ডেভিড কপারফিল্ড – ১১

১১. আমার প্রিয় ডোরা

আমার প্রিয় ডোরা

পেগোটির ইয়ারমাউথে ফিরে যাবার সময় হলো। এমিলির খোঁজে চলে যাবার পর থেকে ভাইয়ের কোন খবর সে পায়নি। এখন বাড়ি যেতে চায় হ্যামের। দেখাশোনার জন্য। কোচে ওঠার আগে সে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য করল যে আমার যদি কখনও টাকার দরকার হয় আমি যেন তার কাছে যাই। বললাম, যাব।

তাকে বিদায় দিয়ে গেলাম ভোরাদের বাড়িতে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম কপর্দকহীন একটা ভিখারিকে ও ভালবাসতে পারবে কিনা। কারণ, আমি এখন তাদেরই একজন। ঝাকড়া চুল দুলিয়ে ও হাসল।

ডোরার ছেলেমানুষী আমার খুবই মিষ্টি লাগে। তবু ওকে ব্যাপারটা বোঝানো দরকার। কিন্তু ডোরা, আমার লক্ষ্মীটি, তোমার ডেভিড ফতুর হয়ে গেছে। এর পরেও কি তুমি আমাকে ভালবাস? বললাম ওকে।

নিশ্চয় বাসি! বলল সে উচ্চকণ্ঠে। কিন্তু ওসব গরীব হয়ে পড়া-টড়ার মত। ভয়ঙ্কর কথা আর বোলো না তো?

সত্যি বলব না, ডার্লিং আশ্বস্ত করলাম ওকে। কিন্তু তুমি যদি এখন একটা রান্নার বইটই পড়ে নাও, সংসারের হিসেবপত্র লিখতে শেখ, তাহলে আমাদের কাজে লাগবে।

আমার কথা শুনে ডোরা কান্নার মত করে চেঁচিয়ে উঠল। আমার মনে হলো ওকে বোধহয় খুন করে ফেলেছি। একটু পরে ওকে শান্ত করলাম। আমার প্রিয় ডোরা একটি সুন্দর শিশু ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তব জগৎ ও সমস্যার মুখোমুখি হতে ও ভীষণ ভয় পায়।

বিদায় নেয়ার সময় ডোরা বলল, ভোর পাঁচটায় উঠো না, বুঝলে দুষ্টু? এত ভোরে ওঠা খুব বিশ্রী ব্যাপার।

আমাকে যে কাজ করতে হয়, লক্ষ্মীটি।

তাহলে কোরো না! বলল সে।

ওই ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটিকে বোঝানো অসম্ভব যে বাঁচতে হলে আমাদেরকে কাজ করতেই হবে। ও কেবল হাসে। হেসে উড়িয়ে দেয় সব যুক্তি। আর, এজন্যই ওকে আমার এত ভাল লাগে।

পার্লামেন্টের বিতর্কের রিপোর্ট করার জন্য শর্টহ্যাণ্ড শিখতে লাগলাম। শর্টহ্যাণ্ডের মাছির পায়ের মত চিহ্ন আর রেখাগুলো আমার স্বপ্নেও হানা দিতে লাগল। মনে হলো যেন একটা নতুন বর্ণমালা শিখছি।

এ সময় একটা দুর্ঘটনা সব কিছু এলোমেলো করে দিল। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মি. স্পেনলো মারা গেলেন। ডোরা চলে গেল পুটুনিতে ওর ফুফুদের কাছে। আমি আর ওকে দেখি না।

দাদী বেটসি আমাকে ডোভার পাঠালেন তার কটেজের ভাড়াটিয়াদের দেখে আসার জন্য। সেখানে গিয়ে মনটা আমার ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।

না, কটেজে সব কিছু ঠিক আছে। কিন্তু লণ্ডনে ফেরার পথে আমি ক্যান্টারবেরিতে থামলাম অ্যাগনেস আর মি. উইকফিল্ডকে দেখার জন্য। ওই বাড়িতে উরিয়া হীপের উপস্থিতি আমার অসহ্য লাগল। প্রথম দিন বিকালে এক মিনিটের জন্যও একা পেলাম না অ্যাগনেসকে।

ডিনারের পর হীপ আর মি. উইকফিন্ডের সঙ্গে বসে ছিলাম। হীপ মি. উইকফিল্ডকে বেশি বেশি উৎসাহ দিতে লাগল মদপান করার জন্য। অতটা পান করা তার উচিত নয়। আমি বসে রইলাম নীরবে।

হঠাৎ উরিয়া হীপ বলে বসল, মি. উইকফিল্ড, আপনার অ্যাগনেসকে আমার অ্যাগনেস বানাতে চাই। আমি চাই ওর স্বামী হতে।

চিৎকার করে উঠে দাঁড়ালেন মি. উইকফিল্ড। মনে হলো ওই মুহূর্তে পাগল হয়ে গেছেন তিনি। নিজের চুল ছিড়তে লাগলেন দুহাতে। নিজের মাথায় বাড়ি দিতে লাগলেন। চোখে তার উন্মাদের দৃষ্টি, মুখ বাক্যহারা। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম যাতে পড়ে না যান।

দেখো ওকে, এই জালেমটাকে! বললেন তিনি অবশেষে, হীপের দিকে আঙুল তুলে। ও আমার সুনাম নষ্ট করেছে। কলঙ্কিত করেছে। আমার শান্তি-স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। আমার বাড়ি-ঘর পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়েছে। এখন অ্যাগনেসকে বিয়ে করবি? কখখনো না!

ওসব তো মাতালের কথা। আগামীকাল আপনি মত বদলাবেন, বলল হীপ।

ঠিক তখনি অ্যাগনেস এসে ওর বাবাকে শোয়াতে নিয়ে গেল। পরে ও এল আমার কাছে। আমি একা বসে ছিলাম। কাঁদতে লাগল অ্যাগনেস। কিন্তু কাঁদলেও খুবই সুন্দর দেখাল ওকে।

প্রিয় অ্যাগনেস, বললাম মৃদুস্বরে। তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। তোমাকে আমি খুবই ভালবাসি। উরিয়া হীপকে কখনও বিয়ে কোরো না। তোমার বাবার ব্যবসার খাতিরে কিংবা অন্য কোন কারণেও নয়। তার মত মানুষ তোমার পায়ের নখেরও যোগ্য নয়!

মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল ওর মুখে। বলল, খোদার ওপরই ভরসা রাখতে হবে আমাকে।

ফিরে আসলাম বাড়িতে। ডোরার ফুফুদেরকে চিঠি লিখে জানতে চাইলাম আমি দেখা করতে যেতে পারি কিনা। জবাব এল, হ্যাঁ, শনি-রবিবারে।

দিনগুলো সুন্দর হয়ে উঠল আমার জন্য। কাজে এবং লেখাপড়ায় মন-প্রাণ ঢেলে দিলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম শনি-রবিবারের জন্য।

কিন্তু ডোরার ফুফুরা ওকে খেলার পুতুল বানিয়ে ফেলেছেন দেখে খুবই খারাপ লাগল আমার। ও কখন কি চায় তা দেয়ার জন্য তারা এক পায়ে খাড়া হয়ে আছেন। ওর চুলে বিনুনি বাধছেন। অলঙ্কার পরাচ্ছেন ওকে। ডোরা এতে খুশি। কিন্তু ওকে এরকম বাচ্চা বানিয়ে ফেললে আমাদের মিলিত জীবনের জন্য তা মোটেই সহায়ক হবে না।

ডোরা একদিন আমাকে বলল ওকে একটা রান্না শেখার বই দিতে এবং সংসারের হিসেবপত্র কেমন করে রাখতে হয় তা শিখিয়ে দিতে। আমি অত্যন্ত খুশি হলাম। কিন্তু পরে দেখা গেল রান্নার বই পড়তে গেলে ওর মাথা ধরে এবং হিসেবের অঙ্কের যোগফল মেলে না বলে ওর কান্না পায়।

তাই বইগুলোর স্থান হল ঘরের কোণে। ডোরা ওর কুকুর জিকে ট্রেনিং দিয়েছে এই দুটোর ওপর দাঁড়িয়ে খেলা দেখাতে। এতে ও এমন আমোদ পাচ্ছে যে আমি খুশি হলাম বইগুলো কিনেছি বলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *