মার্কেট ভিজিট ১৩

মার্কেট ভিজিট ১৩

ইন্দওর ভারি সুন্দওর শহর।

ভারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গা। চওড়া রাস্তাঘাট, ঝলমলে দোকানপাট, লোকজনের ব্যবহারও ভালো। আর ছাপ্পানদুকান বলে একটা জায়গা আছে, গোলগাপ্পা, রাজ কচৌরি আদি নমকিন স্ন্যাক্স ইত্যাদির জন্যে ভারতবিখ্যাত, এখানকার এগ বেঞ্জো যে না খেয়েছে তার পক্ষে….

দেখতে দেখতে নিজের শহর হাওড়ার জন্যে একটা হালকা দুঃখ বুকের মধ্যে চিনচিন করে। প্রায় একই তো পপুলেশন, তাও….হাওড়া যদি আধা শহুরে হতদরিদ্র কলহপরায়ণা বৃদ্ধা হয়, ইন্দোর তাহলে সদ্য যুবতী লাবণ্যঝলমল সহজ মফস্বলী বধূটি, সমৃদ্ধির এয়ো চিহ্ন সর্বাঙ্গে।

তা প্রথম দিন, আট তারিখ, ছিল কনজিউমার ভিজিট। যে কোনও একটি আম আদমি পরিবারে হানা দিয়ে তাঁরা কি করেন, কি দেখেন, কি ভাবেন, কি খান, কি পড়েন, বাড়িতে কে কে আছেন, কি কি আছে ইত্যাদির তত্ত্বতালাশ নেওয়া, যদি কোনও নতুন কনজিউমার ইনসাইট পাওয়া যায়। ধর্মশাস্ত্রে বলেছে আত্মানং বিদ্ধি, ম্যানেজমেন্টশাস্ত্র বলে কনজ্যুমারাৎ সমৃদ্ধি, অর্থাৎ তিনিই সেই বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম…তাঁকে জানলেই মার্কেটিং এর পরমব্রহ্মলাভ হয়, নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহনায়!

তা ইত্যাদির পর সন্ধ্যেবেলা বন্ধুবান্ধব অ্যাজ ইউজুয়াল একত্তর হয়ে যে যার বসের নামে গুচ্ছের গালমন্দ করছি, এমন সময় সবারই মোবাইলে টুংটাং আওয়াজ করে দুয়েকটা মেসেজ ঢুকলো। সবাই একসঙ্গে মেসেজ চেক করতে স্ক্রিনে চোখ রাখলাম….

তারপর কি হইলো জানে শ্যামলাল!!

যে ঝড়ঝঞ্ঝাবজ্রপাতজলোচ্ছ্বাসবন্যামহামারীভূমিকম্প ভেঙে পড়লো তার আর তুলনা নেই। আমরা হতচকিত, টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে ফেটে পড়লো উচ্চকিত তরজা আর আলোচনা, বাড়ি থেকে ঘনঘন ফোন, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজে আর জোক্সের বন্যা, সর্বোপরি ফেসবুকে ফের ফাটাফাটি!

সেই রাত্তিরেই বাইরে বেরিয়ে দেখি এটিএমের সামনে লম্বা লাইন। পান দোকান থেকে খানদানি আংগ্রেজি শরাব কি দুকান অবধি পাঁচশো কি হাজার টাকার নোট দেখালেই এমনভাবে আঁতকে উঠছে যে কহতব্য নয়। চারদিকে ‘যাহ সসালা, এ সব কি হচ্চে বাওয়া’ ভাব।

পরের দিন ৯ তারিখ আমাদের কনজ্যুমার ভিজিটের অ্যানালিসিস অ্যান্ড আইডিয়েশন পার্ট ছিল। ততক্ষণে ফেসবুকে যে যুদ্ধ লেগেছে তার কাছে কুরুক্ষেত্র, ওয়াটার্লু, স্তালিনগ্রাদ সব তুচ্ছ। ফেসবুক না হয়ে এ যদি সামনাসামনি হতো, কলকাতার জনসংখ্যা সেইদিনই হাফ হয়ে যেত, নীরদবাবু গোঁফে তা দিয়ে বলতেন, ‘আত্মঘাতী বাঙালি কি সাধে বলেছিলুম রে বাওয়া?’

সকালে গিন্নি ফোন করে জানালেন যে বাড়ির হাউসমেডটি এসেই হাউহাউ করছে, এই সপ্তাহেই সে মাইনে পেয়েছে, সবই পাঁচশো আর হাজারের নোটে। এখন সে কি করবে? দয়াপরবশ হয়ে গিন্নিকে বললাম, ‘ওকে বলো হাজার দুয়েক ক্যাশ পরে দিয়ে যেতে, আপাতত তুমি ওকে পাশের বিগ বাজার থেকে তোমার ক্রেডিট কার্ডে ওর যা লাগে তেমন হাজার দুয়েকের জিনিসপাতি কিনে দাও।’

দুমিনিট পরে গিন্নি জানালেন যে তিনি সলজ্জমুখে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। ওদের চওলের যে লোক্যাল মুদিশ্রেষ্ঠ, তিনিই আপাতত ধারবাকিতে জিনিসপত্র দিচ্ছেন, দু সপ্তাহের মধ্যে দিতে হবে এই কড়ারে।

তা সেই আইডিয়েশন সেশনে অশ্বডিম্বরূপ একটি আইডিয়া প্রসব করে সন্ধ্যেবেলা স্থির করলুম সদলবলে একটু বেরোব, ইন্দোর শহরটাও দেখা হবে আর তত প্রিভিলেজড নন এমন কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করে হালহকিকত বুঝে নিই।

কপালগুণে একটা ভাড়ার গাড়ি পেয়ে গেলাম, চারঘন্টার জন্যে আটশো টাকা নেবে, এবং কিমাশ্চর্যম, পাঁচশো টাকার নোটেই নেবে?

কেন বাওয়া, সারা দুনিয়া পাঁচশো হাজারের নোট দেখলে কুষ্ঠরোগীর মতন এড়িয়ে যাচ্ছে, তোমার অসুবিধা হবে না?

স্মিত হেসে ছোকরা জানালো কাল পরশু তাকে ব্যাঙ্কে যেতেই হবে ডিপোজিট করতে। আরো চারটে নোট না হয় এক্সট্রা হবে। ডিপোজিট করতে তো আর লিমিট নেই, ‘কাস্টমার কিঁউ ছোড়ে?’

তা তেনার গাড়ি চড়ে চারজন জ্ঞানপিপাসু বৈরাগী গিয়ে যে জায়গায় প্রথমে বডি ফেললাম, তার নাম রাজওয়াড়া। ইন্দোরের পুরোনো রাজপ্রাসাদ আর কি। তবে রাজওয়াড়া তখন বন্ধ। আশেপাশের বাজারহাট অবশ্য খোলা।

রাজওয়াড়ার ঠিক সামনে উদাস চোখে দুই অটোওয়ালা দাঁড়িয়ে, তাদের প্রথমজনকে পাকড়াও করি, ‘কি চাচা, কাজকম্মের হাল কি?’

দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ক্লান্ত উত্তর ভেসে আসে, ‘বহোত খারাব হালত বাবু।’

আমার আবার নাম্বার নিয়ে খুঁতখুঁতুনি আছে, খারাপ মানে কত খারাপ? ভালো মানে কত ভালো? কোয়ান্টিফাই প্লিজ।

বুঝলুম, তেনার দিনমানে হাজার টাকার মতন ব্যবসা হয়। শতিনেক টাকার পেট্রোল পোড়ে, আর পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দোবস্ত’ বাবদ আরও একশো, কুল্লে ছ”শো টাকা দিয়ে ঘরসংসার চলে।

আজ, এই সন্ধ্যেবেলা অবধি মোট ব্যবসার পরিমাণ চল্লিশ টাকা!

হুম। তা তোমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে?

না বাবু, এখনো খাতা খুলিনি।

তা জমানো টাকাকড়ি রাখো কোথায়?

চোরাচাউনির সঙ্গে, ‘ঘরেই থাকে বাবু’।

নিশ্চয়ই পাঁচশো হাজারের নোটেই রাখো। সেটা এখন কি করবে?

উত্তর শুনে টং করে রক্ত মাথায় উঠে গেলো, ‘বস্তিমে এক হ্যায় অটোওয়ালা, দো ঠো অটো হ্যায় উসকে পাস, বোলা হ্যায় সারে কে সারে পাঁসসও না নোট লে লেগা, অওর হর পাঁসসও কে লিয়ে চারশো দেগা’।

ভারতবর্ষের সব কাকই বোধহয় কাকের মাংস খায়, না? সে কাক বুর্জোয়া হোক বা প্রলেতারিয়েত?

পরের অটোওয়ালে ভাইয়ার সঙ্গে কথাবার্তাও প্রায় একই লাইনে। তফাত দুটো জায়গায়, এক, অটো এই ভাইটির নয়, মালিকের। মালিককে দিনান্তে তিনশো টাকা তুলে দিয়ে বাকি যা বাঁচবে সব এঁয়ার। আর জমানো টাকা নিয়ে তিনি চিন্তিত নন, ‘ মালিক বোলে হ্যাঁয়, উনহোনে বন্দোবস্ত কর দেঙ্গে’, না, কোনও কাটমানির প্রশ্নই নেই, ‘হামারে মালিক হ্যাঁয়, ইয়ে সব টাইম পর তো হামলোগোঁ কো দেখনা পড়ে গা না।’

এগোতে এগোতে দেখি ওষুধের দোকান। ইন্দোরের শুকনো আবহাওয়াতে ঠেঁট ফেটে চৌষট্টি হয়ে গেছিলো। গিয়ে বোরোলীন (হ্যাঁ, এই বাঙালি ব্র্যাণ্ডটি ভারতের সর্বত্র পাওয়া যায়) কেনার ছলে প্রৌঢ় মালিকটিকে সেই একই প্রশ্ন, ‘ধান্দাপানি ক্যায়সা হ্যায় বাউজী?’

সেই একই উত্তর, সারাদিনমানে দৈনিক গড় ব্যবসার তিরিশ চল্লিশ পার্সেন্ট হবে কি না সন্দেহ। যারা ক্রেডিট কার্ডে কেনে, তারাই এসেছে শুধু।

পাশে ইলেক্ট্রনিকসের দোকান, তিনি অবশ্য বেশি বিচলিত নন, তেনার দোকানে প্রায় সব কেনাকাটাই কার্ডে হয়। তবে ‘আজ কাস্টমার কম হ্যায়, ছুট্টা দেকে অটো ইয়া টাঙ্গা চঢ়না পড়েগা, ইসি লিয়ে লোগ জ্যাদা নিকলে নেহি হ্যাঁয়।’

এরপর জেল রোড, ইন্দোরের চাঁদনি আর কি। ঢুকেই দেখি এক চানা মসালা ওয়ালা,কম্বুর্ন্টে অর্ডার দিলুম ‘ভাই, চার জাগাহ পে দস দস রুপেয়াকা বানাও, নিম্বু জ্যায়াদা। পাঁসসও কা নোট লোগে না?’

ছোকরা প্রথম ঠোঙাটা তুলে ফিক করে হেসে ফেলে, ‘কাহে মজাক কর রহে হো বাবুজি?’

এরপরে এক বাদামওয়ালার সঙ্গেও ঠিক একই কথোপকথন হয়েছিল। একই বক্তব্য, লিখতে আমিও বোর হবো, পড়তে আপনিও বেহুদ্দ বোর হবেন। তাই দুটো কেস একটাতেই সালটে নিই।

‘বলি ব্যবসাপাতি ক্যামন’

‘খুবই কম কত্তা, নোকজন কম বেরিয়েছে কি না’

‘তা এই পাঁচশো হাজার টাকা ব্যান হলো, তোমার অসুবিধা হচ্ছে না?’

‘হাসালেন কত্তা, পাঁচ দশ টাকার মাল বেচি, লোকে খুব বেশি হলে পঞ্চাশ টাকার নোট দেয়। পাঁচশো টাকার নোট ইয়ে হলে আমার কি?’

টিকেট সাইজ, পারচেজ টিকেট সাইজ। এতক্ষণে জ্ঞানচক্ষুরুন্মীলিত হলো। এদের রোজকার ব্যবসায় পাঁচশো টাকার ভূমিকা সীমিত। লোকাভাবহেতু ব্যবসায় মন্দাটাই আসল অসুবিধার কারণ।

‘ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে?’

‘না বাবু’

‘জমানো টাকাকড়ি নিশ্চয়ই পাঁচশো হাজারে আছে, সেটা কি করবে?’

‘কেন? মহাজনকে দেবো, মানে যার কাছ থেকে এই চানা /বাদাম আনি, তাকে দেবো, সেই বদলে দেবে।’

‘তা সে কত টাকা কাটমানি নেবে?’

ভারি অবাক হয়ে সে চোখ তুলে তাকায় সেই টিকিধারী বিহারি ব্রাহ্মণবালক, ‘সে কি? চাচা আমার মহাজন, আমার মালিক। তার সঙ্গে আমার রোজকার কারোবার চলে, তার বেটির নিকাহতে আমাদের ফুল ফ্যামিলির চার পাঁচদিন রান্না বন্ধের হুকুম হয়, সে থোড়াই আমার সঙ্গে এই রকম চিন্দিগিরি করবে? কি বলছেন কি বাবুজী? এখন যদি আপনি যান তো চাচা টোটালকে উপর তিস প্রতিশত তো পাক্কা লেগা। লেকিন মেরে পিতাজী ভি উনকে সাথ কাম করতে থে, ম্যায় ভি কাম করতা হুঁ দস সাল হো গ্যায়া। হাম লোগোঁকে সাথ ইয়ে সব… শোচ ভি নেহি সকতে।’

বুঝলাম, ভারত, দ্যট ইজ ইণ্ডিয়া নামের দেশটির মানুষী সম্পর্কের সবকটি পেহ্লুঁ দেখতে ও শিখতে আমার এখনো বাকি আছে।

পরের শিকার এক ডিমসিদ্ধওয়ালা। ছ”টাকা পার ডিমসিদ্ধ। একই গল্প, লোক কম বাজারে তাই রোজগার কম। আর দিনে হাজার টাকার মতন ডিমসিদ্ধ বিক্রি হয়। হাজার পাঁচশো নোটের গল্পই নেই। জমানো টাকা কিছু পাঁচশো হাজারের নোট আছে বটে, তবে এঁয়ার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও আছে। অতয়েব ইনি নিশ্চিন্ত আছেন, ‘নেক্সট উইক মে তো ফির সে ওহি কাস্টমার আয়েঙ্গে না, এক হপ্তে কি বাত হ্যায় জি। পিছলে সাল বারিষমে কেয়া কিয়ে থে লোগোঁ নে? ইয়ে ভি ওয়সেহি সমঝ লোঁ।’

সবারই একই বক্তব্য, দুদিনের কেস, মিটে গেলে আর ঝামেলা নেই।

কিন্তু এসব তো এক্কেবারে নিম্নবর্গের ব্যবসায়ীকুল। মধ্যবিত্ত দোকানদার, অর্থাৎ রিটেইলারদের কি হাল হকিকত বাবু? যাদের আমদানি আর খরচা দুটোই পাঁচশো হাজারের নোটে হয়? তাঁদের কি গপ্প, অ্যাঁ?

এইটে বোঝাতে গেলে আপনাদের একটা টেকনিক্যাল জিনিস সামান্য বুঝতে হচ্চে যে কত্তা!

যে কোন কম্পানির উৎপাদিত প্রডাক্ট আপনার হাতে যে আসে, তা অন্তত কমপক্ষে দুজন মধ্যবর্তীর হাত ঘুরে পৌঁছয়, কম্পানি টু ডিস্ট্রিবিউটর, ডিস্ট্রিবিউটর টু রিটেইলার অ্যান্ড ফাইনালি রিটেইলার টু কনজিউমার। অর্থাৎ,

কম্পানি-গ্গ ডিস্ট্রিবিউটর-গ্গ রিটেইলার -গ্গ কনজিউমার।

(হোলসেলারদের এই আলোচনায় আনলাম না, মালটা সামান্য জটিল হয়ে যাবে বলে। আপাতত ধরে নিন হোলসেলার ইকোয়ালটু বড় সাইজের রিটেলার, যদিও কিছু তফাত আছে)।

এখন এই চেনে একটা সাপ্লায়ার -কাস্টমার ব্যাপার আছে। কম্পানি ডিস্ট্রিবিউটরের সাপ্লায়ার, ডিস্ট্রিবিউটর রিটেইলারের সাপ্লায়ার, আবার রিটেইলার হলো কনজিউমারের সাপ্লায়ার।

উল্টোদিক ধরে, কনজিউমার হলো রিটেইলারের কাস্টমার, এবং এইভাবে এগোতে এগোতে ডিস্ট্রিবিউটর হলো কম্পানির কাস্টমার।

ব্যবসার নিয়ম হচ্ছে সাপ্লায়ারের কাছ থেকে যত বেশি সম্ভব ক্রেডিট বা ধার আদায় করা, এবং কাস্টমারকে যত সম্ভব ক্যাশে বিক্রি করা। তাতে ব্যবসায় অপারেটিং ক্যাশ বৃদ্ধি পায়। ওটা ব্যবসার সুস্বাস্থ্যের চিহ্ন, ওতে ট্টঞ্জজ্জ অর্থাৎ রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট বাড়ে, লেভারেজ বাড়ে, অপুত্রের পুত্র হয় নির্ধনের ধন, ইহলোকে সুখী অন্তে বৈকুণ্ঠে গমন, ইত্যাদি প্রভৃতি।

পরের দিন সক্কাল সক্কাল ছানটান করে, চাট্টি ইডলি ধোসা খেয়ে মার্কেটে নেমে যা দেখলাম, তা জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না। আমার সমস্ত ন্যাখাপড়া, দশ বারো বছরের এক্সপিরিয়েন্স ধূলিস্যাৎ করে দেখি গঙ্গা উলটো বইছে!

তাবৎ দোকানদার তাঁদের সাপ্লায়ার,অর্থাৎ ডিস্ট্রিবিউটদের পেমেন্ট দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সে কি দৃশ্য রে ভাই, প্পুরো ‘কে বা আগে প্রাণ করিবেক দান’ কেস, দেখলে সারা শরীরে রোমাঞ্চ জাগে, জেগে আছি না বৈকুণ্ঠধামগতি হয়েছে বোঝা দায়। দোকানদার ঝাঁপিয়ে পড়ে কারেন্ট বিল তো বটেই, আগামী দুমাসের স্টকের জন্যে অগ্রিম পেমেন্ট অবধি ডিস্ট্রিবিউটরের পকেটে গুঁজে দিচ্ছে, মুখে স্পষ্ট ‘তুই কি আমার পর?’ ভঙ্গি।

সব পেমেন্টই অবশ্য পাঁচশো ও হাজারের নোটে!! অর্থাৎ আপদ তো বিদেয় হলো, তার ওপর স্টক দিতেও ডিস্ট্রিবিউটর বাধ্য। ফলে অনেকটা নিশ্চিন্দি।

তা যে ডিস্ট্রিবিউটর মহাশয় সঙ্গে ছিলেন, তিনি দেখলাম নির্বিকার চিত্তে সমস্ত পেমেন্ট কালেক্ট করছেন, হ্যাঁ, পাঁচশো আর হাজারি নোটেই!

এহেন মহত্বের কি কারণ?

তিনি উদাসস্বরে বললেন টাকা জমা দিতেই হবে, একবার নয় অনেক বারই, আর তাছাড়া জমা দেবেন কারেন্ট অ্যাকাউন্টে, সেভিংসে নয়। অতয়েব আমি কি ডরাই সখী ভিখারি রাঘবে? এই সুযোগে ভদ্রলোকের ব্যবসার চেহারা ফিরে গেলো, মার্কেটে এখন জিরো ক্রেডিট!

বুঝলুম, ভদ্রলোক ব্যবসা বোঝেন। তা ইন্দোর শহরের যে দ্বিতীয় ডিস্ট্রিবিউটর আছেন, শুনলাম তিনি কোনও পেমেন্ট নিচ্ছেন না যে? এক যাত্রায় এহেন পৃথক ফলের কারণ?

ইদিকউদিক তাকিয়ে ভদ্রলোক ফিক করে হেসে ফেললেন, ‘উসকা প্রোমোটারি কা ভি ধান্দা হ্যায় না! ‘

এইবার বুঝো সাধু যে জানো সন্ধান!

রিটেইলারদের মধ্যে দেখলাম তিন প্রকারের রিঅ্যাকশন। তার আগে দেখলাম রাতারাতি ইন্দোরের প্রায় সমস্ত গ্রসারি বা জেনেরাল মার্চেন্টে পেটিএমে পেমেন্ট নেওয়া চালু হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম আহ্লাদিত, পুরোনো প্রজন্মের বিচলিত। এতদিন এসব না ব্যবহার করেও দিব্যি চলে যাচ্ছিলো, এখন হুড়মুড় করে ঘাড়ের ওপর এসে পড়াতে তাঁরা মন দিয়ে কি করে পেটিএম ইউজ করা যায় শিখছেন। এ নিয়ে একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতা হলো, উপসংহারে বলবো না হয়।

তা যা বলছিলাম, তিন প্রকারের রিঅ্যাকশন। এক, কিছুতেই পাঁচশো হাজারের নোট নিচ্ছেন না, দুই, নিচ্ছেন, কিন্তু পুরো পাঁচশো টাকার সামান নিতে হচ্ছে। তাঁদের বিশেষ দোষ দিয়ে লাভ নেই, দু একজন গল্লা, অর্থাৎ ক্যাশবাক্স খুলে দেখালেন সবই পাঁচশো হাজারের নোট। খুচরো নোট সার্কুলেশনে নেই, চেঞ্জ দেবে কোত্থেকে? তিন, হাসিমুখে পাঁচশো হাজারের নোট নিচ্ছেন, নো ইস্যুজ।

তবে দুটো জিনিস কমন, এক ব্যবসার পরিমাণ অর্ধেক বা তারও কমে নেমে গেছে। আর দুই, মহল্লার চেনা লোকজনদের সবাই উদারহস্তে ধারবাকি দিচ্ছেন, ‘এক দো হপ্তে মে তো মিল হি জায়েগা। ইতনা তো করনা পড়তা হ্যায়’।

তা তো বুঝনু, কিন্তু ডিস্ট্রিবিউটরদের পেমেন্ট করে দিচ্ছেন, পাবলিককে ক্রেডিটে মাল দিচ্ছেন, আপনাদের চলবে কি করে?

কেন? সবজি ছাড়া সবই তো দোকানেই আছে। আর এক হপ্তা সবজি কেনার পয়সা ঘরে থাকেই। ওটা তেমন বড় ইস্যু নয়।

বুঝলাম, আপাতত মার্কেটে বিশাল পরিমাণ ক্রেডিটে লেনদেন চলছে, ‘এক দো হপ্তে মে কাম নিপট যায়েগা’র আশায়।

তা এত বড় ডিসিশনটা যে নেওয়া হলো, তাতে ফল কিছু হবে?

ব্যবসায়ী লোক, দুটো কথা মুখে বলেন, দশটা কথা পেটে থাকে। অনেকেই সোৎসাহে সমর্থন করলেন, বেশিরভাগই সতর্ক, ‘আশা তো করছি ভালো কিছু হবে, দেখা যাক কি হয়’ টাইপের জবাব।

তা ইত্যাকার জ্ঞানভাণ্ডারে চিত্তপূর্তি হলে পর খেয়াল হলো যে উদরপূর্তির আশু ব্যবস্থা দরকার। তা ইন্দোরের আপনা স্যুইটসের চানা ভাটুরা নাকি বিশ্বের ইতিহাসে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে, আবিষ্কর্তা নোবেল কি অস্কার কিছু একটা পেলেন বলে, এইসব শুনে সেখানে যাওয়াই সাব্যস্ত হলো।

আগে পেমেন্ট কাউন্টার। সেখানে মেনুকার্ড রাখা। সেই দেখে পেমেন্ট করলে আপনি কুপন পাবেন, আর সেই কুপন ”ডেলিভারি” লেখা জানালায় নিয়ে গেলে উদ্দিষ্ট বস্তুটির খোঁজ পাবেন।

গিয়ে দেখি তুমুল বাওয়াল!

এক বছর সত্তর পঁচাত্তরের বৃদ্ধ, মিলিটারিমার্কা গোঁফ নাচিয়ে মিলিটারি মেজাজে পেমেন্ট কাউন্টারে দাঁড়ানো মালিককে চোস্ত ইংরেজিতে ঝেড়ে চলেছেন, কেন পাঁচশো টাকার নোট নেওয়া হবে না তার কারণ দর্শানো হোক, এই মর্মে। মালিক ভদ্রলোকের কাঁদোকাঁদো অবস্থা, বাবুর অবস্থা দেখে কর্মচারীরাও ভীত ও ত্রস্ত। আর তো আর, এমপি পুলিশের এক ইন্সপেক্টর সাহেবও খেতে এসেছিলেন, তিনি চুপচাপ কেটে পড়লেন, ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ আওড়াতে আওড়াতে।

শেষে যখন কিছুতেই কিছু হলো না, মালিক কার্ড বা পেটিএম ছাড়া পেমেন্ট নিলেন না, ভদ্রলোক লাইন থেকে বেরিয়ে এসেই আমাকে পাকড়াও করলেন, ( খুব সম্ভবত মজা দেখার জন্যে সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে ছিলুম বল), ‘হে ইয়ং ম্যান, আই হ্যাভ ইন্সটলড পেটিএম ইন মাই মোবাইল লাস্ট উইক, বাট আই ডোন্ট নো হাউ টু পুট এনি মানি দেয়ার। ক্যান ইউ প্লিজ হেল্প মি? মাই ক্রেডিট কার্ড ইজ উইথ মাই সন, অ্যান্ড দ্যাট বাগার ইজ সিটিং হ্যাপিলি ইন ভোপাল….’ আমি তাড়াতাড়ি ফোন কেড়ে নিয়ে বললাম, ‘দাঁড়ান স্যার, দেখছি।’

স্যার শুনে ঈশ্বর প্রসন্ন হলেন, গোঁফের ফাঁকে মৃদু হাসি দেখা গেলো। পেটিএমে টাকা ভরতে গিয়ে দেখি ক্রেডিট কার্ডের ডিটেইলস সেভ করা। হাজার টাকা ভরে মোবাইলটা ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে বললাম ‘সিভিভি নাম্বার ডালুন।’

তা তিনি সিভিভি নাম্বার ডাললে যথারীতি পেটিএম ওটিপি নাম্বার পাঠালো, এবং তিনি সুগম্ভীর স্বরে জানালেন, ‘ দিস অ্যাপ ইজ রেজিস্টার্ড বাই মাই সানস মোবাইল, প্রব্যাবলি দ্যাট নাম্বার উইল গো টু হিম!!!’

লাও, এখন অ্যাকটিভিটি চলছে, সেটাকে বন্ধ করে তো আর ফোন করা যায় না, তাহলে তো উদ্দেশ্যটাই সিদ্ধ হবে না।

পাশে আমার সেলস অফিসারটি এতক্ষণ ত্রিভঙ্গমুরারি হয়ে সবকিছু নিমীলিত চোখে নিরীক্ষণ করছিলেন, এখন সচল হয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে বিনয়াবনত গলায় বললেন ‘আপকা বেটেকা নাম্বার বাতাইয়ে।’

যেই না ওপাশ থেকে হ্যালো শোনা গেছে, সেই তিনি ফোনটা নিয়ে ছেলের সঙ্গে যে ভাষায় আলাপ শুরু করলেন, তার বাংলাটা খানিকটা এইরকম, ‘ওহে অলপ্পেয়ে অকালকুষ্মাণ্ড, ভোপালে গিয়ে দিব্য ফূর্তিতে আছো, বলি বুড়ো বাপ মা কেমন আছে তার খোঁজপত্তর কি একেবারেই নিতে নেই, অ্যাঁ? ওহে জাম্বুবান, এবার যদি ক্রেডিট কার্ডের বিল বেশি আসে… ‘, ঝট করে ফোনটা কেড়ে নিতে বাধ্য হলাম, কারণ ওটিপি বেশিক্ষণ লাইভ থাকে না।

ওপাশ থেকে পুত্ররত্নটি কাঁপাকাঁপা গলায় ওটিপি আউড়ালেন, আমি টাইপালাম।

পেমেন্ট সাক্সেসফুল।

এইবার সেখান থেকে দোকানিকে পেমেন্ট পাঠানো। পেটিএমের ডিসপ্লে লাগানো ছিলো, বার স্ক্যনার ওয়ালা। দশ সেকেণ্ডের বেশি লাগলো না একশো সত্তর টাকা পে করতে।

ভদ্রলোক পেমেন্ট কাউন্টারের দিকে যেতে যেতে বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘বুড়ির সকাল থেকে খিদে পেয়েছে, এখানে সব দেশোদ্ধার হচ্ছে হুঁহ…যত্তসব…আগাপাছতলা চাবুক চালালে দুদিনে সব সিধে….’

কোণায় জড়সড়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটখাটো চেহারার বৃদ্ধাকে দেখিইনি এতক্ষণ!

বুড়ো মিনিটখানেকের মধ্যে কুপন নিয়ে বেরিয়ে এসে খুবই উদারস্বরে ধন্যবাদ জানালেন, ‘থ্যাংস ইয়ং ম্যান, আসলে আমরা একটু ওল্ড তো, এইসব নতুন কায়দাকানুন শিখতে….’

আমি স্বভাবমতো দন্ত বিকশিত করে বল্লুম, ‘নো ইস্যুজ স্যার, ওয়ান ডে আই”ল বিকাম অ্যাজ ওল্ড অ্যাজ ইউ। হোপ সামওয়ান উইল হেল্প মি দেন দ্য ওয়ে আই হেল্পড ইয়ু টুডে।’

ভদ্রলোক থমকে তাকালেন, তারপর পিঠ চাপড়ে গিন্নির হাত ধরে ডেলিভারি কাউন্টারের দিকে এগোতে থাকলেন।

যে বলে পুরুষ মানুষের চোখ ছলছল করে না, তাকে হাতের কাছে পাই একবার!
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *