০৮. একটা পেশা বেছে নিলাম
একটা পেশা বেছে নিলাম
পরদিন আমি আর স্টিয়ারফোর্থ বিদায় নিলাম ইয়ারমাউথ থেকে। পেগোটি ও তাদের পরিবার, সাগরের অনেক মাঝি মাল্লা-যারা বন্ধু হয়ে গিয়েছিল স্টিয়ারফোর্থের—সবাই মিলে বিদায় জানাল আমাদেরকে।
কিছুক্ষণ কোন আলাপ হলো না স্টিয়ারফোর্থ আর আমার মধ্যে। তারপর স্টিয়ারফোর্থ বলল, বেড়ানো-টেড়ানো তো হলো, কি করবে ভেবেছ কিছু?
তেমন করে কিছু ভাবিনি। তবে মনে করেছিলাম প্রক্টর (ব্যবসার নায়েব) বা এজেন্ট হব, জবাব দিলাম।
স্টিয়ারফোর্থ তখন আমাকে প্রক্টরদের সম্পর্কে, ওদের পেশা সম্পর্কে যা যা জানে সব বলল।
সেদিনই আমরা বিদায় নিলাম পরস্পরের কাছ থেকে। স্টিয়ারফোর্থ গেল হাইগেটে, আমি গেলাম লণ্ডন। দাদী বেটসি তখন লণ্ডনের এক হোটেলে ছিলেন।
হোটেলে গিয়েই দাদীকে বললাম আমার পরিকল্পনার কথা। কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছে প্রক্টর ট্রেনিং-এর খরচ অনেক পড়ে যাবে।
আমার হাত দুটি নিজের হাতে নিয়ে নরম সুরে তিনি বললেন, ট্রট, তোমার দুর্ভাগা বাপ আর বেচারি মা যখন বেঁচে ছিল তখন হয়তো ওদের প্রতি আমি আরেকটু সদয় হতে পারতাম। তুমি যখন ছোট্ট ছিলে তখন তোমার প্রতিও। এখন দুঃখ করে লাভ নেই। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি আশা করেছিলাম। তুমি আরেক জন বেটসি হয়ে জন্মাবে। তুমি জন্মালে ডেভিড হয়ে। কিন্তু সেই হতাশার ধাক্কা অনেক আগেই আমি কাটিয়ে উঠেছি। তার পরে ট্রট, তুমি এলে আমার কাছে। তোমার ভালবাসা, তোমার মমতা পেলাম। তোমাকে এর প্রতিদান দেয়ার ক্ষমতা এই বৃদ্ধার নেই, বাছা। বলতে বলতে দাদীর দুচোখ ভরে গেল অশ্রুতে।
আমি তাকে ধন্যবাদ দিলাম। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন তিনি।
পরদিন আমরা যাত্রা করলাম দাদীর প্রক্টর বা এজেন্ট স্পেনলো অ্যাণ্ড জোর্কিনস্-এর অফিসে। ওদের ওখানে শিক্ষানবিশ প্রক্টরের একটা জায়গা খালি আছে। ওরা আমাকে পরীক্ষামূলকভাবে এক মাসের জন্য নিতে রাজি হলো।
তারপর দাদী আর আমি বেরুলাম আমার জন্য একটা আসবাবপত্রে সাজানো ঘরের খোঁজে। পেয়েও গেলাম নদীর দিকে মুখ করা এক বাড়ির দোতলার একটা ফ্ল্যাট।
খুশি হলাম অমন চমৎকার একটা ঘরের এক বাসিন্দা হয়ে। দারুণ লাগল। পকেটে ঘরের চাবি নিয়ে শহরে ঘুরে বেড়াতে। শুধু রাতের বেলায় বড় একা লাগে নিজেকে। ইচ্ছে হয় কারও সঙ্গে কথা বলতে। মনে পড়ে অ্যাগনেস-এর কথা। উইকফিল্ডদের বাড়িতে কাটানো দিনগুলোর কথা। মন কেমন করে অ্যাগনেসের জন্য!
পরদিন একটা চিঠি পেলাম অ্যাগনেসের। বাবা আর উরিয়া হীপের সাথে সে লণ্ডনে এসেছে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। সেদিন বিকেলেই তাড়াতাড়ি করে চলে গেলাম ওদের হোটেলে।
সাদর অভ্যর্থনা পেলাম ওর কাছে। কিন্তু ওকে যেন কি নিয়ে একটু চিন্তিত মনে হলো। পরে অ্যাগনেস আমাকে বলল যে উরিয়া হীপ ওর বাবাকে রাজি করিয়েছে তাকে তার ব্যবসার অংশীদার করে নিতে। অ্যাগনেস প্রথমে ভেবেছিল যে হীপের সাহায্য পেলে ওর বাবার খাটুনি-উদ্বেগ কমবে। কিন্তু এখন ওর ভয় হচ্ছে যে হীপ বুড়ো মানুষটির দৈহিক অসামর্থ্যের সুযোগ নিচ্ছে। মি. উইকফিল্ডকে যেন হীপ সম্পূর্ণভাবে মুঠোয় পুরে ফেলেছে।
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল অ্যাগনেস। আমি যথাসাধ্য সান্তনা দিলাম। মি. উইকফিন্ড আর হীপ যখন এসে আমাদের সঙ্গে ডিনারে বসলেন ততক্ষণে অ্যাগনেস অনেকটা সামলে উঠেছে। সন্ধ্যায় অ্যাগনেস ওর বাবাকে শোয়াতে নিয়ে যাবার পরে হীপ আমাকে কয়েকটা চমকপ্রদ খবর দিল। বলল, সে অ্যাগনেসের প্রেমে পড়েছে এবং ওকে বিয়ে করতে চায়। তার কথা শুনে আমার ইচ্ছে জাগল, ফায়ারপ্লেস থেকে আগুনে পোড়া লাল তপ্ত লোহার শিকটা তুলে নিয়ে তাকে ওটা দিয়ে গেঁথে ফেলি। আমার প্রিয় অ্যাগনেসকে বিয়ে করবে এই হতচ্ছাড়া? কখখনো না! আমি তা কোনক্রমেই হতে দিতে পারি না। তাছাড়া, আমার সন্দেহ। হলো যে তার অ্যাগনেসকে বিয়ে করতে চাওয়ার কারণ প্রেম নয়। এ রকম হতচ্ছাড়া প্রাণীর পক্ষে কাউকে ভালবাসা সম্ভব নয়। না, তার মতলব উইকফিল্ডদের ব্যবসাটা হস্তগত করা। তার সঙ্গ অসহ্য হয়ে উঠল আমার কাছে। অ্যাগনেস ফিরে আসতেই আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
আমার নতুন মনিব মি, স্পেনলো এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আমাকে তার গ্রামের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। তার ফার্মে চাকরি পাওয়া উপলক্ষে। সেখানে আমার দেখা হলো তার মেয়ে ডোরার সঙ্গে। দুনিয়ার সেরা রূপসী। দেখা মাত্রই প্রেমে পড়ে গেলাম। ছুটির দিনটা হয়ে উঠল আমার জীবনের সেরা দিন, সুন্দরতম দিন।
দিনশেষে ফিরে এলাম লণ্ডনে। আমার প্রশিক্ষণ চলতে লাগল। ব্যবসাসূত্রে পরিচিত কয়েকজন বন্ধুর আমন্ত্রণে একদিন ওদের বাড়িতে গেলাম। ওদের মুখে একজনের নাম শুনলাম। নামটা পরিচিত মনে হলো—মি. ট্র্যাডলস।
আমার মন উড়ে গেল সালেম হাউসের স্কুল জীবনে। ওরা কি সেই টমি। ট্রালস্-এর কথা বলছে? পিঠে সাবধান, ও কামড়ায় লেখা বোর্ড ঝুলানো অবস্থায় যে আমাকে অন্য ছেলেদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল? স্টিয়ারফোর্থকে গল্প শোনাবার সময় নানা রকম শব্দ করে যে আবহসঙ্গীত সৃষ্টি করত সেই ট্যালস্? অতিথিদের মধ্যে আমি খুঁজতে লাগলাম মি. ট্র্যাডলসকে। একজন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল এক কোণে দাঁড়ানো এক তরুণ ভদ্রলোকের প্রতি। তাই তো! সেই মাথা ভর্তি কঁকড়া চুল, সেই বিস্ফারিত চোখ। টমিই বটে!
ছুটে গেলাম ওর দিকে। পরিচয় দিলাম নিজের। কি খুশিই না হলে সে আমাকে দেখে। পরদিনই ওর বাড়িতে যাব বলে আমরা পরিকল্পনা করলাম।
ও যে রাস্তার নাম লিখে দিয়েছিল সেখানে পৌঁছে দেখলাম রাস্তাটা খারাপ, অপরিষ্কার, ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। আমার মনে পড়ল মি. ও মিসেস মিকবারের সঙ্গে এক সময় এরকম রাস্তায় এক বাড়িতে আমি থাকতাম।
ট্র্যাডলস অপেক্ষা করছিল সিঁড়ির গোড়ায়। উচ্ছ্বসিত আনন্দে সে আমাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেল ওর ছিমছাম সুন্দর ছোট্ট ঘরটিতে। আমরা মি, ক্রীকলএর স্কুলের পুরানো দিনের গল্প করলাম। তারপর থেকে এতদিন কে কি করেছি। জানালাম একে অপরকে। টমির মা-বাবা নেই। যে চাচার কাছে থাকত তিনিও মারা গেছেন। ওর জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি। এখন কষ্টেসৃষ্টে আইন। পড়ছে। ছোটখাট কাজকর্ম করে পেট চালাচ্ছে। সোফি নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করবে বলে সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দুনিয়ায় সোফির চাইতে প্রিয় আর কেউ ওর নেই। কিন্তু আর্থিক অবস্থার কারণে বিয়েটা হতে পারছে না। কতদিন ওদেরকে অপেক্ষা করতে হবে কে জানে।
আমি ভাবলাম, আহা, ওর তো বিয়ের বাগদান হয়ে গেছে! আমার যদি হত ডোরার সঙ্গে! হিংসে হলো আমার টমিকে।
টমি বলে গেল, আমার রোজগার বেশি নয়। তবে খরচও বেশি করি না। নিচের তলার পরিবারটির সাথে খাওয়া-দাওয়া করি। মি. ও মিসেস মিকবার খুব অভাবি মানুষ। দারিদ্র-যাতনা অনেক সয়েছেন।
কি নাম বললে? মিকবার? আমি তাদেরকে ভাল করেই চিনি। চলো, নিচে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করি, বললাম আমি।
দুপদাপ করে নেমে গেলাম সিড়ি দিয়ে। সম্ভাষণ জানালাম মি. ও মিসেস মিকবারকে। প্রথমে তারা চিনতে পারলেন না আমাকে। আমি নিজের পরিচয় দেয়ার পর পারলেন। আনন্দে আবেগে অভিভূত হলেন তারা দুজন। আমাকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানালেন। দেখলাম তারা আগের মতই দরিদ্র। হঠাৎ আরেকটি বাড়তি মুখে খাবার জোগানো কঠিন হবে তাদের পক্ষে। তাই বললাম যে ডিনারের সময় পর্যন্ত থাকা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। চট করে একটা তারিখ ঠিক করে আমিই টমি আর মিকবারদের ডিনারে আমন্ত্রণ করলাম।
নির্দিষ্ট দিনে আমার ডিনার পার্টি হলো। ভালই চলল পার্টি। যথাসময়ে বিদায় নিল আমার অতিথিরা। আগুনের পাশে বসে ভাবতে লাগলাম নতুন করে খুঁজে
পাওয়া পুরানো বন্ধুদের সাথে কি সুখেই না কাটল সময়টা। হঠাৎ সিড়িতে দ্রুত পায়ের শব্দ শুনলাম। দরজা খুলে গেল হুস করে। দেখা গেল জেমস স্টিয়ারফোর্থ দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে!
স্টিয়ারফোর্থ বলল সে ইয়ারমাউথ থেকে এসেছে। ওখানে সে তার ন.. নৌকায় চড়ে সাগরে বেড়িয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আমার বন্ধুদের।
স্টিয়ারফোর্থ বলল, এমিলি আর হ্যামের বিয়ে এখনও হয়নি। আর গাড়ি চালক বার্কিস খুবই অসুস্থ। মনে হয় বাঁচবে না বেশিদিন।
তাহলে আমাকে এখনি পেগোটির কাছে যেতে হবে। ওর স্বামীর শেষ সময়ে আমার থাকা দরকার ওর পাশে। সান্ত্বনা দেয়া দরকার ওকে।
স্টিয়ারফোর্থ বলল, আমার সঙ্গে হাই গেট-এ চলো না প্রথমে। আমি ওখানে যাচ্ছি। মা-কে দেখিনি অনেক দিন। একবার দেখে যাই। নইলে আবার কবে বাড়ি যাব কে জানে!
তার আমন্ত্রণটা অদ্ভুত মনে হলো আমার। তবু রাজি হলাম তার সঙ্গে যেতে।
ইয়ারমাউথে যাবার পথে থামলাম হাই গেট-এ, তাদের বাড়িতে। মিসেস স্টিয়ারফোর্থের সহচরী মিস ডার্টল আরও অদ্ভুত ভঙ্গিতে আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনিই কি সেই মানুষটি, যে জেমসকে এতদিন ধরে বাড়িতে আসতে দেয়নি?
সত্যি, বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম প্রশ্নটা শুনে। জবাব দিলাম, স্টিয়ারফোর্থের ব্যাপার-স্যাপার আমি কিছুই জানি না। কোথায় সে থাকে, সময় কাটায় তা-ও আমার জানা নেই। অনেক দিন পরে গত রাতেই প্রথম দেখা হয়েছে তার সঙ্গে।
প্রশ্নোত্তরের এ সময়টায় স্টিয়ারফোর্থ তীক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল আমার দিকে। ভাবলাম, তার মনে কিছু একটা আছে। কিন্তু সেটা কি তা সে বলল না।
সে রাতে শুতে যাবার আগে তাকে বললাম যে পরদিন ভোরে সে জেগে ওঠার আগেই আমি বিদায় নেব। সে আমার কাধ চেপে ধরল এমনভাবে, যেন যেতে দিতে চায় না আমাকে। ডেভিড, কোন কারণে কোনদিন যদি বিচ্ছেদ ঘটে আমাদের, আমাকে মন্দ ভেবো না। আমার ভাল দিকগুলো মনে রেখো, বলল সে।
জবাব দিলাম, তোমার সবচেয়ে ভাল সবচেয়ে খারাপ বলে কিছু নেই। তোমাকে আমি প্রিয় বন্ধু হিসেবেই সব সময় ভালবাসব। আমার এ কথাগুলোও যে অদ্ভুত, বিচ্ছেদের কথাই বা সে কেন তুলল, এসব আমি ভাবলাম না। পেগোটির জন্য দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে আমার মন।