০৬. এই যে প্রফেসর

এই যে প্রফেসর, দেখা নেই যে?

আবদুল খালেক বললে, গত সন্ধ্যায় আপনি বসেন নি, আমি এসে ফিরে গিয়েছিলাম, দেখলাম বন্ধ।

নরহরি ডাক্তার বললে, বলেছিলাম। সন্ধে দিয়েই আবার বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কল ছিল। তা আপনি তো জানেনই। সেই যে। ক্রিমিন্যাল এ্যাবরশন কেসটা! বেশ কাজ হচ্ছিলো মেথারজিনে। গতকাল হঠাৎ দারুণভাবে ফল করলে টেমপারেচার। স্যালাইন ট্রানফিউশনের ব্যবস্থা করলাম। কোনো লাভ হলো না, মাঝরাতের দিকে টেঁসে গেল রুগী। চা খান। তা আপনাদের সব খবরাবখবর কি? কলেজের এ্যাফিলিয়েশনের কদ্দূর কি হলো? প্রিন্সিপ্যাল সাহেব ঢাকা থেকে ফিরেছেন দেখলাম। সকালে পুকুরঘাটে বসে বসে দাঁত ব্রাশ করছিলেন—

আবদুল খালেক স্বললে, খবর খুব খারাপ। এ্যাফিলিয়েশনের এখন আর কোনো আশা নেই, সেই রকমই তো বললেন।

বলেন কি?

এদিকে কলেজের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন, যেকোন সময় দপ্ করে নিভে যেতে পারে। এ বছরে পাসের হারটা কি ছিল, ছাত্র আসবে কোথেকে!

তা বটে—

গত বছরে মোটামুটি শদেড়েক নতুন ছাত্র ভর্তি হয়েছিল। এ বছরে গোটা নয়েক, শেষ পর্যন্ত হয়তো জোরজার করে টেনেটুনে জন পনেরোয় উঠবে, এই তো অবস্থা। খুববেশি হলে আর মাস দুয়েক, তারপরে টিচারদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে!

নরহরি ডাক্তার বললে, আপনাদেরও কুড়েমি কি কম? সব কাজের একটা সময় আছে। সময়মতো চেষ্টা তদবিরটাই হলো বড় কথা। নতুন এ্যাফিলিয়েশন যেই বন্ধ করে দেবার কথা উঠেছে, অমনি আপনাদের ছোটাছুটি শুরু। কি দরকার ছিলো পুকুরটাকে ডাকে দেবার, কলেজ নিজের হাতেই তো রাখতে পারতো, মাছ ছাড়তে পারতো, কতকগুলো টাউটকে খুশি করা, এই তত? তা এখন সেই টাউটগুলোকে বলুন, বলুন কিছু ডোনার যোগাড় করে দাও——

আবদুল খালেক বললে, পরিষ্কার বুঝতে পারছি এখানকার পাট তুলে দেবার দিন এসে গেছে!

চেষ্টা-ফেষ্টা করছেন নাকি অন্য চাকরির?

কোথায় চেষ্টা করব, সে সোর্সও নেই, উদ্যমও নেই। তা, যা হবার একটা হয়ে যাক। তখন দেখা যাবে। এইসব নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলে ভীষণ ভেঙে পড়ি।

এক ফাঁকে একটা রুগী এসে বসেছিল। মাঝে মাঝে কাত হয়ে তার মুখের কাছে কান নিচ্ছিল নরহরি ডাক্তার। তারপর আবার সোজা হয়ে আবদুল খালেকের কথা শুনছিল। এক সময় ধমক মেরে উঠলো। অতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছ কেন ছেলে ছেলে করে, ভাইডালিনটা চলুক না, আমি কি ভেল্কি জানি যে, রাতারাতি ভালো করে দেব?

আবদুল খালেক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে বললে, হেপাটাইটিস, মানে যকৃতের ব্যাপার, প্রদাহের ব্যাপার, কি বুঝলেন! তাও আবার কিনা কনজেনিট্যাল, সারাতে সময় লাগবে না?

রুগীটি বেরিয়ে যেতেই ইমান আলিকে দেখা গেল সামনে দাঁড়িয়ে। ইমান আলি ইউনিয়ন পরিষদের ইলেকশনে চেয়াম্যান পদের জন্য দাঁড়িয়েছিল, জিততে পারেনি।

নরহরি ডাক্তার বললে, এই ডে ঢোলমার্কা ফেলুপট্টি, ভিতরে আসা হোক, ভিতরে আসা হোক!

ইমান আলি বললে, খবরটবর কি ডাক্তারবাবু!

আমদের আর খবর! দিন তো এখন তোমাদের।

ইমান আলি আবদুল খালেকের দিকে তার স্টার সিগ্রেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললে, শুনলেন তো স্যার, ডাক্তারবাবুর কথা?

নরহরি ডাক্তার বললে, উনি কি বলবেন, জানেনটা কি উনি! যে টাকা ঢেলেছিল ইলেকশানে, তার দ্বিগুণ-চতুগুণ ঘরে আসছে, খেলা কথা আর কি! আলুর দাম কতোয় উঠেছে, খেয়াল আছে?

ইমান আলি বললে, তাই বলুন!

বলবো আবার কি, এখনো সত্তরে গিয়ে থমকে আছে, শেষ পর্যন্ত ওই আশিতে গিয়ে ঠেকবে, তোমাদের আর পায় কে! তা ছেড়ে দিয়েছ নাকি আলু?

ইমান আলি বললে, পাঁচশো মণের মতো, এখন এই পর্যন্তই!

প্রফেসর কি বুঝলেন? নরহরি ডাক্তার বললে, কেসটা বুঝলেন। মরলো কারা, বেচারা চাষীরা। একে তো বিষ্টিতে সব পচে নষ্ট হলো, তারপর দাম পেল মোটে তিরিশ টাকা। ওতে কোনোমতে খরচও ওঠে না, লাভ তো দূরের কথা। ওদিকে কর্তারা টাউনে বসে বসে স্বপ্ন দেখছেন গ্রামভিত্তিক অর্থনীতির, কৃষককে বাঁচাতে হবে, ভ্যারেণ্ডা ভাজতে হবে, সব বোগাস!

ইমান আলি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললে, স্যারকে তো বলেছিলাম, কিছু আলু ধরে রাখুন, বেধে গেলেও যেতে পারে, তখন শুনলেন না—

আবদুল খালেক বললে, রাখবো যে তেমন সামর্থ্য কোথায়! আমার কিভাবে চলে ডাক্তারবাবু ভালো করেই জানেন!

আপনার কোনো ঝামেলা পোহাতে হতো না— ইমান আলি বললে, আমার আলুর সঙ্গেই স্টোরেজে উঠতো,মধ্যে থেকে ঘরে বসে কিছু টাকা ফাও এসে যেতো আপনার হাতে–

নরহরি ডাক্তার বললে, কাজের কথায় এসো, কলেজের তো চাট্টিবাট্টি গোল অবস্থা! তোমরা কোনো উদ্যোগ-ব্যবস্থা নেবে, না এইভাবে ধুকে ধুকে ওষুধপথ্যের অভাবে চোখের সামনে কলেজটা পটল তুলবে—

ইমান আলি বললে, মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন!

কেন, কি এমন খারাপ কথাটা বললাম! তোমাদের কি কিছুই করবার নেই? ইলেকশনে দাঁড়াবে, আবার অভিমানও করবে, টিকতে পারবে ভিলেজ পলিটিক্সে?

লোকে যাকে চায় না, তার আবার কিসের দায়দায়িত্ব?

দায়িত্বটা তারই–নরহরি ডাক্তার বললে, পলিটিক্সে আগে মার খেতে হয়, বুঝলে দাদা! গভর্নিং বডির মিটিং, কিছু খুচরো প্ল্যান-প্রোগ্রাম, আর লোক দেখানো ছোটাছুটি, এখনকার চেয়ারম্যানের দৌড় তো এ্যাদ্দুর। তোমারই উচিত কিছু করে দ্যাখানো। বড় বড় পার্টি সব ঢাকায় বসে থাকে। তারা মুততেও কখনও গ্রামে আসে না। তাদের সঙ্গে যারা যোগাযোগ রাখে, তারাই তাদের কাছের মানুষ। তাদের কাছে দৌড়বে, তাদের বোঝাবে, খুব কঠিন একটা ব্যাপার না–

ইমান আলি পা দোলাতে দোলাতে বললে, আগে দেখি, আমাদের চেয়ারম্যানসাব কি করে, তারপর ময়দানে নামবো—

নরহরি ডাক্তার বললে, চেয়ারম্যানের চেষ্টা-তদবিরেই রাস্তা আর ব্রিজের কাজকম্মো রমিজ মুন্সী পেয়েছিল, কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে রমিজ মুন্সী আর সিও ডেভের ভেতর নটখট বেধে গেছে। বাইরে রটেছে কলকাঠিটা তোমার নাড়া—

অমন অনেক কথাই রটে। একটা কাজ সেরে আসি। আপনি থাকবেন— এই বলে উঠে যায় ইমান আলি।

ইমান আলি বেরিয়ে যাবার পর নরহরি ডাক্তার বললে, কেমন একটা ডোজ দিলাম দেখলেন তো? ডোজটা ধরেছে মনে হলো। এখন আপনাদের কপাল—

আবদুল খালেক গায়ের জড় ভেঙে বললে, টুকুর মায়ের শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছে–

কি রকম?

এই অসময়ে আর কি–

আগে হয়েছে আর, না এই প্রথম?

আগেও হয়েছে মাঝে মাঝে। এতোদিন কিছু বলেনি। এবারই বললে–

নরহরি ডাক্তার বললে, মেয়েদের ধরনটাই অমন। রোগটাকে পাকিয়ে ফেলে তারপর বলা। খুব বেশি কি?

তাই তো বলছে—

পিরিয়ড গেছে কতোদিন আগে?

এই দিন পনেরো আগে!

একটা স্লিপ টেনে খচ খচ করে ওষুধের নাম লিখে আবদুল খালেকের দিকে বাড়িয়ে দেয় নরহরি ডাক্তার। বললে, যাওয়ার পথে এটা নিয়ে যাবেন, আমার কাছ নেই, ট্রসটিন-এম। ঘরে ফেরার পথে ফুড়ে দিয়ে যাবোক্ষণ–

স্লিপটা হাতে নিয়ে আবদুল খালেক বললে, কোনোদিকে বেরুবেন নাকি ডাক্তার একদিন না বললেন বেড়াতে বেরুবেন—

ফুরসৎ কই! গেলে আপনাকে বলবো!

আবদুল খালেক বললে, এখানে আর মন বসতে চাচ্ছে না, কি করি বলুন তো? সময় যেন আর কাটে না—

সেদিন যেন বলছিলেন রাতে ঘুমের খুব ডিসটার্ব হয়?

ঘুম হয় আমি ইচ্ছে করেই জেগে থাকি। ঐ সময়টা আমার ভালো লাগে–

বেশ রোমান্টিক লোক আপনি—

নরহরি ডাক্তারের ওখান থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই বাজারের মুখে ওষুধের বড় দোকানটা দেখে তার মনে পড়লো, তার কাছে একটা স্লিপ আছে। স্লিপটা এগিয়ে দিল সে। ট্রসটিন-এম নেই। একবার ভাবলো, গিয়ে বলে। কিন্তু ইচ্ছা হলো না। যাক, পরে হবে। সে হাঁটা শুরু করে। কোথায় যাবে এখন! তার ইচ্ছে নেই এখন ঘরে ফেরার।।

এক হয় হোস্টেলের দিকে হাঁটা। আজ বন্ধের দিন। ইচ্ছে করে। আবদুল খালেক জানে ওখানে এখন ধুমসে কাচ্চু কি হাইড্রোজেনের আসর বসেছে। সে নিজে শিক্ষক, কিন্তু তাস পেটানো সহযোগীদের কাউকেই তার তেমন ভালো লাগে না। এরা কেউ কিছু শেখেনি, এদের কারো চোখ নেই, মন বলে কোনো পদার্থ নেই, কোনোমতে একটা ভঁজকরা ডিগ্রী বগলে পুরে মাছির মতো চাক বেঁধেছে এখানে; এই রকমই তার ধারণা। এরা স্কুল, পরশ্রীকাতর, লোভী, অসৎ।

আবদুল খালেক নিজেকে আলাদাভাবে দ্যাখে। কারো সঙ্গেই তার কোনো রকমের অবনিবনা নেই। না থাকুক, তবু সে এদের একজন নিজেকে ভাবতে পারে না। বিরাট একটা ফাঁক, সে জানে না সে কখনও পার হতে পারবে না।

তা ইচ্ছে নেই এখন ঘরে ফেরার। ক্রমশ বুঝতে পারে, শুধু যে ঘরে তা নয়, কোথাও ফেরার তার ইচ্ছে নেই। এমনকি তার কোনো ইচ্ছাই নেই।

বাজারে বের হবার আগে একটা অদ্ভুত ব্যাপার তার চোখে পড়েছিল। সে জানতো না বলে হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়েছিল। ভেতরে থেকে দরোজাটাকে নিছক ঠেলে না দিয়ে খিল আটকানো উচিত ছিল রেখার। সে তখন শাড়ি বদলাচ্ছিল। এই ধরনের অমনোযোগিতা খুবই অপছন্দের। না কি নিছক অবহেলা, নিজের প্রতি অবহেলা।

অস্বচ্ছ হলেও, এইসব ব্যাপারে তার একটা ধারণা আছে, সব মেয়েরাই এমন অসাবধানী নয়।

ট্রাসটিন-এম, নামটা ভারি সুন্দর।

ডায়াল-এম ফর মার্ডার, এ্যালান পোর একটি গল্প। ফ্রান্টম অব দি রু্য মর্গ, সে ছবি দেখেছিল মুকুলে। একে একে অনেক ছবি আর বইয়ের কথা তা মনে পড়ে। এই অজ পাড়াগাঁয়ে দেখতে না দেখতে সে ভোঁতা মেরে গেল। কেমন একটু নুদির ভাব দেখতে পাচ্ছে পেটে। একজন নাদাপেট প্রফেসর গদাই লস্করে চালে চপর চপর পান চিবাতে চিবাতে বগলে একখানা বই নিয়ে চর্যাপদের ক্লাস নিতে যাচ্ছে, এই যদি হয় দুবছর পরের ছবি, তা কেমন হবে দেখতে।

দুবছর অনেক দূর। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বলেছিলেন, কলেজ উঠিয়ে দিয়ে ওটাকে একটা কোল্ড স্টোরেজ করে দিলে কেমন হয়!

তা উঠে গেলেই এক রকম ভালো। ঝক্কি চুকে যায়। পকেটে সিগ্রেটের প্যাকেট ঠেলে বেরুনো একরাশ ভ্যাদামার্কা ছেলে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এখন সেও হাঁপিয়ে পড়েছে। ছাত্র হলেও এদের অনেকেই পার্টটাইম ব্যবসায়ী, কেউ কেউ বিবাহিত, কারো কারো বয়সে কোনো গাছপাথর নেই। এছাড়াও কতো রকমের যে দুশ্চিন্তা। হাঁড়ির জিওল মাছের মতো অবস্থা, এই আছে এই নেই।

রেখা আর টুকু, এই দুজনের জন্যে তার ভাবনা। নিজেকে সে বাদ দেয়; নিজেকে নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই, কোনো না কোনোভাবে তার চলে যাবে।

এটাও একটা বাতুল চিন্তা ফালতু ধারণী। আবদুল খালেক শুধরে নেয় নিজেকে, তার ভাবনা-চিন্তায় ওদের ভূমিকা যেন নিছক বোঝার। এর ভেতরে আচ্ছন্নভাবে তার একটা অহমিকা আছে, সে চালাচ্ছে ওদের। কে ফাঁদের চালায়, আসলে তো যে যার নিজের জীবনকে নিজেই চালায়। চালানো মানে জীবনকে কোনোরকমে টেনে বেড়ানো। চেয়ে-চিন্তে, মেরে-কেটে, যেভাবেই হোক।

পায়ে পায়ে কাঁঠালতলির দিকে হাঁটতে থাকে আবদুল খালেক; উদ্দেশ্যহীন। দুএকটি ছাত্রের সঙ্গে দেখা হয়। স্যার কোথায় চললেন? জিজ্ঞেস করে কেউ কেউ। যাই দেখি— এর বেশি আর কিছু তার বলার দরকার হয় না।

একটা বিশাল অশথ গাছ আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে। কোনোরকমে সে ডিঙিয়ে গেল। প্রথমে অবাক হলো। বিনা বিষ্টিবাদলাতেই এমনভাবে গাছ-গাছড়ার হুমড়ি খেয়ে পড়া সে আর কখনও দ্যাখেনি। খেয়াল করে দেখলো, গাছের গোড়াটা একেবারে ভোঁতা, শেকড়-বাকড় নেই। ক্ষয়া, পোকা খাওয়া। এই ভেবে কিছুটা অবাকও হলো, এতোদিন তাহলে গাছটা খাড়া দাড়িয়ে ছিল কিভাবেনিছক অভ্যাসবশত? না কি কোনো কিছুর অপেক্ষায়? এ পথে যতোবারই এসেছে, চোখে পড়েছে গাছটা; কেমন যেন ছন্নছাড়া চেহারা ছিল। মনমরা মনমরা। অনেক আগেই তার দিন শেষ হয়ে এসেছিল, এখন বুঝতে পারে, অনেক আগেই।।

দুপাশে ধানখেত, থৈ থৈ করছে বর্ষার পানি; হাঁসের খলবলে একটা বহর ডোবাডুবি শেষ করে খেতের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। আবদুল খালেকের ইচ্ছে কোথাও দু দণ্ড বসার। বাছাবাছির কিছু নেই, বসে পড়লেই হয়, ভয় ছাত্রদের নিয়ে। হাঁটাপথের একপাশে তাকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে মাথামুণ্ডুহীন কতো কথাই তো তারা ছড়াতে পারে।

কোথাও কোনো আড়াল নেই। খুঁজলে পেয়ে যেতে পারে সুবিধেমতো একটা জায়গা। কিন্তু বেশি একটা আগ্রহও তার নেই, এমন নয় যে, সে হই হই করে বেরিয়েছে দিগ্বিজয়ে।

এই বর্ষা কালটা ভারি সুন্দর। প্রতি বছর চার পাশের কয়েকটা নদী পাল্লা দিয়ে ছাপিয়ে ওঠে। তারপর লোকচক্ষুকে প্রায় ফাঁকি দিয়ে আস্তে আস্তে ঢোকে গ্রামের ভেতর। এ গ্রাম, ও গ্রাম, এপাড়া, ওপাড়া, এই করতে করতে পুরো দেশটাকেই তারা ঢেকে দেয়। রুখু রুখু চেহারার গ্রামগুলো বন্য লাবণ্যে মায়াময় হয়ে ওঠে।

আবদুল খালেকের মনে হয় এর আগে কোনোদিন সে এতো মনোযোগ দিয়ে এসব দ্যাখেনি। আধবোজা চোখে অলস ঘুমের ভেতর তার দিন কেটেছে। এক একটা লোকের চেহারার দিকে তাকিয়ে এখন তার মনে হয়, এরা জীবনের মুখোমুখি দাঁড়ানো মানুষ। হয়তো ক্লান্ত, ধসনামা, তবু অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছে।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পাকার করেছে নিজের জীবনকে। কালঘুম। চেষ্টা করলেও এখন আর দেহের জড় ভাঙে না। পাথরের মতো নিরেট,কি অনড় এই মর্মান্তিক অবসন্নতা!

একটা মাছরাঙা গলাপানিতে নামা হিজলের ডালে গিয়ে বসলো। এটা একটা সম্পর্ক, এই মুহূর্তে আবদুল খালেকের তাই মনে হয়,অলিখিত—তবু যুগ যুগ ধরে এইভাবে চলে আসছে সবকিছু। না বসলেও চলে মাছরাঙার, একটা আধডোবা খাড়া কঞ্চির ওপর গিয়ে বসলেও তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। তবু হিজলের একটা শাখা,গোছা গোছা পাতার মনোরম একটা আড়াল সে যখন বেছে নেয়, তখন এক ধরনের নির্ভরশীলতা সত্য হয়ে ওঠে। বড় ক্ষণিকের এ সম্পর্ক, তবু দিব্যকান্তি।

রেখা, টুকু, রেখাটুকু—

কেবল এইটুকুই তার সামনে। দৌড়, দৌড়, লম্বা একটা দৌড়, তারপর সে পৌঁছেছে কেবল এইটুকুর সামনে।

রেখা আমার বাড়িতে মানুষ। তার নিজের ভাষায় পরের বাড়িতে। মামীর অবহেলা আর অত্যাচারে তার সমস্ত অতীত ছেঁড়া, টুকরো-টুকরো, ফালা ফালা। নিজের মনকে তাই রঙচটা তালিমারা ছাড়া অন্য কিছু সে ভাবতে পারলো না কোনোদিন।

রেখার ইচ্ছে ছিল মামীকে সে সবকিছু ফেরত দেবে; সব ঋণ–সব দেনা-পাওনা সে একদিন কড়ায়-ক্রান্তিতে শোধ দিয়ে দেবে। তার সব চিন্তা-ভাবনাকে সে এইভাবে ধারালো আর প্রতিশোধ-উন্মুখ। করে তুলেছিল। ফলে বিয়ের পরদিন থেকে এই একটা ব্যাপার আবিষ্কার করা তার পক্ষে অতি সহজ হয়ে পড়ে, যার নাম অক্ষমতা যতোই দিন গেছে, এই অক্ষমতা তার কাছে আরও প্রকট, আরো আরো নিরেট, আরো হীন হয়ে দেখা দিয়েছে। যতোবারই সে পা বাড়াতে গেছে, আশাভঙ্গের যন্ত্রণা তাকে তার নিজের কাছেই ফিরিয়ে দিয়েছে ততোবার। জীবনে এ এক ধরনের মার খাওয়া।

আবদুল খালেক মার খাওয়া রেখার ভেতরের দৈন্যদশার কথা ভেবে কষ্ট পেল। তার নিজের অপরাধও বড় একটা কম নয়, সে জানে। এমন কিছুই নেই তার কাছে জোর গলায় সে যার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। যদি বলা হয় হতোদ্যম, নৈরাশ্যপীড়িত, তারপরও কিছু বাকি থাকে; আজন্মকাল সে মাথা নিচু করে সবকিছু মেনে নেয়ার পক্ষপাতী। এইভাবে মেনে নিতে নিতে আজ সে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।

ইচ্ছে ছিল মাকে কাছে রাখার। কোনোদিন সামান্য কোনো আগ্রহ দেখালো না রেখা। কথাটা সোজাসুজি কখনো না তুললেও, হাবেভাবে সবসময়ে সে বুঝিয়ে এসেছে। রেখা হয়তো দ্যাখে-একটা পেট; তার নিজের কাছে একটা প্রাণ। কতো রোগ, কতো শোক, কতো ঝড়বিষ্টিই না গেছে তার ওপর দিয়ে, রেখা তো আর সেসব কিছু দ্যাখেনি।

মাঝে মাঝে সে দুঃখ পেয়েছে, ভেবেছে এতো অনীহা কেন রেখার, এতো অশ্রদ্ধা কেন। ভেতর থেকে ভাঙা, যথাসর্বস্ব খোয়ানো, আর কখনো কারও কাছে যার কোনো দাবি নেই, এমন একটা নিরাপদ মানুষকেও রেখা একদিনের জন্যে ঠাই দিতে পারলো না।

কতো তফাৎ, আবদুল খালেক একটা বৌনাগাছের তলায় দাঁড়িয়ে এই কথা ভাবলো,-মা কি ছিল, আর রেখা কি; মাকে কিভাবে দেখেছে সে, রেখাকে কিভাবে দেখেছে। কাউকে না জানিয়ে,খুব গোপনে, টু-শব্দটি না করে, হাসিমুখে, কি অবিরল নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল মা। সংসারের সামান্য একটা ফাটা পিরিচ, কিংবা ডাঙ ভাঙা কাপ, কিংবা ক্ষয়ধরা পেতলের খুন্তির গায়েও চোখের পানি ছিল মার। এমন কিছুই ছিল না, যার কোনো প্রয়োজন নেই, যা কখনও সংসারের কোনো কাজে লাগবে না। সবকিছু ছিল আদরের। পুরনো পাড় থেকে তোলা সামান্য যে পচা সুতো তারও যে যত ছিল, তাতে জীবনের ভার অনেকখানি লাঘব হয়। তুচ্ছ কুটোগাচা থেকে হাত-বেড়ি-খুন্তিরও অভিমান ছিল, তারাও বোধহয় মা বলে ডাকতে শিখেছিল। মনে হতো অপরাধী, ঘটিবাটির কাছে, ঘরদোরের কাছে, বিছানা-বালিশ-লেপ-তোষকের কাছে। সামান্য যে ফেনফেলা গামলা, হাঁড়িধরা ন্যাতা, ঘরপোছা ন্যাতা, তিল তিল করে সে অপরাধের কথা তাদেরও বোধহয় এক সময় জানা হয়ে যেতো। সেই সে বছর, যে বছর উল্টোপাল্টা খুব ঝড় গেল, পুকুরপাড়ের বাতাবি নেবু গাছটা পড়ে যায়, টিন পড়ে সুকদেবের মার পা কেটে গিয়েছিল, রজনী ভেণ্ডারির অমন জোয়ান মেয়েটা কলেরায় মারা যায়, মনি আমার কোলে এলো–মা বলতো এইভাবে। তা, ও ছেলে তো আমার ধুলোয় ঘোঁটাকেটে মানুষ। না পেয়েছে আদর, না যত্ন। বছর না ঘুরতে কোলে এলো। টিপুর পিঠোপিঠি। কাকে দেখি, কাকে ধরি, একলা মানুষ। একটা গামছা বিড়ে পাকিয়ে মাথার নিচে দিয়ে মেঝেয় শুইয়ে রাখি, একা একা হাত-পা ছুঁড়ে খেলা করে, খিদে পেলে কাঁদে, পেট ভরা থাকলে ঘুমিয়ে থাকে, বড় অবহেলায় মানুষ হয়েছে ছেলেটা–

মার সে বলা ছিল কতো সুন্দর! ও আমার কোলে এলো–একটা গানের কলি। আজ, এই ভরদুপুরে, গরিব বৌনাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে, এক অস্থির আবদুল খালেক, রেখা যাকে তার স্বামী বলে জানে, টুকু যাকে তার আব্বা বলে চেনে, হু হু করে কেঁদে ফেললো। এতোদিন পর, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ঝিরঝির বিপর্যয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো, গাজর ঐ কলিতে ভরদুপুরেও আকাশে চাঁদ ওঠে, সব রোগের নিরাময় ঘটে, সব পাপ ধুয়ে যায়, জগৎ-সংসার ভেসে যায়। কেবলই মনে হয়, কৈ, কোথাও তো কোনো দাগ লেগে নেই!

স্যার, আপনি এখানে? আবদুল খালেকের এক ছাত্র রশিদুল বললে, কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন—

আবদুল খালেক ব্রিত হয়ে বললে, এই একটু দাঁড়িয়েছিলাম। তোমাদের গ্রামগুলো ভারি সুন্দর!

রশিদুল খুশি হয়ে হাত কচলে বললে, চলুন না স্যার একদিন আমাদের বাড়িতে, আপনাকে ঘুরে ঘুরে সব দ্যাখাবো।

তোমাকে নিয়ে একদিন বেরুবো। প্রায়ই ইচ্ছে হয় ঘুরে ঘুরে সব দেখি, হয়ে ওঠে না।

আমাকে আগে থেকে বলে দেবেন। নৌকো ঠিক করে রাখবো–

আবদুল খালেক বললে, এবার ফিরতে হয়।

রশিদুল বললে, আমি বাজার থেকে আসছি। ভাবী আপনাকে ডাকার জন্যে লোক পাঠিয়েছিলেন বাজারে। খুঁজছিল—

তাহলে তো তাড়াতাড়ি ফিরতে হয়।

রশিদুল বললে, আমি কিছুদূর এগিয়ে দেবো, এই রোদে একা একা ফিরবেন–

কোনো দরকার নেই–আবদুল খালেক বললে, তুমি বরং বাড়ি যাও, এ আর কতোটুকু পথ!

ফেরার পথে আবদুল খালেকের কানে বাজে অদ্ভুত একটা বাজনা, জিনজার-গিনজার ট্রসটিন-এম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *