দোসর

দোসর

দুনিয়ার সবচেয়ে তাজ্জব চিজ, বুঝেছ–এই শুয়োর। রেল ইষ্টিশনের বাইরে নোংরা একফালি মাঠের ভেতরে, একটা মাদি শুয়োর কতগুলো ছানাপোনা নিয়ে ঘোঁৎঘোঁৎ করছিল, সেই দিকে তাকিয়ে বাঁ-চোখটা কুঁচকে আলতোভাবে কথাটা বলেছিল লোকটা।

তা মানুষটাকে দেখলে কেমন যেন গা-শিরশির করে, একটু ভক্তিটক্তিও হতে চায়। সাদায়-কালোয় মাথার চুল, সাদার ভাগটাই বেশি। মোটা মোটা ভুরু দুটোও পাকধরা, তার নীচে এক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ। মুখে খানিক এবড়োখেবড়ো সাদা দাড়ি, দেখলেই বোঝা যায় দাড়িটা নিয়মিত রাখে না-খেয়ালমতো কামিয়ে ফেলে মধ্যে মধ্যে। নাকের বাঁ-দিকে একটা শুকনো কাটার দাগ, মনে হয় সাঁওতালি তির কিংবা বল্লমের ঘা লেগেছিল কোনোকালে।

প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে গা এলিয়ে, পায়ের কাছে গামছার পুঁটলিটা রেখে, আধ ঘণ্টা লেট লোকাল ট্রেনটার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে একটু দূরের শুয়োরগুলোকে দেখে বাঁ চোখটা একটু কুঁচকে লোকটা বলছিল, হুঁ, যা বলেছি। দুনিয়ার সবচেয়ে তাজ্জব চিজ হল এই শুয়োর।

পাশে বসে ভক্তিমানের মতো শুনছিল জন দুই চাষি গেরস্ত। কয়েক হাত দূরে সুটকেস পেতে বসে আমিও শুনছিলুম, কারণ আধ ঘণ্টা লেট হয়ে যে-ট্রেনটা আসছে তাতে আমাকেও যেতে হবে। সামনের ফাঁকা রেলের লাইন, মাথার ওপর রাধাচুড়োর পাতায় হালকা বাতাসের শব্দ, ওদিকের সাইডিং-এ খান তিনেক কালো কালো পুরোনো ওয়াগন। মালগুদামের টিনের চালে চোখ-ধাঁধানো খানিক রোদের ঝিলিক আর থেকে থেকে কাকের ডাক আমার সারা শরীরে একটা ক্লান্ত ঝিমুনি নিয়ে আসছিল। লোকটার ভরাট আর ভাঙা ভাঙা গলার আওয়াজে আমি নড়েচড়ে বসলুম।

ভক্তি সত্ত্বেও একজন চাষি অবাক হল একটু।

এত জীব থাকতে শুয়োর সবচাইতে তাজ্জব হল কেন?

কখনো সুন্দরবনের তল্লাটে যাওয়া হয়েছে?

আজ্ঞে না।

নদীগুলো যেখানে রাক্ষুসে হয়ে সাগরে পড়ে, সেসব মোহানার খবর জানা আছে কিছু?

আজ্ঞে জানব কী করে? যাইনি তো কখনো।

সেইসব নোনা গাঙের ভেতর চর জাগল। এলোপাথাড়ি গাছগাছলাও গজাল খানিকটা। কিন্তু মানুষ গিয়ে থাকতে পারে না। এক তোনোনা, তার ওপর জোয়ারের সময় সব ডুবে যায়—কিলবিল করে সাপ। একটা পানবোড়া এক বার ঠুকে দিলে তো শিবের অসাধ্যি।

আজ্ঞে সে তো বটেই।

তখন সে-চরে সবচেয়ে আগে কে যায় বলোদিনি?

জানিনে।

যায় শুয়োর। লোকটা এবার একটু হাসল, কুঁচকে প্রায় বন্ধ হয়ে গেল বাঁ-চোখটা। কোত্থেকে যায়?

অন্য চর থেকে, ডাঙা থেকে।

কী করে যায়?

কেন? সাঁতরে।

ওই গহিন গাং?

গহিন গাং বই কী। বাঘের অবধি সাহসে কুলোয় না। কিন্তু যাকে বলে শুয়োরের গোঁ। ওদের সাঁতরাতে দেখেছ কখনো? ঠিক কুকুরের মতো জলের ওপর নাকটা তুলে তুরতুর করে পেরিয়ে যায় দু-এক মাইল।

তা চরে গিয়ে কী করে শুয়োর? আর একজন চাষি একটা বিড়ি ধরাতে গিয়েও ভুলে গেল।

সেখানে তো কচু-কন্দ নেই, খায় কী?

কেন? কাঁকড়া।

কাঁকড়া? এবার দুটি শ্রোতাই চমকাল এবং সেইসঙ্গে আমিও।

বললুম-না দুনিয়ায় অমন আজব চিজ আর নেই? নোনা জলের অ্যাই বড়ো বড়ো কাঁকড়া দেখেছ তো? শুয়োর সেগুলো ধরে কড়মড় করে চিবিয়ে খায়।

শুয়োরে কাঁকড়া খায়? একজন তখনও অবিশ্বাসী।

তেমন তেমন হলে বাঘে ধান খায় শোননি?

তাহলে পেটের চিন্তা নেই?

এক্কেবারে না। আর জোয়ারের জল এসে চর ডুবে গেলে কী করে জান? বুনো গাছ জাপটে ধরে মানুষের মতো সোজা হয়ে জলের ওপর নাক ভাসিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।

খুবই তাজ্জব বলতে হবে তাহলে। প্রথম চাষিটি একটু হাঁ করে চেয়ে থেকে ব্যাপারটা বুঝে নেবার চেষ্টা করল, আপনি এতসব জানলেন কী করে?

খুলনা জেলার লোক না আমি? এইবার লোকটি বিষণ্ণ হল একটু, চোখেই তো দেখা এসব। কিন্তু পাকিস্তান হয়েই… একটা ছোটো নিশ্বাস পড়ল। চারিদিকে বানের কথা বলছিলে তোমরা? তাই শুয়োরগুলোকে মনে পড়ছিল আমার।

বান বান বান। গ্রাম ডুবছে, শহর ডুবছে, মানুষ ডুবছে, ফসল ডুবছে। যেন রসাতলে যেতে বসেছে গোটা দেশটাই। সেই যন্ত্রণা আর দুর্ভাবনা সব কটি মুখেই ছড়িয়ে পড়ল। বেলা এগারোটার সময়েও রাধাচুডোর হালকা ছায়াটার তলায় যেন এক টুকরো বিষণ্ণ অন্ধকার নামল।

মনে হল গোটা তিনেক নিশ্বাস পড়ল একসঙ্গে। চুপ করে কাটল কয়েক সেকেণ্ড। যে চাষিটি তখন থেকে বিড়িটা হাতে নিয়ে বসে ছিল, সে এবার সেটা এগিয়ে দিলে লোকটির দিকে। আমি দূরের চোখ-ধাঁধানো করোগেটেড টিনের চালাটার দিকে তাকিয়ে থেকেও দেশলাইয়ের আওয়াজ পেলুম, বুঝতে পারলুম ওরা তিন জনেই তিনটে বিড়ি ধরিয়েছে।

আমাকে ওরা চোখ দিয়ে দেখেছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু মন দিয়ে কেউ দেখছিল না। ওরা দূরের সুন্দরবনে ছিল, নোনা গাঙের দেশে ছিল, ওরা গহিন গাঙে সাঁতার কাটতে দেখছিল বুনো শুয়োরকে, কড়মড় করে এই বড়ো বড়ো কাঁকড়া খেতে দেখছিল। আমি সেখানে কেউ নই। ওসব আমার দেখবার কথা নয়।

একটু সময় কেটে গিয়েছিল, তবু ওদের একজন মনে করে আগের কথারই জের টানল। এইসব সাধারণ মানুষের যেমন করে বলা উচিত, তেমনি বোকা বোকা ভঙ্গিতে বললে, তা বটে। শুয়োরের কথা মনে পড়ে যায় বই কী। মানুষ যদি শুয়োর হত, তাহলে অমন করে বানের তোড়ে তলিয়ে যেত না, নাক উঁচু করে সাঁতরাতে সাঁতরাতে যেখানে হোক পাড়ি দিত।

কিংবা… যে-লোকটাকে দেখলে গা-টা একটু শিউরে শিউরে ওঠে, সাধারণ পেঁয়ো মানুষের কেমন যেন ভক্তি করতে ইচ্ছে যায়, কথা বলতে বলতে যার বাঁ-চোখটা কুঁচকে যায় বার বার, একটু মোটা আর ভাঙা যার গলার আওয়াজ, সেই খুলনা জেলার মানুষটা আবার বললে, কিংবা হাতের কাছে দু-চারটে বুনো শুয়োর পেলে বেঁচেও যেত কেউ কেউ।

বুনো শুয়োর পেলে? সে আবার কীরকম কথা?

সে আবার কীরকম কথা আমিও এটা জিজ্ঞেস করতে পারতুম। কারণ এই সেদিন— উত্তরবাংলার বন্যার সময় আমিও তো ছিলুম এক বন্ধুর বাড়িতে। শেষরাতে জল এল, হুড়মুড় করে তলিয়ে গেল টিনের ঘর, কে যে কোথায় উধাও হল আমি জানিও না। লাফিয়ে বেরিয়ে একটা গাছে উঠে পড়েছিলুম, জল নেমে গেলে এককোমর পলি আর আতঙ্কে-জমাট মৃত্যুর জগৎ ঠেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়েছি। বন্ধু, তার স্ত্রী, তার ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ের খবর নেবার সময় ছিল না, উপায়ও ছিল না। দিন সাতেক পরে অনেক কষ্টে নিরাপদ জায়গায় এসে পৌঁছেছি, যাকে সামনে পেয়েছি অনেক রোমহর্ষক কাহিনি শুনিয়েছি তাকে। আমি যদি একটা বুনো শুয়োর হতুম—এর বেশি কী আর করতে পারতুম আমি।

লোকগুলোর আলাপ-আলোচনায় আমার কেমন একটা অস্বস্তি হল। এক বার ভাবলুম আমার পকেটে ফ্লেশ-লাভার্স বলে যে পেপারব্যাকটা আছে, সেটা বরং পড়ি—ট্রেনের তো এখনও চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না। তবু ওদের কথাবার্তা আমার কানে আসতে লাগল। আমি ঠিক শুনতে চাইলুম না, তবু শুনে যেতে লাগলুম। করোগেটেড টিনের চালাটা চোখের সামনে ঝকঝক করে চলল।

তারপর সেই লোকটার গলা আরও গভীর হতে থাকল, স্মৃতির ভেতরে ডুবে গিয়ে মানুষ যেমন করে কথা বলে, কখনো স্বপ্ন দেখে কখনো জাগে, কখনো বাইরেটাকে আবছা করে দেখে কখনো দেখে না, তেমনি স্পষ্ট অথচ ছায়া ছায়া ভঙ্গিতে ভাঙা মোটা আওয়াজে সে কথা কইতে লাগল। এখন তার স্বরে জোয়ারে ফেঁপে-ওঠা রায়মঙ্গল নদী গমগম করতে লাগল। নোনা সমুদ্রের হাওয়ায় সুন্দরী-হেঁতাল-গোলপাতার মর্মর উঠতে লাগল। আমি এতক্ষণে কোথাও ছিলুম না—এবার ওই লোক দুটো, রেলের লাইন, রোদ-ঝলসানো টিনের চাল, রাধাচুড়ার ছায়া সব মিলিয়ে গেল। চারদিকে অন্ধকারের ভেতরে শুধু স্মৃতি-জড়ানো একটা স্বর জেগে রইল কুয়াশামাখা আলোকবৃত্তের মতো।

দেশ-ঘর যখন গেল, তখন বউ আর দুটো ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমি শেয়ালদা স্টেশনে। তারপর ক্যাম্পে। তারও পরে… বউটা মরল কলেরায়, ছেলেটা ভিক্ষুকের দলে মিশল, মেয়েটা একটু বড়ো হয়েছিল—সেটা যে কোন চুলোয় গিয়ে পৌঁছুল বোধ করি ভগবানও তা জানে না।

তা ভাই ছাড়ান দাও এসব কথা, এগুলো শুনে শুনে তো তোমাদের কান পচে গেছে। মোদ্দা—বছর না ঘুরতেই আমি হাত-পা ঝেড়ে সাফসুফ হয়ে গেলুম। তখন যেখানে যাই, যেখানেই থাকি, আমার আর কীসের ভাবনা। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলুম বাংলাদেশের আর এক মুল্লুকে।

কী না-করেছি বছর দুই ধরে। সরকার থেকে লোন দিয়েছিল, ব্যাবসা করতে গেলুম, ছ মাসও টিকল না। জাত চাষির ছেলে, সাতজন্মে করেছি ওসব না বুঝি কিছু! অসমের দিকে দল বেঁধে গিয়েছিলুম এক বার, পাহাড়ের ঢালে বাস্তু বেঁধে জমিতে চাষ দিয়েছিলুম, বলব কী ভাই–সোনা ফলেছিল। কিন্তু থাকতে দিলে না। প্রথমে এল সরকারি নোটিশ, কিন্তু বনবাদাড় থেকে এত কষ্টে ফসল করেছি—ছেড়ে যাব? তাতে দিলে হাতি লেলিয়ে। ঘরদোর ভেঙে আমাদের বুকের পাঁজরার সঙ্গে ফসল দলে-পিষে উৎখাত করে দিলে। হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিলে এরা পাকিস্তানের চেয়েও সরেস।

ওসব কথা থাক দাদা, আমাদের ছোটো মুখে মানায় না। কাঁদতে কাঁদতে কে যে কোন দিকে ছটকে পড়ল বলতে পারিনে, আমি অসম ছাড়িয়ে আবার বাংলাদেশে এলুম।

পৌঁছেছিলুম একটা ছোটো শহরে। জনমজুর খাটলুম কিছুদিন, কিন্তু চাষির রক্ত যাবে কোথায়! কারও কাঁধে লাঙল দেখলে, একপশলা বৃষ্টির পর ক-টা লাউ-কুমড়ো-পালঙের পাতা সবুজ হয়ে লকলক করতে দেখলে, যেন কান্না উছলে উঠত বুকের ভেতর।

সরকার থেকে তখন লোক পাঠাচ্ছিল আন্দামানে জমিটমি দেবে। কিন্তু সেই হাতির পর থেকেই আমার ভয় ধরেছিল দাদা। সে তো কালাপানির দেশ, সেখানে আবার কী লেলিয়ে দেবে কে জানে! আমার আর কী আছে, মরি তো এই বাংলাদেশেই মরব।

চাষির ছেলে, একটুখানি জমি চাই আমার। এক বিঘে না-হয় দশ কাঠা, দশ কাঠা না জুটলে পাঁচ কাঠা। কিন্তু কে দেবে জমি—কোথায় জমি! এ তো আমাদের দেশ নয় যে বন কেটে আবাদ করব, বাঘ-কুমির-সাপ তাড়িয়ে মাটির দখল নেব।

তবু আবার জমি পেলুম।

শহরের বাইরে এক পাহাড়ি নদী। যত বড়ো নদী, চর তার চাইতেও বেশি। এই চরা বোধ হয় সরকারি সম্পত্তি, কিন্তু তাতে এখন কাশ-শণ আর ইকড়ার জঙ্গল। আগে বর্ষায় চরাটা তলিয়ে যেত, কিন্তু দশ-বারো বছর ধরে তার খানিক জায়গা অনেকটা উঁচু হয়ে গেছে, আর ডোবে না। সেখানে ঘাস-পাতা পচে বেশ জমি তৈরি হয়ে গেছে।

মানুষজন কেউ থাকে না। কার গরজ পড়েছে ওখানে থাকতে। নদীর খেয়া পেরিয়ে রাতবিরেতে যারা চর পেরিয়ে আসে তারা হাওয়ায় ঘাসবনের সাঁই সাঁই শব্দ শুনে মনে মনে রামনাম জপে। তা ছাড়া ভয় দেখাবার জন্যে দুটো-চারটে আলেয়া তো আছেই।

বিশ্বেস করবে কি না জানি না, জমির খিদে আমি আর সইতে পারছিলুম না, কিছুতেই থামতে চাইছিল না বুকের কান্না, একটা ধানের চারা দেখলে, দুটো শাকের পাতা দেখলে যেন মাথাখারাপ হয়ে যাচ্ছিল আমার। শেষকালে খ্যাপার মতো আমি ওই চরে গিয়ে উঠলুম। হাতে যে দু-চারটে টাকা ছিল, তাই দিয়ে দা কিনলুম, কোদাল কিনলুম, খুঁটিনাটি আরও কিছু কিনলুম। আমার জমি আমিই গড়ব।

একাই?

একাই। আমার আর কে আছে। তা ছাড়া আর কেই-বা আমার সঙ্গে যাবে ওই ভূতুড়ে চরায় জমি গড়তে। কোন ফসলটাই-বা ফলবে ওখানে? বালি জমি, ধান-পাট কীই-বা হবে?

কিন্তু কিছু না হোক ক-টা শাক তো তুলতে পারব। পটোল হবে নিশ্চয়—দু-চারটে ফুটি তরমুজও কি ফলাতে পারব না?

আরও দশ ঘর উদবাস্তুর সঙ্গে আমারও একটা হোগলার ঝাঁপ ছিল শহরের এক টেরেয়। সেটা তুলে নিলুম। সবাই অবাক হয়ে বললে, কোথায় চললে?

নদীর চড়ায়।

সেখানে কী?

জমি গড়ব।

মাথাখারাপ? কী জমি হবে ওই কাশ আর শণের জঙ্গলে?

জানিনে। চেষ্টা করে দেখব।

ঠাট্টা করে কি বিশ্বাস করে বলতে পারিনে, একজন বললে, ওই চড়ায় পেতনি আছে।

বললুম, দেশ ছাড়বার পরে মরে তো ভূত হয়ে আছি, পেতনিতে আমার কী করবে।

মরুক গে, সব কথা বলতে গেলে তো মহাভারত হয়ে যায়। আমি একাই বাস্তু বাঁধলুম নদীর চরায়। বয়েস অল্প ছিল, কবজিতে জোর ছিল, মাথার ভেতরে খ্যাপামি ধরে গিয়েছিল। লেগে গেলুম জঙ্গল কাটতে। গোটা কতক সাপখোপ মেরে শেষতক বিঘেটাক জমি সাফ হয়ে গেল।

তোমরাও তো চাষি, জানই তো ভাই—মাটিতে মন থাকলে মাটি তোমায় কক্ষনো ঠকায়। কিছু সে তোমায় দেবেই। শাকসবজি হল, পটোল হল, ফুটি ধরল বলে। তখন দিনের বেলা যারা চেয়েও দেখত না, আর রাতবিরেতে চড়া পেরিয়ে যাওয়ার সময় রামনাম করত, তারাই দু-একজন করে দাঁড়িয়ে যেতে লাগল।

বাঃ, বেশ পটোল হয়েছে তো তোমার!

এ মাটিতেও তো শাকটাক হয় দেখছি! এক-আধজন বলত, এই চড়ায় একলাটি থাক, তোমার ভয় করে না?

কীসের ভয়?

মানে—জনমনিষ্যি নেই, তেনাদের যাওয়া-আসা আছে…।

বলতুম, তেনাদের তো কখনো দেখিনি। যদি আসেনই, আলাপ করে নেব।

তোমার সাহস আছে, বলতে হবে সেকথা।

হুঁ। এখানে—এমন একলাটি থাকা…।

শুধু একজন একবার বলেছিল, পাহাড়ে নদীর চড়ায় ঘর বাঁধলে হে? এসব নদীকে বিশ্বাস করতে নেই। ইচ্ছেমতো খাত বদলায়, একদিন এসে আবার ঝাঁপিয়ে পড়বে হয়তো।

বারো বছর যদি ঝাঁপিয়ে না পড়ে থাকে, আর পড়বে না।

নদীতে আমার ভয় ছিল না, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী—প্রথম প্রথম রাত্তিরগুলোকে তেমন ইয়ে লাগত না। অন্ধকার থাকলে চারদিকটা কেমন থমথম করত, বাতাসে কাশ-শণ ইকড়ার সোঁ-সোঁ আওয়াজে কেমন ভূতুড়ে কান্না শোনা যেত একটা। অনেক দূরে একটা শ্মশানঘাটা, তার চিতার আগুন দেখা যেত—আরও খারাপ লাগত তখন। অদ্ভুত আওয়াজ করে এক-আধটা পোকা ডাকত, অমন শব্দ এর আগে আর কখনো শুনিনি। যেদিন চাঁদ উঠত সেদিন কেমন সাদা সাদা মড়া আলোয় ভরে যেত সবটা, মনে হত সমস্ত চড়াটা জুড়ে চিতার ধোঁয়ার মতো কী-যেন জমাট হয়ে আছে, বাদুড়ের ডানার আওয়াজ শুনলে পর্যন্ত কেমন একটা কাঁপুনি জেগে উঠত বুকের ভেতরে।

কিন্তু অভ্যেস হয়ে গেল। তারপর এমন হল যে আঁধার রাতে এই চড়ায় আমি একলা মানুষ বসে আছি—এইটে ভাবতেই ভালো লাগত আমার। ভাবতুম আমি সব পারি, সব বন বাদাড় কেটে এই ভূতুড়ে চড়ায় সমস্ত জমি উদ্ধার করে আনতে পারি, ফসলে ফসলে ভরে দিতে পারি। এ চর কারও নয়, কেউ এর মালিক নয়। আমি একে দখল করেছি, এ আমার, শুধুই আমার।

তখন চাঁদের আলোরও রং বদলাতে লাগল। চিতার ধোঁয়া নয়, জোছনা রাত্তিরে যেন দুধের বান ডেকে যেত। আমি দেখতে পেতুম, সেই আলোয় আমার ফসলগুলো শাঁসে আর স্বাদে ভরে উঠছে। টিপ টিপ করে ঝরা শিশিরে আরও পুরন্ত বাড়ন্ত হয়ে উঠছে ক-টা বেগুন, ক-টি ছাঁচিকুমড়ো। আর তখন আমার মনে হত—এখন যদি বউ থাকত, আমার ক-টা ছেলে-মেয়ে থাকত…

এমনি একটা জোছনার সন্ধ্যায়, আমার একলা ঘরের দাওয়ায় বসে এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমি একদিন ভয়ানক চমকে উঠলুম।

একটু দূরেই ছায়া ফেলে গোলমতো কী-একটা দাঁড়িয়ে।

বাছুর? আরে দূর, এখানে কার বাছুর আসতে যাবে? তা ছাড়া অমন চেহারা তার হতে যাবে কোন দুঃখে? এ অনেক মোটা, গোল, বেঁটে বেঁটে পা, ঘাড়ে-গদ্দানে ঠাসা, গায়ে খাড়া খাড়া বড়ো বড়ো লোম, মুখের ডগাটা ছুঁচোলো, আর তার ওপরে ওলটানো নথের মতো বাঁকা দাঁত দুটো। দেখেই বুক চমকে গেল, প্রকান্ড একটা মদ্দা বুনো শুয়োর।

অ্যাদ্দিন আছি এখানে-দেড়-দু বছর হয়ে গেল, এ মক্কেলকে তো এর আগে কখনো দেখিনি। গোটা চরটাই আমি ঘুরেছি, বন-বাদাড় ঠেঙিয়েছি, শণ কেটে এনে ঘরে ছাউনি দিয়েছি, দু-একটা খরগোশ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি এর আগে। সাপ অবিশ্যি আছে, তা যে-তল্লাটের মানুষ আমি—সাপ নিয়ে তো নিত্যি ঘর করতুম। এ হতচ্ছাড়া তো এখানে আগে ছিল না, থাকলে নিশ্চয়ই দেখা হয়ে যেত অনেক আগেই।

এল কোত্থেকে?

কিন্তু সে-ভাবনা পরে। এখন তো বুকের রক্ত শুকিয়ে গেল। মদ্দা দাঁতাল শুয়োর, জানই তো কী বজ্জাত জানোয়ার। আচমকা মুখোমুখি হয়ে গেলে তো আর কথা নেই—সোজা তেড়ে এসে নাড়িভুড়ি ফাঁসিয়ে দেবে। আমার এক পিসেমশাইকে শুয়োরে মেরেছিল, সেকথা মনে হলে এখনও গায়ের ভেতরে আমার ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে।

বেশ ছিলুম একলা চড়ায়—রাজার হালে। কোত্থেকে এই আপদটা এসে জুটল হে?

ঘরে একটা সাপমারা বল্লম ছিল। ভাবলুম, এনে তাক করে দিই ছুড়ে। তারপরেই মনে হল, যদি ফসকায়? প্রায় হাতির ছানার মতো চেহারা, তার ওপর যা বদখত মেজাজ একেবারে ঘরসুদ্ধই উড়িয়ে দেবে আমাকে।

আমি যেখানে ছিলুম সেইখানেই রইলুম ঠায় বসে, আর শুয়োরটাও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে আমার দিকে চেয়ে রইল। নড়াচড়া কিচ্ছুটি নেই, যেন কাঠের পুতুল। আমি দেখতে লাগলুম জোছনায় ওর খুদে চোখ দুটো মিটমিট করে জ্বলছে, একটা গোলমতন ছায়া জমে আছে ওর পায়ের কাছে, আর আমার দিকে তাকিয়ে ও যে কী দেখছিল—সে ও-ই বলতে পারে।

একটু পরে ফোঁস ফোঁস করে গোটা দুই শ্বাস ছাড়ল, ঘোঁৎ করে যেন আওয়াজও তুলল একটু, তারপর আস্তে আস্তে খুট খুট করে বেরিয়ে গেল ঘরের সামনে থেকে। আমি দেখতে পেলুম, একটু এগিয়ে ঢুকে গেল ঘাসবনের ভেতরে।

আপদ এখন তো গেল, কিন্তু গোটা রাত্তির আমি ঘুমুতে পারলুম না। এ তো মহা জ্বালা হল দেখছি। আর তো আমি ইচ্ছেমতো এদিক-ওদিক ঘুরতে পারব না, বলতে পারব না আমি এখানকার মালিক, এই চর আমার রাজত্বি। এ ব্যাটাচ্ছেলে কোনখানে ঘাপটি মেরে থাকবে-কখন কে জানে এর মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে, তারপর ঘোঁৎঘোঁৎ করে তাড়া লাগাবে—যাকে বলে শুয়োরের গোঁ। ঘাস-কাশের বন আর এবড়োখেবড়ো জমি, আমি দৌড়ে পালাতে পারব না। ওই দাঁত দিয়ে একেবারে ফালা ফালা করে ফেলবে আমাকে।

কোত্থেকে এসেছে একথা ভেবে লাভ নেই। কোন দূরের জঙ্গল থেকে পথ ভুলে কিংবা তাড়া খেয়ে এই চরায় এসে নেমেছে সে ওই মক্কেলই বলতে পারে। কিংবা কে যে কোথা থেকে কোথায় যায়, ভগবানেরও কি জানা আছে সে-খবর? আমিও কি জানতুম সুন্দরবন, অথৈ গাং আর মেঘবরণ ধানের দেশ থেকে সোঁতের কুটোর মতো ভাসতে ভাসতে আমি এই চরে এসে ঠেকব? আমি কি জানতুম এমন সন্ধ্যাও আমার আসবে যখন গাঁয়ের বিশালাক্ষীর মন্দির থেকে ঘণ্টার শব্দ উঠবে না, নিম গাছের ছায়া কাঁপবে না আমাদের উঠোনে, হাওয়ায় উঠবে না বুনো ফুল গাছগাছালির সঙ্গে ফুটন্ত ভাত কিংবা তপ্ত খেজুর গুড়ের পাকে চিড়ের গন্ধ, শোনা যাবে না কীর্তনের গান? আমিও কি ভেবেছিলুম, আমার একলা সন্ধ্যায় কেবল ঘাসবনে শনশন করবে হাওয়া, কেবল অদ্ভুত আওয়াজ তুলে পোকা আর ঝিঝি ডাকবে আর অনেক দূরের জ্বলন্ত চিতা থেকে কয়েকটাআগুনের পিন্ড লাফাতে লাফাতে এসে আলেয়া হয়ে দপ দপ করবে এখানে-ওখানে?

তা হলে ওর দশা আমারই মতো। ওরও আলাদা জঙ্গল ছিল, বুনো ওল ছিল। হয়তোবা শুয়োরদেরও দেশ আলাদা হয়ে গেছে, তাড়া খেয়েছে সেখান থেকে। ও ব্যাটাছেলেও আমারই দলের—বাস্তুহারা।

বাস্তুহারা কথাটা মনে হতে একটু হাসি পেল, কিন্তু বেশিক্ষণ হাসিটা থাকল না। বাস্তুহারা হোক আর নাই হোক, আদতে তো বুনো শুয়োর। মানুষের শত্তুর। যখন নিজের তালে আছে, বেশ আছে। কিন্তু যা মেজাজি জানোয়ার, এক বার যদি খেপল তো…

পরদিন থেকে যাহোক একটা দা কিংবা বল্লম সবসময় রাখতুম হাতের কাছে। চলতে ফিরতে বার বার নজর রাখতে হত চারপাশে। আর বলব কী হে—দেখাও হয়ে যেত শুয়োরটার সঙ্গে।

কিন্তু দেখা হলেই দাঁড়িয়ে যেত ওটা। দিনের বেলায় দেখেছিলুম, রাতে যা ভেবেছি জানোয়ারটা তার চেয়েও বড়ো। গা-ভরতি ঝাঁটার মতন রোঁয়া, মস্ত দাঁতটা চকচক করছে সাদা, এখানে-ওখানে কাদার চাপড়া-লাগানো ইয়া পেল্লায় শরীর। তেড়ে এলে মা বলতেও নেই, বাপ বলতেও নেই। কিন্তু যেই মুখোমুখি হল কিংবা আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল বোঁ করে, অমনি ঠায় দাঁড়িয়ে গেল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। নড়াচড়া নেই—কিছুই না—খানিকটা কেবল মিটমিট করে চেয়ে রইল, তারপর যেন কিছুই হয়নি এমনি করে গা দুলিয়ে তুরতুর করে কোনদিকে চলে গেল। অনেক বার ভেবেছি তুলি বল্লম, ধাঁ করে মেরে দিই, কিন্তু কিছুতেই হাত উঠত না। কেবল মনে হত ও যখন আমায় কিছু বলে না, তখন খামোকা ওকে আমি মারতে চাই কেন।

দিনের বেলা আমার ঘরদোরের দিকে ওকে কখনো আসতে দেখিনি। আমি ভেবেছিলুম এই এল শুয়োর, আমার খেতটেত খুঁড়ে কিছু আর রাখবে না, যে ক-টা ফুটি হয়েছে খেয়ে একেবারে শেষ করে দেবে। তা গোড়ার দিকে এক-আধটু খোঁড়াখুড়িও করেছিল বই কী, শুয়োরের স্বভাব যাবে কোথায়।

একদিন বেশি রাত্তিরে আওয়াজ শুনে বেরিয়ে দেখি ওই কান্ড! কী মনে হল, হাঁক পেড়ে বললুম, এই মক্কেল, কী হচ্ছে ওটা? দুড়দুড় করে ছুটে পালাল, তারপর থেকে আর ওসব করতে দেখিনি।

হতে পারে দাঁতাল হলেও শুয়োরটা ভীতু, ভালো মেজাজ, হাঙ্গামা-হুজ্জত পছন্দ করে না। মানুষ তো কত রকমের হয়, জানোয়ারেরই কি রকমফের হতে পারে না? তবু আমার মনে হতে লাগল, ওটার সঙ্গে আমার আলাপ হয়ে গেছে। এই নির্জন ভূতুড়ে চড়ায় ও-ও একা, আমিও একা। আমারও এক-এক সময় বুকের ভেতর হু-হু করে, মনে হয় সব ছিল— ঘর ছিল, ছেলে-মেয়ে ছিল; তখন নিজের এই রাজত্ব, এই খেতটুকু, এই জমি গড়বার সুখ, সব ফাঁকা হয়ে যায়। মনে হয় আমার কিছুই দরকার নেই, কিছুই না। তেমনি ওই শুয়োরটাও একা, ওরও চেনা জঙ্গলটা কোথায় হারিয়ে গেছে। ওরও আপনার জন ছিল, তারা কেউ নেই—কোথাও নেই। আমি যখন ফাঁকা মন নিয়ে কোনো অন্ধকার রাতে কোনো জোছনার ভেতর দাওয়ার ওপর চুপ করে বসে থাকি, তখন অন্ধকারটা এক জায়গায় আরও একটু ঘন হয়। জোছনায় কখনো একটা ছায়া পড়ে—ওই শুয়োরটা এসে দাঁড়ায়। তখন ওরও একা লাগে, ও-ও সঙ্গ খোঁজে। আলোয় হোক আর আঁধারে হোক—ওর চোখ দুটো চিকচিক করে জ্বলে, ও এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি ওর দিকে চেয়ে থাকি। তারপর ফোঁস করে যেন একটা নিশ্বাস ফেলে, ঘোঁত করে একটু আওয়াজ হয়, কী-একটা বুঝে নিয়ে ভারী শরীরটাকে একটু একটু দোলাতে দোলাতে আবার চলে যায় ঘাসবনের ভেতর।

তোমাদের অবাক লাগবে শুনলে, এরপর থেকে আমার আর ওটাকে ভয় লাগত না। কতদিন ঘাসবনের মধ্য দিয়ে আমার প্রায় গা ঘেঁষে চলে গেছে। কত বার দেখেছি কোথায় একটু কাদাজল জমেছে—খুশি হয়ে গড়াগড়ি করছে তার ভেতরে। কোনোদিন দেখেছি মাটি খুঁড়ছে নিজের মনে। আর রাত হলে যখন চরের ওপর কেবল সাঁই সাঁই করছে হাওয়া, যখন দূরের শ্মশানে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে চিতার আগুন, এমনকী মড়াপোড়ার গন্ধও ভেসে আসছে এক-আধটু, আর আমি ফাঁকা মন নিয়ে বুকের ভেতরে একটা কান্না নিয়ে বসে আছি, তখন ও এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে, যেন বলতে চাইছে নিজের কথা, যেন সান্ত্বনা দিতে চাইছে।

শেষে এমন হল, শুনলে হাসি পাবে তোমাদের, দু-এক দিন ওটাকে দেখতে না পেলে আমার মন খারাপ হয়ে যেত। আমি চমকে উঠে ভাবতুম— যেমন নিজের খেয়ালে এসেছিল তেমনি করেই চলে গেল নাকি আবার? আর ভাবলেই আমার ভয় করত। যতদিন একা ছিলুম বেশ ছিলুম। কিন্তু ওটা আসবার পরে কখন যেন দুজন হয়ে গেছি। ও আমাকে বুঝতে পারে, আমি ওকে বুঝতে পারি। তখন বেরোতুম খুঁজতে, হয়তো দেখতুম অনেক দূরে অনেকখানি জঙ্গলের ভেতর কোথাও খানিক জলকাদার ভেতরে হাত-পা মেলে শুয়ে আছে। তোমরা বলবে, আমাকে পাগলে পেয়েছিল। আমিও কি তা ভাবিনি? কিন্তু সেই চরায় সব অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল, একটা আলাদা মন হয়ে গিয়েছিল আমার, আমিও একটা আলাদা জীব হয়ে গিয়েছিলুম যেন। জিজ্ঞেস করতুম, আসিসনি কেন?

ঘোঁত করে একটা আওয়াজ তুলে ছুটে পালাত, যেন লজ্জা পেত মনে হয়।

বলবে, আমার এসব মনগড়া। যাকে বলে বুনো শুয়োর, বোকা, গোঁয়ার, কচু-কন্দ খুঁজে বেড়ায়, যখন-তখন যাকে ইচ্ছে তাড়া করে তার বয়ে গেছে তোমার মনের কথা বুঝতে। নিশ্চয় নিশ্চয়, সব মানি। তবু দেখতুম, সেই রাত্তিরে কিংবা পরের রাত্তিরেই ওটা এসেছে। আমার দাওয়ার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, ছোটো ছোটো চোখ দুটো চিকচিক করছে জোনাকির মতো। কিছুক্ষণ থাকত ওইভাবে, যাহোক একটা কিছু বুঝে নিত, তারপর আবার আস্তে আস্তে চলে যেত নিজের মনে।

শহরের বাজারে তরকারি বেচতে আমি নিজে যেতুম না, অন্য লোক এসে আমার কাছ থেকে কিনে নিয়ে যেত পাইকারি দরে। তারা আসত হপ্তায় দু-চার দিন। তা ছাড়া একটু দূর দিয়ে শেয়ার লোকজনের যাওয়া-আসা তো ছিলই। তাদেরই কারও চোখে পড়ে থাকবে। একদিন হঠাৎ দেখি শহর থেকে শোলার টুপি আর হাফপ্যান্ট পরে, কাঁধে বন্দুক নিয়ে দু তিন জন ভদ্দরলোক এসে হাজির।

প্রথমটা ভেবেছিলুম চরের ওদিকটায় এ-সময়ে দু-চারটে চখাচখি পড়ে তাই মারতে এসেছে, কিন্তু চলে এল আমার ঘরের দিকেই।

তুমি এখানে থাক?

আজ্ঞে।

এসব তরিতরকারি তোমার?

আজ্ঞে।

এ তো খাসমহল জমি। পত্তনি নিয়েছ?

আজ্ঞে না।

বেআইনি। একদম বেআইনি।

কে জানে কাকে বলে আইন, কাকে বলে বেআইন। এই ভূতুড়ে চরায় সরকারের নজর তো কোনোকালে ছিল না—আমিই এখানে একা হাতে মাটি গড়েছি, ফসল ফলিয়েছি। কিন্তু আইন-বেআইনের ভাবনা আমি আর ভাবতে পারি না। যেদিন হাতি এনে অসমের পাহাড়ে ফসলের সঙ্গে আমাদের বুকের পাঁজর অবধি দলে দেওয়া হয়েছিল, সেদিন থেকে ওসব ভাবনা আমি ছেড়ে দিয়েছি।

বাবুদের একজন ফস করে একটা সিগ্রেট জ্বাললেন। বললেন, যাক, সেসব পরে হবে। এই চরায় বুনো শুয়োর আছে, তাই নয়?

ধক করে উঠল আমার বুকের ভেতর। আমি তিনটে বন্দুকের দিকে তাকালুম।

কে বললে আপনাদের?

আমরা খবর পেয়েছি।

তোমরা শুনলে রাগ করবে কি না জানিনে, আমি দেখেছি, হারামির দিকে জানোয়ারের চেয়ে মানুষেরই টাঁক বেশি। তক্ষুনি মনে হল বলি— যান ওদিক পানে, কাদার মধ্যে বসে আছে দেখেছি একটু আগে, দিন সাবড়ে। আর তক্ষুনি কে যেন কানে কানে বললে, ছি ছি হে! তুমি শুয়োরের চাইতেও ছোটোলোক হয়ে গেলে। ও তোমায় বিশ্বেস করে, তার এই প্রিতিদান।

বললুম, বাজে কথা। আড়াই বচ্ছর ধরে আমি আছি এখানে। চরের জঙ্গল ভেঙে চলাফেরা করি। কোনো শুয়োর কখনো আমার চোখে পড়েনি।

কিন্তু একজন যে বললে?

ভুল বলেছে। শেয়ালটেয়াল দেখে থাকবে হয়তো।

তুমি ঠিক জান?

আজ্ঞে এই চরার আমি বাসিন্দে। আমি জানিনে তো অন্য লোকে জানবে?

বাবুরা এ ওর মুখের দিকে তাকালেন।

আমি বললুম, তা খরগোশ-টরগোশ আছে দু-চারটে। খুঁজে দেখতে পারেন।

ধুর, খরগোশ অযাত্রা। আর সেগুলো খুঁজে কে সময় নষ্ট করবে, কেই-বা টোটা খরচ করতে যাবে?

বাবুদের দুঃখ হয়েছে মনে হল।

বাজে লোকের কাছে উড়োখবর শুনে হাঁটাহাঁটিই সার হল। চলো হে।

শুয়োরটা সে-রাতে এল না, এল পরের রাতে। বললুম, তোকে বাঁচিয়েছি, বুঝলি? তিনটে বন্দুক ছিল, কিছু করতে পারতিস না।

নিঃসাড়ে আমার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

বললুম, এবার কটা কচু লাগাব ঠিক করেছি। খুঁড়েমুড়ে যেন বরবাদ করে দিসনি, তাহলে ঠিক বলে দেব বাবুদের।

তেমনি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে চলে গেল।

দিন কাটছিল, এইভাবে কতদিন কাটত জানি না। কিন্তু সেই সকালে সরকারি পেয়াদা এসে আমাকে নোটিশ দিয়ে গেল। কেন আমি খাসমহলে জমি জবরদখল করেছি, কেন আইন মোতাবেক পত্তনি নিইনি, হুজুরে হাজির হয়ে আমায় তার কৈফিয়ত দিতে হবে। সেই যে তিন বাবু এসেছিল, তারাই কেউ ফিরে গিয়ে এই উপকারটা করেছে আমার।

নোটিশ নিয়ে আমি চুপ করে বসে রইলুম ঘরের দাওয়ায়। আগের দিন থেকেই টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছিল; আজ আকাশ আরও ঘোলাটে, আরও অন্ধকার। ওদিকে নদীতে জল বাড়ছে, গোঁ গোঁ করে উঠছে তার ডাক। ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে থেকে থেকে, চারদিকের ঘাসবনে ঢেউ উঠছে।

জল আসছে নদীতে। চরের খানিকটা ডুবে যাবে। কিন্তু আমি যেখানে আছি সেটা ডুববে, আজ চোদ্দো বছর ধরেও ডোবেনি। নদীর ভাবনা নেই, আমি মানুষের কথা ভাবছিলুম। এমনি একটা মেঘলা দিনেই যখন ধানের খেতে বাতাস ঢেউ দিয়েছিল, সেইদিনই ওরা হাতি এনে…

পত্তনি নিতে হবে, খাজনা দিতে হবে। কত চাইবে কে জানে! না কি উচ্ছেদই করে দেবে। খেতের দিকে চেয়ে দেখলুম বৃষ্টিতে ভিজে চিকচিক করছে পটোলগুলো, হাওয়ার মাতন লেগেছে ঢলঢলে লাউয়ের পাতায়। চোখ জ্বালা করতে লাগল। সারাদিন কিচ্ছুটি খেতে ইচ্ছে করল না আমার, ঘরের ঝাঁপ বন্ধ করে চুপ করে শুয়ে রইলুম।

শুয়োরটার ভাগ্যি ভালো আমার চাইতে। ওকে খাজনা দিতে হয় না, পত্তনি দিতে হয় না, ওর উচ্ছেদের ভয় নেই। ভয় নেই? আমি যখন থাকব না তখন ওরও তো পালা মিটে যাবে। তখন আবার তিনটে বন্দুক আসবে, হয়তো লোকজন নিয়ে ঘেরাও করবে জঙ্গল। তারপর আনন্দে বাবুরা…।

সব বিশ্রী লাগছিল, সব ফাঁকা ঠেকছিল, অনেক দিন পরে বউ আর ছেলে-মেয়ের জন্যে আমার কান্না আসছিল। হাওয়া-বৃষ্টি-দুর্যোগের ভেতরে সকাল-বিকাল-সন্ধে যে কীভাবে কেটে গেল জানি না। তারপর রাতে ঘুম এল, আর তারও পরে…

জেগে উঠলুম বানের ডাকে। ঝড়-বৃষ্টির প্রায় মহাপ্রলয় তখন। কিন্তু কিছু আর ভাববার সময় ছিল না। চর ভাসিয়ে ছুটে এল পাহাড়ি নদী, মড়মড় করে ভেঙে পড়লে ঘর। আমি বাইরে বেরিয়ে এসেছিলুম, এক ঝটকায় আমাকে কুটোর মতো তলিয়ে নিয়ে চলল।

ডুবতে ডুবতেও টের পেলুম আমার কাছেই কেমন একটা ঘোঁৎঘোঁৎ আওয়াজ। তাহলে দুজনেই ভেসেছি—দুজনেই আবার একসঙ্গেই বাস্তুহারা। কী করে কী হল জানি না—দু হাতে শুয়োরটাকে জাপটে ধরে মাথা জাগিয়ে তুললুম। আর সেই প্রকান্ড জানোয়ারটা—যার স্বজাতেরা সুন্দরবনের গহিন গাং পেরিয়ে চলে যায়, যারা সমুদুরের মতো রাক্ষুসে নদীকে ভয় পায় না, বাঘ-হরিণ পৌঁছুবার আগে যারা নতুন-জাগা-চরে গিয়ে বাস্তু বাঁধে, সে আমাকে টানতে টানতে—জলের ওপর নাক তুলে সাঁতার কাটতে কাটতে, সেই স্রোতের সঙ্গে ভেসে চলল।

আমাকে ছিনিয়ে নেবার জন্যে খ্যাপা স্রোত মরণ-সাপট দিচ্ছিল। সইতে পারলুম না, আমি জ্ঞান হারালুম।

যখন চোখ চেয়েছি, তখন সকাল। দেখি জন তিনেক মানুষ আমায় সেঁকতাপ করছে। বললুম, শুয়োরটা?

তারা বললে, কীসের শুয়োর? বানে ভাসতে ভাসতে এখানে এসে ডাঙায় ঠেকেছিলে, আমরা তুলে এনেছি তোমায়। কোথাকার লোক হে?

শুয়োরটা কোথায় গেল জানি না। হয়তো আমায় কোনোমতে ডাঙায় ঠেলে দিয়ে সে নিজে আর উঠতে পারেনি—ভেসে গেছে। তোমরা হাসবে, পাগল বলবে আমায়; কিন্তু আমি ঠিক জানি, ও যদি বেঁচে থাকত কিছুতেই আমার সঙ্গ ছাড়ত না। আমি নিশ্চয় জানি, আমার মতো ওরও তো কোনো দোসর নেই!

সেই ভাঙা গভীর গলাটা থামল। নিঃশব্দে বসে থাকল দুটি চাষি, আমি করোগেটেড টিনের চালাটার দিকে চেয়ে রইলুম, আমার চোখ জ্বলতে লাগল, একটা ক্লান্ত কাক ডেকে চলল রাধাচুডোর ডালে।

সেই লোকটা আবার বললে, কখনো শুয়োর মানুষ হয়, বুঝেছ? কখনো আবার মানুষ…

চমকে আমি উঠে দাঁড়ালুম। আমাকেই বলছে? সুটকেসটা তুলে নিয়ে আমি এগিয়ে চললুম। ট্রেনের সিগন্যাল দিয়েছিল। আমি ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী, আমার কামরাটা থাকবে আর একটু ওদিকে। গাড়ি ফাঁকা থাকলে বসে বসে পড়তে পারব ফ্লেশ-লাভার্স বইটা। আর তেমন যদি সহযাত্রী পাই তাহলে বেশ রোমাঞ্চকর বর্ণনা দিয়ে উত্তরবাংলার বন্যার গল্পও শোনাতে পারব তাদের। রেলস্টেশনের এই উদ্ভট বাজে গল্পটা ভুলে যেতে আমার সময় লাগবে না তখন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *