খগনিশা – নির্বেদ রায়

খগনিশা – নির্বেদ রায়

‘না না ওটা তোমরাই খাও, আমি ও জিনিস ছুঁই না।’ সোমেশ্বরের এগিয়ে দেওয়া ধোঁয়া-ওঠা মুরগির রোস্টের প্লেটটাকে সাত তাড়াতাড়ি তর্জনী, মধ্যমা আর অনামিকার আঙুল দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন কুমার সাহেব। গোটা মুখ যেন একমুহূর্তে ছাই-এর মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

খাইয়ে হিসাবে কলকাতার রসিক সমাজে কুমার সাহেবের একটা বেশ চওড়া গোছের নাম-ডাক আছে। আর সেই নাম-ডাক দিনে-দিনে ক্রমশ বৃদ্ধিও পাচ্ছে। তার অন্যতম কারণ হল ভদ্রলোক শুধু নিজে খেতে নয়, অপরকে খাওয়াতেও ভালোবাসেন। তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন পেলে খাদ্যরসিক মানুষ মাত্রেই কিছু-না-কিছু চমকের জন্য তৈরি হয়েই যান। বলা তো যায় না, কখন কী আসে? হয়তো প্রথম পাতে চীনে পুডিং কি শেষ পাতে ফরাসি শুক্তো। সুতরাং, এ হেন খাবার-দাবারের জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়াটি সামনে থেকে গন্ধে-তর-করে দেওয়া একনম্বর কন্টিনেন্টাল ডিশ তিন আঙুলে সরিয়ে দিয়ে শেষ পাতের পায়েসের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন, এটা চোখে দেখেও বিশ্বাস করা কঠিন।

‘কেন, শরীর খারাপ করল নাকি কুমার সাহেব?’ বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটুকু সামলে নিয়ে শুধোল সোমেশ্বর।

‘না না শরীর খারাপ করবে কেন, আমি ঠিক আছি।’ বলতে বলতে প্লেটের পায়েসটা বেশ কিছুটা বাকি থাকতেই উঠে পড়লেন কুমার সাহেব।

অদ্ভুত ব্যাপার। কী কারণ থাকতে পারে এই আতঙ্কের? তিনজনে আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম, কিন্তু তিনজনের চোখের দৃষ্টিই ফাঁকা। কেউই কিছু আন্দাজ করতে পারিনি এটা পরিষ্কার। এরপর খাওয়াটা যে একেবারেই দায়সারা গোছের ব্যাপার হল সেটা বলাই বাহুল্য। অথচ আজকের এই রাতের পাতটা বেশ ভালোরকম জমাবার কথা ছিল।

.

কলেজে গরমের ছুটি পড়ে যাওয়ার পর ওয়াই এম সি এ-র বিলিয়ার্ড রুমে খাওয়া-দাওয়া সেরে দুপুর দুটোর মধ্যে গিয়ে হাজির হতাম। আড়াইটের মধ্যেই একে একে সব এসে যেত— আড্ডাটা বেশ জমে উঠত, চলত সেই রাত আটটা পর্যন্ত। তার মধ্যে সোমেশ্বর, অশোক আর আমি, এই তিনজনের একটা আলাদা ছোট জগৎ ছিল। তার কারণ তিনজনই এক কলেজের ছাত্র, তিনজনেই খেলাধুলায় একটু-আধটু নাম করেছি, আর তিনজনেই সেই দক্ষিণ কলকাতা থেকে আসি। কুমার সাহেবের সঙ্গে আমাদের মধ্যে প্রথম আলাপ হয় সোমেশ্বরের বিলিয়ার্ড টেবিলে। তার আগে অবশ্য আমরা ওঁকে নামে চিনতাম।

যদিও সেটা এমন কিছু বড় কথা নয়। কারণ কুমার দীপেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরিকে শহর কলকাতার অনেকেই নামে চেনে। বাবু গৌরবের কলকাতায় অধিকাংশ বাঙালি জমিদার যখন বুলবুলির লড়াইয়ে বাজি ধরে, বেড়ালের বিয়েতে লাখ-টাকা খরচা করে কি হাজার টাকার নোট বেঁধে ঘুড়ি উড়িয়ে এই গাঙ্গেয় সমভূমির পুঁজির সঞ্চয় দ্রুত সংক্ষিপ্ত করে আনছেন; তখন ভবিষ্যৎ বংশধরদের সর্বনাশের ছবিটা যে ক’জন সামান্য সংখ্যক ভৌমিক কল্পনা করতে পেরেছিলেন দীপেন্দ্রনারায়ণের পিতামহ দীনেন্দ্রনারায়ণ তাঁদের মধ্যে একজন। ফলে ওই বিরাট সম্পত্তি তিনি দেবত্র করে দিয়েছিলেন, যাতে কোনোদিন আর কোনো বংশধরকে অনাহারে কষ্ট পেতে না হয়, অন্যথায় উচ্ছৃঙ্খল হতে না পারে।

কিন্তু দীপেন্দ্রনারায়ণের শিরায়-ধমনীতে যে রক্তের ধারা বইত তার টান ছিল কিছু বেশি, ফলে দাদুর করে যাওয়া ব্যবস্থার জন্যেই হোক অথবা নিজের শিক্ষা-দীক্ষার জন্যই হোক সেই উষ্ণ স্রোত উচ্ছৃঙ্খলতার খাতে বইতে না পেরে, যে ক’টি রুচিশীল আর সম্ভ্রান্ত বিলাসের ফাঁকফোকর ভেদ করে বেরিয়েছিল সেসব ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর মিলত প্রচুর। বিলিয়ার্ডের টেবিলেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সোমেশ্বর আমাদের ব্রাঞ্চ চ্যাম্পিয়ন হয়েও মোটামুটি তাকে দর্শক সেজে যেতে হয়েছিল। কুমার সাহেবের ‘কিউ’ জাদু লাঠির মতো সবুজ গালচে পাতা টেবিলের উপর বল তিনটেকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করেছিল। হেরে যাবার পর সোমেশ্বর বলেছিল ‘কুমার সাহেব, আপনার কাছে হেরেছি বলে তো লজ্জা নয়, লজ্জা এইটাই যে উইলসন জোনস কি মাইকেল ফেরেরার মতো ভারতবর্ষ অন্তত আরও একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের জন্ম দিয়েছিল, কিন্তু আমরা তাঁকে চিনতে পারলাম না।’

উত্তরে ঘর কাঁপিয়ে প্রাণখোলা হাসি হেসেছিলেন কুমার সাহেব, তারপর সোমেশ্বরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ব্রাভো ইয়ংম্যান।’ মোদ্দা কথাটা কী জানো? সেন্স! যে- কোনো খেলায় একবার যদি তোমার এই সেন্স-টা ডেভেলপ করে যায় তাহলে দেখবে যে-কোনো বড় খেলোয়াড়ের সঙ্গে তোমার পার্থক্য হচ্ছে শুধু প্র্যাকটিসের।’

এইভাবেই কুমার সাহেবের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়, কিন্তু সে পরিচয় হৃদ্যতায় গিয়ে ঠেকেছিল মাত্র মাস-দুয়েকের মধ্যেই। এর জন্যে কাউকে দায়ী করতে গেলে পুরোপুরি দায়ী করতে হয় কুমার সাহেবকে। বয়সের হিসাবে প্রৌঢ় প্রায় ষাটের কোঠা ছুঁই-ছুঁই। কিন্তু সে- বয়স তাঁর শরীরের কোথাও এতটুকু ছাপ ফেলতে পারেনি। টকটকে গৌরবর্ণ, ছ-ফুট মাপের বেতের মতো টানটান শরীরে জীবনীশক্তির অফুরন্ত প্রাচুর্য। আর সেই দুরন্ত জীবনীশক্তির প্রকাশ তাঁর দুটি চোখে। আয়ত, গভীর অথচ উজ্জ্বল দুটি চোখ। কথা বলেন পরিষ্কার উচ্চারণে, সংযত আভিজাত্যের ছাপ রেখে, অথচ হাসিটি একেবারে প্রাণখোলা; সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব।

আলাপ হওয়ার পর একদিন বাড়ি নিয়ে গেলেন। ঘুরে ঘুরে দেখালেন, ‘এইগুলো গ্রিক অ্যাস্টিক— এটা ডায়ানা, এটা ডেভিড, এটা অ্যাপোলো…এইগুলো আমার শিকারিজীবনের স্মৃতি— গৌরবের মাথা, ওই মোষগুলোকে ‘ওয়াটার বাফেলো’ বলে, এটা সম্বরের শিং আর চিতা-বাঘের যে খড়পোরা মূর্তিটা দেখছ ওটাকে মেরেছিলাম হরিদ্বারের কাছে এক জায়গায়… চলো এবার আর্ট গ্যালরিটা দেখিয়ে আনি।’

এ তো গেল গরমের ছুটির কথা। তার তিনমাস বাদেই পুজোর ছুটিতে এলাম রূপনারায়ণ— কুমার সাহেবের আমন্ত্রণে তাঁর বাংলোয়। নদীর পাড় থেকেই ঝাউয়ের সারি উঠে এসেছে বাংলোর বারান্দা অবধি, মাঝখানে নুড়ি-বিছানো কুঞ্জপথ। সেই পথের দুপাশে ফুলের বাগান। চার কামরার ছোটখাটো ছিমছাম বাংলো। ডানদিকে খানিকটা দূরে জেলেপাড়া, একটা বড় খাটাল-ও রয়েছে কোনো সম্পন্ন মহাজনের। গোটা পনেরো-কুড়ি গরু-মোষ। খোলামেলা সামার হাউস গোছের ব্যবস্থা, ঘেরা পাঁচিলের ব্যাপার নেই।

এখানে এসে প্রথম দু’ দিন খাওয়া-ঘুম আর গল্প করেই কেটে গেল। গল্প বলে মানুষকে জমিয়ে রাখার ক্ষমতা আমাদের গৃহস্বামীটির অসাধারণ, আর অফুরন্ত তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি, বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর। তার মধ্যেই মাঝে-মাঝে সকালবেলার দিকটায় একটু কাছাকাছি অঞ্চলটায় ঘুরতে বেরোতাম! কিন্তু তিন দিনের দিন রাতে খাবার টেবিলে আশাতীতভাবে যে ঘটনাটা ঘটে গেল সেটা আমাদের এই বর্তমান জীবনধারার সঙ্গে একেবারেই বেমানান। রীতিমতো ধাক্কা।

রোজকারের মতো সেদিনও বিকেলবেলা সরকার মশাই এসেছিলেন রাতের ‘মেনু’ জানতে। গৃহকর্তারই নির্দেশ। তাই গত দু’দিন ধরে নদীর টাটকা মাছে যে স্বাদটুকু আমাদের জিভে লেগে আছে তারই মাঝে একটু বৈচিত্র আনতে অশোকের ফরমাশ ছিল মুরগির। বলা বাহুল্য দু’দিন আগেও যে কিঞ্চিৎ লোকলজ্জাটুকু আমাদের ছিল সেটা এর মধ্যেই অন্তর্হিত হয়েছে। সরকারমশাই বোধ হয় একটু আমতা আমতা করে একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে অশোক পাকা ভোজনরসিকের মতো বললে, ‘তবে দিশি মুরগি, ব্রয়লার বা লেগহর্ন যেন না হয় একটু দেখবেন।’

কথা শেষ করে অশোক আর দাঁড়াল না। চটি জোড়া পায়ে গলিয়ে বলল ‘চল চল, নদীর পাড়ে সান সেট দেখে আসি…’

আসলে সরকারমশাই-এর পিছনে লাগার জন্য একটু নির্দোষ ডেঁপোমিমাত্র, কিন্তু সেই মুরগি নিয়েই ঘটল অনর্থ—

খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে তিনজনেই এসে বারান্দায় বসলাম, কারও মুখেই কোনো কথা নেই। অন্ধকার বারান্দা— কিছুটা দূরেই রূপনারায়ণ বয়ে চলেছে অস্পষ্ট ছল-ছল আওয়াজ তুলে। কয়েকটা জেলেডিঙি পাড়ের উপর শোয়ানো। পাড়ের উপরেই একটা চায়ের দোকান, দোকান না বলে ঝুপড়িই বলা উচিত, সেখান থেকে কেরোসিনের একটা টিমটিমে আলো দেখা যাচ্ছে। পাশের গোয়াল থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে গরুর গলার ঘণ্টার আওয়াজ— টুং-টাং। পরিবেশটা ভারী শান্ত, সুন্দর, কিন্তু মনটা অস্বস্তিতে ভরে আছে, কোনো কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। একটু দূরে বারান্দার কোণে ইজি-চেয়ারে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে পাইপ টানছেন কুমার সাহেব। ‘বলকান সভরেনি’র মিষ্টি গন্ধ হাওয়া ভারী করে তুলেছে।

নিস্তব্ধ বেশ কয়েকটা মুহূর্ত— কেটে যাওয়ার পর প্রথম কথা বললেন কুমার সাহেব, তা-ও যেন অনেকদূর থেকে ভেসে এল।

‘বুঝতে পারছি তোমাদের খুবই খারাপ লাগছে, অস্বস্তি বোধ করছ, ঠিক এইভাবে তোমাদের ”ডিসটার্ব” করতে আমি একেবারেই চাইনি কিন্তু…’ একটু থামলেন কুমার সাহেব কিন্তু খাবারের ওই প্রিপারেশনটা যেন আমাকে একটা ধাক্কা মারল, আমি কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। আসলে একটা ঘটনা…’ কথার মাঝে চমকে গেলেন তিনি। আবার বেশ কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা। তারপর শুরু করলেন আবার:

‘তোমাদের আজ বলতে কোনো বাধা নেই, তবে এই ঘটনার কথা আর কাউকে বলিনি, প্রয়োজনও হয়নি বলার—

সনটা বোধহয় ১৯৪১—

পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধ তখনও ছড়িয়ে পড়েনি। বন্ধু সতীশচন্দ্রের সঙ্গে বেড়াতে গেছিলাম পূর্ববাংলার বাখরগঞ্জে। সতীশচন্দ্ররা উত্তর শাহাবাজপুরের সম্পন্ন জমিদার। বাংলার দ্বিতীয় স্বদেশি ডাকাতি ওদের বাড়িতেই হয়েছিল। সোনাদানাসুদ্ধু যা মালপত্র স্বদেশি বিপ্লবীরা নিয়ে গিয়েছিল তার মূল্য তখনকার হিসাবেই প্রায় আশি হাজার টাকার মতো দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ অবশ্য এই ডাকাতির নেতা হিসাবে সতীশচন্দ্রের বড় ভগ্নিপতিকে সন্দেহ করেছিল। এই মানুষটি তখন কলকাতার এক বিখ্যাত কলেজের দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু সতীশের বাবা দুর্গাপ্রসাদ-ই পুলিশের সে সন্দেহ উড়িয়ে দেন, উল্টে তাদের এই ব্যাপারে আর কোনোরকম খানাতল্লাশি করতে বারণ করে দেন। পুলিশ নিতান্ত অমূলক সন্দেহ করেছিল এমন মনে হয় না। যা হোক, এই ডাকাতির জের সামলাতে দুর্গাপ্রসাদের যে বিশেষ কষ্ট হয়নি তার প্রমাণ হিসাবে তিনি তার পরের বছরেই পর পর দুটি মেয়ের বিয়ে দিলেন চূড়ান্ত রকমের ধূমধাম করে, গ্রাম খাইয়ে। সতীশ কলকাতার হিন্দু হস্টেলে থেকে পড়াশুনো করত। সেই সূত্রেই তার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ।

কলকাতার বনেদি ঘরের ছেলে বলে নদীমাতৃক পূববাংলা সম্বন্ধে আমার আগ্রহ ছিল যেমন প্রচুর, তেমনি অভিজ্ঞতা ছিল ততই কম। পৌঁছে বুঝলাম, এসে ঠকিনি। মোহানার কাছে পদ্মা-মেঘনার সে রূপ যারা দেখেনি তাদের বলে বোঝাবার মতো ক্ষমতা আমার নেই।

সতীশের বাবার সঙ্গে পরিচয় হল। আমি জীবনে এত ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষ খুব কমই দেখেছি, সেইসঙ্গে— একটা অদ্ভুত প্রশান্ত চেহারা। শহরের শিক্ষা যে অনেকদিন আগেই এ বাড়িতে ঢুকে পড়েছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম গেট পেরিয়ে ঢোকামাত্র। নাটমন্দিরের সংলগ্ন থিয়েটারের স্টেজ— ম্যারাপ বেঁধে তৈরি নয়, রীতিমতো শানবাঁধানো।

সাত-আটটা দিন ঝড়ের মতো কোথা দিয়ে কেটে গেল টেরই পেলাম না। বিকেলবেলা মাঝেমধ্যেই নদীর চরে শিকারে বেরোতাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় শিকার ছিল বালিহাঁস, আর বালিহাঁসের মাংসের কাছে মুরগি কোথায় লাগে? সেই শিকারে বেরিয়েই আরেকটা শিক্ষা পেলাম। বন্দুকের নিশানা নিয়ে আমার একটু-আধটু গর্ব ছিল। আর সেটা যে নেহাত অমূলক ছিল না তার প্রমাণ তোমরা কিছু কিছু আমার বাড়িতেই দেখেছ, কিন্তু সে নিশানা যে সমুদ্রের কাছে ডোবামাত্র সেটা সতীশের সঙ্গে না বেরোলে বুঝতে পারতাম না। ইংরাজিতে ‘স্ন্যাপ-শট’ বলতে ঠিক যে-কথাটা বোঝায় সতীশ ছিল তার সার্থকতম উদাহরণ। ডোবা কিংবা জলার মধ্যে থেকে কিংবা ঝোপের মাথায় হাঁস-বক যা-হোক একটা কিছু উড়লেই হল— যে-কোনো দিকে হোক, যতটুকু অল্প সময়ের জন্য হোক বন্দুকের আওতার মধ্যে থাকলে সতীশ আর নিশানা করত না। কোমরের কাছে ধরা বন্দুকটা মুহূর্তের মধ্যে সেদিকে ঘুরিয়ে ট্রিগার টিপত, একটা ধাতব আওয়াজ, কিছু ধোঁয়া, একঝলক আগুন আর সেইসঙ্গে শিকার লুটিয়ে পড়ত মাটিতে। এই ধরনের স্ন্যাপ শুটিং-এর ব্যাপারটা ঠিক অভ্যাস করে আয়ত্ত করা যায় না, ওটা জন্মগত।

শিকার করে একদিন বাড়ি ফিরছি দুজনে; সতীশ বলল, ‘এ ক’টা দিন তো শুধু শিকার করেই কাটালে, দেখার জিনিস তো কিছুই দেখলে না, চলো, কাল এক জায়গায় নিয়ে যাব…’

—’কোথায়’?

—’রাজা লক্ষ্মণমাণিক্যের প্রাসাদে।

—’রাজা লক্ষ্মণমাণিক্য, মানে সেই বারো ভুইঞার লক্ষ্মণমাণিক্য, সে তো ষোড়শ শতাব্দীর ব্যাপার।’

—’হ্যাঁ, এখন অবশ্য নামেই প্রাসাদ, আসলে একটা ভাঙা-চোরা প্রকাণ্ড পোড়োবাড়ি। বংশধররা অন্য জায়গায় থাকেন। কিন্তু তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবার কারণ পোড়োবাড়ি দেখাতে নয়, ‘সাজাকুঠরি’ দেখাতে।

—’সাজা-কুঠরি! মানে?’

—’মধ্যযুগীয় বাংলার অধিকাংশ জমিদাররাই যে দুর্দান্ত প্রকৃতির ছিলেন একথাটা তোমাকে নিশ্চয়ই বলে বোঝাবার দরকার নেই, এমনকী তারা ডাকাতিও করতেন বেনামে। আর বারো ভুইঁঞাদের যে ছিপ নৌকার সারি পদ্মা-মেঘনা-ভৈরবের বুকে দুরন্ত গতিতে টহল মারত সে শুধু সীমান্ত পাহারা দেবার জন্য নয়। তাছাড়া তখন চরের বুকে, গঞ্জের ধারে যে-সব প্রজারা বাস করত তাদের মধ্যে অনেকে জমিদারের লেঠেলকে রেয়াত করত না। খাজনা চাইতে এলে উত্তর দিত লাঠি-সড়কির মুখে। তাই এতসব দিক বজায় রেখে জমিদারি টেঁকাবার জন্য তৈরি করা হয়েছিল ওই ‘সাজা-কুঠরি’, আর সেই কুঠরিতে লক্ষ্মণমাণিক্য আমদানি করেছিলেন বিচিত্র সব শাস্তি দেওয়ার প্রথাপদ্ধতির। তার মধ্যে বাঁশ-ডলা থেকে শুরু করে ইংরাজি ‘এক্স’ অক্ষরের মতো দুটো আড়াআড়ি কাঠে অপরাধীকে বেঁধে চাবুক মারার ব্যবস্থা তো ছিলই, কিন্তু এগুলো নিতান্তই সাবেকি। আশ্চর্য হচ্ছে ‘লৌহভীম।’

—’লৌহভীম মানে সেই মহাভারতের লৌহভীম, যেটা কিনা ধৃতরাষ্ট্র চূর্ণ করেছিল।’

—’না বন্ধু, এ ভীম একেবারেই ভারতীয় নয়, খাস পর্তুগীজ।’

‘পর্তুগীজ!’ বেশ কিছুটা অবাক হলাম আমি, ‘পর্তুগীজ ভীম মানে?’

উত্তরে মৃদু হাসল সতীশ, ‘লক্ষ্মণমাণিক্য ছিলেন ভুলুয়ার রাজা আর তখন ভুলুয়ায় পর্তুগীজদের অবাধ যাতায়াত! সুপুরি, মশলা এইসব কিনে নিয়ে গিয়ে ব্যবসা করত তারা। হুগলি আর সপ্তগ্রামে ছিল তাদের মূল কুঠি। পরে শাজাহান তার সেনাপতি কাসেম খাঁ-কে পাঠিয়ে সেটি ভেঙে দেন। কিন্তু তার আগে এই পর্তুগীজ বণিকদের সঙ্গে লক্ষ্মণমাণিক্যের লেনদেন ছিল বলেই মনে হয়। তাদের কাছ থেকেই ওই লৌহ ভীম জোগাড় করেন তিনি। যন্ত্রটার আসল নাম ‘আয়রন ভার্জিন’, বাংলায় ‘লৌহ কুমারী’ বললেই বোধ হয় ঠিক হয়, কিন্তু লক্ষ্মণমাণিক্যের যন্ত্রটায় মেয়ের আদলের চেয়ে পুরুষের আদলটাই বেশি, তাই ওই নাম। কিন্তু আদলটা বড় কথা নয়…বলতে বলতে থেমে গেল সতীশ।

ততক্ষণে আমরা প্রায় বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছি; সূর্য অনেকক্ষণ ডুবে গেলেও সন্ধের অন্ধকারটা তখনও একটু ফিকে হয়ে আছে। মাথার উপর দিয়ে একটা ছায়া দ্রুত উড়ে যাচ্ছিল, চকিতে সেদিকে বন্দুক তুলেই সতীশ গুলি চালাল। নিস্তব্ধ মাঠের উপর গুলির আওয়াজটা প্রচণ্ড শোনাল, আর উড়ে যাওয়া ছায়া মূর্তিটা আকাশে গোটা দুই চক্কর খেয়ে ছিটকে এসে পড়ল খানিকটা দূরের মাটির উপর। অসাধারণ টিপ!

‘কী মারলে ওটা!’ জিজ্ঞাসা করলাম।

‘জানি না, চলো গিয়ে দেখি, টিয়াগোছের কোনো কিছু হবে বোধহয়! আজ দুটো শট মিস করেছিলাম, তাই একটু প্র্যাকটিস করে নিলাম। মন্দ হয়নি, কী বলো?’

এগিয়ে গিয়ে দেখলাম টিয়া নয়, একটা পেঁচা। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে আছে। গুলিটা ঠিক পেটের কাছে লেগেছে।

‘খেটে-খুটে একটা হাত বাগিয়েছ বটে।’ না বলে আর পারলাম না, ‘কিন্তু তাই দিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা পেঁচা…’

হঠাৎ একটা তীক্ষ্ন আওয়াজে মাথা তুললাম। আমাদের মাথার উপরে আরেকটা ছায়া চক্কর মারছে। সতীশ আবার বন্দুক তুলল বটে কিন্তু তার আগেই পাখিটা বিপদ বুঝে পালিয়েছে। ‘জোড়ার মদ্দাটা’, বলল সতীশ।

ততক্ষণে বাড়ির সদরে আলো হাতে লোকজন বেরিয়ে এসেছে গুলির আওয়াজ পেয়ে। দূর থেকে আমরা সাড়া দিলাম।

সেদিন ঘুমোবার আগে পর্যন্ত লক্ষ্মণমাণিক্যের ইতিহাস শুনে কাটল।

.

পরদিন বিকেলের জলযোগ সেরে বেরোলাম প্রাসাদ দেখতে। নেহাত কম দূর নয়, হাঁটাপথে প্রায় ঘণ্টা-খানেকের পথ। অবশ্য সতীশের দোষ নেই, ও গাড়ির ব্যবস্থা করেছিল, আমিই বারণ করেছি। এখানে না হাঁটলে আর হাঁটব কোথায়।

প্রাসাদের কাছে যখন এসে পৌঁছলাম তখন সূর্য প্রায় ডুবে এসেছে। এক সময়ের প্রকাণ্ড চক-জিলানো বাড়ির কঙ্কালটাই শুধু পড়ে রয়েছে। বিরাট, বিরাট ঘর, থাম, দালান মিলিয়ে সে এক এলাহি ব্যাপার। তবে পোড়োবাড়ি একটু বেশি ফাঁকা-ফাঁকা আর প্রকাণ্ড মনে হয়। লোকজন থাকলে অতটা মনে হয় না। লক্ষ্মণমাণিক্যের রাজধানী এখানে ছিল না, তবে এই প্রাসাদে তিনি প্রায়ই এসে থাকতেন।

এখন মাঝে মধ্যে দু-চার জন লোক দেখতে আসে। সেই সুবাদে বাড়িটা সাপ-খোপের আড্ডা হয়ে পড়েনি।

‘যজ্ঞেশ্বর, যা তো ক’টা মশাল জোগাড় করে নিয়ে আয় দেখি।’ সঙ্গের লোকটিকে বলল সতীশ।

‘দেখছি বাবু।’ সে চলে গেল।

‘কিন্তু এখানে মশালের কী দরকার, টর্চ তো সঙ্গেই আছে।’ বললাম আমি।

‘আরে মশাল মানে গাছের ডালের মাথায় জড়ানো তেল ভেজানো ন্যাকড়া। তার দরকার আছে, আনলেই বুঝবে।’

আমার হাতে বন্দুকটা দিয়ে সামনের একটা গাছ থেকে দুটো হাত দুয়েক করে লম্বা ডাল ভেঙে নিল সতীশ। আজ একটাই বন্দুক সঙ্গে করে এনেছিলাম, রোজ বিকেলের অভ্যাস।

‘নাও এটা ধরো, বলা তো যায় না সাপ-খোপের ব্যাপার,’ আমার হাতে একটা ডাল দিয়ে বলল সতীশ।

যজ্ঞেশ্বর মশাল নিয়ে হাজির হতে বেশি দেরি করেনি। প্রাসাদে যখন ঢুকলাম সন্ধেটা তখন উতরে গেছে। প্রাসাদ দেখার কিছু নেই। কয়েকটা খিলান, দেউড়ি পার হয়ে শেষে একটা সিঁড়ির তলায় এসে থামল সতীশ। তারপর যজ্ঞেশ্বরের হাত থেকে মশাল নিয়ে দেশলাই মেরে জ্বালাল। প্রাসাদের ভিতরে তখন অন্ধকার, টর্চ জ্বেলেই একরকম পুরো পথটা চলতে হচ্ছিল। তার মধ্যে মশালের আলো জ্বলে উঠতে দেখা গেল একটা ভারী কাঠের তৈরি দরজা, দরজার সর্বাঙ্গে লোহার গজাল পোঁতা।

শিকল খুলে জোরে ঠেলা দিল সতীশ। ক্যাঁচ করে ভারী দরজাটা হাট হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভ্যাপসা পুরনো লোহার গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা মারল।

সিঁড়ির নীচে চোরকুঠরি। এই তাহলে ‘সাজা ঘর’।

মশালটাকে প্রথমে সেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল সতীশ, তারপর আস্তে আস্তে উপর থেকে নীচে অবধি নামিয়ে আনল। এতক্ষণে মশালের দরকারটা বুঝলাম। ঘরে কতটা অক্সিজেন আছে সেটা দেখে নেওয়া অবশ্য ঠিকই। কতদিন যে এ ঘর এভাবে বন্ধ পড়ে আছে কে জানে!

সতীশকে অনুসরণ করে প্রায় গোটা দশেক সিঁড়ি নীচে নেমে তারপর ঘরটায় ঢুকলাম। প্রকাণ্ড ঘর, ঠান্ডা আর ভ্যাপসা গন্ধে-ভরা, সেটা বোধহয় মাটির নীচের ঘর বলেই। ঘরের এককোণে মশালটাকে গুঁজে দিয়ে সতীশ এগিয়ে এল, ‘এটাই সেই ”সাজা-কুঠরি”, ষোড়শ শতকের রাজা লক্ষ্মণমাণিক্যের শাস্তি দেওয়ার ঘর। লোকের ধারণা এ ঘর অভিশপ্ত। অবশ্য নেহাত উড়িয়ে দেওয়ার মতো ধারণা নয় কারণ বহু পাপ জমা হয়ে আছে এই ঘরে। কিন্তু সেকথা নয়, তোমাকে যেটা দেখাতে এনেছি তা হল এ ঘরের অভিনবত্ব। ওটা হল বাঁশডলার ব্যবস্থা— বুকে কি পিঠে বাঁশ দিয়ে জোয়ান লাঠিয়ালরা দু-তিনজনে মিলে ডলা দিত। বাঁশগুলো এখনও লোহার চেয়ে শক্ত রযেছে, তবে এ হল সাবেকি ব্যবস্থা। এদিকে ”ঐ ক্রুশ-কাঠ।” লোহাকাঠ দিয়ে তৈরি, কিন্তু এসব নয়, আসল ব্যাপারটা আছে ওইখানে, সেই লৌহভীম!’

প্রকাণ্ড ঘরটাকে মশাল বা টর্চের আলো কোনোটাই পুরোপুরি আলোকিত করতে পারেনি, তবে তার মধ্যেই চারদিক জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাঠ আর লোহার ফ্রেম, কপিকল, দড়ি, বাঁশ, সড়কি, বিভিন্ন সব যন্ত্র। সবগুলোই কেমন নিষ্ঠুর, স্থূল কলকব্জা দিয়ে তৈরি। লোহার জিনিসগুলোয় তিনশো বছরের মরচে পড়েছে, ফলে সেগুলোকে আরও রুক্ষ, আরও ভয়ংকর মনে হয়। কাল রাতে সতীশের কাছে শোনা গল্পগুলোর কথা মনে পড়ছিল আর মনে হচ্ছিল সত্যিই যেন মধ্যযুগে ফিরে গেছি। একটা বিশ্রী গা ছমছমে, ভারী হয়ে-আসা পরিবেশ!

টর্চের আলোটা সতীশের কথা অনুযায়ী বাঁ-দিকের দেওয়ালে ফেললাম। সেখানে দেওয়াল জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আট ফুট উঁচু একটা প্রকাণ্ড লোহার তৈরি মানুষ। তবে নামেই মানুষ, মুখ-চোখ-নাকে একটা পুরুষের আদল আছে মাত্র, নিখুঁত কাজ একেবারেই নয়। তার পেটের কাছে একটা প্রকাণ্ড আংটা লাগানো আর সেই আংটা জড়িয়ে একগাছা মোটা পাটের দড়ি কিছুটা উঁচুতে উঠে ছাদ থেকে ঝোলানো কপিকলের মধ্যে দিয়ে পাক খেয়ে নেমে এসেছে জমির কাছাকাছি। দেখেই বোঝা যায়, অত্যন্ত ভারী একটা মূর্তি, নিরেট লোহার কিন্তু এ বস্তু দিয়ে কোন কাজ সে আমার মাথায় ঢুকল না। সতীশ বোধহয় আমার ধারণাটা বুঝেছিল, তাই বলল, ‘মূর্তিটার স্বরূপ বোধহয় ঠিক বুঝতে পারছ না, দাঁড়াও এখনি তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি। যজ্ঞেশ্বর, দড়িটা ধরে জোরে টান তো।

যজ্ঞেশ্বর মানুষটা শক্তি ধরে। সে দড়িটা ধরে টানতে এবার একটু অবাক হলাম। মূর্তিটা নিরেট নয়, ভেতরে ফাঁপা। দুটো ডালার মতো কব্জা দিয়ে আটকানো। দড়ির টানে ট্রাঙ্কের মতো তার সামনের পাল্লাটা ফাঁক হয়ে গেল। ‘এবার এদিকে এসো, আসল মজাটা দেখবে’, সতীশ ততক্ষণে ফাঁক করা ডালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, আমাকে সেখানেই ডাকল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে যে ব্যাপারটা দেখলাম সেটা মোটেই মজার ব্যাপার নয়। সামনের ডালাটার ভেতর দিকে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত প্রায় গোটা পঞ্চাশ বিরাট বিরাট লোহার গজাল বেরিয়ে এসেছে। ‘এইবার বুঝলে তো ব্যাপারখানা,’ সতীশ যেন বেশ মজা পেল, ‘এই নীচের ডালাটার মধ্যে মানুষটাকে হাত-পা বেঁধে ঢুকিয়ে ওই কপিকলের মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে দড়িটা আলগা দিতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে গজালগুলো তার সর্বাঙ্গে ফুটতে থাকে, প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপর ক্রমে জোর বাড়ানো হয়, শেষপর্যন্ত তাতেও ফল না হলে দড়িটা ছেড়েই দেওয়া হয়, ব্যস…গজালগুলো হাড় পর্যন্ত ফুটো করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরে একসময় ভীমের গহ্বর থেকে লাশটাকে বের করে ভাসিয়ে দিলেই হল। দাঁড়াও তোমাকে ব্যাপারটা হাতে কলমে বুঝিয়ে দিই, যজ্ঞেশ্বর দড়িটা আরও টান তো, আমি ঢুকব…’

না না, কোনো দরকার নেই ঢোকার। আমি বেশ বুঝতে পারছি ব্যাপারটা, যন্ত্রটা আমাকে কেমন যেন সম্মোহিত করে ফেলেছিল, সেই সম্মোহন কাটিয়ে উঠেই তীব্র আপত্তি জানালাম আমি। আমার বলার ভঙ্গিতে শুধু সতীশ নয়, যজ্ঞেশ্বরও হেসে উঠল।

‘বাবু, ভয় পেয়েছেন বুঝি, কিচ্ছু ভয় নেই…ছোটবাবু ভিতরে ঢুকবেন না।’

কিন্তু সতীশ কি আর সে মানা শোনে, হাসতে হাসতেই সে ভীমের খোলে ঢুকে পড়ল, ‘নে যজ্ঞেশ্বর, এবার দড়ি ছাড়, একটু আস্তে আস্তে…’

যজ্ঞেশ্বরের শক্ত মুঠোয় ধরা দড়িটা একটু একটু করে এগোতে লাগল আর পাল্লাটাও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসতে লাগল— ক্যাঁচ, ক্যাঁচ করে মরচে ধার কব্জাটায় আওয়াজ উঠছিল কেবল।

আমার ঘোরটা বোধহয় তখনও কাটেনি, কাটল সতীশের কথায়, ‘এই দ্যাখো, এবার গজালগুলো প্রায় আমার শরীর ছুঁয়েছে, বড় জোর ইঞ্চি দুয়েক বাকি, এইবার জেরা করা শুরু হয় আর…’

আর কী কী কথা সতীশ বলছিল সেগুলো আমার কানে ঢুকছিল না, কারণ আমার চোখের দৃষ্টি তখন যজ্ঞেশ্বরের পিছনে দুটো জ্বলন্ত কয়লার মতো গোল বস্তুর উপর গিয়ে পড়েছে। ও দুটো কী! চোখ, কিন্তু কীসের চোখ? বেড়ালের, না বেড়ালের চোখ তো ওরকম হয় না, তবে কী ও দুটো…

সন্দেহটার কথা আর মুখ ফুটে বেরোতে পারল না, তার আগেই তীক্ষ্ন একটা চিৎকার করে একটা ধূসর রংয়ের শরীর ছিটকে এসে পড়ল যজ্ঞেশ্বরের মুখের উপর আর সঙ্গে সঙ্গে নখ আর ঠোঁটের আঘাতে খুবলে নিল একটা চোখ।

মা গো! বলে চিৎকার করে দু হাত দিয়ে রক্তাক্ত চোখটাকে চেপে ধরল যজ্ঞেশ্বর আর তার ফলে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা বুঝেই আমি প্রচণ্ড আতঙ্কে লাফ দিলাম দড়িটাকে লক্ষ্য করে।

কিন্তু আমার সাধ্য কী সে দড়ি ধরে! কপিকলের উপর দিয়ে একঝলক বিদ্যুতের মতো দড়িটা ছিটকে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল লৌহভীম।

একটা চিৎকার করার সুযোগ পর্যন্ত পায়নি সতীশ। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, তারপর চমক ভাঙল আরেকটা বিশ্রী আওয়াজে।

তাকিয়ে দেখি লোহার মূর্তিটার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই ধূসর রং-এর মদ্দা পেঁচাটা। তার চোখ দুটো তখনও জ্বলছে আগুনের গোলার মতো।

বন্দুকটা তুলে নিয়েই গুলি চালালাম। নিশানা ভুল হবার কথা নয়, হলও না। বুকে গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ল পেঁচাটা, তারপর অনাবশ্যক হলেও আরেকটা গুলি করলাম বন্দুকটাকে একেবারে শয়তানটার গায়ে ঠেকিয়ে। কয়েকটা মাংসের ডেলা আর রক্ত ছিটকে গেল ঘরটার চারিদিকে।

একটু থামলেন কুমার সাহেব, সেই আমার শেষ পাখি শিকার, তারপর থেকে পাখির মাংসও আর কোনোদিন খেতে পারিনি, প্লেটের উপর দেখলেই মনে পড়ে যায় দুটো লাল আগুনের মতো জ্বলন্ত চোখের কথা। ওই চোখ দুটোয় যে ভয়ংকর প্রতিহিংসা আমি দেখেছিলাম সেটা এই চল্লিশ বছরেও ভুলতে পারিনি, হয়তো সারা-জীবনেও পারব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *