১৬. দেবলোকের পরিচিতি

দেবলোকের পরিচিতি

গোড়াতেই দেবলোকের একটা পরিচিতি দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। সংক্ষেপে, দেবতারা যেখানে বাস করতেন, সেটাই দেবলোক । পরবর্তীকালে আমরা দেবলোককে ‘স্বৰ্গ’ আখ্যা দিয়েছি । কিন্তু হিন্দুর সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থে ঋগ্বেদে দেবতাদের আবাসস্থল হিসাবে ‘স্বৰ্গ’-এর কোন উল্লেখ নেই। বস্তুতঃ যুগে যুগে দেবলোকের অবস্থান ও তার বাসিন্দাদের নামধাম ও চরিত্র পালটে গেছে। ঋগ্বেদের যুগে দেবতাদের বাসস্থান ছিল তিন জায়গায়। পৃথিবীতে, অন্তরীক্ষে ও দ্যুস্থানে। পৃথিবীর দেবতাদের মধ্যে ছিলেন অগ্নি, সোম, পৃথিবী, অপ্‌ ও সরস্বতী । অন্তরীক্ষের দেবতাদের মধ্যে ছিলেন ইন্দ্ৰ, পর্জন্য ও রুদ্র, আর দ্যুস্থানের দেবতাদের মধ্যে ছিলেন সূৰ্য, সবিতা, পুষা, বরুণ, দ্যু, অশ্বিণীদ্বয়, ঊষা, রাত্রি, যম ও বৃহস্পতি । পরবর্তী কালে শিব ও কুবেরের বাসস্থান ছিল কৈলাসে। আর অন্যান্য সব দেবতাদের নিবাস ছিল স্বৰ্গে। দেবতা ছাড়া, স্বর্গে আরও বিচরণ করত গন্ধৰ্ব, অপ্সরা, যক্ষ, কিন্নর ইত্যাদি।

পরবর্তীকালে স্বর্গলোকটা আকাশের দিকে বা নভোমণ্ডলের কোন জায়গায় ছিল বলে মনে করা হত। এই কল্পনায় বশীভূত হয়েই জার্মান লেখক এরিখ ফন দানিকেন ও তাঁর অনুগামী ইংরেজ লেখক আর. কে. জি. টেমপাল এক মতবাদ খাড়া করেছেন যে নভোমণ্ডলের অন্য গ্ৰহ থেকেই দেবতারা মর্ত্যে এসেছিলেন । ওই মতবাদের পিছনে যে কোন যুক্তি নেই, তা আমি ১৯৭৬ খ্ৰীষ্টাব্দের ২১ নভেম্বর তারিখের ‘সানডে’ পত্রিকায় লিখেছিলাম। তাঁরা বলেছিলেন যে ‘সিরিয়াস’ ( Sirius ) নামক নক্ষত্র থেকে আফ্রিকার জাতিবিশেষ মর্ত্যে অবতরণ করেছিল । তারই প্ৰতিবাদে আমি লিখেছিলাম–বস্তুতঃ যতক্ষণ না দানিকেন বা তাঁর অনুগামীরা প্ৰমাণ করতে পারছেন যে, যে গ্ৰহ থেকে দেবতারা মর্ত্যলোকে এসেছিলেন সে গ্রহের তাপমাত্রা ও আবহাওয়ার অন্যান্য লক্ষণ মানুষের প্রাণ ধারণের পক্ষে অনুকুল, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁদের মতবাদের কোন বৈজ্ঞানিক মূল্য নেই। বস্তুতঃ হিন্দুর দেবতাদের যে ভাবে বিবর্তন ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেও দানিকেনের মতবাদ গ্ৰহণ করা চলে না। ঋগ্বেদের যুগে আর্যদের দেবতাসমূহ ছিল হয় নৈসর্গিক ঘটনার প্রতীক আর তা নয়তো পার্থিব কোন পদার্থ বা বস্তু-বিশেষ যার দ্বারা আর্যরা উপকৃত হতেন । পরে রূপকের সাহায্যে তাদের মানুষের রূপ ও চারিত্রিক গুণাগুণ দেওয়া হয়েছিল । এরই অতি বিস্তারণ করা হয়েছিল পৌরানিক যুগে নানাবিধ কাহিনীর দ্বারা । তার মানে, তারা অন্য গ্রহ থেকে আসেনি। মর্ত্যলোকের মানুষেরই তারা কল্পনাপ্রসূত। পরের অনুচ্ছেদে আমি হিন্দুর দেবতাদের বিবর্তন সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করছি ।

।। দুই ।।

দেবতাদের সম্বন্ধে নিরুক্তকার যাস্ক বলেছেন- “দেবো দানাদ বা দীপনাদ বা দ্যোতমদ বা দ্যুস্থানো ভবতীতি বা ।’ তার মানে যিনি দান করেন তিনি দেবতা, যিনি দীপ্ত হন বা দ্যোতিত হন তিনি দেবতা, এবং যিনি দ্যুস্থানে থাকেন তিনিও দেবতা । ঋগ্বেদে যে কোন বিষয়বস্তুকেও দেবতা বলা হয়েছে, যদি তাদের মধ্যে বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাবার বা বৈষয়িক ঋদ্ধি বৃদ্ধির কোন শক্তির প্রকাশ দেখা যেত । সোমলতাকেও দেবতা বলা হয়েছে, মণ্ডুককেও দেবতা বলা হয়েছে, আবার সরস্বতী নদীকেও দেবতা বলা হয়েছে । তা ছাড়া, ঋগ্বেদের আৰ্যদের যে সব বড় বড় দেবতা ছিলেন, সে সব দেবতা প্ৰকৃতির মধ্যে নৈসৰ্গিক ঘটনারই প্ৰকাশ মাত্র । বস্তুতঃ ঋগ্বেদের আর্যরা ছিলেন প্ৰকৃতির সৌন্দর্যের উপাসক। যে সকল নৈসর্গিক ঘটনা বা পার্থিব বস্তু তাদের বৈষয়িক জীবনচর্যার সহায়ক ছিল, তাঁদেরই তারা দেবতা আখ্যা দিয়েছিলেন । তারপর রূপকের সাহায্যে তাঁদের মনুষ্য আকৃতি দেয়া হয়েছিল। তার মানে মূলতঃ দেবতারা যাই হন না, পরে তাদের মানুষের রূপ ও গুণাগুণ দেওয়া হয়েছিল ।

পরবর্তীকালে হিন্দুরা তেত্ৰিশ কোটি দেবতার কল্পনা করেছিল। কিন্তু ঋগ্বেদে উল্লিখিত হয়েছে যে দেবতার সংখ্যা মাত্র ৩৩টি । ঋগ্বেদের সাতটি সূক্তে ৩৩টি দেবতার উল্লেখ আছে, যদিও তারা কোন কোন দেবতা, তা বলা হয়নি। আবার দুটি সূক্তে ৩৩৩৯ দেবতার কথা বলা হয়েছে । পণ্ডিতরা বলেন যে ৩৩ সংখ্যার মধ্যে ক্রমান্বয়ে একটি এবং দুটি শূন্য দিয়ে, পরে যোগ করে, এই সংখ্যাটি তৈরী করা হয়েছিল, যথা : ৩৩+ ৩০৩ + ৩০০৩ = ৩৩৩৯ । মনে হয় পৌরাণিক যুগে এই সংখ্যাটাকেই বর্দ্ধিত করে তেত্ৰিশ কোটিতে দাঁড় করানো হয়েছিল। তবে নিরুক্তকার যাস্কের মতে গোড়ায় আৰ্যদের মাত্র তিনটি দেবতা ছিল । তাঁরা হচ্ছেন অগ্নি পৃথিবীর দেবতা, বায়ু ও ইন্দ্র অন্তরীক্ষের দেবতা ও সূর্য দ্যুলোকের দেবতা ।

ঋগ্বেদের দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্ৰই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ দেবতা । প্ৰজাপতির ন্যায় ইন্দ্ৰ স্বয়ম্ভু দেবতা নন। ত্বষ্টা তাঁর পিতা, অদিতি তাঁর মাতা । স্বাভাবিকভাবে মায়ের গর্ভদ্বার দিয়ে তিনি নির্গত হন নি। তিনি মায়ের পেট বিদীর্ণ করে, পেটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন । তার অস্ত্ৰ বজ্র। বজ্র তিনি পেয়েছিলেন উশনা বা শুক্রদেবের কাছ থেকে । বেদে অবশ্য শুক্রের নাম নেই | উশনা একবার মহাদেবের পেটের ভিতরে চলে গিয়েছিলেন, তারপর মহাদেবের বীর্যদ্বার (শিশ্নমূখ) দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন বলেই, তাঁর নাম শুক্র ।

যদি সূক্তসংখ্যার দিক দিয়ে বিচার করা হয়, তা হলে বলতে হবে যে ইন্দ্ৰই ছিলেন ঋগ্বেদের যুগে আর্যদের প্রধান দেবতা। ঋগ্বেদের মোট সূক্তসংখ্যা হচ্ছে ১০১৭। তার মধ্যে ন্যূনাধিক ২৫০ সূক্ত তার উদ্দেশ্যে নিবেদিত । মূলতঃ নৈসৰ্গিক দেবতা হলেও তিনি মনুষ্যরূপে কল্পিত। তিনি যোদ্ধাশ্রেষ্ঠ । আর্যদের তিনি রক্ষক। তিনি আর্যদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেন । তিনি দুটি হরিৎবৰ্ণ অশ্বদ্বারা পরিচালিত স্বর্ণরথে আরোহণ করেন । তিনি সোমরস পান করতে ভালবাসেন । ঋগ্বেদের বর্ণনা অনুযায়ী তার প্রধান কৃতিত্ব তিনি বৃত্ৰকে সংহার করে মেঘ হতে বারিবর্ষণের পথ উন্মুক্ত করেছিলেন, তিনি শত্রুদের দুর্গ সমন্বিত নগরগুলি ধ্বংস করে তাদের বিনাশ সাধন করেছিলেন, এবং বিশ্বস্থিতির জন্য তিনি কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন ।

ঋগ্বেদে অগ্নির উদ্দেশ্যে প্ৰায় ২০০ সূক্ত আছে। সুতরাং ইন্দ্রের পরেই অগ্নি আর্যদের দ্বিতীয় প্রধান দেবতা ছিল । যদিও অরণীর সাহায্যে তিনি উৎপন্ন, তা হলেও মনুষ্যরূপে তিনি কল্পিত । তিনি যজ্ঞের ঋত্বিক, পুরোহিত ও হোতা । অগ্নিই দেবতাদের যজ্ঞে আনয়ন করেন । তাঁর নানারূপ । তিনি কখনও জাতিবেদ্য, কখনও রক্ষোহা, কখনও দ্রবিনোদ, কখনও তমুনপাদ, কখনও নরাশংস, কখনও অপানেপৎ, এবং কখনও মাতরিস্বন । ঘূত ও কাষ্ঠ তাঁর আহার্য । হব্য তাঁর পানীয় ।

ঋগ্বেদে সূর্যকেও মনুষ্যরূপে কল্পনা করা হয়েছে । তিনি হরিৎবর্ণের সাতটি বেগবান অশ্ববাহিত রথে চলাফেরা করেন । বিশ্বভুবন এবং সমস্ত প্ৰাণিবর্গ সূর্যের আশ্রিত । তিনি মনুষ্য ও পশুর রোগ নিরাময় করেন ।

পুষ্য রথিশ্রেষ্ঠ। তিনিই সূর্যের হিরন্ময় রথচক্ৰ পরিচালনা করেন। রাত্রি তাঁর পত্নী ৷ ঊষা তার ভগিনী ।

ঋগ্বেদে আরও অনেক দেবতার উল্লেখ আছে। তাদের মধ্যে বিষ্ণু, যম, বৃহস্পতি ও সোম-এর নাম করা যেতে পারে। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৫ সূক্তে বলা হয়েছে যে, বিষ্ণু তিন পদক্ষেপে সমগ্র ভুবনে অবস্থিতি করেন । বিষ্ণু ঋতুর নিয়ামক দেবতা ।

যম পিতৃলোকের রাজা । দু’টি কুকুর নিয়ে তিনি পিতৃলোকের দ্বারে পাহার দেন । ।

বৃহস্পতি মন্ত্র উৎপাদন করেন। বৃহস্পতি প্ৰভূত প্রজ্ঞাবান । তিনি শক্ৰদের অভিভূত করেন ও তাদের নগরসকল বিদীর্ণ করেন । তার মানে তিনি ইন্দ্রের অনুরূপ আচরণ করেন ।

সোম পার্বত্য অঞ্চলের লতাবিশেষ। সোমলতাকে ধুয়ে, পাথরে পিষে, তার রস বের করে দুধ বা দধির সঙ্গে ব্যবহার করা হত। সোম ইন্দ্রের শক্তিবৰ্দ্ধন করত। দেবতাদের ও আর্যদের এটা একটা প্রিয় পানীয় ছিল । নবম মণ্ডলের সবকটি সূক্তই সোমের উদ্দেশ্যে রচিত । সপ্তম মণ্ডলের ১০৪ সূক্তে ও দশম মণ্ডলের ৮৫ সূক্তে সোমকে দ্যুস্থানের দেবতাও বলা হয়েছে ।

ঋগ্নেদের আর একজন বড় দেবতা হচ্ছেন বরুণ । বহুস্থলে মিত্র ও বরুণ একত্রে মিত্ৰাবারুণ নামে উল্লিখিত হয়েছেন । মিত্র ছিলেন আলোকের দেবতা, আর বরুণ আবরণকারী দেবতা । আর্যরা আকাশকে সমুদ্রের সঙ্গে কল্পনা করে জলময় মনে করতেন । এইজন্য ঋগ্বেদে আকাশ ও সমুদ্রের মিলন রেখাতে বরুণের অবস্থিতি কল্পনা করা । হয়েছে। বরুণ সূর্যের গমনের পথ বিস্তার করেন । ইনি বৃষ্টির দ্বারা পৃথিবী, অন্তরীক্ষ ও স্বর্গকে আদ্র করেন। এক কথায় বরুণ জলের দেবতা ৷

।। তিন ।।

বৈদিক দেবতামণ্ডলী পশ্চাদপটে হটে যান পৌরাণিক যুগে । লোকে আর ইন্দ্রকে প্রধান দেবতা হিসাবে পূজা করে না । পৌরাণিক যুগের তিন প্রধান দেবতা হচ্ছেন ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, ও মহেশ্বর। ইন্দ্ৰ এই তিন শক্তির অধীন, তিনি অপর দেবতাদের ওপর কর্তৃত্ত্ব করেন বলে, পৌরাণিক কাহিনী সমূহে তাকে দেবরাজ বলা হয়েছে। তাছাড়া, বৈদিক দেবতাদের নিয়ে পৌরাণিক যুগে বহু কাহিনী রচিত হয়েছিল।

পৌরাণিক যুগের তিন দেবতার মধ্যে ব্ৰহ্মা হচ্ছেন স্রষ্টা, বৈদিক যুগের হিরণ্যগৰ্ভ প্রজাপতির সামিল। বিষ্ণু হচ্ছেন রক্ষক, আর শিব সংহারকার্তা ।

পৃথিবীতে একবার মহাপ্ৰলয় ঘটেছিল। ওই মহাপ্রলয়ের শেষে জগৎ যখন অন্ধকারময় ছিল, তখন বিরাট মহাপুরুষ পরম ব্ৰহ্ম নিজের তেজে সেই অন্ধকার দূর করে জলের সৃষ্টি করেন। সেই জলে তিনি সৃষ্টির বীজ নিক্ষেপ করেন। ওই বীজ সুবৰ্ণময় অণ্ডে পরিণত হয়। অণ্ড মধ্যে ওই বিরাট মহাপুরুষ স্বয়ং ব্ৰহ্মা রূপে অবস্থান করতে থাকেন। তারপর ওই অণ্ড দুভাগে বিভক্ত হলে, একভাগ আকাশে ও অপর ভাগ পৃথিবীতে পরিণত হয়। এরপর ব্ৰহ্মা, মরীচি, অত্ৰি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্ৰতু, বশিষ্ট, ভৃগু, দক্ষ ও নারদ, এই দশজন প্ৰজাপতিকে মন থেকে উৎপন্ন করেন । এই সকল প্ৰজাপতি থেকে সকল প্ৰাণীর উদ্ভব হয় ।

ব্ৰহ্মা চতুর্ভূজ, চতুরানন ও রক্তবর্ণ। হংস তার বাহন। সরস্বতী তাঁর স্ত্রী । দেবসেনা ও দৈত্যসেনা তাঁর দুই কন্যা ।

শ্ৰীমদ্ভাগবত অনুযায়ী পঞ্চম (রৈবত ) মন্বন্তরে বিষ্ণু শুক্রের ও তাঁর স্ত্রী বৈকুণ্ঠার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্ত্রী লক্ষ্মীর ইচ্ছায় তিনি তাঁর নিবাস বৈকুণ্ঠলোক নির্মাণ করেন। পৌরাণিক যুগে বিষ্ণুর অবতারবাদের সৃষ্টি হয়। এই অবতারবাদের সাহায্যে তিনি রাম ও কৃষ্ণ থেকে অভিন্ন হন। গরুড় বিষ্ণুর বাহন।

শিব অনার্য দেবতা। তার প্রতিরূপ আমরা প্রাকবৈদিক সিন্ধু সভ্যতায় পাই । পৌরাণিক যুগে তিনি বৈদিক রুদ্রের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যান । তিনি সংহারকর্তা, সেজন্য তাঁকে মহাকাল বলা হয় । তবে সংহারের পর তিনি নূতন করে আবার জীব সৃষ্টি করেন। সেজন্য তিনি লিঙ্গরূপে পূজিত হন। তিনি প্ৰথমে দক্ষ রাজার কন্যা সতীকে বিবাহ করেছিলেন, পরে হিমালয় রাজার কন্যা হৈমবতী বা পাৰ্বতীকে । তাঁদের পুত্ৰ কাৰ্তিক দেবতাদের সেনাপতি । তাদের অপর পুত্ৰ গণেশ ও কন্যাদ্ধয় লক্ষ্মী ও সরস্বতী । বৃষভ শিবের বাহন, নন্দী ও ভূঙ্গী তার দুই অনুচর। কুবের তার ধনরক্ষক। কৈলাস তাঁর নিবাস ।

পৌরাণিক যুগের দেবতামণ্ডলীর বৈশিষ্ট্য স্ত্রী দেবতাগণের প্রাধান্য । বৈদিক দেবতাগণের স্ত্রী ছিল বটে, কিন্তু দেবতামণ্ডলীতে তাদের কোন আধিপত্য ছিল না । কিন্তু পৌরাণিক যুগে স্ত্রী দেবতাগণই হন পুরুষদেবতাগণের শক্তির উৎস। শিবজায়া দুৰ্গা এগিয়ে আসেন ‘দেবী’ হিসাবে দেবতা মণ্ডলীতে সৰ্বোচ্চ স্থান অধিকার করতে। তাঁর আঁচল ধরে আসেন অনার্য সমাজের সেই সমস্ত স্ত্রী দেবতা ( যথা শীতলা, মনসা, ষষ্ঠী ইত্যাদি ) যাঁরা আগে লুকিয়ে ছিলেন গাছপালায়, ঝোপজঙ্গলে ও পর্বত-কন্দরে ।

।। চার ।।

এবার আমাদের আলোচনা করা যাক দেবতাদের নিবাসস্থল সম্বন্ধে। তার মানে স্বর্গ বা দেবলোক কোথায় ছিল । আগেই বলেছি যে ঋগ্বেদে ‘স্বর্গ”-এর কোন কথা নেই। পুরাণেই স্বর্গের কথা আছে, এবং সেটাকেই দেবতাদের নিবাসস্থল বলা হয়েছে । কিন্তু এ স্বর্গটা কোথায় ? স্বাগটা আকাশের দিকে, না পৃথিবীতে ? স্বর্গ সম্বন্ধে পুরাণ থেকে যে সকল তথ্য সংগ্ৰহ করা যেতে পারে, সে গুলিই আমি প্রথম এখানে স্থাপন করছি। পুরাণ মতে সুমেরু পর্বতে বিশ্বদেব ও মরুদগণ বাস করতেন । এর শিখরেই ছিল বরুণালয় । ইন্দ্রের আলয় ও রাজধানী অমরাবতীও অবস্থিত ছিল সুমেরু পর্বতে । আমরাবতীর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ছিল অলকানন্দ নদী । সুতরাং সুমেরু পৰ্বত ও অলকানন্দার অবস্থান যদি আমরা নির্ণয় করতে পারি, তা হলে দেবতাদের বাসভূমি দেবলোকের আমরা হদিশ পাব।

বদরিকাশ্রমের পর যে পার্বত্য ভূভাগ অবস্থিত, তাকে বলা হত হৈমবতবৰ্ষ । বদরিকাশ্রমের ঠিক পরেই যে পৰ্বতশ্রেণী ছিল, তার নাম পুরাণে নৈষধ পর্বত। এর পশ্চিমাংশে ছিল হেমকূট পৰ্বতশ্রেণী, আর উত্তরে ক্রমান্বয়ে গন্ধমাদন ( মন্দর ), সুমেরু এবং সর্বশেষ নীল পর্বত । হেমকূট পৰ্বতশ্রেণীর পরেই ছিল কৈলাস পর্বত, তারপর মৈনাক পৰ্বত । এর পররর্তী অঞ্চলে দুটি সমৃদ্ধশালী দেশ ছিল—একটি কেতুমাল ও অপরটি উত্তরকুরু। এই অঞ্চলকে বলা হত হরিবর্ষ। সুমেরু পর্বতের পাশে ছিল ভদ্রাশ্ব, কেতুমাল, জম্ব এবং উত্তর কুরু । কেদারনাথ তীৰ্থ তিনদিকে সুমেরু পর্বতদ্বারা বেষ্টিত ছিল।

এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে তিব্বত দেশের উত্তর ও চীন দেশের পশ্চিমস্থ পর্বতশ্রেণীকেই সুমেরু পর্বত বলা হত । অলকানন্দা গঙ্গোত্রীর কাছে গঙ্গার চারধারার মধ্যে একটি । অমরাবতীর মধ্য দিয়েই অলকানন্দ প্ৰবাহিত হত, এবং এর দক্ষিণ তীরেই বন্দ্রিনাথ তীর্থ অবস্থিত। গঙ্গোত্রীর ভৌগলিক অবস্থান হচ্ছে ৩০°৫৯ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৭৮°৫৯ উত্তর-পূর্ব দ্রাঘিমায়। এর উচ্চতা ৩৪৪১ মিটার। বন্দ্রিনাথ অঞ্চলের চৌখাম্বা (উচ্চতা ৭,৬৪৬ মিটার) শিখর হতে উদ্ভূত গঙ্গোত্রী হিমবাহের উত্তর পশ্চিমে যে স্থান হতে পূর্ব হিমবাহ গলে গঙ্গা নদীরূপে প্ৰকাশিত হত, সেই স্থানটিই গঙ্গোত্রী নামে খ্যাত । এখান হতেই গঙ্গার অপর উৎসমুখ অলকানন্দ প্রবাহিত । ইহা ভারতের অন্যতম দীর্ঘ হিমবাহ। এই হিমবাহের নিকটেই কেদারনাথ শৃঙ্গ ( উচ্চতা ৬৯৪০ মিটার ) ও এর বামদিকে শিবলিঙ্গ পর্বতমালা । কেদারনাথ তীৰ্থ ( উচ্চতা ৩,৫২৫ মিটার ) চামোলি জেলার উখিমঠ মহকুমায় অবস্থিত। হৃষীকেশ হতে বাসে ১৭৯ কিলোমিটার নেমে কুণ্ডচটি। সেখান থেকে হাঁটাপথে ৫১ কিলোমিটার দূরে ত্রিযুগীনারায়ণ । ত্রিযুগীনারায়ণ হয়ে কেদারনাথ তীর্থে যেতে হয়।

কৈলাস পর্বত মহাদেব ও কুবেরের বাসস্থান। কৈলাসের উচ্চতা ৬৭১৪ মিটার। লিঙ্গাকৃতি এই শিখরটি দক্ষিণ-পশ্চিম তিব্বতে, লাসা হতে কাংরিম পোচে । মহাভারতে (৬।৭।৩৯) কৈলাসকে হেমকুট বলা হয়েছে। কৈলাসের ২৬ কিলোমিটার দক্ষিণে মানসসরোবর। এই মানস সরোবরের উত্তর তীরস্থ পর্বতেই ইন্দ্রের সঙ্গে বৃত্রের একশত বৎসর ধরে যুদ্ধ চলেছিল।

উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতেই আমি কতগুলো জায়গার অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা দিচ্ছি। এ থেকেই দেবলোকের ও কৈলাসের অবস্থান বুঝতে পারা যাবে।

কেদারনাথ ৩০°৪৪’ উত্তর অক্ষাংশ ৭৯°৬৩ পূর্ব দ্রাঘিমা ।
গঙ্গোত্ৰী ৩০°৫৬ উত্তর অক্ষাংশ ৭৯°০২ পূর্ব দ্রাঘিমা ।
বদ্রিনাথ ৩০°০০ উত্তর অক্ষাংশ ৭৯°৩০ পূর্ব দ্রাঘিমা ।
মানস সরোবর ২৬°১৩ উত্তর অক্ষাংশ ৯০°৩৮ পূর্ব দ্রাঘিমা ।
মানস সরোবরের ২৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কৈলাস ।

এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে দেবলোক বা স্বর্গ অন্তরীক্ষে কোন জায়গায় নয়। ইহজগতে হিমালয়ের উত্তরাংশে । এটা অন্য কয়েকটি কাহিনীর দ্বারাও সমর্থিত। মহাভারতের মহাপ্ৰস্থনিক পর্ব অনুযায়ী যুধিষ্ঠির হিমালয়েরই অপর প্রান্তে অবস্থিত ‘স্বর্গে’ গিয়েছিলেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মনসামঙ্গল কাব্যসমূহ অনুযায়ীও বেহুলা তার মৃত স্বামীকে বাঁচাবার জন্য নদীপথে গিয়ে নেতা ধোবানীর সাহায্যে স্বর্গে গিয়েছিল । সুতরাং এই কাহিনী অনুযায়ী স্বর্গ ইহলোকেরই কোন জায়গায় অবস্থিত ছিল, নদীপথে যেখানে যাওয়া যেত। তা ছাড়া, স্বর্গের অপ্সরারা উত্তর ভারতে হিমালয়ের সানুদেশের কোন না কোন সরোবরে প্রায়ই স্নান করতে আসত । পুরুরবা যখন উর্বশীর সন্ধানে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তখন তিনি কুরুক্ষেত্রের কাছে চারজন অপ্সরার সঙ্গে উর্বশীকে স্নান করতে দেখেছিলেন ।

3 Comments
Collapse Comments
জয়ন্ত রায়। November 10, 2017 at 11:41 am

এই মূল্যবান গবেষণামূলক আলোচনায় অবশ্যই সমৃদ্ধ হলাম।

ধুর আপনি একটা নাস্তি! বর্তমান বিজ্ঞান নাস্তিক্যতার দিকে এগুচ্ছে।
আপনার কাছে পৌরানিক কথা কাল্পনিক মনেহচ্ছে আসলে সেটাই বাস্তবসত্য! আরেভাই দেবতারা মানুষের চাইতে সতগুন উন্নত জীব ওরা ধরা না দিলে আপনি ওদের ধরতে পরবেননা। এটা মনোকরেন ওর বিজ্ঞানের টাইম 3 সিবিলাজেসনও পারকরে গেছে!

গৌতম দাস, হাওড়া-৪ February 27, 2024 at 9:06 am

দারুন ভাল একটা তথ্য সমৃদ্ধ দলিল। সংগ্রহে রাখার মতো তথ্য। ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *