০৪. কলকাতায় এর আগে

কলকাতায় এর আগে কয়েকবার এসেছে অর্জুন, কিন্তু সল্ট লেকে কখনও যায়নি। শিয়ালদার কাছে একটা হোটেলে সুটকেস রেখে সে ট্যাক্সি নিয়েছিল। নতুন জায়গায় বাসে চেপে গেলে চিনতে অসুবিধে হবে। গতরাতে দার্জিলিং মেলে চমৎকার ঘুম হওয়ায় এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে।

টেলিগ্রামের ঠিকানা মিলিয়ে বাড়ির সামনে পৌঁছে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল অর্জুন। কলকাতা শহরের সঙ্গে সল্ট লেকের পরিবেশ, বাড়িঘরের পার্থক্য আকাশপাতাল। মনে হচ্ছিল, এখানে সম্পন্ন মানুষেরাই বাস করেন। বাড়িটা দোতলা। সামনের দরজা বন্ধ। পাশের প্যাসেজের মুখে লোহার গেট। সেটাও শেকলবন্দি। অর্জুন বেলের বোতাম টিপল। মিনিটখানেক বাদে একটা জানলা খুলে গেল। গেঞ্জি গায়ে এক মধ্যবয়সী মানুষ প্রশ্ন করল, কাকে চাই? বাবুকে হলে দেখা হবে না, বাবুর শরীর খারাপ।

বাড়িতে আর কেউ আছেন?

আমি আছি। এখানে কাজ করি। নিশ্চয়ই আমার কাছে আসেননি।

তা আসিনি। তুমি তোমার বাবুকে এই কাগজটা দাও। পকেট থেকে টেলিগ্রামের কাগজ বের করে জানলা দিয়ে লোকটার হাতে দিল সে। কয়েক মিনিটের মধ্যে দরজা খুলে গেল। অর্জুন দেখল অত্যন্ত সৌম্য চেহারার এক বৃদ্ধ মাথা বাড়িয়ে এপাশ-ওপাশ দেখছেন।

নমস্কার। আপনি অমল সোমকে এই টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। তিনি কোথায়? তিনি আসেননি? বৃদ্ধ যেন থমকে গেলেন।

আপনি যদি আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেন তা হলে এব্যাপারে কথা বলতে পারি।

ও, হ্যাঁ, আসুন। আমি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলাম জলপাইগুড়ির অমল সোমকে। উনি দরজা থেকে সরে যেতে অর্জুন ঘরে ঢুকল। চেয়ার টেবিল এবং দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি ছাড়া এ-ঘরে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই।

অর্জুন বলল, আমার নাম অর্জুন। টেলিগ্রাম পাওয়ার পর অমলদা টেলিফোনে আপনাকে ধরতে চেয়েছিলেন। আপনার ফোন বেজে গিয়েছে, কেউ ধরেনি। সম্ভবত ফোন খারাপ। তাই অমলদা আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।

আপনি এসে আমার কী উপকার করবেন? উনি কি খুব ব্যস্ত?

না। এখন অমলদা কোনওরকম কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চান না। আপনার সমস্যা কী, তা আমি জানি না, কিন্তু আমার যা কিছু শিক্ষা তা অমলদার কাছ থেকেই পাওয়া। অবশ্য আপনার যদি ভরসা না হয় তা হলে—! অর্জুন কথা শেষ করল না। সে বুঝতে পারছিল বৃদ্ধ তাকে অমল সোমের বিকল্প বলৈ ভাবতে পারছেন না। অমলদা তাকে এঁর পরিচয় দিয়েছেন। অত্যন্ত পণ্ডিত এবং বিজ্ঞানসাধক।

কিন্তু আপনার কথা আমি বিশ্বাস করব কী করে?

এবার অর্জুন পকেট থেকে খামটা বের করে এগিয়ে দিল। অমলদা নিজের হাতে তার পরিচয় দিয়ে চিঠি লিখেছেন। বৃদ্ধ সেটা পড়ে মাথা নাড়লেন, ও। বসুন। কলকাতায় আজই এসেছেন বোধ হয়?

হ্যাঁ।

কোথায় উঠেছেন।

হোটেলে।

হুঁ। অর্জুন দেখল বুদ্ধ উলটো দিকের চেয়ারে বসে চিবুকে হাত রাখলেন। তারপর বললেন, আমি এক অদ্ভূত সমস্যার মধ্যে পড়েছি ভাই। আপনার বয়স এত কম যে, দেখে ঠিক ভরসা হয়নি বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু মিস্টার সোম যে চিঠি লিখেছেন তার ওপর তো কিছু বলার নেই।

আপনার সমস্যা জানতে পারি?

নিশ্চয়ই। বৃদ্ধ শুরু করলেন। একে-একে সব ঘটনা শোনার পর অর্জুন বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না। আপনি একা এতবড় পরীক্ষা করছেন?

শুরুটা ভো কাউকে কাউকে একাই করতে হয়।

আপনি সফল হলে বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে যাবে।

হয়তো। আচ্ছা, তোমার কি মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অবাস্তব!

না। জুলে ভের্ন যখন গল্প লিখেছিলেন তখন কেউ কল্পনা করেনি ব্যাপারটা একসময় চূড়ান্ত বাস্তব হবে। কিন্তু এই আবিষ্কার যেমন মানুষের উপকারে আসবে, তেমনই মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলে প্রলয় হয়ে যাবে।

নিশ্চয়ই। যে ব্যবহার করবে তার চরিত্রের ওপর সেটা নির্ভর করছে।

আপনি পুলিশকে জানিয়েছেন?

লিখিত নালিশ করিনি। এখানকার অফিসার ইনচার্জ আমার পরিচিত, টেলিফোনে তাঁকে বলেছিলাম। এখনও পর্যন্ত তিনি এতে রহস্য দেখতে পাননি।

আপনার বাড়িটা একবার দেখতে পারি?

অবশ্যই। বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন।

আপনি কেন, আর কাউকে বলুন না সঙ্গে যেতে।

আর কেউ বলতে আমার কাজের লোক গঙ্গাপদ। এখন পর্যন্ত রাত্রে আমি একাই থাকি। সাধারণত একতলাটা বন্ধ থাকে। দোতলায় আমার শোয়ার ঘর। লাইব্রেরি। ওখানে আর-একটি বেডরুম রয়েছে। তিনতলায়, মানে ছাদের একপাশে আমার গবেষণার ঘর। বলতে বলতে আর-একটি ঘর পেরিয়ে বৃদ্ধ অর্জুনকে নিয়ে ভেতরের বারান্দায় চলে এলেন। একচিলতে শানবাঁধানো উঠোন রয়েছে। এই সময় কুকুরের চিৎকার ভেসে এল। অর্জুন দেখল দুটো কুকুর চেনে বন্দি হয়ে আছে। তার একটা চেঁচাচ্ছে, অন্যটা হিংস্র ভঙ্গিতে ছুটে আসার চেষ্টা করেও চেনে আটকে আছে। সে জিজ্ঞেস করল, যে চিৎকার করছে তার নাম মেয়?

হ্যাঁ। বৃদ্ধ হাসলেন, নেড়ি কুকুরের বাচ্চাদুটোকে কুড়িয়ে নিয়ে এসে মনে হয়েছিল এদের কুকুর না বলে সারমেয় বললে কৌলীন্য বাড়বে।

আপনি বিশ্বাস করেন আপনার যন্ত্র থেকে কোনওমতে শব্দকণা বের হয়ে মেয়র স্বরনালীতে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে তারই ফলে ও স্বর ফিরে পেয়েছে?

এ ছাড়া তো অন্য কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।

সারের ওপর একই পরীক্ষা করছেন না কেন?

ওটা ঘটেছিল নিতান্ত দুর্ঘটনাবশত। ইচ্ছে করলেই এক দুর্ঘটনা ঘটানো যায় না। আর পদ্ধতিটা এখনও আমার অজানা!

অর্জুন লক্ষ করল একটি লোক ওপাশের দরজার আড়াল থেকে উঁকি মারছে। সে জিজ্ঞেস করল, আপনার কাজের লোক কি অনেকদিনের?

না। গঙ্গাপদ এদিকে এসো। বৃদ্ধ ডাকলেন।

গঙ্গাপদ এগিয়ে এল। শক্তপোক্ত চেহারা, অশিক্ষার ছাপ চোখমুখে।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তুমি কতদিন এখানে আছ গঙ্গাপদ?

অল্পদিন।

এর আগে কোথায় কাজ করতে?

গঙ্গাপদ মাথা নিচু করল। বৃদ্ধ হেসে ফেললেন, গঙ্গাপদর পক্ষে নিজের ইতিহাস বলতে ভাল লাগবে না। বেচারা কোনও কাজকর্ম না পেয়ে লোরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে জিনিসপত্র সরাত। তেমনই এক রাত্রে আমার বাড়িতে এসে কুকুরের মুখে পড়ে যায়। ওর সঙ্গে কথা বলার পর আমার মনে হয়, সুস্থ জীবনে ফিরে আসার জন্যে ওকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। এখন ওর কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে আমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জন্মমাত্র মানুষ অপরাধী তৈরি হয় না।

অর্জুন গঙ্গাপদকে আর একার দেখল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে বলল, ঠিক আছে, পরে তোমার সঙ্গে কথা বলা যাবে।

মাথা নেড়ে গঙ্গাপদ ফিরে গেল তার কাজে। অর্জুন বলল, তা হলে ব্যাপারটা এইরকম সাজানো যেতে পারে। প্রথমে গঙ্গাপদ আপনার বাড়িতে চুরি করতে এসেছিল। কিন্তু আপনার কুকুরের জন্যে সে ধরা পড়ে যায়। এর পর একটি ওরাং ওটাং আপনার বাড়িতে ঢোকে, গবেষণাঘরে যায়। কিন্তু সেও কুকুরের তাড়া খেয়ে নীচের ঘরে আশ্রয় নেয়। পরদিন তার মালিক এসে তাকে পালাবার পথ করে দেয়। এর পর টেলিফোনে আপনার কাছে অর্থসাহায্যের প্রস্তাব আসে। অর্থাৎ আপনার গবেষণার ওপর কারও নজর পড়েছে। এ ছাড়া আর কোনও ঘটনা ঘটেনি, তাই তো?

বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, কিন্তু গঙ্গাপদর চুরি করতে আসার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।

আপনি কী করে নিশ্চিন্ত হচ্ছেন?

আমি ওর সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছি। ও নেহাতই ছিচকে চোর ছিল।

হয়তো। আচ্ছা, দ্বিতীয়বার টেলিফোন এসেছে? পরের দিন করার কথা ছিল না?

হ্যাঁ, তাই বলেছিল। কিন্তু আমি বা গঙ্গাপদ কেউ টেলিফোন ধরিনি। ওটা বেজেবেজে থেমে গিয়েছে অনেকবার। বৃদ্ধ বললেন, না, গঙ্গাপদকে আমি সন্দেহ করতে পারি না। ওর যদি মতলব থাকত তা হলে যে-কোনওদিন আমার গবেষণাঘরের আলমারি খুলে কাগজপত্র নিয়ে হাওয়া হয়ে যেতে পারত। বাড়িতে তো তৃতীয় ব্যক্তি নেই।

অর্জুন জবাব না দিয়ে বলল, চলুন, আপনার গবেষণার ঘরটা দেখে আসি।

বৃদ্ধ অর্জুনকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলেন। সিঁড়ির গায়ে জানলাটি এখন বন্ধ কিন্তু তার একটি শার্সি ভেঙে যাওয়ায় ফোকর হয়েছে। বৃদ্ধ সেটি দেখিয়ে বললেন, আমার সন্দেহ, এখান দিয়েই ওরাং ওটাংটা ঢুকেছিল।

ও। এটাকে সারানো হয়নি কেন?

গঙ্গাপদকে বলেছি মিস্ত্রি ডাকতে। সল্ট লেকে চাইলেই কাজের লোক পাওয়া যায় না। আগামী রবিবার আসবে। এইটুকু কাজের জন্যে পুরো দিনের চার্জ নেবে।

গঙ্গাপদ ঢুকেছিল কোন পথে?

প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধ হকচকিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ও খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকে ভেতরে লুকিয়ে ছিল। বিকেলবেলায় খিড়কি দরজা খুলে আমি সার আর মেয়কে পটি করাতে বাইরে বেরিয়েছিলাম।

একটা বাইরের লোক বাড়িতে ঢুকে লুকিয়ে আছে তা কুকুরদুটো বুঝতে পারেনি?

একটু পরিবর্তন ঘটেছিল আচরণের, কিন্তু না ডাকলে কুকুরের মনের কথা কি বোঝা যায়? আসুন ভাই। বন্ধ দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকলেন বৃদ্ধ। বললেন, আগে কখনও এ-ঘরের দরজায় তালা দিইনি, কিন্তু এখন দিচ্ছি।

ঘরটি বড়। অজস্র যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে আছে চারপাশে। ঠিক মাঝখানে বিদঘুটে দেখতে যে মেশিনটি, তার ওপরটা কাচ দিয়ে মোড়া, আবার নীচের দিকের একটা অংশ লোহার জালে ঢাকা। বৃদ্ধ বললেন, অনেক কষ্ট করে এই যন্ত্রটি তৈরি করেছি। এখন পর্যন্ত আকাশের শব্দগুলোর অনুরণন আমি শুনতে পাই। কখনও সখনও আকস্মিক ভয়ঙ্কর শব্দের হদিস আসে। ওরাং ওটাংটা এই যন্ত্রের ক্ষতি করেছিল কিন্তু আমি সেটাকে সামলে নিয়েছি। বৃদ্ধ সুইচ টিপতেই মাথার ওপর থেকে ছাদ সরে গিয়ে ঘরটি রোদুরে ভরে গেল। বৃদ্ধ বললেন, সমুদ্রের নীচে যে রহস্য রয়েছে, মাথার ওপরের আকাশে তার থেকে কয়েক সহস্র গুণ রহস্য এখনও অনাবিষ্কৃত। কিন্তু আমি একটি বিশেষ জায়গায় গিয়ে আটকে যাচ্ছি প্রতিবার। এবার এগোতে হলে যেসব যন্ত্রের সাহায্য দরকার তা সরকারি অনুদান ছাড়া আমার পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। আমি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান কংগ্রেসের কাছেও আবেদন করেছি। আমার এক ইংরেজ বন্ধু এ ব্যাপারে চেষ্টা করছেন, দেখি কী হয়!

অর্জুন ঘরের একপাশে দেওয়াল-ঘেঁষা আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সাধারণ আলমারি। তালা ভেঙে পাল্লা খুলতে কারও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। সে জিজ্ঞেস করল, আপনার গবেষণার কাগজপত্র এর মধ্যেই রয়েছে?

হ্যাঁ।

এর চেয়ে আর কোনও নিরাপদ জায়গা এবাড়িতে নেই?

আছে। আমার শোয়ার ঘরে একটা লোহার সিন্দুক আছে। প্রতিদিন কাজের সময় প্রয়োজন হয় বলে কাগজপত্র ওখানে রেখেছি।

কিন্তু আর রাখা উচিত হবে না। কাজ শেষ হয়ে গেলে ওগুলো লোহার সিন্দুকে চাবি দিয়ে রাখবেন। অর্জুন জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সল্ট লেকের এই অঞ্চলে ড়ুয়ার্সের মতো লম্বা লম্বা দেবদারু গাছের ভিড় দেখা যাচ্ছে। চারপাশ বেশ সবুজ। হঠাৎ অর্জুনের মনে হল, রাস্তার উলটোদিকের দেবদারু গাছের ওপরের দিকের একটা ডাল যেন অস্বাভাবিকভাবে নড়ে উঠল। সে ভাল করে ঠাহর করতেই বানর জাতীয় কোনও প্রাণী চট করে পাতার আড়ালে হারিয়ে গেল। এত দ্রুত তার সরে যাওয়া যে, তার আদলও ভাল করে বোঝা গেল না। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনাদের সল্ট লেকে বুঝি খুব বানর আছে?

বৃদ্ধ বললেন, তাই নাকি? আমি দেখিনি তো?

অর্জুন জানলা বন্ধ করে বলল, বানর না দেখতে পারেন, ওরাং ওটাং তো দেখেছেন?

হোটেলে ফিরে গিয়ে অর্জুন জলপাইগুড়িতে টেলিফোন করল। মোটামুটি ঘটনাটা অমল সোমকে জানিয়ে দিল সে। অমল সোম বললেন, ওবাড়িতে যখন তৃতীয় ব্যক্তি নেই এবং যথেষ্ট জায়গা রয়েছে, তা হলে তুমি হোটেলে থাকছ কেন? তোমার ওখানেই থাকা উচিত।

অর্জুন বলল, আমি নিজে থেকে বলতে পারিনি।

উনি কি এখন টেলিফোন ধরছেন?

আমি এব্যাপারে কিছু বলিনি।

বেশ। তুমি আজই হোটেল থেকে কে আউট করে ওঁর বাড়িতে চলে যাও। গিয়ে বলবে আমি তোমাকে ওঁর বাড়িতে থাকতে বলেছি। প্রয়োজন মনে করলে উনি আমাকে টেলিফোন করতে পারেন। আমার নাম্বারটা দিয়ে দিয়ো ওঁকে।

টেলিফোন রেখে অর্জুন একটু অখুশি হল। কারও বাড়িতে থাকার চেয়ে হোটেলে থাকার স্বাধীনতা অনেক। এই কেসের পাশাপাশি শহরটাকে ঘুরে দেখার সুযোগ পাওয়া যেত তা হলে। কিন্তু অমল সোম যখন বলছেন হোটেল ছেড়ে দিতে, তখন সেটা অমান্য করা সম্ভব নয়। বিকেলবেলায় সুটকেস নিয়ে সে চলে এল সল্ট লেকে।

বাড়ির সদর দরজা বন্ধ। আজ সকালেও দেখেছে লেটার বক্সের গায়ে লেখা রয়েছে ডক্টর কে, পত্ৰনবীশ। অমল নোম যে খাম দিয়েছিলেন তার ওপরও লিখেছিলেন ডক্টর কে. পত্ৰনবীশ। এই কে. অক্ষরের মানে কী, জানা হয়নি।

ভদ্রলোক এত প্রবীণ যে, নাম জিজ্ঞেস করতে কুণ্ঠা হয়েছিল।

অর্জুনকে অমল সোম সল্ট লেকের বাড়িতে থাকতে বলেছেন শুনে বৃদ্ধ খুশি হলেন। তখনই টেলিফোন নাম্বার নিয়ে তিনি জলপাইগুড়িতে এস টি ডি করলেন। অর্জুন দেখতে পেল অমল সোমের সঙ্গে কথা বলার সময় বৃদ্ধের মুখে বেশ খুশি-খুশি ভাব ফুটে উঠল। রিসিভার রেখে বললেন, যাক, ভালই হল। সকালে আমি নিজেই একথা বলব ভাবছিলাম। তুমি বলছি, আঁ, তুমি এবাড়িতে থাকলে আমার ভরসা বাড়বে।

কিন্তু আমি কতখানি উপযুক্ত তা আপনি জানেন না!

জানার দরকার নেই আর। মিস্টার সোম যখন সার্টিফিকেট দিয়েছেন। হা, গঙ্গাপদকে বলছি দোতলার ঘরে তোমার জন্যে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। আমি পাশের ঘরে থাকব। আর হ্যাঁ, ইদানীং আমি, নিরামিষ খাই। কোনও কারণ নেই, শুধু মাছ মাংস ডিমে অরুচি এসেছে বলেই খাই না। তুমি চাইলে ওগুলো গঙ্গাপদ বেঁধে দিতে পারে। বৃদ্ধ হাসলেন।

খাওয়ার ব্যাপারে আমার কোনও পছন্দ নেই। আচ্ছা, কিছু মনে করবেন।, আপনার নামের আদ্যক্ষরকে শব্দটা কী?।

কে, ফর ক্ষেমঙ্কর। নামটা আগে কোথাও দেখেছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ। রবীন্দ্রনাথের মালিনী নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র।

গুড। বাঃ। তোমার সঙ্গে আমার জমবে হে। কথা বলে যদি রেসপন্স পাওয়া যায় তা হলে তার চেয়ে সুখের আর কিছু হয় না।

সন্ধেবেলায় নিজের ঘরে বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল অর্জুন। শিয়ালদার কাছে আজ যেটুকু সময় ছিল, শুধু শব্দই কানে এসেছে। অথচ এখানে কোনও আওয়াজ নেই। চারাগাছের বাংলাতে থাকলে চারপাশের নিস্তব্ধতা যেভাবে চেপে বসে, সল্ট লেকেও যেন তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। একই শহরের দুটো আলাদা চরিত্রের কথা জলপাইগুড়িতে থাকার সময় অর্জুনের জানা ছিল না।

দরজায় শব্দ হতে অর্জুন মুখ ফিরিয়ে দেখল গঙ্গাপদ ট্রে নিয়ে ঢুকছে। তাতে চায়ের কাপ আর প্লেটে কিছু খাবার রয়েছে। সামনের টেবিলে ট্রে নামিয়ে গঙ্গাপদ মাথা নিচু করে দাঁড়াল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে?

না, আজ্ঞে, আপনি বলেছিলেন পরে কথা বলবেন!

অর্জুন চায়ের কাপ তুলল, তুমিই বলো।

আমি কী বলব বাবু। আমার কপাল ভাল না হলে বুড়োবাবুর দেখা পেতাম। পেটের দায়ে যে কাজ করেছি তা তো নিজের মুখে বলা যায় না। বুড়োবাবু আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

তাই? একাজ তো তুমি ইচ্ছে করলে আগেও জোগাড় করতে পারতে।

সত্যি কথা বলব বাবু?

বলো।

আজকাল আমার বয়সী লোককে কেউ বাড়ির কাজে রাখে না। তা ছাড়া তখন মনে হত অন্যের বাড়িতে গোলামি করব না।

সেটা তো এখন করছ।

সেদিন ধরা পড়ার পর বুড়োবাবু যখন আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন না, উলটে এ বাড়িতেই কাজের সুযোগ দিলেন তখন আমার চক্ষু খুলে গেল। এখানে যাকে বলে গোলামি তা আমাকে করতে হয় না। বুড়োবাবু আমাকে ছেলের মতো দেখেন।

কিন্তু তুমি এ বাড়িতে আসার পর থেকেই ডক্টর পত্ৰনবীশের দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে। তুমি নিশ্চয়ই জানো কিছু লোক ওঁর গবেষণার কাগজপত্র চুরি করতে চায়।

আমি সবকিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু এবার থেকে কেউ যদি আসে তা হলে তাকে আর এ-বাড়ি থেকে ফিরে যেতে দেব না।

তারাই যে তোমাকে এখানে পাঠায়নি তার প্রমাণ কী?

হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল গঙ্গাপদ। শব্দটা জোরে হওয়ায় নীচ থেকে মেয় তারস্বরে চেঁচাতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে গঙ্গাপদ জানাচ্ছিল সে এব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ জানে না, তাকে কেউ এখানে পাঠায়নি। দরকার হলে থানায় গিয়েও সে এ কথা জানাতে রাজি আছে। অর্জুন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। তার আশঙ্কা হচ্ছিল এখনই ডক্টর পত্ৰনবীশ এখানে হাজির হবেন। গঙ্গাপদ একটু শান্ত হলে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তোমার বুড়োবাবু এখন কোথায়?।

ছাদের ঘরে কাজ করছেন।

ঠিক আছে। আমি তোমার কথা বিশ্বাস করলাম।

গঙ্গাপদ চোখ মুছল, তারপর ঘর থেকে বের হয়ে গেল। গঙ্গাপদকে দেখতে পেয়ে মেয় বোধ হয় শান্ত হয়েছে, কারণ তার চিৎকার আর শোনা যাচ্ছিল না।

অর্জুন ভেবে পাচ্ছিল না কীভাবে এগনো যায়। ডক্টর পত্ৰনবীশের আশঙ্কা যদি সত্যি হয় তা হলে প্রতিপক্ষ নিজে যোগাযোগ না করলে অন্ধকারে ফুটবল-মাঠে আলপিন খোঁজার ব্যাপার হবে। সেই যোগাযোগ যতদিন না করে ততদিন চুপচাপ বসে থাকাও বেশ বিরক্তিকর। অর্জুন উঠে পড়ল। না বসে থেকে সল্ট লেকের সুন্দর রাস্তায় একটু হাঁটাহাঁটি করে এলে ক্ষতি নেই।

গঙ্গাপদকে দরজা বন্ধ করতে বলে অর্জুন রাস্তায় পা রাখল। ছবির মতো দেখাচ্ছে আলোয়-আলোয় চারধার। বাড়িটার উলটো ফুটপাথে পৌঁছে সে দেখতে পেল ছাদের ঘরে আলো জ্বলছে। ডক্টর পত্ৰনবীশ ওখানে কাজ করছেন। ওই নিরীহদর্শন মানুষটিকে দেখে কে ভাববে এই বাড়িতে বসে তিনি কী বিরাট আবিষ্কারের নেশায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। অর্জুন দুপাশে তাকাল। বেশিরভাগ বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ। রাস্তায় লোকজনও খুবই কম। অর্থাৎ এখানে যে যার মতো থাকেন।

খানিকটা এগিয়ে মোড় নিতেই সে কিছু সাজানো দোকানপাট দেখতে পেল। ওষুধের দোকানটায় বেশ ভিড়। আইসক্রিম পালার এবং সিগারেটের দোকানও রয়েছে। অর্জুন আর একটু এগোতেই একটা পার্ক দেখতে পেয়ে ঢুকে পড়ল। সন্ধে পেরিয়ে যাওয়ায় সম্ভবত পার্কে বাচ্চারা নেই। বড়দেরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। একটা খালি বেঞ্চিতে আরাম করে বসে সিগারেট ধরাল অর্জুন। এখন সারাদিনে গোটা দুয়েক সিগারেট খায় সে। সিগারেট শরীরের ক্ষতি করে জেনেও খায় বলে আজকাল অপরাধবোধ কাজ করে। কিন্তু খুব বিরক্তিকর সময়ে অথবা প্রচণ্ড টেনশনে সিগারেট ধরালে মস্তিষ্ক সাফ হয়ে যায় তার। এটা অবশ্য কখনও সিগারেটের সপক্ষে বিজ্ঞাপন নয়, তবু-।

হঠাৎ অর্জুনের নজরে পড়ল কেউ একজন অন্ধকারে মাটিতে উবু হয়ে বসে কিছু করছে। লোকটার বসার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে যে স্বস্তিতে নেই। একটু লক্ষ করে অর্জুন অনুমান করল লোকটা কিছু খুঁজছে। ওই অন্ধকার মাঠে পকেট থেকে কিছু পড়ে গেলে বেচারা কী করবে? একসময় লোকটা উঠে দাঁড়াল। চারপাশে তাকাল। তারপর গেটের দিকে এগিয়ে এল। ওকে যেতে হবে অর্জুনের বেঞ্চির পাশ ঘেঁষে। লোকটার একটা হাতের মুঠো যেন ইচ্ছে করেই আড়ালে রাখা। অর্জুন বেঞ্চিতে বসেই জিজ্ঞেস করল, পেলেন?

লোকটা হকচকিয়ে গেল, আঁ?

যা খুঁজছিলেন তা পেয়েছেন?

ও হা। পেয়েছি। ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকি, আশেপাশে তো শুধু বালি। এই পার্কে বালির ওপর মাটি ফেলা হয়েছিল বলে দুব্বো গজিয়েছে।

দুব্বো? মানে দূর্বাঘাস?

হ্যাঁ। লোকটা হাসল।

আপনি এতক্ষণ ঘাস খুঁজছিলেন? আমি ভাবলাম কী না কী? অর্জুন উঠে পাশে এসে দাঁড়াল, পুজোআচ্চা আছে বুঝি?

আরে না, না। ওসব কিছু নয়। অন্য কারণ—! আচ্ছা! লোকটা আর না দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল। এই ভঙ্গিটা খারাপ লাগল অর্জুনের। সে পার্কের বাইরে এসে দেখল লোকটা দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে এবং চলার সময় বারংবার আইনে বাঁয়ে তাকাচ্ছে। কোনও গোপন অপরাধ করলে মানুষ ওই ভঙ্গিতে হাঁটে। হাতে কোনও কাজ নেই, অর্জুন লোকটাকে অনুসরণ করল। বড় রাস্তা ছেড়ে লোকটা পাশের গলিতে ঢোকার সময় মুখ ফিরিয়ে পেছনে তাকাতেই অর্জুনকে দেখতে পেল। যদিও দূরত্ব অনেক তবু না দেখতে পাওয়ার কিছু নেই। দেখামাত্র লোকটা দ্রুত পা চালাল। অর্জুনের সন্দেহ আরও বাড়তে সে ব্যবধান কমাতে চেষ্টা করল। এবার লোকটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল।

কাছাকাছি পৌঁছে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনার কী হয়েছে বলুন তো?

আমার আবার কী হবে? আপনি কেন পেছন-পেছন আসছেন?

আপনি যেভাবে দৌড়চ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে কিছু লুকোচ্ছেন?

বেশ, যদি লুকিয়েও থাকি সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনার কী?

আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। অর্জুন হাসল।

দেখুন মশাই, আমার কোনও সাহায্যের দরকার নেই। আমি কিছু লুকোচ্ছি। আমার এই দুব্বো দরকার ছিল। বাড়ির কোনও পোষা জীবজন্তু অসুস্থ হলে তাকে দুব্বো খাওয়ালে ভাল কাজ দেয়। আচ্ছা ঝামেলা! বেড়ালকে অসুস্থ হলে দুব্বো খেতে দ্যাখেননি? এবার কেটে পড়ন। লোকটার মুখচোখ শক্ত হয়ে গেল।

অর্জুন হেসে ফেলল। একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে বেশ নাটক করা গেল। এতে সন্ধেটা মন্দ অটল না। সে পেছন ফিরে কয়েক পা যেতেই ফুচকাওয়ালাকে দেখতে পেল। মোড়ের একপাশে আলো জ্বেলে ফুচকা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে এক বৃদ্ধ পাতায় দেওয়া ফুচকা গালে পুরছেন একটার পর একটা। তাকে দাঁড়াতে দেখে ফুচকাওয়ালা বলল, দেব বাবু? টাকায় দুটো। ফাস্ট ক্লাস জিনিস। এই বুড়োবাবুকে জিজ্ঞেস করুন। রোজ এই সময় উনি পাঁচ টাকার ফুচকা খান।

খাই কি সাধে? ডাক্তারের নিষেধে বাড়িতে সেদ্ধ ছাড়া সব নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। নইলে এ-জিনিস মুখে তুলতাম না আগের দিনে। বেশিদূর হাঁটতেও পারি না যে, কোনও রেস্তরাঁতে বসে খাব। এ-পাড়ায় মনে হচ্ছে নতুন। বৃদ্ধ খাদ্যবস্তু গলা দিয়ে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। কাছে এসে দেখলেই বোঝা যায় ভদ্রলোক মোটেই সুস্থ নন।

আমি আজই এসেছি। ডক্টর পত্ৰনবীশের বাড়িতে উঠেছি।

সে আবার কে? এ-পাড়ায় তো ওনামের কেউ নেই। আমি এই ব্লকের প্রেসিডেন্ট, আমার অজানা কেউ তো এখানে নেই।

আজ্ঞে, উনি এ-পাড়ায় থাকেন না।

অ। তাই বলো। তা ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে কী কথা হচ্ছিল?

ফোটোগ্রাফার?

আঃ। যার সঙ্গে এইমাত্র কথা বললে?

উনি পার্ক থেকে দূর্বাঘাস নিয়ে এলেন। ওঁর কোনও পোষা প্রাণী অসুস্থ। দূর্বাঘাস খেলে সেটা বোধ হয় সুস্থ হয়ে যায়।

কী যা-তা বলছ। তা হলে তো পৃথিবীর সব প্রাণী ওষুধপত্র ছেড়ে দূর্বাঘাস খেত। পশু চিকিৎসকদের ব্যবসা লাটে উঠে যেত। তা ছাড়া ফোটোগ্রাফারের বাড়িতে কোনও পোষা প্রাণী আছে বলে তো শুনিনি।

ভদ্রলোককে আপনি চেনেন?

বিলক্ষণ। ও যে বাড়িতে আছে সেটা ছিল ডক্টর হালদারের। ওঁর ছেলেমেয়ে দুটোই আমেরিকায় থাকে। বছরখানেক হল ডক্টর মারা গিয়েছে। মা এখানে একা কী করে থাকবে তাই ছেলে এসে নিয়ে গেছে নিজের কাছে। মাসদেড়েক আগে মেয়ে আবার এসেছিল। দুদিন থেকে চলে যাওয়ার সময় ওই ফোটোগ্রাফারকে বসিয়ে গেল কেয়ারটেকার হিসেবে। গোপনে ভাড়া নেয় কিনা জানি না। তবে ফোটোগ্রাফার একাই থাকে। একদিন আলাপ করেছিলাম। বিয়ে-থা করেনি। বিদেশে ছিল বলে বাড়ির সব কাজ নিজের হাতে করে। কাজের লোক রাখেনি। বৃদ্ধ বললেন, অ্যাই, আমার ফাউটা দে।