নিশিদুপুর

নিশিদুপুর

মাথার ওপরে ছাতার মতো বকুলগাছ। তার ওপরে নিচু সূর্য। তার ওপরে আইসক্রিম-নীল আকাশ। ঘুড়ি উড়ছে একটা-দুটো। ঘয়লা, বামনা। এই নির্বান্ধব নির্জনে কোথায় কে ঘুড়ি ওড়ায় কে জানে! কোনও স্কুল-ছুট বালক! কোনও কর্মহীন যুবক? তারও উঁচুতে কয়েকটি চিল। আকাশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক যেন মাছের সঙ্গে জলের। আকাশ-জলে সাঁতরায় চিল। মাঝেমধ্যে যখন নেমে আসে তীব্র হ্রেষায় চমকে ওঠে ইঁটকাঠ, গাছপালা। নির্বিকার নীল থেকে খসে পড়ে কালো ফুটকি, ব্রাউন ফুটকি, বড় হতে থাকে ক্রমশ। শিকার? নাঃ। শিকার নেই, স্বার্থ নেই। শুধু খেলা। দেখতে বেশ লাগে। একটা প্রশান্তি আসতে থাকে।

জিনার এখন বায়ুভূত নিরালম্ব লক্ষ্যহীন অবস্থা। সে নাগচৌধুরীতেও নেই, দে সরকারেও নেই। দমদমে যায়নি, ডাফ স্ট্রিটে সে ফিরেও ফেরে না। শরীরের মধ্যে মন নেই। আলাদা হয়ে ঘুরে বেড়ায় মনটা। ‘রোচনা’ সম্পর্কে সে মন স্থির করে নিতে চায়। ভাল লাগবে কি না। এটাই এখন তার একমাত্র চাকরির সুযোগ। ইতিমধ্যে দায়হীন আসা-যাওয়া চলছেই। প্রধান আকর্ষণ কুটুস। কেননা কুটুসেরও প্রধান আকর্ষণ জিয়া।

অন্য সবাই জিনাকে জিনাদিদি বলে। এখানে দিদি বা দিদা ছাড়া আর কিছু বলতে শেখানো হয় না। কুটুস অতটা বলে না, বলে ‘জিয়া’। তার মুখে আধো আধো ‘জিয়া’ ডাক শোনবার জন্যেই সব্বাই তাকে বড্ডই বিরক্ত করে। দিদিরা বলে—ও কুটুস, ওই দেখ দূরে—কে আসছে রে?

কুটুস ভুরু কুঁচকে তাকায়, মুঠো গোল করে দূরবিন বানায়। দেখেটেখে বলে, ‘জিয়া’।

—লাল ছাপ জামাটা তোকে কে দিয়েছিল রে? —‘জিয়া’।

আবার চোখাচোখি। হাসি।

—আজকে কার সঙ্গে লুডো খেলবি রে?

কুটুস বুঝে যায় তাকে নিয়ে মজা করা হচ্ছে, সে এদিক ওদিক চায়, জবাব দেয় না।

বকুলতলায় বসে বসে আকাশ দেখছিল সবাই। বিকেলের নরম নীল আকাশ। কুটুস জিজ্ঞেস করল, জিয়া আঁকাশের মধ্যেও পিঁপড়ে থাঁকে?

—থাকেই তো। দেখিস না গর্জন করে ছুটে যায়।

—কে? সে তো পেলেন?

—ওরাই আকাশের পিঁপড়ে।

এখানকার নিয়মমতো পাঁচ বছর বয়স থেকে বাচ্চা নেওয়া হয়। কুটুসকে তার মায়ের নির্বন্ধে ও মুকুটের সালিসিতে আরও ছোট বয়সে নেওয়া হয়েছিল। তার মা তাকে অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিটের ‘বাবু’র ভাড়া করা ঘর থেকে সরাতে ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কুটুসের জিবের আড় কিছুতেই ভাঙছে না। সে যেখানে-সেখানে চন্দ্রবিন্দু লাগায়। যুক্তাক্ষর তো উচ্চারণ করতে পারেই না। এটা ঋত্বিকদের ভাবাচ্ছে একটু। অন্য অনেক ছেলেই যুক্তাক্ষর ভাল করে উচ্চারণ করতে পারে না। কেননা তারা চারপাশে ওইরকম ভাঙা উচ্চারণই শুনে শুনে বড় হয়েছে। কিন্তু কুটুসেরটা স্পষ্ট আধো আধো। এই ব্যাপারটাই একটু ভাবাচ্ছে সবাইকে। চেহারাতেও সে ছোট্ট। কিন্তু আজকাল জিনা ওর মধ্যে পরিষ্কার কল্যাণবাবুর আদল দেখতে পায়। পুরোটা নয়। ঠোঁটের কাছটা। চোখের আকার, হাসির ধরনটা, কানগুলো ওর মায়ের মতো। কল্যাণবাবুর দুই ছেলে মোটামুটি লম্বাচওড়া হলেও উনি নিজে একটু ছোটখাটোই। ছোটখাটো সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ। কুটুস বোধহয় তার দাদুর ধরনটাই পেয়েছে। নিখিলের রং ছাড়া আর কোনও চিহ্ন নেই তার শরীরে। নিখিলের মতো চৌকোটে ভরাট মুখ, চেরা চেরা নিষ্ঠুর চোখ, পাতলা নির্দয় ঠোঁট কুটুসের হলে তার স্নেহের ধারা কোন দিকে বইত বলা শক্ত। হয়নি যে এটা রক্ষা। কল্যাণবাবু এই শিশুটিকে তাঁর অর্ধেক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে যেতে চাইছেন। কিন্তু জিনার ওপর তিনি নির্ভর করছেন। জিনা ওর ভার নেবে, ও যেখানেই থাকুক। স্পষ্ট করে না বললেও এমন ইচ্ছে তিনি হাবেভাবে প্রকাশ করছেন।

জিনা এ বিষয়ে এখনও কিছু বলেনি। এখনও পর্যন্ত সে দমদমের বাড়িতেও কিচ্ছু বলেনি। ও বাড়িতে তার সবচেয়ে কাছের লোক জেঠু। পিসতুতো দিদি রুমার সঙ্গেও তার খুব মিলত। কিন্তু সে তো এখন মিনেসোটায়। মা, বাবা, দিদি এদের কাউকেই কথাগুলো বলবার সাহস সে সঞ্চয় করতে পারছে না। অথচ কাউকে না-কাউকে শিগগিরই তাকে তো বলতেই হবে। ‘তোমরা যার সঙ্গে আহ্লাদ করে আমার বিয়ে দিয়েছিলে সে লোকটা দুশ্চরিত্র, ভাল করে জানবার চেষ্টা করনি। চাকরি, বাড়ি আর চেহারা এই তিনেই ভুলেছিলে। ওকে আমি ত্যাগ করেছি।’—এমন কিছু কথা নয়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই জাতীয় কথাই তো অনেক মেয়েকেই বলতে হয়। কিন্তু সে সহজে বলতে পারছে না, রাগে অপমানে দুঃখে গা জ্বলে যাচ্ছে তার। আর এতগুলো বছর তো সে-ও নিশ্চিন্ত আহ্লাদে কাটিয়েছে। যেসব পারিবারিক সংকট এসেছে তার মুখ্যত মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার সুবাদে উতরে গেছে সেসব। দমদম জানতেই পারেনি। এত তরল, অগভীর স্বভাবের মেয়ে সে যে সেসব কোনও দাগও রেখে যায়নি তার মনে। কোনও কিছু নিয়ে দুঃখ পেতে, প্রশ্ন করতেই যেন জানত না সে। ভেবে দেখতে গেলে নিখিল তো খুব পছন্দ করার মতো মানুষ ছিল না! রুক্ষ, রূঢ়, স্বার্থপর, কটুভাষী, অতিরিক্ত দাবি সব সময়ে। অন্য কোনও মেয়ে হলে হাজারবার নালিশ করত। প্রতিবাদ করত। সে তো করেনি! কেন করেনি! করলে হয়তো এই বিয়ের মধ্যেকার ফাঁকিটা আরও তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে যেত। কোনওদিন যার সম্পর্কে অভিযোগ করেনি, তূরীয় আহ্লাদ দেখিয়েছে, আজ তার সম্পর্কে কুৎসিত নালিশ নিয়ে হাজির হলে গোটা দমদমের বাড়িটাই কি শকে হার্ট-ফেইল করবে না?

তাই এখনও ডাফ স্ট্রিটেই ফিরছে সে। ডাফ স্ট্রিট থেকেই যাতায়াত। এ বাড়িটা জানে তার অপমানের কাহিনী। অপমানের কালি এ বাড়ির গায়েও লেগেছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তারা এক গোত্রের। এখানে কোনও কৈফিয়ত নেই, উৎকণ্ঠা আছে, আশ্রয় আছে। রোজ কল্যাণবাবুকে কথা দিয়ে বেরোতে হয় সে কোনও হঠকারিতা করবে না। বাড়িতে ফিরে কাউকে না-কাউকে দিয়ে খবর পাঠাতে হয় সে এসেছে। বিতৃষ্ণাটা এই বাড়ি সম্পর্কে আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। যদিও একেক সময়ে প্রচণ্ড একটা ক্ষোভ তাকে দিশেহারা করে দেয়। যতক্ষণ ‘রোচনা’য় থাকে সব ভুলে থাকে। যে মুহূর্তে বাড়িতে পা দেয় হুড়মুড় করে ফিরে আসতে থাকে সব। একেকটা সিঁড়ি পার হয় আর ধাপে ধাপে চড়তে থাকে ক্ষোভের মাত্রা। সামনে যাকে পায় তার ওপরই প্রবল ঘৃণা আর রাগ হতে থাকে। একমাত্র মেয়েদুটি ছাড়া।

আজও মল্লিকা জানলায় চোখ পেতে ছিল। ডলি নীচে দরজা খুলে দিতেই ওপর থেকে সরে গেল তার উৎকণ্ঠিত ভিতু ভিতু মুখটা। কেমন অপরাধী অপরাধী। মল্লিকার এই ভাব কেমন একটা অস্বস্তি জাগায় তার মনে। আর কেউ তো এমন করে না! কল্যাণবাবু প্রথম দিনটি থেকেই দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন—তিনি নিজের ছেলেটিকে বিন্দুমাত্র চিনতেন না। ছেলেকে অপথ-কুপথ থেকে ফেরাবার জন্যে যারা বিয়েকেই একমাত্র ওষুধ মনে করে এবং একটি নির্দোষ মেয়ের সর্বনাশ করে তিনি সে দলের নন। তিনি এখনও মাথা উঁচু করেই থাকেন। দাদা জীবনে কখনও কারও সাতে-পাঁচে থাকেন না। এখনও তাঁর ভূমিকা নিষ্ক্রিয় দর্শকের। জিনা এখন বোঝে মানুষটি কাপুরুষ গোত্রের। ইদানীং তিনি ক্লাবে আড্ডার সময়টা আরও একটু বাড়িয়ে দিয়েছেন, যাতে জিনার মুখোমুখি হতে না হয়। কিন্তু মল্লিকা যেন এ বাড়ির সন্ত্রস্ত বিবেক। পরিবারের হয়ে জিনার প্রতি অবিচারের সমস্ত বোঝা যেন সে তার একলার কাঁধে তুলে নিয়েছে।

ওপরে এসে জিনা আগে হাত-মুখ ধুল। যতক্ষণ ‘রোচনা’য় থাকে তার গায়ে লেগে থাকে খেলাধুলোর ধুলো। বাইরে বেরোবামাত্র সেগুলো হয়ে যায় বাস-লরি-অটোর কালিঝুলি, দূষণ, নোংরা, ঘষে ঘষে ধুয়ে ধুয়েও যায় না সেসব। এইসময়ে মেয়েরা কোনও না কোনও কোচিং-এ যায়। সে একটু চেঁচিয়ে ডলিকে ডাকল, বাবাকে যেন তার আসার খবরটা দিয়ে আসে।

তারপরে অনেকদিন পরে ডাকল, দিদিভাই!

নিজের ঘর থেকে শশব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এল মল্লিকা। বলল, চা করি? না কফি?

—চা দাও। আজ দুবার কফি খাওয়া হয়ে গেছে।

—আর কী দেব? চিঁড়ে ভেজে দেব? না গরম শিঙাড়া আনিয়ে দেব মদনের দোকান থেকে?

—কিছু না। তুমি বসো।

আজকে কি জিনার মেজাজ কোনও কারণে ভাল আছে?

মল্লিকা চা নিয়ে এসে ভয়ে ভয়ে বসল।

দু-এক চুমুক চা খেয়ে জিনা বলল, দু-এক সপ্তাহ পরেই আমি ‘রোচনা’য় চলে যাব ভাবছি।

—কেন?—মুহূর্তে মুখ শুকিয়ে গেল মল্লিকার।

—কতদিন আর তোমাদের ওপর এভাবে থাকব?

—আমাদের ওপর আবার কী? তুই আছিস তোর নিজের জায়গায়। বাবা বোধহয় উকিলের সঙ্গে পরামর্শ শুরু করে দিয়েছেন। ও বাড়ি তোর। টাকাপয়সা সব কিছুরই…

—তা হয় না দিদিভাই। বাবা দিলেই যা আমার নয় তা আমি নিতে পারি না।

—কেন নয় কেন? শ্বশুরবাড়িতে কি মেয়েদের কোনও অধিকার নেই? যে সম্পত্তি স্বামীর প্রাপ্য, তা কি স্ত্রীরও হয় না?

—পাগলামো করো না দিদিভাই। স্বামীটামি বলো না।

—তুই-ই পাগলামি করছিস জিনা, কাগজে-কলমে তুই ওর স্ত্রী-ই।

—কাগজে-কলমে যাতে সেটা না থাকে আর তার ব্যবস্থা করছি।

—কর। কিন্তু একবার যখন বিয়ে হয়েছে তোর কিছু অধিকারও তো আছে। তা ছাড়া অত সহজে ও তোকে ডিভোর্স দেবে না জিনা। তোকে মামলা চালাতে হবে।

—চালাব।

—তুই খালি নিজের কথাই ভাবছিস। আমাদের কথা…

—তোমরা আমরা কথা ভেবেছিলে?

মল্লিকার মুখ শুকিয়ে গেছে। সে টেবিলের দিকে শূন্য চোখে চেয়ে রইল।

জিনা বলল, দিদিভাই, আই ডিডনট মিন ইট। তোমার কী দোষ? বরং তোমার সঙ্গেই কত দিনরাত কত আনন্দে কাটিয়েছি। মনের জ্বালায় এসব বলে ফেলি। কিছু মনে করো না।

মল্লিকা সজল গলায় বলল, আমার কথাটা একটু ভাব জিনা। এখানে থাক। এই তো আমাদের এ দিকে থাকবি। না হলে ও যে কী করবে আমার ভাবতেও হৃৎকম্প হয়।

—আশ্চর্য তো! কী করবে ও? মাঝের দরজাটা বন্ধ করে রাখবে। ও দিকে ও যা খুশি করুক না। দয়া করে খাবারটাবার পাঠাতে যেয়ো না। বনমালা এসে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বনমালাকে মানতে পারছ না জানি। তোমার সেন্টিমেন্ট আমি বুঝতে পারছি দিদিভাই। কিন্তু আমি বলছি দিদিভাই মেনে নাও। ওকে রিহ্যাবিলিটেট করতে সাহায্য করো। কোথাও না-কোথাও এই অন্যায়-শৃঙ্খলটাকে ভাঙা দরকার।

—তুই বড্ড ছেলেমানুষ জিনা। বনমালাকে ও কোনওদিনই বিয়ে করবে না।

—সে ক্ষেত্রে ওর চাকরি যাবে। বাবাও ওকে বার করে দেবেন, যদি আর বেয়াদবি করে। আর কাউকে যাতে বিয়ে করতে না পারে তার ব্যবস্থা আমি করব।

—ও আর কাউকে বিয়েও করবে না।

—ঠিক আছে। তো থাক—এইভাবেই একদিকে পড়ে থাক। আমি তো শুনেছি বাবা কুটুসকে ওর সম্পত্তি লিখে দেবেন।

—তো ভালই তো৷ তুই কুটুসকে দত্তক নে। এখানে নিয়ে আয়। অতগুলো ঘর। নিখিল যেখানে থাকে থাক, তুই তোর মতো থাকবি।

—ডিভোর্সের কেস চলবে, আমি এখানে থাকব? এটা সম্ভব?

—বেশ তো, এখানে আমার কাছে থাকবি। সেটা তো আমার পক্ষে আরও ভাল। তুই আছিস জানলে ওর একটা ভয়ভীতি, একটা চক্ষুলজ্জা থাকবে।

—তোমার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না দিদিভাই। ভয়ভীতি? চক্ষুলজ্জা? কীসের? কেন? এ আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব হতে পারে না। এটা তুমি বোঝো…বোঝবার চেষ্টা করো। জিনা চলে গেল।

কোথা থেকে মামলার টাকাটা আসবে এটা সে এখনও জানে না। এটা নিয়ে তাকে ভাবতে হচ্ছে। বাবা-মাকে বলবে কি না এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি সে৷ জিতে গেলে অবশ্য সবটাই ও পক্ষের মিটিয়ে দেবার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে? ধার নিতে হবে। কার কাছে? মুকুট? ঋত্বিক? ওরা ছাড়া তার আর আছেই বা কে? অ্যালিমনিটা সে নেবে ঠিক করেছে। তার ক্ষতিপূরণ হওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু লোকটাকে বেকায়দায় ফেলার জন্য যা করার সে করবে। টাকাটা নেবে একেবারে থোক। এই টাকাটা দিয়ে যদি পূর্ণিমার কোনও ব্যবস্থা করতে পারে। এখন বাবার সঙ্গে একটু কথা বলে সে ঘরে চলে যাবে। বসে বসে টিভি দেখবে। কিছুই তেমন করে দেখবে না, শুনবে না, তবু দৃশ্য আর শব্দগুলো তার ভেতরের দৃশ্য আর ধ্বনিগুলোকে অকেজো করে রেখে দেবে কিছুক্ষণ। সেটাই লাভ।

দালান। দরজা। দরজার ওপারে তার পুরনো বাড়ি। কদিন আগেও তার ছিল। তার সাজসজ্জা, পারিপাট্য, পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কত ভাবনা ছিল। এখন নেই। সে জানে না বিছানার চাদর, খাবার টেবিলের ঢাকা বদলানো হচ্ছে কি না, বাথটব পরিষ্কার করা হচ্ছে কি না, সম্ভবত হচ্ছে না। কেননা ও বাড়ির বর্তমান বাসিন্দার এসব সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। তার ধারণা এগুলো কোনওটা মেয়েদের, কোনওটা জমাদারের কাজ, এবং এরা বিনা আহ্বানে, বিনা তদারকিতেই সব সমাধা করে থাকে। যাই হোক, এগুলো তার ভাবনার বিষয় নয়। কিন্তু বাবার ঘর থেকে কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে।

—আমি অস্বীকার করছি। ও কখনও আমার ছেলে নয়—নিখিলের গলা।

—ও তোমারই ছেলে। ওকে দেখলেই বোঝা যায়। আমি ছোটবেলায় অবিকল ওইভাবে চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে কথা বলতাম।—বাবার গলা।

অপরিচিত একটা গলা বলে উঠল, বাচ্চাটি আপনার সন্তান হোক বা না হোক, আপনার পিতৃদেব নিজের ইচ্ছায় তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি একজন সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্ক অনাথকেও দিয়ে যেতে পারেন। ব্যাপারটা তাঁর ইচ্ছের ওপর। তাঁর নিজের উপার্জনে এই সম্পত্তি তিনি করেছেন।

—আজ্ঞে না—নিখিলের উত্তপ্ত গলা—উনি ওঁর বাবার থেকে যা পেয়েছিলেন তাতেই এসব হয়েছে।

—তা যদি মনে করেন, সেটা আপনাকে প্রমাণ করতে হবে। করতে পারবেন না।

কল্যাণবাবুর গলা—জিনা ডিভোর্সের পর এসব নিতে চাইছে না। তাকে আমি কুটুসের কাস্টোডিয়ান করে দেব। কুটুস সাবালক হলে সম্পত্তি পাবে, তবে তখনও তার ওপর জিনার তদারকি দায়িত্ব আমি রাখছি।

—একটা বাস্টার্ডকে আপনি আমার প্রাপ্য অংশ দিয়ে দিচ্ছেন? আমি এ উইল কনটেস্ট করব। মগের মুলুক নাকি? দেখি কেমন করে আপনি এমন অন্যায় করেন—নিখিল শব্দ করে বেরিয়ে আসছে।

জিনা দ্রুত সরে গেল। সত্যি কথা বলতে কী কেন সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতগুলো কথা শুনল তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। সম্ভবত কল্যাণবাবু সত্যি সত্যিই নিখিলকে বঞ্চিত করে তার অংশ কুটুসকে দিয়ে যেতে পারবেন এটা সে মনে মনে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এই ধরনের আইনি বন্দোবস্ত হলে তার নিজের কী অবস্থা হবে! কাস্টোডিয়ান মানে কী? সে কতটা বাঁধা পড়ে যাবে এ বাড়ির সঙ্গে? সে মুক্ত হতে চাইছে। কুটুসকে চাইছে ঠিকই, কিন্তু মুক্তিও চাইছে। ছ-সাত বছরের বিবাহিত জীবনের ব্যর্থতা তার ভেতরে একটা চ্যালেঞ্জ জাগিয়েছে। তার সমস্ত সুনিপুণ গৃহিণীপনা, মেলামেশা-সামাজিকতায় দক্ষ আধুনিকাপনা। তার পত্নীত্ব, তার সৌন্দর্য ও রুচিবোধ সমস্ত যেভাবে অস্বীকৃত, অপমানিত হয়েছে তাতে সে ভেতরে ভেতরে জ্বলছে। কুটুসের পালিকার ভূমিকা পালন করলেই তার মোক্ষ মিলবে না। নিখিলের সঙ্গে বাড়ির দেওয়া বিয়েটা একটা বিয়েই নয়। শরীরে স্পর্শ করলেও মনকে স্পর্শ করতে পারেনি। নিজে বুঝেসুজে, নিজের দায়িত্বে সে আবার বিয়ে করবে, দেখিয়ে দেবে সুখী হওয়া কাকে বলে। ডাক্তারবাবু ঠিকই বলেছিলেন তার খুব ভাগ্য যে এই লোকের সন্তান তাকে ধারণ করতে হয়নি। বিয়ে করবে, কিন্তু তার আগে নিজের দাঁড়াবার জায়গা তাকে খুঁজে নিতে হবে। তার যে সামর্থ্য নেই তা তো নয়। কারুর দয়ায় সে বাঁচবে কেন?

কিন্তু কতকগুলো নরম জায়গা তার ভেতরে ভেতরে তৈরি হয়ে গেছে এ বাড়িতে; সেটা সে অস্বীকার করতে পারছে না। দিদিভাই জানে না, সেই এক নম্বর নরম জায়গাটাই তার। যেন দিদিভাই নয়, সে-ই দিদিভাইয়ের দিদি, এমন একটা রক্ষাকর্ত্রীসুলভ মনোভাব। দুর্বল মেয়েদের প্রতি সবল মেয়েদের বোধহয় এই ধরনের একটা দিদিসুলভ দায়িত্ববোধ জন্মায়। আজ যে দুর্দৈব তার জীবনে এসেছে, দিদিভাইয়ের জীবনে তার কাছাকাছিও কিছু যদি কখনও আসত কী করত ও? ভেঙে যেত টুকরো টুকরো হয়ে। কিংবা নিজেই বোধহয় অপরাধীর মতো মুখ বুজে সংসারধর্ম পালন করে যেত। কী প্রচণ্ড ভয় নিখিলকে। যমের মতো ভয় পায় ও নিখিলের রূঢ়তাকে, প্রতাপকে। নিখিলও দিদিভাইকে ভীষণ অপছন্দ করে, সংসার আলাদা করার যা-কিছু ষড়যন্ত্র সে করেছে জিনাকে দিদিভাইয়ের প্রভাব থেকে সরাবার জন্যই। এখন এ কথা স্পষ্ট বুঝতে পারে সে।

দিদিভাই ছাড়াও বাবার প্রতি তার একটা শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালবাসা আস্তে আস্তে তৈরি হয়ে গেছে। ঘটনাচক্রে খুব কাছাকাছি এসে গেছে তারা। ভাবনা-চিন্তায়, ধ্যান-ধারণায়। সুদ্ধু জিনার কথা ভেবে, তার ওপর আস্থা রেখে উনি নিজেকে, নিজের সংস্কারকে যেভাবে ভাঙছেন, তাতে এককথায় উনি আশ্চর্য। তার নিজের জেঠু, বাবা—এঁরা সব বেশ সরল সহজ, বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ভাল লোক, তাঁদের দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ, শৃঙ্খলা ও ঐক্যে বিশ্বাস আছে। কাণ্ডজ্ঞান যেমন রসজ্ঞানও তেমনি। কিন্তু কল্যাণ দে সরকারের সঙ্গে তাঁদের কোনও তুলনা হয় না। এই বাবার পাশে তার জেঠু যেন একটা ভাঁড়, ক্লাউন। এই পরিস্থিতিতে পড়লে জেঠু কী করতেন? বোধহয় নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন ছাপাতে হত; উচ্চতা পাঁচ ফুট সাড়ে নয় ইঞ্চি, স্থূলদেহ, গায়ের রং শ্যামবর্ণ, বয়স ঊনসত্তর, বিশেষ চিহ্ন চিবুকের ওপর কাটা দাগ। প্রমোদ নাগচৌধুরী। কেহ যদি খবর দিতে পারেন কৃতজ্ঞ থাকিব।

তৃতীয় নরম জায়গা ঝুম্পা-মাম্পিকে ছাপিয়ে কুটুস। শিশুর মায়া বড় মায়া। প্রথম দেখার দিন থেকে কুটুসের প্রতি তার যে কী অকারণ স্নেহ পড়েছে, কেন পড়েছে ভেবে সে কূলকিনারা করতে পারে না। ভারী মায়াময় বাচ্চা ও। তারও জিনার ওপর ভীষণ ঝোঁক। সোম, বুধ, শুক্র তিনদিন সে এখন ‘রোচনায়’ যায়। ঋত্বিক বলেছে—দেখো জিনা, ভেবে-চিন্তে কাজে যোগ দাও। তোমার মতো একজন চিফ সুপার পেলে আমরা বর্তে যাব। কিন্তু চিফ সুপারের দায়িত্ব অনেক। রেসিডেনশ্যাল তো বটেই। তুমি ভেবে নাও। চিফ হলে তুমি কোয়ার্টার্স পাবে, টাকাকড়িও ভাল দিতে পারব। অন্য দিকে টিচারের পোস্টে মাইনে কম, কিন্তু স্বাধীনতা বেশি। দুটোর মধ্যে যেটা ইচ্ছে তুমি নিতে পার। কিন্তু আগে ভাল করে ভেবে নাও।’ জিনা এখন তিনদিন পড়াতেই যায়। কিন্তু অন্যান্য দিনগুলোতেও কুটুস তাকে খোঁজে। সে গেলে কাছ থেকে আর নড়তে চায় না।

পরদিন ‘রোচনা’য় গেলে ঋত্বিক বলল, জিনা, তোর জন্যে কুটুসের মা অনেকক্ষণ থেকে এসে বসে আছে। দেখ বোধহয় পূর্ণিমার ঘরে। বনমালার উল্লেখমাত্র ভেতরে একটা রাগ সাপের মতো ফণা তুলছে সে টের পায়। এর কোনও যুক্তি নেই। সে তো বনমালাকে মেনেই নিয়েছে। জানে না কি তার ভূমিকা তার জীবনের বিপর্যয়ের একেবারেই নিমিত্তের মতো? তবু এই রাগ, এই কুঁকড়ে যাওয়া সে থামাতে পারে না।

একটা ছোট ঘর আপাতত পূর্ণিমাকে দেওয়া হয়েছে। সে ‘রোচনা’র জরুরি অবস্থার অতিথি। জিনা তার নিজের উপার্জনের থেকে পূর্ণিমার খরচ বহন করে। খুব সম্ভব তার নিজস্ব টাকাকড়ি যা মুকুটদের কো-অপারেটিভে আছে তার ব্যবস্থাও শিগগির হয়ে যাবে। তবে আহামরি কিছু নয়। পূর্ণিমা এখানে ভাল আছে মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। সুপারদের মধ্যে একটি সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট তাকে খুব সাহায্য করে। সুধাদির বাংলা জ্ঞানও কাজে লাগছে। ইংরেজি দেখিয়ে দেয় জিনা নিজে। অন্য সময়ে বাচ্চাদের একটু দেখাশোনা, তাদের সঙ্গে খেলাধুলো করে পূর্ণিমার সময় ভালই কাটে।

ঘরে ঢুকতেই বনমালা উঠে দাঁড়াল। তার মুখ নিচু। চোখ মাটির দিকে। জিনা ঈষৎ বিরক্ত গলায় বলল, কিছু বলবে?

বলতেই বনলতা উপুড় হয়ে তার পা জড়িয়ে ধরল। কাঁদছে।

জিনা আরও বিরক্ত হয়ে বলল, কান্নাকাটি করো না, আমার ভাল লাগে না। কী বলবে বলো। তোমার ওপর আমার কোনও রাগটাগ নেই।

সেই দিনের পর এই প্রথম বনলতার সঙ্গে তার দেখা। অনেক রোগা হয়ে গেছে মেয়েটি। তাকে কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে।

—দিদি, বনলতা সজল গলায় বলল, আপনি ওসব বিয়ে-থার কথা তুলছেন কেন?

—কেন? সেটাই সভ্য সমাজের নিয়ম, এখনও সেটাই আমি মানি বলে।

—আমাদের কেউ কখনও বিয়ে করে?

—করে না। এবার থেকে করবে। আজ একজন করলে কাল আরও পাঁচজন করবে। তোমরাও প্রমাণ করতে পারবে তোমরা অস্বাভাবিক জীব নও। বাবাও তো রাজি হয়ে গেছেন।

—সে আপনি যা-ই বলুন, এ হয় না। আমিই বা কেন রাজি হব?

—সে তোমার ব্যাপার। কিন্তু রাজি না হলে কেন সেটা আমি জানতে চাইতেই পারি।

—আপনাদের চাপাচাপিতে যদি সত্যি সত্যি ওরকম কিছু ঘটেও, তাতেও কি উনি আমাকে সম্মান দিতে পারবেন?

—আমি ভদ্রঘরের মেয়ে ছিলাম বনমালা। মান উনি আমাকেও দেননি। আমি জানতাম না তাই ছিলাম। তুমি জানতে, কিন্তু তোমার আপত্তি হয়নি। এখন যদি তোমাকে ঘরে নিয়ে গিয়েও আগেকার মতো ব্যবহার করেন তা হলে তোমার অপমানিত বোধ করা উচিত নয়। এসব কথা ছাড়ো। আইনত স্ত্রী হলে তুমি অনেক সুবিধে পাবে, তোমার ছেলে তো পাবেই। ছেলে পিতৃপরিচয় পাবে। সবচেয়ে বড় কথা এই অনাচার থামা উচিত। তুমি কারও সম্পত্তি নও, কোনও মানুষ কারও সম্পত্তি হতে পারে না, তবু তোমাকে একজন বেচে দিল, অমনি তুমি তার দাসী হয়ে গেলে—এটা অনৈতিক তো বটেই, সম্পূর্ণ বেআইনি। নিরুপায় হয়ে তুমি এ জীবন মেনে নিয়েছিলে। আমি চাইছি তোমার ওপর অবিচারের প্রতিকার হোক।

—জিনা দিদি। এবার মুখ তুলে চাইল বনলতা, তার চোখে বেশ অবাধ্যতা— যদি বিয়ে করতেই হয় তা হলে নিখিলবাবুর মতো খারাপ লোককে আমি বিয়ে করব কেন, বলতে পার? আমাদেরও যে কখনওসখনও সত্যিকারের বিয়ে হয় না তা নয়, কিন্তু সে হয় ভালবাসায়। তার জন্যে বিশ্বাস চাই। আপনার উনি তো মিথ্যেবাদী। হপ্তায় তিন-চারদিন তিন-চার ঘণ্টার জন্যে আসে তাইতেই তো হাড় কালি করে দেয়। যা হয় ওই তিন-চার দিনের ওপর দিয়ে যায়। ঘরে নিয়ে গেলে তো দিনরাত্তির যা খুশি করবে। উনিও যেমন আমাকে মান দিতে পারবেন না, আমিও তেমনি ওঁকে মান দিতে পারব না। একফোঁটাও নয়। জোচ্চোরকে কি বিশ্বাস করা যায় নাকি?

জিনা বিরক্ত গলায় বলল, কেন, তুমিই তো সেদিন বলছিলে উনি লোক ভাল! তোমার কাছে উনি ভালই থাকবেন।

—না দিদি, ওটা ওঁদের ফুর্তি করার জায়গা, কখনও বন্ধুবান্ধব নিয়ে, কখনও একা। সে ফুর্তির রকম আপনারা আন্দাজ করতে পারবেন না। আর মদ পেটে পড়লে তো আর দেখতে হবে না। সে চেহারা আপনাদের দেখতে হয় না, সেসব চোখরাঙানি আবদারও আপনাদের শুনতে হয় না। ভাল মানে কী! ভাল মানে পেমেন্ট ভাল। সেখানে জোচ্চুরিটা করেনি। এ দু মাস ওঁকে আমি ও ঘরে ঢুকতে দিইনি। পরের মাসে বাড়ি ভাড়ার অ্যাডভান্স শেষ হবে—আমিও ও ঘর ছেড়ে দেব।

—তারপরে? কোথায় যাবে? তোমার ছেলে? উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল জিনা।

—আমার ছেলেকে ঋত্বিক দাদারা যেমন দেখছে দেখবে। আর নিজের ব্যবস্থা আমি নিজেই করে নিতে পারব।

—আবার ওই…

—তোমার পা ছুঁয়ে বলছি দিদি, আমার ছেলের মাথার দিব্যি, আমি আর ও কাজ করব না। তুমি আমার কথা ভেবে মিছে কষ্ট পেয়ো না।

বনমালা বেরিয়ে গেল।

—শোনো, বনমালা শোনো—জিনা পেছন থেকে ডাকল—কিন্তু বনমালাকে ধরতে পারল না। চিন্তিত মুখে সে পূর্ণিমাকে জিজ্ঞেস করল, তুই কিছু জানিস? ও কোথায় যাবে, কী করবে? কী ঠিক করেছে ও?

পূর্ণিমা মাথা নাড়ল। সে কিছু জানে না।

এরই দু-তিন দিন পরে রবিবার পরেশনাথের মন্দিরে বেড়াতে গিয়ে ফিরল না ‘রোচনা’র কয়েকটি বাচ্চা। কুটুস এবং আরও তিনটি। কুটুসই সবচেয়ে ছোট, অন্যরাও বছর ছয়-সাড়ে ছয়ের বেশি হবে না। নিয়ম অনুযায়ী ওদের সঙ্গে গিয়েছিল ওদের তিনটি দিদি, অর্থাৎ অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার, দুজন টিচার, গভর্নিং বডির পক্ষ থেকে গিয়েছিলেন ললিতা দেবী ছাড়াও সমরেশ চৌধুরী নামে এক ব্যবসায়ী ভদ্রলোক। নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা, এর ওপরে বাসের ড্রাইভার। তার হেল্‌পার। ললিতা দেবী ও সমরেশ চৌধুরী যান নিজস্ব গাড়িতে। এঁরাও প্রায়ই যান। বাচ্চারাও এঁদের ভাল করেই চেনে। বিশেষ করে ললিতা দেবী প্রায়ই হস্টেলে অনেক খাবারদাবার, খেলনা ইত্যাদি নিয়ে যান বলে তাঁকে সব বাচ্চাই ভালবাসে। ওদের গুনে-গেঁথে বাস থেকে নামাতে হয়, গুনে-গেঁথে তুলতে হয়। তোলবার সময়েই গুনতিতে চারজন কম পড়ে। পরক্ষণেই বোঝা যায় তারা ঠিক কোন চারজন। চিড়িয়াখানা বা বট্যানিক্যাল গার্ডন্‌স্‌-এর মতো বড়ো জায়গায় গেলে বাচ্চাদের দল হিসেবে ভাগ করে প্রত্যেক দলের সঙ্গে একজনকে রাখা হয়। নিক্কো পার্ক, সায়েন্স সিটি, পরেশনাথ—এসব জায়গায় দরকার হয় না। শেষ দেখা গেছে ওদের মাছের চৌবাচ্চার কাছে। একমনে মাছ দেখছিল।

সংখ্যায় গরমিল ধরা পড়ার পরে ওঁরা সারা পরেশনাথ মন্দির-চত্বর আঁতিপাঁতি করে খুঁজেছেন, অবশেষে স্থানীয় থানায় ডায়েরি করে এসেছেন। কিন্তু ঋত্বিক রবিবার রাত্রে দিল্লি থেকে ফেরায় সোমবার এগারোটার আগে খবর পায়নি। দিল্লি গিয়ে বেচারি আরও ফান্ডের ব্যবস্থা পাকা করে এসেছে। খুব খুশি মেজাজে ছিল। এসেই এই খবর। সারাদিন বেলগাছিয়া থানা, মিসিং পার্সনস স্কোয়াড, মিডিয়া এইসব নিয়ে ব্যস্ত ছিল ঋত্বিক-মুকুট দুজনেই।

রোববার থেকে জিনার জ্বর জ্বর। সকালে সে যেতে পারবে না জানিয়ে দিয়েছিল ঝুম্পাকে দিয়ে। বিকেল চারটে নাগাদ সে মুকুটের ফোন পেল।

—জিনা একটা বাজে খবর আছে।

—কী? বনমালা? আমি তোকে শুক্রবার থেকে অনেকবার….

—বনমালার কিছু হয়নি। শুক্রবার ওর জন্যেই আমাকে একটু বাইরে যেতে হয়েছিল। ছিলাম না ক’দিন। খবরটা ওর ছেলের।

—কুটুসের? কী হয়েছে?

—কুটুস হারিয়ে গেছে।

—হারিয়ে গেছে মানে?

তখন মুকুট তাকে আদ্যোপান্ত বলল।

পুলিশ ইনভেস্টিগেট করছে, তুই ভাবিসনি।

জিনার মাথা ঝিম ঝিম করছিল।

—কে হারিয়ে গেছে? কী? —রিসিভার রাখতেই পেছন থেকে মল্লিকা জিজ্ঞেস করল।

—কুটুস হারিয়ে গেছে পরেশনাথের মন্দির থেকে।

কুটুস ইদানীং মাঝে মাঝেই এসে ডাফ স্ট্রিটের বাড়িতে থাকছে। জিনার সঙ্গে আসে। আবার একদিন পরে জিনার সঙ্গেই ফিরে যায়।

—কার বাড়িতে এসেছে কুটুস? —মাম্পি জিজ্ঞেস করে।

—জিয়া।

—কে তোমাকে মুড়ি খেতে দেয়?

—ঝুমা।

মুড়ি খেতে খুব ভালবাসে কুটুস। আলুসেদ্ধ দিয়ে মুড়ি। মেখে দেয় মল্লিকা। ঝুম্পা বসে বসে খাওয়ায়। মাটিতে মুড়ি পড়ে গেলে একটি একটি করে তুলতে থাকে কুটুস।

—খেয়ো না, পড়ে যাওয়া খাবার খেতে নেই।

—আঁলু? —আঁলু পড়ে গেলে? যদি খাওয়া না যায়? আলু ভীষণ ভালবাসে কুটুস।

—ফ্রান্স থেকে এসেছিস নাকি রে তুই? —ঝুম্পা জিজ্ঞেস করে।

কুটুস জোরে জোরে মাথা নাড়ে। —‘নোচনা।’ ফ্রান্স নয়, সে ‘রোচনা’ থেকে এসেছে।

আড়াল থেকে তাকে লক্ষ করেন কল্যাণবাবু। অনেক লক্ষ করে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন এ তাঁদের বাড়িরই ছেলে। নিজেকে তো আর ছোটবেলায় দেখেননি! কিন্তু লোকের কাছে শোনা ছিল। তারপর আছে অ্যালবামে ছবি। একটা নিজের ছোটবেলার ছবি, বড় করে তিনি বাঁধিয়ে রেখেছেন, ফ্রেমসুদ্ধ ছবিটা সারা বাড়ি ভ্রমণ করে। কখনও মল্লিকার ঘরে, কখনও ঝুম্পাদের ঘরে, কখনও আবার ফিরে আসে কল্যাণবাবুর নিজের কাছেই। এই ছবিটা দিয়েই তিনি বোধহয় নিজের ও আর সবার মনের সংশয় কাটাতে চান। একজন অনাথ বাচ্চাকে মানুষ করার জন্য অর্থ সাহায্য করতেও কল্যাণবাবুর আপত্তি হত না। কিন্তু সম্পত্তির অংশীদার করতে গেলে নিশ্চিত হওয়া চাই।

ছবিটা দেখিয়ে কুটুসকে যদি বলা যায়—কে বল তো?

কুটুস অমনি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, আঙুল রাখে আয়নার প্রতিবিম্বের ওপর। বলে—কুটুস।

কুটুস হারিয়ে গেছে শুনে অদ্ভুতভাবে চুপ হয়ে গেলেন মানুষটি। রাত্রে শোবার আগে একটু দুধ খান। খেলেন না আজ। রাত আটটার পর সাধারণত তাঁর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আজ খোলা রইল। আলোর একটা চওড়া স্রোত দরজা থেকে বেরিয়ে দালানের ওপর পড়ে রইল।

জিনা বিছানায় মৃতের মতো শুয়েছিল। জ্বর একটু কমেছে। মল্লিকা খাবার এনেছে।

—জিনা, ওঠ, খেয়ে নে।

অনেক সাধাসাধির পর উঠে বসল জিনা। রাগে, চোখের জলে মুখটা মাখামাখি হয়ে গেছে। চুলগুলো কপালে সাঁটা। সে তীব্র স্বরে বলল—যাও না যাও, আমাকে কেন? রান্নাঘরে যাও। দেখো আদরের দেবর বোধহয় এসেছেন, তাঁর জন্যে পঞ্চব্যঞ্জন সাজাতে হবে না? কবে থেকে বলছি—ওকে বুঝতে দাও, বুঝতে দাও সবাই ত্যাগ করলে মানুষের কী অবস্থা হয়! তা কে কাকে বলছে!

কল্যাণবাবু অপেক্ষা করছেন। নটা নাগাদ নীচের দরজা চাবি দিয়ে খুলে সে ওপরে উঠল। দালান অবধি পৌঁছোতেই তিনি ঘরের সামনে বেরিয়ে এলেন।

—শোনো—

নিখিল দাঁড়িয়ে গেল।

—বাচ্চাটি কোথায় আছে?

—কে বাচ্চা?

—বাচ্চা একজনের কথাই আমি জিজ্ঞেস করতে পারি তুমি জান।

—ওহ্, কী ব্যাপার? কোথায় সে?

—সেটাই জানতে চাইছি। কোথায় রেখেছ তাকে? আই অ্যাকিউজ য়ু।

—আপনার কথার মানে? আপনার আস্পদ্দা তো কম নয়?

কল্যাণবাবু ঘরে ঢুকে গেলেন। দরজা বন্ধ হবার শব্দ হল।

নিখিল মাঝের দরজায় এসে দাঁড়াল। চেঁচিয়ে বলল, সবাই শুনে রাখো, বেয়াদবির দিন শেষ হয়েছে। এ আমার বাড়ি। আমি যা খুশি করব। ইচ্ছে হলে পুরো শেঠবাগান-রামবাগান উঠিয়ে নিয়ে আসব। নন-স্টপ মাইফেল চলবে। চানস্‌ দিয়েছিলাম বোঝাপড়ার। হল না। এবার দেখবে আমি কী করতে পারি আর না পারি। —আজ সে বেশ খানিকটা মাতাল। তার চোখ লাল। মত্ততার চিহ্ন তার চলায়-ফেরায়। বিমান যথারীতি এখনও অনুপস্থিত।

সকাল হতে আর দেরি করল না জিনা। কারও কথা শুনল না। একটা ট্যাকসি নিয়ে চলে গেল ঋত্বিকদের বাড়ি। যোধপুর পার্ক। দোতলার জানলা থেকে তার চলে-যাওয়া দেখল নিখিল।

বাড়ির দরজা পেরিয়ে প্রথম কথা বললো জিনা—তোরা রেইড করা।

—কোথায়? —ওই দুই আউটসাইডারের বাড়ি। আমার মনে পড়ছে প্রত্যেক নববর্ষে, ক্রিসমাসে নিখিল একটা করে বড় কার্ড পেত। নাম থাকত ‘ল’। জিজ্ঞেস করলে বলত ‘ললিত’ নামে ওর এক পুরনো বন্ধু ওটা পাঠায়। ওইরকম মনোগ্রাম তার সব কিছুতেই। কখনও এই ললিতকে দেখিনি আমি। আমার ধারণা ওটা ললিত নয়, ললিতা। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল। দেখ, ওই ‘ললিতা’ হয়তো কোনও পাচার-চক্রের সঙ্গে জড়িত।

—সুদ্ধু একটা ওয়াইল্ড গেস-এর ওপর নির্ভর করে কারও বাড়ি রেইড করানো যায়?—মুকুট বলল। কিন্তু জিনার কথায় সে বেশ বিচলিত হয়েছে।

—ওয়াইল্ড? তোরা এটাকে ওয়াইল্ড বলছিস! আমি, বাবা, আমরা হানড্রেড পার্সেন্ট শিয়োর এটা নিখিলেরই কাজ। ওদের লক্ষ্য হল কুটুস। আর তিনটে বাচ্চাকে চোখে ধুলো দেবার জন্যে।

ঋত্বিক বলল—মহিলাকে তো আমার গোড়ার থেকেই ভাল লাগেনি। এইসব লাইনে যারা সারাজীবন ধরে ঘাগু হয়েছে তাদের মধ্যে বহু বড় ধরনের অপরাধ দেখা যায়! কে জানে শিশু-পাচার-চক্র না শুধুই নিখিল-চক্র? জিনা তুইও তো মহিলাকে হস্টেলে এসে বাচ্চাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে দেখেছিস। তখন কী মনে হয়েছিল।

জিনা বলল, ভাল লাগেনি। অত বড়লোকি দেখানোর কী আছে? অত দেমাকই বা কেন? ও সমস্তই মুখোশ। যাই হোক, এখন এসব স্পেকুলেট করে লাভ নেই।

ঋত্বিক বলল, মহিলা যদি এর পেছনে থাকেনও, ওঁর বাড়িতে কখনও পাওয়া যায়, পুলিশে যা করার করছে। আমি একটু পরেই বেরোব। মুকুট, জিনাকে শুইয়ে দে। ওর বেশ জ্বর। প্যারাসিটামল দিয়ে দে একটা। আমার প্রজেক্টটার বারোটা বাজিয়ে দিল এরা।

—হ্যাঁ, খালি নিজের কথাই চব্বিশ ঘণ্টা ভাব। —জিনা রাগ করে বলল।

—তোর খালি কুটুস জিনা, আমার কিন্তু আরও তিনটে আছে শানু, চিতু, শম্ভু। দুর্ভাবনা কারও চেয়ে কম নয় আমার। কিন্তু আমাকে মাথা ঠান্ডা করে চলতে হবে। আমি পুলিশকে তোর সন্দেহের কথা বলব। কোন মিনিস্টার, কোন আমলার সঙ্গে মহিলার দহরমমহরম তো জানি না, তবে আমি শেষ পর্যন্ত লড়ব। এবং তোদের সন্দেহ যদি সত্যি হয়, নিখিল দে সরকার বাঁচবে না।

জিনা চোখ বুজল। তার আর একটা কথাও বলতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে চারপাশে সব কিছুই ছুড়ে ছুড়ে ফেলে দেয়। যেখানে যা আছে। মনে হচ্ছে এইসব দরজা জানলা ভেঙে বেরিয়ে যায় একটা অতিপ্রাকৃত প্রাণীর মতো। তছনছ করে দেয় এই অনাচারে, শয়তানিতে ভর্তি পৃথিবীটার যাবতীয় সংসার। কিন্তু আপাতত তার ভীষণ ঘোর আসছে একটা। মাথায় কে দুরমুশ পিটছে। হাত পা সব যেন কুকুরে চিবোচ্ছে। সে মাথা পর্যন্ত তুলতে পারছে না আর। এত জ্বর! মুকুট মাথা ধুইয়ে দিচ্ছে ঠান্ডা জলে। তার চুলগুলো খাটের পাশ থেকে ঝুলে রয়েছে। হু হু করে পাখা চলছে। জ্বর মাপছে মুকুট, কাকে ফোন করল, সবই যেন স্বপ্নে ঘটছে, যা-কিছু এতদিন ঘটেছে সবই স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন। এক কালরাত্তির যেন তাকে ঘিরে ঘিরে ঘুরছে। কবে, কোথায় এর শেষ? একটা ক্রুদ্ধ জিজ্ঞাসা ছড়িয়ে যাচ্ছে তার জ্বরগ্রস্ত মস্তিষ্ক থেকে। তরঙ্গে তরঙ্গে।

এইভাবেই ঘনিয়ে আসে সেই নিশ্ছিদ্র নিশিদুপুর। জ্বরে অচৈতন্য একজন, একজন নিরুদ্দেশ, আর একজন বসে আছে খোলা জানলার পাশে, করতলে তিনখণ্ড শক্ত মলাটে বাঁধাই গল্পগুচ্ছ। ভেতরে দুশ্চিন্তা, অশান্তি, ভুলে থাকবার একমাত্র উপায় বই। দুপুরে সে ঘুমোবে না স্থির করে, কিছুতেই ঘুমোবে না, কিন্তু এক এক দিন পেরে ওঠে না, আর ঘুমোলেই ম্যমি, ভয়াবহ ভুতুড়ে অন্ধকার, ঘুমোলে বাঘ। সুতরাং তেরোতলা বাড়ির ছাদ থেকে এক লাফে টি.ভি. টাওয়ারে উঠে যায় বাঘটা। মানচিত্র পরিষ্কার। আরেক লাফে নেমে আসে পার্শ্বনাথ মন্দিরের চুড়োয়। আর এক স্লো-মোশন লাফ। জাম্প কাট মানিকতলার মোড়, জাম্প কাট স্টেটবাসের মাথা, জাম্প কাট গোরাচাঁদ বোসের গলি। সরু সরু রাস্তার হেঁতাল ঝোপের পেছনে পেছনে গুঁড়ি মেরে সে এগোতে থাকে। ধূর্ত, নিষ্ঠুর, খল নারীখাদক।

সময়টা অদ্ভুত। দিন অথচ দিন নয়। সূর্য পশ্চিম কোণে ঝুলছে। চাঁদের মতো ক্ষীণ। মেঘের প্রতাপে ভিজে ভিজে নিবু নিবু। ভারী নিষ্প্রভ হাওয়ায় শহরময় ছড়িয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের বাঘের বুনো গন্ধ। ঘরময়, বারান্দাময়। তীব্র মানুষখেকো গন্ধের চোটে হাঁকপাঁক করে জেগে ওঠে সে। কখন সদর দরজা খুলে গেছে হারানো চাবির মোচড়ে সে টেরও পায়নি। অবসরের চুল মেলে নিশ্চিন্তে ছিল। তামাক-অ্যালকোহলে জড়ানো শরীরের বোঁটকা গন্ধ। খুট করে একটা শব্দ। দরজার আলোর আয়তক্ষেত্র উধাও। লুকোনো কোণ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বপ্নের বাঘ।

প্রাণপণে মুখ সরায় সে করাল মুখের কামড় থেকে। থাবা থেকে ছিঁড়ে আলাদা করে নিজের মাংস। শাড়ির ওপর দুর্বহ ওজন, হিঁচড়ে পালিয়ে যায় সে শাড়ি থেকে তারপর বইটা দিয়ে সজোরে আঘাত করে। চোখ ঘেঁষে গেছে চোটটা। দৌড়ে ছিটকিনি খোলে সে, চিৎকার বেরিয়ে আসে গলা দিয়ে, অকথ্য গর্জনে মুখ চেপে ধরছে বাঘটা। সে প্রাণপণে ছুটে যেতে চায় একবার নীচের সিঁড়ির দিকে একবার ছাতের সিঁড়ির দিকে। দরজা চাই, একটামাত্র খোলা দরজা। তাকে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে সিঁড়ির মুখ থেকে টেনে আনতে থাকে বাঘটা, ঘরের দিকে। টুঁটি কামড়ে ধরেছে। থাবাদুটো বুকে। শরীর-মনের সমস্ত শক্তি জড়ো করে সে এবার এক ধাক্কা দেয়। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পড়ে গেছে বাঘটা, আরেকটা ধাক্কা দেয়, বিদ্যুতের মতো বেগে, হাত দিয়ে, পা দিয়ে, সমস্ত দিয়ে। গড়াতে গড়াতে নীচে পড়তে থাকে বাঘটা। ধপ্‌ করে একটা বিশ্রী শব্দ হয়। মাথা নিচু করে পড়েছে। তখন সে ঝাঁপিয়ে পড়ে দালানের মাঝখানে সবুজ দরজার ওপর। তার সমগ্র বিবাহিত জীবনের সংকুচিত নীরবতার ওপার থেকে ভয়, লজ্জার দেয়াল দু হাত দিয়ে ভেঙে বিকৃত গলায় চিৎকার করে ওঠে। জিনা! জিনা! জিনা!।

দরজা খুলে যায়!

এ কী! সায়া-ব্লাউজ পরা আলুথালু হতশ্রী সামনে দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে যান বৃদ্ধ।

ওই যে—সে কান্না আর চিৎকার মেশানো একটা তীব্র আর্তনাদ করে—মেরে ফেলেছি। ঠেলে ফেলে দিয়েছি। আর সইতে পারিনি। কতদিন সইব?

লাঠির ওপর ভর, আস্তে আস্তে সিঁড়ির মাথায় গিয়ে দাঁড়ান তিনি। সিঁড়ির তলায় ঘাড় গুঁজে পড়ে আছে তাঁর ছোট ছেলে, খারাপ ছেলে।

ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছে। খোলা চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে, ব্লাউজ ছিঁড়ে ঝুলছে, উন্মাদিনীর মতো দৃষ্টি—ওপরে-নীচে বারকয়েক তাকিয়ে দেখলেন তিনি বোঝবার প্রবল চেষ্টায়। তারপর তীব্র কশাঘাতের মতো সত্য ধরা দিল। এত দিনের সমস্ত ‘কেন’র কার্যকারণ বুঝে তিনি এক মিনিট তাঁকে আঁকড়ে-ধরা মেয়েটিকে ধরে রইলেন, তারপর এক হাতে লাঠি আর এক হাতে তাকে ধরে ধরে তার ঘরে নিয়ে গেলেন, আলনা থেকে একটা শাড়ি নিয়ে বললেন—পরে নাও, আমি তো পরাতে জানি না মা! নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন আস্তে আস্তে, তাক থেকে একটা ওষুধের পাতা নিলেন, ছিঁড়ে দুটি বড়ি হাতে দিয়ে বললেন—খেয়ে নাও দেখি, জল দিচ্ছি। নিজের আরামচেয়ারে বসিয়ে দিলেন ধরে ধরে। কুঁজোর জলে তোয়ালে ভিজিয়ে বললেন—মুখটুখগুলো ভাল করে মুছে নাও এবার। নিয়ে চুপটি করে শুয়ে থাকো, ঘুম এসে যাবে। …তুমি তো ফেলনি! টাল সামলাতে না পেরে ও আপনি পড়ে গেছে। টাল সামলাতেও তো জানতে হয়!

অপেক্ষা করবেন। তাঁকে এখন বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। ও ঘুমিয়ে পড়বে। তারপরে তিনি কতকগুলো ফোন করবেন। বেশি নয়। মাত্র তিনটে। একটা বিমানকে, তার অফিসে, দ্বিতীয়টা ‘রোচনা’য়, জ্বরগায়ে জিনা বোধহয় সেখানেই গিয়ে বসে আছে, বাচ্চাটার, বাচ্চাগুলোর যদি কোনও খোঁজ পাওয়া যায়। আর তৃতীয় ও সর্বশেষটা ডক্টর সেনগুপ্তকে, তাঁর মোবাইল নম্বরে।

—ডক্টর সেনগুপ্ত? কল্যাণ সরকার বলছি। হ্যাঁ ডাফ স্ট্রিটের। একটা বিশ্রী দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার বাড়িতেই। একদম একা, তার ওপরে খোঁড়া মানুষ, কী যে করি! ছোট ছেলেটি ইদানীং বেসামাল হয়ে বাড়ি ফিরছিল। আপনি তো সবই জানেন! সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে গেছে। ঘাড়টা দেখে ভাল ঠেকছে না। বেকায়দায় পড়েছে। আমি খোঁড়া, নীচে নামতে পারছি না, বড় বউমাটি কীরকম ভিতু প্রকৃতির দেখেছেন তো! দেখেশুনে এমন ঘাবড়ে গেছে যে ট্রাংকু ইলাইজার দিতে হল। আমাকে যেটা দিয়েছিলেন! হ্যাঁ টেন দিয়েছি। —বড় ছেলেকে ফোন করেছি। সে-ই এসে দরজা খুলবে। হ্যাঁ, জানি না এ কেন এমন অসময়ে ফিরল! ঈশ্বর জানেন, নিয়তি! কী বলব বলুন—পাপের বেতন কী তা সবাই জানে। তবু, শত হলেও তো বাপ! আপনি যত শিগগির পারেন… হ্যাঁ শক্ত আছি। শক্তই থাকব। নিশ্চয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *