কার্তিক

কার্তিক

টি আই ও এন এবং এস আই ও এন-এ আমার বড্ড গণ্ডগোল হয়ে যায়। এডুকেশনে এস আই ও এন লিখেছিলাম, বড়সাহেব আমার মুখের দিকে একটুক্ষণ তাকালেন, বললেন গ্র্যাজুয়েট? আমি বললুম ‘হুঁ’। আবার অনার্সও আছে নাকি? বললুম ‘উঁহু’। বললেন—আপনি এই ফাইল ডিল করছেন কেন? বড়বাবুকে পাঠিয়ে দিন। বড়বাবু মানে হেড ক্লার্ক। সুখরঞ্জন পোদ্দার। আমার বিষয়েই কিছু বলবেন হয়তো। নতুন চাকরি আমার, বড্ড টেনশন হয়। টেনশনে কি টি আই ও এন? বড়বাবু ফিরে এলেন। বললেন, একবার পড়ুন তো কী লিখেছেন? আমি পড়ি—এনক্লোসড হিয়ার উইথ অ্যাটাচড সারকুলার ফ্রম দি মিনিস্ট্রি অফ এডুকেশন রিকোয়েস্টিং ইউজ অফ বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ ইন দি গভর্নমেন্ট অফিসেস অব ওয়েস্ট বেঙ্গল৷ বড়বাবু বললেন, চার লাইনে চারটে ভুল। আর সাহেব যখন আপনাকে ভুলটা পয়েন্টাউট করে দিলেন, তখন আপনি নাকি হাসছিলেন? আমি বলি—না স্যার, হাসিনি, আমার সামনের দাঁত দুটো উঁচু উঁচু তো, এইজন্য স্যার, সব সময় মুখটা হাসি হাসি থাকে।

এইজন্যই তো তোমার নাম ক্যালানে। অধিকারীবাবু পাশ থেকে বলে উঠলেন। আমার কল্যাণ নামটাকে অধিকারীবাবু এরকম করে দিয়েছে, এখন প্রায় সবাই আমাকে নতুন নামে ডাকে।

বড়বাবু অধিকারীবাবুকে বললেন, কী করি বলুন তো, সাহেবের তো হুকুম একে ডেসপ্যাচে দাও, এদিকে ডেসপ্যাচের মালটা যা চিজ, আরও কাজ করবে না। বড়বাবু চলে গেলে অধিকারী আমায় বললেন, আর একটা জিনিস শিখ্যা লও। হেড ক্লার্ক ইজ নট স্যার। হি ইজ অলসো গ্রুপ সি। ডোনট সে স্যার টু হেড ক্লার্ক। ও-কে?

অধিকারীবাবুর কাছেই সব কাজ শিখেছি। উনিই আমার কর্মগুরু। ফাইল নাম্বার বসানো, নোট শিট লাগানো, সাহেব যখন সই করবে তখন ফাইলের পৃষ্ঠাগুলো উলটে দেয়া, সই করার পর তারিখ ভুলে যাওয়া সাহেবদের নিয়ম, তখন ক্লার্কদের নিয়ম তারিখ বলে দেয়া, অফিসের পিছনের সিঁড়িটা, যেটা দিয়ে নেমে গেলেই খাবারের রাজ্য। দোসা শিখেছি, ইডলি শিখেছি, শিখেছি ধারে পান খাওয়া।

জয়েন করার ছ-সাত দিনের মাথায় বড়বাবু বললেন ১৮ নম্বর বাড়িতে আমাদের যে অফিস আছে, ওখান থেকে বারোটা চেয়ার নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে। আমার তো মহা বিপদ, ১৮ নম্বর বাড়িটাই চিনি না, যাও বা খুঁজে বার করব, মাথায় করে নিয়ে আসতে হবে? পারব না এমন নয়, দেশের বাড়িতে ধানের বোঝা কি আনিনি? কিন্তু সিঁড়িটা যা সরু, এক বারে যদি দুটো করে আনা যায় মোট ছ’ বার? অধিকারীবাবু সেদিনই প্রথম আমাকে ক্যালানে ডাকলেন। বললেন, বাবা ক্যালানে মণ্ডল, গভরমেন্টের সোনার চাঁদ ছেলে, কোটার জোরে তোমাদের মতো ছেলেরাও চাকরি পাইতাছ, এইটুকু কমন ছেনস নাই যে ইউ আর নট গ্রুপ ডি স্টাফ। ইউ আর নট সাপোসড টু মাথায় কইরা চেয়ার ক্যারি করবা।

উনি তখন দুলালকে ডাকেন। দুলালকে আমার সঙ্গে দিয়ে দেন। অফিসের নোট আমার হাতে। আমি গ্রুপ সি৷ আর দুলাল বয়ে আনবে চেয়ার। ও গ্রুপ ডি। ১৮ নম্বর বাড়ি খুব দূরে নয়, তিন-চার মিনিট লাগে হেঁটে গেলে। দুলাল তখন জানাল ও একদিন পারমেন হবেই কারণ সব স্যাররাই ওকে ভালবাসেন। আর দুলাল আমাকেও যখন স্যার ডাকল, তখন মাইরি ভীষণ লজ্জা করছিল। তখনই জানলাম দুলাল ক্যাজুয়াল। ক্যাজুয়ালই শুধু নয়, ডেইলি লেবার।

মানে মাসে ছ’দিন করে বুকিং হয় ওর। দিনে বাইশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা হিসেবে ও মাসে পায় ১৩৫ টাকা। কিন্তু ও রোজই আসে, রোজ কাজ করে। দুলাল চেয়ারগুলি বয়ে আনল। অধিকারীবাবু আমাকে বললেন, তোমার আর একটু কাম বাকি। একটা লেবার রিক্রুটের ক্লেইম করো। ল্যাখো—অমুক মেমো নম্বরের রেফারেন্সে ১৮ নম্বর বাড়ি থিকা বারোখান চেয়ার আনার জন্য একজন কুলি রিক্রুট করা হল সেই বাবদে বাইশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা… ও বুঝেছি। টাকাটা দুলালকে দেয়া হবে।

ক্যালানে, তুমি একের নম্বরের ডট ডট ডট ডট। আমাদের অফিসটা হল ছ্যাঁচড়া অফিস। কোনও একসট্টা ফেকসট্টা নাই। এইভাবে আমাগোর টিফিন খরচটা উঠাইতে হয়।

অধিকারীবাবু এইভাবে হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন আমাকে। একদিন কয়েকটা ভাউচারের তলায় ডান হাতে বাঁ হাতে কতকগুলো টিপসই করালেন, নিজেও করলেন। বললেন, এগুলোকে বলে পেটি ভাউচার। কেন জানি না, আমাকে বড় ভালবাসেন উনি। গ্রাম থেকে এসেছি বলে আমি নাকি খুব সরল। আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেন পাটখেতের ভিতরে আমার কোনও কেস আছে কি না।

ডেসপ্যাচে যে কাজ করে তাকে সবাই কবিরাজ বলে ডাকে ভাবতাম উনি ওষুধপত্র জানেন। অধিকারীবাবু আমাকে ওর কাছে নিয়ে যেতেই কবিরাজ বললেন, শুনবেন নাকি অধিকারীবাবু, কলিকালের রং তামাশা। নতুন। ‘আইল কি জামানা।’

আইল কি জামানা হাতে দেয় না মেয়েলোকে চুড়ি

নতুন স্টাইলে পরে দেখ হাতে লেডিজ ঘড়ি

ধরল নতুন ফেশন

নতুন ফেশন বলব এখন মেয়েলোকের কথা

বুকের কাপড় ঠিক থাকে না লজ্জায় পুড়ে মাথা

কাপড় পিঠ ঘুরে না…

কবিরাজ নামকরণের সার্থকতা এখন বুঝতে পারলাম। অধিকারীবাবু ওকে বললেন, তোমায় অ্যাসিস্ট্যান্ট দিয়ে গোলাম কবিরাজ। এবার মনের আনন্দে কবিগান লেখো। টেবিলের কাচের তলায় ওই ভদ্রলোকের একটা দাঁড়ানো ছবি। তার তলায় লেখা শ্ৰীজনার্দন হালদার। কবিশেখর।

জনার্দনবাবু কবিশেখর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

নাম?

শ্রীকল্যাণকুমার মণ্ডল।

শুনো কল্যাণ মণ্ডল গণ্ডগোলের অফিসেতে বাস

জয়েন করিয়াছ তুমি হয়নি, তো একমাস, হল পানিশমেন্ট…

বর্তমান থাকা হয় কোথায়?

শেয়ালদার একটা হোটেলে ছিলুম ক’দিন। বড্ড খরচ! দিন তিন-চার হল দাদার ভায়রার বাড়ি আছি; বেলগাছিয়া। ওখানে লজ্জা করে। একটাই ঘর কিনা।

দেশ কোথায়?

বর্ধমান নেমে কালনার দিকের বাসে ১০ মাইল।

বাপ কী করে?

চাষ।

ক’ বিঘে জমি?

ন’ বিঘে।

তা চাষির ছেলে অফিসের বাবু হতে এলে কেন?

বি এ পাশ করলুম যে…

তোমার মতো হাজার হাজার বি এ, এম এ বসে বসে ছিঁড়ছে। একসঙ্গে বহু এস সি, এস টি নিল বলে চাকরিটা পেয়ে গেলে। তোমার বরাত ভাল। কী রাশি?

বিছে।

কর্কট? ভাল রাশি। সামনের মাস থেকে খুব ভাল সময়।

ঘর পাব?

ঘর চাইছ? কালই দিতে পারি। আমাদের পাড়ায় যাবে?

কোথায়?

বারাসাত। শেয়ালদা থেকে ট্রেনে চল্লিশ মিনিট।

গেলেই ঘর পাব?

আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমার ভায়রার বাড়ি। বাইরের দিকে একটা ঘর আছে। রান্নাঘর নেই বলে ফ্যামিলিম্যান ভাড়া হবে না। ব্যাচেলার ট্যাচেলার হলে ভাল, যারা হোটেলে ফোটেলে খাবে। আর গভরমেন্টের চাকরি শুনলে তো দেবেই। সে আমি বলে দেব। ইচ্ছে করলে স্টোভ জ্বালিয়ে রাঁধতেও পারো। রান্নাটা শিখে রাখা ভাল। আজকালকার বউরা রাঁধে না।

বলে রাঁধতে নারি কলির নারী। সিনেমাতে যায়

গালে মাখে পাউডার ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়

চলে ভিড় কাটিয়া

চলে ভিড় কাটিয়া ধাক্কা দিয়া পরপুরুষের গায়

আই এ্যম সরি বলে নারী মুচকি হেসে যায়।

ঘর হয়ে গেল। মাথায় অ্যাসবেস্টাস। দেশে টিনের ঘর আমাদের, উপরে চাষের খড় ছেয়ে দিতাম, ঠান্ডা থাকত। আর ছিল দুটো আম গাছ দু’ পাশে। টুপটাপ আম পড়ত বোশেখ মাসের ঝড়ে। এই ঘরে কিন্তু বড্ড গরম। তার উপর সন্ধে থেকেই পাশের ঘরে গাঁক গাঁক করে টিভি চলে। বাড়িটার চারপাশে সব বিহারিটিহারি থাকে। পিছনে ধাঙরপট্টি। ঘরের সামনে এসে শুয়োর ভোঁক ভোঁক করে। সামনেই মুচিদের ঘর। ঠুকঠাক লেগেই আছে। সন্ধেবেলায় বাড়ি আসতে ইচ্ছে করে না। ক্যারাম পেটাই অফিসে, কিংবা বেলগাছিয়া যাই। ট্রেনে পুরনো ম্যাগাজিন বিক্রি হয়, দু’ টাকা করে পিস, কত কী থাকে, বউদি কর্তৃক দেবর ধর্ষণ, তান্ত্রিকের ব্যাভিচার, নার্সের অন্তরঙ্গ কথা, এইসব। দু-একটা বই কিনেছিলাম, বাড়িওলার ভাই একদিন নিয়ে গেল, আর দিল না। চুপচাপ বসে থাকি ঘরের সামনে। একটা মুচি ছেলেপিলে পড়ায়। এর নাম বদ্রীনাথ।

মাইনে পাবার পর শনি রবি আর দু’দিন সি এল নিয়ে বাড়ি গেলাম। আমাদের গাঁয়ে মণ্ডলদের মধ্যে আমিই ফার্স্ট বি এ এবং গভরমেন্টের চাকরি করছি।

বাবা হরিনাম বসালেন, বাড়িতে হরিলুট করালেন। আমাদের গাঁয়ের বোসবাড়ি, মুখুজ্জেবাড়িতে অফিসার-টফিসার আছে। সেই সঙ্গে আমাদের বাড়িও যুক্ত হল বলে বাবা আনন্দে হাউ হাউ করে কাঁদলেন। রায়পুরের হাটেও খবর হয়ে গেছে, লোক তাকাচ্ছে, যেন বলছে—ওই দাখো, তিনু মণ্ডলের ছেলে, গভরমেন্টের চাকরি পেয়েছে। দু’দিন বেশি থাকলাম। গ্রামে কী প্রেস্টিজ!

ক্যালানে মণ্ডল এসে গেছেন? মাইনে পেয়ে কেটে পড়লেন, খাওয়ালেন না। চঞ্চল বলে একটি ছেলে বলল। এখন অনেকেই আমাকে এই নামে ডাকে।

আমি তখন সত্যি সত্যি দাঁত ক্যালাই। পে কমিশনের এরিয়ার পেয়েছে সবাই, শনিবার ফিস্ট, আমাকে পঞ্চাশ টাকা চাঁদা দিতে হবে। আমি এর মধ্যে এরিয়ার-টেরিয়ার সব বুঝে গেছি। বললুম, আমি তো এরিয়ার পাইনি, চঞ্চল বলল, এরিয়ারের বাপ পেয়েছেন। আজকালকার দিনে একটা চাকরি…

শনিবার দুটোর পরই গেট বন্ধ। দুলালের কত কাজ। ডেকোরেটারদের থেকে গেলাস, প্লেট ভাড়া করে আনা, ওসব ধোয়াধুয়ি। কাগজের কাপ আনতে ভুলে গেল দুলাল, ও কাগজের কাপ বুঝতে পারছে না। অধিকারীবাবু আমাকে বলল, তুমি সঙ্গে যাও তো কল্যাণ। চঞ্চল বলল, ও কী বুঝবে? আমি যে কাগজের কাপ ব্যাপারটা বুঝি সেটা ওদের বুঝিয়ে দেবার জন্য দুলালের সঙ্গে গেলুম। হেভি মেনু। বিরিয়ানি, ফিসফ্রাই, চিংড়ির মালাইকারি, রসমালাই। দুলালের ফ্রি।

আমি বললাম, আজ তোমার খুব মজা। না? দুলাল বলল, কার্তিক দেখেছেন স্যার? কার্তিক? বাবরি চুল, ছাঁটা গোঁফ কোঁচা দুলিয়ে বসে থাকে। লোকে ভাবে খুব সুখে আছে। বুঝলেন না?

বুঝলাম না।

বুঝলেন না স্যার? কার্তিক তো সুখে আছে, আর এদিকে যে একটা গরান কাঠ কার্তিকের পাছার ভিতর দিয়ে উঠে মাথায় গিয়ে ঠেকেছে, সেটা কার্তিক আর কুমোর ছাড়া আর কেউ জানে না। আপনাদের মাইনে বেড়েছে, মনে ফুর্তি আর… এবার জিনিসের দাম বাড়বে।

দুলালের গলায় স্বর পালটায়। বলে, স্যার, আপনাদের ডি এ বাড়ে। আমাদের ডি এ নেই স্যার। জিনিসের দাম বাড়ে। আমাদের ওই একশো পঁইতিরিশ। তেল স্যার আবার বাড়ল। আবার বাসভাড়া বাড়ল। আপনারা মাইনে বাড়াবেন! আমার একশো পঁইতিরিশ। মাঝখান থেকে আমার কাজটাও নষ্ট।

কাজ নষ্ট মানে!

আমি স্যার অফিস ছুটির পর দুশো সতেরো চাপি। নারায়ণপুরে রিফিলের কারখানায় যাই, রাত বারোটা পর্যন্ত কাজ। আট-দশ টাকার কাজ করি। নইলে এই একশো পঁয়তিরিশে কিছু হয়? তারপর বাড়ি যাই। এক মাইল পথ। হাঁটি।

চাঁদের আলো হলে গান গাইতে গাইতে চলে যাই। অন্ধকার হলে অসুবিধে হয়। ব্যাটারির যা দাম। ইশ…আমার যদি একটা সাইকেল থাকত—আমি বললুম, তুমি মাসে ছ’ দিনের পয়সা পাও, রোজ আস কেন?

না এসে উপায় নেই যে।

কেন?

অধিকারীবাবু স্যার বলেছেন, রোজ না এলে পারমেন হবি না।

কবে রেগুলার হবে তুমি?

অধিকারীবাবু স্যার লিখালিখি করছেন, বড়বাবু স্যার লিখালিখি করছেন। পারমেন চাকরি কি মুখের কথা?

সবাই জনার্দন হালদারকে নিয়ে পড়েছে। কবিরাজ, শুরু করো। কবিরাজ শুরু করো। হালদারবাবুর পায়ে ঘুঙুর পরানো হয়েছে। হালদারবাবু শুরু করে— শোনো লোডশেডিং-এর কবিগান। চঞ্চল-টঞ্চল হইচই করে ওঠে। বলে ওসব জমবে না। এতগুলো যে ধর্ষণ হল, নতুন কিছু পয়দা হয়নি? হালদারবাবু মাথা নাড়ায়। তবে ওটা করো, ওই যে, বুড়োর সঙ্গে যুবতীর প্রেম।

ঢেঁকুরে ভেটকির গন্ধ। বেশ রাতে বাড়ি ফিরলাম। দুলালের গতকাল বাড়ি ফেরা হয়নি। চঞ্চল, নিখিল, ওদের জন্য বরফ জোগাড় করতে গিয়ে লাস্ট বাস পায়নি দুলাল। ওকে সবাই ছিঁড়ে খাচ্ছে। ও ইউনিয়কে জানাচ্ছে না কেন? কেন যে জানায় না? ওদের কি ইউনিয়ন নেই? বোধ হয় নেই।

পরদিন রবিবার। খেয়েদেয়ে ঘুমোলাম। বিকেলে কিছুই করার নেই। মুচিদের ওখানে একটু আড্ডা মারছিলাম। শিবনাথ আর বদ্রীনাথের পাশাপাশি ঘর। শিবনাথের ছাপা লুঙ্গি; রঙিন গেঞ্জি। ঘড় ঘড় করে রেডিয়ো বাজছে। ও চটিটটি বানায়। রকমারি চামড়া। আমি হাতে ধরে গোর চামড়া, মোষের চামড়া আর ফোমের তফাত বুঝলাম। বদ্রীনাথের সব মোটা কাজ। ফ্যাশনের কিছু বানায় না, টায়ারের সোলের মোটাসোটা ধ্যাবড়া মতো ঢেঁকি ডিজাইন চটি বানায় আর পুরনো জুতো সারায়। দু-একটা কথা হবার পরই আমায় বলল, দেশ কা ক্যা হাল হো গিয়া সাহাব, মিট্টি তেল বিলকুল না মিলি। ব্ল্যাক মে বহুত দাম মাংতা কেরোসিন। সমস্যাটা আমারও। আমারও ব্ল্যাকে কিনতে হয়। কিন্তু ওদের কিছু বলি না। বদ্রীনাথের চোখে প্লাস্টিকের চশমা। একটা ডাঁটি নেই, সেখানে সুতো। পরনে নোংরা ধুতি, হাঁটুতে ঠেকেছে। সন্ধ্যা হতে না হতেই বদ্রীনাথ সেলাই-এর সরঞ্জাম বাক্সে পুরে ফেলে। হাত-পা ধুয়ে নেয়। একটা কালো রঙের লিকলিকে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দেয়। একটা প্যাকিং বাক্স উলটো করে নিয়ে বসে, আর অমনি ওর চেহারাটা কেমন যেন হয়ে যায়। কী রকম যেন ব্যক্তিত্ব। গাম্ভীর্য এসে যায়।

এখন লোডশেডিং। কী আর করব ঘরে গিয়ে। অফিসে থাকলে এখন ক্যারাম পেটানো যেত। বাবা এ সময় রেডিয়োর কৃষিকথার আসর শুনছে। আমি ক’দিন আগেও এ সময় ঘরে বসে মুখস্থ করেছি। পি এল ও মানে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন, ডব্লু এইচ ও মানে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন। অফিসে এসব কোনও কাজে লাগে না।

এবার একে একে আসতে শুরু করে ছেলেপুলেরা। কেউ একটু আগে লাস্ট টান মেরে ফেলে দিয়েছে বিড়ি। হজমিওলা মালিশওলার ছেলেরা। ধাঙরপট্টির ছেলেরা। যেসব ছেলেরা সারাটা দিন পথে গড়িয়ে গাঁজার ঠেক চুল্লুর ঠেক দেখে শ্রীদেবী ডিম্পল রেখার লাস্য ছবির আগে পাশে থেকে সময় পার করেছে আর একটু বড় হবার জন্য বাপকে মদত দেবে বলে, ওরা এসে যায়। রাস্তাই ওদের শ্লেট। ওদের হাতে হাতে চকখড়ি দেয় বদ্রীনাথ। আমার দিকে তাকিয়ে বদ্রীনাথ বলে, আভি মেরা অক্ষরদান হোগা।

আমার অদ্ভুত লাগছে। একে একে ছেলেরা আসছে, কেউ খালি গা, কেউ চকমকে গেঞ্জি, বলছে পরনাম মাস্টারজি, তখন মুচি বদ্রীনাথ ওলটানো প্যাকিং বাক্সের বেদিতে বসে রাজার মতো হাসে। এমন সময় আলো এসে যায়। বদ্রীনাথ বলে জয়রামজিকি। ছাত্ররা সব হইহই করে ওঠে।

এমন সময় আমার পিঠে থাপড়া পড়ল। হালদারদা। হালদারদা কাছাকাছির মধ্যেই থাকে। হাঁটাপথে পনেরো মিনিট। এর আগেও দু-একবার এসেছে। আমি হালদারদাকে নিয়ে ঘরমুখো হচ্ছিলাম, বদ্রীনাথ বলল, হামার সবসে মাথা সাফ ইস্টুডেন্টকে তানি দেখকে যান সাহেব। ইউসুফ আভি আসবে। হালদারদা আমাকে টেনে নিয়ে যায়।

হালদারদা বলে, রবিবারের বাজার, তার উপর কিছু মালকড়িও পেলাম, একটা ছোট পাঁইট এনেছি। বাড়িতে ছেলেমেয়ে বড় বড় হয়ে গেছে, বুঝলে না, বউ ঝামেলা করে। তুমি হচ্ছ ব্যাচেলার। রাজা মানুষ। গ্লাস দাও। চানাচুরও এনেছি।

তালের তাড়ি খাই ফি চৈত্র-বৈশাখ মাসে। বিলিতি খেয়েছিলাম ‘মা তুমি কেঁদ না’ পালা দেখে ফেরার সময় বছর দুই আগে বাঁশবাগানে বসে। সেই প্রথম সেই শেষ। আজ হালদার এনেছে যখন, ঠিক আছে, একটু মেরে দি। দু-টোক খেয়ে হালদারদা বলল—বুঝলে কল্যাণ, দেশটার আর কিচ্ছু হবে না। সব শালা গান্ডু হয়ে গেছে। হালদারদা বলে যায়। বাইরে তখন বদ্রীনাথ পড়ুয়াদের নামতা শেখাচ্ছে।

একটু পরেই দরজায় টোকা। বদ্রীনাথের গলা। সাহাব, তানি খোলিয়ে। আমি সাততাড়াতাড়ি গেলাস সরাই। মুচি বদ্রীনাথকে আমার ভয়। আমি বলি, থোড়া দাঁড়ান মাস্টারমশাই। বদ্রীনাথ বলে, আরে ছি-ছি-ছি। আমি চামার-উমার মোচি। আপনি মাস্টারজি না বলবেন, বদ্রীনাথ বলবেন। দরজা খুলে দেখি একটি ছেলের মাথায় পরম স্নেহে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বদ্রীনাথ। হামার সবসে মাথা সাফ ইস্টুডেন্ট। ইউসুফ কাগজ-উগজ কুড়ায়। ইউসুফ আমাকে আর হালরদারকে প্রণাম করল। ওরা চলে যেতে হালদারদাকে বললাম, পা-টা কী রকম শিরশির করে উঠল জানো। হালদারদা এক চুমুকে অনেকটা রাম খেয়ে বলল, আমারও রে। পৃথিবীতে মানুষ আছে। আমরাই গান্ডু। বাকি মালটুকু খেয়ে হালদারদা বলল, শুনুন মশায়:

শুনুন মহাশয় গোটিকয় মানুষ আজ আছে,

এদেরই দয়ায় আজ মানুষ সমাজ বাঁচে, দেখে জল আসে…

চেয়ার ক্যারি করার যে বিলটা করেছিলাম, সোমবার দিন টাকাটা পেলাম। টাকাটা নিতেই বদ্রীনাথের কথা মনে হল আমার। টাকাটা দুলালকে দিয়ে দিলাম। বললাম, দুলাল, কাউকে বোলো না। অধিকারীবাবুকেও না।

আমার চটিটা ছিঁড়ে গেলে বদ্রীনাথের কাছে সারাতে যেতে লজ্জা করল। শিবনাথ বলল, চটি সারাই হবে না। অর্ডারি কাজ আছে। অগত্যা বদ্রীনাথের কাছে যাই। বদ্রীনাথ চটিটা সারিয়ে একটা কুপনের বই ধরিয়ে দিল আমার হাতে। পাতায় পাতায় ২৫ পয়সার ছবি, জানলাম ওর পড়ুয়ারা সরস্বতী পুজো করবে। আমি ২০টা কাটলাম। ৫ টাকা। বদ্রীনাথ খুব খুশি হল। যেখানে বিশ-পঁচিশ হাজারের কমে পুজোর ফুর্তি হয় না, সেখানে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পুজোটা দেখলাম বদ্রীনাথের বিনিমাগনার ইস্কুলে। ইটে চুনের প্রলেপ লাগিয়ে মঞ্চ করেছে। তার উপর পুতুলের মতো সরস্বতীর পিছনে শিবনাথের কাছ থেকে নেয়া সাদারঙের এক চকচকে চামড়া। ইউসুফ ভলান্টিয়ার। কাচ্চাবাচ্চা সামলাচ্ছে। বদ্রীনাথ বলল, সরস্বতী পুজোটা করলাম কেন কী, ইসব হামার ইস্টুডেন্টরা ভি বুঝবে সিরফ কিতাব উতাব আর পড়া লিখা দিয়ে ভি ধূম হতে পারে, সব এক সাথ মিলা যায়।

অফিসে সেদিন একটা ঘটনা ঘটল। খামে স্ট্যাম্প মারতে গিয়ে দেখি একটা চিঠি বেরিয়ে পড়েছে। চিঠিফিটি আমি পড়ি না। কী দরকার খামকা ইংরেজি পড়ে। তবু কেন যেন চিঠিটা পড়ি, হয়তো হাতে কাজ ছিল না বলে। চিঠিটা পড়ে আমার সারা গা শিরশির করে উঠল। ডেইলি রেটে লেবার বুকিং নিয়ে একটা স্টেটমেন্ট যাচ্ছে ডাইরেক্টরেটে। বলা হচ্ছে, মাসে ছ’দিন হিসেবে পাঁচজনকে বুকিং দেয়া হচ্ছে। ওই পাঁচজনের নামও দেয়া হয়েছে। দুলালচন্দ্র বিশ্বাস, গুরুপদ গুছাইত, দয়ারাম রায়, রামরতন সিং আর শ্রীপতি দাস। তলায় সাহেবের সই। বাঃ, দুলাল ছাড়া সবাই ফলস। মানে ওদের টাকা ফলস সই করে তুলে নেওয়া হচ্ছে। চিঠিটা হালদারদাকে দেখাই। হালদারদা বলল, এ আর নতুন কী, তুমি নতুন তাই আশ্চর্য হচ্ছ। জানো কতরকম চুরি আছে। পেটি ভাউচারই হয় মাসে চার হাজার টাকার। অর্ধেক ফলস। আমায় পাগল বানিয়ে সরিয়ে রেখেছে। ভাবে কিছু বুঝি না। এ নিয়ে একটা কবিগান আছে আমার। শুনবে?

আর কবিগান শুনতে চাই না হালদারদা।

আমি ভাবি আমার কী। যা হচ্ছে হোক। গাঁয়ের ছেলে আমি, চাকরি করতে বিদেশে এসেছি, কী দরকার আমার। আমি সেদিন একটা ব্যানলনের গেঞ্জি কিনি। দোকানদার বলল, স্মার্ট দেখাবে। আপনাকে!

সন্ধ্যাবেলা বদ্রীনাথ আমাকে ডাকল। একটু মদত করুন স্যার। হামারা ইউসুফ দস্তখত শিখতে চায়। আপনি একটু লিকে দিন, ও ঠিক ধরে লিবে, দিমাক বহুত সাফ। আমি সেদিন ওদের ইস্কুলে যাই, বদ্রীনাথের উপুড়করা প্যাকিং বাক্সের উপর বসি, আর ওমনি নর্দমা থেকে ছুটে আসা বাতাসে জয়ধ্বনি! রাস্তার শালপাতা নাচে। আমি একটা সাদা কাগজে লিখি ইউসুফ আলি। আর নোংরা গেঞ্জি হলুদ দাঁত নয়-দশ বছরের ছেলেটা আমার হাতের লেখার উপর মকস করতে গেলে বদ্রীনাথ বলে, জয় রামজিকি।

বদ্রীনাথের কাছে জানতে পাই, ও যখন আসানসোল ছিল, অ্যাডাল্ট এডুকেশন স্কিমে ও রাতের বেলায় কিছুদিন পড়াশুনো করেছিল! সেই পড়াশুনো ও বৃথা যেতে দেয় না। ও অক্ষর দান করে। আমি বদ্রীনাথকে বলি, আমিও তোমার সঙ্গে আছি বদ্রীনাথ, আমি অঙ্ক শেখাব। ইংরেজিও।

সন্ধ্যার পরই টান অনুভব করি কীরকম। অফিসে ক্যারাম পেটাই না। সোজা ট্রেনে চেপে বসি। ট্রেন লেট করলে বিরক্ত হই। আমি যেন হাঁস। বদ্রীনাথের ইস্কুল যেন দূর থেকে ডাকে, আয় আয় আয়, চই চই। আমি এখন মাস্টারজি। আমায় দেখলে ওরা উঠে দাঁড়ায়, ওরা পরনাম করে। আমি জানি ওরা কেউ বেশিদিন আমাদের ইস্কুলে নেই, কচি দু’হাত উপযুক্ত হলেই ফুচকাওলা হয়ে যাবে কিংবা পকেটমার। উপুড়করা প্যাকিং বাক্সের উপর বসে আমি ওদের অঙ্ক করতে দি, সামনের ধানখেতে চারাগাছ বড় হচ্ছে, ধানে দুধ আসছে। আমি আনন্দে দাঁত বার করে থাকি। দাঁত কেলাই। আমার লজ্জা করে না।

অফিসে চুপচাপ থাকি। তবে দুলালকে দেখলে আজকাল কেমন একটা অস্বস্তি হয়। মনে হয় আমার কী যেন করার ছিল। দুলালকে দেখলে বুকের মধ্যে কাঠঠোকরা পাখি গর্ত খোঁড়ে। আর কাঠঠোকরা পাখির চোখে ডাঁটভাঙা চশমা। বদ্রীনাথের সঙ্গে যদি দেখা না হত তা হলে বোধ হয় এই অস্বস্তিগুলো হত না। দুলালকে এড়িয়ে যাই। দুলালই ডেকে কথা বলে। যেমন বলল, এই গেঞ্জিটায় আপনাকে খুব ইয়ে, এসমারট দেখায় স্যার। গেঞ্জিটা কত নিল? আমি মনে মনে বলি বাইরেটাই দেখছ দুলাল, ভিতরের ব্যাপারটা জানো না তো, তোমার সেই কার্তিক।

পাছা ফুঁড়ে মাথা পর্যন্ত গরান কাঠ।

পাছার ভিতর দিয়ে মাথা পর্যন্ত যেটা গেছে সেটা মেরুদণ্ড না? এটার জন্যই তো মানুষ সোজা থাকে। আমি একটা ডিকশনারি কিনি!

অনেক রাত পর্যন্ত বানান ঠিক করে করে অনেক কষ্টে ও টেনশনে আমি একটা চিঠি লিখি। মিনিস্টারকে। জানাই এই অফিসে দুর্নীতি চলছে। ফলস নামে লেবার পেমেন্ট হচ্ছে। এটা টাইপ করে দেব। নাম দেব না। ঘুমুই।

হেড-ক্লার্ক-এর ঘরে ডাক পড়ে। জেরক্স করা আমার পাঠানো ওই চিঠিটা। আমার পাশে অধিকারীবাবু ঝুঁকে পড়েছেন। নস্যির গন্ধ পাচ্ছি।

চিঠিটা আপনি লিখেছেন?

আমার শরীর ছুঁড়ে মাথা পর্যন্ত যেটা আছে সেটা কী? মেরুদণ্ড না গরান কাঠ?

আমি বলি, না তো!

এই যে দেখুন। টেনশন বানান টি আই ও এন।

আমি বলি, পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কারুর বানান ভুল হয় না?

দেখুন তো ভাউচারগুলো, কার টিপ সই?

দেখি কলসি, চাদর, খসখস কেনার কাঁচা রসিদ। তলায় টিপ সই। অধিকারীবাবু আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছিল প্রথম দিকটায়।

এটা কার টিপ সই?

আমার হতে পারে।

কোথায় খসখস?

কোথায় কলসি?

কোথায় চাদর?

ঘুম ভেঙে যায় আমার। আলো জ্বালাই। জল খাই। পাখাটা আর একটু বাড়াই। বগলে চন্দন পাউডার দি আর একটু। নীল মশারিতে ঢেউ। বাবার চিঠি এসেছে—সুখে থাকো। আমি মিনিস্টারকে লেখা চিঠিটা দলামোচড়া করি। কাঠঠোকরা পাখি উড়ে আসে। চোখে ডাঁটাভাঙা প্লাস্টিকের চশমা। বুকে বসে। যারে পাখি ঘরে যা। আমি নীল মশারিতে ঢুকে চিত হই। আমার দাঁত বেরিয়ে থাকে। সুখে ঘুমাই।

তোমরা ভাব কার্তিক সুখে আছে।

এদিকে যে…

অতএব, ১৯৮৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *