০৫. ভাদ্র

ভাদ্র

ভাদ্র মাস বানভাসির মাস।

মাঠ-ঘাট ভরা ভাদুরে বন্যা। যেমন বন্যা, তেমনি মাথার উপর কাঠফাটা রোদ। ভ্যাপসা গরম। মাঠে মাঠে সবুজ পাটের খেতে দোল খেয়ে যায় বাতাস। সে দৃশ্য দোলা দিত কৃষকের অন্তরেও। মনের মধ্যে বিরাজ করত ফুরফুরে আনন্দ। পাট কাটার সময় ঘনিয়ে এসেছে। পাট বিক্রির কাঁচা পয়সা আসবে হাতে। বৌ-ছেলেমেয়ের পরনে উঠবে নতুন কাপড়।

খেতে খেতে কোমর জলে দাঁড়িয়ে কৃষকরা লম্বা হাতে কাস্তে চালাত। মুখে মুখে চলত বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা সুখের গীত

হা রে… গগনে উঠিল বেলা জল আনিতে যাবি তোরা
জল বিনে মোর দেহ যায় জ্বলিয়া রে,
ন্যাড়া গায়ে কলসি কাঁখে পানের খিলি মুখে
যায় রে কন্যা সানবাঁধা ওই ঘাটে।
পাঠান বলে কার বা কন্যা গোসল করে
হস্ত ধরে তোলো নৌকা পরে ॥

কন্যার শোক–

খবর কইও সোয়ামী রে ফিরে যেন বিয়ে করে
আমারে ধইরা নিল মুখপোড়া পাঠানে
খবর কইয়ো শাশুড়িরে পানের বাটা রইল ঘরে
খবর কইয়ো ননদীরে সোনার কলস রইল ঘাটে
আমারে ধইরা নিল পাঠানে।
তুমি তো পাঠানের ছেলে আমি বাঙালের মেয়ে
তোমার আমার কেমনে হবে বিয়ে ॥

পাঠান বলে–

শাঁখা খোলো চুড়ি পরো নবীর কলেমা ধরো
কলেমায় হও রে মুসলমান…
তারপর তুমি আমি হবো প্রভুর দান ॥

গানের সুর এভাবেই ভেসে বেড়াত মাঠ থেকে মাঠে, গ্রাম্য পথে, পথ পেরিয়ে কখনো কখনো সুর এসে পৌঁছুত বাড়ির উঠোনে।

গানের সেই সুরে উদ্বেলিত হতো গায়ের বধূরাও। হাতের কাজ সারতে সারতে গলা মেলাত গুনগুন করে গানের সাথে। গানের কথা অপরিচিত নয়। সবারই জানা প্রায়।

মাথার উপরে ভাদুরে কড়া রোদ। মাঠভরা থৈ থৈ জল। মাঝখানে ছলছল হাওয়া। এর মধ্যে কড়কড়ে গলায় চলত গান। শীতল হয়ে আসত রোদপোড়া উত্তপ্ত মন। কৃষকেরা বড় বড় পাটগাছ কেটে জলে বিছিয়ে দিত। সমানে চলত কাস্তে, সাথে চলত পাল্লা দিয়ে কণ্ঠে কণ্ঠে গান–

বিন্দে আমায় নিন্দে কোরো না
এমন নাগর তুমি পাবা না
আমি পুরাই মনের বাসনা।

আমি ছিলাম সখীর প্রেমেতে
তাই আসতে পারলাম না
এক রজনী একলা ছিলে গো
তুমি তাইতে বাঁচো না।

হাঁটতে পদ আগে চলে না
নিজের ভালো কেন বোঝ না
রক্তের বরন চোখির (চোখের) দুই কোন
নারী জাতির স্বভাবের দোষ
পিরিত বিনে পরান বাঁচে না
এক রজনী একলা ছিলে তাই তো বাঁচো না ॥

মদন বলে, মদনা থোকা কোন শাস্ত্রে কয়
রাধা আমার প্রাণ প্রেয়সী
সে তো কেউ তো আমার নয়।
ও তার কথা শুনলে অঙ্গ জ্বলে
আমি প্রাণে বাঁচি না ॥

পাশের মাঠ থেকে আর একজন গেয়ে ওঠে—

ব্রজের রাখাল বড়ই তোমার নাম
তুমি গুণের গুণধাম
মামির সাথে করো চোরা কাম
একদিন ধরা পড়ে কালি হলে
ছলনা কী অবিরাম ॥

ওরে রাধা করে কালী পুজো
কুটিলের হয় অপমান
আয়েন ঘোষের চোখে ধাঁধা দিয়ে
পুরালে আপন মনষ্কাম ॥

কালী হলে ভালোই করলে
পুরুষ চিহ্ন কী করিলে
কালীর যোনী কেমনে পেলে
আবার মোহনচূড়া কোথায় লুকোলে
কথামালা পেলে কোথায়
কৃষ্ণধন বলে যাও আমায় ॥

আর এক মাঠ থেকে গেয়ে ওঠে–

শোনো শোনো বিন্দে বাদেনী
আমি তোমারে চিনি
তুমি পাইছো চাকরানির জমি
সেই খাস খামারে প্রজা হই আমি ॥

তুমি ছিলে ঘুমের ঘোরে
আমি ছিলাম সেই বাড়ি
তোমার নকশা পর্চা বার করে দেখি
আবার ঘোনা-ঘুনি ঠিক করে দেই লো
আমি সেই নয়া আমিনি ॥

নকশা-পর্চা হাতেতে পালাম
চোখে চশমা লাগালাম
ঘোনা-ঘুনি ঠিক করে নিলাম
ও জমির চৌদিকেতে চাপিল চুপিল
মাঝখানেতে ওসার (চওড়া) পালাম
নল ফেলায়ে জরিপ করে গো
মধ্যি এক খুটো বসালাম
ওরে ও বিন্দে বাদেনী ॥

এভাবেই গনগনে সূর্যের প্রখর রোদ মাথায় নিয়ে বলিষ্ঠ বাহুতে নমশূদ্র কৃষকরা কাস্তে চালাত মাঠে মাঠে। মুখে মুখে লেগে থাকত উজ্জীবনী গান। এভাবেই অফুরান প্রাণশক্তিতে ভরপুর থাকত তারা। পাট কাটার ফাঁকে ফাঁকে বিলের মধ্যে নৌকা বেঁধে ছিপ ফেলে মাছ ধরত তারা। জাল পাতত লম্বা করে এই আইল থেকে সেই আইল অবধি। জালে ধরা পড়ত কৈ, খয়রা, রয়না, কালিবাউস, ট্যাংরা, পাবদা।

দিনশেষে ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরত তারা। সন্ধ্যার মধ্যেই তাদের রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ। খাওয়া-দাওয়া সেরে গ্রামের কৃষকেরা বসততা কলকো, তাওয়া, তামাক নিয়ে বৈঠকখানায়। পাল্লা দিয়ে বসত গানের আসর। নারী পুরুষ একসাথে তন্ময় হয়ে গান শুনত। আস্বাদন করত গানের রস। ধারণ করত হৃদয়ের গভীরে। মন হয়ে উঠত ফুরফুরে। ক্লান্ত শরীরে পড়ত আরামের প্রলেপ। গানের মাহাত্ম অন্তরের গভীরে পরম যত্নে ধারণ করে ঘুমাতে যেত তারা।

আসরে এক পক্ষ গাইত–

সখী বলে ও বংশীধারি, তোমারে জিগেস (জিজ্ঞেস) করি
বলো কী কারণে গোলকপুরে সাগর হইল শ্রীহরি
আবার সেই সাগরে কে ভাসিল কও প্রকাশ করি ॥  
সেই সাগরে সর্প ভেসে যায়, এক ময়ূর পাখি সেথায়
ও সে গেল উড়ে ধরলো তারে, ঠোক দিল সাপের মাথায়
তিন ফোঁটা রক্ত পোলো (পড়ল) তাতে বা কী হয়!
সেই সর্প কে ধরে নিল, সেই কথা আমায় বলো
কী নাম বলো হায় রে সাপের, কোন যুগে সে কোথায় ছিল
ও তার আসল কথা সভাতে বলো ॥

প্রতিপক্ষ উত্তরে গাইত–

কৃষ্ণ বলে ও সখীগণ, জানতে চাও মধুর ভারতী
আমার কথা নয়, অন্যের কথা শুনে ন্যাও (নাও)
সেই সাগরের নাম বিরজা, গোলকে খ্যাতি ॥

সেই সাগরে ভাসে নারায়ণ, শোনো তার বিশেষ বিবরণ
সেই সাপটি ধরে নিল সাপুড়ে সে পঞ্চানন
ও তার মস্তকেতে রাখে দিল করিয়া যতন ॥

সেই সাপ যখন ঠোক দিল মাথায়
তিন ফোঁটা রক্ত ঝরে যায়
ও তার এক ফোঁটা যায় সমুদ্রে, জলচরেরা সুধা খায়
অন্য ফোঁটায় রতি শাস্ত্র হইল এ ধরায় ॥

আরেক পক্ষ তখন গেয়ে উঠত–

সোনার লায়েক হয় জবর গুণী, তার মুখে কত কথা শুনি
হ্যান করেগা ত্যান করেগা, কাজের বেলায় ঠনঠনি
ক্যাজ-ব্যাজানো হাঁড়িচাছা, সে যে ওই মতো গুণী ॥
দেখছি কত বাগদী বুনো ডোম, উনি তো নয় রে সে রকম
ওরে অন্য কাজে য্যামোন-ত্যামোন, মিথ্যে কথায় পাকা যম
সাদাকে সে কালো করতি অতি যে উত্তম ॥
এ্যামোন শুনি যে দ্যাশেতে রয়, জনাব কয় সে দ্যাশের কী ভয়
গুণীর কাঁধে গুন চড়ায়ে নৌকো নেবো কোলকেতায়
সে দ্যাশের গুণীরা যদি ফুলের মালা দ্যায় গলায় ॥

এভাবেই পাল্লা দিয়ে চলত গীতের পর গীত। বাড়ত রাতের গভীরতা। একসময় শেষ হতে আসর। তামাক-কলকো রেখে ঘুমোতে যেত সবাই। রাত পোহালেই তো শুরু হবে আবার সেই কঠিন কর্মযজ্ঞ।

.

পাট কাটা শেষ।

কিন্তু কাজ শেষ হয় না। কাটার পর আয়োজন করতে হয় পাট জাগ দেবার। কাটা পাটগাছ একসাথে করে জলের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে হয়। ডুবিয়ে রাখার জন্য তার উপরে চাপিয়ে দেয়া হতো গাছের ডাল, কাটা কলাগাছ। তার উপরে বড় বড় ঘাসওয়ালা মাটির চাক। জলে ভিজে পাট পচে আঁশ নরম হতো।

পচা পাটের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত চারদিকে। দুর্গন্ধময় সেই জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে নমশূদ্র কৃষকরা পাটকাঠি থেকে আঁশ ছাড়িয়ে নিত। সেই আঁশ ধুয়ে শুকোতে দিত উঠোনে। হাজামজা পচা জলে ভিজে ভিজে কৃষকের হাতে-পায়ে হতো থকথকে ঘা। পায়ে থাকত জোঁক লাগা ক্ষত। কিন্তু ঘায়ের সেই কষ্ট আর ক্ষতের জ্বালা গায়ে মাখার সময় থাকত না তাদের। পাটধোয়া, শুকোনো, আঁটিবাধা, ওজন করে মাচায় ওঠানো কাজের অন্ত নেই। সময় নেই দম ফেলার। উপায় নেই বসে থাকার। ফেলে রাখা চলবে না কাজ। সময়ের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই শেষ করতে হবে। নইলে কমে যাবে পাটের মান। কমে যাবে তার দাম।

পাট ধুয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে ঘা পচা হাত-পা আগুনে শুকিয়ে নিত নমশুদ্র কৃষকরা। তারপর ভালো করে ঘেয়ো হাত-পায়ে তারা মাখত ‘তুষতেল। তুষ তেলে হাত-পা হতো কড়কড়ে। ভেজা ঘা শুকিয়ে হতো টনটনে। এ দাওয়াই তাদের নিজস্ব আবিষ্কার, দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল।

‘তুষতেল’ তৈরির কায়দাটা অদ্ভুত। মাটির সরায় তুষ নিয়ে তাতে আগুন দিতে হয়। তুষের আগুন থেকে তৈরি হয় ধোঁয়া। সেই ধোঁয়ার উপর পরিষ্কার কাঁসার থালা ধরে রাখতে হয়। থালায় ধোঁয়া লেগে তৈরি হয় ঘাম। সেই ঘাম হাতে-পায়ের পচা ঘায়ে লাগায়। একে এরা বলত তুষতেল।

এই তেল ক্ষতে লাগানন মাত্র যন্ত্রণায় জিলকে উঠত তারা। দাঁত-মুখ এঁটে ধরে তবু তারা ক্ষতে দিত তেলের প্রলেপ। রাতভর সেই তেল শুকিয়ে ক্ষতস্থানগুলোকে কড়কড়ে করে তুলত। সকালে আবার নামতে হবে জলে। শুরু হবে পচাজলের মধ্যে কাজ। হাতে-পায়ে সৃষ্টি হবে আবার নতুন নতুন ক্ষত, নতুন যন্ত্রণা। আবার তুষতেল মাখা। এত ঝামেলায় যেতে চায় না যারা, তারা বাজার থেকে কিনে আনত নীল রঙের তুঁতে। তুঁতে গুলে লাগিয়ে দিত ক্ষতে।

এভাবেই পাট কাটা-ধোয়ার মৌসুম গড়িয়ে যেত। পুরো মৌসুমজুড়েই চলত হাঁজামজা কোমর জলে দাঁড়িয়ে তাদের পাট ধোঁয়া। পাট ধোয়ার সাথে চলত পাল্লা করে জারি, ধুয়ো, তারাসে গান–

বেঁকে কথা কয় মনোঋষি, আমি পার হইতে এসেছি
করবা না পার ক্যানো গো রূপসী
দেখে তোমার রূপেরই বাহার
মন আমার হয় যে উদাসী
তোমার নতুন তরী দেখে সুন্দরী আইছি মনের হাউশি ॥

তুমি দিচ্ছ খেওয়া যমুনার ঘাটে
আমার লেখা ছিল এই ললাটে
তাই এসেছি হে তোমারি ঘাটে
তুমি পার করবা কি করবা না বলে দাও আমারে
যদি পার করবা না তয় পড়ে যাবা ঘোর সংকটে
আমি জোর করে পার হয়ে যাব লো, ভাগ্যে আমার যা থাকে ॥

বুড়ো দেখে ওলো ধনী করলি অহংকার
বুড়ো না রথের চুড়ো অসারেরই সার
রমজান বিশ্বাস কয়, তোর বসাবো নৌকোর পাছার পর
ওরে রাগ জলেতে বাচ (বাইচ) খেলিবো রাখো তরী হুশিয়ার
হালের শলায় নজর রেখে দুই হস্তে টানবো দাঁড় ॥

অন্যদিক থেকে আরেক জন গেয়ে ওঠে–

ও তোর পাটনি জাতির এমন রীতি
সারে সুরে বায় না তরী
নোনা লাগে খায়ে গেছে দ্যাখ না চায়ে
পূরণ হয়ে গেছে সোনার তরী ॥

দধি, দুগ্ধ দেখে তুমি ক্যাননা করো আনাগোনা
এসব খেলে তোমার প্যাটে হজম হবে না
খাও গো তুমি চিটেগুড় আর পচা মাঠা
দধি দুগ্ধর কদর জানোনা ॥

সব সখীরে পার করিতে নেচ্ছো আনা আনা
আমার বেলায় চাচ্ছো তুমি আসল ষোল আনা
এ দেখি মতির সোনা ও দিনে কানা
ডোম জাতি এ পড়তে জানে না
তোর ঘরে গেলে পড়বি ধরা যাবি জেলখানা ॥

সারাদিন ধরে চলত এইসব গীত। সন্ধ্যায় ধোয়া পাটের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরত সবাই। কৃষাণীরা সেই পাট ঝেড়ে বাঁশের আড়া বেঁধে ঝুলিয়ে দিত। কড়া রোদে মেলে দিত টানটান করে। শুরু হতে পাট শুকোনো পর্ব। বারে বারে রমণীরা এসে উল্টেপাল্টে দিত। সমস্ত পাট একভাবে শুকিয়ে ঝরঝরে না হলে ভালো দাম পাওয়া যাবে না। ভেজা থাকলে পাটের রংও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। পাট শুকাতে শুকাতে সেই রোদে কৃষাণীর গায়ের রং পুড়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করত। কিন্তু তাদের শরীর-মনের রস, প্রেম, ঘণা শুকিয়ে যেত না। গভীর সরোবরে কাতলা মাছের মতো ঘর-সংসারের কাজে খলবল করে পুচ্ছ নাড়িয়ে ঘুরে বেড়াত তারা।

কথায় বলে ভাদুরে গরমে তাল পাকে। পাকা তালের বড়া খাওয়ার ধুম পড়ে যেত এই মাসে। তালের ক্ষীর জ্বাল দিয়ে পরদিন সকালে খাওয়ার মজাও কম ছিল না। ভাদ্র মাসের যে কোনো শনিবার নমশূদ্র রমণীরা রাতের বেলা চালের গুঁড়ো, তাল আর গুড় একসাথে মেখে কলার পাতায় করে পোড়াত। খেত পরদিন সকালে। এতে শনির দৃষ্টি চলে যায়। একে বলত ‘শনি তাড়ানো’। কোনো কোনো এলাকায় বলত ‘পিঠে পোড়ানো’ বা ‘পাতা পোড়ানো’। নমশূদ্ররা বিশ্বাস করত, এই পাতা পোড়ানো হলে শনির দৃষ্টি আর তাদের সংসারে পড়বে না সারা বছর।

ভাদরের শেষ। মাঠ, ঘাট, খানাখন্দ ভরা থই থই জল। পাট কাটা, ধোয়াও শেষ প্রায়। শেষ ভাদ্রে নমশূদ্র বউয়েরা চুমোই পুজোয় মেতে উঠত। এই পুজোকে এরা ঘর ঢুকনো পুজোও বলত। এই পুজো হলো নমশূদ্রদের ভাদুরে পার্বণ।

এই পার্বণে নমশূদ্ররা নতুন পাট বাজারে নিয়ে বিক্রি করে জোড়া ধরে ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরত। সারাদিন নমশূদ্র কৃষাণীরা উপোস থেকে সন্ধ্যায় বসত আঁশবঁটি নিয়ে। ইলিশ মাছ আস্ত ধুয়ে বঁটিতে আঁশ ছাড়াত। ছাড়ানো আশ ধুয়ে পরিষ্কার করে পুরত এক খণ্ড বাঁশের চুমোয়। বাড়ির প্রধান গৃহিণী যে ঘরে ঘুমায়, সেই ঘরের মধ্যে মাঝের খুঁটির গোড়া খুঁড়ে পাড়ার সব রমণীরা একত্রিত হয়ে উলুধ্বনির মধ্যে আঁশপোরা বাঁশের চুমো সেই গর্তে পুঁতে দিত। এই পর্ব চলত এক বাড়ি শেষে আরেক বাড়িতে। চুমো পোঁতা শেষ করে বউয়েরা বসততা একসাথে গোল হয়ে। তাদের মধ্য সবচেয়ে প্রবীণা যিনি, তিনি চুমোই দেব-এর মাহাত্ম প্রকাশ করত গল্পের মাধ্যমে–

এক ছিল বুড়ো আর এক ছিল বুড়ি। তাদের ছিল দুই মেয়ে। মেয়ে দুডের নাম উমোনো, আর একজনের নাম ঝুমোনো। বুড়ো ছিল খুব গরিব। এর-ওর কাছ থেকে চায়ে-চিন্তে কোনোমতে সংসার চালাত। কোনোদিন ভিক্ষে করত। ভিক্ষেয় এক-আধ সের চাল পাত, এট্টা দুড়ে কাঁচকলা পাত। যা দিয়ে সংসার চলত না ঠিকমতো। একদিন বুড়ো বুড়ির কাছে কয়, আর তো পারি নে। মেয়ে দুডোর মুখে একমুট ভাতও তুলে দিবার খেমতা নাই আমার। উমোনো, ঝুমোনো দুই বোনরেই মাসির বাড়ি থুয়ে আসি। কয়দিন খায়ে বাচতি পারবি। অনেক চিন্তা করে, মনের কষ্ট মনের মদ্যি চাপে রাখে বউ রাজি হয়ে যায়।

বুড়ো দুই মেয়ে নিয়ে রওনা দেয়। হাঁটতি হাঁটতি দিন পার হয়ে যায়। খিদেয় তাগের পেটের মদ্যি চো চো করতি থাকে। তারপরও তারা হাঁটতি থাকে। হাঁটতি হাঁটতি এক বিজন বনের মদ্যি ঢুকে যায় তারা। বনের মদ্যি এক বুড়ো বট গাছ। সেই গাছের নিচে ঠান্ডা ছায়ায় দাঁড়ায়ে দুই বোন বাবার কাছে কয়–এট্টু বসি বাবা। বিশ্রাম নেই। বাবা কয়–বোসো।

বট গাছের গোড়ায় তিনজন মিলে বসে পড়ে। বাবার এক হাঁটুর উপর উমোনো, আর এক হাঁটুর উপর ঝুমোনো মাথা রাখে ঘুমোয়ে যায়। সেই ঘুম দেখে বুড়োর মনের মদ্যি কী জানি কী হতি লাগল। খানিক চিন্তা-ভাবনা করে শ্যাষে দুই মেয়ের মাথা হাঁটুর উপরেরতে নামায়ে মাথার তলে কিছু ঘাসপাতা দিয়ে বাবা উঠে আস্তে আস্তে বাড়ির পথ ধরলো।

এক সময় দুই বোনের ঘুম ভাঙে। দ্যাখে, বাবা নাই। তারা এদিক তাকায়, ওদিক তাকায়। কোনো জায়গায় বাবারে খুঁজে পায় না। তখন দুই বোন কাঁদতি শুরু করে। কাঁদতি কাঁদতি বেলা শেষ হয়। সন্ধে ঘনায়ে আসে। দুই বোন ভয় পায়ে বুড়ো বট গাছের কাছে কয়–তুমি আমাগের, না অন্য কেরুর?

বটগাছ কয়, আমি তোমাগের ছাড়া আর কার!

উমোনো-ঝুমোনো তহন কয়–তালি রাতটা তুমার মদ্যি আমাগের লুকোয়ে রাখো।

বটগাছ দুই ভাগ হয়ে ফাঁক হয়ে গেল। আর দুই বোন বটগাছের মধ্যি ঢুকে গেল। গাছ আবার আগের মতো হয়ে যায়।

পরদিন সকালে দুই বোন বটগাছের ভেতরের তে বার হয়ে হাটতি শুরু করে। হাঁটতি হাঁটতি বনের শেষে যায়ে দ্যাখে এট্টা বাড়ি। বাড়ির মধ্যি বাস করে এক বুড়ি। বুড়ির আছে দুডে গাই গরু। দুই বোন মাসি… মাসি… কয়ে ডাকতি ডাকতি বাড়ির মদ্যি ঢুকে যায়। বুড়ি চিন্তা করে, তার তো কোনো বোন নাই; তালি এরা কারা? তখন সে জানতি চায়–তোমরা কারা গো? কনতে আইছো!

উমোনো আর ঝুমোনো কয়–মার কাছে শুনিছি এই গায় আমাগের মাসি থাকে। আমরা সেই মাসির কাছে আইছি। খুব খিদে পাইছে আমাগের।

এ শুনে বুড়ি আদর করে তাদের থাকতি দ্যায়। খাতি দ্যায়। পরদিন বুড়ি হাটে দুধ বেচতি যায়ে দুড়ে ঘট কিনে নিয়ে আসে। সেই ঘট দুই বুনির হাতে দিয়ে কয়, পেত্যেক দিন এই ঘটে ফুল-জল দিয়ে আগে পুজো করবি। তারপর ভাত খাবি।

দুই বোন তাই করতি থাকে।

ঘট পুজো শুরু হওয়ার পরের তে বুড়ির সংসারে আরও বেশি আনন্দ আসে। সুখ উপচায়ে পড়তি থাকে। এট্টা এট্টা করে দিন যায়, মাস চলে যায়, বছর গড়ায়ে যায়। উমোনো, ঝুমোনো দুই বোন বুড়ির কাছেই থাকে যায়। বড় হয়ে গেলি একদিন বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। তার কিছুদিন পর ছোট বোনেরও বিয়ে হয়। দুই বোন সোয়ামীর ঘরে যায়েও ঘট পুজো করতি থাকে। আর দুই বোনের সংসারেও আসে শান্তি আর হতি থাকে উন্নতি।

বড় বোন উমোনোর তিন ছেলেমেয়ে হয়। তাগের মানুষ করতি করতি একদিন বড় বোন ঘট পুজোর কথা ভুলে যায়। দিন দিন তার সংসারে অভাব অনটন জুড়ে আসতি থাকে। আর ছোট বোন ভক্তিমান। নিষ্ঠার সাথে সে প্রতিদিন পুজো করতি থাকে। তাই সংসারে সুখ ঝুলে ঝুলে পড়ে।

অভাবের তাড়নায় একদিন উমোনো তার ছেলেমেয়েরে কয়–তোরা তোগের মাসি বাড়ি যা। পেট ভরে খায়ে আয় গে। আর সাথে করে কিছু খাবার নিয়ে আয় গে। ছেলেমেয়েরা তাই করে। ঝুমোনোর বাড়ি যায়।

এদিক, পুজো না করতি করতি বড় বোনের ঘটের জল শুকোয়ে গেছে। একদিন সে টান মারে সেই ঘট বাইরে ফ্যালায়ে দিল। যে জায়গায় ঘট ফেলাইছিল, তার পাশ দিয়েই ছোট বোনের বাড়ি যাতি হয়।

ছেলেমেয়েরা খায়ে-দায়ে মাসির বাড়ির তে মার জন্যি খাবার নিয়ে আসতি লাগল। ঘট ফেলার সেই জায়গায় আসা মাত্তর হাতের তে সব খাবার মাটিতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা কাঁদতি কাঁদতি বাড়ি ফিরে মার কাছে সব খুলে কয়। মা কয়, কাঁদিস নে। কী আর করা যাবি।

কয়দিন পর আবার ওরা চাল আনতে গেল মাসির বাড়ি। চাল নিয়ে ফেরার পথে সেই একই জায়গায় আসে সব চাল পড়ে কাদায় মাখামাখি হয়ে গেল। তারও কয়দিন পর বড় বোন এবার নিজিই ছেলেমেয়ে নিয়ে ছোট বোনের বাড়ি গেল। নিজিরা প্যাট ভরে খায়ে কিছু খাবার নিয়ে রওনা দিল বাড়ির দিক। এবারও ঠিক একই জায়গায় আসে উমোনোর হাতের তে সব খাবার মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাতি লাগল। এবার উমোনো ফিরে গেল ঝুমোনোর কাছে। সব কথা খুলে কয় তারে।

ছোট বোন সব শুনে কয়–ঘট পুজো কি করসি পেত্যেক দিন?

না তো!

কোস কী! তোর পুজোর ঘট কী করিছিস?

উমোনো কয়–ফ্যালায়ে দিছি।

ঝুমোনো চোখ কপালে তুলে কয়–করিছিস কী! ঘট যে জাগায় ফেলিছিস, সে জাগার তে এহনই উঠোয়ে নিয়ে আয়। কালকের তে আবার পুজো শুরু কর। তালি আর মাছ-ভাতের অভাব হবি নে।

বড় বোন সেই ঘট আর খুঁজে পায় না। কী করবে এখন!

বাঁশের চুমোয় করে ঘট বসাল সে। পুজো দিতি লাগল পেত্যকেদিন। এটু এটু করে একদিন তাগের অভাব চলে গেল। আবার তারা নতুন জলের নতুন ইলিশ মাছ দিয়ে পেট ভরে ভাত খাতি লাগল।

সেই থেকে শুরু হলো চুমোই পুজো।

ভাদ্র মাসে অনেক গো-মাতা বাছুর প্রসব করে থাকে। অবশ্য সারা বছর ধরেই গাভী বাছুর দেয়। নমশূদ্রদের ভাষায় গাই বিয়োনো। গাই বিয়োনোর একুশ দিনের মাথায় নমশূদ্ররা আয়োজন করত অনুষ্ঠানের। এই অনুষ্ঠানকে বলে ‘জাগ’। এই একুশ দিন নমশূদ্ররা শাবক প্রসব করা সেই গাভীর দুধ নিজেরা যেমন খেত না, তেমনি বাজারেও বিক্রি করত না। গাভী দোহন না করে পুরো দুধটুকু তারা বাছুরের জন্য রেখে দিত। যাতে মায়ের দুধ খেয়ে সবল হয়ে বেড়ে উঠতে পারে বাছুর।

গাভী প্রসবের একুশ দিন পর নমশূদ্র গৃহস্থ তার বাড়ির উঠোনে পাড়ার সব ছেলেমেয়েদের সন্ধ্যায় নিমন্ত্রণ করত। শুরু হতো জাগ। জাগ মূলত গানের অনুষ্ঠান। বড় একজন জাগ-এর গান গাইত। বাচ্চারা এবং উপস্থিত অন্যরা তার পিছে পিছে সুর মেলাত–

এ বাড়িখান পুবে কাঁটা
ফ্যালা আলাম কদুর কাঁটা
কদুর কাঁটা না রে গোটবেহারি
গোরক্ষ আসপি সাঁঝ লাগলি।

ও হে গিরি মোর কথা শোন
আতাল ভাঙে পাট বোনো
পাট বুনলি হবি বড়
আগা কাটে গোড়া কাটে
মদ্যির ছ্যাও জলে থুয়ে
জলে গুলি হবে কুয়ে (পাট পচবে)
ভাদ্র মাসে আনো ধুয়ে।

ভাদ্র মাসে ডাক রোদ
তাতে দ্যাও পাট রোদ
পাট রোদ দে বাঁধো মোড়া
গরু হবি বত্রিশ জোড়া ॥
তা না, না না, ভুল কোরো না ভুলের কড়ি
গাই বিয়োইছে কবলে সুরি
কী ঘাস খায়? নলের কুঁড়ি
কী জল খায়? চাপ চুপানি
কী নাদ নাদে (মল ত্যাগ)? মরচির কুঁড়ি
কী দুধ দ্যায়? হাঁড়ি হাঁড়ি।

উত্তরে তে এলেন পাঠ
পাঠ বলেন, আমি বড় বীর
গরু বাঁধি সহ স্থির
দিঘলেগুনি মাঠের নড়ি (গরু তাড়ানো লাঠি) গাই বিয়োইছে
গোরক্ষের পুণ্যি ॥

এই জাগ বলা শেষ হলে, বিয়োনো গাভীর প্রথম দোহন করা দুধ আর আতপ চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি করা নাড়ু সবার মধ্যে বিলানো হতো। এর নাম ‘বাগ নাড়ু’ বা ‘গুক্কু নাড়ু’। বাগ নাড়ু বিলানোর পরদিন থেকে সেই গাভীর দুধ গৃহস্থ নিজেরা খেতে পারত এবং বিক্রিও করতে পারত।

ভাদ্র মাসে প্রায় বছরই দেখা দিত কলেরার প্রাদুর্ভাব। শুধু যে ভাদ্র মাসেই কলেরা ছড়িয়ে পড়ত তা নয়। বছরের যে কোনো সময়ই হতে পারত। কলেরা পানিবাহিত ছোঁয়াচে রোগ। কোনো বাড়িতে কারো একবার ভেদবমি শুরু হলে বুক শুকিয়ে যেত গ্রামের অন্য সব মানুষের। অজানিত ভয় আর শঙ্কা গ্রাস করে ফেলত তাদের। দেখতে দেখতে একজন থেকে পাঁচজন, পাঁচজন থেকে বিশজন এভাবে গোটা গ্রাম, গোটা এলাকায় কলেরা মহামারি আকারে ছড়িয়ে যেত। প্রাণের ভয়ে দলে দলে মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে চলে যেত।

কলেরা রোগের চিকিৎসা ছিল তখন হোমিও বা কবিরাজনির্ভর। চিকিৎসার প্রথম ধাপেই রোগীর জন্য নিষিদ্ধ হতে জলপান। জল এবং লবণ-শূন্যতা যে রোগীর মৃত্যুর অন্যতম বড় কারণ সেটা তাদের জানা ছিল না। স্যালাইন। আবিষ্কার হয়নি তখন। একজনকে রোগে ধরলে তাকে ফেলে রেখে পরিবারের অন্যদেরকে নিয়ে কর্তা পালিয়ে চলে যেতেন। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি অসহায় অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যেত। আকাশে দলবেঁধে শকুন উড়ে বেড়াত। রাতে শিয়াল-কুকুরের দল নৃশংস ভোজ-উল্লাসে মেতে উঠত। রোগী মারা গেলে বা মৃতপ্রায় নিস্তেজ রোগাক্রান্তকে ছিঁড়েভুরে খেয়ে ফেলত তারা।

কোনো বছর কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে দরিদ্র নমশূদ্র পরিবারগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত। স্বজন হারানোর কষ্ট বুকের মধ্যে মুচড়ে মুচড়ে বেড়াত। সেই হাহাকার নিয়ে আবার কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়াতে অনেক সময় লেগে যেত তাদের।

ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার হতো ঝিঙে ষষ্ঠী।

এইদিন গ্রামের সব নমশূদ্র কৃষাণী সকাল সকাল ঘর সংসারের কাজ সেরে ছেলেমেয়ে নিয়ে নদী বা পুকুর ঘাটে গিয়ে জড়ো হতো। বাড়ি থেকে সাথে করে সবাই ঝিঙে নিয়ে আসত। ছেলেমেয়েসহ একসাথে স্নান করে বধূরা গোল হয়ে বসত নদীর ঘাটে। কাচি বা দা দিয়ে ঝিঙেগুলো গোল গোল চাক করে কাটত। চাক কাটা ঝিঙেতে দিত গোলানো সিঁদুর এবং আতপ চালের গুঁড়ো গোলানো পিটুলির ফোঁটা। তারপর সাজাত বট-পাকুরের পাতা আর ধান দূর্বা। গোছা গোছা লম্বা করে কাটা সুতোয় তেল-হলুদ দিয়ে বানানো রং মাখানো হতো। এরপর ঘাটে আতপ চালের ভোগ বসিয়ে গোল হয়ে বসে ভক্তিভরে ব্রতকথা শুনত সবাই। বলত প্রবীণ মহিলা কেউ একজন গল্পের মতো করে

একদিন এক চাষা মাঠের তে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরতেছিল। এট্টা গরু ছুটে যায়ে গ্রামের আরেক বাড়ির বউয়ের জাংলার ঝিঙে খায়ে ফেলাল। সিতা দেখে পাশের বাড়ির বুড়ি চ্যাচায়ে কয়-ওলো বউ, তোর জাংলার ঝিঙে সব খায়ে শ্যাষ করে দিল।

জাংলায় ঝুলে রইছে বড় বড়, তাজা তাজা বাহারি ঝিঙে। সকাল-বিকাল বউ খুব যত্ন করে সেই ঝিঙে গাছের। সে তখন উঠোন ঝাড় দিচ্ছিল। ঝিঙে খাওয়ার কথা শুনে ঝাটা হাতেই দৌড়োয়ে আসে বউডা। আসে দেখে, তার সাধের ঝিঙে কচকচ করে গরুতি খায়ে ফেলাচ্ছে। রাগের চোটে বউ তখন সেই ঝাঁটা দিয়ে সপাসপ গরুডারে বাড়ি দিতি থাকে।

সিতা দেখে পাশের বাড়ির বুড়ি কয়-–ও কী করলি লো। লক্ষ্মীর গায় ঝটার বাড়ি মারলি।

বউ রাগের চোটে কয়–খালি বাড়ি মারব না। গরুর চোখও কানা করে দেব। আমার জাংলার সব ঝিঙে খায়ে ফেলাইছে।

সেদিন সাঁঝ না লাগতিই বউ-এর গোয়ালের বলদ জোড়া কাপতি কাপতি শুয়ে পড়ল। বউডার ছেলেপুলে বলতি এট্টা মাত্র মেয়ে। বয়েস দশ-এগারো। সারাদিন মেয়ে খেলে বেড়াল মনের সুখে। বলা নেই কওয়া নেই, জ্বরে কাঁপতি কাপতি সেও শুয়ে পড়ল। বৌডার সোয়ামী গিছিল হাটে। রাতে বাড়ি ফিরলি সব কথা খুলে কয় বউ তার কাছে। রাত যত বাড়ে, মেয়ের জ্বরও তত বাড়ে। আর ওদিক গোয়ালের মদ্যি গরু ঠ্যাং আছড়ায়ে মরে। এরম করেই কাটে যায় রাত। রাত প্রভাতে মা লক্ষ্মী স্বপ্নে দেখা দেয়।

কয়–তুই আমার ছাওয়ালের গায় ঝাঁটা মারিছিস। তোরে আমি মাপ করব না।

বউ কানতি কানতি কাকুতি-মিনতি করে বলতি থাকে–ভুল হয়ে গেছে মা। ক্ষ্যামা করে দ্যাও।

মা লক্ষ্মী নরম হয়ে কয়–ক্ষমা তোরে করতি পারি। তয়, সকালে ঘুমির তে উঠে মেয়ে নিয়ে ঘাটে যায়ে ডুব দিবি। সাথে নিবি তোর জাংলার ঝিঙে। ঘাটে বসে ঝিঙে চাক চাক করে কাটে ত্যাল-সিঁদুর, ধান-দুব্বো দিয়ে আমার নামে পুজো দিবি। আর এ কথা সগলের কাছে প্রচার করবি। তালি তোর সংসারে মঙ্গল আসপি।

পরদিন ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার। ঘুম ভাঙতেই বউ পাড়ায় যায়ে সগলের কাছে স্বপ্নের কথা কয়। তারপর সবাইরে জড়ো করে নিয়ে যায় নদীর ঘাটে। দেয় ঝিঙে পুজো। অন্য বউরাও তাদের সংসারের মঙ্গল কামনায় তার সাথে পুজো দেয়।

সেইদিন থেকে নমশূদ্র বউরা প্রতি বছর ধুমধাম করে ঝিঙে ষষ্ঠীর পুজো দেয়।

ভাদ্র মাসে থৈ থৈ ভরা বিল। ধানখেত ডুবুডুবু। সাদা, খয়েরি রঙা হাঁসেরা জলে চড়ে বেড়ায় সারাদিন আপনমনে। ডানা ঝাড়ে কখনও ডাঙ্গায় ওঠে। কথায় বলে, ভাদ্রের কুড়ি, জল হয় বুড়ি। বিলে জল বাড়ে। আতঙ্কে থাকে নমশূদ্র কৃষক। বানভাসি না হয়ে যায় আবার। এই সময়ে তাদের কাজকর্ম কম। জীবনযাত্রাও তাই ঢিলেঢালা। অলসতার চাদরে মোড়ানো। আরাম আয়েশে কাটে তাদের দিন। দিগন্ত বিস্তৃত বিলের জলে পড়ে নীল আকাশের ছায়া। সেই ছায়া ঢেউয়ের তালে কেঁপে কেঁপে ফেরে। ভাদ্রের দিন অনেক বড়। দীর্ঘ সময়ের রোদের তাপে ধরণী উত্তপ্ত হয়ে থাকে। সে তুলনায় রাত ছোট। সন্ধ্যা হতে না হতেই যেন আঁধার ফুরিয়ে ভোরের আলো ফুটে ওঠে।

ভাদ্র মাস মলা মাস। ভাদ্রে বিয়ে হয় না। ভাদ্র মাসে কোনো শুভ কাজও করা হয় না। নমশুদ্র গেরস্থরা এই মাসে কুকুর-বিড়াল পর্যন্ত বাড়ি থেকে তাড়ায় না। শাস্ত্রমতে, ভাদ্রের পয়লা তারিখে দূরযাত্রা নিষেধ।

ভাদ্র মাসে কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম। জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠান তেমন জমজমাট না হলেও নমশূদ্রদের প্রবল ভক্তিভাবে তা উতরে যেত। উপবাস, নামকীর্তনের মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রার্থনা করত। ভাদ্রের শেষদিনে হতো বিশ্বকর্মা পুজো। এ পুজোয় নমশূদ্রদের তেমন কোনো ভূমিকা থাকে না। তবে নমশূদ্র গেরস্থদের মধ্যে যারা ঘর বানানো, নৌকা নির্মাণ ইত্যাদি মিস্ত্রি কাজের সাথে যুক্ত থাকত, তারা এই পুজোর আয়োজন করত ক্ষুদ্র পরিসরে। পুজোর সকালে হাতুড়-বাটাল, বাটখারা, করাত ইত্যাদি ব্যবহার্য জিনিসপত্র ধুয়ে পরিষ্কার করে সাজিয়ে রাখত। তার আগে বানিয়ে রাখত চালজির ছাতু। কুড়িয়ে রাখত নারকেল। সেসব একসাথে গুড় দিয়ে মেখে বড় বড় নাড়র মতো প্রসাদ বানাত। পুজো শেষে বিতরণ হতো সবার মধ্যে সেই প্রসাদ। কোনো কোনো এলাকায় বিশ্বকর্মা পূজা উপলক্ষে আয়োজন করা হতো নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার।

এইসব পুজো-পার্বণের ভিতর দিয়ে একসময় পার হয়ে যেত নমশূদ্রদের জীবন থেকে আর একটি ভাদ্র মাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *