২৩. মাল্যবান গোলদীঘিতে গেল

মাল্যবান গোলদীঘিতে গেল। গোলদীঘিতে অনেকক্ষণ ঘুরল। তারপরে মেসে এসে দেখল। খাওয়াদাওয়ার পর বিছানায় শুতে গিয়ে মাল্যবানের মনে হল মনুর জন্যে পিল কিনে দেওয়া হয়নি তো।

রাত কম নয়। তখনো দু-একটা ফার্মাসী খোলা ছিল। এক ফাইল লিভারের পিল কিনে নিয়ে উৎপলাকে দেবার জন্যে একেবারে ওপরের ঘরে গিয়ে উঠল। গিয়ে দেখল মেজদা মেজবৌঠান আর উৎপলা তিনজনেই খাওয়াদাওয়ার পর ছাপখাটের ওপর পা ছড়িয়ে হাসি তামাশ দোক্তা পানের মজলিশ বসিয়ে দিয়েছে। ওষুধের ফাইলটা উৎপলাকে দিয়ে মাল্যবান নিচে নেমে যাচ্ছিল। মেজদা বললেন, ও জামাই, পালালে যে—ও জামাই!

মাল্যবান একেবারে নিচের ঘরে নেমে এল। দেখল ছেলেমেয়েরা সব ঘুমুচ্ছে। মনুর খাটের কাছে এসে দাঁড়াল; ছোট্টো মেয়েটার ধঞ্চের কাঠির মতো শরীরটা পড়ে আছে—ফু দিলে উড়ে যাবে যেন-এ-শরীরে মাংস লাগবে এসে কোনো প্রক্রিয়ায় কোনো রকম প্রক্রিয়ারই—সেটা সম্ভব বলে মনে হয় না; ওষুধে ভালো জায়গায় চেঞ্জে গেলে যে—কাঠামোর শরীর সারতে পারে আশা করা যায়, মেরে শণীরে সে-কাঠামোটুকুই নেই। হাড়ের মতন নয়—শুকনো সেলাহীকাঠির মত কয়েকখানা হাড় আছে শুধু।

মশায় খাচ্ছে; বাতাস করে মশারীটা ফেলে দিল মাল্যবান। মনুর বুকের ওপর কম্বলটা টেনে দিল।

মাল্যবানের মন শুকিয়ে যেতে-যেতে ভরে উঠল—কী জিনিসে? তা কামনা নয়—স্ত্রীলোকের জন্যে পুরুষের ভালোবাসাও নয়; মনুর জন্যেও–তার এই একমাত্র সন্তানটির জন্যেই একটা নির্বিশেষ পিতৃস্নেহ শুধু নয়, কেমন একটা সর্বাত্মক করুণা এসেছে—মনুর জন্যে, যে-সব ছেলেমেয়েরা এখানে ঘুমিয়ে আছে, বিপিন ঘোষের স্ত্রী, বিপিন ঘোষ, মেজদা, বৌঠান, এমনকি নিজের স্ত্রীর জন্যেও। এ-মুহূর্তে কোনো তিক্ততা বিরসতা বোধ করল না সে, কোনো যৌন আকর্ষণ বা যৌনাতীত গভীর ভালোবাসা–নারীকে ভালোবাসা—এ-সব স্তর ও ফাঁদ উৎরে গিয়ে একটা নির্জন অন্তর্ভেদী সমভিব্যাপী দয়ার উজ্জ্বলতায় কয়েক মুহূর্তের জন্যে যেন অতিমানুষের মতো হয়ে উঠল মাল্যবান।

রাস্তায় নেমে মাল্যবানের মহাপুরুষদের মতো মনে হল ভালোবাসা বা কামনা নয়, করুণাই মানুষকে সমস্ত সৃষ্টির অগ্নিকারুকার্যের ভেতরে আপতিত শিশিরফোঁটার মতো খচিত করে রাখে।

প্রেম খুব বড়ো জিনিস বটে, নটীর প্রেমের চেয়ে নারীর প্রেম বড়ো, নারীর প্রেমের চেয়ে বড়ো সব্বায়ের জন্যে ভালোবাসা, পুরাণপুরুষের জন্যে নিবিড় আকর্ষণ। কিন্তু করুণা? একটা কীট, সেই মড়া বেড়াল-ছানাটা, মনু, বিপিন ঘোষের স্ত্রী, বিপিনবাবু নিজে, এমন-কি মাল্যবানের নিজের স্ত্রী-সকলেই তো মাল্যবানের হৃদয়ের করুণায় অভিষিক্ত হয়ে পুরাণ-পুরুষের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠবে।

মাল্যবান মেসের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে থমকে দাঁড়িয়ে বললে, ছি ছি, এ-জন্যে অভিমান জেগেছে নাকি আমার হৃদয়ে? আমার প্রাণে সৃষ্টির বড়ো করুণা এসেছে বলে অহঙ্কার বোধ করছি? না, না,করুণার সঙ্গে অভিমানের কোনো সম্পর্কই নেই; এ প্রেম নয় তো,—এ সবচেয়ে দীনতম জিনিস—তুচ্ছতম। আমি সবচেয়ে নিকৃষ্টতম—সব চেয়ে নিকৃষ্টতম—আমি সবাইর কৃপার পাত্র, সকলেই পরমপুরুষের করুণাভাজন, অতএব সকলেই সেই পুরুষের প্রিয়পাত্ৰ-এই যে অনুভাব, এটা করুণা।

কিন্তু মেসের বিছানায় শুয়ে করুণা শীতের রাতের তুলোওঠা গরম লেপের ভেতর স্খলিত হতে-হতে যখন নারীপ্রেম নাগরীপ্রেম এমন-কি গ্রন্থি-মাংসে গিয়ে আঘাত করতে লাগল, তখন মাল্যবান পাড়াগাঁর ছেলেবেলার কত ছোলার ক্ষেত, বড়ো দীঘি, চাচের বেড়ার ঘর, শীতের রাতে পোয়ালের গরম খড়ের গাদি ফোড়নের মতো চারিদিকে শিশির ভেজা মাঠ, পেঁচার পাখার খসখসানি, দুরে সুভাবনীয়তম কালো পাখির ডাক—সময়ের ভাড়ার ভেঙে-ভেঙে মাল্যবান বার করতে লাগল এই সব। মিনিট দশ-পনেরো পরে মনে হল মাল্যবানের অনেক মুখের হামলা, অনেক ঝামেলা, কী ভীষণ ওতপ্রােত ভাব—কী হট্টগোল!

আরো কয়েক মিনিট পরে : যদিও আর কয়েকটি মুখের দাবিও কম নয়, তবুও আজকের নিতান্তই সাময়িক প্রয়োজনের জন্যে নেহাতই আকস্মিক ঘটনার মতো একটি মুখ রয়ে গেল তার বুকের ভেতর; সে-মুখ তার স্ত্রীর নয়।

রাত তিনটের সময় মেসের চৌবাচ্চার থেকে ফিরে এসে হি-হি করে কাপতে-কাপতে মাল্যবান ভাবছিল : তার জীবনের সারাৎসার মুহূর্তে তার স্ত্রী কোনো কাজে লাগে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *