আবারও কেনেথ এডওয়ার্ড জনসন, জিম ক্যালান এবং প্রসঙ্গত আইভ্যান স্যুরিটা

আবারও কেনেথ এডওয়ার্ড জনসন, জিম ক্যালান এবং প্রসঙ্গত আইভ্যান স্যুরিটা

শিকারে অনেক বন্ধু পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার কিন্তু অত্যন্ত বড় আমলা হয়েও বন্ধুত্ব, বিশেষ করে জঙ্গলের বন্ধুত্বকে এমন দাম দিতে Ken Johnson ছাড়া কম মানুষকেই দেখেছি।

উনি আমার চেয়ে বয়সে কম করে বারো থেকে পনেরো বছরের বড় ছিলেন কিন্তু এমন উষ্ণহৃদয়ের বন্ধুতা আমলাদের কাছ থেকে খুব কমই পেয়েছি। ঈশ্বর এবং মা—বাবার আশীর্বাদে সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডায়রেক্ট ট্যাক্সেসের অনেক চেয়ারপার্সনকে (পুরুষ এবং মহিলা) এবং অগণ্য মেম্বারের সঙ্গে বন্ধুতা হয়েছে কিন্তু কেন জনসন এবং তাঁর স্ত্রী জিন—এর মতো হৃদয়ের ঔদার্য কারও মধ্যে দেখেনি। কোনওরকম গুমোর দেখেনি তাঁর মধ্যে, একমাত্র সততার ন্যায্য গুমোর ছাড়া। স্বভাবে এক নম্বরি স্পোর্টসম্যান। ‘স্পোর্টসম্যান’ বলতে কী বোঝায় তা কেনকে দেখে শিখতে হত।

অন্যত্রও বলেছি, আমার সঙ্গে প্রথম আলাপ নামনি আসামের ধুবড়িতে, যখন উনি আসামের কমিশনার অফ ইনকাম ট্যাক্স। তারপর উনি পশ্চিমবঙ্গের এক নাম্বার কমিশনার হয়ে আসেন এবং বহুদিন থাকেন। ওই পদ থেকেই সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডায়রেক্ট ট্যাক্সেসের মেম্বার হয়ে দিল্লিতে যান। ওঁরই চেয়ারম্যান হওয়ার কথা ছিল কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনের আগে একজন অন্যরকমের মানুষের দরকার ছিল। তাই জনসনকে টপকে তাঁকে চেয়ারম্যান করা হয়। পরে অবশ্য জনসন সাহেবকে ডেকে ইন্দিরা বলেন যে শিগগিরই ব্যাঙ্কিং সার্ভিস, কমিশন সেট—আপ করে সেই কমিশনের চেয়ারম্যান করবেন তাঁকে—পাঁচ বছরের ট্রেনিংও—। ওঁর প্রতি যে অন্যায় করেছেন তার প্রতিকার হিসেবে। কিন্তু মেমসাহেব সেবার নির্বাচনেই জিততে পারলেন না তাই কথা রাখা হয়নি।

কেন—এর দাদা ছিলেন লেসলি জনসন, আই সি এস, পশ্চিমবঙ্গের এককালীন রাজ্যপাল ধরমবীরের ব্যাচমেট। লেসলি শেষজীবনে ওএনজিসি—র চেয়ারম্যান ছিলেন। আমি অবশ্য কেন—এর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একতলা ভাড়াবাড়িতে একবারই দেখি লেসলিকে। জনসন সাহেব তোপচাঁচিতে একটি লেপার্ড মেরেছিলেন সেই উপলক্ষে একটি ছোট পার্টি দিয়েছিলেন—লেসলি তখন কলকাতাতে থাকাতে লেসলিকেও বলেছিলেন।

কেন—এর পছন্দ—অপছন্দ অত্যন্ত তীব্র ছিল। যাকে পছন্দ করতেন তাকে ভীষণই পছন্দ করতেন—আর যাকে পছন্দ করতেন না একেবারেই করতেন না। বলতেন, দেয়ার আর ওনলি টু কাইন্ড পিপল হিয়ার, গুড অ্যান্ড ব্যাড—নো—ওয়ান ইন—বিটুইন।

কেন—এর সঙ্গে আমি শিকারে গেছি নামনি আসামে, সুন্দরবনে, ওড়িশার কালাহান্ডিতে, সুন্দরবনে, পাখি মারতে গেছি ধাপা এবং নানা মাছের ভেড়িতে, বহরমপুরের ধুলিয়ানের গঙ্গায় এবং আরও অন্যান্য জায়গাতে। তার মধ্যে শুধু কালাহান্ডির গল্প বলব। ওড়িশার কালাহান্ডিতে খুব কম বাঙালি শিকারিরই যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে বলে জানি। বিখ্যাত শিকারি ও ব্যারিস্টার, প্রমথ চৌধুরির আত্মীয় কুমুদ চৌধুরি, যাঁর নানা শিকারের বই একসময়ে বিখ্যাত ছিল, তিনি ওই কালাহান্ডিতে শিকারে গিয়েই বাঘের হাতে নিহত হন। কালাহান্ডিও সুন্দরবনেরই মতো মানুষখেকো বাঘের জন্যে কুখ্যাত ছিল। আমি নিজচোখে দেখেছি বলেই জানি। এই কালাহান্ডির মানুষদের মুখেই ‘বাঘ মুণ্ডার’ কথা আমি প্রথমবার শুনি। ওদের বিশ্বাস যে—সব মানুষ মানুষখেকো বাঘের হাতে মারা যায় তারা ভূত হয়ে যায়। ছোট একটি পাখির রূপ ধরে রাতের বেলা গভীর বনের মধ্যে তারা ডেকে ওঠে—কিরি—কিরি—কিরি—ধূপ— ধূপ—ধূপ— ধূপ—ধূপ।

আমার ‘নগ্ন নির্জন’ উপন্যাসে ওই বাঘ্বমুণ্ডার উল্লেখ আছে। ‘নগ্ন নির্জন’ আনন্দবাজারের দোল সংখ্যাতে প্রকাশিত হয় ষাটের দশকের শেষাশেষি। নর্থ বেঙ্গলের কমিশনার, দুর্গাকাকুর বন্ধু এবং পিয়ারসন স্যুরিটার দাদা আইভান স্যুরিটা তাঁর ফোর সেভেন্টি ফাইভ ডাবল ব্যারেল রাইফেলটি এবং হাজারিবাগের প্রফেশনাল শিকারি টুটু ইমামের আমেরিকান খদ্দেরদের আনা অনেকগুলি নতুন গুলি আমাকে দেন। ফর আ সঙ। সেই রাইফেলটি নিয়েই কেন—এর সঙ্গে আমি কালাহান্ডিতে যাই বাঘ মারতে। সেই রাইফেলটিরও একটি বড় ভূমিকা আছে ‘নগ্ন নির্জন’—এ।

কেন জনসন—এর সঙ্গে সেবারে তার বিশেষ বন্ধু স্কটসম্যান জিম ক্যালানও যান। জিম তখন কলকাতার ব্রিটিশ হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি। জিম ইংল্যান্ডে খেঁকশিয়ালও শিকার করেননি কিন্তু ভেবেছিলেন কালাহান্ডিতে গিয়ে বাঘ মারবেন। তাও মানুষখেকো। জিম—এর জন্যে, কেন—এর অনুরোধে, বাবার একটি জলের কল হয়ে যাওয়া অর্ডিনারি থ্রি সেভেন্টি ফাইভ সিঙ্গল ব্যারেল রাইফেল ছিল, সেটি নিয়েছিলাম। নলের রাইফলিং জলের কলের মতো মসৃণ হয়ে গেছিল বলছি এই জন্য যে পালামৌর কুমান্ডিতে খুব কাছ থেকে একটি প্রায় ঘোড়ার মতো স্পটেড ডিয়ারকে পেছনে কোমরের কাছে গুলি করাতে সে পেছনের ডানদিকের ঠ্যাংটি রাইফেলের প্রতি ঘেন্নাতে একবার ঝেড়ে দিয়ে ভোঁ দৌড় লাগিয়েছিল।

তবে আইভানের রাইফেল নিয়েও কালাহান্ডিতে গিয়ে ঝামেলাতে পড়েছিলাম। বহিরঙ্গে অত সুন্দর রাইফেল কিন্তু ডান ব্যারেলের স্ট্রাইকিং পিন কাজ করছিল না এবং বাঁদিকের ব্যারেল চারহাত বাঁয়ে ফায়ার করছিল। আসলে আমারই ভুল হয়েছিল। যে কোনও রাইফেল কিনে, রেঞ্জে গিয়ে, ‘জিরোয়িং’ করতে হয়। তা না করেই মানুষখেকো বাঘেদের সঙ্গে টক্কর দিতে কালাহান্ডিতে চলে এসেছিলাম।

রাইফেলটা নিতে যেদিন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পেছনে পিয়ার্সন স্যুরিটার বাড়িতে গেছিলাম দেখলাম আইভান লুঙি পরে বারান্দার মেঝেতে বসে নাপিত ডেকে চুল কাটছেন আর সামনে চেয়ারে বসে আছেন ডেসমন্ড ডয়েগ, কিংবদন্তি চিত্রকর, আর মাঝে একটি শ্বেতপাথরের গোলাকার টেবিলের ওপরে গোটা দশেক নানা রঙের পানীয়—ভর্তি বোতল—কটেজ চিজ—এর একটি বড় স্ল্যাব আর বড় বড় দু’প্যাকেট বিস্কিট।

কালাহান্ডিতে যাওয়ার জন্যে মাদ্রাজ মেলে উঠলাম। ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্ট। ফোর বার্থ। জিম ক্যালান এক কেস হোয়াইট হর্স হুইস্কি এবং চার কেস বেকস বিয়ার নিয়েছিল—কনস্যুলেটের মাল। আর আমি আমাদের মক্কেল কল্যাণী ব্রুয়ারিজ—এর তৈরি এক বস্তা—মানে আটচল্লিশ। বেতাল ব্ল্যাক লেবেল বিয়ার। ওই ব্রান্ড তখন সবে বাজারে এসেছে রাতানজি সাহেবের কল্যাণে। এবং খুবই জনপ্রিয়ও হয়েছে।

জিম, ট্রেন ছাড়তেই হুইস্কির বোতল খুলে নিট হুইস্কি গ্লাসে ঢেলে খেতে শুরু করল। জল দিয়ে। খড়গপুরে ডিনার আসার পরে কফি খেয়ে কফির কাপ ভর্তি হুইস্কি পান করে গুডনাইট বলে শুয়ে পড়ল।

আমি প্রমাদ গুনলাম। কারণ এ মক্কেলকে আমারই সামলাতে হবে।

আইভানের দেওয়া রাইফেল গোলমাল করেছিল বটে কালাহান্ডিতে কিন্তু টুটু ইমানের মক্কেলদের আনা গুলি খুবই কাজে লেগেছিল শুধু আমারই নয় অন্য অনেকেরও। এ গুলি তখন কলকাতাতে পাওয়া যেত না। এবারে আনন্দ পুরস্কার পাওয়া ‘হাতির বই’—এর লেখক ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরি নিয়মিত আমার কাছ থেকেই গুলি নিয়ে যেতেন জঙ্গলে যাওয়ার আগে। অবশ্য দাম দিয়েই নিতেন। তাঁরও একটি ফোর সেভেন্টি ফাইভ ডাবল ব্যারেল রাইফেল ছিল। জানি না, আগে বলেছি কিনা পৃথিবীবিখ্যাত আফ্রিকান হোয়াইট হান্টার জন টেইলর যাঁকে আফ্রিকাতে লোকে ‘পন্ডোরো’ বলে জানত, তাঁর বিখ্যাত শিকারের বইয়ে লিখেছিলেন যে ওই রাইফেল দিয়ে যদি হাতির লেজের গোড়াতে গুলি করা যায়, তবে তা সমস্ত দেহ ভ্রমণ করে মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছবে। এতই শক্তিশালী ছিল ওই রাইফেল। গুলির চেহারাও তেমনই ছিল আর মনোগ্রাম—করা কোনও রাজা—মহারাজার জন্যে কাস্টম—বিল্ট সেই রাইফেল ছিল দেখারই মতো। ওজনও ছিল চোদ্দো পাউন্ড। কোনও স্লিং ছিল না। গান—বেয়ারারাই বইত ওসব রাইফেল।

আমরা ভিজিয়ানাগ্রাম স্টেশনে নামলাম শেষ সকালে। সেখানে বেহরামপুর গঞ্জামের ইনকাম ট্যাক্সের কমিশনার ভৌমিক সাহেব এবং শ্রী রায় নাইডু নামের এক ভদ্রলোক আমাদের বাখ্যাতির সার্কিট হাউসে নিয়ে গেলেন। সেখানে বিয়ার সহযোগে পোলাও—মাংস দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে রওনা হলাম বাড়িতে।

এখন অরাকু উপত্যকার নাম অনেকে জানে। ভ্রমণার্থীদের কাছে অরাকু উপত্যকা একটি জনপ্রিয় গন্তব্য কিন্তু তখন কেউ ও সব জায়গার নামও জানত না। ষাটের দশকের মাঝামাঝি। যেমন সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য পথের, তেমনই বন—পাহাড় ঘেরা আঁকাবাঁকা ঘাট—পথ। শ্রীকাকুলামে পৌঁছে পথপাশের দোকান থেকে কফি খেয়ে সন্ধের পরে আমরা রায়গড়াতে স্ট্র—প্রডাক্টের অতিথিশালাতে গিয়ে পৌঁছলাম। চমৎকার গেস্ট হাউস—স্কচ এবং সাহেবি ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরদিন দুটি জিপ নিয়ে আমরা কাশীপুরের দিকে চললাম। ওই বনবাংলোই আমাদের জন্যে বরাদ্দ ছিল। আমরা যাব বলে জেপুর থেকে দুজন ইনকাম ট্যাক্সের ইনস্পেক্টর আমাদের খাওয়া—দাওয়ার তদারকির জন্যে এসে ক্যাম্প করে ছিলেন এবং একজন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার, তাঁদের খবরদারি করতে।

কালাহান্ডিতে এক আশ্চর্য ব্যাপার দেখেছিলাম। বাঘ শিকারের জন্যে তারা গরু—মোষের বদলে পাঁঠাকেই অধিকাংশ সময়ে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে এবং একটি ছোট মাচা বানিয়ে পাঁঠাটিকে সেই মাচার ওপরে তুলে বেঁধে রাখে। কালাহান্ডির বাঘ চোখে কম দেখে বলে, নাকি বনের গভীর আন্ডারগ্রোথের কারণে দেখতে পায় না বলেই চলে। কেন এরকম করা হয় তা বলতে পারব না। তবে আমরা তিন—চারটি গ্রামে মাচায় বসেছিলাম কিন্তু বাঘ আসেনি। যেখানেই আমরা গেছি সেখানেই মানুষখেকোর অত্যাচারের গল্প শুনেছি। কোনও গ্রামে একমাস আগে মানুষ নিয়েছে, কোনও গ্রামে সাতদিন আগে কিন্তু মানুষ বাঘের পেটে যায়নি এমন গ্রাম কমই আছে। জিম করবেট যেমন পনেরো কুড়িদিন বা মাসাধিককাল একটি বাঘের পেছনে লেগে তাঁকে মারতেন তেমন করা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রথমত সেই স্তরের শিকারি আমরা কেউই ছিলাম না, দ্বিতীয়ত আমরা গেছিলামই তিন রাতের জন্যে।

ওখানকার মানুষ তো বড় গরিব। হয়তো কখনও অনাহারে বা কোনও মারণ ব্যাধিতে মৃতদেহ দাহ করতে পারত না ওরা, সেই সব মৃতদেহ বাঘে খেত এবং অমনি করেই এদিকের সব বাঘ মানুষখেকো হয়ে উঠেছিল। কালাহান্ডির রাজা ব্যারিস্টার কুমুদ চৌধুরির মক্কেল ছিলেন বলে শুনেছিলাম। তাঁর বইয়ে বার বার করে শিকারিদের বাঘকে গুলি করে মাচা থেকে নামতে বারণ করা সত্ত্বেও উনি নিজে দিনের বেলায় হাঁকা শিকারে মাচা থেকে বাঘকে গুলি করার পরে মাচা থেকে নামতেই বাঘ এসে তাঁকে ধরে এবং শেষ করে দেয়।

এখানের ভয়াবহ বাঘকে স্থানীয় মানুষে যত না ভয় পেতে দেখেছি তার চেয়েও বেশি ভয় পেত তারা বাঘ্বমুণ্ডাকে।

কালাহান্ডির প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য আছে। বিরাট বিরাট অনেক কাছিমপেটা পাহাড় অথচ তার ওপরে কোনও গাছপালা নেই। উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুনের কোনও কোনও অংশ (যেমন আলমোড়ার পাহাড়ের মতো) তেমন। অবশ্য যেখানে আছে, যেখানে গভীর জঙ্গল আছে। এই সমস্ত অঞ্চলই খুব উষর,তাই জলাভাব এখানে খুবই। প্রতি বছর খরা—কবলিতও হয়।

কালাহান্ডিতে আমাদের পথপ্রদর্শক এবং গাইড হিসেবে যাকে রায় নাইডুবাবু ঠিক করে দিয়েছিলেন সে ছিল দণ্ডকারণ্যর সরকারি শিকারি—নাম রামচন্দ্র দণ্ডসেনা। কেন—এর দাদা লেসলি যখন দণ্ডকারণ্য প্রজেক্টের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ছিলেন সেই সময়েই দণ্ডসেনা বহাল ছিল। আমরা যখন তাকে দেখি সে তখন অবসর নিয়েছে। তাকে ওড়িয়াতে বললাম যে, তোমার বড়সাহেবের ছোট ভাই বাঘ মারতে এসেছে, তাকে একটা বাঘ মারিয়ে দাও। সে হেসে বলল, আপনি তো সব জানেন। বাঘ কি বাঁধা থাকে? তবু চেষ্টা করব।

ওই দণ্ডসেনা আমাদের একটি গল্পের কথা বলেছিল। শেষের আগের দিন সে আমাদের এমন একটি জায়গাতে নিয়ে গেল যেখানে গভীর জঙ্গল আর অনেক গুহা। নিচে সমতলে হলুদ সর্ষে ক্ষেত। ডিসেম্বর মাস—চারদিক হলুদে হলুদ হয়ে রয়েছে।

দণ্ডসেনা বলল, এই অঞ্চলে একটি পাহাড়ি নালার মধ্যে একটি বাঘ গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর যুবতীকে ধর্ষণ করেছিল এবং এই ঘটনা তখন থানাতে ডাইরিও করা হয়েছিল। দণ্ডসেনা মিথ্যা কথা বলার মানুষ নয়—যদিও ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। কেন বলল, গ্রামের কোনও বদমায়েশ ছেলে ওই কর্ম করে মেয়েটিকে দিয়ে বাঘের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে ছিল। আমি কলকাতাতে ফিরে ‘দ্য স্টেটসম্যান’—এ ওই ঘটনার উল্লেখ করে একটি চিঠি দিই। সেই সময়ে কৃষ্ণান সাহেবের অসামান্য সাপ্তাহিক কলাম প্রকাশিত হত বন ও বন্যপ্রাণীদের ওপরে। কৃষ্ণান সাহেব আমাকে বেইজ্জত করে এক সপ্তাহে ওই চিঠিটির প্রেক্ষিতেই কলাম লিখলেন। উনি লিখেছিলেন, অনেক সময়েই বনাঞ্চলের মেয়েরা ভাল্লুক বা হনুমান দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে এমন খবর আছে কিন্তু বাঘের পক্ষে তা করা অসম্ভব। উনি লিখেছিলেন, ‘সাচ আ হ্যাপেনিং ইজ অ্যানাটমিক্যালি ইমপসিবল’।

খুবই বোকা বনেছিলাম।

কেন জনসন—এর সাহস দুর্জয় ছিল, হাতও খারাপ ছিল না এবং বড় বাঘ মারারও খুব শখ ছিল কিন্তু বাঘ দেখলেই কেন ভয়ে একেবারে প্যারালাইজড হয়ে যেতেন। গুলি করতেই পারতেন না এবং করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা লাগত না। ‘কেন’—এর সঙ্গে নামনি আসামের যমদুয়ারে এবং কালাহান্ডিতে দু—দুবার বড় বাঘের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কালাহান্ডিতে শীতের রাতে বাঘ বসেছিল হলুদ সর্ষে ক্ষেতের ওপরে লক্ষ্মী কুকুরের মতো। হয়তো যোগাব্যায়াম করছিল—তখন তো রামদেব বাবা আসেননি, হয়তো অন্য কোনও বাবার শিষ্য হয়ে। এমন সময়ে অনেক গড়িমসি করে (গুলি না করলেও নয়, এতজন সাক্ষী রয়েছে) ট্রিগার তো টেনে দিলেন আর গুলি গিয়ে লাগল বাঘের পেটে। পেটে গুলি লাগলেই, বাঘ কি চিতা একেবারে সোজা ওপরে লাফিয়ে ওঠে এবং সাক্ষাৎ যম হয়ে যায় কারণ তার সামনের দুটি হাত এবং পেছনের দুটি পা অক্ষত থাকে মুখ ও দাঁতও ব্যবহারযোগ্য থাকে। সে রাতে হুডখোলা, কাচ নামানো আমেরিকান আর্মি ডিসপোজালের জিপে উঠে বাঘ আমাদের ছিন্নভিন্ন করে দিত কারণ সে বিদ্যুৎগতিতে আমাদের দিকে ধেয়ে এসেছিল যদি না জিম ক্যালান অনভিজ্ঞ এবং দুঃসাহসী শিকারি বাবার জলের কলটি দিয়ে তার দিকে গুলি না করতেন। গুলি গিয়ে পড়েছিল বাঘের নাকের সামনে আর তাতেই বাঘজীবন জিপে উঠে আমাদের ফর্দাফাঁই না করে কাঁচা পথ ধরে সামনের দিকে দৌড়তে থাকে। জনসন সাহেব সামনের সিটে ম্যাগাজিনে পাঁচটি গুলি নিয়ে স্থাণুর মতো বসেছিলেন—একটি গুলিও যদি বাঘকে করতেন তবে সে পথের ওপরেই পড়ে যায়। কিন্তু বাঘ যে কী জিনিস যারা জংলি বাঘ (অভয়ারণ্যের) পোষা বাঘ নয়, দেখেছেন শুধুমাত্র তাঁরাই জানেন। স্থাণুর মতো বসে থাকা জনসন সাহেবের সামনে প্রায় পঞ্চাশ গজ দৌড়ে বাঘ পথ ছেড়ে ডানদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল।

ফোর টুয়েন্টি থ্রি সিঙ্গল ব্যারেল রাইফেলের মার। বাঘের পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল। ও বাঘের বাঁচার আশা ছিল না এবং মানুষ ও প্রাণী সকলেই যখন আহত হয় তখন নিজের ঠিকানায় ফেরার চেষ্টা করে—তাই বাঘও তার ডেরার দিকে দৌড়ে ঢুকে গেল।

দুর্গাকাকু ক্যাম্পস্ট্রাইক করে রায়গড়ার দিকে চলে গেছিলেন সব জিনিসপত্র নিয়ে। আমাদের সকলের টিকিট কাটা ছিল পরদিন মাদ্রাজ মেলে। রাতটা রায়গড়াতে থেকে ভোরে রওনা হয়ে আমরা ভাইজাগ থেকে ট্রেন ধরব। প্রত্যেকেরই জরুরি কাজ আছে, দুর্গাকাকুর ছাড়া।

আমরা দণ্ডসেনাকে প্রচুর গুলি এবং টাকা দিয়ে একটি জিপ দিয়ে রায়গড়া থেকে ফেরত পাঠালাম যাতে পুবের আলো ফুটতে না ফুটতে ও স্থানীয় মানুষজন এবং বেপাশী বন্দুকধারী শিকারিও যদি কেউ থাকে, এক বা একাধিক, রক্তের দাগ দেখে বাঘটাকে অনুসরণ করে চামড়াটা উদ্ধার করতে পারে।

কলকাতাতে ফিরে ভৌমিক সাহেবের টেলিগ্রাম পেলাম জনসন সাহেবকে করা, ‘কারকাস ফাউন্ড অ্যাট দ্যা মাউথ অফ দ্যা কেভ কনগ্র্যাচুলেশনস।’

তখন জনসন সাহেব বম্বেতে তাঁর শ্বশুর—শাশুড়ির কাছে ক্রিসমাস কাটাতে গেছেন। ওর পি এ, মিস্টার এ এল সুদ টেলিগ্রামটি আমার কাছে নিয়ে এলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে একটি চিঠি লিখে টেলিগ্রামটি সঙ্গে দিয়ে বম্বের ঠিকানাতে পাঠিয়ে দিলাম। ফোন নাম্বার জানা ছিল না।

জনসন সাহেবের শ্বশুরমশাই ডাক্তার ছিলেন। তাঁরা পরে বাঙ্গালোরের কাছে হোয়াইটফিল্ডে থিতু হন অবসরের পরে। জনসন সাহেবের ছেলে ইয়ানও ডাক্তার হয়েছে এবং খুব ভাল ডাক্তার। সে আজ প্রায় তিরিশ বছরের বেশি স্টেটসে সেটল করেছে। মেয়ে মার্গারেট, সুন্দরী ইয়াং লেডি, প্রথম বিয়ে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর আবার বিয়ে করেছে কিনা জানি না। জনসন সাহেব অসময়ে চলে যাওয়ার পরেও আমি বম্বে বা বাঙ্গালোরের মক্কেলদের মাধ্যমে জিন—এর জন্যে ক্রিসমাসে স্কচ হুইস্কি পাঠাতাম। ওই স্বামী—স্ত্রীর কাছ থেকে আমি যা ভালবাসা ও উষ্ণ ব্যবহার পেয়েছি তা আমার নিজের দাদা বউদির (যদি থাকতেন) কাছ থেকেও পেতাম কি না জানি না। বহুদিন জিন—এর চিঠি পাই না। জানি না, তিনি আছেন কি না।

শিকারি কেনেথ অ্যান্ডারসনের নানা গল্প শুনতাম জিন—এর কাছ থেকে। অ্যান্ডারসনের বাড়িও ছিল হোয়াইটফিল্ডেই।

কালাহান্ডির পটভূমিতে লেখা আমার একটি ঋজুদা কাহিনি আছে ‘অরাটাকিরির বাঘ’। কল্পিত জায়গা না, অরাটাকিরিতে আমরা গেছিলাম কাশীপুর থেকে।

___

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *