৩৫. আজিজ মিয়া

৩৫

মহিতোষের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মইনুল। তার চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা। মহিতোষ অবশ্য ততটা আগ্রহ দেখালেন না। মইনুল বলল, আপনি বুঝতে পারছেন আমি কী বলছি?

জি পারছি।

কী বুঝতে পারছেন?

আপনি ফরিদদের খোঁজ পাওয়ার খুব কাছাকাছি চলে গেছেন।

জি। বলে থামল মইনুল। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।

মহিতোষ ভাবলেশহীন চোখে তাকালেন। যেন কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না তার। মইনুল বলল, পুলিশ আমাদের মেস সিলগালা করে দিয়েছে। আপাতত কেউ আর ওই মেসে থাকতে পারবে না। আমি উঠেছি আমার এক বন্ধুর মেসে।

কেন?

কারণ, পুলিশের ধারণা আমাদের মেসে ভয়ংকর এক অপরাধী ছদ্মবেশে আত্মগোপন করে ছিল। তার নামে অনেকগুলো গুরুতর অভিযোগ আছে। ধর্ষণ এবং খুনের মামলাও আছে।

কী বলছেন আপনি? এবার যেন খানিক অবাক হলেন মহিতোষ।

জি। এবং সেই লোকের নাম শুনলে আপনি চমকে যাবেন।

আমি? আমি তাকে চিনি? মহিতোষ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন।

জি, চেনেন।

কে?

আজিজ মিয়া।

মহিতোষ কপাল কুঁচকে তাকালেন, আজিজ মিয়া! যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না অর।

জি। এবং সে এখানে মিথ্যা পরিচয়ে ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিল। অথচ পুলিশ ভেবেছিল সে ঢাকাতেই নেই। অন্য কোথাও আছে। এতদিন ধরে তাকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজছিল পুলিশ। কিন্তু সে যে একদম তাদের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটা পুলিশ বুঝতে পেরেছে অনেক পরে।

মহিতোষের হঠাৎ ভয় হতে লাগল। যদি সত্যি সত্যিই আজিজ মিয়া এমন ভয়ংকর কেউ হয়ে থাকে, তবে তা পারুর জন্য আরো বিপজ্জনক। তিনি বললেন, এখন তাহলে উপায়?

মইনুল সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। খানিক স্থির হয়ে বসল সে। তারপর বলল, এখানে ভয়ের যেমন ব্যাপার আছে, তেমনি ভয় না পাওয়ারও ব্যাপার আছে।

ভয় না পাওয়ার কী ব্যাপার?

ধরেন আপনার মাথায় যখন এতবড় বিপদের খাড়া ঝুলতে থাকবে, তখন আপনি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন? নাকি অন্যের পেছনে ছুটবেন?

মহিতোষ বিড়বিড় করে বললেন, নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করব।

সেটাই। আজিজ মিয়ার সামনে-পেছনে এখন বিপদ। সে এখন চেষ্টা করবে নিজেকে বাঁচাতে। পারু আর ফরিদের পেছনে এখন আর তার লেগে থাকার কথা না।

মহিতোষ কথা বললেন না। যেন কিছু ভাবছেন তিনি। মইনুল বলল, আপনাকে এমন লাগছে কেন?

কেমন?

মনে হচ্ছে আপনি খুশি হননি?

কী নিয়ে খুশি হবো?

এই যে আমি বললাম পারু-ফরিদের খোঁজ পাওয়ার একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমি?

হুম।

হুম কী? আপনি এতে খুশি হননি?

মহিতোষ ক্লান্ত গলায় বললেন, খুশি হতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পারছি না বাবা।

কেন?

জানি না। মনের মধ্যে আর সাহস নাই বাবা। সারাক্ষণ খালি ভয়। গাছের একটা পাতা পড়লেও কলিজা কেঁপে ওঠে। এমন ভয় সারাক্ষণ। ভয়ে এতটুকু হয়ে থাকি। আমার কী মনে হয় জানেন?

কী?

পরশ পাথর আছে না? পরশ পাথরের নাম শুনেছেন?

জি শুনেছি।

আমি হচ্ছি পরশ পাথরের মতো। তবে ভালো পরশ পাথর না, খারাপ পরশ পাথর। অপয়া।

মানে? আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

মানে পরশ পাথর কী করে? যা ছোঁয়, তা-ই সোনা হয়ে যায়। তাই না? ছাই ছুঁইলেও ছাই সোনা হয়ে যায়। আর আমার ক্ষেত্রে ঘটনা হলো উল্টা। আমি যদি সোনাও ছুঁই, তাহলে সেই সোনাও ছাই হয়ে যায়। আমি হলাম অপয়া। ভগবান আমার জন্য ভালো কিছু রাখেন নাই। আমার ধারণা আমার মেয়ের সঙ্গে এই জীবনে আর কখনোই দেখা হবে না আমার…।

এসব আপনি কী বলছেন? দু-একদিনের মধ্যেই আমরা আপনার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারব।

পারব না। দেখা যাবে আমি গিয়ে তার ঘরের দরজায় দাঁড়াব। আর তখুনি শুনব, কিছুক্ষণ আগেই সে অন্য কোথাও চলে গেছে। কিন্তু কাউকে কিছু বলে যায় নাই।

মহিতোষের গলা প্রায় ভেঙে পড়ছে। যেন দীর্ঘ যুদ্ধে আহত, পরাজিত, হতোদ্যম এক সৈনিক। মইনুল বলল, এমন কিছু হবে না। আমি আশপাশের এলাকার বেশির ভাগ ওষুধের দোকানেই খোঁজ নিয়ে ফেলেছি। এর মধ্যে দুই দোকানদার আমাকে জানিয়েছে, তাদের কাছে বেশ কিছুদিন আগে ফরিদ নামের একজন কাজের জন্য গিয়েছিল। কিন্তু তখন লোক দরকার ছিল না বলে তারা নিতে পারেনি। আমার ধারণা তাকে আমরা খুব শীঘ্রই পেয়ে যাব।

মহিতোষের মধ্যে তারপরও কোনো উচ্ছ্বাস দেখা গেল না। তিনি ক্লান্ত, অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছেন। তাঁর চোখের কোলে কালি পড়ে গেছে। কার হাড় বের হয়ে গেছে। মুখে কাঁচা-পাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ভাঙা গালের হনু উঁচু হয়ে আছে। মইনুল বলল, আপনি এত ভেঙে পড়বেন না। এতদিন এত কষ্ট করেছেন। এবার অন্তত একটু শক্ত হন। ভাগ্য কি এতটাই নিষ্ঠুর যে সবসময়ই কেবল একজন মানুষকে বঞ্চিত করতে থাকবে?

আমি জানি না। বলে ভাঁজ করা দু হাঁটুর মাঝখানে কুঁজো ভঙ্গিতে মাথা খুঁজলেন মহিতোষ। তারপর বললেন, আমার খুব ভয় হয় বাবা। খুব ভয় হয়।

কীসের ভয়?

মনে হয়, আমি এই রাস্তা-ঘাটে কোথাও মরে পড়ে থাকব। আমার লাশ পড়ে থাকবে হাসপাতালের মর্গে। অজ্ঞাতনামা লাশ হিসেবে ডাক্তাররা আমার লাশ নিয়ে কাটা-ছেঁড়া করবে। আমি মহিতোষ মাস্টার। আমার স্ত্রী আছে, মা আছে, দুটা সন্তান আছে। তাদের কাউকে আমি আর এই জনমে দেখতে পাবো না। বলেই হঠাৎ কাঁদতে লাগলেন মহিতোষ। তবে তার সেই কান্না নিঃশব্দ। কুঁজো হয়ে বসে থাকা মানুষটার ভাঁজ করা পিঠটা থরথর করে কাঁপছে। সেই কম্পন ছুঁয়ে যাচ্ছে মইনুলকেও। সে আলতো করে মহিতোষের পিঠে হাত রাখল। তারপর বলল, আমি বুঝতে পারছি আপনার ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে। কিন্তু একটা কথা আছে না, বিপদ যত বাড়ে, আসলে বিপদ তত কমে? আপনার বিপদ তো আর বাড়ার অবস্থায় নাই, এখন তারে কমতেই হবে। এত কষ্ট করে এই শেষ মুহূর্তে এসে যদি আপনি এভাবে ভেঙে পড়েন, তাহলে চলবে? চলবে না।

মহিতোষ জবাব দিলেন না। মইনুল তার পাশে বসেই রইল। তার হাতখানা এখনো মহিতোষের পিঠে। যেন ওই হাতের স্পর্শে দুমড়েমুচড়ে ভেঙে যাওয়া মানুষটাকে খানিক সাহস দেয়ার চেষ্টা করছে সে। খানিক জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। দীর্ঘ সময় পর মহিতোষ মাথা তুলে তাকালেন। তাঁর চোখ লাল। তিনি হাতের উল্টোপিঠে চোখে লেগে থাকা জলের ধারা মুছতে মুছতে বললেন, আপনি। সত্যি বলছেন, আমি আবার পারুকে দেখতে পাব?

পাবেন।

যদি না পাই?

কেন পাবেন না?

তাতো জানি না। বলে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথার ওপরে তাকালেন তিনি। সেখানে শূন্য আকাশ। আকাশের গায়ে মেঘ। সেই মেঘের ভেতর থেকে যেন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে আলো। মহিতোষ বললেন, কিন্তু সারাটাক্ষণ আমার মন বলে, আমি আর কোনোদিন তার ওই মুখটা দেখতে পাব না। তার মুখে বাবা ডাকটা শুনতে পারব না। তার দরজায় গিয়ে দেখব সে নেই!

মইনুল এবার শক্ত করে মহিতোষের হাতখানা ধরল। তারপর বলল, এই যে আমি, আমি শুধু আপনার জন্যই তো এত ছোটাছুটি করছি। করছি না?

হু।

তাহলে? আমি তো এগুলো নাও করতে পারতাম?

মহিতোষ মাথা নাড়লেন, হু।

এই ঢাকা শহরে তো আপনি কাউকে চেনেন না। তো আমি না হলে পারু আর ফরিদের খোঁজে আপনি একা একা কী করতেন? পারতেন কিছু করতে?

নাহ।

তাহলে এই যে আমাকে পেলেন। এই যে আমি আমার সব কাজ বাদ দিয়ে আপনার জন্য দিনের পর দিন ওদের খুঁজছি। এবং প্রায় পেয়েও গেছি। এটাও কি কম কিছু? এটা আপনার ভাগ্য না?

মহিতোষ কথা বললেন না। তবে মইনুলের চোখের দিকে তিনি তাকালেন। মইনুল বলল, এর মানে কী? এর মানে ভাগ্য শুধু আপনার সঙ্গে বিরূপ আচরণই করছে না, সে আপনার সহায়ও হচ্ছে। বলে সামান্য থামল সে। তারপর বলল, হ্যাঁ, হয়তো এতদিন সে বিরূপ ছিল, কিন্তু এখন সদয় হচ্ছে। এটাও তো এক ধরনের ইঙ্গিত। ইঙ্গিত না?

মুখে কোনো জবাব না দিলেও মইনুলের কথায় যেন খানিক প্রশান্তি বোধ করলেন মহিতোষ। যেন সে সত্যি কথাই বলছে। আসলেই তো, না হলে মইনুলের মতো এমন অচেনা-অজানা একজন মানুষ কেন তার জন্য এতকিছু করবে? হয়তো এও ভগবানের ইশারায়ই। এই এতদিনের এত এত দুর্ভোগ, কান্না, কষ্ট, তেষ্টার পর ভগবান হয়তো চাইছেন, এবার খানিক বিরাম পান তিনি। খানিক শান্তি মিলুক। ক্ষান্ত হোক এই অবিরাম যুদ্ধ ও যন্ত্রণার। যে প্রবল হতাশা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল, নির্জীব করে ফেলেছিল পুরোপুরি, মইনুলের ওইটুকু কথাতেই যেন তাতে আবার প্রাণ ফিরে এলো।

তিনি হঠাৎ মইনুলের হাত দু খানা জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, ভগবান আপনার মঙ্গল করবেন বাবা। আপনি সত্যি সত্যিই আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যেতে পারবেন? আমার মায়েরে যদি আমি এক নজর দেখি, তাইলেই আমার এই বুকটা বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। আমি আর কিছু চাই না বাবা। একবার খালি আমার মায়ের মুখটা দেখতে চাই। এই বুকের ভেতর সারাক্ষণ আগুন জ্বলতে থাকে বাবা। কী যে কষ্ট, কী যে কষ্ট! এই কষ্টের কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। বাবাগো, আমার মায়রে আমি একটা নজর দেখতে পারবো না? একটা নজর…। আমি আর কিছু চাই না, কিছু না…।

মহিতোষ কাঁদছেন। দু হাতে মুখ চেপে ধরে নিঃশব্দ কান্না। তার সেই কান্নায় ভেসে যাচ্ছে জীবন ও জগৎ। ক্ষত-বিক্ষত বুকের গহিন। অন্তহীন যন্ত্রণার দিন ও রাত্রির প্রার্থনা।

.

পরদিন ভোরে একসঙ্গেই বের হলেন তারা। এই খোঁজাখুঁজিটা কঠিন। কারণ নির্দিষ্ট কোনো এলাকার কথা আজিজ মিয়া বলেননি। ফলে আশপাশের প্রায় সব এলাকার ওষুধের দোকানেই জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে তাদের। তার চেয়েও বড় সমস্যা, ঢাকা শহরের ওষুধের দোকানের কোনো নির্দিষ্ট তালিকা নেই। ফলে তাদের পক্ষে এটিও বোঝা সম্ভব নয় যে অসাবধানতাবশত কোনো দোকান বাদ পড়ে গেল কী না! তারপরও যতটা সম্ভব সময় নিয়ে সাবধানেই খুঁজতে লাগলেন মহিতোষ ও মইনুল। পরদিন ঠিক দুপুর বেলা তারা যে দোকানটির সামনে এসে দাঁড়ালেন, সেই দোকানের নাম রহমান ফার্মেসি।

ফার্মেসিতে অল্প বয়সী এক ছেলে বসে আছে। মইনুল সরাসরিই তাকে জিজ্ঞেস করল, ফরিদ আছে?

আজ তো সে আসে নাই। ছেলেটা টুপ করে জবাব দিল।

মহিতোষের আচমকা মনে হলো তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি কিছুতেই শ্বাস নিতে পারছেন না। তার বুকের ভেতর অজস্র পাখি যেন সপাটে ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। তিনি চেষ্টা করছেন তাদের থামাতে, কিন্তু পারছেন না।

মইনুল আজ ইচ্ছে করেই দোকানগুলোতে গিয়ে এভাবে ফরিদের কথা জিজ্ঞাস করেছে। যাতে চট করে কেউ ধরতে না পারে যে তারা অচেনা কাউকে খুঁজছে। লোকে তখন নানা বাহানা দেখায়। উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে। তারচেয়ে এই পদ্ধতিটাই ভালো।

মইনুল বলল, কেন? আসেনি কেন?

তার বউয়ের নাকি শরীর খারাপ। এইজন্য পরশু থেকে তিনদিনের ছুটি নিছে। কাল থেকে আসবে। তার বদলে আমি ডিউটি করতেছি।

মহিতোষের ভয়টা আবার ফিরে আসতে লাগল। ছেলেটা কি ফরিদের বউ বলতে পারুর কথা বোঝাচ্ছে? কী হয়েছে পারুর? খুব খারাপ কিছু নয়তো? তিনি চট করে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তার? খুব সিরিয়াস কিছু।

না না। বলল, হঠাই নাকি মাথা ঘুরে বাথরুমে পড়ে গেছে। শরীর দুর্বল।

ওহ! যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মহিতোষ। মইনুল বলল, ইনি ফরিদের স্কুল শিক্ষক। ঢাকায় এসেছিলেন একটা কাজে। যাওয়ার আগে একটু ফরিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছিলেন। কিন্তু কী আর করা, সে তো নাই।

নাই তো কী হইছে? বাসায় চলে যান?

তার নতুন বাসার ঠিকানা তো আমার কাছে নাই।

আমার কাছে আছে। বলেই ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। তারপর একটা কাগজে লিখে দিতে দিতে বলল, এইখান থেকে রিকশা নিলেই একদম বাসার সামনে নামাই দেব।

মহিতোষ কাগজটা হাতে নিলেন। ছেলেটার হাতের লেখা অস্পষ্ট। তবে তাতেও তার ঠিকানাটা পড়তে অসুবিধা হলো না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ঠিকানাটা পড়তে পড়তেই তাঁর হাত কাঁপতে লাগল। চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল। মনে। হলো চারপাশের পৃথিবীটা ক্রমশই অস্পষ্ট হয়ে আসছে। আচ্ছা, তিনি কী কাঁদছেন? আশ্চর্য, এখন তিনি কাঁদবেন কেন? ওই তো পারু। আর খানিকটা পথ, আর কিছুটা সময়। খুব সামান্য। তারপরই পারুর সঙ্গে দেখা হবে তার। তিনি যখন গিয়ে পারুর ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে ডাকবেন, পারু, পারু, ও মা, মারে…।

তখন কী করবে পারু?

৩৬

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বসে আছেন প্রায় অন্ধকার এক ঘরে। তাঁর সামনে কামাল। যদিও তাকে দেখে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া প্রথমে চিনতে পারেননি। মনে হচ্ছিল এই লোককে আগে কখনো দেখেননি। শেষবার তিনি যখন কামালকে দেখেছিলেন, তখন তার চুল ছিল কামানো। এমনিতেই তার চুল কম। তার ওপর সেবার নাপিতের কাছে গিয়ে ক্ষুর দিয়ে চেছেছে সব চুল ফেলে দিয়েছিল সে। সঙ্গে দাড়িও। এর অবশ্য কারণও ছিল। নারীঘটিত কোনো এক মামলা থেকে বাঁচতে ভুবনডাঙা গিয়ে লুকিয়েছিল কামাল। এই কথা অবশ্য জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া ছাড়া আর কেউ জানত না। নিজের বোনকেও বলেনি সে। কিন্তু এরপর হঠাই আবার কী এক জরুরি কাজে ঢাকায় চলে আসতে হয়েছিল তাকে।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অবশ্য এতদিন কামালের ওপর একটু নাখোশই ছিলেন। মহিতোষের ব্যাপারটি নিয়ে তিনি জরুরি চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাকে। যেন চিঠি পাওয়া মাত্রই সে ভুবনডাঙায় চলে আসে। কিন্তু কামাল যায়নি। শুধু যে যায়নি, তাও নয়। সে সেই চিঠির উত্তর পর্যন্ত দেয়নি।

বিষয়টা নিয়ে রেগে থাকলেও তাঁর এই একমাত্র শ্যালকটিকে তিনি খুব পছন্দও করেন। কাজে-কর্মে তার জুড়ি মেলা ভার। তাছাড়া সে ঠাণ্ডা মাথার ভয়ংকর মানুষ। প্রয়োজনে এমন কিছু নেই যা সে করতে পারে না। নিজের বন্ধুকে পর্যন্ত খুন করেছে সে। তাও সামান্য একটি মেয়ের জন্য। তার এই একটিই সমস্যা। কোনো মেয়েকে পছন্দ হয়ে গেলে আর যুক্তি-বুদ্ধি কিছু কাজ করে না। মুহূর্তেই অন্য এক মানুষ হয়ে যায় সে। এই নিয়েই নানা ঝামেলা তার জীবনে। স্বাধীন, স্বেচ্ছাচারী, বেপরোয়া জীবনে নির্বোধের মতো একাধিক বিয়েও করেছে কামাল। সমস্যা হচ্ছে, সেই একাধিক বিয়ের সংখ্যা সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা নেই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। একেক সময় একেক নারীর সঙ্গে তাকে দেখেছেন তিনি। তবে সবচেয়ে বড় যে ঝামেলাটা সে পাকিয়েছিল, তা হলো তার বন্ধুর সঙ্গে। যে কি না একই সঙ্গে তার ব্যবসায়িক অংশীদারও ছিল।

কেরাণীগঞ্জে লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা ছিল তাদের। সেই ব্যবসা ভালোই চলছিল। কামাল চাইছিল লোহা-লক্কড়ের ব্যবসার আড়ালে বৈধ-অবৈধ আরো কিছু ব্যবসা করতে। কিন্তু বন্ধু তাতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। ফলে তাকে একপ্রকার না জানিয়েই গোপনে সেই ব্যবসা শুরু করে দিল সে। বিষয়টা প্রকাশিত হয়ে গেল এক পুলিশি ঝামেলায়। ফলে দুজনের মধ্যে শুরু হলো নানা সমস্যা, মতবিরোধ। সেই মতবিরোধ ভয়ানক বিরোধে পরিণত হলো বন্ধুর স্ত্রীর কারণে। তার সঙ্গে গোপন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কামালের। সেই সম্পর্ক জানাজানি হলো এক মধ্যরাতে। কামালকে তার বন্ধু হাতেনাতে ধরে ফেলল তার স্ত্রীর সঙ্গে। কী এক কাজে সে গিয়েছিল চট্টগ্রামে। কিন্তু তিনদিনের ট্যুর সংক্ষিপ্ত করে হঠাৎই তাকে ঢাকায় ফিরে আসতে হলো। আর ফিরে সে আবিষ্কার করল, কামাল তার বাসায়। এই নিয়ে তৈরি হলো ভয়ানক পরিস্থিতি। ব্যবসা ভাগাভাগি হয়ে গেল। কামালের বিরুদ্ধে অবৈধ ব্যবসার অভিযোগে একাধিক মামলা হলো। সেই মামলায় তার অংশের ব্যবসা পুরোপুরি ধসে গেল। জেলেও যেতে হলো তাকে। তবে জেল থেকে বের হয়ে কামাল প্রথম যে কাজটি করল, তা হলো তার বন্ধুকে খুন করে ফেলল। তারপর তার লাশ ভাসিয়ে দিল বুড়িগঙ্গায়। সেই থেকে শুরু হলো তার ফেরারি জীবন। আজ এখানে তো কাল সেখানে। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও মেয়েমানুষের প্রতি তার আসক্তি কমেনি এতটুকুও। বরং বাড়তে থাকল। বাড়তে থাকল তার অপরাধের পরিমাণ এবং প্রবণতা।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, তোর মাথায় এগুলা কী?

চুল দুলাভাই।

তাতো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু এই চুল তুই কই পাইছিস? তোর মাথায় তো চুল ছিল না!

অরিজিনাল চুল। বহুত টাকা দিয়া কিনছি। বিশ্বাস না হয় ধরে দেখেন।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বিরক্ত গলায় বললেন, ধরে দেখতে পারব না। কিন্তু তুই এই উদ্ভট বেশ ধরছিস কেন? তোকে দেখে তো আমি জীবনেও চিনতাম না। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুই সত্যি সত্যিই আমাদের কামাল। মনে হচ্ছে আমি অন্য কারো সামনে বসে আছি। অচেনা অন্য কেউ।

কামাল হাসল। বলল, এই বেশ কেন ধরছি সেটা তো আপনি জানেনই দুলাভাই। আমার হচ্ছে এখন অন্যের জীবন। সারাক্ষণ নানা পরিচয়ে থাকতে হয়।

এই অবস্থার মধ্যে তুই পারু-ফরিদের খোঁজ করবি কেমনে?

ওটা নিয়া আপনি চিন্তা করবেন না। সব ব্যবস্থা আমি করব।

কী ব্যবস্থা করবি?

আমি আপনারে পারুদের কাছে নিয়া যাব। আপনি নিজ চোখে তাকে দেখে আসবেন। তার সঙ্গে কথা বলবেন। পারুরে বলবেন যে তার বাবা ঢাকায় আছে। তাহলেই সে সুরসুর করে আপনার সঙ্গে চলে আসবে।

আসবে?

অবশ্যই আসবে।

নাও তো আসতে পারে। কারণ সে জানে আমি লোক ভালো না। তাদের ক্ষতি যা করার সব আমিই করছি।

এইটা অবশ্য ভালো কথা। সেক্ষেত্রেও ব্যবস্থা আছে।

কী ব্যবস্থা?

পুলিশের ভয় দেখাবেন। বলবেন যে তারা যে পালিয়ে আসছে, এই কথা পুলিশে জানাই দেবেন। বিয়া-শাদি না করেই যে দুজন একসঙ্গে থাকতেছে, এইটাও। এরপর আর তাদের উপায় থাকবে না। তার ওপর দুজনের ধর্মও আলাদা। বিপদের ওপর বিপদ। আসলে তো আমরা পুলিশের কাছে যাব না। শুধু ভয় দেখাব। এই হুমকি হাড্রেডে হান্ড্রেড কাজে দেবে। কোনো মিস নাই।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া আরো একবার কামালের বুদ্ধিতে মুগ্ধ হলেন। তিনি আসলে একটু চিন্তায়ই ছিলেন যে ঢাকায় তো এসেছেন, এবার পারুদের কবজা করবেন কী করে? ভুবনডাঙায় যে কাজটা তার জন্য অতি সহজ, সেই কাজটিই এখানে ঠিক ততটাই কঠিন। কিন্তু কামালের কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে, বিষয়টা খুব একটা কঠিন হবে না। বরং যে টোটকা কামাল শিখিয়ে দিয়েছে তা প্রয়োগ করতে পারলে ফলাফল অব্যর্থ।

কামাল বলল, তবে দুলাভাই, একটা কথা।

কী কথা?

বলতে শরম লাগতেছে।

শরমের কী আছে? বল।

না মানে…। যেন একটু ইতস্তত করল সে। তারপর বলল, এই মেয়ে কিন্তু আমার খুব পছন্দের। সেই ভুবনডাঙা থেকেই তার ওপর আমার নজর। এছাহাক মিয়া সাক্ষী। কিন্তু আমার কপাল খারাপ, বারবার একটা না একটান ঝামেলা হয়। এবার কিন্তু আর…।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া মৃদু ধমকের স্বরে বললেন, ওসব পরে দেখা যাবে, আগে আসল কাজ হোক।

সব হবে। নো টেনশন। আপনি কার কাছে আসছেন? আমার কাছে। এরপরও টেনশন করলে হবে?

কামালের কথা সত্য। এখানে এসে নিজেকে অনেক নির্ভার লাগছে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। মনে হচ্ছে তাঁর আর কোনো ভয় নেই, দুশ্চিন্তা নেই। যত ঝামেলাই আসুক না কেন কামাল সব সামলে নেবে। সমস্যা হচ্ছে, কামাল নিজেই আছে। বিপদে। তার চারপাশে জাল বিছিয়ে রেখেছে পুলিশ। সামান্য অসতর্কতায়ও বড় ধরনের বিপদ ঘটে যেতে পারে। সুতরাং যতটা সম্ভব সাবধানে থাকতে হবে তাদের।

কামাল বলল, পারুর সঙ্গের এই ফরিদ ছেলেটা কে দুলাভাই?

ওহাব ডাক্তারের ভাইগ্না।

ওহ, কিন্তু এর সঙ্গে তো আমার ভুবনডাঙায় দেখা হয় নাই।

না-ই হতে পারে। হয়তো তখন সে গ্রামে ছিল না। আর তাছাড়া গ্রামের সবার সঙ্গেই কি তোর দেখা হয়েছে না-কি? কতজনের সঙ্গেইতো তোর দেখা হয় নাই।

হ্যাঁ, তাও কথা। এজন্যই পারুরে আমি যেদিন দেখলাম, চিনে ফেললাম। কিন্তু ফরিদরে চিনতে পারি নাই।

এখন কী করব বল?

কী আর করবেন? পাখি খাঁচায় ভরবেন। এবার তো একদম সোনায় সোহাগা। মাস্টারেও হাজির। জমিজমার বিষয়টা এইবার ক্লিয়ার করে নেবেন। সে যদি কারো কাছে বেশি দামে জমি বেচেও থাকে, তাহলেও সমস্যা নাই।

সমস্যা নাই মানে? সে জমি বিক্রি করলে আমরা কী করব?

তার কাছে সম্ভবত ওই জমি বিক্রির সব টাকাই এখনো আছে। আমি ইচ্ছা করেই তাকে টাকার কথা বলেছিলাম। সময় নেয়ার জন্য। যাতে সে ঘুরে ফিরে আমার কাছেই আসে। তখন বুঝলাম তার কাছে ভালো টাকা-পয়সা আছে। সে বলল, টাকা কোনো ব্যাপার না, দিতে রাজি। সে শুধু পারুরে চায়।

কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন আজাহার ভূঁইয়া। তার মানে মহিতোষ আসলেই তার জমি-জমা, বসতবাড়ি, সব কারো কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন? কিন্তু কার কাছে? ওই গ্রামে কার এই পরিমাণ নগদ অর্থ আছে? বিষয়টা ভেবেও কোনো উত্তর পেলেন না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। সত্যি সত্যিই যদি কেউ ওই সম্পত্তি কিনে থাকে তাহলে এতদিনেও কেন সে তা বুঝে নিতে এলো না? ঘটনা কী?

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মুখে আবার চিন্তার ভাঁজ পড়ল। কামাল বলল, এত চিন্তার কিছু নাই। কাল সন্ধ্যায় ফরিদদের ওখানে যাব। তখন সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাপ-মেয়ে পাশাপাশি বসে আপনারে সব বলবে।

জাহাঙ্গীর ভুইয়া তারপরও চিন্তামুক্ত হলেন না। বরং আরো বেশি গম্ভীর হয়ে পড়লেন। হঠাৎ করেই যেন কিছু একটা তাকে তীব্র অস্বস্তি দিতে লাগল। বিষয়টা তিনি অনুভব করতে পারছেন, কিন্তু ধরতে পারছেন না। এ যেন মাছের সূক্ষ্ম কাঁটা বেঁধার মতো। যন্ত্রণাটা টের পাওয়া যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায় না। কামাল একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে, কিন্তু সেদিকে তার মন নেই। তার মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। কিন্তু সেই অন্য কোথাওটা কী?

.

রাতে ঘুমাতে গিয়েও প্রচণ্ড অস্থির হয়ে রইলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। বিকেলের ওই অস্বস্তিকর অনুভূতিটা আবার ফিরে আসছে। তার মস্তিষ্ক যেন অবচেতনেই কিছু একটা ভাবছে। কিন্তু কী ভাবছে সেটি তিনি ধরতে পারলেন না। নিজের ওপরই নিজের অসম্ভব বিরক্ত লাগছে। তিনি উঠে গ্লাসে পানি ঢেলে খেলেন। তারপর জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। একবার বারান্দায়ও গেলেন। পায়চারি করলেন কিছুক্ষণ। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হলো না। অস্থিরতাটাও কমল না। ঘরে এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন তিনি। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল শান্ত অথচ কঠিন এক মানুষের ছবি।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার ঘাড়ের কাছটা হঠাৎ শিরশির করে উঠল। তাঁর চোখের সামনে আশরাফ খাঁর মুখটা ভেসে উঠেছে। মানুষটার সাথে বিশেষ এক হিসেবে কথা একদমই ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। অথচ তার সঙ্গে পুরনো সেই হিসেব এখনো বাকি আছে আশরাফ খাঁর!

.

সারা রাত আর ঘুমাতে পারলেন না তিনি। জেগে রইলেন একা। তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে রইল। তিনি পরদিন ভোর থেকেই অস্থির হয়ে উঠলেন। কামাল বলল, আপনার কী হয়েছে দুলাভাই?

আমি মহিতোষ মাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

অবশ্যই তার সঙ্গে দেখা হবে।

কখন দেখা হবে?

আগে আজ পারুর সঙ্গে দেখা হোক। তারপর মহিতোষ মাস্টার।

না, আমি আজই মহিতোষ মাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

কামাল হাসল। বলল, অস্থিরতার কিছু নাই। আপনি চাইলে আজ মহিতোষ মাস্টারের সঙ্গেও দেখা হবে। পারুর সঙ্গেও।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কথা বললেন না। তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন সন্ধ্যার । সন্ধ্যার অন্ধকারেই তারা বেরিয়ে পড়বেন পারুর উদ্দেশ্যে। সূচনা হবে তার নতুন দিনের।

৩৭

মহিতোষ মাস্টার রিকশা থেকে নামলেন। সামনে রাস্তার কাজ চলছে। এ কারণে রাস্তা বন্ধ। ফলে খানিকটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে তাদের। কিন্তু তিনি হাত পায়ে শক্তি পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছে। যেকোনো সময় মাটিতে লুটিয়ে পড়বেন। তারপরও অনেক কষ্টে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু পুরোপুরি পারছেন না। মইনুল বলল, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?

নাহ। শক্ত কণ্ঠে বললেন মহিতোষ।

কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার শরীর খারাপ লাগছে। গা ঘামছে আপনার।

ও কিছু না। আমার একটু প্রেসারের সমস্যা আছে। সে কারণে হয়তো এরকম লাগছে।

আমরা কি কোথাও একটু জিরিয়ে নেব?

নাহ।

আচ্ছা। বলে হাঁটতে লাগল মইনুল। মহিতোষ খানিক চুপ থেকে আবার বললেন, ফরিদের বাসা আর কতদূর?

এই তো চলে এসেছি প্রায়। বলেই ঠিকানাটা আবার দেখল সে। পাশের বাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে নিল। একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করল। সে আঙুল উঁচিয়ে দূরে নির্দেশ করে বলল, এই সাত-আটটা বাড়ির পরে। সামনে গিয়ে ডান দিকে যাবেন। ওই রাস্তার দ্বিতীয় বাড়িটাই ।

লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল তারা। বেশিক্ষণ লাগল না বাড়িটার সামনে এসে পৌঁছাতে। একটা পুরনো আমলের বাড়ি। বাইরের পলেস্তরা খসা পাঁচিলটাও প্রায় ধসে পড়েছে। এখানে-ওখানে ময়লা জমে আছে। তার পাশেই ভাঙা গেট। তবে গেটে কোনো দারোয়ান নেই। মইনুল ধাক্কা দিতেই ভেতরের দিকে খুলে গেল গেটটা। একটা ঢংঢং শব্দ হলো সঙ্গে। তারা মাথা নিচু করে গেট পেরিয়ে বাড়িটাতে ঢুকল। সেখানে খানিক খোলা জায়গা। কখানা নারকেল ও কাঁঠাল গাছও রয়েছে। ডানদিকের ঘরের দেয়ালঘেঁষে দু খানা পেয়ারাগাছ হেলে আছে। প্রায় জঞ্জালের তূপ হয়ে আছে ছোট্ট জায়গাটা। পুরোনো বাতিল জিনিসপত্র পড়ে আছে। সেখানে এসে দাঁড়াল মইনুল। তার পাশে মহিতোষ মাস্টার। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তাঁর। দোকানের ছেলেটা তো এই ডান পাশের ঘরখানার কথাই লিখে দিয়েছিল তার মানে এই ঘরেই থাকে পারু? ওই যে বুক অবধি উঁচু দেয়াল, ওই দেয়ালের ওপাশে যে অর্ধেকটা লোহার দরজা দেখা যাচ্ছে, ওই দরজার ওপাশেই!

মহিতোষের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। হাত পাঁচেক দূরের ওই বন্ধ দরজাটার ওপাশেই পারু? তিনি এখন দরজায় কড়া নাড়তেই সে দরজা খুলে দেবে। অথবা ভেতর থেকে বলবে, কে?

তিনি যদি তখন বলেন, আমি! দরজাটা খোল।

পারু তখন কী করবে? সে কি সঙ্গে সঙ্গেই তার বাবাকে চিনতে পারবে? নিশ্চয়ই পারবে। মাত্র তো কটা দিন। এ কদিনেই কি কেউ তার বাবার কষ্ঠ ভুলে যেতে পারে? কখনোই না।

তার হঠাৎ খুব তেষ্টা পেতে লাগল। প্রচণ্ড জলতেষ্টা। যেন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। তিনি কয়েকবার ঢোক গিলে বললেন, আমি যাব? না আপনি?

মইনুল মৃদু হাসল। মানুষটাকে দেখে তার মায়াই লাগছে। সে বলল, আপনিই যান। আমি এখানে দাঁড়াই।

মহিতোষ সামনে এগোলেন। তারপর পারুদের ঘরের দরজায় নক করলেন। একবার, দুবার, তিনবার। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলল না। কোনো কথাও বলল না। ভীত মহিতোষ হঠাৎ উচ্চ স্বরে ডাকতে লাগলেন, পারু, ও পারু। পারু… আমি তোর বাবা পারু…। ও ফরিদ, ফরিদ। আমি মহিতোষ, তোমার স্যার। ভুবনডাঙার মহিতোষ মাস্টার। ও ফরিদ, ফরিদ…।

মহিতোষের গলা কাঁপছে। তিনি হাতের উল্টোপিঠে জোরে জোরে শব্দ করতে লাগলেন দরজায়। মইনুল হঠাৎ শব্দ শুনে এগিয়ে এলো। বলল, কী হয়েছে?

ওরা দরজা খুলছে না। আমি এত ডাকছি, কেউ কোনো সাড়াও দিচ্ছে না। ও পারু, পারু…। মহিতোষের গলা মনে হয় ভেঙে পড়ছে। মইনুল হঠাৎ তার কাঁধে হাত রেখে বলল, চাচাজি, দরজা তো বাইরে থেকে বন্ধ। এই যে, তালা মারা।

মহিতোষ নিচের দিকে তাকালেন। সেখানে দরজার সঙ্গে একটা চকচকে নতুন তালা ঝুলছে। তিনি সেই তালার দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। এত বড় একটা তালা ঝোলানো এখানে, অথচ এতক্ষণেও তিনি তা খেয়াল করেননি!

মইনুল বলল, ওরা সম্ভবত বাসায় নেই।

তাহলে?

কোথাও গেছে হয়তো।

মহিতোষের মনে হলো, তিনি আচমকা জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন। তারপর লুটিয়ে পড়বেন মাটিতে। তারপর আর কখনো উঠবেন না। তার এই অবর্ণনীয় যন্ত্রণা আর ভয়ানক তেষ্টার অবসান ঘটবে। তিনি ফাঁসফেঁসে গলায় বললেন, কোথায় গেছে ওরা? ওরা কী সত্যিই এখানে থাকে?

মইনুল মহিতোষের প্রশ্নের জবাব দিল না। তবে পাশের ঘরের লোকটাকে খুঁজে বের করল। তারপর জিজ্ঞেস করল, এখানে ফরিদ নামে কেউ থাকে?

জি থাকে।

আর কে থাকে?

তারা জামাই-বউ থাকে।

তারা কই?

কই তাতো জানি না। তয় ঘন্টা দুই আগে দুজনে সেজে-গুঁজে বের হইছে। কোথাও ঘুরতে গেছে মনে হয়। বলল যে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হইতে পারে। আবার একটু দেরিও হইতে পারে।

রাত হবে?

ওইতো, সন্ধ্যার পরপর।

মইনুল এবার মহিতোষের দিকে তাকাল। বলল, দেখলেন তো? চিন্তার কিছু নাই। সন্ধ্যার পরই ওরা ফিরে আসবে।

মহিষের তাও বিশ্বাস হলো না। তিনি এবার নিজেই লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন, ফরিদের সঙ্গে যে মেয়েটা থাকে, তার নাম কী?

নাম…। বলে যেন একটু থমকালো লোকটা। খানিক ভেবে বলল, পারু বা পারুল। এইরকম কিছু একটা। মেয়েছেলের নাম আমি জিজ্ঞাস করি না।

মহিতোষের মনে হলো, তিনি বহুবছর ধরে বুকে আটকে রাখা দম ছাড়লেন। পারু তাহলে এখানেই থাকে! এ বিষয়ে তার আর কোনো সন্দেহই রইল না। এখন কেবল অপেক্ষা। সন্ধ্যা হওয়ার অপেক্ষা।

তিনি বাড়ির সামনের ভাঙা পাচিলটার ওপর বসে রইলেন।

.

ফরিদ আর পারু অবশ্য সেই রাতে ফিরল না।

মহিতোষ তবুও বসে রইলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। তারপর নেমে এলো রাত্রির অন্ধকার। সেই অন্ধকার আরো গাঢ় হলো। কিন্তু ফরিদ আর পারু ফিরল না। তারা ফিরল না পরদিন ভোরেও। কেন ফিরল না সেই প্রশ্নের উত্তরও কারো কাছে নেই। মহিতোষ তবু বসে রইলেন। একমুহূর্তের জন্যও কোথাও গেলেন না তিনি। তার চোখে কেমন ঘোলাটে দৃষ্টি। পাণ্ডুর মুখ। তিনি সেই পাণ্ডুর মুখে বসে রইলেন পাথরের মূর্তির মতো নিথর, নিশ্চল। পরদিন দুপুরের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়লেন মহিতোষ। তবুও জায়গা থেকে নড়তে চাইলেন না তিনি। শেষ বিকেলে তাকে জোর করে ধরাধরি করে পাশের ঘরের লোকটার বিছানায় নিয়ে শোয়াল মইনুল। লোকটা বলল, উনি এত চিন্তা করছেন কেন? তারা নতুন জামাই-বউ ঘুরতে টুরতে গেছে হয়তো। সময় মতো চইলা আসব। এটা নিয়া এত চিন্তার কী আছে? হয়তো কোনো বন্ধু-বান্ধবের বাসায় বেড়াইতে গেছে। যাইতে পারে না?

হু। পারে। বলল মইনুল।

তাহলে এত চিন্তার কী আছে?

চিন্তার কিছু নেই।

চিন্তার কিছু না থাকলে উনি এমন করতেছেন কেন?

মইনুল এই প্রশ্নের উত্তর কী দেবে? সে কী করে বোঝাবে মহিতোষ কেন এমন করছেন? এই কথা বোঝানোর সাধ্য তার নেই। লোকটা বলল, সরেন, সরেন। আমি ওনার মাথায় একটু তেল-পানি দিয়া দিই। আর জোর করে কিছু খাওয়াই। দেখবেন উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।

মইনুল সরে গিয়ে লোকটাকে জায়গা করে দিল। সে মহিতোষের মাথায় তেল পানি ডলে দিতে লাগল। আর এক মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, এত অল্পতেই অস্থির হইলে হয় না চাচা মিয়া। মানুষের জীবনে আপদ-বিপদের শেষ আছে? নাই। কত মানুষের কত বড় বড় আপদ-বিপদ। তারাই টাইট মাইরা দাঁড়াই থাকে। আর আপনি এই এক দিনেই কাইত হইয়া গেলেন। এমনে হইলে চলবে? চলবে না। শক্ত হইতে হবে। আরেকটা কথা, কাল আসে নাই তো কী হইছে? দেখবেন আজ চইলা আসবে। আজ সন্ধ্যায়ই চইলা আসবে।

তা এলোও। লোকটার কথাই সত্যি হলো। সন্ধ্যার পরপরই গেটের কাছে কারো পায়ের শব্দ শোনা গেল। শোনা গেল গেটের ঢংঢং শব্দও। মহিতোষ হঠাৎ তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। যেন খানিক আগের অসুস্থতাটা মিথ্যে কিংবা ভান ছিল। নাহলে অমন একজন মানুষ মুহূর্তেই কী করে আবার এমন সবল হয়ে ওঠেন? উঠে দাঁড়ান? তিনি উঠেই ছুটে গেলেন গেটের দিকে। সেখানে হাট করে খোলা গেট। কিন্তু সেই গেটের কোথাও পারু নেই। মহিতোষ ছুটে গেটের বাইরে এলেন, তারপর আবার ভেতরে ঢুকলেন। তারপর আবার বাইরে। কিন্তু পারুকে কোথাও দেখতে পেলেন না তিনি! তবে গেটের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ফরিদ। তার শরীর জল-কাদায় মাখামাখি। ফ্যাকাশে মুখজুড়ে কালিঝুলি লেগে আছে। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের অনুজ্জ্বল দাগ। মাথার চুলগুলো উস্কোখুস্কো, নোংরা। রাজ্যের ময়লা লেগে আছে তাতে। তার গায়ের জামাটা বেশ কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় বিবর্ণ, ধূসর মুখ। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে মহিতোষ আচমকা কেঁদে ফেললেন। তারপর জড়ান গলায় বললেন, পারু কোথায়? পারু?

ফরিদ অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো একঘেয়ে গলায় বলল, পারু নাই! পারু নাই!

নাই মানে? পারু কই গেছে? মহিষে কাঁদছেন।

পারু? ফরিদ অদ্ভুত অসংলগ্ন ও জড়ান গলায় জিজ্ঞেস করল।

হুম।

পারু নাই!

নাই মানে? পারু নাই?

না। ফরিদের হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।

মহিতোষ মরিয়া ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, ফরিদ, ও ফরিদ… পারু কোথায়? পারু? আমার পারু… আমার পারু কোথায়? ও ফরিদ? ফরিদ?

ফরিদ বিড়বিড় করে বলল, সে নাই, সে নাই।

নাই মানে? সে কই গেছে?

কই গেছে? ফরিদও উল্টো প্রশ্ন করল নিজেকে। যেন বোধ বুদ্ধি হারান একজন মানুষ সে। সে ঘোরগ্রস্ত গলায় বলল, জানি না।

ও ফরিদ, ফরিদ। পারু কই? কই সে? মহিতোষের গলা বুজে আসছে।

ফরিদ এবার আর জবাব দিল না। কেবল একটানা বিড়বিড় করতে লাগল, পারু? পারু কই? আমার পারু কই? সে নাই, পারু নাই…।

তারপর আচমকা শিকড় ওপড়ানো গাছের মতোই উপড়ে পড়ল সে। জ্ঞান হারাল সঙ্গে সঙ্গেই। মহিতোষ ছুটে গিয়ে তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেন। তারপর দু হাতে ফরিদের মুখ চেপে ধরে বলতে লাগলেন, পারু কোথায়? আমার পারু? পারু?

কাছেই তখন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তাঁর সঙ্গে কামাল। তারা দুজনও রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেছেন, পারু নেই মানে? কোথায় গেছে পারু? পারস্পরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন তারা। তাদের চোখে মুখে অবিশ্বাস, কোথায় যাবে পারু?

খুব গোপনে, সাবধানে পারুর খোঁজে এসেছেন তারাও। কিন্তু এখানে এসে এসব কী শুনছেন? ফরিদ কী বলছে এগুলো? পারু যাবে কোথায়? সে পারুকে কোথায় রেখে এসেছে? কী হয়েছে পারুর?

এমন অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরে বেড়াতে লাগল তাদের মনেও। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর কারো কাছেই নেই। ফলে দিতেও পারল না কেউ। কেবল কতগুলো মানুষ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন মহিতোষও। তবে তাকে দেখে আর জীবিত কোনো মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে মৃত এক লাশের শরীরে অলৌকিক উপায়ে বয়ে বেড়ানো নিঃসাঢ়, নিস্পন্দ এক অস্তিত্ব। সেই স্পন্দনহীন শরীর অপেক্ষায় আছে মহাপতনের। তারপর সে নিমিষেই মিলিয়ে যাবে নিঃসীম কোনো শূন্যতায়। অনন্ত অসীমে। তবে সেই অসীম অনন্তেও হয়তো একটানা বেজে যেতে থাকবে ফরিদের ওই দুটি মাত্র শব্দ, পারু নাই! পারু নাই!

.

প্রশ্ন হচ্ছে, পারু তাহলে কোথায়?

(দ্বিতীয় খণ্ডে সমাপ্য)

1 Comment
Collapse Comments
ফারদীন March 17, 2023 at 7:34 pm

এখানেই কি শেষ এই উপন্যাসটা?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *