পল্লী-চিত্র

পল্লী-চিত্র

মুসলমান-সমাজের অর্থ-সমস্যা ক্রমেই জটিলতর হইয়া উঠিতেছে। এ-সত্য আবিষ্কার করিবার জন্য শিক্ষিত অভাবমুক্ত প্রসন্নচিত্ত মুসলমানের বুকে কোনো বেদনার সঞ্চার হইতেছে কি না জানি না। তবে একথা নিঃসংশয়ে বলা চলে যে, পেটের ক্ষুধা পেটেই বহিয়া আজও লক্ষ লক্ষ মুসলমান বেহেশতে যাইবার আশায় মসজিদ নির্মাণ মেরামত ইত্যাদির চাঁদা, ওয়ায়েজ মওলানার রাস্তা-খরচ, মাদ্রাসা মক্তবের চাঁদা, ফকীরের ভিক্ষা ইত্যাদি অকাতরে দান করে। এই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দোজখের ভয় কত বড় তাহা আজিকার জড়বাদী জগতের পক্ষে উপলব্ধি করা একেবারে মুস্কিল ব্যাপার। কিন্তু বড় দুঃখ লাগে যে, সমাজনেতারা যে পরিমাণ দোজখের ভয় দেখাইয়া এই সব নিঃস্ব- সন্তানগণকে শাসন করিতে সর্বদা যত্নবান, ইহাদের সাংসারিক জীবনের ব্যর্থতার প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা করিবার জন্য তেমন উদ্যোগী নহেন।

সেদিন কোনো কার্যোপলক্ষে এক গ্রামে দুপুর বেলা উপস্থিত হইতে হইয়াছিল। স্নানের জন্য একটু দূরে একটি ভালো পুকুর আছে শুনিয়া তথায় যাওয়া গেল। গ্রামটিতে শুধু মুসলমানের বাস। পুকুরে গিয়া যে অবস্থা দেখিলাম তাহাতে স্নানের স্পৃহা আর রহিল না। পুকুরের জলের রং ঈষৎ লালাভ, –কাঠের তক্তা, কাঁচা ডাবের খোলা ইত্যাদি পুকুরের মধ্যে দেখা গেল। জলের কোলে যে-কাদা দেখা যাইতেছিল সে পচা কাদা।

আমি বলিলাম, এখানে স্নান করিব না। কিন্তু যাঁর অতিথি হইয়াছিলাম তিনি বলিলেন–না, এ পুকুরে স্নান করিলে কোনো অসুখ হইবে না, এ পুকুরের জল ভালো। আমার মন মানিল না, তবু উত্তরোত্তর রৌদ্রের প্রখরতা বৃদ্ধি হওয়ায় এবং বার বার কোনো অসুখের ভয় নাই এইরূপ আশ্বাসবাণী শোনায় শেষে একটি ডুব দিয়া স্নান সমাপন করিব স্থির করিলাম।

ইতিমধ্যে তিনজন লোক বড় বড় তিনটি মাটির কলসী হাতে করিয়া ঐ পুকুরে স্নান করিতে আসিল। লোকগুলি আসিয়াই কলসী তিনটি পূর্ণ করিয়া পুকুরের পাড়ে যত্নে রাখিয়া দিল। কলসী তিনটি তারা ঠিক মাটির উপর না রাখিয়া শুকনো কলাপাতার উপর রাখিয়াছিল এবং দু’জন কলসীর মুখ নারিকেলের মালা দিয়া ঢাকা দিয়া রাখিয়াছিল। তৃতীয় ব্যক্তি মালা সঙ্গে আনে নাই বলিয়াই হউক অথবা সহস্র অভাবের ভিতর এই সামান্য ব্যাপারের প্রতি উদাসীনতার দরুণই হউক কলসীর মুখ কোনো কিছু দিয়া ঢাকিল না।

ইহারা যখন স্নান করিতেছিল তখন পুকুরের মালিক আসিয়া বলিল-”তোমরা উঠে পড়, সাহেব স্নান করিবেন।” আমার স্নানের তাড়া ছিল না। ইহাদের রূঢ়ভাবে স্নান সমাপন জন্য তাড়না করায় আমি লজ্জিত হইয়াছিলাম। কিন্তু লোকগুলিকে কোনরূপ বিচলিত হইতে দেখা গেল না। এমন কত কর্কশ ভাষায় তারা সর্বদাই অভ্যস্ত! লোক তিনটির একজনের বয়স ২০/২১ বৎসর, অপর দুইজন ৩০/৩২ বৎসর বয়সের হইবে। স্নান সম্পন্ন করিতে তাহাদের আজ বোধ হয় অপেক্ষাকৃত বিলম্বই হইতেছিল। অমন রূঢ়ভাবে তাহাদিগকে উঠিতে বলা সত্ত্বেও তাহারা বিচলিত না হওয়ায় এবং অত বিলম্ব করায় আমার মনে হইতেছিল– লোকগুলি ছালে পুরু-প্রকৃতির। আমি মনে ভাবিতেছিলাম, অমন ভাষায় স্বগ্রামবাসী কেহ যদি আমাকে উঠিতে বলিত তবে তৎক্ষণাৎ উঠিয়া যাইতাম এবং ভবিষ্যতে আর কখনো এই পুকুরে আসিতাম না।

লোকগুলির মধ্যে যার বয়স ২০/২১ বৎসর সে একখানি লুঙ্গি পরিয়াই স্নান করিতেছিল। তার একখানা গামছাও ছিল এবং উপরে একখানা শুকনা লুঙ্গিও রাখা ছিল। এই লোকটি সকলের শেষে আসিয়াছিল এবং সকলের পূর্বেই উঠিয়া পড়িল। সে যথারীতি গা মুছিয়া লুঙ্গি বদলাইয়া কলসী কাঁধে তুলিয়া লইয়া প্রস্থান করিল। তার চলিয়া যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে যে উঠিল তার পরিধানে অপ্রশস্ত পাৎলা সিক্ত লুঙ্গি শরীরের উঁচু নিচু অংশগুলিকে আবরণ-আশ্রয় দিতে অক্ষম– পাড়ে আমাদের বিশিষ্ট ভদ্রলোক ও সাঙ্গপাঙ্গ সকলের প্রায় বিংশতি চক্ষুর সামনে লোকটি যথাসম্ভব নিজেকে সঙ্কুচিত করিয়া অবনত মস্তকে অত্যন্ত কুণ্ঠার সহিত উঠিয়া চট করিয়া ময়লা এবং দুই তিন জায়গায় ছিদ্রযুক্ত লুঙ্গি খানিকে টানিয়া লইয়া পরণের লুঙ্গিটি বদলাইয়া ফেলিল। সঙ্গে গামছাও ছিল না, ক্রয় করিবার সঙ্গতিও নাই! পরিধানের সঙ্গে সঙ্গে সিক্ত লুঙ্গি ও পরিহিত লুঙ্গি একাকার হইয়া গেল। তখন সিক্ত বস্ত্রখণ্ড নিড়াইয়া গা মাথা মুছিবার আর প্রয়োজন রহিল না। সে জলপূর্ণ কলসী কাঁধে উঠাইয়া দ্রুত প্রস্থান করিয়া বিংশতি চক্ষুর আড়ালে গিয়া হাঁপ ছাড়িয়াই যে বাঁচিল তাহা তখন বুঝা গেল যখন দেখিলাম যে কিছু দূরে গিয়া সে জঙ্গলের ফাঁক দিয়া কুণ্ঠিত ব্যাকুল নয়নে আমাদের দিকে ঘাড় ফিরাইয়া তাকাইয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিল যে, কেহ তাহার অবস্থা দেখিয়া পরিহাস করিবার জন্য তাহার দিকে চক্ষু নিবদ্ধ করিয়া আছে কিনা। আমি সে দিকেই তাকাইয়াছিলাম বটে! লোকটি যখন ঘাড় ফিরাইয়া দেখিতেছিল তখন আমার চক্ষুদ্বয়ের প্রতি সে লক্ষ্য করিতে পারিয়াছিল কিনা জানি না, কিন্তু যতদূর দেখা গেল সে আর দ্বিতীয়বার ঘাড় ফিরাইতে সাহস করে নাই। বুঝা গেল পরিবার বস্ত্র নাই কিন্তু লজ্জা মরিয়া যায় নাই।

তৃতীয় ব্যক্তি এতক্ষণে স্নান সম্পন্ন করিয়া উপরে উঠিয়া পড়িয়াছে। তাহার গামছা ছিল না; দ্বিতীয় লুঙ্গিও নাই। পিছু ফিরিয়া হাত দিয়া যতটুকু সম্ভব গায়ের জল ঝাড়িয়া লইল। অপ্রশস্ত বস্ত্রের দরুণ লজ্জার অবধি ছিল না। কিন্তু কলসীতে পানীয় জল, কলসীর মুখে ঢাকনাও নাই; তুলিতে গেলে গায়ের জল কলসীতে পড়িবে এই ভয়েই সে আমাদের দিকে পিছন ফিরিয়া নিজেকে যথাসম্ভব খাটো করিয়া হাত দিয়া গা মুছিবার চেষ্টা করিয়াছিল। তবুও যখন কলসী তুলিতে গেল তখন মাথার চুলের মধ্যে লুক্কায়িত কয়েকফোঁটা জল এবং আরও কয়েক ফোঁটা কপাল ও গণ্ড বহিয়া আসিয়া কলসীতে টপাটপ পড়িতে লাগিল। লোকটি একবার জলের দিকে তাকাইয়া কি ভাবিল, তাহার পর কলসীর মুখ ধরিয়া কয়েকটা ঝাঁকি দিল, আবার যেন কি ভাবিয়া মুহূর্তের মধ্যে কলসী কাঁধে লইয়া ভিজা গায়ে ভিজা কাপড়ে প্রস্থান করিল। আমরা উপস্থিত না থাকিলে হয়তো সে জল বদলাইয়া লইত। কিন্তু ৩০/৩২ বৎসর বয়সের সবল কর্মী (Village Blacksmith এর মতো মাংসপেশীর অধিকারী) গৃহস্থের পক্ষে অতগুলি চোখের সামনে দারিদ্র্যের ছবিটি আর কতক্ষণ ধরিয়া রাখা সম্ভব হয়। বেচারার তখন প্রস্থান ভিন্ন আর উপায়ই বা কি ছিল। এই জল সে এবং তার প্রাণাধিকা স্ত্রী, স্নেহের পুত্তলী সন্তান-সন্ততি সকলেই পান করিবে। অথচ ঐ গ্রামে সেদিনও একটি লোক কলেরায় মারা গিয়াছে।

যাঁর অতিথি হইয়াছিলাম তাঁহাকে বলিলাম– “আপনারা একটি টিউব ওয়েলের বন্দোবস্ত করেন না কেন?” বেচারা অনেক কথা বলিল। বলিতে বলিতে কয়েক ফোঁটা অশ্রু তাহার গণ্ড বহিয়া ঝরিয়া পড়িল।

মনে হইল– মুসলমান আজ বড় অসহায়। তার লজ্জা আছে কিন্তু বস্ত্ৰ নাই; ক্ষুধা আছে অন্ন নাই। কবে তাহাদের এই অবস্থার পরিবর্তন হইবে কে জানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *