০২. অপ্সরাদের যৌন আবেদন

অপ্সরাদের যৌ* আবেদন

হিন্দুর তেত্রিশ কোটি দেবতা । কিন্তু স্বর্গের বারযোষিতদের সংখ্যা ষাট কোটি । তেত্ৰিশ কোটি দেবতা, ষাট কোটি বারযোষিতদের নিয়ে কি করতেন, তা আমাদের জানা নেই ।

স্বর্গের বারযোষিতদের বলা হত অপ্সরাা । অপ্সরাারা অপূর্ব লাবন্যময়ী হত । নৃত্যকলায় তারা হত পটীয়সী । তারা সবসময়েই তাদের নৃত্যদ্বারা ইন্দ্রের দেবসভা মাতিয়ে রাখত। ইন্দ্র অত্যন্ত ইন্দ্রিয়পরায়ণ দেবতা ছিলেন । দেবলোক বা নরলোকে আর কেউ কঠোর তপস্যায় রত থেকে ইন্দ্ৰত্ব পাবার চেষ্টা করছে দেখলে, ইন্দ্ৰ প্রায়ই অপ্সরাাদের নিযুক্ত করতেন তাদের তপোভঙ্গের জন্য ।

অপ্সরাাদের মধ্যে সর্বোত্তম অপ্সরাা ছিল উর্বশী। ঋগ্বেদ থেকে আরম্ভ করে কথাসরিৎসাগর পর্যন্ত, নানা প্ৰাচীন গ্রন্থে আমরা উর্বশীর কথা পাই । এসব গ্রন্থে উর্বশীর উদ্ভব সম্বন্ধে নানারকম কাহিনী লিখিত আছে। পদ্মপুরাণে বিবৃত হয়েছে যে একসময় বিষ্ণু ধৰ্মপুত্ৰ হয়ে ঘোরতর তপস্যায় রত হন। ইন্দ্ৰ ভয় পেয়ে তাঁর তপোভঙ্গ করবার জন্য কামদেব ও অপ্সরাদের পাঠান। কিন্তু অপ্সরাাগণ বিষ্ণুর তপোভঙ্গ করতে অসমর্থ হয়। তখন ইন্দ্ৰ নিজ উরু থেকে উর্বশীকে সৃষ্টি করেন। আবার শ্ৰীমদভাগবত অনুযায়ী বিষ্ণু তপস্যায় রত হলে ইন্দ্ৰ কামদেব ও অপ্সরাাগণকে তাঁর তপোভঙ্গের জন্য পাঠান । তারা বিষ্ণুর তপোভঙ্গ করতে না পারলে, নরনারায়ণ দেবতাগণকে বহু লাবন্যময়ী রমণী দেখিয়ে তাদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচন করতে বলেন । দেবতারা উর্বশীকে নির্বাচন করে । তাতেই উর্বশী শ্রেষ্ঠ অপ্সরাা বলে গণ্য হয়। আবার অন্য কাহিনী অনুযায়ী উর্বশী ইন্দ্রের উরু থেকে উদ্ভূত হয়নি, অথন্সরাদের উরু থেকে। এরূপ কাহিনীও আছে যে উর্বশী নারায়ণের উরু ভেদ করে আত্মপ্ৰকাশ করে । আবার অন্যান্য পুরাণের মতে উর্বশী সমুদ্রমন্থনের সময় উদ্ভূত হয়েছিল । সাতজন মনু উৰ্বশীকে সৃষ্টি করেছিল, এ কথাও কোনও কোনও পুরাণে আছে ।

উর্বশী সম্বন্ধে একাধিক কাহিনী প্রাচীন গ্ৰন্থসমূহে আছে । তার মধ্যে সবচেয়ে প্ৰসিদ্ধ কাহিনী হচ্ছে পুরুরবার সঙ্গে উর্বশীর মিলন । পুরুরবা হচ্ছে বুধের পুত্ৰ চন্দ্রের পৌত্র। বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে চন্দ্র একবার হরণ করেছিল । তারার গর্ভে চন্দ্রের এক পুত্র হয়। এই পুত্রের নাম বুধ । বুধ বৈবস্বত মনুর মেয়ে ইলাকে বিবাহ করে । ইলার গর্ভে বুধের যে পুত্ৰ হয় তারই নাম পুরুরবা ।

 

