কল্যাণবাবুর আত্মীয়স্বজন

কল্যাণবাবুর আত্মীয়স্বজন

কল্যাণবাবুর নারীভাগ্য ভাল। মা অবশ্য তাঁর কপালে বেশিদিন টেঁকেননি। কিন্তু যে জেঠিমার কাছে তিনি প্রধানত মানুষ, তিনি তাঁকে চিরকাল বুক দিয়ে আগলেছেন। এক ছেলে হওয়ার দরুন ঠাকুরদাদার ভূ-সম্পত্তির মধ্যে, বরানগরের গোটা একখানা বাড়ি, তা ছাড়া বেশ কিছু টাকাপয়সাও তিনি একলা পাবেন, এ নিয়ে অন্যান্য কাকাদের মধ্যে একটা রাগ-বিরক্তি ছিল। বাবা কর্মোপলক্ষে বিদেশে থাকতেন। ছেলেটি সম্পূর্ণ পরিজনদের করুণানির্ভর, অনেক ক্ষতিই তো হতে পারত। কিছুই হয়নি। জেঠিমা সব সময়ে নজর রাখতেন। বিয়ে যখন করলেন, দেখা গেল স্ত্রীও চমৎকার মানুষ। আমুদে, সংসার চালনায় অতি দক্ষ। এই বাড়ি দুজনে পছন্দ করে কিনলেন। বাড়ি টিপটপ রাখা, পাঁচ বছর অন্তর অন্তর স্বামীকে ধরে-করে চুনকাম, সারাই-ঝালাই করানো—এ সব তিনি একেবারে নিয়ম করে করতেন। কল্যাণবাবু চিরকাল উচ্চপদে চাকরি করেছেন। কিন্তু সৎ মানুষ, বিলাসিতা করার মতো উপার্জন করেননি।

কিন্তু স্ত্রীর প্রবল বাস্তববুদ্ধির জন্য কোনওদিন কোনও অসুবিধের মধ্যে পড়েননি। পিতৃসূত্রে পাওয়া সম্পদ দিব্যি দ্বিগুণ তিনগুণ হয়ে গেছে। মানুষ হিসেবে আরতি কতটা ভাল, কতটা উদার ছিলেন তার অবশ্য কোনও সত্যিকার পরীক্ষা হয়নি। কোনও ভাগীদার তো কখনও ছিল না! নিজের বাপের বাড়ির দেশ থেকে প্রায় অনাথা একটি শান্তশিষ্ট রূপসী মেয়েকে বড় ছেলের জন্য সংগ্রহ করে আনলেন। চালাকিটা কি আর তিনি বোঝেননি? গরিবের মেয়ে, মাতৃহীন, তার ওপর দেশঘরের। এত আদর, এমন ঘর-বর পেয়ে সে তো স্রেফ কৃতজ্ঞতাতেই চিরটাকাল নুয়ে থাকবে! ছেলেও শান্ত প্রকৃতির, তাকে যৌবন থেকেই ব্রিজের নেশা ধরেছে, সে বরাবর মায়ের অনুগত। যেমন ছিল তেমনই রইল। তবে বউমা কি আর এত সত্ত্বেও শাশুড়ির হিসেব উলটে দিতে পারত না? কিন্তু দেয়নি। মল্লিকা বড় ভাল মেয়ে। শান্ত, ঘরোয়া, কল্যাণবাবুর সঙ্গে তার আপন কন্যার মতোই সম্পর্ক হয়ে গেছে। তার একটাই মাত্র দোষ। সে বড় ভুলো, অগোছালো, সুগৃহিণী নয়। হতে পারে, শাশুড়ি অতি সুগৃহিণী ছিলেন বলেই সে ওরকম হতে পারল না, আদেশ পালন করতে করতে আদেশ দেওয়া কী জিনিস, পরিচালনা করা কী জিনিস শিখে উঠতে পারল না। তবে এ নিয়ে তাঁরা সবাই, এমনকী, মল্লিকার মেয়েরাও খালি মজাই করে। কোনও নালিশ নেই।

—দাদু আজকে হরিমটর। মায়ের ভাঁড়ারে চাল, ডাল, তেল, আটা, নুন সব বাড়ন্ত। শাকভাত এমনকী নুনভাত খাবারও উপায় নেই!

—সে কী! বউমা! বউমা!—

—কী বাবা!

—তোমার নাকি সব বাড়ন্ত? আমায় বলনি কেন? এনে দিতুম।

—কে বললে আপনাকে এসব?

—ঝুম্পা।

—ওদের আসলে আজকে হোটেলে খাবার ইচ্ছে হয়েছে, তাই আপনাকে গুচ্ছের বাজে কথাগুলো লাগিয়ে গেছে।

ঝুম্পা কিছুটা বাড়াবাড়ি করলেও একেবারে বাজে কথা কিন্তু মোটেই বলেনি। সত্যিই সব রান্না শেষ করে— মল্লিকা ভাত চাপাতে গিয়ে সেদিন দেখে আধ কুনকেটাক চাল মাত্র পড়ে রয়েছে।

একদিন কল্যাণবাবু রাত্রে শুতে এসে দেখেন পরিপাটি করে বেডকভারটি পাতা রয়েছে। কিন্তু তার তলায় তোশক বালিশ চাদর কিছু নেই। রোদে দেওয়া হয়েছিল। তুলতে ভুল হয়ে গেছে। তোলা-পাড়ার কাজটা হয়তো হাতেকলমে তার করার কথা নয়। কিন্তু তত্ত্বাবধানের দায়টা তো তারই। এতখানি জিভ কেটে মল্লিকা বেচারি যখন ছাতে ছুটছে, লজ্জায় প্রায় চোখে জল এসে গেছে। তখন কল্যাণবাবু তার সঙ্গে ছাতে গিয়ে তাকে নিরস্ত করেন। ক্রন্দনমুখী বউমাকে আশ্বস্ত করে, —তোশক, বালিশ নামিয়ে আনেন। কেন যে এত ভুল, কেন যে এত অগোছালোপনা সে কথা কল্যাণবাবু মাঝে মাঝেই ভাবেন। কেন না তিনি জিজ্ঞাসু মানুষ। প্রশ্নহীন নিরুত্তর টাইপের তিনি নন। কেন মেয়েটি এত আনমনা হয়ে থাকে? আরতি যখন বেঁচেছিলেন, তখন এটা ছিল কি না তিনি খেয়াল করেননি। কিন্তু আরতির আড়ালটা সরে যেতেই এই ভুলোমনের মেয়ে বেরিয়ে পড়ল।

অনেকদিন ধরে লক্ষ করে করে, ভেবেচিন্তে শেষে একদিন বউমাকে ডাকলেন তিনি। সন্ধেবেলা। বাড়িতে আর কেউ নেই। ছেলে তো ফিরে কোনওমতে কিছু গলাধঃকরণ করেই তার ব্রিজ-ক্লাবে চলে যায়। ঝুম্পা-মাম্পি হয় পড়তে গেছে, নয় গানটানের স্কুলে গেছে। কবে যে ওদের গান, আর কবে যে ওদের ছবি আঁকা, তিনি হিসেব রাখতে পারেন না। আর ছোট ছেলে কোনওদিনই আটটার আগে ফেরে না। ডাকতে মল্লিকা এসে বলল, এক কাপ কফি খাবেন, বাবা?

—কেন? তোমার খেতে ইচ্ছে হয়েছে? সঙ্গী চাই?

—তাই বলছি না কি? ও মা! —লজ্জা পেয়ে যায় মল্লিকা।

—বললে হয়েছেটা কী? তোমার এক কাপ সান্ধ্য-কফির আকাঙক্ষা হতে পারে না?

—তা নয়।

—তাই-ই। ভাব শ্বশুর-ব্যাটা নিজেরটি ছাড়া আর কিছু বোঝে না।

—এ মা! ছি ছি!

—ছি ছি বললে কী হবে, আজ অবধি তো তোমাকে স্বীকার করতে দেখলুম না যে তোমার শ্বশুর হল— শ্বশুর উইথ এ ডিফারেন্স। —একটু তরল হলেন কল্যাণবাবু।

—এ মা। আমি আপনাকে বাবা বলে ডাকি, বাবাই ভাবি।

—তা হলে তোমার মন কেন এত খারাপ সে কথা তো বলছ না!

—মনখারাপ? কে বললে? —মল্লিকা আকাশ থেকে পড়ল।

—মন খারাপ নয়?

—না তো!

—তা হলে এমন উদাস দেখি কেন? সব ভুলে ভুলে যাও। সংসারে মন দেখি না কেন মা? ভাল লাগে না?

—ব্যস। অমনি মল্লিকার চোখ ছলছল।

—আমি একেবারে অপদার্থ, বাবা, এবার থেকে চেষ্টা করব।

—শোনো, কল্যাণবাবু উঠে বসলেন—তুমি আমাকে ভুল বুঝলে। আমি কিন্তু তোমার বিচার করছি না। সেনসার নয় এটা। একেবারেই নয়। সবাইকার সব কিছু ভাল লাগে না, এটা ফ্যাক্ট। আমি জাস্ট জানতে চাইছি। না ভাল লাগে তো আর একটা লোক রেখে দাও। —দৈনন্দিন কাজগুলো সত্যিই বড় ক্লান্তিকর।

মল্লিকা বলল, আরও একটা লোক? তা হলে আমি কী করব? আর তো কিছু করতে শিখিনি!

—বেশ তো! খেদ থাকে তো কিছু শেখো না!

—এই বয়সে?

—শেখার আবার বয়স আছে না কি?

—না বাবা, আমার কিছু শিখতেটিখতে ইচ্ছে করে না। একটু বেরোতে পারলে অনেক সময়ে ভাল লাগে। কিন্তু সে তো আপনার ছেলের সময় হয় না।

—নিখিল তো প্রায়ই থিয়েটার-টার যাবার জন্য সাধাসাধি করে?

উত্তরে মল্লিকা বলল, বাবা, ওর এবার বিয়ে দিন না!

কল্যাণবাবু হেসে বললেন, তাতে নিখিলের সমস্যার সমাধান হবে, তোমার সমস্যার হবে কি?

—হবে! ঠিক হবে। —নিখিলের বিয়ের জন্যে মল্লিকা এমন ধরে পড়েছিল, যে পরদিন থেকেই উঠে-পড়ে লাগতে হল তাঁকে।

কল্যাণবাবুর কোনও ছেলেই খুব একটা কিছু নয়। বিমান অধ্যবসায়ী, বাজে খেয়াল এক তাস ছাড়া আর কিছু নেই। তাসের নেশাটা অবশ্য সে পেয়েছে বাবার কাছ থেকেই। কল্যাণবাবু একসময়ে চুটিয়ে ব্রিজ খেলেছেন এবং বহু পুরস্কার জিতেছেন, তারপরে একটা সময় এল যখন তাস তাঁর একেবারে বিষ লাগতে থাকল। একদম ছেড়ে দিলেন। ক্লাবের আড্ডার বন্ধুরা বলতে লাগল— কী হে কল্যাণ সন্ন্যাসী হয়ে যাবে না কি? তাসের নেশা যার ছোটে তার বউ-বাচ্চা ঘর-সংসারের নেশাও ছুটে গেছে, কিংবা ছুটল বলে। তাদের ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ করে দিয়ে কল্যাণবাবু দিব্যি অফিস-বাড়ি, বাড়ি-অফিস করতে লাগলেন। গৃহিণীর সঙ্গে সিনেমা-থিয়েটার করতে লাগলেন, বড় ছেলেটিকে সাধ্যমতো মাজাঘষা করতে থাকলেন, ছোটটি গোঁয়ার। তাঁকে এড়িয়ে গেল। এবং এইসময় থেকেই কল্যাণবাবু টুকটাক পথশিশুদের পড়ানো, ব্লাইন্ড-স্কুলে গল্পের ছলে বিজ্ঞান—এইসব করতে লাগলেন। তাঁর ধারণা সব ভারতীয়রই ব্যক্তিগতভাবে দেশের মানুষের জন্য কিছু করা উচিত। কেননা এখানে রাজনীতি বলতে যা আছে তা হল আত্মনীতি লুঠেরা নীতি। সরকার একটা জ্ঞানপাপী অকর্মা। গোষ্ঠীর ভাঁড়ার ভর্তি করার উদ্দেশ্য নিয়ে চলে। কবে যে বিমান বাবার ক্লাবে ঢুকে গেছে, শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলেছে তিনি জানতেনও না। এক তাসুড়ে বন্ধুর সঙ্গে দেখা হতে সে-ই বলল —‘তোমার ছেলে যে কার্লবার্টসন-ফন্‌ ব্রিজতত্ত্ব সব গুলে খেয়েছে হে!’ তা খেলুক। শুধু সময় কাটাতে তো খেলছে না। বুদ্ধির চর্চা করতেই খেলছে। তবু তাসের নেশায় সংসারকে যে সে খানিকটা অবহেলাই করে এটা তাঁর ভাল লাগে না। মেয়েদু’টিকে গোড়ার দিকে নতুন নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনায় খুব দেখাশোনা করত। এই বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে। এই গল্পের বই কিনে দিচ্ছে। এই এনসাইক্লোপিডিয়ার পুরো সেট এনে ফেলল। এখন উৎসাহে ভাটা পড়ে গেছে। এক ধরনের লোক আছে মুড়ির মতো, একটু হাওয়া লাগল কি না লাগল মিইয়ে যায়। এখন নাতনিদের তিনি খানিকটা দেখেন। বাকিটা কোচিং। তবে এক বছর অন্তর এল.টি.সি-র দরুন পুরো পরিবার নিয়ে বেড়াতে যাওয়াটা বড় ছেলে নিষ্ঠার সঙ্গে করে আসছে। এসব সময়ে মল্লিকাকে খানিকটা সজীব, খুশি খুশি লাগে। এটাই তা হলে ওর আসল সমস্যা! একাকিত্ব! দুই মেয়ের বাপ হওয়া ছেলেকে কি আর বলা যায় বউয়ের দিকে একটু মন দাও বাবাজীবন! কিন্তু কথাটা তাঁর বলতে ইচ্ছে করে। অনেক কষ্ট করে— আত্মসংবরণ করেন। স্ত্রীর প্রতি মনোযোগের অভাব তাঁর তো কোনওদিন হয়নি! তাঁর স্ত্রী বলতেন—সংসার সুখের হয় পুরুষের গুণে।

নারীভাগ্য ভাল হলে পুরুষের দু’ রকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে। একটা হল মেয়েদের পড়ে-পাওয়া বলে গণ্য করা। বিমানের মা সুদক্ষ, কর্তব্যপরায়ণ, স্নেহশীল ছিলেন। —স্ত্রী, রূপসী, লেখাপড়া জানে, অনুগত, সে-ও স্নেহশীল ও কর্তব্যপরায়ণ, ফলে বিমানবাবু ধরেই নিয়েছেন মায়েরা ও স্ত্রীয়েরা এইরকমটাই হয়ে থাকে। হওয়া উচিত। সুতরাং তাদের জন্য আলাদা করে কোনও ভাবনা-চিন্তা খাতির-খয়রাত করবার দরকার নেই। মেয়েমাত্রই এইরকম হয়। ঝুম্পা-মাম্পিও বাবার দেখাশোনা আদর যত্ন ছাড়াই এমনটাই হয়ে উঠবে। বিমান তাদের বিশেষ আদর দিক বা না দিক তারা বাবাকে ঠিকই যত্নআত্তি, সেবাশুশ্রূষা করবে। কল্যাণবাবুর এটা ভাল লাগে না। তাঁর ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াটা হয়েছে দ্বিতীয় রকম। মেয়েদের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা এবং করুণা। কোনও মেয়েকেই তিনি ঠিক ‘খারাপ’ ভাবতে পারেন না। কেউ যদি নিজেকে ‘মন্দ’ প্রমাণ করে তা হলে সেটা হল ঘটনাচক্র। এমনটাই তাঁর থিয়োরি।

তবু বিমান কিছুটা তাঁর আয়ত্তের মধ্যে। কিন্তু নিখিলকে তিনি ততটা ঘনিষ্ঠভাবে জানেন না। একটু বড় হতে না-হতেই তার বিশাল নিজস্ব বন্ধুবাহিনী হয়ে গেল। লেখাপড়ার জন্যেও সে কখনও বাপের ধার ধারেনি। সবই বন্ধুদের পরামর্শে ও সাহায্যে। বেসরকারি অফিসে এগজিকিউটিভ পদে প্রতিষ্ঠিত হতে তার একটু সময় লাগছিল। বিমানের যে বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন, নিখিলের সে বয়সটা পার হয়ে গেল। তারপর স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি খানিকটা দমেও গিয়েছিলেন। বড় বউমার ব্যস্ততায় তিনি নিখিলকে ডেকে পাঠালেন। উঠতে-বসতে তাঁকে তাড়া দিচ্ছিল মল্লিকা।।

—তোমার এবার বিয়ের একটা ব্যবস্থা করতে হয়। নিজের কেউ পছন্দটছন্দ আছে।

—না।

—তা হলে কি আমরা দেখব?

—হ্যাঁ।

—দেখে প্রাথমিকভাবে পছন্দ হলে তোমাকে বলব দেখে আসতে, না কী?

—হ্যাঁ।

—কোনও বিশেষ চাহিদা আছে তোমার?

—না।

একাক্ষরী এইমতো উত্তরে কল্যাণবাবু আরও দমে গেলেন। কিন্ত দু-চারটি পাত্রীকে ছেলে অপছন্দ করায় বুঝলেন— না, যতটা উদাসীন ভেবেছিলেন, বাবাজি ততটা নয়। শেয়ানা আছে।

জিনাকে প্রথমে তিনি আর মল্লিকা দেখতে গিয়ে ভীষণ পছন্দ করে এসেছিলেন। নিখিলেরও পছন্দ হল।

মেয়েটি মল্লিকার ঠিক উলটো। পরিপূরক যাকে বলে। কল্যাণবাবুর ঘর হাসিতে খুশিতে ভরে উঠল। সবাইকার সঙ্গেই জিনার বন্ধুত্ব। ঝুম্পা-মাম্পি তার ডান হাত বাঁ হাত। একের নম্বরের বন্ধু মল্লিকা। বিমানকেও সে রেয়াত করে না। ‘বটঠাকুর’ বলে ডাকতে শুরু করে তাকে হাসিয়ে ছাড়ল। বিমান বলল ‘দোহাই বউমা সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর, বাঁদর যা খুশি বলো আমাকে, ওই বটঠাকুরটি বলো না’।

—আপনিও তা হলে বউমা বলবেন না। আর ঘোমটা দিয়ে থাকবেন না। একটু সকাল সকাল বাড়িও আসবেন, কেননা আমার ঠিক ন’টায় খিদে পায়। আর… বিমান বলল, তোমার এই শর্তাবলির কি কোনও ল্যাজামুড়ো আছে? না এ চলবেই?

মল্লিকা তো আত্মসমর্পণ করে বসেই আছে। ইগো বলতে মেয়েটার কিছু নেই। কিন্তু জিনার স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান দেখে তিনি চমৎকৃত হলেন। এত সহজে সে দিদিভাইকে ওপরে বসাল অথচ তাকে সব কিছুতে সাহায্য করে সংসারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে দিল যে তার মুনশিয়ানার বাহবা দিতেই হয়। একদিন দেখলেন, বিমান দুই বউমাকে নিয়ে থিয়েটার যাচ্ছে, একদিন কোনও মিউজিক কনফারেন্সে গেল। কল্যাণবাবুকে নিয়েও সে যথেষ্ট টানাটানি করে। কিন্তু তিনি জানেন, বেশি বাড়াবাড়ি ভাল নয়। জিনার ব্যবহারে লোক দেখানো কিছু নেই, এ বিষয়ে তিনি আঠারোআনা নিশ্চিত। কেননা তার দমদমের বাপের বাড়ি একটা নামকরা হুল্লোড়ে বাড়ি। গিয়ে দেখেছেন, মানুষগুলি কতকগুলো নিয়ম মেনে নিজেদের বেশ একত্রে ধরে রেখেছেন। জিনার জ্যাঠামশাই খুব জমাটি লোক। বলেন— বুঝলেন দাদা, আমাদের পিতৃদেবটি ছিলেন বিশেষ শেয়ানা, না হলে পাঁচটি পুত্তুর একেবারে এক পদের হয়? ভাবতে পারেন পাঁচটি ভাই-ই আমরা ইন্দিরা গান্ধীর ন্যাশন্যালাইজেশনের সুফল পেলুম একেবারে নিক্তি মেপে? বড় দু’জন আমরা অয়েলে, ছোট তিনটি ব্যাংকে। দুটি বোন, কেউ কারও চেয়ে কম বুঁচি নয়। ঈশ্বর এবং পিতৃদেব উভয়ে ষড়যন্ত্র করে যদি একান্ন পীঠের আইডিয়্যাল কনস্টিট্যুশন তৈরি করে থাকেন তো একটা প্রমোদ বা একটা প্রবীর নাগের বা তাদের নাগিনীদের সাধ্য কী তা নাকচ করে?

জিনার জেঠিমা-ও খুব রসিক মানুষ। তিনি বললেন—শুধু তাই না কি? জানেন দাদা, আমার আর মেজর বিয়ে হয়ে গেছে, সেজর জন্যে কত অপ্সরী, বিদ্যাধরী আসছে। কে কলেজ লেকচারার, কে ডক্টরেট, কে ডাবলু বি. এস. এস, কে দুধেআলতা, কে বা তপ্তকাঞ্চন, ইনি ঘটককে কী বললেন জানেন? —উহুঁ, এসব চলবে না। ঘটক বললে—পাত্রী খারাপ হল? কত খুঁজেপেতে আনলুম। তা ইনি বললেন—পাত্রী সব সোনার চাঁদ। রাজরানি হোক। সে কথা নয়, আমার আর আমার মেজভাইয়ের পত্নী উভয়েই খেঁদিবুঁচি, কোনওমতে পাস। তা সেজভাইয়ের কি বউদিদিদের মনে দুঃখু দিয়ে অপ্সরী বিদুষী বিয়ে করা উচিত? ভাল করে দেখে শুনে পাঁচাপাঁচি আনুন। পাঁচাপাঁচি আনুন।

সেই বাড়ির মেয়ে হয়ে লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতকের ম্যাজিক তাঁর ছোট বউমা আয়ত্ত করেই এসেছে। তার ওপরে, সে কোনওদিক দিয়ে সত্যি সত্যি লঘিষ্ঠ নয়। গুণের সঙ্গে যদি কাণ্ডজ্ঞান ঠিক পরিমাণে মেশে তা হলে একটা জিনা তৈরি হয়। কল্যাণবাবু বড় বউমাকে ভালবাসেন। ভালবাসার সঙ্গে একটু করুণা, মমতা মিশে থাকে। কিন্তু ছোট বউমাকে তিনি বেশ অ্যাডমায়ার করেন, গর্ব করার কারণ খুঁজে পান। তবে তিনিও খুব কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন, বিবেচক মানুষ, মনের কোনও ভাবই কখনও মুখে প্রকাশ করেন না। আরতি থাকলে হয়তো কোনও দাম্পত্য আলাপের দুর্বল মুহূর্তে বলে ফেলতেন। কিন্তু সে-পরিস্থিতি না থাকায় তাঁর ব্যবহারে বিচক্ষণতা, সমদর্শিতা, প্রসন্ন সহযোগিতা ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাওয়া শক্ত।

তবু যে, ছোট পুত্রের বিয়ের বছর দুইয়ের মধ্যে বাড়ি ভাগ করতে হল, তার জন্যে কল্যাণবাবু পুত্রবধূদের দায়ী করেন না। সমস্তটাই তাঁর গোঁয়ার, দুর্মুখ ছোট পুত্রেরই কীর্তি। এখানে আর দ্বিতীয় কোনও পক্ষ নেই। একটা সুখী পরিবারের মধ্যে থেকেও বেয়াড়া সন্তান বেরোতে পারে দেখা যাচ্ছে। চমৎকার শান্তি আর আনন্দের পরিবেশ ছিল। নিখিল চন্দরের সেটা পছন্দ হল না। তার বউ যে সবার বন্ধু হবে, সবার সঙ্গে হেসেখেলে থাকবে এটা তার চক্ষুশূল হল। সে জিনাকে তার একার সম্পত্তি করে রেখে দিতে চায়। এমন অশান্তি, অভদ্রতা শুরু করল যে বিরক্ত হয়ে তিনি বাড়ি ভাগ করে দিলেন। তাঁর ঘরটা পড়েছিল জিনাদের অংশে। ছেড়ে চলে আসছিলেন। ছোট বউমাই কেঁদে কেটে আটকাল। পুরো ব্যাপারটা তাঁর অত্যন্ত অরুচিকর ঠেকেছে। অরুচিকর এবং অপ্রয়োজনীয়। সন্দেহ নেই, অন্যদেরও তাঁরই মনোভাব। ঝুম্পা-মাম্পির স্বতঃস্ফূর্ততা কমে গেছে। তারা আর কাকিমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করছে বলে মনে হয় না, বিমান আবার নিজের অ্যালফা-বিটা ক্লাবে ফিরে গেছে, মল্লিকা একা। জিনা আরও একা। কেননা, আশ্চর্যের বিষয়, নিখিল জিনাকে যৌথ পরিবার থেকে ছিঁড়ে আলাদা করে ফেললেও, খুব যে বউকে সময় দেয়, এমন মনে হয় না। আগে ফিরত নটা, এখন দশটা, কখনও কখনও এগারোটাও হয়ে যায়। আগেও জিনাকে নিয়ে মাঝে মাঝেই বেরোত, এখনও বেরোয়, নতুনের মধ্যে, বাড়িতে বন্ধুবান্ধবদের খুব ডাকে। এবং বছর পাঁচ-ছয় হয়ে গেল ওদের কোনও বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। অর্থাৎ ‘ম্যান প্রপোজেস গড ডিসপোজেস’ বলে আপ্তবাক্যটির যে আধুনিক পাঠ তৈরি হয়েছে ‘ম্যান প্রপোজেস, উয়োম্যান ডিসপোজেস’ বলে, তার একটি আধুনিকতর ও বিশেষ পাঠ তৈরি হতে দেখলেন কল্যাণবাবু! ‘ওয়ান ম্যান প্রপোজেস, অ্যানাদার ম্যান ডিসপোজেস।’ অবশ্য তাঁর কোনও কৃতিত্ব কোনওদিনই সেভাবে ছিল না। পরিবারটা তাঁর আপনা থেকেই হয়ে উঠছিল। তাঁর ভূমিকাটা ছিল শুধু তাকে রক্ষা করবার। সে ভূমিকা তিনি পালন করেছেন। সবাইকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন। কোনও জায়গাতেই কঠোর কর্তৃত্ব ফলাতে যাননি। তাঁরই ছোট পুত্র যে সেই সংসারকে সম্পূর্ণ বিনা কারণে এভাবে দু টুকরো করে দেবে, দিতে পারবে, এ তিনি কখনও ভাবেননি। হ্যাঁ, কোনও না কোনওদিন হয়তো দরকার পড়ত। দুই ভাই যখন। তখন ভবিষ্যৎ হাঙ্গামা এড়াতে তিনি নিজেই হয়তো দুজনের অংশ আলাদা করে নির্দেশ করে দিয়ে যেতেন। কিন্তু নিখিল যা করল, তার কোনও মানে হয় না। সেই নিখিল তাঁর আঙুল ধরে হেদুয়ায় বেড়াতে যেত। সেখানেই সাঁতার শিখল বেশ ছোট বয়সেই। তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার ডাইভ খাওয়া না দেখলে বাবুর রাগ হত। আর ঠাকুর দেখতে যাওয়া? ওরে বাবা! ‘ও বাবা, ফায়ার ব্রিগেড হয়নি।’ ‘ও বাবা মহম্মদ আলি পার্কে রাত্তিরবেলায় নিয়ে চলো।’ ‘ও বাবা কাল সাউথে নিয়ে যেতে হবে!’ কত বায়না! কবে থেকে, কখন থেকে, কেন যে বাপের সঙ্গে তার অসম্পর্ক তৈরি হল তিনি ভেবে পান না। বড় হয়ে গেলে ছেলেরা আর বাপের কাছে ঘেঁষে না, তাদের নিজের নিজের মতো চলতে দেওয়াই ভাল, এটা তিনি মানেন। এমন সেন্টিমেন্টাল লোক নন যে কথায় কথায় অভিমান করবেন। কিন্তু নিখিলের আচরণটা তাঁর হিসেবে মেলে না। জিভের ভেতর একটা বাজে কষা মতো স্বাদ বরাবরের জন্যে রেখে দিয়ে গেছে যেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *