১১. অর্জুন বলল আমাকে মাফ করবেন

অর্জুন বলল, আমাকে মাফ করবেন, এই মুহূর্তে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। প্লিজ! মহিলা কাতর গলায় বললেন। দেখুন আপনি আমাকে চেনেন না, আমার সমস্ত জানেন না। একই কথা আপনার সম্পর্কে প্রযোজ্য। তাই না? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

ঠিকই। কিন্তু মরার আগে জিম আমাকে বলেছে আপনাকে সব বলতে। যেহেতু লকেটটা আপনার কাছে আছে তাই আপনাকে ও গুরুত্ব দিয়েছে।

কী বলতে চেয়েছে, তা আপনি জানেন?

হ্যাঁ। জানি।

আপনি পুলিশের কাছে যাচ্ছেন না কেন?

গেলে আমিও খুন হয়ে যাব। মহিলা বললেন, আমি এই ফ্ল্যাটে থাকতে ভরসা পাচ্ছি না। কীভাবে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব ভেবে না পেয়ে অপেক্ষা করছিলাম যদি জিমের খবর জানতে আপনি এখানে ফোন করেন। আমি এখনই আমার এক মাসির বাড়িতে চলে যাচ্ছি।

আমার নাম অর্জুন। কোথায় যেতে হবে আমাকে?

জ্যাকসন হাইটে যে অফ ট্র্যাক বেটিং সেন্টার আছে সেটা ছাড়িয়ে গেলেই বাঁ দিকে একটা সিঁড়ি নীচে চলে গেছে। সেখানে নেমে একটা কাগজের স্টল দেখতে পাবেন। সেই স্টলে আমার নাম জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন মাসির ফ্ল্যাটটা কোথায়! আমার নাম তো কার্ডেই পেয়ে যাবেন।

ঠিক আছে। আমি ভেবে দেখি। অর্জুন ফোন নামিয়ে রাখল। মিস্টার আলাম্বা জিজ্ঞেস করলেন কী ব্যাপার?

জিম মারা গিয়েছে। ওর সঙ্গে যে মহিলা ছিলেন তাঁকে বলে গেছে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

সিম্বা অর্জুনের হাত থেকে কার্ড নিয়ে নামটা পড়ল, গ্যাব্রিয়েলা! শি ইজ স্প্যানিশ। ব্যাপারটা কী?

অনেক ঘটনা। মিস্টার আলাম্বার কাছে শুনে নেবেন। আমাকে এখন মেজরের ফ্ল্যাটে যেতে হবে। অর্জুন বলল।

কিন্তু তোমার লকেটটা কোথায় গেল? মিস্টার আলাদা জিজ্ঞেস করলেন। তাঁকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল, তোমার সঙ্গে নেই যখন, তখন কি রাস্তায় পড়ে গেছে? ওইরকম লকেট তুমি অবহেলায় হারিয়ে ফেললে?

অর্জুন তাকাল। সোফার পাশে সেই খোদাই করা কাঠের কলসির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে লকেটটাকে বের করে গলায় পরে নিল, আমি খুব দুঃখিত মিস্টার আলাদা। এখানে যদি এটাকে না রাখতাম তা হলে আপনার সংগ্রহশালা আরও মুল্যবান হত এবং আমি কখনওই এটাকে ফেরত পেতাম না। বাই— অর্জুন সোজা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল।

মেজরের ফ্ল্যাটের দরজার বেলের বোতাম টিপতেই সেটা খুলল না, তিনবার বাজানোর পর ঘুম-ঘুম চোখে দরজা খুলে মেজর হাই তুললেন, এই মাঝরাতে

এসে ভোর হলে আসতে পারলে না?

অর্জুন ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখল সবকটা জানলায় ভারী পরদা টানা থাকায় বাইরের আলো একফোঁটা ঢুকছে না। সে বলল, এখন সকাল আটটা। আপনার কাছে স্পেয়ার টুথব্রাশ আছে?

আটটা? মাই গড! ওঃ, কালকের ডিনারটা আমাকে! এইজন্যেই রাত্রে লাইট ডিনার করা উচিত। আছে। টুথব্রাশ কেন, এক্সট্রা সাবান, দাড়ি কামাবার স্টিক সব পেয়ে যাবে ওখানে। মেজর দাড়ি চুলকোতে লাগলেন।

আটঘণ্টা বাদে দুজনে পরিষ্কার হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে টোস্ট, ডিমের পোচ আর চা খাচ্ছিল। মেজর চোখ বড় করে বললেন, এ তো স্রেফ বিশ্বাসঘাতকতা। তোমাকে অজ্ঞান করে লকেট চুরি করবে আলাম্বা, এটা আমি ভাবতে পারছি না। এই পৃথিবীতে দেখছি কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না।

ওঁর লোভ হওয়া স্বাভাবিক।

হুম্‌। মাঝে-মাঝে এমন ভঙ্গিতে কথা বলো যে, মনে হয় তুমি, কোনও তিব্বতি লামা। হাঁটুর বয়সী ছেলে তুমি অথচ একেবারে জ্ঞানবৃদ্ধ। মেজর মচমচ করে টোস্টে কামড় দিলেন, আর এইজন্যেই তোমার ফ্যান আমি।

অর্জুন বলল, আমি ভাবছি গ্যাব্রিয়েলার সঙ্গে দেখা করব।

নিশ্চয়ই করবে। ওই ব্যাটা জিম মরার আগে কী বলে গেছে সেটা না শুনলে এই টোস্ট হজম হবে না আমার।

আপনি সঙ্গে যাবেন?

তুমি তো নিউ ইয়র্কের রাস্তাঘাট কিছুই চেনো না। আমি না নিয়ে গেলে কীভাবে পৌঁছবে?

তা ঠিক। তবে আপনার বাড়ির পাশেই কাল টিউব স্টেশন দেখেছি, জ্যাকসন হাইটে, যেতে নিশ্চয়ই সমস্যা হবে না।

তারপর?

ওখান থেকে নিউ জার্সিতে ফিরবে কী করে? ওখানে তো টিউব নেই।

তা অবশ্য। কিন্তু আপনার স্ব কাজ ফেলে আমার সঙ্গে যেতে কী করে বলি? আপনার নিশ্চয়ই অসুবিধা হবে।

তা হবে। দাড়ি চুলকোলেন মেজর, আজ মিস্টার স্টিভেনসনের সঙ্গে ব্যাপারটা ফাইনাল করার কথা। ওঁর ইচ্ছে আফ্রিকার জঙ্গলে এক মাস থেকে মাকড়সাদের লাইফ ভিডিওতে তুলে আনা। আর আমি বলছি আর একবার ইয়েতি খুঁজতে হিমালয়ে যেতে। হিলারী সাহেব খুঁজে পাননি মানে এই নয় হিমালয়ে ইয়েতি নেই। না থাকলে ইয়েতি শব্দটার জন্মই হত না।

আপনার মিটিং কখন

দুপুরে।

তা হলে চলুন এখনই বেরিয়ে পড়ি।

সঙ্গে অস্ত্র আছে?

না তো!

যদি এটা ট্র্যাপ হয়? কিছুই বলা যায় না। তুমি বরং, ওই লকেটটা আমার ফ্ল্যাটে রেখে যাও। ওটা হারানো উচিত হবে না।

অর্জুন হেসে বলল, এটার কোনও মূল্য আমার কাছে নেই। তবে যেসব আফ্রিকান একে ভয় বা শ্রদ্ধা করেন তাঁদের অসম্মান আমি করছি না। অবশ্য সঠিক জায়গায় যদি এটা পৌঁছয় তার চেষ্টা করা উচিত।

কারেক্ট। এক কাজ করি। ওর ড়ুপ্লিকেট বানিয়ে নিই।

কোথায় পাবেন?

চলো।

তৈরি হয়ে ওরা যখন বেরোতে যাচ্ছে তখন দরজার ওপারে সিদ্ধাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। সিম্বা অত্যন্ত কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলল, আমি আমার বাবার হয়ে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আসলে কোনও বিরল জিনিস দেখলে ওঁর মাথায় ন্যায়-অন্যায় বোধ কাজ করে না।

মেজর বললেন, এটা উনি নিজে না বলে তোমাকে কেন পাঠিয়েছেন?

বাবা আসতে লজ্জা পাচ্ছেন। সিম্বা ম্লান গসল।

অর্জুন বলল, ওঁকে বলবেন সমস্যাটা আমি বুঝেছি। কিন্তু এখন আমরা বের হচ্ছি। আপনাকে তাই ভেতরে আসতে বলতে পারছি না।

সিম্বা বলল, আমি স্পানিশ জানি।

তার মানে? অর্জুন অবাক।

যে ভদ্রমহিলার সঙ্গে তখন টেলিফোনে কথা বললেন তাঁর কাছে যদি যান তা হলে আমি সঙ্গে থাকলে উপকার হবে।

আপনি ভুলে যাচ্ছেন। ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমি ইংরেজিতে কথা বলেছি।

ও, তাই তো! সিম্বা মাথা নাড়ল।

আর মেজর স্প্যানিশ ভালই জানেন।

সিম্বা আর কথা না বাড়িয়ে ওদের সঙ্গে লিফটে নীচে নেমে এল। বাড়ির বাইরে এসে মেজর বললেন, চলো হে, টিউব নিতে হবে।

টিউব শব্দটি কানে যেতে সিম্বা জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? আপনারা গাড়ি নিচ্ছেন না?

মাই ডিয়ার বেবি, আমার গাড়িটাকে তোমার বাবার বন্ধুরা কাল রাত্রে বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। মেজর ঘুরে বললেন।

ও মাই গড! সিম্বা বলল।

তোমার সঙ্গে গাড়ি আছে? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।

আমাদের জ্যাকসন হাইটে নামিয়ে দিতে পারবে? টিউবে উঠতে আমার খুব খারাপ লাগে। মেজর বললেন।

স্বচ্ছন্দে। আসুন। সিম্বা যেন খুশি হল।

 

নিউ জার্সির রাস্তায় লোকজন দেখা যায় না, কিন্তু কুইন্সের চেহারাটা আলাদা। এখন সকাল। গাড়ির ভিড় এখনও শুরু হয়নি। কিন্তু যা আছে তা কলকাতাতেও দেখা যাবে না। অর্জুনের মনে পড়ল কোনও একটা কাগজে পড়েছিল, শুধু নিউ ইয়র্কে যত গাড়ি চলে তার সংখ্যা সমস্ত ভারতবর্ষের গাড়ির সংখ্যা ছাপিয়ে গিয়েছে।

জ্যাকসন হাইটে যেখানে গাড়ি পার্ক করল সিম্বা, সেটাকে ভারতীয় পাড়া বলে মনে হল অর্জুনের। কিন্তু গাড়ি থেকে নামতেই ফুটপাথে হেঁটে যাওয়া মানুষদের বাংলায় কথা বলতে শুনে সে আরও অবাক হল। মেজর বললেন, যখনই বাংলা শুনতে ইচ্ছে করে তখনই চলে আসি এখানে। বাংলাদেশিরা এই পাড়াটা প্রায় দখল করে ফেলেছে। ওদের কম্পিটিটার হল কিছু গুজরাতি ব্যবসায়ী। ওই দ্যাখো, রয়াল বেঙ্গল রেস্টুরেন্ট, দারুণ ইলিশ মাছ রাঁধে। মুখ তুলে একটা সাইনবোর্ড দেখে অর্জুনের মন জুড়িয়ে গেল। বাংলা হরফে লেখা রয়েছে, মুক্তধারা। সমস্ত বাংলা বই এবং বাংলা গানের ক্যাসেট পাওয়া যায়।

ও টি বি অথবা অফ ট্র্যাক বেটিং সেন্টার হল জুয়া খেলার কেন্দ্র। এই পূর্ব-উপকূলে যত রেসকোর্স আছে তার রেসের ছবি এখানকার ভিডিওতে দেখানো হয়। এখন অবশ্য দোকানটি বন্ধ। ও টি বির পাশ দিয়ে খানিকটা এগোতেই চোখে পড়ল সিঁড়িটাকে। বাঁ দিক দিয়ে নীচে নেমে গেছে। অর্থাৎ গ্যাব্রিয়েলা টেলিফোনে যা বলেছে তা মিলে যাচ্ছে। মাথার ওপর দুমদুম শব্দ করে ট্রেন চলে গেল। অর্জুন বলল, এদিকে যেতে হবে।

সিম্বা ওদের সঙ্গে আসেনি। গাড়ি পার্ক করে সেখানেই থেকে গেছে। অর্জুন চেয়েছিল মেয়েটাকে ছেড়ে দিতে কিন্তু মেজর ওকে অনুরোধ করেছেন ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। মেয়েটার কথাবার্তা খারাপ নয়। অন্তত ও কোনও ক্ষতি করবে না বলেই অর্জুনের মনে হয়। অর্জুন হেসে ফেলল। সে ক্ষতির কথা ভাবছে, এখন পর্যন্ত মেয়েটা তো তাদের উপকার করেই যাচ্ছে।

নীচে নামতেই কাগজের স্টলটাকে দেখতে পেলে অর্জুন। একটি বয়স্কা মহিলা কাগজ বিক্রি করছেন। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে বলল, এক্সকিউজ মি?

মহিলা ফিরেও তাকাল না। আর একজন খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। লোকটা কাগজ নিয়ে চলে যেতেই মহিলা আঙুল তুলে কাগজগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল। ওয়ান্ট পেপার?

নো।

দেন গেট লস্ট। মহিলা অন্যদিকে তাকাল।

এবার মেজর এগিয়ে এল, হাই। হি ইজ আস্কিং ফর গ্যাব্রিয়েলা। মেজরের উচ্চারণ আমেরিকানদের মতো জড়ানো। মহিলা চট করে তাকাল, হোয়াট ইজ হিজ নেম?

অর্জুন। মেজর একই গলায় উচ্চারণ করলেন।

মহিলা চট করে পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরো বের করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, সরি। শি ইজ নট হেয়ার।

হোয়ার ইজ শি?

গ্যাবি আটলান্টিক সিটিতে গিয়েছে।

হতেই পারে না। ও ওর মাসির বাড়িতে থাকবে বলেছিল।

তাই ইচ্ছে ছিল ওর। কিন্তু জানোই তো, পরিস্থিতি পালটায়। ও অর্জুনের জন্যে তাজমহল ক্যাসিনোতে অপেক্ষা করবে।

আমরা ওখানে যে যাব তা ও আশা করল কী করে? ননসেন্স!

আমি জানি না। ও বলেছে দুপুর একটা থেকে দুটো তাজমহলের এক ডলারের সট মেশিনের সামনে বসে থাকবে। এখন কেটে পড়ো।

এই খবরটা তুমি কতজনকে দিয়েছ?

তুমি কী বলতে চাও? আমি কাগজ বিক্রি করি, বন্ধুত্ব নয়। গ্যাবি আমার খুব ভাল বন্ধু। ও ওই ছেলেটার চেহারার বর্ণনা দিয়ে গিয়েছিল।

মেজর হাঁটতে শুরু করলেন, অদ্ভুত ব্যাপার! অর্জুন জিজ্ঞেস করল, জায়গাটা কোথায়? কীভাবে যাওয়া যায়?

সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল এখানে দেখা করতে বলে মেয়েটা পালাল কেন? তোমাকে জ্বালাচ্ছে না তো।

তাতে ওর কী লাভ?

তা ঠিক। তুমি যদি না যাও তা হলে ওর কী লাভ হবে? আর গেলেই বা কী লাভ করবে ও, তাও বুঝতে পারছি না। মেজর দাড়ি চুলকে বললেন, জায়গাটা অতলান্তিক সমুদ্রের ধারে। লোকে জুয়া খেলতে যায় কিন্তু দেখার মতো জায়গা। লস ভেগাসের নাম শুনেছ? লস অ্যাঞ্জেলিসের কাছে মরুভূমির ওপর আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের জিন যেন একটা শহর বানিয়ে দিয়েছে যা দিনে ঘুমোয় রাত্রে জাগে। তারই মিনি সংস্করণ এই ইস্টকোস্টে আটলান্টিক সিটি। যেতে ঘণ্টা আড়াই লাগবে।

তাজমহল কি কোনও হোটেলের নাম?

না। ক্যাসিনোর। জায়গাটা জুড়ে শুধু ক্যাসিনো। মুশকিল হল, আমার গাড়ি নেই। বাসে অবশ্য যাওয়া যায়, কিন্তু চলো দেখি।

পার্কিং প্লেসে ফিরে আসামাত্র সিম্বা হাসল, কাজ হয়েছে?

না। মেজর দাড়ি চুলকোলেন, আমাদের একটু আটলান্টিক সিটিতে যাওয়া দরকার। দিনটা অবশ্য যাবে। তোমার কি মনে হয়, যেতে পারবে?