নৈশপর্ব

নৈশপর্ব

এখন যেখানে মুক্তবায়ু সেবন হচ্ছে, সেখানে ভাগাড় ছিল। ওই অঞ্চলটা ছিল কচুরিপানা অধ্যুষিত নিচু জমি। লোকেরা জানত শীলেদের ডোবা। এখন শীলভদ্র আবাসন। শীলভদ্রের ভদ্রলোকেরা পূর্বতন ভাগাড়, অধুনা বিহারিকায় প্রাতঃবিহার করছেন, অনেকেরই পায়ে কেড্‌স, কেউ আবার ট্রাক স্যুট পরেছেন যদিও, স্যুটের ভিতর থেকে ভুঁড়িটা ফুটে বেরুচ্ছে, হাফ প্যান্টও আছেন। মহিলাদের মধ্যে শাড়ি আছেন, উচ্চাঙ্গে তোয়ালে চাপানো ম্যাক্সি আছেন, শালোয়ার কামিজও আছেন।

মহিলারা যতই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, সমাজ-সামঞ্জস্যের জন্য, বা আরও কতকিছুর জন্য চেঁচান না কেন, নিজেরাই মূলস্রোতে মিশতে চান না। কোনও সভাসমিতিতে গেলে দেখা যায় কিছু মহিলা এক জায়গায় একজোট হয়ে আছেন। মিছিলেও তাই, এমনকী পিকনিকেও। এই মাঠেও মহিলারা একটি নির্দিষ্ট কোনায় সমবেত। মহিলারা স্কিপিং করেন না, বুকডন দেন না, বিহারিকায় কিছুক্ষণের জন্য বিহার করেন, যাদের ঘাড়ে স্পন্ডেলোসিস হয়েছে, ঘাড় ঘোরানোর ব্যায়ামে তারা তপন মিত্র-শ্যামল দত্তদের একটু-আধটু দেখেন ও একটু-আধটু মন্তব্য করেন— যতই লাফাক, ওর ভুঁড়ি কমবে না, কিংবা শোনো, উনি না পার্লারে যান, ফেসিয়াল করতে দেখেছি, কিংবা কী মেসোমশাই কেমন আছেন… এইসব কথাবার্তা বলে ব্যায়াম সাঙ্গ করেন।

এই মেসোমশাইরা, মানে বয়োবৃদ্ধদেরও এরকম একটা মাইনরিটি ফিলিং হোক বা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স হোক, কিছু একটা আছে। ওঁরাও মাঠের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সমবেত হন। নিজেদের সুগারলেভেল, কোলেস্টেরল, ব্লাডপ্রেসার ইত্যাদির সংখ্যাতত্ত্ব বিনিময় করেন, দাঁত তোলার পর দাঁত বাঁধানো উচিত নাকি উন্মুক্ত মাড়িই ভাল। প্রস্টেটের জন্য ঢ্যাঁড়শ উপকারী নাকি ক্ষতিকর— ইত্যাদি ব্যাপারে কিঞ্চিৎ ডিবেট। আজকালকার গৃহবধূদের আর তেমন গৃহকর্ম করতেই হয় না— এ ব্যাপারে মতৈক্য শেষে যে যার বাড়ি ফেরেন।

এই যে বিহারিকা, মুক্তবায়ু সেবনের মাঠ, এখানে নারী-পুরুষ বৃদ্ধ নিয়ে জনা ত্রিশেক লোক সমাগম হয়, তারমধ্যে সাত-আট জন বৃদ্ধ। চকচক করলেই যেমন সোনা হয় না, তেমন চুল পাকলেই, কিংবা দাঁত পড়লেই বৃদ্ধ হয় না, —এমনকী পেনশন নিলেও বৃদ্ধ হয় না। পরিমল সেন অন্তত তাই মনে করেন। বৃদ্ধত্বের কি কোনও সংজ্ঞা আছে? রেল কোম্পানি ৬৫ বছর বয়েস হলে কনসেশন দেয়। আবার অফিস-টফিসগুলোতে কোথাও ৫৮, কোথাও ৬০ হলে অবসর নিতে হয়। কিন্তু তমোনাশবাবু তো ৬৭ বছর বয়েস। এখনও জিন্‌স পরেন, চকরাবকরা জামা, নাতনিসমা বান্ধবী, উনি কি বৃদ্ধ?

পরিমল সেন শীলভদ্র আবাসনের পুরনো পাপী। বয়স ৭২। শীলেদের ডোবায় যখন প্রথম লটের ফ্ল্যাটগুলো হল, তখনই রিটায়ার করে পাওয়া টাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনেছিলেন পরিমলবাবু। ‘শীলের ডোবা’ নামটা পালটে শীলভদ্র আবাসনের প্রস্তাব পরিমলবাবুরই। শীলভদ্র আবাসন রেসিড্যান্টস অ্যাসোসিয়েশন, সংক্ষেপে SARA তাঁর হাতে তৈরি। দু’বছর সেক্রেটারিও ছিলেন। একটা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবার পর ওঁকে সবকিছু থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। পরিমলবাবুর ভাগ্নে আর ওঁকে বাজার করতে দেন না, রেশন আনতেও দেন না। অ্যাসোসিয়েশনের নতুন বাড়িতে উনি নেই বহুদিন। বাহাত্তর বছর বয়েস বলে কি সংসারে ফেলনা নাকি?

ভোরবেলায় পরিমলবাবু বিহারিকায় এসে হাত-পা একটু বেশি বেশিই ছোড়েন। বুকে পেসমেকার বসানো বলরামবাবু ফেরার সময় বলেন, অত যে লাফালাফি করেন পরিমলবাবু, আবার হার্ট অ্যাটাক হবে যে। পরিমলবাবু হরধনু ওঠানোর মতো হাতের লাঠিটা আকাশের দিকে তুলে বলেন, কিচ্ছু হইব না। আমি এখন উইদাউট টেকিং এনি রেস্ট দোতলায় উঠতে পারি। জানেন?

এই পরিমলবাবু মুক্তবায়ু সেবন মেম্বারদের ভিতরে একটা উপদল গঠন করেছেন— APA মানে, এজেড পারসন্‌স অ্যাসোসিয়েশন। ওরা চাইছেন বয়স্কদের সামাজিক গুরুত্ব। বাজার করার অধিকার, রেশন তোলার অধিকার, শীলভদ্র আবাসিক অ্যাসোসিয়েশনের কাজের অধিকার। বর্তমান সেক্রেটারি তপন মিত্রকে বলেছেন, অ্যাসোসিয়েশনের কামে আমাগরে লাগান না ক্যান? আমরা কি নেহাতই সরবিট্রেট আর ডায়াবিনিজ খোর বুড়ো হাবরা? এবারের আবাসনের স্পোর্টস-এ মাঝবয়সিদের জন্য হাঁটার রেস ছিল, হাঁড়িভাঙা রেস ছিল, এক্সক্লুসিভলি বৃদ্ধদের জন্য কোনও রেস ছিল না কেন? আমরা অবহেলিত। তপন মিত্র বলেছিল, তা হলে সামনের বার দাঁতপরা রেস নামে একটা ইভেন্ট দিয়ে দেব। বাঁশি বাজলেই মুখ থেকে বাঁধানো দাঁতটা খুলে একটা বাটিতে রাখতে হবে, তারপর আবার মুখে লাগিয়ে নিয়ে একটা বিস্কুট চিবিয়ে খেতে হবে। যিনি আগে পারবেন…। পরিমল বলেছিলেন— যাঁদের বাঁধানো দাঁত নাই, শুধু মাড়ি?

পরিমলবাবুর সাংগঠনিক ক্ষমতা আছে। আগে রিফিউজি সংগঠন করতেন। একটু-আধটু বামপন্থী আন্দোলনের অভিজ্ঞতাও আছে। অবহেলিত, নিপীড়িত, চক্রান্ত, এইসব শব্দগুলি ওঁর ভোকাবুলারিতে রয়েই গেছে। আর রয়ে গেছে একটু বাঙাল-বাঙাল টান। পরিমলবাবু ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হেল্‌থ স্কিম বা সি জি এইচ এস-এর ডিসপেনসারিটা কাছেই। ওখানে মাঝে মধ্যে যান। বয়স্ক মানুষেরা ওখানে আসেন, অন্যরা বড় একটা আসেন না। কী করে আসবেন? ওই ডিসপেনসারিটা খোলা থাকে সকালবেলা। তখন তো অফিস। ওখানে অবসরপ্রাপ্ত বয়স্করা সব হজমের ওষুধ, ডায়বেটিজ, প্রেসার ইত্যাদির ওষুধপত্র নিয়ে থাকেন, আর সুখ-দুঃখের কথা বলে থাকেন। ওখানেই পরিমলবাবু বৃদ্ধদের নিজস্ব সংগঠনের উপযোগিতা নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা রেখেছিলেন। উপস্থিত সবাই ওই প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন, এবং সেইদিনই একটা সংগঠন তৈরি হয়েছিল। সংগঠন মাত্রই মুখপত্র মুখাপেক্ষী। সুতরাং একটি মুখপত্র প্রকাশ করার কথা ওঠে। অবসরপ্রাপ্ত সি বি আই কর্মী নারায়ণ মুখার্জি সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। তাঁর ভিতরে সুপ্ত ছিল সাহিত্যপ্রতিভা। পুলিশের চাকরিতে সেই প্রতিভার স্ফূরণ হয়নি। এবারে সুযোগ পেয়ে তিনি যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পত্রিকাটি ছিল হাতে লেখা পত্রিকা। নারায়ণবাবু প্রথম সম্পাদকীয়টি লিখেছিলেন কবিতায়।

কত অপরাধী নিজে ধরিয়াছি

এখন আমাকে ধরিতে হয়

অপরাধ মোর বুড়া হইয়াছি

কত গঞ্জনা সহিতে হয়… ইত্যাদি

ওই সংখ্যায় পরিমল সেন লিখেছিলেন একটি ওজস্বিনী কবিতা। সুকান্ত ভট্টাচার্যের মানব না বাধা মানব না ক্ষতি চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতির অনুকরণে লিখেছিলেন মানি না সর্দি মানছি না। কাশি/শত গঞ্জনা মুখে তবু হাসি… শেষ লাইনে ছিল আরও খাব আলু আরও খাব ডিম।

পত্রিকাটি ডাক্তার-ইনচার্জের বিশেষ অনুমতিতে ডিসপেনসারির একটি দেয়ালে লাগানো হত, যেখানে রুগিরা ডাক্তারের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকেন। পত্রিকাটি সম্প্রতি বন্ধ হয়েছে— সম্পাদকের ছানি হল কিনা।

পরিমলবাবু ওই শীলভদ্র আবাসনেও একটা বয়স্কদের পত্রিকার প্রকাশ চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনও ভলান্টিয়ার সম্পাদক পাওয়া যায়নি। আর পরিমলবাবু নিজস্ব হাতের লেখাকে তিনি নিজেই বলেন কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং তাই পত্রিকাটি হয়নি। তবে ওল্ড পিপলস অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেছিলেন, কিন্তু ওই তরুণ, তপনরা ওটাকে ওল্ড মংকস, বলতে থাকায় নামটা ঈষৎ পালটে, এজেড পারসনস অ্যাসোসিয়েশন বা এ পি এ করেছেন। আপাতত ছ’জন মেম্বার আছেন। পরিমলবাবু নিজেই স্বঘোষিত সেক্রেটারি। অনেকটা একনায়কত্বই চালান। ষাটোর্দ্ধদের মধ্যে যারা অবহেলিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত ইত্যাদি, তাঁরাই মেম্বার হতে পারেন।

নিপীড়ন নানারকমের। যেমন অবিনাশবাবু নিজেকে নিপীড়িত ভাবেন, কারণ ওর স্ত্রী গুরুমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছেন। গুরুর ছবিতে নিয়মিত মালা পরান। গুরু জীবিত। ছবির সঙ্গে কথা বলেন, সন্দেশ খাওয়ান, গুরুবাক্য পাঠ করেন, গুরুর অবয়ব ধ্যান করেন। বুড়ো বলে কি অবিনাশ পুরুষ নন। হারাধনবাবু আবার অন্যভাবে নিপীড়িত। ওঁর পুত্রবধূ দিনরাত টিভি খুলে বসে থাকে। হই-হট্টগোল একেবারেই ভাল লাগে না হারাধনবাবুর। একটু শুয়ে শুয়ে জীবনে কী পেলাম— কী পেলাম না ভাবছেন, এমন সময় বোলো তারারারা… উকলি কি নীচে দানা। পরিমলবাবু আবার অন্যভাবে নিপীড়ত। উনি ব্যাচেলার মানুষ। ভাগ্নেকে মানুষ করেছেন। ভাগ্নের সংসারেই থাকেন। ভাগ্নে-বউ এখন আর বাজার করতে দেয় না। একটা ছোটখাটো হার্ট-অ্যাটাক হয়েছে বলে কি একেবারেই অকেজো? সংসারের কোনও কাজেই কি লাগতে পারেন না? একটু ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ খাবার ইচ্ছে। পান না। আলু খাওয়া কি পাপ? রোজ স্যুপ। হার্ট অ্যাটাক যেন কারুর হয় না। সরষে-লঙ্কার ঝাল বাদ। মাছপাতুড়ি কী ভালই না লাগে। কিন্তু বাদ। ডিম বাদ। সবই বরবাদ। মামার দুঃখ বোঝে না। এই ভাগ্নেকেই মানুষ করেছেন। রিটায়ার করা টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। টলস্টয়ের আনাক্যারেনিনার প্রথম লাইনটা একটু পালটে পরিমল সেন বলেন, অল হ্যাপি পার্সন রিসেম্বল ওয়ান অ্যানাদার; এভরি নিপীড়িত পার্সন ইজ নিপীড়িত ইন ইট্‌স ওন ওয়ে।

তো, আজকের এই শীলভদ্র আবাসনের পিছনের বিহারিকায় এ পি এ সদস্যদের মধ্যে একটা অন্য আলোচনা। সম্প্রতি পাড়ায় কয়েকটা চুরি হয়ে যাওয়ায় আবাসিক অ্যাসোসিয়েশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে নাইটগার্ড দিতে হবে। নাইটগার্ডের একটা রোস্টারও করা হল, তাতে বুড়োদের রাখা হয়নি। কেন? বুড়ো বলে কি পাহারা দিতে পারা যাবে না? মতিবাবু পরিমল সেনকে বললেন, দেখুন, এটা কিন্তু আমাদের অপমান। পরিমলবাবু বললেন, দেখছি। তারপরই অ্যাটেনশন, ডাইনে মুড়, এবং ফরোয়ার্ড মার্চ। তখন তপন মিত্র হাত ছোঁয়াচ্ছে পায়ের পাতায়। ভুঁড়ি কমাবার ব্যায়াম। পরিমলবাবু বললেন— শোন তপন, কথা আছে।

সব শুনে তপন মিত্র বলল— আপনারা নাইটগার্ড দিলে আপনাদের আবার কে গার্ড দেবে?

কেন পারি না? জানো, রাতে আমার ঘুম হয় না?

আপনাদের সবার বাড়ি থেকে যদি পারমিশন পাই তা হলে ভাবা যেতে পারে।

পারমিশন?

পরিমলবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন। কার পারমিশন? বাড়ির? জানো না আমিই হেড অফ দি ফ্যামিলি? রেশন কার্ড দেখে এসো গে। ভোটার লিস্ট দেখে এসো গে। আমিই পারমিশন দিয়ে থাকি সব ব্যাপারে, আর বলছ আমাকেই পারমিশন নিয়ে আসতে? আমরাও নাইটগার্ড দেব।

ইতিমধ্যে মতিবাবু, হারাধনবাবু ইত্যাদিরা চলে এসেছেন, এবং হাতের মুঠি উপরের দিকে তুলে ফেলেছেন। পরিমলবাবু বললেন, রাত্রির অধিকার…

বাকিরা— দিতে হবে। দিতে হবে।

পরিমলবাবু সংশোধন করলেন, দিতে হবে না, —ছিনিয়ে নেব।

তপন বলল, প্লিজ চেঁচামেচি করবেন না, আমি একজিকিউটিভ বডির মিটিং ডেকে ব্যাপারটা ফয়সালা করছি।

একজিকিউটিভ কমিটিতে বোধহয় এ পি এ লবিটবি করেছিল। ওরা নিমরাজি হল। ঠিক হল মাসে একদিন করে এ পি এ-কে নাইটগার্ড দেবার জন্য আহ্বান জানানো হবে। এ পি এ উইথ প্রটেস্ট রাজি হয়ে গেল। শীলভদ্র আবাসনের অ্যাসোসিয়েশন রুমের দেয়ালে সাঁটানো রস্টারে এ পি এ-র ডেট দেওয়া থাকবে। কে কে আসবে, ক’জন থাকবে সেটা নির্ভর করছে এ পি এ মানে পরিমল সেনের উপর।

পরিমলবাবু তাঁর দলের মিটিংয়ে বললেন, লড়াই করে যখন অধিকার অর্জন করা গেছে, আমরা প্রত্যেকেই গার্ড টিমে থাকব। ওর দলে এখন আটজন বায়ুসেবী মেম্বার।

তারিখটি এসে গেল। কথা ছিল আটজনই থাকবে নাইটগার্ড টিমে। শেষদিকে চারজনই পিছিয়ে গেল। অ্যাডভেঞ্চার উত্তেজনায় একজনার প্রেসারটা বেড়ে গেল তো নার্ভাসনেসে আর একজনার প্রেসারটা ফল করে গেল। অন্য একজনের বাড়িতে এই ইস্যুতেই নিপীড়ন বেড়ে গেল। অবশেষে শ্বেত সন্ত্রাসের কাছে আত্মসমর্পণ করে টিম থেকে নাম কাটিয়ে নিল। অন্য একজন প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের যন্ত্রণায় বেশ কষ্ট পাচ্ছেন। বাকি রইলেন চারজন। রাত এগারোটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত গার্ড দিতে হয়। এগারোটার আগেই যে যার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। মতিবাবু এলেন গলায় মাফলার গায়ে চাদর। মার্চ মাস। শীত চলে গেছে। হারাধনবাবুর আবার বাঁদুরে টুপি, কাঁধে ওয়াটার বটল। অবিনাশবাবু কয়েকটি পান নিয়ে এসেছেন, পরিমলবাবুর ফ্লাস্কে চিনিছাড়া চা। সঙ্গে প্রত্যেকেরই বাড়ির লোক। কারুর ছেলে, কারুর ভাইপো, পরিমলবাবুর পিছন পিছন এসেছে ওঁর ভাগ্নে, পরিমলবাবু ভাগ্নেকে ভাগিয়ে দিলেন। অন্যদেরও। বললেন, এগারোটা বেজে গেছে, সব চলে যাও। আমাদের ডিউটি করতে দাও। পরিমলবাবু বাঁশি বাজালে পি-পিঁপ। ডিউটি শুরু হল।

বসন্ত যাই যাই করছে, নাকি চলেই গেছে। দুপুরবেলায় দু-একটা কোকিল এখন কেঁকুর কেঁকুর করে। হলুদ হ্যালোজেনের আলোয় শিমুলগাছটা ফ্যাকাশে মেরে গেছে। রেডিয়োর এফ এম চ্যানেলে ভুলু সাহার গলা শোনা যাচ্ছে। একটা বাড়ির ফাকা বারান্দায় শতরঞ্জি পেতে চারজনে বসলেন। ওই বাড়িতে এখনও লোক আসেনি। প্রথমেই হারাধনবাবু খুলে ফেলেন মাংকি ক্যাপ। মতিবাবু মাফলার। বোঝাই যাচ্ছে সব জোর করে পরিয়ে দিয়েছিল বাড়ির লোক’। পরিমলবাবু প্লাস্টিকের গ্লাসে ফ্লাস্ক থেকে চা ঢাললেন। ওঁর সিগারেট নিষেধ। ঝোলার ভিতর থেকে বার করলেন নিষিদ্ধ সিগারেট। সবাই সিগারেট ধরালেন। অ্যাডভেঞ্চার। ধোঁয়া ছাড়ার মধ্যে, আঃ।।

পরিমলবাবু বললেন, একটু পরেই আমরা বারইয়া পড়ুম। মুক্তচিত্তে মাতৃভাষায় প্রত্যেককে কাজ বোঝালেন পরিমলবাবু। কে কোনদিকে যাবে ঠিক করে দিলেন। তিনিই কমান্ডার-ইন-চিফ! প্রত্যেকেরই বাঁশি আছে। যে চোর দেখবে সেই বাঁশি বাজাবে। বাঁশি শুনেই বাকিরা সেইদিকে যাবে। হাতের লাঠি দিয়ে দরকার হলে চোরের মাথায় আঘাত করা যেতে পারে। চোর যদি ছুটে পালাতে চায়, তা হলে লাঠির বাকা হাতল চোরের পায়ে লাগিয়ে চোরকে ফেলে দেওয়া যেতে পারে। চোর যদি পুকুরে ঝাঁপ দেয়, তা হলে চারজনে সমবেতভাবে বাঁশি বাজাবে, তখন ফ্ল্যাটের অন্য লোকেরা ধেয়ে এসে পুকুর ঘিরে ধরে চোর পাকড়াও করবে। পরিমলবাবু সবাইকে একটা করে টর্চ বিলি করলেন।

প্ল্যান-প্রোগ্রাম হল। এবার চারজনে বেশ আয়েশ করে বসলেন। বহুদিন এত রাতে এভাবে আড্ডা জমেনি। মতিবাবু গান ধরলেন, সখী যাই যাই বোলো না। হারাধনবাবু বললেন, তবে আমি একটা নিধুবাবু ধরি? সবাই বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ধরো। হারাধনবাবু চারিদিকে তাকালেন। বহু ফ্ল্যাটে আলো জ্বলছে। হারাধন বললেন, এখন থাক। পরে হবে। পরিমল সেন বললেন, এরকম পাহারা দিতাম চল্লিশ বছর আগে। রিফিউজি কলোনিতে যেন গুন্ডারা আগুন দিতে না পারে। নাইট আফটার নাইট পাহারা দিয়েছি। মতিবাবু বললেন, আমিও। আমাদের কারখানা মেশিনপত্র পাচার করে লকআউট করে দেবার চক্রান্ত চলছিল। তখন রাতের পর রাত পাহারা দিয়েছি। অবিনাশবাবু বললেন আমার দেশের বাড়িতে ছিল খেজুরগাছ। শীতে হাঁড়ি ঝোলাতাম। চুরি হবার ভয় ছিল। পাহারা দিতাম। এমন সময় টর্চ হাতে তপন মিত্র এল। এসেই বলল—সব ঠিক আছে তো? কোনও অসুবিধে নেই তো?

পরিমলবাবু একটু রুক্ষভাবেই বললেন— না, কোনও অসুবিধা নাই। এভরিথিং ইজ ওকে। তপন চলে যাবার পর পরিমলবাবু স্বগতোক্তি করলেন— ‘ভেরি ইনসালটিং’।

এ গল্প সেই গল্প করতে করতে আরও রাত হল। ফ্লাস্কের চা শেষ হল। ফ্ল্যাটের আলোগুলো নিভে গেল আস্তে আস্তে। কিন্তু চারটে ঘরে আলো নিভল না। ওদের চারজনের ঘর। পরিমলবাবু আলো জ্বলা ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভেরি ইনসালটিং। পরিমলবাবু ওর নিজের ফ্ল্যাটের দিকে হেঁটে গেলেন। হাঁকলেন— বিদিশা, অ্যাই বিদিশা, শিগগির দরজা বন্ধ কইরা বাত্তি নিভাইয়া শুইয়া পড়। ওঁর হাঁকডাকে আরও দু-চারটে ঘরে আলো জ্বলে উঠল। পরিমলবাবু বললেন— ইগনোর, ইগনোর দেম।

চারজনে চারদিকে ঘুরে পুনরায় ওই ফাঁকা বারান্দায় এসে মিললেন। চারজনেরই মুখে চার রকমের গান। হারাধানবাবুর মুখে নিধুবাবু। উনি গুনগুন করছেন। পরিমলবাবু বললেন— হোক হোক। হারাধনবাবু ধরলেন— এমন চুরি চন্দ্রাননী শিখিলে কোথায়/হাসিয়ে নয়ন বান হরিয়ে লইলে প্রাণ/কথায় কথায়।

গানটা শেষ হলে পরিমল সেন বললেন— আহা! আহা! এবার বিজয়া সম্মেলনে আপনাকে গাইতে হবে আর একটা ধরুন। হারাধনবাবু গাইলেন, মিলনে যতেক সুখ মননে তা হয় না। কুকুর চ্যাঁচাল। ওটাকে ইগনোর করে সবাই বলল, আহা আহা। সবাই বলল, আহা আহা সবাই পুলকিত। মতিবাবু বললেন, আচ্ছা পরিমলবাবু, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। আপনি তো ব্যাচেলার। আপনার জীবনে কি একেবারেই কোনও ইয়ে আসেনি? পরিমলবাবু বললেন— কে বললে আসেনি। তবে বলছি শুনুন।

সবাই ঘন হয়ে বসলেন।

কম বয়সে বাবা বিবাহ দিয়া দিছিলেন। আই ওয়াজ এ স্টুডেন্ট দেন। ঘরে পনেরো বছরের বালিকা বধূ। আমি বিশ বর্ষীয় যুবক। কলকাতার হোস্টেলে থেকে রিপন কলেজে পড়ি। বি এ পরীক্ষার পর দ্যাশে আসলাম। বাড়ির সামনে খাল। বসন্তকাল। আকাশে একটা বিগ সাইজের চাঁদ। আমার বালিকা বধূ রোমান্টিক হইয়া গেল গিয়া। সে বলল— চলো, বেড়াইতে যাই।

সব যখন ঘুমাইয়া পড়ছে, নিশুতি রাইত, দুইজনে নৌকায় উঠলাম। ছোট্ট একখানা বৈঠা। ভাটার টান। আমি বৈঠা ছাইড়া দিছি। বইঠার পরিবর্তে কি ধইরা আছি বুঝতেই পারতাছেন।

সবাই হাসলেন। গো অন গো অন। নৌকা ইজ গোইং অন ইটস ওন ওয়ে। খাল ছাইড়া নদীতে পড়ল গিয়া নৌকা। ভাটিতে ভাইস্যা যায় আমার কি আর হুঁস আছে? মৃদুমন্দ হাওয়া। আহা এমন সময় নৌকাটা কীসের গায়ে ধাক্কা খাইল। দেখি, নৌকাটা নদীতে পাতা জালের সঙ্গে জড়াইয়া গেছে। বাঁশের খটখট শব্দ। আর পর মুহূর্তেই আকাশ ফাটানো চিৎকার ও কাশেম ভাই… কোন হালার পো হালায় বুঝি ভেসালের বেবাক মাছ উডাইয়া নেলে। চোর ধরার লাইগ্যা বেবাক আস…।

সর্বনাশ। আমি আবার বালিকা বধূরে জড়াইয়া ধইরা ঝাঁপ দিলাম। সে ভাল সাঁতার জানত। সাঁতরাইয়া পাড়ে আইস্যা লুকাইয়া রইলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমার গ্রামে ফিরলাম।

লণ্ঠন হাতে গ্রামের চৌকিদার বলাই মণ্ডল আমগরে দেইখ্যা ফালাইল, কিন্তু আন্ধারে চিনতে পারল না। চিনলে কী সর্বনাশ, কী ভাবব সে? গ্রামে রাষ্ট্র করব। আমি আমার বালিকা বধুরে লইয়া ঝোপে গা ঢাকা দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বলাই মণ্ডল চিৎকার পাড়ল। চোর-চোর-চোর… তারপর সেই বালিকা বধূ কী করল শোনবেন? হঠাৎ, অল অন এ সাডেন আমার মুখে নখের আঁচড় বসাইয়া দিল। আমি তো হতভম্ব। বালিকা বধূ কইল— চোরে মারছে। সঙ্গে সঙ্গে ওর তারস্বরে চিৎকার— চোর চোর চোর। আমারেও কইল তুমিও চোর চোর চিৎকার দাও। আমিও চোর চোর চোর…

লোকজন দেখল চোরে আমার গালে কীরকম আঁচড় দিছে। তারপর গালের যন্ত্রণা সেই সারাইল। যে ব্যাথ্যা দিতে পারে, সারাইতেও জানে। কী কইরা সারাইল—কমুনা। হারাধনবাবু বললেন, ব্রাভো! ব্রাভো! কিন্তু আপনার স্ত্রী…

পরিমলবাবু বললেন— অল্প বয়সেই স্বর্গে গেছেন। এ ঘটনার অল্পদিন পরেই। কলেরা।

মতিবাবু বললেন, কিন্তু ঠিক এরকম একটা গল্প যে পড়েছিলাম মনে হচ্ছে… নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা—নৈশপর্ব…

অ! পড়েছেন নাকি! এক ঘটনা কি দু’জনের জীবনে হয়না। গল্প কি সত্যি হয় না, নাকি জীবনে গল্প হয় না। পরিমলবাবুর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল!

এমন সময় একটা আওয়াজ। কথা থেমে গেল। রিভলভারের ট্রিগার টিপলেন পরিমল সেন। ঠিক রিভলভার নয়, টর্চ লাইট। মেশিনগান চালানোর বিক্রমে টর্চ ঘোরালেন। টর্চের আলোয় দেখা গেল একটা লোক রাস্তায় পড়ে আছে।

কুইক মার্চ। ওরা পা চালিয়ে গেলেন ওইদিকে। লেফ্‌ট রাই লেট। লোকটার মাথা ফেটে গেছে। পাশে একটা ফুলের টব, ভাঙা। একটা বনসাই। মতিবাবু বললেন, আমার পুত্রবধূর রচনা। টবটা আমাদের ব্যালকনিতে ছিল।

মতিবাবু লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলেন— তুমি কি চোর? লোকটা বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

পরিমলবাবু বললেন, নাও ইট ইজ প্রুভ্‌ড দ্যাট উই ক্যান। আমরাও… সরি, আমরাই চোর ধরতে পারি। বাঁশি বাজাও। কিন্তু কারুর কাছে বাঁশি নেই। সবাই ওখানেই ফেলে এসেছে।

তবে চেঁচাই? হারাধনবাবু জিজ্ঞাসা করেন। চোরটা উঠে বসে। জোড়হাত করে বলে, দোহাই, চেঁচাবেন না।

কেন?

চেঁচালে আপনাদের প্রেসার বেড়ে যাবে। প্যান্টের পকেট থেকে রুমালটা বের করে মাথার রক্ত মুছল চোর।

ক’দিন আগে যে একটা সাইকেল চুরি হল তুমি করেছ?

আজ্ঞে না।

এর আগে কী কী চুরি করেছ তুমি এ পাড়া থেকে!

কিচ্ছু না। পনেরো বছর পরে আজই কাজে নেমেছিলাম।

তা এই সামান্য টব চুরি করতে গেলে কেন?

দেখছিলাম এখনও পারি কি না।

কী পারো কি না?

কাজ। রিটায়ার করেছি তো, সবাই বলে অকম্যে। তা আজ একটু ট্রাই করতে গিয়েছিলাম।

পরিমলবাবু বলেন— এদিকে এসো। আমাদের ওয়াটার বোটলে জল আছে। ব্যাকটেরিয়া ফ্রি। মাথাটা আগে ধুয়ে নাও।

ওরা ওই বারান্দায় যায় শতরঞ্জিতে বসে। চোরটিও। রাত আড়াইটে। একটা প্যাঁচা ডাকল।

পরিমল জিজ্ঞাসা করে— বয়স কত হল!

চোরটি বলে, হবে ষাট-সত্তর। রায়েটের সময় ছোট ছিলাম।

কোথায় থাকা হয়?

গাধিধোলা। কাছেই।

আগে কী করতে?

চুরি।

ছেড়ে দিয়েছ?

হ্যাঁ। পনেরো বছর পর আজ ট্রাই করলাম।

ট্রাই করে কী মনে হল?

পারি।

কই পারলে? পাইপ থেকে পড়ে গেলে তো।

উঠেছিলাম তো ঠিকই। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি খেলাম। তারপর আপনাদের গল্প শুরু হল। ওই বালিকা বধূর গল্প। এক হাতে টব নিয়ে পাইপ বেয়ে নীচে নামছিলাম। তারপর আপনাদের কে একজন সিনেমার সুখেন দাসের সব ডায়লগ বললেন— গল্প কি জীবনে সত্যি হয় না? তখন ঘাড়টা ওদিকে ঘোরালাম। আর পড়ে গেলাম। তবে রক্ষে, বেশি উঁচু থেকে পড়িনি।

গত পনেরো বছর যে তুমি আর চুরিটুরি করছ না তো তোমার কী করে চলে?

কেন, ছেলে চুরি করে।

কোথায়?

সরকারি অফিসে। আমার চুরির ইনকাম দিয়ে আমার ছেলেটাকে পড়ালেখা শিখিয়েছি। ও এখন সরকারি চাকরি করে। ওর চুরি করতে তো সিঁদকাঠি লাগে না। পাইপ বেয়ে উঠতে হয় না। ওদের কাজ খুব সোজা। সব খাতায়-কলমে হয়।

তো আজই কেন হঠাৎ ট্রাই করতে এলে?

ছেলের বউ যে গতকাল বললে, আপনি কোনও কম্মের না। কোনও কাজই পারেন না। খালি বসে বসে খান…।

তো এখন যদি তোমায় ছেড়ে দি, কী করবে?

বাড়ি চলে যাব। গিয়ে ঘুমব। আমি তো জেনে গেছি— পারি। ঘুমটা ভাল হবে। কী, মশায়রা কী বলেন, পারি না?

পরিমলবাবু সায় দিলেন। অন্যরাও।

এবার মতিবাবু বললেন, তো এবার ওকে নিয়ে কী করা যায়?

পরিমলবাবু বললেন—দ্যান, ছাইড়া দ্যান।

মতিবাবু বললেন, ছেড়ে দেবেন? ছেড়ে দিলে কিন্তু প্রুভ্‌ড হয়ে যাবে আমরা চোর ধরতে পারিনি। সকাল হলেই আমার পুত্রবধূ চেঁচামিচি করবে।

পরিমলবাবু বললেন, তা হলে বরং এক কাজ করি। চোরকে বলি, আবার পাইপ বেয়ে বনসাইটা যথাস্থানে রেখে আসুক।

মতিবাবু বললেন— তো টবটা, টব তো আর গাছ থেকে নিজে নিজে বেরিয়ে এসে বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিতে পারে না…

দ্যাট ইজ কারেক্ট, দ্যাট ইজ কারেক্ট।

দেন?

দেন উই ক্যান ডু ওয়ান থিং…। পরিমলবাবু বললেন। একটা টব জোগাড় করতে হবে। তারপর বনসাইটা টবে প্লেস করতে হবে। হোয়ার ইজ দা চোর?

চোর বলে, ইয়েস স্যার…

পরিমলবাবু বলেন— ওই যে একতলা বাড়িটা দেখতাছ, ওইটা আমার ভাইগনার শ্যালকের বাড়ি। ওই বাড়ির ছাদে অনেকগুলি ফুলের টব আছে। ওর খুব ফুলের শখ। ফাঁকা টবও নিশ্চয়ই আছে। একতলার ছাদে উঠতে পারবা না?

চোর বলল, নিশ্চয়ই পারব।

চোরটা পারল। আর হারাধনবাবু হাততালি দিয়ে উঠলেন, পেরেছে পেরেছে…।

পরিমলবাবু বললেন, ডোন্ট বি একসাইটেড, লোকজন জাইগ্যা যাইব গিয়া। চোরটা একটা লম্বা দড়ি জোগাড় করে নিল ছাদ থেকে। টবটাকে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল। পরিমলবাবু ঝুলন্ত টবটা ঝাপিয়ে ক্যাঁচ লোপার কায়দায় ধরলেন, যেন জন্টি রোডস। চোর নেমে এল। একটু হাঁপাচ্ছে। পরিমলবাবু চোরকে বললেন, টেক রেস্ট।

মতিবাবু এবার নিজের বাড়ির সামনে গেলেন। টবের ভাঙা টুকরোগুলি কুড়িয়ে নিয়ে দূরে ফেলে এসে নিজের বাড়ির পাইপটা চোরকে দেখিয়ে বললেন— যেমন পাইপ বেয়ে উঠেছিলে, তেমন ওঠো। টবটা সঙ্গে নিয়ে উঠতে হবে না। রিস্ক নিতে হবে না। ব্যালকনিতে উঠে গেলে দড়ি ধরে টবটা টেনে নিয়ে, তারপর গাছটা বেঁধে দেব, দড়িতে টেনে নিয়ো। গাছটা ঠিকমতো প্লেস করে দিয়ো টবে। পারবে না?

মতিবাবুর দোতলার ব্যালকনিতে চোর উঠছে পাইপ বেয়ে। হাতে দড়ি। পরিমলবাবু টর্চের আলো ফেলছেন পাইপটির গায়ে। চোর দোতলায় উঠছে। ষাটোর্ধ্ব চোর। আহা পারছে। ওরা হাততালি দিতে পারছে না, উচ্চ শব্দ করে বলতে পারছে না, শাবাশ। পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছেন অন্ধকারে। মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন।

শারদীয় বর্তমান, ২০০১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *