৪১-৪৪. আমেনা যে নিতান্ত মূহ্যমান

একচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

আমেনা যে নিতান্ত মূহ্যমান হইয়া পড়িয়াছিল তাহা নহে। তবুও রায়হানের করুণ হৃদয়। তাহাকে ভুলিতে পারে নাই। আমেনার জন্য তাহার হৃদয়ে সদাই একটা বেদনার ধারা বহিয়া যায়। আমেনার সম্মুখে মন খুলিয়া প্রাণ ভরিয়া হাসিতেও তাঁহার ভয় হয়।

রায়হান মাঝে মাঝে ভাবে, এই দুঃখিনী বালিকাটির জীবনের বেদনা ও অপমানের অবসান কোথায়? তার নিজের সহৃদয়তা ও বেদনাবোধের ভিতর হয়তো কোনো গলদ রহিয়া যাইতেছে।

ঊষার কিরণ সমস্ত মাঠ ও পথকে আলোক ও গৌরবে ভরিয়া দিয়াছিল। নীল আকাশে সে আলোক, গৌরব, উল্লাস ও আনন্দে লক্ষমুখে ছুটিতেছিল।

রায়হানের পিতা দোকান-ঘরে প্রবেশ করিলেন। রায়হান সসম্মানে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“কী আব্বা? কোনো জরুরি কথা আছে নাকি?”

রায়হানের বাপ দোকানে বড় আসিতেন না। দোকানের সমস্ত কাজ রায়হানই করিতেন। বৃদ্ধ সাংসারিক কাজের কোনো ধার ধারিতেন না। টাকা পয়সার প্রয়োজন। হইলে পুত্রের নিকট হইতে চাহিয়া লইতেন। দুটি খাওয়া, পাঁচবার মসজিদে যাওয়া এবং বৈঠকখানায় শুয়ে থাকাই ছিল তাঁহার কাজ।

সকালবেলা পিতার আকস্মিক উপস্থিতিতে রায়হান একটু বিস্মিত হইলেন।

পিতা বলিলেন–“একটা বিশেষ কথা আছে বাপ। একা একা দোকানে তোমার সঙ্গে আলোচনা করবো।”

বৃদ্ধ চেয়ার টানিয়া লইয়া কহিলেন–“হুঁকোর জল বদলিয়ে একটু তামাক দেও তো বাপ।”

রায়হান আলবোলার জল বদলাইয়া তামাকে টিকা বসাইয়া পিতার সম্মুখে টেবিলের উপর রাখিলেন।

তামাক টানিতে টানিতে কেরোসিন-বাক্সের প্রকাণ্ড গাদার দিকে চাহিয়া পিতা জিজ্ঞাসা করিলেন–“কয় বাক্স তেল আছে?”

রায়হান বলিলেন–“প্রায় দুশো বাক্স।” সুজির বস্তাগুলির দিকে চাহিয়া রায়হান বলিলেন, “সুজি বাবত প্রায় ১ টাকা লোকসান হবে। জানি না, কী করে বস্তার ভিতর বালি ঢুকে সুজিগুলি পয়মাল করে ফেলেছে। ওগুলি একেবারে ফেলে দিতে হবে।”

বৃদ্ধ বলিলেন–“সুজির ভেতরে যে বালি ঢুকেছে একথা কাউকে বলো না; কে তোমার শুনতে আসবে?”

রায়হান কথা না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।

বৃদ্ধ বলিলেন–“পীর সাহেব এসেছিলেন। তিনি তাঁর কন্যাকে তোমার হাতে দিতে চান। যা স্বপ্নেও ভাবি নাই তাই হতে যাচ্ছে।”

রায়হান জিজ্ঞাসা করিলেন–“কোন্ পীর সাহেব?”

“কুসুমপুরের বড় পীর সাহেব। দেশের মধ্যে যার শ্রেষ্ঠ আসন। আমাদের দেশের কারো সঙ্গে যিনি সম্বন্ধ করেন না। দিন আমি ঠিক করে ফেলেছি। আগামী মাসের দুই তারিখ।”

একটু থামিয়া কহিলেন–“একই মেয়ে, প্রচুর সম্পত্তি লাভ হবারও সম্ভাবনা আছে”। অতঃপর রায়হানকে দোকান বন্ধ করিয়া বাড়ি যাইতে বলিয়া বৃদ্ধ নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

এই সম্মান ও সম্পদের সংবাদ রায়হানের ভালো লাগিল না। চেয়ারে বসিয়া রায়হান দুয়ারের পথে আকাশের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

আমেনার সম্মুখে এই সম্মান ও সম্পদ মানিয়া লইতে রায়হানের কাছে নিতান্ত বিশ্রী বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। আমেনার তাহার উপর বিশেষ কি দাবি ছিল? কিছু না। তবুও রায়হান সঙ্কোচে, ব্যথায় অস্পষ্ট স্বপ্নস্বরে বলিয়া উঠিলেন–এই নিরপরাধিনী বালিকার দুঃখ-অপমানের সম্মুখে কোনো স্বচ্ছন্দতা গ্রহণ করিতে পারিতেছি না।

.

দ্বিত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

কয়েকদিন চিন্তায়-চিন্তায় কাটিয়া গেল–তবে কি পিতাকে বলিতে হইবে বিবাহের কথা এখন থাক? রায়হান ভাবিলে, পিতা হয়তো তাহাতে অনেকখানি রুষ্ট হইবেন। পিতার জীবনের অনেকখানি আনন্দ হয়তো ইহার মধ্যে নিবন্ধ আছে। সন্তানের কি পিতাকে আনন্দ দেওয়াই জীবনের কর্তব্য নহে?

অকস্মাৎ এত বড় একটা দুর্ঘটনার মধ্যে পড়িতে হইবে রায়হান ইহা ভাবিয়া উঠিতে পারেন নাই। কয়েকদিন ধরিয়া রায়হান বিদ্যালয়ে কিংবা আমেনার কাছেও যান না।

মন তার বড় অবনত হইয়া পড়িয়াছে। একটা কঠিন অস্বস্তি তাহাকে ব্ৰিত করিয়া তুলিয়াছে।

পিতাকে আনন্দ দেওয়া তার কর্তব্য কিন্তু তাই বলিয়া সে তাহার স্বভাব ও আত্মার ধর্মকে অস্বীকার করিতে পারে না–তাতে যে তার মৃত্যু–তার জীবনকে একেবারে মিথ্যা করিয়া দেওয়া। জীবনের স্বপ্ন ও আকর্ষণকে চূর্ণ করিয়া কে কবে বাচিয়া থাকিতে পারে? তার পিতা কি একথা বোঝেন? সে সম্মান-সম্পদ দিয়া কী করিবে?–যদি তাতে তার জীবনের স্বপ্ন আকর্ষণ মাটি হইয়া যায়! আমেনার সম্মুখে সে কোনো স্বচ্ছন্দতা মানিয়া লইতে পারে না–অসম্ভব!

মানুষের দুঃখ বেদনা প্রাণে প্রাণে অনুভব করাতেই তার জীবনের আনন্দ। মানুষের দুঃখের মীমাংসা করাতেই তার জীবনের সার্থকতা। সুখ দিয়া কী করিবে? স্বার্থপর সুখের সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ নাই। মানুষকে ভুলিয়া সে কোনো সুখ চান না। পরের জন্য দাঃখ যদি ভোগ করিতে হয়, যদি তার জীবন কন্টকময় হয় তাতে তার বিরক্তি নাই;–তাতেই তার গৌরব; সেই গৌরবের সন্ধান করাই তার উদ্দেশ্য।

সন্ধ্যার আগে পাইকারদিগকে পঞ্চাশ মণ লবণ মাপিয়া দিয়া রায়হান খোরশেদের বাড়ির দিকে চলিলেন।

দুয়ারে দাঁড়াইয়া ছাচা আঙুল লইয়া আমেনা দাঁড়াইয়াছিল। মা নামাজ পড়িতেছিলেন। রায়হান আগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন–“আঙুল কী করে ভেঙ্গেছে?”

কথার উত্তর না দিয়া ঘরের বাতি জ্বালিয়া পাটি পাতিয়া আমেনা রায়হানকে বসিতে অনুরোধ করিল।

রায়হান আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাত ছেঁচেছে কেমন করে?”

আমেনা কহিল–“ঢেঁকিতে।”

রায়হান বলিলেন–“একখানা ঘেঁড়া ন্যাকড়া নিয়ে এস; আঙুল বেঁধে পানিপট্টি করে দি, নইলে ব্যথা বাড়বে।”

ততক্ষণে আমেনার মা নামাজ সারিয়া উঠিয়াছেন। তিনি বলিলেন–“বাবা আঙুলটা একেবারে ছেচে গিয়েছে”।

মেয়েকে বলিলেন–“বাক্সের ভিতর ধোয়া ন্যাকড়া আছে, বের করে আন, তোমার ভাইকে দিয়ে বেঁধে লও।”

রায়হান ন্যাকড়া দিয়া আমেনার আঙুলটি বাঁধিয়া পানিপট্টি করিয়া দিলেন। আমেনার মা ঘরের মধ্যে যাইয়া কতকগুলি সূতা লইয়া নাড়াচাড়া করিতে লাগিলেন।

রায়হান বলিলেন–“করিমা বুবুর সঙ্গে আজ কদিন দেখা হয় না। তিনি আজ এসেছিলেন?”

আমেনা কহিল–“সারা বিকেলবেলা তিনি এখানে কাটিয়েছেন।”

“তোমার জামাগুলি নিয়ে এস। কতদূর অগ্রসর হয়েছে দেখি।”

আমেনা তার হাতের ছাটা তৈরি জামাগুলি লইয়া আসিল। রায়হান দেখিলেন সেগুলি চমৎকার হইয়াছে–কোথায়ও একটু গলদ নাই।

রায়হান আমেনার মাকে ডাকিয়া কহিলেন–“চাচিজান, আমেনা চমৎকার জামা তৈরি করেছে। এমন সেলাইয়ের দাম প্রত্যেক জামাতে এক টাকার কম নয়।”

থালায় কতগুলি গুড়ের মুড়কি এবং কয়েকটা নাড় আনিয়া আমেনার মা রায়হানের সম্মুখে রাখিয়া কহিলেন–“আজ কতগুলি মুড়কি তৈরি করেছি–তুমি দুটো মুখে দাও।”

তারপর কহিলেন–“আমেনা যে চমৎকার সেলাই শিখেছে সে তোমারই অনুগ্রহে।”

রায়হান হাসিয়া কহিলেন–“বেশ! আমারই অনুগ্রহে! ঐ কথা বলবার দরকার কী? আমি কি আপনার পর?”

আমেনার মা বলিলেন–“পর নয় বাপ! পুত্রের চেয়েও আপন।”

তসবিহ টিপিতে টিপিতে তিনি আবার বলিলেন–“শুনলাম তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। বড় খুশি হয়েছি। বেশ বিয়ে! শুনলাম মেয়ে দেখতে পরীর মতো–বেশ মানাবে। আমি নিজে সে মেয়েকে দেখেছি।”

রায়হানের কণ্ঠ অকস্মাৎ শুষ্ক হইয়া গেল।

আমেনা সহজ কণ্ঠে কহিল–“সকলের চেয়ে বেশি আনন্দ আমার।”

মায়ের দিকে মুখ ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“বিয়ে হবার কদিন বাকি আছে মা?”

মা বলিলেন–“আগামী মাসেই দুই তারিখ।”

আমেনা কহিল–“আমার ইচ্ছে করে বিবাহের দিন ভাবিকে একজোড়া সোনার বালা উপহার দেই। আমার বালাগুলি যে গিল্টি করা–ক্যামিকেল সোনা।”

মা বলিলেন–“আমার সোনার বালা আছে–তাই দিও।”

রায়হান খানিক পানি খাইয়া জড়িত কণ্ঠে কহিল–“তোমার সেই গিল্টি করা বালাই তুমি উপহার দিও–সোনার বালায় কাজ নেই।” তাড়াতাড়ি চাচিকে সালাম করিয়া রায়হান বাহির হইয়া পড়িলেন।

আমেনার কথাগুলি কঠিন বেদনায় রায়হানের বুকের ভিতর বাজিতেছিল। কতখানি দুঃখকে জয় করিয়া আমেনা তাহাকে এই প্রীতির কথা বলিল। রায়হান ভাবিলেন–তিনি ছোট। হয়তো তার বেদনাবোধ ও সহৃদয়তার কোনো মূল্য নাই।

সেই গাছের নিচে–যেখানে তার একদিন দুপুরবেলা নগেন ঘোষের সঙ্গে কথা হইয়াছিল, রায়হান আঁধারে যাইয়া বসিলেন। নীলাকাশে অনন্ত নক্ষত্র দেখা যাইতেছিল। চিন্তাক্লিষ্ট হৃদয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহিত হইয়া গেল।

সারারাত্রি রায়হান সেখানে বসিয়া কাটাইলেন। পূর্বাকাশ যখন ঈষৎ শুভ্র হইয়া উঠিল তখন তিনি চমকিত হইয়া উঠিয়া বাড়ির দিকে গমন করিলেন।

পিতা তখন বৈঠকখানায় নামাজ পড়িতেছিলেন। রায়হানকে জিজ্ঞাসা করিলেন–রাত্রে কোথায় ছিলে বাপ?

রায়হান কহিলেন–দোকানেই ছিলাম। তারপর পিতার জায়নামাজের কাছে অগ্রসর হইয়া আড়ষ্ট কণ্ঠে বাম হাতে ললাট ঢাকিয়া কহিলেন–“আব্বা! আমি এখন বিয়ে করতে চাই নে। আমায় মাফ করুন!”

পিতা মৃদু হাসিয়া বলিলেন–“পাগল আর কি!”

.

ত্ৰিশ্চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

বিবাহের আয়োজন চলিতেছিল। খাসি কেনা, হলুদ কোটা মেয়েদের আনন্দ-উৎসব পূর্ণমাত্রায় আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল।

মেয়েদের আনন্দ-উৎসবের প্রসঙ্গে রায়হানের হৃদয়ও অধিকতর ক্লিষ্ট হইয়া পড়িতেছিল।

একদিন আমেনা অশ্রুসিক্ত চোখে রায়হানের পায়ের কাছে করুণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল–“গুরু! আমার চরিত্র সম্বন্ধে কেউ সন্দেহ পোষণ করে কি?”

রায়হান দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর করিয়াছিলেন–“না।”

আমেনা আবার বলিয়াছিল–“এখন থেকে আমার জীবনের কোনো মূল্য নাই। সংসারের অবহেলা ও কৃপায় আমাকে বেঁচে থাকতে হবেজিজ্ঞাসা করি, এর জন্য দায়ী কে?”

রায়হান কোনো উত্তর দেন নাই!

আমেনা আবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিল–“মানুষ মানুষকে কী দেখিয়া শ্রদ্ধা করে? মানুষের আদর মানুষের কাছে কীসে হয়?”

রায়হান বলিয়াছিলেন–“মহত্ত্বে, পুণ্যে ও আত্মার নির্মলতায়!”

আমেনা উত্তর করিয়াছিলেন–“আমার কি তাহা নাই?”

রায়হান বলিয়াছিলেন–“আছে।”

আমেনা আবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন–“জগৎ কি তাহা বিশ্বাস করে?”

রায়হান বলিয়াছিলেন–“আমি তাহা বিশ্বাস করি।”

আমেনা শান্ত আবেগে কহিয়াছিল–“তা হলে জীবনে আমার কোনো দুঃখ নাই। ছাত্রের কাছে গুরুর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাই ঢের।”

রায়হানের প্রার্থনার কোনো মূল্য হয় নাই। পিতা পুত্রের কথার উপর কোনো মূল্যই স্থাপন করেন নাই।

বিবাহার আর তিন দিন মাত্র বাকি। মেয়েরা উৎসব করিয়া দুপুর বেলা রায়হানের গায়ে হলুদ দিতেছিল। পিতা উৎসাহে-আনন্দে এদিক-ওদিক ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন।

চাচি পাড়ার স্ত্রীলোকদিগেকে দাবায় বসিয়া পান দিতেছিলেন এবং কন্যার রূপ লাবণ্যের কাহিনী কহিতেছিলেন।

একটা জড় পদার্থের মতো রায়হান মেয়েদের ইচ্ছানুযায়ী এখানে-ওখানে নীত হইতেছিলেন। বিবাহের কালে সকল ছেলেই লাজুক ও মৌন হয়ে থাকে তা সবাই জানে।

রায়হানের মুখ বন্ধ হইয়া গিয়াছিল–সরমে নয়, সীমাহীন বেদনায়। উল্লাস কোলাহল তাহার মনুষ্যত্বের প্রতি একটা উপহাস বলিয়াই তাহার মনে মনে হইতেছিল।

দুপুর বেলায় উৎসব-অবসাদে বৈকালে বাড়িখানি নিস্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল। রায়হান একটা মোটা জোলার তৈরি চাঁদর গায়ে দিয়া খালি পায়ে একাকী রাস্তা ধরিয়া চলিলেন। একটা কঠিন দুর্জয় মানসিক তেজ তাহার মুখখানাকে থাকিয়া থাকিযা শক্ত করিয়া তুলিতেছিল।খানিক পথ চলিয়া রায়হান একবার মাঠের দিকে চাহিলেন। অস্পষ্ট দৃঢ়কণ্ঠে রায়হান দূর দিগন্ত পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন–“জীবনকে মিথ্যা করিতে পারি না। পিতার জীবনের একটা অলীক খেয়ালকে না মানিলে যদি তিনি ব্যথিত হন তা হলে কোনো উপায় নাই। আমি আমার পিতাকে সত্যরূপেই গ্রহণ করিতে চাই।”

ক্রমে সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিল। রায়হান রাস্তা ছাড়িয়া পার্শ্বের সরু পথ ধরিয়া খোরশেদদের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। একটা বিপুল শান্তি তখন তাহার চোখে মুখে প্রতিভাত হইতেছিল। আমেনা তখন কোরান পাঠ করিতেছিল। আমেনার মা রায়হানকে স্নেহের স্বরে বসিতে অনুরোধ করিলেন।

রায়হান সালাম করিয়া বিনা ভূমিকায় উঠানের উপর দাঁড়াইয়া ধীর প্রশান্ত স্বারে কহিলেন–“চাচিজান! আমেনাকেই বিয়ে করবো”।

আমেনা তখন রায়হানের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল-সহসা সে মাটির উপর বসিয়া পড়িল।

আমেনার মা কথা কহিতে পারিরেন না–তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন।

রায়হান আমেনার অশ্রুসিক্ত হাতখানি হাতে লইয়া কহিলেন–“আমেনা, তুমি সজ্জিতা হও–আজ রাত্রেই আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে–দুজন অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং করিমাকে আমি ডেকে আনি।”

রায়হান বাহির হইয়া গেলেন।

.

চতুশ্চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

চার বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছিল। খোরশেদ এসলামপুরে বদলি হইয়াছে। ইহারি মধ্যে স্থানীয় জমিদারদের বাড়িতে এক কেলেঙ্কারী হইয়া গিয়াছে। জাহানপুরের যোগেন্দ্র বাবুরা। বহুঁকালের বড় লোক এবং লোকে বলে বনিয়াদি বংশ।

যোগেন্দ্র বাবুর সাত মেয়ে-মেয়েদের বিবাহে তিনি সর্বস্বান্ত হইয়াছেন। রূপে মনোহরা হইলেও বিনা অর্থে তাহাদের একজনেরও সদগতি হয় নাই।

একটি মোকদ্দমায় তাহার বহু হাজার টাকা ব্যয় হইয়া গিয়াছিল। তার পরেই হইয়াছিল তাহার ছোট মেয়ের বিবাহ। বিবাহের দিনই জামাই শ্বশুরের দুরবস্থার পরিচয় পাইয়া মুরুব্বীদের আদেশে ঐ যে চলিয়া গিয়াছিলেন, চার বৎসরের ভিতর আর ফেরেন নাই।

যোগেন্দ্রবাবু বৈবাহিকের নীচতা ও সঙ্কীর্ণতার উপর ক্রুদ্ধ হইয়া ভিতরে জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিলেও অর্থ দিয়া কিংবা ক্ষমা চাহিয়া জামাইকে ফিরাইয়া আনেন নাই।

কনিষ্ঠা মেয়ে যামিনীর বয়স ১৮ বৎসর। বিবাহের পর সে স্বামীকে একদিনও আদর সোহাগ জানাইতে পারে নাই। জমিদার বাড়ি বলিয়া কেউ কোনো কথা বলিতে সাহস পাইত না। একেবারে অসংযত বাতাসের মতো সর্বত্র সে খেলিয়া বেড়াইত। চাকর, আমলা, নফর কেউ তাহার সরল আলাপ ও হাসি হইতে বঞ্চিত হইত না।

জমিদার বাড়িতে একজন মুসলমান পেয়াদা ছিল। খোরশেদ আসবার পর সহসা একদিন থানায় সংবাদ আসিল, এই পেয়াদাকে জমিদারেরা হত্যা করিয়া নিকটস্থ দিঘিতে ফেলিয়া দিয়াছেন। কারণ কী তাহা অনেকে অনুমান করিতে প্রয়াস পাইল।

খোরশেদ বিশজন সিপাই পঞ্চাশজন চৌকিদার লইয়া দিঘি পরিষ্কার করিতে প্রবৃত্ত হইল। পেয়াদার মা খোরশেদের পা জড়াইয়া ধরিয়া যাহা বলিল তাহাতে জমিদারদের উপর সমস্ত দোষ গড়াইল।

উদ্ধারের পর দেখা গেল, মৃতদেহের শিরায় শিরায় লৌহশলাকা বিদ্ধ করা হইয়াছে। তাহার চোখ তুলিয়া ফেলা হইয়াছিল এবং জিহ্বাও অতি নিষ্ঠুরভাবে কাটিয়া ফেলা হইয়াছিল।

যোগেন্দ্রবাবুর বাড়িতে তদারক হইল এবং ফলে যাহা যাহা ঘটিল তাহাতে যোগেন্দ্রবাবু বিপন্ন হইয়া পড়িলেন।

.

প্রায় বার হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণ করিয়াও খোরশেদ মুসলমান পেয়াদার প্রতি হিন্দুদের অত্যাচারের প্রতিশোধ লইতে বদ্ধপরিকর হইল!

জমিদাররাও খোরশেদকে গোপনে হত্যা করিতে ইচ্ছা করিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *