০৩. শেষ পর্যন্ত সার্কিট হাউসেই

শেষ পর্যন্ত সার্কিট হাউসেই ঘরের ব্যবস্থা করতে হল অর্জুনকে। গোরানসাহেবের যুক্তি মনঃপূত হয়নি মেজরের।

পাহাড়ে জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে থাকতে হয় বিকল্প ব্যবস্থা নেই বলে। এভারেস্টের পাঁচশো ফুট নীচে যদি একটা বিশ্রী ধর্মশালাও থাকত তা হলে অভিযাত্রীরা সেখানেই গিয়ে উঠতেন, তাঁবু খাটাতেন না। গোরানসাহেব অ্যাডভেঞ্চার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু মেজর রাজি হলেন না।

সার্কিট হাউসের ব্যবস্থা করে ওঁদের ওখানে তুলে দিতে-দিতে সন্ধে হয়ে এল। এত লটবহর টানাটানি না করে হাবুর জিম্মায় রেখে দেওয়া হল। গোরানসাহেব জর ঘরের দরজা বন্ধ করলে অর্জুন খাওয়াদাওয়ার প্রসঙ্গ তুলল। মেজর ততক্ষণে পাশাক পালটে ফেলেছেন। আলখাল্লায় বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বললেন, নো প্রবলেম। প্রথমে বলো, তোমার মা কীরকম আছেন?

ভাল।

তা হলে তো চুকেই গেল। ওঁর হাতের নিরামিষ রান্না খাব। এই ধরো লাউয়ের ঘন্ট, চালকুমড়ো নারকোল দিয়ে, শুক্তো, বড়ির ঝোল। বলতে বলতে খেয়াল হল তাঁর, ওঁকে খাটানো হয়ে যাবে না তো?

মোটেই না। মা এসব রান্না করতে পারলে খুশি হবেন। কিন্তু ওই ভদ্রলোক দিশি রান্না খাবেন?

আলবত খাবে। আমেরিকানরা তো সেদ্ধ ছাড়া কিছুই খেতে জানে না। এবার খেয়ে দেখুক রান্না কাকে বলে! শুধু একটু মিষ্টি দিতে বোলো।

কিন্তু এগুলো তো দিনের খাবার।

তাই তো! আমাদের কাছে কিছু টিনফুড আছে। আজ চালিয়ে নেব। মেজর একটা ব্যাগ খুলে হুইস্কির বোতল বের করলেন। সেটাকে আলোর সামনে ধরে খানিকক্ষণ দেখলেন। ওঁর দাড়িগোঁফের জঙ্গলের মধ্যে দিয়েও তৃপ্তির হাসিটা ফুটে উঠছিল, গুড। তুমি তো এখন সাবালক। চলবে তো?

না। অর্জুন হেসে মাথা নাড়ল।

ছিপি খুলে বোতল থেকে সরাসরি কয়েক ঢোক গলায় চালান করে দিলেন মেজর। তারপর চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলেন। অর্জুনের মনে পড়ল মেজরের মদ্যপান সে প্রথম দিন থেকে দেখে আসছে। অনেক বছর চলে গেল। ইতিমধ্যে মেজরের দাড়ির বেশিরভাগই সাদাটে হয়ে গিয়েছে। অথচ ওঁর স্বভাব বদলায়নি, মদের প্রতি আসক্তি একই রয়েছে।

বোতলটাকে যত্ন করে টেবিলের ওপর রেখে মেজর বিছানায় বসলেন, এবার বলো, গোরান স্যুলম্যানকে তোমার কেমন লাগল।

একটু অন্যরকম।

ঠিক। মাঝে-মাঝে আমারও মনে হয় ও মানুষ নয়, মানুষের শরীরে বাস করা একটা আত্মা। আসলে আত্মা নিয়ে গবেষণা করতে করতে ওর মধ্যে পরিবর্তন এসে গিয়েছে। এমনিতে লোকটা ভাল।

আজ অমলদার বাগানে একটা শঙ্খচূড় সাপকে উনি মুঠোয় চেপে মেরেছেন। পরে সেই সাপটার মাথা কেটে পাতায় জড়িয়ে নিয়ে এসেছেন।

সাপের মাথা? চোখ বড় করলেন মেজর, সাপের মাথার সঙ্গে হয়তো আত্মার কোনও সম্পর্ক আছে। এসব লোকদের বোঝা মুশকিল। আমি আসতে রাজি হলাম, কারণ তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। দ্বিতীয়ত, ভূতপ্রেতে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু ড্রাকুলার গল্প পেলেই পড়ে ফেলি। এই সুযোগে যদি জ্যান্ত ড্রাকুলা দেখা যায়, মন্দ কী। বোতলের দিকে হাত বাড়ালেন মেজর।

আপনি চিঠিতে স্পষ্ট কিছু লেখেননি। ব্যাপারটা কী?

গোরান সুলম্যানকে আত্মা নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা খুব গুরুত্ব দেন। গোরান বিশ্বাস করে আত্মা আছে। তবে ভালমানুষ মারা গেলে তাঁদের আত্মা মহাশূন্যে মিলিয়ে যায়। কিন্তু মন্দ মানুষের আত্মা পৃথিবীতে আটকে থাকে, যন্ত্রণা পায়। সেই যন্ত্রণা নাকি মারাত্মক। মানুষ হয়ে থাকার সময় যাদের কামনা-বাসনা মেটে না, লোভের শেষ যাদের হয়নি, তারাই বদ-আত্মা হয়ে যায়। এই আত্মাদের কেউ প্রতিশোধ নিতে, অত্যাচার করতে একটা শরীর বেছে নেয়। এদের বলা হয়। ড্রাকুলা। দিনের বেলায় এদের কোনও ক্ষমতা নেই, কিন্তু রাত্রে এরা ভয়ানক হয়ে ওঠে। গলায় মদ ঢাললেন মেজর।

এসব কথা এখন একটা কিশোরও জেনে গিয়েছে। সেইসঙ্গে এও জানে রাক্ষস-খোক্ষস ড্রাকুলা স্রেফ গাঁজাখুরি গপ্পো। আমি একটা কথা ভেবে পাচ্ছি না, গোরাসাহেবের মতো একজন আধুনিক মানুষ কেন এসবে ইন্টারেস্টেড হলেন?

গাঁজাখুরি! মাই ডিয়ার অর্জুন, পৃথিবীর নানান দুর্গম জায়গায় ঘুরে আমি স্পষ্ট জেনে গেছি আমার জ্ঞানই শেষ কথা নয়। তুমি একটা গোরুকে দেখবে সুন্দর সাঁতার কেটে নদী পার হচ্ছে। ওকে সাঁতার শেখাল কে? কখনও যে-মানুষ জলে নামেনি সে কি সাঁতার কাটতে পারবে? একবার আলাস্কা পেরিয়ে এমন একটা বরফের দেশে গিয়েছিলাম যেখানে আমাদের আগে কেউ যায়নি। তুষারঝড়ে আমরা আটকে পড়ায় খাবার শেষ হয়ে যাচ্ছিল। একদিন আমি আর একজন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান শিকার করতে বের হলাম। ওইসব অঞ্চলে সীল পাওয়া যায়। বরফের চুড়োয় একটা বসে ছিল। আমাদের দেখেই সেটা শূন্যে ঝাঁপ দিল। অতবড় চর্বিওয়ালা শরীর নিয়ে ঠিক পাখির মতো অনেকটা উড়ে নীচের বরফের খাঁজে লুকিয়ে পড়ল। সীল উড়তে পারে একথা তুমি বিশ্বাস করবে? অত কথা বলার দরকার কী, এ-দেশে এখনও নিশ্চয়ই তান্ত্রিকদের খুব প্রভাব আছে, আছে তো? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।

তা আছে। অর্জুন স্বীকার করল।

শুধু সরল অশিক্ষিত মানুষরাই তাদের কাছে যায়, একথা নিশ্চয়ই বলবে না। শিক্ষিত মানুষ যখন তাদের সামনে মাথা নিচু করে বসে তখন গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিতে পারবে? রামকৃষ্ণদেব মা কালীর দর্শন পেতেন। তুমি জানো না?

পড়েছি। কিন্তু–!

ভগবান থাকলে ভূত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

গোরানসাহেব আগে কী করতেন?

ও ডাক্তারি পাশ করে গবেষণা করে গেছে চিরকাল।

কী ব্যাপারে?

ওই একটা প্রশ্ন করলে গোরান খুব রেগে যায়। চলো, অনেকক্ষণ বকবক করে যাচ্ছি। তোমাদের শহরটা একটু ঘুরে দেখি। মেজর আবার বোতলের দিকে হাত বাড়ালেন। অর্জুন বলল, আজকে বিশ্রাম নিলে ভাল হত না? অনেকটা জার্নি করে এসেছেন। তার চেয়ে আপনাদের পরিকল্পনার কথা শুনলে ভাল লাগবে। অর্জুন বলল।

মেজর উঠে একটা ব্যাগ খুলে বড় প্যাকেট বের করলেন। সেখান থেকে ভাঁজ করে রাখা একটা ম্যাপ টেবিলের ওপর বিছিয়ে বললেন, কাম হিয়ার।

অর্জুন কাছে গেল। একটা বড় বিন্দুর ওপর আঙুল রেখে মেজর বললেন, দিস ইজ জলপাইগুড়ি। এখানে আমরা এখন রয়েছি। ঠিক আছে। এটা তিস্তা নদী। সাহেবদের তৈরি ম্যাপ, ভুল থাকলে বলে দেবে তুমি। এই তিস্তা পার হলে হিমালয়ের নীচের পুরো জায়গাটার নাম ড়ুয়ার্স। এই যে রাস্তাটা ড়ুয়ার্স পেরিয়ে সোজা আসামে চলে গিয়েছে।

অর্জুন ম্যাপটাকে লক্ষ করছিল। প্রথমেই চোখে পড়ল তিস্তার ওপর যে দুটো ব্রিজ তৈরি হয়েছে তা ম্যাপে নেই। এখান থেকে ময়নাগুড়ি হয়ে ধুপগুড়ি চলে গিয়েছে রাস্তাটা। এখন যে ময়নাগুড়িতে না গিয়ে বাইপাস হয়ে নতুন তৈরি ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে ধুপগুড়ি যাওয়া যায়, সেই রাস্তাটাও ম্যাপে নেই। অর্থাৎ এই ম্যাপ তৈরি হয়েছিল ষাট সালের আগে। ড়ুয়ার্সের ভূগোল মোটামুটি এক থাকলেও পথঘাট বদলে গেছে।

মেজর বললেন, এই পথ ধরে আমরা সোজা চলে যাব হাসিমারায়। তারপর থেকেই ভুটানের এলাকা। এই হাসিমারার পাশে একসময় ব্রিটিশদের কবরখানা ছিল। গোরান যা তথ্য পেয়েছে এই এলাকায় একশো বছর আগে প্রচুর ব্রিটিশ প্রয়োজনে থাকতেন। চা বাগানের পত্তনের পর এখানে তাঁদের একটা ক্লাবও তৈরি হয়েছিল। সেই ক্লাব ভারতীয় বিপ্লবীরা পুড়িয়ে দিয়েছিল একসময়। তিনজন ব্রিটিশ সেই আগুনে পুড়ে মারা যায়। আমরা ওখানে যেতে চাই।

কেন?

ওই তিনজন ব্রিটিশের মৃত আত্মা এখনও ওইসব অঞ্চলে সক্রিয় বলে গোরানের ধারণা। ও নাকি ওর পরিচিত আত্মার কাছ থেকে এমন তথ্য পেয়েছে।

অর্জুন হেসে ফেলল। মেজর চোখ ছোট করলেন, তুমি হাসছ কেন?

অর্জুন বলল, ওই আত্মারা এখানে পড়ে আছে কেন? ওরা যখন ব্রিটেন থেকে এসেছিল তখন স্বচ্ছন্দে স্বদেশে চলে যেতে পারে। সেটাই তো স্বাভাবিক। আর চলে যেতে ওদের তো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।

মেজর মাথা নাড়লেন, ঠিক এই প্রশ্নটাই আমি গোরানকে করেছিলাম।

উনি কী জবাব দিয়েছেন?

খুব ভুল বলেননি। এই আত্মারা বদ-আত্মা। এদের কামনা-বাসনা ড়ুয়ার্সের জঙ্গল এবং মানুষকে নিয়েই জীবিত অবস্থায় ছিল। মারা যাওয়ার পর তাই এরা এখানেই থেকে গেছে। তা ছাড়া দীর্ঘকাল দেশছাড়া হওয়ায় দেশের জন্যে কোনও আকর্ষণ এদের মধ্যে নেই। মেজর বললেন।

অর্জুন উঠে দাঁড়াল, আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না। আপনি এর আগে যেসব অভিযানে গিয়েছেন তার প্রত্যেকটাই বিজ্ঞান-নির্ভর ছিল। কিন্তু এই আত্মা খোঁজার ব্যাপারটা যে-কোনও সুস্থ লোকের কাছেই হাস্যকর শোনাবে।

তুমি ভুল করছ। গোরান যদি শুধু আত্মা খুঁজতে এখানে আসতে চাইত তা হলে আমি ওর সঙ্গী হতাম না। ও এসেছে ড্রাকুলার সন্ধানে। এখানেই আমার ইন্টারেস্ট।

ড্রাকুলা? ওটা তো একটা কাউন্টকে নিয়ে বানানো গল্প।

ঠিক। কিন্তু কাগজে পড়েছি এদেশে এখন ডাইনি সন্দেহে মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়। আমি তাই দেখতে চাই আসল ব্যাপারটা কী। আর এই কাজে তোমার সাহায্য চাই। মেজর আবার গলায় তরল পদার্থ ঢাললেন।

কীরকম?

এই অভিযানে তুমি আমাদের সঙ্গী হবে।

আপনার বন্ধু কি সেটা চাইবেন?

হ্যাঁ। সেইজন্যে আমরা প্রথমে জলপাইগুড়িতে এলাম।

কিন্তু আপনি বুঝতেই পারছেন আমি ব্যাপারটাকে আজগুবি ভাবছি। তাই প্রতিটি স্তরে আমি প্রমাণ খুঁজব। এটা কি ভাল লাগবে? মানুষ যখন ভক্তিতে নম্র হয় তখন সে অন্ধ হয়ে যায়। সে-সময় কারও সন্দেহ সে সহ্য করতে পারে না।

তোমার আর গোরানের মাঝখানে তো আমি আছি।

 

কিছুক্ষণ বাদে অর্জুন বেরিয়ে এল মেজরের ঘর থেকে। এখন সন্ধে শেষ হতে চলেছে। গোরান স্যুলম্যানের ঘরের দরজা বন্ধ। একটা সাপের মাথা কেটে ঘরে নিয়ে এসে ভদ্রলোক তখন থেকে দরজা বন্ধ করে কী করছেন তা তিনিই জানেন। হয়তো ঘনিষ্ঠ আত্মাদের ডেকে কথাবার্তা বলছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেবযান বইটা ইংরেজিতে কেউ অনুবাদ করেছে কিনা অর্জুনের জানা নেই, থাকলে ওঁকে পড়তে দেওয়া যেত।

সার্কিট হাউসের সামনে বাইকে উঠতেই অর্জুন শুনতে পেল, কী খবর? এখানে?

সে পেছন ফিরে তাকাতেই অবনীবাবুকে দেখতে পেল। জলপাইগুড়ি থানার ও.সি অবনীবাবু মানুষটি ভাল। অর্জুনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। অর্জুন বাইক থেকে নেমে বলল, বাইরে থেকে দুজন অতিথি এসেছেন, দেখা করতে এসেছিলাম। আপনি?

আরে বলবেন না। ওপরওয়ালা এসেছেন। ডেকে এনে ধমকালেন। কেন এটা হচ্ছে, কেন ওটা হচ্ছে। অবনীবাবুকে একটু বিরক্ত দেখাল।

অর্জুনের মনে পড়ে গেল, তিস্তার ওপাশে হাইওয়েতে নাকি সন্ধের পরে ছিনতাই হচ্ছে? গাড়ি থামিয়ে করছে?

আরে! এই খবর আপনি পেয়ে গেছেন? হ্যাঁ। পরপর কয়েকটা হয়েছে। গাড়িগুলো থেমে যাচ্ছে আর মুখোশপরা ছিনতাইবাজরা যা পাচ্ছে কেড়ে নিচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত খুনখারাপি করেনি।

সেটা কেউ বাধা দেয়নি বলে করেনি। কারা করছে?

কোনও ক্লু পাইনি। পরিচিত ছিনতাইবাজরা ইংরেজিতে কথা বলতে পারে, এরা নাকি বলে। দুটো গাড়ির ড্রাইভার একই স্টেটমেন্ট দিয়েছে।

আচ্ছা, ওই সময় হাইওয়ে ফাঁকা থাকার কথা। গাড়িগুলো যাওয়া-আসা করে বেশ দ্রুতগতিতে। এরা ওদের থামায় কী করে?

এটাই মিস্ট্রি। ঠিক ছিনতাইবাজদের সামনে এসে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে যায়। ভাবছি আজ একটু টহলে বের হব।

অর্জুন হাসল, আপনার গাড়ি দেখতে পেলে ওরা ভদ্রলোক হয়ে যাবে। ওরা কি কোনও একটা বিশেষ জায়গায় রোজ ছিনতাই করছে?

না। জায়গা পালটাচ্ছে। তবে তিস্তা ব্রিজের এক মাইলের মধ্যেই ঘটনাগুলো ঘটেছে। ঠিকই বলেছেন, আমার গাড়ি না নিয়ে প্রাইভেট গাড়িতে যাওয়াই ভাল। আসবেন নাকি আমার সঙ্গে?

কোনও কাজ যখন নেই, তখন যাওয়া যেতে পারে। অর্জুন বলল।

অবনীবাবু ঘড়ি দেখলেন, তা হলে মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে থানায় চলে আসুন। অবনীবাবু তাঁর জিপের দিকে এগোলেন।

বাড়ি ফিরে এ পি সাহেবকে ফোন করল অর্জুন। তিনি মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ফিরেছেন। অর্জুনের গলা পেয়েই বললেন, সন্তু আমাকে বাগানে ফোন করেছিল। তুমি বলেছ কোনও বড় খারাপ কাজ করার আগে ওকে এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু আজ অফিসে ও তোমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তাতে আমি খুব অপমানিত বোধ করছি। তুমি কি নিশ্চিত ও খারাপ কাজ করছে?

হ্যাঁ।

কী কাজ?

সেটা জানতে হলে ওকে হাতেনাতে ধরতে হয়। আর ধরা পড়লে আইন তার মতো কাজ করবে। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।

নিশ্চয়ই। ও যদি কোনও অন্যায় করে থাকে তা হলে আমি চাইব শাস্তি হোক। আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় হলেও আমি ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করব না। আমি চেয়েছিলাম তেমন কিছু করার আগে ওকে সাবধান করে দিতে। ও যদি ইতিমধ্যেই অপরাধী হয়ে থাকে তা হলে আইন ওর বিচার করুক। থ্যাঙ্কু অর্জুন। এ পি সাহেব টেলিফোন রেখে দিলেন। মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল অর্জুনের।

 

তিস্তা ব্রিজের ওপর গাড়িটা থামিয়ে অবনীবাবু ড্রাইভারকে পাঠালেন টোল দিতে। এখনও এই ব্রিজ পারাপার করতে টাকা দিতে হয়। সরকারি গাড়ি, বিশেষ করে গাড়ি বদি পুলিশের হয় তা হলে তাদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। কিন্তু অবনীবাবু যেন ইচ্ছে করেই জানাতে চাইলেন তাঁরা সরকারি মানুষ নন! অন্ধকার গাড়ির ভেতর বসে থাকায় টোল যারা সংগ্রহ করছে তারা তাঁকে চিনতে পারল না।

মোড় পর্যন্ত চলে এসে অবনীবাবু বললেন, আমি কিন্তু আমার এলাকার বাইরে চলে এসেছি। এবার ফিরতে হয়।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, শেষ ছিনতাই কোথায় হয়েছিল?

গাড়িটা আবার ব্রিজের দিকে ফিরে যাচ্ছিল। রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে পৌঁছে অবনীবাবু বললেন, এখানে।

গাড়ি থামল না। অর্জুন দেখল জায়গাটা বেশ অন্ধকার। দুপাশে লুকিয়ে থাকার মতো চমৎকার পাথরের আড়াল রয়েছে। অর্থাৎ ছিনতাই যারা করছে তারা প্রথমে লুকিয়ে থাকার আড়াল খুঁজবে। একই জায়গায় পরপর দুদিন তারা নিশ্চয়ই ছিনতাই করবে না। করাটা স্বাভাবিক নয়।

খানিকটা যাওয়ার পর রাস্তার দুপাশে গাছ চোখে পড়ল। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় বোঝা গেল ওখানে লুকিয়ে থাকলে রাস্তা থেকে দেখা সম্ভব নয়। দূরে ব্রিজের আলো দেখা যাওয়ামাত্র অর্জুন গাড়িটাকে থামাতে বলল। ডানদিকে একটা কাঁচা রাস্তা নেমে গেছে। সে অবনীবাবুকে বলল, গাড়িটাকে নীচে নিয়ে গিয়ে একটু অপেক্ষা করা যায় না?

কেন? ওহো, আপনি ভাবছেন ঠিক এখানেই ছিনতাই করবে ওরা। কী মশাই, জ্যোতিষী হলেন কবে থেকে? অবনীবাবু হাসলেন।

ছিনতাই করে ওরা চলে যায় কীসে?

কোনও ড্রাইভার বা গাড়ির প্যাসেঞ্জার সেটা দেখেনি। ওরা অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে তারা।

ওরা নিশ্চয়ই হেঁটে আসবে না। আমরা এই আড়ালে থেকে লক্ষ করতে পারি কোনও সন্দেহজনক গাড়ি যাচ্ছে কি না!

তা পারি।

অবনীবাবুর নির্দেশে গাড়ি নীচে নামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখা হল। এই গাড়িতে এ দুজন ছাড়া আরও তিনজন পুলিশ রয়েছে। এদের সঙ্গে কী অস্ত্র আছে অর্জুন চান না। ছিনতাই যারা করছে তারা নিশ্চয়ই খালি হাতে আসে না।

গাড়ি থেকে নেমে ওরা এমন একটা আড়ালে দাঁড়াল, যেখানে রাস্তায় ছুটে যাওয়া গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়ছে না। এখন রাত দশটা। হাইওয়েতে গাড়ি চলাচল কমে এসেছে। যারা যাচ্ছে তাদের গতি স্বাভাবিকের থেকে বেশি।  আজ রাত্রে যে ওরা আসবেই তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। এই সময় দূরে মোটরবাইকের আওয়াজ পাওয়া গেল।