১২. চৈত্র

চৈত্র

দেখতে দেখতে শেষ হয়ে আসে বছর। ফাল্গুন শেষে আসে চৈত্র মাস।

চৈতালি ফসল তোলা শেষ। লাঙল জোয়াল বলদ নিয়ে কৃষকেরা চৈত্রের হাড়শক্ত মাটিতে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ত। সূর্য ওঠার আগেই কাঁচা মরিচে এক থালা পান্তা গিলে, কেউ বা খালি পেটে লাঙল কাঁধে বলদ নিয়ে খেতের দিকে রওনা হতো। চৈত্রের যেমন শুকনো খরখরে মাটি, তেমনি শক্ত লাঙলের ফলায় ওঠা চাপ চাপ ঢেলা। এই টেলার ভিতরেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটানা লাঙল বেয়ে যাওয়া। বৈশাখী বৃষ্টি নামার আগেই জমি তৈরি করে রাখা। বৃষ্টির জলে লাঙল দেয়া শক্ত চেলা ভিজে নরম হবে। জমিতে আসবে জো। সাথে সাথে বীজ বুনে দিতে পারবে কৃষক।

সুর্য চড়তে থাকে মাথার উপরে একটু একটু করে। বাড়ি থেকে বাঁকে করে ডাল-ভাত চলে আসে। ঘর্মাক্ত কলেবরে টান টান রোদে ঢেলার মধ্যেই কোনোমতে হাত ধুয়ে প্রচণ্ড খিদে পেটে খেতে বসে যেত কৃষক। খাওয়া শেষে সেঁকুর তুলে হুকে নিয়ে আয়েশ করে বসে কলকোয় টান দিত।

প্রখর সূর্য যখন মাথার উপরে, কড়া টানা রোদের প্রচণ্ড তেজে কৃষক আর তখন টিকতে পারে না মাঠে। সেদিনের মতো ক্ষান্ত দিয়ে লাঙল-গরু নিয়ে ঘরে ফিরত তারা। শুরু হবে আবার কর্মযজ্ঞ আগামীকাল থেকে।

বিকালে বিলের নমশূদ্র নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো মেতে উঠত আরেক আনন্দে। চৈত্র সংক্রান্তির পুজো।

এ এক আদিম পুজো উৎসব। গায়ে ছাই-ভস্মমাখা হর-গৌরীর পুজো। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহে নিদাঘ রৌদ্রে ঢাক-ঢোল, কাশির উল্লাসে ছেলে-বুড়ো গায়ে ছাইভস্ম মেখে বাঘ, ভালুক, হাতি, ঘোড়ার মুখোশ পরত। কেউবা সাজত বেদে, সাঁওতাল, গারো, রাখাল। কেউবা মেম সাহেব। এদের সাথে থাকত শিঙ্গা, ত্রিশূল হাতে স্বয়ং জটাধারী শিব আর লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরা গৌরি।

বিল এলাকায় এই উৎসব গাজন বা দেউল পূজা নামেও পরিচিত। নিদাঘ রৌদ্রে রুদ্র ঢাক-কাসির কড়া উল্লাসে এরা দলে দলে দিনভর মাগন মেঙে বেড়াত গ্রামে গ্রামে। এই পুজোর বিগ্রহ কুমির আকৃতির নিম কাঠের তৈরি শিব। বিগ্রহ তেল-সিঁদুরে রাঙানো। এই পুজোর সমস্ত পূজারিরা সন্ন্যাসী। তাদের হাতে বেতের ছড়ি। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। শিব বিগ্রহ মাথায় নিয়ে এরা যেত বাড়ি বাড়ি। পিছে থাকত দলবল। সাথে থাকত অষ্টসখীর দল। অষ্টসখী নেচে নেচে গান করত। একে এরা বলে ‘অষ্টগান। সারাদিনে গান গেয়ে চাল-ডাল, তরি-তরকারি মাঙন পায়।

এই পুজোর মন্ত্র পড়ে ব্রাহ্মণ বালাঠাকুর। বালাঠাকুর যে কেউ হতে পারে, ব্রাহ্মণ হবার প্রয়োজন পড়ে না। তাকে শিখতে হয় শিব ঠাকুরের মন্ত্র। পুজোর কয়দিন সকাল-সন্ধ্যা মন্ত্র পড়ে শিব ঠাকুরকে জাগাতে হয়। এই মন্ত্র পড়ে বালাঠাকুর। এই পুজোর যেমন আদিম রূপ, তেমনি পুজোর মন্ত্রগুলোর সুর আদিম এবং ভয়ঙ্করও বটে….

স্বর্গে দেখি মেঘের জটা
যম গিয়েছে দূর,
বৈশাল বলে রে বেটা
তুই বড় নিষ্ঠুর।
এক পথে আসি আমি
আরেক পথে যাই,
ঘাড় ভাঙিয়া রক্ত খাই
আর পোয়াতি চাই।
নামটি আমার নিশিচোরা
বৈশাল বলে ডাকে,
মোর সঙ্গে দেখা হলে
যাবি শ্মশান ঘাটে।
শ্মশানঘাটের মাটিখানি
অঞ্চলেতে ভরে,
বৈশাল গঞ্জ চলে এসো
এই ধূপেরই পরে।।

ডাকিনী যুগিনী মোরা
খাই রক্ত রুধি
পথে পথে চলি মোরা
শনি মঙ্গল বুধি।
জন্ম মোদের শুশানঘাটে
শ্মশানবাসীর উদোর,
হাড় মস্তক রক্ত খাই
খাই পোয়াতির জঠর।
ড্যাঁও খাই, দৈত্য খাই
গড়াই গাঙের কূল,
আয় আয় নিশিচোরা
উল্টো মাথার চুল।
এ ডাল ভাঙে ও ডাল ছিঁড়ে
মুড়ো করলাম সার,
মুড়োর উপর পাও তুললাম
কই যাবি তুই আর।।

জানি রে জানি বেটা
তুই বড় জানি,
শুনে রাখ তোর সেই
জন্মেরও কাহিনি।
তোর মা শ্মশানঘাটে
ফ্যালায়ে ছিল যার,
ছয় কুড়ি ছয়টি তার
পাটনি ভাতার।
পাটনি ভাতারের ছাওয়াল
শীঘ্র করে আয়,
তোর মা আমার সাথে
শ্মশানঘাটে যায়।।

এমনি আরও কত মন্ত্র। এক একদিন এক একরকম মন্ত্র।

চৈত্র মাসে হতো ভাসান পুজো। মোট নয়টা বেদির এক একটিতে এক এক দেবতার আসন। মাঝখানটাতে বিশালকায় মাটির কুমির, হাঁ করে গিলে খেতে আসছে যেন। বড় বড় ধারালো দাঁত। দেখে মনে হয় একেবারে জীবন্ত। সারা চৈত্র মাস ধরে কুমির আর বেদিগুলোতে সন্ধ্যায় পুজো দেয়া হতো। পুজোর পর থেকে ভোর পর্যন্ত এই পথে চলাচল নিষেধ ছিল। গভীর রাতে নাকি কুমির জীবন্ত হয়ে রাস্তায় বের হয়ে পড়ে। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে দেখে কে কেমন আছে। কে ভালো কাজ করে, কে খারাপ কাজ করে। এ সময়ে কেউ সামনে পড়লে তার নির্ঘাৎ মৃত্যু।

নয়টা বেদির জন্য নয় জন পুরো চৈত্র মাস ধরে সন্ন্যাশ্রত পালন করত। তাদের থাকতে হতো এক কাপড়ে। গায়ে-মাথায় তেল সাবান মাখাও নিষেধ। তেল-সিঁদুর মাখানো কাঠের দেউল মাথায় নিয়ে সারাদিন তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরত। গৃহস্থ বধূরা যত্ন করে দেউলে তেল-সিঁদুর মাখাত, শঙ্খ বাজাত, উলুধ্বনি দিত। সূর্যাস্তের পর শুরু হতে ভাসান পূজা। পুরোহিত ঘুরে ঘুরে মন্ত্র পড়ত। বাজত ঢোল, কাঁসর। দিনশেষে সন্ন্যাসীদের উপোস ভাঙার পালা। আহার মাত্র এক মুঠো আতপ চালের ভাত।

চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন সন্ন্যাসীরা খেজুর গাছের মাথা ভাঙত। কাঁটা উপেক্ষা করে উঠে যেত খেজুর গাছের মাথায়। কিন্তু গায়ে তাদের কাটা বিধতো না। কায়দাটা রপ্ত করতে নিঃসন্দেহে অনেক চর্চা করতে হতো তাদের। কাঁদি থেকে হলুদ হলুদ কাঁচা খেজুর ছিঁড়ে চারদিকে ছুঁড়ে দিত সন্ন্যাসীরা। লোকজন কাড়াকাড়ি করে পুণ্যের আশায় সেই খেজুর কুড়িয়ে খেত।

শ্মশানে হতো চড়ক পুজো। ভয়ঙ্কর সব খেলা। পোঁতা হতো অনেক উঁচু করে চড়কি। সন্ন্যাসীদের পিঠের শিরদাঁড়ায় বড় বঁড়শি গেঁথে সেই চড়কিতে ঝুলিয়ে ঘোরানো হতো।

ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে তৈরি হতে অষ্ট গানের দল। একজন সাজত কৃষ্ণ, আরেকজন রাধা। বাকিরা সব সখী। সখীরা কৃষ্ণকে উদ্দেশ করে গায়। কৃষ্ণ তার উত্তর দেয়। কখনও রাধিকার উদ্দেশে গায়, রাধিকা তার উত্তর দেয়।

কৃষ্ণের আক্ষেপ–

আমার শূন্য কুঞ্জবন, রাধার নাই আগমন
ওরে শ্রীমতী রে না দেখিলে বাঁচে না এ জীবন
আমার মোহন বাঁশি বাজে না করি কী এখন ।।

সুবল বলি তোমারে ও সে আয়েনের ঘরে
ও সে দুরন্ত কুটিলা বুঝি শ্ৰীমতীরে রাখিছে ধরে
সুবল শীঘ্র তুমি যাও, এনে দাও রাই ধনীরে ॥

রাধার বিচ্ছেদ আমার প্রাণে সহে না
ও রে শ্রীমতীরে না দেখিলে প্রাণে বাঁচি না
সুবল শীঘ্র করে যাও নয় আমি থাকি না ॥

রাধিকার ক্ষোভ–

যাব যাব কনে যাব, কৃষ্ণ আমার কে
ও যে বড় নিঠুর তাও জানে না সে
অন্য রে কাঁদায় শুধু, নিজে কাঁদে না হে ॥

আপন কুলে কালি দিয়ে যে কুল বেঁধেছি
যার জন্যি জীবন-মরণ সকল সঁপেছি
সে নিষ্ঠুর কাঁদায় শুধু, তাও জানে না হে ॥

যাব না যাব না আমি, যাব যমুনায়
কলসি দড়ি গলায় নেব, সকল জ্বালা দুখ মেটাব
জগৎ জোড়া সকল মানুষ জানুক জানুক হে।।

কৃষ্ণ সে যে কী পাষণ্ড দুঃখ সুখের আসল ভাণ্ড
স্বার্থ ছাড়া বোঝে না সে, পরের কী বেদন
যাব না আর যাব না, ওই পাষণ্ডের কাছে হে ॥

কৃষ্ণলীলা ছাড়াও তারা গাইত পালা গান। রাম-সীতা, সীতা হরণ, সীতার সয়ম্বর, পাষাণ উদ্ধার এমন আরও অনেক পালা।

সীতার স্বয়ম্বর পালায় গাইত–

মিথিলাতে জনক নামে ছিল এক রাজন
তার অতি সুলক্ষণ
সীতা নামে কন্যা ছিল হারে পরম রতন
বিয়ে দিতে করল রাজা ধনুকভঙ্গ পণ ॥

ও রে রাজার কন্যা সীতাদেবীর হবে স্বয়ম্বর
রাজা করিল প্রচার
ও রে তাই শুনিয়া এলো তথায় যত রাজকুমার
গেল মুনির সঙ্গে রাম-লক্ষ্মণ সেই রাজার আগার ॥

ও রে কাঞ্চন ধনুক রাজা দিল বাহির করে
সেই ধনুক ধরে কত রাজার
তনয় হলো পরাজিত, কেহ ভাঙিতে না পারে
শেষে ধরল ধনুক দশরথ পুত্র রাম রঘুবরে।।

ধনুক ধরিয়া রাম যেই গুণে দিল টান
ধনুক ভেঙে হলো দুই খান
ও রে মহানন্দে জনক রাজা তখন সীতারে করে দান
সীতা পেয়ে শ্রীরাম চন্দ্র আহ্লাদে আটখান।

‘সীতা হরণ’ পালায় তারা গাইত–

মায়া হরিণ ধরতে গেল ও রাম, সীতার অনুরোধে
কিছুদূরে গিয়ে হরিণ গো কান্দে রামের কণ্ঠস্বরে
আমি মলাম মলাম লক্ষ্মণ আমার ও রে ॥

সীতা বলে প্রাণের লক্ষ্মণ ভাই, শোনো ওই না কাননপুরে
হরিণ ধরতে গিয়ে প্রভু গো, কান্দে লক্ষ্মণ লক্ষ্মণ বলে
ও লক্ষ্মণ শীঘ্র যাও প্রভু বুঝি মরে।।

ধনুক হাতে লক্ষ্মণ চলে গো, ওই না রাম উদ্ধারিতে
হেনকালে লঙ্কার রাবণ গো, ওই না সীতারে তুলে নেয়
সীতারে লয়ে রাবণ চলে লঙ্কার পথে ॥

শ্রীরাম বলে, প্রাণের লক্ষ্মণ রে, ও লক্ষ্মণ সীতা কোথায় গেল
একেলা সীতারে পেয়ে বুঝি গো, বনের বাঘে ধরে খেল
আমার সীতা কোথায় তুমি বলো।।

(এর সঙ্গে পদ গায় তারা)
আমি সীতাহারা হলাম লক্ষ্মণ রে
আমি সীতা পাব কই?
বনে বনে খুঁজে বেড়াই গো
আমি সীতারে না পাই
আমি সীতাহারা হলাম লক্ষ্মণ রে ॥

এভাবে পুজোর দিন এবং রাতগুলো এরা আসর করে গান গাইত। সঙেরা হরেক রকম রঙ দেখাত।

চৈত্র মাসে হতো নীলপূজা। নীলপূজা আসলে শিবেরই পূজা। চৈত্রের শুরু থেকে সংক্রান্তির পূর্বদিন পর্যন্ত কাঠের তৈরি নৌকার মতো নীল মাথায় নিয়ে সাত-আটজনের দল বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াত। নীলে খোদাই করা থাকত দশ অবতারের মূর্তি-মৎস, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও কল্কি। এছাড়া নীলের মাথায় আঁকা থাকত শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম। সরিষার তেল মাখিয়ে মাখিয়ে কলাই করা হতো নীলের প্রতিকৃতি। মাথার অংশে লাগানো হতো সিঁদুরের ফোঁটা। নীলের গান হতো। বাদ্যের তালে তালে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে একবার সামনে এগিয়ে আবার পেছনে গিয়ে নেচে নেচে গান গাইত তারা। নানা রকমের গান গাইত তারা

১. দেবীর পতিপূজা

একদিন বসিয়া কৈলাস ভবনে, দেবী আনন্দিতা মনে,
কী ভাব জাগিল মায়ের মনে।
ওমা পতির চরণ করতে পূজা, এনে দিল বিল্বদল জবা,
পূজা দিচ্ছেন পতির চরণে।।

ওমা পড়ে পতির চরণতলে, চরণ ধোয়ায় মা নয়ন জলে,
মাথার কেশে মুছায়ে চরণ,
ওমা কাজল দিচ্ছেন নয়ন কোণে, বসিয়া আপন মনে
পদে দিচ্ছেন আগুরু চন্দন।।

ওমা ফুলের মালা হস্তে লইয়া, নয়নে নয়ন রাখিয়া
পরায় মালা পতির গলায়
ওমা সুগন্ধী তৈল মাথায় দিয়া, অষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া
চরণ দুইখান লইয়াছেন মাথায় ॥

তখন মদন মোহন মূর্তি ধরি, বসা ছিলেন ত্রিপুরারী,
মহাশক্তি মহামায়া হইল,
তখন নন্দীশ্বর ছিল দ্বারে, বলে নয়ন চেয়ে দেখ রে
আকূল হয়ে কাঁদিতে লাগিল ।৷

তখন নন্দী কান্দে অবিরত, দেখে লই জনমের মতো
কোন তত্ত্বে মা হয়েছে মগন,
একদিন পতির বুকে চরণ দিলে, পতির চরণ আজ মাথায় নিলে
এই তত্ত্বেও মা জানতে চাই কারণ ॥

নন্দী জানতে চায় সেই শিবতত্ত্ব, জানলে দূরে যায় জীবাত্ম
জীবদেহে হয় পরম তত্ত্বজ্ঞান,
তখন নন্দী বলে, ও অবোধ মন, রূপ দেখে ভুলিস কখন
সময় থাকতে তত্ত্বের করো সন্ধান।।

পাগোল রঘুনাথ কয় বিনয় করি, মনের আধা ত্রিপুরারী
এ জনমে হইল না পূরণ,
আমি পুনঃ যদি আসি ধরায়, নিবেদি তব রাঙ্গা পায়
অন্তে ফাঁকি দিও না কখন ॥

২. পতিপূজার উত্তর

নন্দীর ভাব দেখিয়া শূলপাণী, নন্দীকে বলেছে বাণী
শুনো নন্দী, আমার বচন
ভবে চারিভাবে জগৎ মাতে, দেখলে যেভাব কৈলাসেতে
সেই কথা আজ করিব বর্ণন।।

ঘয়ে আমার দ্বারের দারী তুমি, বুঝ না তাই বলি আমি
মন দিয়া করো হে শ্রবণ
আছে ভাব, মহাভাব, রূঢ়ভাব, অধিরূঢ় মহাভাব
চারিভাবে জীবের হয় সাধন ॥

আছে ভাবের মানুষ জগৎ ভরা, ভাব না হলে যায় না ধরা
ভাবের ঘোরে দেখেছ আমায়,
যদি মহাভাবে হতে মত্ত, পেতে তুমি পরম তত্ত্ব
পেলে না, আর কী বলব তোমায়।।

দেবী রূঢ়ভাবে রণ করিল, আপনপর জ্ঞান নাহি ছিল
তাইতে চরণ ছিল আমার বুকে
আবার অধিরূঢ় মহাভাবে, দেবীর মন যখনে ডুবে
আমার পদে পূজা দিল সুখে।।

আছে জীবদেহেতে পঞ্চ আত্মা, জীবাত্মা আর ভূত আত্মা
ঈরম আত্মা আরেক আত্মার নাম
আছে আত্মারাম, আত্মা রামেশ্বর, দেখা যদি পাবে তাহার
যোগে বসে জেনে লও সন্ধান।।

তোমার জীবত্য জ্ঞান নাহি রবে, শিবত্ব জ্ঞান প্রকাশিবে
শুনে নন্দী শিব গুণ গায়
পাগোল রঘুনাথ কর জোড়ে, জনম লইয়া এ সংসারে
ভজিলাম হর-পার্বতীর পায়।।

৩. দেবীর দুঃখ

এক দিবসে কৈলাস ধামে, শিবা বসি শিবের বামে
কেন্দে বলে শিবের গোচর,
আমি কী কহিব দুঃখের কথা, মর্মে সহে না ব্যথা
সুখ হলো না করে তোমার ঘর।।

প্রভু যোগীশ্বর হলে তুমি, অন্নপূর্ণারূপে আমি
তবু অভাব হইল না মোচন,
তোমার ভাঙা ঘরে জল পড়ে, কার্তিক গণেশ অনাহারে
অন্নের জ্বালায় কাঁদে সর্বক্ষণ।।

প্রভু এ দৃশ্য আর যায় না দেখা, কী সুখ আমার বেঁচে থাকা
দুঃখানলে জ্বলে সদাই প্রাণ
ভবে নারী হয়ে আসে যারা, মা বলে ডাক শুনিলে তারা
সফল হয় তার নারীর জনম ॥

আমার কার্তিক গণেশ শিশু ছেলে, কাঁদে যখন ক্ষুধা পেলে
মন দুঃখে আমি এদিক-ওদিক চাই
আমি অভাগিনী মা হইয়া, কী দেব তার মুখ চাহিয়া
তোমার ঘরে এমন কিছু নাই ॥

তাদের মুখ দেখে কেউ দুঃখ বোঝে না, বুঝাইলে তো মন বুঝে না
বুড়া-বুড়ি থাকত যদি ঘরে
আমার দুটি শিশু কান্না করলে, যত্ন করে নিত কোলে
কাঁদ তো না আর এমনি করে ঘরে ॥

আমি সেই দুঃখেতে জ্বলে মরি, কেমন করে ধৈর্য ধরি
দিবানিশি ছাড়ি দুঃখের হাই
আমার চিরদিন গেল দুঃখে, বিমুখ হলেম কান্ত সুখে
আমার এ প্রাণ কী দিয়া বোঝাই।।

পাগোল রঘুনাথ কয় বিনয় করি, কোথায় রলে ত্রিপুরারী
এসে তোমার শক্তিকে বুঝাও,
তুমি অজ্ঞানের জ্ঞানদাতা, তবু কেন কান্দে মাতা
মায়ের দুঃখ দূর করিয়া দাও।।

৪. দেবীকে শিবের অবোধ

দেবীর নয়নের জল দর্শন করি, শঙ্কর বলে ও শঙ্করী
মায়া কান্নায় কেন ছাড় হাই
ভবে অর্থ যত অনর্থের মূল, অর্থে মানুষ করে বাতুল
পরমার্থ অর্থের সনে নাই।।

তুমি খুঁজে দেখো এ জগন্ময়, অর্থে অনাসক্ত যে হয়
পরমার্থে হয়ে যায় সে ভোরা
আমি পরমার্থে অনুরাগী, হয়েছি তাই সর্বত্যাগী
জীয়ন্তেতে হয়ে আছি মরা ॥

আমি নামের খুঁটি দিয়া ঘরে, দেশ-দেশান্তর বেড়াই ঘুরে
কীর্তনের ছাওনি দিয়া চালে
আমি অনুরাগের দিয়ে প্যালা, নাম ধরেছি পাগলা ভোলা
কী করিবে আমায় বৃষ্টির জলে।।

ছোট ছেলেমেয়েরা অথবা মেয়েরা ছেলে সেজে বা ছেলেরা মেয়ে সেজে অভিনয় করত অষ্টগানের দলে। যমুনার ঘাটে সখীরা যাবে মথুরায় ননী বিক্রি করতে। ছল করে কৃষ্ণ মাঝি সেজে বসে আছে নৌকা নিয়ে। নৌকা পারাপারের কড়ি নিয়ে চলছে দরকষাকষি। কৃষ্ণ সুরে সুরে বলত–

সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা
এক সখীরে পার করিতে নেব কানের সোনা

বলাবাহুল্য এই সখী রাধিকা ছাড়া আর কেউ নয়। কানু বিনা যেমন গীত নাই, তেমনি রাধা ছাড়া সাধা নাই।

তিন দিন ধরে চলত চৈত্র সংক্রান্তির মেলা। চৈত্রের শেষদিনে মেলা হতো শুরু। ধুমধামের সে মেলা। বিদায়ী বছরের শেষদিন, নতুন বছরের প্রথম দিন আর দ্বিতীয় দিন। মেলাতেও আসত গানের দল, যাত্রাদল, পুতুল নাচ। থাকত নানা রকম ভোজবাজি, আনন্দ আয়োজন। মেলায় বিক্রি হতো মাটির হাঁড়ি পুতুল, বেত-বাঁশের তৈরি ব্যবহার্য জিনিসপত্র। লোহার দা-বঁটি। কাগজের ফুল, তালপাতার পাখা। কিনত তারা বাতাসা, কদমা, শিঙে, তিলে খাজা, জিলাপি, দানাদার, রসগোল্লা।

ছেলেরা কিনত ছুড়ি বা চাকু। গাছের মোটা ডালে পা ছড়িয়ে বসে এই চাকু দিয়ে কাঁচা আম ছিলে লবণ-মরিচ দিয়ে খাবে তারা। কার চাকু কত বড়, কত সুন্দর, ধার কেমন–এসব নিয়ে চলত আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক।

এভাবেই ফুরিয়ে যেত চৈত্রমাস। দেখতে দেখতে পার হয়ে যেত একটা বছর। গড়িয়ে গড়িয়ে শেষ হয়ে যেত পুরো একটা ঋতুচক্র। পুরনো বছরের গ্লানি-ক্লেদ মুছে নমশূদ্রদের জীবনচক্র থেকেও হারিয়ে যেত আর একটা বছর।

আবার শুরু হতো নতুন বছর। বছর নতুন হলেও নমশূদ্র কৃষকদের জীবনে নতুনত্ব থাকত না কোনো। জীবন তাদের বয়ে চলত একইভাবে। গতানুগতিক ধারায়। তবু তারা স্বপ্ন দেখত…

নতুন বছরে রূপকথার গল্পের মতো কোনো এক সোনার কাঠির পরশে বদলে যাবে তাদের জীবন। ধনধান্যে পূর্ণ হয়ে উঠবে তাদের সংসার। গোলাভরা থাকবে ধান, গোয়ালে গরু, পুকুরে মাছ। তাদের হৃষ্টপুষ্ট সন্তানেরা উঠোনে খেলে বেড়াবে। তুলসীতলায় প্রতি সন্ধ্যায় প্রসন্ন চিত্তে প্রদীপ জ্বালবে গাঁয়ের বধূ। খোল-করতালের ঝংকারে মুখরিত হবে চারিদিক। গভীর আনন্দ নিয়ে তারা কাজ করবে মাঠে। মাছ ধরবে, গীত গাইবে। অভাব-অনটন দূর হয়ে তাদের জীবন বয়ে যাবে বহমান নদীর মতো সাবলীল ধারায়।

কিন্তু বাস্তবে তা হতো না। সংসারে তাদের লেগে থাকত নিত্য অভাব, অনটন। বাচ্চাদের অসুখ, বিসুখ। বৌ-ঝির পরনে থাকত ছেঁড়াফাটা কাপড়। জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে চলত বিলের নমশূদ্রদের জীবন। তবু তাদের চোখে ভাসত অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্ন। ভাবত, বদলে যাবে সবকিছু। নিশ্চয়ই সুখের দিন আসবে একদিন না একদিন…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *