৫. বিশ্বাস

৫. বিশ্বাস

বাইবেল-এর একটা কাহিনি দিয়ে শুরু করি। যিশু খ্রিস্ট ক্রুশে মৃত্যুবরণের পর তৃতীয় দিন সমাধি থেকে উত্থিত হয়ে শিষ্যদের কাছে দেখা দিলেন। একজন শিষ্য, থোমাস, বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এমন হতে পারে। যিশু থোমাসকে কাছে ডেকে তাঁর হাতে ক্রুশের পেরেকের ছিদ্রগুলি স্পর্শ করতে বললেন; এক সৈনিক তাঁর দেহের এক পাশে বর্শা দিয়ে আঘাত করেছিল, সেই ক্ষতে হাত দিয়ে দেখতে বললেন। এত করে থোমাসের বিশ্বাস জন্মাল ইনি সত্যিই যিশু, সমাধি থেকে উঠে এসেছেন। যিশু তখন তাঁকে বললেন, ‘থোমাস, তুমি তো দেখে তবে বিশ্বাস করলে। যারা না দেখেও বিশ্বাস করে, তারাই ঈশ্বরধন্য।’৬০

যাকে আমরা ‘বিশ্বাস’ বলি, যিশুর কথায় তার মূল চরিত্র প্রকাশ পাচ্ছে। কোনও জিনিস চোখে দেখা গেলে বা তার স্পষ্ট প্রমাণ মিললে বিশ্বাসের প্রশ্ন ওঠে না। আমরা বলি না আমরা ‘বিশ্বাস করি’ সূর্য পুব দিকে ওঠে, বা দিল্লি ভারতের রাজধানী। পদার্থবিজ্ঞানী বলেন না তিনি মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে ‘বিশ্বাস করেন’: ওটা প্রকৃতিতে ও পরীক্ষাগারে পর্যবেক্ষণ করে, এবং অঙ্ক কষে, প্রমাণ হয়েছে।

‘দেখে তবে বিশ্বাস’ অতএব বিশ্বাসই নয়, স্থির প্রত্যয়। তবে যিশুর কথার একটা তাৎপর্য আছে, কারণ যে জিনিসটা থোমাসকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে সেটা সাধারণ নিয়মে হবার নয়: মরা মানুষ বেঁচে ওঠে না। এই ‘বিশ্বাসের’ পিছনে তথ্য আছে (যিশু তো সত্যিই উঠে এসেছেন) কিন্তু তত্ত্ব অর্থাৎ স্বীকৃত প্রাকৃতিক নিয়ম নেই, বরং সেই নিয়ম ভাঙা হচ্ছে। এটা অলৌকিক, এ জন্যই সম্ভব হল যে যিশু মানুষ নন, ঈশ্বরপুত্র, প্রকৃতির নিয়ম তাঁর বেলায় খাটে না। আর একটা রাস্তা অবশ্য আছে, সেটা হচ্ছে আপাত অলৌকিক ঘটনার একটা বাস্তব ব্যাখ্যা খোঁজা। কেউ কেউ যেমন বলেছেন, যিশু আসলে মারা যাননি; শিষ্যেরা ভুল করে তেমন ভেবে তাঁকে সমাধিস্থ করেছিলেন, তিনি যথাসময়ে জেগে ওঠেন। এমন ঘটনা মাঝে মধ্যে ঘটে, আধুনিক হাসপাতালে পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রেই বা নয় কেন?

সত্যি তো, নয় কেন? মুশকিল এই, কোনও ভক্ত খ্রিস্টান এ ব্যাখ্যা মানবেন না। খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের মর্মস্থল হল যে মানবজাতিকে তার আদি পাপ থেকে উদ্ধার করার জন্য যিশু ক্রুশে প্রাণ দিয়ে আবার উত্থিত হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষে একবার মরলে বেঁচে উঠতে পারে না; পারে না বলেই যিশুর পুনরুত্থানের তাৎপর্য আছে। এতেই প্রমাণ হয় তিনি ঈশ্বরের অবতার, অতএব মানুষকে উদ্ধার করতে সক্ষম। খ্রিস্টান হতে গেলে এই ঘটনার অলৌকিকতা মানতেই হবে— কিন্তু তা যে সত্যি ঘটেছিল তাও মানতে হবে। থোমাসের অভিজ্ঞতা সেই সত্যতার সাক্ষ্য।

সচরাচর তথ্য-প্রমাণের অবতারণা হয় জানা-বোঝা বাস্তব জগৎটার প্রেক্ষিতে; এখানে ঠিক উলটো, জানা-বোঝার বাইরে একটা বিশ্বাসের জগৎকে পোক্ত করতে। বিশ্বাসের অবস্থান যুক্তিপন্থার জগতের বাইরে। তবু সেটা তো প্রত্যয়িত ও গ্রহণযোগ্য করা চাই, প্রমাণসিদ্ধ বাস্তবের পাশাপাশি— যেন বাস্তবেরই আর একটা স্তর বা অঙ্গ; কিংবা (বিশেষত ধর্মবিশ্বাস হলে) বাস্তবের ঊর্ধ্বে আরও অভ্রান্ত কোনও সত্যের স্তরে। সেখানে আমরা পৌঁছই যুক্তি-প্রমাণের রাস্তায় নয়, অন্য পথে, অন্য বিচারে; তা বলে সেই বিশ্বাসবস্তু যে সব সময় অযৌক্তিক বা অবাস্তব হবে এমন কথা নেই। বিশ্বাসের প্রবক্তারাও তাই সুযোগ পেলে যুক্তি-প্রমাণের শরণ নেন: থোমাসের এই কাহিনিতে সেটাই আমরা দেখছি। যিশু থোমাসকে বলতে পারতেন, ‘আমার কথা বিশ্বাস না করো তো দূর হও, এমন শিষ্য আমার চাই না।’ তার বদলে তিনি নিজের দেহ পরখ করে দেখার অবকাশ দিলেন, যাতে বিশ্বাসটা আরও দৃঢ় হয়।

গত অধ্যায়ে দেখেছিলাম, গল্পের বিচরণ বাস্তব আর কল্পনা এই দুই জগতের মিলনভূমিতে, তাদের মধ্যেকার সীমারেখা ক্রমাগত পারাপার করে। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বাসও দুই জগতের সঙ্গে যোগ রাখতে চায়: তার নিজস্ব সিদ্ধি ও স্বীকৃতির জগতে তো বটেই, কিন্তু সেই সঙ্গে যুক্তি-তথ্যের বাস্তব জগতে, হয়তো সেখানেও একটা বিশেষ স্বকীয় ও সম্মানিত স্থানে। এই সম্মানের দাবিটা ঘিরে বিশ্বাস নিয়ে কতগুলি সমস্যার সৃষ্টি হয় যা গল্প বা কল্পনা নিয়ে হয় না। তার আলোচনায় আমরা যথাসময়ে আসব। কিন্তু তার আগে আরও কিছু বিষয় দেখা দরকার।

আমরা যত জিনিস ‘বিশ্বাস’ করি, তা মোটামুটি দুই ভাগে পড়ে। একটা বাস্তবসম্মত, হোক বা না হোক হওয়া সম্ভব। বাড়িতে কিছু টাকা রেখেছিলাম, খুঁজে পাচ্ছি না। বললাম, ‘আমার বিশ্বাস, গতকাল যে লোকটা কল সারাতে এসেছিল, সে হাতিয়েছে।’ এটা মনে করার কোনও প্রমাণ বা যুক্তি নেই, হয়তো ভাবছি নিছক শ্রেণিগত সন্দেহে; তবে হতেও পারে সে নিয়েছে, অসম্ভব তো নয়। এক বন্ধুর সময় খারাপ যাচ্ছে; তাকে বললাম, ‘আমার খুব বিশ্বাস, আগামী মাস থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এমন আশা করার কোনও কারণ আমার জানা নেই, নেহাত তাকে সান্ত্বনা দিতে বললাম; তবে না হওয়ারও স্পষ্ট কারণ নেই, ফলে সত্যিই আমার কথায় বন্ধু হয়তো একটু বল পাবে।

তার বদলে আমি যদি বলি, ‘আমার বিশ্বাস, একটা ভূত উড়ে এসে টাকাটা নিয়ে গেছে’ কিংবা ‘গোমেদ ধারণ করলে তোমার সময়টা ফিরবে’, সেই বিশ্বাসগুলি অন্য শ্রেণির, বাস্তবগ্রাহ্য নয়। রত্নধারণে অবশ্য বহু লোকে বিশ্বাস করেন, কিন্তু তার প্রামাণ্য ভিত্তি দুর্বল বা অনুপস্থিত। বিশ্বাসীর দল বলেন বটে, ‘দেখো, পলা ধারণ করে আমার মেজো ভায়রাভাইয়ের ব্যবসায় কেমন উন্নতি হয়েছে।’ এমন চুটকি (anecdotal) দৃষ্টান্তে কিছু প্রমাণ হয় না। প্রমাণ করতে গেলে প্রচুর নজির জড়ো করা চাই; আর পাশাপাশি দেখা চাই পলা ধারণ সত্ত্বেও ক’টা লোকের লাভ হয়নি বা ক্ষতি হয়েছে, এবং ধারণ না করেও ক’টা লোকে দিব্যি উন্নতি করেছে।

গত অধ্যায়ে সামঞ্জস্য আর সংগতির কথা বলেছিলাম: কোনও কিছু আদৌ ঘটা সম্ভব কিনা, এবং কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে ঘটছে কিনা। এখানেও একই প্রশ্ন উঠছে, তবে উত্তরটা দেখা হচ্ছে ভিন্নভাবে। প্রথম ধরনের বিশ্বাস আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার ছকের মধ্যে পড়ে, দ্বিতীয়টা পড়ে না। দুটোই বিশ্বাস, কারণ তথ্যপ্রমাণ বিনা স্রেফ মনের তাগিদে আমরা এগুলি মানছি। যদি সত্যিই দেখা যায় কলমিস্ত্রি টাকাটা সরিয়েছে, কিংবা গোমেদ ধারণের পর বন্ধুর ভাগ্য ফিরেছে, বলব, ‘কেমন, বলেছিলাম তো!’ কিন্তু না হলে আমাদের বিশ্বাস টলবে না। বাস্তব সমর্থন পেলে ভাল, নইলে কিছু আসে যায় না। দুই শ্রেণির বিশ্বাসের মধ্যে তাও একটা বড় তফাত আছে। প্রথম ক্ষেত্রে অন্য কেউ চোর সাব্যস্ত হলে কলমিস্ত্রিকে নিয়ে সন্দেহ ঘুচবে: এই শ্রেণির বিশ্বাস সরাসরি তথ্যবিরোধী হতে পারে না। কিন্ত রত্নধারণ করে বন্ধুর হাল আরও খারাপ হলে খটকা লাগবে, ভাবব গোমেদটা খাঁটি ছিল না, তবে রত্নধারণে বিশ্বাস সম্ভবত ঘুচবে না। এই শ্রেণির বিশ্বাস বাস্তবনির্ভর নয়, ফলে বাস্তবের দ্বারা খণ্ডিত হলেও বিশ্বাসে চিড় ধরে না।

এই সঙ্গে আরও ক’টা কথা বলতে হয়। দ্বিতীয় ধরনের বিশ্বাসেও যুক্তি এমনকী অঙ্কের ভূমিকা থাকতে পারে। ঠিকুজি-কুষ্ঠি বানাতে অঙ্ক লাগে, কিন্তু তার যুক্তিগত ভিত্তি (rationale) সম্বন্ধে একটা মৌলিক প্রশ্ন তোলা যায়: গ্রহনক্ষত্রের অঙ্ক না হয় নির্ভুল, কিন্তু তাদের আধিভৌতিক গতিবিধির সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যার যোগ কি অঙ্ক কষে প্রমাণ করা যায়? নাকি আছে দুটো ভিন্ন অনুক্রমের হিসাব, একটা গ্রহনক্ষত্র অন্যটা মানবজীবন নিয়ে— মাঝখানে ফাঁক, টপকে পার হতে হচ্ছে? মানবজীবনের এই দিকগুলি আদৌ হিসাবের ছকে পড়ে কিনা তাই সন্দেহ। ইঞ্জিনিয়ারের অঙ্কও মানুষের জীবনযাত্রায় প্রয়োগ হয়; কিন্তু তা নিয়ে এমন সন্দেহ নেই, কারণ তা পুরোপুরি বস্তুকেন্দ্রিক। ইঞ্জিনিয়ারের একমাত্র চিন্তা, যে বাড়িটা তিনি বানাচ্ছেন সেটা খাড়া থাকবে কি না এবং উদ্দিষ্ট ব্যবহারের উপযুক্ত হবে কি না। বাড়ির ভাবী বাসিন্দাদের সুখদুঃখ নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। যদি বাস্তুশাস্ত্র, ফেং শুই ইত্যাদি শিখে তিনি তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন, বলতে হয় তিনি স্থাপত্যবিদ্যার পাশাপাশি একটা একদম নতুন ক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন, যার বৌদ্ধিক প্রণালী (epistemology) শুধু আলাদা নয়, বিপরীত— ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের পাশাপাশি তাবিজ বা মাদুলি লিখে দেবার মতো।

কোনও ধারণা বা চর্চাক্ষেত্রকে ‘বিশ্বাস’ বলতে হয় যখন তার মৌলিক ভিত্তি যুক্তি-তথ্য বা বাস্তব বিচার নয়, তার বাইরে বা তার বাড়া একটা নিছক মানসিক স্বীকৃতি, প্রশ্নাতীতভাবে কোনও ধারণাকে আঁকড়ে ধরা। বিশ্বাসের একটা মূল লক্ষণ তার প্রশ্নাতীত চরিত্র। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে সব কিছু নিয়ে নিরন্তর প্রশ্ন করা হয়, এবং পর্যবেক্ষণ, যুক্তি বা গণিতের বিচারে জবাব মিললে তবেই গ্রহণ করা হয়। ‘বৈজ্ঞানিক’ বলা হলেও এই বৌদ্ধিক পদ্ধতি কেবল বিজ্ঞানে নয়, জ্ঞানচর্চার অন্যান্য শাখায় ও ব্যবহারিক জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে অনুসৃত হয়। বলতে কী, এই পদ্ধতির সবচেয়ে কড়া প্রয়োগ বিজ্ঞানে নয়, দর্শনশাস্ত্রে। অনেকের ভুল ধারণা যে দর্শনশাস্ত্র একটা আধ্যাত্মিক ব্যাপার, তার সঙ্গে ধর্মশাস্ত্রের নিবিড় যোগ আছে। এই দুই বিদ্যাক্ষেত্রের অবস্থান আসলে মৌলিকভাবে বিপরীত। দার্শনিক সব কিছু প্রশ্ন করেন; বিষয়ের যত গভীরেই যান না কেন, তর্ক-বিশ্লেষণ ত্যাগ করেন না। ধর্মশাস্ত্রজ্ঞও হয়তো অনেক কিছু বিশ্লেষণ করেন, সেজন্য যুক্তি-তথ্যের অবতারণা করেন; কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে বলেন, আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নয়, এবার বিশ্বাসের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি: এর পরের কথাগুলি আমরা প্রশ্ন না করে মেনে নেব— ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে বলে, বা যুগে যুগে লোকে ভেবে আসছে বলে। অনেক ধার্মিক মানুষ আর এক পা এগিয়ে বলেন, যদি এসব নিয়ে তুমি প্রশ্ন করো— না হয় আরও ভাল করে বোঝার জন্যই— তবে তুমি ধর্মবিরোধী। আমরা দেখেছি, বিশ্বাসের এক্তিয়ারের মধ্যে যুক্তি-তথ্যের যথেষ্ট আনুষঙ্গিক ভূমিকা থাকতে পারে; কিন্তু গোঁড়া ধার্মিক তা মানেন না। বাইবেল-এর সেই ঘটনায় উপস্থিত থাকলে তাঁরা থোমাসকে তাড়াতেন কি মেরেই বসতেন, তাঁকে আশকারা দেবার জন্য যিশুকেও দুষতেন।

বিশ্বাসমাত্রই গোঁড়া নয়। নানারকম বিশ্বাস, বিশেষত ধর্মবিশ্বাস, যুগ যুগ ধরে মানুষের বৌদ্ধিক জীবনের একটা মূল উপজীব্য ও অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করে এসেছে, আজও করছে। আমাদের সবচেয়ে সূক্ষ্ম, জটিল, বিচিত্র ও উপকারী চিন্তা (এমনকী একটা স্তরে যুক্তির অনুশীলন), সেই সঙ্গে শিল্প সাহিত্য ও বিবিধ মানবিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের একটা প্রধান উৎস ধর্মীয়। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে বিশ্বাস, বিশেষ করে ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশাসন, একক ও সংকীর্ণভাবে বিভিন্ন সমাজের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যুগ যুগ ধরে। যদৃচ্ছ কোনও বাক্য বা বাহ্যরীতি বেঁচে থাকার শর্ত করে তোলা হয়েছে, হয়তো আক্ষরিক অর্থে বাঁচা-মরার শর্ত। ফলে অসংখ্য যথার্থ ধার্মিক মানুষ ধর্মের ধ্বজাধারীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন বা নিগৃহীত হয়েছেন।

জ্ঞানতত্ত্ব ও সংকেততত্ত্বের আলোচনায় অন্যান্য প্রসঙ্গে আমরা যা বলেছি, ধর্ম সম্বন্ধেও অতএব তাই বলতে হয়। এক-একটা ধর্ম একটা বিশাল বৌদ্ধিক ক্ষেত্র, তার প্রকাশ সমান বিশাল সংকেতপ্রণালীর মধ্য দিয়ে। সেই সংকেতের মধ্যে প্রচলিত ভাষা অবশ্যই একটা মস্ত উপাদান, তবে এ ক্ষেত্রে (অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো) ভাষা বলতে একেবারে প্রাথমিক স্তরে শব্দ বা বাক্যের চেয়ে বেশি করে বোঝাচ্ছে সেই শব্দ ও বাক্য দিয়ে নির্মিত রচনা, পাঠ বা ব্যাখ্যান। সেই সঙ্গে ওই ধর্ম থেকে উৎসারিত বা তার দ্বারা অনুপ্রাণিত সমস্ত ক্রিয়াকর্ম আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, শিল্প সংগীত স্থাপত্য ইত্যাদি যত রকম সম্ভাব্য প্রকাশ, সবই সেই ধর্মের অন্তর্বস্তুর সংকেত। এই নিবিড় জটিল সংকেতরাশির মধ্য দিয়ে— যাকে আমি আগে বলেছি ‘অতিভাষা’— একটা ধর্মের ভরপুর বৌদ্ধিক প্রকাশ। কিন্তু ধর্ম বলেই, একটা মোক্ষম পর্যায়ে পৌঁছে সেই প্রকাশ তার অবস্থান বদলায় বৌদ্ধিক স্তর থেকে বিশ্বাসের স্তরে। অনেক ধর্মে একটা বাঁধা বিশ্বাসবাক্য (creed) নির্দিষ্ট থাকে, তার পিছনে থাকে কিছু আবশ্যিক ধর্মমত বা বিশ্বাসবস্তু (dogma): সেই ধর্মাবলম্বী হতে গেলে সেগুলি বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করতে হয়। হিন্দুধর্মের মতো যে বহুমুখী ধর্মে কোনও বিশ্বাসবাক্য বা বিশ্বাসবস্তু নির্ধারিত নেই, সেখানেও সামাজিক বা সাম্প্রদায়িক তাগিদে তার উদ্ভাবন হতে পারে: বলা বাহুল্য, হিন্দুধর্মের বিশাল বিচিত্র মননের সামান্য অংশ তাতে ধরা পড়বে।

বিশ্বাসবাক্য আকারে ছোট, কিন্তু তার অন্তর্বস্তু সরল নাও হতে পারে, বরং হতে পারে গভীরভাবে সাংকেতিক: তাতে নিহিত থাকতে পারে (বলা চলে, থাকতেই হবে) সেই ধর্মের জটিল তত্ত্বরাশি। কিন্তু চুম্বক শ্রেণির অন্যান্য উচ্চারণের মতো, এখানেও উগ্রপন্থীরা তার নিহিত সংকেতবদ্ধ অর্থ অগ্রাহ্য করে বিশ্বাসবাক্যকে দেখে সোজাসুজি ধর্মীয় আনুগত্যের নির্ঘোষ হিসাবে। তখন তার বার্তা হয়ে দাঁড়ায়, যত-না ‘আমি এই তত্ত্বে বিশ্বাস করি’ তার চেয়ে বেশি ‘আমি এই ধর্মসম্প্রদায়ের লোক, ভুলো না কিন্তু’। শব্দগুলো এক থাকলেও বাচনক্রিয়া বেমালুম পালটে যায়, সূক্ষ্ম বৌদ্ধিক বার্তা হয়ে দাঁড়ায় মোটা দাগের পরিচয়চিহ্ন বা পাসওয়ার্ড, তারপর আরও এক ধাপ এগিয়ে নিছক আস্ফালন। ‘এটা মানা আবশ্যক’, ধর্মতত্ত্বের এই বিধান ভোল পালটে হয়ে যায় জনতার জবরদস্ত দাবি, ‘এটা মানতেই হবে’: আত্মিক বিকাশের অভিজ্ঞান নয়, স্লোগানধর্মী হুকুম বা হুমকি। তৃতীয় অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি।

যাই বলি না কেন, আজকের মানবসভ্যতায় যুক্তি ও তথ্যের প্রয়োগক্ষেত্র যথেষ্ট বেড়েছে। তার একটা কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার; আর একটা (বাস্তবে যতই খামতি থাক) বিশ্বাসনিরপেক্ষভাবে ন্যায্যতা ও সংগতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও সমাজের পুনর্গঠন। এই ধারাগুলি বিক্ষিপ্তভাবে নানা সময়ে নানা দেশে দেখা দিয়েছে (যেমন তেরো শতকে সিসিলির রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক বা ষোলো শতকে সম্রাট আকবরের রাজত্বে), কখনও আরও দীর্ঘস্থায়ী ও ফলপ্রসূভাবে (যেমন প্রাচীন আথেন্সে); কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে এর সূত্রপাত আঠারো শতকে ইউরোপের Enlightenment (বাংলায় বলা যাক ‘জ্ঞানোন্মেষ’), বা বড়জোর সতেরো শতকে তার প্রস্ততিপর্ব থেকে। এই ধারার কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য হল: ধর্মবিশ্বাস থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পৃথক করা; রাষ্ট্রশাসনকে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা; এবং স্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায্যতা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি নীতির মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্ব ও মানবাধিকারের একটা আদর্শ স্থাপন করা। এই সব বিশদ নীতি ও আদর্শের চেয়েও ক্রান্তিকারী অবদান এগুলির সঞ্চালক এক বৈপ্লবিক নতুন জ্ঞানপ্রণালী (epistemology), যার প্রধান সূত্র হল বিশ্বাসের জায়গায় যুক্তি, তথ্যপ্রমাণ ও বাস্তবনিষ্ঠার উপর একান্ত নির্ভর, তাকেই মূল বৌদ্ধিক ও সামাজিক নীতি হিসাবে গ্রহণ করা। যাকে বৈজ্ঞানিক মনোভাব বলছি (মনে করিয়ে দিচ্ছি, তা কেবল আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চা নয়, জ্ঞান ও জীবনধারণের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য), এখানেই তার কার্যকর সূত্রপাত। এই ধারাকে এখন থেকে সংক্ষেপে ‘যুক্তিপন্থা’ বলব।

গত কয় শতকে বিশ্ব জুড়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার আধিপত্যের ফলে ইউরোপীয় জ্ঞানোন্মেষের প্রভাব সব দেশে সব সভ্যতার উপর পড়েছে, যদিও পাশ্চাত্যের নিজের ইতিহাস ও আচরণে এই নীতিনিষ্ঠ আলোকপ্রাপ্ত আদর্শ প্রায়ই দেখা যায়নি। বিশ শতকে পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সদ্য মুক্ত দেশগুলির অধিকাংশ তাদের নতুন কর্মসূচি ও ভাবাদর্শ এই ভিত্তিতে স্থাপন করেছে— অন্তত গোড়ায়, অন্তত আপাতভাবে। শত ত্রুটি ও স্খলন সত্ত্বেও বলা চলে, বিশ্বের সব উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশের মধ্যে এই আদর্শের সবচেয়ে সফল ও দীর্ঘস্থায়ী প্রকাশ স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের ইতিহাসে।

নিজেদের স্বার্থে ও গৌরবার্থে ভারতের নাগরিককুল এই আদর্শ রক্ষার তাগিদ বোধ করবেন, এমনটা ভাবা স্বাভাবিক। কিন্তু ভুললে চলবে না, এই চিন্তাধারার একটানা বিবর্তন সারা বিশ্বে মাত্র তিন-চারশো বছর ধরে, ভারতে আরও কম। ইতিহাসের মাটিতে তার শিকড় কতদূর পোক্ত তা প্রশ্নের বিষয়। বিশেষ করে ভারতের মতো প্রাচীন ও বহুবিধ সভ্যতায় বিভিন্ন বিশ্বাসপুষ্ট ধারা এখনও অত্যন্ত প্রবল, হয়তো দিনে দিনে বেশি করে: আমাদের জনজীবনে তার প্রতিফলন যথেষ্ট স্পষ্ট। এই পরিস্থিতির আদত ভিত্তিটা বোঝা জরুরি। এ কেবল বিভিন্ন শ্রেণি বা গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত নয়, নিছক রাজনৈতিক দলের মধ্যে তো নয়ই। এর পিছনে আছে চেতনার গূঢ় স্তরে জগৎটা দেখার ও বোঝার আমূলভাবে বিপরীত দুই পদ্ধতি, দুটো সম্পূর্ণ পৃথক জ্ঞানপ্রণালী ও মানসিক পরিমণ্ডল।

মননের ইতিহাসে যে ধারাকে যুক্তিপন্থী বলছি, তার দার্শনিক ভিত্তি সর্বজনীন মানবিকতা। তার উদ্দীপক প্রভাব পড়েছে দেশ ও সমাজের গণ্ডি ছাপিয়ে মানুষের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান ও নীতিবোধের উপর। মনে যাই ভাবি, কাজে যাই করি, আমাদের বেশিরভাগ আচরণে ও কাজকর্মে আজ আমরা ন্যায়, যুক্তি ও তথ্য-প্রমাণের অন্তত ঠাট বজায় রাখার দরকার বোধ করি। বলা যেতে পারে, এটা আজ পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজ ও মানুষের অভিপ্রেত বা নিদেনপক্ষে ঘোষিত চিন্তাপ্রণালী— অবশ্যই সর্বত্র নয়, প্রায়ই বাস্তবায়িত নয়, কিন্তু এতটাও আগে কখনও ছিল না। জীবনের তিনটি ক্ষেত্র কিন্তু এখনও এই সাধারণ প্রবণতার উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম: অন্তরঙ্গ ব্যক্তিগত জীবন, শিল্প-সংগীত-সাহিত্য, এবং ধর্ম।

ব্যক্তিগত জীবনে যুক্তিবিহীন আচরণ অবাধ হতে পারে না। একান্ত নিজস্ব রুচিতে অনেকটা স্বাধীনতা থাকে: অমুক খাবার বা অমুক রঙের জামা পছন্দের জন্য ব্যাখ্যা দিতে হয় না, দেওয়া সম্ভব নয়— ভাল লাগে, ব্যাস, কেন লাগে আমিও জানি না। তবু ‘পররুচি পরনা’র কথা ওঠে, ‘আপরুচি খানা’ও ভারতে দুষ্কর হয়ে উঠছে: অন্যের ইচ্ছা বা সমাজের বিধান অনুসারে খেতে-পরতে হয়। সেই ইচ্ছা তো বটেই, সেই বিধানও প্রায়ই যুক্তিভিত্তিক নয়, সংস্কার বা বিশ্বাসের (প্রায়ই ধর্মবিশ্বাসের) দ্বারা চালিত। অন্যান্য সামাজিক বিধান অবশ্যই যুক্তি-তথ্য ন্যায়নীতি অনুসারে, যেমন জনস্বাস্থ্য বা যান চলাচলের বিধিনিয়ম। একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কেও বাস্তবে যাই হোক, অন্তত নীতির স্তরে যুক্তি, সমতা ও ন্যায্যতার দাবি ক্রমে বাড়ছে, রূপায়িতও হচ্ছে কিছু মাত্রায়: স্ত্রীপুরুষের সম্পর্কে, পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কে, বৃহত্তর পারিবারিক বন্ধনে। কিন্তু সম্পর্কস্থাপনের সবচেয়ে গভীর স্তরে অন্য দাবি এসে পড়ে: বন্ধুনির্বাচন বা প্রেম যুক্তি মেনে হয় না। অনেক সমাজ এমন আবেগভিত্তিক সম্পর্ক মেনে নিতে চায় না, জোর খাটিয়ে জাগতিক বিধান জারি করে। সেই বিধানও হতে পারে সমান যুক্তিহীন ও অনেক বেশি হানিকর, যেমন ভিন্ন ধর্ম বা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব (ও অবশ্যই প্রেম) নিষেধ করা, হয়তো হিংসা ও আক্রোশের সঙ্গে।

এক কথায়, ব্যক্তিগত পরিসরে যুক্তিমুক্ত আচরণের অবকাশ কিছুমাত্রায় হলেও সামগ্রিক নয়। যুক্তিপন্থার সঙ্গে তার মানিয়ে চলতে হয়; তার চেয়ে বড় কথা, আপস করতে হয় যুক্তিমুক্ত আরও শক্তিশালী এক ধারার সঙ্গে, অর্থাৎ সামাজিক সংস্কার ও ধর্মবিশ্বাস। ব্যক্তিস্তরে যুক্তিমুক্ত আচরণকে বিশ্বাসের তকমা দেওয়া হয় না। আমি ইলিশ মাছ খেতে ভালবাসি বা বেড়াল দেখলে আঁতকে উঠি, সেটা কোনও বিশ্বাসের বশে নয়: ওগুলি আমার তুচ্ছ ব্যক্তিগত প্রবৃত্তি। অন্য কেউ পাবদা মাছ পছন্দ করলে বা বেড়াল দেখলেই আদর করলে আমি তাদের সঙ্গে তর্ক জুড়ব না। এমনকী প্রেমে পড়লেও সেটা একান্তভাবে দুই ব্যক্তির দৈবাৎ পারস্পরিক আকর্ষণ বলে মনে করব, তার বাইরে আর কিছুর সঙ্গে যুক্ত করব না, ভাবব না সেজন্য আমার কোনও বৃহৎ তত্ত্বে বিশ্বাস করতে হবে।

তবে এও ঠিক, নেহাত অকারণে প্রেমে পড়েছি বা বন্ধুত্ব পেতেছি ভাবতে ভাল লাগে না; বন্ধু বা প্রেমাস্পদের কত গুণ, তাকে ভালবাসা কত যুক্তিসিদ্ধ এমনকী অনিবার্য, তা আমরা ফলাও করে বোঝাই— অপরের কাছে, তার আগে নিজের কাছে। শিল্প সম্বন্ধে কথাটা আরও বেশি খাটে। একটা গান, ছবি বা কবিতা মনকে নাড়া দেয়, ভাল লাগে বলেই লাগে। তারপর কিন্তু আমরা ভাবতে বসি কেন লেগেছে, কী তার শিল্পশৈলী, কী বিষয়মাহাত্ম্য; তা নিয়ে অন্যের সঙ্গে আলোচনা করি, তর্ক জুড়ে দিই। যুক্তিপ্রমাণের ছকে ফেলার তাগিদ নেই বলেই আমরা শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হই; কিন্তু আকর্ষণটা সার্থক করতে শরণ নিই সেই যুক্তিপ্রমাণের, নিছক উপভোগ ছাপিয়ে একটা পরিপূর্ণ বৌদ্ধিক অভিজ্ঞতা খুঁজি।

সে তুলনায় ধর্মের ভূমিতে যুক্তিমুক্ত বিশ্বাসের প্রায় অবাধ অধিষ্ঠান। আজকের পৃথিবীতে এই একটাই ব্যাপক মানসিক ক্ষেত্র যার মৌলিক সত্তা তো বটেই, শাখা-প্রশাখা খুঁটিনাটি মায় আচার-সংস্কার সমাজবিধি— সবই যুক্তির বাহ্যিক বিচার থেকে প্রায় সর্বাংশে মুক্ত। আগেই দেখেছি, ধর্মচিন্তার অঙ্গ হিসাবে যুক্তি-তথ্যের অবতারণা যথেষ্ট ঘটতে পারে, কিন্তু সেটা আবশ্যিক নয়, মৌলিক তো নয়ই। বরং আমাদের ধর্মীয় তত্ত্ব বা প্রথা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে বলি, ‘ওটা আমাদের ধর্মবিশ্বাস’— অর্থাৎ যুক্তি-ব্যাখ্যার প্রশ্ন ওঠে না, আমি ভাবি বা করি বলেই তোমাকে মেনে নিতে হবে। ধর্ম ব্যতীত অন্য কোনও ক্ষেত্রে এমন সহিষ্ণুতার দাবি নীতিগতভাবে স্বীকৃত হয় না, বাস্তবে যাই হোক।

এই কারণে আইনের অপেক্ষাকৃত লঘু কিছু বিধিনিষেধ থেকে ধর্মীয় প্রথাকে ছাড় দেওয়া হয়, যেমন পোশাকবিধি এমনকী অস্ত্রধারণের ক্ষেত্রে। আধুনিক পৃথিবীতে অধিকাংশ সমাজে গুরুতর ক্ষেত্রে ছাড় নেই: নরবলি বা সতীদাহ আইনের চোখে নৃশংস অপরাধ। (এই প্রথাগুলি আদৌ ধর্মীয় কি না সে আলাদা প্রশ্ন।) তবু নরবলি, বিশেষত শুভকার্যে শিশুবলির ঘটনা আজও শোনা যায়, সতীদাহও ঘটেছে আমাদের জীবৎকালে। অর্থাৎ আইন বা সরকার যাই বলুক, সমাজের একাংশের চেতনায় শুধু অযৌক্তিক নয়, অমানবিক এই প্রথাগুলি মান্যতা পেয়ে চলেছে। আর প্রবল, ব্যাপক ও ক্রমবর্ধমান মান্যতা পাচ্ছে জাতিভেদ, বর্ণভেদ, লিঙ্গবিদ্বেষ ও ধর্মবিদ্বেষ ঘটিত অসংখ্য অপরাধ। সেখানে ব্যাপারটা আরও বিভ্রান্তিকর ও অভিসন্ধিমূলক: আইনের বিধান আওড়ানো হচ্ছে, কিন্তু সেই কণ্ঠ ছাপিয়ে হাজার গুণ প্রচার হচ্ছে অন্ধ বিদ্বেষবার্তা, প্রায়ই স্লোগানের আদলে। আইনের ভাষা বিশদভাবে অর্থবহ, সাংকেতিক; তার কোনও তাৎক্ষণিক আকর্ষণ নেই, বুঝতে কষ্ট করতে হয়, সহজে মনে দাগ কাটে না। স্লোগানের ভাষা সহজবোধ্য, রক্ত গরম করা; তার সংক্ষিপ্ত বার্তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না— তার ক্রিয়া সাংকেতিক নয়, সরাসরি বাস্তব অভিঘাতে, বন্দুকের ঘোড়া টেপার মতো।

তৃতীয় অধ্যায়ে স্লোগান বা চুম্বকবার্তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। চুম্বকধর্মী উচ্চারণের ভিত্তি প্রায়ই কোনও অর্থবহ ব্যাখ্যান (discourse), হয়তো ধর্মীয় তত্ত্ব বা রাজনৈতিক ভাবাদর্শ। সেই আদি ব্যাখ্যান হতে পারে মহান, মূল্যবান, ইতিহাসসিদ্ধ। স্লোগানওয়ালাদের অত পোষায় না, তারা সেটা থেকে ছেঁকে নেয় একটা চটজলদি সংক্ষিপ্তসার। চতুর্থ অধ্যায়ে দেখেছিলাম, জাতীয় জীবন ও ইতিহাসের পরিপূর্ণ বৈচিত্র্যময় ব্যাখ্যান থেকে অংশবিশেষ তুলে সংকীর্ণ রাজনৈতিক প্রয়োজনে কেমন আধাখেঁচড়া লোকরঞ্জক ব্যাখ্যান তৈরি করা যায়। ধর্মের ক্ষেত্রেও এক জিনিস ঘটতে পারে: নানা মাধ্যমে নানা প্রকাশে একটা পরিপূর্ণ বহুমুখী উদার ব্যাখ্যান ভেঙে বেছে বিকৃত করে তা থেকে সংকীর্ণ উদ্দেশ্যে একটা তরল বিশ্বাসবার্তা বার করা যায়; তারপর বাস্তবে, বলতে গেলে বাজারি প্রয়োগের জন্য তারও রসটুকু নিংড়ে স্লোগান বাঁধা যায়। মূল ব্যাখ্যান ততক্ষণে বলতে গেলে অবান্তর, কিন্তু স্লোগানবিলাসীরা সেই নামের আড়ালে আত্মরক্ষা করতে পারে।

রাজনৈতিক ও ধর্মীয়, দু’ রকম নির্মাণ সমান্তরাল এমনকী যুক্ত হতে পারে। যোগ করা কঠিন নয়, বরং সংগত, কারণ প্রায় সব দেশের ইতিহাসে ও জনজীবনে ধর্মের একটা বড় ভূমিকা থাকে। কিন্তু সেই যৌথ ব্যাখ্যানে ধর্মের উপস্থিতির ফলে একটা বিশেষ মাত্রা যোগ হয়, সেটা হল বিশ্বাসের মাত্রা। ইতিহাস বা সামাজিক জীবনে কোনও তথ্য বা ব্যাখ্যার ভুলভ্রান্তি সংশোধনের চেষ্টা করা যায়, তা নিয়ে তর্ক করা যায়, অন্তত মানুষকে সাবধান করা যায়। কিন্তু ধর্মের সংযোগে বিশ্বাসের মাত্রা যোগ হলে তা সংশোধন বা সমালোচনার নাগালের বাইরে চলে যায়। সেই অভেদ্য বর্মের আড়ালে তাই আশ্রয় নিতে পারে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন এমনকী ধর্মবিরোধী কার্যকলাপ।

উলটো কৌশলও দেখা যায়: যুক্তিপন্থার বিচার থেকে বিশ্বাসকে মুক্তি দেওয়া হয়, কিন্তু বিশ্বাস নিজের স্বার্থে বা আত্মরক্ষায় যুক্তির বিচারের, তথা দেশের আইন বা গণতান্ত্রিক নীতির শরণ নিতে পারে। একটু আগে দেখেছি, ধর্মবিশ্বাসের কারণে কিছু কিছু গৌণ বিষয়ে আইনের ছাড় দেওয়া হয়। বিশ্বাসের প্রবক্তাদের স্বাভাবিক ঝোঁক থাকে একই যুক্তিতে আরও গুরুতর ছাড় আদায় করার, সমাজে আরও নিরঙ্কুশভাবে তাদের কর্মসূচি প্রসারিত করার, যদিও সেই কর্মসূচি যুক্তিভিত্তিক নয়।

একদিকে যুক্তিপন্থা, অন্যদিকে বিশ্বাস— দুইয়ের আদানপ্রদানে তাই পাল্লাটা বিশ্বাসের দিকে ভারী হবার সম্ভাবনা। দুই বিপরীত চেতনা ও জ্ঞানপ্রণালী এখানে পরস্পরের সম্মুখীন। যুক্তিপন্থার প্রবণতা হল সব কিছুকে নিরপেক্ষ বিচারে যথাযোগ্য স্থান দেওয়া। বিশ্বাসের প্রবক্তারা তাতে লাভবান হন; কিন্তু যেহেতু বিশ্বাসের তরফে এমন কোনও বাধ্যতা নেই, সেই স্থান অধিকার করার পর তাঁরা নিজস্ব ধারায় চলতে পারেন, বৃহত্তর ন্যায্যতা বা যুক্তিকে অস্বীকার করে।

এমন ঘটার বিশেষ সম্ভাবনা, যখন অকাট্য যুক্তিতে বিশ্বাসের অস্তিত্বটাই তথ্য হিসাবে স্বীকৃতি পায়। ভারতে সম্প্রতি এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। বিবেচ্য বিষয় একটা তথ্য নির্ধারণ, রামচন্দ্রের জন্মস্থল। জায়গাটা ঠিক কোথায়, ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ঠিক করতে পারেননি; কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করেন সেটা একটা বিশেষ স্থানে। তাঁরা যে এমন বিশ্বাস করেন তাতে সন্দেহ নেই: সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক স্তরে সেটা অবশ্যই তথ্য, যে জিনিসটা তাঁরা বিশ্বাস করেন তা ঐতিহাসিক তথ্য হোক আর না হোক। সুতরাং যুক্তির বিচারে সেই বিশ্বাসের অস্তিত্বকে তথ্য হিসাবে মান্যতা দিতে হয়; আর সে মান্যতা কার্যকর করতে বিশ্বাসবস্তুটাকেও গ্রহণ করতে হয়, যদিও তথ্য হিসাবে তা অপ্রমাণিত। এখানে মূল বা প্রাথমিক তথ্য (substantive fact) হল (বা প্রমাণ হলে হত) জন্মস্থলের অবস্থান; অনুবর্তী বা আনুষঙ্গিক তথ্য (contingent fact), সে বিষয়ে লোকের বিশ্বাস। সচরাচর মূল বিষয়ের জেরে বা প্রভাবে অনুবর্তী বিষয় মান্যতা পায়, এখানে উলটোটা ঘটছে। বিষয়টা গুরুতর, মীমাংসা হওয়া সমাজের স্বার্থে জরুরি; মূল তথ্য উপলব্ধ না হলে আনুষঙ্গিক তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবার তাগিদটা তাই জরুরি হয়ে ওঠে।

অতএব সিদ্ধান্ত নেওয়া হল সংখ্যার ভিত্তিতে: অনেক মানুষ একটা কথা বিশ্বাস করেন বলে সেটাকে মান্যতা দেওয়া হল, গণতান্ত্রিক ন্যায়নীতি অনুসরণ করে। অবস্থাবিশেষে গণতান্ত্রিক নীতির বিপরীত প্রয়োগও ঘটে, সেই সংখ্যার বিচারেই: ভাবা হয়, সংখ্যলঘুদের স্বার্থ বিশেষভাবে রক্ষা করা উচিত। রামজন্মভূমি বিতর্কে বিশ্বাসবস্তু ছিল একটা তথ্যের প্রশ্ন, অর্থাৎ জন্মস্থলের অবস্থান। সত্যিকারের সমস্যা হতে পারে যেখানে বিশ্বাসবস্তু কোনও সামাজিক বা মানবিক প্রসঙ্গ (যেমন জাতপাত); বা আর্থিক লাভের সুযোগ (যথা, কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের মানুষ কী কাজ করবে); কিংবা প্রথা বা অভ্যাস (যথা, অমুক খাদ্য চলবে না, অমুক মন্দিরে নারীর প্রবেশ নিষেধ)।

এমন ক্ষেত্রে সমাজে গুরুতর টানাপোড়েন চলে, যুক্তিপন্থার সঙ্গে বিশ্বাস ও সংস্কারের। এমনকী রাষ্ট্রীয় ও আইনি স্তরে, যেখানে দুইয়ের মধ্যে সংঘাত হওয়ার কথা নয়, যেখানে সাংবিধানিক নির্দেশ স্পষ্টই যুক্তিপন্থার দিকে, সেখানেও বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শেষ সিদ্ধান্ত ক্ষেত্রবিশেষে কখনও একদিকে, কখনও অন্যদিকে ঝোঁকে, প্রায়ই হয়— হতেই হয়— দুটো ধারার সংমিশ্রণ; এবং ধারা দুটো যেহেতু পরস্পরের বিপরীত, অবধারিতভাবে নানা জটিলতা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়— নতুন সমস্যা দেখা দেয়, বা পুরনো সমস্যাটাই মলাট পালটিয়ে। যা লক্ষণীয় তা হল, আপাত যুক্তিপন্থী সাংবিধানিক ব্যবস্থার মধ্যে যুক্তিমুক্ত বিশ্বাস ও সংস্কার আদৌ ঠাঁই পাচ্ছে; এবং বৃহত্তর সমাজে তাদের এত গুরুত্ব যে যুক্তির বিচারেই বাস্তব তথ্য হিসাবে তাদের গ্রাহ্য করতে হচ্ছে, মর্যাদা দিতে হচ্ছে।

পুরো চিত্রটা তা হলে এইরকম দাঁড়াচ্ছে। আমাদের মননের ভূমি জুড়ে আছে অনেকগুলি সমৃদ্ধ ব্যাখ্যান— ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি। প্রত্যেকটির বৌদ্ধিক প্রকাশ ভাষা সহ নানা বিচিত্র সংকেতের বিস্তারে; এই সমবেত মাধ্যমকে আমি বলছি ‘অতিভাষা’। এর মধ্যে কয়েকটি (সচরাচর ধর্মীয়) ব্যাখ্যান বলছে, বৌদ্ধিক সম্পদ যতই থাক, তার ভিত্তিতে তারা প্রতিষ্ঠা দাবি করবে না, করবে বিশ্বাসের ভিত্তিতে। সেই বিশ্বাসবস্তুর নিজস্ব সারবত্তা থাকতে পারে, কিন্তু তা ভেঙে খুঁটিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রশ্ন নেই; তার বদলে আছে একটাই অভিন্ন অবিশ্লেষ্য সত্তা, একশিলা মূর্তির মতো, যা প্রশ্নাতীতভাবে মান্যতা দাবি করছে। তার ছত্রছায়ায় যে বিচিত্র মননের জগৎ— তর্ক তত্ত্ব দর্শন, শিল্প সাহিত্য সংগীত, আচার অনুষ্ঠান সামাজিকতা, সংকেতের ঐশ্বর্য, বার্তার প্রাচুর্য— তা যদি বজায় থাকেও (বিশ্বাসটা গোঁড়া বা মৌলবাদী পর্যায়ে পৌঁছলে থাকে না), তার গুরুত্ব অতএব কমে যায়, সব কিছু হয়ে পড়ে মূল বিশ্বাসবস্তুর অনুষঙ্গ মাত্র।

এর পাশাপাশি আছে অন্যান্য ব্যাখ্যান যা বিশ্বাসনির্ভর নয়: তাদের মৌলিক অবস্থান যুক্তিপন্থী ও বিশ্লেষক। তাদেরও সাংকেতিক ভাণ্ডার ‘অতিভাষার’ পর্যায়ে, তাতে আছে তর্ক তত্ত্ব দর্শন, শিল্প সাহিত্য সংগীত, আচার অনুষ্ঠান সামাজিকতা, হয়তো অনেক উপাদানের একটি হিসাবে ধর্মবিশ্বাস পর্যন্ত— কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই সাংকেতিক তন্ত্রের মান্যতা পুরোপুরি বৌদ্ধিক পর্যায়ে, তার বাইরে কোনও বিশ্বাসবস্তুতে নয়।

এ পর্যন্ত বলা চলে, এই উন্মুক্ত মননের জগৎ আর বিশ্বাসের জগৎ বৌদ্ধিক দিক দিয়ে পৃথক এমনকী বিপরীত, কিন্তু তুলনীয়। তাদের পরের ইতিহাস কিন্তু ভিন্ন পথে যাবার জন্য যেন মুখিয়ে আছে। এই বিভাজনটা কীরকম হতে পারে, উপরের আলোচনায় তার ইঙ্গিত আছে। তবে শুরু থেকে এ পর্যন্ত সবগুলি অধ্যায় মিলে যে বক্তব্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি, তার খেই ধরে আর একবার দেখা যেতে পারে।

যে কোনও মানসিক ক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল সংকেতপ্রণালী: যা কিছু আমরা দেখছি বুঝছি ভাবছি, সংকেতের মাধ্যমে তা আমাদের চেতনায় ফুটে উঠছে, বাঁধা পড়ছে। এভাবে আমাদের অস্তিত্বের এক একটা প্রধান ক্ষেত্র বা ব্যাখ্যান (discourse) ব্যক্ত ও সঞ্চিত হচ্ছে এক-একটা সাংকেতিক মণ্ডলে, যার সবচেয়ে মৌলিক ও ব্যাপক মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। একটা বিপরীত প্রবণতাও কিন্তু দেখা যাচ্ছে: সংকেতপ্রণালীগুলি ক্রমে আরও সহজ ও সংক্ষিপ্ত হয়ে পড়ছে, তাদের লক্ষ্য হয়ে উঠছে কেবল কোনও বিশেষ বাস্তব উদ্দেশ্যসাধন। এভাবে সরলীকৃত হতে হতে সেগুলি এমন অবস্থায় পৌঁছচ্ছে যেখানে কার্যত তাদের কোনও সাংকেতিক মূল্য থাকছে না, একটা সংকীর্ণ দ্বিমাত্রিক বার্তা হয়ে দাঁড়াচ্ছে: তারা আর নিজেদের বাইরে কিছু ইঙ্গিত করছে না। অর্থবহ ভাষার ক্ষেত্রে এমন হচ্ছে, যেমন হচ্ছে মূ্ল্যবহ টাকার ক্ষেত্রে। টাকা হয়ে উঠছে অন্য পণ্য নিয়ে নয়, নিজেকে নিয়েই লেনদেনের সামগ্রী। ভাষা হয়ে উঠছে বাহ্য বা বৃহত্তর কিছুর নির্দেশক নয়, সীমিত আবদ্ধ একটা উচ্চারণ।

বলা যেতে পারে, সংকেতের দ্বারা আগের মতো ‘আসল’ কিছু নির্দিষ্ট হচ্ছে না, বরং সংকেতটাই নতুন ‘আসল’ বস্তুসুলভ পরিচয় আয়ত্ত করছে: সংকেতটা নিয়েই আমরা কারবার করছি, তার দ্বারা নির্দিষ্ট অন্য কিছুকে নিয়ে নয়। বলা বাহুল্য, সে ক্ষেত্রে তা আর সংকেত থাকছে না। সাংকেতিক প্রক্রিয়া কখনও পুরোপুরি লোপ পেতে পারে না। হাজার হলেও ভাষায় শব্দগুলির একটা মানে থাকবে, সেগুলি বাক্যে গঠিত হলে একটা উপলব্ধিকে চিহ্নিত করবে। টাকার একটা অর্থমূল্য নির্দিষ্ট থাকবে, লেনদেনে তা যতই অবান্তর হোক। কিন্তু ভাষা হোক টাকা হোক, তার নির্দেশবহ ভূমিকা বহু ক্ষেত্রে প্রকটভাবে কমে আসছে, কখনও প্রায় তলানিতে ঠেকছে।

আরও মনে হতে পারে, বর্তমান বিশ্বে আগের তুলনায় এমনটা শুধু বেশি ঘটছে না, একেবারে নতুন ধাঁচে আরও গভীর ও বিচিত্রভাবে ঘটছে; মানুষের জীবনে সংকেতের ব্যবহার— যা কিনা মানবসভ্যতার সবচেয়ে মৌলিক ও স্বকীয় প্রচলন— আমূল রূপান্তরিত হচ্ছে। তার একটা প্রধান কারণ নানা বৈপ্লবিক প্রযুক্তির আবির্ভাব, সর্বোপরি বৈদ্যুতিন প্রযুক্তি, বিশেষ করে শ্রাব্য ও দৃশ্য উপাদান ধরে রাখা ও সম্প্রচার করার অভূতপূর্ব উপায়। তার ফলে ভাষার গুরুত্ব কমছে, ভাষা ব্যবহারের পদ্ধতিও পালটাচ্ছে। আর একটা মূল কারণ নতুন বিশ্বায়িত অর্থব্যবস্থা ও বিপণনরীতি, বস্তু-দ্রব্য-পণ্যের সঙ্গে তাদের সাংকেতিক প্রতিভূ টাকার যোগে সম্যক পরিবর্তন। পণ্যের ব্যবহার ও বিপণন একটা বৈপ্লবিক নতুন মাত্রা ধারণ করেছে, অন্য দিকে টাকার ব্যবহারও হয়েছে বৈপ্লবিক ও অভিনব। ফলে মানুষের বৃহত্তর জীবনে— শুধু জাগতিক নয়, মানসিক জীবনে— আর্থিক জগতের অভাবনীয় প্রভাব পড়েছে, যেমন পড়েছে ভোগপণ্যের ও ভোগবাদের।

এই নতুন পৃথিবীতে ধর্মের স্থান ও চরিত্র যে নতুন রকমের হবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সেই স্থান শুধু বিশাল নয়, যেন বেড়ে চলেছে। কয়েক শতক ধরে একদিকে ইউরোপীয় জ্ঞানোন্মেষের তাত্ত্বিক প্রভাব, আর এক দিকে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর প্রগতি সত্ত্বেও বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ধর্ম আজও একটা বিপুল শক্তি। বহু দেশের অভ্যন্তরীণ জীবনে ধর্মের উপস্থিতি প্রবল ও ক্রমবর্ধমান। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই নাম করতে হয় ভারতের: বিপুল জনসংখ্যার সুবাদে এই একটা দেশই সারা বিশ্বের ভারসাম্য টলিয়ে দিতে পারে, বিশেষ করে যেখানে আরও বহু দেশে একই দিকে পাল্লা ভারী হচ্ছে। তুরস্ক আর একটি উল্লেখযোগ্য দেশ, যার সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ হলেও রাষ্ট্রব্যবস্থা উত্তরোত্তর ধর্মের দিকে ঝুঁকছে। দেশে-দেশে তারতম্য থাকলেও সাধারণভাবে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ধর্মই রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রধান নির্ধারক, বা মৌলবাদী অবতারে বিধ্বংসী শক্তি। দুনিয়াভর নানা দেশে ধর্মের নিজস্ব প্রতিপত্তি ছাড়াও সাধারণ প্রশাসন ও রাজনীতিতে ধর্মীয় প্রভাব বাড়ছে, বাড়ছে শান্তিপূর্ণ ও হিংসাশ্রয়ী উভয় গোত্রের বহু ধর্মীয় গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড। সত্যি বলতে কী, মানুষের মস্তিষ্কলব্ধ অন্য কোনও শক্তি বিশ্ব জুড়ে রাষ্ট্রীয় জীবনে এত প্রভাব বিস্তার করছে না।

বলা যায়, এ আর নতুন কী? ধর্ম তো চিরকালই মানবজীবনে একটা মস্ত শক্তি, মানবশাসনেও। ইতিহাসে ধর্মকে কেন্দ্র করে কম যুদ্ধ হয়নি। শাসনব্যবস্থায় ধর্মের (ও ধর্মভেদের) আধিপত্য, এমনকী শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ধর্মপ্রচার, চিরকাল হয়ে এসেছে। একটা তফাত তবু মানতে হয়। দু’-এক শতক আগে অবধি প্রায় সব দেশের জনজীবনে ধর্ম ছিল মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, রাজ্যশাসনে তার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। আধুনিক জগতে রাজনীতি, রাজ্যশাসন ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ধর্মভিত্তিক নয়, অন্তত অধিকাংশ দেশে ঘোষিতভাবে নয়; বরং রাষ্ট্র পরিচালনার একটা মৌলিক নীতি আজ ধর্মনিরপেক্ষতা। তাতে ধর্মের বিস্তার ও পরাক্রম আদৌ কমেনি, বরং আরও সজ্ঞান ও সোচ্চার হয়েছে। তার কারণ, রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের ভূমিকা সেকালে বিনা বাক্যে ধরে নেওয়া হত, আজ উদ্যোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। রাষ্ট্রগঠন ও আন্তর্জাতিক আদানপ্রদানের একাধিক মৌলিক সূত্রের মধ্যে ধর্ম একটি মাত্র; অন্যান্য সম্ভাব্য সূত্রের সঙ্গে তার রীতিমতো লড়ে জায়গা দখল করতে হয়।

এমন অবস্থায় ধর্ম স্বভাবতই তার বিশেষ সুবিধাটুকুর সদ্ব্যবহার করতে চাইবে, অর্থাৎ বিশ্বাসের সুবাদে তার যুক্তিমুক্ত স্বাধীন বিচরণের প্রশ্নাতীত অধিকার। সমাজে ও রাজনীতিতে এই দাবির বাস্তব ফল কোনও-না-কোনও ভাবে বিশ্বের প্রায় সব মানুষই উপলব্ধি করছেন। তার নেপথ্য বৌদ্ধিক মাত্রাটা দেখা যাক।

আগের আলোচনা থেকে স্পষ্ট, বিশ্বাসভিত্তিক মননের যে কোনও ক্ষেত্র বৌদ্ধিকভাবে যতই সমৃদ্ধ হোক না কেন, সে তার বৌদ্ধিক সম্পদ শেষ অবধি সমর্পণ করে যুক্তিমুক্ত বিশ্বাসবস্তুর কাছে। যুক্তির উপাদানটা তাতে খারিজ হয়ে যায় না, কিন্তু তার গুরুত্ব কমে যায়। যুক্তিপন্থী শাসনের অভাবে বিশ্বাসের ছত্রছায়ায় বহু মিথ্যা ও অন্যায় ঢুকে পড়তে পারে— বিশ্বাসের সৎ উপাদানগুলির প্রতি সন্দেহ ও অমর্যাদা ডেকে এনে, বিশ্বাসকে করে তুলে কল্যাণের বদলে অমঙ্গলের হেতু।

বিশ্বাসকে মান্যতাদানের একটা বড় কারণ, তা অনেক লোকে অনেক দিন ধরে মেনে আসছে। অর্থাৎ দুটো শর্ত কাজ করছে: এক, ব্যাপক গ্রহণ বা সমর্থন; এবং দুই, দীর্ঘকাল ধরে প্রচলন। দুটো না হোক অন্তত একটা শর্ত পূরণ না হলে কোনও বিশ্বাস মান্যতা লাভ করে না। আমার যদি হঠাৎ ইচ্ছা হয় আমি অযৌক্তিক অসামাজিক কিছু করব, এককভাবে ‘এটা আমার বিশ্বাস’ বলে পার পাব না; সমর্থনে প্রচুর লোক জোগাড় করলে হয়তো পাব। অনেক স্বঘোষিত মহাপুরুষ এই পন্থায় নানা অপকীর্তি করেন, সমাজে স্বীকৃতিও পান। কাজ হাসিলের জন্য তাঁরা তাঁদের প্রচেষ্টাকে জুড়ে দেন ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে; তাতে সৎ ধর্মগুরুদের মায় ধর্মের নাম খারাপ হয়। আরও অনেক মর্মান্তিকভাবে, বহু বিধ্বংসী রাজনৈতিক আন্দোলন দেশ থেকে দেশে ছড়িয়ে পড়ে ধর্মের নামে। উপরে যে দুটো শর্তের কথা বললাম, ভয়ে-ভক্তিতে তার প্রথমটা, অর্থাৎ ব্যাপক জনসমর্থন, যদি নিশ্চিত হয়, তবে দ্বিতীয় শর্ত অর্থাৎ দীর্ঘ প্রচলন কোনও প্রতিষ্ঠিত ধর্মের ভাবমূর্তি থেকে ‘ধার’ করা যায়: তার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আড়ালে আশ্রয় নিতে পারে অর্বাচীন অসামাজিক কীর্তিকলাপ। যুক্তিবলে তা প্রতিরোধ করা যায় না, যেহেতু বিশ্বাসের ব্যাপারে যুক্তিপন্থা মীমাংসার চূড়ান্ত ভিত্তি নয়। এক কথায়, যে অনাচার বৌদ্ধিক বিচারে, অতএব আইন ও সাধারণ সমাজজীবনের বিচারে, গ্রহণীয় হত না, বিশ্বাসের ছত্রছায়ায় তা লালিত হতে পারে; ফলে সেই বিশ্বাসের, বা যে-কোনও বিশ্বাসের, সম্ভ্রম কমে, তার সদর্থক ভূমিকা ক্ষুণ্ণ হয়।

শেষ অবধি দেখা দেয় আরও মারাত্মক পরিণতি: যুক্তিপন্থার হাতিয়ার দিয়ে বিশ্বাসের এই অপপ্রয়োগ রোখা যায় না, কিন্তু তার প্রতিরোধে আসরে নামে কোনও বিপক্ষীয় অপবিশ্বাসের সমর্থকদল। এতদিন বিরোধটা ছিল যুক্তিপন্থী বনাম যুক্তিমুক্তের; এবার জনজীবন ও রাষ্ট্রিক সত্তা চীর্ণ হতে থাকে দুই যুক্তিমুক্ত শিবিরের সংঘাতে, যুক্তিপন্থার সমর্থকদের পুরোপুরি হটিয়ে। যুক্তিপন্থীদের বৌদ্ধিক অস্ত্র এখন অপ্রাসঙ্গিক। নিরুপায় হয়ে তাঁদের কেউ কেউ— হয়তো জ্ঞানীগুণী বুদ্ধিজীবী— একটা কিছু করার তাড়নায় কোনও-না-কোনও যুক্তিমুক্ত শিবিরে যোগ দেন: অর্থাৎ নিজেদের হাতিয়ার ছেড়ে বিপক্ষের হাতিয়ার তুলে নেন। এই স্ববিরোধের জালে জড়িয়ে তাঁরা আরও অসহায় ও অবান্তর হয়ে পড়েন, নইলে বৌদ্ধিক সম্ভ্রম জলাঞ্জলি দিয়ে দলাদলি হানাহানির আবর্তে ডুবে যান। রাষ্ট্র ও সমাজের এই পরিস্থিতি আজ ভারতে অপরিচিত নয়; নয় আরও বহু দেশে, যেখানে এমন দশা অল্প দিন আগেও ভাবা যেত না।

বিশ শতক, বিশেষত তার দ্বিতীয়ার্ধ, মানুষের ইতিহাসে একটা ব্যতিক্রমী সময় ছিল। এক দিকে বিশ্বব্যাপী হিংসা আর অনাচার তুঙ্গে উঠেছিল, প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে তার প্রসারও ঘটেছিল জ্যামিতিক হারে। একই সঙ্গে প্রথমে পাশ্চাত্যে, তারপর ঔপনিবেশিক যুগের অবসানে বিভিন্ন মাত্রায় পৃথিবীর অন্যত্র উন্নয়ন, সাম্য ও মানবকল্যাণে যে আগ্রহ দেখা গেল তাও অভূতপূর্ব। কেবল এই শুভ প্রভাবে নয়, বরং বেশি মাত্রায় ১৯৩০এর দশকের বিশ্বমন্দা, তারপর বিশ্বযুদ্ধের মতো অশুভ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বিশ শতকের মাঝামাঝি কয়েক দশক মানব-ইতিহাসে এক রোমাঞ্চকর পর্যায় ঘটল, যা বিস্তারে তুলে ধরেছেন ফরাসি অর্থবিদ তোমা পিকেত্তি। এটাই ইতিহাসের একমাত্র সময় যখন পাশ্চাত্য দুনিয়ায়, এবং স্বাধীনতার পর ভারতেও, ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান দৃশ্যত কমল: গরিব লোকে একটু কম গরিব হল, এবং— যেটা একেবারে অভূতপূর্ব— ধনীদের ধনের মাত্রা অল্প হলেও হ্রাস পেল। ১৯৮০র পর চাকা আবার উলটো অর্থাৎ চিরাচরিত দিকে ঘুরছে: অসাম্য বাড়ছে, এবং ইদানীং বিশ্বের সব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারতে।৬১

এ তো গেল আর্থনীতিক চিত্র। আগেই বলেছি, এর পিছনে বিশ শতকে ন্যায় ও যুক্তিনিষ্ঠ মানবিকতার আরও ব্যাপক একটা ধারা কাজ করেছে, যতই আংশিক ও অপ্রতুলভাবে হোক; তার প্রধান উৎস ইউরোপীয় জ্ঞানোন্মেষ থেকে উদ্ভূত কিছু ভাবনা। আজ কিন্তু সাধারণভাবে স্বীকৃত, ভাষণে-ঘোষণায় যে যাই বলুক, একুশ শতকে সাম্য ও গণতন্ত্রের ধারা বহু দেশে ক্ষীণ হচ্ছে, যুক্তি ও ন্যায়ের বদলে দমন ও স্বৈরাচারের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে, ব্যক্তিসত্তা খর্ব হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিশ্বাস— অবশ্যই রাজনৈতিক, কিন্তু বিশেষ করে (ও প্রায়ই রাজনীতির সঞ্চালক হিসাবে) ধর্মীয় বিশ্বাস— ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের জীবনে নানা দেশে নানা ভাবে নতুন করে আধিপত্য বিস্তার করছে।

যুক্তিপন্থার মূল্যবোধে দীক্ষিত হলে এই দুই ধারার একটি আমাদের কাছে বেশি (বা একমাত্র) গ্রহণীয় মনে হতে পারে। কিন্তু নির্মোহ বিচারে বলতেই হয়, ইতিহাসে যুক্তিপন্থার ব্যাখ্যানই অর্বাচীন: আগেই বলেছি, তার ধারাবাহিক অস্তিত্ব তিন-চারশো বছরের বেশি নয়, তার আগে বিভিন্ন যুগে ও দেশে বিক্ষিপ্তভাবে দেখা গেছে মাত্র। (বলা বাহুল্য, আমি চিন্তা, তত্ত্ব ও ভাবাদর্শে যুক্তিপন্থার মৌলিক অবস্থানের কথা বলছি, আটপৌরে বাস্তববোধ বা বিশেষ বিদ্যাক্ষেত্রে যুক্তির প্রয়োগ নয়।) বরং বিশ্বাসের ধারা এই তিন-চারশো বছর কিছুটা স্তিমিত থাকলেও (অন্তত একচ্ছত্রভাবে বিরাজ না করলেও) অনেক প্রাচীন ও গভীর। তার মননের প্রণালীও প্রাচীন, তাই ভুল করে আমরা ভেবেছি বিলুপ্ত। উপরন্তু তা প্রাচীনত্বে আবদ্ধ থাকেনি: যুগে যুগে বহু নতুন চিন্তা ও প্রণালী প্রয়োজনমতো আয়ত্ত করেছে— কৌশলগত কারণে তো বটেই, প্রায়ই বৌদ্ধিক কারণেও। বৈজ্ঞানিক চেতনা ও পদ্ধতি পরিহার করলেও বিজ্ঞানসৃষ্ট আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েছে, কিছু ব্যবহারিক উদ্ভাবন ঘটিয়েছে পর্যন্ত। ফলে বিশ্বাসের প্রাচীন উপকরণগুলিও নতুন বেশে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, সময়ের সঙ্গে নিপুণ সমন্বয় ঘটিয়ে।

ধর্মে হোক আর অন্য ক্ষেত্রেই হোক, বিশ্বাস ব্যাপারটাকে অনড় অপরিবর্তনীয় ভাবলে ভুল হবে। তার গোঁড়া মৌলবাদী প্রকাশ সম্বন্ধেও তা বলা চলে না: ‘মৌলবাদ’ মানে আদিতে ফিরে যাবার একটা অভিনব প্রচেষ্টা, অর্থাৎ পরিবর্তনের প্রয়াস। আর যে ব্যাপক বিশ্বাসগুলি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, তাদের দীর্ঘ অস্তিত্বের পিছনে আছে অশেষ বিবর্তন ও উদ্ভাবন: সেটাই তাদের জীবনীশক্তি। ভালমন্দ যাই ভাবি, স্বাগত জানাই বা অভিসম্পাত করি, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে সেই শক্তির ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন করা দরকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *