০৭. নতুন বউঠান আর আমার বর

এই যে নতুন বউঠান আর আমার বর, দু’জনে মিলে বাড়ির ছাদে তৈরি করল ওদের নন্দনকানন, ওটার একটা ভিতরের রূপ আছে।

ওটা শুধুমাত্র একটা বাগান নয়।

ওটা ওদের দুজনের সম্পর্কের বাগান। ওই বাগানটার মধ্যে ওদের লুকোনো প্রেমকে ওরা ঘোষণা করল।

ভালোবাসা কি কখনও লুকিয়ে রাখা যায়? যায় না। এ তো আমার বরের কথা। গোপন কথা নাকি চোখের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে।

একদিন আমাকেও বলেছিল, আমার অনেক কবিতা আর গানের মধ্যে আমি জানিয়ে দিয়েছি আমার গোপন ভালোবাসার কথা। এই গোপন কখা তো গোপন রাখা যায় না ছোটবউ। যে কথা বলছিলেম, ওই নন্দনকাননের মধ্যেই দেয়ানেয়া, ওদের সম্পর্ক আরও গাঢ় হল।

সন্ধে হলেই নতুন বউঠান গা-ধুয়ে চুল বেঁধে প্রিয়তম ঠাকুরপোটির সঙ্গে ছাদে যেতেন। নন্দনকাননে পাতা হত মাদুর আর তাকিয়া।

নতুন বউঠান রুপোর রেকাবিতে ভিজে রুমালে বেলফুলের গোড়ে মালা ঢাকা দিয়ে রাখতেন।

আর নিজের ঠোঁট রাঙিয়ে তোলার জন্যে বাটিতে রাখতেন ছাঁচি পান।

আমার স্বামীর মুখেই শোনা—নতুন বউঠানের জন্যে, শুধু তাঁকে শোনাব বলেই নতুন-নতুন গান লিখতুম আমি। আমার মধ্যে যেন ভালোবাসার গানের প্লাবন এসেছিল। নন্দনকাননে হু-হু করে বইত দক্ষিণে বাতাস। নতুন বউঠাকরুণ তার আঁচল আর চুল সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। আর দক্ষিণে বাতাসের কাছে পরাজয় স্বীকার করে তার সেই হাসি মনে পড়ে আমার কী যে সুন্দর দেখাত তাকে। ওর হাসি যেন আকাশের গায়ে ফুটিয়ে তুলত তারা। সে বলত, কী গো ঠাকুরপো, আজ আমায় নতুন গান শোনাবে না? আমিও দিলেম নতুন বউঠানকে আমার নতুন গানটি শুনিয়ে—ধরলেম বেহাগে—

মধুর মিলন। হাসিতে মিলেছে হাসি, নয়নে নয়ন।
মরমর মৃদু বাণী মরমর মরমে, কপোলে মিলায় হাসি সুমধুর শরমে—নয়নে স্বপন।।
তারাগুলি চেয়ে আছে, কুসুম গাছে গাছে—
বাতাস চুপি চুপি ফিরিছে কাছে কাছে। মা
লাগুলি গেঁথে নিয়ে, আড়ালে লুকাইয়ে
সখীরা নেহারিছে দোঁহার আনন—
হেসে আকুল হল বকুলকানন।

গানটা পুরোটাই গাইলেন আপনাদের রবি ঠাকুর। তারপর নিজেকেই যেন ঠাট্টা করে গেয়ে উঠলেন—আ মরি মরি।

আমি তো অবাক। কতদিন আগের লেখা গান, এখনও মনে আছে! এই গানটা তো কোনওদিন কাউকে গাইতে শুনিনি।

কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে ও বললে, বুঝলে ছোটবউ, তখন গান বললেই গান আসত। সুরও আসত সঙ্গে। একুশ-বাইশ বছরের লেখা তো বেশ কাঁচা। কিন্তু গানের মধ্যে সেই নন্দনকাননের পরিবেশ আর নতুন বউঠানের হাসিটি ধরা আছে। ধরা আছে তার চোখের মায়া আর লজ্জার সুমধুর রূপটি। একেবারে ক্যামেরার মতো। ছবিটার মধ্যে আমিও আছি-ওই যে, হাসিতে মিলছে হাসি, নয়নে নয়ন। আমার বুকের মধ্যে সমস্ত তোলপাড়ের গলা টিপে আমি জিগ্যেস করলুম, এমন সুন্দর গান শুনে নতুন বউঠান কী বললেন?

বিশেষ কিছু বলল না। এক পাগলামি করে বসল। গড়ে মালাটা ভিজে রুমালের ভিতর থেকে বের করে দিলে আমার গলায় পরিয়ে। আর হেসে বললে, আজ স্বীকার করছি ঠাকুরপো, তুমি বিহারীলালের চেয়ে অনেক বড় কবি।

আমি বললুম, নতুন বউঠান যে শেষ পর্যন্ত তোমাকে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে বিহারীলাল চক্রবর্তীর থেকে তুমি বড় কবি—এ তো তোমার খুব একটা বড় জয়। তুমিও নিশ্চয় আনন্দে তাঁকে কিছু একটা দিয়েছিলে।

ও বেশ কিছুক্ষণ আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। মনে হল, ও কিছু একটা, গভীর কিছু ভাবছে। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। ও হঠাৎ আমাকে ডেকে বলল, ওই মালাটা আমি আমার কাছে অনেকদিন পর্যন্ত রেখে দিয়েছিলেম। ফুলগুলি শুকিয়ে সব কালো হয়ে গিয়েছিল। তবু আমার কাছে ওই মালাটা বেঁচে ছিল—এতটুকু নষ্ট হয়নি। কত বসন্তে, কত বর্ষায়, কত শরতে আমি যে নতুন বউঠানের কত কাছে ছিলেম, কত প্রভাতে দুপুরে সন্ধ্যায় সে আমাকে কতভাবে দেখেছে, কত ভালোবেসেছে আমাকে সতেরো বছর ধরে, কত সুখদুঃখের মধ্যে দিয়ে আমরা দু’জনে একসঙ্গে গেছি, সতেরো বছর ধরে আমার জীবন যে তার সব ডাকে সাড়া দিত—এই সমস্ত কিছু আমাদের মেলামেশা, ভালোবাসা তার সবটুকু দিয়ে ওই গড়ে মালাটি গেঁথে নতুন বউঠান আমার গলায় সেদিন পরিয়ে দিয়েছিল। আমি তা-ই ওটিকে ফেলতে পারিনি।

আমি দরজার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে।

ও কথা থামিয়ে নীরব।

ঘড়ির কাঁটার শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু।

জিগ্যেস করলুম, মালাটা এখনও আছে?

ও বললে, না ছোটবউ, মালা আর নেই। ওটা নতুন বউঠানের সঙ্গে চিতায় শেষ হয়েছে।

আমার তখনও রবি ঠাকুরের বউ হতে বছর দুই দেরি। আমার বয়েস তখন সাত বছর ক’মাস। আমি তখন যশোর জেলার ফুলতুলি গ্রামের গরিব ঘরের মেয়ে ভবতারিণী। আমাদের গ্রামের চারধারে এক ক্রোশের মধ্যেও কোনও ইস্কুল নেই। আমি কাছেই একটা পাঠশালায় প্রথম বর্গ পর্যন্ত পড়েছি। তারপর লোকনিন্দের ভয়ে পড়া বন্ধ হয়েছে।

এই সময়ে, ১৮৮১ সালে রবি ঠাকুরের বয়েস কুড়ি। আর নতুন বউঠান বাইশ।

রবি ঠাকুরের নতুন বই বেরোল। নাম ‘ভগ্নহৃদয়’। বিয়ের বেশ কয়েক বছর পরে এ-বই আমি প্রথম দেখি। দেখলুম, উৎসর্গের জায়গায় লেখা, শ্রীমতী হে!

কে গো শ্ৰীমতী হে?

কেমন যেন রহস্যের গন্ধ পেয়েছিলুম আমি। কৌতূহল থেকে প্রশ্নটা করে ফেলেছিলুম।

ও সম্ভবত একটু বিরক্তই হল। বললে, সব কথা সবাইকে জানতে নেই।

আমি বললুম, আমাকেও জানতে নেই?

ও বললে, জানলেও বুঝবে না। তবু, জানতে যখন চাইছই, শোনো। ’হে’ হল হেমাঙ্গিনী।

—হেমাঙ্গিনী! সে কে?

—হেকেটি আর হেমাঙ্গিনী সব একাকার হয়ে আছে।।

–বুঝতে পারছিনে, একটু খোলসা করে বলো না বাপু।

—হেকেটি এক রহস্যময়ী দেবী। আর হেমাঙ্গিনী হল নতুন দাদার লেখা অলীকবাবু নাটকের নায়িকা। দু’টি চরিত্রের মধ্যেই মিশে আছে নতুন বউঠান।

এর বেশি কিছু সেদিন আমাকেও বলেনি। বাকি গল্পটুকুও আমি একটু একটু করে জোগাড় করে গেঁথেছি। আগে বলেওছি সেকথা। কিন্তু যা বলিনি, তা এবার বলতে চলেছি।

লিখতে খুব খারাপ লাগছে। তবু লিখছি।

কেন লিখছি, জানি না। আমার জীবদ্দশায় এ-লেখার কথা কেউ জানবে না।

আমার মৃত্যুর পরে যদি কোনওদিন কেউ আবিষ্কার করে এই লেখা…তবু কোনওদিন ছাপা হবে, এ-আশা আমি করি না। ঠাকুরবাড়ির যা রীতি, সেই অনুসারে এই লেখা, এই অপ্রিয় সত্য, জ্বলে-পুড়ে শেষ হবে।

আমার স্বামী বিলেত থেকে ফেরবার পরেই নতুন বউঠানের মধ্যে যে প্রাণের জোয়ার এল, যেভাবে দু’জনের মেলামেশা ঘনিষ্ঠতা শুরু হল, সেটা ঠাকুরবাড়ির অনেকেরই চোখে পড়ল।

বিশেষ চোখ টাটাল আমার মেজোজা জ্ঞানদানন্দিনীর। তিনি কিংবা মেজোভাশুর, কেউ একজন কথাটা বাবামশায়ের কানে তুলে দেন বলে আমার ধারণা।

বাবামশায় তো কোনওরকম উত্তেজনা বা আবেগ দেখান না। উনি চাইলেন, রবিকে যেন তখুনি আবার বিলেত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওর আবার বিলেত যাওয়ার সব ঠিকঠাক হয়ে গেল।

কথাটা নতুন বউঠানের কাছে পৌঁছোতে দেরি হল না।

রবি আবার তাঁকে ছেড়ে চলে যাবে?

আবার সেই একা জীবনের যন্ত্রণা? আবার ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলের সেই অত্যাচার?

তাঁর প্রাণের দেওরটিই তো শুধু তাঁর বেদনার কথা বোঝে এতবড় বাড়িতে।

তাঁর মনের কথা বলার আর তো কেউ নেই সেই ছেলেবেলা থেকে। দেড়বছর পরে ফিরে আসার পর রবিই হয়ে উঠেছে তাঁর একমাত্র অবলম্বন।

রবিকে ছেড়ে থাকা এখন আর তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

নতুন বউঠান আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁর সেই প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হল।

তাঁর ব্যর্থ আত্মহত্যার গল্প নানাভাবে রটতে লাগল। এরকম একটা মুখরোচক গল্পে ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহল যে কত রকমের রং চড়াল। বাবামশায় যে সে গল্প জানতেন, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই।

আমি নিশ্চিত, নতুন বউঠান আত্মহত্যা করার চেষ্টা করায় তাঁর সঙ্গে আমার স্বামীর সম্পর্ক নিয়ে আরও বেশি কানাঘুষো শুরু হল। নতুন বউঠান আর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে থাকতে পারলেন না। কোথায় যাবেন তিনি?

তাঁর তো কোনও বাপের বাড়িও নেই।

স্বাভাবিকভাবে জ্ঞানদানন্দিনীর চাপ এল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উপর—নতুন ঠাকুরপো, কোথাও একটু কিছুদিনের জন্যে বউকে নিয়ে ঘুরে এসো। এ বাড়িতে এখন তোমাদের বেশ কিছুদিন না থাকাই উচিত। ব্যাপারটা একটু থিতিয়ে যাক। তখন না হয় ফিরে এসো। আমার তো মনে হয় বাবামশায়ই পিছন থেকে আমার মেজোজাকে বলেছিলেন, নতুন বউঠানকে তাঁর স্বামীর সঙ্গে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে। তিনি চাইছিলেন, নতুন বউঠানের সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্কটা আরও অনেক আঁটসাঁট হোক।

ওকে যে আবার বিলেতে ফেরত যেতে হবে, সেটা আমার বর বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল। বুঝতে পেরেছিল, নতুন বউঠানের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙে দেওয়া হবেই—আজ না হয় কাল।

ব্যারিস্টার হতেই হবে, যাও বিলেত যাও, আইন পড়ো, শুধু গান-কবিতা লিখে বাড়িতে বসে থাকলে হবে না রবি ঠাকুরকে তো প্রায় হুকুম করা হল। আদেশ করলেন তার মেজোদাদা ও মেজো বউঠাকরুণ।

ওর মনেও তো কষ্ট কম হয়নি নতুন বউঠানকে ছেড়ে আবার চলে যেতে হবে ভেবে। নতুন বউঠান তাঁর রবিকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না, তা তিনি যেখানেই যান তাঁর স্বামীর সঙ্গে, একথাও প্রিয়তম দেওরটি অনুভব করেছিল।

আর সেই কথাটাই তো অকপটে না লিখে পারল না ‘ভগ্নহৃদয়’-এর উৎসর্গে—সে লিখেছে, আমি যে কতবার পড়েছি এই লাইনগুলি, কষ্ট পেতে ভালো লেগেছে, তাই পড়েছি–

আজ সাগরের তীরে দাঁড়ায়ে
তোমার কাছে;
পরপারে মেঘাচ্ছন্ন
অন্ধকার দেশ আছে।
দিবস ফুরায়ে যবে সে দেশে
যাইতে হবে,
এপারে ফেলিয়া যাব
আমার তপন শশী—
ফুরাইবে গীত গান,
 অবসাদে ম্রিয়মান,
সুখ শান্তি অবসান—
কাঁদিব আঁধারে বসি।

আমি ভাবতে চেষ্টা করছি তখন ঠিক আমার বরের মনের অবস্থা কেমন?

যে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে তার নতুন বউঠানকে। তার নতুন বউঠানও খুব ভালোবাসেন তাকে। তাঁদের জীবনের প্রথম প্রেম বলতে কিন্তু এই ভালোবাসাটাই।

জোর করে ঘটানো হচ্ছে তাঁদের বিচ্ছেদ। এছাড়া উপায় বা কী? এই অসামাজিক সম্পর্ক কোন সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাবে দু’জনকে? হয়তো সমগ্র পরিবারকেই? ।

নতুন বউঠানকে ছেড়ে ও যে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে, কেমন তার মনের অবস্থা সেই মুহূর্তে? আমার বর কিন্তু কিছু লুকোয়নি। তার মনে ভয়, তার সঙ্গে তার নতুন বউঠানের আর কোনওদিন দেখা হবে না। তাকে ছাড়া তার বউঠান বাঁচবে না—এ-বিষয়ে সে নিশ্চিত। এর পরে, সে-ও হয়তো আর লিখবে না। লিখলেও সেই লেখার জন্যে থাকবে না তার নতুন বউঠানের হৃদয়ের ছায়া, তার প্রেমের আশ্রয়। সে শুধু চাইছে একটুখানি কান্না—তার নতুন বউঠানের চোখের জল। এই লেখা যখন ছেপে বেরোল সবাই তো বুঝল। আমার বরের কি একটুও ভয় করেনি! আমার বর কী মরিয়া হয়ে ভালোবেসেছিল নতুন বউঠানকে!

মরিয়া না হলে সবাই দেখবে পড়বে জানবে জেনেও সে লিখল কী করে এইভাবে–

স্নেহের অরুণাললাকে
খুলিয়া হৃদয় প্রাণ।
এপারে দাঁড়াবে দেবি,
গাহিনু যে শেষ গান
তোমারি মনের ছায়
সে গান আশ্রয় চায়—
একটি নয়নজল তাহারে
করিয়ো দান।
আজিকে বিদায় তবে,
আবার কি দেখা হবে—
পাইয়া স্নেহের আলো
হৃদয় গাহিবে গান?

উপর-উপর একটা মোড়ক আছে বটে। স্নেহের মোড়ক। কিন্তু সে তো শাক দিয়ে মাছ ঢাকা। সবাই যা বোঝার তাই বুঝেছিল নিশ্চয়।

ও কিন্তু বিলেত গেল না।

গেল না মানে যেতে পারল না।

নতুন বউঠানের জন্যে মনকেমন সামলাতে পারেনি।

তাছাড়া ওর মনে ভয় ছিল, নতুন বউঠান ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না, আবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করবে। তাই জাহাজ মাদ্রাজে পৌঁছতে ও জাহাজ থেকে পালিয়ে গেলই বলা যায়।

একেবারে সোজা চন্দননগরে। সেখানেই নতুন বউঠানকে নিয়ে উঠেছিলেন তাঁর স্বামী। আমার বর সেখানে হঠাৎ গিয়ে হাজির।

নতুন বউঠান আশাই করেননি তাঁর রবি জাহাজ থেকে পালিয়ে তাঁর কাছে চলে আসবে। সেই পুনর্মিলনের গল্প আমি আমার বরের মুখেই শুনেছি। যতটা মনে আছে ওর ভাষাতেই লিখছি— আমি তো ফিরে এলেম মাদ্রাজ থেকে। সেই ফিরে আসাটা বিফলে গেল না ছোটবউ। নতুন বউঠান তখন জ্যোতিদাদার সঙ্গে তেলেনিপাড়ায় বাঁড়ুজ্যেদের বাগানবাড়িতে। গিয়ে দেখি জ্যোতিদাদা রয়েছেন তাঁর নিজস্ব জগতে। আর নতুন বউঠান ভারি নিঃসঙ্গ। আমাকে ফিরে পেয়ে সে যে কী খুশি হয়েছিল! আবার গানে কবিতায় ভরিয়ে দিলেম তাকে। বুঝলে ছুটি, গঙ্গা সাঁতরে তখন এপার-ওপার হতেন। নতুন বউঠান দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠত। আর সেই মেয়ে যে আমার জন্যে এতটাই উদ্বিগ্ন তা দেখতে আমার ভালোলাগত। আমি সাঁতার কাটতে কাটতে এতই দূরে চলে যেতাম যে সে আর আমাকে দেখতে পেত না। তখন প্রায় কান্নাকাটি শুরু করে দিত আমি ডুবে গেছি ভেবে। এখন ভাবি নতুন বউঠানকে এতটা কষ্ট না দিলেই পারতাম—তার তো মনের কষ্টের অভাব ছিল না।

তারপর একদিন বাঁড়ুজ্যেদের বাগানবাড়ি থেকে চন্দননগরেই আরও একটা রোম্যান্টিক ঠিকানায় চলে এলাম আমরা। মোরান সাহেবের বাগানবাড়ি—এ-বাড়িটা আরও সুন্দর। একেবারে গঙ্গার উপরেই। আর তখন ভরা বর্ষা। একদিন দুপুরবেলা খুব বৃষ্টি এল। যাকে বলে বৃষ্টিপাত মুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন। সেই দুপুরবেলাটা নতুন বউঠানের সঙ্গে আমি খ্যাপার মতো কাটিয়েছিলাম। সেই খ্যাপামিটা ছিল আমাদের দু’জনের। বিদ্যাপতির ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’ পদটিকে মনের মতো সুর বসিয়ে গাইতে গাইতে আমরা দুজনে বৃষ্টিতে ভিজেছিলুম— কোনও বাধা ছিল না সেদিন আমাদের মধ্যে। আবার হয়তো কোনও-কোনওদিন সূর্যাস্তের সময় আমরা দুজনে নৌকো করে বেরিয়ে পড়তাম—তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, তার আলো এসে পড়েছে নতুন বউঠানের চোখে, চুলে। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে তাকে! সেই মায়া কাটতে না কাটতে তাকে আবার নতুন রূপে পেতুম, যখন সূর্যাস্তের পর পূর্ববনান্ত থেকে চাঁদ উঠত। তারপর আমরা বাগানের ঘাটে ফিরে নদীতীরের ছাদটার উপরে বিছানা করে চুপচাপ। তীরের বনরেখা অন্ধকারে নিবিড় হয়ে আসত। সেই যে দু’জনে মিলে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ, সেই মৃদু গম্ভীর স্বরে গভীর আলোচনা, মনের দেয়ানেয়া, সেই সন্ধেবেলার ছায়া, কোনও-কোনওদিন শ্রাবণের বর্ষণ আর বিদ্যাপতির গান—ছোটবউ, তারা সব চলে গেছে। কিন্তু তবু তারা যায়নি। আমার গানে, আমার কবিতায় তাদের ইতিহাস লেখা থাকল। মনে পড়ছে, একদিন নতুন বউঠানকে বলেছিলুম, আমার লেখার মধ্যে আরও একটি লেখা লুকিয়ে থাকল। এক লেখা আর সকলে পড়বে। আর সেই লুকিয়ে থাকা লেখা তুমি আমি পড়ব। কিন্তু তা-ই কি হয় রবি ঠাকুর? সবাই কি এত বোকা? তোমার লেখার মধ্যে লুকিয়ে থাকা লেখার মানে যে সবাই বুঝে গেল একদিন। তোমার লুকিয়ে থাকা লেখাই যে ডেকে আনল সর্বনাশ! আমাদের বিয়ের মাস সাতেক আগেই হবে, ‘ভারতী’ পত্রিকাতে তুমি লিখেছিলে একটা লেখা—সেই লেখার আমি খোঁজ পেয়ে পড়েছি। তুমি কেন লিখতে গেলে এই লেখাটা? আবেগ সামলাতে পারোনি? ভেবেছিলে কেউ বুঝবে না? বা বুঝেও চুপ করে থাকবে? তুমি লিখেছিলে হুবহু এই কথা—

সেই জানলার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রুজলে সিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন যে আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে

মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই তো যথার্থ কবিতা লিখিয়া ছিল। তাহার সেই অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আর আমার রচিত গোটাকতক অর্থহীন হিজিবিজি ছাপা হইয়া গেল।

এই লেখা বেরোবার পরে বাবামশায় আর বসে থাকেননি। তখন তিনি মুসৌরিতে। সেখান থেকে তিনি আপনাদের রবি ঠাকুরকে চিঠি লিখে আজ্ঞা করেন, অবিলম্বে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে। আপনাদের রবি ঠাকুর বলেছেন বটে, তাঁর বিয়ের কোনও গল্প নেই, কিন্তু গল্প একটা আছে বইকি। সেই গল্পের শুরু ‘ভারতী’ পত্রিকায় এই লেখাটি থেকে। তারপর বাবামশায়ের চিঠি—অবিলম্বে আমার সঙ্গে দেখা করো এবং তাঁর আদেশ, যত শীঘ্র সম্ভব, বিয়ে করো। এরপরেই বউদিদিদের আগ্রহ রবির বিয়ের জন্যে বিশেষ করে মেজোজার ইচ্ছে বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোক।

এইবার সেই প্রশ্নের উত্তরের কাছাকাছি আসছি রবি ঠাকুর, তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে কেন? কেন রবি ঠাকুর, কেন? সেই ‘কেন’-র উত্তর আমি নিজেই খুঁজেছি সারা জীবন। এবার হয়তো উত্তরটির কাছাকাছি আসছি ক্রমশ।

ঠাকুরবাড়ির বধূদের চিরাচরিত ‘আকর’ যশোর। বউঠাকুরানিরা তাঁদের প্রিয় রবির বউ খুঁজতে সেখানেই এলেন। তার মানে, কনে খুঁজতে এলেন, জ্ঞানদানন্দিনীদেবী এবং কাদম্বরীদেবী, দু’জনেই। সঙ্গে এসেছিল ইন্দিরা, মানে মেজোজার মেয়ে। আর কে এসেছিলেন জানেন—স্বয়ং রবি ঠাকুর।

যদিও উনি বলেছেন, উনি আসেননি। কিন্তু উনি না এসে পারেননি।

কারণ নতুন বউঠান যে এসেছিলেন। কে

ন এসেছিলেন নতুন বউঠান?

অনেক পরে বুঝেছি, তাঁর আত্মহত্যারও অনেক পরে, যখন একটু বয়েস হল আমার, তখন বুঝেছি তাঁর ভালোবাসার মানুষটির বউ খুঁজতে তাঁকে জোর করে নিয়ে আসা হয়েছিল—ইচ্ছে করে তাঁকে এই মানসিক শাস্তি দেয়া হয়েছিল। এই হল ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলের নিষ্ঠুরতা। পরে যখন বুঝতে পেরেছি, আমার খুব কষ্ট হয়েছে নতুন বউঠানের জন্যে। সেই মানসিক কষ্ট যাতে তাঁকে একা না পেতে হয়, জ্ঞানদানন্দিনীর চাপ তাঁকে না একা সহ্য করতে হয়, সেইজন্যেই নতুন বউঠানের সঙ্গে তাঁর প্রিয়তম মানুষটিও এসেছিল—আমাকে দেখে পছন্দ করতে নয়, নতুন বউঠানকে আগলাতে, তাঁর পাশে থাকতে।

এবার প্রশ্ন হল, যশোরে এত মেয়ে থাকতে আমাকে পছন্দ হল কেন?

যশোরে এত মেয়ে তো কী হয়েছে, সবাই তো আর পিরালি-ব্রাহ্মণ ঠাকুরবাড়িতে মেয়ে দেবে না। পিরালিরা মুসলমানের জলছোঁয়া ব্রাহ্মণ। তায় আবার ব্রাহ্ম। হিন্দুদের মতো নারায়ণ-সাক্ষী করে বিয়ে করে না। তা ছাড়া সে বছর বোধহয় যশোরে সুন্দরী মেয়েদের আকাল পড়েছিল। আমাকে পছন্দ হওয়ার কারণ বউঠাকরুণরা অনেক চেষ্টা করেও রবি ঠাকুরের জন্যে মনের মতো কনে খুঁজে পাননি।

তবে আরও একটু কারণ আছে। একটু গোপন কারণ এবং আরও জরুরি কারণ।

আমার বাপ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এক সামান্য কর্মচারী বেণী রায়। সুতরাং এ-বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, আমি ঠাকুরবাড়ির একান্ত বাধ্য বউ হব, সারা জীবন মুখে রা-টি কাটব না। সেই সাহসই হবে না আমার।

নতুন বউঠানও তো তাই। বাজার সরকারের মেয়ে—তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বউ!

আমি ঠাকুরবাড়ির আর এক কাজের লোকের মেয়ে—রবি ঠাকুরের বউ!

আর জ্ঞানদানন্দিনী, আমার মেজোজা? তাঁর বাবা অভয়চরণের তো এক বিরাট গল্প। সে গল্প তাঁর মুখেই শুনেছি। তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে এক ধনী পিরালি-ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। এবং তাঁরই মেয়ে নিস্তারিণীকে তিনি বিয়ে করে ঘরজামাই হন। জ্ঞানদানন্দিনী বউ হয়ে ঠাকুরবাড়িতে এলেন তাঁর দুধেদাঁত পড়ার আগে। একদিন আমাকে গপ্পো করে বললেন, দুধেদাঁত পড়লে ইঁদুরের গর্ত খুঁজে সেখানে দাঁতটি দিয়ে বলতে হয়, ইঁদুর, পড়া দাঁত তুমি নাও, তোমার দাঁত আমায় দাও। বিয়ের পরে আমার যখন দুধেদাঁত পড়ল তখন কলকাতার পাকা ইটচুনের বাড়িতে কোথায় খুঁজব ইঁদুরের গর্ত? সে এক সমস্যা হয়েছিল। এই জ্ঞানদানন্দিনী লেখাপড়া শিখে একা বিলেত গিয়েছিলেন। তারপর আবার গভর্নর লরেন্সের পার্টিতেও একা গিয়েছিলেন! তাঁর কাছে আমরা তো কোন ছার! আমার তো মনে হয়, আমার মেজোজা চেয়েছিলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের বউ যেন আমরাই হই, যাদের সামাজিক পরিচয় অনেক নীচের। এখানে স্বীকার করছি, একটা ব্যাপার আমার খুব ভালোলাগে—এই যে ঠাকুরবাড়ির মঞ্চ আলো করে হঠাৎ যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলেন ওর নতুন বউঠান কাদম্বরীদেবী আর জ্ঞানদানন্দিনীকে কিছুদিনের জন্যে যে ছায়ায় চলে যেতে হয়েছিল, ওঁর লাঠি ঘোরানো একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই ব্যাপারটা আমার বেশ মনে ধরেছে। নতুন বউঠানকে সারা জীবন ঠাকুরবাড়ির মহিলামহল নানাভাবে মানসিক কষ্ট দিয়েছে। আমি যখন ভাবি, আপনাদের রবি ঠাকুর অত অল্প বয়সে তাঁর নতুন বউঠানের পাশে দাঁড়িয়ে সেই অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়ার হয়তো চেষ্টা করেছিলেন, তখন আমার মধ্যে কষ্টের, বেদনার যে আগুন জ্বলছে তার মধ্যে কোথাও যেন একটু অহংকারও মিশে যায়। আমার বরকে আমার ভালোবাসার মতো একজন মানুষ বলে মনে হয়। ওর কবিতা, গান, কতরকমের লেখা আমি অত বুঝিনে। কিন্তু এইটুকু বুঝি, ও নতুন বউঠানকে এত ভালোবেসেছিল, আজও বাসে, সেই মেয়ে এ-বাড়িতে এত একা একা কষ্ট পেয়েছিল বলে। তার বাপের বাড়ির জোর ছিল না বলেই তো এত কষ্ট তাঁকে পেতে হল। আমারও তো তা-ই।

আমার সঙ্গে রবি ঠাকুরের বিয়ের ঠিক হল আর যশোরেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন নতুন বউঠান।

তাঁর প্রিয়তম মানুষটির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এ-বিয়ে আটকাবার আর কোনও উপায় নেই, রবি আর তাঁর থাকবে না—এই মানসিক যন্ত্রণা তিনি সহ্য করতে পারেননি। এবং এই যে তিনি অসুস্থ হলেন, আমার বিয়ের পরে যে ক’টি মাস তিনি বেঁচে ছিলেন, তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশ অসুস্থই ছিলেন। আমি যখন তাঁকে দূর থেকেই দেখতুম, কেমন যেন মানুষ বলে মনেই হত না তাঁকে। মনে হত তিনি ছায়া। খুব দুঃখী ছায়া। তবে ভারি সুন্দর দেখতে। ঠাকুরবাড়িতে সবচেয়ে সুন্দরী ওই ছায়ার মতো মেয়ে। শুনেছিলুম, ওঁর বয়স নাকি পঁচিশ। আমার মনে হত অনেক কম। কী পাতলা হালকা গড়ন। তাই হয়তো বয়স অত কম মনে হত। রং বেশ চাপা, ছিপছিপে, আর চোখের চাউনিতে কী যেন ছিল, ঠিক বলতে পারব না—অন্য কোনও মেয়ের অমন চাউনি দেখিনি–।

একদিন আপনাদের রবি ঠাকুরকে হঠাৎ জিগ্যেস করেছিলেন, তোমার মুখে মারাঠি মেয়ে আন্না তড়খড়ের গল্প শুনেছি, বিলেতের কত মেয়েদের গল্প শুনেছি, ওদের দেখে আসার পর

আমাকে পছন্দ করলে কেন?

এতটুকু না দেরি করে ও বললে, আমার বিয়ের যেমন কোনও গল্প নেই, আমার পছন্দ অপছন্দেরও তেমনই কোনও ব্যাপার নেই। বউঠানরা যখন বড় বেশি পীড়াপীড়ি শুরু করলেন, আমি বললুম, তোমরা যা হয় করো, আমার কোনও মতামত নেই।

আমি বললুম, তুমি তো মেয়ে দেখতে গিয়েছিলে। আমাকে কী কারণে পছন্দ করলে?

ও কী বললে জানেন? বললে, দেখতে গিয়েছিলুম বুঝি?

আমার কখনও-কখনও মনে হয়, নিজের বিয়েটাকে অন্তত প্রথম প্রথম, ও নিজেই মেনে নিতে পারেনি।

ও তো ঠাট্টাই করেছিল আমার সঙ্গে ওর বিয়েটাকে।

তা না হলে কেউ নিজের বিয়ের নেমনতন্নের চিঠি ও যে ভাবে লিখেছিল, সেই ভাবে লেখে?

নেমনতন্ন চিঠিটার প্রথমেই মাইকেল মধুসূদনের লেখা এই লাইনটা ছিল—আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়! তারপর এই চিঠি—নিজের হাতে লেখা—

আগামী রবিবার ২৪ অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক।

আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন। ইতি।

অনুগত শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অনেকে এই চিঠিতে রবি ঠাকুরের কৌতুকভরা মনের পরিচয় পেয়েছেন। আমি চিঠিটা অনেক পরে হঠাৎ-ই দেখেছিলুম। এবং আমার বেশ খারাপ লেগেছিল।

তবে ভয় করেছিল—সত্যিই ভয়ে আমি কেঁদে ফেলেছিলুমবাসরঘরে। বাসরঘর আমাদের বাড়িতে হয়নি।

হয়েছিল জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।

উনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতি।

কত বড় জমিদার!

সেই বাড়ির ছেলে কী করে যাবে তার কর্মচারীর মেয়েকে বিয়ে করতে তারই বাড়িতে?

কী করে সেই বাড়িতে হতে পারে তার বাসরঘর?

ও পরিষ্কার বলে দিলে, বিয়ে করতে আমি কোথাও যাব না।

কনেকে নিয়ে এসো জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।

যা হওয়ার এখানেই হবে।

তাই হল। আমার বিয়েই হল সম্পূর্ণ এক অজানা অচেনা পরিবেশে।

এতবড় বাড়ি সেই আমি প্রথম দেখলুম।

এইরকম মানুষজনও কখনও আগে দেখিনি।

এঁদের কথাবার্তা, আদবকায়দা সব আলাদা।

বিশেষ করে মেয়েদের সাজপোশাক, কথা, পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা—এরকম তো আগে কখনও দেখিনি।

আমার যে কী লজ্জা করছিল, আর ভয় করছিল।

কোথায় গেল সব—আমার মা, আমার বাবা, আত্মীয়রা?

কোথাও তো তাদের দেখতেই পেলুম না।

তবে মনে আছে, এতটুকু ধুমধাম হয়নি আমার বিয়েতে। কোনও আনন্দ ছিল না বাড়িতে। যেন হঠাৎ আলো নিভে গেল। তার একটা কারণ অবিশ্যি আগেই বলেছি, আমার বড় ননদাই সারদাপ্রসাদ আমার বিয়ের দিনেই মারা যান।

আরও একটা কারণ, বরের নিজের মনে মনে কোনও আনন্দ ছিল না। এবং সবার মনের মধ্যে এই ভাবটি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, জোর করে আমার মতো একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাড়িতে সবার প্রিয় রবির প্রতি নিদারুণ অবিচার করা হল।

এই অপরাধের ক্ষমা নেই, এ কথাটা মনে-মনে ঘুরছিল।

বাসরঘরে সম্ভবত চাপা অভিমান, রাগ, হতাশা থেকে আমার বর যে কাণ্ডটা করল, আমার বুক কাঁপছিল। পাশে আমার কেউ নিজের লোক, মানে বাপের বাড়ির কেউ ছিল না, তা-ই আরও ভয় পেয়ে গেলুম।

নিজেরই বাড়িতে পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে বর এল আমাকে বিয়ে করতে। এসে দাঁড়াল পিঁড়ির উপর।

এরপর মনে পড়ছে বাসরঘরের কথা। ভাঁড়-কুলো খেলার সময় এল।

ভাঁড়ের চালগুলি ঢালাই-ভরাই করা হল ভাঁড়খেলা।

আমি একগলা ঘোমটার মধ্যে দিয়ে দেখছি আমার বর কেমন ভাঁড় খেলে।

ও করল কী, ভাঁড়গুলো ধরে ধরে সব উপুড় করে দিতে লাগল।

ওর ছোট কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী, যাঁর গল্প ইতিমধ্যে বলেছি, উনি তো চিৎকার করে উঠলেন —ও কী করিস রবি? ওই বুঝি তোর ভাঁড়খেলা? ভাঁড়গুলো সব উলটেপালটে দিচ্ছিস কেন?

দেখলাম, ঠিক সেই সময়ে ঘরে এসে দাঁড়ালেন যিনি, পরে জেনেছিলুম তিনিই নতুন বউঠান!

খুব অসুস্থ লাগছিল তাঁকে।

সবাই তাকিয়ে তাঁর দিকে।

তাঁর চোখ দিয়ে মনে হল আগুন ঝরছে। আর ঠোঁটে হাসি।

আমার বর ছোট কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরীকে বললে, জানো না কাকিমা, আজ আমার জীবনের সব কিছুই তো উলটপালট হয়ে গেল! কাজেই আমি ভাঁড়গুলোও উলটে দিচ্ছি। আমার বর তাঁর ছোটকাকিমাকে কথাগুলো বললেন বটে, উনি কিন্তু সারাক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন নতুন বউঠানের চোখের দিকে! ওর সেই কথা আজও শুনতে পাই।

আমার বরের মুখে একথা শুনেই নতুন বউঠান মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ছোট কাকিমা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, রবি, তুই একটা বরং গান কর। তোর মতো গাইয়ে থাকতে তোর বাসরে আর কে গান গাইবে?

কাকিমার মুখের কথা খসতে না খসতে কর্তাটি আমার মনে হল আমাকে বেশ ঠাট্টা করেই গান শুরু করে দিল—

আ মরি লাবণ্যময়ী
কে ও স্থিরসৌদামিনী,
পূর্ণিমা-জোছনা দিয়ে
মার্জিত বদনখানি!
নেহারিয়া রূপ হায়,
আঁখি না ফিরিতে চায়,
অপ্সরা কি বিদ্যাধরী
কে রূপসী নাহি জানি।

প্রথম রাত্তিরেই আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন উনি আমাকে কী চোখে দেখলেন—বাকি জীবন কী চোখে দেখবেন।

উনি কিন্তু বেড়াল মারতে দেরি করেননি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *