উর্দু বাংলা তর্ক

উর্দু বাংলা তর্ক

বাঙ্গালী মুসলমানের ভাষা সম্বন্ধে তর্ক আজও শেষ হয়নি। এ নিয়ে কয়েকটি দল আছে:

(১) বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে একদল, মুসলমান যে বাঙ্গালী একথা স্বীকার করতে নারাজ। তাঁদের ধারণা, যেহেতু তাঁরা বাঙ্গালী নন এবং যেহেতু সকল দেশের মুসলমান উর্দু কিছু কিছু জানেন, অতএব বাঙ্গালী মুসলমানেরও ভাষা উর্দু হওয়া উচিত। এঁদের অধিকাংশ কলকাতায় বাস করেন, অথবা কলকাতাবাসীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। মুসলমান সমাজে এঁদের সম্মান খুব বেশী–কারণ এঁরা অধিকাংশই উচ্চপদস্থ

(২) অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরের কিন্তু বেশ সচ্ছল অবস্থার একদল মুসলমান, যাঁরা মফঃস্বলের শহরে বাস করেন এবং আত্মীয়-স্বজনকে একেবারে বাদ দিতে এখনও সক্ষম হননি, তাঁদেরও কেউ কেউ বলতে চান যে মুসলমান বাঙ্গালী (বঙ্গদেশবাসী) হলেও এদের ভাষা প্রকৃতপক্ষে উর্দু এবং উর্দুকেই এদের মাতৃভাষা ক’রে নেবার জন্য চেষ্টা করা উচিত।

(৩) তৃতীয় দলের বাঙ্গালী মুসলমান, বাংলা সাহিত্যে মুসলমানকে হেয় ক’রে দেখান হয়েছে এবং ইসলামের আদর্শকে অপমান করা হয়েছে, এই দুঃখে বাংলার চর্চাকে বর্জন ক’রে উর্দুর চর্চা করতে চাচ্ছেন।

(৪) বাংলা দেশে যখন মুসলমান বাস করছে তখন তারা বাঙ্গালী, অতএব তাদের মাতৃভাষা বাংলা; কিন্তু উর্দুকে বাদ দেওয়া যায় না, কারণ ওটি মুসলমানের Lingua franca

(৫) আবার আর একদল বিদ্রোহী বাঙ্গালী মুসলমান বলছে : বঙ্গদেশে আমাদের বাস, অতএব আমরা বাঙ্গালী আমাদের ভাষাও বাংলা। কলকাতাবাসী সমাজ আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন; তাদের চোখ-রাঙানিকে আমরা ডরাই না। আর অমুসলমান লেখক যদি বাংলা সাহিত্যে ইসলামের মর্যাদাহানী করে, তাই ব’লে আমাদের সত্যিকারের অধিকার আমরা ছাড়বো না। আমাদের জমীদারী বন্য বরাহে ছেয়ে গেছে ব’লে কি জমীদারী ছেড়ে পালাবো? –আমরা আমাদের আদর্শ দিয়ে বাংলা সাহিত্য রাঙিয়ে তুলবো।

এরা আরও বলছে : আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের সাহিত্যকে আমরা গড়ে তুলি। তারপর যদি আবশ্যক হয় তখন Lingua franca র কথা ভাববো।

এই সমস্ত মতামত সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এখানে শুধু বক্তব্য এই যে, এই উর্দু ও বাংলা নিয়ে যে তর্ক তাতে ক’রে আমরা কোনো ভাষার চর্চা করছি না, এবং তার ফলে আমাদের চিন্তাশক্তি ক্রমেই হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে চলেছে।

যে জাতির মন ভাব-সম্পদে ভরা, তাদের ভাষা নিয়ে তর্ক উঠতেই পারে না। ভাষা ভাবের বাহন মাত্র। মনে যখন ভাবের বন্যা আগত হয় তখন কোন্ জাতীয় ভাষায় মনের ভাব বেরিয়ে আসবে, সে বিচারের অবসর থাকে না। যদি বাইরে থেকেই আগে ভাগে বিধি-নিষেধের বাঁধ বেঁধে দেওয়া হয়, তা হ’লে ভাবরাজি ভেতরে আটকে থাকে এবং সেখানেই দম বন্ধ হয়ে মারা যায়।

বাঙ্গালী মুসলমানদের যাঁরা পথপ্রদর্শক, যারা উর্দু ও বাংলা নিয়ে তর্ক করছেন, তাঁরা কয়েক কোটি মানব-সন্তানের চিন্তাশক্তির বিষয় না ভেবে শুধু ভাষার জাতি- বিচারে ব্যস্ত। তাঁরা ভাবের আদান-প্রদানই যে ভাষার মূল উদ্দেশ্য একথা ভুলে যাচ্ছেন। তাতে ক’রে অসুবিধে হচ্ছে– কয়েক কোটি মানব-সন্তানের হৃদয়ের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার গতিরোধ হচ্ছে। সহজে যে ভাষারই হোক তাদের ভাবরাজিকে প্রবাহিত হতে বাধা দেওয়া ভালো কাজ হচ্ছে না।

মানব-হৃদয় কত জটিল! তার হাসি-কান্না কত বিচিত্র বর্ণের! কত বিচিত্র ভঙ্গীতে তার বিকাশ! তাই, মানব-হৃদয়ের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতি যার শ্রদ্ধা নেই, তাকে প্রশংসা করা যায় না। আমারই মতো একজন মানব-সন্তান পুত্রশোকে কাঁদছে। তাকে যদি বলা হয় : ও কান্না কান্নাই হ’ল না, উর্দুতে কাঁদতে হবে,– যদি উর্দু না জান তবে উর্দু শিখে নাও, তার পরে উর্দুতে কাঁদবে এবং তখন তোমার কান্না দোরোস্ত হবে; তা হ’লে তার কান্নাকেই বন্ধ ক’রে দেওয়া হয়। আজ বাঙ্গালী মুসলমানের অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে এমনি ক’রে তার সমস্ত ভাব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে; তার হাসি-কান্না তার কণ্ঠ পার হয়ে, এমন কি ওষ্ঠপ্রান্ত পর্যন্ত এসে, বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা আজ যেমন ভাষাহীন, তেমন ভাবহীন। তাদের চিন্তাশক্তি আজ অসাড়, বুদ্ধি আড়ষ্ট।

একজন দুইজন নয়, দুই এক শত নয়, দুচার হাজার নয়, লাখ লাখ পল্লীবাসী নির্ধন নিরন্ন অক্ষম বাঙ্গালী মুসলমানের দুরবস্থা সম্বন্ধে যাঁরা একেবারে বে-খবর, তাঁরা বাইরে থেকে শুধু এদের ভাষা উর্দু হবে কি বাংলা হবে এই সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে এদের কোনো উপকার করতে সক্ষম হবেন না। সত্যিকার উপকারের স্পৃহা যার আছে তাকে অন্তরের দরদ দিয়ে বিষয়টি উপলব্ধি করবার চেষ্টা করতে হবে।

মানুষের অন্তরের দরদ বা অনুভূতিটি কোন্ ভাষায় প্রকাশ করতে হবে সে সম্বন্ধে বিধি-নিষেধ দ্বারা শাসন করা নিষ্ঠুর আচরণ। এই নিষ্ঠুরতার ফলে বাঙ্গালী মুসলমানের চিন্তাশক্তিকে দুর্বল করা হয়েছে। সত্য সত্যই এদের কোনো ভাষা নেই। বাংলাও তাদের ভাষা নয়; উর্দুও তারা আয়ত্ত করতে পারেনি– পারছেও না।

প্রাইমারী স্কুলে এরা যে বাংলা পড়ে, সে ভয়ে ভয়ে পড়ে এবং পাছে বাংলা ভালো জানার অপরাধে লোকের কাছে নিন্দনীয় হতে হয়, সেই ভয়ে তারা কোনো প্রকারে পরীক্ষায় পাশের পড়াটুকুই পড়ে; এবং পরীক্ষায় পাশ হয়ে গেলে যেটুকু শিখেছিল সেটুকুও ক্রমে ক্রমে ভুলে যায়। আবার মক্তব হ’লে তো কথাই নেই। অনেক প্রাইমারী স্কুলেও একজন উর্দু শিক্ষক বাংলা শিক্ষার নিষেধের পাহাড় স্বরূপ বিরাজ করেন। তিনি অনবরত কোমলমতি বালকগণের কানে পৌঁছচ্ছেন : “কি হবে ওসব হিদুদের দেবদেবীদের কথা পড়ে?” এদিকে এই সব উর্দু শিক্ষক নিজেরাই উর্দু ভালো জানেন না। সুতরাং ছেলেবেলা থেকেই বাঙ্গালী মুসলমানের ভবিষ্যৎ আশা-ভরসার স্থল বালক বালিকারা না শেখে উর্দু না শেখে বাংলা।

যাঁদের অবস্থা সচ্ছল এবং যাঁরা শহরে বাস করেন, তাঁদের দু একজনের ছেলেরা যা একটু কোনো প্রকার লেখাপড়া শিখছে। কিন্তু সহস্র সহস্র পল্লীবাসী বাঙ্গালী মুসলমানদের লেখাপড়া শিক্ষার প্রাণপণ আকাঙ্ক্ষা শুধু এই উর্দু ও বাংলার তর্কের জন্য ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেবেলা থেকেই এদের চিন্তাশক্তিকে মুগুর মেরে মেরে থেঁৎলে দেওয়া হচ্ছে। তারা তাই প্রাথমিক জ্ঞানের ওপরে আর উঠতেই পারছে না; এবং শুধু এই কারণেই প্রাইমারী স্কুলের ছাত্রসংখ্যার তুলনায় মধ্য ও উচ্চ ইংরাজী স্কুলের ছাত্রসংখ্যা এত কম।

একমাত্র কারণ উর্দু ও বাংলার তর্ক একথায় আপত্তি হবে। কেউ বলেন : অনেক প্রাইমারী স্কুলে উর্দু শিক্ষকও নেই–উর্দু পড়ানোও হয় না। সে কথা ঠিক। কিন্তু স্কুলের বাইরেও তো একটি আকর্ষণ আছে। এবং সেই আবেষ্টনের একটি অদম্য প্রভাবও আছে! এঁরা বলেন : দারিদ্র্যই মূল কারণ; কিন্তু এই দারিদ্র্যেরও একটি কারণ এই উর্দু ও বাংলা নিয়ে তর্ক। এই তর্কের দরুণ মুসলমান ভাবতে শিখছে না মোটেই। যে জাতির ভাষা নেই তার ভাববার শক্তিও নেই–আর ভাববার শক্তি না থাকলে একটি জাতি দরিদ্র তো হবেই। কেউ কেউ বলবেন : মুসলমান সুদ খায় না, তাই তারা দরিদ্র। এই যদি দারিদ্র্যের কারণ হত তা হ’লে বিহার প্রদেশের মুসলমানদের অবস্থাও বাঙ্গালী মুসলমানদের মতো হতো–বিহার প্রদেশে উর্দু বাংলার তর্ক নেই।

ভাষা না জানলে ভাবের আদানপ্রদান হয় না– সৌভ্রাত্র অসম্ভব। জাতির উন্নতির জন্য ভাবের আদানপ্রদান এবং সৌভ্রাত্র একান্ত আবশ্যক। ভাবের আদানপ্রদানের কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। বাংলা দেশে যে সব ওয়াজ হয়, সেখানে আজকাল যদি বা কোনো কোনো বাঙ্গালী মৌলবী বা মওলানা সাহেব বাংলায় ওয়াজ করেন, সে বাংলার অর্ধেক আরবী, সিকি ফারসী এবং কতকাংশ উর্দু। সে ভাষা সাধারণ পল্লীবাসী মুসলমানের পক্ষে দুর্বোধ্য। তাছাড়া এই সব মৌলবী মওলানারা উর্দু বা আরবী বা ফারসী কোনো সাহিত্যের উপরই ভালো দখল লাভ করেননি। এঁদের অনেকেরই পড়াশুনা অতি সামান্য। আজকের দিনে জীবনসংগ্রামে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যাদের পড়াশুনা কম তাঁরা কোনো বিষয়ে চিন্তা বা আলোচনা করতে অক্ষম।

মসজিদে যে খোত্বা পড়া হয়, তা হয় আরবীতে। মিলাদ শরীফের সভায়ও আরবী ফারসী বা উর্দুতেই হয় আলোচনা। তা পল্লীবাসীরা সম্যক উপলব্ধি করতে পারে না। এ সবে শ্রোতাদের মনে কোনো সত্যিকার প্রেরণা আনে না। এই সব কারণে ভাবের আদানপ্রদান হচ্ছে না। তাতে ক’রে চিন্তা-শক্তি বর্ধিত হতে পারছে না এবং কোনো চরিত্র গড়ে উঠছে না। ফলে চরিত্রহীনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। জেলখানা তার সাক্ষী!

অতএব নিঃসংশয়ে বলা চলে যে চিন্তাশক্তির অভাবেরও একমাত্র কারণ এই উর্দু ও বাংলা নিয়ে তর্ক। এই তর্কের ফলে বাঙ্গালী মুসলমান আজ দিশেহারা, তারা কিছুই ঠিক করতে পারছে না–কোথাও এক জায়গায় দাঁড়াতে পারছে না। উর্দু তারা শিখতে চায়; কিন্তু সুযোগ, সুবিধে, আবেষ্টন সবগুলির সমান অভাব। উর্দু আয়ত্ত করতে পারছে না, এই দুঃখেই তাদের মন চঞ্চল; সুতরাং ভালো বাংলাও শিখতে পারছে না।

ভাষাহীন মানুষের দুর্গতি তো অনিবার্য। ভাষার অভাবে ভাব প্রস্ফুটিত হতে পারছে না। ভাবের (Idea র) দৈন্য মানুষের পক্ষে অমার্জনীয় অপরাধ। ভাব হিসাবে বাঙ্গালী মুসলমান যে কত দরিদ্র তা ভাবতেও চিত্ত পীড়িত হয়।

বাঙ্গালী মুসলমানের ঘরে অন্নের অভাব। ক্ষুধার জ্বালায় সে একান্ত কাতর। কিন্তু তাকে যে উর্দুতে কাঁদতে হবে–উর্দুতে তার নালিশ ব্যক্ত করতে হবে। সুতরাং তার কান্নারও পথ বন্ধ, নালিশ করবারও ক্ষমতা নেই। সঙ্গে সঙ্গে ভাববারও ক্ষমতা নেই।

বাস্তবিক বাঙ্গালী মুসলমানের অন্নাভাবের কথা এরা তেমন ভাবছেই না। কি উপায়ে যে এদের অন্নাভাব ঘুচান সম্ভব সে সম্বন্ধে কোনো চিন্তাই নেই। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়ে কথাটি একটু স্পষ্ট ক’রে বলার চেষ্টা করা যাক্।

বাংলা দেশে বৎসরে অন্ততঃ কয়েক লক্ষ টাকা কেবল তুর্কী টুপীর জন্য বাঙ্গালী মুসলমান ব্যয় করছে। অথচ এই টাকার একটি পয়সাও মুসলমানের পকেটে যাচ্ছে না। প্রায় ত্রিশ বৎসর যাবৎ তুর্কী টুপীর ব্যবহার বেশ ব্যাপকভাবে চলছে। এই ত্রিশ বৎসরে বাঙ্গলার মুসলমান অন্ততঃ কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করেছে এই তুর্কী টুপীতে। এই কয়েক কোটি টাকা যদি তার ঘর থেকে এমন ক’রে না বেরিয়ে যেতো তো তার অন্নাভাবের অনেকখানি লাঘব হতো।

যেকারণে এই টুপী পরা হয় সে-কারণ তো আজ অন্তর্ধান হয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত কোনো আলোচনা কানে পৌঁছয়নি। এখানে এটুকু বলা প্রয়োজন যে, পূর্বে যে সব টুপী ব্যবহৃত হতো তাতে মুসলমানের ঘরে অন্ততঃ কিছু পয়সা যেতো।  

শুধু টুপীর কথা নয়; আমাদের দেশে যে সব সহজ ব্যবসা আছে- কর্মকারের ব্যবসা, কুম্ভকার, কংসকার, স্বর্ণকার, সূত্রধর, তাঁতি, পরামাণিক ও তেলীর ব্যবসা, পাথর খোদাই করা, ঝিনুকের বোতাম তৈরী করা ইত্যাদির ব্যবসা-ক্ষেত্রে বাঙ্গালী মুসলমান নেই এর একমাত্র কারণ এদের এসব idea দেওয়া হয়নি। কে দেবে? যাদের দেওয়ার ক্ষমতা আছে তারা উর্দু ও বাংলার তর্কের মীমাংসায় ব্যস্ত; দেবার অবকাশ, স্পৃহা ও ভাষা কানোটি নাই।

তাই, মুসলমান ওজু ক’রে নামাজ পড়বে, বদনা সে তৈরী করতে জানে না। ভাত রেঁধে খাবে সে ডেক্‌চি, পাতিল তৈরী করতে জানে না। মশলা পিশবে, সে শীল নড়া তৈরী করতে জানে না। লাঙলের ফলা ইত্যাদির জন্য তার পরিশ্রমলব্ধ অর্থ তাকে ব্যয় করতে হবে। সংসারের যা কিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্য তার একটিও সে তৈরী করতে পারে না। তার গামছাখানা কিনতে হবে। এমন কি, চিড়ে মুড়ী পর্যন্ত সে কিনে খায়!

এমন ক’রে কি কোনো জাতির অন্ন-সমস্যার সমাধান হতে পারে? যে জাতি উপার্জন করবে সবচেয়ে কম, অথচ ব্যয় করবে সব জাতির চেয়ে বেশী, তার দুঃখ তো অনিবার্য।

বাংলা দেশে অন্ততঃ কয়েক লক্ষ লাঙলের ফলা বিক্রি হয় এবং তার জন্য যে কয়েক লক্ষ টাকা প্রতি বৎসর মুসলমান ব্যয় করে সেসম্বন্ধে যাঁরা উর্দু বাংলার তর্কে ব্যস্ত তারা খবরও হয়তো রাখেন না।

সুতরাং উর্দু ও বাংলার তর্কে এ সমস্ত বিষয়ে ভাববার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই তর্কের দরুণ তারা গোড়ায় আটকে গেছে। অগ্রসর হবে কেমন ক’রে? এতে ক’রে এমন ক’রে এদের সর্বনাশ করা হচ্ছে যে, অচিরে একেবারে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিছুই আশ্চর্য নয়।

তাই মনে হয়, যাতে ভেতরে ভাববার শক্তি জাগে, যাতে ভাবের আদানপ্রদানের অসুবিধে না হয়, সেই দিকে লক্ষ্য থাকলে উর্দু ও বাংলা নিয়ে তর্ক উঠতেই পারে না।

এ সব ছাড়া আবার এই তর্কের ফলে বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ ঘটে গেছে; যাঁরা উর্দুর পক্ষে তাঁরা সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর এবং যারা উর্দুর বিপক্ষে তারা ইতর। সচ্ছল অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালী মুসলমান বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে এবং বাংলা ভাষায় কথা বলতেও ঘৃণা বোধ করতে আরম্ভ করেন এবং কোন্ সুদূর অতীতে কোন্ সুদূর বিদেশ থেকে তাঁদের এদেশে আগমন হয়েছিল, তার ইতিহাস এবং তাতে ক’রে যে তাঁদের মাতৃভাষা উর্দু তারই প্রমাণাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে শ্ৰেণীবিভাগ বেশ দৃঢ় হয়ে গেছে। এখানে একটি অবান্তর কথা না বললে একটু অন্যায় হবে। অনেক পল্লীবাসী বঙ্গভাষাভাষী বাঙ্গালী মুসলমানও বরাবরই এদেশের বাসীন্দা নন্। তাঁরাও সুদূর অতীতে সুদূর বিদেশ থেকে এসেছিলেন।

উর্দু ভাষাভাষী বাঙ্গালী মুসলমান বঙ্গভাষাভাষী বাঙ্গালী মুসলমানকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন। এমন কি মফঃস্বলের শহরে অনেক সচ্ছল অবস্থার মুসলমান, যাঁরা উর্দু ভালো জানেন না কিন্তু কেবল মুখে বলেন যে উর্দু বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা হওয়া উচিত, তাঁরাও বঙ্গভাষাভাষী মুসলমানকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন। সুতরাং আত্মীয়তার বন্ধন বা অন্য কোনো দায়িত্ব এ সমাজে নেই।

আরো আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই সমস্ত তথাকথিত ইতর শ্রেণীর মুসলমান, যখনই একটু অবস্থার উন্নতি হয়, তখনই, সম্ভ্রান্তের দলে মিশে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনকে পাড়া প্রতিবেশীকে ভুলে যায়।

এমনি ক’রে একদিকে অবস্থাপন্ন মুসলমান যেমন বঙ্গভাষাভাষী মুসলমানকে পর ক’রে রেখেছেন, অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁরা শিক্ষিত ও প্রতিপত্তিশালী তাঁরাও বঙ্গভাষাভাষী মুসলমানকে কিছু আপনার মনে করেন না।

অবস্থার সঙ্গে কৃষ্টির নৈকট্যকে অস্বীকার করা যায় না। সুতরাং বাংলাভাষাভাষী মুসলমান, কি হিন্দু, কি মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যকার উৎকট কৃষ্টির সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে পরিচিত হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

আবার কয়েক কোটি মুসলমানের বাস সত্ত্বেও বাংলা দেশের মুসলমানের কোনো কৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায় না। একটি কৃষ্টিকে গড়ে তুলতে বা পুনরুদ্ধার করতে সমবেত চেষ্টার আবশ্যক। বিছিন্ন হয়ে আমাদের যেমন ক’রে শক্তিক্ষয় হয়েছে তাতে কোনো কৃষ্টি সম্ভব হয়নি।

যে সব সম্ভ্রান্ত মুসলমান বাংলা বর্জ্জন করেছেন, উর্দু যাঁদের মাতৃভাষা, কৃষ্টির দিক দিয়ে তাঁদেরও বিশেষ কিছু পরিচয় পাওয়া যায় না। অবশ্য উর্দুতে কথা বলতে পারাই একটি কৃষ্টি যদি বলা হয়, তবে স্বতন্ত্র কথা। তা না হ’লে ভাব (idea) হিসাবে এঁরাও যে এমন কিছু সম্পৎশালী তা নিশ্চয় ক’রে বলা চলে না। উর্দু সাহিত্যে এঁদের কারও কোনো বিশেষ দানের কথা শোনা যায় না। অন্য কোনো ললিতকলায়ও এদের কোনো এমন কিছু উল্লেখযোগ্য দানের নিদর্শন দেখা যায় না। শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার মধ্যে কত বিচিত্র ভাবের সন্ধান পাওয়া যায়। উর্দু ভাষাভাষী সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালী মুসলমানের মধ্যে কি কেউ তেমন কিছু জগতকে দিতে পেরেছেন? রবীন্দ্রনাথের কথা বাদ দিয়ে দেখা যাক্। ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, নরেশচন্দ্র, জলধর, ভূদেব, রামেন্দ্রসুন্দর ইত্যাদি অসংখ্য বাঙ্গালী মনীষীর নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁদের দানের সমকক্ষ দান কোনো উর্দুভাষাভাষী বাঙ্গালী মুসলমান উর্দু সাহিত্যের ভেতর দিয়ে করতে সক্ষম হননি। এই সব মনীষীদের নাম করতেই হৃদয় যেমন ভক্তিতে পূর্ণ হয়, মাথাও তেমনি শ্রদ্ধায় নত হয়ে পড়ে। উর্দুভাষাভাষী উচ্চপদস্থ বাঙ্গালী মুসলমানের নামোল্লেখে তাঁদের ভাগ্যের প্রশংসা করা যায়, তাঁদের সম্মান করতেও বাধা নেই; কিন্তু হৃদয়ের ভক্তি, অন্তরের শ্রদ্ধা তেমন কি জাগে? তাঁরা ধনে প্রতিপত্তিতে বড়; মুসলমান হিসাবে করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা–তাঁরা আরো বড় হউন! এবং সত্যিই বড় হউন!

কিন্তু ভাবের জগতে তাঁদের অক্ষমতার কথা মনে হ’লে মুসলমান হিসাবে দুঃখ লাগে। তাঁদের অক্ষমতার কারণ এই যে, বাঙ্গালী মুসলমানদের যাঁরা উর্দুর চর্চা করছেন তাঁদের সংখ্যা খুব বেশী নয়। এঁদের ভাবের আদানপ্রদান অল্পসংখ্যক কয়েকজনের মধ্যে আবদ্ধ। সুবিস্তৃত বাংলার বড় বাজারে এঁদের গতিবিধি নেই। তাই কোনো প্রতিযোগিতাও নেই। যিনি যা জানেন, ভালো হোক মন্দ হোক, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট। এঁদের দলের অবস্থা এই–”তু মরা হাজী বগো মন তোরা হাজী বগোয়ম।” তুমি আমাকের বলো হাজী, আমি তোমাকে বলি হাজী। বাস্তবিক এঁদের মধ্যে এমন একটি অনড় Selfcomplacent attitude দেখতে পাওয়া যায়, যা আজকের দিনে জগতের কোনো জাতির পক্ষে অসম্ভব। এদের এমন কতকগুলি সুবিধে আছে যা জগতের কোথাও মেলে না।

এঁদের সুবিধের ভিত্তি মাথা-গুতির অর্থাৎ communal representation এর ওপর; অথচ, সেই communityর প্রতি এঁদের কোনো দায়িত্ব নেই। কিছু লেখাপড়া কোনো প্রকারে আয়ত্ত ক’রে ঐ সাম্প্রদায়িক অধিকারের ধাপের ওপর পা রেখে একবার ডেপুটি বা মুন্সেফ বা অমনি একটা কিছু হবার পর সম্প্রদায়ের প্রতি সব দায়িত্বের একেবারে অবসান! এমন সুবিধে আর কোথাও আছে বলে কেউ বলতে পারবেন না।

যখনই এঁদের দায়িত্বের অবসান হ’ল তখন থেকেই এঁরা স্বজাতি প্রতিবেশী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তখন বঙ্গভাষাভাষী মুসলমানকে অবজ্ঞার চোখে দেখতে আরম্ভ করেন।–এমন কি, বাঙ্গালী বা হিন্দু কনভার্ট বলে তাদের ঠাট্টা বিদ্রূপ করা হয় না, এমন কথা নিঃসংশয়ে বলা চলে না। বাস্তবিক অনেক উর্দু ভাষাভাষী বাঙ্গালী মুসলমানের মনের ভেতরকার ধারণা এই যে, সম্ভ্রান্ত বংশের হলেই ভালো উর্দু বলতে পারা যায় এবং উর্দু না বলতে পারলেই বুঝতে হবে যে লোকটি ইতর শ্রেণীর এবং তার প্রতি ওঁদের কোনো দায়িত্ব নেই এবং থাকা অস্বাভাবিক।

এমনি ক’রে অবস্থা ভালো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে সমস্ত মুসলমান শহরে বাস গ্রহণ করেন এবং সুদূর বা অদূর পশ্চিমের কৃষ্টির অনুকরণ করতে আরম্ভ করেন, তাঁদের সুদূর পল্লীবাসী আত্মীয়-প্রতিবেশীর প্রতি তাঁদের কোনো কালে কোনো দায়িত্ব ছিল বা আছে এ কথা স্বপ্নেও মনে হয় না।

এমন দায়িত্বহীনতার সুবিধে অন্য কোনো জাতির ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয় কারণ অন্য কোনো জাতির বেলায় এমন সুদৃঢ় ভাষার প্রাচীর রচনা ক’রে সেই প্রাচীরের অভ্যন্তরে নিরাপদে ও নিরুপদ্রবে থাকা অসম্ভব।

এখানে একটি কথা বলা আবশ্যক– দায়িত্ব জিনিষটি এমন যে ওকে যথেচ্ছা সংকুচিত ও প্রসারিত করা চলে। সংসারে এমন লোকও আছেন যাঁরা, যেমনই অবস্থা হোক না কেন, সমস্ত জগতের সুখদুঃখের কথা ভেবে তাঁদের যেমন মহিমান্বিত করেছেন, অন্যদিকে তেমন বিপন্নও করেছেন। বাঙ্গালী মুসলমান নেতাদের বেলায় দায়িত্ববোধ জিনিষটি যে যথার্থ প্রসারিত একথা নিঃসংশয়ে বলা চলে না।

কিন্তু, এই দায়িত্ববোধের অভাবের দরুণ আজ সমগ্র বাংলা দেশে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যা নিয়ে বাংলার মুসলমান বড়াই করতে পারে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বেলায় সারা বাংলা দেশে এক করোটিয়া ভিন্ন অন্য কোথাও একটি কলেজ নেই। মাথা গুতির উপর নির্ভর ক’রে আমাদের দেশের মুসলমান মিনিষ্টার হতে চাচ্ছেন, একজিকিউটিভ কাউন্সিলার হতে চেষ্টা করছেন, হাইকোর্টের জজ হবার আশা করছেন; কিন্তু কৈ, এক করোটিয়া কলেজ আর বড়জোর Sir Ahsanullah School of Engineering ভিন্ন অন্য ক’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, যার সঙ্গে মুসলমানের নাম করা যেতে পারে? বাঙ্গালী মুসলমানের মধ্যে এমন পরিবারও আছে যাদের মধ্যে একাধিক ভাগ্যবান পুরুষ ‘Sir’ উপাধি পর্যন্ত প্রাপ্ত হয়েছেন! অবশ্য এঁদের মাতৃভাষা উর্দু এবং বঙ্গভাষাভাষী বাঙ্গালী মুসলমানের প্রতি এঁদের কোনো সত্যিকার দায়িত্ব আছে কিনা তা তাঁরাই বলতে পারবেন।

দায়িত্ববোধ আছে কিনা তা তাঁরা জানেন, কিন্তু সত্যিকার দরদ যে নেই তার প্রমাণ আমরা মাঝে মাঝে পেয়েছি। এবং এমনি ক’রে সত্যিকার দরদ, একটুখানি সহানুভূতির অভাবে আজ কয়েক কোটি বাঙ্গালী মুসলমান কাণ্ডারীবিহীন তরীর মতো ভেসে চলেছে। নিজের পায়ে দাঁড়াবার তাদের সামর্থ্য নেই, নিজের দেশের কাছে এক বিন্দু দাবী দাওয়া নেই তাদের।

অদৃষ্টের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! এই হতভাগ্য বাঙ্গালী মুসলমানই সব চেয়ে কম খেয়ে, কম প’রে সকলের চেয়ে বেশী পরিশ্রম ক’রে এবং সকলের অসম্মান মাথায় নিয়ে দেশের সকলেরই অন্ন যোগাচ্ছে। তাদেরই মাথা-গুতির ওপর নির্ভর ক’রে সম্ভ্রান্ত মুসলমান জজ ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন। কিন্তু এরা যে কি অন্ন খায়, কি জলে তাদের পিপাসা মেটে, কি সুগভীর এদের অশিক্ষা, তা খোঁজ করবার কেউ নেই। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্র, শ্রাবণের অবিরাম ধারা, মাঘের প্রচণ্ড শীত, সবই এদের গায়ের উপর দিয়ে বয়ে যায়। এদের তপ্ত অশ্রু এদের গণ্ড বেয়ে আপনিই ঝরে পড়ে। মোছাবার কেউ নেই! সকল সুযোগ ও সুবিধে থেকে বঞ্চিত এরা, তার ওপর এই উর্দু ও বাংলা তর্ক দিয়ে তাদের ভাষাটুকু পর্যন্ত কেড়ে নেবার বন্দোবস্ত, আর তাতে ক’রে এই শ্রেণীর বিভাগ! এমনি ক’রে এই সর্বহারাদের একেবারে সর্বনাশ করা হচ্ছে।

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *