• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

১০৩. বিশাখার বিবাহ

লাইব্রেরি » শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » উপন্যাস (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » দূরবীন - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » ১০৩. বিশাখার বিবাহ

“বিশাখার বিবাহই বোধহয় আমার জীবনের শেষ শুভ কাজ। কারণ, আমার কনিষ্ঠ পুত্র কৃষ্ণকান্তর বিবাহ আমি দিয়া যাইতে পারিব বলিয়া ভরসা করি না। স্বদেশি ও সন্ন্যাসী কৃষ্ণকান্ত আপাতত ঢাকার পথে। সেখানে সে আত্মসমর্পণ করিবার পর কী হইবে তাহা ঠাকুর জানেন। ফাঁসি যদি নাও হয় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর কি ঠেকানো যাইবে? লক্ষণ দেখিয়া বুঝিতেছি, তাহাকে বেশ কিছুদিন হাজতবাস করিতে হইবে। সে গেল এক কথা। তাহার উপর পুত্রের মতিগতি দেখিয়া বুঝিতেছি, সংসারধর্ম পালন করিবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তাহার নাই এবং অদূর ভবিষ্যতে হইবেও না। আমার আয়ুর বেষ্টনী দিয়া আমি আর তাহার জন্য বিশেষ কিছু করিতে পারিব বলিয়া মনে হয় না। তাই ধরিয়া লইয়াছি, বিশাখার বিবাহই আমার জীবনের শেষ শুভ কাজ। কাজটি নির্বিঘ্নে সমাধা হয়, ইহাই আমার ইচ্ছা।

“এই কাজে বাধা পড়িলে মর্মপীড়ার কারণ হইতেই পারে। আমার প্রতি পুত্র, কন্যা ও পুত্রবধূদের বিরাগের ভাবটি তাহারা গোপন রাখে নাই, স্পষ্টভাবেই প্রকাশ করিয়াছে। মনুর প্রতি আমার গোচরে ও অগোচরে আরও কত লাঞ্ছনা বর্ষিত হইতেছে তাহা জানি না। মনুও আমাকে। খুলিয়া বলিবে না। কিন্তু সংসারের বদ্ধ জলাশয়ে সফরীর ন্যায় ক্ষণ ও ক্ষুদ্রজীবী এইসব আত্মীয়েরা যে আমার সত্তা, আমারই শোণিত ধারণ করিয়া আছে তাহা ভাবিলে নিজের প্রতিই ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করে। আমি অপরাধ যদি-বা করিয়া থাকি তাহার দণ্ড বিশাখাকে পাইতে হইবে কেন?

“অপটু শরীর লইয়াই উঠিলাম। ঘুরিয়া ঘুরিয়া বিবাহের আয়োজন দেখিতে লাগিলাম। পুবের চওড়া বারান্দায় কনককান্তি পুরোহিতের সামনে বসিয়া বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ করিতেছে। নীচের উঠানে জেলেরা মস্ত মস্ত মাছ আনিয়া ধড়াস ধড়াস করিয়া ফেলিতেছে। বিশাল আকৃতির ঝকঝকে বঁটিতে তাহা চোখের পলকে খণ্ড বিখণ্ড হইয়া ঝুড়িতে তূপাকৃতি হইতেছে। উঠানে, বাহিরের মাঠে শামিয়ানা টাঙানোর শেষ পর্ব চলিতেছে। ফটকের উপর নহবৎখানায় সানাই বাজিয়া চলিয়াছে। বাহির হইতে দেখিলে কোনও গণ্ডগোল নাই, সবই সুশৃঙ্খলভাবে চলিতেছে। এস্টেটের পুরাতন ও বিশ্বস্ত কর্মচারীরা বুক দিয়া খাটিতেছে এবং তত্ত্বাবধান করিতেছে। গোরুর গাড়ি করিয়া কত যে জিনিস আসিতেছে তাহা হিসাব করিতে পারি না। তবু এইসব আয়োজনের আড়ালে একটা উলটা ধারাস্রোতও বহিতেছে। স্ত্রী-আচার হইতেছে না, বা প্রতিবেশিনী কতিপয় স্ত্রীলোকের উদ্যোগে ক্ষীণভাবে হইতেছে। উলুধ্বনি শোনা যায় না। গাত্র-হরিদ্রার উদ্যোগ নাই। বিশাখা সম্ভবত একা ঘরে বসিয়া অশ্রুবিসর্জন করিতেছে। মনুর মাকে ছোটাছুটি করিতে দেখিলাম, কিন্তু সে মনুর মা বলিয়াই মহা অপরাধী। তাহাকে কে আমল দিবে?

“জীমূত কোথায় গিয়াছে জানি না। হয় কাজেই কোথাও গিয়াছে বা কাজের নাম করিয়া গা-ঢাকা দিয়াছে। জামাই বাবাজীবনদেরও পাত্তা নাই।

“হতাশভাবে কাছারির বারান্দায় দুর্বল শরীরে বসিয়া পড়িলাম। একজন বৃদ্ধ কর্মচারী শশব্যন্তে আগাইয়া আসিয়া কহিল, কর্তাবাবু, একখানা চেয়ার বের করে দিই?

“মাথা নাড়িয়া কহিলাম, চেয়ারের দরকার নাই। শোন, আমার বাড়িতে এয়োর কাজ করার লোক নেই। আমি চাই, এস্টেটের কর্মচারীরা প্রত্যেকেই নিজের স্ত্রী, মা এবং বয়স্কা আত্মীয়াদের এখনই নিয়ে আসুক। এটা আমার দায় বলে জেনো। এ দায় উদ্ধার করতেই হবে।

“সে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। কহিল, যে আজ্ঞে।

“আমি আবার কহিলাম, বেশি দেরি যেন না হয়।

“সে অনুগতের মতো মাথা নাড়িয়া কহিল, যে আজ্ঞে।

“সে চলিয়া গেল। আমি ক্লান্তভাবে বসিয়া রইলাম। এয়োর অভাব হইবে না, কিন্তু তবু মন শান্ত হইতেছে না। পাড়া-প্রতিবেশী দিয়া কি সব কাজ হয়?

“ক্লান্তির ভার লইয়াই উঠিলাম। অন্দরমহলে এক দাসীকে দিয়া আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা সবিতার কাছে এত্তেলা পাঠাইয়া নিজের ঘরে বসিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।

“থমথমে মুখ লইয়া সবিতা আসিল। চক্ষু নত রাখিয়া বলিল, ডেকেছেন?

“হ্যাঁ। তোমরা সব কী করছ? এত বড় আয়োজন, একটু দেখাশোনা করার লোক নেই!

আমরা তো দেখাশোনা করতেই চাই। কিন্তু মানমর্যাদা বলেও তো একটা কথা আছে।

তার অর্থ কী? তোমাদের মানমর্যাদার হানি হল কীসে?

আপনি অসুস্থ ছিলেন, তাই জানেন না। আমরা এসে অবধি দেখছি এ বাড়িতে একজনেরই আধিপত্য। আমরা যেন কেউ কিছুই নই।

সেই একজন কি মনু?

পুরুতের মেয়েকে আস্কারা দিয়ে আপনি মাথায় তুলেছেন। চিরকাল আমাদের এঁটোপাত কুড়িয়ে ওদের সংসার চলেছে। কাঙালকে শাকের খেত দেখালে যা হয়।

সে কি তোমাদের কোনও অমর্যাদা করেছে?

অনবরতই করছে। আপনি তাকে ঘরে স্থান দিয়েছেন শুনেছি, কিন্তু সে কোন অধিকারে ঘরে ঢোকে তা আমাদের জানা নেই।

অধিকার তার একটু আছে।

আমরা তা কী করে জানব? আপনি তাকে বিয়ে করেছেন বলে সে শতমুখ করে লোকের কাছে বলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বিয়ের কোনও সাক্ষী নেই, নিমন্ত্রণপত্র নেই, শহরের লোকেও বিয়ের খবর কেউ রাখে না। সুতরাং লোকে যা খুশি তা বলে বেড়াচ্ছে। পাঁচজনের কাছে আমরা মুখ দেখাতে পারছি না।

তোমরা কি এখানে আসবার আগে খবর পাওনি?

আপনি কি আমাদের জানিয়েছেন?

জানাইনি ঠিকই, তবে–

আপনি একজন নষ্টচরিত্রের মেয়েমানুষকে ঘরে ঠাঁই দেবেন জানলে আমরা বিশাখার বিয়েতে আসতাম না। আপনার জামাইরাও অত্যন্ত লজ্জায় পড়েছেন।

“নিজেকেই কহিলাম, ধীরে রজনী ধীরে। উত্তেজিত হইয়া লাভ নাই, ক্রুদ্ধ হইলে ব্যাপার আরও বহুদুরে গড়াইবে। কিন্তু বাহিরে ক্রোধ বা উত্তেজনা প্রকাশ পাইতে না দিলেও আমার ভিতরে ঝড় বহিতেছিল। বুকে আবার চাপ ও মৃদু বেদনা অনুভব করিতেছি। সম্মুখে দাঁড়াইয়া আমারই তো কন্যা, ইহার শিরায় আমারই রক্ত প্রবহমান। এত কঠিন কথা ইহার মুখ হইতে বাহির হইল কীরূপে?

“মৃদুস্বরে কহিলাম, তোমার কথার জবাব দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। তবে মনুকে নিয়ে তোমরা আন্দোলন কোরো না। তাকে আমি অগ্নি ও শালগ্রাম সাক্ষী রেখেই বিয়ে করেছি। কিন্তু তার বিচার পরে হতে পারবে। বিশাখার বিয়ে তো আর ফিরে আসবে না।

আমাদের আপনি কী করতে বলেন?

ব্যাপার বাড়িতে কত কাজ!

বললাম তো, কাজ করতে আমাদের কেউ ডাকেনি। আপনার মনুই যখন সব দিক সামলাচ্ছে, তখন আমাদের আর কীসের দরকার?

বউমাদেরও কি তাই মত?

জানি না। আপনি তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। তবে আমি আজই শ্বশুরবাড়ি রওনা হয়ে যাচ্ছি। সেখানেও এসব কেলেঙ্কারির কথা পৌঁছবে। কী করে যে শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে মুখ দেখাব তা জানি না।

বিশাখার মুখের দিকে চেয়েও আজকের দিনটা থাকতে পারবে না?

কারও মুখের দিকে চাইতেই আর প্রবৃত্তি নেই। এ বাড়িতে পা দেওয়াই পাপ। বংশের মুখে এমন চুনকালি পড়বে তা জানতাম না।

“আজ আমি আর সেই হেমকান্ত নাই যে অল্প আঘাতেই আহত হইবে! নানা দাগা খাইয়া পরিণত বয়সে আজ আমি একটু শক্তপোক্ত হইয়াছি। কিন্তু আমার বুকের ব্যথাটা চাগাড় দিতেছে। রক্তচাপ বাড়িতেছে। চেয়ারের হাতলটা শক্ত করিয়া ধরিয়া কহিলাম, যদি যেতে হয় তবে যাবে। আমি আটকাব না। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম তোমাদের অসহযোগিতাটা কেন? এখন জেনে নিশ্চিন্ত হয়েছি।

“সবিতা বিনা বাক্যব্যয়ে চলিয়া গেল। আমি একাকী বসিয়া আকাশপাতাল ভাবিতে লাগিলাম। শরীরটা বড় দুর্বল লাগিতেছে। মাথাটা ঘুরাইতেছে। চোখে অন্ধকার দেখিতেছি। বারান্দায় কাহার পদশব্দ পাইলাম। ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকিলাম, ওরে, কে আছিস? মনুকে একটু খবর দে।

“খবর দিতে হইল না। মনু নিজেই সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। পরনে চওড়া লালপেড়ে গরদ। মুখোনি উপবাসে ক্ষীণ, তবু জ্যোতির্ময়ী। হাতখানা বাড়াইয়া দিয়া কহিলাম, আমার শরীর আবার খারাপ লাগছে।

“মনু আসিয়া আমাকে ধরিল। তারপর আর কিছু মনে নাই।

“মরিবার আর-একটি মাহেন্দ্রক্ষণ নিকটে আসিল। কিন্তু মরিলাম কই? মানুষ কখন মরিবে তাহার কোনও স্থিরতা নাই। কিন্তু আমার মনে হইতেছে ঠিক সময়ে মরিতে পারাটাও এক মস্ত বড় সাধনার বস্তু। আমরা মরিতে জানি না।

“যখন জ্ঞান ফিরিল তখন আমার চারিদিকে ভিড়। ডাক্তার গম্ভীর মুখে বসিয়া আছে। বুক কাঁপাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস বাহির হইয়া গেল।

“কে প্রশ্ন করিল, কেমন আছেন?

“কহিলাম, ভাল। বেশ ভাল। প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে।

“ডাক্তার কহিল, প্রায়শ্চিত্ত আপনার একার কেন? আমাদেরও। এবার বলুন তো কী হয়েছিল? কিছু না। বসে ছিলাম। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেল। এখুনি ঠিক হয়ে যাবে।

হলে ভাল। মনে রাখবেন, আপনার শরীরে দু-দুটো ফেটাল অসুখ। ব্লাডপ্রেশার আর হার্ট ট্রাবল। কোনওরকম রিস্ক নিলে কিন্তু বিপদে পড়বেন।

আমার তো এসব রোগ কোনওদিন ছিল না, ডাক্তার।

শরীরং ব্যাধিমন্দিরম্‌। শরীর থাকলে রোগ ভোগ আছেই। একটু সাবধানে থাকবেন।

“বিছানার চারদিকে জমায়েত লোকজনের মধ্যে হঠাৎ সবিতাকেও দেখিতে পাইলাম। সে এখনও যায় নাই। সর্পিল কঠিন এক চোখে আমার দিকে চাহিয়া আছে। আমার মৃত্যু কামনা করিতেছে কি? আহা, তাহার বাসনা কেন যে ঈশ্বর পূরণ করিলেন না!

“ডাক্তার বলিল, আপনার এখন ফুল রেস্ট দরকার। বিশাখার বিয়ে না হলে আমি ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে যেতাম। তা অবশ্য করছি না। কিন্তু এখন ঘণ্টা কয়েক আপনি একদম নড়াচড়া করবেন না। বিয়ের সময়ে আপনাকে ধরাধরি করে আসরে নিয়ে যাওয়া হবে। খবরদার সিঁড়ি ভাঙবেন না কিন্তু। শরীর খারাপ বোধ করলেই শুয়ে পড়বেন এসে।

ঠিক আছে, তাই হবে।

“ডাক্তার চলিয়া যাইবার আগে সকলকে সাবধান করিয়া গেলেন, কোনও কারণেই যেন আমাকে বিরক্ত করা না হয়। এই সাবধানবাণী শুনিয়া ধীরে ধীরে সকলে বাহির হইয়া গেল। রহিল শুধু মনু। সে যথারীতি আমার মাথায় হাত বুলাইতেছিল।

“আমি কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়া মটকা মারিয়া পড়িয়া রহিলাম। বুকে ক্ষীণ হইলেও ব্যথাটা আছেই। রক্তের চাপও যে বেশি তাহাও অনুভব করিতেছি। চোখ বুজিয়াই ডাকিলাম, মনু।

বলো।

আমরা কবে কাশী যাব?

যেদিন তুমি যেতে চাও।

আমি তো আজই যেতে চাই।

আজ তো আর হয় না। বউভাত মিটে যাক, তার পরেই।

আজ যে হয় না তা জানি। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

এখন একটু চুপ করে শুয়ে থাকে। কথা পরে হবে।

না, জরুরি কথা।

বলো।

আমরা বিয়েটা না করলে কী হত?

কেন গো? কেউ কিছু বলেছে?

তোমাকেও তো বলে।

আমাকে বলে বলুক। তোমাকে বলেছে কি না বলো।

বলেছে।

কে? সবিতা নাকি?

তুমি কী করে জানলে?

কালীবাড়ি থেকে ফিরে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দেখলাম সবিতা ঝড়ের বেগে নেমে যাচ্ছে। এসে দেখি তোমার এই অবস্থা।

“চুপ করিয়া থাকিয়া কিছুক্ষণ পরে বলিলাম, ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ আমাদের, মনু।

দোষ! দোষ হবে কেন? ওসব কথা ভেবো না। যত ভাববে ওর থই পাবে না। ঘুমোও। মাথাটাকে একটু ক্ষান্তি দাও।

আজকের দিনটায় ওরা যদি কেউ বিয়ের উৎসবে যোগ না দেয় তাহলে কেমন দেখাবে, মনু? লোকে ভাববেই বা কী?

আবার কথা বলছ! ডাক্তারবাবু কী বলে গেলেন মনে নেই?

ডাক্তার কি আর ঘরের কথা জানে? ওরা চোখ বুজে নিদান দেয়, বিশ্রাম করুন, ঘুমোন, ভাববেন।

কী বলব বলো? তোমাকে সান্ত্বনা দিতে পারি এমন কথা আমার জানা নেই। তবে আমার একবারও মনে হয়নি যে বিয়ে করে আমরা ভুল করেছি।

ভুল যে করিনি তা বুঝিয়ে দিতে পারো?

পারি। তবে কথা দিয়ে নয়। কথায় কি সব হয় গো? তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, যতদিন বাঁচব ততদিন ধরে তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করব যে, বিয়ে করে আমরা একটুও ভুল করিনি।

“আজ কাশীতে বসিয়া অনেক বিলম্বে সেদিনের কথা লিখিতেছি। লিখিতে লিখিতে মনটা স্নিগ্ধ হইতেছে। আজ আমারও মনে হয়, কিছুমাত্র ভুল করি নাই। মনুকে বিবাহ করিয়া আমি ঠিকই করিয়াছি। বঙ্কিমবাবুর সেই লাইনটি মনে পড়িতেছে, আমরা একই বৃন্তের দুটি ফুল। চন্দ্রশেখর একটু ফুল ছিড়িয়াছিলেন। আমার ক্ষেত্রে পুস্পটি বড় বিলম্বে ফুটিয়াছে।

“বিবাহসভায় ঘটা হইয়াছিল মন্দ নহে। আমার বিরূপ আত্মীয়স্বজনেরা কিছু নিষ্প্রভ ছিল। কিন্তু অভ্যাগতের সমাগম আমার কলঙ্ক সত্ত্বেও বড় কম হয় নাই। সামনের উঠানটিতে ভিড় উপচাইয়া পড়িতেছিল। বিবাহবাসরের একপার্শ্বে কয়েকখানা চেয়ারে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সমাসীন। গোলাপজল ও আতরের গন্ধে চারিদিক ম ম করিতেছে। কলকোলাহলে অনুষ্ঠান পরিপূর্ণ। ভিতরে ভিতরে কীটের দংশন হয়তো ছিল।

“রাজেনবাবু আমার পাশেই উপবিষ্ট ছিলেন। হঠাৎ নিম্নস্বরে কহিলেন, আপনার আত্মীয় কুটুম্বরা বোধহয় খুব খুশি নন?

না। খুশি হওয়ার কথাও নয়।

“রাজেনবাবু মাথা নাড়িয়া কহিলেন, জানি। বুঝিও সব। আপনার এই অপমানের জন্য আমি নিজেও খানিকটা দায়ী।

ও কিছু নয়। সংসার বিচিত্র জায়গা।

তা বলে আমি নিজেকে অপরাধী ভাবছি না। রঙ্গময়ীর সঙ্গে আপনার বিয়ে হওয়াটার পিছনে একটা কারণ ছিল।

আপনি তো আমাকে তাও বলেছেন।

আপনার আত্মীয়দেরও কারণটা আমি বুঝিয়ে বলতে চাই।

তার দরকার কী? ওরা বুঝতে চাইবে না।

“রাজেনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া কহিলেন, সে কথাও ঠিক। এ সংসারে যে যার নিজের সুবিধেমতো ঘটনাবলীর অর্থ বা ব্যাখ্যা করে নেয়। আমরা আমাদের মতো ব্যাখ্যা করেছি। ওরা ওদের মতো করবে। কিন্তু আমি ভাবছি, আপনার মানসিক চাপের কথা। আপনাকে অনেক সইতে হচ্ছে তো! শরীরটাও তাই বোধহয় খারাপ!

শরীর সেরে যাবে। এখন ভালই আছি। আমার কোনও অনুশোচনা নেই।

“রাজেনবাবু একটু কী ভাবিলেন। তারপর বলিলেন, শচীনকে আপনি কতটা চেনেন জানি না। তবে বলি ওর চিন্তা ভাবনাগুলো আমাদের মতো নয়। খুব আধুনিক ধ্যানধারণার ছেলে। দৃষ্টিটাও স্বচ্ছ। আপনার সঙ্গে যে রঙ্গময়ীর বিয়ে হওয়াটাও দরকার তা ওই আমাদের বুঝিয়ে দেয়।

আপনার ছেলেটি রত্নবিশেষ। আপনাদেরই আশীর্বাদ।

“সেদিন রাজেনবাবুর উক্তি বড় স্বাদু লাগিয়াছিল। রাজেনবাবু আমাদের ত্যাগ করেন নাই। তিনি সমর্থন জানাইয়াছেন, মন্দার বাজারে সেইটুকুরই তো অনেক দাম।

“অনেক রাতে শয্যাগ্রহণ করিলাম। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ ঠাসিয়াছে। মনু তখনও আসে নাই। একাই ঘুমাইয়া পড়িলাম। ঘুম ভাঙিল মাঝরাতে। আমার পাশে শুইয়া অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া মনু ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছে। মনুকে ইদানীং কাঁদিতে দেখি নাই। তাহার কান্নার রকমটাই জানি না।

মনু, কাঁদছ কেন?

ওরা তোমাকে ওরকম করে কেন?

কারা কীরকম করে?

তোমার ছেলেমেয়েরা?

করুক। তুমিই তো বলেছ ওসব গ্রাহ্য না করতে।

বলেছি, কিন্তু তুমি তো আর সে কথা শুনছ না!

শুনছি তো। আর ভাবছি না।

তোমার শরীর ভাল নেই, জেনেও ওরা কেন যে–

তুমি কেঁদো না, মনু। তুমি কাঁদলে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়।

সেই জন্যই তো লুকিয়ে কাঁদছিলাম।

লুকিয়েও কেঁদো না। স্বামী-স্ত্রীর দুজনের মধ্যে একজনকে অন্তত শক্ত হতেই হয়।

সব মানি। কিন্তু ওদের কথায় তোমারও সন্দেহ হচ্ছে আমাকে বিয়ে করে ভুল করেছ কি না!

সন্দেহ নয়, মনু। ভুল যে করিনি তার একটা অ্যাসুয়ারেন্স তোমার কাছ থেকে পেতে চাইছিলাম।

তোমার সন্দেহ হলে আমারও যে পায়ের তলায় মাটি থাকে না।

কাশী কবে যাচ্ছি আমরা?

কবে যেতে চাও?

দ্বিরাগমনের পর চলো।

তাই হবে।

শচীনকে সব বুঝিয়ে দিতে কদিন সময় লাগবে।

“আর দুজনের ঘুম হইল না। সারা রাত্রি আমরাও নানা কথা কহিয়া একরকম বাসর জাগিলাম।

“বউভাতের জন্য কেহ অপেক্ষা করিল না। বিবাহের পরদিনই আত্মীয়রা বিদায় লইল। কুটুষেরা কিছু রহিল। কিছু গেল। তবে বাড়ি অনেক ফাঁকা হইয়া গেল।

“দ্বিরাগমনের পর একদিন শচীনকে ডাকাইয়া উইল পাকা করিলাম। স্থাবর-অস্থাবর সমুদয় সম্পত্তিই পাইবে কৃষ্ণকান্ত। আপাতত শচীন কেয়ারটেকার থাকিবে। যদি কৃষ্ণকান্ত দখল না লয়

তবে জ্যেষ্ঠ দুই পুত্রের উপর সকল সম্পত্তি বৰ্তাইবে।

“আর এই জায়গা ভাল লাগিতেছিল না। সব বন্ধন যেন ছিন্ন হইয়াছে। একদিন শুভ লগ্ন দেখিয়া আমি ও মনু কাশী রওনা হইলাম।

“ইহাই বনগমন কি না জানি না। বন মানে তো বৃহৎ। পৌরাণিক আমলে বৃদ্ধবয়সে বৃহৎ সংসারের অর্থাৎ দেশ ও দশের সেবায় আত্মনিয়োগ করা বিধি ছিল। জঙ্গলে যাওয়ার বিধান বলিয়া অনেকে ভুল করেন। যাহা হউক, আমার এই কাশী গমনটি জঙ্গল বা বৃহৎ কোনওটাতেই গমন নয়, ইহা কেবল পলায়ন।

“আজ কাশীর উত্তরবাহিনী গঙ্গার ধারে আমাদের নাতিবৃহৎ বাড়ির দ্বিতলে জানালার পাশে বসিয়া এই ডায়েরি লিখিতে লিখিতে মনে হইতেছে, জীবনটা বড়ই করুণ-মধুর।

“পৃথিবীতে আমার কোনও কীর্তি নাই, বৃহৎ ত্যাগ নাই, যশ নাই। আমি একরূপ আত্মগোপনকারী পলায়নবাদী কাপুরুষ মানুষ। কিন্তু মানুষ তো এক প্রজন্মের নহে। সে যেমনই হোক তাহার উত্তরাধিকারী, বংশপরম্পরার ভিতর দিয়া তাহার রেশ চলিতে থাকে। পুত্রের ভিতর দিয়া পিতাই তো জন্ম লাভ করে। আজ মনে হইতেছে আমি যদি কৃষ্ণকান্তর ভিতরে একটুখানিও জন্ম লইয়া থাকি তবেই জীবন সার্থক হইবে।

“খবরের কাগজে আকস্মিকভাবে একদিন কৃষ্ণকান্তর নাম দেখিতে পাইলাম। স্বদেশি নেতা কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী বিচারে দোষী সাব্যস্ত হইলেও তাহার তরুণ বয়সের কথা বিবেচনা করিয়া মাত্র পাঁচ বৎসর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হইয়াছে।

Category: দূরবীন - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ১০২. দরজা খুলে বৃদ্ধা
পরবর্তী:
১০৪. গুজবটা কী করে ছড়াল কে জানে »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