১২. তারানাথের কাছ থেকে চলে আসার ঠিক পরে

সেদিন তারানাথের কাছ থেকে চলে আসার ঠিক পরে পরেই কোনও ছুটির দিন ছিল না। তারপর দুটো রবিবার আমি আর কিশোরী দুজনেই ব্যস্ত ছিলাম, ফলে গল্পের দারুণ আকর্ষণ থাকলেও তারানাথের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অবশ্য আমরা ইচ্ছে করেও মাঝে মাঝে ফাঁক দিই, বিশেষ করে একটু পুরনো আর লম্বা গল্প শোনার সময়। এ ধরনের গল্প একদিন বা দুদিনে শেষ হয় না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ডুব দিয়ে আমরা দেখতে চাই তারানাথ গল্পের খুঁটিনাটিতে কোনও গোলমাল করে ফেলে কিনা। আজ পর্যন্ত তেমন কোনও ঘটনা ঘটেনি, তিনমাস পরে ফের শুরু করলেও সব সে ঠিকঠাক বলে। নামধাম ভুল করে না, তারিখ গুলিয়ে ফেলে না, কে কার কী হয় তা সঠিক মনে। রাখে। ফলে আমরা তার গল্প এখন প্রায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, আগের মত কেবল গল্পের নেশা নয়, তার সঙ্গে মিশেছে বেশ কিছুটা শ্রদ্ধা। তবে এবার গল্পের খেই ধরতে একটু দেরি হল, কারণ যে কোম্পানিতে আমি কাজ করি তারা হঠাৎ মাসখানেকের জন্য আমাকে বদলি করল বিহার আর মধ্যপ্রদেশের সীমান্তে একটা জায়গায়। সেখানে কোম্পানির নতুন কারখানা হবে, দু-তিনটে জায়গা দেখা হয়েছে। আপাতত অফিসের একজন মেজকর্তা, সার্ভেয়ার আর আমি যাচ্ছি। ঘোর পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু ফেলে থাকতে হবে। রান্নাবান্না, জঙ্গল পরিষ্কার করা, জরিপের কাজে সাহায্য—এসবের জন্য জনপনেরো লোক স্থানীয় কোনও আদিবাসী গ্রাম থেকে জোগাড় করতে হবে। আমার কাজ হল তহবিল আর হিসেবপত্র রাখা, আর সাধারণভাবে সবকিছুর তত্ত্বাবধান করা।

বাঙালী বাড়ি ছেড়ে বেরুতে ভালবাসে না। বেশ আছি বাপু কলকাতায়, বাড়ি অবশ্য গ্রামে—তবু ইচ্ছে করলে দুই কী আড়াইঘণ্টার মধ্যে সেখানে পৌঁছতে পারি। শহরে মেসে থাকি, মেস থেকে সকালে স্নান-খাওয়া সেরে পান মুখে দিয়ে ধীরেসুস্থে সাড়ে ন’টায় বেরুলেও কোনও তাড়াহুড়ো না করেই দশটার ভেতর অফিসে হাজির হই। বিকেলে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার খেয়ে অন্য বোর্ডারদের সঙ্গে ব্রিজ খেলায় বসে যাই। রাত দশটায় খাওয়া, এগারোটার মধ্যে বিছানা আশ্রয়। সমস্ত ব্যাপারটার ভেতর একটা নিশ্চিত নির্ভরতা আছে, মসৃণ গতিতে এভাবে জীবন চলে গেলে কে আর যেচে জটিলতা আমদানি। করে? তারপর অফিস থেকে বলছে বটে একমাস, শেষপর্যন্ত সেটা কতদিনে গিয়ে ঠেকবে বলা কঠিন। কাজ শেষ না হলে আমার ভাল লাগছে না বলে বায়না করলে তো আর কোম্পানি কলকাতায় ফিরিয়ে আনবে না। বন্ধু আর আড্ডা ফেলে, সিনেমা থিয়েটার আর শহরের হরেক মজা ফেলে কি জঙ্গলে যেতে ইচ্ছে করে? অফিসের নির্দেশ জানিয়ে বাবাকে চিঠি লিখলাম, আশা ছিল বাবা যদি অত দূরে জনমানবহীন জায়গায় যাওয়া নিয়ে একটুও উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তাহলে বাবার স্বাস্থ্য ভাল নয় এই অজুহাত দেখিয়ে অফিসে দরখাস্ত করে যাওয়া ঠেকাতে চেষ্টা করব। হায় রে! নিজের বাবাকে এতদিনেও কেন ঠিকঠাক চিনিনি তা ভেবে অবাক লাগল। বাবা লিখলেন—স্নেহের বাবাজীবন, তোমার পত্র পাইয়া আনন্দিত হইলাম। কলিকাতার বদ্ধ বাঁচা হইতে এতদিনে কর্মের সূত্রে তোমার বাহিরে যাইবার সুযোগ ঘটিয়াছে ইহার জন্য পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। এক জায়গায় কাদায় গুণ পুঁতিয়া পড়িয়া থাকিলে মনুষ্যত্বের সম্যক বিকাশ ঘটে না। ঈশ্বরের এই সুন্দর সৃষ্টির বৈচিত্র্য দেখিবার সুযোগ পাওয়া ভাগ্যের কথা। আমাদের যৌবনে এত সুযোগ ছিল না, আমার সারাজীবন পাড়াগ্রামেই কাটিল। যাহা আমি পারি নাই তুমি তাহা করিতে চলিয়াছ ভাবিয়া গর্বিত বোধ করিতেছি। আমার জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তা করিও না, আমি ভালই আছি। এখনও বেশ পরিশ্রম করিতে পারি। একমাস কেন, ছয়মাস তুমি বাইরে থাকিলেও ক্ষতি হইবে না। নিয়মিত পত্র দিয়া কুশল জানাইবে। ইতি, আশীর্বাদক–বাবা।

নাঃ, বাবাকে আর মানুষ করা গেল না। সুটকেস গোছাতে শুরু করলাম।

হাতে সময় বেশি ছিল না, ভেবেছিলাম যাওয়ার আগে একবার তারানাথের সঙ্গে দেখা করে যাব, কিন্তু তার আর সময় পেলাম না। কিশোরীকে বলে গেলাম সে যেন তারানাথকে জানিয়ে দেয় খবরটা। মেসে একমাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়ে গেলাম, ম্যানেজারকে জানিয়ে রাখলাম যদি একমাসেরও বেশি দেরি হয় তাহলে মনিঅর্ডারে টাকা পাঠাব, নইলে কিশোরী এসে দিয়ে যাবে। মেসে বহুদিন আছি, ম্যানেজারের সঙ্গে প্রায় বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে, তিনি হেসে বললেন—অ্যাডভান্স না দিলেও চলত। এমনিই চলে যান না, বাইরে যাচ্ছেন, হাতে বাড়তি নগদ থাকা ভাল। আমি অবশ্য শুনলাম না, যেখানে যাচ্ছি সেই জঙ্গলে পয়সা খরচ করার কোনও সুযোগ নেই। খামোক বেশি টাকা হাতে রেখে কী করব?

রাত দশটা বেজে দশ মিনিটে হাওড়া থেকে রাউরকেল্লা এক্সপ্রেস ছাড়ে, সেই ট্রেনে রওনা দিতে হবে। পরদিন ভোররাত্তিরে রাউরকেল্লা নেমে বাস ধরে বিরমিত্রাপুর হয়ে সিমডেগা যেতে হবে। বনজঙ্গল আর পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে প্রায় ষাট মাইল রাস্তা। সিমডেগা বিহারের রাঁচি জেলায় অবস্থিত হলেও জায়গাটা বিহার উড়িষ্যা আর মধ্যপ্রদেশের প্রায় সংযোগস্থলে। বাঙালী আছে সামান্য কয়েকঘর, বেশিরভাগই বিহারী, মাড়োয়ারি আর হো মুণ্ডা ওরাঁও ইত্যাদি আদিবাসী। সিমডেগায় স্থানীয় অফিস হিসেবে একটা বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানে থাকবে আপাতত একজন মালিগোছের কর্মচারী, সে বাড়িঘর দেখাশোনা করবে আর পাহারা দেবে।

বাঙালী বাড়ির বাইরে যেতে চায় না, শুনেছি বেড়াতে যাবার সময় ঘোড়ার গাড়ি ডেকে তাতে মালপত্র তুলে দরজায় তালা বন্ধ করবার সময় চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে সে মনে মনে ভাবে না গেলেই হত। আমারও প্রথম দিকে তাই হয়েছিল বটে, কিন্তু যাবার দিন সকাল থেকে মনের বিষণ্ণতা কেটে গিয়ে বেশ একটা চনমনে ভাব মনের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল। সত্যি বলতে কী, একবার পুরী আর একবার বৈদ্যনাথ ধাম ছাড়া সেভাবে বাইরে বেরুনো হয়নি কখনও। মনটা বিভক্ত হয়ে গিয়ে রক্ষণশীল ভাগটা বলছে—ঘরের নিরাপদ পরিবেশ ছেড়ে বেরুচ্ছ কোথায় বাপু? এসব ইচ্ছে তো ভাল নয়। আবার মুক্ত বাতাসলোভী তরুণ সত্তার অংশটা বলছে—বেরিয়ে পড়, এতবড় পৃথিবীটা শত বৈচিত্র্য নিয়ে অপেক্ষা করে রয়েছে তোমারই জন্য। সে সব না দেখে কলকাতায় কেরানীগিরি করে মরবে!

জিতে গেল তরুণ সত্তা। ইতিহাসে চিরকাল তাই জিতেছে।

রাত্রি দশটার পরে ট্রেন, কাজেই মেস থেকে রাত্তিরের খাওয়া সেরেই বেরুলাম পৌনে দশটার মধ্যে রাউলকেল্লা এক্সপ্রেসের নির্দিষ্ট কামরার সামনে পৌঁছে গেলাম। সার্ভেয়ার সাহেব দেখি আগেই এসে গিয়ে দুখানা বেঞ্চিতে চাদর বিছিয়ে জায়গা অধিকার করে রেখেছেন। ট্রেনে বিশেষ ভিড় নেই, অপর দুটি বেঞ্চির মধ্যে একটিতে মধ্যবয়েসী একজন অবাঙালী ভদ্রলোক পুটলি খুলে সামনে চাপাটির গোছা, সবজি আর আচার নিয়ে বসে গিয়েছেন। অপর বেঞ্চিটি এখনও খালি। সার্ভেয়ার ভদ্রলোকের নাম নির্মল কাঞ্জিলাল, তিনি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে নজর রাখছিলেন। আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে বললেন—এই যে, এই কামরায়! চলে আসুন–

গাড়িতে উঠে সুটকেসটা বাঙ্কে তুলে দিয়ে হোল্ড-অল খুলে বেঞ্চিতে বিছানা পাততে পাততে বললাম—মেজকর্তা তো সেকেন্ড ক্লাসে যাবেন, তিনি এসেছেন তো?

-ওঃ, সে আমাদের আগে! মহা ব্যস্তবাগীশ মানুষ, এরমধ্যেই দুবার এসে আপনি পৌঁছেছেন কিনা সে খোঁজ নিয়ে গিয়েছেন। একটু খামখেয়ালি, কিন্তু ভাল লোক— এ নির্মলবাবুর কথা শেষ হতে না হতে মেজকর্তা ফের এসে হাজির। জানালায় উঁকি দিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—যাক্, এসে গিয়েছেন। আপনারা মশাই ইয়ং ম্যান, আপনাদের এত দেরি হয় কী করে বলুন তো?

সবিনয়ে জানালাম-খাওয়াদাওয়া করে বেরুতে একটু সময় লেগেছে।

—এঃ হে, খেয়ে এসেছেন! ট্রেন জার্নির আদ্দেক মজাই তো মাটি করেছেন! শুকনো খাবার—যেমন পরোটা, রুটি, সামান্য সবজি, গুটিকয়েক কড়াপাকের সন্দেশ—এইসব নিয়ে ট্রেনে উঠবেন। গুটগুট করে ট্রেন চাবে, আর টুকটুক করে খাবেন। তবে না মজা! তারপর গলার স্বর নিচু করে ওদিকের বেঞ্চিতে ভোজনরত অবাঙালী ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন—ওই দেখুন একজন বুদ্ধিমান লোক। গলার স্বর আবার স্বাভাবিক করে হেসে বললেন—এই দেরি করে খাওয়া সারতে গিয়ে কত লোক ট্রেন মিস্ করে। যাক্, আবার যেন নামতে দেরি করবেন না। আলো ফোটবার আগেই গাড়ি রাউরকেল্লা ঢুকে যায়। বাঙামুণ্ডা পার হতে আরম্ভ করলেই জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবেন–

বললাম–ভয় কী। এ ট্রেন তো রাউরকেল্লা ছাড়িয়ে আর যাবে না–

মেজকর্তা হেসে বললেন—তা ঠিক। আর একটা কথা, টাটানগর ছাড়াবার পর লাইনের দুদিকের দৃশ্য খুব সুন্দর, কেবল পাহাড় জঙ্গল আর ঝর্ণা। চাঁদনি রাত এখন, দেখতে খুব ভাল লাগবে। আজকে রাত দুটোর পর আর ঘুমোবেন না—

মানুষটার ওপর শ্রদ্ধা জন্মে গেল। অফিসের একঘেয়ে আর নীরস কাজের মধ্যে মেজকর্তার এই সরস ব্যক্তিত্বের দিকটা চোখে পড়ার কোনও সুযোগ ঘটেনি। বরং তার। খামখেয়ালিপনা নিয়ে আড়ালে আমরা সকলে হাসাহাসিই করেছি। কার মধ্যে যে কী। থাকে!

ট্রেন ছাড়ল। রেলের গুমটি, শান্টিং ইয়ার্ড ইত্যাদি ছাড়াবার পর গতি বাড়িয়ে ট্রেন জোরে ছুটতে শুরু করল। প্রথম থামবে একেবারে খঙ্গপুরে। কিন্তু এখন সত্যিই দুদিকে দেখবার কিছু নেই। অতি সাধারণ কিছু কুশ্রী জনপদ, দোকানপাট বন্ধ, পথে মানুষ প্রায় নেই। বিদ্যুতের আলো কম, তেলের বাতি জ্বলছে কোথাও কোনও বাড়ির বারান্দায়। বড় শহরের উপকণ্ঠ যেমন নিরানন্দ আর নীরস হয়। মেজকর্তার কথা মেনে রাত দুটোর পর জাগলেই হবে এখন। মাথার পেছনে দুইহাত দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে কামরার ছাদে কম পাওয়ারের বাতিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ট্রেনের দুলুনিতে আস্তে আস্তে ঘুম পেয়ে গেল।

ঘণ্টা আড়াই পরে ঘুমটা আপনিই ভেঙে গেল। ঘড়িতে দেখি রাত প্রায় একটা। তার মানে সামনে খড়গপুর আসছে। কনুইয়ে ভর দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। চাদের আলোয় ধোয়া মাঠপ্রান্তর দ্রুতবেগে পেছনদিকে ছুটে চলেছে, মৃদু আলোয় দৃশ্যমান। পরিবেশে ফুটে রয়েছে এক দৈবী মায়া। এখনও এক কী দেড়ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়ে উঠলেই হবে। আবার শুয়ে পড়তে যাচ্ছি, হঠাৎ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আকাশের অনেকখানি অংশে দীর্ঘ পথরেখা টেনে চন্দ্রালোকিত মাঠে এক বিশাল নীল উল্কা এসে পড়ল! আকাশে তার সঞ্চরণপথে এখনও আবছা নীল আভা জেগে রয়েছে। দুরন্ত গতিতে ছুটে এসে মাঠে পড়ার প্রচণ্ড অভিঘাতে বোধহয় উল্কাটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল, একরাশ নীল আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছিটকে উঠল মাঠের বুক থেকে। স্কুলের পাঠ্যবইতে পড়েছিলাম প্রতিদিনই বহু উল্কা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, কিন্তু তার ভেতর খুব কমই মাটি পর্যন্ত পৌঁছায়। আমিও এই প্রথম কোনও উল্কা মাটিতে পড়তে দেখলাম। তাছাড়া উল্কা কি কখনও নীল রঙের হয়? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল একটা কথা—বহুদিন আগে তারানাথ কালভৈরবের উপাখ্যান শোনাবার সময় বলেছিল তার জন্মমুহূর্তে নাকি বিশাল এক নীল উল্কা আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অবধি চলে গিয়েছিল ঠিক এমনি পথরেখা তৈরি করে। এবার যে গল্প অসমাপ্ত রেখে বাইরে যাচ্ছি—ফিরে নিশ্চয়ই বাকিটা শুনব—তাতেও তারানাথ একবার এই ব্যাপারটার উল্লেখ করেছিল বলে মনে পড়ল। এই দুটো ঘটনার কি কোনও যোগসূত্র আছে? নইলে আজই হঠাৎ নীল উল্কাপাত দেখলাম কেন?

অবশ্য একটা কথা ঠিক, এর আগে খুব একটা বাইরে বেরুই নি কখনও। গ্রামের পাঠশালা সাঙ্গ করে মহকুমা শহরে হোস্টেলে থেকে পড়তাম। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে কলকাতার কলেজ, তারপর কলকাতাতেই চাকরি। আমি সত্যেন দত্ত বা নজরুলের কবিতার বাংলার দামাল ছেলে নই, সেভাবে দেখা হয়নি কিছু। জীবনে প্রথম গৃহপ্রাঙ্গণ পার হয়ে বেরুতে না বেরুতে একটা বিচিত্র জিনিস দেখে ফেললাম। এমনই অভিজ্ঞতার জনক!

আবার শুয়ে পড়তে যাচ্ছি, হঠাৎ নজরে পড়ল ওধারের বেঞ্চের দিকে।

সেখানে একজন মানুষ শুয়ে ঘুমোচ্ছ। ঘুমোচ্ছে বললাম বটে, কিন্তু নিদ্রিত লোকের দেহে এক ধরনের অচেতন শিথিলতা থাকে-একে দেখে মনে হয় যেন এমনি এমনি চোখ বুজে শুয়ে রয়েছে। বছর চল্লিশেক বয়েস হবে, পরনে খাটো ধুতি আর ফতুয়া বা পিরাণ জাতীয় কিছু। মুখশ্রী শান্ত আর নিরীহ, সে মুখে এমন একটা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যার জন্য বারবার তাকাতে ইচ্ছে করে। যদিও লোকটি একটু ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকায় সম্পূর্ণ মুখটা ভাল করে দেখতে পাচ্ছি না।

কিন্তু কথা হল, লোকটি ট্রেনে উঠল কখন? হাওড়া থেকে গাড়ি ছাড়ার সময় পর্যন্ত কামরায় আমি, নির্মলবাবু আর সেই ভোজনরত অবাঙালী ভদ্রলোক ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। গাড়িতে ঠিক গভীর ঘুম হয় না, আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে চাকার শব্দ, লাইনের ক্রসিং পার হবার ঘটাং ঘটাং আওয়াজ, কামরার দুলুনি—সব অস্পষ্টভাবে টের। পাওয়া যায়। কাজেই আমি জানি ট্রেন মধ্যে কোনও স্টেশনে থামেনি। থামলে টের পেতাম। তা হলে?

অথবা থেমেছে নিশ্চয়ই, হয়তো মাঝখানে একটু গভীর ঘুম হওয়ায় বুঝতে পারিনি। নইলে আস্ত একটা মানুষ তো বাতাসে উড়ে এসে কামরার জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েনি!

এইসব ভাবছি, গাড়ি ঢুকে পড়ল খঙ্গপুর স্টেশনে।

এত রাত্তিরে প্ল্যাটফর্মে ভিড় ছিল না। দু-একজন ঝিমন্ত চা-ওয়ালা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই কামরায় কেউ উঠল না। নির্মলবাবু ঘুমের মধ্যেই একবার বিড়বিড় করে বললেন—কী স্টেশন?

বললাম-খড়গপুর।

‘বাঃ বাঃ, বেশ!’ বলে নির্মলবাবু পাশ ফিরে আবার গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়লেন।

ট্রেন ছাড়তে আমিও আরাম করে শুয়ে চোখ বুজলাম।

পরের বার ঘুম ভাঙল ট্রেন থামার সামান্য ঝাঁকুনিতে : রাত তখন সওয়া তিনটে। দেখলাম ছোট একটা স্টেশনে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। আমাদের কামরার ঠিক সামনেই লোহার খুঁটির ওপর তেলের বাতি জ্বলছে, যদিও চমৎকার জ্যোৎস্নায় ফুটফুট করছে, বাতির কোনও দরকার নেই, তবু সরকারী আইন—গাড়ি আসবার দশ-পনেরো মিনিট আগে স্টেশনের কুলি এসে বাতি জ্বেলে দিয়ে যায়। সারারাত টানা জ্বলে না, তাতে সরকারের অকারণ খরচ বাড়ে। মাথায় পাগড়ি, গায়ে লাল কুর্তা পরা রেলের এক কুলি কামরার পাশ দিয়ে গম্ভীর হেঁড়ে গলায় বলতে বলতে চলেছে—গৈলকেরা। গৈলকেরা–

তাকে জিজ্ঞাসা করলাম—কী স্টেশন এটা, ও ভাই?

সে হাঁটতে হাঁটতেই বলল–গৈলকেরা, বাবুজি।

মেজকর্তা ঠিকই বলেছিলেন, ভারি অপূর্ব দৃশ্য তো এ লাইনের! স্টেশনের একেবারে গা ঘেঁষে একটা বনজঙ্গলে ভর্তি পাহাড় উঠে গিয়েছে ওপরদিকে। প্ল্যাটফর্মে জনমানব নেই, পরিবেশে কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই, কেবল চাদের আলোয় হাল্কা স্বপ্নের রঙ দিয়ে আঁকা একখানি দক্ষ শিল্পীর তৈরি ছবি আমার সামনে মেলে রাখা আছে। হঠাৎই নৈশ মগ্নতা ভেঙে সামনের পাহাড়ের জঙ্গল থেকে কর্কশ গলায় কী একটা প্রাণী ডেকে উঠল। অবাক হয়ে ভাবছি, জিনিসটা কী হতে পারে, এমন সময় আমার পেছন থেকে নির্মলবাবুর গলা ভেসে এল—ময়ুর! ওটা ময়ুরের ডাক–

পেছনে তাকিয়ে দেখি সার্ভেয়ার সাহেব ঘুম ভেঙে উঠে বসেছেন।

বললাম–হ্যাঁ। প্রথমে বুঝতে পারিনি, তারপরে মনে পড়ল কলকাতার চিড়িয়াখানায় এই ডাক শুনেছি। শহরের লোক তো, একটু ধাঁধা লেগে যায়। আপনি কী করে বুঝলেন?

একটা হাই চেপে সার্ভেয়ার সাহেব বললেন—সিনেমা দেখে।

—সিনেমা দেখে। তার মানে?

—আরে মশাই, আমিও আপনার মত শহরের মানুষ, ময়ূরের ডাক রোজ শুনব কোথা থেকে? গত মাসে ভক্ত ধ্রুব ফিলিম দেখতে গিয়েছিলাম, তাতে একটা দৃশ্যে রয়েছে ধ্রুব জঙ্গলে চোখ বুজে বসে ধ্যান করছে, আর তার চারদিকে চরে রেড়াচ্ছে কটা ময়ূর। তারই মধ্যে একটা কয়েকবার ক্যাক ক্যাক করে ডাকল। কিন্তু সে আওয়াজে ধ্রুবর ধ্যান ভাঙল না, ডিরেকটার সেই ব্যাপারটাই দেখাতে চেয়েছিলেন। সেটা মনে পড়ে গেল–

নির্মলবাবু উঠে এসে আমার বেঞ্চিতেই জানালার ধারে বসলেন। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিয়ে বললেন–নিন।

একসঙ্গে বাইরে বেরুলে একটা সহজ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে পদমর্যাদা কিংবা সামাজিক। অবস্থানের পার্থক্যটুকু মুছে দেয়। তবু অফিসে নির্মলবাবু আমার ওপরওয়ালা, উনি দিচ্ছেন বলেই তো আর সঙ্গে সঙ্গে একটা তুলে নেওয়া যায় না। সসঙ্কোচে বললাম-না, থাক–

—থাক কেন, নিন-ধরান একটা। এখন আমাদের বেশ কিছুদিন একসঙ্গে থাকতে হবে। লজ্জা ঝেড়ে না ফেললে চলবে কী করে? আপনি স্মোক করেন তা আমি জানি–

ক্যাভেন্ডার্স নেভিকাট একখানা ধরিয়ে মাথা সোজা করতেই প্রথম নজর পড়ল ওপাশের বেঞ্চিতে। অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।

সেই মাঝপথে হঠাৎ উঠে আসা রহস্যময় লোকটি আর সেখানে নেই।

আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে নির্মল কাঞ্জিলাল একবার ওপাশে তাকালেন, তারপর বললেন—কী হয়েছে? ওদিকে অমন করে কী দেখছেন?

বললাম–না, মানে-ওই ওদিকের বেঞ্চিতে একজন লোক শুয়ে ঘুমোচ্ছিল, সে গেল কোথায়?

নির্মলবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—মাঝে কোনও স্টেশনে নেমে গিয়েছে হয়তো। জিনিসপত্র কিছু নিয়েটিয়ে যায়নি তো? দেখে নিন ভাল করে, দিনকাল খারাপ পড়েছে–

—না, ঠিক তা নয়, মানে—

বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে বেশি কথা বললে নির্মলবাবু হয়তো আমাকে বাতিকগ্রস্ত ভাববেন। কথার গতি বদলে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললাম—কী অপূর্ব দৃশ্য, তাই না? মেজকর্তা ঠিকই বলেছিলেন, বাকি রাতটুকু আর। ঘুমোনা উচিত হবে না–

নির্মল কাঞ্জিলাল মানুষ ভাল, কিন্তু একটু বাস্তববাদী নীরস প্রকৃতির। ক্যাভেন্ডার্সে একটা লম্বা সুখটান দিয়ে জানালা গলিয়ে অবশিষ্টাংশ বাইরে ফেলে আবার শোয়ার উদ্যোগ করতে করতে তিনি বললেন—আপনাদের মনে অসীম কবিত্ব, জেগে বসে প্রকৃতি দেখুন বরং, আমি আরও ঘণ্টাদুই ঘুমিয়ে নিই। রাউরকেল্লা ঢোকবার মুখে ডেকে দেবেন। মেজকর্তা অমন করে বললেন, তাঁর মুখের ওপর তো আর ‘না’ বলা যায় না। কিন্তু আমার ঘুমই ভাল–

তিনি আবার লম্বা হয়ে শুয়ে চোখ বুজলেন। অবাঙালী ভদ্রলোক সেই যে খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়েছেন, সারারাত ট্রেনের দুলুনি ঝাঁকুনি বা আমাদের কথাবার্তার শব্দে। তার নিদ্রার কিছুমাত্র ব্যাঘাত ঘটেনি। এসব নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ মানুষ দেখলেও হিংসে হয়।

রাউলকেল্লা পৌঁছনো পর্যন্ত সত্যিই আমার আর ঘুম হল না। শুক্লা নবমীর চাঁদ পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, সট সফ্ট পিছিয়ে যাওয়া বড় বড় গাছগুলোর দীর্ঘ ছায়া মাটিতে। হঠাৎই একটা কালো গ্রানাইটের টিলা লাইনের পাশেই, ক্ষীণধারা ঝর্না নেমে এসেছে তার গা বেয়ে। আর সবকিছুর ওপর সেই ম্লান হয়ে আসা শেষরাতের মায়াবী জ্যোৎস্না। সম্মোহিতের মত বাকি রাতটুকু জানালার পাশে বসে কাটিয়ে দিলাম।

ট্রেন যখন রাউরকেল্লা পৌঁছল তখনও ভাল করে ভোর হয়নি। আমরা তিনজন যখন স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম তখনও মানুষজন জাগেনি, দু-তিনটে ছোট গুমটি দোকান আছে—বোধহয় চা বা খাবারের, সেগুলো বন্ধ। কেবল মাথায় পাগড়ি জড়ানো এক বৃদ্ধ নলওয়ালা পেতলের কলসীতে করে চা বিক্রি করছে। তাকে ডেকে সবাইকে চা দিতে বলা হল। ভঁড়ে চুমুক দিয়ে মেজকর্তা বললেন–সিমডেগা থেকে জিপ নিয়ে লোক আসবার কথা ছিল, কী হল তাদের বুঝতে পারছি না তো–

প্রথম ভাঁড় শেষ করে মেজকর্তা চাওয়ালাকে বললেন–আর একবার করে দাও, এই এতেই দাও—

দ্বিতীয়বারের চায়ে যখন চুমুক দিচ্ছি, তখনই একটা রঙওঠা উইলির জিপ নানারকম শব্দ করতে করতে স্টেশন চত্বরে এসে ঢুকল। তার থেকে নেমে হহ করে আমাদের সামনে দাঁড়াল এক অদ্ভুত চেহারার মানুষ। অদ্ভুত বলছি এই কারণে যে, লোকটি কেবলই লম্বা—তার শরীরের অন্য কোনও মাত্রা নেই। সরু সরু কয়েক টুকরো বাঁশের ওপর পোশাক-আশাক জড়ালে যেমন দেখায়, একেও ঠিক তেমনি দেখতে। ছোটবেলায় পাঁকাটি আর তালপাতা দিয়ে তৈরি একরকমের খেলনা সেপাই মেলায় বিক্রি হতে দেখেছি, এই মানুষটিকে দেখে সে কথা মনে পড়ে গেল।

লোকটি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বারদুই প্রবল হোঁচট খেয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়ে নির্ভুলভাবে মেজকর্তাকে দলপতি হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে বলল–নমস্কার। আমি জলধর পণ্ডা।

মেজকর্তা বললেন—নমস্কার। তুমি আমাদের সিমডেগা অফিসের ওভারসিয়ার?

—আইজ্ঞাঁ।

জলধর পণ্ডার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যে সে কোন অঞ্চলের মানুষ তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে যে মানুষ ভাল তাও তার বিনীত কথা বলার ভঙ্গি আর আচরণে বোঝা যায়।

-–ঠিক আছে। আমাদের মালপত্রগুলো জিপে ওঠাবার ব্যবস্থা করো। যেতে যেতে কথা হবে—

আমাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিস কারোই খুব বেশি নেই, একটা করে তোরঙ্গ আর একটা করে বিছানার বাণ্ডিল। কেবল সার্ভেয়ার নির্মলবাবুর জরিপের কাজে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তিনটে বড় কাঠের তালা-লাগানো বাক্সে চলেছে। দুরবীন-চেনথিওড়োলাইট এবং আরও কী কী সব। জিপের সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসলেন মেজকর্তা। আমি, নির্মলবাবু আর জলধর পেছনের দু-সারি মুখখামুখি সিটে ভাগ করে। গাড়ি যখন চলতে আরম্ভ করল তখন ভোরের আলো বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে। জলধর। বলল—এখনও শহরের দোকানপাট কিছু খোলেনি। চলুন, কুড়ি-বাইশ মাইল গেলে বিরমিত্রাপুর বলে একটা ছোট জায়গা পড়বে। সেটা বিহার আর উড়িষ্যার বর্ডার, সেখানে। একটা খাবারের দোকানে সকালে খুব ভাল কচুড়ি আর জিলিপি ভাজে, বহু লোক ভিড় করে খেতে আসে। আমরাও ওই দোকানেই খেয়ে নেব। আপনাদের খুব খিদে পেয়ে গিয়েছে নিশ্চয়–

সামনের সিট থেকে মুখ না ঘুরিয়েই মেজকর্তা বললেন—কচুড়ির সঙ্গে কী দেয়?

একটু অবাক হয়ে জলধর বলল—আইজ্ঞাঁ?

-বলছি কচুড়ির সঙ্গে সে দোকানে কী দেয়? ডাল, না তরকারি?

—অঃ, না তরকারি না—ডাল দেয়। বুটের ডাল—

একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেজকর্তা বললেন—আমি ছোটবেলায় যে ইস্কুলে পড়তাম, সেই স্কুলের দারোয়ান শান্তি টিফিনের সময় ছেলেদের কাছে বিক্রি করার জন্য লুচি ভাজত।

লুচির সঙ্গে দিত আলু, কুমড়ো আর পেঁয়াজ দিয়ে রান্না একটা তরকারি। সত্যি কথা বলতে কী, ওই তরকারির লোভেই আমরা শান্তির লুচি কিনে খেতাম। সে স্বাদ এখনও মুখে লেগে রয়েছে। বড় বড় সাইজের লুচি, দু-পয়সা করে দাম নিত–

বললাম—এক একজন লোকের রান্নার হাত খুব ভাল হয়। ঠিকই বলেছেন–

মেজকর্তা বললেন—এক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু ভাল রান্নার নয়। এখন বুঝতে পারি দুটো কারণে শান্তির রান্না আমাদের ভাল লাগত। প্রথম কারণ, তখন অল্প বয়েস, বাড়ির আটপৌরে রান্নার বাইরে অন্য কোনও ভাল খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। সেই অনভিজ্ঞ রসনায় দোকান থেকে কিছু কিনে খেলেই তা মধুর লাগত। দ্বিতীয় কারণ, রান্নায় কুমড়োর সঙ্গে পেঁয়াজের ব্যবহার, আমাদের পরিবারে, বা সাধারণভাবে বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজে ছিল না। সেই নতুনত্বটাও আকর্ষণ করত।

একটু থেমে মেজকর্তা আবার বললেন—বছরদুয়েক আগে কী একটা কাজে আমার ছোটবেলার সেই ইস্কুলে একবার যেতে হয়েছিল। কাজ সেরে বেরুবার সময় হঠাৎ মনে হল একবার শান্তির খোঁজ করে যাই। স্কুলের বড় ফটকের পাশে দুখানা নিচু ধরনের টালির ঘরে সপরিবারে শান্তি বাস করত। ঘরদুটো দেখলাম একইরকম আছে। ডাকাডাকি করতে একজন নজদেহ বৃদ্ধ বেরিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল-কাকে খুঁজছেন?

বললাম—এই ঘরে শান্তি বলে একজন থাকত, এই স্কুলের দারোয়ান। অনেকদিন আগের কথা বলছি। সে এখন কোথায় থাকে বলতে পারেন?

কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা সেই বুড়ো অবাক হয়ে একটু তাকিয়ে থেকে বলল—আমিই তো শান্তি!

ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ, ছোটবেলায় যে শান্তিকে দেখেছি অনেকটা মিল আছে তার সঙ্গে। কিন্তু জরা তার পূর্বের চেহারাকে গ্রাস করেছে। শান্তি বলল–আপনি কে বাবু? আমাকে কেন খুঁজছেন?।

বললাম—আমি এই স্কুলে অনেকদিন আগে পড়তাম। তুমি টিফিনের সময় লুচি ভাজতে, মনে আছে? লুচি খাবার জন্য পয়সা জমিয়ে রাখতাম। ওঃ, তুমি বড্ড বুড়ো হয়ে গেছ শান্তিদা–

শান্তি হেসে বলল—তা হব না? বয়েস পঁচাত্তর হল। তোমার নাম কী খোকাবাবু?

নাম বললাম, আমাদের ব্যাচের দু-একজন ছেলের নাম বললাম। সে ভাল চিনতে পারল না। কিন্তু পুরনো ছাত্র মনে করে দেখা করতে এসেছে, এতেই সে ভারি খুশি। আর চাকরির বয়েস নেই, কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ ভালবেসে পুরনো দুটো ঘরের মধ্যে একটায় তাকে থাকতে দিয়েছে। সেখানেই বাকি জীবনটা সে কাটিয়ে দেবে। আমাকে সে আবার যেতে বলেছিল। আর যাওয়া হয়নি।

বিরমিত্রাপুর এসে গেল। গরম কচুড়ি আর জিলিপি পেট ভরে খেয়ে আবার পথে। গাড়িতে ওঠবার আগে নির্মলবাবুর মতই মেজকর্তাও বললেন—শুনুন ভাই, বাইরে কাজ করতে এসেছি, এখানে আর অফিসের ফর্মালিটি টেনে আনবেন না। সিগারেট খেলে ধরিয়ে ফেলুন—

সিগারেট ধরিয়ে গাড়িতে উঠলাম। পথের দুধারে প্রান্তর, কোথাও শ্যামল শোস্তীর্ণ, কোথাও প্রস্তরময়। কখনও বা নিবিড় বনভূমি, তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী নদী। পথ কখনও চড়াই ভেঙে উঠছে, কখনও আবার নেমে আসছে সমতলে। এই আশ্চর্য সুন্দর পরিবেশের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি কী অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আমার হবে।

পরের এক সপ্তাহের ভেতরেই উপলব্ধি করেছিলাম, তারানাথ আমার জীবনের সঙ্গে কতখানি জড়িয়ে গিয়েছে।

যাক, যেভাবে ঘটেছিল সেভাবেই ঘটনাটা বলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *