ডেভিড কপারফিল্ড – চার্লস ডিকেন্স
০১. শৈশব স্মৃতি
শৈশব স্মৃতি
আমার জন্ম হয় এক শুক্রবার রাত বারোটায়। ঘড়ির ঢং ঢং আর আমার প্রথম কান্নার আওয়াজ মিলে যায় একসাথে।
এর আগে, সেদিন বিকেলে এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। ভীত মনে বিষণ্ণ মুখে আমার মা বসেছিলেন আগুনের পাশে। তিনি দেখলেন যে এক অপরিচিত মহিলা এগিয়ে আসছেন আমাদের বাগানের পথে। দরজার বেল না বাজিয়ে মহিলাটি জানালা দিয়ে তাকালেন ভেতরে। কাচের ওপর চাপ পড়ায় তার নাকটা চ্যাপ্টা ও সাদা হয়ে উঠল। মাকে চমকে দিলেন মহিলা। চট করে দাঁড়াতে গিয়ে মূৰ্ছা গেলেন মা।
মা-র মূৰ্ছা ভাঙল সন্ধ্যায়। মহিলাটি তখন দাঁড়িয়ে আছেন ঘরের মধ্যে, জানালার কাছে। তিনি আমার বাবার ফুফু মিসট্রটউড। মা বলতেন মিস বেটসি। আমার বাবা ছিলেন এক সময় তার খুব প্রিয় ভাইপো। কিন্তু একদিন যেই শুনলেন। যে ভাইপোটি বিশ বছরের কমবয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে-অমনি রেগেমেগে তিনি চলে গেলেন তার সাগরতীরের কটেজ-এ। আর কখনও ভাইপোর মুখ দেখেননি। বেচারা বাবা মারা যান আমার জন্মের ছমাস আগে।
শোনো বাছা, বললেন মিস বেটসি আমার মাকে। এই মেয়েটি জন্মালে…
ছেলেও হতে পারে, আস্তে করে বললেন মা।
না, মেয়েই হতে হবে, বললেন মিস বেটসি। আমি ওর নাম দেব বেটসি ট্রটউড কপারফিল্ড। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আমি হব ওর বন্ধু। ওর ধর্ম-মা। ওকে হেলাফেলা করা যাবে না। খুব যত্নে লালন-পালন করতে হবে। সব রকম সুযোগ দিতে হবে। আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করব।
মা-র চেহারা বিবর্ণ হয়ে উঠল। ফিসফিস করে তিনি বললেন, আমার কাঁপুনি ধরবে মনে হচ্ছে। আমি মরে যাব।
না-না-না! চেঁচিয়ে উঠলেন মিস বেটসি। চা খাও একটু। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কাজের মেয়েটির নামে কি?
পেগোটি, বললেন মা।
পেগোটি আবার একটা নাম হলো নাকি? খেকিয়ে উঠলেন মিস বেটসি।
ওরকম নাম কেউ রাখে?
ওটা ওর ডাক নাম। ওর আসল নামটা আমার নাম কিনা, তাই মিস্টার কপারফিল্ড ওই নামে ডাকতেন ওকে।
বসার ঘরের দরজা খুলে মিস বেটসি হাঁক দিলেন, পেপগাটি, এদিকে এসো। তোমার মনিব চা খাবেন। চা নিয়ে এসো।
পেগোটি চা আনল। আঁধার ঘনিয়ে আসছে, তাই মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিল ঘরে। মোমের আলোয় মা-র দিকে একবার তাকিয়েই সে ছুটল ডাক্তার ডেকে আনতে।
ডাক্তার চিলিপ এলেন। ঘণ্টা কয়েক পরে ডাক্তার আমার জনের বার্তা নিয়ে মা-র কামরা থেকে বেরিয়ে পা রাখলেন বসার ঘরে। মিস বেটসি শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলেন যে, নবজাত শিশুটি মেয়ে নয়-ছেলে। তার আশা সফল হয়নি। রেগেমেগে তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের বনেটটি তিনি ছুঁড়ে মারলেন ডাক্তারের মাথায়। তারপর বেরিয়ে চলে গেলেন হনহন করে। আর কখনও ফিরে আসেননি।
এই হলো আমার জন্মকাহিনি।
মাকে আমার মনে পড়ে। মনে পড়ে তার লম্বা চুল, তন্বীদেহ। মনে পড়ে পেগোটিকে। ওর কালো চোখ, মোটা শরীর, স্নেহমাখা মুখের স্মৃতি আমি ভুলতে পারি না।
মায়ের ঘরে শুতাম। বিছানায় শুয়ে দেখতে পেতাম গির্জার আঙিনা। রাতের বেলা প্রায়ই মনে হত ওখানে আমার বাবার কবরটি বড় নিঃসঙ্গ, একা।
মনে পড়ে, শীতের সন্ধ্যায় বসার ঘরে মায়ের সঙ্গে খেলতাম। নাচানাচি করতাম। দম ফুরিয়ে গেলে মা বসে পড়তেন। বিশ্রাম নিতেন। তাঁর উজ্জ্বল কোঁকড়ানো চুলে চিরুনির মত আঙুল বুলাতেন। আমাকে সব সময় ডাকতেন আমার ছোট্ট ডেভি সোনা। বুকে চেপে ধরে গান গাইতেন। লেখাপড়া শেখাতেন।
০২. পরিবর্তন এল আমার জীবনে
পরিবর্তন এল আমার জীবনে
আমার বয়স তখন আট বছর। এক রাতে পেগোটি আর আমি বসে ছিলাম। আগুনের পাশে। আর কেউ ছিল না বসার ঘরে। আমি ওকে কুমিরের গল্প পড়ে শোনাচ্ছিলাম। পড়াটা বোধহয় খুব ভাল হচ্ছিল না। কারণ, পড়া শেষ হতে দেখা গেল, পেয়গাটির ধারণা হয়েছে যে ক্রকডাইল (ওর ভাষায় ক্রর্কিনডিল) এক রকমের সজি।
পড়া চলল আরও কিছুক্ষণ। তারপর মা এলেন এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে। লোকটি রোববার গির্জা থেকে ফেরার সময়ও এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে।
এখন জানি তার নাম মি, মার্ডস্টোন। প্রায়ই আসছেন আমাদের বাড়িতে। তাকে আমার ভাল লাগেনি। তার গলার আওয়াজও পছন্দ হয়নি আমার। মনে পড়ে, নোকটা এলেই পেগোটির মুখে-চোখে একটা অদ্ভুত ভাব ফুটে উঠত।
পেগোটির মুখের ভাব ওরকম হচ্ছে কেন বুঝলাম না। একদিন শুনলাম মা-র সঙ্গে ওর কথা কাটাকাটি হচ্ছে চাপা স্বরে। পেগোটি ওই অচেনা লোকটির সঙ্গে মা-র মেলামেশা পছন্দ করছে না। লোকটিকেও পছন্দ হচ্ছে না ওর। মা বকছেন পেগোটিকে। বলছেন পেগোটি তার সুখ চায় না।
ঝাপসা হয়ে আসছে স্মৃতি। মনে হয় পরের দিন। আসলে সেদিনের মাস দেড়েক পরে। পেগোটি হঠাৎ তোষামোদের সুরে আমাকে বলল, ডেভি সোনা, যাবে আমার সঙ্গে ইয়ারমাউথে? চলো না, আমার ভায়ের বাড়ি থেকে সপ্তা দুয়েক বেড়িয়ে আসি? ওখানে সাগর আছে, নৌকা আর জেলেরা আছে। আমার ভাইপো হ্যাম আছে।
সে তো খুব মজার ব্যাপার হবে, তবে মাকে একা ফেলে আমি যেতে চাই, বললাম ওকে।
পেগোটি বলল, তোমার মা বেড়াতে যাবেন আরেক জায়গায়। আবারও লক্ষ করলাম কথাগুলো বলতে বলতে ওর মুখে সেই অদ্ভুত ভাবটা ফুটে উঠল।
আমাদের দুচাকার ঘোড়ার গাড়িটা বাড়ির সামনে থেকে চলল ইয়ারমাউথের পথে। দেখলাম মা যেখান থেকে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছেন আমাদেরকে, সেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন মি. মার্ডস্টোন। তিনি কেন ওখানে, বুঝলাম না।
গাড়ির চালক মি. বার্কিস। বন্ধু লোক। দীর্ঘ যাত্রাপথে তিনি আর পেগোটি অনেক হাসিঠাট্টা করলেন।
ইয়ারমাউথে পৌঁছতেই নাকে লাগল মাছ, পিচ, আলকাতরা আর লবণের গন্ধ। দেখলাম নাবিকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে, পাথরে ছাওয়া রাস্তায় ঝুনঝুন শব্দ তুলে চলছে গাড়ি-ঘোড়া।
শহরেই দেখা হলো হ্যামের সঙ্গে। বিশালদেহী বলিষ্ঠ লোক। ছফুট লম্বা। কিন্তু মুখটা ছেলে মানুষের মত। আমাকে পিঠে তুলে নিয়ে এবং আমাদের ছোট বাক্সটি বগলদাবা করে চলল হ্যাম। পেপগাটি তুলে নিল আরেকটি বাক্স। গ্যাসকারখানা, নৌকার ঘাট, কামারশালা, দড়ির কারখানা পেছনে ফেলে আমরা পৌঁছলাম সাগরের তীর বরাবর একটি সমতল জায়গায়।
মাস্টার ডেভি, ওই যে আমাদের বাড়ি! বলল হ্যাম।
চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। সাগরতীরে এবং সাগরে যতদূর দৃষ্টি যায়। নদীর দিকেও দেখলাম। কিন্তু বাড়ি-টাড়ি কিছুই নজরে পড়ল না।
একমাত্র যে জিনিসটি নজরে এল সেটি হচ্ছে একটি কালো মালবাহী বড় নৌকা, কিংবা কোন সেকেলে জাহাজ। শুকনো ডাঙায়, অনেক ওপরে। ওটার গা কেটে দরজা-জানালা বানানো হয়েছে। একটা লোহার চোঙা চিমনির মত উঁচু হয়ে রয়েছে ওটার ওপর। সেই চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উঠছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। এ ছাড়া বাড়ির মত আর কিছুই দেখলাম না।
জাহাজের মত দেখতে ওই জিনিসটা নাকি? জিজ্ঞেস করলাম।
হ্যাঁ, ওটাই, মাস্টার ডেভি, জবাব দিল হ্যাম।
ওখানে থাকার কথা ভেবে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলাম। এতটা মাতোয়ারা বোধহয় আলাদীনের মহলে থাকার জন্যও হতাম না!
পেগোটি বার্জের পেছন দিককার একটা ছোট্ট দুয়ার খুলে আমার শোবার ঘরটা দেখিয়ে দিল। ঘরে একটা ছোট্ট জানালাও আছে। আয়না আছে। একজন শুতে পারার মত বিছানা আছে একটা। আর আছে টেবিলের ওপর নীল মগ-এ সাগরগুল্মের তৈরি একটি ছোট ফুলের তোড়া।
সাদা অ্যাপ্রন পরা একটি অতি ভদ্রমহিলা এবং একটি ফুটফুটে সুন্দর ছোট্ট মেয়ে অভ্যর্থনা জানাল আমাদেরকে। মেয়েটির চোখ নীল। মাথায় লম্বা কোঁকড়ানো হলদে চুল।
পেগোটি আমাকে বলল, ইনি হচ্ছেন মিসেস গামিজ। বিধবা মহিলা। আমার ভাইয়ের সংসার দেখেন।
আমি মিষ্টি করে হাসলাম মহিলার দিকে চেয়ে।
আর ওই ছোট্ট মেয়েটি হলো, বলে গেল পেগোটি, এমিলি। আমার ভাইয়ের পালিত মেয়ে। ও হলো এতিম, বুঝলে ডেভি সোনা, ঠিক হ্যামের মত। আমার ভাইটি খুব ভাল। একেবারে সোনার মানুষ। হ্যাম আর এমিলি দুজনকেই তিনি পুষ্যি নিয়েছেন।
কিছুক্ষণ পরেই মি. পেগোটি এলেন। দেখলাম যে পেগোটির কথাই ঠিক। লোকটা সত্যিই ভাল।
পরদিন ভোরের আলো আমার ঝিনুকের খোলের ফ্রেমে বাঁধানো আয়নাটায় পড়তেই লাফিয়ে উঠলাম বিছানা ছেড়ে। ছোট্ট এমিলিকে নিয়ে চলে গেলাম বাইরে। নুড়ি পাথর কুড়াতে লাগলাম দুজনে মিলে।
এমিলিকে বললাম আমার মায়ের কথা। বললাম আমার আর কেউ নেই মা ছাড়া। বললাম বড় হলেই মা-কে দেখাশোনা করব আমি।
এমিলি বলল, বড় হলে সে হয়ে উঠবে একজন চমৎকার ভদ্রমহিলা। আরও বলল, মা-কে সে হারিয়েছে এবং ওর বাপ মরেছে সাগরে ডুবে।
দুই সপ্তাহ আমরা দুজনে একত্রে কাটালাম। সাগর তীরে খেলা করলাম। হ্যামের নৌকায় চড়ে ফুর্তি করলাম, অনর্গল বকবক করে কত কথা বললাম। আমাদের বেড়ানোর মেয়াদ ফুরোবার আগেই প্রেমে পড়ে গেলাম ছোট্ট এমিলির।
ওখানে থাকার পুরো সময়টায় বাড়ির কথা আমার খুব কমই মনে পড়ল। কিন্তু সময় কেটে গেল যেন হাওয়ার ডানায় ভর করে। এল বিদায়ের লগ্ন। চোখের জলে বিদায়ের পালা সাঙ্গ করে আমরা চললাম ইয়ারমাউথ ছেড়ে। যতই এগোতে লাগলাম বাড়ির কাছে ততই উত্তেজনা বাড়তে লাগল আমার মনে। কিন্তু ফিরতি পথে দেখা গেল যে পেগোটির মনটা খারাপ। ওর মুখে আবারও সেই অদ্ভুত ভাবটি ফুটে উঠেছে।
মা দরজায় ছিলেন না আমাদেরকে অভ্যর্থনার জন্য। পেপগাটি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল রান্নাঘরে। এতে ঘাবড়ে গেলাম আমি।
মা কোথায়? চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। বাবার মত মরে যাননি তো?
না, না, মাস্টার ডেভি, বলল পেগোটি। তোমার মা মারা যাননি। তোমার একজন নতুন বাবা হয়েছে। এসো, তার সঙ্গে দেখা করো।
দেখা করতে আমি চাই না, বললাম চিৎকার করে।
কিন্তু পেগোটি জোর করতে লাগল। মা-কে দেখতে চাই বলে ওর পিছু পিছু। গিয়ে ঢুকলাম বসার ঘরে। দেখলাম মা বসে আছেন আগুনের ধারে এবং তার পাশে বসে আছেন মি. মার্ডস্টোন। তিনি মাকে হুঁশিয়ার করে দিলেন নিজেকে সংযত রাখার জন্য। তাই মা ধীরে, ভীরু পায়ে এগিয়ে এলেন এবং আমাকে চুমু দিলেন। আমি হ্যাণ্ডশেক করলাম মি. মার্ডস্টোনের সঙ্গে, কিন্তু সুযোগ পাওয়া মাত্রই চলে গেলাম দোতলায়।
দেখলাম, আমার শোবার ঘর বদলে গেছে। আমাকে এখন শুতে হবে মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে।
মনটা আমার ভরে গেল বিষাদে। রুমটা একেবারে ছোট। সিলিং-এ ফাটল। জানালার কাচে ময়লা। আজেবাজে জিনিসে ভর্তি ঘরটা। আমি কাদতে লাগলাম। ছোট্ট এমিলিকে ভালবাসি গভীরভাবে। কিন্তু আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে ওর কাছ থেকে। মা-কে ভালবাসি। মা-র কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে আমাকে। কেউ যেন আমাকে চায় না। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে মা আর পেগোটি এসে আমাকে জাগালেন। আমার মুখচোখে অশ্রুর দাগ দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে, ডেভি?।
কি হয়েছে যেন জানেন না তিনি। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে জবাব দিলাম, জানি না।
মা পেগোটিকে দোষ দিলেন, এসব তোমার কাজ, পেগোটি। তুমি ডেভির মন বিষিয়ে তুলেছ আমার আর আমার প্রিয়জনের বিরুদ্ধে। কেমন করে, কেন এমন করলে?
পেগোটি বলল, মিসেস কপারফিল্ড, আপনি এ মুহূর্তে যা বললেন এর জন্য খোদা আপনাকে মাফ করুক।
এ সময় আমার কাঁধে একটি হাত পড়ল। মি. মার্ডস্টোনের হাত। আমি নেমে দাঁড়ালাম বিছানার পাশে।
এসব কি হচ্ছে, ক্লারা? তুমি কি ভুলে গেলে যে তোমাকে দৃঢ় হতে হবে? বললেন তিনি।
মা বললেন, খুবই দুঃখিত, এডওয়ার্ড। কিন্তু কি করব? মন নরম হয়ে যায়। চেষ্টা করি শক্ত হতে, কিন্তু…পারি না…
তাই নাকি? শুনতে ভাল লাগল না, বলে তিনি কাছে টেনে নিলেন মা-কে। কানে কানে কি বললেন। চুমু দিলেন। মা-র মাথাটা এলিয়ে পড়ল তার কাঁধের ওপর। বুঝলাম, মা এখন তার হাতে একতাল কাদার মত। তিনি ওই কাদাকে ইচ্ছামত রূপ ও আকার দিতে পারেন। এবং দিলেনও।
তুমি এখন নিচে যাও। ডেভিড আর আমি এক সঙ্গে আসব।
মা বেরিয়ে যাবার পর মুখ কালো করে পেগোটির দিকে ফিরে তিনি বললেন, তোমার মনিবের নাম জানো?
অনেক দিন ধরে তিনি আমার মনিব। আমার তো জানা উচিত, স্যার, বলল পেগোটি।
কিন্তু ওপরে আসার সময় শুনলাম তুমি ওকে অন্য নামে ডাকছ। ওটা ওর নাম নয়। ওর নাম এখন মিসেস মার্ডস্টোন। মনে থাকবে তো?
মাথা নুইয়ে নীরবে বেরিয়ে গেল পেপগাটি।
এবার আমার দিকে ফিরে তিনি বললেন, ডেভিড, আমার ঘোড়া বা কুকুরটা অবাধ্য হলে আমি কি করি বলো তো?
জানি না।
পিটিয়ে শায়েস্তা করি। তুমি চালাক ছেলে। আশা করি, আমার কথাটার মানে বুঝতে পেরেছ।
ওই সময় থেকে আমি ভয় ও ঘৃণা করতে লাগলাম মি. মার্ডস্টোনকে। মা আমাকে তাড়াহুড়ো করে বুকে টেনে নেন। একমাত্র তখনি-যখন লোকটি কাছে থাকে না। এ পরিবর্তন ঘটে যাবার ফলে বাড়ি আর আমার কাছে বাড়ি বলে মনে হত না। মি. মার্ডস্টোন উঠে পড়ে লাগলেন আমাদের জীবনযাত্রাকে শোধরাবার জন্য। কিন্তু আমি না পারলাম তাকে শ্রদ্ধা করতে, বা পছন্দ করতে। আমার একমাত্র আরামের স্থল হয়ে দাঁড়াল রান্নাঘর, একমাত্র প্রিয় হয়ে দাঁড়াল পেগোটির সঙ্গ।
এর পরে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত এসে উদয় হলেন মি. মার্ডস্টোনের বড় বোন মিস জেন মার্ডস্টোন। তিনি থাকবেন আমাদের সঙ্গে। আসামাত্রই তিনি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন যে আমাকে তার পছন্দ হচ্ছে না। ফলে আমি প্রায় বন্দী হয়ে পড়লাম আমার ছোট্ট শোবার ঘরটায়। সেখানেই কাটতে লাগল আমার দিনগুলো মৃত বাবার কিছু পুরানো বই পড়ে।
মিস মার্ডস্টোন মা-কে বললেন যে তিনি এসেছেন সাহায্য করতে। মা-র। কাঁধ থেকে সংসারের বোঝা নামিয়ে নিজের কাঁধে নিতে। এসব বলে মা-র চাবির গোছাটা তিনি তুলে নিলেন। ওটা আর মা ফেরত পাননি। মহিলা এখানকার জিনিস ওখানে, ওখানকার জিনিস এখানে করে বদলে দিলেন সবকিছু।
ক্রমে আমাদের সংসারের সব কর্তৃত্ব চলে গেল মার্ডস্টোনদের হাতে। মা। একবার ক্ষীণ প্রতিবাদ করতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেলেন।
মি. মার্ডস্টোন আর তাঁর বোন আমাকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলাবলি করতে লাগলেন। এ বিষয়ে তারা সিদ্ধান্তে পৌছানো পর্যন্ত আমার পড়াশোনা চলতে লাগল বাড়িতে, মায়ের কাছে। সেখানে একটা পরিবর্তন হলো। আগে পড়া মুখস্থ হলে বলে শোনাতাম মাকে। কিন্তু এখন ওই লোকটা এবং তাঁর। বোন আমার পড়ার সময় হাজির থাকেন চৌকিদারের মত। ফলে যা শিখি সব ডেভিড কপারফিল্ড উধাও হয়ে যায় আমার মগজ থেকে। আমি তোতলাতে থাকি, থমকে যাই।
ভুলব না সেসব দিনের কথা। মা-র কাছে পড়াশোনা কি সহজই না ছিল। এখন সব গোলমাল হয়ে গেল। একদিনের কথা বলি: সকাল বেলায় বই-খাতা আর স্লেট নিয়ে ভীরু পায়ে চলে গেলাম মা-র কাছে। তার একপাশে ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ার ভান করছেন মি. মার্ডস্টোন। অন্য পাশে হাতে ইস্পাতের জপমালা নিয়ে বসে আছেন মিস মার্ডস্টোন। ওই দুজনকে দেখামাত্রই আমার মাথায় ঝিম ধরল। মগজ অবশ হয়ে গেল। মনে হলো, যা শিখেছি সবই মগজ থেকে পানির মত গড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। একটা শব্দও বেরুল না আমার মুখ দিয়ে। শব্দগুলো যেন এক এক করে উড়ে গেছে ডানা মেলে। একটা বইয়ের পড়াও পারলাম না। মা-র চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে, আমি তার দিকে। আমার ঠোঁট দুটো নড়ছে নিঃশব্দে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মি. মার্ডস্টোন। কেড়ে নিলেন বইগুলো। ছুঁড়ে মারলেন আমার গায়ে। ঘাড় ধরে কান মলে বের করে দিলেন বারান্দা থেকে।
এইভাবে চলতে লাগল আমার লেখাপড়া দিনের পর দিন। বকেয়া পড়ার পাহাড় জমতে লাগল। এর ওপর মুখে মুখে কঠিন-কঠিন অঙ্ক দিতেন মি. মার্ডস্টোন। আমার ঘাম বেরিয়ে যেত অঙ্কগুলো নিয়ে ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে। সারাদিন ছুটি মিলত না। এমনি করে আমি একেবারে নিরেট বোকা হয়ে গেলাম। ছয় মাস ধরে চলল এরকম।
একদিন সকালে দেখলাম মা-র মুখটা ভীষণ উদ্বিগ্ন। মি. মার্ডস্টোনের মুখটা কঠোর। তার হাতে একটি বেত। মিস মার্ডস্টোন তার ভাইকে চোখের ইশারা। করলেন। মি. মার্ডস্টোন বললেন আমাকে বেত মারা দরকার। মা-র ক্ষীণ আপত্তি তিনি গ্রাহ্য করলেন না। হাত ধরে আমাকে নিয়ে গেলেন আমার শোবার ঘরে। ওখানে যেতেই তিনি হঠাৎ আমাকে উপুড় করে ফেললেন তার হাঁটুর ওপর।
মি. মার্ডস্টোন! মি. মার্ডস্টোন! স্যার! বলে চেঁচাতে লাগলাম আমি। মারবেন না, আমাকে মারবেন না, স্যার! পড়া শিখতে আমি চেষ্টা করেছি। কিন্তু আপনি আর মিস মার্ডস্টোন চেয়ে থাকলে আমার কিছুই মনে থাকে না!
মনে থাকে না, না? আচ্ছা দেখা যাবে কেমন মনে থাকে না, বলে তিনি বেত দিয়ে শপাং শপাং পিটাতে লাগলেন আমাকে।
যন্ত্রণায় চিৎকার করলাম। কত মিনতি করলাম আমাকে না মারার জন্য। কিন্তু বেত পড়তে লাগল অবিরাম। তখন আমি হঠাৎ তাঁর হাত কামড়ে দিলাম।
তিনি এমনভাবে আমাকে পিটাতে লাগলেন যেন মেরেই ফেলতে চান। দরজার বাইরে থেকে মা আর পেপগাটির কান্না শুনলাম। তারপর তিনি চলে গেলেন। বাইরে থেকে তালা পড়ল আমার দরজায়।
পাঁচদিন বন্দী রইলাম আমার ঘরে। মা-কে দেখারও সুযোগ দেয়া হলো না আমাকে। শেষের রাতে বিছানায় বসে দেখছিলাম, আমার ঘর আর গির্জার মাঝখানের জায়গাটিতে বৃষ্টির ধারা নামছে প্রবল বেগে। এমন সময় পেগোটি এল আমার দরজায়। চাবির ছিদ্রে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে বলল, মাস্টার ডেভি, তোমাকে লণ্ডনের কাছে এক স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু চিন্তা কোরো না। আমি তোমার মায়ের দেখাশোনা করব। ও আমাকে চুমু দিতে পারছিল না, তাই চাবির ছিদ্রে চুমু দিয়ে চলে গেল।
সকালে আমাকে রূম থেকে বের করা হলে মা-কে দেখলাম। ফ্যাকাসে বিবর্ণ হয়ে গেছেন মা। লাল হয়ে গেছে তার চোখ দুটো। বিদায়কালে আমাকে বুকে নিতেও মাকে দিলেন না মি. মার্ডস্টোন।
মি. বার্কিস আমার জিনিসপত্র তুলে নিলেন গাড়িতে। আমরা রওনা হলাম। মাত্র আধ মাইল গিয়েছি এমন সময় রাস্তার পাশের ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল পেগোটি। উঠে পড়ল গাড়িতে। কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল বুকে। কয়েকটা কেক, তিনটি শিলিং, দুটি আধা-ক্রাউন এবং মায়ের একটি চিঠি দিল। তারপর নেমে গেল গাড়ি থেকে।
যেতে যেতে পেগোটি সম্পর্কে আমাকে অনেক প্রশ্ন করলেন মি. বার্কিস। আমি বললাম পেগোটির বিয়ে হয়নি। এতে তিনি যেন খুবই আগ্রহী হয়ে উঠলেন পেগোটির প্রতি। বললেন ওর কাছে চিঠি লিখলে আমি যেন বলি যে বার্কিস ইচ্ছুক। বার্তাটি ওই সময় বিভ্রান্ত করেছিল আমাকে। পরে আমি জানতে পারি যে বার্কিস আমাদের লক্ষ্মী পেগোটিকে বিয়ে করতে চান, কিন্তু বেশি লাজুক হওয়ায় ওকে বলতে পারছেন না।
বার্কিসের জন্য লণ্ডন অনেক দূরের জায়গা। অত দূর তিনি যাবেন না। তাই আমাকে আরেকটি কোচে, নাইট কোচে উঠতে হলো। কিন্তু কোচ-স্টেশনে নেমে দেখলাম কপারফিল্ড বা মার্ডস্টোন নামের কোন বাচ্চাকে নেয়ার জন্য সেখানে কেউ নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম হেঁটে বাড়ি ফিরে যেতে কতক্ষণ লাগতে পারে। এ সময় একজন রোগাটে তরুণ এসে প্রশ্ন করল, নতুন ছেলে কি তুমি?
ইনি হচ্ছেন মি. মেল, আমি যে স্কুলে যাচ্ছি সেই সালেম হাউসের মাস্টারদের একজন।
একটা উঁচু ইটের দেয়ালেঘেরা বাড়ি। গেট-এ একটা বোর্ডে লেখা রয়েছেসালেম হাউস। বেল টিপতেই ষাঁড়ের মত মোটা ঘাড়, কাঠের পা, আর খাটো চুল-অলা একটা লোক গেট খুলে দিল।
নতুন ছেলে, বললেন মাস্টারটি।
তিনি আমাকে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে দেখলাম পেস্টবোর্ড প্ল্যাকার্ডের ওপর সুন্দর করে লিখে রাখা হয়েছে: হুঁশিয়ার, ও কামড়ায়। বোর্ডটা পড়ে আছে একটা টেবিলের ওপর।
দেখামাত্রই আশঙ্কা করলাম যে নিচে কোথাও কুকুর আছে। লাফিয়ে উঠলাম একটা চেয়ারে। মি. মেল জিজ্ঞেস করলেন চেয়ারে উঠলাম কেন?
বললাম, মাফ করবেন, স্যার, কুকুরটা কোথায় দেখছি।
কুকুর? কোন্ কুকুর?
ওটা কি কুকুর নয়?
কোনটা?
যেটা থেকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে? যেটা কামড়ায়?
না, কপারফিল্ড, বললেন তিনি গম্ভীরভাবে। ওটা কুকুর নয়, একটি ছেলে। আমার ওপর নির্দেশ, এই প্ল্যাকার্ডটা তোমার পিঠে ঝুলিয়ে দিতে হবে। শুরুতেই এরকম করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু আমাকে এটা করতেই হবে।
মি. মেল সত্যি প্ল্যাকার্ডটা ঝুলিয়ে দিলেন আমার পিঠে একটা ন্যাপস্যাকের মত।
সে যে কী যন্ত্রণা কেউ তা কল্পনাও করতে পারবে না। যেদিকে যাই, যেদিকে ফিরি, মনে হয় কেউ যেন পেছন থেকে ওটা পড়ছে, আর হাসছে দাঁত বের করে।
০৩. সালেম হাউসের দিনগুলো
সালেম হাউসের দিনগুলো
একমাস পড়লাম মি. মেল-এর কাছে। ভালই চলছিল পড়াশোনা। হঠাৎ একদিন তলব করলেন হেডমাস্টার মি. ক্রীক্ল।
মি. ক্রী্ক্ল-এর মুখটা দেখতে ভয়ঙ্কর। চোখদুটো ছোট, কুতকুঁতে। নাকও ছোট। বিশাল চিবুক। মাথায় মস্ত টাক।
এটাই তাহলে সেই তরুণ ভদ্রলোকটি-যাকে শেখাতে হবে বাধ্যতা কাকে বলে। যার দাঁত ফাইল দিয়ে ঘসে ছোট করে দিতে হবে, যাতে সে না কামড়ায়। ওর সৎ বাপকে আমি চিনি। তিনি একজন অত্যন্ত ভাল মানুষ, বলতে বলতে তিনি আমার কান মোচড়াতে লাগলেন খুব জোরে জোরে।
আমি কে, জানো? প্রশ্ন করলেন মি. ক্রীক্লকল।
যন্ত্রণা-বিকৃত মুখে বললাম, এখনও জানি না, স্যার।
আমার কানে আরেকটা জোর মোচড় দিয়ে তিনি বললেন, আমি এক তাতার। যখন বলি কাউকে দিয়ে একটা কাজ করাব তখন বুঝতে হবে যে করাবই। আমি কর্তব্য পালন করি। তুমি শীঘ্রিই জানবে আমাকে। এখন যাও, বলে ছেড়ে দিলেন আমার কানটা।
যেতে বলায় খুশি হলাম। ছুটে পালাতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মনে যে একটা নালিশ আছে। সেটা না বলে যেতে পারলাম না। নিজের সাহস দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, প্লীজ, স্যার…
আবার কি?
প্লীজ, স্যার, অন্য ছেলেরা এসে পৌছার আগে আমার পিঠের লেখাটা…
আমাকে ভয় দেখানোর জন্য কিনা জানি না, মি. ক্রীক্ল এমনভাবে লাফিয়ে উঠলেন চেয়ার ছেড়ে যে আমি আর দাঁড়ালাম না। প্রাণপণে ছুটে চলে গেলাম আমার বেডরূমে। বিছানায় পড়ে কাপতে লাগলাম থরথর করে। বুঝলাম, মি. ক্রীক্ল কম কঠোর নন মি. মার্ডস্টোনের চেয়ে। তপ্ত কড়াই থেকে আমি জ্বলন্ত উনুনে পড়ে গেছি।
প্রথম যে ছেলেটি স্কুলে ফিরে এল তার নাম টমি ট্যাস। আমার পিঠের বিজ্ঞপ্তিটা পড়ে হেসে গড়িয়ে পড়ল সে।
এরপর আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো জেমস স্টিয়ারফোর্থের সাথে। উঁচু ক্লাসের ছাত্র। প্রায় ছফুট লম্বা। অত্যন্ত সুশ্রী এবং ভাল ছাত্র। সে আমাকে বলল যে ওখানকার রীতি হচ্ছে কোন নতুন ছাত্র এলে অন্যদেরকে গোপনে ভোজ দেয়া। সে আরও বলল, এক বোতল কার্যাণ্ট মদ, বিস্কুট, কিছু ফলমূল কিনে আমার ঘরে পাচার করবে।
রাজি হলাম, যদিও জানি যে এতে আমার মায়ের দেয়া শেষ আধ-ক্রাউনটিও খরচ হয়ে যাবে।
সেই রাতে আমার বিছানায় খাবারগুলো সাজিয়ে দিল স্টিয়ারফোর্থ। ঘরের অন্য ছেলেরা যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। কেউ বসল কাছাকাছি বিছানায়, কেউ কেউ গাদাগাদি করে ফ্লোরে। আমাদের সেই ঘন হয়ে বসা, ফিসফিস করে কথা বলা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। ছেলেরা সবাই স্কুলের গল্প, মাস্টারদের কাহিনি আমাকে শোনাল।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলল গল্পগুজব। স্কুলটা সম্পর্কে কত রকম কথাই না শুনলাম। শুনলাম, মি, ক্রীকল যে নিজেকে তাতার বলেছেন সেটা মিথ্যে বড়াই নয়। তিনি সত্যিই এক কঠোর নিষ্ঠুর দানব। প্রতিদিন বাচ্চাদেরকে বেধড়ক পিটান। ডানে-বাঁয়ে হাতের কাছে যাকে পান পিটুনি দেন নির্মমভাবে। বেত চালানো ছাড়া আর কিছুই তিনি জানেন না। স্কুলের একেবারে নিচের ক্লাসের ছেলেদের চেয়েও অজ্ঞ লোকটা। জিঞ্জার-বিয়ার বেচতেন ফেরী করে। ওটাতে ফেল মেরে স্কুলের ব্যবসা ফেঁদেছেন।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে স্কুলের একটি ছেলের গায়ে হাত তোলার সাহস তার হয় না। সেই ছেলেটি হলো জে. স্টিয়ারফোর্থ। সে নিজেই বলল যে কথাটা ঠিক। হাত তুলে দেখুক না! তুললে সে কি করবে—এ প্রশ্নের জবাবে স্টিয়ারফোর্থ বলল কপালে অ্যায়সা জোরে ঘুসি মারবে যে ব্যাটা চিৎপটাং হয়ে যাবে।
এসব শুনতে শুনতে অনেক রাত হয়ে গেল। আমরা শুতে চললাম।
গুড নাইট, কপারফিল্ড, বলল স্টিয়ারফোর্থ। আমি তোমার দেখাশোনা করব।
আপনার অনুগ্রহ, বললাম কৃতজ্ঞভাবে।
ওই রাত থেকে সুশ্রী, লম্বা, বলিষ্ঠ ছাত্র স্টিয়ারফোর্থ আমার রক্ষক হয়ে দাঁড়াল।
শুয়ে শুয়ে আমি অনেকক্ষণ ভাবলাম ওর কথা। শেষ পর্যন্ত উঠে বসে যাওয়া হলো। ওটা ছিল আমার দশম জন্মদিন। আশা করেছিলাম পেগোটি কিছু পাঠিয়েছে আমার জন্যে। দেখলাম হেড-মাস্টারের বৌ, মিসেস ক্রীক্লকল দাঁড়িয়ে আছেন একটা চিঠি হাতে। আমার দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে তিনি বললেন, আমি দুঃখিত, ডেভিড, তোমার মা আর ভাইটি মারা গেছে।
মিসেস ক্রীক্ল আমাকে সারা দিন রেখে দিলেন বসার ঘরে। আমি কাঁদলাম, ঘুমালাম। আবার কাঁদলাম, আবার ঘুমালাম। পরদিন বিদায় জানালাম ট্র্যাডলস আর স্টিয়ারফোর্থকে। তখনও আমি বুঝতে পারিনি যে সালেম হাউস থেকে ওটাই আমার শেষ বিদায়। আর কখনও যাব না সেই স্কুলে।
বাড়ি পৌঁছলাম। দরজা পর্যন্ত যাবার আগেই পেগোটি এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে। ওকে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ও অবসন্ন দেখাল। মায়ের শেষ দিনগুলোতে সে রাত-দিন বসে ছিল তার পাশে।
একটা কালো সুট পরানো হলো আমাকে মায়ের অন্ত্যেষ্টির জন্যে। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে একেবারে অসহায় ও একা মনে হলো। এতটা অসহায় আর নিঃসঙ্গ দশ বছরের জীবনে নিজেকে আর কখনও ভাবিনি।
মা চলে গেলেন। পরে মিস মার্ডস্টোনের প্রথম কাজটি হলো পেগোটিকে বরখাস্ত করা। আমার বা আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি কথাও বলা হলো না। আমার মনে হয়, এক মাসের নোটিসে আমাকেও বরখাস্ত করতে পারলে বোধহয় খুশি হত ওরা। শেষ পর্যন্ত বলা হলো যে আমি আর স্কুলে ফিরে যাচ্ছি না।
মি. ও মিস মার্ডস্টোন কোন মনোযোগই দিলেন না আমার প্রতি। কাছাকাছি কোথাও কাজ না পেয়ে পেগোটি ইয়ারমাউথে ভাইয়ের কাছে চলে যাবে স্থির। করল। সবচেয়ে বড় কথা, আমার ইচ্ছা হলো ওর সঙ্গে যেতে, ছোট্ট এমিলিকে আমার দুঃখের কথা জানাতে। যাবার কথা বলতেই মিস মার্ডস্টোন রাজি হয়ে। গেলেন। মনে হলো, আমাকে বাড়ি থেকে বের করার সুযোগ পাওয়া গেছে ভেবে খুশি হয়ে উঠলেন তিনি। কাজেই আমি চলে গেলাম পেপগাটির সঙ্গে।
ইয়ারমাউথ পর্যন্ত সারাটা পথ মি, বার্কিস মুখ টিপে হাসলেন পেগোটির দিকে চেয়ে।
সাগর-তীরের দিনগুলো কাটতে লাগল আগের মতই দ্রুত। আমি আমার স্কুলের কথা, ট্র্যাডলস আর স্টিয়ারফোর্থের কথা বললাম বন্ধুদেরকে। মা-র কথা কিছুই বলা হলো না। সবাই খুব সদয় ব্যবহার করল আমার সঙ্গে।
একদিন পেগোটি আর বার্কিস এমিলি আর আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে বলে গাড়িতে বসিয়ে চলল। গাড়ি গিয়ে থামল গির্জার সামনে। পেগোটি আর বার্কিন্স গেল ভেতরে। আমরা বসে রইলাম গাড়িতে। অনেকক্ষণ পরে বেরিয়ে এল ওরা। আমাদেরকে বলল যে ওদের বিয়ে হয়ে গেছে।
বার্কিসের ছিমছাম কটেজে থাকতে যাবার আগ মুহূর্তে পেগোটি আমাকে বলল, মাস্টার ডেভি, আজকের দিন থেকে আমার বাড়িতে তোমার জন্য একটা বিশেষ ঘর থাকবে। টেবিলের ওপর থাকবে তোমার কুমিরের বই-যাতে আগামীকাল, কিংবা বহু বছর পরে এলেও বইটা তুমি পড়তে পারো।
তাকালাম ওর দিকে। ও শুয়ে আছে উপুড় হয়ে। মাথাটা বাহুর ওপর পড়ে আছে। পরে জেনেছি ওর শোবার ওটাই প্রিয় ভঙ্গি।
পরদিন স্কুল শুরু হলো পুরোদমে। মি. ক্রীক্ল-এর প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে গোটা স্কুলে নেমে এল কবরের স্তব্ধতা। আমার কাছে এসে তিনি বললেন, ওহে ছোট্ট মিঞা, শুনলাম তুমি নাকি কামড়ানোর ওস্তাদ। আমারও খ্যাতি আছে পিটানোতে। কথাটার তিনি প্রমাণ দিলেন সেদিন আমাকে আর অন্য প্রায় সব ছেলেকে বেদম পিটিয়ে। আমার জামার পিঠে আটকানো বিজ্ঞপ্তিটা বেতের বাড়ি ঠেকিয়ে দিচ্ছিল। তাই ওটা তিনি খুলে ফেলে দিলেন।
বছরের ওই ছমাস বেচারা ট্র্যাডলস প্রতিদিন বেত খেল। অন্য ছেলেরাও খেল। কেবল একজন, জেমস স্টিয়ারফোর্থ ছাড়া।
একদিন স্টিয়ারফোর্থকে বললাম আমার বাবার লাইব্রেরিতে পড়া গল্পগুলোর কথা।
তোমার মনে আছে ওগুলো? জিজ্ঞেস করল সে।
সব মনে আছে, জবাব দিলাম। আমার স্মরণশক্তি ভাল।
তাহলে এক কাজ করা যাক, কপারফিল্ড। আমার ভাল ঘুম হয় না। তুমি। আমাকে গল্পগুলো শোনাও। একটা একটা করে তুমি বলে যাবে, আর আমি শুনব। এমনি করে রাতগুলোকে আমরা আরব্যরজনী বানিয়ে তুলব, বলল সে।
সেইদিন থেকেই শুরু করলাম আমরা। বিছানায় শুয়ে অন্ধকারে গল্প বলতে লাগলাম। বিভিন্ন চরিত্র অনুযায়ী গলার স্বর বদলে। এক ধরনের কোরাস হিসেবে যোগ দিল ট্র্যাডলস। আহা-উহু, কান্নাকাটি, দীর্ঘশ্বাস ইত্যাদি দিয়ে শব্দের আবহ সৃষ্টি করল সে।
এর প্রতিদানে স্টিয়ারফোর্থ আমাকে অঙ্কের ব্যাপারে সাহায্য করল এবং অন্য ছেলেদের জুলুম থেকে রক্ষা করল।
পড়াশোনার ব্যাপারে সালেম হাউসের তেমন সুনাম ছিল না। তবুও আমার কিছু উন্নতি হলো। কারণ, পড়ুয়া হিসেবে আমি ভাল ছিলাম এবং একটা প্রকৃত শিক্ষালাভের প্রথম সুযোগটা আমি উপভোগ করছিলাম।
ছুটির দিন এগিয়ে আসছে। সপ্তাহ গোনার বদলে দিন গোনা শুরু হয়েছে। আমার ভয় হচ্ছিল মি. মার্ডস্টোন আমাকে বাড়ি যেতে ডাকবেন না। কিন্তু একদিন স্টিয়ারফোর্থ একটা চিঠি নিয়ে এল। মায়ের চিঠি। মা আমাকে বাড়ি যেতে বলেছেন।
০৪. মা আমার মারা গেলেন
মা আমার মারা গেলেন
গাড়ি চালক মি. বার্কিস কোচ স্টেশনে আমাকে সম্ভাষণ জানালেন এমনভাবে, যেন আমাদের শেষ দেখার পরে পাঁচ মিনিটও যায়নি। পেগোটির কথা জিজ্ঞেস করলেন তিনি। বললাম, তার বার্কিস ইচ্ছুক বার্তাটি আমি পাঠিয়েছি।
বাগানের গেট-এ তিনি আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। প্রতি পদক্ষেপে ভয় হতে লাগল জানালায় চোখ পাকিয়ে দাঁড়ানো মি. ও মিস মার্ডস্টোনকে দেখব বলে। কিন্তু খুবই খুশি হলাম ওদেরকে ওখানে না দেখে। দরজার কাছে যেতে শুনলাম, মা গান গাইছেন বসার ঘরে। নিঃশব্দে ঢুকলাম। আগুনের ধারে বসে তিনি একটা বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন। আমার নবজাত ভাই! আনন্দে আত্মহারা হলাম!
মি. ও মিস মার্ডস্টোন কোথাও গেছেন। তাই মা, পেগোটি আর আমি আগুনের ধারে একত্রে বসে খেলাম। পেগোটিকে মি, বার্কিসের বার্তাটি আবারও দিলাম। সে অ্যাথনে মুখ ঢেকে হাসল।
পোকা ঢুকেছে লোকটার মাথায়! হাসতে হাসতে বলল পেগোটি। আমাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু আমি বিয়ে ওকে বা অন্য কাউকেই করব না।
কিন্তু, পেপগাটি ডিয়ার, বললেন মা নরম সুরে, তোমার একদিন বিয়ে করা উচিত। তবে এখন আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।
থুথুরে বুড়ি, কালা, খোড়া আর একদম অন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমি যাব না। তার পরে চলে যাব আমার ডেভির কাছে। বলব, আমাকে থাকতে দাও।
আর আমি তোমাকে রানীর মত অভ্যর্থনা জানাব, বললাম আমার প্রিয় নার্সকে।
খাওয়ার পরে আমরা বসলাম আগুনের কাছ ঘেঁষে। মা আমাকে আগের মতই বুকে জড়িয়ে রাখলেন। খুদে ভাইটি জেগে উঠল। আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম।
বসে বসে আমরা আমাদের পরিবার ও বন্ধুদের কথা বলাবলি করলাম। পেগোটি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল, আচ্ছা, ডেভির সেই দাদীটির কি হলো?
আন্ট বেটসিকে তাঁর সাগর-তীরের কটেজেই থাকতে দাও, বললেন মা। অবশ্য যদি না চাও যে তিনি আবার আসুন।
খোদা না করুন! বলে চেঁচিয়ে উঠল পেগোটি। তবে আমি ভাবি, ডেভির ছেলে হয়ে জন্মানোর অপরাধটা তিনি মাফ করেছেন কিনা।
আমার এক মাসের ছুটির মধ্যে একমাত্র ওই রাতটিই সুখের। কারণ পরদিনই মিস মার্ডস্টোন আমার পেগোটির সঙ্গে বসে খাওয়া এবং খুদে ভাইটিকে কোলে নেয়া বন্ধ করে দিলেন। মি. মার্ডস্টোন বললেন পেগোটির সঙ্গে না মিশতে।
বাড়িতে জীবন আমার অসহ্য হয়ে উঠল। এদিকে ছুটিও ফুরিয়ে গেল দেখতে দেখতে।
চলে যেতে আমার দুঃখ লাগেনি। তবে মা-কে যখন বাগানের গেট-এ ছেড়ে বিদায় নিলাম তখন বিষাদে ভরে গেল মনটা। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন আমার দিকে চেয়ে। মনে হলো তাকে জীবনের জন্য ছেড়ে যাচ্ছি।
দুই মাস পরে আমাকে ক্লাস থেকে ডেকে সালেম হাউসের বৈঠকখানায় নিয়ে সারা অন্তর দিয়ে আমি ধন্যবাদ জানালাম আমার পুরানো নার্সকে।
শেষ হলো বেড়ানোর দিন। আমাকে ফিরতে হলো বাড়িতে যদিও ওটাকে আমি আর নিজের বাড়ি বলি না। দিনের পর দিন, সপ্তার পর সপ্তা আমি উপেক্ষিত হলাম। আমার মা নেই, পেগোটি নেই। মনেপ্রাণে চাইলাম আমাকে স্কুলে ফিরে যেতে দেয়া হোক। কিন্তু তা হবার নয়। মি. মার্ডস্টোন বললেন খরচ জোগাতে তিনি পারবেন না।
শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে লণ্ডন পাঠাবেন-কাজ করতে! মি. মার্ডস্টোন ও তার এক বন্ধুর মালগুদামে যেতে হবে আমাকে। সেখানে সপ্তায়। সাত শিলিং, অর্থাৎ ১.৬৮ ডলার বেতন পাব আমি। ওই টাকায় আমার খাওয়াপরা সবই চালাতে হবে। গুদামঘরের কাছে একটা পরিবার থাকে। সেই পরিবারে। থাকার ঘর ভাড়াটা তিনি দেবেন।
এমনি করে, দশ বছর বয়সে আমি যাত্রা করলাম লণ্ডনে কাজ করার জন্যে।
০৫. জীবনের পথে একা
জীবনের পথে একা
মার্ডস্টোন অ্যাণ্ড গ্রিনবির মালগুদামটি নদীর কিনারে। একটা সরু গলির একেবারে শেষ প্রান্তে। গুদামের পরেই গলিটা খাড়া নিচে নেমে শেষ হয়েছে। নদী পর্যন্ত গিয়ে। গুদামঘরটা জরাজীর্ণ। ইঁদুরে ভরা। শত বছরের ময়লা আর আবর্জনায় ভরা। প্রথম দিন সকালে কয়েকটি ছেলের সঙ্গে দেখা হলো। ওদের সাথে কাজ করতে হবে আমাকে। আমরা মদের বোতল ধােয়ামোছা করলাম। ভাঙাগুলোকে বাতিল করলাম। লেবেল এটে দিলাম ভালগুলোর গায়ে। ছিপি। লাগালাম। পিপের মধ্যে বোতলগুলোকে সাজিয়ে রাখলাম।
সাড়ে বারোটায় মি. গ্রিনবি আমাকে হাতের ইশারায় ডেকে নিয়ে গেলেন তার অফিসে। গিয়ে দেখলাম মোটাসোটা মাঝবয়েসী একজন লোক বসে আছেন। সেখানে। লোকটার মাথা ডিমের মত মসৃণ। চুলের নাম-গন্ধ নেই!
ইনি হলেন মি. মিকবার, বললেন মি. গ্রিনবি।
লোকটা বললেন, হ্যাঁ, ওটাই আমার নাম। তুমি বোধহয় ডেভিড কপারফিল্ড-আমার বাড়িতে যার থাকার কথা। পোশাক-আশাক মলিন হলেও তার কথাবার্তায় বেশ দিল-দরিয়া ভাব। লোকটি আরও বললেন যে সন্ধ্যায় তিনি আসবেন আমাকে নিতে। মালগুদাম থেকে খুব কম সময়ে তার বাড়ি যাবার পথটি আমাকে দেখিয়ে দেবেন।
যথাসময়ে তিনি এলেন। হাতমুখ ধুয়ে গেলাম তার সঙ্গে। বাড়িটা তারই মত মলিন। নিচতলায় কোন আসবাব নেই। জানালাগুলো বন্ধ। উদ্দেশ্য, প্রতিবেশী ও পাওনাদারদের ধােকা দেয়া। তারা যাতে মনে করে যে বাড়িতে কেউ নেই। মিসেস মিকবার এবং তাঁদের চারটি ছোট্ট ছেলেমেয়ের সাথে তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
ওখানে থাকতে লাগলাম। মিকবার পরিবার খুব সদয় ব্যবহার করতে লাগল আমার সঙ্গে। কিন্তু তবু এটা তো সত্য যে এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। নেই কোন বন্ধু, বা মুরুব্বি। বিশাল ভীতিকর লণ্ডন শহরে আমি এক অপরিচিত ছোই বালক।
কাজ করি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। ক্লান্তি, হতাশা আর অবসাদে ভরে যায় মন। ভয় হয় স্কুলে যা কিছু শিখেছি সবই বুঝি ভুলে যাব। মদের বোতল ধােয়ার সময় পানির সাথে মিশে যায় আমার অশ্রু। চেষ্টা করি আমার কান্না যেন অন্য। ছেলেরা দেখতে না পায়।
মিকবাররা আমার প্রতি সদয়। সব সময় টাকা-পয়সার টানাটানি লেগে থাকলেও তারা আমাকে নিজেদের খাবারের ভাগ দিতে চান। শীতের রাতে তাদের সঙ্গে আগুনের পাশে বসতে ডাকেন। মিকবারদের দেনা অনেক। দিনের যে-কোন সময় পাওনাদাররা এসে হানা দেয়। কেউ কেউ রীতিমত চোটপাট করে। মিকবারদের একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় তাদের যে গুটিকয়েক আসবাবপত্র আছে সেগুলো বন্ধক রাখা। তাই কাজ থেকে ফিরে একটা ছোট টেবিল বা খানকয় চেয়ার, কিংবা একটি কম্বল নিয়ে যাই বন্ধকী দোকানে এবং নিয়ে আসি কয়েকটা শিলিং। কিন্তু অবস্থা যত খারাপই হোক, মি. মিকবার সব সময় বলেন, উপায় কিছু একটা হবেই।
অদ্ভুত লোক এই মিকবাররা। মিসেস মিকবার একদিন বললেন, ওর পাওনাদারগুলো ওকে সময় দেবে না। না দিলে না দিক। যা হবার তাই হবে। পাথর থেকে তো রক্ত বের করা যাবে না! মি. মিকবারের কাছ থেকেও এখন ওরা কিছু বের করতে পারবে না।
বেচারী মিসেস মিকবার! স্বামীকে সাহায্যের চেষ্টা তিনি করেছেন। বাড়িতে ছোট্টমণিদের জন্য মিসেস মিকবারের বোর্ডিং হাউস লিখে একটা সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন। কিন্তু ছোট্টমণিরা কেউ আসেনি।
এক একদিন অবস্থা চরমে উঠত। সকাল সাতটায় এক পাওনাদার এসে হাজির হত। হিংস্র চেহারা। মুখে ময়লা লেগে আছে। লোকটা মুচি। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার জুড়ে দিত, বেরিয়ে এসো। তুমি বাড়িতেই আছ। আমার পাওনা মিটিয়ে দাও। লুকিয়ে থেকো না। শুনছ? ছোটলোকের মত লুকিয়ে আছ। কেন? জোচ্চোর! ইতর! ডাকাত! এসময় মি. মিকবার দুঃখে অপমানে ভেঙে পড়তেন। আত্মহত্যার ভঙ্গি করতেন। এমন ভাব দেখাতেন যেন ক্ষুর দিয়ে। নিজের গলা কাটবেন। কিন্তু লোকটা বিদায় নেয়ার আধঘণ্টা পরেই দেখা যেত মি. মিকবার গুনগুন করে গান করতে করতে মনোযাগ দিয়ে নিজের জুতোয় রঙ লাগাচ্ছেন। মিসেস মিকবারকেও দেখা যেত বেশ হাসিখুশি। চায়ের চামচ বন্ধক রেখে আনা টাকায় খাসির মাংসের চপ আর মদ কিনে মনের সুখে গিলছেন।
অবশেষে মি. মিকবার গ্রেফতার হলেন। একদিন খুব ভোরে তাকে কিংসবেঞ্চ জেলে নিয়ে যাওয়া হলো। ঋণ শোধ করতে না পারা পর্যন্ত সেখানে বন্দী থাকবেন। তার পরিবারকে সঙ্গে থাকার অনুমতি দেয়া হলো।
আমি একটা দশ বছরের ছেলে। পেট ভরে খেতে পাই না। গায়ে ভাল জামাকাপড় নেই। এ অবস্থায় কেমন করে লণ্ডনে থাকব—এসব ভেবে ভয় পেলেন মিসেস মিকবার। তাই তিনি আমার জন্যে জেলের কাছেই সস্তায় একটা ঘর খুঁজে দিলেন। এতে কাজ থেকে ফিরে এসে তাদের সঙ্গে আমার দেখা করার সুবিধে হলো।
মি. মিকবার কিছু একটা উপায়ের অপেক্ষায় বসেছিলেন। অবশেষে সেই উপায়টা হলো। তার এক ধনী আত্মীয় মারা গেছেন অস্ট্রেলিয়ায়। কিছু টাকা রেখে গেছেন মি. মিকবারের জন্য। তিনি স্থির করলেন ধার-দেনা শোধ করে সপরিবারে চলে যাবেন অস্ট্রেলিয়ায়।
তারা না থাকলে লণ্ডনে থাকার ইচ্ছা আমার হলো না। হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল মা আর পেগোটির মুখে শোনা আমার খামখেয়ালী দাদীটির কথা। আমি মেয়ে না হয়ে ছেলে হয়ে জন্মেছি বলে রাগ করে যিনি ডাক্তারের মাথায় বনেট ছুঁড়ে মেরেছিলেন। সিদ্ধান্ত নিলাম, দুনিয়াতে তিনিই আমার একমাত্র প্রকৃত আত্মীয়। কাজেই তাকে খুঁজে বের করব। তার কাছে আশ্রয় চাইব। কিন্তু তিনি কোথায় থাকেন জানি না। তাই মিস বেটসি কোথায় থাকেন জানতে চেয়ে চিঠি লিখলাম পপগোটিকে।
সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল পেগোটির। সে জানাল মিস বেটসি থাকেন ডোভারে। চিঠির সাথে পেলাম তার পাঠানো একটা আধ-গিনি।
ভাবলাম আধ-গিনিতে একটা একা গাড়ি ভাড়া করে আমার ছোট্ট জামাকাপড়ের বাক্সটি সহ চলে যাব ডোভারে। কিন্তু যে লোকটার গাড়ি ভাড়া করলাম সে আমার আধ-গিনি আর বাক্সটা সহ গাড়ি নিয়ে ছুটে চলে গেল।
আমি যত জোরে সম্ভব ছুটলাম তার পেছনে। কিন্তু ধরতে পারলাম না। কাদার মধ্যে পড়ে গেলাম হাঁপাতে হাঁপাতে, কাদতে কাদতে। হপ্তার মজুরি পাঁচ শিলিং ছাড়া আর কিছুই রইল না আমার কাছে। এই পয়সায় ডোভারের ভাড়া হবে না। অগত্যা পায়ে হেঁটেই চললাম। রাতগুলো কাটাতে লাগলাম কারও খড়ের গাদায়, কিংবা মাঠে।
ছয় দিনের শেষে পকেট একদম খালি হয়ে গেল। আমি তখন ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, পথের শ্রমে ক্লান্ত। আমার জুতোগুলো আর জুতোর মত নেই। লণ্ডন ছাড়ার পরে চুলে আর চিরুনির আঁচড় পড়েনি। যে সামান্য কাপড়-চোপড় ছিল গায়ে সেগুলো শতচ্ছিন্ন। ভাল কাপড় যা ছিল সব বন্ধক দিয়ে ফেলেছি।
অবসন্ন অবস্থায় পৌঁছলাম ডোভারে। এক গাড়োয়ান মিস বেটসির বাড়িটা দেখিয়ে দিল আমাকে। ছোট্ট পাহাড়-চূড়ায় সুন্দর ছিমছাম কটেজ।
আমার পোশাক আর চেহারা খুবই বিশ্রী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় দরজায় ঘা দিতেও ভয় হলো। তাই দাঁড়িয়ে রইলাম গেট-এর সামনে। কিছুক্ষণ পরে একজন লম্বা, ছিপছিপে, পাকাচুলো মহিলা বেরিয়ে এলেন দরজা খুলে। হাতে বাগানে কাজ করার দস্তানা আর খুরপি।
আমার ওপর নজর পড়তেই বললেন, ভাগো হিয়াসে! ছেলেদের এখানে ঢুকতে দেয়া হয় না। এরপর সোজা তিনি নেমে গেলেন বাগানে। নিচু হয়ে একটা শেকড় খুঁড়ে তুলতে লাগলেন।
দাদী বেটসি, শুনুন দয়া করে, বললাম আমি তার কাছে এগিয়ে গিয়ে। ভয়ে। কাঁপতে কাঁপতে। আমি আপনার নাতি, ডেভিড কপারফিল্ড।
ও গড! বলে তিনি ধপাস করে বসে পড়লেন বাগানের রাস্তার ওপর।
মা মারা যাবার আগে আপনার কথা বলতেন, বুঝিয়ে বললাম আমি। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে আমাকে চরম অবহেলা করা হয়েছে। অন্যায় দুর্ব্যবহার করা হয়েছে আমার প্রতি। তাই পালিয়ে এসেছি আপনার কাছে। দিনের পর দিন হেঁটেছি। শোবার জন্যে বিছানা পাইনি… এ পর্যন্ত বলার পর আর কথা বেরুলো না আমার মুখ দিয়ে। একটি সপ্তাহের অসহায়তা, দুঃখ কষ্ট উন্মত্ত কান্না হয়ে ঝরে পড়ল আমার কণ্ঠ থেকে।
অত্যন্ত দ্রুতবেগে উঠে দাঁড়ালেন মিস বেটসি। আমাকে নিয়ে গেলেন ঘরের মধ্যে। সোফায় শুইয়ে একটা শাল গুঁজে দিলেন মাথার নিচে। গ্লাসে ভরে কি একটা এনে খাইয়ে দিলেন। তারপর হাঁক দিলেন, মি. ডিক, একটু আসুন এদিকে। আমি আপনার পরামর্শ চাই।
সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এলেন এক সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক। মুখে বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত ধরনের উদাসী উজ্জ্বলতা। হাবভাব তার ছেলেমানুষী।
মি. ডিক, আমার কিছু ভাল পরামর্শ দরকার, বললেন মিস বেটসি। এই বাচ্চাটা হলো ডেভিড কপারফিল্ড। আমার মৃত ভাইপোর ছেলে। সে পালিয়ে এসেছে। আমি একে নিয়ে কি করব?
কেন, আমি হলে একে…গোসল করাব, বললেন মি. ডিক চটপট, তারপরে খাওয়াব।
গোসল করলাম। তারা আমাকে মি. ডিকের একটা শার্ট আর ট্রাউজার পরিয়ে গায়ে দুতিনটা শাল জড়িয়ে দিলেন। আমাকে কেমন পোটলার মত দেখাচ্ছিল জানি না, তবে খুব গরম লাগল। সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙল ঘণ্টাকয়েক পরে। দাদীকে বললাম মি. মার্ডস্টোনের সঙ্গে মায়ের দুর্ভাগ্যজনক বিয়ে এবং আমার সঙ্গে তার দুর্ব্যবহারের কাহিনি।
ব্যাটা আস্ত খুনী! বললেন দাদী।
পরদিন দাদী আমাকে বললেন যে তিনি মি. মার্ডস্টোনকে, তাঁর ভাষায় মি, মার্ডারকে চিঠি লিখেছেন।
আতঙ্কিত হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, উনি কি জানেন আমি কোথায় আছি?
আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছি, জবাব দিলেন তিনি।
আমাকে কি ফিরে যেতে হবে তার কাছে?
জানি না। সেটা দেখা যাবে পরে, বললেন তিনি।
আমার নাস্তা খাওয়ার পরে মিস বেটসি বললেন, তুমি ওপর তলায় গিয়ে মি. ডিককে গুড মর্নিং বলে এসো। তার একটা লম্বা নাম আছে-রিচার্ড ব্যাবলি। কিন্তু ওই নামে তাকে ডেকো না। তিনি ওই নামটা সহ্য করতে পারেন না। কাজেই খুব সাবধান। তাকে মি. ডিক ছাড়া আর কিছু ডেকো না।
গেলাম দোতলায়। দেখলাম তিনি তার বই-কোন এক লর্ডের স্মৃতিকথারচনায় ব্যস্ত। বইটা তিনি লিখছেন দশ বছর ধরে। কিন্তু কয়েক পৃষ্ঠা পরে পরেই। রাজা চার্লস-এর হত্যাকাণ্ড বর্ণনা না করে বেশিদূর এগোতে পারেন না। দাদী আমাকে পরে বুঝিয়ে দেন যে এটা তার নির্দোষ অসুখের একটি লক্ষণ।
কলমটা রেখে দিয়ে তিনি বলে উঠলেন, হ্যা! চলছে কেমন দুনিয়াটা? আরে বোকা, এটা হচ্ছে পাগলা দুনিয়া! হেসে উঠলেন তিনি। হাসিটা একটু অদ্ভুত। এর পর তিনি আমাকে তার ঘুড়ি দেখালেন। মস্ত ঘুড়ি। অন্তত সাত ফুট উঁচু!
কেমন মনে হয় ঘুড়িটা? জিজ্ঞেস করলেন গর্বিত ভাবে।
জবাব দিলাম, সুন্দর ঘুড়ি।
আমি বানিয়েছি, বললেন মি. ডিক। আমরা, তুমি আর আমি, এটা ওড়াব।
কিন্তু আমার বাইরে যাবার মত কাপড় ছিল না। তাই সেদিন আমাদের ঘুড়ি ওড়ানো হলো না।
নিচে নেমে আসার পরে দাদীকে জিজ্ঞেস করলাম, মি. ডিকের মাথায়…কি কোন গোলমাল আছে?
গোলমাল ঠিক নয়! বললেন মিস বেটসি। মি. ডিক আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তাঁর পরিবার তাকে পাগল বলে। তার ভাই চেয়েছিল তাঁকে আজীবন পাগলা গারদে বন্দী করে রাখতে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম তিনি সুস্থ। দশ বছর আগে তাকে নিয়ে আসি আমার কাছে। সেই থেকে তিনি আমার। সেরা বন্ধু এবং বুদ্ধিদাতা।
পরের কয়েকটা দিন দাদী আর মি. ডিক খুব সদয় ব্যবহার করলেন আমার সঙ্গে। অনেকটা সময় আমরা একত্রে কাটালাম পরম সুখে। অতীতকে প্রায় ভুলে। গেলাম। তারপর মনে পড়ল যে দাদী মি. ও মিস মার্ডস্টোনকে তার সঙ্গে দেখা। করতে আসার জন্যে বলেছেন। আবার আতঙ্ক গ্রাস করল আমাকে।
অপেক্ষা করতে লাগলাম মি. ও মিস মার্ডস্টোনের ভয়ঙ্কর মুখ আবার দেখার।
একদিন দুপুরে দাদী বসে ছিলেন জানালার পাশে। দাদী অত্যন্ত রাশভারী ও কঠোর স্বভাবের মানুষ। হঠাৎ তিনি গাধা! গাধা! বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। চমকে। উঠে দেখলাম একটা গাধা ঢুকে পড়েছে বাগানে। বাড়ির সামনেকার ছোট্ট ঘাসেছাওয়া জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে। পরিচারিকা জানেট ধরার চেষ্টা করছে গাধাটাকে। এমন সময় মার্ডস্টোনরা ঘোড়া হাঁকিয়ে এসে ওই জায়গাটা মাড়িয়ে নামলেন বাড়ির সামনে।
ঘাসে-ছাওয়া ওই জায়গাটা দাদীর বড় প্রিয়। তিনি রেগে গেলেন। মুঠো ধরা হাত জানালার দিকে ছুঁড়ে তিনি বললেন, ভাগো হিয়াসে! কেন এসেছ এখানে? কোন সাহসে এসেছ বিনা হুকুমে?
আমি তাকে জানালাম কারা এসেছেন।
ওরা যে-ই হোক, পরোয়া করি না। অনধিকার প্রবেশ সহ্য করব না।
জানেট এসে জানাল যে মার্ডস্টোনরা এসেছেন।
কাঁপতে কাঁপতে বললাম, আমি চলে যাব, দাদী?
না, স্যার। নিশ্চয়ই না, বলে আমাকে তিনি ঠেলে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন তার কাছে, ঘরের কোনায়। ওখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম মি. ও মিস মার্ডস্টোন ঘরে প্রবেশ করলেন।
ওহো, আপনারা? কার বিরুদ্ধে আপত্তি করছি তা প্রথমে খেয়াল করিনি। তবে ওই ঘাসটা মাড়াতে আমি কাউকে দিই না। সে যে-ই হোক, বললেন দাদী।
অপরিচিতদের জন্য নিয়মটা একটু অসুবিধাজনক, বললেন মিস মার্ডস্টোন।
তাই নাকি?
আবার ঝগড়া বেধে যাবে মনে করে মি. মার্ডস্টোন তাড়াতাড়ি বললেন, মিস ট্রটউড!
মাফ করুন, বললেন দাদী। আপনিই সেই মি. মার্ডস্টোন যিনি আমার ভাইপো ডেভিডের বিধবা বৌটাকে বিয়ে করেছিলেন?
হ্যাঁ, আমি, বললেন মি. মার্ডস্টোন।
মাফ করবেন, কথাটা বলতেই হচ্ছে, মন্তব্য করলেন দাদী। বেচারি মেয়েটিকে আপনি বিয়ে না করলেই অনেক ভাল হত। জানেট, মি. ডিককে আমার সালাম জানিয়ে বললা যে তিনি একটু নিচে এলে আমি খুশি হব।
মি. ডিক এলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন দাদী, মি. ডিক একজন পুরানো ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার বিচার বুদ্ধির ওপর আমি নির্ভর করি।
মিস ট্রটউড, আপনার চিঠি পেয়ে লিখিত জবাব না দিয়ে নিজেই এলাম। এই ছেলেটা তার বন্ধুদের কাছ থেকে এবং কাজ ছেড়ে পালিয়ে এসেছে।
ওর আচরণ অত্যন্ত কেলেঙ্কারিজনক, যোগ করলেন মিস মার্ডস্টোন।
ছেলেটি আমাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। ভীষণ একগুঁয়ে এবং বদমেজাজী।
হ্যাঁ, সায় দিয়ে বললেন মিস মার্ডস্টোন। দুনিয়ার সেরা পাজি ছেলে এটা।
হুম, তারপর? বললেন দাদী।
মিস্টার মার্ডস্টোন বললেন, আমি এসেছি ওকে নিয়ে যেতে। ওকে কিভাবে মানুষ করতে হবে সে বিষয়ে আমার নিজস্ব মতামত আছে। আমার সঙ্গতি কতটা তা-ও ভেবে দেখতে হবে। আমি ছেলেটাকে আমার এক বন্ধুর হেফাজতে একটা সম্মানজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়েছিলাম। সেটা ওর পছন্দ হয়নি। ও পালিয়ে যায়। ভবঘুরের মত ঘেঁড়া ন্যাকড়া পরে দুনিয়া ঘুরে আপনার কাছে এসে ধর্না দেয়। আপনি যদি প্রশ্রয় দেন তবে পরিণামের জন্য আমি দায়ী হব না।
আপনার আর কিছু বলার আছে? প্রশ্ন করলেন দাদী।
শুধু এটুকু, মিস ট্রটউড! ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। যেভাবে যা ঠিক মনে করব সেভাবে গড়ে তুলব। এখন আপনি যদি ওকে প্রশ্রয় দেন, তাহলে আমার দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।
রাবিশ! গর্জে উঠলেন মিস বেটসি। আপনাদের একটা কথাও আমার বিশ্বাস হয়নি। আপনারা দুজন খুনী ছাড়া আর কিছুই নন। মিষ্টি কথা বলে ভুলিয়ে ভালিয়ে বোেকা বিধবা মেয়েটাকে বিয়ে করেছেন। তারপর মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে, নিষ্ঠুরতা দিয়ে বেচারীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। দশ বছরের একটা ছেলেকে জীবিকার জন্যে কাজ করতে পাঠিয়েছেন এক জঘন্য গুদামে। আর নিজেরা আরামে বাস করছেন ওদের বাড়িতে। মা-র মৃত্যুর পর বাড়িটার আসল। মালিক ডেভিড। ওটা ওর বাবার কেনা। এই অপরাধে শাস্তি হওয়া উচিত আপনাদের। তবে এ ব্যাপারে যা করার ডেভিডই করবে। আমি হস্তক্ষেপ করব না।
এবার আমার দিকে ফিরলেন দাদী। জিজ্ঞেস করলেন, ডেভিড, তুমি ফিরে যেতে চাও এদের সঙ্গে?
দাদী, আমাকে ফিরে যেতে বলবেন না, বললাম আমি। ওরা কেউ আমাকে পছন্দ করেনি। দয়া-মায়া দেখায়নি কোনদিন। ওরা আমার মা-কে সুখ দেয়নি। পেগোটিকে শান্তি দেয়নি। আমাকে চরম হেনস্তা করেছে। ওদের সঙ্গে যেতে বাধ্য করবেন না আমাকে।
চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল মি, মার্ডস্টোনের। ক্রদ্ধভাবে আমার দাদীর দিকে আঙুল তুলে বললেন, এখানে আমি এসেছি এই প্রথম ও শেষ বারের মত। হয় ডেভিডকে নিয়ে যাব, যেমন ভাল মনে করি সেরকম ব্যবহার করব, নতুবা তাকে রেখে যাব আপনার কাছে। আপনার সঙ্গে থেকে গেলে তার ব্যাপারে আমার আর কিছুই করার থাকবে না।
মি. ডিক, বললেন আমার দাদী, আমরা এই বাচ্চাটিকে নিয়ে কি করব?
মি. ডিক ভাবলেন। একটু দ্বিধা করলেন। তারপরে হেসে বললেন, নতুন সুট বানানোর জন্য ওর মাপ নেয়ার ব্যবস্থা করব।
ধন্যবাদ, মি. ডিক, বললেন দাদী। তারপর মি. ও মিস মার্ডস্টোনের দিকে ফিরে বললেন, শুভ দিন, স্যার। শুভ দিন, ম্যাডাম। আপনাদেরকে যদি আবার কখনও দেখি আমার দরজায়, ঘুসি মেরে আপনার বনেট ফেলে দিয়ে পায়ে মাড়িয়ে দেব!
ওরা চলে যেতেই আমি ছুটে গিয়ে দাদী বেটসির গলা জড়িয়ে ধরে তাকে চুমু দিলাম। তারপর মি. ডিকের সাথে হ্যাণ্ডশেক করে তাকে ধন্যবাদ দিলাম।
এইভাবে শুরু হলো আমার নতুন জীবন। নামও নতুন হলো। দাদী আমাকে ট্রটউড কপারফিল্ড নামে ডাকতে লাগলেন।
দুজন নতুন অভিভাবক হলো আমার। দুজনেরই মন খাঁটি সোনার!
০৬. নতুন জীবন
নতুন জীবন
মিস বেটসি অপেক্ষা করলেন কয়েক সপ্তাহ আমার শরীর-মন সবই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার জন্যে। তারপর এক সন্ধ্যায় মি. ডিকের সাথে পাশা খেলতে খেলতে আমার দিকে ফিরে বললেন, ট্রট, তোমার শিক্ষার কথা ভুললে আমাদের চলবে না। তুমি ক্যান্টারবেরিতে যাবে? স্কুলে পড়তে?
আমার খুবই ইচ্ছে যাওয়ার। জায়গাটা এখান থেকে বেশ কাছেই, জবাব দিলাম।
পরদিন সকালে ঘোড়ার গাড়িতে আমরা যাত্রা করলাম ক্যান্টারবেরির উদ্দেশে। পথে দাদী বললেন যে তিনি আমাকে তার উকিলের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। তার উকিল মি. উইকফিল্ড বলতে পারবেন কোন স্কুল সবচেয়ে ভাল হবে আমার জন্যে।
মিস বেটসি একটা অত্যন্ত পুরানো বাড়ির সামনে গাড়ি থামালেন। বাড়িটা মনে হলো ঝুঁকে আছে রাস্তার দিকে। একটা বছর পনেরো বয়সী লালচুলো ছেলে দরজা খুলে দিল। ওর মুখটা মুর্দার মুখের মত ফ্যাকাসে। হাড্ডিসার দেহটা কালো পোশাকে ঢাকা। কপালে বলতে কিছুই নেই। চোখের পাতায় নোমও নেই।
উরিয়া হীপ, মি. উইকফিল্ড আছেন? জিজ্ঞেস করলেন দাদী।
আমাদেরকে ভেতরে যেতে ইঙ্গিত করে সে বলল, আছেন, ম্যাডাম।
মি. উইকফিল্ড একজন সুশ্রী বুড়ো ভদ্রলোক। অফিসের দরজায় দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন আমাদেরকে। তার মুখের লালচে রঙ আর মোটা কোমর দেখে। আমার মনে পড়ল, পেগোটি বলত যারা বেশি মদ খায় তাদের ওরকম হয়। ভাবলাম, মি. উইকফিল্ডও কি বেশি মদ খান?
বলুন, মিস ট্রটউড, কি মনে করে এলেন এদিকে? জিজ্ঞেস করলেন মি. উইকফিল্ড হাসিমুখে।
এটা হচ্ছে আমার নাতি, ডেভিড কপারফিল্ড, বললেন মিস বেটসি। আমি ওকে একটা ভাল স্কুলে দিতে চাই, যেখানে ওকে ভাল শিক্ষা দেয়া হবে এবং ওর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করা হবে। স্কুল বাছাইয়ের ব্যাপারে আপনার পরামর্শ চাই।
মি. উইকফিল্ড ডক্টর স্ট্রং-এর স্কুলে ভর্তি করতে বললেন। ওটা বোর্ডিং স্কুল নয়। তিনি আমাকে সপ্তাহের ছয় দিন তার বাড়িতে থাকার প্রস্তাব দিলেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনটা আমার ইচ্ছা অনুযায়ী দাদীর কাছে থাকতে পারব।
এর পরে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো মি. উইকফিন্ডের মেয়ে অ্যাগনেস-এর সঙ্গে। আমার বয়সী হাসিখুশি উজ্জ্বল চেহারার মেয়ে। বাপকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে।
আমি যে ঘরটিতে থাকব তা আমাকে দেখিয়ে দিল অ্যাগনেস। ঘরটা অ্যাগনেসের মতই উজ্জ্বল এবং সুন্দর। দাদী বিদায় নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বাক্স-বিছানা খুলে সেখানে বসবাস শুরু করতে ব্যস্ত হলাম।
রাতে শোবার আগে উরিয়া হীপের সঙ্গে দেখা হলো। সে অফিস বন্ধ করছিল। আমি বন্ধুভাবে হাত বাড়িয়ে দিলাম। কি ঠাণ্ডা চটচটে ওর হাত! ও চলে যাবার পর হাতটা ঘষতে লাগলাম-চেষ্টা করলাম হাতে লাগা ঠাণ্ডাটা, আর ওর চটচটে স্পর্শটা ঘষে তুলে ফেলতে। ওর ভেতর এমন একটা কিছু রয়েছে যা আমার মনে ভয় ধরিয়ে দিল।
পরদিন সকালে আবার প্রবেশ করলাম স্কুল জীবনে। মি. উইকফিল্ড আমাকে নিয়ে গেলেন স্কুলে। পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার নতুন মাস্টার ডক্টর স্ট্রং এবং একজন সুন্দরী তরুণী মহিলার সঙ্গে। মহিলাটিকে ডক্টর স্ট্রং অ্যানি বলে ডাকেন। আমি ভাবলাম তরুণীটি তার মেয়ে। কিন্তু মি, উইকফিল্ড মহিলাটিকে মিসেস স্ট্রং বলায় খুবই বিস্মিত হলাম। কারণ, ডক্টর স্ট্রং-এর বয়স ষাটের কোঠায়।
ডক্টর স্ট্রং তাঁর অবসর সময়ে একটি নতুন অভিধান রচনার কাজে ব্যস্ত থাকেন। আমার এক ক্লাসমেট অঙ্কে খুব ভাল। সে বলল, ডক্টর যে গতিতে অভিধান রচনার কাজ করছেন তাতে ওর হিসেব মতে কাজটা শেষ করতে তার এক হাজার ছয়শো উনপঞ্চাশ বছর লেগে যাবে! স্কুলটি চমৎকার। মি. ক্রীক্লকলএর স্কুলের তুলনায় স্বর্গ। শিক্ষক হিসেবে ড. স্ট্রং দারুণ ভাল। সব ছেলের প্রতি সদয়। ছেলেরাও তাকে ভালবাসে, সম্মান করে এবং মন দিয়ে লেখাপড়া করে।
আমার এ-সময়কার একমাত্র অস্বস্তির কারণ ছিল উরিয়া হীপের নিত্য উপস্থিতি!
০৭. পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে
পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে
শৈশব থেকে আমি যাত্রা করলাম যৌবনের পথে। মন আমার আনন্দে ভরপুর।
আমার বয়স এখন সতেরো। আমি স্কুলের হেড-বয়। উক্টর স্ট্রং আমাকে প্রতিশ্রুতিবান তরুণ পণ্ডিত বলে উল্লেখ করেন। অ্যাগনেস উইকফিল্ডও এখন আর ছোট্ট মেয়েটি নয়! সে এখন আমার পরামর্শদাতা ও বন্ধু। স্কুলের কথা, আমার স্বপ্নের কথা, কি কি আমার ভাল লাগে, কার কার সাথে আমার লড়াই সব আমি ওকে বলেছি।
স্কুল জীবন ফুরিয়ে গেল। এসময় আমার ভবিষ্যৎ জীবন, পেশা ইত্যাদি নিয়ে দাদীর সঙ্গে অনেকবার আলোচনা হলো। কোন বিশেষ পেশার দিকে আমার টান ছিল না। তাই দাদী বললেন মাসখানেক কোথাও বেড়িয়ে আসতে। এতে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তে আসার সুবিধে হবে। তিনি বললেন ইয়ারমাউথে গিয়ে পেগোটিকে দেখে আসতে। ফেরার পথে লণ্ডনে কয়েকদিন থাকতে।
আমি প্রথমে গেলাম ক্যান্টারবেরিতে। অ্যাগনেস ও মি. উইকফিল্ডের কাছে বিদায় নেয়ার জন্যে। লক্ষ করলাম যে আমি যে কদিন ছিলাম না এর মধ্যে বুড়োর কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। তার হাত কাঁপে, গলার আওয়াজ কাঁপে। চোখে এক ধরনের খ্যাপাটে দৃষ্টি। অ্যাগনেস উদ্বিগ্ন। বাপের এই পরিবর্তন নিয়ে প্রায় আতঙ্কিত।
বিষণ্ণ হৃদয়ে বইপত্র কাপড়-চোপড় গুছিয়ে বাঁধাছাদা করলাম ডোভারে দাদীর বাড়িতে পাঠাবার জন্যে। উরিয়া হীপ খুব উৎসাহ দেখাল এ কাজে আমাকে সাহায্য করতে। মনে হলো আমি চলে যাচ্ছি দেখে সে আসলে খুশি হয়েছে।
লণ্ডনের কোচে চাপলাম। আমি একজন সুশিক্ষিত যুবক। গায়ের পোশাকআশাকও ভাল। পকেটে প্রচুর পয়সা। বছর কয়েক আগে ছেড়া পোশাকে ক্লান্ত অবসন্ন দেহে যে ছেলেটি এই একই পথে পায়ে হেঁটে ডোভারে এসেছিল তার সাথে আজকের এই আমার কি বিরাট পার্থক্য! সালেম হাউসের সামনে দিয়ে যাবার সময় গোপন ইচ্ছা জাগল ভেতরে গিয়ে মি. ক্রিক্লকে আচ্ছা করে দিয়ে তার হাতে যে পিটুনি খেয়েছি সেটার প্রতিশোধ নিতে।
চ্যারিংক্রশ-এ কোচ থামল রাতের জন্যে। ডিনারের পরে কফি-রূমে বসে আছি। এমন সময় এক সুশ্রী সুবেশধারী তরুণের দিকে নজর গেল। সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলাম তাকে। ডাক দিলাম, স্টিয়ারফোর্থ! আমার সঙ্গে কথা বলবে না?
মাই গড! বলে চেঁচিয়ে উঠল সে। আরে, এ যে দেখছি ছোট্ট কপারফিল্ড!
পুরানো স্কুলের বন্ধুকে দেখে ভীষণ খুশি হলাম। আমি একজন তরুণ ভদ্রলোক। না হলে তার গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলতাম। চোখে পানি বেরিয়ে। পড়েছিল, ওটা মুছে ফেললাম। বসলাম দুজনে মুখোমুখি। বললাম সালেম হাউস ছাড়ার পরে আমার জীবনে যা যা ঘটেছে সব। সে-ও বলল তার কাহিনি। সে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্র। এখন চলেছে মায়ের কাছে।
আমি যাচ্ছি ইয়ারমাউথে পেগোটিদের কাছে, বললাম ওকে। তার পরে নিজের ভবিষ্যৎ কাজকর্ম সম্পর্কে পরিকল্পনা করব। আমার সাথে চলো না। ইয়ারমাউথে? দারুণ মজা হবে।
চমৎকার প্রস্তাব! বলল স্টিয়ারফোর্থ। তবে তোমার যদি তাড়া না থাকে, আগে চলো না হাইগেটে আমার বাড়িতে দুএক দিনের জন্যে?
যেতে পারলে খুশিই হব, জবাব দিলাম।
পৌঁছলাম হাইগেটে। একজন বয়স্কা মহিলার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। মহিলার সুন্দর মুখে গর্বিত ভাব। তিনি স্টিয়ারফোর্থের মা। তার সঙ্গে একজন সহচরী, মিস রোসা ডার্টল। পাতলা, কালো চুলঅলা তরুণী। ঠোঁটে একটা কাটা দাগ। আমি আশ্চর্য হলাম যখন স্টিয়ারফোর্থ বলল যে ওই কাটা দাগটার জন্যে সে-ই দায়ী।
ছোট থাকতে সে একদিন আমাকে খ্যাপায়। আমি একটা হাতুড়ি ছুঁড়ে মারি। দুষ্ট্র একখানা ছিলাম বটে! কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমাকে ভালবাসে ও, বলে হাসতে হাসতে মদের গ্লাসটি তুলে ধরল স্টিয়ারফোর্থ। এসো, কপারফিল্ড, অতীতের কথা এখন থাক। এস, আমরা আমাদের যৌথ সফরের উদ্দেশ্যে পান করি।
স্টিয়ারফোর্ধের চাকর লিটিমার একজন ভদ্র-চেহারার লোক। স্টিয়ারফোর্ধের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো থেকেই কাজ করে আসছে। আমার। ওখানে থাকাকালে আমাদের দুজনের ফুট-ফরমাশ পালন করেছে সে। স্টিয়ারফোর্থ আমাকে ঘোড়ায় চড়তে শেখাবে-লিটিমার ঘোড় নিয়ে এল। তরবারি এনে দিল তরবারি চালনা শেখাবার জন্যে। গ্লাক্স এনে দিল স্টিয়ারফোর্থ আমাকে বক্সিং শেখাবে বলে।
ইয়ারমাউথ শহরে পৌঁছে আমরা রাতটা কাটালাম এক হোটেলে। পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙার আগেই স্টিয়ারফোর্থ চলে গেল সাগর-তীরে। দেখা করে ভাব জমিয়ে ফেলল শহরের সব নৌকাঅলাদের সঙ্গে, জেলেদের সঙ্গে।
আমি সবে নাস্তা খেতে বসছি-এমন সময় ছুটতে ছুটতে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল, আমি মি. পেপগাটির জাহাজ-বাড়ি দেখেছি! তুমি যেমন বলেছিলে ঠিক ওই রকম। লোভ হচ্ছিল ভেতরে গিয়ে বলি যে আমি ডেডিভ কপারফিল্ড। এখন বড় হয়ে গেছি বলে চেনা যাচ্ছে না। তারপরে ঠিক করলাম, আগে তোমাকেই যেতে দেয়া উচিত। পুরানো নার্সের সাথে প্রথমে দেখা করা দরকার তোমার। কাজেই যাও এখন পেগোটির বাড়ি। আমি পরে ওখানে তোমার সঙ্গে একত্র হব। তারপর দুজনে মিলে যাব মি, পেগোটির জাহাজ-বাড়িতে।
সাত বছর পেগোটি আমাকে দেখেনি। তবে চিঠিপত্র আমি বরাবরই লিখে এসেছি। তাই যখন ঘা দিলাম তার দরজায়, সে দরজা খুলে দিয়ে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি চান, স্যার?
গলার স্বর যথাসম্ভব পুরুষালি করে জবাব দিলাম, ব্লাণ্ডারস্টোনের এক বাড়ি-কপারফিল্ডদের বাড়ি সম্পর্কে কিছু খবর জানতে চাই। আমাকে চিনতে পারছ না, পেগোটি?
এক পা পিছিয়ে গিয়ে দুহাতে মুখ চেপে কেঁদে উঠল পেগোটি, আমার আদরের খোকা!
আমার পেগোটি! বলে উঠলাম আমি। দুজনে দুজনের বাহু জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম আমরা।
মি. বার্কিস বাতের ব্যথায় কাতর হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পেগোটির মতই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তিনি স্বাগত জানালেন আমাকে। কয়েক ঘণ্টা ধরে আমরা অতীতের দিনের কথা—সেই বার্কিস ইচ্ছুক বার্তা পাঠানোর সময়কার কথা বলাবলি করলাম।
কিছুক্ষণ পরে স্টিয়ারফোর্থ এসে যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। তার সহজ, প্রাণখোলা হাসি, রসিকতা, শিষ্ট ব্যবহার ও সুন্দর মুখশ্রী মিনিট কয়েকের মধ্যেই পোেটির হৃদয় জয় করল।
আটটায় আমরা চললাম জাহাজ-বাড়িতে মি. পেগোটি, এমিলি এবং হ্যামের সঙ্গে দেখা করতে।
দরজার তালা খোলাই ছিল। তাই নিঃশব্দে প্রবেশ করলাম আমরা। দেখলাম, মি. পেগোটি বসে আছেন আগুনের পাশে। তার সামনে হাতে হাত ধরে বসে এমিলি আর হ্যাম উত্তেজিতভাবে কিছু একটা বলছে। ওদের কথা শুনে হাসি ফুটে উঠেছে বুড়োর মুখে। মিসেস গামিজ হাততালি দিচ্ছেন আনন্দে।
পরমুহূর্তে লাফ দিয়ে দাঁড়াল হ্যাম। চেঁচিয়ে উঠল, মাস্টার ডেভি এসেছে!
ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল সবাই। শুরু হলো হ্যাণ্ডশেক কথা বলা, হাসাহাসি। আমরাও বসে পড়লাম ওদের সঙ্গে আগুনের পাশে। হ্যাম লজ্জায় লাল হয়ে আমাদেরকে বলল যে সে আর এমিলি বিয়ে করতে যাচ্ছে। আমরা অভিনন্দন জানালাম ওদেরকে। তারপর শুরু হলো কথা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। স্টিয়ারফোর্থের গল্প শুনে হাসলাম। স্টিয়ারফোর্থ কথা বলার সময় এমিলি তাকিয়ে রইল তার দিকে। শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে এমিলিও আলাপে যোগ দিল আমাদের সঙ্গে।
পরিবারটির, বিশেষভাবে এমিলির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল স্টিয়ারফোর্থ। এবং পরে এক সময় সে আমাকে বলল যে বর হিসেবে হ্যাম এমিলির উপযুক্ত নয়, তাকে বড় বেশি মাথামোটা মনে হয়।
এই কঠোর মন্তব্যে বিস্মিত হলাম আমি। তবে তার চোখে হাসির ঝিলিক লক্ষ্য করে ধরে নিলাম যে ঠাট্টা করছে সে।
এক পক্ষকালের বেশি কাটালাম আমরা ইয়ার-মাউথে। স্টিয়ারফোর্থ নৌকায় চড়ে প্রায়ই চলে যেত সাগরে মি. পেগোটির সঙ্গে। আমি কয়েকবার ব্লাণ্ডারস্টোনে আমার শৈশবের বাড়িটা দেখে এসেছি। অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে ওখানে। মার্ডস্টোনরা এখন আর ওই বাড়িতে থাকে না। বাগানটা আগাছায় ভরে গেছে। গাছের নিচে মা-বাবা আর খুদে সৎ ভাইটির কবর দেখে বিষাদে ভরে গেছে। আমার মনটা।
একদিন সন্ধ্যায় ব্লাণ্ডারস্টোন থেকে ফিরে স্টিয়ার-ফোর্থকে একা পেলাম মি. পেগোটির বাড়িতে। আগুনের দিকে চেয়ে বসে আছে মুখটা কালো করে।
আমাকে দেখে হাসি ফিরে এল তার মুখে। বলল, আমি একটা নৌকা কিনেছি। আমি না থাকলে মি. পেগোটি ওটা চালাবেন। লিটিমার এসে নতুন পাল লাগিয়ে দেবে এবং নৌকার নতুন নাম দেবে। নামটা হবে ছোট্ট এমিলি।
বুঝলাম না এমন একটি ভাল খবর নিয়ে স্টিয়ার-ফোর্থ অমন মুখ-গোমড়া করে কেন বসে ছিল আগুনের পাশে…তাছাড়া, নৌকার নামই বা কেন দিতে যাচ্ছে ছোট্ট এমিলি!
সেই রাতের পরে পেগোটির বাড়িতে এমিলির এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয় আমার। ওর নাম মার্থা। শৈশব থেকে মার্থা আর এমিলি জানে একে অন্যকে। মার্থা কি এক গোলমাল বা বিপদে পড়েছে। এমিলির কাছে এসেছে সাহায্যের আশায়। মাথার কাহিনি শুনে কেঁদে ফেলে এমিলি। নিজের কাছে টাকাকড়ি যা ছিল সব দিয়ে দেয় বেচারি মেয়েটাকে। যাতে, মার্থা লণ্ডনে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে।
০৮. একটা পেশা বেছে নিলাম
একটা পেশা বেছে নিলাম
পরদিন আমি আর স্টিয়ারফোর্থ বিদায় নিলাম ইয়ারমাউথ থেকে। পেগোটি ও তাদের পরিবার, সাগরের অনেক মাঝি মাল্লা-যারা বন্ধু হয়ে গিয়েছিল স্টিয়ারফোর্থের—সবাই মিলে বিদায় জানাল আমাদেরকে।
কিছুক্ষণ কোন আলাপ হলো না স্টিয়ারফোর্থ আর আমার মধ্যে। তারপর স্টিয়ারফোর্থ বলল, বেড়ানো-টেড়ানো তো হলো, কি করবে ভেবেছ কিছু?
তেমন করে কিছু ভাবিনি। তবে মনে করেছিলাম প্রক্টর (ব্যবসার নায়েব) বা এজেন্ট হব, জবাব দিলাম।
স্টিয়ারফোর্থ তখন আমাকে প্রক্টরদের সম্পর্কে, ওদের পেশা সম্পর্কে যা যা জানে সব বলল।
সেদিনই আমরা বিদায় নিলাম পরস্পরের কাছ থেকে। স্টিয়ারফোর্থ গেল হাইগেটে, আমি গেলাম লণ্ডন। দাদী বেটসি তখন লণ্ডনের এক হোটেলে ছিলেন।
হোটেলে গিয়েই দাদীকে বললাম আমার পরিকল্পনার কথা। কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছে প্রক্টর ট্রেনিং-এর খরচ অনেক পড়ে যাবে।
আমার হাত দুটি নিজের হাতে নিয়ে নরম সুরে তিনি বললেন, ট্রট, তোমার দুর্ভাগা বাপ আর বেচারি মা যখন বেঁচে ছিল তখন হয়তো ওদের প্রতি আমি আরেকটু সদয় হতে পারতাম। তুমি যখন ছোট্ট ছিলে তখন তোমার প্রতিও। এখন দুঃখ করে লাভ নেই। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি আশা করেছিলাম। তুমি আরেক জন বেটসি হয়ে জন্মাবে। তুমি জন্মালে ডেভিড হয়ে। কিন্তু সেই হতাশার ধাক্কা অনেক আগেই আমি কাটিয়ে উঠেছি। তার পরে ট্রট, তুমি এলে আমার কাছে। তোমার ভালবাসা, তোমার মমতা পেলাম। তোমাকে এর প্রতিদান দেয়ার ক্ষমতা এই বৃদ্ধার নেই, বাছা। বলতে বলতে দাদীর দুচোখ ভরে গেল অশ্রুতে।
আমি তাকে ধন্যবাদ দিলাম। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন তিনি।
পরদিন আমরা যাত্রা করলাম দাদীর প্রক্টর বা এজেন্ট স্পেনলো অ্যাণ্ড জোর্কিনস্-এর অফিসে। ওদের ওখানে শিক্ষানবিশ প্রক্টরের একটা জায়গা খালি আছে। ওরা আমাকে পরীক্ষামূলকভাবে এক মাসের জন্য নিতে রাজি হলো।
তারপর দাদী আর আমি বেরুলাম আমার জন্য একটা আসবাবপত্রে সাজানো ঘরের খোঁজে। পেয়েও গেলাম নদীর দিকে মুখ করা এক বাড়ির দোতলার একটা ফ্ল্যাট।
খুশি হলাম অমন চমৎকার একটা ঘরের এক বাসিন্দা হয়ে। দারুণ লাগল। পকেটে ঘরের চাবি নিয়ে শহরে ঘুরে বেড়াতে। শুধু রাতের বেলায় বড় একা লাগে নিজেকে। ইচ্ছে হয় কারও সঙ্গে কথা বলতে। মনে পড়ে অ্যাগনেস-এর কথা। উইকফিল্ডদের বাড়িতে কাটানো দিনগুলোর কথা। মন কেমন করে অ্যাগনেসের জন্য!
পরদিন একটা চিঠি পেলাম অ্যাগনেসের। বাবা আর উরিয়া হীপের সাথে সে লণ্ডনে এসেছে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। সেদিন বিকেলেই তাড়াতাড়ি করে চলে গেলাম ওদের হোটেলে।
সাদর অভ্যর্থনা পেলাম ওর কাছে। কিন্তু ওকে যেন কি নিয়ে একটু চিন্তিত মনে হলো। পরে অ্যাগনেস আমাকে বলল যে উরিয়া হীপ ওর বাবাকে রাজি করিয়েছে তাকে তার ব্যবসার অংশীদার করে নিতে। অ্যাগনেস প্রথমে ভেবেছিল যে হীপের সাহায্য পেলে ওর বাবার খাটুনি-উদ্বেগ কমবে। কিন্তু এখন ওর ভয় হচ্ছে যে হীপ বুড়ো মানুষটির দৈহিক অসামর্থ্যের সুযোগ নিচ্ছে। মি. উইকফিল্ডকে যেন হীপ সম্পূর্ণভাবে মুঠোয় পুরে ফেলেছে।
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল অ্যাগনেস। আমি যথাসাধ্য সান্তনা দিলাম। মি. উইকফিন্ড আর হীপ যখন এসে আমাদের সঙ্গে ডিনারে বসলেন ততক্ষণে অ্যাগনেস অনেকটা সামলে উঠেছে। সন্ধ্যায় অ্যাগনেস ওর বাবাকে শোয়াতে নিয়ে যাবার পরে হীপ আমাকে কয়েকটা চমকপ্রদ খবর দিল। বলল, সে অ্যাগনেসের প্রেমে পড়েছে এবং ওকে বিয়ে করতে চায়। তার কথা শুনে আমার ইচ্ছে জাগল, ফায়ারপ্লেস থেকে আগুনে পোড়া লাল তপ্ত লোহার শিকটা তুলে নিয়ে তাকে ওটা দিয়ে গেঁথে ফেলি। আমার প্রিয় অ্যাগনেসকে বিয়ে করবে এই হতচ্ছাড়া? কখখনো না! আমি তা কোনক্রমেই হতে দিতে পারি না। তাছাড়া, আমার সন্দেহ। হলো যে তার অ্যাগনেসকে বিয়ে করতে চাওয়ার কারণ প্রেম নয়। এ রকম হতচ্ছাড়া প্রাণীর পক্ষে কাউকে ভালবাসা সম্ভব নয়। না, তার মতলব উইকফিল্ডদের ব্যবসাটা হস্তগত করা। তার সঙ্গ অসহ্য হয়ে উঠল আমার কাছে। অ্যাগনেস ফিরে আসতেই আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
আমার নতুন মনিব মি, স্পেনলো এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আমাকে তার গ্রামের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। তার ফার্মে চাকরি পাওয়া উপলক্ষে। সেখানে আমার দেখা হলো তার মেয়ে ডোরার সঙ্গে। দুনিয়ার সেরা রূপসী। দেখা মাত্রই প্রেমে পড়ে গেলাম। ছুটির দিনটা হয়ে উঠল আমার জীবনের সেরা দিন, সুন্দরতম দিন।
দিনশেষে ফিরে এলাম লণ্ডনে। আমার প্রশিক্ষণ চলতে লাগল। ব্যবসাসূত্রে পরিচিত কয়েকজন বন্ধুর আমন্ত্রণে একদিন ওদের বাড়িতে গেলাম। ওদের মুখে একজনের নাম শুনলাম। নামটা পরিচিত মনে হলো—মি. ট্র্যাডলস।
আমার মন উড়ে গেল সালেম হাউসের স্কুল জীবনে। ওরা কি সেই টমি। ট্রালস্-এর কথা বলছে? পিঠে সাবধান, ও কামড়ায় লেখা বোর্ড ঝুলানো অবস্থায় যে আমাকে অন্য ছেলেদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল? স্টিয়ারফোর্থকে গল্প শোনাবার সময় নানা রকম শব্দ করে যে আবহসঙ্গীত সৃষ্টি করত সেই ট্যালস্? অতিথিদের মধ্যে আমি খুঁজতে লাগলাম মি. ট্র্যাডলসকে। একজন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল এক কোণে দাঁড়ানো এক তরুণ ভদ্রলোকের প্রতি। তাই তো! সেই মাথা ভর্তি কঁকড়া চুল, সেই বিস্ফারিত চোখ। টমিই বটে!
ছুটে গেলাম ওর দিকে। পরিচয় দিলাম নিজের। কি খুশিই না হলে সে আমাকে দেখে। পরদিনই ওর বাড়িতে যাব বলে আমরা পরিকল্পনা করলাম।
ও যে রাস্তার নাম লিখে দিয়েছিল সেখানে পৌঁছে দেখলাম রাস্তাটা খারাপ, অপরিষ্কার, ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। আমার মনে পড়ল মি. ও মিসেস মিকবারের সঙ্গে এক সময় এরকম রাস্তায় এক বাড়িতে আমি থাকতাম।
ট্র্যাডলস অপেক্ষা করছিল সিঁড়ির গোড়ায়। উচ্ছ্বসিত আনন্দে সে আমাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেল ওর ছিমছাম সুন্দর ছোট্ট ঘরটিতে। আমরা মি, ক্রীকলএর স্কুলের পুরানো দিনের গল্প করলাম। তারপর থেকে এতদিন কে কি করেছি। জানালাম একে অপরকে। টমির মা-বাবা নেই। যে চাচার কাছে থাকত তিনিও মারা গেছেন। ওর জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি। এখন কষ্টেসৃষ্টে আইন। পড়ছে। ছোটখাট কাজকর্ম করে পেট চালাচ্ছে। সোফি নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করবে বলে সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দুনিয়ায় সোফির চাইতে প্রিয় আর কেউ ওর নেই। কিন্তু আর্থিক অবস্থার কারণে বিয়েটা হতে পারছে না। কতদিন ওদেরকে অপেক্ষা করতে হবে কে জানে।
আমি ভাবলাম, আহা, ওর তো বিয়ের বাগদান হয়ে গেছে! আমার যদি হত ডোরার সঙ্গে! হিংসে হলো আমার টমিকে।
টমি বলে গেল, আমার রোজগার বেশি নয়। তবে খরচও বেশি করি না। নিচের তলার পরিবারটির সাথে খাওয়া-দাওয়া করি। মি. ও মিসেস মিকবার খুব অভাবি মানুষ। দারিদ্র-যাতনা অনেক সয়েছেন।
কি নাম বললে? মিকবার? আমি তাদেরকে ভাল করেই চিনি। চলো, নিচে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করি, বললাম আমি।
দুপদাপ করে নেমে গেলাম সিড়ি দিয়ে। সম্ভাষণ জানালাম মি. ও মিসেস মিকবারকে। প্রথমে তারা চিনতে পারলেন না আমাকে। আমি নিজের পরিচয় দেয়ার পর পারলেন। আনন্দে আবেগে অভিভূত হলেন তারা দুজন। আমাকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানালেন। দেখলাম তারা আগের মতই দরিদ্র। হঠাৎ আরেকটি বাড়তি মুখে খাবার জোগানো কঠিন হবে তাদের পক্ষে। তাই বললাম যে ডিনারের সময় পর্যন্ত থাকা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। চট করে একটা তারিখ ঠিক করে আমিই টমি আর মিকবারদের ডিনারে আমন্ত্রণ করলাম।
নির্দিষ্ট দিনে আমার ডিনার পার্টি হলো। ভালই চলল পার্টি। যথাসময়ে বিদায় নিল আমার অতিথিরা। আগুনের পাশে বসে ভাবতে লাগলাম নতুন করে খুঁজে
পাওয়া পুরানো বন্ধুদের সাথে কি সুখেই না কাটল সময়টা। হঠাৎ সিড়িতে দ্রুত পায়ের শব্দ শুনলাম। দরজা খুলে গেল হুস করে। দেখা গেল জেমস স্টিয়ারফোর্থ দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে!
স্টিয়ারফোর্থ বলল সে ইয়ারমাউথ থেকে এসেছে। ওখানে সে তার ন.. নৌকায় চড়ে সাগরে বেড়িয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আমার বন্ধুদের।
স্টিয়ারফোর্থ বলল, এমিলি আর হ্যামের বিয়ে এখনও হয়নি। আর গাড়ি চালক বার্কিস খুবই অসুস্থ। মনে হয় বাঁচবে না বেশিদিন।
তাহলে আমাকে এখনি পেগোটির কাছে যেতে হবে। ওর স্বামীর শেষ সময়ে আমার থাকা দরকার ওর পাশে। সান্ত্বনা দেয়া দরকার ওকে।
স্টিয়ারফোর্থ বলল, আমার সঙ্গে হাই গেট-এ চলো না প্রথমে। আমি ওখানে যাচ্ছি। মা-কে দেখিনি অনেক দিন। একবার দেখে যাই। নইলে আবার কবে বাড়ি যাব কে জানে!
তার আমন্ত্রণটা অদ্ভুত মনে হলো আমার। তবু রাজি হলাম তার সঙ্গে যেতে।
ইয়ারমাউথে যাবার পথে থামলাম হাই গেট-এ, তাদের বাড়িতে। মিসেস স্টিয়ারফোর্থের সহচরী মিস ডার্টল আরও অদ্ভুত ভঙ্গিতে আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনিই কি সেই মানুষটি, যে জেমসকে এতদিন ধরে বাড়িতে আসতে দেয়নি?
সত্যি, বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম প্রশ্নটা শুনে। জবাব দিলাম, স্টিয়ারফোর্থের ব্যাপার-স্যাপার আমি কিছুই জানি না। কোথায় সে থাকে, সময় কাটায় তা-ও আমার জানা নেই। অনেক দিন পরে গত রাতেই প্রথম দেখা হয়েছে তার সঙ্গে।
প্রশ্নোত্তরের এ সময়টায় স্টিয়ারফোর্থ তীক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল আমার দিকে। ভাবলাম, তার মনে কিছু একটা আছে। কিন্তু সেটা কি তা সে বলল না।
সে রাতে শুতে যাবার আগে তাকে বললাম যে পরদিন ভোরে সে জেগে ওঠার আগেই আমি বিদায় নেব। সে আমার কাধ চেপে ধরল এমনভাবে, যেন যেতে দিতে চায় না আমাকে। ডেভিড, কোন কারণে কোনদিন যদি বিচ্ছেদ ঘটে আমাদের, আমাকে মন্দ ভেবো না। আমার ভাল দিকগুলো মনে রেখো, বলল সে।
জবাব দিলাম, তোমার সবচেয়ে ভাল সবচেয়ে খারাপ বলে কিছু নেই। তোমাকে আমি প্রিয় বন্ধু হিসেবেই সব সময় ভালবাসব। আমার এ কথাগুলোও যে অদ্ভুত, বিচ্ছেদের কথাই বা সে কেন তুলল, এসব আমি ভাবলাম না। পেগোটির জন্য দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে আমার মন।
০৯. এক বিরাট ক্ষতি
এক বিরাট ক্ষতি
সন্ধ্যায় পৌঁছলাম ইয়ারমাউথে পেগোটির বাড়িতে। দরজায় মৃদু টোকা দিতেই খুলে দিলেন মি. পেগোটি। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে। সেখানে আগুনের পাশে বসে আছে এমিলি। বিষণ্ণ, চুপচাপ। হ্যাম দাঁড়িয়ে আছে ওর পাশে। ওর কাঁধে হাত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু ও যেন পছন্দ করছে না কাধে হাত দেয়া। হ্যাম আমাকে বলল যে সপ্তা দুয়েকের মধ্যে বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ওদের বিয়েটা হয়ে যাবে।
আমি বসে বসে ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনতে লাগলাম। একটু পরেই ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে পেগোটি এসে হাজির হলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল ওপরতলায় যেতে। সেখানে শোবার ঘরে শুয়ে আছেন বার্কিস-নীরব, অচেতন।
ভাটার টানের সাথে সাথে সে চলে যাচ্ছে। সাগরকূলের মানুষ মারা যায় ভাটার টানের শেষে, বলল পেগোটি ফিসফিস করে।
বার্কিসের কাছে কয়েক ঘণ্টা আমরা রইলাম। একবার চোখ মেলে তাকালেন। আমার দিকে একটা হাত বাড়াতে চেষ্টা করলেন।
অতিকষ্টে মুখে একটু হাসি আনার চেষ্টা করে বার্কিস ইচ্ছুক! বলেই তিনি ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে।
পরদিন নীরবে শেষ হলো অন্ত্যেষ্টির কাজ। আমরা চলে গেলাম যার যার পথে। কথা রইল সন্ধ্যায় মিটার পেপগাটির জাহাজ-বাড়িতে একত্র হব। দিনটা কাটল ধীর গতিতে।
বৃষ্টি শুরু হলো অঝোর ধারায়। তবে মেঘের আড়ালে চাদ আছে। তাই জাহাজ-বাড়ির পথটা তেমন অন্ধকার নয়। সেখানে পৌঁছে দেখি পেগোটি, মিসেস গামিজ আর মি. পেগোটি আছেন।
একটুখানি পরে এসে ঢুকল হ্যাম। একা।
এমিলি কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন মি. পেগোটি।
হ্যাম এমন ভঙ্গিতে হাত নাড়ল যাতে মনে হতে পারে ও বাইরে আছে। তারপর সে ফিরল আমার দিকে। তার চেহারা মড়ার মত ফ্যাকাসে। বলল, মাস্টার ডেভি, এক মিনিটের জন্য বাইরে চলুন। আমি আর এমিলি আপনাকে একটা জিনিস দেখাব।
আমরা বাইরে গেলাম। হ্যাম দরজা বন্ধ করে দিল যাতে কেউ কিছু না শোনে। তারপর বলল, এমিলি পালিয়ে গেছে। এ কথা আমি কেমন করে বলব মি. পেগোটিকে? বলে হু-হু করে কেঁদে ফেলল হ্যাম। কাঁদতে কাঁদতে একটা ভাজ করা কাগজ গুজে দিল আমার হাতে।
বিস্মিত হবার সময়ও পেলাম না, কারণ মি. পেগোটি দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। আমাদের দিকে এক নজর তাকিয়েই তিনি বুঝে ফেললেন গুরুতর কিছু ঘটে গেছে।
আমরা ফিরে গেলাম ঘরে। পেগোটি ও মিসেস গামিজ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। জড়িয়ে ধরলেন মি. পেপগাটিকে। মি. পেগোটির ওয়েস্টকোট হেঁড়া, চুল এলোমেলো, মুখ আর ঠোঁট দুটো সাদা, মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে বুকের ওপর। স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে তিনি বললেন, চিঠিটা পড়ুন, স্যার।
আমি পড়লাম। এমিলি তার চিঠিতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছে হ্যামের জন্য-যে তাকে ভালবেসেছিল। ও দুঃখ প্রকাশ করেছে ঘর ছেড়ে, প্রিয়জনদের ছেড়ে, ওর অতি স্নেহপ্রবণ কাকাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে। লিখেছে, যার সঙ্গে সে চলে যাচ্ছে সে যদি ওকে একজন লেডির মর্যাদা দিয়ে ফিরিয়ে না আনে তাহলে সে আর ফিরবে না। হ্যামকে সে অনুরোধ করেছে ওর প্রিয় কাকাকে দেখার জন্য। বলেছে হ্যাম যেন একটি ভাল মেয়েকে বিয়ে করে।
স্থির দাঁড়িয়ে মি. পেগোটি শুনলেন। কাঁপতে লাগলেন থরথর করে। জিজ্ঞেস করলেন, লোকটা কে?
হ্যাম আমার দিকে তাকিয়ে নীরব রইল। আমি একটা ধাক্কা খেলাম—বুঝতে পারলাম লোকটা কে। অবসন্নভাবে বসে পড়লাম চেয়ারে।
লোকটার নাম বললা! গর্জে উঠলেন মি. পেগোটি।
হ্যাম থতমত খেয়ে বলল, গত কদিন ধরে একটা চাকর আর তার মনিব অসময়ে ঘুরঘুর করছিল এদিকে। গত রাতে চাকরটা বেচারি এমিলির সঙ্গে দেখা করে। লোকটি এখানে কোথাও লুকিয়ে থাকত।
পেগোটি পেছন থেকে আমার গলা জড়িয়ে ধরল। কিন্তু আমার তখন নড়ার শক্তিও নেই।
আজ খুব ভোরে শহরের বাইরে নরউইচের রাস্তায় একটা অচেনা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। এমিলিকে নিয়ে চাকরটি ওই গাড়িতে ওঠে। তার মনিব গাড়ির ভেতরে ছিল।
ওর নাম কি স্টিয়ারফোর্থ?
হ্যাম আমার দিকে ফিরে ভাঙা গলায় বলল, মাস্টার ডেভি, এতে আপনার কোন দোষ নেই। তবে লোকটার নাম স্টিয়ারফোর্থ এবং সে একজন জঘন্য বদমাশ!
মি. পেগোটি কাঁদলেন না। চোখের পানি ফেললেন না। নড়লেন না। তারপর যেন হঠাৎ জেগে উঠলেন ঘুম থেকে। দেয়ালে ঝোলানো কোটটা নামিয়ে নিলেন। বললেন, আমার হ্যাটটা দাও।
হ্যাম জিজ্ঞেস করল তিনি কোথায় যাচ্ছেন।
যাচ্ছি আমার ভাইঝিকে খুঁজতে। আমার এমিলিকে খুঁজতে। প্রথমে স্টিয়ারফোর্থের নৌকাটা ফুটো করে ডুবিয়ে দেব। তাকেও ওখানে ডোবাতাম যদি তার মতলবটা টের পেতাম। তারপর আমি খুঁজব এমিলিকে।
কোথায়? দরজা আগলে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল হ্যাম।
যে-কোন জায়গায়। দুনিয়ার সবখানে। কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবে।
না, না, বলে কেঁদে উঠলেন মিসেস গামিজ। না, তোমার বর্তমান অবস্থায় যেতে পারবে না। পরে, শান্ত ও সুস্থ হয়ে তুমি যেয়ো। এখন নয়।
শান্ত হলেন মি. পেগোটি। কাঁদতে লাগলেন। আমার ইচ্ছে হলো হাঁটু গেড়ে বসে তাঁদের কাছে ক্ষমা চাইতে। কারণ, আমার জন্যই তাদের জীবনে এ দুর্যোগ নেমে এসেছে। আমিই স্টিয়ারফোর্থকে এনেছিলাম এখানে।
কিন্তু আমি ক্ষমা চাইলাম না। স্টিয়ারফোর্থকে অভিসম্পাতও দিলাম না। শুধু কাঁদলাম বসে বসে। বন্ধুর স্মৃতিটা আমার কাছে প্রিয়। তবে, অনুভব করলাম যে আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। তার সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের রাতে সে-ও তা অনুভব করেছিল। এজন্যই সম্ভবত গতকাল হাইগেট-এ সে বলেছিল, আমাদের মধ্যে যদি কোনদিন বিচ্ছেদ ঘটে, আমাকে মন্দ ভেবো না।
মি. পেগোটিকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা বৃথা।
আমি এখন আমার ভাইঝিকে খুঁজতে যাচ্ছি। গোটা দুনিয়ায় খুঁজে বেড়াব। হ্যাঁ, আমি খুঁজব। আর ওই লোকটাকে নৌকাসুদ্ধ ডুবিয়ে মারা আমার উচিত ছিল… বলতে লাগলেন তিনি উন্মাদের মত চিৎকার করে।
পরদিন ওদের দেখা পেলাম সাগরতীরে। চেহারা দেখেই বুঝলাম সারা রাত ঘুমায়নি। বসে ছিল মুখোমুখি। দুজনই সাগরের মত গম্ভীর এবং স্থির।
কি করব না করব সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। এখন আমাদের কর্মপন্থা পরিষ্কার, বললেন মি. পেগোটি।
হ্যামের দিকে তাকালাম। সে চেয়ে আছে সাগরের দিকে। তার মুখে যেন একটা দৃঢ় সংকল্পের অভিব্যক্তি। আমার ভয় হলো স্টিয়ারফোর্থের দেখা পেলেই তাকে খুন করবে সে।
এখানে আমার কাজ শেষ হয়েছে। আমি ওকে খুঁজতে যাচ্ছি। এখন ওটাই আমার বড় কর্তব্য।
আমি মি. পেগোটিকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি লণ্ডন যাবেন কিনা। গেলে যেতে পারেন আমার সঙ্গে। তার কোন কাজে লাগতে পারি ভেবে আজ যাইনি। কাল যাব।
যাব, স্যার। হ্যাম, তুমি এখানে নিজের কাজকর্ম করবে। আমার বোনের সঙ্গে গিয়ে থাকবে। আমার জাহাজ-বাড়িটা যেমন আছে তেমনি থাকবে। শীতেগ্রীষ্মে রোদে-বৃষ্টিতে। এমিলি যেমন ফেলে গেছে তেমনি, বললেন মি. পেগোটি।
পেগোটির বিষয়-আশয়ের ব্যবস্থাপনার কাজে হাত দিলাম। বার্কিসের উইল অনুযায়ী সব কিছুর বিলিবণ্টনের দায়িত্ব নিলাম।
তারপর যথাসময়ে ফিরে এলাম লণ্ডনে।
মি. পেগোটি আমাকে জানালেন যে তিনি প্রথমে মিসেস স্টিয়ারফোর্থের সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি বিনীতভাবে মিসেস স্টিয়ারফোর্থকে চিঠি লিখে অনুরোধ করলাম বিপন্ন মানুষটিকে সাক্ষাৎ দেয়ার জন্য। তিনি রাজি হলেন।
নির্ধারিত সময়ে আমরা পৌঁছলাম। মিসেস স্টিয়ারফোর্থ বসে ছিলেন ড্রয়িংরূমে। মিস ডার্টল এসে দাঁড়ালেন তাঁর চেয়ারের পেছনে।
মিসেস স্টিয়ারফোর্থের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম ছেলের অপকর্মের খবর তিনি তার কাছ থেকেই পেয়েছেন। কিন্তু তিনি অবিচল। আর্মচেয়ারে বসে আছেন গর্বিত ভঙ্গিতে। মি. পেগোটিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে দেখলেন। একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে ইঙ্গিত করলেন। মি. পেগোটি এমিলির চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বললেন এমিলি লিখেছে: একজন লেডি হিসেবে (স্টিয়ারফোর্থের বৌ হিসেবে) ফিরিয়ে না আনলে ও আর ফিরবে না। আমি জানতে এসেছি, ম্যাডাম, আপনার ছেলে কি তার কথা রাখবেন?
না।
না কেন?
পরদিনই অফিসে গিয়ে মি. স্পেনলো এবং তার পার্টনার মি. জোর্কিনের সঙ্গে দেখা করলাম। আমার আর্থিক সঙ্কটের বিষয় জানালাম তাদেরকে। বললাম আমার ট্রেনিং-এর খরচ দিচ্ছিলেন দাদী। ওটা বন্ধ করতে হবে। দুজনের কেউই বললেন না যে তুমি থেকে যাও, বা ট্রেনিং চলুক। ট্রেনিং-এর জন্য দাদী যে এক হাজার পাউণ্ড অগ্রিম দিয়েছিলেন ওটা ফেরত দেয়ার কথাও তারা বললেন না।
অফিস থেকে ফিরে চললাম বাড়িতে। চরম আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে কিভাবে চলব সেই চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে। হঠাৎ একটা একা গাড়ি এসে থামল আমার পাশে। তাকাতেই চোখ পড়ল সেই একটি মুখের ওপর যে মুখটি দেখলেই খুশি হয়ে উঠি আমি। অ্যাগনেস বসে আছে গাড়িতে!
আরে অ্যাগনেস যে! কী সৌভাগ্য আমার! তোমাকেই আমি এখন চাচ্ছিলাম মনেপ্রাণে। ভাবছিলাম তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারলে কি ভালই না হত, বললাম উচ্ছ্বাসের সঙ্গে।
গাড়ি ছেড়ে নামল অ্যাগনেস। হাঁটতে লাগলাম দুজনে। ও বলল যে আমার দাদীর আর্থিক সমস্যার কথা শুনে তার সঙ্গে দেখা করতে লণ্ডনে এসেছে। অ্যাগনেস ও আমার দাদী বহু বছর ধরে পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ। ওর সাথে ওর বাবা আর উরিয়া হীপ এসেছে। অ্যাগনেস বিষণ্ণভাবে বলল যে বাবার সঙ্গে ও এখন একা থাকতে বা কথা বলতে পারে না। এমনকি নিজেও একা থাকতে পারে না। কারণ, উরিয়া হীপ কেবল মি. উইকফিল্ডের ব্যবসারই অংশীদার হয়নি, সে ওদের বাড়িতে উঠে এসেছে এবং থাকছে।
ট্রেট, আমার ভয় হচ্ছে হীপ বাবার বিরুদ্ধে কোন জালিয়াতি কিংবা বেঈমানীর মতলব আঁটছে, বলল ও কম্পিত স্বরে। তবে আমি প্রার্থনা করি, আশঙ্কা যেন ভুল প্রমাণিত হয়।
আমরা পৌঁছে গেলাম আমার ফ্ল্যাটে। দাদী সাদরে অভ্যর্থনা করলেন অ্যাগনেসকে। ওকে বলতে লাগলেন তার দুর্ভাগ্যের কথা। এই প্রথমবারের মত আমি জানলাম আমার দাদীর টাকা-পয়সার ঠিক কি হয়েছে। মনে হলো তিনি উইকফিল্ড অ্যাণ্ড হীপ কোম্পানির পরামর্শে কোন এক ব্যাঙ্কে শেয়ারের জন্য টাকা লগ্নি করেছিলেন। কিন্তু ব্যাঙ্কটি ফেল মারে। লগ্নিকারকরা সবাই সর্বস্বান্ত হয়।
কিছু একটা করতেই হবে! বললাম আমি।
কি বললে? আঁতকে উঠলেন দাদী বেটসি। জাহাজে কিংবা সেনাবাহিনীতে চলে যাবে? আমি ওসব কথা শুনতেই চাই না। তুমি তোমার পড়াশোনা চালিয়ে যবে প্রােক্টর হবে। তারপরে হয়তো আইনজীবী হবে।
বিবর্ণ মুখে এবং প্রায় রুদ্ধশ্বাসে এসব কথা শুনছিল অ্যাগনেস। অবশেষে ও বলল, ডেভিড, তুমি হয়তো তোমার ট্রেনিং চালিয়ে যেতে পারবে, সেই সঙ্গে অবসর সময়ে কাজও করতে পারবে। তোমার প্রিয় পুরানো শিক্ষক ড. স্ট্রং এখন লণ্ডনে। তিনি একজন সেক্রেটারি খুঁজছেন। তার অভিধান রচনার কাজে সাহায্য করার জন্যে। অভিধানটি তিনি এখনও লিখছেন। কাজটা নেবে নাকি?
নেব না মানে? বলছ কি, অ্যাগনেস! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম। তুমি ছাড়া আর
ওটা অসম্ভব। সে ছোট হয়ে যাবে সমাজে। আপনার না জানার কথা নয় যে মেয়েটি সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে তার চেয়ে অনেক নিচে, বললেন মিসেস স্টিয়ারফোর্থ।
ওকে ওপরে তুলে নিন, বললেন মি. পেগোটি।
সে অশিক্ষিত এবং অজ্ঞ। তাছাড়া নিচু ঘরের মেয়ে। ওরকম মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে আমার ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে।
মিসেস স্টিয়ারফোর্থ বললেন এমিলির সঙ্গে তার ছেলের বিয়ে হবে না। তবে যা ঘটেছে এবং মি. পেগোটির যে ক্ষতি হয়েছে সেটা তিনি অন্যভাবে পূরণ করে দিতে পারেন। অন্যভাবে, মানে টাকাপয়সা দিয়ে।
মি. পেগোটি ঘৃণাভরে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বললেন স্টিয়ারফোর্থদের বাড়িটা তাঁর ও তাঁর পরিবারের জন্য চরম অশুভ বয়ে এনেছে। এ বাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকার বা কথা বলার আর কোন অর্থ হয় না।
আমরা বেরিয়ে এলাম। মি. পেগোটি বললেন যে লণ্ডনে তার কাজ শেষ হয়েছে। এখন তিনি তার ভাইঝিকে খুঁজতে বেরুবেন। সেদিনই তিনি বিদায় নিলেন আমার কাছ থেকে।
১০. ফতুর হয়ে গেলাম
ফতুর হয়ে গেলাম
মি. স্পেনলো ডোরার জন্মদিন উপলক্ষে এক পিকনিকে দাওয়াত করলেন আমাকে। আমি ফুল নিয়ে গেলাম ভোরার জন্য। ফুলগুলো ও সারাক্ষণ নিজের কাছে রাখল। ওর ছোট্ট কুকুর জিকে দিয়ে শোঁকাতে চেষ্টা করল। কিন্তু কুকুরটি গোঁ গোঁ করে শুকতে অনিচ্ছা জানাল। ডোরার সঙ্গ আনন্দে ভরিয়ে দিল আমার মন।
চারদিন পরে ডোরা আর আমি এনগেজড হলাম। তবে কথাটা আমরা কিছুদিনের জন্য ওর বাপকে জানাব না বলে স্থির করলাম। পেগোটি তার স্বামীর উইলের ব্যাপারে তখন লণ্ডনে ছিল। আমি তাকে বললাম এবং অ্যাগনেসকে চিঠি লিখে জানালাম।
একদিন পেগোটিকে নিয়ে বাসায় ফিরে আশ্চর্য হয়ে দেখি যে দরজা খোলা এবং ভেতরে কারা যেন কথা বলছে। দুজনে চোখাচোখি করে আমরা ঢুকলাম বসার ঘরে। বিস্মিত হয়ে দেখলাম কথা বলছেন আর কেউ নয়—আমার দাদী ও মি. ডিক! দাদী তার লাগেজ-এর ওপর বসে চা খাচ্ছেন। তার বেড়ালটা বসে আছে হাঁটুর ওপর। মি. ডিক প্রকাণ্ড একটা ঘুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আরও অনেকগুলো বাক্স-পেটরার মাঝখানে।
দাদী! বলে চেঁচিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। এ কি অপ্রত্যাশিত আনন্দ!
দাদীকে আমি ভাল করেই জানি। গুরুত্বপূর্ণ কোন কারণ ছাড়া তিনি লণ্ডনে আসেননি। কিন্তু কী সেই কারণ? ডোরার সঙ্গে আমার এনগেজমেন্টের কথা কি তিনি জেনে গেছেন? কিন্তু আমি তো তাকে এখনও জানাইনি! কোনভাবে তাঁর মনে কি আঘাত দিয়েছি? কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে আমি জানি যে যথাসময়ে তিনি নিজেই বলবেন ব্যাপারটা কি।
অবশেষে চা-পান শেষ হলো তার। তিনি বললেন, ট্রট, আমি আমার লাগেজ-এর ওপর কেন বসে আছি, জানো?
মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম—জানি না।
কারণ, এগুলোই আমার যথাসর্বস্ব। আমি ফতুর হয়ে গেছি! আমার যা কিছু আছে সবই এখন এই ঘরে। অবশ্য ডোভারের কটেজটি আছে। ওটা ভাড়া দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এতে আমাদের ঘাবড়ে গেলে চলে না। ট্রট, দুর্ভাগ্যের মধ্যেই বেঁচে থাকতে হবে আমাদেরকে। তোমাকে হতে হবে বলিষ্ঠ এবং স্বনির্ভর।
আমার জন্য এর চাইতে বড় আঘাত আর কি হতে পারে?
ডিক জানেন, শান্তভাবে বললেন দাদী আমার কাঁধে হাত রেখে। ডিক-এর জন্য আজ রাতের মত শোবার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আমার জন্য এখানেই একটা বিছানা পেতে দিতে পারো। এতে খরচ বাচবে। কোনরকমে শুতে পারলেই হবে। কেবল আজকের রাতটার জন্য।
দাদীর কথায় বিস্ময়ের ঘোর আমার কেটে গেল। বললাম আমার জানা এক জায়গায় মি. ডিক-এর জন্য একটা রুম ভাড়া নেয়া যাবে।
রাত হয়ে যাচ্ছে। মি. ডিককে নিয়ে চললাম রুম ভাড়া করতে। তিনি তার প্রকাণ্ড ঘুড়িটা পিঠে ঝুলিয়ে আমাকে অনুসরণ করলেন।
তাকে সেখানে রেখে ফিরে গেলাম আমার ফ্ল্যাটে। দেখলাম দাদী পায়চারি করছেন ঘরের মধ্যে। আমাকে বললেন যে তিনি আর পেগোটি ডোরার সঙ্গে আমার এনগেজমেন্ট নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
তুমি তাহলে মনে করছ যে ডোরার প্রেমে পড়েছ? বললেন তিনি।
মনে করছি মানে? চেঁচিয়ে উঠলাম লজ্জায় লাল হয়ে। ভোরাকে আমি মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসি! আমাদের বয়স কম। লোকে আমাদেরকে বোকা মনে করতে পারে। কিন্তু পরস্পরের জন্যে আমাদের ভালবাসাটা খাটি।
বিষণ্ণ হাসি হেসে দাদী বেটসি মৃদু কণ্ঠে বললেন, ভাল কথা। কিন্তু তোমাদের প্রেম বিফল হয়ে যেতে পারে। তবে, সফলও হতে পারে একদিন।
খুশি হলাম। অন্তত তাঁর কথায় আমাদের প্রতি মেহের আভাস পেলাম। তাই তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম।
কিন্তু ঘুম এল না দুচোখে। ভাবতে লাগলাম। আমার আর্থিক দুরবস্থা ও দারিদ্র্যের কথা শুনলে মি. স্পেনলো হয়তো আমাকে বিয়ে করার ব্যাপারে ডোরাকে অনুমতি দেবেন না। ট্রেনিং-এর সময় আমি কোন বেতন পাচ্ছি না। এ অবস্থায় ভোরার সঙ্গে কিভাবে মেলামেশা করব, দাদীকেই বা কেমন করে সাহায্য করব?
[একটা পেজ মিসিং, সরি!]
কে আমাকে এ পরামর্শ দিত? তুমি সব সময় আমার জন্য দেবদূত!
এখন তো ডোরা তোমার স্বর্গীয় দূত, আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল ও মৃদু হেসে।
নিজে কিছু রোজগার করব এটা ভেবে কী খুশিই না হয়ে উঠলাম! তখনি দেখা করার অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখলাম ড. স্ট্রংকে।
পরদিন গেলাম ড. স্ট্রং-এর কাছে। দেখলাম তিনি পায়চারি করছেন বাগানে।
কপারফিল্ড যে! বললেন তিনি। তুমি তো বেশ বড়ো হয়ে গেছ! কিছুক্ষণ আমরা আলাপ করলাম পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে, পুরানো বন্ধুবান্ধবদের সম্পর্কে। তারপর গম্ভীর হয়ে তিনি বললেন, কপারফিল্ড, তুমি চমৎকার ছাত্র ছিলে। অনেক কিছু করার মত শিক্ষা তুমি পেয়েছ। আমার সেক্রেটারি হবার মত সামান্য কাজ তুমি কেন নিতে চাও? বছরে সত্তর পাউণ্ডের বেশি তো দিতে পারব না।
ওতেই আমার চলবে। অবসর সময়ে আপনার কাজ করব। ওদিকে আমার ট্রেনিং এবং অধ্যয়নও চালিয়ে যেতে পারব।
ঠিক আছে, বললেন ড. স্ট্রং। তবে তোমাকে কথা দিতে হবে যে ভাল চাকরি পেলে গ্রহণ করবে এটা ছেড়ে দিয়ে।
কথা দিলাম, স্যার। বেশ, বেশ, বললেন ড. স্ট্রং।
আমরা ঠিক করলাম যে আমি প্রতিদিন সকালে দুঘণ্টা এবং রাতে তিন ঘণ্টা কাজ করব। শনিবার-রোববার ছাড়া। ওই দুদিন আমার ছুটি।
শুরু হলো আমার ব্যস্ত জীবন। ভোর পাঁচটায় ওঠা, ড. স্ট্রং-এর ওখানে যাওয়া। রাত নয়-দশটায় বাসায় ফেরা।
মি. ডিক মনমরা হয়ে রইলেন। নিজেকে তাঁর অকর্মণ্য মনে হলো। কারণ দাদী বেটসির সাহায্যের জন্যে তিনি কিছুই করতে পারছেন না। আমার তখন মনে পড়ল পুরানো বন্ধু টমি ট্র্যাডলস-এর কথা। ভাবলাম সে বোধহয় কোন বুদ্ধি দিতে পারবে। তার হয়তো মি. ডিককে সাহায্য করার মত ব্যবসায়িক যোগাযোগ আছে। দেখা গেল, সত্যিই সাহায্য করতে পারল ট্র্যাডস।
ট্র্যাডলস নিজেই মি. ডিককে কাজে লাগাতে পারবে। মি. ডিকের হাতের লেখা অসাধারণ সুন্দর। তাকে দিয়ে ট্র্যাডলস দলিলপত্র নকল করাবে। আমাকেও সে একটা পরামর্শ দিল। বলল আমি যদি শর্টহ্যাণ্ডটা শিখে নিতে পারি তাহলে খবরের কাগজের জন্য পার্লামেন্টের বিতর্কের রিপোর্ট তৈরির কাজ পেতে পারব।
ট্র্যাডলস আমাকে আরও কিছু খবর দিল। আমাদের পুরানো বন্ধু মি. মিকবারের এক চিঠি পেয়েছে সে। ট্র্যাডলস তাকে মাঝেমধ্যে টাকা ধার দিয়ে সাহায্য করে। মি. মিকবার লিখেছেন যে তিনি এখন ক্যান্টারবেরিতে একটা চাকরি পেয়েছেন। কাজ করছেন উরিয়া হীপের খাস কেরানী হিসেবে। বিস্মিত এবং কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বসে রইলাম, কারণ উরিয়া হীপকে আমি বিশ্বাস করি না।
১১. আমার প্রিয় ডোরা
আমার প্রিয় ডোরা
পেগোটির ইয়ারমাউথে ফিরে যাবার সময় হলো। এমিলির খোঁজে চলে যাবার পর থেকে ভাইয়ের কোন খবর সে পায়নি। এখন বাড়ি যেতে চায় হ্যামের। দেখাশোনার জন্য। কোচে ওঠার আগে সে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য করল যে আমার যদি কখনও টাকার দরকার হয় আমি যেন তার কাছে যাই। বললাম, যাব।
তাকে বিদায় দিয়ে গেলাম ভোরাদের বাড়িতে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম কপর্দকহীন একটা ভিখারিকে ও ভালবাসতে পারবে কিনা। কারণ, আমি এখন তাদেরই একজন। ঝাকড়া চুল দুলিয়ে ও হাসল।
ডোরার ছেলেমানুষী আমার খুবই মিষ্টি লাগে। তবু ওকে ব্যাপারটা বোঝানো দরকার। কিন্তু ডোরা, আমার লক্ষ্মীটি, তোমার ডেভিড ফতুর হয়ে গেছে। এর পরেও কি তুমি আমাকে ভালবাস? বললাম ওকে।
নিশ্চয় বাসি! বলল সে উচ্চকণ্ঠে। কিন্তু ওসব গরীব হয়ে পড়া-টড়ার মত। ভয়ঙ্কর কথা আর বোলো না তো?
সত্যি বলব না, ডার্লিং আশ্বস্ত করলাম ওকে। কিন্তু তুমি যদি এখন একটা রান্নার বইটই পড়ে নাও, সংসারের হিসেবপত্র লিখতে শেখ, তাহলে আমাদের কাজে লাগবে।
আমার কথা শুনে ডোরা কান্নার মত করে চেঁচিয়ে উঠল। আমার মনে হলো ওকে বোধহয় খুন করে ফেলেছি। একটু পরে ওকে শান্ত করলাম। আমার প্রিয় ডোরা একটি সুন্দর শিশু ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তব জগৎ ও সমস্যার মুখোমুখি হতে ও ভীষণ ভয় পায়।
বিদায় নেয়ার সময় ডোরা বলল, ভোর পাঁচটায় উঠো না, বুঝলে দুষ্টু? এত ভোরে ওঠা খুব বিশ্রী ব্যাপার।
আমাকে যে কাজ করতে হয়, লক্ষ্মীটি।
তাহলে কোরো না! বলল সে।
ওই ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটিকে বোঝানো অসম্ভব যে বাঁচতে হলে আমাদেরকে কাজ করতেই হবে। ও কেবল হাসে। হেসে উড়িয়ে দেয় সব যুক্তি। আর, এজন্যই ওকে আমার এত ভাল লাগে।
পার্লামেন্টের বিতর্কের রিপোর্ট করার জন্য শর্টহ্যাণ্ড শিখতে লাগলাম। শর্টহ্যাণ্ডের মাছির পায়ের মত চিহ্ন আর রেখাগুলো আমার স্বপ্নেও হানা দিতে লাগল। মনে হলো যেন একটা নতুন বর্ণমালা শিখছি।
এ সময় একটা দুর্ঘটনা সব কিছু এলোমেলো করে দিল। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মি. স্পেনলো মারা গেলেন। ডোরা চলে গেল পুটুনিতে ওর ফুফুদের কাছে। আমি আর ওকে দেখি না।
দাদী বেটসি আমাকে ডোভার পাঠালেন তার কটেজের ভাড়াটিয়াদের দেখে আসার জন্য। সেখানে গিয়ে মনটা আমার ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
না, কটেজে সব কিছু ঠিক আছে। কিন্তু লণ্ডনে ফেরার পথে আমি ক্যান্টারবেরিতে থামলাম অ্যাগনেস আর মি. উইকফিল্ডকে দেখার জন্য। ওই বাড়িতে উরিয়া হীপের উপস্থিতি আমার অসহ্য লাগল। প্রথম দিন বিকালে এক মিনিটের জন্যও একা পেলাম না অ্যাগনেসকে।
ডিনারের পর হীপ আর মি. উইকফিন্ডের সঙ্গে বসে ছিলাম। হীপ মি. উইকফিল্ডকে বেশি বেশি উৎসাহ দিতে লাগল মদপান করার জন্য। অতটা পান করা তার উচিত নয়। আমি বসে রইলাম নীরবে।
হঠাৎ উরিয়া হীপ বলে বসল, মি. উইকফিল্ড, আপনার অ্যাগনেসকে আমার অ্যাগনেস বানাতে চাই। আমি চাই ওর স্বামী হতে।
চিৎকার করে উঠে দাঁড়ালেন মি. উইকফিল্ড। মনে হলো ওই মুহূর্তে পাগল হয়ে গেছেন তিনি। নিজের চুল ছিড়তে লাগলেন দুহাতে। নিজের মাথায় বাড়ি দিতে লাগলেন। চোখে তার উন্মাদের দৃষ্টি, মুখ বাক্যহারা। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম যাতে পড়ে না যান।
দেখো ওকে, এই জালেমটাকে! বললেন তিনি অবশেষে, হীপের দিকে আঙুল তুলে। ও আমার সুনাম নষ্ট করেছে। কলঙ্কিত করেছে। আমার শান্তি-স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। আমার বাড়ি-ঘর পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়েছে। এখন অ্যাগনেসকে বিয়ে করবি? কখখনো না!
ওসব তো মাতালের কথা। আগামীকাল আপনি মত বদলাবেন, বলল হীপ।
ঠিক তখনি অ্যাগনেস এসে ওর বাবাকে শোয়াতে নিয়ে গেল। পরে ও এল আমার কাছে। আমি একা বসে ছিলাম। কাঁদতে লাগল অ্যাগনেস। কিন্তু কাঁদলেও খুবই সুন্দর দেখাল ওকে।
প্রিয় অ্যাগনেস, বললাম মৃদুস্বরে। তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। তোমাকে আমি খুবই ভালবাসি। উরিয়া হীপকে কখনও বিয়ে কোরো না। তোমার বাবার ব্যবসার খাতিরে কিংবা অন্য কোন কারণেও নয়। তার মত মানুষ তোমার পায়ের নখেরও যোগ্য নয়!
মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল ওর মুখে। বলল, খোদার ওপরই ভরসা রাখতে হবে আমাকে।
ফিরে আসলাম বাড়িতে। ডোরার ফুফুদেরকে চিঠি লিখে জানতে চাইলাম আমি দেখা করতে যেতে পারি কিনা। জবাব এল, হ্যাঁ, শনি-রবিবারে।
দিনগুলো সুন্দর হয়ে উঠল আমার জন্য। কাজে এবং লেখাপড়ায় মন-প্রাণ ঢেলে দিলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম শনি-রবিবারের জন্য।
কিন্তু ডোরার ফুফুরা ওকে খেলার পুতুল বানিয়ে ফেলেছেন দেখে খুবই খারাপ লাগল আমার। ও কখন কি চায় তা দেয়ার জন্য তারা এক পায়ে খাড়া হয়ে আছেন। ওর চুলে বিনুনি বাধছেন। অলঙ্কার পরাচ্ছেন ওকে। ডোরা এতে খুশি। কিন্তু ওকে এরকম বাচ্চা বানিয়ে ফেললে আমাদের মিলিত জীবনের জন্য তা মোটেই সহায়ক হবে না।
ডোরা একদিন আমাকে বলল ওকে একটা রান্না শেখার বই দিতে এবং সংসারের হিসেবপত্র কেমন করে রাখতে হয় তা শিখিয়ে দিতে। আমি অত্যন্ত খুশি হলাম। কিন্তু পরে দেখা গেল রান্নার বই পড়তে গেলে ওর মাথা ধরে এবং হিসেবের অঙ্কের যোগফল মেলে না বলে ওর কান্না পায়।
তাই বইগুলোর স্থান হল ঘরের কোণে। ডোরা ওর কুকুর জিকে ট্রেনিং দিয়েছে এই দুটোর ওপর দাঁড়িয়ে খেলা দেখাতে। এতে ও এমন আমোদ পাচ্ছে যে আমি খুশি হলাম বইগুলো কিনেছি বলে।
১২. মি. পেগোটির খবর
মি. পেগোটির খবর
ড, স্ট্রং-এর বাড়িতে কাজ শেষে এক তুষার-ঝরা রাতে ঘরে ফিরছিলাম পায়ে হেঁটে। তুষারে ঢাকা পড়েছে রাস্তা। গাড়ির চাকা আর লোকের চলার শব্দ শোনা যাচ্ছে কম। পথ সংক্ষেপ করার জন্য সেন্ট মার্টিন লেন দিয়ে চলেছি। গলির মোড়ে একটি মেয়ের মুখ দেখলাম। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু মুখটা আমি চিনতে পারলাম। ওটা মার্থা, মার্থা এনডেল, এমিলির বন্ধু। এ মেয়েটিকেই এমিলি একদিন টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিল।
তারপর সেন্ট মার্টিনের গির্জার সিঁড়ির ওপর দেখলাম একজন মাথা নিচু করে একটা বোঝা ঠিকঠাক করে বেঁধে নিচ্ছে। বাঁধা শেষ করে লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়াল। আমি লোকটার মুখ দেখলাম, লোকটাও দেখল আমার মুখ। লোকটা হচ্ছে মি. পেপগাটি। হ্যাণ্ডশেক করলাম আমরা। দুজনই বাক্যহারা।
অবশেষে আমার বাহু আঁকড়ে ধরে তিনি বললেন, মাস্টার ডেভি। আপনাকে দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল, স্যার!
প্রিয় বন্ধু আমার! বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে না থেকে চলুন গরম কিছু পান করি। বাহুতে বাহু জড়িয়ে আমরা গিয়ে ঢুকলাম এক সরাইতে।
আলোর মধ্যে গিয়ে দেখলাম তার চুল আরও পেকেছে। মুখ আর কপালের বলিরেখা আরও গভীর হয়েছে। মি. পেগোটি বললেন এমিলির অনুসরণে তিনি পায়ে হেঁটে ফ্রান্স, ফ্রান্স থেকে ইতালি, ইতালি থেকে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে সুইটজারল্যাণ্ড গেছেন। তিনি কথা বলে যাচ্ছেন, এমন সময় দরজা খুলে গেল। বাতাসের ঝাপটায় কিছু তুষার ঢুকল ভেতরে। দেখলাম মার্থা দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখে ক্লান্তির ছাপ। কান খাড়া, শোনার চেষ্টা করছে আমাদের আলাপ। আশা করলাম মি. পেগোটি ওকে দেখেননি। এমিলির সাথে মার্থার বন্ধুত্বকে তিনি কখনও অনুমোদন করেননি। ওকে দেখলে বুড়ো মানুষটির মন খারাপ হয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া, মার্থা হাতের ইশারায় আমাকে বলছে ওর উপস্থিতির কথা মি. পেগোটিকে না জানাতে।
এমিলি আমার জন্যে টাকা পাঠায় মিসেস গামিজের কাছে, কিন্তু ঠিকানা দেয় না, বললেন মি. পেগোটি কাঁদতে কাঁদতে। ওই টাকায় তিনি হাত দেননি। আমাকে তিনি এমিলির চিঠি ও টাকা দেখালেন। এখন আবার যাত্রা শুরু করবেন। এবার যাবেন জার্মানী। এমিলির শেষ চিঠিতে জার্মান পোস্টাফিসের সিলমোহর আছে।
হ্যামের কি খবর? সে কেমন আছে? জিজ্ঞেস করলাম।
মি. পেগোটি মাথা ঝাকিয়ে বললেন, কাজ করছে। কোন নালিশ নেই ওর। তবে মনে বড় আঘাত পেয়েছে।
চিঠিগুলো গুছিয়ে যত্নের সঙ্গে রেখে উঠে দাঁড়ালেন মি. পেগোটি। দরজায় তাকিয়ে দেখলাম মার্থা নেই। মি. পেগোটি চলে গেলেন। আমি সরাই থেকে বেরিয়ে দেখলাম সব পায়ের দাগ ঢাকা পড়েছে বরফে। আমার নতুন পায়ের। দাগই কেবল দেখা যাচ্ছে। সেগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
১৩. উরিয়া হীপের শয়তানী
উরিয়া হীপের শয়তানী
অ্যাগনেস আর মি. উইকফিল্ড কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছেন ড. স্ট্রিংএর বাড়িতে। স্বাভাবিকভাবে হীপও এসেছে সঙ্গে। এক রাতে আমি আমার কাজকর্ম শেষ করছি, এমন সময় ডক্টর স্ট্রং-এর স্টাডিতে আলো জ্বলতে দেখলাম। আমি ওখানে গেলাম তাকে শুভরাত্রি বলতে এবং অত রাত জেগে আমাকে ছাড়া অভিধানের কাজ নিয়ে খাটাখাটি করায় একটু বকুনি দিতে। দেখলাম ওখানে উরিয়া হীপ আছে ডক্টর ও মি. উইকফিল্ডের সঙ্গে। ডক্টর বসে আছেন দুহাতে মুখ ঢেকে। মি. উইকফিল্ডের মুখে উদ্বেগ ও বেদনার ছাপ। কি ঘটল ভাবতে লাগলাম।
আমি ডক্টরকে মিসেস স্ট্রং-এর ব্যাপার-স্যাপার, তাঁর প্রিয় অ্যানি যে অন্য পুরুষের প্রতি অনুরক্ত সেকথা বলে দিয়েছি, হীপ বলল আমাকে লক্ষ্য করে।
হীপের নিষ্ঠুরতা স্তম্ভিত করে দিল আমাকে। তার গল্প মোটেও সত্য নয়। কিন্তু ডক্টর স্ট্রং তা বিশ্বাস করেছেন, যেহেতু তার সুন্দরী স্ত্রীর বয়স তার চাইতে অনেক কম। ডক্টর ভেবে নিয়েছেন মিসেস স্ট্রং সম্ভবত তাকে বিয়ে করেছেন। তিনি ধনী বলেই। আমার কাছে অসহ্য লাগল ব্যাপারটা। হপ একটা মিথ্যক এবং প্রতারক। সবার জীবনে দুঃখ আর বিপর্যয় ডেকে আনাই যেন তার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর পরে হীপ মি. উইকফিল্ডকে বলল, আর, মিসেস স্টং-এর সাথেই কিনা আপনার আদরের মেয়ে অ্যাগনেসের অমন গলায় গলায় ভাব! ভেবে দেখুন একবার। এই যে কপারফিল্ড, ডক্টরের সঙ্গে এখানে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন, তিনিও নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন মিসেস স্ট্রং-এর এসব কাজ কারবার।
ওরে শয়তান! ক্রোধে গর্জে উঠলাম আমি। তোর ঘৃণ্য চক্রান্তে কোন্ সাহসে তুই আমাকে জড়াচ্ছিস! বলে আর সহ্য করতে না পেরে প্রচণ্ড চড় মারলাম হীপের গালে। সে পিছিয়ে গেল চড় খেয়ে। আমার হাতের আঙুল জ্বালা করে উঠল। জাহান্নামে যা তুই! বলে ছুটে বেরিয়ে গেলাম ওই বাড়ি থেকে।
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ধরে লক্ষ করলাম যে স্ট্রংদের একদা-সুখী পরিবারে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। ডক্টর স্ট্রং দৃশ্যত বুড়িয়ে গেছেন। অ্যানির মুখে সারাক্ষণ একটা আহত ভাব, চোখে অশ্রুর আভাস। নীরব হয়ে গেছে বাড়িটা।
একমাত্র মি. ডিক এলেই অবস্থাটা একটু সহজ হয়ে ওঠে। তিনি ডক্টরের সঙ্গে বাগানে পায়চারি করেন। মিসেস স্ট্রং-এর সঙ্গে আলাপ করেন। দুজনের মধ্যে তিনি যোগসূত্র হয়ে দাঁড়ালেন। এমন হওয়া অন্য কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না।
উইকফিল্ডদের এখানে থাকা কালে উরিয়া হীপ তার খাস কেরানী মি. মিকবারের কাছ থেকে ব্যবসা-সংক্রান্ত অনেকগুলো চিঠি পায়। এ সময় হঠাৎ মিসেস মিকবারের একটা চিঠি পেয়ে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তাঁর স্বামী ইদানীং তাদের সাথে মন খুলে কথা বলছেন না। কিছু যেন লুকোতে চাচ্ছেন। তার এবং বাচ্চাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। এক সময় তিনি ছিলেন প্রেমময় স্বামী, স্নেহময় পিতা। অথচ এখন হয়ে পড়েছেন নিরুত্তাপ এবং কঠোর। এতে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন মিসেস মিকবার। উপদেশ চেয়েছেন আমার কাছে। কিন্তু আমি কি উপদেশ দেব? একমাত্র সংযত থাকতে এবং ধৈর্যশীল হতে বলা ছাড়া?
তাঁর চিঠি ভাবিয়ে তুলল আমাকে।
১৪. আমার বাচ্চা-বৌ
আমার বাচ্চা–বৌ
সপ্তা, মাস, বছর গড়িয়ে গেল। আইনগতভাবে আমি সাবালক হলাম, অর্থাৎ আমার একুশ বছর পূর্ণ হলো। আমার আর ভোরার বিয়ে হয়ে গেল।
ঘর-সংসার সম্পর্কে একজোড়া পাখির বাচ্চাও বোধহয় আমাদের দুজনের চাইতে কম জানে না। একজন পরিচারিকা রেখেছিলাম। কিন্তু তাকে সামলাতে গিয়ে আমরা হিমশিম খেলাম। ডিনার দিতে তার দেরি হয়ে যায়, কিংবা দেয়ই না। মাংস থেকে যায় একদম কাচা, কিংবা পুড়ে ছাই। আমাদের রূপোর বাসনপত্র যায় উধাও হয়ে। তাকে কিছু বলা কিংবা শাসানি দেয়ার মত শক্ত হতে পারে না ডোরা।
অগত্যা, প্রিয় ডোরার সঙ্গে ঝগড়া না করে আমাদের অগোছাল সংসারের সব ঝামেলা নিজের কাঁধেই তুলে নিলাম। ডোরা হেসে খেলে দিন কাটাতে লাগল।
দাদীর সঙ্গে ভোরার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। মিস বেটসি এসব সাংসারিক ব্যাপারে আমাকে ধৈর্যশীল হবার উপদেশ দিলেন। আমি তাকে বললাম সংসার কিভাবে চালাতে হয় সে ব্যাপারে ভোরাকে উপদেশ দিতে। তিনি অস্বীকার করলেন।
এখনও সময় হয়নি। সবে তো শুরু। তুমি বিয়ে করেছ একটি পরমা সুন্দরী মেয়েকে। মেয়েটির হৃদয়ভরা ভালবাসা। তোমার কর্তব্য হচ্ছে ওর ভাল গুণগুলো দিয়ে ওকে বিচার করা। যে-গুণ ওর নেই সেগুলো দিয়ে নয়। তুমি ওর মধ্যে ওসব গুণ বিকাশের চেষ্টা করো। তোমার ভবিষ্যৎ তোমাদের দুজনের মধ্যে-তোমাদের সমস্যা নিজেদেরকেই সমাধান করতে হবে।
দাদীর উপদেশের জন্য তাকে ধন্যবাদ দিলাম।
শিক্ষা ও কাজে কঠোর শ্রম দিতে লাগলাম। সন্ধ্যার অবসরে কিছু কিছু লিখতেও শুরু করলাম। আমার লেখা গল্পগুলোর বেশ কাটতি হলো। ফলে ডক্টর স্ট্রং-এর কাজটা ছেড়ে দিলাম। আমার বাচ্চা-বৌটাকে ভালবাসলেও এক এক সময় ভাবি, বৌটা চরিত্রগতভাবে যদি আরেকটু দৃঢ় হত, আমার কাজকর্মের সহযোগী হত তাহলে কি সুখীই না হতাম। কিন্তু তা তো হবার নয়। সুখী যে ছিলাম না, তা নয়। তবে যেরকম আশা করেছিলাম তেমন সুখী হতে পারিনি। কি যেন নেই, কিসের যেন অভাব। কিন্তু ডোরা সব সময় হাসিখুশি, আর আনন্দে ভরপুর।
বছর শেষ হতে না হতেই দেখা গেল যে ডোরা দুর্বল হয়ে পড়ছে। আমার বাচ্চা-বৌ নারী হয়ে উঠছে না। ওকে আগের মত হাসিখুশি দেখালেও পা দুটো ওর অবশ অচল হয়ে যাচ্ছে। এই পা দুটোই কি চঞ্চল ছিল, জি-এর চারপাশে ঘুরে ঘুরে কতই না নেচে বেড়াত। অথচ এখন ওগুলো অচল।
প্রতিদিন সকালে পাজাকোলা করে ওকে নিচতলায় নামাতে লাগলাম। প্রতিরাতে তেমনি করে আবার দোতলায় নিয়ে যাই। জিপ ঘেউ ঘেউ করে ঘুরপাক খায় আমাদের চারদিকে। আমার দাদী হয়ে গেলেন ওর নার্স। তিনি আমাদেরকে অনুসরণ করেন এক বোঝা শাল আর বালিশ নিয়ে। এখন ডোরাকে বহন করতে গিয়ে অনুভব করি যে দিনে দিনে ও হাল্কা হয়ে যাচ্ছে। একটা ভয় জাগে আমার মধ্যে। শূন্যতায় ভরে যায় মনটা।
১৫. ধন্যবাদ, মি. ডিক
ধন্যবাদ, মি. ডিক
ডক্টর স্ট্রং-এর কাজ ছেড়ে দিয়েছি অনেক দিন হলো। কিন্তু কাছাকাছি থাকি বলে প্রায়ই দেখা হয় তার সঙ্গে। উরিয়া হীপের নির্মম কথাগুলো তার হৃদয়ে আসন গেড়ে বসেছে এবং তাঁকে পীড়া দিচ্ছে অবিরাম। ক্রমেই তিনি মনমরা ও নীরব হয়ে যাচ্ছেন।
এক রাতে মি, ডিক এসে আমাকে বললেন, ট্রটউড, আমার সঙ্গে একটু কথা বলার সময় হবে তোমার?
নিশ্চয়ই, মি. ডিক।
শোনো বাবা, শুরু করলেন তিনি, তোমাকে একটা প্রশ্ন করব। আমার এদিকটা সম্পর্কে তোমার ধারণা কি? বলে তিনি তাঁর কপালটা ছুঁয়ে দেখালেন।
আমি হতভম্ব! কি জবাব দেব বুঝতে পারলাম না। তবে তিনি আমাকে সাহায্য করলেন। বললেন, আমি সহজ-সরল দুর্বল-মনা লোক। আমি যে বোকা তা আমার জানা আছে, যদিও তোমার দাদী দেখাতে চান যে আমি বোকা নই। আমি এত বেশি সহজ-সরল যে তিনি অতগুলো বছর আমার বন্ধু না হলে এবং আমার দেখাশোনা না করলে আমাকে পাগলা-গারদে আটকে রাখা হত। কিন্তু, স্যার, সহজ-সরল বোকা মানুষও আকাশে মেঘ জমলে দেখতে পায়।
কোন্ মেঘের কথা বলছেন? জিজ্ঞেস করলাম তাকে।
অ্যানি আর ডক্টর স্ট্রং-এর মাঝখানে যে মেঘ জমেছে, জবাব দিলেন তিনি। কেন এ মেঘ জমল?
যথাসম্ভব সহজভাবে ব্যাখ্যা করে তাকে বুঝিয়ে দিলাম উরিয়া হীপ কি করেছে।
কিন্তু মিস বেটসি, দুনিয়ার সবচেয়ে চমক্কার মহিলাটি এ ব্যাপারে কিছু করছেন না কেন? তুমি তো একজন বিদ্বান। তুমি কিছু করছ না কেন?
বিষয়টা খুবই নাজুক, বললাম তাকে। আমরা এতে নাক গলাতে পারি না।
ঠিক আছে, স্যার। তাহলে যে কাজটি চমৎকার ও বিদ্বান লোকেরা করতে পারে না তা আমার মত গরীব সহজ-সরল লোকই করুক। আমিই ওদেরকে মিলিয়ে দেব। নাক গলাচ্ছি বলে আমাকে ওরা দোষ দেবে না। আমি তো শুধু মি. ডিক। মি. ডিককে কেই বা পাত্তা দেয়? আমি কিছুদিন ধরে ভাবছি ব্যাপারটা নিয়ে। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে, বললেন তিনি।
সপ্তা দুয়েক এ বিষয়ে আর কিছুই শোনা গেল না। নিশ্চিত হলাম যে অস্থিরচিত্ত মি. ডিক গোটা ব্যাপারটাই ভুলে গেছেন। তারপর একদিন সন্ধ্যায় আমাদের উপস্থিতিতে মি. ডিক বিবর্ণ কম্পমান অ্যানিকে নিয়ে ডক্টরের স্টাডিতে গিয়ে ঢুকলেন।
ডক্টরের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে কাঁদতে অ্যানি বললেন, তুমি আমার স্বামী। দয়া করে মুখ খোল। চুপ করে থেকো না আর। বলো কি হয়েছে আমাদের মধ্যে।
প্রিয় অ্যানি, বললেন ডক্টর স্ত্রীর হাত ধরে, আমাদের জীবনে যে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে তার জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালবাসা আর শ্রদ্ধার কোন পরিবর্তন হয়নি।
কিন্তু কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। আমার মন বলছে। তুমি যদি তা না বললা, তবে আমার উপস্থিত বন্ধুরা বলুক কি হয়েছে, বলে অ্যানি ফিরে তাকাল মি. ডিক এবং আমাদের দিকে।
দীর্ঘ নীরবতার পর আমি দুঃখিত ও দ্বিধান্বিত ভাবে তাকে বললাম উরিয়া হীপ কি জঘন্য কথা বলেছে। আমার কথা শেষ হবার পর অ্যানি ডক্টরের হাতে চুমু দিয়ে কোমলস্বরে বললেন:
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তোমাকে বাপের মতই ভালবাসতাম। অত্যন্ত। ন্যাওটা ছিলাম তোমার। পরে তুমি যখন আমাকে বিয়ে করতে চাইলে তখন। বিস্মিত হলেও গর্ববোধ করছিলাম এই কারণে যে তুমি আমাকে নিজের জন্য যোগ্য মনে করেছ। পরে স্বামী হিসেবে তুমি আমার সাথে এত ভাল ও সদয় ব্যবহার করলে যে আমি তোমাকে ভিন্নভাবে ভালবেসে ফেললাম। আমাদের মাঝখানে আর কোন পুরুষ আসেনি কখনও। কোনদিন আমি তোমার অপমান করিনি।
অ্যানি, আমার অ্যানি, বলে কেঁদে উঠে ডক্টর জড়িয়ে ধরলেন স্ত্রীকে।
এর পর আমার দাদী মি. ডিকের দিকে ঝুঁকে তাকে চুমু দিয়ে বললেন, ডিক, অত্যন্ত অসাধারণ মানুষ আপনি। আর বোকা সাজতে চেষ্টা করবেন না, কারণ আমি জানি আপনি বোকা নন।
মি. ডিক, দাদী আর আমি স্ট্রংদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।
১৬. দুই রহস্যের জালে
দুই রহস্যের জালে
একদিন সন্ধ্যায় বেড়িয়ে ঘরে ফিরছিলাম মিসেস স্টিয়ারফোর্থের বাড়ির সামনে দিয়ে আসার সময় একজন চাকরানী ছুটে এসে আমাকে ডাকল। বলল, মিসেস স্টিয়ারফোর্থ এখন লণ্ডনের ওই বাড়িতে আছেন। তিনি আমাকে ডাকছেন। গেলাম।
এমিলিকে পাওয়া গেছে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি ক্রুদ্ধভাবে।
না, বললাম আশ্চর্য হয়ে ও কি জেমস-এর সঙ্গে নেই?
ক্রূর হাসি হেসে তিনি বললেন, আমার ছেলের কাছ থেকে সে পালিয়ে গেছে। হয়তো তাকে আর কখনও খুঁজে পওয়া যাবে না। হয়তো সে মরে গেছে।
এমিলির ব্যাপারে আপনি কি জানেন? জিজ্ঞেস করলাম। ওর পরিবার আর বন্ধুবান্ধব অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ওর জন্য।
মিসেস স্টিয়ারফোর্থ বললেন, জেমস আর তার চাকর লিটিমারের সঙ্গে সে ইওরোপে ছিল। কিছুদিন জেমস ওর মোহে আচ্ছন্ন ছিল যেসব দেশে তারা গেছে সব দেশের ভাষা ও শিখে নিয়েছিল। বলতে পারত অনর্গল। সব জায়গায় খুব প্রশংসা পেয়েছে ও। তারপর মেজাজ বিগড়ে গেল মেয়েটির। জেমস ক্লান্ত হয়ে পড়ল ওকে নিয়ে। জেমস ওকে বলল ওর উচিত তার চাকর লিটিমারকে বিয়ে করা। কারণ ওরা দুজন একই সামাজিক স্তরের লোক। লিটিমারের জিম্মায় ওকে রেখে জেমস চলে যায় ইতালীতে।
হায় এমিলি! দুঃখী মেয়ে! ওপরে ওঠার-লেডি হবার মিথ্যে মোহে, অভিজাত ঘরের ছেলের মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে ভুলে কি হেনস্তাই না হলো তোমার! ভাবলাম মনে মনে।
মিসেস স্টিয়ারফোর্থ বলে গেলেন, জেমস চলে যাবার পরে ভীষণ খেপে গেল এমিলি। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। লিটিমার বাধ্য হলো ওকে ঘরের মধ্যে তালা মেরে আটকে রাখতে। কিন্তু জানালাপথে ও পালিয়ে যায়। হয়তো সাগরে ঝাঁপ দিয়ে মরেছে। তাই করবে বলে হুমকি দিয়েছিল। মোট কথা, ও পালিয়ে গেছে। এর পরে ওকে আর কোথাও দেখা যায়নি। কোন খবরও মেলেনি ওর। জেমস এখন স্পেনের উপকূলে নৌ-বিহার করছে।
তাহলে আমাকে ডেকেছেন কেন? কি চান আমার কাছে? জিজ্ঞেস করলাম তাকে।
তোমাকে ডেকেছি হতভাগা মেয়েটি কোথায় তা জানো কিনা জিজ্ঞেস করতে। আমি চাই না আমার ছেলে ওর খপ্পরে আবার পড়ুক! ওই মেয়ে টাকাপয়সা খসাক ওর কাছ থেকে।
ম্যাডাম, বললাম ভদ্রভাবে, ছেলেবেলা থেকে এমিলির পরিবারকে আমি জানি। ওরা গরীব, সাধারণ মানুষ, একথা ঠিক। কিন্তু আমি জোর দিয়ে আপনাকে বলতে পারি যে ওই পরিবারের মেয়ে এমিলি আপনার ছেলের কাছ থেকে কখনও কিছু নেবে না। কথাগুলো বলেই আমি বেরিয়ে আসলাম ওই বাড়ি থেকে।
পরদিন সন্ধ্যায় বেরুলাম মি. পেগোটিকে খুঁজতে। তিনি সব সময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লণ্ডনে আমি তাঁকে দেখেছি রাস্তায়, প্রতিটি বাড়ির দরজায় এমিলিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
তাকে পেয়ে গেলাম জঁর ভাড়া করা ঘরটিতে। বললাম সব খবর। শুনে তার মুখটা সাদা হয়ে গেল।
ভয়ার্তকণ্ঠে তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, ও কি বেঁচে আছে মনে করেন?
হ্যাঁ, বললাম আমি। ও যদি লণ্ডনে ফিরে এসে থাকে, আমার বিশ্বাস একটি মাত্র মানুষের সঙ্গে ও যোগাযোগ করতে পারে। মানুষটি হচ্ছে ওর বন্ধু মার্থা। আমি জানি মার্থা লণ্ডনে আছে। কারণ আপনার সঙ্গে শেষ যেবার আমার দেখা হয় তখন সরাইয়ের বাইরে তাকে আমি দেখেছি।
আমিও তাকে দেখেছি রাস্তাঘাটে, বললেন মি. পেগোটি। কিন্তু এমিলি তার কাছে কেন যাবে? আমি সব সময় মনে করেছি এমিলির মেলামেশা করার উপযুক্ত মেয়ে মার্থা নয়।
এমিলি মার্থার সঙ্গে যোগাযোগ করবে এজন্য যে মার্থা বাড়ি ছেড়ে চলে আসার আগে তাকে এমিলি একবার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিল, বুঝিয়ে বললাম বুড়োকে।
আমি বোধহয় জানি কোথায় খুঁজলে মার্থাকে পাওয়া যাবে, বললেন মি. পেগোটি। চলুন যাওয়া যাক।
ব্ল্যাক ফ্লেয়ার্স ব্রিজের কাছাকাছি যেতেই মি. পেগোটি ঘুরে দাঁড়ালেন। হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলেন একটি মেয়েকে। আমরা চললাম ওর পিছু পিছু নদীর ধারে একটা নির্জন এলাকার দিকে। বুনো ঘাস, লতাপাতা, ঝোপঝাড়ে ভরা জলাময় জায়গা ওটা। এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে আছে অসমাপ্ত ও পরিত্যক্ত বাড়িঘরের কাঠামো। চারদিকে ছড়িয়ে আছে স্টীম বয়লারের টুকরো, পরিত্যক্ত পাইপ, চাকা, ফার্নের্স, মাটিতে বসে-যাওয়া নৌকা, আর রাজ্যের যত জঞ্জাল। আমার কাঁপন ধরে গেল। জায়গাটার মধ্যে ভয়ঙ্কর কিছু আছে বলে মনে হলো আমার।
যাকে অনুসরণ করছিলাম সেই মেয়েটি থামল। ওই পরিত্যক্ত জঞ্জালের মধ্যে একা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল নদীর পানির দিকে। আমি নিশ্চিত যে ও ডুবে মরতে চায়। ছুটে গিয়ে ওর বাহু ধরে ডাক দিলাম মার্থা!
চিৎকার করে উঠল সে। ধস্তাধস্তি করল নিজেকে ছাড়াবার জন্য। মি. পেগোটি ওর অন্য হাতখানা ধরে ফেললেন। শেষ পর্যন্ত ও চিনতে পারল আমাদেরকে। লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আমরা ওকে পাজাকোলা করে নিয়ে চললাম। নদী থেকে দূরে।
অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল হিস্টিরিয়া রোগীর মত। ও শান্ত হবার পর এমিলির খবর জানালাম।
মার্থা আবার কেঁদে ফেলল। বলল, আমার প্রতি সব সময় টান ছিল ওর। ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর আমি ভয় করেছিলাম লোকে ভাববে আমার সঙ্গে মেলামেশার ফলেই ও নষ্ট হয়ে গেছে। এমিলির সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্য জীবন দিতেও তৈরি ছিলাম আমি।
মি. পেগোটি তাকিয়ে ছিলেন মাটিতে বসা মেয়েটির দিকে। তিনি মার্থার শালটা জড়িয়ে দিলেন ওর গায়ে। হাত ধরে ওঠালেন। বললেন, মার্থা, আমার প্রাণের ভাইঝিকে খুঁজতে দুনিয়ার প্রায় শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গিয়েছি। আমি ওকে ভালবাসি। কিন্তু ও এখন কলঙ্কিত। মাস্টার ডেভি এবং আমার ধারণা, ও লণ্ডনে ফিরে আসবে একদিন। তুমি দয়া করে আমাদেরকে সাহায্য করো, যাতে ওকে খুঁজে পাই।
চোখ তুলে মার্থা শপথ করে বলল, আমি বিশ্বস্তভাবে এ কর্তব্য পালন করব। খুঁজে পেলে ওর সেবাযত্ন করব, সঙ্গে সঙ্গে আপনাদেরকে জানাব।
মি. পেগোটি আমার কানে কানে বললেন ওকে কিছু টাকাকড়ি দেবেন কিনা। কথাটা আমারও মনে এসেছিল। তাই পার্সটা বের করলাম। কিন্তু টাকা ও নিল। না। অনেক বুঝিয়েও টাকা নিতে রাজি করাতে পারলাম না। বললাম, ওর যা অবস্থা তাতে নিজের ক্ষমতায় এমিলিকে খোজা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু। আমাদের কারও কথায় টলল না মার্থা।
একটা কাজটাজ হয়তো পেয়ে যাব, আমি চেষ্টা করব, বলল ও।
কাজ পাওয়ার আগের জন্য অন্তত কিছু সাহায্য নাও, বললাম ওকে।
আমি যা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা পয়সার জন্য নয়। উপপাসে মরলেও এ কাজের জন্য পয়সা নিতে পারব না। আমাকে পয়সা দেয়া মানে অবিশ্বাস করা। এ কাজটি করব বলেই আমি নদীতে ডুবে মরব না। টাকা নিলে মরার সঙ্কল্প আবার আমাকে পেয়ে বসবে, বলল মার্থা।
মরার কথা মুখেও এনো না। সবাই মিলে আমরা এখনও অনেক ভাল কাজ করতে পারি।
আপনারা দয়ার বশে এ দুর্দশাগ্রস্ত জীবকে উদ্ধার করতে চান। কিন্তু বেঁচে থেকে আমার কোন লাভ হবে না। এ যাবৎ যা কিছুই করেছি তার ফল খারাপ ছাড়া ভাল হয়নি। কেবল দুর্ভাগ্যই ডেকে এনেছি নিজের ওপর। জীবনে এই প্রথমবার আপনারা আমাকে একটা কাজের মত কাজের দায়িত্ব দিলেন। এর বেশি আমি আর কিছু চাই না, জানি না।
চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেল মার্থা। কিছুদূর আমরাও গেলাম ওর পিছু পিছু।
মাঝরাতে বাড়ি ফিরলাম।
এ সময়টায় ট্র্যাডস আর আমি আতঙ্কজনক চিঠি পেতে লাগলাম মিকবারদের কাছ থেকে। তারপর একদিন মি. মিকবার নিজেই এসে হাজির হলেন। তাঁর মুখ থমথমে, চোখে ক্লান্তির ছাপ।
আমাকে আর ট্র্যাডলসকে সম্বোধন করে তিনি বললেন, ভদ্রমহোদয়রা, আপনারা আমার প্রকৃত বন্ধু, বিপদের বন্ধু। আপনারা এখন একজন বিধ্বস্ত মানুষকে দেখছেন। আমার মনে অশান্তির আগুন। আমি আত্মসম্মান হারিয়ে ফেলেছি। এবং এ সবকিছুর জন্যই দায়ী উরিয়া হীপের শয়তানী, ধোকাবাজি, জালিয়াতি আর ষড়যন্ত্র।
পাগলের মত প্রলাপ বকতে লাগলেন মিকবার। এ জীবন আমি আর রাখব! ওই নরকের কীটের চাকরি নিয়ে আমি অশুভ মায়াজালে পড়ে গিয়েছিলাম। ওই ঘণ্য সাপ হীপকে আমি টুকরো টুকরো করে ফেলব! ওই শয়তান প্রতারক ও মিথ্যকের গলা টিপে কোটর থেকে ওর চোখ বের করব। ভিসুভিয়াসের জুলন্ত লাভাস্রোত নামিয়ে আনব বদমাশ হীপের মাথার ওপর। বেঈমান হীপের মুখোশ আমি খুবই খুলব!
মি. মিকবার এতটা রেগে গেছেন যে তিনি দম নিতে পারছেন না। আমার ভয় হলো তিনি ওখানেই দম ফেটে মারা যাবেন। অবশেষে দম নেয়ার জন্য একটা চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি। আমাকে, ট্র্যাডস, দাদী বেটসি ও মি. ডিককে এক সপ্তার মধ্যে ক্যান্টারবেরির একটি হোটেলে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। হীপের চক্রান্ত ফাঁস করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি তিনি ওখানে নিয়ে আসবেন। যেমন এসেছিলেন তেমনি ঝড়ের বেগে বেরিয়ে চলে গেলেন মি. মিকবার।
১৭. মি. পেগোটির স্বপ্ন সফল হলো
মি. পেগোটির স্বপ্ন সফল হলো
মি. পেগোটি আর আমি যেদিন মার্থাকে পেয়েছিলাম নদীতীরে তার পরে অনেক মাস চলে গেছে। এমিলিকে জীবিত অবস্থায় খুঁজে পাবার আশা আমি এক রকম ছেড়েই দিতে যাচ্ছি। কিন্তু মি. পেগোটির আশা ও ধৈর্য অটল রয়ে গেল।
একদিন সন্ধ্যায় বাগানে হাঁটছি—এমন সময় মার্থা এসে হাজির হলো গেটের সামনে।
আমার সঙ্গে আসতে পারেন? বলল সে ফিসফিসিয়ে। মি. পেগোটির ওখানে গিয়েছিলাম, কিন্তু তাকে পাইনি। চিঠি রেখে এসেছি তার টেবিলে। ওতে বলে দিয়েছি কোথায় আসতে হবে। আপনি এখন আসতে পারেন?
সঙ্গে সঙ্গে বাগান থেকে বেরিয়ে গেলাম। ওর সাথে চললাম লণ্ডনের দিকে। একটা খালি কোচ যাচ্ছিল ওখান দিয়ে। ওটা ভাড়া করে ফেললাম। ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিয়ে চুপচাপ পেছনের সীটে বসে রইল মার্থা। গোল্ডেন স্কোয়ারে পৌঁছলাম। এককালের অভিজাত এলাকা এটা। এখন এই এলাকার বাড়িঘরের দাম পড়ে গেছে। গরীবদেরকে কম ভাড়ায় থাকতে দেয়া হয় এখানে। একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল মার্থা। আমাকে ইশারা করল ওর পেছন পেছন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে।, আমরা বাড়িটার ওপরতলায় উঠে গেলাম।
কারও কোন সাড়াশব্দ নেই। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে অপেক্ষা করে রইলাম আমরা। তারপর সিঁড়িতে কার যেন পায়ের শব্দ শুনলাম। মি. পেগোটির পায়ের শব্দ। তিনি দ্রুত উঠে এসে আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে ছুটে গেলেন ঘরের মধ্যে।
কাকা! বলে উঠল এমিলি নরম স্বরে।
পরক্ষণেই একটা আর্ত চিৎকার শোনা গেল। ঘরের ভেতরে তাকিয়ে দেখলাম মি, পেগোটি সংজ্ঞাহারা এমিলিকে পাজাকোলা করে দাঁড়িয়ে আছেন।
মাস্টার ডেভি, বললেন তিনি নিচু ভগ্নস্বরে, খোদাকে ধন্যবাদ যে আমার স্বপ্ন সফল হয়েছে!
অচেতন এমিলিকে বহন করে তিনি নেমে গেলেন সিঁড়ি বেয়ে।
পরদিন সকালে দাদী আর আমি বাগানে বসে আছি, এমন সময় মি. পেপগাটি এলেন। তিনি আমাকে বললেন কিভাবে এমিলি স্টিয়ারফোর্থের চাকরের হাত থেকে পালিয়ে যায়, সাগরতীরের জেলে পাড়ায় এক দয়ালু নারী কেমন করে ওকে লুকিয়ে রাখে এবং রক্ষা করে। এমিলির জ্বর হয়েছিল। কিন্তু স্ত্রী লোকটি সেবাযত্ন করে ওকে সুস্থ করে তোলে। দেহের শক্তি ফিরে আসার পর ও লণ্ডনের পথে যাত্রা করে। সামান্য টাকা-পয়সা যা ছিল সবই দিয়ে দেয় ওই দয়ালু নারীকে। মি, পেগোটির চোখ দুটি ভরে গেল অশ্রুতে। তবু বলে গেলেন, ইংল্যাণ্ডে ফিরে আসার ভাড়া জোগাড় করার জন্য ও ইতালী-ফ্রান্সের নানা হোটেলে কাজ করে। কিভাবে আমার সামনে আসবে এই ভয়ে ও অস্থির ছিল। লণ্ডনে আসার পর মার্থা ওকে দেখে ফেলে এবং জানায় যে আমি এখনও ওকে ভালবাসি।
শুনে গেলাম নীরবে। কিন্তু দাদী বেটসি কেঁদে ফেললেন। আমি মি. পেগোটিকে জিজ্ঞেস করলাম, এখন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কি চিন্তা করছেন?
আমি এমিলিকে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে আমরা নতুনভাবে জীবন শুরু করব।
কখন যাবেন ঠিক করেছেন?
ইয়ারমাউথে সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়া এবং আমার জাহাজ-বাড়িটার একটা বিলি-ব্যবস্থা হয়ে গেলেই যাত্রা করতে পারব, জবাব দিলেন তিনি। মাস্টার ডেভি, আমার সঙ্গে গিয়ে বিষয়-আশয়ের নিষ্পত্তির ব্যাপারে দয়া করে সাহায্য করবেন তো?
রাজি হলাম, যেহেতু ডোরা হাসিখুশিতে আছে এবং দাদী রয়েছেন ওর সঙ্গে।
ইয়ারমাউথে গেলাম। দেখাসাক্ষাৎ হলো পুরানো বন্ধুদের সাথে। পেগোটি আর হ্যামকে বললেন মি. পেগোটি এমিলিকে খুঁজে পাবার কথা—তার অস্ট্রেলিয়া। চলে যাবার সঙ্কল্পের কথা। অস্ট্রেলিয়া বিরাট দেশ। সেখানে কেউ জানবে না তার এমিলির কলঙ্কের কাহিনি। কেউ ওকে গঞ্জনা দিতে পারবে না।
জাহাজবাড়ির দুয়ার খোলা হলো। লণ্ডনের উকে জাহাজে তোলার জন্য বের করা হলো সব আসবাবপত্র। আমি শেষবারের মত দেখে নিলাম আমার পুরানো শোবার ঘরটি। ঘরটা খালি। সব কিছু বের করে ফেলা হয়েছে। সাগরগুল্মে সাজানো সেই ছোট্ট নীল মগটি পর্যন্ত। পুরানো কথা–অতীত স্মৃতি মনে পড়ল। আমার মায়ের বিয়ে হচ্ছিল মি, মার্ডস্টোনের সঙ্গে। পেগোটি ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাকে নিয়ে এল এখানে। এই ঘরেই আমি ঘুমাতাম। মনে পড়ল এমিলির সঙ্গে সাগরতীরে ছুটে বেড়ানোর কথা। স্টিয়ারফোর্থের কথাও ভাবলাম। ভয় হলো সে হয়তো কাছাকাছি কোথাও আছে, হঠাৎ বুঝি এসে হাজির হবে।
১৮. উরিয়া হীপের পতন
উরিয়া হীপের পতন
আমি ফিরে এলাম ইয়ারমাউথ থেকে। ক্যান্টারবেরিতে মি, মিকবারের সঙ্গে রহস্যজনক সাক্ষাৎকারের সময় হল। তাঁর আমন্ত্রণে আমরা চারজন—আমি, দাদী বেটসি, মি. ডিক আর ট্র্যাডলস। পৈৗছলাম হোটেলে। সঙ্গে সঙ্গে মি. মিকবার এসে হাজির হলেন আমাদের সামনে।
আমরা এখন ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাত কিংবা অন্য যে-কোন কিছুর জন্য প্রস্তুত, বললেন দাদী মি. মিকবারকে।
মি. মিকবার বললেন, আপনারা শীঘ্রি একটা বিস্ফোরণ দেখবেন বলে আমার বিশ্বাস। আমি কেবল এটুকু বলব যে মি. ট্র্যাডলস-এর সঙ্গে আমি পত্র বিনিময় করেছি, তিনি আমাকে সর্বোত্তম আইনগত পরামর্শ দিয়েছেন এবং সেই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করছি। আমাকে তৈরি হবার জন্য পাঁচটা মিনিট সময় দিন। তারপর চলে আসুন উইকফিল্ড অ্যাণ্ড হীপ-এর অফিসে।
পাঁচ মিনিট পরেই আমরা গেলাম। পথে একটি কথাও হলো না আমাদের মধ্যে। দেখলাম মি. মিকবার নিচতলার অফিস ঘরে বসে কিছু লিখছেন, অথবা লেখার ভান করছেন।–
কেমন আছেন, মি. মিকবার? বললাম লোক-দেখানোর খাতিরে।
বিস্ময়ের ভান করে মি. মিকবার গম্ভীরমুখে বললেন, মি. কপারফিল্ড যে! ভাল আছেন তো?
মিস উইকফিল্ড বাড়িতে আছেন? জানতে চাইলাম আমি।
মি. উইকফিল্ড বাতের জ্বরে শয্যাশায়ী, তবে মিস উইকফিল্ড যে পুরানো বন্ধুদের দেখে খুশি হবে এতে সন্দেহ নেই। আসুন, স্যার, ভেতরে আসুন, বলে তিনি আমাদেরকে নিয়ে গেলেন ডাইনিং রূমে। সুরেলা গমগমে কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, মিস ট্রটউড, মি. ডেভিড কপারফিল্ড, মি. টমাস ট্র্যাডলস এবং মি. ডিক্সন!
ডাইনিং রূমে তাঁর গলার শব্দ শুনে উরিয়া হীপ এল ব্যাপার কি দেখতে।
ডক্টর স্ট্রং-এর বাড়িতে সেই চড় মারার পর থেকে উরিয়া হীপের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। আমাদেরকে দেখে বিস্মিত হলো সে। ঐ কোঁচকায়নি, কারণ। ভ্র বলতে কিছু তার নেই। তবে কপালটা এমনভাবে কোঁচকাল যেন চোখজোড়া। প্রায় বন্ধ হয়ে গেল তার। ঘামে চটচটে হাতের তালু যেভাবে তাড়াতাড়ি থুতনিতে চাপা দিল এতে মনে হলো বিচলিত হয়েছে সে। মিনিট খানেক পরে সামলে উঠে সে বলল:
তাই তো! কি আনন্দের কথা! পুরানো বন্ধুরা সবাই এসেছেন! মি কপারফিল্ড, আশা করি ভাল আছেন। মিসেস কপারফিল্ডও আশা করি ভাল। আছেন।
আমার হাতটা ধরে ঝাকুনি দিল সে। আমার লজ্জা লাগল তাকে আমার হাত ধরতে দিতে।
মিস ট্ৰটউড, আমি যখন এখানে সামান্য একজন কেরানী ছিলাম, আপনার ঘোড়া ধরে রাখতাম, তার পর থেকে এ অফিসের কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। তাই না? কিন্তু আমি বদলাইনি, মিসট্রটউড।
আমার দাদী জবাব দিলেন, আপনার মধ্যে তখন থেকে যে উদ্যম দেখা গিয়েছিল সেটা অক্ষুন্ন রয়েছে।
ধন্যবাদ, মিস ট্রটউড। মিকবার! মিস অ্যাগনেস আর মাকে খবর দিন। মা কি খুশিই না হবেন এঁদেরকে দেখে।
আপনি ব্যস্ত নন তো, মি. হীপ? প্রশ্ন করলট্র্যাডলস।
উরিয়া হীপ তার চেয়ারে বসে হাতের তালু দুটি জোড়া করে দুই হাঁটুর মধ্যে রেখে জবাব দিল, না, মি.ট্র্যাডস। তবে জানেন তো, আইনজীবী, হাঙর, আর জোঁক সহজে সন্তুষ্ট হয় না! আমার যে ব্যস্ততা নেই তা নয়। মি. উইকফিল্ড অসুস্থ। তাই আমার ও মিকবারের হাতে প্রচুর কাজ। কিন্তু তার জন্য কাজ করা আমার কর্তব্য। মি. ট্র্যাডল্স, আমি বোধহয় এই প্রথম আপনার সাথে পরিচিত হবার সৌভাগ্য লাভ করলাম?
অ্যাগনেস এসে প্রবেশ করল ডাইনিং রূমে। লক্ষ করলাম অ্যাগনেস আসতে হাসি ফুটল উরিয়ার মুখে।
মিকবার, আপনি এখন যেতে পারেন, বলল উরিয়া।
মি. মিকবার উরিয়ার চোখে চোখ রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দরজার মুখে।
দাঁড়িয়ে আছেন কেন, মিকবার? আপনার থাকার দরকার নেই বলেছি, শোনেননি?
শুনেছি।
তাহলে কেন দাঁড়িয়ে আছেন?
আমার ইচ্ছে হয়েছে, তাই, বললেন মি. মিকবার গলায় ঝাঁঝ মিশিয়ে।
সবাই জানে আপনি একটা অসংযত লোক। আপনাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে হবে দেখছি। ঠিক আছে, যান, পরে কথা বলব আপনার সঙ্গে, বলল উরিয়া জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে।
প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়ে মি. মিকবার বললেন, দুনিয়াতে যদি কোন পাষণ্ড থাকে যার সঙ্গে আমি ইতিমধ্যেই বড় বেশি কথা বলে ফেলেছি, সেই পাষণ্ডের নামহীপ!
উরিয়া হেলে পড়ল চেয়ারের পিঠে। যেন কোন বিষাক্ত সাপের ছোবল খেয়ে, বা আকস্মিক আঘাত পেয়ে। তারপর ধীরে ধীরে চারদিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বলল, ওহ্-হো, এটা তাহলে একটা ষড়যন্ত্র! আগে থেকে পরিকল্পনা করেই আপনারা এখানে এসে মিলেছেন! আমার কেরানীর সঙ্গে যোগসাজশ করেছেন, তাই না, কপারফিল্ড? কিন্তু সাবধান! এতে আপনার কোন লাভ হবে না। আমার উন্নতি দেখে আপনার ঈর্ষা হচ্ছে, তাই না? কিন্তু আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কিছু হবে না। আমি পাল্টা ষড়যন্ত্র করব আপনাদের বিরুদ্ধে মিকবার, চলে যান। পরে আলাপ করব।
মি. মিকবার, এই লোকটার থোতা মুখটা ভোঁতা করে দিন, বললাম আমি।
গলার স্বর একই রকম রেখে উরিয়া বলল, আপনারা তো সাংঘাতিক লোক! আমার কেরানীকে কিনে ফেলা! লোকটা সমাজের আবর্জনা! তুমি ও কপারফিল্ড, অন্যের আশ্রয় পাবার আগে আবর্জনাই ছিলে। কি সাহস তোমার মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমার মানহানি করতে এসেছ? মিস ট্রটউড, এসব থামান। নইলে আমি আপনাকেও দেখে নেব। মিস উইকফিল্ড, বাপের জন্য দয়ামায়া থাকলে এই দলে যোগ দেবেন না! নইলে আপনাকে সর্বস্বান্ত করব আমি। মিকবার! ধ্বংস হয়ে যেতে না চাইলে আরেকবার ভেবে দেখো। এখনও তোমার সময় আছে পিছিয়ে যাবার। একটু পরেই আলাপ হবে আমাদের। মা কোথায়?
হঠাৎ সে লক্ষ করল যে কোন ফাঁকে বেরিয়ে গিয়ে ট্র্যাডলস ওর মাকে নিয়ে ঘরে ঢুকছে। আঁতকে উঠল সে।
মিসেস হীপ এখানে আছেন, স্যার। আমি নিজেই পরিচয় করে নিয়েছি তাঁর সঙ্গে, বলল ট্র্যাডলস।
আপনি কে পরিচয় করে নেয়ার? কি চান আপনি এখানে? জিজ্ঞেস করল উরিয়া।
ট্র্যাডলস শান্তভাবে বলল, আমি মি. উইকফিল্ডের এজেন্ট এবং বন্ধু। তিনি আমাকে সকল বিষয়ে তার হয়ে কাজ করার জন্য ওকালতনামা (পাওয়ার অভ অ্যাটর্নি) সই করে দিয়েছেন।
বুড়ো গাধাটা মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে আছে। জালিয়াতি করে ওর সই নেয়া হয়েছে, বলল উরিয়া বিশ্রীভাবে মুখ খিচিয়ে।
ট্র্যাডলস বলল, জালিয়াতি করে তার কাছ থেকে যে কিছু নেয়া হয়েছে তা আমিও জানি, আপনিও ভাল করেই জানেন, মি. হীপ। আমরা এ ব্যাপারে মি. মিকবারের বক্তব্য শুনব।
উরিয়া হীপ বরাবর অতি বিনয়ী ও বশংবদ ভাব দেখাত। কিন্তু ওটা ছিল তার মুখোশ। এখন এক মুহূর্তে মুখোশটা সে খুলে ফেলল। তার হিংস্র, উদ্ধত, ঘৃণ্য মূর্তি প্রকাশ পেল।
আমাকে তীব্র হিংসাপূর্ণ দৃষ্টিতে বিদ্ধ করে সে আবার বলল, নিজেকে ভদ্রলোক বলে জাহির করো। লজ্জা করল না আমার কেরানীর সঙ্গে গোপনে যোগসাজশ করতে? ঠিক আছে। আমিও দেখে নেব। ষড়যন্ত্রের অভিযোগে, তোমাকে জড়াব। এখন কি-যে-আপনার নাম, মিকবারকে কি প্রশ্ন করবেন বলেছিলেন। করুন না। চুপ করে আছেন কেন?
মি. মিকবার সামনে এগিয়ে এলেন। তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে পকেট থেকে একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজে লেখা দলিল বের করে পড়তে লাগলেন। ওটা হচ্ছে একখানা চিঠি। আমার দাদী এবং আমাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে মি. মিকবার লিখেছেন। এতে তিনি অভিযোগ করেছেন যে উরিয়া হীপ মি. উইকফিল্ডের সই জাল করে তার টাকা সরিয়েছে। হীপের কেরানী হিসেবে মি. মিকবার জানেন যে হীপ মিথ্যে নকল খাতাপত্র ও হিসেব রাখে। ভুয়া বিল তৈরি করে মি. উইকফিল্ডের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। তার চিঠি থেকে আমরা আরও জানলাম যে আমার দাদীর টাকা-পয়সাও হীপই মেরে দিয়েছে। তিনি টাকা দিয়েছিলেন মি. উইকফিল্ডকে, লগ্নী করার জন্য। উরিয়া প্রচার করে, যে ব্যাঙ্কটি ফেল মেরেছে ওটাতে টাকাটা লগ্নী করেছিল। আসলে টাকাটা সে রেখে দিয়েছে নিজের কাছে।
উরিয়া ঝাপ দিল চিঠিটা মি. মিকবারের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু মি. মিকবার বাড়ি মেরে তার হাতটা সরিয়ে দিলেন।
ট্র্যাডলস বলল, চোরাই টাকা ফেরত দাও, হীপ, এবং মি. উইকফিল্ডের সঙ্গে তোমার অংশীদারিত্বের দলিলটি ছিড়ে ফেল।
না, কখনো তা করব না! চিৎকার করে বলল হীপ।
তাহলে তোমাকে হয়তো জেলে যেতে হবে, বলল ট্র্যাডস। কপারফিল্ড, পুলিশ ডেকে আনেনা।
আমি যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম, থাম! গর্জন করে বলল হীপ। আমি সবই দিয়ে দেব।
ভাল কথা! বললট্র্যাডলস। এখন নিজের ঘরে যাও। আমরা সব কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখার আগে বেরুবে না ওখান থেকে।
এতদিনে মি. মিকবার বিবেকের দংশন থেকে মুক্ত হলেন। হীপের চাকরি করতে এসে বিবেকের দংশনে অস্থির ছিলেন। এ কারণে পরিবারের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করছিলেন তিনি। এখন আবার সুখী মানুষ হিসেবে ফিরে গেলেন পরিবারের কাছে। কাজের সন্ধানে নতুন কোন শহরে চলে যেতে চাইলেন। আমার দাদী তাকে বললেন মি. পেয়গাটি আর এমিলির সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যেতে। মি. মিকবারের সততার গুণে দাদী তার খোয়ানো টাকা-পয়সা সব ফেরত পাবেন। তিনি মিকবারদের অস্ট্রেলিয়া যাবার ভাড়াটা দিতে চাইলেন। এতে দারুণ খুশি হলেন মি. মিকবার।
১৯. মৃত্যু আর নীরবতা
মৃত্যু আর নীরবতা
বহুদিন ধরে অসুস্থ ডোরা। আমার বাচ্চা-বৌ যে এত সহসা ছেড়ে যাবে আমাকে তা কি আমি জানতাম? ডাক্তাররা বলেছিলেন আমাকে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি।
এক রাতে ও আমাকে বলল যে এটাই হয়তো ভাল। আমি ছিলাম ছোট্ট বাচ্চা। বয়সের দিক থেকে নয়, মনের দিক থেকে। অভিজ্ঞতার দিক থেকে। বৌ। হবার যোগ্যতা আমার ছিল না। কিসে তোমার আনন্দ, কিসে তোমার সুখ তা, বোঝার মত বুদ্ধি আমার ছিল না।
আমি কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ডোরা, প্রিয় ডোরা, তোমাকে নিয়ে আমি অনেক অনেক সুখী হয়েছি। ওরকম কথা তুমি বোলো না।
সে রাতে ডোরা অ্যাগনেসকে দেখতে চাইল। অ্যাগনেসকে সে ভয় করত। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল অ্যাগনেস-এর মত মেয়েকে ফেলে আমি ওকে বিয়ে করলাম কেন। হেসে বলেছিলাম, তোমাকে দেখামাত্রই প্রেমে না পড়ে পারিনি যে! অ্যাগনেস এল খবর পেয়ে। আমি বসে রইলাম নিচে আগুনের ধারে। আমার ভালবাসার দুই নারী আলাপ করতে লাগল একান্তে। জিপ আমার পায়ের কাছে বসে কুঁই কুঁই করতে লাগল ওপরে, ডোরার কাছে যাবার জন্য।
আজ রাতে নয়, জিপ, বললাম তাকে।
কুকুরটি আমার পায়ের কাছে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল…কেঁদে উঠল কেউ করে…তারপর মরে গেল হঠাৎ!
সেই মুহূর্তে অ্যাগনেস নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে ছুটতে ছুটতে। মুখটা ওর শোকে-দুঃখে কাতর। দুই হাত আকাশের দিকে তোলা। শেষ হয়ে গেছে সব। আমার প্রিয় ডোরা, প্রাণের ডোরা, আমার বাচ্চা-বৌ আর নেই।
ভাবলাম আমার জীবনও শেষ হয়ে গেল। কবরই আমার একমাত্র আশ্রয়। কিন্তু দাদী বললেন কিছুদিন আমার বিদেশে কোথাও বেরিয়ে আসা উচিত। রাজি। হলাম। কিন্তু হীপ-এর চূড়ান্ত বিনাশ দেখা এবং মিকবার ও পেগোটিদের বিদায়ের আগে গেলাম না।
ক্যান্টারবেরিতে ফিরে এলাম আমরা। উইকফিল্ডদের বাড়ি গিয়ে দেখলাম খাতাপত্র আর কাগজের স্তুপের পেছনে বসে আছে ট্র্যাডলস। ট্র্যাডলস আমাদেরকে বলল যে মি. ডিক সারাক্ষণ যত্ন নিচ্ছেন মি. উইকফিল্ডের ৷ তিনি। এখন অনেকটা সুস্থ। প্রায় আগের মত হয়ে উঠেছেন। ট্র্যাডলস হিসেব করে দেখেছে নিজের ব্যবসা ও বিষয়-সম্পত্তি রক্ষা করার মত প্রচুর টাকা মি. উইকফিল্ডের থাকবে।
আর, মিস ট্রটউড, মি. মিকবারের মুখেই তো শুনেছেন যে আপনার টাকা লগ্নীও করা হয়নি, হারায়ওনি। উরিয়া গায়েব করে রেখে দিয়েছিল।
উরিয়া হীপ যে বিদায় নিয়েছে এজন্য আমি খোদাকে ধন্যবাদ দিলাম।
ডোরার মৃত্যুর খবর শুনেই ভগ্ন-হৃদয় পেগোটি আমার কাছে চলে এসেছিল কিছুদিন কাটিয়ে যাবে বলে। হ্যামের ব্যাপারে আলাপ হলো আমাদের। সেদিনই সন্ধ্যায় তাকে দেখার জন্য ইয়ারমাউথে যাব বলে স্থির করলাম। সে হয়তো চাইবে আমাকে দিয়ে এমিলিকে একটা চিঠি লেখাতে।
সাগর তীরের শহরটির দিকে যেতে যেতে বাতাসের গতিবেগ বাড়তে লাগল। শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়। ঝড়ের প্রবল তোড়ে বালি, পাথর উড়তে লাগল। মুষলধারে নামল বৃষ্টি। বিরাট বিরাট উে তুলে সাগর ছুটে আসছে সগর্জনে। বুঝিবা গ্রাস করবে শহরটাকে। তবু দেখলাম, দলে দলে লোক ছুটে চলেছে সাগরতীরের দিকে।
কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করলাম চেঁচিয়ে।
একটা স্কুনার (পালের জাহাজ)! তীরের কাছেই! দেখতে চাইলে শিগগির আসুন! স্পেন থেকে আসছে স্কুনারটি। যে কোন মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে!
ছুটে গেলাম তীরে। দেখলাম স্কুনাবটিকে। বন্দুকের গুলির মত তীব্র বেগে আসছে তীরে আছড়ে পড়ার জন্য।
একটি মাস্তুল ভাঙা। পালগুলো জড়িয়ে গেছে দড়িদড়া আর মাস্তুলে। জাহাজটি দোল খাচ্ছে ভয়ঙ্কর ভাবে। প্রচণ্ড আক্রোশে ফুলে ফেঁপে গর্জে উঠে। সাগর ছুঁড়ে ফেলল স্কুনারটিকে তীরবর্তী ফেনিল তরঙ্গের মধ্যে। জাহাজটি ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। একটি লোককে ক্ষণিকের জন্য দেখা গেল পাল আর দড়িদড়ার স্তূপ থেকে বেরিয়ে আসতে। পরক্ষণেই স্কুনারটি কাৎ হয়ে গেল। ( কারও সাহস হলো না ওই উত্তাল সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়ে ডুবন্ত লোকটিকে বাচাতে এগিয়ে যাবার। তারপর হঠাৎ লক্ষ করলাম হ্যামকে। জনতার ভিড়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে সে চলেছে সাগরের দিকে আমি ছুটলাম তার পিছু পিছু। দুহাতে। ধরে চেষ্টা করলাম তাকে আটকাতে। কিন্তু পারলাম না। সে যাবেই। মাস্তুল আঁকড়ে যে লম্বা কালো-চুলো লাল টুকটুকে টুপি পরা লোকটি বাঁচার চেষ্টা করছে ওকে সে উদ্ধার করবেই।
আমার দুহাত ধরে সে বলল, মাস্টার ডেভি, মরণ যদি এসে থাকে তবে আসুক। যদি না এসে থাকে, আমি বাঁচব। খোদা আপনার ভাল করুক!
হ্যামের কোমরে একটা দড়ি বাঁধা। সে ঝাঁপ দিল সাগরে। কিন্তু একটা প্রকাণ্ড ঢেউ তাকে পেছনে ছুঁড়ে দিল। আঘাত পেয়েছে সে। দেখলাম তার মুখে রক্ত। কিন্তু আবার সে ছুটে গেল জাহজ-ডুবির ওই জায়গাটার দিকে। একেবারে কাছাকাছি চলে গেল সে। কিন্তু সেই মুহূর্তে পাহাড়-সমান উঁচু এক ঢেউ এসে। তলিয়ে দিল স্কুনারটিকে! তীরের লোকেরা দড়ি ধরে টেনে হ্যামকে এনে ফেলল আমার পায়ের কাছে। হ্যাম মৃত।
তাকে আমরা নিয়ে গেলাম নিকটবর্তী বাড়িতে। আমি বসে রইলাম হ্যামের প্রাণহীন দেহের পাশে। একজন জেলে এল আমার কাছে। আমি আর এমিলি। যখন বাচ্চা ছিলাম তখন থেকেই আমাকে চেনে নোকটা।
কাঁপা কাঁপা স্বরে সে বলল, স্যার, আমার সঙ্গে একটু বাইরে আসবেন কি?
আমার হঠাৎ মনে পড়ল মাস্তুল আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টায় রত সেই নাবিকটির কথা।
আতঙ্কিত হয়ে জেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কি তীরে এসেছে?
হ্যাঁ।
আমার পরিচিত কেউ?
সে জবাব দিল না। কিন্তু আমাকে নিয়ে চলল তীরের দিকে। সাগরতীরের যে জায়গায় শৈশবে আমি আর এমিলি ঝিনুক কুড়াতাম সেখানে দেখলাম একজন লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে বালুর ওপর মাথা রেখে। স্কুলে তাকে আমি প্রায়ই দেখেছি ওভাবে শুয়ে থাকতে। লোকটা জেমস স্টিয়ারফোর্থ!
ওরা একটা খাটিয়া নিয়ে এল। তাকে শুইয়ে দিল খাটিয়ার ওপর। যারা তাকে বয়ে নিয়ে চলল তারা সবাই তাকে চেনে। তার সঙ্গে পাল তুলে সাগরে গেছে। তার হাসি আনন্দে শরিক হয়েছে
সে রাতেই লাশটা আমি নিয়ে গেলাম লণ্ডনে। শুইয়ে দিলাম তার মায়ের ঘরে। মিসেস স্টিয়ারফোর্থ স্থির বসে রইলেন শক্ত হয়ে। দুচোখ মেলে চেয়ে রইলেন ছেলের লাশের দিকে। গোঙাতে লাগলেন অস্ফুট স্বরে। কিন্তু এ ছাড়া তার মধ্যে জীবনের আর কোন লক্ষণ দেখলাম না। আমি তার একটা হাত তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরলাম। আমার মনে হলো গোটা পৃথিবী যেন ভরে গেছে মৃত্যু আর নীরবতায়।
২০. অ্যাগনেসের কাছে প্রত্যাবর্তন
অ্যাগনেসের কাছে প্রত্যাবর্তন
পেগোটি আর আমি বন্ধুদেরকে বিদায় দিতে গেলাম। মি. পেগোটি মার্থাকেও অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যাচ্ছেন দেখে দারুণ খুশি হলাম আমি। দুই দুটি মৃত্যুর বিষয়ে কিছুই জানালাম না ওদেরকে। কারণ ওদের বিদায়ের আনন্দকে আমরা মাটি করে দিতে চাইনি।
কয়েক দিন পরে আমিও ইংল্যাণ্ডের বাইরে চলে গেলাম। তিন বছর ধরে ঘুরে বেড়ালাম দেশে দেশে। আর লিখলাম। গল্পগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করার জন্য ট্র্যাডস-এর কাছে পাঠিয়ে দিলাম। আমার স্বাস্থ্যের উন্নতি হলো। সিদ্ধান্ত নিলাম এবার দেশে ফিরব।
তিনটি বছর বিদেশে থাকার পর স্বদেশের টান প্রবল হয়ে উঠল আমার মনে। অ্যাগনেসের টানও বটে। এ তিন বছর ধরে ও আমাকে চিঠি লিখেছে। আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। সান্ত্বনা দিয়েছে। ছোট মেয়েদের জন্য ও যে স্কুলটি খুলেছে তার কথা জানিয়েছে। এ তিন বছরে ওর কথা যতই ভেবেছি ততই উপলব্ধি করেছি ওকে আমি কত বেশি ভালবাসি এবং আমার প্রতি ও কত সদয়। আমার আশা, খুব বেশি দেরি করে ফেলিনি, হয়তো ও বিয়ে করে ফেলেনি। কাউকে।
হেমন্তের এক হিমেল রাতে লণ্ডনে এসে নামলাম। পরদিন কোচে চড়ে ডোভারে গেলাম আমার দাদীকে দেখতে। তিনি সেখানে তার পুরানো কটেজে ফিরে গেছেন। তিনি, মি. ডিক আর পেগাটি চোখে আনন্দের অশ্রু নিয়ে অভ্যর্থনা করলেন আমাকে।
সন্ধ্যার পরে আমরা যখন একা হলাম তখন দাদী জিজ্ঞেস করলেন, এখন বলো তো, টুট, উইকফিল্ডদের দেখতে আমরা কখন যাব?
আশা করি আগামীকাল, জবাব দিলাম কিন্তু ওমানে অ্যাগনেস বিয়ে করেনি তো?
তুমি যতদিন বাইরে ছিলে ততদিনে ইচ্ছে হলে ও বিশবার বিয়ে করতে পারত। কিন্তু তা করেনি। তবে আমার সনেই এই যে, এমন একজন কেউ আছে যাকে ও বিয়ে করবে, বলে ধূর্ত হাসি হাসলেন তিনি।
সেক্ষেত্রে আমি জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয়ই অ্যাণনেস আমাকে বলবে লোকটা কে?
পরদিন সকালে আমি চলে গেলাম! অ্যাগনেসকে দেখে দারুণ খুশি হলাম। কিন্তু ও কি বলবে তা ভেবে ভয় হলো আমার মনে। আমরা আমার ভ্রমণ এবং পেগোটিদের বিষয়ে আলোচনা করলাম! শেষমেশ জিজ্ঞেস করলাম, তোমার খবর কি? তুমি কেমন ছিলে এতদিন?
একটুখানি হেসে অ্যাগনেস বলল, বাবা ভাল আছেন। আমাদের বাড়ির পরিবেশ শান্ত ও আনন্দময়। এর বেশি আর কিছু বলার নেই।
কেবল এটুকু? আর কিছুই নেই বলার মত?
মাথা ঝাঁকিয়ে ও জানাল যে সত্যি বলার মত আর কোন ঘটনাই ঘটেনি ওর জীবনে।
আমি তোমাকে জানাতে চাই অ্যাগনেস, সারা জীবন আমি তোমার দিকে তাকাব। সারা জীবন তোমাকে ভালবাসব বরাবরই ভালবেসে এসেছি তোমাকে। কিন্তু এখন তোমাকে মুখ খুলতেই হবে। অন্যের কাছে শুনেছি, তুমি নাকি কাউকে
ভালবাস এবং বিয়ে করবে। কথাটা কি সত্যি?
অ্যাগনেস কেঁদে ফেলল। আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বসল। আমার যদি কোন গোপন কথা থাকে তবে তা এত বছর যেমন ছিল তেমনি গোপনই। থাকুক আমার মনে। আমি তা প্রকাশ করতে পারব না, বলল সে।
এত বছর ধরে! বলো কি! চেঁচিয়ে উঠে টেনে নিলাম ওকে বুকের মধ্যে। হঠাৎ বুঝতে পারলাম যে বহু বছর ধরে আমাকে ভালবেসে এসেছে অ্যাগনেস! প্রিয় অ্যাগনেস! আমি কি তাহলে বিশ্বাস করব যে…।
প্রিয় ট্রটউড, একটা কথা আমাকে বলতেই হচ্ছে—যা কখনও মুখ ফুটে বলতে পারিনি। আজীবন আমি তোমাকেই ভালবেসেছি।
এখন আমাদের চাইতে সুখী আর কে আছে? দুজনে গেলাম দাদীর কাছে। তাকে বললাম আমাদের পরস্পরের ভালবাসার কথা। দাদী এত খুশি হলেন যে আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে কেঁদে ফেললেন। পেগোটি আর মি. ডিক ছুটে এলেন বারান্দায়, দাদী আলিঙ্গন করলেন দুজনকে।
অ্যাগনেস আরেকজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছে বলে তিনি কি মজা করেছিলেন আমার সঙ্গে?
পনেরো দিনের মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেল আমার এবং অ্যাগনেসের। বিয়ের পরে অ্যাগনেস আমাকে বলল যে মৃত্যুর আগে ডোরা ওকে ডেকে পাঠিয়েছিল শুধু। একটি কারণে-অ্যাগনেসকে আমার স্ত্রী হতে অনুরোধ করেছিল, এটাই ছিল তার অন্তিম ইচ্ছে।
কথাটা বলতে বলতে কেঁদে উঠল অ্যাগনেস। আমিও কাঁদলাম, যদিও দুজনেই তখন আমরা সুখের সাগরে ভাসছি।
২১. অস্ট্রেলিয়ার অতিথি
অস্ট্রেলিয়ার অতিথি
আমি একজন খ্যাতিমান এবং ধনী লেখক হয়ে গেলাম। অ্যাগনেসের সঙ্গে জীবনটা আমার হয়ে উঠল আনন্দময়।
আমাদের বিয়ের দশ বছর পূর্ণ হলো। আমি আর অ্যাগনেস বসে আছি আমাদের লণ্ডনের বাড়িতে, আগুনের পাশে। আমাদের তিন বাচ্চা খেলছে ঘরের মধ্যে। এমন সময় একজন চাকর এসে আমাকে বলল যে জনৈক অপরিচিত লোক দেখা করতে চায় আমার সঙ্গে।
লোকটা কি কোন দরকারে এসেছে? জিজ্ঞেস করলাম।
না, জবাব দিল চাকরটি। তিনি একজন বৃদ্ধ। চাষীর মত দেখতে। আমার বাচ্চারা এর মধ্যে রহস্যের গন্ধ পেল।
তাকে নিয়ে এসো, বললাম ওকে।
একজন স্বাস্থ্যবাদন পাকা চুলঅলা বুড়ো এসে দাঁড়ালেন দরজার মুখে।
এ যে মি. পেগোটি! বলে চেঁচিয়ে উঠে অ্যাগনেস ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে।
পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের পর আমরা বসলাম আগুনের পাশে। আমার বাচ্চারা চড়ে বসল তার কোলে।
আমি তো আর জোয়ান হচ্ছি না, বললেন তিনি। তাই এ তেরো বছর ধরে কেবলই ভেবেছি থুথুরে বুড়ো হয়ে যাবার আগে একবার এসে মাস্টার ডেভিকে দেখে যেতে হবে।
বললাম, এখন আমাদেরকে বলুন, বলুন সবকিছু। আমাদের বন্ধুরা সবাই কেমন আছে অস্ট্রেলিয়ায়?
প্রথম দিকে আমাদের সবাইকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে, জানালেন তিনি। এখন আমাদের ভেড়ার খামারের বেশ উন্নতি হয়েছে।
আর, এমিলি? একসাথে জিজ্ঞেস করলাম আমি এবং অ্যাগনেস।
হ্যামের মৃত্যুর খবর আমি জেনেছিলাম একজন ইংরেজের কাছে। আমি খবরটা বছরখানেক এমিলিকে জানতে দিইনি। ও জানল এক বছর পরে। কিছুদিন খুব মনমরা হয়েছিল। তবে খামারের কাজে ব্যস্ত থাকার ফলে আঘাতটা সামলে ওঠে। বিয়ে করার সুযোগ অনেক এসেছে ওর কাছে। কিন্তু ও বলে, কাকা, সেসব আর হবে না। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে, রোগীর সেবা করে, আর ওর প্রিয় কাকার সেবাযত্ন করেই দিন কাটায় মেয়েটি, বললেন মি. পেগোটি।
মার্থার কি হলো? জানতে চাইলাম। একটি চমৎকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে ওর। ছেলেটি চাষী। এবার শেষ খবরটি বলুন। মি. মিকবারের কি হলো? জিজ্ঞেস করলাম।
তিনি কয়েক বছর চাষ-আবাদ করেছেন। কিন্তু এখন তিনি আমাদের শহরের ম্যাজিস্ট্রেট। সবাই তাকে অত্যন্ত সম্মান করে।
মি. পেগোটি এক মাস থাকলেন আমাদের সাথে। অস্ট্রেলিয়ায় ফেরার আগে হ্যামের কবর দেখতে ইয়ারমাউথে যেতে চাইলেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। আমি কবর-ফলকে উৎকীর্ণ বাণীটি লিখে দিলাম তাকে। তিনি নিচু হয়ে এক গোছা ঘাস তুলে নিলেন কবর থেকে।
এমিলির জন্য, বললেন তিনি ঘাসগুলো পকেটে ভরে। ওকে কথা দিয়েছিলাম, মাস্টার ডেভি। গ্রেট এক্সপেকটেশানস
২২. সুখ
সুখ
আমার গল্পের এখানেই শেষ। এই তো আমার দাদী। চোখে চশমা পরা। বয়স আশির ওপরে। তবু শীতের দিনেও একটানা হাঁটেন ছয় মাইল। তিনি এখন একটি আসল বেটসি ট্রটউডের, আমার মেয়ের, ধর্ম-মা। এতে তার মনে আর আনন্দ ধরে না।
এই যে আসছে পেগোটি, দাদীর সারাক্ষণের সঙ্গী। ওর ফোলা ফোলা গাল চুপসে গেছে, শরীর শুকিয়েছে, কিন্তু আমার বাচ্চাদের দুরন্তপনা সামলাতে সে সদা তৎপর। পেগোটির বগলে মোটা কি একটা আছে। সেই কুমিরের বইটি। এখন অবশ্য অত্যন্ত জীর্ণ দশা ওটার। আজকাল আমার বাচ্চারা ওকে ক্ররকিনডিল-এর গল্প পড়ে শোনায়।
এখন গরমের ছুটি। আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গে এক বুড়োকে দেখছি। বড় বড় ঘুড়ি বানাচ্ছেন, আকাশে উড়িয়ে মহানন্দে দেখছেন। বাচ্চারা তাঁকে ঘিরে হাততালি দিচ্ছে, নাচছে। মি. ডিক আগের মতই আছেন।
ডক্টর স্ট্রং এখনও লিখে যাচ্ছেন তার অভিধান। তিনি আমাদের একজন প্রিয় বন্ধু।
আমার বাতি নিভে আসছে। অনেক রাত পর্যন্ত লিখেছি। আমার সুন্দরী বৌ বসে আছে পাশে। বাচ্চারা গভীর ঘুমে।
বহু বছর ধরে এ সুখই আমি চেয়েছিলাম।
Leave a Reply