১৩. বাড়ির সামনের লনে

বাড়ির সামনের লনে যে বৈঞ্চিটা স্থায়ীভাবে রয়েছে তার বয়স প্রায় বাড়িটার মতন হলেও এখনও মজবুত রয়েছে। অর্জুন সেখানে বসে ছিল।

এখন বিকেল। রোদ রয়েছে বাড়ির পেছনে। এদিকটায় ছায়া ঘন হয়েছে। সামনের জঙ্গলে পাখিরা গলা খুলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সেই আদিম দিনে যখন প্রাণ গলা পেয়েছিল সেদিন থেকেই বোধ হয় সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার সময় অজানা আতঙ্কে এমনি চেঁচামেচি শুরু হয়েছিল। দিন মানেই চারপাশ চোখের সামনে, রাত মানে সমস্ত নিরাপত্তা উধাও। জঙ্গলের আর-এক প্রান্তে এই যে নিঝুম অঞ্চলে স্টিভেনসন সাহেব বাড়ি বানিয়েছিলেন, তার সৌন্দর্য সারাদিন ধরে প্রশংসা পাবে কিন্তু রাত্রে তিনি কী করতেন সত্তর বছর আগে?

হ্যালো, মাই বয়। মেজরের গলা পেয়ে পেছন ফিরে তাকাল অর্জুন। ইতিমধ্যে তিনি পোশাক পালটেছে। এখন তাঁর পরনে বারমুডা এবং গেঞ্জি। এগিয়ে আসতে আসতে বারমুডার পকেট থেকে পাইপ বের করে একটু পঁড়িয়ে তামাক জ্বালালেন। কাছে এসে বললেন, ফ্যান্টাস্টিক। কী জায়গা! আঃ পাখিগুলো চেঁচাচ্ছে কেন?

সন্ধে হয়ে আসছে, তাই। আপনি তরল থেকে ধোঁয়ায় চলে গেলেন?

নো! আজ একাদশী। দিনের বেলায় আমি ড্রিঙ্ক করি না। শুকনো থাকি। আঃ, এরকম জায়গায় সারাটা জীবন চুপচাপ কাটিয়ে দেওয়া যায়! তাই না?

আমি পারতাম না। কথা বলার লোক নেই, খাবার ফুরিয়ে গেলে এনে দেওয়ার কেউ নেই। পাগল হয়ে যেতাম। কিন্তু আপনার সাহেববন্ধু তো কথাই বলছেন না। তার ড্রাকুলা কোন অঞ্চলে থাকে, কীভাবে সেখানে গিয়ে আলাপ করে আসা যাবে, সেটা না জানলে অস্বস্তি হচ্ছে। অর্জুন বলল।

মেজরের দাড়িগোঁফের জঙ্গল থেকে ধোঁয়া বের হল, আমাদের বাল্যকালে একটা বাংলা ছবি দেখেছিলাম। তাতে সংলাপ ছিল, কৌতূহল থাকা ভাল, তবে তার সীমারেখা থাকা উচিত।আহা! দারুণ কথা। তোমার দেখছি একটু ধৈর্য কম। জলপাইগুড়িতে থাকলে তুমি এই সুন্দর জায়গাটাকে দেখতে পেতে না। তাই না?

এই সময় গোরানসাহেবকে দেখা গেল। গেট খুলে ভেতরে আসছেন। তিনি যে কখন বাড়ির বাইরে গিয়েছেন তা অৰ্জুন জানে না। কাছে এসে বললেন, এই জায়গাটা ভাল নয়। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসার সময় আমার অস্বস্তি হচ্ছিল।

অস্বস্তি? কীরকম? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।

আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না। ওয়েট! হঠাৎ সোজা হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে অর্জুন দেখল একটা বিরাট সাপ ধীরে ধীরে জঙ্গলের ভেতর থেকে এগিয়ে আসছে লনের দিকে। লম্বায় অন্তত বারো ফুট এবং বেশ মোটা আর কুচকুচে কালো সাপটা এখনও খানিকটা দূরে।

মেজর চাপা গলায় বললেন, কিং কোবরা!

গোরানসাহেবের গলা হিসহিসে শোনাল, নো। ইটস কুইন।

অর্জুন দেখল গোরানসাহেবের মুখের চেহারা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। অমলদার বাড়ির বাগানে সাপটাকে ধরার সময় এইরকম মুখ হয়েছিল। তিনি এক পা এগিয়ে যেতেই মেজর ওঁর হাত ধরে টানলেন, ডোন্ট।

লেট মি গো মেজর।

না। ওটা কী করে, কোথায় যায়, তা আমাদের দেখা উচিত।

বাট, বাট, আই মাস্ট কিল হার। কুইন কোবরার হেড আমার কালেকশানে নেই। লিভ মি প্লিজ। মেজরের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করছিলেন গোরানসাহেব। কিন্তু মেজর ওঁকে ছাড়লেন না। সাপটা ওঁদের দিকে এল না। সে যেন বেড়াতে যাচ্ছে এমন ভঙ্গিতে লনের একপাশ ধরে বাড়িটার পেছনদিকে যেতে লাগল।

শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলেন গোরানসাহেব। তাঁর মুখ-চোখ স্বাভাবিক হয়ে এল। ওরা তিনজনই ধীরে ধীরে সাপটাকে অনুসরণ করতে লাগল। বাড়িটার পেছনদিকের খোলা জমিতে ওরা প্রথম এল। বুনো ঝোপঝাড় ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। লোকনাথ এই বাড়ি আর লনের সংস্কার করেছেন কিন্তু পেছনদিকে বোধ হয় নজর দেননি। হঠাৎ গোরানসাহেব হাত বাড়িয়ে ইশারায় ওদের থামতে বললেন। জমিটার একপাশে কয়েক হাত দূরত্বে উঁচু উঁচু ঢিবির মতো কিছু রয়েছে। সাপটা তার একটার পাশে গিয়ে স্বচ্ছন্দে ভেতরে চলে যেতে লাগল সরসর করে। কিছুক্ষণ বাদে তাকে আর দেখা গেল না। গোরানসাহেব বললেন, ওইখানে ওর বাসা।

কথাগুলো ইংরেজিতে বলায় গোরানসাহেব মাথা নাড়লেন। তারপর এগিয়ে গেলেন। ওরা সন্তর্পণে অনুসরণ করল। কাছে যাওয়ার পর বোঝা গেল যেগুলোকে টিবি বলে মনে হচ্ছিল সেগুলো একসময় সমাধিবেদি ছিল। অর্থাৎ গত সত্তর বছরের কোনও একসময়ে এ বাড়ির তিনটি মানুষ মারা যাওয়ার পর এখানেই তাঁদের কবর দেওয়া হয়েছিল। যে বেদির তলায় সাপটা ঢুকেছিল তার ওপরের মাটি সরিয়ে সরিয়ে গোরানসাহেব লেখাটা আবিষ্কার করলেন, আর্নল্ড স্টিভেনসন। বর্ন 1870,এক্সপায়ার্ড 3 June 1938.

বাকি দুটো সমাধিবেদিতে হয়তো কিছু লেখা ছিল কিন্তু এখন সেটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বেদির ওপরের অংশের অনেকটাই নেই।

ওরা ফিরে এল। লনে ফিরতেই বটাকে দেখা গেল একটা ট্রের ওপর চায়ের কাপ নিয়ে আসতে। গোরানসাহেব কাপ তুলে থ্যাঙ্কস বললেন। মেজর বললেন, না হে, এ সময় চা খেলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে। অর্জুন কাপ তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, গোরক্ষনাথ কোথায়?

বটা বলল, আসন পেতে বসে ধ্যান করছে।

ওকে একটু এখানে আসতে বলতো?

বটা চলে গেলে গোরানসাহেব বললেন, এই স্টিভেনসন লোকটা তা হলে এখানেই মারা গিয়েছিল। ও তখন এখানে পাকাপাকি থাকত, না আসা-যাওয়া করত, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বাকি দুজন কারা?

মেজর বললেন, ওঁর আত্মীয়স্বজন।

তা হলে তারা ওর আগে মারা গিয়েছিল। ওই সমাধিবেদি দুটো একটু বেশি পুরনো বলে মনে হল। কিন্তু স্টিভেনসন লোকটার শরীর বিশাল ছিল।

মেজর বললেন, তা তো বটেই। নইলে এখানে অত বছর আগে থাকার হিম্মত হত না। সাহসী মানুষ। কিন্তু কী করে বোঝা গেল শরীর বিশাল ছিল?

সমাধিবেদির আয়তন দেখে। আর ওই বড় সাপটা সেই কারণে ওটাকেই নিজের জায়গা বলে বেছে নিয়েছে। গোরানসাহেব কথা শেষ করতেই গোরক্ষনাথ এগিয়ে এল, আদেশ করুন বাবু।

ওইভাবে কথা বলায় একটু অবাক হল অর্জুন। কিন্তু সেটাকে উপেক্ষা করে সে জিজ্ঞেস করল, এখানে আপনার কেমন লাগছে গোরক্ষনাথ?

সারাদিন ধরে বড়গুরুকে ডেকে গেলাম। নিজের কথা ভাবিনি।

বড়গুরু?

আমার গুরুর গুরু। ত্রিকাল দেখতে পেতেন।

তোমার সঙ্গী তিনটে কী করছে?

ওরা ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ ওরদিকে নাক তুলে কিছু শোঁকার চেষ্টা করল গোরক্ষনাথ, এই জায়গাটা ভাল নয় বাবু। কীসের যেন গন্ধ পাচ্ছি।

কীসের? কই, আমরা তো পাচ্ছি না!

নাক টানতে টানতে যেন গন্ধের পিছু নিয়ে গোরক্ষনাথকে এগোতে দেখে অর্জুন তার সঙ্গী হল। গোরক্ষনাথ বাড়িটার পাশ দিয়ে পেছনের জমিতে চলে এসে মাথা নাড়ল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী হল?

কেমন আঁশটে, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। এখান থেকেই গন্ধটা উঠছে।

অর্জুন অবাক হয়ে গেল। এই লোকটির সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকেই তার মনে হয়েছিল, আসলে সরল মানুষ, কিন্তু কিছু অন্ধ বিশ্বাস সম্বল করে নির্বোধ মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রোজগার করে। কিন্তু এখন ও হেঁটে এল সাপটা যে পথে এসেছিল সেই জায়গা দিয়ে। তা হলে ও কি সাপের গন্ধ পেয়েছে? প্রশ্নটা করল অর্জুন।

সাপ? কী জানি? এর আগে অনেক সাপ দেখেছি কিন্তু তাদের গায়ের গন্ধ তো পাইনি বাবু। কী সাপ? আপনি দেখেছেন?

খুব বড় কোবরা। কুচকুচে কালো।

তা হলে বাস্তুসাপ। তা তেনারা তো একা থাকেন না। জোড়া আছে।

তাদের শরীর থেকে গন্ধ বের হয়

একথা কখনও শুনিনি বাবু! অ তিনি কোথায় গেলেন?

ওই সমাধিবেদির নীচে গর্ত আছে, সেখানে ঢুকেছে।

গোরক্ষনাথ এক পা এগিয়ে গেল, আই বাপ, এ তো কবর। বাস্তুসাপ তো কবরের ভেতরে কখনও টুকবে না। না বাবু, এই জায়গাটা আমার ভাল লাগছে না।

কিন্তু কেন ভাল লাগছে না। সাপের ভয় পাচ্ছ?

গোরক্ষনাথ অর্জুনের দিকে তাকলি, বিষধর সাপকে কে না ভয় পায় বাবু। তবে এই জায়গাটা ভাল নয়। এখানে আসার কিছুক্ষণ পর থেকে কাকটা একবারও ডাকেনি।

অর্জুন হেসে বলল, চলো,এদিকটায় না থাকাই ভাল, অন্ধকার হয়ে আসছে।

 

এখানে সন্ধে বলে কোনও সময়কে চিহ্নিত করা গেল না। দিন শেষ হলেই ঝুপ করে রাত নেমে গেল। এমন নিকষ কালো রাত অর্জুন কখনও দেখেনি। বটা জেনারেটার চালু করায় ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। তার ফলে আর-এক বিপদ। জঙ্গলের যাবতীয় পতঙ্গ ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়ছে বাড়িটার ওপর। মেজরের খুব ইচ্ছে ছিল বারান্দায় বসে জঙ্গুলে অন্ধকার উপভোগ করার। কিন্তু পোকার হাত থেকে বাঁচতে ভেতরে এসে সব জানলা-দরজা বন্ধ করতে হল। এখন জানলার শার্সিতে শব্দ হচ্ছে। মাঝে-মাঝেই বড় বড় পোকা আছড়ে পড়ছে সেখানে। আলোর কাছে আসতে চায়। গোরানসাহেবের নির্দেশে শুধু রান্নাঘর ছাড়া সব আলো নিভিয়ে দেওয়ার পর শব্দটা কমে গেল। তিনি তার ঝোলা থেকে ব্যাটারিচালিত একটা বাব বের করলেন, যার মৃদু আলোয় ঘর পরিষ্কার দেখাবে। অর্জুন উঠে রান্নাঘরে চলে এল। সেখানে এখন গোরক্ষনাথ আর বঁটা পাশাপাশি দাড়িয়ে রান্নার আয়োজনে লেগেছে। তাকে দেখে বটা বলল, আপনারা কখন খাবেন? আটটার মধ্যে খেয়ে নেওয়াই ভাল।

কেন?

তা হলে আমরা ছুটি পাই। বঁটা হাসল।

আটটা বাজতে অনেক দেরি আছে। অর্জুন মাথা নাড়ল। তারপর এগিয়ে গিয়ে গোরক্ষনাথদের ঘরে উঁকি মারতেই অন্ধকারে লাল দুটো চোখ দেখতে পেল। চোখ দুটো জ্বলছে। সে আলো জ্বালতেই বেড়ালটা মুখ ফিরিয়ে নিল খাঁচায় বসে। শকুনটা বিরক্ত হয়ে বিশ্রী শব্দ করল, শুধু কাকটা চুপচাপ রইল। আলো নিভিয়ে দিয়ে অর্জুন বাইরের ঘরে এসে দেখল মেজর মদ্যপান শুরু করেছেন। বেশ ঘূর্তি এসে গিয়েছে ওঁর হাবভাবে। অর্জুনকে দেখে বললেন, এইরকম পরিবেশে দু-তিনটে গান হলে মন্দ হয় না। তুমি গান জানো?

না। অর্জুন মাথা নাড়ল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন না?