো গাড়িকে বাড়ি করে বাস করে। তাতে ঘোড়া লাগিয়েই এক জায়গা থেকে অন্যত্র চলে যায়। কী যেন নাম কেট?

কেট জিজ্ঞাসা করলো–আপনি জিপসি মেয়েদের কথা মনে করছেন? ভালোনয় কিন্তু।

খুব গরম বুঝি? রাজু হাসলো। বললো–কিন্তু জাতিটার কথাই মনে করো। বললো– সে, জানো নয়ন, তাদের নিজস্ব নানা বিদ্যা আছে নাকি, পূর্বপুরুষ থেকে মুখে মুখে শোনা অলিখিত নীতিগুচ্ছ আছে। সারা ইউরোপে তারা হাজার বছর থেকে বাস করছে, কিন্তু কিছুতেই ইউরোপীয়দের সঙ্গে মিশে যায়নি। এমনকী ভাষা–যে ভাষায় তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে, তা না ইংরেজি, না ফরাসি, ইউরোপীয়ই নাকি নয়।

নয়নতারা বললো–তারা কি আমাদের দেশের বেদের মতো?

রাজু বললো, কিন্তু তাদের সম্বন্ধে এই এক গল্প আছে, হাজার বছর ধরে তারা পথ হাঁটছে। তাদের ভাষাই প্রমাণ তারা একসময়ে ভারতবর্ষে ছিলো। কিন্তু হাজার বছর হেঁটেও ভারতবর্ষে ফিরতে পারছে না আর। বরং আরো দূরেই চলে যাচ্ছে। বোধ হয় ফেরার। সময়টাকে হারিয়ে ফেলে আর তা খুঁজে পাচ্ছে না।

নয়নতারা গোপনে রাজুর মুখের দিকে তাকালো। যে কথা বলছে তার স্বর কোনো কোনো সময়ে যা সে বলছে তার থেকে পৃথক কিছু বলতে থাকে।

.

০৩.

কিন্তু নয়নতারা বললো, কতদূরে সরে গিয়েছে নদী! কোথায় বা নৌকা ভিড়বে, কী করেই বা স্নানে যাবে মানুষ, পুরোহিতই বা কোথায় গেলো? এই খাড়া বাঁধ, ফরাসীরাই বা জলের কী করতো?

রাজচন্দ্র বলল–এখন কুতঘাট অনেকটা উজানে। সেখানেনদীর পাড় চালু হয়ে নিশ্চয় জল ছোঁয়। গোরুর গাড়িগুলোকে যেতে হয় জলের ধারে। কিন্তু তাই বা কেন? ফরাসডাঙারই ঘাট আছে, যে পথে তোমার পুরোহিত স্নানে গিয়েছে নিশ্চয়।

ডানদিকে খানিকটা চলে তারা বাঁধের গায়ে গড়ে তোলা ঘাট পেলো। এত চওড়া এত সিঁড়ির সেই ঘাট অনেক খরচে তৈরী হয়ে থাকবে। এখন তো ভাঙাই, মাঝে দু-এক ধাপ সিঁড়িও উধাও। ফাটলে ঘাস জন্মেছে।

-তোমরা নামবে কি? কী করে তা পারবে? রসসা, হাত ধরো। শুধু রোদ আর আলো নয় ধুলোও কিন্তু। প্রথম কেটকে, পরে নয়নতারাকে হাত ধরে নামতে সাহায্য করলো রাজচন্দ্র। সে বললো, আমরা কি নদীর জল পর্যন্তই যাবো? তাহলে কিন্তু চরের সীমা বলে যা মনে হচ্ছে ওই ঘাসবন পর্যন্ত যেতে হবে। অনেকটা দূরই। নয়নতারা বললো–আধঘণ্টায় ফেরা যাবে না? তাহলে চলুন, ভালো লাগছে না কেট?

কেট বললো, এখন আর অসুবিধা কি বালিটা সমতলই তো।

খানিকটা দূরে গিয়ে সম্ভবত বাঁধটাকে দেখতে ইচ্ছা হলো, নয়নতারা ফিরে দাঁড়ালো। প্রকাণ্ড নিরেট ইটগাঁথা বাঁধ। নয়নতারা বললো–দেখুন, রাজকুমার, দেখুন। ওদিকে কেমন ফাটল লেগেছে বাঁধে।

তা বটে। শুধু ফাটলই নয়, সেখানে বাঁধটার গোড়ায় একটা সুড়ঙ্গ, যেন কোনো বন্যজন্তু গুহা তৈরী করেছে।

রাজচন্দ্র বললো–তুমি কি বলবে শেয়াল গর্ত করেছে? নাও হতে পারে।

যেখানে তারা দাঁড়িয়েছিলো তার বাঁদিকে খানিকটা দূর পর্যন্ত চরটা বালিআড়ির মতো উঁচু হয়ে উঠেছে। তার ওদিকের ঢালুটার গায়ে যেন সবুজের ভাব। বালিআড়ির গায়েও এখানে চরঝাউ। সবুজের ভাবটা প্রমাণ করে, জল কাছেই হবে সেদিকে। অন্যদিকে তাদের পিছনেই বাঁধানো পাড়ের বড়ো ফাটলটা যেন তখন দূর থেকে গুহার মতো দেখাচ্ছে।

কিন্তু পতপত করে শব্দ হলো। বালিআড়ির ওপাশ থেকেই যেন আকাশে উঠে পড়েছে শব্দটা। কেট উত্তেজিত হয়ে বললো–হাঁস, হাঁস।

হাঁস হলে তা বেশ বড় আর রঙিন। দুটো ডানাই চঞ্চল, কিন্তু ঠোঁট গলা যেন তখন মাটির দিকে ঝুঁকে।

বুনো হাঁস? নয়নতারাও জিজ্ঞাসা করলো।

রাজচন্দ্ৰ হেসে বললো, কী বলল তো, সার্বভৌমপাড়ার মেয়ে? এই কিন্তু সেই চক্রবাক বধূ আমন্ত্রয়স্ব ইত্যাদি। কেট, ফর ইনফরমেশন, একে চকা বলে। দ্যাখো, ঠিক একজোড়া।

কিন্তু তাদের বালিআড়ির সবটা উঠতে হলো না। তারা ওপার থেকে একজন মানুষকে আসতে দেখলো। খালি গায়ে, কাঁধে ভিজেকাপড়, হাতে ঘড়ার মতো বড়ো পিতলের কমণ্ডলু। পূজারী ছাড়া এখানে আর তেমন কে হবে?

নয়নতারা বললো– রাজকুমার, এ যদি পূজারী হয় তবে পূজার খবর, স্নানের খবর এর চাইতে আর কে ভালো বলবে? আমাদের আর এগিয়ে কী হবে? কী বলল, কেট?

পূজারীই লম্বা লম্বা পায়ে তাদের কাছে এসে পড়লো। নয়নতারা তাকে জানালো, রাজবাড়ি থেকে তারা শিবমন্দিরের খোঁজ খবর নিতে এসেছিলো। পূজারী বোধহয় স্বল্পভাষী এবং নমস্কার করে না। একবারমাত্র তিনজনকে দেখে নিয়ে মৃদু হেসে পথ চলতে লাগলো। রাজু বললো–চলো, আমরাও ফিরি। বাঁধের সেই ফাটলটা কিন্তু আমাদের পথের দিশারী। নাকি পূজারীর পিছন পিছন চলবে। অন্তত কোথায় স্নান হবে তা তোমার জানা হয়েছে।

তারা ফিরতে শুরু করলো।

কেট বললো– চলতে চলতে–আচ্ছা, রাজকুমার, সেই গর্তটা কি কাঁকড়ার হতে পারে? হাসছেন যে?

হাসছি? রাজচন্দ্র হাসিমুখেই বললো, এ কি হাসির কথা? দ্যাখো মন্দিরের অনেকটা দেখা যাচ্ছে আকাশ ছুঁড়ে যেন, আর এদিকে বাঁধে এত বড়ো ফাটল।

সামনে থেকে পূজারী বললো–অউর ভি হৈ।

পূজারীর এই অনুপ্রবেশ সামলে নিয়ে নয়নতারা নিচু গলায় বললো–শুনলেন?

আপনি কি বলছেন রাজকুমার, মন্দিরের বিপদ হতে পারে?

রাজনগর রাজচন্দ্র বললো–নদীর যদি ফেরার মতি হয়। এ বিষয়ে আপনার কী মত, ঠাকুরমশাই?

নয়নতারা চাপা গলায় আ বলে রাজচন্দ্রকে নিরস্ত করতে গেলোলা। কিন্তু তার আগেই পুরোহিত ভাঙা বাংলায় বললো–নাম যাই হোক, আসলে গঙ্গামাঈ। তো লোটাসে গঙ্গা চড়াই বুঢ়াকে। কখুন মাঈ-এর সওখ হোবে বুঢ়াকে আপন কোরে নিতে।

রাজচন্দ্রর মুখে চাপা হাসি, নয়নতারার গালে রক্তাভা।

কিন্তু বালিআড়ির আলগা ঢালুটায় বোধ হয় পূজারী সতর্ক ছিলো নিজের ভারি শরীরের জন্য। বালিআড়ির থেকে নামতে পেরে লম্বা লম্বা পায়ে পূজারী অনেকটা এগিয়ে গেলো।

রাজচন্দ্র বললো–নয়ন, লোকটি পূজারীবটে তো? গোঁফটা দেখেছো? কমণ্ডলুটা খালি থাকলেও তুমি তুলতে পারবে কি?

কেট বললো–লোকটি, আমি বাজি রাখতে পারি, পাহাড়ী, অন্তত পাহাড়ে ঘোরা অভ্যাস আছে।

তারা সেই ঘাটের কাছে এসেছিলো। পূজারী কয়েকটা লম্বা পা ফেলে উঠে গেলো। রাজচন্দ্র বললো–এবার?

নামার চাইতে ওঠাই আরো কঠিন। শুধু হাত ধরাতেই হলো না।

পারে উঠে রাজচন্দ্র বললো, এখন কিন্তু বেলা আর বেশি নেই। দ্যাখো, নদীর উপরে আকাশের ওদিকটা সোনালি রাংতার মতো।

নয়নতারা নিঃশব্দে হাঁটতে লাগলো। যে-চাদরটা সারাক্ষণই ছিলো এখন আবার তা অবগুণ্ঠন হয়ে মুখের দুপাশকেই খানিকটা করে ঢেকে ফেলেছে।

রাজচন্দ্র হাসি হাসি মুখে বললো–তোমার পুরোহিত হয়তো আবাল্য সন্ন্যাসী, কিন্তু প্রেমের কথা বোঝে দ্যাখো! কিংবা রানীমার উজিরাইন কি এখনো বাঁধের ফাটল নিয়েই দুশ্চিন্তায়?

নয়নতারা বললো–নদীর গতি তো বদলায়ই। কুতঘাট সরে গিয়েছে সেটাও একটা প্রমাণ।

রাজচন্দ্র জোরে জোরে হাসলো। বললো, তাতেই বা তোমার ভাবনার কী? ফরাসীরা শক্ত করে বাঁধ দিয়েছিলো। রানীমা কি প্রয়োজনে আরো শক্ত করে বাঁধ দেবেন না?

.

০৪.

তারা মন্দিরের কাছে যেতে রাজুর ইশারায় পালকি এগিয়ে এলো। তখনো অন্ধকার হয়নি, কিন্তু আলো বাদামী হয়েছে। কেট ও নয়নতারা পালকিতে উঠলো, রাজচন্দ্র তার ঘোড়ায়। ততক্ষণে বরকন্দাজ মশাল জ্বালিয়ে নিয়েছে। বেহারারা পালকি নিয়ে চলেছে, কিন্তু ঘোড়ার শব্দ কানে না আসায় পালকির দরজায় মুখ বার করলো নয়নতারা। সে অবাক হলো। দেখলো, যেখানে তারা পালকিতে উঠেছিলো সেখানে বাদামী আলোতে কালো স্তব্ধ এক ঘোড়সওয়ার হয়ে রাজচন্দ্র : নড়ছে না। কিছু ভাবছে?

পালকি ততক্ষণে ছুটতে শুরু করেছে। ছাদের কাছে ছোটো গোল কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরের মশালের আলো লাল ছোটো বৃত্তের মতো পড়ছে, লাফাচ্ছে। কখনো তা নয়নতারার সিঁথির উপর দিয়ে, কখনো কেটের মুখে, কখনও কোলের উপরে জড়ো করে রাখা তাদের হাতে। এরকমক্ষেত্রে মনও দুলে দুলে ওঠে, সরে সরে যায়। চিন্তার উৎস অনির্দেশ্য হয়ে পড়ে। কেট বললো– শীত এসে গেলো, এখন কিন্তু সোয়েটারকে বুনে তুলতে হয়। সে কি কল্পনায় সুন্দর সুঠাম এক পুরুষকে তার বৈঠকখানার দেখলো! অথবা মেলাই বৈঠকখানার আলাপের অভ্যাস!নয়নতারা যেন শুনতে পায়নি এমনভাবে চাইলো। শুনতে সে অবশ্যই পেয়েছিলো, মন সজাগ হতে একটু দেরি হলো। কেটকে দেখেই তার পরামর্শে গত শীতের গোড়ায় রাজকুমারের জন্য একটা সোয়েটার বুনতে শুরু করেছিলো। সেই বিলেতি উলের রং রাজকুমারকে নিশ্চয়ই মানাতো। তাছাড়া কি বিলেতি উল, কি উলবোনা তখন কলকাতাতেও চূড়ান্ত আধুনিকতা। একবছর থেকে তা আরম্ভ হয়েই পড়ে আছে।

নয়নতারা কল্পনায় কি এক খয়েরি অন্ধকারে গাঢ় খয়েরি এক ঘোড়সওয়ারকে দেখতে পেলো? কী চায়? কী খোঁজে? এখন কি আর মানায়? নয়নতারা বললো–বলতে গিয়ে যেন বিব্রত হয়ে হাসলো–দ্যাখো কাণ্ড! একেবারে মনে ছিলো না। তুমি কি বুনে দিতে পারো না, কেট?

পালকিটা হুমহাম করে চলতে লাগলো। নয়নতারা কেটের হাতে-মুখে যেন সেই আলোর বৃত্তগুলোর নাচন দেখছে। তখন অনুভব করলো, পার্থক্যটাই অভিপ্রেত। তাই নয় কি? কষ্ট বটে।

উলের কথায় নীরবতা কাটলো না দেখে অন্য গল্প ভেবে নিয়ে কেট বললো–পুরোহিত যে গঙ্গার ফিরে আসার কথা বলছিলেন, তা কি কোনো উপাখ্যান?

নয়নতারা হাসিমুখে বললো–ধারণাটা আছে, গল্প বানালেই হলো। এই বলে গঙ্গাকে শিবের স্ত্রীরূপে কল্পনা করা হয়, শিবের জটায় গঙ্গা নেমেছিলো, সেখানে ফাঁদে পড়েছিলো কিংবা প্রেমে–এমন সব গল্প করলো।

কেট বললো–এটা কি কোনো প্রাকৃতিক ঘটনার বিন্যাস? তাহলে শিক্ষিত মানুষেরা কেন পূজা করবে?

নয়নতারা হেসে বললো–এই দ্যাখো আমি নাকি শিরোমণিঠাকুর! আমরা বড়োজোর অনুভব করতে পারি। গঙ্গা চঞ্চলা, স্নিগ্ধা, প্রমত্তা,কী যেন এক অদ্ভুত প্রবাহ! প্রাণের বলবে? কিংবা প্রবহমান কালের ছায়া? অন্যদিকে জানো কেট, শিবের নাম মহাকাল–যার শেষ নেই, প্রথম নেই, খণ্ড হয় না। এরকম ব্যক্তিত্বে স্নেহ থাকতে পারে? কিন্তু মনে হয় না যে সে গঙ্গাকে যদি বা ভালোবাসে যেন কোনো এক বিষে তার মন জর্জর, যেন উদাসীন, যেন কীসের সাধনা করে, যেন বুঝতে পারে না কী চায়?

নয়নতারার গলাটা ধরে এলো।

বাগচীর কুঠির সামনে পালকি থামলে কেট দরজা খুলে নামতে গিয়ে দেখলো, ইতিমধ্যে ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। বাগচী তোফিরেছেই, রাজকুমারও অন্যপথে তাদের একটু আগেই এসেছে। সে তখনো ঘোড়ার পিঠে, ঘোড়াটা স্থির, কিন্তু বালামচি দোলাচ্ছে।

রাজচন্দ্র বললো–আমরা আর দাঁড়াবো না। দ্যাখো, আলো তোমাকে অভ্যর্থনা করতে পথে এসে পড়েছে।

কেট কিছু বলতে দাঁড়িয়েছিলো। পথের ধারের একটা গাছের ডালপালায় আটকানো একখণ্ড চাঁদ তার চোখে পড়লো যা এই সন্ধ্যাকে কখনোই ঘন কালো হতে দেয়নি। তার আলো যেন নয়নতারার মুখেও। কেট বললো–আমি আর মাঝখানে থাকতে চাইছিনা। গুড নাইট ডিয়ার্স।

এক ভারি কৌতুকের প্রশ্ন : আমাদের চিন্তা কি সিঁড়ি বেয়ে চলে? অথবা কি নিত্য প্রবহমান?

কেট দেখলো রাজকুমার ঘোড়া থেকে নেমে খানিকটা হেঁটে গেলো। নয়নতারা তো পালকি থেকে নেমেছিলোই। সেও কয়েক পা হেঁটে রাজকুমারের কাছাকাছি গেলো, দাঁড়ালো। কেট অনুভব করলো, এই সুন্দর যুবক…ও সেই সিড অব ডেথ…আশ্চর্য! কিন্তু যদি তা হয়, এমন স্বাস্থ্য, এত রূপ!মৃত্যুবীজ থেকে কেউ কি বাঁচাতে পারেনা? কেন পারছে না তবে?

রাজচন্দ্র বললো–তোমাকে কি তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেবো।

নয়নতারা বলতে গেলো, কী সুন্দর চাঁদ, রাজু। রাজকুমারের লাগাম-ধরা হাতটার দিকে বাড়ানো আঙুলগুলোকে মুঠি করে গুটিয়ে আনলো। বললো–রাজবাড়িতে যেতে হবে না? রানীমাকে খবর দিতে হবে। একটু হাসলো সে। বললো– আবার-যাই রাজকুমার, আমি কিন্তু গুড নাইট বলতে জানি না।

নয়নতারা উঠলে পালকিটা ছুটে চলতে শুরু করলো। এখানে রাস্তা বিশেষ ভালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *