১৯. নিউ ইয়র্ক শহরের যেসব অঞ্চলে

নিউ ইয়র্ক শহরের যেসব অঞ্চলে দিনের বেলায় ফুটপাথে মানুষকে হাঁটতে দেখা যায়, তাদের মধ্যে কুইন্সের নাম করা যায়। ম্যানহাটান যেমন সকাল নটা থেকে বিকেল ছটা পর্যন্ত কলকাতার এসপ্ল্যানেড হয়ে থাকে এবং তার আগে ও পরে শ্মশানের শূন্যতা, কুইন্স তেমন নয়। তবু রাত আটটার পর লোকজন গোনা যায়। আর অর্জুনরা যখন সেখানে পৌঁছল, তখন হুসহাস গাড়ির ছুটে যাওয়া ছাড়া কোনও প্রাণের চিহ্ন নেই।

নিউ ইয়র্কের রাতের রাস্তায় হাঁটলেই ছিনতাই হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। স্প্যাস্কি, সংকর রক্তের মানুষ এবং অবশ্য কালোদের রাজত্ব তখন। পুলিশের গাড়ি দেখলেই তারা গলির মধ্যে গা ঢাকা দেয়, নইলে ফুটপাথ ওদের দখলে। মারিওর সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে অর্জুন দেখল, দুটো বিশাল চেহারার কালো লোক সামনের লাইট পোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের পাশ দিয়ে তাদের যেতে হবে। লোক দুটোর উচ্চতা এবং স্বাস্থ্যের কাছে টাইসন, প্যাটার্সন ইত্যাদি বিখ্যাত বক্সারদের শিশু বলে মনে হবে।

অর্জুন চাপা গলায় মারিওকে কথাটা বলতেই সে মাথা নাড়ল। তারপর নিচু গলায় বলল, জাস্ট ফলো মি।

ওদের এগিয়ে আসতে দেখে লোক দুটো ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। মারিও একটু এগিয়ে গিয়ে দুজনের সামনে হাত পাতল, গিম মি এ ডলার মিস্টার, নো ফুড, ভেরি হাঙরি। গিম মি এ ডলার।

অর্জুন হতভম্ব হয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে দুবার মাথা নেড়ে মারিওর বক্তব্য সমর্থন করার চেষ্টা করল। লোকদুটো জুলজুল করে মারিওকে দেখল, তারপর অর্জুনকে। শেষ পর্যন্ত দুজনেই একসঙ্গে হো হো করে হাসতে লাগল। ওই বিশাল চেহারার দুটো মানুষ যে কী মজা পেয়েছে বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু হাসতে-হাসতে একজন অন্যজনের হাতে চাঁটি মারছে, ফুটবলে গোল করে যেভাবে খেলোয়াড়রা মেরে থাকে। তারপর ওরা রাস্তা পেরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

মারিও হাসল, দেখলে তো। ওরা নিজেদের আমাদের চেয়ে বড়লোক ভাবল।

অর্জুন মারিওর বুদ্ধির প্রশংসা করল।

বাকি পথটুকু আসতে কোনও অসুবিধে হল না। মেজরের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে অর্জুন বলল, আমি একশো ভাগ নিশ্চিত ওরা ওখানে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। বাড়িটার সামনে যেতে পারলে ভাল হত।

মারিও মাথা নাড়ল, তাতে ওদের চোখে পড়ে যাবে তুমি। দাঁড়াও। তখন ফুটপাথের লাগোয়া দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু একটা নিয়ন সাইন জ্বলে-নিভে জানাচ্ছিল সেখানে এখনও প্রাণ আছে। মারিও অর্জুনকে নিয়ে সেখানে ঢুকল। দোকানটা একটা ফ্যামিলি পাব। অর্থাৎ এ-পাড়ায় যারা থাকে তারা সন্ধের পর এখানে এসে পানভোজন করে, একটু আড্ডা মারে। এদের অবস্থা সাধারণ। অর্থবানরা এরকম জায়গায় আসে না।

লম্বা বার কাউন্টারের সামনে টুলের ওপর কয়েকজন বসে পান করছে। সামনের গোটাদশেক টেবিলে খদ্দেররা কথা বলছে, খাচ্ছে। মারিও সেই কাউন্টারের সামনে পৌঁছে অর্জুনকে একটা টুলে বসতে ইঙ্গিত করে নিজে আর একটায় বসল। তৎক্ষণাৎ কাউন্টারের উলটো দিকে একটি তরুণ এসে হেসে বলল, কল মি চার্লি। কী দেব তোমাদের?

মারিও বলল, তার আগে বলো তোমরা কতক্ষণ খোলা রাখো।

চার্লি বলল, রাত একটা পর্যন্ত।

মারিও বলল, ভালই হল। আমার এই ইয়ং বন্ধু একটু বসবে। আমি তাড়াতাড়ি ঘুরে আসছি। তারপর খাওয়াদাওয়া করব।

চার্লি মাথা নাড়ল, ওকে। ততক্ষণ তুমি একটা বিয়ার খেতে পারো।

অর্জুন মাথা নাড়ল। এরকম জায়গায় ঢোকার কথা সে জলপাইগুড়িতে বসে কল্পনাও করতে পারত না। ইচ্ছেও হত না। পানীয়ের গন্ধ পাবের বাতাসে ভাসছে আর তাতেই তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। গা গুলোচ্ছে। মারিও

অর্জুনের দিকে তাকাল, তুমি ড্রিঙ্ক করো না?

অর্জুন বলল, আমাদের দেশের নব্বই ভাগ মানুষই করে না। চার্লি বলল, তা হলে তুমি একটা আইসক্রিম সোডা যেতে পারো। চার্লি চলে যেতে মারিও বলল, আমি চট করে দেখে আসছি। মনে হয় এখানে যদি কেউ থাকে সে আমাকে চিনতে পারবে না।

মারিও বেরিয়ে গেলে অর্জুন দেখল কাউন্টারের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় চরকির মতো ঘুরে চার্লি ড্রিঙ্কের গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছে। এই সময় পাবের দরজা ঠেলে একজন মহিলা ঢুকলেন। মহিলার শরীর বেশ ভারী, পঞ্চাশের কাছে বয়স, মাথায় রুমাল বাঁধা 1 চারপাশে তাকিয়ে মহিলা অর্জুনের পাশের টুলে এসে বসলেন। তারপর ব্যাগ খুলে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে লাইটার জ্বেলে ধরালেন। চার্লি ছুটে এল, গুড ইভিনিং ম্যাডাম, বেশ কিছুদিন পরে আপনাকে দেখতে পেলাম!

আমি এখানে ছিলাম না। ধোঁয়া ছাড়লেন মহিলা।

আপনাকে জ্যামাইকান রাম দেব, তাই তো?

তোমার স্মরণশক্তি ভাল।

চার্লি দুহাতে দুটো গ্লাস নিয়ে ফিরে এল। অর্জুন দেখল তার গ্লাসে আইসক্রিম সোডার মধ্যে বরফের টুকরো রয়েছে কয়েকটা। এভাবে সে কখনও আইসক্রিম সোডা খায়নি। চুমুক দিতে আরাম লাগল।

ওয়াটার প্লিজ। ভদ্রমহিলার কথা শুনে অর্জুন অবাক হয়ে দেখল তিনি গ্লাসে পানীয় শেষ করে ফেলেছেন এক চুমুকে। চার্লি সেই গ্লাসে জল দিতেই সেটা গলায় ঢাললেন। চার্লি বলল, এবার জল মিশিয়ে দেব, তাই তো?

তুমি খুব ভাল ছেলে।

চার্লি হাসল, আপনার পাশে বসে আমাদের নবাগত অতিথি আইসক্রিম সোডা খাচ্ছেন। এই পাবে এরকম খদ্দের খুব কম আসে।

চার্লি চলে যেতে মহিলা অর্জুনের দিকে তাকালেন, তুমি এশিয়ান?

ইন্ডিয়ান।

ইন্ডিয়ার লোকেরা তো ড্রিঙ্ক করে।

সবাই করে না। আমার নাম অর্জুন।

আমি লুসি।

আপনি এ-পাড়ায় থাকেন?

না। তুমি?

আমি টুরিস্ট। এখানে একটা কাজে এসেছি।

তা কাজটা না করে পাবে বসে আছ কেন?

একটু অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

অপেক্ষা! সেটা তো আমি রাতের পর রাত করে যাচ্ছি।

আপনার কথা বুঝলাম না। ভদ্রমহিলা জবাব না দিয়ে চার্লির দেওয়া দ্বিতীয় গ্লাসটি ধরলেন।

অর্জুন লক্ষ করেছিল অপেক্ষার কথা বলার সময় ভদ্রমহিলার মুখ-চোখ কীরকম শক্ত হয়ে গিয়েছিল। এখনও গ্লাস হাতে নিয়ে তিনি ওই মুখ নিয়ে কিছু ভেবে চলেছেন। সে জিজ্ঞেস করল, আপনার দেশ নিশ্চয়ই আফ্রিকায়?

লুসি তাকালেন, আমার গায়ের চামড়াই তো সে কথা বলছে।

আফ্রিকার কোথায়?

জাম্বিয়া। লিভিংস্টোনে আমি জন্মেছি। নাম শুনেছ?

নিশ্চয়ই। জিম্বাবোয়ে, অ্যাঙ্গোলা, জাইরে আর তানজানিয়ার মাঝখানে জাম্বিয়া। তাই তো? অর্জুনের মাথার ভেতর একটা আলো চলকে উঠল।

ভদ্রমহিলা চোখ বড় করে দেখলেন, আশ্চর্য! তুমি আফ্রিকার এত খবর রাখো? এদেশে বেশিরভাগ মানুষই এইসব নাম জানে না।

অর্জুন হাসল, আরও জানি। পাশেই বসওয়ানা। তার ছোট্ট শহর গ্যাবর্ন থেকেই প্রায় কালাহারি মরুভূমি, শুরু। সেখানে মরুভূমির উপজাতিরা এসে কেনাবেচা করে। ঠিক বলেছি?

লুসি ঘুরে বসলেন, তুমি এসব জানতে গেলে কেন?

আমাদের স্কুলে এসব পড়ানো হয়।

তুমি কী করো?

একজন বয়স্কা মহিলার এই প্রশ্নের জবাবে মিথ্যে কথা বলতে পারল না অর্জুন। উত্তরটা শোনামাত্র ভদ্রমহিলার চোখ ছোট হল, গ্যাবন সম্পর্কে তুমি আর কী জানো? আমার মন বলছে তুমি সেখানে গিয়েছিলে?

না। বিশ্বাস করুন আমি কখনওই আফ্রিকায় যাইনি।

কথাটা বিশ্বাস করলেন লুসি। গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, ওকে যদি একবার গ্যাবর্নে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত তা হলে আমার চেয়ে খুশি কেউ হত না। ওর শরীরটাকে ওরা মরুভূমিতে পুঁতে ফেলত।

কেন?

ওদিকের মানুষরা অনেক বছর আগে মাটির তলা থেকে একটি ধাতব বস্তুতে তৈরি সাপকে উদ্ধার করেছিল। সেই সাপটি ওদের ভাগ্য খুলে দিয়েছিল। তার অধিকার নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই হত। একদিন সেই সাপ চুরি হয়ে যায়। সেটাকে আর পাওয়া যায়নি। তখন ওরা আর একটি অবিকল ওই সাপ তৈরি করে। কিন্তু সেটা একটা ব্ল্যাক কোবরার মাথা আর খানিকটা শরীর। এই সাপটিকেও একজন চুরি করে বিক্রি করেছে কিছু বছর আগে। যে বিক্রি করেছে সে মারা গিয়েছে কিন্তু যে কিনেছে সে এদেশে আছে।

আপনিও কি ওই সাপকে ভগবান বলে মনে করেন?

না। আমি খ্রিস্টান। ওসব আমি মানি না। কিন্তু যে ওটা কিনে এদেশে পালিয়ে এসেছে সে আমার সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমার কোনও দোষ না থাকা সত্ত্বেও আমাকে ত্যাগ করে আর একজনকে বিয়ে করেছিল সে।

আপনি কি এখানে প্রতিশোধ নিতেই আসেন?

মাথা নাড়ালেন লুসি, কীভাবে নেব? এর মধ্যে ও যে কটা ফ্ল্যাট পালটেছে আমি তার সন্ধান পেয়েছি। একদিন এই পাব থেকে বেরোতে দেখেছিলাম তাকে। তারপরই মাঝে-মাঝে চলে আসি। যদি সামনাসামনি দেখতে পাই…! লুসি কথা শেষ করলেন না।

আপনি ওঁর কথা দেশে জানিয়ে দিচ্ছেন না কেন?

কাকে জানাব? ভেবেছিলাম কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে ওর ঠিকানা জানিয়ে দেব। ওদের ভয়ে সে অনেককাল নিজের দেশে যায় না।

এই সময় মারিও পাবে ফিরে এল। লুসিকে দেখে নিয়ে অর্জুনের এ-পাশের টুলে বসে চার্লিকে বলল, বিয়ার।

চার্লি বিয়ার দিয়ে গেলে তাতে চুমুক দিয়ে চাপা গলায় মারিও বলল, বাড়ির সামনে পার্ক করা গাড়িতে পাঁচজন বসে আছে।

ভেতরে ঢোকা যাবে না?

না। অন্তত ওদের চোখ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।

কিন্তু আমাদের সেই চেষ্টা করতে হবে।

দাঁড়াও, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।

অর্জুন ঘুরে বসল, আপনি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন?

কীরকম?

অর্জুন লকেটটা বের করল। করে টেবিলে রাখল, চিনতে পারেন?

হঠাৎ ভদ্রমহিলা প্রায় পাথর হয়ে গেলেন, এটা—এটা–?

সেই সাপের লকেট, যেটা বহু বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল।

মাই গড!

আমরা এখন মিস্টার আলাম্বার ফ্ল্যাটে যাচ্ছি। মাফিয়ারা ওর ফ্ল্যাট আবিষ্কার করে ফেলেছে। মিস্টার আলাম্বার বাড়ির সামনে পাহারা দিচ্ছে ওরা। আপনি শুনে নিশ্চয়ই দুঃখিত হবেন ওঁর মেয়েকে ওরা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মেরে ফেলেছে। বেচারা নির্দোষ, কিছুই জানত না।

তুমি মিস্টার আলাদাকে চেনো? লুসির মুখে বিস্ময়!

হ্যাঁ। এটা খুব কাকতালীয় ব্যাপার যে, আপনার দেখা পেয়েছি।

তোমরা কী করতে চাও?

মিস্টার আলাম্বাকে বাঁচাতে চাই। আমাদের এক বন্ধু ওঁর ফোন নাম্বার ওদের দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। নইলে ওরা ওঁকে ধরতে পারত না।

কিন্তু আমি তো ওঁকে বাঁচাতে চাই না।

কিন্তু উনি মারা গেলে আপনি প্রতিশোধ নেবেন কী করে?

বেশ। কী করতে হবে আমাকে?

আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। কাছেই।

তার মানে তুমি যে কাজটা করতে এসেছ সেটা…।

হ্যাঁ, এই ব্যাপার। ইনি আমাদের বন্ধু, মারিও।

মারিও মাথা নেড়ে বিয়ার শেষ করল।