৪. গল্প

৪. গল্প

পাঠককে একটা সমীক্ষা করতে বলব। টিভি খুলে, অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপনগুলো দেখুন— অন্তত পঞ্চাশটা, বেশি হলে আরও ভাল। নিঃসন্দেহে দেখবেন, পঞ্চাশের মধ্যে বড়জোর দশটা (সম্ভবত আরও কম) বিজ্ঞপিত পণ্যের কোনও সুস্পষ্ট গুণের উল্লেখ করছে, যার জন্য দর্শক ভেবেচিন্তে সেটি কিনতে পারেন। (দাবির সত্যতা আলাদা প্রশ্ন, আদৌ করা হচ্ছে কি না সেটাই আপাতত বিবেচ্য।) বাকি চল্লিশটা বিজ্ঞাপনের কৌশল তবে কী?

সবচেয়ে ব্যাপক কৌশল কোনও-না-কোনও ভাবে দর্শকের আবেগ উদ্রেক করা। একটি সুখী সমৃদ্ধ পরিবারের ছবি দেখে দর্শকের মনে হবে, আহা, আমার সংসারও যদি অমন হত! উপায়টাও দেখছি সহজ, অমুক তেলে রান্না করলে বা অমুক রং দেয়ালে লাগালেই হল। এর রকমফের হচ্ছে ভয় দেখানো: এমন যে সুখী সংসার, তার রোজগেরে মানুষটির একটা কিছু ঘটলে কী হবে? এখনই অমুক সংস্থার জীবনবিমা করান। বার্তার প্রয়োগ অত ব্যক্তিগত নাও হতে পারে, হতে পারে স্রেফ মন-ভেজানো, মন-ভাল-করা কোনও দৃশ্য: একটি ফুটফুটে বাচ্চার ছবি, বা অবশ্যই কোনও রমণীয় নারীর; কিংবা প্রাণোচ্ছল এক দল বন্ধু, মনোরম পরিবেশে বেড়াচ্ছে ফুর্তি করছে।

আর একটা পন্থা হল বিখ্যাত লোকের সার্টিফিকেট পেশ। এককালে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এমন প্রচুর করেছেন, বিশ্বভারতীর জন্য টাকা জোগাড় করতে। আজকাল এই বাজার কবজা করে ফেলেছেন মূলত দুই পেশার মানুষ, খেলোয়াড় আর চিত্রতারকা। তাঁদের দক্ষিণার বহর যদি রবীন্দ্রনাথের জুটত, আজ দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী বিশ্ববিদ্যালয় হত হার্ভার্ড নয়, বিশ্বভারতী।

একাধিক কৌশল একসঙ্গে একই বিজ্ঞাপনে প্রয়োগ করা যেতে পারে, আর বসানো যেতে পারে একটা ছোট্ট কাহিনি বা নাটকের মধ্যে। সেটা দেখে যদি আমাদের মজা লাগে বা মনকে নাড়া দেয়, তা থেকেও পণ্যটা কেনার ইচ্ছা হতে পারে। আর এক রকম যুগ্ম আক্রমণে কোনও সত্যিকারের উপকার বা উৎকর্ষের সঙ্গে ধোঁয়াটে সওয়াল যোগ করা হয়। জীবনবিমা নিশ্চয় উপকারী, কিন্তু অমুক সংস্থার অমুক পলিসিটাই করাতে হবে কেন? দিঘা বা দার্জিলিং সুন্দর জায়গা, তার দৃশ্য দেখালে প্রমাণ হয় না সেখানকার তমুক হোটেলের ব্যবস্থাপনা ভাল।

বহু বিজ্ঞাপনেই অবান্তরের ছড়াছড়ি। কেউ ভাল ক্রিকেট খেলতে বা অভিনয় করতে পারেন, তা বলে সিমেন্ট বা ইস্পাত সম্বন্ধে তাঁর মতের দাম বাড়ে না। অবান্তরের আবাহন প্রায়ই আজগুবি স্তরে পৌঁছয়। সত্যি কি কেউ ঠান্ডা মাথায় বিশ্বাস করে, অমুক হেলথ ড্রিংক খাওয়ালে ছেলে ক্লাসে প্রথম হবে? অমুক পোশাক পরে অফিসে গেলে পদোন্নতি নিশ্চিত? অমুক নির্যাসের দৌলতে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে? চরম পর্যায়ে এই স্বপ্নের বেসাতি ক্ষতিকারক মিথ্যার আশ্রয় নেয়, যেমন অমুক ক্রিম মাখলে রং ফরসা হবে: তা হতে পারে একমাত্র হানিকর রাসায়নিকের প্রয়োগে। তারও ওপারে আছে গ্রহরত্ন, তাগা-তাবিজ-মাদুলি, দৈব যন্ত্র প্রভৃতির সরাসরি বিশ্বাসভিত্তিক বা সংস্কারভিত্তিক বিপণন।

বলতে ইচ্ছা করে, এই শেষোক্ত পণ্যের প্রচার বাকিগুলো থেকে তেমন আলাদা নয়, একই মানসিক প্রক্রিয়া সর্বত্র কাজ করছে। তবে তা হয়ও যদি, কার্যসিদ্ধির রাস্তা অন্য সব ক্ষেত্রে অনেক সর্পিল, ভাষা ও বৌদ্ধিক অভ্যাসের আরও অনেক বিকারের সাক্ষী। এই অধ্যায়ে সেগুলি একটু দেখা যাক; আর দেখা যাক, পণ্য বিপণনের বাইরে এই কৌশলগুলির কতটা প্রসার ও প্রভাব।

গোড়াতেই একটা প্রশ্নের নিষ্পত্তি করে নিই। আজকের বিপণনের জগতে ভাষার আদৌ কতটা গুরুত্ব? আজ বিজ্ঞাপনের প্রথম ও প্রধান মাধ্যম টিভির দৃশ্য-শ্রাব্য কমার্শিয়াল (ও উত্তরোত্তর আন্তর্জালে তার প্রসার); তারপর রাস্তার হোর্ডিং; নেহাত তৃতীয় স্থানে পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন। সবগুলি মাধ্যমেই ভাষার চেয়ে ছবির গুরুত্ব অনেক বেশি, টিভিতে সেই সঙ্গে কথা বা সংগীত। হোর্ডিং ও ছাপা বিজ্ঞাপনে প্রায়ই তুলে ধরা হয় বিপণনচিত্রের এক লাইন সংলাপ, টিভিতে না দেখা থাকলে ব্যাপারটা বোঝাই যায় না। মানতেই হবে, বিজ্ঞাপনে (ও সাধারণভাবে সমাজজীবনে) ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য অন্তত একশো বছর ধরে কমে আসছে, একুশ শতকে তো নাটকীয়ভাবে। তার কারণ অবশ্যই ধ্বনি ও চিত্র ধরে রাখার ও স্থানান্তরে পাঠাবার প্রযুক্তির তাকলাগানো অগ্রগতি। ফলে আমাদের গোটা বৌদ্ধিক অস্তিত্বের ভোল পালটে গেছে: সব কিছু আমরা গ্রহণ করি বহুমাধ্যমিক উপায়ে বা মাল্টিমিডিয়াতে, ভাষা তার একাধিক মাধ্যমের একটা মাত্র। ফলে ভাষার ব্যবহারও বদলে গেছে। সেই নতুন ব্যবহার আমার আলোচনার একটা প্রধান বিষয়, এখানে ও পরবর্তী অধ্যায়ে। বিজ্ঞাপন নিয়ে আলোচনায় কিন্তু নজর রাখতেই হবে টিভি ও আন্তর্জালের বিপণনচিত্রে: আজকের দিনে তা না হয়ে যায় না। আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য ভাষা নয়, অর্থের গঠন ও প্রকাশ।

সেটা বুঝতে গেলে কিন্তু ভাষার জমিতে দাঁড়িয়ে আলোচনাই সবচেয়ে ফলপ্রসূ হতে পারে, কারণ এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবনাচিন্তা গবেষণা হয়েছে ভাষার প্রেক্ষিতে। ভাষার কাজ কেবল শব্দ বা বাক্যের স্তরে অর্থনির্দেশ নয়, তার কিছু বৃহত্তর ভূমিকা আছে। আমাদের নিবিড় বৌদ্ধিক অভ্যাস, ভাবনাচিন্তা, জগৎকে দেখা ও বোঝা, সব কিছু ধরা আছে ভাষার বৃহত্তর ছকে। তারই প্রতিফলন দেখা যায় ভাষার বাহ্যিক প্রকাশে, শব্দ-বাক্য-উক্তির স্তরে। অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে ভাষাও পালটায়, তার গুরুত্ব বাড়ে বা (আজকের দিনে) কমে। ভাষার গভীরে এই মননক্রিয়ার কথা আমার আলোচনায় ক্রমশ বেশি করে উঠে আসবে। এটা যে বিভিন্ন স্তরে ও প্রেক্ষিতে ঘটে, তা ভাল করে বোঝা দরকার।

একাধিক শব্দ দিয়ে গঠিত হয় বাক্য; অনেক বাক্য দিয়ে একটা পাঠ বা রচনা; অনেক রচনা দিয়ে, আর সেগুলি ঘিরে আরও নানা উক্তি ও আলোচনা মিলে, একটা ব্যাখ্যান (discourse) বা চিন্তাজগৎ। প্রত্যেক স্তরেই ভাষা তার সাংকেতিক ভূমিকা পালন করে। প্রথম অধ্যায়ে আমরা একেবারে মৌলিক স্তরে ধ্বনি ও শব্দের সাংকেতিক ক্রিয়া দেখেছি, দেখেছি কীভাবে সেগুলি অর্থ নির্দেশ করে। তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি, শব্দগুলি বাক্যে বাঁধা পড়লে সবটা মিলিয়ে একটা অর্থ হয়— অর্থাৎ পুরো বাক্যটা একটা নতুন স্তরের সংকেত। তার অর্থের মূলে আছে আলাদা শব্দগুলির অর্থের যোগফল; কিন্তু বাচনক্রিয়ার আলোচনায় এটাও দেখেছি, শব্দের অর্থ ছাড়িয়ে বা এড়িয়ে অন্য একটা উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে। শব্দ-বাক্যের স্তর ছাড়িয়ে আরও একাধিক পর্যায়ে অর্থ সৃষ্টি হয়। বাক্যগুলি যুক্ত করে যে বৃহত্তর রচনা, পূর্ণাঙ্গভাবে সেটাও সংকেত, সবটা মিলিয়ে তার একটা ‘মানে’ বা বক্তব্য আছে; আর এমন অনেক রচনা-আলাপ-আলোচনা মিলিয়ে গঠিত হচ্ছে একটা আস্ত ব্যাখ্যান, জ্ঞান ও চিন্তার একটা গোটা জগতের সংকেত।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে দার্শনিক এর্ন্স্ট কাস্‌সিরেরের মতামত বিস্তারে আলোচনা করব; এখানে তাঁর একটু আগাম শরণ নিই। তিনি ব্যাপারটা বিশদভাবে বুঝিয়েছেন: বলেছেন, ভাষা, শিল্প, বিজ্ঞান ইত্যাদি মননের এক-একটি ক্ষেত্র কেবল বাহ্যজগতের নথি নয়; সেগুলি এক-একটা স্বকীয় সাংকেতিক মণ্ডল, নিজের নিজের বিশেষ পদ্ধতিতে নিজস্ব জগৎ নির্মাণ ও নির্দেশ করে। এই সাংকেতিক সৃষ্টিগুলি বাস্তবের অনুকরণ নয়, বলা চলে বাস্তবের ব্যাখ্যা: একমাত্র এদের মাধ্যমেই বাস্তব কোনও কিছু আমাদের চেতনায় উপলব্ধ হয়, আমরা তা দেখতে জানতে বুঝতে পারি।৪৮ এখন থেকে আমার আলোচনায় ‘সংকেত’ বলতে প্রায়ই বোঝাব বিচ্ছিন্ন শব্দ নয়, শব্দ ও বাক্যের এই বৃহত্তর সমষ্টিগুলি: পাঠ বা রচনা, বা আরও বড় মাপের কোনও বৌদ্ধিক সৃষ্টি, হয়তো একটা আস্ত ব্যাখ্যান। কখন কোনটার কথা বলছি, তা নির্দেশ করার চেষ্টা করব। ঠিক এখনই যে কথা বলতে নিচ্ছি, একটা পূর্ণাঙ্গ রচনার সাংকেতিক ভূমিকা তাতে জরুরি।

বিজ্ঞাপনের আলোচনায় ফিরে যাই। ধরা যাক আমি ক কোম্পানির বিস্কুটের বিজ্ঞাপন বানাচ্ছি। ভালই জানি, খ ও গ কোম্পানির বিস্কুট মোটামুটি এক মানের ও দামের, ক-এর আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। মিথ্যা বলে ধরা পড়লে দণ্ড দিতে হবে, খ বা গ-এর মালিক ধরিয়েও দেবে সোৎসাহে। সুতরাং আমাকে এমন কিছু করতে হবে যা ধোঁকা বা ধাপ্পা হতে পারে, মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু আক্ষরিক মিথ্যা নয়। সৌভাগ্যক্রমে এমন একটা হাতিয়ার আবহমানকাল মানুষের হাতে আছে, তাকে আমরা বলি গল্প।

গল্পের নানা গুণের মধ্যে বিস্কুট বিক্রির পক্ষে একটা মস্ত সুবিধা: গল্পকে কখনও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা যায় না, কারণ তা সত্যতা দাবি করছে না। আমরা তো জানি গল্প একটা বানানো জিনিস। খুব গূঢ় স্তরে তাই দার্শনিক প্রশ্ন তোলা হয়: গল্পের ভাষা কি আদৌ অর্থপূর্ণ? অর্থ বা মানে বলতে আমরা বুঝি শব্দের দ্বারা বাস্তবকে নির্দেশ করা। গল্পের জগৎ বাস্তব নয়, কাল্পনিক; গল্পের ভাষা তবে কী নির্দেশ করছে?

দার্শনিকরা এই অতল প্রশ্নের নিষ্পত্তি করবেন। আমাদের মতো সাধারণ লোকের গোদা বুদ্ধি বলে, এটা কোনও প্রশ্নই নয়। আমাদের সরল যুক্তি বোঝাবার জন্য দার্শনিকদেরই একটা তত্ত্ব আমরা কাজে লাগাতে পারি। সত্যাসত্য বাস্তবতার দু’ রকম বিচার হতে পারে: একটা সামঞ্জস্যের ভিত্তিতে (coherence), আর একটা সংগতির ভিত্তিতে (correspondence)।৪৯ প্রথম বিচারে দেখা হচ্ছে, কোনও উক্তি বাস্তবের সঙ্গে সাধারণভাবে মেলে কি না; দ্বিতীয়টায়, সত্যিই কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে মিলছে কি না। ‘বৃষ্টি পড়ছে’ কথাটা প্রথম বিচারে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য, কারণ বাস্তব প্রকৃতিতে বৃষ্টি পড়ে; দ্বিতীয় বিচারটা নির্ভর করবে বলার সময় সত্যি বাইরে বৃষ্টি পড়ছে কি না, তার উপর। কিন্তু যদি বলি ‘আকাশ থেকে দুধ ঝরে পড়ছে’, কথাটা উভয় বিচারেই অসার, কারণ এমন কখনও ঘটে না।

বোঝাই যাচ্ছে, বাস্তব জীবনে কোনও উক্তির সত্য-মিথ্যা বিচারে এই তফাতটা জরুরি: যা ‘হতে পারে’, সেটাই ‘হয়েছে’ বলে চালিয়ে দিলে মিথ্যা বলা হয়। বানানো গল্পের ক্ষেত্রে তফাতটা অচল: গল্পের ঘটনাগুলি হুবহু ওইভাবে বাস্তবে ঘটেনি আমরা জানি, ঘটতে পারত সেটাই যথেষ্ট। গল্পের উপকরণ বাস্তব থেকে নেওয়া: বাস্তবের সঙ্গে আখ্যানের সাদৃশ্য আছে, আছে বলেই আমরা গল্প পড়ি। অতএব গল্পের ভাষা বাস্তবকেই নির্দেশ করছে, তা সম্পূর্ণ অর্থপূর্ণ। রূপকথা বা কল্পকাহিনি হলেও উত্তরটা বাতিল হত না, তবে অন্যভাবে সাজাতে হত। আপাতত সে আলোচনায় না গেলেও চলবে: আমাদের আলোচ্য বিষয় বিজ্ঞাপন, আর অল্প বিজ্ঞাপনই সরাসরি কল্পজগতের আশ্রয় নেয়।

বিজ্ঞাপনের ‘গল্প’ সবসময় পুরোদস্তুর একটা আখ্যান বা নাটক নয়, যাতে ঘটনাপ্রবাহ আছে, শেষে নিষ্পত্তিও হচ্ছে (অবশ্যই বিজ্ঞপিত পণ্যটির দৌলতে)। এমন ক্ষুদ্র নাটিকা টিভির বিজ্ঞাপনে অনেক দেখা যায়। কিন্ত ব্যাপক অর্থে পর্দার প্রায় সব বিজ্ঞাপনেই একটা গল্প আছে— ঘটনা না থাক, চরিত্র ও দৃশ্যপট আছে। সেই চরিত্রদের ঘরসংসার আছে, পরিবার ও বন্ধুমহল আছে; কখনও কর্মস্থলে, কখনও রাস্তায়, কখনও বাড়িতে নানা পরিস্থিতি বা সমস্যায় তাদের দেখা যাচ্ছে। সেগুলি ঘিরে কোনও কাহিনি দানা না বাঁধলেও আন্দাজ করা যায়, তাদের জীবনের এক ঝলক পরিচয় পাওয়া যায়। এমন একটা পট সৃষ্টি করতে কল্পনা লাগে: তাই আখ্যান বা narrative না হোক, একে কল্পনাশ্রয়ী রচনা বা নির্মাণ (fiction) বলতেই হয়।

গল্পের যে বিশেষ গুণের কথা বলছিলাম, এই নির্মাণে তা রীতিমতো উপস্থিত। চরিত্র, সংলাপ, পরিস্থিতি সবই কাল্পনিক; কিন্তু তার উপাদান বাস্তব জগৎ থেকে নেওয়া, অতএব দর্শকের বোধের নাগালে। দর্শক নিজেকে ওই পটভূমিকায় কল্পনা করতে পারেন, গল্পের একটা চরিত্র হয়ে যেতে পারেন। হবেন কিন্তু নিজের দায়িত্বে, নিজের অনুপ্রেরণায়, কারণ ওই জগতের লভ্য বস্তুগুলি তিনি চান। ‘চান’ মানেই বর্তমানে পাচ্ছেন না, অর্থাৎ ওই জগতের তিনি পুরোদস্তুর (বা আদৌ) বাসিন্দা নন; হতে গেলে অল্পবিস্তর খরচ করতে হবে, কাঠখড় পোড়াতে হবে। যদি না পারেন, বা পারলেও পরিতৃপ্ত না হন, তিনিই পস্তাবেন, বিক্রেতা ও বিজ্ঞাপনদাতা দায়মুক্ত। তাঁদের তৈরি গল্প তো টিভির পর্দার ওপারে নিরাপদ দূরত্বে ছিল, পর্দা ডিঙিয়ে দর্শক নাও ঢুকতে পারতেন: উপন্যাসের গোড়ায় যেমন লেখা থাকে, সব চরিত্র কাল্পনিক, বাস্তব কোনও ব্যক্তি বা ঘটনার সঙ্গে মিল থাকলে কাহিনিকার দায়ী নন।

এমন বিজ্ঞাপন আমাদের গল্পের জাঁতাকলে আটকে ফেলে। জাঁতার একটা চাকি কল্পনা, অন্যটা বাস্তব। গল্পমাত্রেই আমাদের কল্পনার জগতে নিয়ে যায়। আমরা যাই, কারণ সেই জগতের আদলটা পরিচিত বাস্তবের মতো হলেও উপাদানগুলি অভিনব: পড়তে বা দেখতে অসুবিধা হয় না, আবার নতুনের আস্বাদও মেলে। এর পরেই কিন্তু সাহিত্যের গল্পের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের গল্পের মস্ত তফাত। সাহিত্যের গল্প-উপন্যাসে নতুনের আস্বাদটা মেলে কল্পনার স্তরে অর্থাৎ সম্পূর্ণ মানসিক স্তরে। তার বেশি কিছু আমরা চাই না। সাহিত্যিক কল্পনার এই জগতের একটা পরিপূর্ণতা বা স্বয়ংসম্পূর্ণতা আছে। তার উপকরণ বাস্তবের মতো হলেও শেষ অবধি তা আমাদের বাস্তবের বাইরে নিয়ে যায়। জাঁতাকল থেকে আমরা মুক্তি পাই— পাবার জন্যই গল্পটা পড়ি।

‘কল্প’ শব্দের অনেক মানে, কিন্তু চালু অর্থ অভিপ্রায়, পরি‘কল্প’না— আমরা যা করতে চাই তার একটা চিত্র বা ভাবনা। কল্পনায় যা আমরা পরিকল্পনা করি, সেটা রূপায়িত হলে প্রায়ই বলি ‘রচনা’। যা কিছু বানানো হচ্ছে সবই রচনা হতে পারে: ‘সৌধ রচনা’ থেকে ‘শয্যা রচনা’, ‘কবরী রচনা’— সাবেক বাংলায় এমন অনেক শব্দবন্ধ মিলবে। কিন্তু বিশেষ প্রচলিত প্রয়োগে রচনা হচ্ছে শিল্পকীর্তি। স্কুল থেকেই আমরা জানি, রচনা জিনিসটা করতে হয় না, লিখতে হয়। ইংরেজি composition-এর ঝোঁক প্রায় এক; তবে তার প্রাথমিক প্রয়োগ সংগীতে, বাংলায় যেমন ভাষায়— সেক্ষেত্রে বিশেষণ জুড়ে ব্যাখ্যা করতে হয় না, অন্যথায় দরকার পড়ে: বলতে হয় poetic composition, সংগীতরচনা। Poetryর উৎসে যে প্রাচীন গ্রীক শব্দ তারও মানে ‘নির্মাণ’; কথাটার প্রয়োগ হত কাব্য আর সংগীত উভয় ক্ষেত্রে। অর্থাৎ poetryর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ সেই ‘রচনা’। বানানো-রচনা-নির্মাণের সাধারণ ধারণার একটা শাখা বিশেষ করে শিল্পকীর্তির দিকে প্রসারিত হয়েছে একাধিক ভাষায় ও সভ্যতায়। অতএব ‘রচনা’র পরিচয় হয়ে উঠেছে উত্তরোত্তর ভাবাশ্রয়ী; তার আঙ্গিক সংগীতের ক্ষেত্রে পুরোপুরি বিমূর্ত, সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভাষাশ্রয়ী অর্থাৎ সাংকেতিক। বাড়ি বা পণ্যদ্রব্যের মতো জড়পদার্থের তৈরি কোনও কিছুকে আজকাল আমরা বড় ‘রচনা’ বলি না।

বিজ্ঞাপনের রচনা ছবি-গান-ভাষা-সংলাপ সব মিলিয়ে বহুমাধ্যমের; আর সেই রচনা ভাবরাজ্যে আবদ্ধ নয়। তার উদ্দেশ্য পণ্যবস্তু বিক্রি করা; অধিকাংশ বিজ্ঞাপনে সেই বস্তু প্রবলভাবে দৃশ্যমান। (মনে করিয়ে দিই, এই আলোচনায় ‘বস্তু’র সংজ্ঞায় পরিষেবাও অন্তর্ভুক্ত।) এমন গল্প কেবল পড়া বা পর্দায় দেখা মানে দর্শনে অর্ধভোজন। অভিজ্ঞতাটা সার্থক করতে গেলে কল্পনা ত্যাগ করে বস্তুটা বাস্তবে আয়ত্ত করতে হবে— টাকা খরচ করে কিনে, হয়তো আরও কিছু দাবি পূরণ করে। একটু আগে বলেছি, বিজ্ঞাপন দেখে দর্শক যেন টিভির পর্দা ভেদ করে গল্পের জগতে প্রবেশ করেন। সেটা প্রথম ধাপ; পরবর্তী ধাপে সেই জগৎটাই পর্দার ওপার থেকে তুলে এনে এপারের জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন বা করতে চান। গল্পের জগৎ আর কাল্পনিক নেই, রীতিমতো বাস্তব হয়ে উঠছে। বলা যায়, বিজ্ঞাপন তুলে ধরছে এক সোনার পাথরবাটি, বিকল্প বা ‘কাল্পনিক বাস্তব’; তাকে আমরা নিজেদের অস্তিত্বে, পণ্যটা কিনে, পরিণত করছি ‘সত্যিকারের বাস্তবে’। এই দ্বিরুক্তির যে দরকার পড়ছে, সেটাও বিচিত্র: বাস্তবেরও তবে সত্য-মিথ্যা আছে! এই কৌতুককর, চিন্তাকর ধারণাটায় বারবার আমরা ঘুরেফিরে আসব: এক অর্থে সেটাই এ বইয়ের সবচেয়ে মৌলিক প্রতিপাদ্য।

উপন্যাসের গল্প এমন আক্ষরিকভাবে আসল হয়ে ওঠে না; বিজ্ঞাপনের গল্প কিন্তু যতই তুচ্ছ বা প্রান্তিকভাবে হোক, আমাদের জীবনের ছক পালটে দেয়। শেষ অবধি পরিবর্তনটা মোটেই তুচ্ছ থাকে না। একের পর এক বিজ্ঞাপনের পণ্য অল্পে অল্পে আমাদের ঘরে ঠাঁই করে নেয়, ঘরের চেহারা আমূল পালটে যায়। আর যদি ঘরে না তুলতে পারি, সে অভাবটাও আমাদের মানসিকভাবে ক্ষুণ্ণ করে, জীবনে প্রভাব ফেলে। সবটা সরাসরি বিজ্ঞাপন দেখে হয় না; প্রভাব আসে পরিপার্শ্ব থেকে, আত্মীয় বন্ধু পড়শির সঙ্গে আদানপ্রদানে। তাঁরাও একইভাবে বিজ্ঞাপন দেখছেন, জিনিস কিনছেন: তাঁদের কেনা জিনিসগুলো আমাদের চোখে একটা জীবন্ত বিজ্ঞাপনের কাজ করছে, তাঁদের চোখে আমাদেরটা। ভোগপণ্যের কল্পচিত্রে ঠাসা একটা আরশিনগর গিজগিজ করছে আমাদের দৈনন্দিন জগতের সর্বত্র, একেবারে অন্তরীণ হয়ে। (সত্যিকারের ‘আরশি’ও একটা আছে, টিভির পর্দা।) আমাদের জীবন কাটছে এই দুটো জগতের মধ্যভূমিতে, যেন দুই বাস্তব। কিংবা বলা যায় দুটো আর আলাদা নেই, হয়ে গেছে একই জগতের দুটো ভাগ— যেমন একটা বাড়ি আছে যার অর্ধেক কানাডায়, অর্ধেক মার্কিন দেশে।

ভোগবস্তু লোকে চিরকাল চেয়ে এসেছে। চাওয়াটা কখনও আতিশয্যে এমনকী বিকারের পর্যায়ে পৌঁছেছে, কিন্তু আজকের মতো সামাজিক জীবনের অবশ্যশর্ত হয়ে ওঠেনি— অতএব তাকে আর বিকার বলা চলে না, তা মানুষের স্বীকৃত স্বাভাবিক দশা। সংগতি থাকলে এই নিরন্তর চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে, যথেষ্ট মাত্রায় তার দাবি মিটিয়েও লোকে সুস্থিত ছন্দোময় জীবন কাটাতে পারে। সংগতির অভাবে (যার বিচার অবশ্যই মানসিক ও আপেক্ষিক) অশেষ বিষাদ ও অশান্তি নেমে আসে— ব্যক্তিজীবনে, সমাজজীবনে। ভোগবাদী সমাজের সামাজিক ও নৈতিক বিপর্যয় নিয়ে হাহুতাশের অভাব নেই। পাঠককে কথা দিয়েছি, নৈতিক আলোচনার বিস্তার বাড়াব না। তবে বৌদ্ধিক কারণেও এই অবস্থা সম্বন্ধে কিছু বলার আছে।

গত অধ্যায়ে দেখেছিলাম, একটা বাক্য কেমন করে তার অর্থবহতার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে হয়ে পড়ে একটা ব্যবহারিক উপচার, পণ্য বিক্রি বা অন্য কাজ হাসিলের উপায়। এবার দেখছি, একই ভাবে একটা আস্ত গল্প বা রচনার ভাবাশ্রয়ী কল্পনার মাত্রাটা পুরোপুরি বহাল হচ্ছে পণ্য বিক্রির কেজো উদ্দেশ্যে। এই সহজ কাজ হাসিল করতে উপন্যাস বা কাহিনিচিত্রের দরকার হয় না, এক-আধ মিনিটের ভিডিয়ো যথেষ্ট: এই ক্ষুদ্র প্রচারচিত্রগুলি যেন দৃশ্য-শ্রাব্য স্লোগান বা টুইট। পাঠককে দোহাই, পণ্য বিক্রি হচ্ছে বলে নাক সিঁটকাচ্ছি না। আসল কথা, যে বৌদ্ধিক শক্তি অর্থাৎ কল্পনার চিরাচরিত গতি ছিল বহির্মুখী, অ-জাগতিক, এই প্রয়োগে সেটা বিপরীতমুখী, বাস্তবে বাঁধা পড়ে গেছে। বলা চলে, গল্পের কারবারে কল্পনা এবং বাস্তব আর যৌথ অংশীদার নেই, কল্পনা হয়েছে বাস্তবের আজ্ঞাবহ কর্মী।

গত অধ্যায়ে আরও দেখেছিলাম, অর্থের যোগ ক্ষীয়মাণ হওয়ায় পদ-শব্দ-বাক্যগুলি তাদের সাংকেতিক গুরুত্ব হারিয়ে কেবল পণ্য বিক্রির উপায় নয়, শেষ অবধি নিজেরাই কার্যত পণ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার তুলনা করেছিলাম টাকার বাজারে পণ্যের সঙ্গে টাকার সংযোগ লোপের। টাকা সেখানে সংকেত নয়, অর্থাৎ বাস্তব সামগ্রীর মূল্যের সূচক নয়; তার বদলে টাকাকেই পণ্য করে কারবার চলছে, খুশিমতো মূল্য ধার্য করে। আর দেখেছিলাম, ভাষা আর টাকা উভয়েই গূঢ় স্তরে একটা ভাব বা মানসিক নির্মাণ; কিন্তু সাংকেতিক ভূমিকার ফলে বৃহত্তর বাস্তবের সঙ্গে তাদের ওতপ্রোত সম্পর্ক। নতুন ব্যবস্থায় এই বৃহত্তর সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে টাকা ও ভাষা দুটোই প্রচলিত ভূমিকায় অসার ও বিমূর্ত হয়ে পড়ছে।

এদিক দিয়ে বিজ্ঞাপনের গল্পে একটা তফাত দেখা যাচ্ছে। বিপণনের জগতে গল্পটা টাকা বা ভাষার মতো বিমূর্ত পণ্য হয়ে উঠছে না। (গল্প বরং বরাবর পণ্য ছিল ও আছে সাহিত্যের চিরাচরিত জগতে অর্থাৎ বই প্রকাশের বাজারে, প্রচলিত কল্পনাশ্রয়ী সাহিত্যের অবতারে।) বিপণনের বিজ্ঞাপনে নতুন ভূমিকায় গল্পটা পণ্য নয়, বরং কোনও সত্যিকারের বস্তুপণ্যকে নতুন মহিমায় অধিষ্ঠিত করছে: খাবার, পোশাক, আসবাব, গাড়ি, মোবাইল, টিভি ফ্রিজ ইত্যাদি গার্হস্থ যন্ত্র, ফ্ল্যাট ও বাসগৃহ ইত্যাদি।

তফাতটা কিন্তু অত সরল নয়। এখানেও একটা বিমূর্ত মানসিক উপাদান এসে যাচ্ছে। হঠাৎ বললে অবাক শোনাতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞাপনে এত চমকদার ছবি দেখিয়ে, মনোগ্রাহী পরিবেশে সাজিয়ে, ‘রিয়াল-লাইফ’ অনুভূতির আমেজ এনে পণ্যটির বস্তুগত পরিচয় আদতে রূপান্তরিত হচ্ছে তার মানসিক প্রতিরূপে— বস্তুটার প্রতি ইচ্ছা বা আকর্ষণের একটা কেন্দ্রে। ভোগবাদী সমাজ সম্বন্ধে খুব মামুলি কথা যে আগেকার দিনে লোকে প্রয়োজন হলে জিনিস কিনত (কিছু শখ, জমক, আতিশয্য এই ‘প্রয়োজনের’ অন্তর্ভুক্ত ছিল); আজ বিপণনের কৌশলে প্রয়োজন ছাপিয়ে অশেষ নতুন চাহিদা সৃষ্টি হয়েই চলেছে, বাহুল্য থেকে ক্রমে পরিণত হচ্ছে প্রয়োজনে। অপর দিকে— যেটা আমরা অত ভাবি না— দরকারি জিনিসের চাহিদাতেও শখ বা পছন্দের একটা মাত্রা যোগ হয়েছে: রুটি বা সাবান কেনার সময় শুধু যে শৌখিন জিনিসের জন্য বেশি দাম দিচ্ছি তা নয়, পাঁচটা সাধারণ জিনিসের মধ্যে রুচিমতো বা স্রেফ খেয়ালমতো একটা বাছছি ও ক্রমে তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, অন্যগুলো নিতে মন সরছে না। ‘মন সরার’ এই ব্যাপারটা আমাদের ঠাকুমা-দিদিমাদের অত মাথায় আসত না: আসার সুযোগই ছিল না, পসরার এত বৈচিত্র্য ছিল না বলে। বেশিরভাগ দৈনন্দিন সামগ্রী ব্র্যান্ডশোভিত আকর্ষণীয় মোড়কে পাওয়া যেত না, টিন বা বস্তা থেকে ওজন করে ক্রেতার নিজের পাত্রে ভরে দেওয়া হত।

ব্যাপারটা তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে? টিভি-হোর্ডিং-পত্রিকা যতই পণ্যের ছবিতে ঠাসা হোক, বাজারের ব্যাগ যতই ভারী হোক, ঘর যতই ভরুক আসবাবে গ্যাজেটে, চাহিদা-ক্রয়-বিপণনের পুরো প্রক্রিয়াটা আদতে ঘটছে আমাদের মনের ভিতরে। বিপণনকারী আমাদের মনে যে উপায়েই হোক পণ্যটা ঘিরে একটা আকর্ষণ সৃষ্টি করছেন: সাবান বা ফ্রিজ নয়, ওই আকর্ষণই তাঁর সবিশেষ পণ্য। অমন সাবান বা ফ্রিজ বাজারে আরও আছে (হয়তো এক দামে আরও ভাল কিছু আছে), অবিকল এই আকর্ষণটা তাদের ঘিরে তৈরি হয়নি; অন্য প্রতিযোগী আকর্ষণ থাকতে পারে, সেগুলোকে টেক্কা দিয়ে খরিদ্দার ধরতে হবে। আকর্ষণবোধ তো মনের ব্যাপার। সেই আকর্ষণের ফলে আমাদের জিনিসটা কেনার ইচ্ছা জাগে— সেটাও মনের ব্যাপার। জিনিসটা সরবরাহ করে বিক্রেতা সেই ইচ্ছা পূরণ করেন: বলা যায়, তিনি আমাকে যা বিক্রি করছেন তা শুধু একটা বস্তু নয়, আমারই মানসিক সৃষ্টি সেই ইচ্ছাটার একটা বাহন বা আধার। একটু বাড়িয়ে বলা যায়, তিনি ইচ্ছাপূরণের পরিষেবা দান করছেন, সেজন্য আমি তাঁকে টাকা দিচ্ছি— খেলা বা সিনেমা দেখতে যেমন দিই, মনের আরাম হয় বলে। পণ্যবস্তুটা উপলক্ষ মাত্র, যদিও অপরিহার্য উপলক্ষ: সেটা পাচ্ছি বলেই মন ভাল হচ্ছে।

এই পুরো আদানপ্রদানে আসল বাণিজ্যবস্তুর একটা সাংকেতিক বিকল্প বা প্রতিভূ কাজ করছে, তা হল সেই আদলে সৃষ্ট ইচ্ছাবস্তু। ব্যবসার ভাষায় যাকে চাহিদা (demand) বলা হয়, তা আদতে ক্রেতার ইচ্ছা। ‘চাহিদা’ শব্দের দুটো প্রয়োগ। একটা হল, পরিমাণ বা সংখ্যার বিচারে কত পণ্য লোকে কেনে (‘মাসে এক হাজার টিভির চাহিদা আছে’); অন্যটা বিমূর্ত ধারণা, কিছু কেনার পিছনে লোকের মনে যে ইচ্ছা বা সিদ্ধান্ত (‘এই সাবানটার একদম চাহিদা নেই’)। দ্বিতীয় অর্থটাই মৌলিক, এটা বাড়লে তবে বিক্রিবাটা বাড়ে, অতএব বাড়ে উৎপাদন।

খানিক আগে বিজ্ঞাপনের জগৎটাকে বলেছিলাম আরশিনগর: সেখানে বস্তুপণ্য নয়, পণ্যের একটা কল্পচিত্র লোকে গড়ছে বাছছে কিনছে। দেখা যাচ্ছে, সেই আরশিনগরের ওপারে আছে পুরোপুরি বিমূর্ত ভাব-অনুভবে গড়া এক ইচ্ছাপুরী: তার কারবার হল ইচ্ছার উদ্রেক, ইচ্ছা পোষণ, ইচ্ছাপূরণ। (পরে আশাভঙ্গ হতে পারে, সেটা অন্য কথা।) ধনতান্ত্রিক ভোগবাদী সমাজে ইচ্ছা এক বিকল্প মুদ্রাব্যবস্থা (currency) বলা যেতে পারে: টাকার চেয়েও বিমূর্ত, কারণ টাকার লেনদেন হয় ইচ্ছার ভিত্তিতে। জিনিসের দাম ঠিক হয় টাকা দিয়ে। কিন্তু কোন জিনিসের জন্য আমি কত টাকা খরচ করতে রাজি, তা ঠিক হয় আমার ইচ্ছা দিয়ে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলেছিলাম, টাকার বাজারে টাকার সরকারি মূল্য যাই হোক, স্থান-কাল-পাত্র অনুসারে কার্যকর মূল্য বাড়ে-কমে। পণ্যের বাজারে কিছুটা এক ভাবে, ক্রেতা-উপভোক্তার ইচ্ছা অনুসারে পণ্যের মূল্য বাড়ে-কমে।

ইচ্ছার প্রভাবে এই বাড়া-কমা দু’ ভাবে হয়। এক, সরাসরি অর্থমূল্যে। কোনও জিনিসের ন্যায্য দাম হয়তো পঞ্চাশ টাকা; কিন্তু সেটা আমি খুব চাই, তাই একশো টাকা দিতে রাজি। কিছু সঙ্গিন অবস্থায় আমরা বেশি দাম দিই দায়ে পড়ে: অত্যাবশ্যক খাবার বা ওষুধ কালোবাজারে কিনে, সংকটাপন্ন রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাড়তি গাড়িভাড়া দিয়ে। প্রায়ই কিন্তু চড়া দাম দিতে রাজি হই স্রেফ মানসিক সন্তুষ্টির জন্য— শখ মেটাতে, সমাজে কদর বাড়াতে, বাড়ির লোককে খুশি করতে ইত্যাদি। একই চিন্তার রকমফেরে, টাকার অঙ্কে দাম এক থাকলেও মানসিক মূল্যায়নে তা কমে-বাড়ে। আমার একটা সুন্দর জামা কেনার খুব শখ। হাতে অল্প টাকা, জামা কিনলে বাজার খরচে টান পড়বে, ক’দিন আলুসেদ্ধ ভাত খেয়ে থাকতে হবে; ঠিক করলাম, তাই সই। কিংবা একটা বই কিনলে নাটক দেখার পয়সা থাকবে না; ঠিক করলাম, বইটাই কিনব। খাবার আর জামা, বা বই আর নাটকের টিকিট, টাকার হিসাবে সমমূল্য; আমার ইচ্ছার বিচারে কিন্তু একটার ‘দাম’ বেশি, অন্যটার কম।

এই আলোচনা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট হবে। এই মনগড়া দামের সঙ্গে তিনটে বিষয়ের যোগ নেই: পণ্যটির বাস্তব প্রয়োজন; তার গুণাগুণ; এবং বহু ক্ষেত্রে তার বাজারদর— যেমন জামা বা বই কেনার উদাহরণে, অর্থমূল্য এক হলেও আমার কাছে একটা জিনিসের দাম আর একটার চেয়ে বেশি। এটাও ভোগবাদী সমাজে ক্রেতার সমাদৃত ‘চয়েস’-এর একটা দিক। তার বড় করুণ প্রকাশ দেখা যায় যখন গরিব মানুষ মনের তাগিদে তার সামান্য পুঁজি খরচ করে অত্যাবশ্যক জিনিসের বদলে ছোটখাটো কোনও শখ মেটাতে, হয়তো বাচ্চাকে একটা খেলনা কিনে দিতে।

টাকা ও ভাষার ক্ষেত্রে দেখেছি পুরনো প্রচলনের ভোল বদল, পরিচিত সাংকেতিক প্রণালীর রূপান্তর এবং (অন্তত সাবেক দৃষ্টিতে) বিপর্যয়। বিপণনের ক্ষেত্রে চাহিদার এই সাংকেতিক ভূমিকা নতুন। তার অভিনব বিবর্তনের পিছনে যে কারণগুলি কাজ করছে তা হল: ধনতান্ত্রিক সমাজে পণ্য উৎপাদনের স্ফীতি; সেই উৎপাদন বিপণনের জন্য প্রচার ও বিজ্ঞাপনের জালবিস্তার; এবং প্রচারের ফলে সম্ভাব্য ক্রেতার মনে নতুন ধরনের স্পৃহা বা ইচ্ছার সৃষ্টি, অর্থাৎ ভোগবাদের গোড়াপত্তন। আগেকার যুগে লোকে প্রয়োজনমতো পণ্য উৎপাদন করত, প্রয়োজনমতো কিনত। প্রয়োজন ছাপিয়ে আজকের অর্থে চাহিদা সৃষ্টির ফলে ব্যাপারটা জটিল ও বিস্তৃত হয়েছে: পণ্য কেনার প্রণালীতে নতুন মানসিক প্রক্রিয়া যুক্ত হয়েছে, ফলে অবধারিতভাবে বস্তুর স্তর অতিক্রম করে সাংকেতিক স্তরে ব্যাপারটা পরিচালনা করতে হচ্ছে।

এই সাংকেতিক জগৎটা ত্রিস্তর: প্রথম স্তরে আসল পণ্যবস্তু; দ্বিতীয় স্তরে তার একটা ভাবরূপ, যা প্রচারের ফলে আমাদের মনে বাসা বাঁধে; তৃতীয় স্তরে সেই ভাবরূপের প্রভাবে সৃষ্ট আমাদের ইচ্ছা বা চাহিদা, যার অভিঘাত বস্তুপণ্যের উপর (অর্থাৎ জিনিসটা কিনে), কিন্তু যার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক পণ্যের ভাবরূপের মধ্য দিয়ে। পুরো ব্যবস্থাটার সঙ্গে ভাষার সাংকেতিক প্রক্রিয়ার বিলক্ষণ মিল, বিশেষত ‘শব্দার্থের ত্রিভুজ’এর ধারণাটার। কৌতূহল হতে পারে, বর্তমান যুগে ভাষা ও অর্থব্যবস্থার কালজয়ী সংকেতের রাজত্ব যখন টালমাটাল, তখনই বিশ্বের দরবারে একটা নতুন সংকেতমালার কী করে প্রবেশ ঘটল। এর পূরবী আর ওর বিভাসের মধ্যে যোগসূত্র আছে কি?

টাকার ক্ষেত্রে দেখেছি, পণ্য, পরিষেবা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের সঙ্গে যোগ বিচ্ছিন্ন করে টাকা নিজেই পণ্য হয়ে উঠেছে। ভাষার ক্ষেত্রেও বাক্য হয়ে পড়েছে শব্দগুলির আলাদা আলাদা মানে মুছে-সাপটে একটা স্থূল সরল বার্তার ইঙ্গিত। টাকা আর ভাষা, উভয়েই তাদের সমৃদ্ধ সাংকেতিক ভূমিকা ত্যাগ করে উত্তরোত্তর হয়ে উঠছে আদানপ্রদানের সরল চটজলদি উপাদান, বিমূর্ত হলেও ব্যবহারের নিরিখে ‘বস্তু’ বলা চলে।

পণ্য বিপণনের লক্ষ্য কিন্তু সত্যিকারের বস্তু; তবে তা নিয়ে লেনদেনের জন্য, আর সেই লেনদেন অনুপ্রাণিত করার জন্য, একটা সাংকেতিক প্রণালীর দরকার। টাকা চিরকাল এই কাজটা করে এসেছে; কিন্তু আজ টাকার বাজারে পণ্যের গুরুত্ব কমেছে, এবং পণ্যের নিজস্ব বাজার নতুন বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করেছে। সেই বাজারের দাবিমতো, টাকার শূন্যস্থান পূরণ করতে পণ্যের বাজার নিজস্ব একটা বিমূর্ত সাংকেতিক কাঠামো খাড়া করেছে, যার উপকরণ ইচ্ছা বা চাহিদা। পণ্যের মূল্যায়ন হচ্ছে চাহিদার নিরিখে: বাজারের দাম সেই অনুসারে বাড়ছে-কমছে, পণ্যের গুণ অনুসারে নয়। দোকানে বিশেষ সময়ে বা বিশেষ পণ্যের ‘সেল’ এর একটা সহজ উদাহরণ। তারিখ ও যাত্রীসংখ্যা অনুসারে বিমানের একই আসনে ভাড়ার ওঠা-নামা আর একটা। এ দিক দিয়ে দেখলে পণ্য বিপণনের সাংকেতিক প্রণালী যুগধর্ম অনুসরণ করছে, ভাষা বা অর্থব্যবস্থার সঙ্গে একই পথে হাঁটছে: অর্থাৎ তা চালনা করছে বস্তুজগৎ নয়, একটা বিমূর্ত ধারণা বা মানসিক ক্রিয়া— এক্ষেত্রে চাহিদা।

এর পর কিন্তু সত্যিই একটা মৌলিক তফাত। টাকার বাজারে পণ্যের লেনদেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘বিশুদ্ধ’ টাকার কারবার চলতে পারে; ভাষার অর্থবহতা ত্যাগ করে বাক্য তার নিজস্ব স্বয়ম্ভূ উদ্দেশ্য মেটাতে পারে; কিন্তু বস্তুপণ্যের বাজারে তেমনটার প্রশ্ন ওঠে না, কারণ ক্রেতার ইচ্ছা বা চাহিদা মনের ব্যাপার হলেও সেটা বস্তুপণ্যকে কেন্দ্র করে। শেষ অবধি তিনি পণ্যটাই পেতে চান— সেটাই হল জোগান বা অর্পণসামগ্রী, deliverable। পণ্যের ক্ষেত্রে একটা বাস্তব অনুশাসন বা ‘রিয়ালিটি চেক’ কাজ করে— এক পর্যায়ে বিক্রেতার উপর, কারণ তাঁকে জিনিসটা সরবরাহ করতে হবে; তারপর ক্রেতার উপর, কারণ সেটা তাঁকে গছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যতই শখ করে নতুন গাড়ি কিনি, পড়শিদের ঈর্ষার উদ্রেক করে যতই আহ্লাদিত হই, গাড়িটা যদি রোজ রোজ বিগড়ে যায় তো মোহভঙ্গ হতে বাধ্য। ভোগবাদী মধ্যবিত্ত মাত্রে জানি, এমন ক্ষেত্রে আমরা বেজায় অসহায়। যাই ওয়ারেন্টি থাক, প্রায়ই নাজেহাল হতে হয়, সময় সুবিধা মানসিক শান্তি জলাঞ্জলি দিতে হয়, হয়তো টাকাটাই জলে যায়।

এমন অবস্থায় পড়লে আমরা রেগে গিয়ে ভাবি, কে কাকে কিনছে? ‘কী’ নয়, ‘কাকে’। বিক্রেতা তো আমাদের একটা নির্দিষ্ট পণ্য জোগান দিচ্ছেন মাত্র; পরিবর্তে আমরা কি তাঁর কেনা গোলাম হয়ে গেছি? বিক্রেতারাও অবুঝ ক্রেতা সম্বন্ধে এমন ভেবে থাকেন। রাগের কথা ছেড়ে ঠান্ডা মাথায় প্রশ্নটা ভাবা যাক। সত্যি করে কে কাকে কিনছে? তথ্যপ্রযুক্তির বাজারে দেখেছিলাম, প্রযুক্তি ব্যবহারের ‘দাম’ হিসাবে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য সঁপে দিচ্ছি, অর্থাৎ আদতে আমরাই পণ্য। বস্তুপণ্যের বাজারে কী হচ্ছে?

ক্রেতা নিজের ইচ্ছামতো পণ্য নির্বাচন করছেন। প্রক্রিয়াটা উলটো দিক থেকে দেখা যাক। প্রচারের ফলে ক্রেতার মনে পণ্য সম্বন্ধে একটা ধারণা গেঁথে গেছে, জিনিসটা কেনার ইচ্ছা হয়েছে। সে ইচ্ছার বশে তিনি বাজারে (হয়তো সশরীরে নয়, উত্তরোত্তর আন্তর্জালের সাইবার বাজারে) জিনিসটা সম্পর্কে খোঁজ নিতে লাগলেন। বিক্রেতারা নানা পসরা তাঁর সামনে মেলে ধরলেন, তিনি একটা বাছলেন। একই সঙ্গে কিন্তু তিনিও তাঁর খরিদ করার ইচ্ছাটা বিক্রেতাদের সামনে মেলে ধরলেন: প্রকারান্তে বললেন, ‘দেখ কে কী “দামে”, অর্থাৎ কী পণ্য কী শর্তে দিয়ে, এই ইচ্ছাটা “কিনে” নিতে পার’, আর শেষ অবধি সফল বিক্রেতার কাছে ধরা দিলেন। দু’জনের মধ্যে একটা সম্পর্ক স্থাপন হল, তার অভিজ্ঞান খরিদ করা পণ্যটি। ক্রেতা যদি সেটা নিয়ে খুশি হন, ভবিষ্যতে ওই বিক্রেতার থেকে আরও জিনিস কিনতে পারেন, সম্পর্কটা দৃঢ় হতে পারে। বড় বড় বিপণন সংস্থায় বাঁধা খরিদ্দারদের ‘আনুগত্য’ বা ‘লয়ালটির’ ইনাম হিসাবে ছাড় বা উপহার দেবার প্রথা আছে। ফলে আনুগত্যের প্রমাণ দিতে ক্রেতারা বেশি বেশি জিনিস কেনেন, বিপণনচক্র ঘুরতেই থাকে।

বিজ্ঞাপন আর জনসংযোগের কুশীলবেরা এই অন্তরঙ্গতা, আপন-আপন ভাব খুব করে ফুটিয়ে তুলতে চান— ক্রেতারা যেন তাঁদের কত কাছের মানুষ। এটা বিপণনের অভ্যস্ত বাগ্রীতি, আগের অধ্যায়ে জন্মদিনের মোবাইল বার্তায় দেখা গেছিল। ক্রেতারা বরং ভাষায় বা মনোভাবে সচরাচর অত অন্তরঙ্গতা প্রকাশ করেন না। অমন ভাব ও ভাষা আমরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের পক্ষে উপযুক্ত মনে করি, ব্যবহারিক ও ব্যবসায়িক জগৎকে মানসিকভাবে পৃথক রাখতে চাই। মানবিক সম্পর্কেও কিন্তু লেনদেনের পাট আছে, এবং সব লেনদেনের নিহিত যুক্তি কিছু্টা এক। যে সম্পর্কগুলি আমরা লেনদেনের আদলে সচরাচর দেখি না, যেমন পারিবারিক বন্ধন, প্রেম-ভালবাসা ও বন্ধুত্ব, তাতেও চিড় ধরলে লেনদেনের ভাষায় অনুযোগ করি— বলি, অপর পক্ষ যত পেয়েছে তত দেয়নি। তখন প্রকাশ পায় যে সম্পর্কটা সুখী থাকার সময়েও তাতে বিনিময়ের একটা মাত্রা ছিল। ব্যক্তিগত আর ব্যবহারিক জগৎ সত্যি পৃথক কিনা, তা মোটেই তর্কাতীত নয়। সে বিতর্কে আমি যাব না। এই অধ্যায়ের বাকি অংশে বরং দেখব, সমাজের আর একটা গুরুতর ক্ষেত্রে পণ্য লেনদেনের প্রণালীর কতটা প্রতিফলন। এই ক্ষেত্রটা নির্বাচনী রাজনীতি। অর্থব্যবস্থা ও ভাষাব্যবস্থা সম্বন্ধে এ পর্যন্ত যা বলেছি, সেটা এখানে কতদূর প্রযোজ্য তাও দেখব।

একটা কথা স্পষ্ট করে নিই। রাজনৈতিক দুর্নীতি হিংসা চক্রান্ত হানাহানি নিয়ে আমি কোনও আলোচনা করব না। টাকার প্রসঙ্গ যদি ওঠে, উঠবে অর্থব্যবস্থার সঙ্গে তাত্ত্বিক তুলনায় (যেমন এই বইয়ে আগাগোড়া), ভ্রষ্টাচারের সূত্রে নয়। বরং আমার বক্তব্য: বহু নাগরিক যদি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ও বিশেষ করে নির্বাচনী ব্যবস্থা, সম্বন্ধে হতাশ বোধ করেন— শুধু আজকে নয়, শুধু আমাদের দেশে নয়— তার মূল কারণ বৌদ্ধিক: ভ্রান্তি ও কুযুক্তি, ভাষার ব্যবহার ও মানসিক অভ্যাসের বিকার। মানসিক পরিমণ্ডল এমন হলেই গণতন্ত্রের হানি ঘটে, দুর্নীতি হিংসা বিরোধ প্রবল হয়ে ওঠে।

রাজনৈতিক নির্বাচনের মূল পদ্ধতির সঙ্গে বাজারি লেনদেনের স্পষ্ট সাদৃশ্য আছে। নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা তাঁদের আগের কাজের খতিয়ান ও আগামী কাজের প্রতিশ্রুতির পসরা নিয়ে উপস্থিত হন, আমরা তা বিচার করে আমাদেরই হিতার্থে একজনকে নির্বাচন করি; বিধি অনুসারে পাঁচ বছর বাদে সরিয়েও দিতে পারি, পারব কি না সে আলাদা প্রশ্ন। একবার নির্বাচিত হলে কিন্তু তিনি আমাদের উপর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন: কেতাবি গণতন্ত্র যাই বলুক, বাস্তবে তখন আমাদেরই তাঁর প্রতি আনুগত্যের প্রশ্ন ওঠে, পণ্য বিক্রেতার প্রতি ক্রেতার ‘আনুগত্যের’ চেয়ে যার গুরুত্ব অনেক বেশি। কোনও বিক্রেতা আমাদের কত অসহায় অবস্থায় ফেলতে পারে, তা নির্ভর করে পণ্যের দামের উপর। একশো টাকার জামা কিনে ঠকলে আমরা সহজেই তার মায়া কাটাতে পারি, বিশ লাখ টাকার গাড়ি বা কোটি টাকার ফ্ল্যাট হলে মাথায় বাজ পড়ে। যে রাজনীতিক এবং তাঁর দল আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তাঁদের কাছে আমরা সর্বাংশে বাঁধা পড়ে থাকব আশ্চর্য কী? কে কাকে কিনছে, এই প্রশ্নের জবাব অতএব কঠিন নয়।

পণ্যের সওদাগরদের মতো রাজনীতির সওদাগরেরাও আমাদের গল্প বলেন। আগেই দেখেছি, গল্পের (fiction) অবস্থান বাস্তব আর কল্পনার বিভাজন রেখায়, দু’দিকেরই কিছু জমি দখল করে অর্থাৎ বিভাজনটা অস্পষ্ট করে। গল্পে তাই বাস্তবের নামে কল্পনা আর কল্পনার নামে বাস্তব, দুটোই চালিয়ে দেওয়া যায়। এই সীমান্ত-বাণিজ্য সাহিত্যে মনোগ্রাহী রূপ নেয়, কারণ সেখানে প্রকৃত অস্পষ্টতা নেই: আমরা জানি কাহিনিটা আক্ষরিক অর্থে বাস্তব নয়, বাস্তবের উপাদানকে কল্পনার স্তরে বাড়িয়ে বদলিয়ে নতুনভাবে দেখিয়ে বাস্তবকে আরও বুঝতে সাহায্য করছে। জাগতিক ক্ষেত্রে গল্পের ব্যবহারে কিন্তু বাস্তব আর কল্পনা গুলিয়ে ধন্দ বাধতে পারে, চতুর গল্পকার নিজের স্বার্থে গুলিয়ে দিতে চান। পণ্যব্যবসায়ীরা কীভাবে তা করেন আমরা দেখেছি; এবার রাজনীতিকদের পালা।

দার্শনিক রোলাঁ বার্তের একটা তত্ত্ব দিয়ে শুরু করি। তার উদাহরণ কৌতুককর। বার্ত সংবাদপত্রে দেখলেন মস্ত হেডলাইনের নীচে ছাপা: ‘দ্রব্যমূল্য কমতে শুরু করেছে! সবজির দাম কমল!’ বিজ্ঞাপন নয়, খবর হিসাবেই কাগজ এই সুসংবাদ প্রচার করছে, সরকারের আর্থিক নীতিকে বশংবদ অভিনন্দন জানাতে। ব্যাপারটা কাঁচিয়ে দিচ্ছে ওই কাগজেই অন্যত্র একটা ছোট্ট খবর: এটা ফসল তোলার মরশুম, তাই প্রচুর নতুন সবজি বাজারে আসছে। অর্থাৎ দাম এমনিতেই কমত, সরকারের কোনও বাহাদুরি নেই।৫০

বিপণনের এটা অভ্যস্ত পন্থা: সত্যি কথাটাই এমনভাবে বলা যে একটা ভুল ধারণা হয়— মামুলি ব্যাপারকে মনে হয় অসামান্য, ক্ষতিকারকটা উপকারী। শব্দগুলি সংকেত আবার সংকেত নয়, প্রত্যেকটার মানে সঠিক কিন্তু বাক্যটার ‘মানে’ ভুল। তৃতীয় অধ্যায়ে বাচনক্রিয়াতত্ত্বের কথা বলেছিলাম, এটা তার মোক্ষম দৃষ্টান্ত: বাক্যের সরল অর্থের আড়ালে একটা ঘোরালো ‘মতলব’ আছে। খবরটার আপাত অর্থ ‘সবজির দাম কমছে’, কিন্তু আসল ইঙ্গিত ‘সরকার খুব ভাল’। পণ্যের ক্রেতার মতো সরকারের ‘ক্রেতা’ অর্থাৎ ভোটদাতা নাগরিককেও সাবধানে থাকতে হবে, যাতে তিনি না ঠকেন। বিক্রেতা নিজের পিঠ বাঁচাবার পাকা ব্যবস্থা করে রেখেছেন: তিনি কোনও মিথ্যা বলছেন না, সরকার সম্বন্ধে কোনও কথাই বলছেন না।

সরাসরি নির্বাচনী প্রচার বাদে রাজনৈতিক বিপণনের আর সব কাজ প্রায়ই এমন প্রচ্ছন্ন ও পরোক্ষ। রাজনীতির প্রসঙ্গই যেন উঠছে না, কথা হচ্ছে সবজির দাম, কি নতুন রাস্তা, কি বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে। বার্ত বলছেন, এমন ক্ষেত্রে প্রচারবস্তুটা ডবল করে সাংকেতিক। যে খবরটা পড়ছি, তার ভাষাগত পাঠ একটা সংকেত, যার নির্দিষ্ট অর্থ ‘সবজির দাম কমল’। দ্বিতীয় এক স্তরে সেই দাম কমার খবরটা সরকারের সাফল্যের প্রতীক, অর্থাৎ সেটাই সংকেত, তার নির্দিষ্ট অর্থ ‘সরকার খুব ভাল’। পরবর্তীকালে দেরিদা যাকে বলবেন ‘সংকেতের সংকেত’ (প্রথম অধ্যায় দ্রষ্টব্য), এটা তার এক ধরনের উদাহরণ।

সরাসরি প্রচার বা প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রেও রাজনীতিকেরা একটা বাড়তি অস্পষ্টতার সুযোগ নিতে পারেন ও অবশ্যই নিয়ে থাকেন। আগে বলেছি, যতই বাকচাতুরী বা বিপণনের কৌশল থাক, পণ্যব্যবসায়ী শেষতক একটা নির্দিষ্ট বাস্তব পণ্যের জোগান দিতে বাধ্য। রাজনীতিক অত দায়বদ্ধ নন। তাঁর প্রতিশ্রুত ফল যদি বাস্তব কিছু হয় (যেমন রাস্তা বা সেতু, স্কুল বা হাসপাতাল) সেটা (কার্যত অনির্দিষ্ট) ভবিষ্যতের গর্ভে, ঠিক কী রূপ ধারণ করবে তাও প্রায়ই অস্পষ্ট; অথবা তা দৃষ্টি বা মানসিকতার ব্যাপার, স্বভাবত অস্পষ্ট বা অমেয় (যথা, বিশ্বের চোখে ভারতের গৌরববৃদ্ধি, সমাজে নারীর মর্যাদাবৃদ্ধি)। বিশেষত শেষ ধরনের অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি হাতের বাইরে নানা বিচিত্র পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে; ফলে প্রতিশ্রুতি রক্ষা হল কি না, বা আদৌ হওয়া সম্ভব ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে। দ্বিতীয়ত, রাজনীতিকেরা ভোট চান অতীত ও ভবিষ্যতের প্রেক্ষিতে: তাঁরা বা তাঁদের দল ইতিপূর্বে যে কাজ করেছেন, বা নির্বাচিত হলে আগামী দিনে যা করবেন। ফলে কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে কুমিরডাঙা খেলার পাশাপাশি ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যতের মধ্যেও তাঁদের ক্ষিপ্র আনাগোনায় আমরা বিভ্রান্ত হতে পারি। রাজনীতিকদের গল্পগুলি বিশেষ করেই ‘ধরা যাক’ বা ‘কল্পনা করুন’ গোত্রের। রাজনীতির ভাষার বিশ্লেষক টমাস ডখর্টি একে বলছেন রাজনৈতিক অনুমিতি, political hypothesis,৫১ দর্শনের ভাষায় ‘প্রকল্প’ (‘কল্প’ শব্দ নিয়ে আগের আলোচনার কথা ভাবুন)।

হয়তো কোনও পুরভোটের প্রার্থী বললেন, ভোটে জিতলে পাড়ার খালি জমিতে একটা পার্ক বানিয়ে দেবেন। কথাটা আমাদের মনে ধরল; নিজেদের উৎসাহী কল্পনা থেকে একটা ছবিও জুড়ে দিলাম, পাড়ার বাচ্চারা সেখানে খেলছে, বৃদ্ধেরা পায়চারি করছেন। প্রার্থী মহোদয় আরও মনে করালেন, তাঁর পূর্বসূরি দশ বছর আগে এই অঞ্চলে কত ভাল কাজ করে গেছেন; তাতেও আমাদের আস্থা বাড়ল। উপরন্তু এই ভদ্রলোককে না চিনলেও তাঁর দলের অন্য কিছু সদস্য সম্বন্ধে আমাদের ধারণা খারাপ নয়। খেয়াল করবেন যে এই তিনটি বিচার্য বিষয়েরই স্থান-কাল-পাত্র আলাদা: হয় ভবিষ্যৎ, নয় অতীত, নয় অন্যত্র অন্য ব্যক্তি সংক্রান্ত। তাতেই আশাভরসা করে আমরা এই প্রার্থীকে ভোট দিলাম। তারপর হয় তিনি সত্যিই পার্ক বানিয়ে দিলেন; নয় পার্কের নামে সরকারি খরচে বানালেন দলের ছেলেদের একটা আস্তানা, তাতে আমাদের উপদ্রব বাড়ল; নয় কিছুই করলেন না। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্ষেত্রে আমরা সচরাচর অসহায়। ভাবতে পারি, পাঁচ বছর বাদে এঁকে বিদায় করব। ততদিনে তিনি যথেষ্ট আখের গুছিয়ে নেবেন; কিংবা এমন অবস্থা আসবে যে হয় ভয়ে নয়তো, কী আশ্চর্য, স্বেচ্ছাতেই এই ব্যক্তিকে আমরা ফিরিয়ে আনব।

উদাহরণটা সর্বভারতীয় স্তরে নিয়ে যাওয়া যাক। সংসদীয় নির্বাচনের আগে কোনও শক্তিশালী দল বলল, ক্ষমতায় এলে তারা পাঁচ বছরে এত কোটি কর্মসংস্থান করবে; বা সর্বজনীন চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে; বা সাধারণ মানুষের উপার্জন তিনগুণ বাড়িয়ে দেবে, উপরন্তু প্রত্যেকের ব্যাঙ্কে মোটা অঙ্কের টাকা জমা পড়বে। দেশবাসী পরম উৎসাহে তাদের বিপুল হারে ভোট দিলেন। পাঁচ বছর বাদে দেখা গেল কিছু প্রতিশ্রুতি আদৌ পূরণ হয়নি, কতগুলি যেভাবে হয়েছে তাতে প্রত্যাশিত উপকার মেলেনি। বিরোধী দল তো বটেই, সাধারণ মানুষও প্রতিশ্রুতিভঙ্গের অনুযোগ করছে। মুশকিল এই, এমন মস্ত মাপের উন্নতির অসংখ্য উপাদান ও উপসর্গ আছে; সাফল্য নির্ভর করে নানা জটিল পরিস্থিতির উপর, যা অনেক সময় শাসকদেরও হাতের বাইরে। বাস্তবে প্রায় কোনও প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি পালন করা অসম্ভব, এমনকী চেষ্টা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়া বিচিত্র নয়। আবার বাস্তব সমস্যার দোহাই দিয়ে ব্যর্থতা ও দুর্নীতি চাপা দেওয়া হচ্ছে, তাও অতি পরিচিত চিত্র। ফলে সাফল্যের মাত্রা নিয়ে বিতর্ক কোনওদিন শেষ হবার নয়, যাঁরা বিতর্কে মাতছেন তাঁরাই হতে দেবেন না। এও বলা বাহুল্য, প্রতিশ্রুতি যত আকাশছোঁয়া চটকদার হবে, ব্যর্থতার আশঙ্কা তত বেশি। অমন প্রতিশ্রুতি দেওয়াই অনুচিত; তবে ভোটের বাজারে খরিদ্দার ধরতে সকলেই দেন, তারপর ব্যর্থতার সাফাই গাইতে বারবার প্রতিশ্রুতির বয়ান পালটান— যাকে বলে, খেলার গোলপোস্ট সরাতে থাকেন। তার পাশাপাশি, অতীতের অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ থেকে নজর ঘোরাতে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য একেবারে আলাদা এক প্রস্থ প্রতিশ্রুতি ঘোষণা হয়— বলা চলে, নতুন মাঠে নতুন খেলার জন্য আরও গোলপোস্ট পোঁতা হয়, যথাসময়ে সেগুলিও সরতে থাকে।

এই পুরো প্রবাহের সঙ্গে পণ্য বিপণনের অবশ্যই মিল আছে। নাগরিকের ভূমিকা অনেকটা ক্রেতার মতো: প্রার্থীরা তাঁর সামনে প্রতিশ্রুতির পসরা মেলে ধরছেন, নাগরিক ইচ্ছামতো তার কোনওটাকে ভোট দিয়ে ‘কিনছেন’। তার পরেই কিন্তু মোক্ষম তফাত। পণ্যের ক্রেতা তাঁর ইচ্ছা অনুসারে, জিনিসটার যে ভাবরূপ তাঁর মনে গাঁথা তার ভিত্তিতে সেটা বাছছেন ও কিনছেন; কিন্তু আগে যা বলেছি, শেষমেশ তিনি কিনছেন একটা নির্দিষ্ট বাস্তব জিনিস, দেখা যায় ধরা যায়; বা নির্দিষ্ট পরিষেবা, যার বাস্তব উপকার হাতে হাতে পাওয়া যায়। নির্বাচনী ইস্তাহারের ‘পণ্য’ বাস্তব নয়, প্রতিশ্রুতি, বা আমাদের মনে সেই প্রতিশ্রুতিটারই একটা ভাবরূপ, আমাদের কল্পনায় গড়া: পুরো প্রক্রিয়াটা মানসিক, বায়বীয়— বাস্তব কিছু নেই। প্রতিশ্রুতি পূরণ হবার হলে ভবিষ্যতে; ভোট কিন্তু এখনই দিতে হবে— অর্থাৎ জিনিসটা শেষ অবধি পাই না পাই, দাম এখনই মেটাতে হবে, এবং তা কোনও অবস্থাতেই ফেরতযোগ্য নয়। পণ্য কেনাবেচার লেনদেন কখনও হয় হাতে-হাতে নগদে, নয়তো লিখিত বা অলিখিত চুক্তি মারফত। ব্যবসাবাণিজ্যে প্রতিশ্রুতি আবদ্ধ হয় চুক্তিতে, তার একটা আইনি ভিত্তি থাকে; ফলে কার্যত সম্ভব হোক না হোক, চুক্তিভঙ্গ হলে আইনি প্রতিকারের সম্ভাবনা থাকে। রাজনীতিকের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কেবল কথার কথা।

প্রচার ও বিপণনের ‘গল্পের’ ধাঁচটাও রাজনীতির ক্ষেত্রে বদলে যাচ্ছে, বদলাচ্ছে কল্পনার ভূমিকা। কল্পনা সম্বন্ধে দার্শনিক হান্না আরেন্টের একটা বিখ্যাত আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক। আরেন্ট বলছেন, কল্পনা ব্যবহার করা যায় দুটো উদ্দেশ্যে: মিথ্যা বলতে অর্থাৎ তথ্যের অপলাপ করতে, এবং গঠনমূলকভাবে তথ্য অর্থাৎ বাস্তবের সংস্কার করে সমাজে পরিবর্তন আনতে।৫২ আরেন্টের কাছে দুটো সম্ভাবনা পুরোপুরি বিপরীত। তাঁর নাৎসি জার্মানির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে, এবং এই মন্তব্য পেন্টাগন পেপার্স অর্থাৎ ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে আমেরিকার অমানবিক দ্বিচারিতার নথি প্রসঙ্গে; সেই প্রেক্ষাপটে তাঁর আপসহীন অবস্থান প্রত্যাশিত ও যুক্তিযুক্ত। তিনি যে শব্দটা ব্যবহার করছেন, তা সোজাসুজি ‘মিথ্যাভাষণ’ (lying)। ‘মিথ্যা’ শব্দটায় অন্তর্ঘাতী অসত্যের ব্যঞ্জনা গভীর ও সর্বাত্মক: মিথ্যা কেবল অন্যের ক্ষতি করে না, মিথ্যাচারীর নিজের সত্তা বিনষ্ট করে। বিশেষত রাষ্ট্র যখন মিথ্যার শক্তিতে চালিত হয়, মিথ্যার বর্ম ধারণ করে, দেশের ও মানবজাতির সমূহ দুর্দিন।

সৌভাগ্যক্রমে আমাদের মতো বহু মানুষ— বলতে পারলে ভাল লাগত, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ— রাষ্ট্রের নানা উপদ্রব সত্ত্বেও হিটলারি ঢঙের শাসন ভোগ করি না। আরেন্ট যে নির্মম বৈপরীত্য দেখছেন কল্পনাশ্রয়ী ইতিবাচক সংস্কার আর মিথ্যাশ্রয়ী বিপর্যয়ের মধ্যে, তার বদলে আমরা বাস করি রাষ্ট্রিক জীবনের একটা মধ্যভূমিতে যেখানে কল্পনা আর বাস্তব, আদর্শ সাংবিধানিক নীতি আর অনুদার বিশৃঙ্খল শাসনরীতির মধ্যে একটা সহনীয় ভারসাম্য কাজ করছে। এমন দেশে সত্যি উন্নয়ন হয়, সমাজেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। পাশাপাশি থাকে নানা মাত্রায় নানা অনাচার; আরও মৌলিকভাবে, নাগরিক জীবনের শর্ত হিসাবে মানতে হয় রাষ্ট্রের আধিপত্য, আর সেই আধিপত্যের সমর্থনে কোনও না কোনও অবতারে জাতীয়তাবাদী আখ্যান। সেই আখ্যানে (অর্থাৎ গল্পে) ইতিহাসের বাস্তব তথ্য আর ভাবাদর্শের অলীক উপজীব্য লুকোচুরি খেলে। জাতীয় জীবনকে সেই ভাবাদর্শের নিরিখে কেবল দেখা হয় না, চালিত করা হয়।

পণ্য বিপণনের গল্পে বাস্তব আর কল্পনার লুকোচুরির বিবরণ দিয়েছিলাম। রাজনৈতিক ‘বিপণন’-এর গল্পে অনুরূপ কিছু দেখা যাচ্ছে, সঙ্গে যোগ দিচ্ছে নতুন জটিলতা। পণ্য বিপণনের প্রক্রিয়া সহজ সরল: জিনিসটা কিনলাম, মিটে গেল— নাও কিনতে পারি, সেটুকু ‘চয়েস’ আমার আছে। কেনার পর কখনও কখনও বিক্রেতার সঙ্গে যোগ থাকতে পারে, ‘আনুগত্যের’ প্রশ্ন উঠতে পারে, কিন্তু তা গৌণ ব্যাপার। শাসকপক্ষের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক নিবিড় ও অপরিহার্য, অথচ অসম। ব্যক্তি নাগরিকের উপর রাষ্ট্রের ক্ষমতা কমবেশি প্রকট কিন্তু সব সময়েই প্রবল; রাষ্ট্রের দরবারে নাগরিকের অধিকার সে তুলনায় দুর্বল ও অনিশ্চিত। সাংবিধানিক অধিকার আদায় করা প্রায়ই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তার চেয়ে বড় কথা, সেই অধিকার যতই সুনির্দিষ্ট হোক, সমাজের ভাবাদর্শ বদলাতে থাকে, ফলে দুটোর মধ্যে ব্যবধান বাড়তে থাকে। শেষ অবধি অধিকারের আক্ষরিক বয়ান যদি নাও পালটায়, নাগরিক চেতনায় তার সংজ্ঞা পালটে যায়, নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।

কথায়-কথায় নির্বাচনের প্রসঙ্গ থেকে বৃহত্তর নাগরিক জীবনের প্রসঙ্গে চলে এসেছি: কোনও রাজনৈতিক দল বা ভোটপ্রার্থী নয়, পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার কথায়, রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তি-নাগরিকের স্থায়ী সার্বিক সম্পর্কের কথায়। সম্পর্কটা দেখা যাচ্ছে বেজায় জটিল, ভাব আর বাস্তবের যোগটা যেমন ভাবছিলাম তা নয়। ভাবাদর্শের দিকটা বহুমাত্রিক ও বহুবিভক্ত, একটা অংশের সঙ্গে আর একটা মেলে না। সেখানে আছে: এক, অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল একটা আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামো; দুই, তার লক্ষগুণ জটিল, অস্থির ও অসংগতিতে দীর্ণ ইতিহাসের স্মৃতি (এবং কিছু মোক্ষম বিস্মরণ); তিন, তার উত্তরাধিকার হিসাবে আজকের সামাজিক আবহ; চার, অজস্র রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংগঠনের নিজস্ব ও প্রায়ই পরস্পরবিরোধী অবস্থান; এবং পাঁচ, ব্যক্তি-নাগরিকের চেতনায় এই পুরো সংমিশ্রণের একান্ত নিজস্ব ও আংশিক প্রতিফলন।

এত উপাদান মিলিয়ে, অসংখ্য চরিত্র আর পটভূমি জুড়ে বিবর্তিত হয়ে চলেছে বিশাল একটা গল্প: এদেশে আমরা যমক অলঙ্কার প্রয়োগে বলতে পারি, একটা ‘মহাভারত’। দেশভরা মানুষের সুখ দুঃখ ভালমন্দ, ইতিহাস জীবনযাত্রা কৃষ্টি চিন্তা উজাড় করে এই উপলব্ধির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। খুব পণ্ডিত মানুষও তার কণামাত্র ভাল করে বোঝেন, কিন্তু অল্পবিস্তর নাগাল পান সকলেই, যত না সজ্ঞানে তার বহুগুণ বেশি সহজাতভাবে, অবচেতনে, এই দেশে বেঁচে থাকার সুবাদে। এই সার্বিক উপলব্ধি একটা দেশের অস্তিত্বের বৌদ্ধিক ভিত্তি: নিজস্ব ইতিহাসলব্ধ বয়ানে তার জাতীয় ব্যাখ্যান, national discourse। (কিছু আগে ‘জাতীয়তাবাদী আখ্যান’-এর কথা বলেছিলাম, সেটা অন্য এবং আরও অনেক সীমিত জিনিস।)

এই ব্যাখ্যানের একটা বড় ও সুপরিচিত অংশ ভাষায় ব্যক্ত ও রক্ষিত, কিন্তু তার পূর্ণ বিস্তৃতি আরও বহু মাধ্যমে, বহু প্রণালীতে: শিল্প-সংগীত, নির্মাণ-স্থাপত্য, আচার-প্রচলন ক্রিয়াকর্ম, অব্যক্ত ভাব আর বিশ্বাস— কত বলব? সবটা মিলে যেন দেশের ভরপুর অস্তিত্ব বোঝাতে একটা সর্বব্যাপী সংকেতমালা, বা বলা চলে ‘অতিভাষা’: বিশাল, অসম্ভব জটিল, অসংখ্য চিহ্ন ও প্রতিরূপের সমষ্টি। যদি ভাষার সংকেতপ্রণালীর সঙ্গে তুলনা করি, বাংলা ইংরেজির মতো অক্ষরলিপিতে কুলোবে না, বরং সাদৃশ্য পাওয়া যাবে চিনা জাপানির মতো ভাবসাংকেতিক (ideogrammatic) ভাষায়, যেখানে প্রত্যেক বস্তু বা ভাবের জন্য আলাদা চিহ্ন বা যুক্তচিহ্ন আছে। এ ছাড়া যে কথাটা আগে ভাষা সম্বন্ধে বলেছি, তা এই অতিভাষা সম্বন্ধে আরও বেশি খাটে: এটা কেবল বক্তব্য প্রকাশের বাহন নয়, উপলব্ধির মাধ্যম। প্রত্যেক ভাষার গঠন ও বাচনপ্রণালী জগৎকে এক বিশেষ ভাবে দেখতে ও বুঝতে শেখায়: আক্ষরিক অর্থে ভাষার মধ্যে একটা ‘দর্শন’ বা দেখার প্রক্রিয়া নিহিত আছে। ভাষার গাঠনিক ভিন্নতার জন্য একই বিষয়কে বাংলা, চিনা ও জার্মান ভাষায় ভিন্ন বয়ানে ভিন্ন প্রেক্ষিতে ব্যক্ত করতে হয়, সেটা আর ‘এক’ বিষয় থাকে না। তেমনি (বরং আরও স্পষ্টভাবে) ভারত, চিন আর জার্মানির জাতীয় ব্যাখ্যান ভিন্ন, তার অভিব্যক্তি বহু মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন অতিভাষায়, সুতরাং তাদের জাতীয় জীবন ও ইতিহাস ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। বলা যেতে পারে, প্রত্যেক জাতীয় ব্যাখ্যানকে তার গর্ভস্থল থেকে সঞ্চারিত করছে জাতীয় জ্ঞানপ্রণালী (epistemology)।

এই প্রবহমান ব্যাখ্যান ও তার বৌদ্ধিক প্রণালী দেশের অতীতের প্রতিফলন ও ভবিষ্যতের নির্ধারক; সুতরাং শাসকবর্গের পক্ষে তার দখল পাওয়া ভীষণ জরুরি। কাজটা সহজ নয়, কারণ এই ব্যাখ্যান নিরন্তর সৃষ্টি করে চলেছে সমগ্র দেশবাসী, স্রেফ বেঁচে থেকে এবং সামাজিক জীবনযাত্রা পালন করে। সেটা সজ্ঞানে ফুটিয়ে তোলার, প্রচার ও রক্ষা করার কাজটাও অসংখ্য গোষ্ঠীর উপর ন্যস্ত: রাজনীতিকদের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় ইতিহাসবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, ধর্মগুরু, বিজ্ঞানী, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজ্ঞ ইত্যাদি। এঁদের এক-একটা গোষ্ঠীই বিশাল, বিচিত্র ও বিভক্ত, সবগুলি একত্রে তো বটেই। সেটা বাঞ্ছনীয়, কারণ এভাবেই এই বিশাল ব্যাখ্যানের অসংখ্য দিক ব্যক্ত হতে পারে। তাও একটা মৌলিক ঘাটতি থেকে যায়: উচ্চবর্গীয় ব্যাখ্যাতারা আপামর জনজীবনকে তেমন গুরুত্ব দেন না। মাঝে মাঝে তাঁদের মধ্য থেকেই এই অনুযোগ ওঠে, সংশোধনের বিক্ষিপ্ত ও প্রায়ই আত্মবিরোধী চেষ্টা হয়। পাশাপাশি আরও বিক্ষিপ্তভাবে নিজেদের অস্তিত্ব সরাসরি ঘোষণা করেন বৃহত্তর জনসাধারণের কোনও কোনও অংশ।

প্লাতোন এক আদর্শ গণরাজ্যের প্রস্তাব করেছিলেন, যার পরিচালক হবেন দার্শনিকেরা। বলা বাহুল্য, ইতিহাসে এমন রাষ্ট্রের নজির নেই। প্লাতোনের গুরু সক্রাতেসকে তৎকালীন শাসকদের রায়ে বিষ খেয়ে মরতে হয়েছিল। বোদ্ধাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক পরবর্তীকালে খুব একটা পালটায়নি। দেশের শাসকদের পক্ষে উপরোক্ত এতগুলি গোষ্ঠীর সঙ্গে আদানপ্রদান করে দেশের নাড়ির সন্ধান পাওয়া দুষ্কর; পেলেও তাঁদের লাভের আশা কম, নানা উৎপাত সৃষ্টি হবে বরং। সবচেয়ে বড় কথা, যে শাসক যত স্বৈরাচারী বা একচ্ছত্রবাদী (totalitarian), তত তাঁরা ঠিক করেন (মানতে হয়, প্রায়ই নির্ভুলভাবে) যে অত গবেষণার দরকার নেই; জাতীয় ব্যাখ্যানের কয়েকটা মাত্র উপকরণ বেছে একটা সহজ সংক্ষিপ্তসার চালু করলে তাঁদেরও সুবিধা, অধিকাংশ দেশবাসীরও। সেই সম্পাদনার ভার তাঁরা বৌদ্ধিক গোষ্ঠীগুলির একটা বশংবদ অংশের উপর ন্যস্ত করেন। সেই হুকুমবরদারের দল খাড়া করেন ছাঁচে-ঢালা অনুগত মানসিকতার উপযুক্ত করে জাতীয় ব্যাখ্যানের সরল কৃত্রিম সংস্করণ।

এ তো গেল ব্যাখ্যানের বিষয়বস্তুর কথা। সমান গুরুত্ব দিয়ে তাঁরা সেটা দেশবাসীর কাছে প্রচার করার কিছু সহজ পদ্ধতি চালু করে ফেলেন: অর্থাৎ লোকে কী জানছেন বা ভাবছেন শুধু তা নয়, কীভাবে জানছেন বা ভাবছেন সেটাও দখলে আনেন। এর ফলে লোকে ভবিষ্যতেও কী জানবেন, ভাববেন ও বলবেন, সেটা একেবারে শিকড় থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কতক বাঁধা ধাঁচের চিন্তা ও বাক্রীতি বহাল করে। কয়েকটা কৌশল আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি: অর্থলুপ্ত বাক্যের কেজো ব্যবহার; তার বিশেষ নিদর্শন হিসাবে নানা ধরনের চুম্বকবার্তা; সর্বোপরি আধুনিক বিপণনকৌশল, বিশেষ করে টিভি বা অন্য দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম ও সমাজমাধ্যমের নিবিড় ব্যবহার। (ভারতে ২০১৪র সংসদীয় নির্বাচনের তুলনায় ২০১৯এ বৈদ্যুতিন সমাজমাধ্যমে প্রচারের খরচ বেড়েছিল আনুমানিক কুড়ি গুণ, ২৫০ কোটি থেকে ৫০০০ কোটি।৫৩) এমন যত প্রণালী ও কৌশল আলাদা আলাদা করে উল্লেখ করেছি, আজকের দুনিয়ায় সবগুলির একত্র নিবিড় প্রয়োগে যে কর্মকাণ্ড চলে তাকে ‘প্রচার’ বললে কিছু বলা হয় না; সেটা নাগরিককুলের মানসিক জীবনের আদ্যন্ত নিয়ন্ত্রণ।

এক কথায়, জাতীয় ব্যাখ্যানের যে অশেষ ঐশ্বর্য, কেবল যে তার বিষয়বস্তু শোচনীয়ভাবে সংকুচিত হয় তাই নয়, তার উপলব্ধি আর ব্যাখ্যাও সংকীর্ণ ও দুর্বল হয়ে পড়ে, বিপন্ন হয় নাগরিক চেতনা ও বোধশক্তি। তবু বোঝা সহজ বলে, এবং নিজেদের জীবনে চটজলদি প্রয়োগ করা যায় বলে (সেভাবেই ব্যাখ্যানটা গড়েপিটে নেওয়া হয়েছে) সাধারণ মানুষ তা সাদরে গ্রহণ করেন, তার বেশি কিছু শুনতে চান না। এ যেন বলা, ‘ব্যাঙ্কে লাখ টাকা আছে তো কী, সে তো আমি দেখতে ছুঁতে পারছি না, তোলাও ঝামেলা। ওটার মালিকানা ত্যাগ করে বরং নগদ হাজার টাকা বাড়ির সিন্দুকে রাখলেই যথেষ্ট।’ এর সঙ্গে একটা স্বার্থের হিসাবও থাকে। দেশবাসী নানা দায়ে জর্জর এবং নিজেদের নাগরিক ক্ষমতায়ন সম্বন্ধে হতাশ ও সন্দিহান। তাঁরা জানেন, কোনও উপকার পেতে গেলে শাসকের দাক্ষিণ্যেই তা মিলবে। সেই শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে এত সহজ মনোগ্রাহী উপায়ে মানসিক সেতুবন্ধনের সুযোগ পেলে অধিকাংশ মানুষ সোৎসাহে সাড়া দেন। বিচক্ষণ শাসকও তাঁদের ব্যাখ্যান এমন মালমশলা দিয়ে তৈরি করেন, যা জনগণের সাধারণ বিশ্বাস ও সংস্কার, এমনকী অন্ধতা ও কুসংস্কারের সঙ্গে মেলে।

এর ফলে একটা বিচিত্র পরিস্থিতি আজ নানা দেশে দেখা যাচ্ছে। বহু দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারী শাসক, যাঁদের রাজত্বের ধারা গণতন্ত্রের পরিপন্থী, এবং হয়তো যাঁদের শাসনে জনগণের আর্থিক অবস্থা, জীবনযাত্রার মান বা গণপরিষেবার উন্নতি মোটেই ঘটছে না, এত সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের অটুট সমর্থন পাচ্ছেন। খুব সম্প্রতি ইংরেজি populist শব্দটার সংজ্ঞা বিস্ময়করভাবে পালটে গেছে। সেদিন অবধি তা বোঝাত জনমুখী, হয়তো অতিরিক্ত মাত্রায় বামপন্থী অবস্থান। এক-দেড়শো বছর আগে আমেরিকায় পপিউলিস্ট পার্টি বলে একটা রাজনৈতিক দল ছিল, যেমন ছিল রাশিয়ায়, যাদের ভাবাদর্শ এই ধারার। আজ (বিশেষ করে আমেরিকায়) ‘পপিউলিস্ট’ নেতা বলা হয় ডনাল্ড ট্রাম্পকে— যাঁর রাজনীতি দক্ষিণপন্থী, আর্থিক নীতি ঘোরতর পুঁজিবাদী, চিকিৎসা পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে অবস্থান প্রবলভাবে জনবিরোধী, অথচ আমেরিকার দরিদ্র বেকার মানুষের একটা বিরাট অংশ আজও যাঁর পরম ভক্ত। আজকের পপিউলিস্ট শাসন (পপিউলিস্টদের ‘শাসন’? এককালে শব্দবন্ধটাই স্ববিরোধী মনে হত) জবরদস্ত, কর্তৃত্বপ্রিয়, স্বৈরাচারী, তার ঝোঁক একচ্ছত্রবাদের দিকে। বহু সাধারণ মানুষ তাতেই আশ্বস্ত বোধ করেন, নিজেদের প্রতিনিধিত্ব এমন শাসকের হাতে সাগ্রহে সঁপে দেন, এবং সেই শাসকের প্রতাপকে তাঁদেরই ক্ষমতায়ন হিসাবে দেখেন, যদিও তাঁদের ব্যক্তিগত পরিসর বহু দেশেই কমে গেছে বা যাচ্ছে। স্টিভ়ন লেভ়িট্‌‌স্কি ও ড্যানিয়েল জ়িবল্যাট খুব সম্প্রতি তাঁদের গণতন্ত্র কীভাবে মরে (How Democracies Die) বইয়ে একটা কথা বলেছেন, যা চল্লিশ বছর আগেও আজগুবি মনে হত: ‘পপিউলিস্টরা নির্বাচনে জিতলে প্রায়ই গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলি আক্রান্ত করে।’৫৪

পপিউলিজম শব্দটার এই অর্থে প্রয়োগ নতুন হলেও ব্যাপারটা নতুন নয়। স্বৈরতন্ত্রী ও একচ্ছত্রবাদী শাসকের ব্যাপক জনপ্রিয়তা, এবং তার প্রকাশ হিসাবে জনবাহিনী গঠন ও যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনীতির সমর্থন, হিটলার আর মুসোলিনির রাজত্বে প্রভূতভাবে দেখা গেছিল। তার সবচেয়ে কলঙ্কজনক প্রকাশ ঘটেছিল এক বিশেষ ধর্ম ও জাতির প্রতি সর্বাত্মক বিদ্বেষ ও জাতিনিধনে (genocide)। এই অধ্যায়ের শেষ পর্যায়ে ফিরে যাওয়া যাক সেই জমানার ভুক্তভোগী ও তার সমকালীন স্তালিনি জমানার ভাষ্যকার হান্না আরেন্টের কথায়।

আরেন্ট আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন এমন স্বৈরাচারী শাসকদের বিপুল জনসমর্থনের কথা।৫৫ সেই সমর্থন কোনও বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীতে আবদ্ধ থাকেনি; বরং শ্রেণিনির্বিশেষে যতটা ব্যাপক ও অটুট ছিল, কোনও সাচ্চা গণতান্ত্রিক দলের ভাগ্যে কদাচিৎ জোটে। এমনও নয় যে এই সমর্থন আদায় হয়েছিল জনগণকে ধোঁকা দিয়ে বা অন্ধকারে রেখে। বরং সেই জমানায় জাতীয় ব্যাখ্যানের (আরেন্ট অবশ্য কথাটা ব্যবহার করেননি, ধারণাটাও খুব একটা নয়) যে সরল বিকৃত রূপ চালু ছিল, জনগণের বিপুল অংশ সাগ্রহে তা সমর্থন করেছিল, হয়তো যথেষ্ট ত্যাগ ও ক্ষতি স্বীকার করে। এটা কী করে সম্ভব হয়, পরবর্তী এক অধ্যায়ে তা বিস্তারে দেখব। শুধু একটা প্রসঙ্গ দিয়ে বর্তমান আলোচনা শেষ করতে চাই।

একচ্ছত্র উৎপীড়ক শাসকগোষ্ঠীর ব্যাখ্যানে প্রায়ই একটা বড় উপাদান হয় হিংসাশ্রয়ী বিদ্বেষ— কোনও সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতি, সচরাচর ঐতিহাসিক কারণে যারা আগে থেকেই বিদ্বেষের পাত্র। সবচেয়ে কুখ্যাত দৃষ্টান্ত অবশ্যই নাৎসি জার্মানির ইহুদি নিধন। এমন মারণ-পীড়নের কারণ হিসাবে একটা উদ্ভট তত্ত্ব খাড়া করা হয়, যে দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই সংখ্যালঘুদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপন্ন। ফলে সংখ্যালঘুদের নিশানা করে সমাজে হিংসা ধিক্কার অসহিষ্ণুতার একটা আবহ সৃষ্টি করা হয়; সংখ্যাগরিষ্ঠেরা সেটা সমর্থন করে, তাদের একটা অংশ সক্রিয়ভাবে কার্যকর করতে দল বাঁধে— প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কাঠামো।

এ পর্যন্ত ব্যাপারটা পরিচিত ও বহুচর্চিত। আরেন্টের চিন্তায় তাতে আর একটা মাত্রা যোগ হয়েছে। একদিন আসে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক আর এই ব্যাখ্যান মানতে রাজি হন না। (এর পরের কথাগুলো আরেন্ট এভাবে বলেননি বা আদৌ বলেননি।) হয়তো তাঁরা ব্যাখ্যানের অসারতা সম্বন্ধে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন, হয়তো অন্য ক্ষোভ-বঞ্চনার শিকার হন। এমন সরকার প্রায়ই আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থ, এবং কখনওই মানবাধিকারের তোয়াক্কা করে না; ফলে ক্ষোভের কারণ সব সময় মজুত থাকে, অবস্থাবিশেষে ফেটে পড়ে। সে দিন এলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসযন্ত্রের আক্রোশ আছড়ে পড়ে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপর, যাঁরা এতদিন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সমাদর ও সমর্থন করেছেন, রাষ্ট্রও যাঁদের লালন করেছে। (পাঁচশো বছর আগে ইতালির কিংবদন্তি রাজনৈতিক চিন্তাবিদ মাকিয়াভেল্লির বিখ্যাত সূত্র স্মর্তব্য: শাসক চাইবেন প্রজারা তাঁকে ভয়ও করবে ভালও বাসবে, কিন্তু দুটো যদি সম্ভব না হয়, ভালবাসার চেয়ে ভয়টাই বলবৎ রাখা বেশি জরুরি।৫৬) সংখ্যাগরিষ্ঠেরাই এখন হয়ে পড়েন হিংসা ও দমন-পীড়নের শিকার, প্রতিবাদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় নৃশংস হাতে। প্রকৃষ্ট উদাহরণ ১৯৫৬এ হাঙ্গেরির সোভিয়েতবিরোধী অভ্যুত্থান ও ১৯৬৮তে চেকোস্লোভাকিয়ার ‘প্রাগ বসন্ত’। আরেন্ট এতটাও বলছেন, হিংসা-বিদ্বেষ-নিপীড়ন এমন রাষ্ট্রের মজ্জাগত ধর্ম: নিজের অস্তিত্বের তাগিদেই সে নিরন্তর একের পর এক শত্রু চিহ্নিত করে নিকেশ করতে থাকে, সমগ্র মানবজাতি অধীনস্থ হলেও রক্তক্ষয় থামে না।৫৭

এমন মানবিক বিপর্যয়ের সময়ে বৌদ্ধিক বিশ্লেষণ তুচ্ছ বা অবান্তর মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি করে দরকার, কারণ সব পাপাচারের মতো এটারও জন্ম মানুষের চেতনার বিকারে। একটু আগে দেখেছি, স্বৈরতন্ত্রী বা একচ্ছত্রবাদী রাজত্বে জাতীয় ব্যাখ্যান কত সরলীকৃত হয়: জাতীয় সত্তা প্রকাশের যে সমৃদ্ধ সংকেতমালা, তার বেশিরভাগ বাদ দেওয়া হয়, যা থাকে তাও দেখা হয় অগভীর সংকীর্ণ দৃষ্টিতে। এই বৌদ্ধিক অপশাসন বা মগজধোলাই যখন সন্ত্রাসের দ্বারা বলবৎ করতে হয়, বুঝতে হবে ব্যাখ্যানের সাংকেতিক মাত্রা একেবারেই লোপ পেয়েছে: ওটা এখন কার্যত অর্থহীন, জাতির মানসিক জীবনে তার কোনও ভূমিকা নেই, একচ্ছত্র শাসনের দমন ও ধ্বংসের হাতিয়ারে পর্যবসিত হয়েছে। সেই সঙ্গে আর একটা সংকেতপ্রণালীও লোপ পায়, তা হল সংবিধান: আরেন্টের বিশ্লেষণে, স্বৈরাচারই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অঙ্গীভূত হয়ে সাংবিধানিক ন্যায়নীতির স্থান নেয়।৫৮ শাসক যা জারি করে সেটাই ন্যায়— আছে বলেই আছে, হচ্ছে বলেই হচ্ছে: তার কোনও বিবরণ বা ব্যাখ্যার প্রশ্ন ওঠে না, চিন্তায় যুক্তিতে ন্যায়নীতির ভাষায় মেলে ধরতে হয় না।

রাষ্ট্র এখন নাগরিকের সঙ্গে আদৌ কথা বলতে চায় না, শক্তির আস্ফালনে আধিপত্যের বার্তা পাঠাতে চায় কেবল। ধরে নিতে হয় রাষ্ট্রের আর স্বপক্ষ সমর্থনের কোনও অবলম্বন নেই, নিজের চোখেও নিজেকে প্রমাণ করার মতো রসদ নেই, যান্ত্রিকভাবে শাসনক্রিয়ার মহড়া চালিয়ে যাচ্ছে। শেকসপিয়রের নাটকে ম্যাকবেথের শেষ দশায় এই পরিস্থিতির একটা বিধ্বংসী চিত্র পাওয়া যায়। ম্যাকবেথও ভাষার দৈন্য বোধ করেছিল, এমনকী পত্নীর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশের জন্য: ‘There would have been a time for such a word.’৫৯ শব্দের সংকেত ব্যবহার হয় মানবিক বা মানসিক ভাব প্রকাশ করতে; এমন ভাবই আর রাজত্বে অবশিষ্ট নেই। ঘটে গেছে রাষ্ট্রীয় স্তরে ভাষার সার্বিক বিপর্যয়, failure of language; গালভরা বক্তৃতা সেই অসারতার প্রকাশ। শাসকের এখন একমাত্র ভরসা হিংসা-উৎপীড়ন: লাঠি-গুলির ভাষা সব দেশেই এক।

শেষ অবধি তাই পণ্ডিতি বিশ্লেষণের চেয়ে লাগসই মনে হতে পারে নাৎসিবিরোধী যাজক মার্টিন নাইমোয়েলারের কবিতায় এক জার্মান নাগরিকের খেদোক্তি: ‘ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের ধরতে এল; আমি কিছু বললাম না, কারণ আমি তো কমিউনিস্ট নই। তারপর শ্রমিকনেতাদের ধরতে এল; আমি কিছু বললাম না, কারণ আমি তো শ্রমিকনেতা নই। তারপর ইহুদিদের ধরতে এল; আমি কিছু বললাম না, কারণ আমি তো ইহুদি নই। শেষে একদিন আমাকেই ধরে নিয়ে যেতে এল; তখন দেখলাম, আমার হয়ে বলার কেউ বাকি নেই।’ সেই সহায়হীন নিঃসঙ্গতার দিনে কথা বলার লোক থাকবে না, থাকবে না ন্যায়-যুক্তি-আবেদননির্ভর বিচারব্যবস্থা। ভাষার তাই দরকার হবে না, বা বৃহত্তর জীবন ও ভাবজগতের ইঙ্গিতকারী কোনও সংকেতমালার। আয়ুষ্কালের বাকিটুকু জুড়ে থাকবে শুধু তাৎক্ষণিক মৌন বাস্তব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *