১.১৪.১১ বনদুর্গার পূজা

প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – বনদুর্গার পূজা

মাঘ মাস পড়বার সাথে সাথেই পল্লীবাংলার বিশেষ করে যশোহর, নদীয়া ও চব্বিশ-পরগণার কোনো কোনো অঞ্চলে বালক বালিকারা শুরু করে দেয় ‘বনদুর্গার’ পূজা। তবে এর জন্য তৈরী হতে থাকে প্রায় দশ বার দিন আগে থাকতেই। এই সময় মধ্যে তারা প্রচুর পরিমানে পূজার ফুল সংগ্রহ করে। ফুলই বনদুর্গা পূজার প্রধান উপকরণ। যে কোনো ফুল দিয়েই এ পূজা হতে পারে। কয়েক বাড়ি বা ঘরের ছেলে মেয়ে মিলে এক একই ছোট দল তৈরী করে নেয় নিজেদের ভিতর। তারপর তারা নিজেদের পূজার জন্য একটি বেদী তৈরী করে। মাঘ মাসের পয়লা থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতিদিন অতি ভোরে এবং সন্ধ্যায় দলের ছেলে মেয়েরা এসে ঘিরে বসে সেই বেদী মণ্ডপ। তারপর তারা শুরু করে পূজা। এই পূজায় পুরোহিতের কোনো দরকার নেই, তারা নিজেরাই পুরোহিত। এ পূজার মন্ত্রও কিছু নেই। কেবল কতকগুলি ছড়া—এর প্রায় সবগুলিই তাদের নিজেদেরই তৈরী। এর ভিতর একাধারে তাদের সাংসারিক খবরাখবরের কাহিনী, রাধা-কৃষ্ণ, হর-গৌরীর কাহিনী সব কিছুই পাওয়া যায়।

ভোরবেলা সূর্য উঠবার এখনও অনেক দেবী (কারণ, সূর্য উঠলে আর পূজা হবে না) ছেলে মেয়েরা সব বেদীর চারদিক ঘিরে বসে শুরু করে বন্দনা গাইতে :—

উঠরে উঠরে সূজ্জ্য উদয় দিয়া,
বায়ণ বাড়ির পাছ দিয়ে।
বায়নের মেয়েরা বড়ই সিয়ানা,
পৈতা জোগায় লো অতি বিয়ানা।

এরপর একে একে বলে যায় অনেক ছড়া। পূর্বেই বলেছি এসব ছড়ার ভিতর নির্দিষ্ট কোনো নীতি বা রীতি নেই। এর ভিতর একাধারে বিয়ের ছড়া থেকে বিরহের সব কিছুই থাকা সম্ভব। যতক্ষণ না সূর্য উদিত হয় ততক্ষণ এইভাবে ছড়ার পর ছড়া বলতে থাকে, তারপর যে যার ঘরে চলে যায়। আবার সবাই এসে জোটে সন্ধ্যা বেলা। এইবার ধূপ, দীপ সব জ্বালিয়ে দেয় সেই বেদীর উপর। হাতের ফুল ছিটাতে ছিটাতে তারা আবার শুরু করে ছড়া বলতে। একে বন্দনা গীতিও বলতে পারেন :—

সাজ এসরে সাঁজনা গীতি।
ক্যানরে সবে এত রাই।।
বাড়ির কাছে ভাঙা বন।
তাই ভাঙ্‌তি এতক্ষণ।।
এক কড়ার ঘুটি মুচি দুই কড়ায় ঘি।
সাজ পরদীপ লাগাল বয়ণগের ঝি।।
বায়ণ ঝি, বায়ণ ঝি বলে আলাম তোরে।
তোর গৌরাঙ্গের বিয়ে শনি মঙ্গল বারে।।

এ ছাড়া আরতিত ছড়াও আছে আলাদা। প্রদীপ হাতে নিয়ে ছেলে মেয়েরা বেদীর সুমুখে আরতি করতে করতে সমস্বরে ছড়া গায় :—

গঙ্গা পার করহে, না করিলে পার।
হাতের বাজু বাঁধা থুয়ে মারব সাঁতার।।
সকল সখি পার করিতে লাগবে আনা আনা।
রাধিকারে পার করিতে লাগবে কানের সোনা।।
আমরাতো গোপের মেয়ে সোনা কথায় পাব।
হাতের বেসাতি ভাসে গেলি উপোস করে রব।।
নলোক দেবে, বাজু দেবে, দেবে কানের ফুল।
তবেই না নিয়ে যাব ওপারেরি কূল।।

পাঠকগণ নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন এ ছড়ার সঙ্গে বনদুর্গার কোথাও কোনো সম্পর্ক মাত্রই নেই। এ পূজাও যেমনি বালকদের তেমনি এ ছড়াগুলিও প্রায়ই তাদের রচনা। তারা বুড়ো-বুড়িদের মুখে রামায়ণ মহাভারত ও পুরাণের কাহিনী যেরূপ শোনে সেগুলিই তারা ছড়ার আকারে এখানে পরিবেশন করে।

বনদুর্গার পূজার তাৎপর্য সম্পর্কে যতটুকু যানা যায়, এ পূজা করলে নাকি ফোঁড়া, পাঁচড়া প্রভৃতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এর সঙ্গে পূর্ববঙ্গের, ‘পাঁচড়া পূজা’ এবং পশ্চিমবঙ্গের ‘ঘেঁটু’ পূজার বেশ সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে। এই প্রসঙ্গে বনদুর্গার প্রণাম মন্ত্রটি লক্ষ্য করা যাক। এর ভিতর দেখা যায় এঁকে বলা হয়েছে, ‘হে দেবতা (ঠাকুর) তুমি ফোঁড়া, পাঁচড়া প্রভৃতি নিয়ে চলে যাও, আবার যখন আসবে তখন টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় নিয়ে এসো’ :—

এবার যাওরে ঠাকুর ফোট পাঁচড়া নিয়ে।
আবার এসো ঠাকুর শঙ্খ শাড়ি নিয়ে।

এই ভাবে গোটা মাঘ মাসটা পূজা করবার পর সংক্রান্তির দিন বিকালে ছেলেরা মহা উল্লাসের সাথে সেই বেদীতে সঞ্চিত এক মাসের ফুল, দূর্বা গুছিয়ে নিয়ে নিকটস্থ কোন জলাশয়ে বিসর্জ্জন দিয়ে আসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *