১২. তিস্তা ব্রিজ ছাড়িয়ে সুমো ডুয়ার্সে ঢুকল

তিস্তা ব্রিজ ছাড়িয়ে সুমো ডুয়ার্সে ঢুকল। দুপাশে ধানের মাঠ, চওড়া হাইওয়ে, তখনও রোদ কড়া না হওয়ায় বাতাসে ঠাণ্ডা আমেজ, পেছনের খাঁচায় বসে কাকটা কা কা করে উঠল। মেজর দুহাতে কান ঢাকলেন, ওঃ, হাঁড়িচাচাটার মুখ বাঁধা যায় না?

গাড়ি দোমহনি পেরিয়ে বাইপাস ধরল, চারপাশের সবুজের দিকে তাকিয়ে গোরানসাহেব বললেন, বিউটিফুল। অর্জুনের মনে পড়ল, সে যখন আমেরিকায় গিয়ে হাইওয়ে ধরে কোথাও গিয়েছিল তখন দুপাশে একই দৃশ্য দেখেছে, কোথাও দৃশ্যান্তর হয়নি। ফলে একটু বাদেই একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল।

ধুপগুড়ি থেকে বাঁক নিয়ে ওরা রাস্তা সংক্ষেপ করল। ধুপগুড়িতে মেজর ব্রেকফাস্ট করতে চাইলেন। দুটো করে ডিম আর হাতে-গড়া রুটি। এর বেশি অন্য কিছু খেলে নাকি ওঁদের পেট খারাপ হতে পারে। সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে জলের বোতল রয়েছে। এঁরা দুজনেই বাইরের জল খান না। অর্জুন গরম গরম পুরি এবং তরকারি খেল। সঙ্গে জিলিপি। গোরক্ষনাথও তাই। ওদের খাওয়া জুলজুল করে দেখছিলেন মেজর। তারপর বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, এসব আমিও ছেলেবেলায় খেতাম।

এখন অসুবিধে হচ্ছে কেন?

বড়লোকের বাড়ির কুকুরকে দেখেছ? বাছাই করা খাবার ছাড়া খায় না। মাছ বা মাংস কাঁটা বা হাড় বাদ দিয়ে তাদের মুখের সামনে তুলে ধরা হয়। ইনজেকশন, ওষুধ নিয়মিত খাইয়ে তাজা রাখা হয়। গরমের সময় ঠাণ্ডা ঘর, আবার ঠাণ্ডার সময়ে গায়ে কম্বল চাপিয়ে দেওয়া হয়। আর এইসব করে ওদের স্বাভাবিক প্রতিরোধ শক্তির বারোটা বেজে যায়। রাস্তার কুকুর বা বাড়ির নেড়ি কুকুর যা খেয়ে সহজে হজম করে ফেলে, ওরা তা খেলে মরে যাবে। আমিও তাই হয়ে গেছি বলতে পারো। তেলেভাজা কিছু দেখলেই সন্দেহ করি! মেজর বললেন।

নিজের সঙ্গে একটি নেড়ি কুকুরের তুলনা ভাল লাগার কথা নয়, তবু অর্জুনের মনে হল মেজর তো তাকে আহত করার জন্যে উপমাটা দেননি। এই কথাগুলোর মধ্যে তিনি নিজেকে নিয়েও ঠাট্টা করেছেন। ইচ্ছে করলেই এখন সব কিছু খেতে পারেন না।

ওরা যখন মাদারিহাটে পৌঁছল তখন প্রায় এগারোটা বাজে। ইতিমধ্যে গোরানসাহেব দুবার ম্যাপ দেখেছেন। ড়ুয়ার্সের এই অঞ্চলের বিশদ বিবরণ ছাপা ম্যাপ কী করে আমেরিকায় পাওয়া যায় তা কে জানে! নিজের দেশের বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে ওরা যত খোঁজখবর রাখে তার এক শতাংশও আমরা নিজেদের দেশ সম্পর্কে রাখি না।

মোড়ের মাথায় এসে গাড়ি থামিয়ে গোরানসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ম্যাপে বলছে, ডান দিক ধরে কিছুটা গেলেই হলং নামের জঙ্গল পড়বে। রাইট?

অর্জুন মাথা নাড়ল, জঙ্গলটার নাম হলং কিনা জানি না। তবে ওখানে হলং ফরেস্ট বাংলো আছে। আপনি কি ওখানে যেতে চান?

ফরেস্ট বাংলোতে টুরিস্টরা থাকবে, হ্যাঁ, ইয়েস, নাম বলছে জলদাপাড়া।

অর্জুন বলল, হ্যাঁ। খুব বিখ্যাত ফরেস্ট। গণ্ডার দেখা যায়। গোরানসাহেব বললেন, আমরা ওদিকে যাব না। এখানে কোনও হোটেল আছে?

গাড়ি একটু এগোতেই বাজার এলাকা এসে গেল। সেখানে ওরা গাড়ি থেকে নেমে একটা চায়ের দোকানে ঢুকল। গোরক্ষনাথ নামল না। সে তার ব্যাগ থেকে খাবার বের করে পাখি দুটো আর বেড়ালটাকে খাওয়াতে লাগল।

তিন গ্লাস চা নিয়ে বসে দোকানদারের কাছে জিজ্ঞেস করে জানা গেল এখানে কোনও হোটেল নেই। জলদাপাড়ার জঙ্গলের ভেতরে যেমন হলং বাংলো আছে তেমনি জঙ্গলের বাইরে মাদারিহাট টুরিস্ট লজটি এত বড় যে, এখানে আর হোটেল ব্যবসা করার কথা কেউ ভাবেনি। হোটেল আছে হাসিমারায়, ফুন্টশলিঙে।

দুজন ভদ্রলোক চা খাচ্ছিলেন আর ওদের কথাবার্তা শুনছিলেন। তাঁদের একজন উঠে এলেন, আপনারা কোত্থেকে আসছেন?

মেজর জবাব দিলেন, আপাতত জলপাইগুড়ি থেকে আসছি ভাই। ও ওখানে থাকে। ওর নাম অর্জুন। তুমি যেন নিজেকে কী বলো?

অর্জুন বলল, থাক না?

ভদ্রলোক বললেন, অর্জুন! কিছু মনে করবেন না, আপনি কি সেই সত্যসন্ধানী?

মেজর লুফে নিলেন শব্দটা, ইয়েস, ইয়েস! সত্যসন্ধানী!

ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিলেন, আরে ভাই, আপনার গল্প খুব শুনেছি। আপনি তো আমেরিকায় গিয়ে রহস্য উদঘাটন করেছেন। আপনার জন্যে আমরা গর্বিত। তা ছাড়া আপনার গুরু মিস্টার অমল সোমের সঙ্গে আমার একসময় পরিচয় ছিল। খুব ভাল লাগছে।

আপনার পরিচয়টা—? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

আমি সামান্য লোক। ব্যবসা করে খাই। আলিপুরদুয়ারে থাকি। তবে এখানে, মাইল কুড়ি দূরে একটি বাড়ি কিনেছি ঝোঁকের মাথায়। একজন ব্রিটিশ বাড়িটা বানিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর ভদ্রলোক এক চা বাগানের মালিককে সেটা বিক্রি করে দেন। ওঁরা কিছুদিন ব্যবহার করে প্রায় পোড়ো বাড়ির মতো ফেলে রেখেছিলেন। জলের দামে পেয়ে গেলাম বলে নিয়ে নিলাম। আমার নাম লোকনাথ দত্ত।

এই নামের কোনও লোকের কথা অমল সোমের কাছে শুনেছে বলে মনে পড়ল না অর্জুনের। তবে ভদ্রলোক বেশ মিশুকে, এটা বোঝা গেল।

চায়ের দাম দিতে যাচ্ছিল অর্জুন, লোকনাথ বাধা দিলেন। নিজে দাম মিটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা এদিকে কেন? বেড়াতে?

একরকম তাই। ওঁরা এসেছেন আমেরিকা থেকে। জঙ্গলে থাকতে চান কিন্তু ফরেস্ট বাংলোতে নয়। অর্জুন জানাল।

তাই নাকি? কিন্তু এদিকের জঙ্গল এখন নিরাপদ নয়।

কেন? মেজর জানতে চাইলেন, ম্যান ইটার আছে নাকি?

জন্তু-জানোয়ার নিশ্চয়ই আছে, তবে তারা মানুষখেকো নয়। প্রায়ই একটা না একটা মানুষের ডেডবডি পাওয়া যাচ্ছে, যার শরীরে রক্ত নেই।

মেজর চট করে গোরানসাহেবের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে খবরটা ইংরেজিতে পরিবেশন করলেন। গোরান কৌতূহলী হয়ে লোকনাথকে জিজ্ঞেস করলেন, লোকগুলোর শরীরে কোনও দাগ আছে? বিশেষ করে গলার পাশে?

আমি দেখিনি। লোকাল থানার অফিসার বলতে পারবে। যাক গে, আপনারা ইচ্ছে করলে আমার বাড়িতে থাকতে পারেন। জঙ্গলের গায়ে বাড়ি। মুশকিল হল ওখানে কোনও কাজের লোক থাকতে চায় না। অনেক চেষ্টা করেছি, সবাই থাকতে ভয় পায়।

কেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

পাণ্ডববর্জিত জায়গা তো! অন্তত দশ মাইলের মধ্যে লোকজন নেই। আমার স্ত্রী তো খুব বকাবকি করেছেন ওরকম জায়গায় বাড়ি কিনেছি বলে। তা জঙ্গলে থাকবেন কী করে? তাঁবু আছে? তাঁবুতে থাকলেও নিজের হাতে সব করতে হবে। আমার ওখানে বিছানাপত্র সব পাবেন। কিচেন আছে। গ্যাস রেখে দিয়েছি। দরকার হলে রান্না করে নিতে পারবেন। নইলে গাড়ি পাঠিয়ে খাবার আনিয়ে নেবেন। কদিনের প্রোগ্রাম আপনাদের? লোকনাথ জানতে চাইলেন।

খুব বেশি হলে দিনসাতেক।

তা হলে চলুন। দ্বিতীয় ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছিলেন পাশে। লোকনাথ তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমার বন্ধু। প্রদীপ পান্ডে।

ভদ্রলোক নমস্কার করলেন। লোকনাথ বললেন, চলুন আপনারা। ড্রাইভারকে বলুন আমার গাড়িকে ফলো করতে।

সুমোতে উঠে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে মেজর বললেন, এই জিনিসটা আমার জীবনে অনেকবার হয়েছে। চিনি জোগান চিন্তামণি। একবার কালাহারি মরুভূমিতে আমাদের গাড়ি খারাপ হয়ে গেল। রাত তখন তিনটে। দিনে বিশ্রাম, রাত্রে চলতে হত। আর ঘণ্টাদেড়েক বাদে সূর্য উঠবে। তখন আর গাড়িতে বসে থাকা যাবে না। কী করা যায়? সঙ্গীরা মতলব বের করল। গাড়ির নীচে বালি সরিয়ে গর্ত করল। বলল, সারাদিন সেখানে শুয়ে থাকবে। মাথার ওপর গাড়ি থাকায় তার ছায়া পাওয়া যাবে। ব্যাপারটা আমার পছন্দ হল না। তখনও অন্ধকার রয়েছে। একটা টর্চ নিয়ে বাঁ দিক ধরে কিছুটা এগোলাম। যাতে পথ চিনে ফিরে আসতে পারি তার চিহ্ন রেখে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ শব্দ কানে এল। একটা ক্যারাভান আসছে। অনেক উট। তাদের সর্দার আমায় দেখে অবাক! ওদের ভাষায় বিপদের কথা জানালাম। ভাগ্য ভাল, ওদের দলে একজন মোটর মেকানিক ছিল। তাকে নিয়ে গাড়ির কাছে ফিরে এলাম প্রায় আধমাইল পথ হেঁটে। সে এসে দশ মিনিটের মধ্যে গাড়ি চালু করে দিল। এখন কথা হল, আমি যদি আধমাইল না হেঁটে যেতাম তা হলে ওই ক্যারাভান আমাদের চোখের আড়াল দিয়ে বেরিয়ে যেত। ওরাও আমাদের দেখতে পেত না। কাকতালীয় ব্যাপার, কিন্তু আমার জীবনে এটা প্রায়ই হয়।

অর্জুনের মনে হল এই গল্প প্রায় বিশ্বাসযোগ্য। মেজরের অনেক গল্প যেমন মেনে নেওয়া যায় না তেমন এটা নয়। সুমো গাড়ি তখন আবার হাইওয়েতে উঠেছে। দুপাশে এখন জঙ্গল। ঝিঝি ডাকছে। সামনে একটা ব্রিজ পড়বে। তারপর বাঁ দিকে খানিকটা গেলে পার্বতী বরুয়ার বাড়ি, যেখানে তিনি হাতি নিয়ে থাকেন। এসব জায়গা দিয়ে সে অনেকবার গিয়েছে। সুভাষিণী চা বাগানে যখন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন, তখন বেশি যাওয়া হত। ভানুদা এখন আর সুভাষিণীতে নেই। তিনি চলে গিয়েছেন বানারহাটের কাছে রেডব্যাঙ্ক বাগানে। অনেকদিন দেখা হয়নি হাসিখুশি মানুষটার সঙ্গে।

রাস্তার পাশে একটা ধাবা। লোকনাথের গাড়িটা দাঁড়িয়ে যেতে বঁটা সুমোকে তার পাশে নিয়ে গেল। লোকনাথ চিকার করে জিজ্ঞেস করলেন, লাঞ্চ করবেন?

মেজর জবাব দিলেন, না। সঙ্গে আছে।

গাড়ি আবার চলল। একটা মেঠো পথ ডান দিকের জঙ্গল ভেদ করে চলে গিয়েছে। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ জঙ্গল শেষ হয়ে নদীর শুকনো বুক চোখের সামনে চলে এল। একফোঁটা জল নেই কোথাও। বালি আর নুড়ির ওপর দিয়ে নদীটা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকল ওরা।

গোরানসাহেব বললেন, অদ্ভুত পথ তো! যখন নদী জলে ভরে যায় তখন কী করে যায়?

মেজর বললেন, নিশ্চয়ই অন্য কোনও ঘুরপথ আছে।

এখানকার জঙ্গল বেশ ঘন এবং বুনো। ভেতরে সূর্যের আলো তেমন করে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে না। অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসছে জঙ্গল থেকে। পথ শেষ হল জঙ্গলের ঠিক বাইরে, যেখান থেকে পাহাড় হাত বাড়াবেই। ড়ুয়ার্সের এই অঞ্চলের পাহাড় বেশি উঁচু নয়। আর তখনই ওরা বাড়িটাকে দেখতে পেল। তারের বাউন্ডারি দেওয়া একতলা বিশাল বাড়ি। লোহার গেট খুলে সোজা বাড়ির সামনে চলে এসে গাড়ি দুটো থামল।

গাড়ি থেকে নামার পর লোকনাথ বললেন, এই বাড়ি এখন আমার। বুঝতেই পারছেন এতদূরে কোনও লোক একা থাকতে চাইবে না। ফলে তালা ঝুলিয়ে রাখতে হয়েছে। দূরত্বের জন্যেই বোধহয় দরজা-জানলা এখনও চুরি হয়নি। ভেতরটা পরিষ্কার করা আছে। এই নিন চাবি। ঠিক সাতদিনের মাথায় সকাল-সকাল আমি চলে আসব। যদি তার আগে চলে যেতে চান তা হলে মাদারিহাটের যে চায়ের দোকানে আমাদের আলাপ হল, তার মালিকের কাছে চাবিটা রেখে যাবেন। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। অনেকটা দূরে যেতে হবে।

ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গীকে নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে লোহার গেট বন্ধ করে গেলেন। গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যাওয়ামাত্র চারপাশ অন্যরকম হয়ে গেল। বাউন্ডারির বাইরে জঙ্গলের শুরু। সেখান থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে। সম্ভবত একদল বাঁদর বাঁদরামি করছে। এই দুপুরেও গাছের ছায়া ঢেকে রেখেছে বাড়িটাকে।

অর্জুন তালা খুলল। বিরাট বসার ঘর। ফায়ার প্লেসও রয়েছে। পুরনো দিনের সব আসবাব। পর্দা নেই ভেতরের দরজায়, কিন্তু জানলায় রয়েছে। গোটা চারেক বড় বেডরুম। কিচেনটা বিশাল। দুটো বাথরুম এবং টয়লেট। জেনারেটার আছে। আছে পাম্পও। সেগুলো চালিয়ে ওপরের ট্যাঙ্কে জল তোলার ব্যবস্থা করল অর্জুন।

মেজর বললেন, তোফা ব্যবস্থা।

গোরানসাহেব বললেন, গুড।

জিনিসপত্র নামাতে হবে। ওরা বাড়ির বাইরে এসে দেখল বটা আর গোরক্ষনাথ সেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ গোরানাহেব এগিয়ে গেলেন। বারান্দার পাশে একটা থামের গায়ে শ্বেতপাথরের ফলকে কিছু লেখা আছে। অর্জুন আর মেজর গোরানসাহেবের পাশে গিয়ে দেখল, মিস্টার আর্নল্ড স্টিভেনসন। নাইনটিন থার্টি। অর্থাৎ এই বাড়ির বয়স সত্তর বছর। বাড়িটা বানিয়েছিলেন স্টিভেনসন সাহেব। তিনি কবে জন্মেছিলেন বা মারা গিয়েছিলেন, তা জানা যাচ্ছে না।

গোরানসাহেব দু-দুবার নামটা উচ্চারণ করলেন।

জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখার পর ঠিক হল ওরা তিনজন তিনটে বেডরুমে থাকবে। গোরক্ষনাথ আর বটা পেছনের দিকের বেডরুমটা ব্যবহার করবে। সেই ঘর দেখে বটা খুব খুশি। দু-দুটো খাটে বিছানা পাতা আছে। শুধু সে অর্জুনের কাছে এসে নিচু গলায় বলল, সব ভাল সার, শুধু ওই শকুন, কাকের সঙ্গে এক ঘরে থাকতে হবে, এটা ভাল লাগছে না।

ওরা খাঁচায় থাকবে ওদের মতো, তোমার কী! অর্জুন উড়িয়ে দিল। মেজর তাঁর বিখ্যাত পাইপ বের করলেন। এ-যাত্রায় ওঁকে ধূমপান করতে দেখেছে বলে মনে পড়ল না অর্জুনের। তাঁকে জ্বালাতে দেখে গোরানসাহেব বিরক্ত হলেন। ওঁরা বসে ছিলেন ড্রইংরুমে। অর্জুন বলল, এখন খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়।

মেজর বললেন, ব্যবস্থার তো কিছু নেই, করাই আছে।

কীরকম?

দারুন সার্ডিন মাছের কৌটো আছে আর সঙ্গে পাউরুটি।

সে কী! আপনি বলেছিলেন রান্না করবেন? অর্জুন মনে করিয়ে দিল।

সেটা অন্য সময়ে করা যাবে। এখন কৌটো খাও।

অর্জুন রেগে গেল খুব। বলল, সহ্য হবে না জিভে।

মানে? মেজর বললেন, আরে আগে খেয়ে দ্যাখো। ডাক্তাররা সেন্ট পার্সেন্ট হাইজেনিক বলে সার্টিফাই করেছেন।

আপনি বলেছিলেন নেড়ি কুকুর যা খায় তা বড়লোকের কুকুর খেলে মরে যাবে। আবার ঠিক উলটোটাও হয়। বড়লোকের কুকুরকে যে নির্বিষ খাবার দেওয়া হয় তা নেড়ি কুকুরের সামনে ধরলে মুখ ঘুরিয়ে নেবে।

ব্যাপারটা কীরকম হল?

কেন?

মনে হচ্ছে তুমি আমাকে কথাটা ফিরিয়ে দিলে?

অর্জুন হেসে ফেলল, দেখুন, বিদেশে যখন গিয়েছিলাম তখন কেউ আমাকে কন্টিনেন্টাল ফুড খাওয়ালে বার্লির কথা মনে পড়ত। মনে হত আমার পেট খারাপ হয়েছে বলে খাচ্ছি। দেখি, অন্য চেষ্টা করি।

চার নম্বর ঘরটায় গেল অর্জুন। বটা বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে বিড়ি টানছে। গোরক্ষনাথ ইতিমধ্যে লাল লুঙ্গি পরে বাবু হয়ে চোখ বন্ধ করে বসে পড়েছে। তার সামনে তিনটে খাঁচার প্রাণী, তিনটে চুপচাপ রয়েছে। এখন বোধহয় কোনও পুজো। করছে গোরক্ষনাথ। বটা তাকে দেখে লাফিয়ে উঠল।

অর্জুন তাকে বলল, বটা, রাঁধতে পারো?

সেদ্ধ যা খাবেন, করে দিতে পারি।

তা হলে ভাত, আলু আর ডিমসেদ্ধ করে ফেললা চটপট।

সঙ্গে একটু ডাল, আলুভাজা আর কাঁচা মরিচ।

পারবে?

খুউব। কিন্তু কজনের জন্যে?

তিনজনের জন্যে। ওই সাহেবরা কৌটোর খাবার খাবে।

অর্জুন নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। লম্বা দেওয়াল, বড় ছাদ। ছাদে একটু ফাটল ধরেছে। এই ঘরে কোনও আসবাব নেই, এই খাট ছাড়া। তার সুটকেসটাকেও মাটিতে রাখতে হয়েছে। জল পড়ার শব্দ হল। তারপরেই পাম্প বন্ধ হয়ে গেল। বোধহয় বটাই কাজটা করল। ওকে নিয়ে এসে ভাল হয়েছে।

কিন্তু গোরানসাহেব ঠিক কী চাইছেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। এখানে বসে থাকলে ড্রাকুলার দেখা উনি পাবেন কী করে? লোকনাথ বললেন এখানে রক্তহীন মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। ওটাকে ড্রাকুলার কাণ্ড বলে মনে করেন নাকি গোরানসাহেব? তবে স্টিভেনসন সাহেবের বাড়িতে ঢোকার পর মনে হচ্ছে এরকম জায়গায় ড্রাকুলাবাবু এলেও আসতে পারেন। সে জানলার দিকে তাকাল। তারের ওপাশে কাঠের পাল্লা। ঘর গরম হচ্ছে। অর্জুন জানলা খুলে দিতেই জঙ্গলটাকে দেখতে পেল। হাওয়া ঢুকছে এখন।

বটা এসে জানাল, খাবার রেডি। অর্জুন উঠে ডাইনিংরুমে গিয়ে দেখল ভাত ডিমসেদ্ধ আলুভাজা আর ডাল তৈরি। সে ড্রইংরুমে ফিরে গিয়ে দেখল মেজর আর গোরানসাহেব কৌটো আর পাঁউরুটি নিয়ে এদিকে আসছিলেন। ওঁরা ডাইনিং টেবিলে সাজানো খাবার দেখে অবাক হলেন। মেজর গম্ভীর মুখে কৌটো খুলে ফেললেন।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ডিমসেদ্ধ ভাত দিয়ে মেখে খাবেন নাকি?

মেজর জবাব দিলেন না। গোরানসাহেব একটা প্লেটে সামান্য ভাত তুলে নিয়ে কৌটোর সার্ডিন মাছ তাতে উপুড় করে দিলেন। তেল দেওয়া মাছটা দিয়ে ভাত মেখে চামচ দিয়ে খেতে লাগলেন।

সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মেজর বললেন, রোমে যখন থাকব তখন রোমানদের মতো ব্যবহার করব। আমাকে দুটি ভাত আর ডিমসেদ্ধ দাও হে।