2 of 2

৯৮. প্লেটো (খ্রীস্টপূর্ব ৩২৭-খ্রীস্টপূর্ব ৩৪)

৯৮. প্লেটো (খ্রীস্টপূর্ব ৩২৭-খ্রীস্টপূর্ব ৩৪)

সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল- মানুষের চিন্তা আর জ্ঞানের জগতে তিন উজ্জল নক্ষত্র। সক্রেটিসের মধ্যে যে চিন্তার উন্মেষ ঘটেছিল; প্লেটো, অ্যারিস্টটল তাকেই সুসংহত দর্শনের রূপ দিলেন। এঁরা শুধু যে গ্রীসের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক তাই নয়, সমগ্র ইউরোপের জ্ঞানের জগতে যুগপুরুষ।

প্লেটো ছিলেন সেই সব সীমিত সংখ্যক মানুষদের একজন যারা ঈশ্বরের অকৃপণ করুণা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম হয়েছিল সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারে। অপরূপ ছিল তার দেহলাবণ্য, সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞানের প্রতি আকাঙ্ক্ষা, সক্রেটিসের মত গুরুর শিষ্যত্ব লাভ করা, সব কিছুতেই তিনি ছিলেন সৌভাগ্যবান।

পিতা ছিলেন এথেন্সের বিশিষ্ট ব্যক্তি। কিন্তু আভিজাত্যের কৌলিন্য তাকে কোনদিন স্পর্শ করেনি। রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে তিনি বরাবরই ছিলেন উদাসীন। বাস্তব জীবনের জটিলতা, সমস্যার চেয়ে জ্ঞানের সীমাহীন জগৎ তার মনকে আরো বেশি আকৃষ্ট করত। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ভাবুক আর কল্পনাপ্রবণ। এক সময় এথেন্স সর্ববিষয়ে সমৃদ্ধ। প্লেটো যখন কিশোর সেই সময় সিসিলির সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এথেন্স। এই যুদ্ধের পর থেকেই শুরু হল সেই সময় সিসিলির সাথে যুদ্ধ জড়িয়ে পড়ে এথেন্স। এই যুদ্ধের পর থেকেই শুরু হল এথেন্সের বিপর্যয়। দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠিত হল স্বৈরাচারী শাসন। সমাজের সর্বক্ষেত্রে দেখা দিল অবক্ষয় আর দুর্নীতি।

প্লেটো বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে শিক্ষা লাভ করেছে। তাদের কারোর কাছে শিখেছেন সংগীত, কারোর কাছে শিল্প, কেউ শিখিয়েছেন সাহিত্য আবার কারো কাছে পাঠ নিয়েছেন বিজ্ঞানের। সক্রেটিসের প্রতি ছেলেবেলা থেকেই ছিল প্লেটোর গভীর শ্রদ্ধা। সক্রেটিসের জ্ঞান, তার শিক্ষাদানের পদ্ধতির প্রতি কিশোর বয়সেই আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন। কুড়ি বছর বয়সে তিনি সক্রেটিসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।

তরুণ প্লেটো অল্পদিনের মধ্যেই হয়ে উঠলেন সক্রেটিসের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য। গুরুর বিপদের মুহূর্তেও প্লেটো ছিলেন তার নিত্য সঙ্গী।

বিচারের নামে মিথ্যা প্রহসন করে সক্রেটিসকে হত্যা করা হল। সক্রেটিসের মত্যু হল কিন্তু তার প্রজ্ঞার আলো জ্বলে উঠল শিষ্য প্লেটোর মধ্যে। প্লেটো শুধু যে সক্রেটিসের প্রিয় শিষ্য ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন গুরুর জ্ঞানের ধারক-বাহক। গুরুর প্রতি এত গভীর শ্রদ্ধা খুব কম শিষ্যের মধ্যেই দেখা যায়। প্লেটো যা কিছু লিখেছেন, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর প্রধান নায়ক সক্রেটিস। এর ফলে উত্তর কালের মানুষদের কাছে একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সক্রেটিসকে কেন্দ্র প্লেটো তাঁর সব সংলাপ তত্ত্বকথা প্রকাশ করেছেন। সবসময়েই প্লেটো নিজেকে আড়ালে রেখেছেন-কখনোই প্রকাশ করেননি। সক্রেটিসের জীবনের অন্তিম পর্যায়ের যে অসাধারণ বর্ণনা করেছেন প্লেটো তার “সক্রেটিসের জীবনের শেষ দিন” গ্রন্থে, জগতে তার কোনো তুলনা নেই।

প্লেটোর মত প্রতিভাবান পুরুষ যে শুধুমাত্র সক্রেটিসকে অন্ধ অনুসরণ করে তার অভিমতকেই প্রকাশ করেছেন, এ কথা মেনে নেওয়া কষ্টকর। তাঁর কথোপকথনগুলো দীর্ঘকাল ধরে রচনা করা হয়েছে। প্লেটোর মত একজন মহান চিন্তাবিদ দার্শনিক সমস্ত জীবন ধরে শুধু সক্রেটিসের বাণী প্রচার করবেন, একথা কখনই মেনে নেওয়া যায় না। তাই পণ্ডিত ব্যক্তিদের ধারণা, প্লেটো তার নিজের অভিমতকেই প্রকাশ করেছেন। তার এই সব অভিমতের উৎস ও প্রেরণা হচ্ছে সক্রেটিসের জীবন ও তাঁর বাণী।

গুরুর মৃত্যুতে গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন প্লেটো। তার কয়েক বছরের এথেন্স স্পার্টার হাতে সম্পূর্ণ হাতে বিধ্বস্ত হল। আর এথেন্সে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি যখন যে দেশেই গিয়েছেন সেখানকার জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিতদের সাথে নানান বিষয়ে আলোচনা করতেন। এতে একদিন যেমন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞানের প্রসার ঘটছিল, অন্যদিকে তেমনি পণ্ডিত দার্শনিক হিসাবে তাঁর খ্যাতি সম্মান ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। দীর্ঘ দশ বছর ধরে প্রবাসে জীবন কাটিয়ে অবশেষে ফিরে এলেন। এথেন্সে।

মহান শুরুর মহান শিষ্য। ভ্রমর যেমন ফুলের সুবাসে চারদিকে থেকে ছুটে আসে দলে দলে, ছাত্ররা এসে ভিড় করল প্লেটোর কাছে। সক্রেটিস শিষ্যদের নিয়ে প্রকাশ্য স্থানে গিয়ে শিক্ষা দিতেন কিন্তু প্লেটো উন্মুক্ত কল-কোলাহলে শিক্ষাদানকে মেনে নিতে পারতেন না। নগরের উপকণ্ঠে প্লেটোর একটি বাগানবাড়ি ছিল, সেখানেই তিনি শিক্ষাকেন্দ্র, খুললেন, এর নাম দিলেন একাডেমি। এই একাডেমির ছাত্রদের কাছেই প্লেটো উজাড় করে দিলেন তার জ্ঞান চিন্তা মনীষা। তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল সিসিলি দ্বীপের শাসকদের আহবানে তিনি উপদেষ্টা হিসাবে সেখানে যান। তিনি চেয়েছিলেন সিসিলিকে এক আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে গঠন করতে। দার্শনিকদের চিন্তাভাবনার সাথে রাষ্ট্রনেতাদের চিন্তাভাবনার কোনদিনই মিল হয় না। তাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে এলেন এথেন্সে। তার এই অভিজ্ঞতার আলোকে লিখলেন রিপাবলিক-এক আদর্শ রাষ্ট্রের রূপ ফুটে উঠেছে সেখানে। আসলে প্লেটোর আগে দর্শনশাস্ত্রের কোন শৃঙ্খলা ছিল না। তিনিই তাকে একটি সুদৃঢ় ভিক্তির উপর প্রতিষ্ঠা করলেন। তাকে নতুন ব্যঞ্জনা দিলেন। তিনি জীবনব্যপী সাধনার মধ্যে দিয়ে মানুষকে দিয়েছেন এক নতুন প্রজ্ঞার আলো। ইউরোপ তাঁকে বর্জন করলেও আরবরা তাঁকে গ্রহণ করল। আরব পণ্ডিতরা তাঁকে নতুনভাবে আবিষ্কার করল। আবার চারদিকে প্রচারিত হল তার আদর্শবাদ। ইউরোপের মানুষের চিন্তাভাবনা মননের জগতে যে দুজন মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তাদের একজন প্লেটো, অপরজন অ্যারিস্টটল।

প্লেটোর চিন্তাভাবনা তাঁর যুগকে অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে এক চিরকালীন সত্য। প্লেটোর চিন্তাভাবনার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে তার রিপাবলিক গ্রন্থে। বিশ্ব সাহিত্যেল এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। যদিও বইখানিতে মূলত রাষ্ট্রনীতির আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রনীতির প্রয়োজনে এখানে নানান প্রসঙ্গ এসেছে। মানব জীবন এবং সমাজ জীবনে যা কিছু প্রয়োজন শরীরচর্চা, শিল্পকলা, সাহিত্য, শিক্ষা, এমনকি সুপ্রজনন বিদ্যা। এছাড়াও কাব্য অলঙ্কার নন্দন তত্ত্ব এই বইয়ের অন্তর্ভূক্ত। প্লেটো রাষ্ট্রের নাগরিকদের তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন- (১) শাসক সম্প্রদায়, (২) সৈনিক, (৩) জনসাধারণ ও ক্রীতদাস।

রাষ্ট্র তখনই সুপরিচালিত হয় যখন তিন বিভাগের কাজের মধ্যে সুসামঞ্জস্য বর্তমান থাকে এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে। তিনি বলেছেন শাসক সম্প্রদায়ের প্রয়োজন জ্ঞান, শাসন ক্ষমতা- সৈনিকদের চাই সাহস বীরত্ব, জনগণের প্রয়োজন সংযম ও শাসকদের প্রতি আনুগত্য। রাষ্ট্রের উন্নতি-অবনতি অনেকাংশে নির্ভর করে শাসকদের উপর। তাই প্লেটো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন শাসক নির্বাচনের উপর।

তিনি বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্র ক্ষমতায় কোন স্বৈরাচারীর স্থান নেই। “রাষ্ট্রের অস্তিত্ব শুধু জীবন ধারণের জন্য নয়। যতদিন মানুষ জীবিত থাকবে ততদিনই সে শ্রেষ্ঠ জীবন যাপন করবে।” তার রাষ্ট্রব্যবস্থায় উচ্চ-নীচের ভেদ থাকবে না, থাকবে পারস্পরিক সৌহার্দ ও প্রীতির সম্পর্ক। দি লস গ্রন্থে তিনি বলেছেন, নগরবাসীরা সকলে পরস্পরকে জানবে বুঝবে। এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আর কিছুই হতে পারে না।

সুপ্রজনন বিজ্ঞান-প্রাচীন গ্রীসের মানুষেরা সুস্থ সবল দেহের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিত। তারা দুর্বল অসুস্থ শিশুকে জীবিত রাখবার পক্ষপাতী ছিলেন না। প্লেটো এই অভিমত সমর্থন করতেন। তাই তিনি বলেছেন, যাদের শরীর ব্যাধিগ্রস্থ তাদের কোন সন্তান প্রজনন করা উচিত নয়। আপাত দৃষ্টিতে প্লেটোর অভিমত নিষ্ঠুর বলে মনে হলেও সামাজিক বিচারে তা একেবারে মূল্যহীন নয়। সংগীতের প্রতি প্লেটোর ছিল গভীর আকর্ষণ। তিনি বিশ্বাস করতেন সংগীত মানব জীবনকে পূর্ণতা দেয়, মানবিক গুণকে বিকশিত করে। নারীদের প্রতি প্লেটোর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। তাদের শিক্ষা সম্বন্ধে তিনি উদার নীতিতে বিশ্বাস করতেন। সেই যুগে অনেক মহিলাই পুরুষের যোগ্য সঙ্গিনী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মনে করতেন পুরুষেরা অহমিকাবশত নারীদের উপেক্ষা করে। গ্রীসের পুরুষদের এই অহমিকা প্লেটোকে স্পর্শ করেনি। তিনি দেখেছেন বিভিন্ন গ্রীক মনীষীদের প্রেরণার উৎসই হচ্ছে নারী।

প্লেটো তাঁর আইন সমস্ত শিক্ষার মধ্যে দিয়ে এক আদর্শ রাষ্ট্র, মানব সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। জীবনের অন্তিম পর্বে এসে বাস্তবের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন, রিপাবলিকের মধ্যে তিনি যে রাষ্ট্রের যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন তা কোনদিনই বাস্তব হওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি লিখলেন তার আইন (Laws) গ্রন্থ। এতে মানুষের বাস্তব প্রয়োজন, তার কল্যাণের কথা চিন্তা করে রাষ্ট্রের আদর্শের কথঅ বলেছেন। দার্শনিক প্লেটোর আরেক দিক তার কবিসত্তা। তাঁর প্রবন্ধগুলোর মধ্যে একদিকে যেমন প্রকাশ পেয়েছে জ্ঞান, গভীরতা, প্রজ্ঞা… অন্যদিকে ফুটে উঠেছে অন্যতম লালিত্য। দর্শনের ভাষা যে এমন প্রাণবন্ত, কাব্য সৌন্দর্যে অতুলনীয় হয়ে উঠতে পারে, প্লেটোর রচনা না পড়লে তা অনুভব করা যায় না। প্লেটো কবিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না কিন্তু তাঁর রচনার মধ্যে কবি আর দার্শনিকসত্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। তাই তাঁর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক রাসেল বলেছেন, “প্লেটো ভাবুক ছিলেন না- ছিলেন কলাকুশলী। তাঁর প্রতিটি রচনাই সাহিত্যক নিপুণতার এক উৎকৃষ্ঠ নিদর্শন। কোথাও তার রচনা নাটকীয়, কোথাও ঐতিহাসিক ঘনঘটায় আচ্ছন্ন। ভোরের আলোছায়ার মত তার রচনায় হাস্যরস, গাম্ভীর্য, করুণ রস একই সাথে পরস্পরকে অনুগমন করেছে। বিষয় বৈচিত্র্যে রচনাশৈলীর সৌন্দর্য আর বিশুদ্ধতার প্লেটোর নাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যস্রষ্টাদের পাশে অমর হয়ে থাকবে।”

প্লেটো ছিলেন একেশ্বরবাদী। তাঁর ঈশ্বর মঙ্গলময়, তিনি মানুষের কল্যাণ করেন। তিনি পূজা পাঠ উপাসনাকে স্বীকার করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন শ্রদ্ধা আর পবিত্র চরিত্র। সেই সাথে প্রজ্ঞা, জ্ঞানের মাধ্যমেই ঈশ্বরের পূজা করতে হয়।

একদিন তার এক বন্ধুর ছেলের বিয়েতে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার কলকোলাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। বিশ্রাম নেবার জন্য পাশের ঘরে গেলেন কিন্তু আনন্দ উল্লাসের শব্দ ক্রমশই বেড়ে চলছিল। উপস্থিত সকলেই ভুলে গিয়েছিল বৃদ্ধ দার্শনিকের কথা। এক সময় বিবাহ শেষ হল। নব দম্পতি আশীর্বাদ গ্রহণের জন্য প্লেটোর কক্ষে প্রবেশ করল। প্লেটো তখন গভীর ঘুমে অচেতন। পৃথিবীর কোন মানুষের ডাকেই সে ঘুম ভাঙাবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *