০৫. ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মাধব

ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মাধব। ঠিক গুরুং-এর দোকানের সামনেই সে ভ্যানটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এতক্ষণ আটকে থাকায় ভ্যানের যাত্রীরা এবার চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছে। জিপটাকে পাশে আনতেই মাধব এগিয়ে এল, আধ কিলোমিটার নেমে বাঁ দিকের কাঁচা রাস্তা ধরে গেলে সিংলা পড়বে! এবার আমি যাই দাদা?

ঠিক আছে। খামটা ছেড়া দেখে কিছু বলেনি?

আমার হাত থেকে নিয়ে টেবিলে রেখে দিল বুড়ো। ভাল করে দেখল না পর্যন্ত। চলিঃ দ্রুত ভ্যানে উঠে নেমে গেল মাধব।

ঘড়ি দেখল অর্জুন। আড়াইটে বেজে গেছে। এইসব পাহাড়ে দিন শেষ হয় খুব তাড়াতাড়ি। সে ড্রাইভারকে একটু জোরে চালাতে অনুরোধ করল। পুলিশের ড্রাইভারকে এরকম অনুরোধ করলে কী হয় তা হাড়ে হাড়ে টের পেল অর্জুন। ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটছিল, এই গাছটা সামনে চলে আসছে, এই সরে যাচ্ছে। আধ কিলোমিটার পথ ফুড়ুত করে ফুরিয়ে যেতেই অর্জুন চিৎকার করে বলল, এবার বাঁ দিকের রাস্তা ধরে আস্তে চলুন।

মিস্টার থাপা বললেন, জেরক্সের পেছনে ওই লেখাটা তো অন্য কোনও কারণেও লেখা হতে পারে। তাই না?

ঠিকই। কিন্তু আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই, ওরা কোথায় গেল তাও জানতে পারছি না। সিংলা বলে যখন একটা জায়গা আছে তখন তার বাংলোটা দেখে আসা যাক।

এই সময় পেছনে বসা একটি সেপাই জানাল, খানিকটা দূরে আর-একটা গাড়ি আসছে। এই রাস্তা পাকা নয়। বেশ সরু এবং পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলেছে। দুটো বড় গাড়ি পাশাপাশি হলে অনেক জায়গায় আটকে যাবে। অর্জুন তেমন একটা জায়গায় পৌঁছে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে যান। পেছনের গাড়ির লোকদের একটু দেখুন মিস্টার থাপা।

মিনিটখানেকের মধ্যে পেছন থেকে হর্নের আওয়াজ ভেসে এল। খুব তাড়া থাকলে লোকে ওইভাবে হর্ন বাজায়।

অর্জুন বলল, আমি নামব না। আপনারাই দেখুন।

কিন্তু তার আগেই পেছনের গাড়ির আরোহী নেমে এসে বেশ কর্কশ গলায় গাড়ি সরাতে বলছে। একজন সেপাই জবাব দিল, পুলিশের গাড়ি দেখছেন না?

পুলিশের গাড়ি বলে কিনে নিয়েছ নাকি? এটা পাহাড়, শিলিগুড়ি নয়। এই জিপ তো শিলিগুড়ির।

মিস্টার থাপা নেমে দাঁড়ালেন। হ্যাঁ শিলিগুড়ির।

ও, আপনি! এখানে আপনাকে দেখতে পাব ভাবিনি।

আপনি এখানে কী করছেন?

এই একটু পারিবারিক কাজে যাচ্ছিলাম।

অর্জুন বুঝতে পারল গলাটা মানাভাইয়ের। জিপের সামনের সিটে বসে থাকায় সে লোকটাকে দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু লোকটা এখানে এসেছে যখন, তখন নিশ্চয়ই দেরি করে এসেছে। জেরক্সের পেছনে লেখা ছিল আড়াইটে।

সার। গাড়িটা একটু সরালে আমরা বেরিয়ে যেতে পারি।

আপনি তো সিংলা বাংলোয় যাচ্ছেন?

না, মানে, আপনি..!

আপনার কোনও চিন্তা নেই, আমরাও সেখানে যাচ্ছি।

না, না, আমি এক রিলেটিভের বাড়িতে যাচ্ছি।

ইতিমধ্যে ড্রাইভার দু-তিনবার ইচ্ছে করে ফস স্টার্ট দিচ্ছিল। শব্দ করে থেমে যাচ্ছিল এঞ্জিন। এবার অর্জুনের ইঙ্গিতে এঞ্জিন চালু করল। মিস্টার থাপা বললেন, ওই যে, গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। এদিকটায় আমি কখনও আসিনি। আপনি আসুন না আমার সঙ্গে! আপনার রিলেটিভের বাড়িতে নামিয়ে দেব। আপনার ড্রাইভারকে বলুন ফলো করতে। আসুন।

জিপের পাশে পৌঁছে অর্জুনের দিকে অর্থবহ হাসি ছুড়ে মিস্টার থাপা ডাকলেন, জলদি।এবার অর্জুন মানাভাইকে দেখতে পেল। লোকটা যদি ভূত দেখত তা হলেও এত অবাক হত না। কিন্তু দ্রুত নিজেকে সামলে নিল সে, অর্জুনের পাশে উঠে বসল গম্ভীর মুখে। এই জিপে ড্রাইভারের পাশে দুজন স্বাভাবিকভাবে বসতে পারে, তিনজন হওয়ায় মিস্টার থাপাকে একটু বেকায়দায় বসতে হয়েছিল। জিপ চলতে শুরু করলে মিস্টার থাপা বললেন, সিংলা বাংলোটা কোথায় বলে দেবেন।

অর্জুন শুনল, এই লোকটা যে পুলিশের চর তা যদি আগে বুঝতাম! শালা ভাই একে চেনে।ওর হচ্ছে। এরা সিংলা বাংলার খবর পেল কী করে? ওখানে

নিশ্চয়ই বস্ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। গাড়িটা যদি রাস্তায় খারাপ না হত তা হলে অনেক আগে পৌঁছে যেতাম।

অর্জুন হাসল শব্দ করে।

লোকটা রাগী চোখে তাকাল। অর্জুন শুনল, এ ব্যাটা হাসছে কেন?

অর্জুন বলল, গাড়ির কথা কেউ বলতে পারে। কিন্তু কখন খারাপ হবে তা কেউ জানে না। আড়াইটের মধ্যে পৌঁছতে হলে আপনার উচিত ছিল অনেক আগে রওনা হওয়া। তাই না মানাভাই।

আপনি কে বলুন তো?

থটরিডার। আপনি যা ভাববেন আমি তা বলে দেব।

আমি এখন থেকে কিছুই ভাবব না। অর্জুন শুনতে পেল।

সে হাসল, তা কি হয়? আজ সকালে ট্রেনে যে ডাকাতিটা হল তা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না? হারাধন যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সেটা নিয়ে ভাববেন না?

হতভম্ব হয়ে গেল মানাভাই। অর্জুন শুনল, এ ব্যাটা সব জেনে গেল কী করে?

জানতে ইচ্ছে করলে জানা যায়। অর্জুন বলতেই মানাভাই চিৎকার করে উঠল, আমি নেমে যাব। এই লোকটা যা ইচ্ছে আমার নামে বলছে।

মনে মনে আপনি ঠিক উলটো ভাবছেন।

মানাভাই মাথা নামাতেই অর্জুন মিস্টার থাপাকে বলল, ও ভাবছে কখনওই আমাদের সিংলা বাংলোতে নিয়ে যাবে না।

আমি মরে যাব, আমাকে মেরে ফেলবে। আর্তনাদ করে উঠল লোকটা।

হঠাৎ মিস্টার থাপার গলার স্বর বদলে গেল, না নিয়ে গেলে আমি আপনাকে মেরে ফেলব। অপরাধীদের মারতে আমার খুব ভাল লাগে।

সার, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি শিলিগুড়িতে ফিরে যাচ্ছি।

অর্জুন মানাভাইয়ের হাঁটুতে হাত রাখল, ওই বেঁটে লোকটার নাম কী?

কোন বেঁটে লোক?

যাকে রিপোর্ট করতে আজ আপনি এসেছেন।

আমি নাম জানি না। সবাই চিফ বলে, আমিও তাই বলি।

মিস্টার থাপা, এই লোকটা মিথ্যে কথা বলছে।

ঠিক আছে। ওঁর নাম এস কে গুরুং।

দোকানদার গুরুংয়ের দাদা?

না। উনি নেপাল থেকে এসেছেন।

আপনার সঙ্গে আলাপ হল কী করে?

আমি কাজ খুঁজছিলাম, উনি কাজ দিয়েছেন।

এ-পর্যন্ত কটা ট্রেনডাকাতি করেছেন?

আমি করিনি।

যারা করেছে তাদের রিক্রুট তো আপনি করেছেন।

অর্জুন শুনল, আর বলব না। অনেক বলে ফেলেছি।

এই পথে মানুষ ছিল না এতক্ষণ। এবার এক বৃদ্ধকে দেখা গেল। মিস্টার থাপা জিপ থামিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সিংলা কতদূরে?

আপনারা সিংলা পেরিয়ে এসেছেন।

আচমকা খেপে গেলেন মিস্টার থাপা। জিপ থেকে মানাভাইকে প্রচণ্ড জোরে ঘুসি মারলেন; মানাভাই মাটিতে পড়ে গিয়ে আর্তনাদ করতেই পেছনে আসা ভ্যানটা মুখ ঘোরাতে চেষ্টা করল। মানাভাই চিৎকার করে ড্রাইভারকে নিষেধ করতে সে থেমে গেল। মাটি থেকে উঠে মানাভাই বলল, ঠিক আছে, যা বলবেন তাই করব।

অর্জুন গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। ভ্যানের ড্রাইভারকে জিপে নিয়ে আসা হল। মানাভাইকে নিয়ে ওরা ভ্যানে উঠল। মিস্টার থাপা ড্রাইভিং সিটে বসলেন। দুটো গাড়ি মুখ ঘোরাল। জিপের ড্রাইভারকে বলা হল ইশারা করা মাত্র থেমে যেতে।

মিনিট দশেক যাওয়ার পর মানাভাই বলল, এই জায়গার নাম সিংলা।

অর্জুন বলল, এবার আপনি সত্যি কথা বলেছেন।

কী করে বুঝলেন?

কারণ উলটোপালটা ভাবেননি। বাংলোটা কোথায়?

ডান দিকের রাস্তায়। বাঁক নিলেই দেখা যাবে।

গাড়ি থামল। অর্জুন নেমে জিপের কাছে গেল। ভ্যানের ড্রাইভার গম্ভীর মুখে। বসে ছিল। অর্জুন তাকে বলল, তুমি ওই ভ্যান ভাড়া খাটাও।

হ্যাঁ। এসব ঝামেলা হবে জানলে কে আসত।

মাধবকে চেনো?

মাধব? আমার বন্ধু।

বাঃ। শোনো, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, তা হলে জিপ থেকে নেমো না। তারপর সেপাইদের দিকে তাকিয়ে অর্জুন বলল, আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন। পনেরো মিনিটের মধ্যে না ফিরলে বাংলোর ভেতর যাবেন। সামনের বাঁক ঘুরলেই বাংলো।

মিস্টার থাপা ধীরে ধীরে গাড়িটাকে নীচে নামিয়ে আনলেন। তাঁর পাশের সিটে বসে আছে মানাভাই, পেছনের সিটে যতটা সম্ভব নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল অর্জুন। বাঁক ঘুরতেই বাংলোটাকে দেখা গেল। কাঠের বাড়ি। দোতলা। সামনে লন। দোতলার বারান্দায় দুজন লোক বসে আছে। তাদের একজন চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল, এতক্ষণে আসার সময় হল? চিফ তোমাকে কখন রিপোর্ট করতে বলেছিল?

মানাভাই জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার কিছু করার ছিল না।

অর্জুন বুঝল, দোতলার লোকটা গুরুং। কিন্তু সে যদি ড্রাইভারকে দেখতে পায় তা হলে স্পষ্ট চিনে ফেলবে। ভাগ্যিস ভ্যানের ড্রাইভারের দিকটা বাংলোর উলটো দিকে পড়েছে। অর্জুন চাপা গলায় বলল, আপনি নামবেন না। বলুন পায়ে চোট পেয়েছেন, হাঁটতে পারছেন না।

কী হল? নামছ না কেন? গুরুং চিৎকার করল ওপর থেকে।

হাঁটতে পারছি না। পায়ে চোট।

গুরুং মুখ ঘুরিয়ে কিছু বলল। এবার বারান্দায় রেলিং-এর ঠিক ওপরে দ্বিতীয় লোকটির মুখ দেখা গেল। সেই বেঁটে লোকটা। কোনও মানুষের মুখ যে এত কদর্য হতে পারে, তা ভাবা যায় না।

কী করে চোট পেলে? গুরুং জিজ্ঞেস করল।

বললাম না গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল অ্যাকসিডেন্টে, তখনই চোট পাই। ডাক্তার পর্যন্ত দেখাতে পারিনি। মানাভাই জবাব দিল।

চোট পেলে না নামাই ভাল। সেটা আরও খারাপ হবে। গমগম করল কণ্ঠস্বর। ওই বেঁটে মানুষের শরীর থেকে এত জোরে শব্দ বেরুতে পারে না শুনলে বিশ্বাস করা যাবে না। তারপর ধীরে ধীরে সিঁড়ির ওপর এসে দাঁড়াল লোকটা। বেঁটে, গালি দেওয়া প্যান্ট, মাথায় টুপি এবং মুখে চুরুট। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। লোকটা বলল, রিপোর্ট?

আজ আমাদের কেউ ধরা পড়েনি। তবে পাঁচজন প্যাসেঞ্জার উল্ডেড হয়েছে। ছেলেরা বাধ্য হয়েছে ওটা করতে।

ভুল। উড়ে নয়। চারজন মারা গেছে।

আমি খবর পাইনি সার।

তুমি আজকাল গাফিলতি করছ মানাভাই। আমি এখানে বসে যে খবর পাই, তুমি শিলিগুড়িতে থেকে তা পাও না। কত টাকার জিনিস?

এখনও কাউন্ট করিনি। আনুয়াবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।

এটাও ঠিক নয়। হিসেব তোমার রাখা দরকার। আজ মাত্র পঁচিশ হাজার এনেছে ছেলেরা। এত কম টাকার জন্যে চার্জ করা বোকামি। মালদা থেকে যে তোমাকে খবরটা দিয়েছে তাকে আর দরকার নেই।

ঠিক আছে।

গাড়িটা কার?

ভাড়া গাড়ি।

ড্রাইভার?

বিশ্বাসী।

এখন থেকে নিজে গাড়ি চালাবে। সাক্ষী সঙ্গে রেখে ঘোরা আমি পছন্দ করি না। আরও দুপা নেমে এল বেঁটে লোকটা, গুরুং, ওদের আনো।

 

একটু পরেই নীচের ঘরের দরজা খুলে ছজন ছেলেকে বাইরে বের করে আনা হল। ওদের সঙ্গে ছজন লবান মানুষ ছিল। দুজনের হাত পেছন দিক করে বাঁধা।

ওদের আলাদা করে দাও।

গুরুং নেমে এসেছিল নীচে। হারাধন আর বিশ্বনাথকে দল থেকে সরিয়ে একটা বিশাল গর্তের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। যে মাটি খুঁড়ে গর্ত করা হয়েছে সেই মাটি পাশেই স্থূপ করা। পেছনে হাত থাকায় ওদের অসহায় দেখাচ্ছিল।

এই দুটো ছেলেকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছিল। কেন করেছিল? না, একজন যে ডাকাতি করেছে সেই প্রমাণ ট্রেনে রেখে এসেছিল। তার সূত্র ধরে ওর বাড়িতে সেই রাত্রে দুজন হানা দিয়েছিল, যারা পুলিশ নয়। খবরটা যদিও সে আমাদের কাছে ঠিক পৌঁছে দিয়েছিল কিন্তু লোক দুজনকে ওদের ঠিকানায় পাওয়া যায়নি। অতএব সাক্ষী থেকেই গেল। পুলিশ ওকে পরদিন ধরল। ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় দ্বিতীয়জনকেও তুলে নিল। কিন্তু পুলিশ কী করল? এই দ্বিতীয়জনকে মারল। বরং দুজনকেই আদর করে সেদিনই জামিন দিয়ে দিল। কেন দিল? যেখানে পুলিশ ডাকাতের সন্ধানে মরিয়া সেখানে তাদের দুজনকে হাতে পেয়েও কোন কারণে ছেড়ে দিতে পারে? আমি এই প্রশ্নের জবাব ওই ছজনের কাছে জানতে চাইছি।

বিশ্বনাথ মাথা নাড়ল, আমি কিছু বলিনি। জলপাইগুড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর ওকেই পুলিশ বারংবার জেরা করেছে।

তাই। কিন্তু তোমাকে নিয়ে যাওয়ার সময় ওকে ধরল কী করে?

ওদের সঙ্গে একটা লোক ছিল, যে মনের কথা বুঝতে পারে।

অ্যাঁ? হা হা করে হাসল বেটে লোকটা। হাসি যেন তার থামতেই চায় না।

গুরুং শুনেছ? কী হে, তুমিও একই কথা বলবে নাকি?

হারাধন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। বুঝতে পারে।

অসম্ভব! চিৎকার করে উঠল লোকটা, একমাত্র মূর্খরাই এমন কথা বলতে পারে। এই বিজ্ঞানের যুগে একথা শোনাও অন্যায়। নিজেদের দোষ ঢাকতে তোমরা গল্প শোনাচ্ছ। বলতে বলতে লোকটা নেমে এল গাড়ির পাশে।

হারাধন চিৎকার করল, আমি মিথ্যে কথা বলছি না।

হঠাৎ অর্জুনের কানে এল, এই দুটোকে এবার মাটির তলায় পাঠানো যাক। বাক চারজন দৃশ্যটা দেখে সবাইকে বলবে বেইমানির শাস্তি কী!

বিশ্বনাথ চেঁচাল, মানাভাই, ওঁকে একটু বলুন, চুপ করে থাকবেন না।

অর্জুন শুনল মানাভাইয়ের গলা, পাগল।

বেঁটে লোকটি দুবার গালিস ধরে টানল। ফত ফত করে শব্দ বাজল। অর্জুন স্পষ্ট শুনতে পেল, মানাভাই বাঁচাবে? ওরও তো সময় হয়ে এসেছে। তারপরেই চিৎকার শুনতে পেল, গুরুং, রেডি ফর অ্যাকশন।

সঙ্গে সঙ্গে পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল অর্জুন! সে বসে ছিল দুটো সিটের মাঝখানে পা রাখার জায়গায়। একেবারে গাড়ির মধ্যে ঝুঁকে না দেখলে তাকে কেউ দেখতে পাবে না। তার শরীরের পাশেই ভ্যানের দরজা, দরজার ওপাশে বেঁটে লোকটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। অর্জুন শুনতে পেল বেঁটে লোকটা ভাবছে, ওদের জ্যান্ত কবর দেওয়াই ভাল।

সে সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, জ্যান্ত কবর দেওয়া ভাল কেন?

বেঁটে লোকটা আপনমনে জবাব দিল, ভাল, কারণ এতে কোনও খরচ নেই।

গুরুংয়ের গলা কানে এল, আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন?

বেঁটে সজাগ হল, মানে?

আপনি বললেন এতে কোনও খরচ নেই। কীসের খরচ বুঝলাম না?

তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছ জ্যান্ত কবর দেওয়া ভাল কেন?

না তো? আমি এইমাত্র এখানে এলাম।

তা হলে নিশ্চয়ই মানা জিজ্ঞেস করেছে।

সঙ্গে সঙ্গে মানা প্রতিবাদ করল, আমি? আমি জ্যান্ত কবরের কথা জানব কী করে যে জিজ্ঞেস করব?

তাই তো! এটা কীরকম ব্যাপার হল?

আপনি কি জ্যান্ত কবর দেওয়ার কথা ভেবেছেন?

অ্যাঁ? হ্যাঁ। বোধ হয়।

তা হলে সেই থটরিডার এখানেও এসে গিয়েছে। মানাভাই বলল।

থটরিডার? বেঁটে লোকটার গলা ফাঁসফেসে শোনাল।

ওই যে যার কথা ওই ছেলেগুলো এতক্ষণ বলছিল।

বাজে কথা। মনের ভুল। ওদের গর্তে ফেলে দাও। তোমরা যারা দৃশ্যটা দেখছ, তারা মনে রেখো, তোমাদের দেখানোর জন্যে এইখানে নিয়ে আসা হয়েছে। বেইমানির শাস্তি কী তা তোমরা নিজের চোখে দ্যাখো। এর পরে ফিরে গিয়ে তোমাদের অন্য সহকর্মীদের এই গল্প শোনাবে। তোমরা যতদিন বিশ্বস্ত থাকবে ততদিন তোমাদের সমস্ত দায়িত্ব আমার। কিন্তু বেইমানি করলেই আমার চেয়ে নির্দয় পৃথিবীতে আর কাউকে পাবে না। তবে আমি এদের সুযোগ দিতে চাই। গুলি করে মেরে ফেলে না দিয়ে জ্যান্ত গর্তে ফেলব ওদের। ফেলে মাটি চাপা দিয়ে দেব। ওরা সুযোগ পাবে ওপরে উঠে আসার। যে নরম মাটি মাথার ওপর থাকবে তা সরিয়ে উঠে আসতে পারলেই বেঁচে যাবে। গালিস টানল লোকটা, শুরুং।

গুরুং ইশারা করতেই বলবান লোকদুটো হারাধন এবং বিশ্বনাথকে গর্তে ফেলার জন্যে এগিয়ে গেল।

ইতিমধ্যে পনেরো মিনিট সময় চলে গেছে। জিপের শব্দে অর্জুন বুঝল সেপাইরা চলে এসেছে। সে ঝট করে ভ্যানের দরজা খুলতেই বেঁটে লোকটা খুব অবাক হয়ে তাকাল। অর্জুন তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ভ্যানের ভেতর টেনে আনার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গে সে মিস্টার থাপার চিৎকার শুনতে পেল। ড্রাইভারের সিট থেকে নেমে তিনি সতর্ক করছেন, যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, সেখানেই থাকো, নড়বার চেষ্টা করলেই গুলি করব।

ওই বেঁটে মানুষটার শরীরে এত শক্তি যে, অর্জুন ওকে কিছুতেই কাবু করতে পারছিল না। লোকটা তাকে খামচাচ্ছিল। পা ছুড়ছিল শূন্যে, আবার মাথা দিয়ে ওর পেটে আঘাত করছিল। সেপাইরা ছুটে এল জিপ থেকে। ওরা বেঁটে লোকটাকে টেনে সরাতে যেতেই ওর হাত এসে পড়ল অর্জুনের বুকে। সঙ্গে সঙ্গে গলায় এত জোরে টান লাগল যে, শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। অর্জুন মুখ ফেরাতেই শব্দ হল এবং ঝুরঝুর করে রুদ্রাক্ষের ফলগুলো ছড়িয়ে পড়তে লাগল মাটিতে।

ততক্ষণে লোকটাকে কজা করে ফেলেছে সেপাইরা। অর্জুন নিচু হয়ে রুদ্রাক্ষ কুড়নোর চেষ্টা করল। ওদিকে মিস্টার থাপা তখন গুরুংকে আটক করেছেন। কিন্তু বাকি চারটে ছেলে প্রাণপণে দৌড়তে শুরু করেছে। সেপাইরা তাদের ধরার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল।

পরিস্থিতি আয়ত্তে আসার পর মিস্টার থাপা অর্জুনের দিকে এগিয়ে আসছিলেন। অর্জুন তখনও উবু হয়ে রুদ্রাক্ষ খুঁজে চলেছে। গোটা দশেক পাওয়া গিয়েছে এতক্ষণে। সে চিৎকার করল, এগোবেন না। পায়ের তলায় পড়লে নষ্ট হয়ে যাবে ওগুলো।

কী খুঁজছেন?

রুদ্রাক্ষ। এক মুঠোর প্রচুর দাম।

মিস্টার থাপার সামনে একটা পড়ে ছিল। সেটা তুলে তিনি অর্জুনের দিকে ছুড়ে দিলেন। ওরা বাড়ির ভেতরটা সার্চ করতে গেল, এক এক করে প্রায় আঠারোটা রুদ্রাক্ষ পেল অর্জুন। এগুলো কী দিয়ে গাঁথা ছিল সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কোনও সুতো নেই বা চেন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। হারাধন আর বিশ্বনাথ কাছে এসে দাঁড়াতে সে চিৎকার করল,খোঁজো, ভাল করে খুঁজে দ্যাখো তো এরকম রুদ্রাক্ষ পাও কি না।

হারাধন কান্নাজড়ানো গলায় বলল, দাদা, আমাদের কী হবে?

অর্জুন মুখ ফিরিয়ে দেখল। হাত বাঁধা অবস্থাতেও বেঁটে লোকটা শরীর মুচড়ে যাচ্ছে সমানে। তার চোখ জ্বলছে।

অর্জুন বলল, কী আর হবে? আবার ডাকাতি করবে।

না দাদা। জীবনে আর ওসব কাজ করব না।

সেটা পুলিশ বুঝবে। এখন পারো যদি খুঁজে বের করো।

 

ইতিমধ্যে লোকাল থানায় খবর পাঠিয়েছেন মিস্টার থাপা। সেখান থেকে বিরাট পুলিশবাহিনী এসে গেছে। একই সঙ্গে তল্লাশি চালানো হচ্ছে গুরুংয়ের বিশাল বাড়িতে। গুরুংয়ের মানাভাই পুলিশকে জানিয়েছে এই লোকটি নেপাল থেকে এসেছিল তিন বছর আগে। একটু একটু করে লোকটা টাকা ছড়িয়ে ওদের দলে টেনে নিয়েছে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ারের রেলপথ ডাকাতির পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা বলে দল অর্গানাইজ করিয়েছে। স্থানীয় ছেলে নেওয়ার কারণ ওরা ওই রেলপথ থেকে চট করে যে যার বাড়িতে গিয়ে লুকোতে পারবে। এদিকে শিলিগুড়ি থেকে আলুয়াবাড়ি পর্যন্ত বাসরাস্তায় ডাকাতির পরিকল্পনা এই লোকেরই! ওরা এর নাম জানে না। ওকে চিফ বলে ডাকতে হয়।

তল্লাশি তখনও শেষ হয়নি, অর্জুন মিস্টার থাপাকে বলল, এদের নিয়ে কী করবেন? এদের তো কোর্ট জামিন দিয়েছে।

তা হলে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু যে চারজন পালিয়েছে তাদের ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। ডাকাতির কিছু জিনিস এখানে পেয়েছি। গুরুংয়ের বাড়িতে কী পাওয়া যাবে জানি না। মিস্টার থাপা বললেন।

আমি এবার ফিরে যেতে চাই।

বেশ তো। যদি সম্ভব হয় কাল একবার আমার থানায় আসবেন।

চেষ্টা করব।

মানাভাই পুলিশ হেফাজতে বলে ওর ভ্যানটাকে পাওয়া গেল। পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে বলে ড্রাইভার খুব কৃতজ্ঞ। অর্জুনের সঙ্গে হারাধন এবং বিশ্বনাথ ভ্যানে উঠে বসল।

কিছুক্ষণ যাওয়ার পর হঠাৎ বিশ্বনাথ জিজ্ঞেস করল, দাদা, কিছু বলছেন না যে।

কী ব্যাপারে!

এখনই আমি একটা উলটোপালটা ভেবে ফেলেছিলাম।

কী ভেবেছ?

বাঃ, আপনি তো সব বুঝতে পারেন। আমি ভাবছিলাম আপনি না থাকলে এতক্ষণে মাটির তলায় শুয়ে থাকতাম।

অর্জুন চোখ বন্ধ করল সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। রুদ্রাক্ষগুলো এখন তার পকেটে। বাড়ি গিয়ে মালা গেঁথে গলায় পরলে তবে হয়তো এটা সক্রিয় হবে। এই শয়তানটা যে মালা আঁকড়ে ধরবে তা সে বুঝতে পারেনি।

ভ্যানের ড্রাইভার জলপাইগুড়িতে যখন পৌঁছে দিল তখন রাত নটা। পথে মণ্ডলপাড়ায় বিশ্বনাথ এবং রেলগেটে হারাধন নেমে গিয়েছিল।

বাড়িতে না গিয়ে সোজা ঘোষপাড়া কালীবাড়ির কাছে দেবাশিসের সোনার দোকানে চলে এল অর্জুন। দেবাশিস তখন দোকান বন্ধ করছে। ওকে দেখে অবাক হল, কী ব্যাপার? অর্জুন, তুই?

যাঃ, দোকান বন্ধ হয়ে গেছে?

বল না, কী করতে হবে?

একটা মালা, রুদ্রাক্ষের, গেঁথে দিতে হবে।

দেবাশিস মজা পেল। আলোর সামনে রুদ্রাক্ষগুলো ধরে বলল, এগুলো কোথায় পেলে? একমুখী রুদ্রাক্ষ। বেশ দামি। কী দিয়ে গাঁথব?

কী দিয়ে গাঁথলে ভাল হয়?

এগুলো তো সুতোয় গাঁথা হয়। লাল সুতো দাঁড়া। অনেকক্ষণ ধরে একটা একটা করে রুদ্রাক্ষ বসিয়ে মালা গেঁথে ফেলল দেবাশিস। ওটা হাতে নিয়ে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কত দিতে হবে?

ধুস। এর জন্যে কেউ পয়সা নেয়! দামি জিনিস, যদি বিক্রি করার ইচ্ছে হয় তো বলবি। দেবাশিস বলল।

মালাটা গলায় পরতেই অর্জুন বুঝল একটু ছোট হয়ে গেছে। তার মানে কয়েকটা ফল সে খুঁজে পায়নি। সে চোখ বন্ধ করল কিন্তু কোনও শব্দ শুনতে পেল না। অথচ দেবাশিসের মনে কোনও ভাবনা আসছে না এমন তো হতে পারে না!

অর্জুন জিজ্ঞেস করল; তুমি কিছু ভাবছ?

দেবাশিস মাথা নাড়ল, ভাবছি এই জিনিস কোথায় পেলে?

অর্জুন বেরিয়ে এল। রাত সাড়ে নটায় জলপাইগুড়ির রাস্তা ফাঁকা। ওর বুকের মধ্যে তখন প্রচণ্ড চাপ। এ কী হল? মালাটা অকেজো হয়ে গেল? অমল সোমকে সে কী জবাব দেবে? আর অমল সোমকে না পেলে এই রহস্যের সমাধানও হবে না। কিন্তু তিনি কবে ফিরবেন তা তিনিই জানেন।

ততদিন এই মৃত রুদ্রাক্ষ আগলে বসে থাকতে হবে তাকে।