৷৷ দুই ।।

পুরুরবা ও উর্বশীর মিলনের সবচেয়ে প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের সংবাদসুক্তে ( ১০।১৫ ) । সেখানে যে আখ্যান আছে, সে আখ্যান অনুযায়ী উর্বশী চার বছর পুরুরবার সঙ্গে ছিলেন, এবং গর্ভবতী হবার পর তিনি অন্তর্হিতা হন। ঋগ্বেদের সংবাদসুক্তে (১০|১৫) উল্লিখিত এক অস্পষ্ট আভাষ থেকে আমরা জানতে পারি যে পূর্বজন্মে উৰ্বশী ছিল ঊষা ও পুরুরবা সূৰ্য । যে যাই হোক সংবাদসুক্তে আমরা দেখি যে পুরুরবা উর্বশীকে অনুনয় বিনয় করছে ফিরে আসবার জন্য । আর উর্বশী তা প্ৰত্যাখান করছে। উর্বশী বলছে–‘হে নির্বোধ ! ঘরে ফিরে যাও । আমাকে আর পাবে না–স্ত্রীলোকের প্রণয় স্থায়ী হয় না। স্ত্রীলোকের হৃদয়, আর বৃকের হৃদয় দুই এক প্রকার ।’

ঋগ্বেদের সংবাদসুক্তের সংক্ষিপ্ত আখ্যানটাকে বিস্তৃততর রূপ দেওয়া হয়েছে শতপথব্ৰাহ্মণে ( ১১।৫।১ ) । এখানে বৃহৎদেবতার একটা কথার উল্লেখ করা যেতে পারে । সেখানে বলা হয়েছে যে মিত্র ও বরুণ উৰ্বশীকে কামনা করেন। উর্বশীর প্রত্যাখানে তারা অভিশাপ দেন যে উৰ্বশী মনুষ্যভোগ্য হবেন । সেইজন্যই উর্বশীর সঙ্গে রাজা পুরুরবার মিলন ঘটেছিল । শতপথব্ৰাহ্মণের কাহিনী অনুযায়ী উর্বশী কয়েকটি শর্তে পুরুরবার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীরূপে বাস করতে রাজী হন । এই শর্তগুলি হচ্ছে—(১) উর্বশী যেন কোনদিন পুরুরবাকে বিবস্ত্র না দেখেন, (২) উর্বশীর শয্যার পাশে পুত্রবৎ প্রিয় দুটি মেষ বাধা থাকবে এবং এরা কখনও অপহৃত হবে না, (৩) উর্বশী একসন্ধ্যা ঘৃতমাত্র আহার করবেন । অন্য কাহিনী অনুযায়ী আরও একটা শর্ত ছিল । সেটা হচ্ছে-উৰ্বশী কামাতুরা না হলে, মৈথুনকৰ্ম সংগত হবে না। শতপথব্রাহ্মণ অনুযায়ী পুরুরবা শর্তগুলি পালন করতে সন্মত হন। অতঃপর পুরুরবা ও উর্বশী পরম সুখে বহু বৎসর একত্রে বাস করেন । কিন্তু দেবলোকে উর্বশীর অনুপস্থিতে গন্ধৰ্বরা ব্যথিত হয়ে ওঠে । গন্ধর্বরা তখন উৰ্বশীকে দেবলোকে নিয়ে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে । পুরুরবার সঙ্গে উর্বশীর বসবাসের শর্তগুলি তারা জানত। সুতরাং কৌশল করে তার শর্তগুলি ভাঙাবার উপায় উদ্ভাবন করে। একদিন রাত্রিকালে গন্ধৰ্ব বিশ্বাবসু, উর্বশীর মেষদুটিকে হরণ করে। উর্বশী চিৎকার করে ওঠে ও কাঁদিতে কাঁদিতে পুরুরবাকে মেষ দুটি উদ্ধার করবার জন্য অনুরোধ করে । পুরুরবা নগ্ন অবস্থাতেই শয্যা হতে উঠে ক্ষিপ্ৰগতিতে বিশ্বাবসুর পশ্চাদ্ধাবন করে । এই সময় দেবতারা বজপাতের সূচনা করে বিদ্যুতের সৃষ্টি করে। বিদ্যুতের আলোকে উর্বশী পুরুরবাকে নগ্ন দেখে তৎক্ষণাৎ তাকে ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে যায়।

পুরুরবা তখন উর্বশীর সন্ধানে দেশবিদেশে ভ্ৰমণ করতে থাকে। একদিন কুরুক্ষেত্রের কাছে এক সরোবরে পুরুরবা চারজন অপ্সরাার সঙ্গে উর্বশীকে স্নান করতে দেখে । পুরুরবা তাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করে। উর্বশী বলে-’আমি তোমার সহবাসে গর্ভবতী হয়েছি। তুমি এক বছর পর আমার সঙ্গে দেখা করলে, আমি তোমাকে আমার প্রথম সন্তান উপহার দিব এবং মাত্র একরাত্রি তোমার সঙ্গে বাস করব ।’ এভাবে দীর্ঘ ছয় বছর কাল এক রাত্রির জন্য উর্বশী ও পুরুরবার মিলন ঘটে। তার ফলে আয়ু, বিশ্বায়ু, শতাষ্ণু প্ৰভৃতি নামে তাদের ছয়টি পুত্র জন্ম গ্ৰহণ করে । তারপর উর্বশী পুরুরবাকে জানান যে গন্ধর্বরা পুরুরবাকে যে কোন প্রার্থিত বর দিতে প্ৰস্তুত আছে । পুরুরবা তখন বলেন যে উর্বশীর সঙ্গে তিনি চিরজীবন বাস করতে চান এবং এটাই তার একমাত্র প্রার্থনা । তখন গন্ধৰ্বরা অগ্নিপূর্ণ একপাত্র পুরুরবার সামনে রাখে এবং বলে যে – ‘এই অগ্নিপাত্ৰ গ্ৰহণ করে বেদের নির্দেশানুযায়ী এই অগ্নিকে তিনভাগে ভাগ কর । তারপর উর্বশীতে মনসংযোগ করে আহুতি দাও । তবেই তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে ।’ পুরুরবা সেই অনুযায়ী কার্য করলে গন্ধৰ্বলোকে স্থান পান এবং উর্বশীর চিরসঙ্গী ও চিরপ্রেমিক হয়ে সেখানে বাস করতে থাকেন ( শতপথব্ৰাহ্মণ ৩।৪৷১।১১)। উর্বশীর গর্ভে মোট ছয় সন্তান হয়- আয়ু, বিশ্বায়ু, অমাবসু, বলায়ু দৃঢ়ায়ু ও শতায়ু ।

 

।। তিন ॥

পুরুরবার সঙ্গে উর্বশীর মিলন সম্বন্ধে বেদে আরও এক কাহিনী আছে । একবার আদিত্যযজ্ঞে মিত্র ও বরুণ নিমন্ত্রিত হয়েছিল । সেখানে অপ্সরাা উর্বশীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ায় তাদের রেতঃপাত হয় । রেতের যে ভাগ কুম্ভে পড়ে, তা থেকে বশিষ্ঠ ও অগস্ত্য জন্ম গ্ৰহণ করে । তাতে এই দুই দেবতা ক্রদ্ধ হয়ে উর্বশীকে অভিশাপ দেয় যে তাকে মর্ত্যে নিৰ্বাসিত হতে হবে । সেই কারণেই মর্ত্যে এসে উর্বশী পুরুরবার স্ত্রী হয় ।

উৰ্বশী সম্বন্ধে আরও আখ্যান প্ৰাচীন গ্রন্থে আছে। মহাভারতের বনপর্ব অনুযায়ী মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে অর্জুন যখন দিব্যাস্ত্ৰ সংগ্রহের জন্য দেবলোকে গিয়ে পাঁচ বৎসর বাস করেছিলেন, তখন তিনি ইন্দ্রের আদেশে গন্ধৰ্ব চিত্ৰসেনের কাছে নৃত্য-গীত-বাদ্য শিখছিলেন । একদিন

চিত্ৰসেন উর্বশীর কাছে গিয়ে বলল–‘কল্যাণী দেবরাজের আদেশে তােমাকে জানাচ্ছি যে অর্জুন তোমার প্রতি আসক্ত হয়েছেন । তিনি আজ তোমার কাছে আসবেন।’ – উর্বশী নিজেকে সম্মানিত জ্ঞান করে বলল, ‘আমিও তার প্রতি অনুরক্ত । সখা তুমি যাও, আমি অর্জুনের সঙ্গে মিলিত হব।’ তারপর রাত্রিকালে উর্বশী অর্জুনের গৃহে যান । তার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে উর্বশী বলে—‘তুমি যখন দেবালোকে আস, তখন তোমার আগমনের জন্য ইন্দ্ৰ যে আনন্দোৎসবের অনুষ্ঠান করেছিলেন, সে সময় তুমি নাকি অনিমেষনয়নে শুধু আমাকেই দেখেছিলে ।’ তাই দেখে ইন্দ্ৰ চিত্ৰসেনকে আদেশ দিয়েছিলেন আমি যেন তোমার সঙ্গে মিলিত হই । আমিও তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনঙ্গের বশবর্তী হয়ে তোমার কাছে এসেছি ।’ সে কথা শুনে অর্জুন কান ঢেকে উর্বশীকে বলে—‘ভাগ্যবতী, আপনার কথা আমার শ্রবণযোগ্য নয়, কেননা কুন্তী ও শচীর ন্যায় আপনি আমার গুরুপত্নী তুল্য। আপনি পুরুবংশের জননী ( পুরুরবার ঔরসে উর্বশীর গর্ভে আয়ু জন্মগ্রহণ করে, তারই প্রপৌত্র পুরু ), গুরুর অপেক্ষাও গুরুতম, সেজন্যই উৎফুল্লনয়নে আপনাকে দেখেছিলাম ।’ তখন উর্বশী বলল, ‘আমাকে গুরুস্থানীয়া মনে করা অনুচিৎ, কেননা অপ্সরারা নিয়মাধীন নয়। পুরুবংশের পুত্র বা পৌত্র যে কেউ স্বর্গে এলে আমার সঙ্গে মিলিত হয়। তুমিও আমার বাঞ্ছা পূর্ণ কর।’ অৰ্জুন কর্তৃক প্ৰত্যাখাতা হয়ে উর্বশী ক্ৰোধে অভিভূত হয়ে অর্জুনকে অভিশাপ দেয় —’আমি ইন্দ্রের অনুজ্ঞায় স্বয়ং তোমার গৃহে কামার্ত হয়ে এসেছি, তথাপি তুমি আমাকে গ্ৰহণ করলে না, তুমি সম্মানহীন নপুংসক নর্তকী হয়ে স্ত্রীদের মধ্যে বিচরণ করবে।’ এই বলে উর্বশী নিজ গৃহে চলে যায়। এই অভিশাপের জন্যই অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাট রাজার গৃহে অৰ্জুনকে বৃহন্নলা নামে নর্তকীর ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকতে হয়েছিল ।

আবার মহাকবি কালিদাসের ‘বিক্রমোর্বিশী’ নাটকে আছে যে একবার কেশী দৈত্য উর্বশীকে হরণ করলে পুরুরবা তার হাত থেকে উর্বশীকে উদ্ধার করেছিল এবং উভয়ে পরস্পরের প্রণয়াসক্ত হয় । স্বৰ্গে অভিনয়কালে ভুলক্রমে পুরুরবার নাম উল্লেখ করে ফেলায় শাপগ্ৰস্ত হয়ে উর্বশী মর্ত্যে পুরুরবার স্ত্রী হয়। পুত্ৰ মুখ দর্শনের শাপমোচন হয় । পরে নারদের বরে উর্বশী ও পুরুরবার মিলন চিরস্থায়ী হয়।

একবার অভিশপ্ত হয়ে উর্বশী ঘোটকী হয়েছিল। তখন রাজা দণ্ডী তাকে গ্ৰহণ করেছিল ।

 

।। চার ।।

উৰ্বশী ছাড়া আরও অপ্সরা ছিল। আগেই বলেছি যে দেবলোকের বারযোষিতদের সংখ্যা ৬০ কোটি বলে উল্লিখিত হয়েছে । তাদের মধ্যে উল্লেখনীয় হচ্ছে মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, সুকেশী, মঞ্জুঘোষা, অলম্বুষা, বিদ্যুৎপর্না, সুপ্রিয়া, সরসা, পঞ্জিকাস্থলা, বিশ্বাচী প্রভৃতি। বিভিন্ন পুরাণে এদের সৌন্দর্য ও নৃত্যগীত পারদর্শিতার অনেক উল্লেখ আছে। রম্ভা, মেনকা প্ৰভৃতি অপ্সরা ক্ষীরোদসাগর মন্থনের সময়ে উদ্ভূত হয়। একবার রম্ভা কুবেরের পুত্র নলকুবেরের নিকট অভিসার গমনকালে, রাবণ তাকে দেখে কামমুগ্ধ হয় ও বলপূর্বক তাকে ধর্ষণ করে । ধর্ষণের প্রাক্কালে রাবণের উক্তি থেকে আমরা রম্ভার রূপলাবণ্যের পরিচয় পাই । রাবণ বলেছিল—“স্বর্ণকুম্ভ পীনৌ শুভৌ ভীরু নিরন্তরৌ । কস্যেরঃ স্থলসংস্পৰ্শং যস্যেতস্তে কুচাবিমৌ।। সুবৰ্ণচক্ৰ প্ৰতিমং স্বর্ণদামচিতং পৃথু। অধ্যারোক্ষ্যতি কস্তেইদ্য জঘনং স্বৰ্গরূপিণম ||’ ( রামায়ণ উত্তরকাণ্ড ৩১।২৩-২৪ ) । ‘তোমার সুন্দর কুচযুগল স্বর্ণকুম্ভসদৃশ পীন, নিরন্তর ( কুচদ্বয় মধ্যে কোন ব্যবধান নেই ) ; তোমার কুচযুগল কোন পুরুষের বক্ষ স্পর্শ করবে ? তোমার জঘনদ্বয় সুবর্ণচক্ৰ প্ৰতিম, স্বর্ণহারশোভিত স্থূল ; তোমার এই স্বৰ্গরূপী শ্ৰোণিতটে কোন পুরুষ অদ্য আরোহন করবে।’ ‘আমি ধৰ্মানুসারে আপনার পুত্রবধু’, এই কথা বলে রম্ভা রাবণকে প্ৰতিহত করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাবণ রম্ভাকে শিলাতলে ফেলে উপভোগ করল। রম্ভা রতিশ্রমে কাতরা ও ব্যাকুলা, বেপমানা ও ভীতিগ্ৰস্তা হয়ে নলকুবেরকে একথা জানালে নলকুবের রাবণকে অভিশাপ দেন যে রাবণ যদি কোন স্ত্রীলোকের অনিচ্ছায় তার প্রতি বলপ্ৰয়োগ করে, তাহলে রাবণের মস্তক সপ্তখণ্ডে ভগ্ন হবে । এই জন্যই সীতা রাবণ কর্তৃক, অপহৃত হয়েও নিজের সতীত্ব রক্ষা করেন । রামায়ণের আদিকাণ্ডে ও মহাভারতের অনুশাসন পর্বে রম্ভা সম্বন্ধে আর এক কাহিনী আছে । একবার ইন্দ্র বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গ করবার জন্য অপ্সরা রম্ভাকে পাঠান । কিন্তু বিশ্বামিস্ত্রের শাপে রম্ভা শিলাতে পরিণত হয়ে ১০০ বৎসর অবস্থান করে । স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী রম্ভা যখন বিশ্বামিত্রের আশ্রমে শিলারূপে বাস করছিল, তখন অঙ্গারিকা নামে এক রাক্ষসী সেখানে উপদ্রব্য করতে আরম্ভ করে । তখন ওই আশ্রমে তপস্যারত শ্বেতমুনি বায়ব্য অস্ত্রে ওই শিলাখণ্ড যোজনা করে রাক্ষসীর দিকে নিক্ষেপ করে । অস্ত্ৰভয়ে ভীত রাক্ষসী পলায়ন করে কপিতীর্থে এলে তার মস্তকে ওই শিক্ষাখণ্ড পড়ে ও তার মৃত্যু হয়। ওই শিলাখণ্ড কপিতীর্থে নিমগ্ন হলে রম্ভা আবার নিজরূপ ফিরে পায়। স্কন্দপুরাণে রম্ভা সম্বন্ধে আরও দু’টা কাহিনী আছে। একটা কাহিনী অনুযায়ী একবার ইন্দ্ৰসভায় নৃত্যুকালে রম্ভার তালভঙ্গ হয়। তখন ক্রুদ্ধ ইন্দ্রের শাপে স্পন্দনহীন বিকলাঙ্গ হয়ে রম্ভা ভূতলে পতিত হয়। পরে নারদের পরামর্শে রম্ভা শিবের পূজা করে পুনরায় স্বৰ্গে ফিরে যেতে পারে। অপর কাহিনী অনুযায়ী ইন্দ্রের আদেশে রম্ভা জাবালি মুনির তপোভঙ্গ করে । মুনির ঔরসে রম্ভার এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। জাবালি ওই কন্যাকে প্রতিপালন করেন । ওই কন্যার নাম ফলবতী ।

পূর্বকালে ঋষি বিশ্বামিত্রকে ঘোর তপস্যারত দেখে ইন্দ্র ভীত হয়ে তার তপস্যাভঙ্গের জন্য অপ্সরা মেনকাকে প্রেরণ করেন। সর্বাঙ্গসুন্দরী বিবস্ত্রা মেনকার রূপে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্ৰ মেনকার সহিত মিলিত হয় । এই মিলনের ফলে বিশ্বামিত্রের ঔরসে ও অপ্সরা মেনকার গর্ভে কন্যা শকুন্তলার জন্ম হয়। শকুন্তলার জন্মের পর বিশ্বামিত্র অপ্সরা মেনকাকে বিদায় দিয়ে আবার তপস্যায় রত হন । তখন মেনকা সদ্যজাতা কন্যাকে বনমধ্যে মালিনী নদীর তীরে পরিত্যাগ করে ইন্দ্ৰসভায় প্ৰস্থান করেন। এই পরিত্যক্ত কন্যা শকুন্ত অর্থাৎ পক্ষী কর্তৃক রক্ষিত হয় ও মহৰ্ষি কন্বের দৃষ্টিপথে পতিত হয় । মহর্ষি কন্ব নিজের আশ্রমে এনে একে নিজ কন্যার ন্যায় পালন করতে থাকেন। শকুন্ত কর্তৃক রক্ষিত বলে কন্যাটির নাম হয় শকুন্তলা । গন্ধৰ্বরাজ বিশ্বাবসুর ঔরসেও অপ্সরা মেনকার গর্ভে প্ৰমদ্বারা নামে এক কন্যা হয় । জন্মের পর মেনকা প্ৰমদ্বারাকে পরিত্যাগ করলে মহৰ্ষি স্থূলকেশ্‌ তাকে নিজ আশ্রমে এনে পালন করেন। রুরু মুনির সঙ্গে তার বিবাহ হয়।

ইন্দ্ৰ সব সময়েই সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতেন, পাছে কেউ কঠোর তপস্যা করে তাঁর ইন্দ্ৰত্ব কেড়ে নেয় । সেজন্য ইন্দ্ৰ স্বর্গের বারযোষিতদের নিযুক্ত করতেন তাদের তপস্যা ভঙ্গ করবার জন্য। একটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এখানে তোলা যেতে পারে । স্বর্গের এসব বারযোষিতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সুন্দরী ছিল কে ? মনে হয় তিলোত্তমাই সবচেয়ে বেশী সুন্দরী ছিল । সেটা তিলোত্তমার উৎপত্তি থেকে আমরা জানতে পারি । এ সম্বন্ধে উপাখ্যানটি এখানে বিবৃত করা যেতে পারে । একবার দৈত্যরাজ নিষ্কুম্ভের দুই পুত্র সুন্দ ও উপসুন্দ ব্ৰহ্মার কঠোর তপস্যা করে ত্ৰিলোক বিজয়ের জন্য অমরত্ব প্রার্থনা করে । কিন্তু ব্ৰহ্মা তাদের অমরত্বের বর না দিয়ে বলেন যে ত্রিলোকের কোন প্রাণীর হাতে তাদের মৃত্যু হবে না। যদি কখনও তাদের মৃত্যু হয় তবে পরস্পরের হাতে হবে । এই বর পাবার পর তারা আবার দেবতাদের পীড়ন করতে থাকে, তখন দেবতারা ব্ৰহ্মার কাছে যায়। ব্ৰহ্মা বিশ্বকর্মাকে এক পরমাসুন্দরী নারী সৃষ্টি করতে বলেন । ত্ৰিভুবনের সমস্ত উত্তম জিনিস তিল তিল করে সংগ্ৰহ করে বিশ্বকর্মা এক অতুলনীয় সুন্দরী নারী সৃষ্টি করে। এই কারণেই তার নাম হয় তিলোত্তমা । সৃষ্টির পর তিলোত্তমা দেবতাদের প্রদক্ষিণ করে । তাকে দেখবার জন্য ব্ৰহ্মার চারদিকে চারটি মুখ সৃষ্টি হয় ও ইন্দ্রের সহস্ৰ চক্ষু হয় । তাকে সুন্দ ও উপসুন্দকে প্ৰলুব্ধ করবার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় । তিলোত্তমা তাদের সামনে গিয়ে নৃত্য করতে থাকে । সুন্দ ও উপসুন্দ তিলোত্তমার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে পাবার জন্য পরস্পর যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হয়, এবং সেই যুদ্ধেই তারা পরস্পরের হাতে নিহত হয়। ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুযায়ী তিলোত্তমা একবার দুর্বাশা মুনির ধ্যান ভঙ্গ করতে গেলে দুর্বাশার শাপে বাণের কন্যা ঊষারূপে জন্মগ্রহণ করে ।

অপ্সরা ঘৃতাচী, দু’দুজন ঋষিকে কাৎ করেছিলেন । তার মধ্যে একজন হচ্ছেন ভরদ্বাজ ঋষি। মহাভারতের আদিপর্ব অনুযায়ী ওই ঋষি গঙ্গোত্তরী প্রদেশে বাস করতেন। একদিন স্নানরতা অপ্সরা ঘৃতাচীকে দেখে তার রেতস্খলন হয়। ওই বীৰ্য তিনি কলসের মধ্যে রাখেন এবং তা থেকে কৌরবদের শিক্ষাগুরু দ্রোণের জন্ম হয়। ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী বশিষ্ঠের ঔরসে অপ্সরা ঘৃতাচীর গর্ভে কপিঞ্জলের জন্ম হয় । চ্যবন ও সুকন্যার পুত্র প্রমতির ঔরসেও ঘৃতাচীর গর্ভে রুরু নামে এক পুত্র হয় । ( আগে মেনকা দেখুন )। রামায়ণের আদিকাণ্ড অনুযায়ী রাজৰ্ষি কুশানাভ ও ঘৃতাচীর গর্ভে একশত পরম রূপবতী কন্যা উৎপাদন করেছিলেন। বর্গাও একজন অপ্সরা । একদিন চার সহচরীর সঙ্গে তিনি ইন্দ্রসভা থেকে ফিরছিলেন। পথে এক তপস্যারত ব্রাহ্মণের সঙ্গে তাদের দেখা হয় । তারা এই ব্ৰাহ্মণের তপোভঙ্গ করবার জন্য তাকে প্রলুব্ধ করতে থাকে। ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন যেন শতবর্ষ তারা কুম্ভীর হয়ে জলে বাস করে। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর ব্ৰাহ্মণ প্রশমিত হয়ে বলেন, যদি কোন পুরুষ তাদের জলমধ্য থেকে তোলেন, তবেই তারা তাদের পূর্ব রূপ ফিরে পাবে। অর্জুন একসময় তীর্থভ্ৰমণ করতে এসে শোনেন যে ওই তীর্থে পাঁচটি কুম্ভীর বাস করে এবং তারা মানুষকে জলের মধ্যে টেনে নেয় । জলের মধ্যে অৰ্জুনের পা আঁকড়ে ধরলে, অৰ্জুন সবলে তাকে তুলে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে সে সুন্দরী নারীরূপ পায় । সেই অপ্সরা বর্গা ওইভাবে অৰ্জুন তার সহচরীদেরও উদ্ধার করে । এ কাহিনীটা মহাভারতের আদিপর্বে আছে।

আর একজন অপ্সরাা পঞ্জিকাস্থলা । পঞ্জিকাস্থলা পঞ্চচূড়াবিশিষ্ট অপ্সরাদের অন্যতম । ইন্দ্র একবার মার্কণ্ডেয় মুনির তপোভঙ্গের জন্য পঞ্জিকাস্থলাকে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু পঞ্জিকাস্থলাকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল । একবার পঞ্জিকাস্থলা যখন ব্ৰহ্মার কাছে যাচ্ছিল, তখন রাবণ তাকে বিবসনা করেছিল । ব্ৰহ্মা একথা শুনে রাবণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে ভবিষ্যতে কোন স্ত্রীলোকের প্রতি বলপ্রয়োগ করলে তার মস্তক শতধা চুৰ্ণ হবে। এই অপ্সরাাই বানররাজ কেশরীর স্ত্রী অঞ্জনা রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । পবনদেব এর গর্ভে হনুমানকে উৎপাদন করেছিলেন ।

স্বর্গের আর একজন অগ্রসর হচ্ছে পূর্বাচিত্তী । একবার জম্বুদ্বীপের রাজা প্রিয়ব্রতের জ্যেষ্ঠপুত্র অগ্নিধ্রের কোন পুত্র না হওয়ায়, তিনি পুত্ৰকামনায় মন্দার পর্বতে ব্ৰহ্মার তপস্যায় রত হন। ব্ৰহ্মা তার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে পূর্বাচিত্তী নামে অপ্সরাাকে তার কাছে পাঠিয়ে দেন। পূর্বচিত্তীর রূপে মুগ্ধ হয়ে অগ্নিধ্র তাকে গান্ধৰ্বমতে বিবাহ করে । এই বিবাহের ফলে অগ্নিধ্রের ঔরসে ও পূর্বাচিত্তীর গর্ভে নয়টি পুত্রসন্তান হয় ।

আরও একজন অপ্সরা হচ্ছে প্রম্লোচ্চা । কণ্ডু মুনির তপস্যা ভঙ্গ করবার জন্য ইন্দ্র প্রম্লোচ্চাকে কণ্ডুমুনির কাছে পাঠিয়ে দেন। কণ্ডু প্ৰণয়াসক্ত হয়ে প্রম্লোচ্চার সঙ্গে দীর্ঘকাল বাস করেন। তাঁর ঔরসে প্রম্লোচ্চার এক কন্যা সন্তান হয়, তার নাম মারিষা । বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী মারিষার গর্ভে প্ৰজাপতি দক্ষ জন্মগ্রহণ করেন । বরুণ পুত্র পুষ্করের ঔরসে ও প্রম্লোচ্চার গর্ভে মনোরমা নামে এক কন্যা হয় । প্রম্লোচ্চার অনুরোধে প্ৰজাপতি রুচি এঁকে স্ত্রী রূপে গ্ৰহণ করেন। রুচির ঔরসে এঁর গর্ভে রৌচ্যমনুর জন্ম হয় । হেমা নামে আর একজন অপ্সরা ময়দানবকে বিবাহ করে। তাঁর গর্ভে মায়াবী ও দুন্দুভী নামে দুই পুত্ৰ ও মন্দোদরী নামে এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে, মন্দোদরী রাবণের স্ত্রী ও মেঘনাদের মাতা ।

অগণিত অপসারদের মধ্যে সকলের নাম আমাদের জানা নেই । যাদের নাম জানা আছে, তাদের কথাই আগে বললাম । তবে অদ্রিকা নামে আর একজন অপ্সরাার নাম আমরা মহাভারতে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম বৃত্তান্তের কাহিনীর মধ্যে পাই । কুরুরাজ চেদিবংশীয় উপরিচর বসু একবার মৃগয়া করতে গিয়ে তঁর রূপবতী স্ত্রী গিরিকাকে স্মরণ করে কামাতুর হয়ে পড়েন। তাতে তাঁর রেতঃস্বলন হয় । স্খলিত শুক্র তিনি এক শ্যেনপক্ষীর সাহায্যে তঁর স্ত্রীর নিকট প্রেরণ করেন । পথে অন্য এক শ্যেনের আক্রমনে উক্ত শুক্র যমুনার জলে পড়ে। সে সময় অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা ব্ৰহ্মশাপে মৎস্যরূপ ধারণ করে যমুনার জলে বাস করছিল । সেই অপ্সরাা ওই শুক্র গ্ৰহণ করে গর্ভবতী হয়। তার ফলে তার এক পুত্র ও কন্যা হয়। কন্যা এক ধীবর কর্তৃক পালিত হয় । তার গায়ে মৎস্যের গন্ধ থাকার দরুন তার নাম মৎস্যগন্ধা হয় । তাঁর অপর নাম সত্যবতী। কুমারী অবস্থায় পরাশর মুনির ঔরসে তাঁর গর্ভে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম হয় ।

 

৷৷ পাঁচ ॥

অপ্সরাাদের সঙ্গে যৌ*সম্পর্ক ছিল গন্ধৰ্বদের । বৈদিকযুগে গন্ধৰ্বরা ছিল এক শ্রেণীর উপদেবতা । কিন্তু যখন তাদের সংখ্যা বেড়ে গেল, স্বৰ্গেই তারা নিম্নশ্রেণীর দেবতা হিসাবে স্থান পেল । সঙ্গীতবিদ্যায় তারা বিশেষ পারদর্শী ছিল। এছাড়া, ওষধি বিষয়েও তারা অভিজ্ঞ ছিল । সেজন্য তাদের স্বর্গের বৈদ্য বলা হত । স্বর্গে তারা অপ্সরাাদের সঙ্গে গায়ক হিসাবে যোগদান করত । অপ্সরাদের সঙ্গে তারা অবাধে মেলামেশা করত। নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে যে বিবাহ হয়, তাকেই গান্ধৰ্ব বিবাহ বলা হত। বিষ্ণুপুরাণ মতে ব্ৰহ্মার কান্তি থেকে তাদের জন্ম হয় । আর হরিবংশ মতে স্বারোচিষ মন্বন্তরে অবিষ্ঠার গর্ভে গন্ধৰ্বরা জন্মগ্রহণ করে । তাদের সমৃদ্ধশালী নগরী ও প্রাসাদ ছিল । এই সকল নগরীর অধিপতি ছিল হা হা, হু হু, চিত্ররথ, হংস, বিশ্ববায়ু, সোমারা, তুম্বুরু, নন্দি প্রভৃতি গন্ধর্বগণ ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *