১২. আমার কথা শুনলে

আমার কথা শুনলে তোমরা দুজনে হয়তো হাসবে, কিন্তু ভাই বিশ্বাস কর, সেদিন সন্দীপনের বুকের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে আমি যেন এই নির্মম রূঢ় পৃথিবী ছেড়ে আনন্দময় অমরাবতীতে চলে গেলাম। মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, আমি লাল বেনারসী পরেছি, মাথায় ওড়না। সন্দীপন আমাকে তার জীবনবৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু করে সাতপাক ঘুরছে। আমার গলায় মালা দিল। আমি পলকের জন্য বিমুগ্ধ মনে ওকে দেখলাম। সানাই শখ আর উলুধ্বনিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে মাতাল করেছে আমাদের, চারপাশের মানুষকে। সন্দীপন একটু হাসল। দুটি স্বপ্নাতুর চোখ দিয়ে আমাকে ফিস ফিস করে বলল, কবিতা, আমার সর্বস্ব তোমাকে দিলাম।

ওই কয়েকটা অবিস্মরণীয় মুহূর্তের মধ্যেই আমি অনুভব করলাম, বাসর রাত্রির আনন্দ ফুলশয্যার উন্মাদনা। দ্বিধা, সঙ্কোচ বিসর্জন দিয়ে আমি যেন আনন্দ-সমুদ্রে স্নান করলাম। মনে মনে কত কথা বললাম, কত কথা শুনলাম।

জানো কবিতা, তোমাকে প্রথম দেখেই বুঝেছিলাম, ঈশান কোণের মেঘের মতো তুমি একদিন আমার সারা আকাশ ভরিয়ে দেবে।

আমিও জানতাম, এই দিগন্তবিহীন অনন্ত সমুদ্রে একদিন আমি নিজেকে তলিয়ে দেব। আর কি জানতে?

জানতাম, সেই সমুদ্রের অতল গহ্বর থেকে সব ধনরত্ন তুলে নিয়ে আমার শূন্য মন পূর্ণ করব।

স্বপ্ন দেখলাম আরো অনেক কিছু। আমি যন্ত্রণায় ছটফট করছি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এক অভাবিত সম্ভাবনায় আমি মাঝে মাঝে সব যন্ত্রণা ভুলে যাচ্ছি। আবার যন্ত্রণার বেগ বাড়তেই আমি চিৎকার করে বললাম, সন্দীপন, আমাকে একটু জড়িয়ে ধর, আমাকে একটু আদর কর। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

নিদারুণ দীর্ঘ গ্রীষ্মের পর আকাশে এক টুকরো কালো মেঘ দেখেই ভেবেছিলাম, এই তাপক্লিষ্ট পৃথিবীতে এবার সবুজের মেলা বসবে।

হঠাৎ সন্দীপন দুহাত দিয়ে আমার মখখানা ধরে বলল, কবে ব্রিস্টল আসছ?

আমি কপট গাম্ভীর্য আনলেও চোখে-মুখে আমার মনের আনন্দের সুস্পষ্ট চিহ্ন ফুটে উঠল। বললাম, সত্যি আসব?

ও আমার কানে কানে বলল, না।

তাহলে কালই আসছি।

দুজনেই প্রাণভরে হেসে উঠলাম।

ভাই রিপোর্টার, তুমি তোমার সুন্দরীকে বোলো, সেদিন আনন্দে আর চাপা উত্তেজনায় আমি যেন চঞ্চলা যোড়শী হয়ে গিয়েছিলাম। সন্দীপনের স্পর্শে, ওই কয়েক মুহূর্তের নিবিড় সান্নিধ্যে আমি মৃগনাভী হরিণীর মতো পাগল হয়ে উঠেছিলাম। আমার জীবনে এমন আনন্দময় দিন আর আসেনি। এমন পরিপূর্ণ দিনও আমার জীবনে আর আসেনি।

অনেক বেলায় দুজনে খেতে বসলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, এতকাল বিয়ে করনি কেন?

সন্দীপন নির্বিবাদে উত্তর দিল, তোমার সর্বনাশ করব বলে।

আমি বুকে ভরে নিশ্বাস নিয়ে বললাম, ঠিক বলেছ। আমিও বোধহয় তোমারই জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

বিকেলবেলায় ডক্টর সরকার ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরেই সন্দীপন চলে গেল। যাবার সময় শুধু বলল, ব্রিস্টলে আসুন। কোনো অসুবিধে হবে না। তবে আসার আগে একটা টেলিফোন করবেন।

সন্দীপন চলে যাবার সময় আমার মন এমনই খারাপ হয়েছিল যে আমি বিশেষ কোনো কথা বলতে পারলাম না। ও আমার মনের অবস্থা বুঝেছিল বলেই ডক্টর সরকারকে প্রণাম। করেই হ্যাঁন্ডসেক করার জন্য আমার দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিল। আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। ও আমার হাতটা শুধু একটু টিপে দিল।

সন্দীপনের অভাব এত বেশি অনুভব করছিলাম যে রাত্রে খাবার সময় ডক্টর সরকারকে বলেই ফেললাম, আজ হঠাৎ বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

ঠিক বলেছ মা। ও যখনই চলে যায় তখনই আমার মন খারাপ হয়!

হ্যাঁ, কদিন বেশ জমিয়ে রেখেছিলেন।

ও সত্যি বড় আমুদে ছেলে।

ডক্টর সরকার একটু হেসে বললে, সন্দীপন শুধু আমার ছাত্র নয়, বাট এ ফ্রেন্ড অ্যাজ ওয়েল।

আমি হেসে বললাম, আমিও তাই দেখলাম। একটু থেমে, একটু পরে বললাম, ওদের সব ভাইবোনই বুঝি আপনার ছাত্র?

ওরা সাত ভাইবোন। তার মধ্যে তিন বোন আর সন্দীপনই আমার স্টুডেন্ট। ডক্টর সরকার আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, সন্দীপনের বড়দি আমার খুবই প্রিয় ছাত্রী ছিল।

আমি ইঙ্গিতটা বুঝলেও গম্ভীর হয়ে বললাম, তাই নাকি?

উনি একটা চাপা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, সি ইজ এ ডেঞ্জারাস গার্ল!

ডেঞ্জারাস মানে?

যে রকম সর্বনাশা সুন্দরী, সেই রকম বুদ্ধিমতী; অ্যান্ড সি ইজ এ ভেরি ফাস্ট গার্ল।

এবার আর আমি হাসি চেপে রাখতে পারি না। হেসে বলি, তাই নাকি?

হ্যাঁ মা। কয়েকটা বছর ওকে নিয়ে খুবই আনন্দে কাটিয়েছি।

উনি কি সন্দীপনবাবুর চাইতে অনেক বড়?

হ্যাঁ, অনেক বড়। সি মাস্ট বি অ্যাবাউট ফিফটি-ফাইভ বাই নাউ।

উনি এখন কোথায় আছেন?

কলকাতায়।

আপনার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ আছে?

ডক্টর সরকার হেসে বললেন, এখনও মাসে একখানা প্রেমপত্র লেখে।

আপনি লেখেন?

লিখি বৈকি।

দেখাশুনো?

কলকাতায় গেলেই দেখা হয়। উনি একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, এখনও ওর রূপ দেখলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে।

বিয়ে করেছেন নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ, বিয়ে করেছে। বেশ সুখেই ঘর-সংসার করছে।

সন্দীপনবাবুর অন্যান্য ভাইবোনেরা…

ওদের বাড়িটা যেন অভিশাপগ্রস্ত। সন্দীপনের বড়দা ক্যান্সারে ভুগে ভুগে মারা গেলেন এই বছর তিনেক আগে। মেজদা মারা গিয়েছেন মোটর অ্যাকসিডেন্টে। এছাড়া তিনটি বোন বিধবা।

ইস! এইসব কারণেই তো সন্দীপন বিয়ে করল না।

এরপরই হঠাৎ ডক্টর সরকার বললেন, ও যদি বিয়ে করতে রাজি হয়, তাহলে আমি ওর সঙ্গে তোমার বিয়ে দিয়ে দেব।

আমি হাসি।

না, মা, হাসির কথা নয়! তোমার মতো সন্দীপনও বড় নিঃসঙ্গ। তাছাড়া ছেলেমেয়ে হিসেবে তোমাদের দুজনেরই তুলনা হয় না।

আমি চুপ করে বসে থাকি। কোনো কথা বলি না।

উনিই আবার বললেন, ব্রিস্টলে তোমার সঙ্গে মেলামেশা করার ফলে যদি ওর মতের পরিবর্তন হয়, তাহলে তুমি মা ওকে বিয়ে করো। আমি বলছি, তোমরা নিশ্চয়ই সুখী হবে।

বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ থাকার পর ডক্টর সরকার বললেন, দেখ মা, এই পৃথিবীর সমাজ-সংসার এমন ভাবে গড়ে উঠেছে যে একা থাকা বড় কঠিন। আমার কথাই ধর। আই। হ্যাড প্লেন্টি অব সেক্স কিন্তু কোনো নারীর সান্নিধ্য, সাহচর্য আর ভালোবাসা পেলাম না। আমি একটা ক্যাক্টাস হয়েই রইলাম।

ডক্টর সরকারের কথাগুলো শুনে আমার মনের মধ্যে স্বপ্নের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলাম না। মাথা নীচু করে বসে রইলাম। তবে মনে মনে অনেক কথা বললাম। বললাম, আমাদের শুভাকাক্ষী হিসেবে আপনি যা ভেবেছেন, যে স্বপ্ন দেখছেন, আমরাও তাই ভেবেছি। আর বললাম, সন্দীপন দুহাত বাড়িয়ে আমাকে বুকে টেনে নেবার অনেক আগেই আমি মনে মনে উপলব্ধি করেছিলাম, সন্দীপনই আমার জীবন দেবতা।

ডক্টর সরকার জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কবে ব্রিস্টল যেতে চাও?

ভাবছি, সপ্তাহখানেক পরে যাব।

প্রত্যেক শুক্রবার বিকেলে আসবে তো?

আসব।

হ্যাঁ এসো। আবার সোমবার সকালে ফিরে যেও। সঙ্গে সন্দীপনকে আনতে পারলে আরো। ভালো হয়।

আমি হাসি।

ডক্টর সরকার একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, না, না, মা, হাসিরা কথা নয়। আমার গর্ভধারিণীর চরিত্র ভালো ছিল না বলে আমি সারাজীবন মেয়েদের শুধু উপভোগের সামগ্রী ভেবেছি, কিন্তু হেরে গেলাম শুরু তোমার কাছে।

ওঁর দুটো চোখ ছলছল করে উঠল। গলার স্বরও ভারি হয়ে গেল। বললেন, মা পেয়েছিলাম কিন্তু মাতৃস্নেহ পাইনি; নারী পেয়েছি কিন্তু নারীর ভালোবাসা পাইনি। এখন এই বুড়ো বয়সে সেই মাতৃস্নেহ আর ভালোবাসা পাবার জন্য বড় লোভ হয়েছে।

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে ওঁর পাশে দাঁড়ালাম। দুহাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে ওঁর মাথার ওপর থুতনি রেখে বললাম, এখন তো মা পেয়েছেন; আবার দুঃখ কিসের?

নিশ্চয়ই পেয়েছি, কিন্তু তুমি তো চলে যাচ্ছ।

আপনি বারণ করলে যাব না।

না, মা, তা হয় না।

এবার আমি ওঁর হাত ধরে বললাম, চলুন, আমি আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দিই।

ডক্টর সরকার শুয়ে পড়েন। আমি ওঁর পাশে মাথায় হাত দিই। ছোট্ট অসহায় শিশুর মতো উনি আমার কোলের ওপর হাত রেখেই ঘুমিয়ে পড়েন। তবু আমি উঠতে পারি না। বিমুগ্ধ বিস্ময়ে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।

কতক্ষণ ওইভাবে বসেছিলাম, জানি না। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠতেই উঠে গেলাম। হ্যালো!

আমি সন্দীপন।

আমি হেসে বললাম, এত রাত্রে টেলিফোনের বেল শুনেই বুঝেছি, ডক্টর সরকারের পাগল ছাত্রের টেলিফোন।

আমি পাগল?

পাগল না হলে আমাকে পাগল করতে পারো?

যাক, শুনে খুশি হলাম।

খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?

হাফ বল হুইস্কি শেষ করেছি।

হুইস্কি খেলেই পেট ভরবে?

এতদিন ভরতো, কিন্তু আজ ভরলো না।

কেন?

আজ মনে হচ্ছে, বোধহয় হুইস্কির বোতলে জল ছিল।

তার মানে?

রোজ নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে পড়ি কিন্তু আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না।

এভাবে ড্রিঙ্ক করলে আমি আসছি।

তুমি এলে আমি আর এত ড্রিঙ্ক করব না।

ঠিক বলছ?

কবিতা, যেদিন দেখবে আমি তোমাকে একটা মিথ্যে কথা বলছি, সেদিনই তুমি চলে যেও। আমি বাধা দেব না।

তুমিও মিথ্যে বলবে না, আমিও চলে আসব না।

এবার সন্দীপন জিজ্ঞাসা করল, স্যার কি ঘুমোচ্ছেন?

একটু আগেই ওঁকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।

তুমি কি নাইটি পরেছ?

আমি হাসি। বললাম, কেন?

তোমার ওই লাল নাইটি দেখলে…সন্দীপন কথাটা শেষ করল না।

আমি জানতে চাইলাম, আমার নাইটি দেখলে কি হয়?

ফুলশয্যার দিন বলব।

আমি হাসতে হাসতে বলি, এতদিন অপেক্ষা করতে হবে? তার আগে…

এতদিন অপেক্ষা করতে না চাইলে আগেই ফুলশয্যা হবে। তারপর সময় মতো বিয়ে-টিয়ে করা যাবে।

এবার তুমি মার খাবে।

সন্দীপন আর বিশেষ কিছু বলল না। শুধু বলল, অনেক রাত হয়েছে। শুয়ে পড়। গুড নাইট।

পরের কটা দিন আমি যেন সন্দীপনের স্বপ্নের বিভোর হয়েই রইলাম। সব সময় শুধু ওর কথা ভাবি; প্রতি মুহূর্তে ওকে চোখের সামনে দেখি। ডক্টর সরকার বাড়িতে না থাকলে আমি মনে মনে ওর সঙ্গে কথাও বলি।

সন্দীপন, উঠবে না? লক্ষ্মীটি উঠে পড়। অনেক বেলা হয়ে গেছে। আর ঘুমোতে হবে না।…কি? উঠবে না? বেশ, আমি চলে যাচ্ছি।…আঃ। ধরো না। আমি সত্যি যাচ্ছি। আমার অনেক কাজ আছে।

ওইসব স্বপ্ন দেখি আর আমি আপন মনেই হাসি। ভাবি, আমি কি পাগল হলাম? না, না, পাগল হব কেন? যাকে ভালোবাসি তাকে স্বপ্ন দেখব না? নিশ্চয়ই দেখব, একসোবার দেখব।

.

ভাই রিপোর্টার, ভালোবাসা বহু ব্যবহৃত শব্দ। যেদিকে তাকাই সেদিকেই ভালোবাসার ছড়াছড়ি। শুনি, সব ছেলেমেয়েরাই প্রেমে পড়ে। কিন্তু সত্যি কি সবাই ভালোবাসতে পারে? সবাই কি প্রেমে পড়তে পারে? বোধহয় না। দেহে যখন বিপ্লব আসে, তখন স্বপ্ন দেখবেই। তখন সমস্ত পৃথিবীতেই রামধনুর রঙ দেখা যায় কিন্তু ভালোবাসা তো স্বপ্ন নয়। পৃথিবীকে রঙিন দেখার জন্যই তো প্রেম নয়। ভালোবাসা মানুষকে দেবতা করে; প্রেম আনে অমরত্ব। তাই তো আমরা শ্রীকান্তকে ভুলতে পারি না, রাজলক্ষ্মীকে সবাই ভালোবাসি। যে ভালোবাসা নারী-পুরুষকে শুধু বিয়ের বন্ধনে বাঁধে, শুধু উপভোগের অধিকার দেয়, সে ভালোবাসায় প্রেম নেই এবং সেইজন্যই আমাদের ঘরে ঘরে এত অশান্তি, এত সংঘাত, এত দ্বন্দ্ব।

তুমি বিশ্বাস কর, আমি শুধু কামনা-বাসনা লালসার তৃষ্ণা মেটাবার জন্য সন্দীপনকে ভালোবাসিনি। যে কোনো পুরুষকে দিয়েই এ তৃষ্ণা মেটানো যায় কিন্তু যে কোনো পুরুষকে কি ভালোবাসা যায়? না, তা সম্ভব নয়। আমি আমার সমস্ত-অনুভূতি দিয়ে সন্দীপনকে নিজের মধ্যে বরণ করেছিলাম, চেয়েছিলাম সমস্ত সত্ত্বা বিলীন করে ওর মধ্যে মিশে যেতে।

.

দিন দুই পরের কথা। আমি ব্রিস্টল যাবার জন্য কেনাকাটা করতে অক্সফোর্ড সার্কাসের দিকে গিয়েছিলাম। বৃষ্টির জন্য ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেল। বাড়িতে ঢুকে ডক্টর সরকারের মুখ দেখেই ঘাবড়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি ওঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে আপনার? এভাবে মুখ কালো করে বসে কেন?

উনি মুখ নীচু করে বললেন, মনটা বড় খারাপ।

কেন? কি হয়েছে?

সন্দীপন টেলিফোন করে একটা দুঃসংবাদ জানালো।

আমি প্রায় চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম, কি দুঃসংবাদ জানালো?

ওর সব চাইতে ছোট বোনটি বিধবা হয়েছে।

ইস!

আমাকে আর প্রশ্ন করতে হয় না। ডক্টর সরকার নিজেই বললেন, এই ছোটবোনকে সন্দীপন কি অসম্ভব ভালোবাসত তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বাবা-মা মারা যাবার পর সন্দীপনই ওর বাবা-মা ছিল। বাড়িতে তিন-চারটে ঝি-চাকর থাকা সত্ত্বেও সন্দীপন ওকে নিজের হাতে চান করাতো, খাওয়াতো। ছোট বোন পাশে না শুলে সন্দীপন ঘুমুতে পারত না।

আমি বোবার মতো দাঁড়িয়ে চোখের সামনে যেন ওইসব দৃশ্য দেখছি।

ডক্টর সরকার থামেন না। বলে যান, বিলেত আসার বছর খানেক আগে সন্দীপনই ওর বিয়ে দিল, কিন্তু বিধাতা পুরুষ ওর স্বপ্ন চুরমার করে দিলেন।

আমি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কখন খবর পেলেন? তুমি বেরিয়ে যাবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই টেলিফোন এলো।

উনি কি বললেন?

শুধু সর্বনাশা সংবাদটা জানিয়েই টেলিফোন রেখে দিল।

আর কিছু বললেন না?

না। বলার মতো অবস্থা ওর ছিল না। একটু থেমে ডক্টর সরকার বললেন, আমি অনেকবার ওকে ফোন করলাম কিন্তু কোনো জবাব পেলাম না।

আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।

কিছুক্ষণ পরে ডক্টর সরকার বললেন, নিশ্চয়ই বেঢপ মাতাল হয়ে পাগলের মতো রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কথাটা শুনেই আমার সমস্ত বুকটা জ্বলে-পুড়ে গেল। সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে চাইলাম, ছুটে গিয়ে ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি, চোখের জল মুছিয়ে দিই, কিন্তু না ভাই, সে সুযোগ এলো না। কোনোদিনও আসবে না।

রাত্রে আমরা দুইজনেই আরো অনেকবার সন্দীপনকে ফোন করলাম কিন্তু ওকে পেলাম না। অনেক রাত্রে শুতে যাবার আগে ডক্টর সরকার আমাকে বললেন, একটু সজাগ থেকো। ও হয়তো পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে এখানে এসে হাজির হতে পারে।

সন্দীপনের প্রতীক্ষায় সারা রাত জেগেই রইলাম, কিন্তু না, সে এলো না। একেবারে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম-হঠাৎ ডক্টর সরকারের চিৎকার শুনেই পাগলের মতো লাফিয়ে উঠলাম। ওঁর কাছে ছুটে যেতেই উনি আমাকে দুহাত দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, মা, আমার সন্দীপন নেই!

ডক্টর সরকারের আশঙ্কাই ঠিক হল। সন্দীপন বেঢপ মাতাল হয়ে পাগলের মতো গাড়ি নিয়ে ঘুরছিল সারা শহর। শেষ রাত্তিরের দিকে মারাত্মক অ্যাকসিডেন্ট করে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়।

.

ভাই রিপোর্টার, শুনলে আমার প্রেমের কাহিনি? কেমন লাগল? এ সংসারে কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা ধুলো হাতে নিলে সোনা হয়; আবার কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের ছোঁয়ায় সব জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। আমার এই সুন্দর দেহটার মধ্যে একটা অভিশপ্ত আত্মা লুকিয়ে আছে। তাই তো আমার দ্বারা এ পৃথিবীর কোনো মানুষের কোনো কল্যাণ হবে না, হতে পারে না। অসম্ভব।

তোমার সুন্দরীকে বোলো, পরবর্তীকালে আমার এই দেহটা অনেক পুরুষ উপভোগ করেছে। যাদের এ দেহ দিয়েছি, তাদের সবাইকে আমি ঘেন্না করি কিন্তু শুধু সন্দীপনের ওপর অভিমান করে এ দেহ তাদের বিলিয়ে দিয়েছি। পরে কেঁদেছি। অবোধ শিশুর মতো হাউ হাউ করে কেঁদেছি। হাত জোড় করে হাজার বার সন্দীপনের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।

সন্দীপন মারা গেছে কিন্তু হারিয়ে যায়নি। তাকে আমি সযত্নে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি। সেখান থেকেও কি সে পালিয়ে যাবে? না, তাকে আমি কোথাও যেতে দেব না। সে চিরদিনের, চিরকালের জন্য শুধু আমার।

আর লিখতে পারছি না। আমাকে তোমরা ক্ষমা কোরো। দোহাই তোমাদের, আর কোনোদিন আমার সন্দীপনের কথা জানতে চেও না!

আমার প্রাণভরা বুকভরা ভালোবাসা নিও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *