১০. পাশের বাড়ির ছোট্ট মেয়েটি

পাশের বাড়ির ছোট্ট মেয়েটি আঁতুড়েই মারা গেল।

আমি তো তখনই বলেছিলাম, এই রকম হবে—

দুতিন দিন উৎপলা কেমন একটা শোকগ্রাহিতায় আচ্ছন্ন (না, বিমুগ্ধ?) হয়ে কাটাল।

বললে, আমি একটু দেখতেও পারলাম না, আমাকে একটু ডেকে দেখালও না।

কী করতে তুমি দেখে?

এই তো পাশাপাশি বাড়ি-মানুষ জন্মায়—মরে যায়—যেন ঘড়ির কাটা ঘুরে চলে, মরবার সময়ে একবার ডাকলেও তো পারত। পরশু রাত তিনটের সময়ে মারা গেছে বললে?

হ্যাঁ।

কী করছিলাম তখন আমি?

ঘুমুচ্ছিলে!

মাল্যবান বললে, কতো শিশুরাই তো মরে যাচ্ছে।

খুব কেঁদেছিলেন সেজো গিন্নি? উৎপলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে হাত-পা নিঝুম করে ছাদের এ-পারে ও-পারে পরপারে শূন্যতার বড় একটা রৌদ্রচাঙাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

বড় বৌকে শাড়ি পাঠালে—কোনো খবর-টবর দিল না তো। মাল্যবান বললে।

খবর দেবার সময় হয়েছে কি?

বাঃ, দশ-পনেরো দিন হয়ে গেল।

দাদা নিশ্চয় জবাব দিয়েছিলেন, উৎপলা বললে, কিন্তু পথে চিঠি মারা গেছে।

তা নয়, মাল্যবান একটু কঁধ নাচিয়ে বললে, পোস্ট অফিসের চিঠি ওঝার বাটির মতো চলে। তিন পয়সার একটা পোস্টকার্ড ঝেড়ে দিলে যে-মল্লুকে পাঠাও, ঠিক গিয়ে পৌঁছুবে।

বড় শামকল কেমন ঘাড়ের রোঁ ফুলিয়ে ফুলিয়ে কথা কইছে শোন—মাল্যবানের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল উৎপলা। কিন্তু চিঠি সম্পর্কে কথা বাড়াতে গেল না সে আর।

আঁতুড়ের মেয়েটাকে বাক্স করে শ্মশানে নেওয়া হয়েছিল?

হ্যাঁ।

কী রকম বাক্স?

প্যাকিং বাক্স—পাইন কাঠের—

ভেতরে আটকে নিলে? পেরেক ঠুকে?

তবে কি বাক্সের বাইরে লেপটে নেবে গদের আঠা দিয়ে লেবেল মেরে?

কী করলে তারপর?

শ্মশানে নিয়ে গেল—

দাহ তো হয় না ছোটদের?

না।

না।

পুঁতে ফেললে তবে?

হ্যাঁ।

তারপর কী হবে?

কীসের পরে?

আমি বলছি, মাটির নিচে কী হবে ওর?

মাল্যবান এবার চুরুট জ্বালিয়ে নিয়ে বললে, ও-সব কথা কেউ ভাবে না। হবেই একটা কিছু। শেয়ালে মাটি খুঁড়ে না খেলে পচে গলে যাবে–কৃমি হবে।

কলকাতায় শেয়াল কোথায়? পচে মাটি হয়ে যাবে–

শুনতে-শুনতে সামনের চেয়ারটায় না বসে মেঝের ওপরই ঝুপ করে বসল উৎপলা, দেয়ালে ঠেস দিয়ে, পা ছড়িয়ে, বসে রইল।

মাল্যবান চুরুট টানতে-টানতে ভাবছিল কী বোেকা! কী বোকার মতো কথা জিজ্ঞেস করে। কতো রাজ্যি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, উৎপলা ফ্যাকড়া নিয়ে বসে আছে। তারপর কী হবে? মাটির নিচে কী হবে ওর? হুশ! কিন্তু, তবুও, বোকা নয় ও, বোেকা একেবারেই নয়; একটি সন্তানের মা হয়েও যেমন ভাবে মা হতে চেয়েছিল বহু সন্তানের, তা হতে পারেনি; সেই সব নিহিত তেজ উৎপলার আপাতমুখতার অতৃপ্তিতে ঝরে পড়ছে।

আচ্ছা, মরে যাওয়ার পর বড়-বড় মেয়েদের মাটিতে পুঁতলে তারপর কী হয়?

মাটিতে পুঁতবে কেন? দাহ হয়।

না, আমি বলছি, যাদের ভেতর দাহ-টাহ করার চল নেই, তাদের কথা—

ওঃ, মাল্যবান একটু পুরুষ চিল-তীক্ষ্ণ ভাবে উৎপলার দিকে তাকাল।

আমি শুনেছি, একজন খুব রূপসী কুড়ি-একুশ বছর বয়সেই সুস্থ শরীরে হঠাৎ কেন যেন মারা গেল। বিকেলবেলাতে তাকে মাটি দেওয়া হল। তারপর সবাই চলে গেল যে যার গাঁয়ে। সেখানে আট-দশ মাইলের মধ্যে জনমানব কেউ ছিল না। সন্ধ্যের পরেই একটা লোক এসে মাটি সরিয়ে সেই মড়াতে চুরি করে নিয়ে গেল। কেন নিল, বলো তো?

কুড়ি-একুশ বছরের মেয়ে মানুষ?

হ্যাঁ, বেশ সুন্দরী ছিল, বেশ সোমত্ত; শবটাকে মাটি খুঁড়ে বার করবার পরও গা ফুটে রূপ বেরুচ্ছে; আর গতরের সেকীপুষ্টতা।

এই জন্যেই চুরি করা হয়েছিল—মাল্যবান বললে।

মাল্যবানকে খুব বেশি জাগিয়ে দিয়েছে উৎপলা, কথায়-কথায় নিজেও খুব বেশি জেগে পড়েছে আজ।

নিচের ঘরে আর যেতে দেওয়া হল না মাল্যবানকে আজ রাতে।

এ-রাতটা মালাবান ও উৎপলার বেশ নিবিড় ভাবেই কাটল।—সমস্ত রাত—সমস্তটা শীতের রাত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *