পূর্বজন্মের ভাই

পূর্বজন্মের ভাই

তান্ত্রিকাচার্য পণ্ডিত শ্রীবামাভূষণ চক্রবর্তী তান্ত্রিক উপায়ে সর্বরোগের উপশম করেন। মোকদ্দমায় জয়, পরীক্ষাপাশ, সুপাত্রে বিবাহ ইত্যাদির জন্য পরামাশ্চর্য ‘কামদা কবচ’। নির্বাচন জয়লাভ, দৈবধনপ্রাপ্তি, পুত্রসন্তানলাভ, লটারির পুরস্কারলাভ ইত্যাদির জন্য ‘স্পেশাল কামদা কবচ’। মনোমতো পুরুষ বা নারী যেই হউক না কেন, বশীভূত করিবার জন্য ‘বগলামুখী কবচ’, কোষ্ঠি-বিচার, যোটকবিচার, ভবিষ্যত-গণনা ইত্যাদি কার্য মহাকালীপ্রদত্ত আশ্চর্য শক্তিবলে হইয়া থাকে। শত্রুবিনাশ, নজর-লাগার প্রতিবিধান, গোপন ব্যাধির প্রতিকার হইয়া থাকে। ডি এম সাহেব মাননীয় এম এল, মুন্সেফ, যাত্রাজগতের পবনকুমার ও ঝর্ণাকুমারী, বনগ্রাম বার্তার সম্পাদক রমণীমোহন মণ্ডল এম এ সাহিত্যতীর্থ, হাইকোর্টের জজ বি সি ঘোষ, সিবিল সার্জন মি. এম এম কাঞ্জিলাল এন বি এম আর সি পি ও আরও বহু গণ্যমান ব্যক্তি-কর্তৃক উচ্চ-প্রশংসিত।

—ভক্তবৃন্দকর্তৃক প্রচারিত।

এই হ্যান্ডবিলগুলো ঠাকুরনগরের হাটে বিলি করে নকুল। ‘মাসিক বন্ধ ? ভয় কী ? পাঁচ মিনিটেই আরোগ্য।’—এই পোস্টারের ওপর ওই হ্যান্ডবিল আঠা দিয়ে মেরে দেয়। ‘স্বপ্না সিনেমায় চলিতেছে পিস্তলওয়ালী—পরবর্তী আকর্ষণ সতীসাবিত্রী’—এই পোস্টারের চারপাশেও নকুল হ্যান্ডবিল মারে। কর্তামশাইয়ের শিষ্য নটবর হয়তো কালই আসবে, তত্ত্বতালাশ করে যাবে। নিকেশ নেবে।—কীরে নকুল, ফাঁকিবাজি শিখেছিস ?—ভজার চায়ের দোকানে এত কম মেরেছিস কেন ? সারের দোকানে একটাও দেখলাম না যে !

‘হৈমপতি’ ডাক্তারখানায় মারবে বলে নটবর যতবারই মারতে গেছে বুড়ো ডাক্তার খেঁকিয়ে উঠেছে। সামনের রুগিদের বলে—মাদুলিতেই যদি সব হবে তো আগের হাটে কর্তামশাই এখান থেকে পালসেটিলা কিনে নিয়ে গেল কেন ?

হাটের কাজ সেরে, সন্ধের আগে-আগেই রিকশায় বেল মারতে মারতে ফিরে আসে নকুল। রিকশার নাম ‘মায়ের খেলা’। ‘ভাড়ার জন্য নহে’—বামাভূষণের প্রাইভেট রিকশা। ডবল আয়না ফিট করা। বেলও আছে , রবারের হর্নও আছে। কর্তাবাবুরাই এই রিকশা চড়েন। নকুল এদের বিশ্বাসের পাইলট।

কর্তাবাবু কাল ভোরের ট্রেনে কলকাতা যাত্রা করবেন। বড়মেয়েটির সন্তান হয়েছে—এগারো দিন হল। যাই যাই করে যাওয়া হচ্ছে না। একদিন চেম্বার কামাই মানে কত লোকসান। উকিল, ব্যারিস্টার আর ডাক্তার-জ্যোতিষী-তান্ত্রিকদের হল এই এক মহা ফ্যাচাং। বামাভূষণ চক্রবর্তীমশাই ভাত খাবার পর বজ্রাসনে বসেছেন। ইড়া ও পিঙ্গলার মধ্যবর্তী চিত্রা নাড়িতে ঘেরণ্ড সংহিতা মতে বায়ু প্রশমিত করতে করতে ছোটমেয়ে মাধুরীকে বললেন ফর্দটা পড়ো তো মা—

মাধুরী পড়তে থাকে—

রুদ্রাক্ষ—২০০;

হরীতকী—২ কেজি;

চকখড়ি, খাম

নাক্স ভোমিকা—২০০;

থুজা—২০০; অজিনা মটো

ওটা কী বললি মা, অজীর্ণের মতো !

বড় স্টেশনারি দোকানে অজিনা মটো পাওয়া যায়, বইতে লিখেছে।

এই বইটা প্রেজেন্ট পেয়েছে মাধুরী। রকমারি জলখাবার ও চাইনিজ রান্না—প্রীতি ও শুভেচ্ছাসহ, বিশ্বাসদা।

বিশ্বাসদা হলেন জে এল আর ও। কর্তামশাইয়ের সাথে ভারী ভাব ওনার। কর্তামশাইয়ের ছত্রিশ বিঘা জমিতে বর্গা রেকর্ড হতে পারত, বিশ্বাসবাবু করেননি। এটা কি কম উপকার ! এই রান্নার বইটা উপহার দিয়ে বিশ্বাসবাবু মাধুরীকে বলেছে—বাড়িতে এলে আর মোয়া নাড়ু ছানা ক্ষীর নয়। চাইনিজ প্রিপারেশন খাওয়াতে হবে। ওইসব আজব মশলাপাতি শহর ছাড়া মেলে না।

লিস্টি পড়ে যায় মাধুরী—

চিলি স্‌স্ সয়া সস ২ শিশি করে;

এগ নুডুলস চারশো গ্রাম;

হাওয়াই চটির ফিতে এক জোড়া;

কালো সুতা ২০ গজ;

তামার মাদুলি—২০০;

আর পদ্যগুলো বাঁধিয়ে আনবে মনে করে।

এই পদ্যদুটো হালে লিখেছেন শ্রীবামাভূষণ চক্রবর্তী। কিছুদিন আগে তাদের গ্রামের উপর দিয়ে তুমুল ঝড় বয়ে যায়। প্রচুর ঘরবাড়ি নষ্ট হয়। ওই ঝড় তাকে এই পদ্য লেখার অনুপ্রেরণা দেয়।

বন্যা খরা ঝড়ে

পাপী তাপী মরে

বাঁচিবার উপায় শুধু একটি আছে ভাই,

দেবদ্বিজে নতুন করে ভক্তি আনা চাই।

অপর পদ্যটা হল—

আধি ব্যাধি রোগ শোক সবই গ্রহের ফল

গ্রহশান্তি হলে হয় জীবন সফল।

বামাভূষণের বালবিধবা বোন কাপড়ের মধ্যে সুতো বুনে এইসব এমব্রোডায়রি করেছেন। অক্ষরগুলো সব আলাদা আলাদা রঙের। কর্তাবাবুর বারান্দায় যেখানে লোকজন এসে বসেন সেখানে দেয়াল জুড়ে এরকম অনেক কাচবাঁধানো পদ্য আছে।

ভোরের ট্রেনে যাত্রা, নকুল খুব ভোরে এসে হাজির। ওর পা শিশিরে ভিজেছে, পায়ের আঙুলে হাজাঘায়ের ফাকে দু-একটা ছেঁড়া দুর্বা-ঘাস, পা চালিয়ে এসেছে তো। নকুল ‘মায়ের খেলা’র লাল সিটের শিশির গামছা দিয়ে মুছে গাড়ি রেডি করল। কর্তামশাই কোষ্ঠিবিচারের শ্লেটটাতে চকখড়ি দিয়ে লিখলেন—‘তান্ত্রিকাচার্য আগামী রবিবার আসিবেন।’ শ্লেটটা বারান্দায় ঝুলিয়ে রিকশায় উঠলেন। মাধুরী আর বিধবা বোন দুর্গা দুর্গা করল। কর্তাবাবুর স্ত্রী থাকলে, আহা, তিনিও থাকতেন। রিকশায় এঁরা বাজারহাট যান, গণ্যমান্য লোকজন, যেমন পঞ্চায়েতপ্রধান, কালাচাঁদ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক, গোবরডাঙার জমিদারবাড়ির মেয়ে বাংলার হেলেন মিস কিটি, এঁনারা তাবিজ মাদুলি নিতে এলে ফেরার সময় নকুলই রিকশা করে স্টেশনে পৌঁছে দেয়। জে এল আর ও সাহেব মাঝে মাঝে আসেন, তেঁনাকেও নকুল পৌঁছে দেয়। সে যাই হোক।—সাবধানে থাকিস নকুল, বাড়িঘর তোর জিম্মায় রেখে গেলাম। গাড়িটা নিয়ে মাতব্বরি করিস না, দিদিমণি যা বলবে তাই শুনবি। পিছনের সিটে বসে চক্রবর্তীমশাই এইসব বলেন।

প্রাতঃকাল। শিশিরের সোহাগ রাত সারারাত পেয়েছে কাঁচা রাস্তা, তাই সাইকেল টায়ারের আলপনা রাস্তার গায়ে। পাতলা ছানির মতো পাতলা কুয়াশার আস্তরণ কেটে যাচ্ছে। স্থলপদ্মের মতো ফুটে উঠেছে গোটা চরাচর। সূর্যের আলো ডিম ফেটে সদ্য বেরিয়ে আসা নরম রোঁয়ার মুরগির ছানার মতো।

নকুল এসময় হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে—

আচ্ছা পণ্ডিতমশাই, আপনি কি ধ্যানযোগে বলতি পারবেন পূর্বজন্মে আমি কী ছিলাম ?

কেন বল দেখি,

না, জানতি ইচ্ছে করে।

পারি বইকী, পারি , মায়ের ইচ্ছে হলি মাঝে মাঝে সব বুঝতি পারি।

একবার ধ্যানযোগে বলি দেবেন তো কর্তা—। বড় জানতি সাধ যায়।

পথে জে এল আর ও সাহেব চলেছেন হেঁটে হেঁটে। শুধোলে উনি জানান, ভোরের ট্রেনে এনকোয়ারিতে চলেছেন; তবে তো কথাই নেই, রিকশায় ওঠা হোক। কলকাতায় যাচ্ছি, রবিবারে আসব, কিছু আনতে হবে নাকি স্যার ?

লিস্টিতে তামার মাদুলির পরে যোগ হয় জেলুসিল ট্যাবলেট আর দাড়ি কামাবার ক্রিম।

—একটা সুসংবাদ আছে, আমি ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছি, জে এল আর ও সাহেব বললেন।

সেকী ? কবে ? কত বড় দুঃসংবাদ। মহাচিন্তা এবং উদ্বেগের কারণ হল।

চিন্তার কোনও ব্যাপার নেই, আপনার সব কাজ তো করেই দিয়েছি। রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছি আপনার কোনও বর্গাচাষ নেই। পাম্পটা যাতে কুচকে মৌজার ৫৭ দাগের উপর বসে, সেরকম সুপারিশ করেছি। দেবোত্তর সম্পত্তিটা নিয়েও কোনও ঝামেলা রাখিনি।

সবই স্যার আপনার ইচ্ছা আর মায়ের দয়া।

নকুল ক’টা দিন অন্য মেজাজে থাকে। কাজ তেমন নেই। মায়ের খেলাটা করবী গাছের ছায়ায় রেখে দেয়। কখনও লাল সিটে বসে থাকলে, করবী গাছটা থেকে টুপ করে একটা করবী ফল খসে পড়লে নকুলের সাইকেলের ঘণ্টি টিং বেজে ওঠে।

তবে এরকম রাজার হালে সময় কাটানোর ফাঁক খুব বেশি পায় না নকুল। ফাইফরমাশ খাটতে হয়, জঙ্গল নিড়ানো, বেড়া দেওয়া এইসব। এ ছাড়া লোকজন এলে কর্তামশায়ের আসবার তারিখ বলে দেয়। ফিচলে ছোঁড়ারা মায়ের খেলার হর্ন টিপে পালালে নকুল মুখ খিস্তি দেয়—যাও না, বাপেরটা টেপো গে। খিস্তির লোভে ছোঁড়াগুলো বার বার হর্ন টিপে জ্বালাতন করে।

মাঠাকরুন স্বর্গে যাবার মাস দুয়েক আগে লাগিয়েছিলেন এই বাতাবিলেবুর গাছটা। নকুল বেড়া দিয়ে গাছটা রক্ষা করেছে। গাছেরা নকুল বুনোর জল নেয়, সেই জলে কচি পাতা হয়, ফুল হয়, সেই ফুল দেবতার প্রসাদে লাগে, ভগবান খায়। কিন্তু নকুলের ছোঁয়া জল কর্তামশাই খান না। নকুলের আনা জলে পা ধোয়া চলে। কিন্তু খাওয়া চলে না। নকুল গাছ থেকে ডাব পাড়লে ভক্ত শিষ্যদের সামনে কর্তামশাই মন্ত্ৰপড়া জল ছিটিয়ে তবে খান। কর্তামশাই এত এত আচারবিচার মানেন বলেই না তাঁর এত শক্তি ! তাঁর ফুঁ দেওয়া জলে আধি-ব্যাধি আরাম হয়।

দিদিমণি আজ নকুলকে বিকেল বিকেল ছুটি দিয়ে দিল। নকুল ছিপে কেঁচোর টোপ দিয়ে রেল লাইনের ধারের ঝিলে বসতেই একটা শোলমাছ খপাং। খাবে না বেচবে ভাবতে ভাবতে এগুচ্ছে, এমন সময় ইস্টিশনের টিকিটবাবুর সঙ্গে দেখা। মাছটা দেখেই টিকিটবাবু বললেন—বেচবি নাকি ?

হাতের লক্ষ্মী হেলা করতে নেই, বলল—বেচব। টিকিটবাবু দু’টাকার দুটো নোট নকুলের হাতে গুঁজে দিয়ে বলল—তবে দে।

শিক্ষিত লোকের এই বিচার। বাজারে দশ টাকার কমে পাবে ! নকুলের হাত মাছটাকে ঢিলে করে না।

কীরে দিবি নে ?

ধরেছি যে, আট টাকা লাগবে।

মাছ তো আর আচার্যমশাইয়ের শিষ্য নয় যে নিজে থেকে ধরা দেবে, ধরতে হয়। ধরতে তো পয়সা লাগে না, পাঁচ টাকা নিস।

নকুল মাছটা দিয়ে দেয়।—‘বাকি টাকাটা এখন নেই, কাল নিয়ে যাস’।

বারো আনার টিকিট বাইরের লোকের কাছে দেড় টাকায় কিনে নকুল দেখল জয় বাবা তারকনাথ। ভাবল যতই উড়োজাহাজ আকাশ ফালা ফালা করে উড়ুক কলের গান রেডিয়োর গান চালাক, যতই কলিকাল আসুক, ভগবানের মাহাত্ম্যে মানুষ হাত দিতি পারবে না। সিনেমা হলের পিছনে ফটিক সাহার দোকানে দু’ গ্লাস বাংলা খেল, তারপর ঘরে ফেরার পথে বাতাসে পেল আমের মুকুলের গন্ধ।

ঘরে ফিরতে একটু রাত। বউকে সোহাগ করতে গিয়ে কাপড়ে পেঁয়াজের গন্ধ পায়।

কী রেঁধেছিস ?

শুকনো মাছ, নংকা—প্যাঁজ দে।

জিভে জল আসে নকুলের। বলে—বাঃ।

আর ওমনি বাঃ শব্দটা নকুলের বউয়ের কানের লতিতে প্লাসটিকের দুল হয়ে নড়ে।

নকুলের বউ বলল—চাঁদের মাথাটা কেমন ফালি করে খাওয়া, তারপর ধরো আম-বকুলের সুবাস, এইসব দেখেশুনে আমার কেমন কেমন লাগল,—মাস্টারবাড়ি শুধোলাম,—আজ মাসের কত গো—বলে এগারো,—যা ভেবেছি সেই, আমাদের বিয়ের দিন। হাসে। হাসির শব্দটা জ্যোৎস্নায় গিয়ে মেশে। এবার নকুল পুকুরে গিয়ে মুখটা কুলকুচি করে মদের গন্ধ ধোয়, পেয়ারাপাতা চিবোয় তারপর ওকে চুমু খায়, বউয়ের আঙুলের নখকুনির পুঁজরক্ত নকুলের হাতে লাগে।

নকুল কড়া করে রান্নাকরা শুকনো মাছের তরকারি খেতে খেতে একটু উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে— আজ, জানলি তোরে রিকশা চড়াব। তুই জানলি, লাল সিটখানায় ঠ্যাং তুলে বসে থাকবি, আমি কুচকে ছাইড়ে, সুটেবাসা ছাইড়ে গোকুলি নদীর পাড় পর্যন্ত নে যাব। লাইলন মশারি দেখেছিস না বাবুদের বাড়ি, চাঁদের আলো দেখবি নাইলন মশারির মতো বিছোয়েছেন ভগবান পিরথিবীটার উপরে, আর ফুল নিয়ি আসব বাগান থে। গন্ধরাজ ফুল মাদুরে বিছিয়ে আজ শোব, ফুলশয্যা হবে। মদ খেয়েছি বলে রাগ করিসনি।

অনেক রাতে নকুল কর্তামশাইয়ের বাড়ির দিকে যায়। ঠাকুরঘরের পিছনের নিস্তব্ধ বাগান থেকে গন্ধরাজ আর কাঠচাঁপা তুলতে গিয়ে টের পায়, ঠাকুরঘরের ভিতর থেকে মানুষের গভীর নিশ্বাসের শব্দ। কান খাড়া করে শোনে। গোঙানির মতো মেয়েছেলের আওয়াজ। জানালা বন্ধ। ঠিক গোঙানি নয়, এ শব্দ অন্য রকমের, এ শব্দ শুনলে মন ঠিক থাকে না। নকুল জানালার উইপোকা খাওয়া ফোকরে চোখ রাখে। প্রদীপ জ্বলছে। ঘরে সামান্য একটু অংশ দেখা যাচ্ছে, একটা বালাপরা হাতের ওপর একটা ঘড়িপরা হাত। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। দরজা বন্ধ। দরজার গোড়ায় একজোড়া জুতো। অন্য জানলায় যায়। উই-নষ্টকরা গর্তে চোখ রাখে, সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নেয়। কী দেখল ! ছিঃ ! চোখের মাথা পড়ে যাবে না তো। নকুলের কোঁচর থেকে গন্ধরাজ ফুল পড়ে যায়। ওর কী করা উচিত এখন ? কর্তামশাই মা-মরা মেয়ের জন্য পাত্র দেখছেন। বিশ্বাস সাহেবের সাথে তো আর বে হবে না, সাহেব তো আর বামুন নয়। নকুল কী করবে—লোকটাকে প্যাঁদাবে ?—কিন্তু গাই-বাছুরে ভাব না থাকলে…

রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরায় নকুল—এমন সময় টর্চের আলো।—কে ? না— কর্তামশাই। এত রেতে ? কর্তামশাই বললেন—কলকাতার কাজ হয়ে গেল, একদিন আগেই ফিরে এলাম। ঠাকুরনগর স্টেশনে চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইল ট্রেন। কী—না তার চুরি গেছে। রাত আটটা-ন’টায় তার চুরি যেতে পারে ? অ্যাঁ ? চোরেদের এত সাহস ?

গাইবাছুরে ভাব না থাকলে…

নকুল নিজের মুখে আঙুল দেয়। চুপ।

কেন রে ?—গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করেন। নকুল কিছু বলে না, বলতে পারে না।

চাঁদের আলোয় নিজেদের ছায়াগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে—আমার জিম্মায় ঘরদোর দিয়ে গেছিলেন কর্তামশাই। কিন্তুক…

চুরি ? চুরি হয়েছে ?

ঠাকুঘরের সামনে ‘জেলারো’ সাহেবের জুতোজোড়া, ভিতরে তিনি—আর…আর ?

নকুল কিছু বলে না। ঠাকুরঘরের ওই জানলার দিকে এগোয়। ঝিঁঝির ডাক একশো গুণ বেশি হয় চারিপাশে। কর্তামশাই নকুলের পিছনে, নকুল যেন রথের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে কর্তামশাইকে। অম্বলের টক বমির মতো চাদের আলো ! নকুল ওই জানালার সামনে এসে থামে। কর্তামশাই জানালার ফাকে চোখ রাখে তারপরই—বসে পড়ে।

নকুল, বুনো নকুল, যার ছোঁয়া জল ফেলে দিতে হয়, সেই নকুলের হাজা আর কাদায় মাখানো পা দুটো চেপে ধরে হাউ হাউ করে ডুকরে ওঠেন কর্তামশাই। বলেন, কাউকে বলিস না, নকুল আমার দিব্যি। পূর্বজন্মে তুই আমার ভাই ছিলি। আমার মুখ রক্ষা কর নকুল। নকুল সরিয়ে নেয় পা, কর্তামশাই নকুলের হাত ধরে ফিসফিস করে—বউকেও বলিসনি নকুল, তুই আমার পূর্বজন্মের ভাই, মা-মরা মেয়েটার জন্য সদ্বংশের ব্যাংকে কাজ করা ব্রাহ্মণ পাত্র দেখে এসেছি। দু’কান করিসনি নকুল।

নকুল বলে, অধৈর্য হন কেন কর্তা, আপনি কত কী জানেন—ওই বদমাইশটারে বান মেরে দেন; মুখি রক্ত উঠে মরুক, খিলেন করি দেন,—হাত পা শক্ত হয়ে যাক।

কর্তামশাই কী বিড়বিড় করে—বোঝা যায় না।

নকুল বলে, কর্তা, পূর্বজন্মে যদি আপনার ভাই হয়ে থাকি, তবে হুকুম করেন কর্তা, ওই বদমাইশটারে প্যাঁদাই। আমি নকুল। বুনো নকুল। ভয় পাই না।

কর্তামশাই বলেন—ছত্রিশ বিঘা জমি বর্গা রে নকুল, দেবোত্তর সম্পত্তি, ডিপ টিউবয়েল। মাথা ঠান্ডা রাখরে নকুল, পূর্বজন্মে ভাই ছিলি তুই, কথা দে।

নকুল মাথা ঠান্ডা করে। ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞাসা করে—তবে কি কর্তামশাই আপনার খিলেন, মারণ, বশীকরণ সবই মিছা ?

কর্তামশাই বলেন, ওসব প্যাচালি এখন রাখরে নকুল, টিউকলে একটু পাম্প দে, জল খাব।

চাঁদের আলোয় নকুল দেখে কর্তামশাইয়ের কপালে ঘামের কুচো-কুচো ফোঁটা, নকুলের সাহস বাড়ে, নকুল নিজের গামছাটা দিয়ে কর্তামশাইয়ের ঘাম মুছিয়ে দেয়, কচুপাতা মুড়ে জল এনে একঢোঁক খাইয়ে দেয়, নকুলের সাহস বাড়ে। নকুল কর্তামশাইয়ের কানের কাছে মুখ নেয়। নকুল শাস্ত্রকথা বলে। বলে, দুঃখ ছাড়ি দেন কর্তা, সবই কলির খেলা, আরও কত কী দেকবেন। কর্তাবাবা জামরুল গাছে হেলান দিয়ে বসে আছেন। নকুল হাঁটুমুড়ে সামনে বসে। নকুলের সাহস বাড়ে। নকুল বলে, একটা রিকশা আমারে করি দেন কর্তা, নিজের রিকশা, সওয়ারি নেব, ম্যাজাজ ভাল না থাকলে আচ্ছা আচ্ছা বাবুদের মুখের উপর কয়ে দেব—এখন ভাড়া যাবনি, একটা রিকশার মালিক করে দ্যান কর্তা, ঠ্যাং তুলে বাজারের শিরিষতলায় বসে থাকব, আপনার ‘মায়ের খেলার’ জন্য ভাল লোক দেখে দেবনে…কর্তামশাই নকুলের গায়ে হাত দিলেন। বলেন, দেব। মাধুরীর বিয়েটা হলেই দেব।

কর্তামশাই আরও ঘনিষ্ঠ হলেন। নকুলের কানে কানে বলেন—আমি থাকলে গর্ভস্রাবটা লজ্জায় বের হবে না। তুই রিকশা নিয়ে এখানে বসে থাক, পাষণ্ডটা বের হলেই ওকে পৌঁছে দিস। যেন অসুবিধা না হয়। নকুলের মাথায় বিলি কেটে দেন কর্তামশাই—দু’কান করিসনে নকুল, আমি কথা দিলাম রিকশা করে দেব, তুই বটবৃক্ষ সাক্ষী রেখে কথা দে নকুল…।

প্রমা, ১৯৮৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *