ভাবের গান

ভাবের গান

নাগরদোলা ঘুরছে। হাতা খুন্তি বেলুনচাকি প্লাস্টিকের এটা-ওটা, আর মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। চটের দেয়াল, ত্রিপলের ছাউনি।

ভাইফোঁটার মেলা বসেছে বিরহীতে।

যাদের ভাই দূরে রয়েছে তারা মন্দিরের দুয়ারে বা থামের গায়ে ফোঁটা দিচ্ছে আর যমদুয়ারে কাঁটা পড়ে যাচ্ছে। ভাই মরা বোনের কড়ে আঙুলের ফোঁটা থামের গায়ে নয়, মৃত ভাইয়ের কপালে গিয়ে পড়ছে আর যাদের ভাই নেই, সেই সব বোনেরা ওই মন্দিরের দেবতা মদনগোপালকেই ভাই পাতাচ্ছে।

মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের আজকের দিনের এসপেশাল—‘ভাইফোটা’ সন্দেশ। সন্দেশের গায়ে লেখা আছে ‘ভাইকে দিলাম।’

একটা বউ লক্ষ্মীঠাকুরনের মতো তার মুখ, সে রকম টানাটানা চোখ, নাকে নথ, দোকানে এল। সঙ্গে বুড়িমতো একজন।

টেবিল বয় দুলালচাঁদ অর্ডার নিতে আসে। বলুন ঠাক্‌মা, কী দোব।

কী আছে?

দুলাল বলতে থাকে—

ল্যাংচা, বোঁদে, লেডিকিনি, সন্দেশ,

রাজভোগ, রসগোল্লা, মিহিদানা দরবেশ

সরপুরিয়া, সরের নাড়ু সরভাজা,

নিমকি সিঙারা বালুসাই গজা…

বউটার মুখ থেকে হাসি ছলকে উঠতেই দুলাল থামে।

বুড়িটা বলে, অত কী হবে গো, উপোস ভাঙা মেঠাই ভাল যা আছে, দুটো করে দাও।

ক’টা সরপুরিয়া দিয়ে দুলালচাঁদ বলে, ভাল ল্যাংচা আছে, এসেপেশাল সন্দেশ আছে, দুটো খান না ঠাকমা, এই ভাইফোঁটার দিনে।

‘ভাইফোঁটায় আমাদের কী, ভাইফোঁটা তো তোদের।’

দুলালচাঁদের মুখখানার দিকে তাকিয়ে বুড়িটা বলল—

‘তোর ভাইফোঁটা হবেনি ?’

আমার কপালে কে ফোঁটা দিবে ? আমার হল পোড়া কপাল।

কেন ? তোর বুন নাই বুঝি ?

বুন নাই, মা নাই, বাপ নাই…

এবার ওই বউটা কথা বলল। কত কথা বলল। জল নিয়ে কথা, চা নিয়ে কথা, ভাই নিয়ে কথা। বউটারও ভাই নেই। ক’বছর আগে ছুরি খেয়ে মরেছে নবদ্বীপে। এই বিরহীতে ওর মামার বাড়ি। বউমার কত্ত বড় বংশ। নবদ্বীপের অদ্বৈতাচার্যের বংশ ওরা… বুড়িমা বলেছিল।

ওই টেবিলটার সামনে এত সময় দাঁড়িয়ে থাকছিল বলে মালিক দীনবন্ধু মোদক কতবার হাঁক দিয়েছে, তবু ছল করে জল নিয়ে কতবার ওই টেবিলে গেল দুলালচাঁদ। ওই বউটা জিজ্ঞাসা করল মা’র কথা বাপের কথা, দুলাল সংক্ষেপ সময়ে শুধু বলেছিল— বাপ-মা হারায়ে গেছে।

দু’ টাকায় ভাইফোঁটা সন্দেশ আনাল বউটা। কলাপাতায় সাপটানো তেলহলুদে কড়ে আঙুল ঘসে আঙুলটা দুলালচাঁদের কপালের দিকে নিয়ে যায়, বলে, বোস একটু, এই বেঞ্চিতে। কড়ে আঙুল কপাল ছোঁয়, দুলাল চোখ বন্ধ করে আর ওমনি চেয়ার টেবিল, জলের ড্রাম সব্বাই উলুধ্বনি মারে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে— বোঁচকা, ন্যাড়া, মালিক সবাই দেখছে ওকে। ভীষণ লজ্জা করে। দুলাল পালায়।

দুলাল বড় আনমনা। খদ্দের চাইছে পান্তুয়া, দিচ্ছে রসগোল্লা।

দীনবন্ধু মোদক মাথায় নরম টোকা মেরে বলে, একটু হুঁশ লাগিয়ে কাজ করবে দুলাল… খিস্তি দিল না।

ভোগের পাড়ার ঘোষেরা এল। দোকানে হুটোপুটি, কড়াতে নতুন তেল চাপল। পাঁচুদা হেড কারিগর। নিজেই ময়দা বেলতে বসে গেছে।

ঘোষেদের একজন গান শুরু করে দেয়।

তারপর মদনগোপাল—

তারপর মদনগোপাল কলির রাখাল ঘুরিতে ঘুরিতে,

চুপি চুপি ঢুকে পড়ে ঘোষেদের বাড়িতে।

ত্যাখন গা ধুচ্ছে বউ—

ত্যাখন গা ধুচ্ছে বউ, মাচায় ঝুলছে বড় বড় লাউ—

আর রাখালরূপী মদন বলে লাউ কি খেতে পাঁউ।

লাজের মাথা খেল…

লাজের মাথা খেল বউ ওগুলো গামছা ঢাকা দিয়ে,

বলে বে-আক্কেলে ঢ্যামনা ছেলে বলগে মাকে গিয়ে,

ত্যাখন রাখাল ছেলে…

অনেকে তাল দিচ্ছে। দোকানে বসা বউ-ঝিরা আঁচল মুখে জড়িয়েছে। হাসির শব্দ আসে।

গানের মধ্যে দুলাল জানতে পারল রাখালরূপী মদনগোপাল সত্যি সত্যি লাউ আর লাউশাক খেতে চেয়েছিল, ঘোষ বউ বোঝেনি। সেই রাতে ঘোষেদের লাউমাচা ছত্রাখান, মদনগোপালের গায়ের চাদরটা পড়ে আছে সেখানে। সেই থেকে ঘোষেরা মদনগোপালকে লাউ আর লাউশাকের ভোগ দেয়।

মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে এখন ভোগের গ্রামের ঘোষেদের আমোদ আহ্লাদ।

ওরে দেরে—আরও গরম গরম কচুরি দে—

বাঁশের খুঁটিতে লাগানো চটে সাঁটানো ছড়াগুলো পড়তে থাকে ওরা, আর বেড়ে, ব্বাহা এইসব প্রশংসার শব্দ করে। একজন ওই ছড়াটাতে সুর দিয়ে গেয়ে ফেলে

সব দই কি ভাল হয়

এমনটি তো কভু লয়

মহামায়ার দই-এর হাঁড়ির

সবক’টা দই ভাল হয়।

লোকটা বলে— বারেব্বা, দেখেছ। কর্তাভজাদের ভাবের গানের প্যারোটি হয়েছে— বলেই মূল গানটা গাইল— সব ফল কি মিঠে হয়/এমনটি তো কভু নয়/কতক গেল রৌদ্রে পুড়ে/কতকগুলো পচে যায়… বলে এ গান কে বেঁধেছে ?

দুলালচাঁদ কনে বউয়ের মতো নত মাথায় বলে— আমি।

অন্যগুলি ?

আমি।

হ্যাঁরে, তুই তো বেশ বড় বাঁধনদার রে, নাম কী তোর ?

দুলালচাঁদ।

দুলালচাঁদ ? বাব্বা, সতীমায়ের ছেলে ? তুই নিজে দুলালচাঁদ হয়ে দুলালচাঁদের গানের প্যারোটি করিস ? তোর মা জানলে প্যাঁদাবে।

দুলাল বলে, মাকে দাও না এনে, মায়ের হাতের প্যাঁদানিও মিঠা।

তা যা না, কাছেই তো, সতীমায়ের সঙ্গে দেখা করে আয়, মদনপুর ইস্টিশন থেকে রেলে চেপে কল্যাণী, তারপরেই ঘোষপাড়ায় সতীমায়ের থান।

কতক্ষণ লাগে !

আর কতক্ষণ ? একঘণ্টাও নয়, তুই কি সত্যিসত্যিই যাবি নাকি রে পাগলা ?

মালিক কি ছাড়বে, আজ মেলার দিন।…

তোর বাবা মদনগোপালকে বল, মালিকের মতি ফেরাতে, তোর মা তো আবার আমাদের বাবার প্রথম পক্ষ।

সে আবার কী ?

তখন এক গপ্পো শুনল দুলালচাঁদ। মদনগোপালের প্রথম পক্ষটিকে ডাকাতে কলঙ্ক করে। এ নিয়ে মদনগোপাল ঠেস মেরে কথা কয়েছিলেন তাঁর পরিবারকে। উনি তখন অভিমান করে যমুনা পেরোয়ে চলে গেলেন ঘোষপাড়া। রামশরণের পরিবারে সতীমা হলেন। আর তাঁরই ছেলে দুলালচাঁদ। হাজার হাজার লাখ লাখ লোক তেনাকে মানে…আর এদিকে মদনগোপাল বিরহে দিন কাটাতে লাগলেন। তাইতে এই গাঁয়ের নাম হল বিরহী।

সব তো ভুলেই ছিল ও। তার ঢ্যাঙাপানা বাপের চেহারাটা ক্রমশ আবছা হয়ে এসেছে। আর মায়ের কথা মনে হলেই সতীমার ডালিমতলায় ভীষণ ভিড়ের মধ্যে আলতা-সিঁদুর আর রক্তে ল্যাপটানো মায়ের ছবি ভাসে। ও তখন দুলালচাঁদ ছিল না। ওর নাম ছিল দয়াময়। দয়াময়রা কর্তাভজা। ওর বাপ-মায়ের গলায় কণ্ঠি। ওরা একসঙ্গে গান করত— ভাবের গান। একদিন খুব ঝগড়া-চেঁচামেচি হল মা-বাবায়। তবে চললাম, বলে চলে গিয়ে আর এল না দয়ার বাপ।

দয়ার মা কত কাঁদল, চাঁদপিরের থানে গোলকচাঁপা গাছে ঢিল বাঁধল। গণকঠাকুরকে হাত দেখাল। তারপর একদিন— দোলের দিনে দয়ার মা দয়াকে সঙ্গে নিয়ে গেল সতীমায়ের থানে। মায়ের দয়া হলে সব হয়।

সেদিন দয়ার এক হাতে মুড়ির পুঁটলি আর অন্য হাতে মায়ের আঙুল। লোকজন-নাগরদোলা-জিলিপি-পাঁপরভাজার ওই কোলাহলের মধ্যেও মায়ের হাতের নীল শিরাটা নিঝ্‌ঝুম রাস্তার মতো এঁকেবেঁকে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল।

ওর মনটা কীরকম হু হু করতে থাকে। দুপুরের দিকে একটু ছুটি চায় ও। মালিক ভিরমি খায়। এই মেলার দিনে কেউ ছুটি চায় ? মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি ?

মেলার মাঠের পিছনে পড়ে থাকা মরা যমুনার সোঁতায় দমকা বাতাসে পাতা ওড়ে।

মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দুলালকে পাওয়া যাচ্ছে না।

দুই

ঘোষপাড়ার আমবাগানের ছায়ায় দুলালচাঁদ ঘোরে, সামনে দুঃখিনী মাঠ, ওধারে কর্তাবাবাদের বাড়ি। কোথায় গেয়েছিল দুলালের মা, কোন আমগাছ তলায় বসে—‘এক ডালেতে দুলছে দুটি ফুল ফুলের রং চিনে ফুল বেছে তোল…’

এই তো সেই পুকুরটা, এর চারপাশেই ঘুরেছে নাগরদোলা, বেজেছে বেলুনবাঁশি।

পুকুরেই চান করেছিল মা। ভেজা কাপড়ে হত্যে দিতে দিতে ডালিমতলার দিকে গিয়েছে দুলালের মা, হাওয়ায় দু’হাত, আঁচল লুটায়… জয় সতী মায়ের জয়— শব্দ ঝড়ের মধ্যে কচি গলার কান্নাটা হারিয়ে গিয়েছিল।

ডালিমগাছে সতীমায়ের উত্থান হয় দোলের দিনে। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। দুলালের মা মুঠোর মধ্যে লোহা-সিঁদুর নিয়ে জয় জয় গো সতীমা— বলে হাজার লোকের হাউ হাউ ভিড়ের মধ্যে চলে গেলে ভিড় ওর মাকে নিয়ে নেয়।

ডালিমগাছ সেদিন কল্পতরু। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। দুলালের মা কি ডালিম গাছকে মনোবাঞ্ছা জানাতে পেরেছিল ? কেননা কোলাহলের মধ্যে চিৎকার, চিৎকার ভীষণ হল, তুমুল হল, তারপর একসময় কোমল হল। ভিড় ছিত্তিস্থান হল, ভিড়ের মধ্যে অন্য একটা ভিড় ওর রক্তমাখা মাকে নিয়ে এল। কল্পতরু ডালিম গাছের গোড়ায় গিয়ে লুটিয়ে পড়েছিল ওর মা, তারপর হাজার মানুষের পা ওই পোয়াতি শরীরে পড়েছে। কাদামাখা শাড়ি করমচা লাল মায়ের মুখের কষ বেয়ে লাল, নাক বেয়ে লাল।

এই রক্তিম শরীরটা ঘিরে এবার অন্যরকম ভিড়। ইনি যে সাক্ষাৎ সতী। ডালিম থানে দেহ রাখলেন। সতী মায়ের কৃপা আছে নির্ঘাত।

মায়ের খাংলা চুল ক্রমশ সিঁদুরে সিঁদুর, পায়ে আলতা, শরীরে ফুল। দয়াময় তখন ভীষণ শব্দে মা বলে আর্ত চিৎকার করেছিল। লোকেরা বলছিল:

এই বুঝি এনার ছেলে, আহারে কী সুন্দর দ্যাখো,…সাক্ষাৎ দুলালচাঁদ।

ওগো সতীমায়ের ছেলে, একটু দাঁড়াও পেন্নাম করি।

কোথায় গেল আমার মা ?

তোর মা সগ্‌গে গেল বাছা, সগ্‌গে। ওর মা মর্গে চলে গেলে দয়াময়কে মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক কাছে ডেকে নেয়। নাম রাখে দুলালচাঁদ।

সমস্ত মাঠটা এখন থম মেরে পড়ে থাকা মায়ের হাতের নীল শিরাটার মতো নিঝ্‌ঝুম। থুক করে থুতু ছিটোয় দয়াময়।

তিন

খুব ভয়ে ভয়ে সন্তর্পণে বিরহীর মেলার মাঠে ঢোকে দুলাল। মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের হ্যাজাক জ্বলছে। সুড়ুৎ করে ঢুকে গেল দুলাল, হেড কারিগর পাঁচুদা বলে— বাইরে ডাঁড়া দুলাল, সেই দুক্কুরবেলা দোকান পালিয়ে এখন এই এখন এলি ! মালিক মানা করেছে। বাহ্যি ফিরে আসুক উনি, কথা কয়ে নিস।

দুলাল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নখ খোঁটে। একজন খদ্দের অন্য খদ্দেরকে বলে—মালিক কেমন রসিক দেখেছেন— কেমন ছড়া লিখে রেখেছে ‘রাম ভজে কৃষ্ণহরি রহিম ভজে আল্লা। রাম রহিম মিলেমিশে ভজরে রসগোল্লা।’ দারুণ লিখেছে। ব্বাঃ। বাঃ শব্দটা বুলবুলি পাখি হয়ে দুলালচাঁদের কাঁধে দোল খায়। দুলাল নখ খোটা বন্ধ করে। দুলাল এক গামলা টগবগানো লেডিকেনির অনুভূতিতে বলে—ওইটা পড়ুন তো, ওইটা,

লোকটা পড়ে—

আসল দুধের না হলে কি

সরপুরিয়া নরম হয়

পাউডার দুধ দিলে পরে

আসল স্বাদটি নাহি রয়।

চমৎকার ! তোমাদের মালিক তো সত্যিই বড় রসিক লোক হে। দুলাল মাথা নিচু করে, আঙুল কামড়ায়। কিছু বলে না, শুধু খুশি হয়, বড় খুশি হয়।

কীরে উল্লুক। ফিরলি যে বড়, যা— যেথা গেছিলি যা—

দুলালের মাথা নিচু।

কীরে শোরের বাচ্চা, কথা কইছিস না যে…

মা তুলবেন না।

ঠাস করে চড় পড়ে দুলালের গালে। আবার বড় গলা ? কুচকি-কণ্ঠা সমান হয়েছে দেক্‌চি। খুব আস্পদ্দা। তোর কাজের দরকার নেই এখানে। নাই দিয়ে মাথায় তোলা হয়েছিল…ভাগ। তুই তোর মালপত্র নিয়ে এখনই ভাগ।

দুলালচাঁদ টেরা তাকায়।

বেতন ? তিন মাসের ?

বেতন ?—নেঃ—

ছুটে গিয়ে ক্যাশ বাকশো থেকে কয়েকটা দশ টাকার নোট নিয়ে ছুড়ে ফেলে দীনবন্ধু। দুলাল কুড়িয়ে নেয়। চারটে।

আর ?

হিসেব করে কেশনগরের দোকান থেকে নিয়ে নিবি।

আর আমার গানগুলান ?

মানে ? গানগুলান মানে ?

আমি যে গানগুলান বেঁধেছি ?

‘আমার কাগজ, আমার আটিস, বলে কিনা আমার গান !

যাঃ তাই নে ?’ এই শব্দ ক’টা উচ্চারণ করতে যতটুকু সময় লাগে ঠিক ততটুকু সময়ের মধ্যে দীনবন্ধু ছুটে গিয়ে পিছনের চটের উপর সাঁটানো আসল দুধের না হলে কি সরপুরিয়া নরম হয় ছিঁড়ে ফেলে। চটের দেয়াল থিরথির করে কাঁপে। দুলালচাঁদ দু’হাত তুলে আর্তনাদ করে, বলে, থাক ! থাক।

ততক্ষণে ওটা ছেঁড়া এবং দলাপাকানো হয়ে গেছে। দুলালচাঁদ চটের দেয়ালের ফাঁকার দিকে থাকে।

গানটা তবু থেকে গেল কিন্তুক।

দীনবন্ধু পিছনে তাকায়। চটের গায়ে কয়েকটা সাদা চল্‌টা ছাড়া কিছু দেখতে পায় না। দীনবন্ধু তখন আরও তিন-চারটে পোস্টার ছিড়ে ফেলে। হাঁপায়।—যা— নিয়ে যা…

গান একবার দিলে আর নেয়া যায় না। দুলাল বিড়বিড় করে। চোখে জল। দুলাল ফিরে যায়।

চার

মা মরা দয়াময়টা যখন ঘোষপাড়ায় মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে এসে পড়েছিল, ও তখন নেহাৎ বাচ্চা, বাঁ হাতের চেটো শিকনিমোছার কারণে খড়খড়ে, গা চুলকোলে হাতের মাদুলি বাজত ঝনঝন। মালিক ওর নাম রেখেছিল দুলালচাঁদ। ও জানত ও দুলালচাঁদ নয়। দুলালচাঁদ শুধু একটা ইয়ারকি।

ওর গানের গলা ভাল ছিল। ওর মায়ের কাছে শোনা ভাবের গানগুলি আবছা মনে ছিল দুলালের। গাইত দু-এক কলি। আর ইয়ারকি করে গান বাঁধত পান্তুয়া নিয়ে, সিঙারা নিয়ে, দরবেশ নিয়ে, রসগোল্লা নিয়ে।

মালিকের বড়ছেলে সুধাবিন্দু গত বছর বি কম পাশ দিল। এখন ব্যবসাপত্র দেখতে শুরু করেছে একটু একটু করে। ছেলে এসে দোকানে নতুন লাইট লাগিয়েছে, নতুন আলমারি। সুধাবিন্দু একদিন দুলালচাঁদকে ডাকে। বলে, হ্যাঁরে, তুই নাকি গান বাঁধিস ? দুলাল বোঝে না গান বাঁধা ব্যাপারটা ভাল না খারাপ। ও চুপ করে থাকে। পাঁচুদা বলে, চুপ মেরে আছিস কেন ? দাদাবাবুকে বল না। রসগোল্লার গানটা দুলাল প্রাণে বল পেয়ে বলে।

রাম ভজে কৃষ্ণহরি রহিম ভজে আল্লা

রাম রহিম দু’জনাতে ভজে রসগোল্লা।

সুধাবিন্দু বলে, বাহ। আর একটা—

সুধাবিন্দু দুলালকে বাড়ি ডেকে নিয়ে গেল একদিন। পা-জামা পরা গালে চাপদাড়ি একজন লোক ওখানে বসে চা খাচ্ছিল। দুলালকে বলা হল দোকানের খাবারটাবার নিয়ে ও যত গান বেঁধেছে সবগুলো বলে যেতে। দুলাল তখন ‘হরি চিত্ত হরি বিত্ত হরি নিত্য’ গানের মতো করে ‘সরের নাড়ু সরপুরিয়া সরভাজা ও সন্দেশ’ গানটা বলল, ‘সব ফল কি মিঠে হয়’ গানটার মতো করে ‘সব দই কি মিঠে হয়’ বলল, ‘সুধা ফেলে বিষপানে মত্ত অতিশয়’ গানটার মতন করে ‘ঘি ফেলে রেপসিডে ভাজা খাও মহাশয়’ গাইল ‘আপন হতে না পাকিলে, গাছের ফল কি মিঠা হয়’ গেয়ে নিয়ে দুলাল গাইল ‘আসল দুধের না হলে কি সরপুরিয়া নরম হয়, পাউডার দুধ দিলি পরে আসল স্বাদটি নাহি রয়’আর দাড়িওয়ালা লোকটা কী সুন্দর কাগজে কত রকমের রং-এ ওর গানগুলো আঁকল, দুলাল তো ভাল করে পড়তে পারে না, তাই— জানল না কোনটা ওর সরপুরিয়ার গান, কোনটা রসগোল্লার, শুধু ওর সেবেলার পড়ে পাওয়া ছুটিটা ওর গানের কথার ছবি হয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে একরকম ভালই কেটে গেল।

আর্টিস্টকে দিয়ে আঁকানো পোস্টারগুলো এই মেলাতেই প্রথম লাগানো হয়েছে। প্রথম দিন সুধাবিন্দু এসে লাগিয়ে দিয়ে গেছেন। দুলাল কিন্তু জেনে গেছে— কোনটা ওর রসগোল্লার গান, কোনটা সরপুরিয়ার, মেনুলিস্টির পাশে কোন গানটা লাগানো আছে।

ওইসব কিছু ছেড়ে দুলালের চলে যেতে হয়। বেলুনবাঁশির শব্দ আর পাঁপড় ভাজার গন্ধ আবছা হয়। পিচরাস্তায় বাঁক নেয় দুলালচাঁদ।

পাচঁ

বিরহী বাজারের বাসরাস্তায় সকালবেলার দিদির সঙ্গে দেখা। দুলাল অনেকটা হেসে বলল, কী গো দিদি ! দিদি মুচকি হাসলেন। দুলাল পেন্নাম করার জন্য নিচু হতেই লাল চটি সরে গেল। দিদির সঙ্গে একজন লোক। ফুলপ্যান্ট—গেঞ্জি। কপালে তেল হলুদের ফোঁটা। উনিই বোধহয় দিদির মামাতো ভাই। সারাদিন দিদি তবে এখানেই ছিল। এখন বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে।

দুলালচাঁদ দিদির চোখের কাজলরেখার দিকে সোজা তাকিয়ে বলে— আমার কাজটা আর নাই দিদি, আমার কী হবে ?

কাজলরেখা কুঞ্চিত হয়। দুলালের চোখের তলা চিকচিক করে ওঠে, জলটাকে কোনওমতেই গড়াতে দেয় না। রানাঘাটের বাস চলে আসে— হুড়মুড় করে। দিদি আর সেই বুড়িমা উঠে যায়। দিদি হাত নাড়ায়,… লোকটা হাত নাড়ায়। লোকটা দুলালকে বলে— কাজ করবি তো চল।

অদ্বৈত মহাপ্রভুর আত্মীয়বংশের ছেলে বাপি গোস্বামীর ব্যাংকলোন পাওয়া জুতোর দোকান গোস্বামী সু হাউসে কাজে লাগল দুলালচাঁদ। ঝাড়ু দাও, জল আনো, হয়ে গেলে দোকানেই থাকো, চা-টা এনে দাও,—এইসব। দুলাল ধীরে ধীরে বাটারফেলাই ৬ নম্বর আছে, মোকাসিন ৭ নম্বর নেই শিখে যায়। কিন্তু কাজে মন লাগে না। সেই যে মেঠাই দোকানে, উছলানো তেলের মধ্যে কচুরিগুলোর ক্রমশ ফুলে ওঠা, টগবগানো রসে রসগোল্লার নাচ, দলদলে ছানা ফুলেফেঁপে হয়ে উঠছে রাজভোগ, আর বোঁচকা, ন্যাড়া, পাঁচুদা, আর গান বাঁধা মেঠাই দোকানের মজাই আলাদা। এই গোস্বামী সু হাউসে, একদিন দুলালচাঁদ মালিক গোঁসাইকে বলব বলব করে বলেই ফেলেছিল, একটা গান বেন্ধেছি দেওয়ালে টাঙায়ে রাখবেন বাবু ?

কী গান ? টেপ রেকর্ডের আর ডি বর্মনের ভল্যুম কমে।

ভোলামন…

পরে নে গোঁসাইয়ের জুতো

পাড়ি দে বৈকুণ্ঠেতে—

পাবি ধন মনের মতো—

থাম। জুতো পরিয়ে বৈকুণ্ঠ পাঠাতে হবে না। খালি পাকামি। টেপ রেকর্ডের ভল্যুম বাড়ে। জিলেলে…জিলেলে…

একদিন কী যেন হাঁক পাড়ছিল মালিক। দোকানের কোনায় বসে থাকা দুলালের তখন অন্যদিকে মন। মালিক দুলালের দিকে তাকিয়ে ধমক দিল জোরে। বলল, কতদিন বলেছি… কাজের সময় এখানে রামপ্রসাদগিরি চলবে না। টেনে অ্যাইসা থাবড়া দেব না তোর গান বাঁধা এক্কেবারে ঢুকিয়ে দেব। ধুস, বলে দুলালচাঁদ সেদিনই পালায় !

ছয়

কেষ্টনগরে ফিরল দুলালচাঁদ। হাঁটি হাঁটি পা পা- করে এগুতে থাকল মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দিকে। ও কান ধরে ক্ষমা চেয়ে নেবে। দোকানের কাছাকাছি চলে এলে মুখে কাঁচুমাচু ভাব আর একপোঁচ ফ্যাকাশে রং। দূর থেকে দোকানটার দিকে তাকায়। এটাই কি সেই দোকান ? চেনাই যায় না। চকচকাচ্ছে টেবিল চেয়ার, ফ্যান ঘুরছে বন বন বন, কত আলো ঝলমলায়, দোকানের ভিতরে বাহারি রং, আর ওই তো, ক্যাশে বসে আছেন সুধাবিন্দু দাদা।

দুলাল আরও দ্যাখে, দেয়ালের গায়ে, নামের গায়ে, মেনু লিস্টের পাশে কাচ বাঁধানো কিছু বাহারি লেখা ফ্রেমের গায়ে সাঁটা। অক্ষরগুলির গায়ে জরির ঝিকিমিকি। দুলাল পড়তে পারে না তাই জানে না অক্ষরগুলির মর্মকথা।

দোকান থেকে বের হল ন্যাড়া। টাকা ভাঙাতে যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে ন্যাড়াকে ধরে দুলালচাঁদ। ন্যাড়া ভীষণ অবাক হয়। দুলালচাঁদ— তুই ?

ন্যাড়া জানায়—পুরনো কিছু নেই। শুধু ন্যাড়া আর গানগুলান।

কোন গানগুলান ? দুলালচাঁদের ব্যাকুল প্রশ্ন। ন্যাড়া হাসে। তোর। দুলাল দ্যাখে কাচ বাঁধানো জরির অক্ষর।

ও তবে ছিল। গান হয়ে ছিল। এতদিন তা হলে এখানেই ছিল দুলালচাঁদ।

গান ফিরোয়ে দিতে পারেনি মালিক। জরির অক্ষর ঝিকিমিকি ডাকে। ওই তো আসল দুধের না হলে কি, ওই তো রসগোল্লার গান, ওই তো পান্তুয়ার গান…।

একগাছ শিউলি ফুল ঝরঝর করল দুলালচাঁদেরই সর্বাঙ্গে, এক পুকুর শাপলা ফুটল। এক কড়াই রসে টগবগানো রসগোল্লা খিলখিল হেসে উঠল। বহে গেল ভরা জলঙ্গীর স্রোত। ও তবে ছিল। ওর গান এতদিন ছিল। ও এখানেও ছিল।

মালিক সুধাবিন্দু একবার ওর দিকে তাকায়। তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। চিনতে পারল না ? নাকি ও কেউ নয় আর। ওর গানগুলো জরির অক্ষর হয়ে খদ্দের ডাকে। ও কেউ নয় আর।

তবু দুলালচাঁদ এগোয়। দোকানের ভিতরে আলো, রং আর কাচ বাঁধানো জরির অক্ষর।

দুলাল তবু এগোয়। পেরুল চৌকাঠ। বলে, এলাম গো দাদাবাবু, আবার এলাম। সুধাবিন্দুর কপাল কুঁচকে যায় আর কাচ বাঁধানো দুলালচাঁদের গান দেওয়ালে দেওয়ালে উলু দিয়ে ওঠে।

পরিচয়, ১৯৮৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *