১.১৪.০৭ ইতু পূজা

প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – ইতু পূজা

অগ্রাহয়ণের সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এই একটা মাস প্রতি রবিবার ভোরে বাসী বিছানায় বসে পশ্চিমবঙ্গের পুরনারীদের দেখা যায় ইতুপূজা করতে। ইতু শস্যের দেবী। একটি মাটির সরার উপর মাটির ঘট বসাতে হয়। এই মাটির ঘটই হলো ইতু ঘট। ঘটটি পূর্ণ করা হয় দুধ দিয়ে। ঘটের মধ্যে দেয় কল্‌মী ফুল ও আম্ রপল্লব; তাছাড়া সরার উপর পুঁতে দেওয়া হয় ধানের শীষ, যবের শীষ, কল্‌মীলতা, কচু গাছ। এই ব্রত না করে ব্রতীরা জল খায় না।
ইতু পূজার উদ্দেশ্য হলো সংসারের সুখ ও ঐশ্বর্য কামনা। পূর্ববঙ্গে একেই বলে ‘চুঙ্গির ব্রত’। চুঙ্গি অর্থে চোঙ্গ। সেখানে ঘটের পরিবর্তে বাঁশের চোঙ্গ ব্যবহার করা হয়—এইমাত্র পার্থক্য। সাধারণতঃ ব্রতী নিজেই এই ব্রতের ছড়া বলে সেদিনের মতো ব্রত সাঙ্গ করে।
কোথাও কোথাও পাড়া-প্রতিবেশীরা একত্র হয়ে বসে একজন ইতুর ব্রত কথা বলে, আর ব্রতীরা হাতে ফুল নিয়ে বসে বসে শুনে যায় ব্রত কথা :

অষ্ট লোক পালনী মাতা সংসারের সার
জগৎ পালনে মাতা যারে অবতার।
খণ্ডিয়া পাপ দারিদ্র্য সকল
সকল বিপদে বন্ধন হয় যায় রসাতল।
তোমার মহিমা কে কহিতে পারে
তোমার মহিলা (ও গো) কে বুঝিতে পারে,
একচিত্ত হয়ে যেবা যম লোক তরে।
ধর্মরাজ বলে আয়লেন নরপতি,ব্
রাহ্মণ কুলে তারা ব্রাহ্মণে বিদ্যাবতী।
জয়া-বিজয়া তার কন্যা দুইখানি,
অরণ্য ভ্রমিয়া তারা নানা দ্রব্য আনে
প্রভাতে ভিক্ষার তরে আইলেন দ্বিজবর
বনের মধ্যে আছে এক সরোবর।
স্ত্রী সহ পুরুষ সহ কাটত বিধি
নিয়ম করিয়া তারা দিলেন তিন ডাক
আসিবারে দিব বরত বিস্তর
না আসিব দিব শাপত বিস্তর,
কর পাঠ, কর রানী, কর নমস্কার।
হাসিতে খেলিতে গেল যত নারীগণ
শনিবার সপ্তমীতে থাকিবে নিয়মে
রবিবারে ব্রতের কথা শুনিবে প্রভাতে
দুইভগ্নী ব্রত করে, করে একমনে,
দুই বোনে কথা শোনে শোনে একমনে।
কাটিলেন অশ্বারিয়া মঙ্গল আঁকিয়া
রাজা লয়ে যান হস্তে ধরিয়া।
ললাট লিখন রাজা হের বিধির ফল
কাটিল অষ্টম বুড়ি বছর অষ্টম সুফল
হাড়িকীর ব্রতের কথা হল সমাপন
যারে যা মনবাঞ্ছা করহ পূরণ।

গোটা মাস এইভাবে ব্রতকথা শুনে পৌষ সংক্রান্তির দিন সেই সরায় বসানো ঘট এবং অন্যান্য জিনিসপত্র সহ মেয়েরা দল বেঁধে যায় নদীর ঘাটে কিংবা পুষ্করিণীর পাড়ে। একে একে টুসু ভাসান দেবার মতোই তারা ভাসিয়ে দেয় তাদের যার যার ইতুর ঘট ও সরা। সাঙ্গ হয় ইতু পূজার পালা সে বছরের মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *