৮. হে অর্জুন

হে অর্জুন

ঢাকা জেলায় আমাদের গ্রামের কথা মনে এলেই চোখের সামনে একটা অ্যাবস্ট্রাকট্ ছবি ফুটে ওঠে। আগাগোড়া সুবজ রঙ দিয়ে আঁকা। নানারকমের সবুজ থাকে-থাকে সাজানো। অনেকটা নাম-করা আধুনিক মার্কিনী আর্টিস্ট মার্ক রথকো- র আঁকা ছবির মতো। এক কথায় বলা যায় একটা সবুজের সমুদ্র। ভরা বর্ষা আর বসন্তে মনে হ’ত যেন সারা গ্রামটা এইমাত্র সবুজ আলোর পুকুরে ডুব দিয়ে উঠেছে। সব-কিছু যেন একটা সবুজ কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখছি, যেন সব-কিছু সবুজ সেলোফিনে মোড়া। কোনো-কোনো অচেতন মুহূর্তে মনে হয় যেন সুর্যটিও সবুজ। রোদের রঙটাও সবুজ। চারিদিকে এমনই সবুজের ছটা। আকাশের নীলের তলায় গাছপালার সবুজ, তার তলায় জলের নীল-সবুজ, পলিমাটির ছাই রঙের ওপর ঘাসের সবুজ, শ্যাওলার সবুজ, কচুরিপানার সবুজ, কচুপাতার সবুজ-কালো-সবুজ, নীল-সবুজ, গাঢ়-সবুজ, হলদে-সবুজ, এমারেল্ড-সবুজ, ওনিক্সি-সবুজ, টাকোয়াজি- সবুজ, চীনাজেডি-সবুজ, সবুজ-সবুজ, আরো-সবুজ–এক সবুজের সিম্‌ফনি। আঃ! সব ইন্দ্রিয়গুলো যেন সবুজের সংগীতে ঘুমিয়ে পড়ে।

আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানার মধ্যে নানারকম গাছপালায়ও এই সবুজের ছড়াছড়ি। আম-জাম-কাঁঠালে, জারুল-জিয়লে, জামরুল আর তেঁতুল, গা–কদম- ডুমুরে, চাতা, আর ফলসায়, কনকচাঁপা আর ডালিমে, সুপারি আর নারিকেলে–আরো যে কত অসংখ্য লতাপাতায়, তার হিসেব করা কঠিন। কিন্তু এদের সবাইকে বামন বানিয়ে ছাপিয়ে উঠেছিল আমাদের পুকুরের উত্তর-পুব কোণে একটা অৰ্জুন গাছ। জাতে ছিল সে বনস্পতি। এত বড়ো আর বিশাল যে, সে ছিল একাই একশো, একাই একটা বন।

জীবজগতের মতো গাছপালার জগতেও বোধহয় পুরুষ আর স্ত্রী আছে-কতকগুলো গাছ আছে যার ডাল-পাতায় সজ্জা, ফুলের চেহারা, গন্ধ, রঙ, সব মিলিয়ে খুব সাজগোজ করা সুন্দরী মেয়েদের কথা মনে করিয়ে দেয়। একটু হাওয়া লাগলেই কী রকম নাচের তালে দুলতে থাকে। ভরাযৌবনা মেয়েরা যেমন নিজের স্তনের ভারে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, এ-ধরনের গাছগুলোও তাদের ফলফুলের সম্ভারে তেমনি নুয়ে পড়ে। ওই তো। আমার ছাদে রক্ত-করবীটা বসন্তের হাওয়ায় কীরকম নাচছে আর ফুলের ভারে কীরকম ঝুঁকে পড়ছে। প্রায় ছাদ ছোঁয় আর-কী। আরো ওই-যে কলকে ফুলের গাছটা। সাদা-সাদা ফুলের ছাপ দেওয়া সবুজ শাড়ির ঘোমটা মাথায় লজ্জাবতী নতুন বউয়ের মতো মাথা নিচু ক’রে আছে! আর চালতা গাছের পাতাগুলোই-বা কী বাহারের। কে যেন একটা-একটা ক’রে ফুলের তোড়ার মতো সাজিয়ে রেখেছে। কী সুন্দর ইস্ত্রি-করা পাতার ভাঁজ। তেমনি তার শিরদাঁড়াগুলোর নিখুঁত সিমেট্রি। আর পাতার রঙটিই-বা কী চমৎকার–একেবারে খাঁটি ভ্যাট্-সিটিনাইন্ বোতলের মতো গাঢ় সবুজ। আজারবাইজান নর্তকীর ফিনফিনে ওড়নার মতো কচি কলাপাতার কিংবা নিমপাতার ভেতর দিয়ে ভোরবেলার শরতের মোলায়েম সোনালী আলো কীরকম চুঁইয়ে আসে, একটু হাওয়া লাগলেই কী চমৎকার সবুজ-হলদে ঝাড়লণ্ঠনের মতো ঠিকরে পড়ে–যত খুশি তাকিয়ে থাকি কিছুতেই ক্লান্তি আসে না।

আর ওই-যে দূরে হলদে রঙের বাড়িটার পাশে নারকেল গাছটা দেখা যাচ্ছে, তার পাশে ঠিক ঐ রকম আর-একটি ছিল। হাওয়ার সাথে ছন্দ রেখে নাচ দেখাতে ওর জুড়ি এই শহরে খুবই কমই ছিল। কালবৈশাখীর জন্যে সারা বছর যেন ব’সে থাকত। যেই-না ঝড় ওঠা তাকে আর ধ’রে রাখে কে? একবার এমনি এক ঝড়ের সন্ধ্যায় সামনে, পেছনে, নুয়ে-নুয়ে দোল খেতে-খেতে মটাশ্ ক’রে হঠাৎ ভেঙে দু- টুকরো হয়ে পড়ে গেল। ছোটোবেলায় আমাদের দাই জামিলার মা’র কাছে তখনকার ঢাকার সবচেয়ে নাম-করা বাঈজি সুন্নত্বাঈর আশ্চর্য নাচের গল্প শুনেছি। ময়ূরীর গলার মতো সরু আর তেমনি নিটোল তার শরীর, হরিণীর মতো ত্রস্ত আর তেমনি ছিল তার চলন। হাড়গোড় বলতে কিছুই ছিল না। শরীরটাকে যেমন খুশি বাঁকাতে পারত। একবার জন্মাষ্টমী উপলক্ষে শহরের বিত্তবান্ গন্ধবণিক নিমাইচাঁদ সাহার মলিসে জয়সালমিরের কোনো নাম-করা বাঈজিকে ডাকা হয়েছিল। গোটা ঢাকা শহরে হৈ-হৈ-রৈ-রৈ ব্যাপার। তাই শুনে সুন্নত্বাঈ তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। একই আসরে দু-জনকে নাচবার দাওয়াত্ দেওয়া হ’ল। সুন্নত্বাঈ কিছুতেই রাজি হয় না, নানারকম নখ়াবাজি করে। তারপর যখন নাচের আসরে কুর্নিশ করতে-করতে ঢুকল, পায়ে রাশি-রাশি ঘুঙুর-পরা সত্তেও একটা ঘুঙুরেরও আওয়াজ শোনা গেল না। যেন হাওয়ার ওপরে পা ফেলছে, একই সঙ্গে, নাটকীয়ভাবে সারেঙ্গি, তবলা আর ঘুঙুর ঝমঝম্ ক’রে বেজে উঠল। নাচতে-নাচতে তবলার বোলের সঙ্গে সুন্নত্বাঈ নিজেও মুখে বোল্ বলে আর সেই বোল্ পায়ে তোলে-

ধারি কিট্ মারি কিট্, তুন্ তুন্ থারি
বেঁধে কেটে, মেরে কেটে
দগমগ দগমগ
তেরে কিট্ মেরে চিট্‌
যা ধরিঙ্, তা ফরিঙ্ থুন্ গা
কিট্ কিট্ তাক্ তাক্
থারিক্ থারিক্ চিট্-পিট্ থাক্ থাক্
ঝিন্ কিট্ ফাঁকা ধালঙ্গ তাকা থেই

ষোলো মাত্রার বোল-তাকে চারবার রিপিট্ ক’রে চৌষট্টি মাত্রায় তোলে।

নাচিয়ে শুরুতে প্রথম লয়ে, তারপর মধ্যমে, শেষে ধীরে-ধীরে দ্রুতলয়ের দিকে এগুতে থাকে। নিজের ঊরুতে তালি বাজিয়ে তবলচিকে ইঙ্গিত করে লয় বাড়াতে। তবলচির আঙুল থেকে ফুলঝুরির মতো যেমন বোলের বৃষ্টি নামে তেমনি নামে নাচিয়ের পায়ে। সুন্নত্বাঈ আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজিয়ে বাদ্যকরকে আবার ইশারা করে বলে, ‘লয় আউরভি বাঢ়াইয়ে।’ সে এক তাজ্জব ব্যাপার। সভাশুদ্ধ লোকের চোখ ছানাবড়া। নাচঘরটা যেন এক বিরাট পেতলের জালা–সংগীতের আওয়াজ তার ভেতর থেকে গগম্ ক’রে বেরুচ্ছে। তারই স্পন্দনে ঝাড়লণ্ঠনের স্ফটিকগুলোও নড়ে-চড়ে, আর ঠুং-ঠাং বেজে ওঠে। সুর আর লয় দ্রুততর হতে- হতে এক সাংঘাতিক চরমে উঠল। সুস্নত্বাঈ তার সাপের মতো শরীরটাকে আস্তে আস্তে পেছনের দিকে বাঁকাতে থাকে। এ-অবস্থায়ই ছোটো একজোড়া পাকা বাতাবি লেবুর মতো সুন্দর, মোলায়েম বক্ষস্থলকে এমনভাবে নাচাতে থাকে যেন ঝড়ে কচি বাঁশপাতা কাঁপছে। ওঠাচ্ছে আর নামাচ্ছে। ভেতর থেকে যেন কিছু উথলে পড়তে চাইছে। একচুল, দু-চুল ক’রে বাঁকাতে-বাঁকাতে মাথাটা এসে নিতম্বে ঠেকে আর- কী! ঠিক যেন একটি বকফুল। সদ্য তা-দেয়া ঢাকের চামড়ার মতোই পেট আর কোমরে অসম্ভব টান পড়েছে। বেদম্ হাততালি আর, ‘বাহবাঃ, বাহবাঃ, কেয়া বাৎ, কেয়া বাৎ, মুকর’ চিৎকারে নাচঘর ফেটে পড়ল। কানে তালা লেগে যায় আর- কী। অত্যধিক মিড়ের টানে সেতারের জোয়ারির তার যেমন ঝনাৎ ক’রে ছিঁড়ে যায়, তেমনি কোমর থেকে নাচিয়ের শরীরটা হঠাৎ দু-টুকরো হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ঐ নারকেল গাছটার মতো সুস্নত্বাঈও আর কোনোদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি।

হ্যাঁ, কী বলছিলাম! সেই অর্জুন গাছটার কথা। গ্রামের বাইরে-দক্ষিণে, উত্তরে, পশ্চিমে, পুবে-যতদূরই যাই-না কেন আমাদের বাড়ির দিকে তাকালেই দেখি দিগন্ত-বিস্তৃত সবুজের মধ্যে তার মাথা ঠিক উঁচিয়ে আছে। ঐ-গাছটির দিকে তাকিয়ে আমার মনে কেমন পাঁচমিশালি আবেগ আসে। একদিকে শান্তি আর আনন্দ, অন্যদিকে তেমন বিস্ময় আর ভয়। তার আশ্চর্য গড়ন আর ঋজু কাঠামো দেখে মনে হয় কোনো ওস্তাদ ইন্জিনিয়ারের হাতের সৃষ্টি। বাইরের এবং ভেতরকার খাড়া ও সমান্তরাল রেখার কী নিখুঁত সমন্বয়। তেমনই নিখুঁত তার ব্যালেন্স। সমস্ত গাছটাতেই, আপাদমস্তক ওজনের এমনই চমৎকার বিভাজন যে ম্যানহাটানের একশো আশি তলার বাড়ির মতো যত ইচ্ছে আকাশের দিকে বাড়িয়ে যাও। ঝড়- বৃষ্টি, ভূমিকম্প, এ-সবকিছুই তার গায়ে এতটুকু আঁচড়ও কাটতে পারবে না। মা- র কাছে গল্প শুনেছি যে ১৩২৫ সালে প্রলয়ের মতো এক সাংঘাতিক ঝড় উঠেছিল। সে-ঝড়ে ঢাকা জেলার বেশির ভাগ গ্রামই নাকি মরুভূমির মতো উজাড় হয়ে যায়। কিন্তু অর্জুন গাছটা যেমন ছিল তেমনই রইল দাঁড়িয়ে-পাহাড়ের মতো সোজা আর নিশ্চল। এমনই তার স্থিতি আর গঠনসৌকর্য! এমনই তার আসুরিক শক্তি। অনেককাল আগে কিংকং-এর সিনেমা দেখেছিলাম। দেখে যেমন ভয় পেয়েছিলাম, হয়েছিলাম অবাক। কী বিরাট তার দেহ যেন দশ-বিশটা বেস্মোদৈত্যি একসঙ্গে হয়েছে। তাকে মারবার জন্যে কতরকম ফন্দি-ফিকিরই-না আঁটা হয়েছে-কামান, বন্দুক এরোপ্লেন, আরো কত-কী। কিংকং নিরুদ্‌বেগ নির্বিকার। মশা-মাছির মতোই সামান্য বিরক্তিকর ভেবে সেগুলোকে হাতের মুঠোর মধ্যে ধ’রে পিষে ফেলছে। নিজের শক্তি এবং আয়তন সম্বন্ধে সে এতই সচেতন, এতই নিশ্চিন্ত, এতই দাম্ভিক, যে চারিদিকে যত ওলট-পালটই হোক-না কেন তাতে তার কিছু এসে যায় না।

এই তো গেল গাছটির শক্তির কথা। এবার তার রূপ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা। শাস্ত্রে বলে ‘রূপন্ত ঘোড়শবিধম্। অর্থাৎ রূপের আকার-প্রকার হ’ল ষোলো রকম। সেভাবে এ-গাছের রূপ বিশ্লেষণ করতে গেলে অনেক পাতা ফুরিয়ে যাবে। সোজা কথায় বলি। যে-কোনো জিনিসের রূপের একটা প্রধান নিয়ম হ’ল তার মাপজোক। অর্থাৎ যাকে আমরা বলি প্রোপোরশান্। তা-ও, এক-এক দেশের এক-এক নিয়ম। মানুষের বেলায় তো সোজা নিয়ম আছে। তার নিজের হাতের সাড়ে-তিন হাত লম্বা, নিজের মুখমণ্ডল তারই নিজের এক বিঘত। সব মানুষের পক্ষেই মোটামুটিভাবে এই নিয়ম চলে। কিন্তু অর্জুন গাছটার বেলায় কি করি? গাছের মাপজোক তো জানা নেই। তবুও দূর থেকে যখন গাছটাকে দেখি মনে হয় যেন শ্রবণবেগোলার গগনচুম্বী সেই বিরাট দিগম্বর মূর্তির মতোই নিখুঁত সুন্দর। যে-মাপজোকে ঐ-মূর্তি তৈরি হয়েছে, মনে প্রশ্ন জাগে, সে-পরিমাণেই কি বিধাতা একেও সৃষ্টি করেছেন? না কি নানা রঙ, নানা ডৌলের সংমিশ্রণে এই রূপজগৎকে সৃষ্টি করেছেন?

শাস্ত্রে এ-ও বলে যে মূর্তির গুণ তিনরকমের। উষার গোলাপী আলো যখন গাছের চূড়ায় এসে লাগে মনে হয় যেন বিরাট এক সাত্ত্বিক পুরুষ সটান হয়ে যোগে বসেছেন। হাতে বরাভয়। বসন্তে সেই আলো বর্শার ফলকের মতো কাঁচা, কচি পাতায় লেগে একটা স্বচ্ছ, সবুজ, দিব্যজ্যোতি মহাযোগীর মুখমণ্ডলের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আস্তে-আস্তে হাল্কা হয়ে আকাশের নীলের সঙ্গে মিশে যায়। কতকগুলো বুনো পায়রা তাঁর চারদিকে নানারকম ছন্দে উড়ে-উড়ে চক্কর কাটে। যেন প্রভাতের বন্দনা করছে। গাছের গোড়ায় শিশির-ভেজা সাদা আকন্দগুচ্ছ এই আলোর স্পর্শে ঝলমল করে। যোগীর শ্রীচরণে যেন ভক্তদের পুষ্পাঞ্জলি। বিকালের পড়ন্ত আলোতে তাঁকে মনে হয় রাজসিক–যেন তার রঙ-বেরঙের, নানারকম কারুকার্য-করা বাহনে দাঁড়িয়ে পশ্চিমের দিকে ছুটেছে। আর মধ্যাহ্নের কড়া চোখ- ধাঁধানো আলো যখন তাঁর মাথার ওপর আসে তখন ফুটে ওঠে তাঁর প্রচণ্ড উগ্র তামসিক মূর্তি–শুম্ভ, নিশুম্ভ, হিড়িম্বা, পুলোমা, বকাসুর–আকাশ, পাতাল, মর্তের সব রাক্ষস-দৈত্যদের সঙ্গে লড়াই করতে যাচ্ছে।

‘সর্ব্বং মনোরমা’–অর্থাৎ যে-মূর্তির প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেশি সরুও নয়, আবার বেশি মোটাও নয়। বেশি লম্বাও নয়, আবার বেশি খাটোও নয়, কেবল এমনই শাস্ত্র মানসম্পন্ন মূর্তিকেই নাকি ‘রম্য’ বলা যায়। দশ লাখে মাত্র একটি এমন চোখে পড়ে। ‘তৎ লগ্নম্ হৃদ্’ হৃদয়কে জয় করে এমন জিনিস মনোরম হতে পারে কিন্তু সত্যিকারের ‘অনুপম’ হতে হ’লে তাকে ‘শাস্ত্রমান্’ হতে হবে। ‘বাক্যম্ রসাত্মকম্ কাব্যম্।’ অর্থাৎ শিল্প তখন সৃষ্ট হয় যখন সৃষ্ট মূর্তিতে ‘রস’ তার আত্মারূপে প্রবেশ করে। অর্জুন গাছটাকে দেখে এমন কত কথাই যে মনে আসে তা কোনোদিন ব’লে শেষ করতে পারব না।

দেশীই হোক আর বিদেশীই হোক, যে-শিল্পের মানদণ্ডেই বিচার করি-না কেন, তাতেও গাছটার সৌন্দর্যের কোনো ঘাটতি দেখি না। রিয়ালিস্টিক অর্থাৎ বাস্তবধর্মী স্কাল্পচার ওপর থেকে পড়া আলোতেই তো সব চাইতে ভালো দেখায়। তার শরীরের বহিঃরেখা, অর্থাৎ আমরা যাকে কন্টুর বলি–তাঁর কাঠামোর, তার মাংসপেশীর সূক্ষ্ম মোলায়েম উত্থান, তার ডালপালায় ছন্দের যে-খেলা, তার দাঁড়াবার ভঙ্গি, তার ত্রিমাত্রিকতা–সব-কিছু মিলিয়ে যেন রেনেসাঁস যুগের ভাস্কর্যের চরম উৎকর্ষ মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ‘ডেভিড’। বিশ্বকর্মা এই মহীরূহকে লাবণ্য দিয়েছেন সকলরকমে, সকলভাবে, নানা উপায়ে– আলো ছায়া দিয়ে, রঙ-বেরঙ মিলিয়ে, কঠোর-কোমলে একত্রে বেঁধে। বড়ো-বড়ো শক্ত পাথরের ওপর দিয়ে পাহাড়ি স্রোত কী রকম গড়িয়ে-গড়িয়ে যায়! নিছক কড়ি আর নিছক কোমল দিয়ে কি আর সেতার বাজে? জীবন-মরণ, আলো-অন্ধকার–এসবই একসঙ্গে থাকলে তবেই তো বাজবে ঐক্যের সুর সারা সাংসারে। একেই তো আমরা বলি ইউনিটি। এর সূত্রেই তো সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বাঁধা।

কে জানে কত যুগ ধ’রে পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণে অর্জুন গাছটা দাঁড়িয়ে আছে? কেউ কি তার বয়স জানে? পঙ্কস্তরের মধ্যে পৃথিবীর ভাবী অরণ্যের যেদিন প্রথম মর্মরধ্বনি উঠেছিল সেদিন থেকেই কি তার আবির্ভাব পূর্বনির্ধারিত হয়েছিল? নুবিয়ার মরুভূমিতে নীলনদের ধারে যেদিন মিশরের সব ওস্তাদ রূপদক্ষেরা আবুসিম্বলের মন্দিরের গায়ে দ্বিতীয় রামাসিসের পর্বতপ্রমাণ মূর্তি খোদাই করেছিল হয়তো সেদিন এই মহীরুহেরও জন্ম হয়েছিল। দুই-ই যেন সৃষ্টির আদিকাল থেকে স্থির নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালের পথে অগ্রগামী এই গাছটা যেন আকাশের দিকে জোড়-হাত তুলে বলেছে, আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব। পুরোনো বট-অশ্বত্থ দেখলেও ঠিক একই কথা মনে আসে। কিন্তু অর্জুনের সঙ্গে তাদের মিল এখানেই শেষ। বট-অশ্বত্থেরা পৃথিবীর যত নিরাশ্রিত, শান্ত জীবদের তাদের ঠাণ্ডা ছায়ার কোলে টেনে নেয়, যেমন ক’রে নিত গভীর অরণ্যের প্রাচীন সাদা জটাজুটধারী, মুনিঋষিদের অবারিত দ্বারের আশ্রম। বট-অশ্বত্থের ধর্ম হচ্ছে করুণা। অর্জুন তার নিজের বিশালতায়, নিজের শক্তিতে এমনই তন্ময়, যে জৈব জগতের উপকারে সে এল কিনা, তাই নিয়ে সে এতটুকুও মাথা থামায় না। এতই তার দম্ভ, এতই তার নির্লিপ্তি। আপাতদৃস্টতে এ-কথাগুলো যতই সত্যি মনে হোক-না কেন আসলে কিন্তু ঠিক তা নয়। সে-কথায় পরে আসছি।

আমাদের পুকুরের ঐ উত্তর-পূর্ব কোণটা ফিতের মাপে তেমন দূর না-হ’লেও বাড়ির অন্যান্য অংশের চাইতে বেশ দূরে মনে হ’ত। একটা কারণ হয়তো এই যে পুরুষদের হাল্কা হবার জায়গাটা তখনকার বাড়ির নক্সায় সবচেয়ে দূরে ঠেলে দেওয়াই নিয়ম ছিল। সকালবেলা ছাড়া আমরা সাধারণত ঐ দিকটা তেমন মাড়াতাম না। দিনে-দুপুরে গেলেও কীরকম গা-ছম্‌ছম্ করত। কতরকম সাপখোপ পোকামাকড় আর পাখিদের আড্ডাই যে ঐ-গাছটায় ছিল তার ইয়ত্তা নাই। এক কথায় একটা মস্ত চিড়িয়াখানা।

প্রত্যেক জাতের জীবেরই নিজেদের, অদৃশ্য হ’লেও নির্ধারিত সীমানা টানা থাকে। এক-একদিন ওই সীমানা নিয়ে প্রথমটায় শুধু কলরব, তারপর ঝগড়া, শেষটায় তুমুল দাঙ্গা–রীতিমতো রক্তারক্তি হয়ে যেত। এমন চিৎকার-চেঁচা-মেচি- নিখর কিচ্, নিখর কিচ্, কিররররর-মিররররর, উইটি উইটি, বিটর-বিট বিটুর-বিট বিররররর, প্রুইচি-প্রুইচি-পইচি চিরি চিরি চিড়ড়ড়ড়ড় কুচিড়ি কুচিড়ি কুইটুং, পি পি পি ইকুইচুং চুড়ড়ড়ড়ড় ডড়ড় টুইয়া টুইয়া টুইয়া–আরো যে কতরকমের ক্যাকাফোনি, কার সাধ্যি তা বোঝে। কান ঝালাপালা হয়ে যায়। ছোটোবেলায় কড়াই থেকে ঝিনুক দিয়ে পায়েসের চাঁচি তুলবার সময় তার খ্যাচ-খাঁচ তীক্ষ্ণ কর্কশ আওয়াজে সারা শরীরটা কীরকম সিরসির করত। পাখিদের ক্যাচর-ব্যাচর শুনেও মনে হ’ত যেন পৃথিবীর সব ঠিকা-ঝিদের লাইন ক’রে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে কড়াই চাঁচতে। কী ভীষণ ব্যাপার।

একদিন ভোরে প্রচণ্ড একটা গোলমালে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দেখি অর্জুন গাছটাকে ঘিরে ছোটো বড়ো অসংখ্য পাখি পাগলের মতো উড়ছে আর তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। দলভারী করবার জন্যে বেপাড়ার পাখিরাও এসে জুটেছে। শুনেই মনে হ’ল এ-চেঁচামেচি অন্য ধরনের। একদিকে ভয়ানক বিপদের আশঙ্কায় চিৎকার, অন্যদিকে রণক্ষেত্রের চিৎকার। গাছটার দিকে এগুতেই দেখলাম কোত্থেকে দুটো হনুমান অজস্র ডালপালার মধ্যে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। কখনো ওস্তাদ ট্র্যাপিজ খেলোয়াড়দের মতো ডালে ল্যাজ পেঁচিয়ে দোলা খেতে খেতে তিড়িং ক’রে এক লাফে দূরের আর-একটা ডালকে ল্যাজ দিয়ে ধ’রে ঝুলে টার্জানের মতো শাঁই ক’রে এক লাফে চ’লে যাচ্ছে গাছের আর-এক প্রান্তে। কী দারুণ ফুর্তি আর আনন্দ। গাছটা যেন সার্কাসের তাঁবু-নানারকম তামাসার জায়গা। নিছক, নির্ভেজাল আনন্দের এমন লীলাক্ষেত্র কি আর কোথাও আছে? গাছটাকে দখল ক’রে নিলে কেমন হয়? হয়তো এই ভেবেই হনুমানদুটো হঠাৎ এক তাণ্ডবনৃত্যে মেতে উঠল। পাখিদের যত বাসা ছিল টান মেরে একে-একে সবগুলোকে ভেঙে ছুঁড়ে ফেলতে আরম্ভ করল। গোটা ঘটনাটাই ঘটছে গাছের মাঝামাঝি আর নীচের অংশে। (বলা বাহুল্য, ডগার দিকে, অর্থাৎ যেখানে চিল, বাজপাখি আর শকুন-শকুনিদের আড্ডা ছিল, বাঁদূর- দুটো সেদিকটায় যাওয়া একেবারেই নিরাপদ মনে করেনি)। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব তছনছ হয়ে গেল। সাধারণ নিয়মে হনুমানদুটোরই জয় হবার কথা। কিন্তু ব্যাপারটা হঠাৎ একটা নাটকীয় মোড় নিল। অনেকটা অ্যালফ্রেড হিচককের ‘দি বার্ড” ফিল্মের মতো। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ পাখিদের মতো জীবেবাও যে কী ভয়ংকর রকম হিংস্র হ’তে পারে চৈত্রের সকালের সেই দৃশ্য দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। যেমন ক’রেই হোক, নিজেদের ভিটেমাটি জান বাঁচাতে হবে এই ইনস্টিংক্ট-এর তাড়নায় প্রায় হাজারখানেক পাখি-এমন-কী ফিঙ্গে, টুনটুনি, চড়ুইও—-একজোট হয়ে ‘মারো মারো কাটো কাটো, ছিঁড়ে ফেলো’ এই হুংকারে ভয়ংকর একটা কালো মেঘের মতো হনুমানদুটোর ওপর বেপরোয়াভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে এক কুরুক্ষেত্র। চারদিকে রক্তারক্তি। বেগতিক দেখে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বিদ্যুৎবেগে লাফাতে-লাফাতে বানরদুটো পাখিদের নাগালের বাইরে চ’লে গেল। গাছতলায় প’ড়ে রইল চেনা-অচেনা অনেক পাখির মৃতদেহ।

বাদরদের মধ্যে শুধু-শুধু ধ্বংস করবার একটা প্রবৃত্তি এর আগেও লক্ষ করেছি। কিন্তু সেই তুলনায় মানুষের মধ্যে তো এই পশুপ্রবৃত্তি হাজার গুণে বেশি। নিছক আনন্দ পাবার দুর্বার লোভেই হোক, কিম্বা ব্যবসার লালচেই হোক, এ-দুয়ের ফলে পৃথিবীর বুক থেকে আজ একশো কুড়ি রকমের স্তন্যপায়ী প্রাণী, আর দুশো পঁচিশ রকমের পাখি, মানুষের শিকার হয়ে একেবারেই লোপ পেয়ে গেছে। শোনা যায় আরো ছয়শো পঞ্চাশ রকমের স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদের লোপ নাকি অনিবার্য।

হিংস্রতায় অবশ্য পাখিরা বাঘ ভালুক মানুষ কারোর চাইতে কম যায় না। একবার পুজোর সময় চুরি ক’রে অনেকগুলো বিচিকলা খেয়েছিলাম। ফলে পর পর বেশ কয়েকবার আমাকে অর্জুনতলায় ছুটতে হয়। সেখানে ঢুকেই দেখি ফুটফুটে অথচ রক্তাক্ত একটা শালিক পাখি এক কোণে ব’সে ধুঁকছে। আমার ধারণা, চিৎকার- চেঁচামেচি ক’রে ঝগড়া করতে শালিকের জুড়ি নেই। সাধে কি আমাদের পাড়ার বি.এ. পাস করা বংকু মুদি দজ্জাল বউয়ের সঙ্গে ঝগড়ায় না পেরে উঠে নাকি সুরে বিড়বিড় ক’রে বলত, ‘বেটি, মেয়েমানুষ নাঁ তঁ যেন শালিক পাখি।’ সে যাকগে। হাজার হোক, আমি কবিরাজের ছেলে। তাকে ধুতির খোঁটে আলতো ক’রে জড়িয়ে এনে গ্যাদা পাতার রস দিয়ে ধুয়ে মুছে, হলুদ-চুন দিয়ে বেঁধে দিলাম। তিন-চারদিন ছোলার সঙ্গে কেঁচো আর ফড়িংয়ের ঘণ্ট খেয়ে সে এমনই তরতাজা হয়ে উঠল যে, পালাবার জন্যে ছট্‌ফট্ করে। আমারই সঙ্গে তাকে রাখি পায়ে সুতো বেঁধে। অনিত্য এই সংসারে মায়া বাড়িয়ে আর লাভ কী। এই মনে ক’রে শালিকটাকে যেই-না অর্জুন গাছটার কাছে নিয়ে গেলাম মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যে সে ডালপালা আর পাতার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল আর তাকে কোনোদিন দেখিনি।

পশুপাখির জগতেই হোক, আর মানুষের জগতেই হোক, সীমানা নিয়ে ঝগড়া আজকাল অনেক দূর গড়িয়েছে। ঠাকুর রামকৃষ্ণেদেব বলতেন যে, মানুষ ধনদৌলত, জমি নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করে। কই আকাশ নিয়ে তো কেউ ঝগড়া করে না।’ আজকের যুগের মানুষ হ’লে তিনি নিশ্চয়ই এ-কথা আর বলতেন না। আজ আকাশ-বাতাস-জল, সর্বত্রই এই সীমানা নিয়ে লড়াই দেখা যায়। জমিতে যে ফসল ফলছে তাতে ক’রে বর্তমান মানুষের আর কুলোচ্ছে কোথায়। জলের তলায় যে মৎস্য এবং অন্যান্য খাদ্যসম্পদ রয়েছে তাই নিয়েও কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে। তাছাড়া সমুদ্রের মেঝের তলায় কোথায় কখন তরল সোনা বেরুবে তাই-বা কে বলতে পারে? তাই জমির মতো মহাসমুদ্রেও সীমানা নিয়ে লড়াই চলছে। অদৃশ্য হ’লেও আকাশের ওপর দিয়েও ঐ-রকম সীমানা টানা আছে। বিনা অনুমতিতে পেরিয়েছে তো তার ঘোরতর ফলাফল হ’তে পারে। এমন-কী, রাতারাতি যুদ্ধও লেগে যেতে পারে। আকাশ-বাতাস-জল যেদিকেই তাকাও এ-নিয়ে গোলমাল। গাছের ডালপালাও তার ব্যতিক্রম নয়।

আমাদের ঐ অর্জুন গাছটার সঙ্গে আজকালকার গগনচুম্বী ফ্ল্যাটবাড়ির একটা আশ্চর্য মিল দেখি। যাদের আর্থিক সামর্থ্য তুলনামূলকভাবে কম, তাঁরা সাধারণত এইধরনের বাড়িতে তলার এবং পেছনের দিকে স্থান পায়। যে-অনুপাতে মালিকদের অবস্থা বাড়তির দিকে যায়, সে-অনুপাতে তার ক্ষমতাও। আর সে- অনুপাতে তাদের স্থানও ক্রমশই ওপরের দিকে! তাছাড়া রোদ-বাতাসের অংশটাও তাঁরা ভোগ করেন বেশি। গোড়ার দিকে গর্তগুলোতে সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর ইত্যাদির আশ্রয়। তার ঠিক ওপরের স্তরে কোটরগুলোতে কাঠঠোকরা, মাছরাঙা, টিয়ে পাখি, শালিক, বুলবুল আরো কত-কী। গাছের পেছনের দিকটা অর্থাৎ যে-দিকটায় শীতকাল ছাড়া তেমন রোদ লাগত না, তারই মাঝামাঝি উচ্চতায় কয়েকশো বাদুড়ের একটা ঘন বস্তি ছিল। দূর থেকে হঠাৎ দেখলে মনে হয় যে গাছের ঐ জায়গাকে কে যেন পুড়িয়ে দিয়েছে। এদেরই কাছাকাছি ছিল কয়েকটা বড়ো বড়ো হুতোম প্যাঁচা। এই পেছনের দিকের ডাল-পালা পাতা এবং গাছতলার রঙটা বাদুড়গুলো বিশ্রী রকমের সাদা ক’রে রেখেছে। ফ্ল্যাটবাড়িতে চুনকাম যতই বাড়ির শোভা বাড়ায় মহীরুহের গায়ে এ- ধরনের সাদার পোঁচ ততই অশোভন। এই বস্তির ওপরে, সামনের দিকে থাকত একদল বক। এদের ওপরের স্তরে ছিল গাঙচিল আর শঙ্খচিলেরা। মাঝে-মাঝে দু- একটা বাজপাখিও দেখেছি। গ্রীষ্মের দুপুরে পাতার তলায় ব’সে ঝিমচ্ছে। আর সবার ওপরে ছিল শকুন-শকুনিদের লাক্সারি ফ্ল্যাট। মানুষের রাজ্যেও যেমন শ্রেণীভেদ- বর্ণভেদ পশুপাখি কীটপতঙ্গের জগতেও দেখছি এর কোনো ব্যতিক্রম নেই।

আগেই বলেছি যে অর্জুন গাছটার ধারকাছ দিয়ে ঘেঁষতে দিনের বেলায়ই আমাদের হৃদপিণ্ড কীরকম ধড়ফড় ক’রে উঠত। রাত্রিবেলায় নাকি যত রাজ্যের ভূত-পেত্নিরা এসে ওখানে আড্ডা জমাত। গাছটাকে রীতিমতো নাকি ক্লাবঘর বানিয়ে ফেলেছিল। শুনেছি যে চারপাশের গ্রামের যত অপমৃত্যু ঘটত, তাঁদের প্রেতাত্মারা নাকি ঐ-গাছটায় বাসা বেঁধেছিল। তাছাড়া, আত্মীয়-স্বজন, যাঁরা আমাদের মায়া কাটিয়ে চ’লে গিয়েছেন, তাঁরাও নাকি অন্তত বছরখানেক এই গাছটার চারপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করতেন।

একদিন আমরা সবাই হা-ডু-ডু খেলছি। হঠাৎ দেখি আমাদের মাইনে-করা কাঠুরে কার্তিকচাঁদ ছুটতে ছুটতে এসে আমাদের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মুখ দিয়ে আর টু-শব্দটা বেরুচ্ছে না। ভয়ে যেন জ’মে গেছে। অনেকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করবার পর হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল যে বড়োকর্তা ওখান দিয়ে যেতে-যেতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রে কার্তিক, ভালো আছিস তো? অনেকদিন পর তোকে দেখলুম।’ ব্যাপারটা হ’ল, বড়োকর্তা, অর্থাৎ আমাদের বাবা, মাসখানেক আগেই মারা গিয়েছিলেন।

আর-একবার কালীপূজার রাত্তিরে আমাদের এক খুড়তুতো ভাই বাজি ধ’রে দিস্তে পাঁচ-ছয় লুচি, সের-দুই নারকেল কুঁচি দেওয়া ছোলার ডাল, বিশ-পঁচিশ-খানা বড়ো সাইজের বেগুনভাজা, তিন-চার গণ্ডা পোড়া লাল লঙ্কা ড’লে খেয়ে ফেললেন। এর উপর দিলেন ঘন সরপড়া পাঁচ-ছয় বাটি পায়েস সাফ ক’রে। যা অনিবার্য তাই ঘটল। ঘোর অমাবশ্যার আকাতরার মতো ঘন অন্ধকারে বেরুতে হ’ল লোটা হাতে। শরতের শেষের হাল্কা নীল একটা কুয়াশার জাল এই অন্ধকারকে ঘিরে আরো রহস্যময় ক’রে তুলেছে। পুকুরধারে মস্ত বড়ো-বড়ো হাতপাখার মতো দেখতে কচুপাতার জঙ্গলের ঠিক ওপরই অনেকগুলো জোনাকি একসঙ্গে জ্বলছে আর নিভছে। শিশিরভেজা পাকাধান, পচা পাতা পাটের গন্ধ কাদামাটির গন্ধের সঙ্গে মিশে চারদিকের আবহাওয়ায় কেমন যেন একটা ভারী ধথমে ভাব সৃষ্টি করেছে। হাওয়ার লেশমাত্র নেই। লণ্ঠন-হাতে খুড়তুতো ভাই আস্তে-আস্তে সরুপথ দিয়ে অর্জুনতলার দিকে এগুতে থাকল। দূর থেকে হঠাৎ গাছটার দিকে চোখ পড়তেই দেখা গেল তার একেবারে অন্য-এক মূর্তি। যেন রামপ্রসাদী শ্যামা এলোচুলে শ্মশানকালীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। চার-দিকে সুসান্। ছপ্ ক’রে জলের মধ্যে কী-একটা লাফিয়ে পড়ল। হয়তো একটা কোলা ব্যাঙ। কিম্বা হয়তো একটা বড়ো মাছ পুকুরের জলের ওপরের দিকটায় হাওয়া খেতে এসে গোত্তা মেরে গভীরে লুকিয়ে পড়ল। ওকি? ওটা কী! কুয়াশার ভেতর দিয়ে আবছা-আবছা ওটা কী দেখা যাচ্ছে! খুড়তুতো ভাই একটুও দমবার পাত্র নয়। আমাদের বাড়িতে ওর মতো আশ্চর্য সাহস আর কারো ছিল না। লণ্ঠনটার সলতে বাড়িয়ে দিয়ে একটু উঁচু ক’রে ধ’রে দেখতে গিয়েই হাত পা চোখ সব ‘ফ্রিজ’ ক’রে গেল। আমাদের পোষা ‘ভোলা’ কুকুরটা বিশ্রী কান্নার সুরে থেকে-থেকে ডাকতে আরম্ভ করল। কী যেন একটা বলতে চাইছে। পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বাঁশবনটার থেকে কতগুলো শেয়ালও তেমনই একটা বিশ্রী চিৎকারে দ্বৈত সংগীত জুড়ে দিল ঝিঁঝিঁ পোকাগুলোও তাদের ডাক সপ্তমে চড়াল। সবাই যেন সমস্বরে বলছে ‘পালাও, পালাও।’ কার অদৃশ্য এক তর্জনীর সংকেতে এক মুহূর্তে সব-কিছু গেল থেমে। কী ঠুনকো নিস্তব্ধতা। আঙুলের টোকা মারলেই যেন ভেনিশিয়ান ওয়াইন গ্লাসের মতো ঠুং-ঠাং আওয়াজে হাজার টুকরো হয়ে যাবে। কুয়াশাটা আস্তে আস্তে বাঁশবনটার দিকে স’রে গেল। লণ্ঠনের মিটমিটে আলোয় পরিস্কার দেখা গেল যে দেয়াশলাই কাঠির মতো শুকনো রোগাপট্‌কা– অনেকটা আমাদের সেজোপিসির মতো দেখতে এক বিধবা বুড়ি, ছিপ হাতে পুকুরধারে মাছ ধরতে বসেছে। ভাসুরকে দেখে ছোটো পিসি যেমন আড়াই হাত এক ঘোমটা টানতেন, তেমনি মাথার ওপর এক বিরাট ঘোমটা টানা। ঐ অবসথাতেই মাথাটা খড়তুতো ভাইয়ের দিকে ঘোরাতেই আবছা আলোতে পরিষ্কার দেখা গেল ঘোমটার তলায় মাথা নেই। বঁড়শির ফাত্নার ডগায় লাইটহাউসের আলোর মতোই একটা নীল সবুজ আলো চারদিকে ঘুরে যাচ্ছে। বুড়ির ঐ কাঠির মতো হাতের এক হাঁচকা টানে হাত-পনেরো লম্বা-পেটের কাছটা বেল্টপরা মেমসাহেবের কোমরের মতো সরু, একটার জায়গায় তিনটে ক’রে মাথা আর তিনটে ক’রে ল্যাজ, নীচের দিকটা দু-হাত পর-পরই কীরকম গাঁট-গাঁট বাঁধা যেন অনেকগুলো আনারস একসঙ্গে জোড়া হয়েছে– অ্যালসেশিয়ান কুকুরের মতো মস্ত বড়ো লাল টকুটকে জিভ লক্লক্ করছে, মাথার ওপরে গণ্ডারের মতো ধারালো শিং, আর ওয়ালরাসের মতো গোঁফ। চোখদুটো থেকে বিয়েবাড়ির উনুনের মতো আগুন দাউ-দাউ ক’রে জ’লে উঠছে, আবার বিনা কারণে নিভে যাচ্ছে। আবার জ্বলছে, আবার নিভে যাচ্ছে-এমন একটা অদ্ভূত দেখতে মাছ পুকুরপাড়ে আছড়ে পড়ল। মাটিটা থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। গুজরাটি একধরনের কাপড়-চোপড়ে যেমন ছোটে-ছোটো কাঁচ বসানো থাকে, মাছটার সারা গায়ে তেমিন কাঁচের মোজাইক বসানো। লণ্ঠনের আলো পড়তেই মাছের আঁশগুলো এক-একটা আরশির মতো ঝলমল ক’রে উঠল I মাছটা যেমন তড়পাচ্ছে, তেমনি কাঁচের মোজাইক বসানো। লণ্ঠনের আলো পড়তেই মাছের আঁমগুলো এক একটা আরশির মতো ঝলমল ক’রে উঠল। মাছটা যেমন তড়পাচ্ছে, তেমনি যেন শত-শত সার্চলাইট জলছে আর নিভছে। একটা আলিশান্ বঁটিদা শুকনো পাতার মতো ভাসতে ভাসতে এসে ঠিক বুড়ির সামনে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে ভেসে এল তেমনি মানানসই দুটো পেতলের পরাত। একী! অর্জুন গাছটার চারপাশে কি হঠাৎ জিরো গ্র্যাভিটি নেমে এল? বুড়ি হাতে খানিকটা মাটি মেখে যেই-না মাছের গর্দানটা বঁটিতে ছোঁয়াল, অমনি ফিনকি দিয়ে টাটকা রক্তের স্রোত হেমন্তের পুকুরটাকে আনাচে-কানাচে ভরিয়ে দিল। খানিকটা এসে খুড়তুতো ভাইয়ের ফুটো হাতকাটা গেঞ্জিটাকে ভিজিয়ে দিল। একী! পায়ের ফাঁক দিয়ে ওটা কী বেরিয়ে গেল? ইঁদুর না বেজি? শুকনো পাতাগুলোর মধ্যে কী খচমচ করছে? একটা চামচিকে শাঁই ক’রে কানের পাশ দিয়ে চ’লে গেল। একটা উঁচুঙ্গে এসে ঠং ক’রে কপালে এমন জোর ধাক্কা খেল যে দাদা প্রায় চিৎপটাং হয়ে পড়ে যাচ্ছিল। এ-সব কাণ্ডকারখানা দেখে দাদা পালাতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে ইয়ারি ঢং-এ একটা বরফের মতো ঠাণ্ডা হাতে কাঁধের ওপর রেখে কানের কাছে ফিসফিস ক’রে কে শুধালো, ‘জান আমাদের আজ চড়ুইভাতি হচ্ছে। কী মেনু জান? মাছের বিড়িয়ানি, পাতুড়ী, কোর্মা, মুড়িঘণ্ট। রান্না কে করবে জান? সেই ড়ায়বাড়ীর পল্টু ড়ায়ের স্ত্রী। আমাদের সঙ্গে খাবে তো?’ পরিষ্কার বাংলা। একটুও খুঁত নেই। কিন্তু র- এর উচ্চারণটা ড্র-এর মতো কেন? লোকটা তামিলনাডুতে বাংলা শিখেছে নাকি?

পরদিন আমাদের পুরুতমশাই, অভ্যেসমতো খুব ভোরে প্রাতঃকৃত্যাদি সারতে এসে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পেলেন। মুখ দিয়ে নাকি ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির মতো ভক্‌ভক্ ক’রে গরম ফেনা বেরুচ্ছিল। আর-একবার আমাদের গ্রামের নাম- করা যোগেশ ভাটিয়াল এ-রকমই এক অমাবস্যার রাতে মনের আনন্দে গান গাইতে- গাইতে অর্জুন গাছটার পেছনের বিলের ধার ঘেঁষে ডিঙি বেয়ে যাচ্ছিল। নসিমপুর গ্রাম থেকে যাত্রার পার্ট ক’রে ফিরছিল নাকি। যেই-না গাছটার তলায় আসা, ব্যাস্ তার গান গেল থেমে। তারপর থেকে সে নিখোঁজ। এখন নাকি মাঝে-মাঝে অনেক গভীর রাতে গাছটার মগডাল থেকে তার গান ভেসে আসে। সেই থেকে গ্রামে রাত্রি- বেলা শোবার সময় সবাই কানে তুলো গুঁজে শোয়। সেই গান যার কানে পৌঁছয় তার দিন নাকি আস্তে-আস্তে ঘনিয়ে আসে।

কিন্তু বিচিত্র রূপে মূর্ত গগনচুম্বী এই মহীরুহকে যখনই আমি দেখেছি আমার কানে শুধুমাত্র সৃষ্টির শাশ্বত সংগীতই ভেসে এসেছে যে-সংগীতকে এক কথায় বলা হয় জীবনসংগীত এবং যে-সংগীত এক অনাবিল, উন্নত অনুভবে আমার জীবনকে করেছে সহস্রভাবে সমৃদ্ধ।

হে তরুবর! আজ প্রায় অর্ধশতাব্দী হ’ল তোমাকে দেখিনি। আজ তুমি পরদেশী। তুমি এখনো আছ কি নেই, কে জানে? জনবিস্ফোরণের চাপে, মানুষের প্রয়োজনে, তুমি হয়তো হয়েছ বিসর্জিত। তোমার পাদপীঠের ওপর দিয়ে হয়তো তৈরি হয়েছে নতুন রাজপথ। একদিন তৈরি হবে কলকারখানাও। ভোরে সোনালী আলোয় যেখানে দেখেছি তোমার মণিমুকুট, সেখানে উঁচিয়ে থাকবে একদিন দৈত্যের মতো তার বিরাট চিমনি। কালো-কালো বিষাক্ত সাপের মতো অনর্গল ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠে লাপিস-লাজুলির মতো স্বচ্ছ নীল আকাশটাকে ক’রে দেবে অন্ধকার।

কবে কোন দারচিনি দ্বীপ থেকে বসন্তের এক দিনের শেষে সুদূর সাইবেরিয়া- গামী একটি বেগুনীরঙের বেলেহাঁস আমাদের এই পুকুরপাড়ের নরম ঘাসে দু-দণ্ড বিশ্রাম করতে নেমে অকস্মাৎ একটি বীজ ফেলে গিয়েছিল। তোমার জন্মের সেই শুভ মুহূর্তে, স্বাতী, রেবতী, অরুন্ধতী-সব নক্ষত্রেরা শঙ্খধ্বনি ক’রে তোমার আগমন ঘোষণা করেছিল। সেদিন ছিল ফাল্গুনী পূর্ণিমা। সেদিন প্রকৃতি তোমার সৃষ্টির কল্পনায় মশগুল। সে-কল্পনায় ছিল দূর ভবিষ্যতে নতুন বিস্ময়ের আবির্ভাব, নতুন- নতুন সৌন্দর্যের জন্ম, নতুন-নতুন প্রাণের বিকাশ বীজরূপে নিহিত। চরক, সুশ্রুত, বাগভট্র, চক্রদত্ত, আর্যাবর্তের সব মুনিঋষিরা কত ধুমধাম ক’রে তোমার নামকরণ উৎসব করেছিলেন। চমৎকার সব নাম রেখে তাঁরা তোমার মহিমা গাইলেন। যেমনই ধ্বনি তেমনই তার মাধুরী–গাণ্ডবী, কিরীটী, কর্ণারী, অর্জুন, শম্বর পৃথজ, কৌন্তেয়, ধনঞ্জয়, ককুভ–আর কত কী! তুমি ছিলে কোটিতে একটি, সহস্র গুণের আধার। তোমার গুণে কত দুরারোগ্য রোগ থেকে হাজার-হাজার মানুষ মুক্তি পেয়েছে, পেয়েছে নতুন জীবন। তোমার একাধিক নাম হবে তাতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে? তুমিই প্রেম, তুমিই সৌন্দর্য, তুমিই শিল্প। তুমিই ভাবুকতা, তুমিই অনুকম্পা। তুমিই সৌন্দর্যপিপাসু প্রকৃত রসিকদের অনুভূতি ও আনন্দের উৎস। কীটপতঙ্গ, পশুপাখি, মানুষ সবাইকে তুমি প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছ। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলিয়ে দিয়েছ নিঃশেষে। তাই তোমার কপালে আঁকা আছে প্রেমের জয়তিলক, প্রেমের উজ্জ্বল বর্তিকা।

হে তরুরাজ, ঘন কালো কত অমাবস্যার অন্ধকারে তোমাকে দেখেছি যেন এক রহস্যময় স্বপ্নবন্দর। কবে শুক্লপক্ষের ফালিচাঁদ উঠে তোমার চারদিকের ছায়া ও আসন্ন প্রদোষের গভীর অন্ধকার দূর করবে, দেখেছি তুমি তারই প্রতীক্ষায় কত রাত চুপ ক’রে ছিলে দাঁড়িয়ে। গ্রীষ্মের কত অলস দুপুরে তোমার শীতল ছায়ায় শুনেছি পাখির কূজন। কতদিন স্বপ্নে ভেবেছি তোমার ঐ উঁচু চূড়ায় দাঁড়িয়ে, হাত বাড়িয়ে নীল আকাশটাকে ছোঁব, ওপর থেকে পৃথিবীটাকে দেখব, যেমন ক’রে দেখে চিলেরা। শীতে তোমার পাতাঝরা রুক্ষ কর্কশমুতি দেখেছি। দেখেছি তোমার চক্চকে তামাটে রঙের নতুন পাতাগুলো ফাল্গুনের গরম আলোতে ঝিলমিল করছে। কী অপূর্ব সে-দৃশ্য। যেন ওমর খৈয়ামের দেশের কোন্ ওস্তাদ কারিগরের তৈরি অনুপম একটি আকাশজোড়া কাঁচের সুরাপাত্র খোরাসানী বেদানার সরবতে টইটুম্বুর। তোমার চূড়ায় ধাক্কা লেগে বর্ষার প্রথম মেঘ তোমাকে করেছে সিঞ্চিত। শালিক, মাছরাঙা, বুলবুল টিয়াপাখিরা ডালে-ডালে সারি-সারি ব’সে শুকোয় তাদের ভেজা পালক। আহা! ডালপালায় যেন রঙ- বেরঙের, নানা নক্সার ঘুড়ির দোকান বসেছে। আবার ভরা বসন্তে দেখেছি । তোমাকে মসৃণ সবুজ মখমলের কুর্তায়। মাথায় ছোটে- ছোটো মাখন রঙের ফুলের স্তবকের মুকুট। তোমার হৃদয়স্পন্দন আজও আমি নিজের রক্তের মধ্যে অনুভব করি। কলকাতার মতো এই জনাকীর্ণ, কোলাহলমুখর ব্যস্ত, পচা, নোংরা, ভাঙাচোরা শহরে বাস ক’রেও তোমাকে কোনোদিন ভুলিনি। জীবনানন্দের যে-অমৃতবাণী তুমি আমায় শুনিয়েছিলে, তার কথা মনে এলে আমি আজও কীরকম ছন্নছাড়া হয়ে যাই– যেন অনেক দূরে, এক জনহীন অজ্ঞাত জগতের, উদাস, অপরূপ এক বুনো সৌন্দর্যের মধ্যে যেখানে জীবন এনে দেয় এক মুক্তির স্বাদ আর আনন্দের অনুভূতি।

‘হে সময়, হে সূর্য, হে মাঘ-নিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া, আমাকে জাগাতে চাও কেন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *