১০৮. সীতাকে রাবণের নিধন বার্ত্তা জ্ঞাপন ও সীতার প্রতি মন্দোদরীর অভিশাপ

পাত্রমিত্র লয়ে রাম বসিল দেওয়ানে।
সীতারে আনিতে পাঠাইল হনুমানে।।
সীতারে আনিতে যায় পবন-নন্দন।
হনুরে প্রণাম করে নিশাচরগণ।।
সবে বলে আচম্বিতে এলো হনুমান।
না জানি কাহার এবে লইবে পরাণ।।
এই কথা নিশাচরে ভাবে মনে মন।
হনুমান প্রবেশিল অশোকের বন।।
সীতারে দেখিয়া হনু নোঙাইল মাথা।
যোড়হাতে কহে বীর শ্রীরামের কথা।।
দুষ্ট নিশাচর দিল তোমারে যে তাপ।
সবান্ধবে পড়িল রাবণ মহাপোপ।।
রাম পাঠাইলেন আমারে তব পাশ।
সমাচার কহিবারে মনেতে উল্লাস।।
হনুর নিকটে শুনি এতেক কাহিনী।
আনন্দ-সাগরে ভাসে সীতা ঠাকুরাণী।।
হনুমান বলে মাতা কি ভাবিছ মনে।
শুভ কথার উত্তর না দেহ কি কারণে।।
সীতা কহে যে বার্ত্তা কহিলে হনুমান।
নাহি ধন তাহার সদৃশ দিতে দান।।
যদ্যপি তোমারে করি রাজ্য-অধিকারী।
তথাপি তোমার ধার শুধিবারে নারি।।
হনু বলে, রাজ্য ধনে নাহি প্রয়োজন।
রাজ্য ধন সব মাতা তব শ্রীচরণ।।
তবে যদি দান দিবে সীতা ঠাকুরাণী।
এই দান তব স্থানে মাগি গো জননী।।
তোমার রক্ষক আছে রাবণের চেড়ী।
আমার সাক্ষাতে তোমায় উঠাইত বাড়ি।।
করিয়াছে তোমার দুর্গতি অপমান।
এ সবার প্রাণ লব এই মাগি দান।।
দন্ত উপাড়িয়া চুল ছিঁড়ি গোছে গোছে।
আছাড়িয়া প্রাণ লব বড় বড় গাছে।।
সমুদ্রের তীরে আছে বালি খরশান।
তাতে মুখ ঘসাড়িয়া লইব পরাণ।।
শুনিয়া হনুর বাক্য যত চেড়ীগণ।
ভয়ে সব চেড়ী ধরে সীতার চরণ।।
চেড়ী সব বলে শুন সীতা ঠাকুরাণী।
হনুমান প্রাণ লয় রাখ গো আপনি।।
জানকী বলেন তুমি বিচারে পণ্ডিত।
যত দুঃখ পাই আমি কপালে লিখিত।।
মহাবীর হনু তুমি বুদ্ধে বৃহস্পতি।
স্ত্রীবধ করিয়া কেন রাখিবে অখ্যাতি।।
যতদিন ছিল চেড়ী রাবণের ঘরে।
তাহার আজ্ঞায় দুঃখ দিয়াছে আমারে।।
এখন সে সবংশেতে মরিল দশানন।
চেড়ীগণ করে এবে আমার সেবন।।
কহিবে আমার দুঃখ শ্রীরামের স্থানে।
প্রণাম করিব গিয়া রামের চরণে।।
চলিলেন হনুমান সীতার বচনে।
কহিল সকল কথা শ্রীরামের স্থানে।।
যে সীতার লাগিয়া করিলে মহামার।
সে সীতার হইয়াছে অস্থি চর্ম্মসার।।
চেড়ীর তাড়নে সীতার কণ্ঠাগত প্রাণ।
তবু রাম বিনা তাঁর মনে নাহি আন।।
এত যদি কহিলেন পবন-নন্দন।
শ্রীরাম বলেন সীতায় আনে কোন্ জন।।
এত ভাবি রঘুনাথ বিচারিয়া মনে।
সীতারে আনিতে পাঠাইল বিভীষণে।।
চলিলেন বিভীষণ রামের বচনে।
মাথা নোঙাইল গিয়া সীতার চরণে।।
বিভীষণ বলে মাতা করি নিবেদন।
তোমারে যাইতে হৈল রাম-দরশন।।
আনিল সুবর্ণ দোলা রতনে মণ্ডিত।
সীতার সম্মুখে আনি কৈল উপস্থিত।।
বিভীষণ বলে শুন জনক-নন্দিনী।
সুবর্ণ-দোলাতে আসি উঠহ আপনি।।
পর-রত্ন-আভরণ যেবা লয় চিতে।
রাম-দরশনে মাতা চলহ।।
মরিল রাবণ তব দুঃখ হৈল শেষ।
রাম-সম্ভাষণে চল করিয়া সুবেশ।।
স্নান করি পর মাতা বিচিত্র বসনে।
সোনার দোলায় চল রাম-সম্ভাষণে।।
সীতা বলে কিবা স্নান কিবা মোর বেশ।
অশোকের বনে কাটাইনু দুঃখ শেষ।।
বিভীষণ বলে কথা কহিলে প্রমাণ।
কেমনে এ বেশে যাবে রাম বিদ্যমান।।
বিভীষণের পরিবার সরমা সুন্দরী।
স্নান-দ্রব্য লয়ে সবে এল ত্বরা করি।।
সিংহাসনে বসাইল সীতা চন্দ্রমুখী।
কেহ তৈল দেয় গায়ে কেহ আমলকী।।
পিঠালি মাখায়ে কেহ অঙ্গে তুলে মলি।
রত্নের কলসে কেহ শিরে জল ঢালি।।
নেতের বসনে কেহ মুছাইছে বারি।
যতনে পরান বস্ত্র যতেক সুন্দরী।।
জানকীর রূপে তথা পড়িছে বিজলি।
কনক রচিত সীতা পরেন পাশুলি।।
রত্নেতে জড়িত বান্ধে বিচিত্র কবরী।
নানা চিত্রলেখা তাহে আছে সারি সারি।।
নয়নে অঞ্জন দিল অতি সুশোভিত।
নানা অলঙ্কার বিশ্বকর্ম্মার নির্ম্মিত।।
অঙ্গরাগ সিন্দূর দিলেক ভালে অঙ্গে।
গলেতে বিচিত্র হার মরকত সঙ্গে।।
বিচিত্র নির্ম্মাণ দিল শঙ্খ দুই বাই।
যেন পূর্ণ শশধর দেখিবারে পাই।।
লুকাইতে চাহে রূপ না হয় গোপন।
জানকীর রূপে আলো করে ত্রিভুবন।।
রত্নময় চতুর্দ্দোল যোগাইল আনি।
সানন্দে বসিলা তাহে জনক-নন্দিনী।।
ঘেরিলেক চতুর্দ্দোলা নেতের বসনে।
যাত্রা কৈলা সীতাদেবী রাম-সম্ভাষণে।।
যতনে পাতিল পথে নেতের পাছড়া।
রাক্ষসেতে দেয় পথে চন্দনের ছড়া।।
মল্লিকা মালতী পারিজাত রাশি রাশি।
পথেতে বিস্তার কৈল রাক্ষসেতে আসি।।
রাক্ষস বানরেতে বেষ্টিত চারিভিতে।
বিভীষণ অগ্রেতে সুবর্ণ-বেত হাতে।।
যতেক বানর-সেনা চারিভিতে ঘেরে।
পরস্পর দ্বন্দ্ব সীতা দেখিবার তরে।।
দেখিতে না পায় কেহ চক্ষে বহে নীর।
যতেক লঙ্কার নারী হইলা বাহির।।
বাল বৃদ্ধ যুবতী লঙ্কার যত ছিল।
সীতারে দেখিতে সবে ধাইয়া চলিল।।
না সম্বরে অম্বর ধাইয়া যায় রড়ে।
বৃদ্ধ জন দ্রুত যেতে উছটিয়া পড়ে।।
শোককুলে মগ্ন যত রাক্ষসের নারী।
দ্রুতগতি ধেয়ে চলে লজ্জা পরিহরি।।
মন্দোদরী প্রণাম করিল হেনকালে।
ধূলায় ধূসর অঙ্গ আলুলিত চুলে।।
মন্দোদরী বলে শুন জনক-নন্দিনী।
তোমা লাগি হইলাম আমি অনাথিনী।।
পুরীসহ বিনাশ করিয়া কোপগুণে।
আনন্দে চলেছ তুমি রাম-সম্ভাষণে।।
এ আনন্দ নিরানন্দ হবে অকস্মাৎ।
বিষদৃষ্টে তোমারে দেখিবে রঘুনাথ।।
যদি সতী হই, থাকে পতি প্রতি মন।
কখন আমার শাপ না হবে খণ্ডন।।
এত বলি অন্তঃপুরে গেল মন্দোদরী।
সীতা লয়ে বিভীষণ গেল ত্বরা করি।।
কিছুদূর থাকিতে না যায় চতুর্দ্দোল।
সীতা দেখিবারে বেড়ে বানর সকল।।
কনক রচিত সীতার শ্রবণকুণ্ডল।
লেগেছে তাহার ছায়া গগন মণ্ডল।।
নানা বনপুষ্পমালা আমোদিত গন্ধে।
কনক রচিত দোলা করে আনে স্কন্ধে।।
চলিলেন সীতাদেবী রাম-সম্ভাষণে।
লঙ্কার রমণী কান্দে সীতার গমনে।।
রাক্ষসের নারী সব দুঃখে অঙ্গ দহে।
রোদন করিয়া সবে জানকীরে কহে।।
সুখেতে চলেছ তুমি রাম-সম্ভাষণে।
এককালে বিধবা হইনু সর্ব্বজনে।।
তোমারে দেখিবে রাম অশুভ-নয়নে।
আমাদের বাক্য কভু না হবে খণ্ডনে।।
কান্দিতে কান্দিতে সবে নিজ ঘরে নড়ে।
রাম-সম্ভাষণে সীতা চতুর্দ্দোলে চড়ে।।
বাহির হইল দোলা লঙ্কাপুর-গড়ে।
নেতের বসনে দোলা লয়েছেন বেড়ে।।
দুই ঠাটে হুড়াহুড়ি হৈল ঠেলাঠেলি।
বহিতে না পারে বাট যত চতুর্দ্দোলী।।
রাজা হয়ে বিভীষণ ভূমে বহে বাট।
কটকের চাপ দেখি হাতে নিল ছাট।।
ছাট হাতে লইল বানর কোটি কোটি।
চারিদিকে পড়ে ছাট লাগে চট্চটি।।
ফুটিয়া গায়ের মাংস রক্ত পড়ে ধারে।
তবু দেখিবারে যায় আপনা পাসরে।।
পরিশ্রমে বিভীষণ ঘন বহে শ্বাস।
বহুকষ্টে গেল দোলা শ্রীরামের পাশ।।
বসিয়া আছেন রাম গুণের সাগর।
দক্ষিণে বসিয়া মিত্র সুগ্রীব বানর।।
বামভিতে বসিয়াছে অনুজ লক্ষ্মণ।
নিকটেতে জাম্ববান যোড়হস্তে রন।।
পথ বাহি যাইতে কটকে ঠেলাঠেলি।
ছাট মারি বিভীষণ মধ্যে করে গলি।।
কটকের দুঃখে রাম কোপ হৈল মনে।
কোপে রাম কহিলেন রাজা বিভীষণে।।
রাজার গৃহিণী হয় প্রজার জননী।
মাতাকে দেখিবে পুত্র ইহাতে কি হানি।।
কেন ঘেরিয়াছ দোলা আমিত না জানি।
কেন বা করিছ তুমি এত হানাহানি।।
দেখুক সকলে সীতা ঘুচাও ঝঞ্ঝাট।।
ঘুচাও দোলার বস্ত্র ছাড় ছাড় ছাট।
দেখুক সকলে সীতা ঘুচাও ঝঞ্ঝাট।।
যারে উদ্ধারিলাম দেখুক সর্ব্বলোকে।
সতী যে হইবে সে রাখিবে আপনাকে।।
বুঝিলেন হনুমান শ্রীরামের মন।
সীতার পরীক্ষা হেতু হয়েছে মনন।।
দেখিয়া রামের ক্রোধ ভীত বিভীষণ।
পরীক্ষা করেন কিম্বা দেন বিসর্জ্জন।।
ঘুচান দোলার বস্ত্র রাজা বিভীষণ।
করিলেন জানকী ভূমিতে পদার্পণ।।
দোলা ছাড়ি জানকী নামেন ভূমিতলে।
বিদ্যুতের ছটা যেন অবনী-মণ্ডলে।।
সীমন্তে সিন্দূর-চিহ্ন রঙ্গ বড় লাগে।
চন্দন তিলক শোভে কপালের ভাগে।।
দেখিতে সুন্দর অতি সীতার অধর।
পক্ব বিম্বফল জিনি অতি শোভাকর।।
নানা রত্ন পরিধান রূপে নাহি সীমা।
চরাচরে নাহি দেখি সীতার প্রতিমা।।
পূর্ণিমার চন্দ্র যেন উদয় গগনে।
মূর্চ্ছিত হইল সবে সীতা দরশনে।।
জানকীরে দেখে যেই সে হয় মূর্চ্ছিত।
অন্যের কি কব কথা দেবতা বিস্মিত।।
কেহ ভাবে আইলেন আপনি শঙ্করী।
শ্রীরামেরে দেখিতে কৈলাস পরিহরি।।
অন্যে বলে ত্যজিয়া বিষ্ণুর বক্ষঃস্থল।
লক্ষ্মী অবতীর্ণা বুঝি দেখিতে ভূতল।।
কেহ ভাবে আপনি সাবিত্রী মূর্ত্তিমতি।
কেহ বলে বশিষ্ঠ-গৃহিণী অরুন্ধতী।।
দেখিয়াছে সীতারে যে সেই সীতা বলে।
অন্য লোকে কত তর্ক করে রণস্থলে।।
পাদস্পর্শে পবিত্র করেন বসুন্ধরা।
বসুন্ধরা-সুতা সীতা কৃশা কলেবরা।।
উপস্থিত হইলেন সভা বিদ্যমান।
হেরিয়া হরিষে সবে হয় হতজ্ঞান।।
রামের চরণ সীতা করে নমস্কার।
করিলেন লক্ষ্মণে বাৎসল্য ব্যবহার।।
করপুটে সীতা রহিলেন সভা-স্থানে।
লক্ষ্মণ প্রণাম করে তাঁহার চরণে।।