৩০. আতাহার মওলানার বাড়ির সামনে

৩০

মহিতোষ দাঁড়িয়ে আছেন আতাহার মওলানার বাড়ির সামনে। তিনি সকালের ট্রেনে ঢাকা থেকে এসেছেন। এখন প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এই সময়ে সাধারণত পুরুষ লোকরা বাড়িতে থাকে না। থাকে মেয়েরা। ফলে তিনি চাইলেই নিঃসঙ্কোচে বাড়িতে ঢুকে যেতে পারেন। কিন্তু কেন যেন ভয় হচ্ছে তার। যে প্রবল প্রত্যাশা নিয়ে তিনি ঢাকা থেকে এক মুহূর্তেই রওয়ানা হয়েছেন, সেই প্রত্যাশা যদি পূরণ না হয়? যদি দিলারা কিছু না জানে? যদি ফরিদ আর পারু তাকে কিছু না জানিয়েই। ঢাকায় গিয়ে থাকে।

শেষরাতে ঘুমাতে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে হঠাৎ করেই ভাবনাটা মাথায় এসেছিল মহিতোষের। সেদিন দিলারা যখন তাকে বলল যে পারু আর ফরিদ ঢাকায় চলে যাচ্ছে। তারা স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানাও করে ফেলেছে। ঠিক ওই সময়ে তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেননি মহিতোষ। কিংবা বলার সুযোগও দেননি। সঙ্গে সঙ্গেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়েছিলেন স্টেশনের উদ্দেশ্যে। তারপর ভয়ানক সব মুহূর্ত। রাজ্যের দুশ্চিন্তা, দুর্ভোগ, ভয়। ফলে এই সহজ বিষয়টা একবারও তার মাথায় আসেনি। তিনি চাইলেই তো দিলারার কাছ থেকে জানতে পারতেন ঢাকায় কোথায় যাচ্ছে ফরিদ আর পারু? ওই অতবড় শহরে নিশ্চয়ই নাম-ঠিকানাবিহীন ঘুরে বেড়াবে না তারা! নিশ্চয়ই কারো না কারো কাছে যাবে? আর তাদের ঠিকানা না জানার কথা নয় দিলারা। এমনও হতে পারে যে হয়তো দিলারাই তাদের কারো কাছে পাঠাচ্ছে? এসবই মহিতোষের ভাবনা। এই ভাবনার উল্টোটাও তিনি ভেবেছেন। যেহেতু একের পর এক দুর্ভাগ্য তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে, সেহেতু তেমন কিছুও হওয়াও অসম্ভব নয়। হয়তো দিলারা কিছুই জানে না। তারপরও মহিতোষ নানা যুক্তি দিয়ে ভেবেছেন। এবং সেই যুক্তি-তর্ক-ভাবনা থেকেই তার মনে হয়েছে, পারু আর ফরিদ ঢাকায় কোথায় গিয়েছে, সেটা কেউ যদি জেনে থাকে তবে তা একমাত্র দিলারাই।

ভোরের আলো ফুটতেই তাই কাউকে কিছু না বলে বিছানা ছেড়েছেন তিনি। তারপর চুপিচুপি চলে এসেছেন হাসপাতাল থেকে। সারাটা পথ শান্তই ছিলেন মহিতোষ। নিজেকে নানা কিছু বুঝিয়েছেন। দিলারা যদি পারুদের কোনো খবর নাও জানে, তারপরও তিনি বিচলিত হবেন না বলে নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছেন। বরং তেমন খবর শোনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়ারও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার এই সব চেষ্টাই যে ব্যর্থ হয়েছে সেটা বুঝলেন আতাহার মওলানার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। এই খানিক আগ পর্যন্তও নিজেকে যথেষ্ট শক্ত মনে হয়েছিল তার। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বুক ধুকপুক করছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। একটা কনকনে শীতল হাওয়া তার বুকটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে।

ভীত মহিতোষ বাড়িতে ঢুকে গলা খাকড়ি দিয়ে শব্দ করলেন। ভেতর বাড়িতে যদি কেউ থাকে তাহলে নিশ্চয়ই তারা বেরিয়ে আসবেন। এই সময়ে যেহেতু পুরুষ মানুষের বাড়িতে থাকার সম্ভাবনা কম, তাই কোনো নারীকেই আশা করছিলেন মহিতোষ। কিন্তু তাকে চমকে দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো রফিকুল। সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। মহিতোষ তাকে হাত তুলে আদাব জানালেন। তারপর বললেন, এই বাড়িতে দিলারা নামে একজন থাকে না? মওলানা সাহেবের পুত্রবধূ

দিলারার খোঁজে অপরিচিত কেউ এ বাড়িতে এসেছে, বিষয়টিতে খানিক অবাকই হলো রফিকুল। তবে সঙ্গে সঙ্গে সতর্কও হলো। ভদ্রলোক তাকে যে ভঙ্গিতে হাত তুলে আদাব জানিয়েছেন তাতে সে নিশ্চিত যে লোকটি হিন্দু। এবং সেদিন পারু আর ফরিদ চলে যাওয়ার ঠিক পর মুহূর্তেই পারুর বাবা যে এখানে এসেছিলেন, সেকথাও শুনেছে সে। ফলে মুহূর্তেই সতর্ক হয়ে উঠল রফিকুল। আতাহার মওলানা সাধারণত এই সময়ে বাড়িতে থাকেন না। তারপরও সাবধান থাকা ভালো। এতদিনে বাড়ির পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। সুতরাং নতুন করে আর ঝামেলা পাকাতে চায় না সে।

সেই রাতে বাড়ি ফেরার পর দিলারা আর রফিকুলকে তুমুল বকা-ঝকা করেছিলেন আতাহার মওলানা। তবে পরিস্থিতি যতটা ভয়াবহ হবে বলে রফিকুল ভেবেছিল, ঠিক ততটা হয়নি। বরং তিনি আসার আগেই ফরিদ আর পারু যে ভালোয় ভালোয় বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল এতে যেন খানিক খুশি হয়েছিলেন তিনি। হয়তো বিষয়টা নিয়ে বড়সড় কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাননি।

রফিকুল বলল, আপনি পারুর বাবা?

মহিতোষ বুঝতে পারলেন না তিনি কী জবাব দেবেন। তবে রফিকুল তাকে আশ্বম্ভ করল, আমার কাছে আপনার ভয় নেই, ফরিদ আমার বন্ধু। আমি আর ফরিদই গিয়ে রতনপুর স্টেশন থেকে পারুকে নিয়ে এসেছিলাম। এটা আমাদের বাড়ি।

মহিতোষ যেন খানিক থমকে গেলেন। সেই রাতে পারু তবে রতনপুর স্টেশনে নেমে গিয়েছিল। আর তারপর তার সামনে দাঁড়ানো এই ছেলেটিই তাকে দেখেছে। এই যে রফিকুল তাকে দেখেছিল, এই ব্যাপারটুকুও যেন কেমন বিশেষ হয়ে গেল মহিতোষের কাছে। যেন রফিকুলকে নিজের চোখের সামনে দেখতে পেয়ে সেদিন পারুকে দেখার সেই অনুভবটুকু পেতে চাইলেন তিনি। রফিকুল বলল, আপনি দাঁড়ান, আমি দিলারা ভাবিকে ডেকে দিচ্ছি।

মহিতোষ দাঁড়িয়ে রইলেন উঠানে। তিনি বুঝতে পারছেন এই বাড়ির আবহাওয়া খানিক থমথমে। তাই একটা স্পষ্ট অস্বস্তি নিয়েই অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। সঙ্গে তাঁর সেই ভয়টা আবার প্রবল পরাক্রমে ফিরে আসতে লাগল। যদি দিলারা কিছু না জানে! দিলারা অবশ্য তার সেই ভয়টাকে তুমুল আনন্দে পরিণত করে দিল। সে বেশি কথা বলল না। একটা কাগজে মইনুলের মেসের ঠিকানা লিখে দিয়ে বলল, চাচাজি, আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনাকে একটু বসতেও বলতে পারলাম না। বুঝতেই পারছেন বিষয়টা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর আমরাও নানা ঝামেলায় আছি। পারু আর ফরিদকে আমি এই ঠিকানায় যেতে বলেছিলাম। ওর নাম মইনুল। আপনি তার কাছে যান। আশা করি ওদের একটা না একটা খবর আপনি পেয়েই যাবেন।

মহিতোষের আর কিছু শোনার ধৈর্য রইল না। তিনি যতটা সম্ভব দিলারাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ঢাকার পথ ধরলেন। এখন ঢাকার আর গাড়ি নেই। তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে রাত পর্যন্ত। তবে তাতে সমস্যার কিছু নেই। কাল ভোরের আলো নতুন এক দিন নিয়ে আসবে তাঁর প্রগাঢ় অমানিশার এই জীবনে। এই ভাবনায়ই আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন তিনি। আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন পারুকে আবার চোখের সামনে দেখতে পাওয়ার আনন্দে।

.

মহিতোষ ঢাকা পৌঁছালেন খুব ভোরে। তখনো অন্ধকার কাটেনি। কিন্তু আলো ফোঁটা অবধি আর অপেক্ষা করতে পারলেন না তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই রওয়ানা হয়ে গেলেন মইনুলের মেসের উদ্দেশ্যে। সেখানে তখন গমগম করছে লোকজনে। সামনের খোলা চত্বরের চাপকল চেপে গোসল করছে অসংখ্য মানুষ। কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বে তারা। দৃশ্যটা দেখে খানিক দমে গেলেন মহিতোষ। এখানে পারু থাকবে কী করে?

মইনুল তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। তাকে দরজায় কড়া নেড়ে জাগালেন মহিতোষ। তারপর হড়বড় করে বলতে লাগলেন পারুর কথা। ফরিদের কথা। কিন্তু মইনুল যেন হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। খানিক গম্ভীরও। বিষয়টা মহিতোষকে শঙ্কিত করে তুলল। তিনি তটস্থ ভঙ্গিতে বললেন, বাবা, আমার মেয়েটা কই আছে আপনি একবার শুধু আমাকে বলেন। আমি তারে কেবল এক নজর চোখের দেখা দেখব। আপনাদের আপত্তি থাকলে আমি তার সঙ্গে কথাও বলব না। কিন্তু একবার শুধু দেখব।

মইনুল বলল, চাচা, আপনি বহুদূর থেকে আসছেন। এখানে বসেন। নাশতা পানি খান। তারপর আপনার সঙ্গে ধীরে-সুস্থে কথা বলি।

না বাবা। আমার কিছু খাওয়ার মতো অবস্থা নেই। আপনি যা বলার আমাকে এখনই বলেন।

মইনুল খানিক চুপ থেকে বলল, হ্যাঁ, ওনারা আমার এখানে এসেছিলেন। আমি তাদের একটা থাকার ব্যবস্থাও করেছিলাম। কিন্তু…।

কিন্তু কী?

কীভাবে যে বলব, বুঝতে পারছি না। আপনি মেয়েটার বাবা। মেয়েকে না পেয়ে এমনিতেই দিশেহারা। এই অবস্থায় এসব কথা শুনতে আপনার ভালো লাগবে না।

ভয়ে চুপসে গেলেন মহিতোষ। এই এতটা পথ যে শক্তি নিয়ে তিনি একটানা ছুটে বেরিয়েছেন, সেই শক্তিটুকু যেন হারিয়ে ফেললেন নিমিষেই। তিনি কাঁপা গলায় বললেন, কী হয়েছে?

মইনুল কথাটা বলতে সময় নিল। তারপর বলল, এই শহরে তো চট করে কারো জন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায় না। তারপরও দিলারা চিঠি লিখে দিয়েছিল বলে আমি আমার সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু পেরেছি চেষ্টা করেছি। একটা রাত খুব। কষ্ট করে আমার এখানেও ছিলেন তাঁরা। কিন্তু এখানকার অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। কোনো মেয়ে মানুষের পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব না। আমি তাই আমার এক বড় ভাইয়ের বাসায় তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু দিন কয়েক পরে তারা একদিন কাউকে কিছু না বলেই চলে গেছেন।

কোথায় গেছে?

কোথায় গেছেন সেকথা তো আর বলে যায়নি।

আপনাকেও কিছু জানায়নি? ভারি অবাক হলেন মহিতোষ।

নাহ। আসলে আপনাকে বলা হয়তো ঠিক হচ্ছে না, তারপরও বলছি। যে ঘটনা ঘটিয়ে উনারা চলে গেছেন, তারপর তো কাউকে আর কিছু বলা যায় না।

মানে! কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন মহিতোষ।

আমি আজিজ ভাইকে ডাকছি। আপনি তার কাছেই শুনুন। ওনারা তার বাসাতেই ছিলেন। বলে উঠে গেল মইনুল। ফিরল খানিক বাদেই। তার সঙ্গে আজিজ মিয়া। তিনি মহিতোষকে দেখে যেন রীতিমতো চমকে উঠলেন। মুহূর্তের জন্য তার চোখে একটা কম্পন দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল। যেন নিজেকে অত্যন্ত সতর্কভাবে সামলে নিলেন তিনি। তারপর বললেন, চাচা মিয়া, কী বলব শরমের কথা। এই কথা কি কাউরে বলা যায়? এত আদর-যত্ন করে থাকতে দিলাম। আপনার মেয়ে জামাইরে কাজ পর্যন্ত জোটাই দিলাম। ঢাকা শহরে এসেই দুইদিনের মাথায় কেউ থাকার জায়গা, কাজ পায়? আপনিই বলেন?

মহিতোষ জবাব দিলেন না। তবে মনে মনে তিনি উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছেন। এরা আশপাশের অনেক কথাই বলছে। কিন্তু আসল কথাটাই বলছে না। আজিজ মিয়া বললেন, সেই ছেলে কিছু না জানিয়েই চলে গেল। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে যাওয়ার সময় কী করছে জানেন? আমার বাসার নগদ টাকা, আমার স্ত্রীর দুই ভরি ওজনের সোনার চেইন, বিদেশি ফুলদানিসহ আরো বেশ কিছু দামি দামি জিনিস নিয়ে গেছে। এইজন্যই কথায় বলে, উপকারীরে বাঘে খায়। আপনিই বলেন চাচা, চিনি না, জানি না, এমন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমি কি তাদের আশ্রয় দিয়ে ভুল করেছি?

আজিজ মিয়ার কথা শুনে মহিতোষ হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাঁর মনে হলো তিনি ভুল কিছু শুনেছেন। প্রচণ্ড রাগে-অপমানে তাঁর কান দিয়ে যেন ধোয়া ছুটতে লাগল। তিনি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে গেলেন। বললেন, আপনি কী বলছেন সেটা বোধহয় আপনি নিজেই জানেন না। আমার মেয়েকে আমি চিনি না? আমি ভুবনডাঙার মহিতোষ মাস্টার …।

প্রচণ্ড ক্রোধে মহিতোষের শরীর কাঁপতে লাগল। কথা জড়িয়ে আসতে লাগল। তাঁর অবস্থা দেখে আজিজ মিয়া বিচলিত হওয়ার পরিবর্তে যেন সামান্য হাসলেন। তবে সেই হাসি লক্ষ করলেন না মহিতোষ। তিনি তখন প্রবল রাগে ফুঁসছেন।

আজিজ মিয়া শান্ত গলায় বললেন, চাচা আপনি ভুল বুঝতেছেন। দোষ তো আপনার মেয়ের না। সে লক্ষ্মী মেয়ে। উচ্চবংশের সন্তান, তা তার চলন-বলনেই বোঝা যায়। সমস্যা তো ওই ছেলের। কেমনে যে সে এরকম একটা মেয়েরে ফুসলাই ফেলল! আসলে হয় কী জানেন চাচা মিয়া? এই ধরনের সহজ-সরল মেয়েরেই এই ধান্ধাবাজ ছেলেগুলা টার্গেট করে। আপনি মনে কষ্ট নেবেন না। চাচা।

মহিতোষ যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। আজিজ মিয়াকে দেখেই তার পছন্দ হয়নি। এখন তার কথা শুনে আরো সন্দেহ হচ্ছে। আর যা-ই হোক, পারু কিংবা ফরিদ মরে গেলেও এমন জঘন্য কাজ করতে পারে না। এটা অসম্ভব। তিনি গম্ভীর গলায় মইনুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি জানি না ঘটনা কী হয়েছে। তবে আমার মেয়েকে আমি চিনি। ফরিদকেও। তাদের পক্ষে এই ধরনের কাজ করা অসম্ভব। তারপরও যদি এমন কিছু হয়ে থাকে, আমি করজোড়ে ক্ষমা চাইছি। আমি ভুবনডাঙার মহিতোষ মাস্টার। দশগ্রামের লোকে আমায় চেনে। আমার একটা মান-সম্মান আছে। যদি সত্যি সত্যিই এমন কিছু হয়ে থাকে, আমি ওনার সব পয়সা ফেরতের ব্যবস্থা করব। কিন্তু আপনারা দয়া করে আমার মেয়ের খবরটা আমাকে দিন। আপনাদের। কাছে এই আমার অনুরোধ।

এখানে এসে প্রথমে যে ভঙ্গুর, বিনয়ী মহিতোষ দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে এই মহিতোষ মাস্টারের যেন অনেক তফাৎ। ইনি শান্ত, গম্ভীর, ব্যক্তিত্ববান। কথায় পরিশীলিত। প্রচণ্ড আত্মসম্মান বোধ ঠিকরে পড়ছে তার চোখ-মুখে। মইনুল যেন খানিক হতচকিত হয়ে গেছে। তবে আজিজ মিয়ার ঠোঁটে সেই বিদ্রুপাত্মক রহস্যময় হাসিটুকু লেগেই আছে। যেন মহিতোষকে দেখে তিনি চাপা এক ধরনের আনন্দ অনুভব করছেন। মহিতোষ বললেন, আমার মেয়ের খোঁজ দিতে পারলে আমি আপনাদের কাছে চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। এর বিনিময়ে আপনারা আমার কাছে যা চাইবেন আমি তা-ই দেওয়ার চেষ্টা করব। এই মুহূর্তে আমার কাছে খুব বেশি নগদ অর্থ নেই। কিন্তু আপনারা চিন্তা করবেন না। টাকা আমার আছে। আমাকে সময় দিলে আমি ব্যবস্থা করে দেব। তার আগে দয়া করে আমার মেয়েকে আপনারা আমার কাছে এনে দিন।

মহিতোষের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল মইনুল। হঠাৎ টাকা-পয়সার কথা কেন বলছেন তিনি? মইনুলকে দেখে কি তাঁর এমনই মনে হয়েছে? বিষয়টা ভীষণ বিব্রত করে ফেলল মইনুলকে। কিন্তু তাকে চমকে দিয়ে আজিজ মিয়া বললেন, আপনি কয়েকটা দিন সময় দেন, আমি আপনার মেয়ের খোঁজ বের করে দেব। কিন্তু টাকা-পয়সার হিসাব কী হবে? কত দেবেন?

মহিতোষ শান্ত কিন্তু স্থির গলায় বললেন, আপনিই বলুন, কত চান?

মইনুল কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে আজিজ মিয়া বললেন, বিষয়টা মইনুলের সঙ্গে কথা বলে আমি আপনাকে জানাচ্ছি। কিন্তু আপনাকে পাব কোথায়?

এই প্রশ্নে বিচলিত হয়ে পড়লেন মহিতোষ। আসলেই তো, এই শহরে তাঁর ঠিকানা কই? তিনি আচমকা বললেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ? খুবই অবাক হলো আজিজ মিয়া।

হুম। ওখানে গিয়ে আমাকে খুঁজলেই পাবেন।

আপনি কী করেন ওখানে? প্রশ্নটা করলো মইনুল।

মহিতোষ সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না। ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, আমার মেয়ের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি।

মানে? সে ওখানে আসবে বলেছিল?

নাহ।

তাহলে?

যদি কোনো কারণে সে ওখানে আসে? মানুষের তো নানা অসুখ-বিসুখ হয়। তখন কখনো না কখনো তো তাকে একবারের জন্য হলেও হাসপাতালে যেতে হয়…।

স্বাভাবিক গলায়ই কথাটা বললেন মহিতোষ। কিন্তু তার ওইটুকু কথাতেই কেমন এলোমেলো হয়ে গেল মইনুল। সে দীর্ঘসময় কোনো কথা বলল না। চুপচাপ বসে রইল। তবে তার মাথায় ঝড়ের বেগে নানা চিন্তা চলছে। সেই চিন্তা মূলত আজিজ মিয়াকে নিয়ে। গত ছয় মাস ধরে দেখা মানুষটাকে আজ হঠাৎ কেমন অচেনা অন্যরকম লাগছে তার কাছে। এই ছ মাসেও আজকের এই আজিজ মিয়াকে কখনো দেখেনি সে। এমন অর্থলিন্দু, লোভী কখনো মনে হয়নি! তাহলে?

না-কি ভেতরে ভেতরে তিনি এমনই? হয়তো মহিতোষ খানিক কথা বলেই বিষয়টা আঁচ করে ফেলতে পেরেছেন। আর তাই সরাসরিই টাকার প্রসঙ্গ তুলেছেন তিনি! বিষয়টা ভাবনায় ফেলে দিল মইনুলকে।

ফরিদ আর পারুর পালিয়ে যাওয়া নিয়ে এখন অন্যরকম ভাবনা হচ্ছে তার। আজিজ মিয়া বলেছিল বটে যে তারা চুরি করে পালিয়েছে। শুনে মইনুল অবাক হলেও কিছু বলেনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাদের পক্ষে অমন জঘন্য কিছু করা অসম্ভব। যে বিপদে পড়ে তারা এভাবে টাকা শহরের এসেছে, সেই বিপদে অমন একটি আশ্রয় এবং কাজের সুযোগ কোনোভাবেই নষ্ট করার কোনো যুক্তি নেই তাদের। আজিজ মিয়া কি কোনো কারণে মিথ্যে বলছে? কিন্তু কেন?

তবে এটাও তো সত্যি যে তারা কাউকে কিছু না বলেই চলে গিয়েছে? এমনকি তাকেও কিছু জানায়নি। তাহলে? কী এমন হয়েছিল যে ওভাবে চলে যেতে হলো তাদের? এই প্রশ্নটা মাথায় গেঁথে রইল মইনুলের।

মহিতোষ চলে যেতেই সে আজিজ মিয়াকে ধরল, আপনি এটা কী করলেন?

কী?

ওনার কাছে টাকার কথা কেন বললেন? আপনি তার কাছ থেকে টাকা নেবেন?

নেব না?

কেন নেবেন?

তার মেয়েকে খুঁজে দেব আর টাকা নেব না? আমার সময়, শ্রম নষ্ট হবে না?

মইনুল যেন তার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। সে এবার সাবধান হলো। বলল, আপনি জানেন তার মেয়ে কোথায় আছে?

না জানলেও শীঘ্রই জেনে যাব।

কীভাবে?

আমার লোক লাগানো আছে।

কোথায় লোক লাগানো আছে?

এলাকায়। সে এলাকার আশপাশেই আছে। বেশিদূরে যায় নাই। আড়তের লোকজন তো ফরিদ মিয়াকে চেনে। তারা নাকি তাকে দু-একবার দেখেছেও।

কোথায়?

এই তো এলাকার আশপাশেই।

তো তাকে দেখলে আপনি ধরতে যাননি কেন?

যাব যাব। সময় হলেই যাব।

সময় কখন হবে?

সেটা সময়ই বলবে।

মইনুল সামান্য চুপ করে থেকে বলল, আজিজ ভাই, কিছু মনে করবেন না। আপনার কথা শুনে কিন্তু আমার অন্যরকম মনে হচ্ছে।

কী অন্যরকম?

তারা যেদিন আপনার বাসা থেকে চলে গেল, সেদিন রাতে আপনি মেসে ফিরে অনেক হম্বিতম্বি করলেন। বললেন, পুলিশে মামলা করবেন। পেলে আস্ত রাখবেন না। আর এখন সব জেনেশুনেও আপনি এভাবে চুপ করে আছেন। কিছু বলছেন না। বিষয়টা একটু কেমন না?

বললাম তো সময় হলেই বলব।

আপনার সময় কিন্তু এখনই। তারা আপনার ঘর থেকে দামি দামি জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে গেছে। এখন আপনি যত দ্রুত পুলিশে অভিযোগ জানাবেন, তত আপনার প্রমাণ করতে সুবিধা হবে। দেরি করলে গিয়ে দেখবেন যে কিছুই প্রমাণ করতে পারছেন না। হয়তো ততদিনে সব জিনিসপত্র বিক্রি করে দিয়েছে, তাই না?

মইনুলের কথা যুক্তিসংগত। তবে আজিজ মিয়ার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তিনি বললেন, ওই জিনিসের পিছে ছুটে আর লাভ কী? এখন তো নগদ টাকাই পাচ্ছি।

কীসের টাকা?

কেন? মাস্টার সাহেব না বললেন টাকা দেবেন! আপনার আমার ফিফটি ফিফটি শেয়ার বুঝলেন? তাছাড়া অন্য একটা হিসেবও আমার আছে।

কী হিসেব?

আজিজ মিয়া এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তবে মইনুল গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। এই লোকের আচার-আচরণ নিয়ে অন্য সবার অভিযোগ থাকলেও তার সঙ্গে কেমন কেমন করে যেন একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল। একাই এক রুম ভাড়া নিয়ে থাকেন তিনি। কখনোই তেমন বাইরে বের হন না। মেসের সবাই খুব ভোরে বের হয়ে রাতে ফিরলেও দিনভর একা একাই থাকেন তিনি। এই নিয়ে অবশ্য টুকটাক কথাও উঠেছিল। ফাঁকা মেসে নাকি মেয়ে মানুষ নিয়ে আসেন আজিজ মিয়া। মইনুল অবশ্য সেসবে কান দেয়নি। কারণ বিপদে-আপদে অনেকবারই লোকটাকে পাশে পেয়েছিল সে। বেশ কয়েকবার টাকাও ধার দিয়েছিলেন। ফলে একধরনের কৃতজ্ঞতাবোধও ছিল তার।

তবে মইনুলের এখন মনে হচ্ছে, আজিজ মিয়া হয়তো এসব এমনি এমনিই করেননি। এর বিনিময়ে তাকেও কিছু কাজ করে দিতে হয়েছে। বিশেষ করে আজিজ মিয়ার প্রথম স্ত্রী যখন ঢাকায় আসতেন, তখন তার পক্ষ হয়ে নানা মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে মইনুলকে। নির্দোষ মিথ্যে ভেবেই সেসব বলেছে সে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে অন্য কোনো ব্যাপার আছে লোকটার।

বিষয়গুলো আগে কখনো গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে চায়নি বলেই হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে। এই মেসে সম্ভবত একমাত্র সে-ই জানত যে আজিজ মিয়ার দুজন ফ্রী। শুধু তা-ই নয়, মাথায় চুল নেই বলে টাক ঢাকতে বাউলদের মতো লম্বা পরচুলাও পরেন তিনি। মইনুল একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, চুল নাই তো কী হয়েছে আজিজ ভাই? কত মানুষেরই তো চুল নাই।

আজিজ মিয়া হেসে বলেছিল, এইটা একটা শখ বলতে পারেন। ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিল বাউলদের মতো চুল রাখব। অথচ ভাগ্যে থাকল টাক মাথা। তার ওপর বিয়া করছি অল্প বয়সী মেয়ে। টাক মাথার জামাই নিয়ে তার নাকি মান সম্মান থাকে না। তাই এই ব্যবস্থা। কাউরে বইলেন না ভাই।

মইনুল কাউকে কিছু বলেনি। কিন্তু এখন নানা কিছুই তার কাছে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। এমনকি পারুরা যেদিন তার বাসায় উঠল, সেদিনও একটা কথা বলেছিলেন আজিজ মিয়া। তার ছোটো স্ত্রীও তাকে বিশ্বাস করে না। সে হয়তো ভাববে যে পারু তার তৃতীয় স্ত্রী! আপাতত পরিস্থিতি সামাল দিতে মিথ্যে পরিচয়ে বাসায় তুলছেন। পরে সুযোগ বুঝে সব খোলাসা করবেন।

বিষয়গুলো ভাবতে গিয়ে এমন নানা অসংগতি চোখে পড়তে লাগল মইনুলের। তার এখন মনে হচ্ছে, পারু আর ফরিদের ওভাবে চলে যাওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ আছে। এবং সেই কারণ ঢাকতেই আজিজ মিয়া এই মিথ্যা চুরির গল্প ফেঁদেছেন। সে হঠাৎ বলল, আপনি সত্যি করে বলেন তো আজিজ ভাই, সেদিন আসলে আপনার বাড়িতে কী হয়েছিল?

কোনদিন?

যেদিন ফরিদরা চলে গেল?

কী হবে? ওই তো বললাম যে চুরি…।

মইনুল তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনি আমাকে যতটা বোকা ভাবেন আমি ঠিক ততটা বোকা না আজিজ ভাই। হ্যাঁ, খানিক সহজ-সরল হতে পারি। হয়তো চট করে মানুষকে বিশ্বাসও করে ফেলি। কিন্তু আপনি সত্যি করে বলেন তো আপনার বাসায় আসলে পারু আর ফরিদের সঙ্গে কী হয়েছিল?

আজিজ মিয়া এবার আর উত্তর দিলেন না। মইনুল বলল, আপনি যে ধরনের মানুষ, তাতে আপনার কিন্তু এতদিনে থানা-পুলিশ করার কথা ছিল। অথচ সেসব কিছু তো আপনি করেনইনি, বরং এখন ফরিদের খোঁজ পেয়েও চুপ করে আছেন। ঘটনা কী?

এই কথায় আজিজ মিয়া আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, আপনার এত কিছু বোঝার দরকার নাই। আপনার চাকরি-বাকরি নাই। টাকা-পয়সা দরকার। মাস্টারে কিছু দিলে আপনার ভাগ আপনি পাবেন। আর অন্যকিছুর ভাগ লাগলেও বইলেন। সেইটাও সমান ভাগেই পাবেন। বলে কেমন রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলেন আজিজ মিয়া।

অন্যকিছুর ভাগ মানে?

আপনার মিয়া বয়স কম, কিন্তু মানুষটা ওল্ড মডেল। বলে তীর্যক হাসলেন আজিজ মিয়া। হিন্দু মেয়ে নিয়ে ভাগছে মুসলমান ছেলে। মেয়ের চেহারা-ছবি ভালো। তাদের চারদিকে ভয়-বিপদ। আত্মীয়-স্বজন নাই। সাহায্য করারও কেউ নাই। কিছু হলে পুলিশের কাছেও যেতে পারবে না। এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর আছে? কোনো বুদ্ধিমান ব্যাটাছেলে এই সুযোগ ছাড়বে?

এই প্রথম মইনুলের মনে হলো তার সামনে একটা গা ঘিনঘিনে নোংরা কীট বসে আছে। অথচ তার চেহারাটা মানুষের মতো! কী আশ্চর্য, এত কাছে থেকেও এই মানুষটাকে এতদিন চিনতে পারেনি সে।

আজিজ মিয়া বললেন, আপনি টেনশন নিয়েন না। সব ব্যবস্থা আমি করতেছি। আপসে চাইছিলাম বিষয়টা, হয় নাই। কী আর করা! এইবার অন্য পথ ধরতে হবে।

অন্য কী পথ? মইনুল প্রায় রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।

ব্যবস্থা চলতেছে। ফরিদ মিয়ার খবর পেয়ে গেছি। এবার খেলা জমবে…। বলে খে খে করে হাসলেন আজিজ মিয়া। সেই হাসি দেখে গা শিউরে উঠল মইনুলের।

৩১

অন্ধকার রাস্তা। সন্ধ্যার পর থেকে ইলেকট্রিসিটি নেই। রাত এখন ঠিক কটা বাজে ফরিদ জানে না। সে বুকের ওপর দু হাত ভাঁজ করে হাঁটছে। এখন দিনের বেলা তেমন শীত না থাকলেও সন্ধ্যার পরপর ঠাণ্ডা বাড়তে থাকে। দোকান থেকে বের হতে খানিক দেরি হয়েছে আজ। এ কারণেই পা চালিয়ে হাঁটছে ফরিদ। পারু একা বাসায়। নিশ্চয়ই চিন্তা করছে সে। ফরিদ মনে মনে হাসে। এই কদিন আগেও বাসায় ফিরতে ইচ্ছে হতো না তার। সেই তো পারুর গম্ভীর বিষণ্ণ মুখ। নির্লিপ্ত অবয়ব। কোথাও কোনো ভালোবাসা নেই। কথা নেই। জিজ্ঞাসা নেই। দুজন মানুষ চুপচাপ শুয়ে থাকত বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। ফরিদের কেমন দমবন্ধ লাগত। মাঝে মাঝে মনে হতো, কার জন্য এতকিছু করছে সে? কেন করছে?

অথচ এখন সারাটা দিন ঘরে ফেরার জন্য ছটফট করে সে। প্রতিটি মুহূর্ত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হয়। এ এক ভয়ানক যন্ত্রণা। কারণ সে জানে, পারু তার জন্য অপেক্ষা করছে। মানুষ জীবনভর চায়, কেউ তার জন্য অপেক্ষা করুক। প্রবল ভালোবাসায় ছুঁয়ে দিক। কিন্তু একজনমে এমন সৌভাগ্য খুব কম মানুষেরই হয়। ফরিদের আজকাল নিজেকে সেই সৌভাগ্যবান মানুষ বলে মনে হয়। এত এত দুর্বিপাকের মধ্যেও শেষ অবধি সে তার আরাধ্য সেই ভালোবাসাটুকু পেয়েছে। এত শঙ্কা, অনিশ্চয়তা, বিপদের মধ্যেও অমন প্রগাঢ় ভালোবাসা নিয়ে তার জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে। এরচেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই। ঢাকায় আসার পর দু মাসেরও বেশি পেরিয়ে গেছে। অথচ এর মধ্যে একবারের জন্যও পারুকে নিয়ে কোথাও যাওয়া হয়নি। সারাটা দিন ওইটুকু এক ঘরে বন্দি হয়ে থাকে সে। কখনো ফরিদকে কিছু বলে না। যেন কোনো বায়না নেই তার। কোনো অভিযোগ অনুযোগ নেই। ফরিদের এত মায়া হয় মেয়েটার জন্য! মনে হয়, এইটুকু এক মানুষ, এত নরম, এত মায়াময়! অথচ সেই মানুষটাই কী করে এই এত এত অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করছে? নিশ্চয়ই তার বুকের ভেতর অসংখ্য কষ্টের দগদগে ক্ষত! সেই ক্ষতগুলো সে ধীরে ধীরে মুছে দিতে চায়। যতটা সম্ভব পরিপূর্ণ করে দিতে চায় আনন্দে।

তা দেয়ও। আজকাল তাদের সম্পর্কটা টলটলে স্বচ্ছ জলের মতো। যেখানে ভেসে যাওয়া যায়। ডুবে যাওয়া যায়। অনায়াসে সাঁতার কেটে ছুঁয়ে যাওয়া যায় পরস্পরের অনুভবের গলিখুঁজি। আবার অভিমান হলে ভেসে ভেসে খানিক দূরেও সরে যাওয়া যায়। তবে পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকা ওই জলের স্পর্শ, ওই ঢেউ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যায় না কখনোই। তা অবিরাম অধীর করে রাখে দুজনকে।

ফরিদ মোড়টা ঘুরতেই হঠাৎ থমকে গেল। তার মনে হলো কেউ একজন দীর্ঘ সময় ধরে তাকে অনুসরণ করছে। এতক্ষণ পারুর ভাবনায় নিমগ্ন ছিল বলে খেয়াল করেনি সে। কিন্তু দোকান থেকে বের হওয়া পর পরই লোকটা তার সঙ্গে একই দূরত্ব রেখে হেঁটে এসেছে। দোকান থেকে ফরিদের বাসার দূরত্ব কম নয়। এদিকটাতে রিকশা-ভ্যানও অহরহই পাওয়া যায়। তারপরও সে হেঁটেই আসে। এতে যে টাকাটা সাশ্রয় হয়, তা তার সংসারের প্রয়োজনে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তাছাড়া তার একটা গোপন ইচ্ছাও আছে। এই এতদিনেও পারুকে নিয়ে কোথাও যায়নি সে। বাসা ভাড়া আর খাবার খরচের বাইরে অতিরিক্ত কিছু টাকা জমাতে পারলেই তাকে নিয়ে একদিন ঘুরতে যাবে। ফরিদ শুনেছে ঢাকার কাছেই ধামরাইতে প্রতিবছর মে-জুনের দিকে বিশাল রথের মেলা হয়। কী এক কারণে সেই মেলা এবার মাস দুয়েক এগিয়ে আনা হয়েছে। তার খুব ইচ্ছা পারুকে নিয়ে একদিন ওই মেলা দেখতে যাবে সে। তবে বিষয়টা আগেভাগেই তাকে জানাতে চায় না। যাওয়ার ঠিক আগের দিন হঠাৎ চমকে দিতে চায়। এ কারণে লুকিয়ে লুকিয়ে পারুর জন্য একটা লাল শাড়িও কিনেছে ফরিদ। তার জীবনে কেনা প্রথম শাড়ি।

.

জায়গাটা নির্জন। কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ নেই। ফলে পেছনের লোকটার পায়ের শব্দ যেন একটু বেশিই কানে বাজছে। ফরিদ চট করে থমকে দাঁড়াল। সে দেখতে চায় লোকটা এবার কী করে! তবে তাকে অবাক করে দিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সামনে হেঁটে চলে গেল লোকটা। যেন তাকে দেখেইনি। তারপর হারিয়ে গেল গলির মধ্যে। এবার যেন খানিক বিভ্রান্ত হলো ফরিদ। সে কি তবে ভুল ভেবেছিল? কিন্তু বিষয়টা ঠিক বৃপ্তি দিল না তাকে। সে বাসায় ফিরে দেখে পারু চুপচাপ বসে আছে। তার মুখ ভার। ফরিদ বলল, খুব দেরি করে ফেললাম?

পারু বলল, না। এখন তো ভোর অবধি রাত বাকি।

তাই?

হুম।

তাহলে আরো দেরি করে ফিরব?

আপনার ইচ্ছে।

তোমার কোনো ইচ্ছে নেই?

আমার ইচ্ছে থাকলেই কী আর না থাকলেই কী?

কিছুই না?

উহু।

আমি না থাকলে তোমার মন খারাপ হয়?

না।

সত্যি না?।

পারু এবার আর জবাব দিল না। ফরিদ তার সামনে এসে বসল। তারপর বলল, আমার কী ইচ্ছে হয় জানো?

পারু কথা বলল না। তবে মুখ তুলে তাকাল। ফরিদ বলল, আমার ইচ্ছে করে সারাক্ষণ এভাবে তোমার মুখোমুখি বসে থাকি। তারপর ফিসফিস করে জীবনানন্দের কবিতাটা একটু অন্যরকম করে বলি থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার, আমি আর পারুলতা সেন। বলে হাসল ফরিদ। কিন্তু পারু হাসল না। সে গম্ভীর গলায় বলল, পারুলতা সেন কে?

তুমি।

আমি সেন?

উহু।

তাহলে?

তাহলে…। বলে কী ভাবল ফরিদ। তারপর বলল, তুমি হচ্ছো স্মৃতি।

স্মৃতি?

হু।

আমি স্মৃতি হতে যাব কেন? মানুষ হারিয়ে গেলে স্মৃতি হয়।

উহু, মানুষ আসলে স্মৃতি হয় না। স্মৃতি হয় সময়।

কীভাবে?

এই যে ধরো, আমাদের রোজ কত কত গল্প। কত কত স্মৃতি। এগুলো একটু একটু বুকে গেঁথে থাকে। এই যে প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্তের তুমি বুকে জমা হতে থাকো, এটাই স্মৃতি। আজ থেকে অনেক বছর পর, যখন আমরা বুড়ো হয়ে যাব, তখন এই প্রতিদিনের তুমি কল্পনায় একটু একটু করে জেগে উঠতে থাকবে। সেটা তো আসলে সময়ই। তুমি তো তখনো থাকবে। কিন্তু এই সময়টা তখন স্মৃতি হয়ে সুবাস ছড়াতে থাকবে।

পারু কথা বলল না। ফরিদ বলল, আসলে মানুষ হারিয়ে যায় না। হারিয়ে যায় সময়।

আপনি আবার কঠিন করে কথা বলছেন।

ফরিদ খানিক চুপ করে থেকে বলল, হুম, বলছি। এই যে প্রতিদিন একটু একটু করে সময় চলে যাচ্ছে। এই সময়টা কি আর কখনো ফিরে আসবে?

উহু।

কিন্তু দেখবে আজ থেকে অনেক বছর পর এই সময়গুলোর জন্য কী কষ্ট হবে আমাদের। মন খারাপ হবে। মনে হবে, ইশ। আবার যদি এই সময়টা ফিরে পেতাম! কিন্তু জানো তো, সময় একবার চলে গেলে আর কখনো ফিরে আসে না।

হু।

তখন এই সময়ই স্মৃতি হয়ে গন্ধ বিলাবে। সুবাস ছড়াতে থাকবে। স্মৃতিগন্ধা হয়ে উঠবে।

পারু কথা বলল না। ফরিদ বলল, কাল সারাদিন আমি বাসায় থাকব।

সত্যি? পারুর মুখ যেন ঝলমল করে উঠল।

হ্যাঁ। কিন্তু…।

কিন্তু কী?

সন্ধ্যার দিকে বেরিয়ে যেতে হবে। রাতে যে ছেলেটা কাজ করত ও কাল থাকবে না। তাই আমাকে কাল রাতে যেতে হবে।

পারুর ঝলমলে মুখটা নিমিষেই অন্ধকার হয়ে গেল। সে বলল, আমার ভয় হয়।

বুঝতে পারছি। কিন্তু কী করব বলো? একটা মাত্র রাত। আর এখানে তো কোনো ভয় নেই।

পারু কথা বলল না। চুপচাপ বসে রইল। সেই সারাটা রাত ফরিদের বুকের ভেতর গুটিশুটি মেরে শুয়ে রইল পারু। শুষে নিতে থাকল সুতীব্র উষ্ণতা। কালবোশখির মতো উন্মাতাল ঝড়ের কাছে নিজেকে ভেঙেচুড়ে নিঃশেষে সমর্পণ করে দিতে লাগল। তারপর শান্ত প্রকৃতির মতো স্থির হয়ে রইল ফরিদের বুকে। ফরিদ বলল, তোমাকে ছেড়ে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। একটুও না।

পারু কথা বলল না। ফরিদের খোলা বুকে আদুরে বেড়ালের মতো মুখ ঘষল সে। তারপর বলল, আমি আপনার সঙ্গে কোথাও যেতে চাই।

কোথায়?

জানি না কোথায়? তবে এই বন্ধ ঘরের অন্ধকারে থাকতে থাকতে আমার ভেতরটা কেমন হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে শ্যাওলা জমা স্যাঁতসেঁতে এক মজা পুকুর। কোথাও একটু রোদ নেই। হাওয়া নেই। গুমোট অন্ধকার।

ফরিদ মৃদু হাসল, এত সুন্দর করে বললে!

পারু লজ্জা পেয়ে গেল। ফরিদ বলল, একদিন যাব আমরা। তারপর হারিয়ে যাব।

পার কথা বলল না। ফরিদের বুকের ভেতর টিপটিপ বয়ে চলা হৃৎপিণ্ডের শব্দটা কান পেতে শুনতে লাগল। ওই শব্দ কী বলে? সব শব্দেরই তো কোনো না কোনো ভাষা থাকে। ওই শব্দগুলোরও কি আছে?

.

পরদিন সন্ধ্যা বেলা ফরিদ কাজে গেল। যাওয়ার আগে বলল, কেউ যদি বাইরে থেকে দরজা খুলতে বলে, একদম খুলবে না।

আপনি হলেও না?

ফরিদ হাসল, উহু।

তাহলে?

তাহলে আর কী, সারারাত বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব। রজকিনির জন্য চণ্ডীদাস বারো বছর বঁড়শি বেয়েছিল, আমি না হয় একটা রাত দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলাম।

শুনে হাসল পারু। মানুষটা এমন কেন! যা বলে তাই ভালো লাগে তার। কিন্তু একা একা এই রাতটা সে কী করে কাটাবে!

ফরিদ বের হলো সন্ধ্যার খানিক পর। তাদের বাসাটা নিচতলায়। সামনে খানিক খোলা জায়গা। কয়েকটা ফুলের গাছ সেখানে। লম্বা দু খানা নারকেল আর কাঁঠাল গাছও রয়েছে। তারপরই মূল রাস্তা। সেই রাস্তায় উঠতে গিয়ে গতরাতের মতো আবারও চমকে গেল সে। মনে হলো, কেউ একজন যেন চট করে দেয়ালের আড়ালে সরে গেছে। বিষয়টা কেমন অজানা এক অস্বস্তি তৈরি করল ফরিদের মধ্যে। সে ভুল ভাবছে না তো!

আজিজ মিয়ার বিষয়টা এখনো মাথা থেকে পুরোপুরি তাড়াতে পারেনি সে। পারু এরপরও কয়েকবার বলেছে, লোকটাকে তার চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু বিষয়টা পারুর ভীত-সন্ত্রস্ত মস্তিষ্কের কল্পনা বলে উড়িয়ে দিয়েছে ফরিদ। যদিও এখনো মাঝে মাঝেই লোকটার কথা মনে পড়ে তার। ভোলাভালা মুখোশের আড়ালে কী ভয়ানক এক মানুষ। ভাবলেই অপ্তি হয়। যখন তখন একটা অকারণ ভয় বা অস্থিরতা তাড়িয়ে বেড়ায়। গতরাতে যেমন। শুধু শুধু একটা মানুষকে সন্দেহ করেছিল সে। এই এখন আবার কেন যেন মনে হলো দেয়ালের ওদিকটাতে চট করে কেউ সরে গেল। বিষয়টা হয়তো কিছুই না। কিন্তু তারপরও মনের ভেতর কেমন খচখচ করতে লাগল। ফরিদ সামনে এগিয়ে দেয়ালের ওপাশটা উঁকিঝুঁকি মেরে দেখল। কেউ নেই সেখানে। পুরো জায়গাটিই সুনসান নি। নিজের মনে মনেই নিজেকে ভর্ৎসনা করল সে। একের পর এক ভয়াবহ সময় কাটিয়ে এখন সবকিছুতেই সন্দেহ হয়। রঞ্জুকে সর্প ভেবে বিভ্রম হয়। ফরিদ দ্রুত পায়ে দোকানের পথ ধরল।

.

পারু বসেছিল একা। এই সময়টা যেন কাটতেই চায় না। ফরিদ যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ চড়ুই পাখির ডানায় যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় সময়। অথচ যখন থাকে না, তখন একেকটা মুহূর্তও এত দীর্ঘ মনে হয়। আসলে ফরিদকে তার প্রতিটা মুহূর্ত কাছে লাগে। ফরিদেরও কি তাই? এই প্রশ্নের উত্তরও অবশ্য পারুর কাছে আছে। সেদিন ভোরে ফরিদ কী সুন্দর কটি লাইন লিখে গিয়েছিল। লাইন কটা এখনো মনে আছে পারুর। সে একা একাই মনে মনে লাইনগুলো আওড়াল

তোমায় আমার লাগে,
সূর্য ওঠা-সূর্য ডোবার আগে।
একেকটা দিন মুহূর্তেরও বিন্দু বিন্দু ভাগে,
তোমায় আমার লাগে।
বুকের ভেতর এক সাহারা তৃষ্ণা যখন জাগে।

পারুর মনে হয়, ফরিদ ঠিক তার মনের কথাটাই বলে দিয়েছে। কী করে পারে সে! কিন্তু এই যে একটা রাত, এই রাতটা সে একা একা কী করে থাকবে? ঘরের ভেতর কোথাও একটা ইঁদুর কিংবা একটা তেলাপোকা হয়তো হঠাৎ খানিক শব্দ করল। পারু তাতেও অবচেতনেই চমকে ওঠে। তার ভেতরে তীব্র এক ভয়, অজানা আতঙ্ক যেন চিরস্থায়ী বসত গেড়ে বসেছে। এ থেকে তার মুক্তি নেই। দুপুর বেলাও এমন হয়। একটু জোরে হাওয়া দিলে, বাইরের পেয়ারাগাছটার ডাল-পাতায় খানিক শব্দ হলেও ভয়ে চমকে ওঠে সে। আর তখনই ধীরে ধীরে ভয়টা জাঁকিয়ে বসতে থাকে।

সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে বাইরে। পারু জানালার কাছে বসে রইল। দূর থেকে গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে আসছে। কিন্তু সেই শব্দগুলোকেও যেন বড্ড একঘেয়ে লাগে তার। সে আলো বন্ধ করে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে রইল। আর ঠিক তখুনি তার মুখের সামনে এসে দাঁড়াল চারু। তারপর একে একে মা, বাবা, ঠাকুরমা। কেমন আছে তারা কোথায় আছে? এই দেশ পেরিয়ে অন্য কোনো দেশে? সেখানেও তো ঠিক এই সময়ে এমন করে সন্ধ্যা নেমেছে। সেই সন্ধ্যায় তারা কেউ কি তার মতো এমন করে তাকে মনে করে?

হয়তো করে। হয়তো করে না। কেন করবে? সে মনে করার মতো কী করেছে? পারুর বুক ভেঙে হঠাৎ কান্না আসে। কিন্তু কাঁদে না সে। তার কেবল মনে হয় এই এত এত কান্নার জল সে বৃথাই ঝরে দিতে চাইছে। এই কান্নার কোনো অর্থ নেই। কোনো প্রাপ্তি নেই। এতে তার যন্ত্রণা এতটুকুও কমে না। সে কোথায় যেন পড়েছে, মানুষের বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা কষ্টের উপশম ঘটায় কান্না। যে মানুষ কাঁদতে পারে না, তারচেয়ে বড় দুর্ভাগা আর কেউ নেই। কিন্তু কই, এই যে তার এত কান্না পায়। রোজ এত জল ঝরে চোখের, তারপরও তো এতটুকু যন্ত্রণার উপশম ঘটে না। মুহূর্তের জন্যও না।

.

সে সেই অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে থাকে দীর্ঘ সময়। খুব একা লাগতে থাকে তার। এই পুরো রাতটা সে কী করে কাটাবে? এত দীর্ঘ এক রাত? ফরিদ কী করছে এখন? মানুষটা জন্য কী যে মায়া হয় পারুর! তাকে একটু ভালো রাখার জন্য, একটু আনন্দ দেয়ার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করে মানুষটা। এই ভালোবাসাও কি অকিঞ্চিৎকর কিছু? পারুর তা মনে হয় না। বরং রোজ যত সময় যায়, তত তার মনে হতে থাকে, এই মানুষটা তার এই যন্ত্রণাকাতর জীবনকে হয়তো আলগোছে বয়ে নেবে। যত ঢেউ আসুক, যত ঝড়ঝঞ্ঝাই আসুক, সে কখনো তাকে ছেড়ে যাবে না। বরং আগলে রাখবে ছোট্ট এক শিশুর মতো।

পারু উঠে বসল। তারপর আলো জ্বালাল ঘরের। আর ঠিক তখুনি তার মনে পড়ল, ফরিদ তার জন্য আজও একটা চিরকুট লিখে গেছে। সে চিরকুটটা খুলল। সেখানে বড় বড় করে লেখা

জানি যাচ্ছি ফেলে সন্ধ্যা,
সঙ্গে তোমাকেও, স্মৃতিগন্ধা।

পারুর চোখটা কেমন জ্বালা করে উঠল। এই কথাটা কেন লিখল ফরিদ? এইটুকু এক লেখা, অথচ তার সবটা জুড়েই যেন চির এক প্রস্থানের গল্প। যেন মানুষটা সবকিছু ছেড়ে না-ছোঁয়া দূরত্বের দূর কোনো দেশে চলে যাচ্ছে। তাদের আর কখনোই দেখা হবে না। মনটা ভার হয়ে রইল পারুর। সে বসে রইল চুপচাপ। বাইরে ক্রমশই নেমে আসছে রাত। সঙ্গে শীতল হাওয়ায়ও। পেয়ারাগাছটার পাতায় পাতায় ঘষা খেয়ে আচমকা শব্দ হতে লাগল। নারকেল গাছ থেকে কী যেন কী একটা পড়ল শব্দ করে। পারু কেঁপে উঠল ভয়ে। আর তখুনি কাগজের উল্টোদিকের লেখাটা চোখে পড়ল তার। সেখানে লেখা, কী মন খারাপ হয়েছে? তাহলে এটুকু পড়ো।

পারু পড়ল। সেখানে লেখা—

যেতে যেতেও ফিরে আসবার বাহানা কুড়াই
স্মৃতিগন্ধা-অচেনা সন্ধ্যা, তোমাতে উড়াই।

পারু লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার হঠাৎ মনে হলো এই লেখাটুকু জুড়ে অদ্ভুত এক ফুলের সুবাস রয়েছে। সেই সুবাস ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে তার বুকের ভেতর। ধীরে ধীরে তার মনে ভালো করে দিচ্ছে।

রাত কটা বাজে পারু জানে না। আচমকা ঘুম ভেঙে গেল তার। প্রথম মনে হলো দরজায় কেউ শব্দ করছে। কিন্তু এত রাতে কে শব্দ করবে? ফরিদ কি চলে এসেছে? পারু একবার ভাবল উঠে দরজা খুলবে। কিংবা জিজ্ঞেস করবে কে? কিন্তু হঠাই মনে হলো, হয়তো ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছে সে। সেই স্বপ্নেই হয়তো কোনো শব্দের ব্যাপার ছিল। এখন ঘুম ভাঙার পরও তার রেশ রয়ে গেছে। সে আরো খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল। না, কোথাও কোনো শব্দ নেই। বাইরের পেয়ারাগাছটার পাতাগুলো হয়তো মৃদু হাওয়ায় কাঁপছে। একটা ডাল প্রায়। দেয়ালঘেঁষে বেড়ে উঠেছে। সেই ডাল বাড়ি খাচ্ছে থেকে থেকে। হয়তো সে কারণেই শব্দ হচ্ছে। পারু উঠে বসল। বাইরের রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো পড়েছে জানালার কাছে। সেই কাচের দিকে তাকিয়ে পারু আচমকা জমে গেল। আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

কে সে?

৩২

মইনুল এসেছে মহিতোষের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি ঢাকা মেডিকেলের মূল ফটকের পাশে একটা গাছের ছায়ায় বসে আছেন। গত কিছুদিন ধরে তার আচার আচরণ খানিক এলোমেলো। সেদিন মইনুলদের মেস থেকে ফিরে তিনি তরুকে খুঁজে বের করেছেন। তরু তাকে দেখে অবাক হলেও প্রথমে কথা বলতে চায়নি। পরে গম্ভীর মুখে বলেছে, আপনি এখন সুস্থ। সুস্থ মানুষের হাসপাতালে কী কাজ?

মহিতোষ কাঁচুমাচু মুখে বলেছেন, তুমি আমার ওপর রাগ করেছ, সেইটা ঠিক আছে মা। আমি রাগ করার মতো কাজই করছি।

তরু চুপ। সে থমথমে মুখে কাজ করছিল। মহিতোষ বললেন, আমার ভালো-মন্দ জ্ঞান নাই মা। জ্ঞান-বুদ্ধি ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। কখন কী করি নিজেই জানি না। তুমি আমার ওপর রাগ করো না।

আমি আপনার ওপর রাগ কেন করব?

রাগ কেন করবা, তাতো জানি না। তবে রাগ যে করছো, তা জানি।

মহিতোষের কথায় তরুর রাগ আরো বেড়ে গেল। সে বলল, আপনার যা বলার বলে বিদায় হন। আমার অনেক কাজ। অযথা নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই।

কই যাব আমি?

কই যাবেন মানে? আপনার বাড়ি যাবেন?

আমার তো বাড়ি নাই মা।

বাড়ি নেই মানে? আপনি পথে-ঘাটে থাকেন?

মহিতোষ সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না। যেন খানিক চিন্তা-ভাবনা করার সময় নিলেন। তারপর বললেন, তাও তো বুঝতে পারছি না। তবে গত কয়েকদিন তো এই হাসপাতাল আর রাস্তাঘাটেই ছিলাম। মাইলের পর মাইল বাসে-ট্রেনে, বাসে ট্রেনে ছোটাছুটি করছি…।

মানে? ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল তরু। যেন নতুন করে আবার কৌতূহলটা ফিরে এসেছে তার। সে বলল, আপনি বাসে-ট্রেনে কী করেন?

খুঁজি মা।

কাকে খোঁজেন?

আমার মেয়েকে।

আপনার মেয়ে কই?

তাতো জানি না মা। মহিতোষের গলা ভাঙা।

জানেন না মানে?

জানি না মানে, সে হারিয়ে গেছে। বলেই কেঁদে ফেললেন মহিতোষ। তার এই কান্নাটাকে তিনি আর আটকে রাখতে পারলেন না। যেন গত বেশ কিছুদিন ধরে বুকের ভেতর একটু একটু করে দুঃখের বরফ জমা করে রেখেছিলেন তিনি। সেই বরফগুলো এখন কান্না হয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে। তরু তখন আর কিছু বলল না। সে মহিতোষকে হাসপাতালেরই এক স্টাফের ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে তার শ্রিাম-থাকার ব্যবস্থা করল। তারপর বলল, আপনি আমার কাছে না বলে আর কোথাও যাবেন না। মনে থাকবে?

থাকবে।

আর যদি যান, এরপর আর কখনো আমি আপনার মুখ দেখতে চাই না। আর কখনো আমার সামনে আসবেন না আপনি। ঠিক আছে?

হু। বললেন মহিতোষ।

তরু সেইদিনের মতো চলে গেল। তার অনেক কাজ। গতরাত থেকে টানা ডিউটি করছে সে। শরীরটাও ভেঙে পড়ছে। হাসপাতালে আরো জরুরি কিছু দায়িত্ব আছে। সেগুলো বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় যেতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে তার মা এসেছেন। মায়ের শরীরটা একটু খারাপ। তাকে সময় দিতে হবে। আগামীকাল এসে মহিতোষের সঙ্গে কথা বলতে চায় সে।

তরু পরদিন এলো। মহিতোষকে নিয়ে হাসপাতাল কম্পাউন্ডেই খোলামেলা এক জায়গা দেখে বসল সে। তারপর বলল, কী হয়েছে আপনার এবার বলেন?

মহিতোষ যতটা সম্ভব সংক্ষেপে তার ঘটনা খুলে বললেন। তরুর মনে হলো সে বাস্তবের কোনো ঘটনা শুনছে না। সে শুনছে গল্প-উপন্যাসের কোনো ঘটনা। বাস্তবেও কারো জীবনে এমন কিছু ঘটতে পারে! এ যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। সে বলল, আপনি এখন কী করবেন?

অপেক্ষায় থাকব।

কীসের অপেক্ষায়?

যদি ওই মইনুল ছেলেটা কোনো খবর দিতে পারে। অথবা…।

অথবা কী?

কথাটা বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে মহিতোষের। আজকাল খুব সাধারণ বিষয়েও সঙ্কোচ হয় তাঁর। যেন কোনো যুক্তি-বুদ্ধিই কাজ করে না। তিনি খুব কাতর গলায় বললেন, আমি এই হাসপাতালের গেটে বসে থাকব।

কেন? হাসপাতালের গেটে বসে থাকবেন কেন?

মহিতোষ খানিক চুপ করে রইলেন। যেন কী বলবেন সেটা মনে মনে গুছিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, তুমি না বলছিলা, কেউ হারিয়ে গেলে লোকে তারে হাসপাতালে খোঁজে?

হু।

এইজন্য আমিও এইখানে বসে থাকব। যদি আমার মেয়ে কখনো এইখানে বসে থাকে?

কতদিন বসে থাকবেন?

তাতো জানি না মা। যতদিন সে না আসে।

তরু আর কথা বলল না। লোকটাকে গতকাল থেকে যেন খানিক অন্যরকম লাগছে। একটু অসংলগ্ন । সে বলল, বসে থাকবেন ভালো কথা। কিন্তু আমাকে না বলে কোথাও যাবেন না।

মহিতোষ মাথা নাড়লেন। সেই থেকে তিনি বসে আছেন। কয়েকবার ভেবেছিলেন মইনুলের কাছে যাবেন। কিন্তু তার সঙ্গে থাকা লোকটাকে একদমই পছন্দ হয়নি মহিতোষের। কারণটা ঠিক স্পষ্ট জানেন না তিনি। তবে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হয়েছে লোকটাকে দেখে। কিছু একটা আছে লোকটার মধ্যে, যা তিনি ধরতে পারছেন না। তবে লোকটা পারু আর ফরিদের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ এনেছে শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সামান্য একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য যে ছেলে-মেয়ে দুটি অমন দিশেহারার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই তারাই আবার এমন জঘন্য একটা কাজ করে নিজেদের ঘাড়ে নতুন বিপদ ডেকে আনবে এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

এ তো গেল যুক্তির কথা। কিন্তু মহিতোষ এই যুক্তি পর্যন্তও যেতে চান না। তিনি তার মেয়েকে চেনেন। ফরিদকেও চেনেন। কোনো পরিস্থিতিতেই তাদের পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব নয়।

মহিতোষের বরং মনে হচ্ছে, নতুন কোনো বিপদের আঁচ পেয়েই ওই লোকের বাসা ছেড়ে গেছে পারু আর ফরিদ। এবং লোকটা এখন সেই ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। সবচেয়ে ভয়ের কথা, লোকটা নিজেই স্বীকার করেছে যে সে এখনো তাদের খুঁজছে। বিষয়টা নিয়ে মহিতোষ উদ্বিগ্ন। কারণ, যদি তা-ই হয়, তবে পারু আর ফরিদ এই লোকের কাছ থেকে এখনো নিরাপদ নয়।

বিষয়টা চিন্তা করেই হঠাৎ ওভাবে টাকার কথাটা বলেছিলেন তিনি। যাতে অন্তত টাকা পাওয়ার লোভে হলেও পারুদের কোনো ক্ষতি করে না বসে লোকটা। বরং তাদের খোঁজ পাওয়া মাত্রই যেন মহিতোষকে জানায়। এতে খানিকটা হলেও তাৎক্ষণিক ক্ষতির হাত থেকে নিরাপদ থাকবে পারু আর ফরিদ।

মহিতোষ অবশ্য একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। আর তা হলো পারুদের খোঁজ নিতে লোকটার কাছে আবার যাবেন কি না? নাকি এখানেই অপেক্ষা করবেন? তার অবশ্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না। সেদিন মইনুলকে হাসপাতালের গেটের কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখে তিনি নিজ থেকেই এগিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, কোনো খোঁজ পেলেন বাবা?

মইনুল তাকে নিয়ে নিরিবিলি একটা জায়গা দেখে বসল। তারপর বলল, খোঁজ সম্ভবত মিলে যাবে চাচা। তবে একটা সমস্যা আছে।

কী সমস্যা?

আপনি নিশ্চয়ই কথা-বার্তা শুনেই বুঝেছেন যে আজিজ মিয়া নোকটা খুব একটা সুবিধার না?

মহিতোষ জবাব দিলেন না। তিনি আগে মইনুলের কথা শুনতে চান। মইনুল বলল, আমি একটা ভুল করে ফেলেছি চাচা। না জেনেই ভুলটা করেছি। ইচ্ছে করে করিনি।

কী ভুল।

আমি এই লোকটাকে বুঝতে পারিনি। প্রায় ছয় মাস ধরে তার সঙ্গে আমি। পাশাপাশি রুমে থাকি। একটা বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছে। কিন্তু তারপরও তার এই রূপটা আমি ধরতে পারিনি।

কী রূপ? মহিতোষ বুঝতে পারছেন না তাঁর সামনে বসে থাকা এই ছেলেটিকেও তিনি বিশ্বাস করবে কি না। কিংবা করলেও কতটুকু করবেন?

মইনুল বলল, উনি লোক সুবিধার না। আপনার কাছে উনি যে টাকা-পয়সার কথা বলেছেন, এই বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। এমনকি আপনার সঙ্গে কথা বলার আগ পর্যন্তও উনি আমাকে টাকা-পয়সা বা ফরিদদের খোঁজসংক্রান্ত কিছু বলেননি।

মহিতোষ কথা বললেন না। মইনুল ভারি গলায় বলল, আমার খুব খারাপ লাগছে চাচা। দিলারা আমাকে বিশ্বাস করে ছেলে-মেয়ে দুটাকে আমার কাছে পাঠাল। অথচ আমি কি না নিজের হাতে তাদের নতুন এক বিপদে ফেললাম।

মহিতোষ বললেন, এখন কী অবস্থা, কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি?

চাচা, খোঁজ আশা করি পাওয়া যাবে। যদিও উনি ভেঙে কিছুই বলছেন না। তবে তার হাব-ভাবে বোঝা যাচ্ছে। এর অবশ্য কারণও আছে। উনি আমাকেও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমি আপনাকে যে কথাটা বলার জন্য এসেছি। সেটা এখন শোনেন।

জি।

আসলে ওই দিন আপনি চলে আসার পর ওনার সঙ্গে আমি একটু বেশিই খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছিলাম। বিষয়টা উনি সহজভাবে নিতে পারেননি।

আচ্ছা।

এরপর থেকে আমাকে খানিক এড়িয়ে চলেন। কিছুই বলছেন না। শুধু বলছেন, আপনার এত কিছু জানার দরকার নাই। টাকা পেলে আপনার ভাগ আপনি পেয়ে যাবেন।

ওহ।

হতাশ ভঙ্গিতে বললেন মহিতোষ মাস্টার।

আসলে আমারই ভুল হয়েছে। বিষয়টা নিতে পারিনি আমি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তখন ওরকম না করে যদি আমি ওনার কথায় তাল মেলাতাম, তাহলে হয়তো এই সমস্যাটা হতো না। পারুদের বর্তমান অবস্থানের ব্যাপারে উনি যা যা জানেন, সবই আমাকে বলতেন।

মহিতোষ কথা বললেন না। যেন ধীরে ধীরে এসবে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন তিনি। যেখানে প্রাপ্তির শতভাগ সম্ভাবনা, সেখানেও যেন তার জন্য নিশ্চিত অপেক্ষায় থাকে অপ্রাপ্তি, দুর্ভাগ্য। কে জানে, এই জীবনে আর কখনোই তিনি পারুর দেখা পাবেন কি না? এই যে বুকের ভেতর পারুকে দেখার অন্তহীন এক তেষ্টা, তীব্র হাহাকার, এই হাহাকার কি আর এই জনমে আর কখনোই মিটবে না? এই যন্ত্রণা নিয়েই কি তার মৃত্যু হবে?

মইনুল বলল, আমি ঠিক করেছি, পারু আর ফরিদকে নিয়ে আজিজ মিয়ার সঙ্গে আর কোনো ঝগড়া-বিবাদে যাব না আমি। এখন থেকে উনি যা-ই বলবেন তাতেই সায় দিব। এতে যদি ওনার সঙ্গে আমার আগের সম্পর্কটা কিছুটা হলেও ফিরে আসে। হয়তো তখন কোনো সময় উনি আমার কাছে ঘটনা খুলে বলবেন। তবে একটা কথা…।

কী?

আপনার সঙ্গে উনি যোগাযোগ করলে আপনি চট করে তাকে কোনো টাকা পয়সা দিয়ে বসবেন না। আবার না-ও বলবেন না। বলবেন যে টাকা নিয়ে সমস্যা নেই। যত টাকা লাগে আপনি দিতে পারবেন। প্রয়োজনে খুবই লোভনীয় কোনো টাকার অঙ্ক বলবেন। কিন্তু বলবেন, সেজন্য আগে পারু আর ফরিদকে আপনার কাছে এনে দিতে হবে। এতে করে অন্তত আগেই পারুর কোনো ক্ষতি করার কথা ভাববেন না তিনি।

আচ্ছা। বলে চুপ করে রইলেন মহিতোষ। এই এতক্ষণে একটু হলেও মইনুলের ওপর বিশ্বাস ফিরে পাচ্ছেন তিনি। কারণ সে যে কথাগুলো বলেছে তাতে আসলেই তার কোনো লাভ নেই। বরং তার কথা শুনে মনে হচ্ছে, বিষয়টি নিয়ে সত্যি সত্যিই চিন্তিত সে।

মইনুল বলল, এর মধ্যে যদি পারুদের কোনো খবর আমি তার কাছ থেকে আদায় করতে পারি, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই আপনাকে জানানোর চেষ্টা করব। বলেই উঠে দাঁড়াল মইনুল। তারপর বলল, আজ যাই চাচা। আর দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না।

.

আজিজ মিয়া অবশ্য মহিতোষের কাছে এলেন না। তবে মহিতোষের কেন যেন মনে হলো বেশ কিছুদিন ধরেই হাসপাতালের ফটকের আশপাশে দু-একজন মানুষকে তিনি নিয়মিত ঘোরাঘুরি করতে দেখছেন। যেন মানুষগুলো আড়াল থেকে তাঁর ওপর নজর রাখছে। চোখ পড়তেই চট করে সরে যাচ্ছে। বিষয়টাতে তিনি সামান্য বিভ্রান্ত বোধ করছেন। কারণ, তিনি এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ নন যে তাকে আড়াল থেকে অনুসরণ করতে হবে! এই শহরে তাঁর কোনো শত্রু থাকার কথা নয়। মিত্রও না।

তাহলে?

বিষয়টার কোনো জবাব খুঁজে পেলেন না মহিতোষ। তবে মইনুলের প্রতি যে বিশ্বাসটুকু তার জন্মেছিল, সেখানে যেন আবার খানিক সন্দেহের চোরাকাঁটা ঢুকে গেল।

.

মইনুলের মন আজ খানিকটা ভালো। সে আজিজ মিয়ার কাছ থেকে ফরিদ সম্পর্কে একটা তথ্য পেয়েছে। তথ্যটা যদিও পরিপূর্ণ নয়। তারপরও এই তথ্য ধরে তাকে খুঁজে বের করার একটা ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। আজিজ মিয়া সম্পর্কে রীতিমতো বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে মইনুল। সেদিনের পর থেকে কেমন যেন অন্য মানুষ মনে হচ্ছে তাকে। মইনুল নানাভাবে চেষ্টা করেছিল আগের সেই সহজ সম্পর্কটা ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু সেটা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। আজিজ মিয়া বারবার একটা কথাই বলেছেন, আমি ভাই মানুষ খারাপ। খারাপ মানুষ না হলে কেউ দুই বিয়া করে, বলেন? তার মুখে হাসি। কথার ভঙ্গিতে রসিকতার ছাপ। তবে মইনুল ঠিকই টের পাচ্ছিল, ভেতরে ভেতরে মেঘের মতো গম্ভীর হয়ে আছেন আজিজ মিয়া।

মইনুল বলল, আরে পুরুষ মানুষের তো চার বিয়া পর্যন্ত করার বিধান আছে।

আছে। সেটা আপনাদের মতো ভালো মানুষের জন্য। আমি হলাম খারাপ লোক। আমার চোখ খারাপ। যারে দেখি, তারেই পছন্দ হয়। আমার জন্য তো চার বিয়ার বিধান শাস্তিস্বরূপ। বলে আবারও হাসলেন আজিজ মিয়া। মইনুল বলল, পারু মেয়েটারেও পছন্দ হইছে নাকি? আমি তো ওইটুক সময় দেখলাম। চেহারাটাও ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম না।

এই কথায় যেন সতর্ক হয়ে গেলেন আজিজ মিয়া। বললেন, কী ব্যাপার মইনুল সাব। আগে শুনছি ভূতের মুখে রাম নাম। আর এখন দেখছি রামের মুখে ভূত নাম। ঘটনা কী বলেন?

ঘটনা তেমন কিছুই না। বোঝেনই তো, একা একা থাকি। বিয়ে-শাদিও করি নাই। আমোদ-প্রমোদের ইচ্ছা তো সবারই হয়। কেউ মুখ ফুটে বলতে পারে, কেউ পারে না। আমি দ্বিতীয় দলের। পেটে ক্ষিদা, কিন্তু মুখে শরম। মইনুল ভেবেছিল তার এই কথায় আজিজ মিয়া খুব উচ্ছ্বসিত হবেন। আগ্রহ দেখাবেন। কিন্তু তিনি তেমন কিছুই করলেন না। বরং খানিক গম্ভীর হয়ে বললেন, শোনেন, গাছ কাটতে কী লাগে?

করাত বা কুড়াল।

আর ঘাস কাটতে?

কাঁচি।

তো কাঁচি দিয়ে কি কোনোদিন গাছ কাটা যায়? যায় না। তেমনি করাত বা কুড়াল দিয়েও ঘাস কাটা যায় না। আমরা মানুষ আলাদা। আপনি একরকম, আমি অন্যরকম। আমি যেমন আপনার মতো হইতে পারব না। তেমনি আপনিও আমার মতো হইতে পারবেন না। শুধু শুধু ভান ধইরা লাভ কী?

আজিজ মিয়ার কথা শুনে খানিক চুপসে গেল মইনুল। গত কদিন ধরেই মানুষটাকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করছে সে। যেন এতদিন অন্য একটা মানুষের ছদ্মবেশে নিজের ভেতরের এই মানুষটাকে আড়াল করে রেখেছিলেন তিনি। এই মানুষটা তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিমান এবং ধুরন্ধর। সঙ্গে বিপজ্জনকও। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে সদা সতর্ক থাকতে হয়। মুহূর্তের জন্যও ভুল করা যায় না। তার চোখের দৃষ্টি প্রখর। যেন পলকেই অন্যের বুকের ভেতরটাও দেখতে পান তিনি। কিছুই লুকিয়ে রাখা যায় না।

আজিজ মিয়া সেদিন বললেন, আমার কিছু ঝামেলা যাচ্ছে মইনুল সাহেব। কয়েকদিন মেসে থাকতে পারব না। আর কেউ যদি আমার খোঁজে আসে, কলবেন সে আর এইখানে থাকে না। ঠিক আছে?

জি।

আরেকটা কথা, আপনি যে মহিতোষ স্যারের সঙ্গে একা একা দেখা করতে গেছিলেন, কাজটা ঠিক করেন নাই। টাকা-পয়সার ডিলিং হলে সেইটা তাঁর সঙ্গে আমার হবে। আপনার না। আপনি তো আর ফরিদদের খোঁজ জানেন না। জানেন?

জি না।..

তাহলে?

মইনুল কথা বলল না। তার গা শিরশির করছে। সে যে মহিতোষের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, এই কথাও তিনি জানেন! আজিজ মিয়া বললেন, আপনি টাকার ভাগ পাবেন, কারণ আপনার কারণেই তারা আমার কাছে আসছে। এই জন্য। না দিলেও পারি, কিন্তু আপনি বয়সে ছোটো হলেও আমার বন্ধু মানুষ। সজ্জন। অনেক উপকার করছেন।

মইনুল ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না আজিজ ভাই। আমি আসলে…।

আজিজ মিয়া আর বাকি কথা বলতে দিলেন না। তিনি হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি কাউরে ভুল বুঝি না। ফরিদের খোঁজ আমি পেয়ে গেছি। কিন্তু হঠাৎ করেই কিছু বিপদ এসে পড়ছে আমার ঘাড়ে। এইজন্য চট করে কিছু করতে পারছি না। তাছাড়া একজন বিশেষ লোকের জন্যও অপেক্ষা করতেছি আমি।

কোন লোক?

আজিজ মিয়া এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তবে মৃদু হাসলেন। তার সেই হাসি রহস্যময়, ভয়ংকর। মইনুল বলল, পারুকে কি তার বাবার সঙ্গে দেখা করাবেন না?

সময় আসুক। সময় আসলে এমনিতেই দেখা হবে। আমার আর দেখা করানো লাগবে না। এত অস্থির হওয়ার কিছু নাই। বলে আবারও হাসলেন তিনি। তারপর বললেন, একটা কথা। সত্যি করে বলবেন। আপনার কাছে তারা কীভাবে এলো? কী হয় আপনার?

না, তেমন কিছু না। আমার এক আত্মীয়ের বন্ধু ফরিদ।

হুম। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন আজিজ মিয়া। মইনুল খুব সাবধানে জিজ্ঞেস করুল, তা, এখন কী অবস্থায় আছে ওরা? আমাকে আমার সেই আত্মীয় পাগল করে ফেলছে ওদের খবরের জন্য। চিঠিও পাঠিয়েছে অনেকগুলো। আমি তাকে কোনো জবাবই দিতে পারছি না।

কী জানতে চায় সে?

এই কোথায় আছে ওরা? কী করছে? ফরিদ কোনো কাজ পেয়েছে কি না?

আজিজ মিয়া হাসলেন। বললেন, জানাই দেন যে তারা ভালো আছে। ফরিদও ভালো কাজ পেয়ে গেছে।

ভালো কাজ? অবাক গলায় বলল মইনুল।

হুম।

কী কাজ?

ওষুধের দোকানের কাজ। বলেই উঠে দাঁড়ালেন আজিজ মিয়া। তারপর বললেন, আর সাবধান, আমার খোঁজে কেউ এলে কিন্তু বইলেন যে আমি এই মেস অনেক আগেই ছেড়ে দিছি।

আচ্ছা।

আজিজ মিয়া চলে গেলেও মইনুল নড়ল না। সে স্থির বসে রইল। চুপচাপ, শান্ত। তার মাথায় ঘুরছে ওষুধের দোকানের কথাটা। আজিজ মিয়ার ওই ওষুধের দোকানের কথাটা খট করে কানে লেগে গেছে তার। সামান্য এই তথ্যে ফরিদকে খুঁজে বের করা সম্ভব না। ঢাকা শহরে অসংখ্য ওষুধের দোকান আছে। কোনটায় ফরিদ কাজ করে কে জানে! তবে বিষয়টা মাথায় গেঁথে রইল তার। সেই সারাটা দিন কাজ করতে গিয়েও চিন্তাটা তাড়াতে পারল না মইনুল। তবে সন্ধ্যায় বাসায়। ফিরতে গিয়ে হঠাৎই মনে পড়ল, আজিজ মিয়া এর আগে একবার বলেছিলেন, ফরিদ তার এলাকার আশপাশেই কোথাও আছে। সেক্ষেত্রে তাকে খুঁজে বের করা কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু নয়। এই আশপাশের এলাকাগুলোতে খুব বেশি ওষুধের দোকান থাকার কথা না। সে চাইলেই ওই ওষুধের দোকানগুলোতে খোঁজ নিতে পারে। কোনো না কোনো দোকানে ফরিদের খোঁজ মিলবেই। মনে মনে খানিক উত্তেজিত হয়ে উঠল মইনুল। সে দ্রুত মেসের দিকে ফিরতে লাগল। কাল ছুটি নিয়ে সারাদিন ফরিদকে খুঁজবে সে।

.

মেসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় আটটা। কিন্তু মেসের সামনে গিয়েই থমকে গেল মইনুল। ভেতরে ঢুকতে পারল না সে। মেসের সামনের খোলা চত্বরটাতে গিজগিজ করছে পুলিশ। তাদের হাতে ভারি অস্ত্র। সতর্ক ভঙ্গি। মেসের সব সদস্যদের সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের কাউকে কাউকে আলাদা করে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। দৃশ্যটা যে কারো জন্য ভয়ানক। মইনুলও ভয় পেয়ে গেছে। তার মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের তীব্র শীতল স্রোত নেমে যাচ্ছে। কী হয়েছে এখানে?

পাশের চায়ের দোকানটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। দোকানি বলল, আপনে এইহানে? আপনারে ধরে নাই

আমাকে কেন ধরবে?

সবাইরেই তো ধরতেছে। মেসের যারে পাইতেছে, তারেই।

কেন? কী করেছে মেসের লোকজন?

সবাই তো আর করে নাই। করছে একজন-দুইজন। কিন্তু সন্দেহ করতেছে সবাইরে। উদাস ভঙ্গিতে বলল দোকানি।

ঘটনা কী বলেন তো? মইনুল উত্তেজনা চেপে রেখে বলল।

আপনে জানেন না?

নাহ। জানলে কি আর আপনার কাছে জিজ্ঞেস করতাম?

ওহ। তাও তো কথা। লোকটা আয়েশি ভঙ্গিতে পান বানাচ্ছে। মইনুলের আর তড় সইছে না। সে বলল, কী হলো? বলেন না?

বলতেছি। এই মেসে নাকি এক দাগি আসামি থাকে। তার বিরুদ্ধে খুন ধর্ষণের মামলাও আছে।

কী বলছেন আপনি? শিউরে ওঠা কন্ঠে বলল মইনুল। তার গলা কাঁপছে। খুন-ধর্ষণের মামলার দাগি আসামি এই মেসে!

হুম।

কে সে? কী নাম?

তার আসল নাম তো আর আমি জানি না। জানে পুলিশ। তয় সে নাকি একেক জায়গায় একেক নামে থাকে। চেহারাও চেনা যায় না। ছদ্মবেশ ধরে থাকে।

মইনুলের বুকের ভেতরটা তিরতির করে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে। সে ফাসফেঁসে করে বলল, এইখানে তার নামটা কী?

আজিজ মিয়া। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলল দোকানি। কিন্তু মইনুলের মনে। হলো ভয়ে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। গা ঘামছে। সে ঠিক মতো বসতে পারছে না। এই লোকের সঙ্গে সে এতদিন একসঙ্গে ছিল!

৩৩

ভুবনডাঙা নিস্তরঙ্গ, স্বাভাবিক। যেন কোথাও কোনো স্পন্দন নেই। শান্ত-শীতল এক গ্রাম। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। মহিতোষ মাস্টারের বাড়ির অবস্থাও তেমনই। যেভাবে তিনি রেখে গিয়েছিলেন, সবকিছু যেন সেভাবেই পড়ে আছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া প্রথম দিকে খুব হম্বিতম্বি করলেও পরে হঠাৎ চুপ হয়ে গেছেন। বিশেষ করে পারু আর ফরিদের ঘটনার পর থেকে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না পারু ফরিদের সঙ্গে রয়ে গেছে। বিষয়টা একই সঙ্গে বিস্ময়কর। অন্যদিকে রহস্যময়ও। কিছু হিসেবও মেলাতে পারছেন না তিনি। বিশেষ করে মহিতোষের সহায়-সম্পত্তির মালিকানা কেন এতদিনেও কেউ বুঝে নিতে এলো না! আর মহিতোষরাই আসলে কোথায়? তার ধারণা, মহিতোষরা এখনো দেশ ছেড়ে যায়নি। তাঁরাও পারুকে খুঁজছে। আর তাই যদি হয়, তাহলে পারুকে একদম শেষ মুহূর্তে ওভাবে হাত ফসকে চলে যেতে দেয়াটা ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। একবার পারুকে হাতে পেলে বাকি সব হিসেব আপনাআপনিই মিলে যেত। কিন্তু ওই অত বড় ঢাকা শহরে তিনি পারুদের কোথায় খুঁজবেন?

ঘটনার পর থেকে তিনি চুপসে গেছেন। বারবার মনে হচ্ছে ভাগ্য তার সঙ্গে নেই। আর ভাগ্য যদি সঙ্গে না থাকে তাহলে অনেক চেষ্টা করেও কিছু পাওয়া যায় না। আর ভাগ্য সঙ্গে থাকলে এমনি এমনিই সবকিছু এসে হাতের মুঠোয় ধরা দেয়। মহিতোষের পুরো ব্যাপারটাই তাঁর কাছে এখনো ধোয়াশে। যদি তিনি দেশে থেকে থাকেন, তবে সামান্য হলেও একটা সম্ভাবনা আছে তাঁকে আয়ত্তের মধ্যে পাওয়ার। এখন মূলত সেই অপেক্ষায়ই আছেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। যদি ভাগ্য কোনোভাবে সেই সুযোগটা তাঁকে দেয়, তাহলেই কেবল সেটা সম্ভব।

তবে একটা বিষয়ে তিনি এখন নিশ্চিত। আব্দুল ওহাব এসবের সঙ্গে যুক্ত নন। এমনকি আতাহার মওলানার ছেলে রফিকুলের সঙ্গে এই নিয়ে কথাও বলেছেন তিনি। সেও জানিয়েছে, ফরিদের মামা আগে থেকে এসবের কিছুই জানতেন না। শুধু তা-ই না, মহিতোষদের ব্যাপারেও তার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু তারপরও কোনো এক অজানা কারণে আব্দুল ওহাবের প্রতি ভয়ানক বিদ্বেষ অনুভব করছেন। তিনি। এই বিদ্বেষ কিছুতেই তাড়াতে পারছেন না।

মহিতোষের বাড়িতেও আজকাল আর সেভাবে যান না তিনি। মনে হয় আড়াল থেকে কেউ একজন তাকে দেখে যেন মুখ টিপে হাসছে। যেন সেই আড়ালে থাকা মানুষটার সহায়-সম্পত্তি দেখে-শুনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখার দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অনেকটা তত্ত্বাবধায়কের মতো। যখনই তিনি আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সবকিছুর হিসেব-নিকেশ বুঝে চাইবেন, তখনই তা দিয়ে দিতে বাধ্য থাকবেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারপর এই সবকিছু ছেড়ে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে হবে তাকে। বিষয়টা ভাবলেই ভেতরে ভেতরে লজ্জায়, অপমানে কুঁকড়ে যান জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। একই সঙ্গে ক্রোধও অনুভব করেন।

গাঁয়ের লোকজনও যেন আজকাল একটু কেমন করে তাকায় তার দিকে। যেন তাঁর এই হাঁসফাঁস অবস্থাটা তারা খুব উপভোগ করে। মহিতোষের সম্পত্তিটা এখন তাঁর গলার কাঁটা হয়ে আছে। না পারছেন গিলতে, না পারছেন উগড়ে ফেলতে। ওই বসতবাড়ি থেকে শুরু করে ফসলের মাঠ, সবখানে তিনি চটজলদি বড় বড় সাইনবোর্ড নিয়ে দিয়েছেন। সেই সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা, মহিতোষের গছ থেকে ওই জমি, ওই বসতবাড়ি তিনি নগদ অর্থে খরিদ করেছেন। ক্রয়সূত্রে সেসবের মালিক এখন তিনি। অথচ সেসবে তিনি উঠতে পারছেন না। নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন না। বিষয়টা সবার চোখেই ধরা পড়েছে। তবে তারা সরাসরি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে কিছু না বললেও আড়ালে আবডালে নানা কথা বলে।

সেদিন যেমন নামাজ শেষে ইমাম সাহেব বললেন, ভূঁইয়া সাব, বহুদিন ভালো মন্দ খাওয়া-দাওয়া হয় না। একটা দাওয়াত দেন। নতুন জমি কিনলেন, পাকা দালান উঠাইবেন না ওইখানে? তখন তো মিলাদ দিতে হবে? আমরা আছি কী জন্য?

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া গম্ভীর মুখে বললেন, তাড়াহুড়ার তো কিছু নাই। একটু অপেক্ষা করেন। সবই হবে।

আরে ভূঁইয়া সাব, তাড়াহুড়া তো আমাদের জন্য না। আপনার জন্যই। এখন শীতকাল। বৃষ্টি-বাদলা নাই। এই সময়েই ঘর-দুয়ার ওঠানোতে আরাম। কয়দিন পর থেকে তো শুরু হইব একটানা বৃষ্টি। তখন কেমনে কী করবেন?

সেইটা নিয়া আপনার ভাবতে হবে না। দোয়া কইরেন, তাইলেই হবে।

আকারে ইঙ্গিতে এমন অনেকেই অনেক খোঁচা মারার চেষ্টা করেন। সেসব বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকেন জাহাঙ্গীর ভূইয়া। আজকাল আড়তেও খুব একটা যান না তিনি। বেশির ভাগ সময়ই বাড়িতে বসে কাটান। আর নানা চিন্তাভাবনা গিজগিজ করেতে থাকে মাথাজুড়ে।

গত কয়েকদিন আগে অবশ্য এছাহাক তাকে একটা খবর দিয়েছিল। কিন্তু তিনি সেটা পাত্তা দেননি। কারণ এছাহাকের প্রতি তার আর বিন্দুমাত্র আস্থা অবশিষ্ট নেই। মূলত তার অবিমৃশ্যকারীতার জন্যই পারু আর ফরিদ সেদিন পালিয়ে যেতে পেরেছিল। সে যদি দেখামাত্রই ছুটে গিয়ে তাদের ধরে ফেলত, তাহলে কিছুতেই তারা পালিয়ে যেতে পারত না। এছাহাক অবশ্য তার আত্মপক্ষ সমর্থন করে নানা যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে মন গলেনি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। বরং আরো ক্ষিপ্ত হয়েছেন তিনি। ফলে দিন কয়েক আগে এসে সে যখন বলল, ভূঁইয়া সাব, আপনি অভয় দিলে একখান কথা বলতাম।

অভয় দরকার হবে এমন কথা হলে বলার দরকার নাই। এমনিতে আমার মেজাজ মর্জি ভালো না।

না মানে, কথাখান জরুরি। কিন্তু আপনার সামনে বলতে ভয় লাগতেছে।

জরুরি কথা বলতে যদি ভয় লাগে, বুঝতে হবে সেই কথা জরুরি না। অথবা সেই কথাতেই ঝামেলা আছে।

না মানে মহিতোষ মাস্টারের বিষয়ে।

ঝট করে ফিরে তাকালেন তিনি। তারপর বললেন, মহিতোষ মাস্টারের বিষয়ে কী কথা?

সে মনে হয় এখনো ইন্ডিয়া যায় নাই।

সে যে ইন্ডিয়া যায় নাই, এই কথা বলার জন্য তো গণক হওয়া লাগে না। এইটা দুই মাসের দুধের বাচ্চাও বুঝবে। তুমি তোমার মেয়েকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে পারবা?

এছাহাক মাথা নাড়ল। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া খানিক চুপ থেকে বললেন, হঠাৎ তার কথা এলো কেন? কোনো ঘটনা?

জি।

বলো কী ঘটনা?

তারে সম্ভবত থানা শহরের বাসস্ট্যান্ডে দেখা গেছে।

থানা শহরের বাসস্ট্যান্ডে যেন খানিক অবাক হলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।

হুম।

কবে? কখন?

এই দুই-তিনদিন আগে। উত্তর পাড়ার রবিউল ঘরামি আরেক বাসে ঢাকা যাইতেছিল, তখন সে নাকি দেখছে মহিতোষ মাস্টারের মতো একজন অন্য একটা বাসে উঠতেছে।

ঢাকার বাসে?

হুম।

স্পষ্ট দেখছে?

মানে চাদর গায়ে ছিল। মাথা ঢাকা। কিন্তু তারপরও তার মনে হইছে ওইটা মহিতোষ মাস্টারই।

ঘটনা শুনে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া যে খুব উত্তেজিত হলেন, তা নয়। বরং চুপচাপই হয়ে গেলেন। মহিতোষ যে দেশেই আছেন সেটা তিনিও অনুমান করতে পেরেছেন। সমস্যা হচ্ছে তাকে খুঁজে বের করার তো কোনো উপায় নেই। যেমন উপায় নেই পারুকে খুঁজে বের করার। তবে একটা বিষয়তো নিশ্চিত হওয়া গেল যে মহিতোষও আসলে পারুকেই খুঁজছেন! তার মানে তিনি জানেন যে পারুরা ঢাকায় গিয়েছে?

বিষয়টা নিয়ে সেই সারারাত ভাবলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। কিন্তু কোনো কূলকিনারা করতে পারলেন না। সবচেয়ে ভালো হতো তিনি নিজে ঢাকায় যেতে পারলে। কিন্তু ঢাকায় তিনি কিছু চেনেন না। থাকার কোনো জায়গাও নেই। পরিচিত লোকজন নেই। এরমধ্যে ঢাকায় গিয়ে তিনি কী করবেন?

এই কী করবেন প্রশ্নটিই তাকে আরো বেশি হতাশায় নিমজ্জিত করে ফেলল। তার মনে হলো মহিষেরা দেশ ছেড়ে চলে গেলে তবুও নিজেকে প্রবোধ দেয়া যেত যে তারা তার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এখন আর কিছুই করার নেই। কিন্তু তাতে নয়। তারা এই দেশেই রয়েছে। এমনকি হাত-ছোঁয়া দূরত্বের মধ্যেই ছিল। অথচ তারপরও তিনি কিছুই করতে পারেননি। এখনো পারছেন না। এই যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ভেতরটা অক্ষম আক্রোশে পরিপূর্ণ করে তুলছে। ডুবিয়ে দিচ্ছে প্রবল হতাশায়।

তবে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার এই প্রবল হতাশা কেটে গেল অদ্ভুত এক ঘটনায়। তিনি ভাগ্যে বিশ্বাস করেন। সেই ভাগ্যই যেন তার বরমাল্য নিয়ে তাকে আলিঙ্গন করতে এগিয়ে এলো। এক সন্ধ্যায় তিনি গোমড়া মুখে বসে আছেন বাড়ির উঠানে। তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। এই মুহূর্তে এছাহাক এসে হাজির হলো। তাকে দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। বললেন, যখন তখন তুমি বাড়ি চলে আসো কেন? কোনো দরকার হলে বাড়ির বাইরে থেকে চাকর-বাকর ডেকে খবর দিবা। কী সমস্যা তোমার?

এছাহাক কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে আসছে ভূঁইয়া সাব। অনেক দূর থেকে আসছেন তিনি।

যত দূর থেকেই আসুক এখন আমি কারো সঙ্গে দেখা করব না।

দেখা করাটা খুব জরুরি।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বিড়বিড় করে বললেন, কীসের জরুরি? তোমার জরুরি কী আমি জানি। বলল, কে আসছে?

সোবহানগঞ্জ পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার তালেব পিওন আসছে।

সে আমার কাছে কী চায়?

আমাগো ইউনিয়নের পোস্ট অফিসটা তো নদীভাঙনে ভাইঙ্গা গেল। এখন চিঠিপত্র যা আসে, তা সোবহানগঞ্জ পোস্ট অফিসেই। তো আপনার নামে নাকি গতমাসে দুই-তিনখান চিঠি আসছে। কিন্তু তালেব পিওন অসুস্থ ছিল বলে অতদূর থেকে চিঠি দিতে আসতে পারে নাই। এখন সে সেই চিঠি নিয়ে আসছে।

চিঠি! খুবই অবাক হলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। বললেন, আমাকে কে চিঠি লিখবে?

তাতো জানি না। ঢাকা থেকে নাকি আসছে!

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া তালেব পিওনকে ডাকলেন। সে তিনখানা চিঠি দিয়ে গেল জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে সেই চিঠি পড়ে গা শিউরে উঠল জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার।

.

প্রথম চিঠিটা খুললেন তিনি। তাতে বড় বড় হাতের অক্ষরে লেখা–

দুলাভাই, এই চিঠিটা অত্যন্ত জরুরি। আপনার গ্রামের মহিতোষ মাস্টারের বড় মেয়ে পারুকে ঢাকায় দেখা গেছে। তার সঙ্গে একটি ছেলেও রয়েছে। আমি যখন ভুবনডাঙায় গিয়েছিলাম, তখন পারুর সঙ্গে আমার দেখা হলেও এই ছেলেকে আমি দেখিনি। তবে যতটুকু বুঝেছি, সেও ভুবনডাঙারই ছেলে। তার নাম ফরিদ। মাস চারেক আগে আপনি আমাকে একখান চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেখানে লিখেছিলেন যে মহিতোষ মাস্টার রাতের অন্ধকারে পরিবারসহ পালিয়ে গিয়েছে। আমি যেন জরুরি ভিত্তিতে ভুবনডাঙা আসি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো যে আমি আসতে তো পারি-ই নাই। বরঞ্চ, নানাবিধ ঝামেলায় থাকার কারণে আপনার সেই চিঠির উত্তর পর্যন্ত দিতে পারি নাই। হয়তো এই কারণে আপনি আমার ওপর রাগান্বিত। কিন্তু দুলাভাই, এখন রাগের সময় নাই। আপনি এই চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকায় রওয়ানা হবেন।

ইতি–মোহাম্মদ কামাল।

বি.দ্র. আপনাকে চিঠির উল্টাপাশে আমার বর্তমান মেসের ঠিকানা দিয়েছি। মেসের নাম ব্যাচেলর কোয়ার্টার। আপনি সরাসরি এখানেই চলে আসবেন। আর এখানে এসে কলবেন আজিজ মিয়াকে চাই। সংগত কারণে আমি আমার পরিচয় গোপন করে এখানে আজিজ মিয়া নামে আত্মগোপন করে আছি।

.

চিঠি পড়ে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার হাত-পা কাঁপতে লাগল। তাঁর একবার মনে হলো তালেব পিওনকে ডেকে ইচ্ছেমতো বকা-ঝকা করেন। এই চিঠি এসেছে প্রায় দেড় মাস আগে। সে সেই চিঠি দিয়ে গেল এখন! রাগান্বিত জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া পরের চিঠিখানা খুললেন। সেই চিঠিতেই ওই একই কথা। তবে সেখানে কামাল অতিরিক্ত যা লিখেছে, তা হলো, দুলাভাই, আপনি বোধহয় আমার ওপর এখনো রেগে আছেন। তবে এখন রাগার সময় নয়। সম্ভব হলে আমি নিজেই ভুবনডাঙা চলে আসতাম। কিন্তু আমার পেছনে পুলিশ লেগে আছে। তারা খুব হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজছে। ফলে এই মুহূর্তে আমার পক্ষে বাসে-ট্রেনে ওঠা খুবই বিপজ্জনক। তারা এসব জায়গাতেই সবচেয়ে বেশি তল্লাশি চালায়। আপনি চিঠি পাওয়া মাত্রই চলিয়া আসিবেন।

তৃতীয় চিঠিতেও ওপরের কথাগুলোই রয়েছে। তবে এটিতে কামাল আরো সংযুক্ত করেছে-দুলাভাই, আমি মহা বিপদে আছি। পুলিশ আমার খোঁজে ভয়ানক সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় আমার গাঢাকা দেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নাই। আমি চাই তার আগেই আপনি ঢাকায় চলে আসেন। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমার আগের চিঠিগুলো আপনি পান নাই। তাই এই চিঠিখানি সরকারি রেজিস্ট্রি খামে পাঠালাম। আশা করছি যথাসময়ে চিঠিখানা আপনি পাবেন।

পুনশ্চ-আমি ভয়াবহ বিপদে আছি। আজ এখানে, কাল ওখানে রাত কাটাচিছ। আমার পূর্বের মেস ব্যাচেলর কোয়ার্টারও ছাড়িয়া দিয়াছি। আপনি দয়া করে চিঠির অন্যপাশে দেয়া নতুন ঠিকানায় আসিবেন।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া উঠে দাঁড়ালেন। সন্ধ্যার অন্ধকার ততক্ষণে ঘনীভূত হয়েছে। নেমে আসছে গাঢ় রাত্রি। সেই রাত্রির অন্ধকারে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মুখে হঠাৎ ভোরের ঝলমলে হাসি ফুটে উঠল।

৩৪

পারুর শরীরটা বেশ কিছুদিন থেকেই খারাপ। কিন্তু কেন যেন ফরিদকে সেটা বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল তার। মানুষটা দিনরাত পরিশ্রম করে। বাসায় ফিরেও একটু বিশ্রাম পায় না। বরং সারাক্ষণ চেষ্টা করে তাকে একটু ভালো রাখতে। একটু হাসিখুশি রাখতে। যাতে সে কিছুতেই মন খারাপ করতে না পারে। এরমধ্যে পারু যদি আবার তার শরীর খারাপের কথা বলে, তাহলে নিশ্চয়ই আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে সে। এ কারণেই কিছু বলতে চায়নি পারু। কিন্তু দিন দুই আগে হঠাৎ বাথরুমে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল সে। ফরিদ তখন ঘরেই ছিল। বাথরুমে কিছু পতনের শব্দ শুনতে পেয়ে পারুকে ডাকল সে, পারু?

পারু যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ?

কোনো সমস্যা?

না তো।

তুমি ঠিক আছো?

হু।

পারু কিছু না বললেও ফরিদের বুঝতে বাকি রইল না। সে ঘরে ঢুকতেই ফরিদ বলল কী হয়েছে?

কিছু না।

তুমি পড়ে গিয়েছিলে?

না তো।

এই যে তোমার কাপড় ভেজা? কী হয়েছিল?

বলালাম তো, কিছু না।

উহু। বলেই পারুকে ধরল ফরিদ। আর তখুনি টের পেল পারুর গায়ে জ্বর । সে বলল, জ্বর কখন থেকে?

আজ ভোর থেকে।

তা আমাকে বলোনি কেন?

এমন কিছু তো নয়। একটু গা গরম। সিজন বদলালে এমন হয় আমার।

ফরিদ পারুকে ধরে বসাল। তারপর বলল, ওষুধ খেয়েছো?

উহু।

কেন খাওনি?

ঘরে তো কোনো ওষুধ নেই।

কথাটা শুনে একটু বিব্রতই হলো ফরিদ। সে কাজ করে ওষুধের দোকানে। অথচ তার ঘরেই কোনো ওষুধ নেই! সকালে ঘুম ভাঙতেই দোকানে চলে গেল সে। তারপর ছুটি নিয়ে নিল দিন কয়েকের। পারুর জন্য কিছু ওষুধও নিল। তবে যতটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল সে, ততটা চিন্তিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। বরং ঘুম ভাঙার পর বেশ ভালো বোধ করছে পারু। ফরিদ বলল, এবার থেকে ঘরে অনেক ওষুধ থাকবে।

পারু হাসল, যেই ওষুধটা সবচেয়ে বেশি দরকার, সেটা তো আর থাকবে না।

ফরিদ কপাল কোঁচকালো, কোন ওষুধ?

পারু এবার আর জবাব দিল না। ওই হাসিটুকু ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখল কেবল। ফরিদ বলল, বলো, কোন ওষুধ?

ও আপনি চিনবেন না?

আমি চিনব না?

উহু।

তুমি জানো আমি কে?

কে?

ফরিদ বুকে আলতো চাপড় মেরে বলল, আমি ভুবনডাঙার আব্দুল ওহাব ডাক্তারের ভাগ্নে। আমি যদি ওষুধ না চিনি তো সেটা সেই ওষুধের জন্যই অসম্মান।

তাহলে আর কী? আপনার নিজের জন্যই অসম্মান হয়ে গেল।

আমার নিজের জন্য? আমার জন্য অসম্মান হবে কেন?

পারু এবারও জবাব দিল না। তবে তার মুখে ওই হাসিটুকু লেগে আছে। ফরিদ বলল, কী হলো? বলো?

বলেছিই তো, ওষুধ নিজেই যদি তাকে না চেনে, তাহলে তো সেটা তার জন্য অসম্মানই।

মানে? বলেই থমকে গেল ফরিদ। আমি ওষুধ?

নয় তো কী?

আমি কীভাবে ওষুধ হই? পারু কাপড় ভাঁজ করে রাখতে রাখতে খুব নরম গলায় বলল, এই যে আপনি থাকলে আমার সারাক্ষণ মন খারাপ হয়ে থাকে, এটা অসুখ নয়?

ফরিদ চট করে জবাব দিতে পারল না। পারু বলল, আর আপনি এলেই যে মন ভালো হয়ে যায়?

ফরিদের বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন করে উঠল। পারু এমন আদুরে গলায় কথাগুলো বলল যে তার মন ভালো হয়ে গেল। সে দু হাত বাড়িয়ে পারুকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল, আমি তাহলে তোমার মন খারাপের ওষুধ?

হু।

আমাকে তোমার সবসময় চাই?

পারু এবার আর জবাব দিল না। ফরিদ বলল, আচ্ছা, এখন থেকে আর কাজে যাব না। সারাক্ষণ তোমার পাশে বসে থাকব। হবে?

পারু হাসল, তাহলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে?

ওহ, তাই তো! ফরিদ চিন্তিত হওয়ার ভান করল। তারপর বলল, তোমার এই চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকতে থাকতে দম বন্ধ লাগে?

লাগে তো।

অনেক হুম অনেক।

কী ইচ্ছে হয় তখন?

ইচ্ছে হয় যদি দূরে কোথাও যেতে পারতাম। যেখানে আকাশ, নদী, মাঠ আছে। মানুষের শব্দ, হৈ-হুঁল্লোড় আছে। একা থাকতে থাকতে আজকাল নিজেকে কেমন মৃত মানুষ মনে হয় আমার।

তাই?

হুম।

অমন কোথাও যেতে চাও?

খুব চাই। খুব। যেন চাপা উচ্ছ্বাস ঠিকরে পড়ল পারুর কণ্ঠে। সে বলল, যদি সারাজীবনের জন্য অমন কোথাও হারিয়ে যেতে পারতাম! উফ!

ফরিদ হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, অমন একটা জায়গায়ই হারিয়ে যাব আমরা। তবে সারাজীবনের জন্য না, একদিনের জন্য।

সত্যি? যেন পারুর আনন্দ আর ধরে না।

সত্যি ।

কিন্তু কবে? কখন?

সারপ্রাইজ! বলে হাসল ফরিদ।

পরের দিনটা যেন স্বপ্নের মতো কাটল তাদের। যেন সারাটাক্ষণ পরস্পরকে গভীর আলিঙ্গনে শুষে নিতে থাকল তারা। এই যে তাদের চারপাশজুড়ে এত এত ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদ, বিসংবাদ এর কিছুই যেন ছুঁয়ে গেল না। বরং ওই সময়টুকু যেন হয়ে রইল এক অবিনশ্বর স্মৃতির মিনার।

.

পরদিন গভীর রাতে হঠাৎ পারুকে ডাকল ফরিদ। বলল, একটা ইচ্ছে হচ্ছে।

কী ইচ্ছে?

বলা যাবে না।

কেন?

বললে তুমি বকবে।

বকব না।

উহু, বকবে।

একদম না।

উমমম…। বলে খানিক সময় নিল ফরিদ। যেন ইচ্ছে করেই পারুর কৌতূহল বাড়াচ্ছে। তারপর বলল, পরনের কাপড়টা একটু ছাড়ো না?

পারু চোখ পাকিয়ে বলল, আপনি দিনদিন ভারি অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন।

দিন দিন?

হুম।

ওহ, তাহলে বাচলাম।

মানে? পারু অবাক চোখে তাকাল।

মানে এখন তো আর দিন নয়, এখন রাত। রাতে তো তাহলে অসভ্য হওয়াই যায়। ফরিদ দুষ্টুমির ভঙ্গিতে হাসল।

এখন তো একদমই না।কঠিন গলায় বলল পারু।

একদম হ্যাঁ। বলেই প্যাকেটটা বের করল ফরিদ। তারপর বলল, এই যে দেখো?

কী?

হাতে নিয়েই দেখো।

পারু নিল। তারপর রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করল প্যাকেটটার মধ্যে একটা লাল টুকটুকে শাড়ি। সে শাড়িটা চোখের সামনে মেলে ধরল। তারপর ফরিদের দিকে তাকাল। ফরিদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পারুর বুকের ভেতর যেন রক্ত ছলকে উঠল। সে বলল, এটা আমার?

হুম।

সত্যি?

সত্যি ।

সেই রাতেই পারু তার পরনের জামা ছেড়ে শাড়িটা পরল। ফরিদ শাড়ির সঙ্গে প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়েই এসেছে। সে বলল, এবার কী হলো বলো তো?

কী?

আমার ইচ্ছেটা পূরণ হলো।

কী ইচ্ছে?

তোমাকে বউ সাজে দেখার ইচ্ছে।

কথাটা শুনে মুহূর্তেই মন খারাপ হয়ে গেল পারুর। আবার যেন তার চোখের সামনে একে একে ভেসে উঠতে থাকল সেই ভুবনডাঙার বাড়ি। বাবা, মা, চারু, ঠাকুরমা। সেই ট্রেন। সেই স্টেশনের ভয়ংকর রাত। সেই কুকুরগুলো। তারপর আরো কত কী! এ কদিন সব ভুলেই ছিল সে। কিন্তু এই যে ভুলে থাকার জীবন তারা কাটাচ্ছে, এই জীবনের পরিণতি কী? ফরিদের সঙ্গে তার জীবনটা কি এমনই কাটবে? কী হবে তাদের এই সম্পর্কের নাম? পরিচয়? তাদের ধর্ম আলাদা। বিশ্বাস আলাদা। অথচ কী এক তীব্র ভালোবাসার সম্মোহনেই না তারা ভেসে চলেছে। কিন্তু এই ভাসমান জীবনের শেষ কোথায়? ঠিক কোন পরিচয়ে কোন ঘাটে গিয়ে তাদের এই অসংজ্ঞায়িত যুগল জীবনের নৌকাখানা ভিড়বে? সেখানে কি তারা তাদের পায়ের তলায় নতুন কোনো পরিচয়ের মাটি খুঁজে পাবে? পেলে কী হবে সেই পরিচয়?

পারুর হঠাৎ খুব ভয় হতে লাগল। প্রচণ্ড ভয়। সে ফরিদকে একটা কথা বলতে চায়। কিন্তু যতবার কথাটা বলতে চেয়েছে, ততবারই তার মনে হয়েছে কথাটা শোনার জন্য ফরিদ প্রস্তুত নয়। কিন্তু কথাটা তাকে বলতেই হবে। এই সত্য সে বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারবে না। সেই গভীর রাতে, ফরিদ যখন ঘুমিয়ে গেল, তখন একা অন্ধকারে পারু হঠাৎ আলতো করে তার নিজের পেটে হাত রাখল। তারপর শুয়ে রইল চুপচাপ। যেন সে আলগোছে স্পর্শ করতে চাইল। অপার্থিব এক অনুভব। যেন সেই অনুভব জানে, সেখানে ক্রমশই জেগে উঠছে নতুন এক প্রাণের স্পন্দন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *