1 of 8

দাঁত

দাঁত

দক্ষিণ কলকাতায় কালীঘাট অঞ্চলে, (জানি না এখনও আছে কিনা, পাতাল রেলের কল্যাণে সে রাস্তা দিয়ে আজ কয়েক বছর যাতায়াত নেই) একটা বাড়ির সামনে বহুকাল ধরে একটা সাইনবোর্ড ছিল, তাতে লেখা ছিল, ‘দান্তের হাসপাতাল’।

বলা বাহুল্য, এটি একটি নিতান্তই বানান-বিভ্রাট, মহাকবি দান্তের সঙ্গে এই হাসপাতালটির সামান্যতম যোগাযোগ থাকার কোনও সম্ভাবনাই নেই। আসলে দাঁতের চন্দ্রবিন্দু কোনও বিচিত্র ভ্রমে পিছিয়ে গিয়ে ‘ন’ হয়ে গেছে, ফলে দাঁতের হাসপাতাল দান্তের হাসপাতালে পরিণত হয়েছে।

শুধু বানানে নয়, বাস্তবে চিকিৎসায় এ রকম দাঁত বিভ্রাট অনবরতই শোনা যায়। হাসপাতালে দেখা গেছে বারো নম্বর রোগীর মাড়ির দাঁতে ব্যথা, কাগজ দেখে ভুল করে তেরো নম্বর রোগীর মাড়ির দাঁত তুলে ফেলা হয়েছে, যার আসলে সামনের দাঁতে ব্যথা। একবার এক রোগীকে দেখেছিলাম দাঁতের চেয়ারে যন্ত্রণাকাতর বিকৃত মুখে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে ককাচ্ছেন, ডাক্তার বলছেন, ‘কী হল? এখনও তো আমি আপনার দাতে হাত দিইনি৷’ রোগী বলছেন, ‘দাঁত নয়, আপনি পায়ের বুটজুতো দিয়ে আমার পায়ের বুড়ো আঙুল মাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।’

কিন্তু এ সমস্ত গল্পই খুবই তুচ্ছ এবং হাস্যকর মনে হবে, আজ আমি আপনাদের যে মর্মান্তিক কাহিনী শোনাতে বসেছি তার তুলনায়। কাণ্ডজ্ঞানের মতো তরল পৃষ্ঠার পক্ষে কাহিনীটি মোটেই উপযুক্ত নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে হাতে কোনও ভাল বিষয় না থাকার জন্যে নিতান্ত বাধ্য হয়ে এই গর্হিত কাজটি করছি।

এই গল্পটির কোনও ইতিহাস বা ভূগোল নেই। কবে কোথায় ঘটেছিল তা বলা যাবে না, বলা উচিতও হবে না। বর্ণনার সুবিধের জন্যে আমি গল্পটি উত্তমপুরুষে বলছি, কিন্তু গল্পটি আমার নয়, আমি শুনেছিলাম যাঁর কাছে তিনি কার কাছে শুনেছিলেন বা কোথাও পড়েছিলেন কি না, তা বলতে পারব না।

গল্পটির কেন্দ্রস্থল এক মফস্বল শহর, কলকাতার কাছেই। সেখানে এই গরমে এক প্রীতিসম্মেলন সহ মধ্যাহ্নভোজে গিয়েছিলাম। আজকাল সন্ধ্যায় বিদ্যুতের অভাব এবং চুরি-ছিনতাইয়ের প্রাচুর্যের জন্যে কলকাতা এবং মফস্বলে বহু গৃহস্থই প্রীতিভোজের আয়োজন দুপুরবেলা করছেন।

যেমন হয়, সেই প্রীতিভোজের আসরে অনেক পরিচিত লোকের সঙ্গে বেশ অনেকদিন পরে দেখা হল। এখানেই অনেকদিন পরে চিন্তাহরণ বসুর সঙ্গে দেখা। একসময় ওঁর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব ছিল, এক পাড়ায় থাকতাম, প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা একসঙ্গে আড্ডা দিতাম। এখন দু’জনে দু’জায়গায় দু’রকম ব্যস্ত জীবন যাপন করি, কদাচিৎ দেখা হয় তাঁর সঙ্গে, আজ এখানে দেখা হল দেড় বছর বাদে।

চিন্তাহরণবাবুকে দেখে বিশেষ ভাল লাগল না। মুখ কালো করে, গালে হাত দিয়ে অর্ধনিমীলিত চোখে স্থির হয়ে বসে আছেন, পাশে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে বললেন, দাঁত ব্যথা, সকাল থেকেই অল্প অল্প ছিল। ব্যথাসুদ্ধই বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। কিন্তু তখনও কোনওরকম ছিল, কিন্তু এখন অসহ্য, শুধু দাঁত নয় সমস্ত শরীর যেন টনটন করছে। জিজ্ঞাসা করে আরও জানতে পারলাম, এখানে আসবার পথে মোড়ের ওষুধের দোকান থেকে এক শিশি ‘টুথেক কিওর’ কিনে লাগিয়েছেন, পায়ের কাছে লাল ওষুধের ফাঁকা শিশিটা পড়ে রয়েছে। তারপর সামনের পানের দোকান থেকে চারটে কোডোপাইরিন কিনে সোডা ওয়াটার দিয়ে খেয়েছেন। তারপর সহনিমন্ত্রিতদের পরামর্শে ভোজবাড়ির ব্যস্ত রান্নাঘর থেকে এক ঘটি গরমজল এনে নুন দিয়ে কুলকুচি করেছেন, এমনকী যারা পান সাজছে তাদের কাছ থেকে গুটিকয় লবঙ্গ চেয়ে নিয়ে দাঁতের গোড়ায় চেপে রেখেছেন।

কিছুতেই কিছু হয়নি। সর্বশেষে স্থানীয় এক ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আগে পাশের পাড়ায় এক হাফ-সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে যান। মাত্র পাঁচ সিকে পয়সার বিনিময়ে সেই সন্ন্যাসীটি চিন্তাহরণবাবুকে স্বপ্নলব্ধ ব্যথাহরণ একটি মন্ত্র দিয়েছেন, মন্ত্রটি মনে মনে আটশো আটবার জপ করা মাত্র ব্যথা দূর হয়ে যাবে; জিপটি খুবই গোপন এবং অব্যর্থ। কিন্তু এই দুঃসহ ব্যথায় আটশো আটবার কোনও মন্ত্র জপ করার মতো মনের জোর তাঁর নেই। আর মন্ত্রটিও অতি খটমটে, আমি জিজ্ঞাসা করায় গোপনীয়তা ভঙ্গ করে চিন্তাহরণবাবু জানালেন মন্ত্রটি হল—

‘পরম ব্রহ্ম প্রজাপতি ঋষি

শূলা শান্তি অহর্নিশি।

সুখ শান্তি দিশি দিশি

পরম শান্তি প্রজাপতি ঋষি।’

বলা বাহুল্য, এই মন্ত্র আটশো আটবার জপ করে যন্ত্রণা দূর করা বোধহয় কারও পক্ষেই সম্ভব নয় এবং সময় লাগে অন্তত বারো-চৌদ্দ ঘন্টা।

এখন চিন্তাহরণবাবু একা একা গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছেন এমনিতে যদি ব্যথাটা একটু কমে যায়। নিমন্ত্রণ খাওয়া মাথায় উঠেছে, ব্যথাটা সামান্য কমলেই সোজা একটা রিকশা করে স্টেশনে, সেখান থেকে কলকাতা ফিরবেন। আমি প্রস্তাব করলাম, ‘তার চেয়ে চলুন একজন ডেন্টিস্টের কাছে যাই।’ চিন্তাহরণবাবু বললেন, ‘সে কথা কি আমি ভাবিনি? কিন্তু এই গ্রীষ্মের ভরদুপুরে ছুটির দিনে এই মফস্বল শহরে দাঁতের ডাক্তার কোথায় পাব?’

প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক আমার আর চিন্তাহরণবাবুর কথাটা শুনছিলেন, তিনি বললেন, কাছেই রেল স্টেশনের ওপারে ‘সিওর কিওর’ নামে একটা নার্সিংহোম আছে, সেখানে মিলিটারির প্রাক্তন ডাক্তার মেজর সিং, দাঁত-চোখ-কান-বুক যাবতীয় চিকিৎসা করেন এবং তাকে দিবারাত্র পাওয়া যায়।

রিকশা করে চিন্তাহরণবাবুকে নার্সিংহোমে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার সিংকে দেখে শ্রদ্ধা হল। আমরা যখন গেলাম তখন তিনি স্থূলদেহ এক স্থানীয় ব্যবসায়ীর নাতিবৃহৎ তলপেট হাঁটু দিয়ে চেপে সেই ব্যক্তির লিভারের ক্ষমতা পরীক্ষা করছিলেন। শুধু লিভার নয়, দাঁত ব্যথা, চক্ষু পরীক্ষা, পাগলের চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার ইত্যাদি নানাবিধ ডাক্তারি ও শল্যচিকিৎসা মেজর সিং একা নিজ হাতে করেন।

আমাদের নতুন লোক দেখে এবং প্রয়োজন শুনে মেজর সিং যকৃৎ রোগীকে কিছুক্ষণের জন্যে ছেড়ে দিয়ে আমাদের কাছে এলেন। একটা পুরনো লোহার চেয়ারে চিন্তাহরণবাবু বসলেন, চেয়ারের পিছনে চুলকাটার সেলুনের মতো একটা স্কন্ধাসন, তাতে মাথা হেলিয়ে দিলেন। মেজর সিং একটা টেবিলের ড্রয়ার থেকে কয়েকটা ছুরি, কাঁচি, ফরসেপস ইত্যাদি বার করে নিয়ে এলেন; যন্ত্রপাতি পুরনো কিন্তু বেশ মজবুত, বোধহয় মিলিটারি থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছেন। চিন্তাহরণবাবু এত যন্ত্রণার মধ্যেও আশঙ্কান্বিতভাবে মেজর সাহেবের ও তাঁর অস্ত্রাদির দিকে তাকাতে লাগলেন। আমি চিন্তাহরণবাবুর মাথার ওপাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

মেজর সিং চিন্তাহরণবাবুর ডানদিকে এসে তাঁকে হাঁ করতে বললেন। চিন্তাহরণবাবু হাঁ করা মাত্র মুহূর্তের মধ্যে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। কোনও প্রশ্ন না করে, কিছু না জেনে, কোনও বিবেচনা না করে মেজর সাহেব বিদ্যুৎগতিতে চিন্তাহরণবাবুর ওপরের পাটির সামনের তিনটা দাঁত ফটাফট তুলে মেজেতে ফেলে দিলেন। আমি দেখলাম একটা রক্তারক্তি ব্যাপার হতে চলেছে, কিন্তু চিন্তাহরণবাবুর এক ফোঁটা রক্ত বেরোল না, মেজর সাহেবও বললেন, ‘সাংঘাতিক অ্যানিমিয়া দেখছি, একবিন্দু রক্ত নেই।’

চিন্তাহরণবাবু ইতিমধ্যে চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে পড়েছেন। সদ্য তোলা দাঁত তিনটে মেজে থেকে তুলে পাশের বেসিন থেকে ধুয়ে নিলেন, তারপর সযত্নে ওপরের পাটিতে দাঁত তিনটি লাগালেন। তারপর মেজরকে বললেন, ‘খুব রক্ত দেখার সাধ হয়েছে বুঝি? কথা নেই বার্তা নেই, তিনটে দাঁত তুলে ফেললেন? পাগল নাকি? ভাগ্যিস বাঁধানো দাঁত তাই রক্ষা পেয়ে গেলাম।’

চিন্তাহরণবাবু আমাকে বললেন, ‘চলুন এই পাগলের আস্তানা থেকে বেরিয়ে প্রাণ বাঁচাই। তবে এমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিল যে উত্তেজনায় দাঁতের ব্যথাটা মরে গেছে।’

দু’জনে বেরিয়ে এলাম। তখনও মেজর সাহেব আমাদের পিছু ছাড়েননি। পিছন ফিরে তাঁর দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, ‘আমার ভিজিটটা!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *