রায় পিথৌরার কলমে
০১.
একদা হিন্দুকুশের উত্তরপ্রান্ত ও পারস্যের পূর্ব সীমান্তের বহিক ও কপিশা, গান্ধার (বর্তমান বখ, কাবুল, জালালাবাদ) এইসব অঞ্চল ভারতের অংশরূপে গণ্য করা হইত এবং এইসব প্রদেশ হইতে বহু বিদ্যার্থী ভারতে আগমনপূর্বক বিদ্যাভ্যাস করিত। পরবর্তী যুগে নালন্দা-তক্ষশিলায় দূরতর দেশ হইতে আগত বহু ছাত্র বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের চর্চা করিত, এ তথ্যও আমাদের অবিদিত নহে।
বৌদ্ধধর্মের পতনের পর মুসলমানরা এই দেশের বড় বড় নগরে বিস্তর মক্তব-মাদ্রাসা স্থাপনা করেন। প্রাচীন পন্থানুযায়ী তুর্কিস্থান, বখ, কাবুল, জালালাবাদ হইতে পূর্বেরই ন্যায় বহু মুসলমান ছাত্র এই দেশে জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য আগমন করিত। অদ্যাবধি বহু উজবেগ (বাংলায় তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত উজবুক), হাজারা, আফগান তুর্কমান ভারতের দেওবন্দ, রামপুর, রাদের মাদ্রাসায় আগমন করিয়া ন্যূনাধিক চতুর্দশ বৎসর যাপন করত শেষ উপাধি গ্রহণ করিয়া স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করিত। ভারতবিভাগের পরও এ স্রোতধারা অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে; কারণ পাকিস্তানে দেওবন্দ, রামপুরের মতো উচ্চ শ্রেণির বিদ্যায়তন নাই।
ব্রিটিশ যুগে ইতিহাস অন্যরূপ ধারণ করিল। ব্রিটিশ স্কুল-কলেজে যে শিক্ষা দিল, আমরা তাহা বাধ্য হইয়া গ্রহণ করিলাম, কিন্তু আমাদের প্রতিবেশীরা এই শিক্ষা যে কতদূর পদার্থহীন, তাহা সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইয়া আপন সাধ্যমতো স্বদেশে বিদ্যায়তন নির্মাণ করিতে যত্নবান হইল। এই ব্যবস্থা ইংরেজেরও মনঃপূত হইল। পৃথিবীর সহিত আমাদের যোগসূত্র যত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয় ইংরেজের স্বার্থ ছিল সেই দিকে।
স্বরাজ লাভের পর আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি যে উন্নততর হইয়াছে তাহা নহে, কিন্তু আমাদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করার জন্য পুনরায় একটি ক্ষীণ স্রোত বাহিয়া অল্পবিস্তর বিদ্যার্থী এই দেশে আগমন করিতেছে।
বার্লিন, ভিয়েনা, প্যারিস, জিনিভা উদ্বাহু হইয়া বিদেশাগত ছাত্রকে অভ্যর্থনা করে, তাহাদের সুখ-সুবিধার জন্য বহু প্রকারের ব্যাপক ব্যবস্থা করে। এই দেশে সেই জাতীয় কোনও আন্দোলন অদ্যাবধি আরম্ভ হয় নাই।
তাই যখন দিল্পির জনৈক প্রধান রাজকর্মচারী কয়েকদিন পূর্বে দিল্লিবাসী বিদেশি ছাত্রদের নিমন্ত্রণ করিয়া আদর আপ্যায়ন করিলেন তখন আমার অবিমিশ্র উল্লাস হইল। নিমন্ত্রণাগত একটি ছাত্র বলিল যে, প্রায় দুইশত বিদেশি ছাত্র দিল্লিতে অধ্যয়ন করিয়া থাকে এবং তাহাদের একটি আপন প্রতিষ্ঠানও আছে।
পূর্ব আফ্রিকাগত দুইটি নিগ্রো ছাত্রের সঙ্গে পরিচয় হইল ও তাহাদিগের সঙ্গে আলাপ করিয়া হৃদয়ে বড়ই আনন্দ হইল। অতিশয় ভদ্র এবং নম্র স্বভাব এবং মনে হইল, এই দেশের প্রতি তাহারা ভক্তি পোষণ করে। আমাকে বিনয় এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিল– তাহা হইতে তাহাদিগের বুদ্ধিবৃত্তির তীক্ষ্ণতাও অনুভব করিলাম। নিমন্ত্রণ হইতে প্রত্যাগমনের সময়ে আমাকে তাহারা পূর্ব আফ্রিকায় সহৃদয় নিমন্ত্রণ জানাইল।
দিল্লিবাসীর কর্তব্য ইহাদিগের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করিয়া ইহাদিগকে আতিথেয়তা প্রদর্শন করা এবং সঙ্গে সঙ্গে আপন জ্ঞান অভিজ্ঞতার পরিধি প্রসার করা। রাষ্ট্রের কর্তব্য ইহাদিগের প্রবাসক্লেশ লাঘব করিবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা।
***
এই শীতে বঙ্গদেশ হইতে যাহারা দিল্লি আগমন করিবেন, তাহাদিগকে আরও সদুপদেশ দিবার বাসনা হইতেছে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে দেখিতে পাই বহু সদুপদেশ বহুতর অমঙ্গলের সৃষ্টি করিয়াছে– অতএব নিবেদন, যাঁহারা সস্ত্রীক আসিবেন, এই উপদেশ তাঁহাদের জন্য নহে। কারণ আমার উপদেশ যদি গৃহিণীরা মাত্রাজ্ঞান হারাইয়া পালন করেন, তবে দাম্পত্যকলহ শুরু হইবার সমূহ সম্ভাবনা এবং বঙ্গভূমে প্রত্যাবর্তন করিবার পাথেয় অবশিষ্ট না থাকিবার গুরুতর ভয়ও রহিয়াছে। সবিস্তর নিবেদন করি।
চাঁদনি চৌকে গৃহিণী কত বস্তু ক্রয় করিবেন, তাহার অল্পবিস্তর ধারণা আপনার হয়তো আছে, কিন্তু অধুনা ভারত সরকার দিল্লিতে যে কটেজ ইন্ডাস্ট্রিস এম্পোরিয়াম প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন, তাহাতে গৃহিণী প্রবেশ করিলে আপনার কী দুরবস্থা হইবে, তাহার কল্পনা আমি করিতে অক্ষম। অমৃতশহর হইতে ডিব্ৰুগড়, কুমায়ুন হইতে কন্যাকুমারী পর্যন্ত যত প্রকারের কুটির শিল্প আছে, তাহার তাবৎ নিদর্শন সরকার এই গৃহে সঞ্চয় করিয়া এক বিরাট প্রদর্শনী খুলিয়াছেন।
তাহাতে কাহার আপত্তি, কিন্তু হায় সেইগুলো বিক্ৰয়ার্থে। যাদুঘরে গৃহিণীকে লইয়া যান। পরমানন্দে, নির্ভয়ে। মানিব্যাগ, চেক বুক-পকেটে বিরাজমান– কোনও ভয় নাই– গৃহিণী অশোকস্তম্ভ কিংবা যক্ষিণীর প্রতিমূর্তি ক্রয় করিতে চাহিলেও আপনাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত হইতে হয় না, কিন্তু এই হলে যমুনার স্রোত পর্বতাভিমুখী। সরকার এই প্রতিষ্ঠানে যেসব তরুণীদিগকে নিযুক্ত করিয়াছেন, তাহারা বিক্রয় করার কলাকৌশল এমনি মোক্ষম আয়ত্ত করিয়াছে যে, আমার গৃহিণীর মতো কৃপণাও লোহিত-বর্তিকা প্রজ্বলন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন (এই বিষয়ে অত্যধিক বাক্যব্যয় করিব না, আমি আমার দাম্পত্যজীবনে শান্তি কামনা করি)।
যদিও-বা আপনি এই কুম্ভীরের চক্ষুতে ধূলি নিক্ষেপ করিতে সমর্থ হয়েন, তথাপি আপনার জন্য দিল্লিতে আর একটি ব্যাঘ্র রহিয়াছে।
কাশির সরকারের নিজস্ব কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠান।
বড়ই মনোরম বিপণি। কত প্রকারের শাল-দুশালা, পট্টু-ধোসা, পাপিয়ের মাশের কলাসামগ্রী, ধাতুনির্মিত তৈজসপত্র দেখিতে দেখিতে আপনার গৃহিণী চঞ্চল হইয়া উঠিবেন, তাহার নিশ্বাস ঘন ঘন বহিতে থাকিবে, কল্পনার চক্ষে তিনি দেখিবেন কোন শাল ক্রয় করিলে তিনি ডলি মলি তাবৎ সুন্দরীদিগকে কলিকাতার সান্ধ্যক্লাবে নির্মমভাবে পরাজয় করিতে সক্ষম হইবেন আর আপনিও সঙ্গে সঙ্গে রক্তবর্তিকার যে বিভীষিকা দেখিতে পাইবেন, তাহার কল্পনা করিয়া আমার বিঘ্নসন্তোষী হৃদয় বিপুলানন্দ লাভ করিতেছে। আমার নিজস্ব নিদারুণ অভিজ্ঞতা এই স্থলে বর্ণন করিব না।
ধর্ম বলেন, আমার অনুচিত এইসব প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করা, কিন্তু আমি নিরুপায়। দিল্লিতে বাস করি, এই দুইটি মনোরম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমি সুপরিচিত। আমার কি কর্তব্যবোধ নাই যে, আপনাদিগকে সত্যসুন্দর মঙ্গলের সন্ধান দিব না? আমি কি এতই কাপুরুষ যে, সামান্যা অবলাদিগের ভয়ে সত্য গোপন করিব?
অবশ্য আমার সাহস সম্পূর্ণ অন্য কারণে। আনন্দবাজারের স্কন্ধ কর্তন করিলেও সেই মহাজনগণ আপনাকে আমার বাসস্থানের উদ্দেশ দিবেন না। তাহারা নরহত্যার ঘোরতর বিরোধী। আপনার মঙ্গলও তাহারা সর্বান্তঃকরণে কামনা করেন।
***
প্রাচ্য-প্রতীচ্যের দার্শনিকগণ দেহলিপ্রান্তে সমবেত হইয়া সপ্তাহাধিক কাল নানা প্রকারের গবেষণা আলোচনা করিবেন। ইহাদিগের প্রধান উদ্দেশ্য হইবে কী প্রকারে উভয় ভূখণ্ডের জ্ঞানবিজ্ঞান একত্র করিয়া পৃথিবীতে সত্যশিবসুন্দরের শাশ্বত প্রতিষ্ঠা করা যায়।
ফ্রান্স, জর্মনি, সুইটজারল্যান্ড, ইতালি, ইংলন্ড, জাপান, মিশর, তুর্কি, সিংহল, আমেরিকা ও ভারতের দর্শন-শার্দূলগণ ইতোমধ্যে স্ব স্ব সহানুভূতি ও সহযোগিতা স্থাপন করিয়া পত্র বিনিময় করিয়াছেন।
দর্শনের সেবা করিবার সৌভাগ্য না ঘটিয়া থাকিলেও দার্শনিকদের সেবা করিয়াছি বলিয়া ইহাদের সকলেই আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত নহেন।
বিশেষত জর্মনির অধ্যাপক হেলমুট ফন প্ল্যাজেনাপ। সংস্কৃতে ইহার পাণ্ডিত্য গভীর এবং বর্তমান ভারতের সঙ্গেও তাহার বিলক্ষণ পরিচয় আছে। ইহার অন্যতম পুস্তক বুদ্ধ হইতে গাঁধী পুস্তক পাঠ করিয়া আমি পুনঃপুন সাধুবাদ দিয়াছি। ইনি একাধারে দার্শনিক, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক এবং আলঙ্কারিক। তাঁহার ভারত-প্রেম অতুলনীয়। ইনি জর্মনির পক্ষ হইতে ভারত আগমন করিবেন।
তাঁহার পিতা জর্মন ব্যাঙ্কে বহুকাল একচ্ছত্রাধিপত্য করিয়াছেন। তিনিও ভারতীয় বহু বিদ্যায় সুপণ্ডিত। স্পস্ট স্মরণ নাই, তবে বোধ হইত তিনি কবি ইকবালের সতীর্থ ছিলেন। তাঁহার কাব্যাংশ জৰ্মনে অনুবাদ করিয়া ইকবাল তাই লইয়া গৌরব অনুভব করিতেন।
পাঠক, দেহলি-প্রান্তের এই আসন্ন সভার প্রতি দৃষ্টি রাখিলে তুমি লাভবান হইবে।
.
০২.
কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা দপ্তরের প্রধান সেক্রেটারি ডক্টর তারাচান্দ ভারতীয় রাজদূতরূপে ইরান যাইতেছেন।
ডক্টর তারাচান্দ যুক্তপ্রদেশ তথা দিল্লি অঞ্চলে সুপরিচিত। সংস্কৃত, ফারসি আর উর্দু এই তিন ভাষাতে তাহার অসাধারণ পাণ্ডিত্য বহু বিদ্বজ্জনের প্রশংসা অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছে। ভারতে মুসলিম সংস্কৃতির আবেদন সম্বন্ধে তিনি যে গবেষণা করিয়াছেন, তাহাতে যে শুধু তাহার পাণ্ডিত্যই প্রকাশ পাইয়াছে তাহা নহে– চিত্র, সঙ্গীত, নাট্যকলায় তাঁহার সূক্ষ্ম রসানুভূতি তাঁহার পুস্তকরাজিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করিতে সক্ষম হইয়াছে। দারাশিকুহর সম্বন্ধে তাহার প্রামাণিক প্রবন্ধ দেশে-বিদেশে অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করিয়াছে। পণ্ডিত তারাচান্দ শব্দ এবং ধ্বনিতত্ত্বে সুপণ্ডিত বলিয়া দারার যুগের সংস্কৃত উচ্চারণ কিরূপ ছিল তাহা তিনি দারাকৃত সংস্কৃত শব্দের ফারসি লিখন পদ্ধতি হইতে উদ্ধার করিতে সমর্থ হইয়াছেন। তারাচান্দের সংস্কারবর্জিত মন হিন্দু-মুসলমান উভয় বৈদগ্ধ্যের সম্পূর্ণ সম্মান দিতে সক্ষম হইয়াছে।
ইরান এবং মিশরে এতদিন যাবৎ দুইজন মুসলমান ভারতীয় রাজদূত ছিলেন। কাজেই ওই দেশবাসীদের মনে এই ভুল ধারণা হওয়া অসঙ্গত নয় যে, ভারতবর্ষের হিন্দুরা বুঝি আরবি-ফারসির চর্চা করেন না এবং মুসলমানেরাও বুঝি সংস্কৃত, হিন্দি তথা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন।
মৌলবি তারাচান্দ যখন উত্তম উচ্চারণ সহযোগে রুমি-সাদি, হাফিজ-আত্তারের বয়েত আওড়াইয়া ইরানের মজলিস-মুশায়েরা সরগরম করিয়া তুলিবেন তখন যে তিনি অকুষ্ঠ প্রশস্তিকীর্তন শুনিতে পাইবেন তাহার কল্পনা করিয়াও আমরা উল্লাস বোধ করিতেছি।
ডক্টর তারাচান্দের যাত্রা জয়যুক্ত হউক।
***
শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং ছাত্র, নেপাল যাদুঘরের ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ শ্ৰীযুত বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের চিত্রপ্রদর্শনী দিল্লিতে সুরসিকজনের প্রশংসা অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছে।
হিন্দুর যেমন শাক্ত-বৈষ্ণব, মুসলমানের যেমন শিয়া-সুন্নি, ইংরেজের যেমন লেবার কনসারভেটিভ, দিল্লির তেমনি অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্টস্ সোসাইটি এবং শিল্পীচক্র। প্রথমটি আভিজাত্যাড়ম্বরে আমন্ত্রিত। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং অত্যন্ত অনটনের সময় অর্থমন্ত্রী ইঁহারাই এই প্রতিষ্ঠানের শিল্পপ্রদর্শনী উপলক্ষে হোতা হইবার অধিকার ধারণ করেন। বিদেশাগত যাবতীয় রাজদূতমণ্ডলী, তাহাদের ভামিনীকামিনীগণ নগরশ্রেষ্ঠী, ধর্মাধিকারী এবং তাহাদের পুত্রকলত্র এইসব প্রদর্শনীতে যোগদান করিবার জন্য যেসব রথ আরোহণ করিয়া আগমন করেন একমাত্র সেইগুলিকেই পরিবেক্ষণ করিবার জন্য রবাহূত অনাহূতগণ যজ্ঞশালার প্রান্তভূমিতে দ্বিতীয় শিল্পপ্রদর্শনীর আয়োজন করিয়া ফেলে।
উত্তম উত্তম চিত্র প্রদর্শিত হয়। দৈনিক মাসিক সর্বত্র সাধুবাদ মুখরিত হইয়া উঠে। নিজেকে ধন্য মনে করি। সার্থক আমাদের দিল্লিবাস!
আর শিল্পীচক্র নিতান্তই অঘ্রাহ্মণ শ্রেণির জনপদ প্রচেষ্টা। ইহাতেও উত্তম উত্তম চিত্র প্রদর্শিত হয়। মন্ত্রিবর্গ সচরাচর এই স্থলে আগমন করিবার সময় করিয়া উঠিতে পারেন না, তবে বিদেশাগত রাজদূতমণ্ডলীর সুরসিক দর্শকেরা শিল্পীচক্রকে অপাঙক্তেয় করিয়া রাখেন নাই। অনেকেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া অতিশয় সৌজন্যের সঙ্গে জীর্ণবাস শিল্পীর সঙ্গে আলাপ পরিচয় করেন। তাঁহাদের ললনাগণ উদার স্মিতহাস্যে শিল্পীকে আপ্যায়িত করেন।
দুইটি প্রতিষ্ঠানই দিল্লিনগরের জন্য প্রয়োজনীয়। উভয়েই আপন আপন আদর্শ পালন করিবার চেষ্টা করিতেছেন।
অর্থাভাবে শিল্পীচক্র অনেক সময় আপন প্রদর্শনীগুলিকে অনাড়ম্বর এমনকি জীর্ণ বেশে পরিবেশন করেন। রসিকজন তাহাতে দুঃখিত হন, কিন্তু বিচলিত হন না। কদলীপত্র অতিথি-সেবকের দৈন্যের পরিচয় দিতে পারে সত্য, কিন্তু তাই বলিয়া কদলীপত্রে আতপান্ন ভক্ষণ বিস্বাদ প্রতীয়মান হয় না, কিন্তু সে দৈন্য রুচিহীনতার পরিচয় দেয় না। বিনোদবিহারীর চিত্র চিত্র-বিচিত্ররূপে পরিবেশিত হয় নাই। রসিকজন তাহাতে বিন্দুমাত্র চিত্তচাঞ্চল্য প্রকাশ করেন নাই। তাহার কলাপ্রচেষ্টা অনায়াসে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছে।
কিন্তু এই সংসারে কাণ্ডজ্ঞানহীনেরও অভাব নাই। রসবোধ তাহাদের নাই জানি কিন্তু কিঞ্চিৎ বুদ্ধি থাকিলে অরসিকজন আপন রসহীনতা প্রকাশ করে না। এস্থলে যে ব্যক্তি বিনোদবিহারীর নিন্দা করিয়াছেন তিনি রস হইতে বঞ্চিত সে তত্ত্ব আমরা বিলক্ষণ জানি, কিন্তু তিনি যদি ভাষণ না করিতেন, তবে হয়তো পণ্ডিতরূপেই শোভাবর্ধন করিতেন। তাহাতে আমাদের কিছুমাত্র আপত্তি নাই; শুধু যে নগরে গুণীজনের অহেতুক নিন্দা হয় সে নগরের নাগরিকমাত্রই নিজেকে বিড়ম্বিত মনে করেন।
***
কলিকাতা মহানগরীতে ফুটবল খেলা দেখিবার মতো ধৈর্য এবং শক্তি আমার আর নাই এবং দিল্লি শহরে দেখিবার মতো প্রবৃত্তিও নাই।
এক বন্ধু বলিলেন, বিবেচনা করে এই রাজস্থান এবং পূর্ববঙ্গের মল্লযুদ্ধ যদি তুমি দেখিতে চাও তবে তোমাকে অন্ততপক্ষে তিনশটি রৌপ্যমুদ্রা ব্যয় করিয়া কলিকাতা গমনাগমন করিয়া তাহা দেখিতে হইবে। অপিচ, উভয়পক্ষের যুযুধান ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে সমবেত। দিল্লীশ্বর বা জগদীশ্বর বলিলে যেখানে সামান্যতম অতিশয়োক্তি হয় মাত্র সেই রাষ্ট্রপতি সশরীরে উপস্থিত থাকিয়া ক্রীড়াজনিত ক্ষাত্রধর্মের উৎসাহ উদ্দীপনা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিবেন, সে স্থলে তুমি ন্যূনাধিক তিনটি রৌপ্যমুদ্রা ব্যয় করিতে কুণ্ঠা বোধ করিতেছ? হা ধর্ম! ঘোর কলিকাল! ধিক্ তোমাকে!
সবিনয় প্রশ্ন করিলাম, মূল্য-পত্রিকা ক্রয় করিবার জন্য কত প্রহর পূর্বে কুরুক্ষেত্রের প্রধান তোরণে উপস্থিত হইতে হইবে?
সবিস্ময়ে উত্তর করিলেন, এ কী বাতুলের প্রশ্ন? অর্ধঘণ্টাই প্রশস্ত।
এই সুসংবাদ শুনিয়া চিত্তে পুলক সঞ্চারিত হইল না। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের পীঠস্থান কলিকাতা নগরে মল্লযুদ্ধ দেখিতে হইলে দ্বাদশপ্রহর পূর্বে মৃতলবণ তৈলতণ্ডুলবস্ত্রইন্ধন বন্ধুবান্ধবসখাসজ্জন লইয়া উপস্থিত হইতে হয়, আর এই মহানগরী ইন্দ্রপ্রস্থে মাত্র অর্ধঘণ্টা।
আমার দ্বিধা অমূলক নহে। ইন্দ্রপ্রস্থের সজ্জনগণ মক্রীড়া নিরীক্ষণ করিলেন, ঈষৎ উত্তেজিত হইয়া করতালি দিলেন, যত্রতত্র অবান্তর সমালোচনা করিলেন, ভদ্রজনোচিত পদ্ধতিতে উভয় পক্ষের মঙ্গল কামনা করিলেন এবং ক্রীড়াশেষে দুঃখে অনুদ্বিগ্নমনা সুখে বিগতস্পৃহ মুনিজনের ন্যায় শান্তসমাহিত চিত্তে স্ব স্ব ভবনে প্রত্যাবর্তন করিলেন।
এইবার আমি বলিলাম, হা ধর্ম। বিকট চিৎকার, ছত্রহস্তে লম্ফঝম্প, শ্রাবণের বারিধারার মতো শোকাশ্রু আনন্দবারি বর্ষণ, মল্লবিশেষের নামোল্লেখ করিয়া তীব্রকণ্ঠে তাহার চতুর্দশ পুরুষকে অভিসম্পাত, পার্শ্বে দণ্ডায়মান, বিপক্ষানুরাগীকে নিদারুণ চপেটাঘাত, ফলস্বরূপ অনুরাগীদের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ, তস্য ফলস্বরূপ ছত্র ও পাদুকা ক্ষয়, রক্তপাত অঙ্গাঘাত, গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর জয়ী হইলে সন্দেশ বিতরণ, পরাজিত হইলে গৃহিণীকে কটু বাক্যবৰ্ষণ
কিছুই না?
এবম্বিধ ক্রীড়া দর্শনে কালক্ষেপ করে কোন সুরসিক?
.
০৩.
একই সময়ে দিল্লি শহরে দুইটি প্রদর্শনী খোলা হইয়াছে; প্রথমটিতে দুই মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তী সময়ের মধ্য ইউরোপের চিত্রতারকাগণ যে কলা সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহার নিদর্শন; দ্বিতীয়টিতে ইন্দোনেশিয়ার কলা সৃষ্টির সর্বাঙ্গসুন্দর সঞ্চয়ন।
এই দুইটি প্রদর্শনী দেখিয়া মনে পুনরায় প্রশ্ন জাগে, প্রাচ্য এবং প্রতীচ্য কি একই রসের অনুসন্ধান করিয়াছে এবং সেই রস যদি একই রস হয়, তবে তাহা উভয় ভূখণ্ডের ব্যক্তি এবং সামাজিক জীবনে কতখানি প্রসার লাভ করিয়াছে?
কলের জিনিস সস্তায় তৈয়ারি বলিয়া ইউরোপের বাড়িঘর, তৈজসপত্র, বেশ-ভূষা, এমনই এক সর্বজনীন রূপ গ্রহণ করিয়াছে যে, তাহাতে আর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য এবং ব্যক্তির রসানুভূতি প্রকাশ পায় না। স্বীকার করি, ইউরোপীয় রমণী পর্দা কিনিবার সময় আপন রুচির উপর নির্ভর করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই পর্দা অন্য লক্ষ লক্ষ পর্দার সঙ্গেই মিলিয়া যায়। পর্দার ক্ষেত্রে কোনও কোনও রমণী হয়তো নিজের হাতে তাহার উপর কিছু কিছু কারুকার্য করিয়া তাহাতে কিঞ্চিৎ বৈশিষ্ট্য আনয়ন করেন, কিন্তু টেবিল-চেয়ার, বাসন-কোসনের বেলা তাহার কিছুমাত্র অবকাশ থাকে না।
কল সবকিছু তৈয়ার করিয়া দিতেছে, সেখানে মানুষ রসসৃষ্টি করিবার অবকাশ পাইতেছে না–অথচ সেরকম মানুষ সব দেশেই আছে বিস্তর– তাহাদের তখন উপায় কী? তখন মানুষ নিত্যব্যবহার্য তৈজসপত্রকে আর কারুকার্য বিভূষিত না করিয়া সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন কলাসৃষ্টি আরম্ভ করে। ফলে চিত্র এবং ভাস্কর্য মানুষের রসসৃষ্টির মাধ্যমরূপে ব্যবহৃত হয়। তাই কলের জিনিস যেখানে সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত–দৃষ্টান্তস্থলে মধ্য ইউরোপ সেখানেই প্রচুর পরিমাণে চিত্র অঙ্কিত হয়, মূর্তি নির্মিত হয়। আমার বিশ্বাস প্যারিস-বার্লিন দুই শহরে যে পরিমাণ চিত্র অঙ্কিত হয়, সমস্ত প্রাচ্য দেশে এত ছবি আঁকা হয় না।
আর একটি তত্ত্ব এস্থলে লক্ষণীয়; নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের কোনও অভাব এইসব চিত্র পূরণ করে না বলিয়া তাহারা দশের মনোরঞ্জন করিবার চেষ্টা করে না এবং ক্রমে ক্রমে নিরতিশয় ব্যক্তি-কেন্দ্রিক হইয়া দাঁড়ায় এবং খুব বেশি হইলে মাত্র সেই গোষ্ঠীরই চিত্তবিনোদন করিবার চেষ্টা করে যাহারা রসের সংসারে সমগোত্রীয় এবং তাহার শেষ ফল এই হয় যে, এ ধরনের চিত্র এবং ভাস্কর্য অতিশয় অ্যাবস্ট্রাক্ট রূপ ধারণ করে।
***
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই মধ্য ইউরোপীয় চিত্রকলার এই পরিণতি ঘটিয়াছিল। প্যারিস যদিও বহু বৎসর যাবৎ এই আন্দোলন আলোড়নের কেন্দ্রভূমি ছিল, তথাপি বার্লিন যখন একবার এই আন্দোলন গ্রহণ করিল, তখন তাহার পরিণতি অদ্ভুত অদ্ভুত রূপ গ্রহণ করিতে লাগিল।
দিল্লির চিত্রপ্রদর্শনীতে আজ আমরা প্রধানত সেইসব চিত্রের কিয়দংশ দেখিতে পাইতেছি।
ইহাতে ভালো চিত্র নাই, এই কথা আমার বলিবার উদ্দেশ্য নহে, কিন্তু মানুষের অধীর চিত্তকে যে শান্তি দেয়, তাহার সন্ধান এই প্রদর্শনীতে বড়ই কম। যেখানে সমস্তক্ষণ চিত্রকার নূতন ভাষা, নূতন শৈলী, নূতন আঙ্গিকের অনুসন্ধানে ব্যস্ত, সেখানে দর্শক সমাহিত রসের সন্ধান করিলে নিরাশ হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কী?
গুণের দিক দিয়া অতি অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে, এই চিত্রগুলিতে প্রাণ আছে। প্রচেষ্টার ফল ভালো হউক, মন্দ হউক, প্রচেষ্টা মাত্রই দর্শকের চিত্তে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং সে চাঞ্চল্য গতানুগতিক কিংবা মৃত কলা অপেক্ষা অতি অবশ্য সর্বথা কাম্য।
***
ইন্দোনেশিয়ার কলা সেই দেশের জনসাধারণের কলা। প্রদর্শনীতে যেসব বস্তু রাখা হইয়াছে তাহার অধিকাংশই দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী। এমনকি তৈজস এবং মূর্তিগুলি পর্যন্ত হয় গৃহসজ্জায় নয় পুতুলরূপে আনন্দদানের জন্য ব্যবহৃত হয়।
এবং সর্বাপেক্ষা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, কি বালির পুতুল, কি গরুড়ের মূর্তি, কি পরিধান বস্ত্রের নকশা, কি বেতের ঝাপি, বারকোশ, কি বালা ব্রোচ আংটি, কি বাতিকের কারুকার্য সর্বত্রই স্পষ্ট বোঝা যায় এখানে কোনও নূতন শৈলীর অনুসন্ধানে উন্মত্ত নৃত্য নাই। রস কী করিয়া প্রত্যেক বস্তুটির ভিতর দিয়া প্রকাশ করিতে হয় তাহার সন্ধান ইন্দোনেশিয়ার কলাকার বহু শতাব্দী পূর্বেই পাইয়াছিলেন এবং সেই সত্যপথ ধরিয়া তাঁহারা প্রতিদিন জীবনের নিত্য ব্যবহারে আর কোন বস্তুকে আরও সুন্দর করা যায় তাহার চেষ্টা করিয়াছেন। এককালে আমাদের দেশের শিল্পীরাও প্রত্যেকটি জিনিসকে রসরূপ দিবার চেষ্টা করিতেন; এখন তাহাদের পরাজয়ের পালা আরম্ভ হইয়াছে। প্রতিদিন মিলের কাপড়, এলুমিনিয়মের বাসন আপন সাম্রাজ্য বিস্তার করিয়া চলিয়াছে। বিবেচনা করি, এমন দিনও আসিবে যখন দুর্গাপ্রতিমা কলে তৈয়ারি হইয়া এই দেশে প্রতিষ্ঠিত হইবেন।
এই প্রদর্শনীর বহু বস্তুর সম্মুখে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ভাবিয়াছি, এ জিনিসটির কি কোনও দোষ, কোনও ক্রটি নাই? স্পষ্ট ভাষায় বলি, এমন বহু জিনিস দেখিলাম যাহাতে সত্যই কোনও প্রকারের ত্রুটিবিচ্যুতি নাই। সর্বাঙ্গসুন্দর কলাসৃজনের এইরূপ অভিনব সঞ্চয়ন আমি আমার জীবনে আর কোথাও দেখি নাই।
রসবস্তু বিচারে কোনওপ্রকারের ব্যক্তিগত দুর্বলতা বা ভৌগোলিক ক্ষুদ্রতার স্থান নাই এই সত্য বারম্বার স্বীকার করিয়াও যদি নিবেদন করি, কোনও সুন্দরী রমণীর মুখে যদি আমি আমার মাতার সাদৃশ্য দেখিতে পাই তবে সেই সুন্দরী কি আমার কাছে প্রিয়তর মনে হয় না?
মাতা, ভগ্নী, সকলকেই বাল্যকাল হইতে দেখিয়াছি, ঢাকাই শাড়ি পরিতে। দাওয়ায় বসিয়া কত সহস্রবার দেখিয়াছি, বাঁশের বেড়ায় শাড়ি শুকাইতেছে এবং সেইসব পাড়ের নকশাই তো আমাকে রসশাস্ত্রের প্রথম অ আ ক খ শিখাইয়াছে। জ্বরের ঘোরে যখন বালক তাহার দৃষ্টিশক্তির কর্তৃত্ব হারাইয়া ফেলে তখন সে একদৃষ্টে তাকাইয়া থাকে মাসিমার শাড়ির পাড়ের দিকে। চেতন-অর্ধচেতন উভয় মনই বাল্যকাল হইতে আপন অজানাতে এইসব বস্তু দিয়াই তাহার শিল্পসূত্র (ক্যানস অব আর্ট) নির্মাণ করে।
অকস্মাৎ এই প্রদর্শনীতে দেখি, ঢাকাই পাড়ের নকশা! দেহলি প্রান্তের রসযজ্ঞশালার প্রান্তভূমিতে ঢাকাই নকশা অনাদৃতা। তাই অর্ধপরিচিত সমুদ্রপারে আদৃত (না হইলে এই নকশা প্রদর্শনীতে স্থান পাইবে কেন) এই নকশা দেখিয়া আমার চিত্ত অভিভূত হইয়া গেল।
প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা শ্ৰীযুত বিনোদ এবং মহারাজা উভয়ই ইন্দোনেশিয়ার কলাতে ভারতের প্রভাব সম্বন্ধে ইঙ্গিত দিয়াছিলেন। তদুপরি এই তথ্যও জানি ভারতের বঙ্গদেশ, উড়িষ্যা ও মাদ্রাজ অঞ্চলই ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে সর্বাধিক বাণিজ্য করিয়াছে। আরও জানি ঢাকাই শাড়ির নকশা উড়িষ্যা এবং মাদ্রাজ অঞ্চলে প্রচলিত নহে।
তাহা হইলে আমার সুপরিচিত ঢাকাই শাড়ির নকশাই তো এই নকশাকে অনুপ্রাণিত করিয়াছে।
তাহা হইলে আমারই অনাদৃত আমার দেশের তন্তুবায় একদা রসভুমিতে ইন্দোনেশিয়া জয় করিতে সক্ষম হইয়াছে। পাঠক আপনাকে শ্রদ্ধা করি, আপনি পারেন না। আমিও পারি নাই।
কবিগুরু কর্তৃক রচিত বালি দ্বীপ কবিতাটির কয়েকটি ছত্র এই উপলক্ষে উল্লেখ করি :
সন্ধ্যাতারা উঠল যবে গিরিশিখর পরে,
একেলা ছিলে ঘরে।
কটিতে ছিল নীল দুকূল, মালতীমালা সাথে,
কাঁকন দুটি ছিল দু খানি হাতে।
চলিতে পথে বাজায়ে দিনু বাঁশি–
‘অতিথি আমি’ কহিনু দ্বারে আসি।
তরাসভরে চকিত করে প্রদীপখানি জ্বেলে
চাহিলে মুখে; কহিলে ‘কেন এলে’।
কহিনু আমি, রেখোনা ভয় মনে–
তনুদেহটি সাজাব তব আমার আভরণে।
আধোচাঁদের কনকমালা দোলানু তব বুকে।
মকরচূড় মুকুটখানি করবী তব ঘিরে
পরায়ে দিনু শিরে।
জ্বালায়ে বাতি মাতিল সখীদল,
তোমার দেহে রতনসাজ করিল ঝলমল।
.
০৪.
ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কৌতূহল সবদেশেই আছে, কিন্তু যদি জিগ্যেস করা যায় আজ পর্যন্ত কোন দেশ সবচেয়ে বেশি কৌতূহল দেখিয়েছে এবং সেই কৌতূহল পরিতৃপ্ত করার জন্য সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করেছে কে, তা হলে সকলের পয়লা নাম নিতে হয় জর্মনির।
আর কিছু না; শুধু যদি এই মাপকাঠিই নিই, ভারতীয় ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্র, কাব্য, অলঙ্কার সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি বই লেখা হয়েছে কোন ভাষায় তা হলেই জর্মনি পয়লা প্রাইজ পেয়ে যাবে। এখানে অবশ্য এমন সব কেতাবের কথা উঠছে না যেগুলো সুদ্ধমাত্র ভারতবর্ষকে কবজা রাখার জন্য ইংরেজ লিখেছে বা লিখিয়েছে, কিংবা এমন সব কেতাবের কথাও উঠছে না যেগুলো পড়া থাকলে হাতি শিকারের সুবিধে হয় অথবা ক্রিকেট খেলার পিচ বানাবার সময় কাজে লাগে। সোজা বাংলায় যাকে বলে শাস্ত্র-চর্চা আমি সেই শীল সেই অধ্যবসায়ের কথা ভাবছি।
***
জর্মনিতেও ভারতের চর্চা আরম্ভ হয় পঞ্চতন্ত্র নিয়ে। পঞ্চতন্ত্রের পেহলভি তর্জমার আরবি তর্জমার লাতিন তর্জমার জর্মন অনুবাদ হয় টুবিঙ্গেন শহরে সেখানকার রাজার আদেশে। তার পর আঠারো আর উনিশ শতকে জর্মনি সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত আর অর্ধ-মাগধী শিখে ভারত সম্বন্ধে যে চর্চাটা করল তার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার মাথা নিচু করতে হয়। এ চর্চাতে যে শুধু ভাষাবিদ পণ্ডিতেরাই যোগ দিলেন তা নয়, জর্মন দার্শনিক, সাহিত্যিক, কবিরা পর্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে ভারতীয় চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত হলেন।
***
প্লাতো, দেকার্ত আর তার পরেই কান্ট।
দার্শনিক কান্টও যে ভারত নিয়ে চর্চা করেছিলেন এ তত্ত্ব কজন লোক জানে?
কান্টের সময় ভারত সম্বন্ধে ইয়োরোপের জ্ঞান এত সামান্য ছিল যে কান্টের পক্ষে ভারতীয় দর্শন চর্চা করা সম্ভবপর হয়নি, কিন্তু গভীর অন্তদৃষ্টি ছিল বলে যে সামান্য দু একটি খবর তিনি জানতে পেরেছিলেন তারই জোরে বলে যান, ক্রিশ্চান মিশনারিরা ভারতে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখেন, ভারতীয় পণ্ডিতরা অত্যন্ত উৎসাহ এবং সহিষ্ণুতার সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের বাণী শোনেন; কিন্তু ভারতীয়রা আশ্চর্য হল এই দেখে যে ক্রিস্টান মিশনারিদের হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে কোনও কৌতূহল নেই।
এ তত্ত্ব আজ আমরা সবাই জানি, কিন্তু আশ্চর্য সে যুগে কান্ট ওটা জানলেন কী করে? খ্রিস্টধর্ম যে এদেশে প্রচার এবং প্রসার লাভ করল না সেই তো তার প্রধান কারণ। ভাবের জগতে তো ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক অচল!
***
গ্যোটে শকুন্তলার প্রশস্তি গেয়েছিলেন তারই খেই ধরে রবীন্দ্রনাথ একখানা উত্তম প্রবন্ধ লেখেন সেকথা আমরা সবাই জানি।
তার পর বিখ্যাত কবি হাইনরিশ হাইনে কল্পনার চোখে ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভারি চমৎকার কয়েকটি কবিতা লেখেন। জর্মন ছেলে-বুড়ো কোনও ভারতীয়কে পেলেই সেসব কবিতা আবৃত্তি করে নিয়ে আনন্দ পায়। ভারতীয় গর্ব অনুভব করে–অবশ্য বলে রাখা ভালো নিছক কল্পনার উপর খাড়া বলে হাইনের কবিতাতে দু একটি বর্ণনার ভুল থেকে গেছে। গঙ্গার জলে হাইনে পদ্ম ফুটিয়েছেন এবং সেই পদ্মার সামনে হাঁটু গেড়ে পুজো করছে ভারতীয় তরুণী।
তাতে কিছু যায়-আসে না। কারণ ওদিকে আবার বশিষ্ঠ-বিশ্বমিত্রের কলহে হাইনে গণতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্রের দ্বন্দ্ব দেখতে পেয়েছেন এবং জর্মনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
***
আসল কৃতিত্ব কিন্তু জর্মনরা দেখিয়েছে বেদ উপনিষদ রামায়ণ মহাভারত পুরাণ গীতা, শ্ৰেীত সূত্র, গৃহ্য সূত্র, ষড়দর্শন, ভক্তিবাদ, অলঙ্কার, ব্যাকরণ, অর্থশাস্ত্র, কামশাস্ত্র নিয়ে।
ঋগ্বেদের অনুবাদ উনিশ শতকে হয়; তার পর তুলনামূলক ভাষা চর্চার ফলে ঋগ্বেদ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অনেকখানি বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেই পুরাতন অনুবাদই চালু থাকে। মামলারের পর ঋগ্বেদ অনুবাদ করবার মতো দুটো মাথা কটা লোকের ঘাড়ে আছে?
সেই সাহস দেখালেন আরেক জর্মন পণ্ডিত– মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেলডনার।
গেলডনারের ঋগ্বেদ-অনুবাদ আশ্চর্য বই। গ্রাসমান, লুডবিশ, ম্যাক্সম্যুলারের যুগ থেকে ১৯২০ (মোটামুটি) পর্যন্ত ঋগ্বেদ সম্বন্ধে যত প্রবন্ধ যত ভাষায় লেখা হয়েছে তার সামান্যতম মূল্যবান জিনিসও কোনও কোনও উপলক্ষে গেলনারের অনুবাদে স্থান পেয়েছে। ফলে এই হয়েছে যে আজ ঋগ্বেদ সম্বন্ধে প্রামাণিক কোনও তথ্য অনুসন্ধান করার সময় বিশ্বভুবন খুঁজে বেড়াতে হয় না– গের্ডনারের জর্মন অনুবাদখানাই যথেষ্ট।
***
কিন্তু এর শেষ কোথায়? ঋগ্বেদ সম্বন্ধে যা বলা হল তা-ও তো অতিশয় সংক্ষেপে ) এখন যদি আর তিনখানা বেদ নিয়ে আলাপ-আলোচনা আরম্ভ করি, তা হলে লিখতে হবে আরেকখানা মহাভারত এবং সে মহাভারত ব্যোটলিঙ্ক-রোটের সংস্কৃত-জর্মন অভিধানের আকার ধারণ করবে।
ব্যোটলিঙ্ক-রোটের অভিধানখানি সার্থক বই। এ অভিধানকে হার মানাতে পারে এরকম অভিধান পৃথিবীতে নেই।
এর পশ্চাতে একটুখানি ইতিহাস আছে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি জর্মনরা বলল, ভালো অভিধান ছাড়া আর তো সংস্কৃত চর্চা করা অসম্ভব হয়ে উঠল। এর একটা কিছু ব্যবস্থা করা উচিত।
ব্যোটলিঙ্ক-রোট দুই গুণী অভিধানখানা লিখতে রাজি হলেন। বিরাট সাত ভলুমে সে
অভিধান শেষ হল, কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল এ অভিধান ছাপাতে যাবে কোন প্রকাশক এত রেস্ত আছে কোন গৌরী সেনের?
গৌরী সেন রাজা ছিলেন না– তাই তুলনাটা টায়-টায় মেলে না। কারণ শেষ পর্যন্ত দেখা গেল এ অভিধান ছাপাবার মতো পয়সা আছে শুধু রাশিয়ার জারের।
তখন জর্মন পণ্ডিতরা পাকড়াও করলেন তাঁকে– জারটি ভালো মানুষ ছিলেন (রামচন্দ্র! কম্যুনিস্ট ভায়ারা না আবার চটে যান) এবং টাকাটা অকাতরে ঢেলে দিলেন।
শুধু এই অভিধানখানিকে ভালো করে কাজে লাগানোর জন্যই জর্মন ভাষা শেখা উচিত।
মনে পড়ছে, প্রথম যৌবনে ক্রন্দসী শব্দের সামনে কাঁদ কাঁদ হয়ে মেলা অভিধান ঘটার পর ব্যোটলিঙ্ক-রোটের অভিধান খুলে শব্দের হদিস পাই। (স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস মহোদয়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধার অন্ত নেই তিনি বাঙালির গৌরবস্থল ও প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। তাই তার সামান্য দোষ-ত্রুটির প্রতি ইঙ্গিত করলে তার আত্মা বিরক্ত হবেন না বলে আশা রাখি। তাই এই উপলক্ষে নিবেদন করি, জ্ঞানেন্দ্রমোহন তার অভিধানে ক্রন্দসী শব্দ উল্লেখ করে যে বলেছেন সংস্কৃত অভিধানে পাই নাই, কিন্তু রোদসী পাইয়াছি পুনরায়, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক উদ্ভাবিত এই দুটি বাক্যই খুব ঠিক নয়।)
***
বপ, ডয়সেন, অল্ডেনবুর্গ, য়াকোবি, হিলেব্রান্ট, ড্যুটওয়া এদের সবাইকে বাদ দিয়ে তাদের কথায়ই আসি না কেন যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ যোগাযোগ হয়েছে।
এই ধরুন ল্যুডার্স। গেলডনারের পরেই চতুর্বেদে পণ্ডিত ছিলেন এই বার্লিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক।
মোন-জো-দড়ো নিয়ে যখন বিশ্বভুবন মাথা ফাটাফাটি করছে, এ কোন সভ্যতা, এর বয়স কত, একে গড়ে তুলল কে, তখন জর্মনি ডার্সকে অনুনয় করে বলল, চতুর্বেদে হেন বস্তু নেই যা আপনার অজানা। আপনি মোন-জো-দড় ঘুরে এসে বলুন, বেদে বর্ণিত কোনও কিছু কী মোন-জো-দভড়াতে আছে যার থেকে প্রমাণ করা যেতে পারে যে মোন-জো-দড়ো আর্য সভ্যতা।
ল্যুডার্স ঘুরে গিয়ে বললেন, না, বেদের সঙ্গে এর কোনও যোগাযোগ নেই।
ব্যস্। সব মাথা-ঘামানো বন্ধ।
সব শাস্ত্রেই ল্যুডার্সের অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। শেষ বয়সে সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রটি অধ্যয়ন করে তার সঙ্গে গ্রিক অলঙ্কার শাস্ত্র মিলিয়ে যখন বক্তৃতা দিতেন তখন দেখেছি তার শ্রোতারা বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনে যেতেন। এরকম পণ্ডিত জর্মনিতে আবার জন্মাবেন কবে?
***
কিংবা ধরুন কির্ফেল।
জৈন শাস্ত্রের মহাপণ্ডিত যাকোবির (ইনি স্বাধীনভাবে হিসেব করে লোকমান্য টিলকের সিদ্ধান্তেই উপস্থিত হন) শিষ্য কির্ফেলকে একদিন জিগ্যেস করেছিলুম, উপস্থিত কোন বিষয় নিয়ে মগ্ন আছেন?
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, পুরাণ নিয়েই তো জীবনটা কাটল। অন্য জিনিস ভালো করে পড়বার ফুর্সৎ পেলুম কই।
জিজ্ঞাসা করি, পুরাণের দেশ ভারতবর্ষে কয়জন লোক পুরাণের জন্য প্রাণ দেয়? একজনকে জানি বাঙালি মাত্রই তাকে জানে।
কিন্তু আজ এ শিবের গীত কেন?
এ সপ্তাহে দিল্লিতে বক্তৃতা দিয়ে গেলেন জর্মন পণ্ডিত অধ্যাপক ডক্টর হেলমুট ফন গ্লাজেনাপ। বিষয় ছিল, জর্মনির ওপর ভারতীয় প্রভাব। সে বক্তৃতায় উপস্থিত ছিলুম।
শ্লেগেল থেকে আরম্ভ করে উইন্টারনিৎস-লডার্স পর্যন্ত তিনি পণ্ডিতের ভারতীয় জ্ঞানচর্চার ইতিহাস দিলেন। বয়স হয়েছে, স্মরণশক্তির ওপর আর নির্ভর করতে পারিনে, তবু টুকতে পারিনি।
তাই যেটুকু মনে ছিল তার সঙ্গে পিথৌরার অভিজ্ঞতা জুড়ে দিয়ে আপনাদের সামনে নিবেদন করলুম।
প্ল্যাজেনাপ তার বক্তৃতা শেষ করেন একটি প্রশ্ন জিগ্যেস করে এবং তার উত্তর দিয়ে।
জর্মনি ভারতীয় শাস্ত্র নিয়ে এত চর্চা করে কেন?
উত্তরে বলেন, উভয় জাতিই উচ্চ চিন্তাতে আনন্দ পায়।
আমরাও স্বীকার করি।
.
০৫.
ইংরেজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেবা করাতে, ফরাসি উত্তম ছবি আঁকতে, জর্মন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত রচনা করাতে কৈবল্যানন্দ অনুভব করে আর বাঙালি বলেছিলুম, তখুনি বলেছিলুম বলতে পারলে অর্থাৎ ভবিষ্যদ্বাণী করাতে সে সুপটু একথা সপ্রমাণ করতে পারলে জীবনে তার আর কোনও বাসনা থাকে না।
তাই আমিও আজ সোল্লাসে বলছি, বলিনি, তখন বলিনি শ্ৰীযুত মুখুজ্যে মশাইকে লাটসাহেব বানিয়ে ভারত সরকার অতি উত্তম কর্ম করেছেন? ভদ্রলোক মাইনে নেন নামমাত্র, আর আজ শুনতে পেলুম, তিনি নাকি বলেছেন, এত বড় বিরাট লাট-ভবনের তার প্রয়োজন নেই, তিনি মাত্র দু একখানি ঘর নিয়ে বাদবাকি অন্য কাজের জন্য ছেড়ে দেবেন।
কিন্তু একটা জিনিসে মনে একটু খটকা লাগল। শুনলুম, লাটবাড়ির ফালতো ঘরগুলোতে নাকি আপিস বসবে।
***
আমার জনকয়েক গুণী বন্ধুবান্ধবের বিশ্বাস তার চেয়ে যদি ওই ঘরগুলো দিয়ে কোনওপ্রকারের বৈদগ্ধ্যগত প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা যায়, তবে লাটবাড়ির সম্মান বজায় থাকবে, বাঙালিরও উপকার হবে।
এই ধরুন না, রবীন্দ্রভবন। কলকাতার কবি রবীন্দ্রনাথ। কলকাতা বাংলা দেশের রাজধানীও বটে। তবু এই কলকাতা শহরেই যদি আপনি রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কোনও প্রামাণিক গ্রন্থ লিখতে চান, তবে আপনাকে একাধিক জায়গায় ছুটোছুটি করতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত সব জিনিস পাবেন কি না, সে বিষয়েও আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
লাটবাড়িতে এ ব্যবস্থাটা করলে হয় না?
কিংবা মনে করুন, একখানা উত্তম চিত্রশালা খুললে হয় না?
আরও কত কিছু করা যেতে পারে। আমার পাঠকেরা গুণী লোক মাথা না চুলকিয়েও গুম গুম করে পঁচিশখানা ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা বাতলে দিতে পারবেন। আমার মনে হয়, গুণীদের এ বিষয়ে চুপ করে থাকা উচিত নয়। আমাকে যদি পত্রযোগে জানান, তবে আমি তাদের মোক্তার এবং মুহুরিরূপে পাঠক-ধর্মাবতারের এজলাসে পেশ করতে পারি।
কিন্তু আপিস, না স্যার, লাটবাড়িতে আপিস- ও কোনও কাজের কথা নয়। শালিগ্রাম দিয়ে মশারির পেরেক পোতা? (ক্ষিতিমোহনবাবুর কপিরাইট)।
***
দুই দোরে ডবল পর্দা, দরজায় হুড়কো, ভেন্টিলেটারে কালো কাগজ সঁটা তবু দুপুরবেলা ঘরে বসেই আমেজ করতে পারলুম বাইরে কিছু একটা হচ্ছে– ভূতের নৃত্য কিংবা পিশাচিনীর শ্রাদ্ধ।
অতি সন্তর্পণে দরজা ফাঁক করে দেখি– মারাত্মক কাণ্ড।
আসমানজমিন গাছপালা সবকিছুর যেন জন্ডিস হয়েছে। অতি সূক্ষ্ম ধুলোর ঝড় বইছে– এখানে যাকে বলে আঁধি– আর সেই ধুলো আকাশে-বাতাসে এমনি ছড়িয়ে পড়েছে যে মনে হয়, যেন জন্ডিসের কুয়াশায় সবকিছু আচ্ছন্ন।
মনে হল যেন, পরশুরামের সেই ছবি দেখছি। কুয়াশার ভিতর দিয়ে শোনা গেল সব আছে, হরিনাথ, সব আছে।
নিজাম প্রাসাদে, জানিনে, কোন কারসিক গুটিকয়েক ঝাউগাছ গজিয়েছেন। বিরাট বিরাট গাছ–এদের আসল জন্মভূমি পাহাড়ে। সমস্ত বৎসর এরা বিরস বিবর্ণ মুখে কাটায়, শুধু শীতকাল এলে দেশের হাওয়া পেয়ে যেন চঞ্চল নৃত্যে নেচে ওঠে।
গ্রীষ্মকালে গরমের তেজে এদের থোকা থোকা সবুজ নিডল (পাতা) ঝলসে গিয়ে একদম হলদে হয়ে যায়, আর যেন কোনও গতিকে গাছের গায়ে আঁকড়ে ধরে টিকে থাকে।
দেখি ঝড়ের হাওয়া ঠাস ঠাস করে ঝাউয়ের গায়ে থাবড়া মারছে আর খাবলা খাবলা নিডলের গুচ্ছো তুলোর মতো এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে। মাটিতে পড়ে গিয়েও এদের নিষ্কৃতি নেই। আঁধির জল্লাদ খুন করে চলে গেল, এখন তারই মুফরাস এদের ঝেটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে– বাগানে এদিক থেকে ওদিক, আবার ওদিক থেকে এদিক।
তিনটে বাজল, চারটে বাজল ঝড়ের বেগ বেড়েই চলেছে। কী অলক্ষুণে কাণ্ড!
***
রাত তখন আটটা। শুনলুম, প্রধানমন্ত্রীর প্লেন অতি কষ্টে নাকি অ্যারোড্রোমে নামতে পেরেছে, আর তার আধঘন্টাটাক পরেই মাদ্রাজের প্লেন মাটিতে নামতে না পেরে দুর্ঘটনায় খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গিয়েছে একটি প্রাণীও বাঁচেনি।
আমি জানি, আপনারা বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু সমস্ত দুপুর আমার মনে কেমন যেন একটা অজানা ভয় জেগে রয়েছিল, কিন্তু শেষটায় যে এতগুলো জীবন নষ্ট হবে, তার কল্পনাও মনে করতে পারিনি। আর কল্পনা করলেই-বা কী করতে পারতুম?
পরদিন সুহৃদ ডাক্তার মজুমদার এবং লেডি ডাক্তার স্বরূপের সঙ্গে দেখা। এরা দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে অকুস্থানে যান। যে কজনের তখনও প্রাণ ছিল, তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান, কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না।
আমার মনে শুধু এটুকু সান্ত্বনা যে, আমার বন্ধু মজুমদার এবং আমার শিষ্যা (ডাক্তারিতে ) শ্ৰীমতী স্বরূপ আর্তজনের সাহায্য করাতে কোনও ক্রটি তো করেনইনি– স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। এঁরা সফদরজঙ্গ হাসপাতালে কর্ম করেন অ্যারোপ্লেন দুর্ঘটনা সম্পর্কে এঁদের কোনও সরকারি দায়িত্ব নেই। ভগবান এদের মঙ্গল করুন।
***
দিল্লিস্থ শান্তিনিকেতন-আশ্রমিক সঙ্ এবং নিউদিল্লি বাঙালি ক্লাব যুগ্মভাবে সুসাহিত্যিক শ্ৰীযুক্ত প্রমথনাথ বিশীকে ২৫শে বৈশাখ উপলক্ষে দিল্লিতে নিমন্ত্রণ করেছেন। শ্রীযুক্ত প্রমথনাথের লেখার কদর কে কতটা দেন, তার বিচার রায় পিথৌরা করবেন না। কিন্তু একথা ঠিক, বাংলা সাহিত্যের সেবা আজকের দিনে যারা করেন তাদের মধ্যে শ্ৰীযুত বিশীই রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য পেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। রবীন্দ্রনাথ তখন প্রৌঢ়। তার স্বাস্থ্য তখন অটুট, ওদিকে কবিত্বের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তিনি তখন পরিপূর্ণতায় পৌঁছে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তখন অক্লান্ত অধ্যাপনা করছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে কাব্যসৃষ্টিও চলছে। এবং সর্বশেষ কথা, প্রমথনাথ রবীন্দ্রনাথের স্নেহ পেয়েছিলেন অকৃপণভাবে।
রবীন্দ্রনাথ শ্ৰীযুত বিশীর কাব্য এবং সাহিত্যপ্রচেষ্টার প্রশংসা করতেন আবার প্রয়োজন হলে কঠিন সমালোচনাও করতেন। নিতান্ত আত্মজন না হলে রবীন্দ্রনাথ কারও কঠোর সমালোচনা করতে চাইতেন না। (আর সাহিত্যের বাইরে তেল কিংবা কালির জন্য তিনি যেসব সার্টিফিকেট দিয়েছেন, সেগুলোর মূল্য কতটুকু সে তো সবাই জানেন) তাই শ্ৰীযুত বিশী সেদিক দিয়েও ভাগ্যবান।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, বাংলা দেশ শ্রীযুত বিশীর সামর্থ্যের সম্পূর্ণ ফললাভ করতে পারেনি।
***
পূর্ব এবং মধ্য আফ্রিকায় বহু ভারতীয় বসবাস করেন। মহাত্মা গান্ধীর কর্মজীবন এঁদের নিয়েই আরম্ভ হয়।
এসব জায়গায় বর্ণের শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হচ্ছেন, খাস ইয়োরোপীয়। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন ভারতীয়। তার পর বোধ করি আরব এবং সর্বশেষে দেশের মাটির ছেলেমেয়েরা অর্থাৎ নিগ্রোরা।
ইংরেজ যে ভারতীয়দের ভালো চোখে দেখে না, সে তো জানা কথা কিন্তু সেখানকার ভারতীয়রা যখন নিগ্রোকে তাচ্ছিল্য করে, তখন আমার মনে বড় লাগে। অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান রবীন্দ্রনাথ যে কতবড় এই বেদবাক্য বলে গিয়েছেন, সেকথা তারা জানেন না (আমরাই জানি কি?)।
পূর্ব আফ্রিকার ভারতীয় হাইকমিশনার শ্রীযুক্ত আরাসাহেব পর্যন্ত দিল্লি এসেছেন। তিনি বলেন, আফ্রিকা, ইংরেজ, ভারতীয়, আরব, নিগ্রো সবাই মিলিয়ে একটা অখণ্ড সমাজ যদি না গড়ে তোলা যায় তবে ভবিষ্যতে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। তাঁর বিশ্বাস এই অখণ্ড সমাজ গড়ে তুলতে পারে প্রধানত তথাকার ভারতীয়রাই। তাই তিনি মনে করেন, এখানকার ভারতীয়েরা যেন পূর্ব আফ্রিকার ভারতীয়দের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেই সন্তুষ্ট না হন, তারা যেন সেই অখণ্ড সমাজের দিকে দৃষ্টি রেখে আপন প্রচেষ্টা ধাবিত করেন।
মহাত্মাজির সহকর্মী শ্ৰীযুত কাকাসাহেব কালেলকর পূর্ব আফ্রিকায় গিয়ে বহু সকর্ম করেছেন। আপন অভিজ্ঞতা একখানা উত্তম হিন্দি পুস্তকে প্রকাশ করেছেন সে পুস্তকের ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে।
আরেকটি গুণী লোক পণ্ডিত শ্রীঋষিরাম। ইনি উপস্থিত আফ্রিকাতে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচার করছেন। আমাকে প্রায়ই চিঠিপত্র লেখেন এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যের যেসব ছবি পাঠান, সেগুলো দেখে ভগবানকে বলি, আসছে জন্মে যেন নিগ্রো হয়ে জন্মাই।
উঁহু; সেটি হবার জো নেই।
তন্দুরি, মুর্গি মাফিক দিল্লির গ্রীষ্ম জাহান্নম তন্দুরি-আদমি বনে যাওয়ার পর তো।
পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।
.
০৬.
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিবস পালন করাতে দিল্লি যা উৎসাহ দেখায়, কলকাতার তুলনায় সে কিছু কম না। অবশ্য দিল্লি শহরে গণ্ডায় গণ্ডায় সুসাহিত্যিক নেই; কাজেই রবীন্দ্রজীবনী এবং সাহিত্য সম্বন্ধে বহুমুখী এবং বিস্তর আলোচনা হওয়ার প্রয়োজন ঠিক ততখানি হয়তো হয়ে ওঠে না।
এবারে কলকাতা থেকে এলেন শ্ৰীযুত প্রমথনাথ বিশী সেই অভাব খানিকটে পূরণ করতে। কালীবাড়ি ক্লাবে শ্ৰীযুত বিশী বিরাট জনতার সামনে বক্তৃতা দেন। শ্ৰীযুত বিশী সম্বন্ধে দিল্লির নগণ্য নাগরিকরূপে রায় পিথৌরা কী ধারণা পোষণ করেন, সে সম্বন্ধে গত সপ্তাহে নিবেদন করেছি এবং এ সপ্তাহে সপ্রমাণ হয়ে গেল যে, তার ধারণা ভুল নয়।
অন্যান্য স্থলে ভাষণ দেন শ্ৰীযুত হুমায়ুন কবীর এবং শ্ৰীযুত দেবেশ দাশ। একই দিনে প্রায় সবকটি পরব হয়েছিল বলে রায় পিথৌরা দু একটির বেশি সামলে উঠতে পারেননি। তবে এঁদের পাণ্ডিত্যের খবর রাখি বলে লোকমুখে যখন শুনলুম এঁদের বক্তৃতা সত্যই উপভোগ্য হয়েছিল তখন সেকথা অনায়াসেই বিশ্বাস করতে পারলুম।
শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক স চিত্রাঙ্গদা গীতিনাট্যের প্রায় সবকটি গান গাওয়ার ব্যবস্থা করেন। শ্ৰীযুত নীলমাধব সিংহ নিষ্ঠার সঙ্গে গানগুলোর পরিচালনা করেন এবং অনুষ্ঠানটি যে সফল হয়েছিল, তার প্রধান কারণ ছেলেমেয়েরা গানগুলো অতি সযত্নে বহু পরিশ্রম করে আয়ত্ত করেছিল। শ্রীমান কৌশিক ও শ্রীমতী নন্দিতা এবং আরও অনেকেই অনুষ্ঠানটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করার জন্য সাহায্য করেন। রায় পিথৌরাও মাঝে মাঝে উপর চাল মারার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাকে কেউ বড় একটা আমল দেয়নি।
***
অনেকেই বলেন, একই দিনে অনেকগুলো পরব না করে কোনও এক কেন্দ্রীয় স্থলে মাত্র একটি বিরাট সভা করা উচিত। আমি এ মত পোষণ করিনে। দিল্লি বিরাট শহর এবং এক স্থল থেকে অন্য স্থল যাওয়ার যা কুব্যবস্থা তাতে করে সেই কেন্দ্রীয় সভায় দিল্লির অধিকাংশ রবি-ভক্তরাই উপস্থিত হতে পারবেন না। তাই একই দিনে কালীবাড়ি, লেডি আরউইন স্কুল, লোদি কলোনি এবং বিনয়নগরে যদি রবীন্দ্রজন্মোৎসব অনুষ্ঠিত হয় তবে সেই ব্যবস্থাই ভালো।
অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় একটি সভা হলে আরও ভালো। গেল বৎসর টেগোর সোসাইটি নিউদিল্লি এবং টাউন হলে তার আগের বৎসর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় সভার আয়োজন করেছিলেন। এ বছর কেন হল না বোঝা গেল না। তবে একটা কারণ এই যে, দিল্লিতে প্রফেশনাল সাহিত্যিক কিংবা সাহিত্যসেবী কেউ নেই–সকলকেই কোনও-না-কোনও দপ্তরে সুবো-শাম কলম পিষতে হয়, তাই সবাই প্রতি বৎসর সবকিছু করে উঠতে পারেন না।
রবীন্দ্রনাথ-জন্মোৎসব আরও কিছুদিন ধরে চলবে। এ জিনিস যত বেশি দিন ধরে চলে ততই ভালো।
***
খাদ্যমন্ত্রী শ্ৰীযুত কানহাইয়ালাল মুন্সী বিদায় নেবার সময় বলেন ভারতবর্ষের কোনও খাদ্যমন্ত্রীই কিছুটি করতে পারবেন না, যদি তিনি বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রকে চাপরাসিরূপে না পান।
তাতেও কিছু হবে না। মন্ত্রীদের চাপরাসি মহাশয়গণের প্রধান কর্ম চেয়ারে বসে বেঞ্চিতে পা তুলে দিয়ে মেঘগর্জনে ঘুমনো। পর্জন্য যদি চাপরাসি হন তবে তিনি ওই গর্জনই ছাড়বেন– ওই একই পদ্ধতিতে বৃষ্টি নামাবেন না।
দ্বিতীয়ত পর্জন্যকে চাপরাসি ইতঃপূর্বে একবার হতে হয়েছিল তবে কি না যার চাপরাসি তিনি হয়েছিলেন সে বেচারি খুন হয় এক মানুষেরই দ্বারা।
স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে, তবু আবছা মনে পড়ছে–
ইন্দ্র যম আদি করে বাঁধা আছে যার ঘরে
ছয় ঋতু খাটে বারো মাস
সমীরণ ভয়ে ভয়ে চলে মৃদু গতি হয়ে
দেব রক্ষ যক্ষ যার দাস।
সেই শ্রীমান রাবণ যখন বেঘোরে প্রাণ দিলেন, তখনই ইন্দ্রকে পুনরায় চাপরাসি করতে যাবে! কে?
আমার মনে হয়, মুন্সীজি উত্তমরূপে বিবেচনা না করে এ প্রস্তাবটি করেছেন। যদি ধরেই নিই, তিনি ইন্দ্রকে কবজাতে এনে ফেলেছেন– তা হলে? তা হলে তো তাকে রাবণ বলে ডাকতে হবে। রাম, রাম!
***
কিন্তু আসল কথা সেইটে নয়।
ইন্দ্র কে, বৃষ্টিই বা কী?
শাস্ত্র বলেন, জল কারারুদ্ধ করে রাখে বৃত্র এবং সেই বৃত্রকে বধ করে ইন্দ্র জলকে মুক্তি দিয়ে মানুষের জন্য নাবিয়ে নিয়ে আসেন। কোনও মুনি বলেন, হিমালয়ের গিরিকরে বৃত্র জলকে বরফে পরিণত করে দেয় বলে সে জল আর জনপদভূমিতে নেমে আসতে পারে না। ইন্দ্র হচ্ছেন বসন্তের সূর্য। শীতের শেষে তার রৌদ্রবাণ বরফকে খণ্ড খণ্ড করে দেয় আর গভীর গর্জনে জলধারা নেমে আসে গঙ্গা যমুনা ব্ৰহ্মপুত্ৰ দিয়ে। অন্য মুনি বলেন, বৃত্র জলকে কারারুদ্ধ করে রাখে কালো মেঘে। ইন্দ্র তার বস্র হানেন, বিদ্যুৎ চমকায়, দামিনী ধমকায়, আর সঙ্গে সঙ্গে নেমে আসে বৃষ্টিধারা, নববরিষণ।
এই মুনিগণের মতবাদের প্রতি লক্ষ রেখে রবীন্দ্রনাথও গেয়েছেন
দহনশয়নে তপ্তধরণী
পড়েছিল পিপাসার্তা।
পাঠালে তাহারে ইন্দ্রলোকের
অমৃতবারির বার্তা।
মাটির কঠিন বাধা হল ক্ষীণ,
দিকে দিকে হল দীর্ণ
নব-অঙ্কুর জয়পতাকায়।
ধরাতল সমাকীর্ণ
ছিন্ন হয়েছে বন্ধন বন্দীর, হে গম্ভীর।
আমার মনে হয়, ইন্দ্রদেব তাঁর কর্ম এখনও করে যাচ্ছেন বৈদিক যুগে যেরকম করে গিয়েছিলেন। বেদের ঋষি সে যুগে তার প্রশস্তি যেরকম ধারা গেয়েছিলেন, এ যুগে রবীন্দ্রনাথও তার প্রশস্তি ঠিক সেই রকমই গেয়েছেন।
বৃষ্টি হয়, বরফ গলেও জল নামে, কিন্তু আমরা সেই জলের ব্যবহার করতে জানিনে।
মিশরে বষ্টি হয় না। বৃষ্টি হয় সুদানে। কিন্তু মিশরীয়রা নাইল দিয়ে যে জল নেমে আসে, সেই জল নালা কেটে কেটে চতুর্দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে আপন জমি ভেজায়– মাঠে মাঠে ক্ষেতে সোনার ফসল ফলে ওঠে।
আমরা সেই কর্মটি করিনে। আমাদের নদী-নালা দিয়ে কি কিছু কম জল সাগরে গিয়ে পড়ে? আমরা কি সে জলের সদ্ব্যবহার করছি।
***
মুন্সীজি যে ব্যাকরণে ভুলটি করলেন, তাতে কোনও ক্ষতি নেই।
তিনি সুসাহিত্যিক– গুজরাতিতে উত্তম উত্তম পুস্তক লিখেছেন, কিন্তু আমার বড় দুঃখ। সেগুলো বাংলাতে অনূদিত হয়নি।
ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গসুন্দর ইতিহাস লেখাবার জন্যও মুসীজি ব্যাপক বন্দোবস্ত করেছেন।
আমার মনে হয়, মুন্সীজির পক্ষে রাজনীতি বর্জন করাই ভালো।
.
০৭.
শেক্সপিয়র বলিয়াছেন, এই সত্য জানাইবার জন্য ভূতের কী প্রয়োজন ছিল, মহারাজ ড. শাখট যে অতিশয় গুণী লোককে সেকথা জানাইবার জন্য রায় পিথৌরারও প্রয়োজন নাই।
কিন্তু আশ্চর্য হইলাম লোকটির অসাধারণ অধ্যবসায়, সহিষ্ণুতা এবং সদাজাগ্রত তীক্ষ্ণতা লক্ষ করিয়া উদয়াস্ত নানাপ্রকারের লোকের সঙ্গে নানাবিধ আলোচনার পর সামান্য মানুষ অপরাকের দিকে তৈলহীন প্রদীপের ন্যায় নির্জীব হইয়া পড়ে। তখন সে জিজ্ঞাসুর প্রশ্ন শুনিতে পায় না, শুনিলেও বিষয়বস্তুটি সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিয়া সদুত্তর দিবার জন্য চেষ্টিত হয় না।
এবং আমরা যে কয়টি প্রাণী তাহার চতুর্দিকে সমবেত হইয়াছিলাম, তাহাদিগের প্রত্যেককে অর্থনীতি ক্ষেত্রে অপোগও শিশু বলিলে কিছুমাত্র সত্যের অপলাপ হয় না। অথচ কী অদ্ভুত ধৈর্য ও মনোনিবেশ সহকারে আমাদের প্রত্যেকটি প্রশ্ন সম্পূর্ণরূপে বুঝিয়া লইয়া সোসাহে উত্তর দিতে লাগিলেন। কণ্ঠে বর্ণনামাত্র ক্লান্তি নাই, বচনভঙ্গিতে বিন্দুমাত্র ক্লৈব্য নাই।
এই বিশাল সংসারে অরসিক জনের অভাব নেই। তাঁহাদের একজন ড. শাখটের স্বন্ধে জর্মনির পুনরায় সশস্ত্রীকরণের দায়িত্ব চাপাইবার চেষ্টা করিলেন। ড. শাখট তাহার কী উত্তর দিলেন, সেই কথার পুনরুল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন। যে বিরাট আট ভলুমে নুরেনবের্গ মোকদ্দমার দলিল দস্তাবেজ প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতেই জ্ঞানী পাঠক এই ব্যাপারে তাবৎ বর্ণনা পাইবেন।
আমার ইচ্ছা হইতেছিল হঠাৎ অট্টহাস্য করিবার। যে মার্কিন, ফরাসি, ইংরেজ রুশের প্রতিভূ শাণিতবুদ্ধি উকিলগণ শাখকে নুরেনবের্গে কণামাত্র বিচলিত করিতে পারেন নাই, অবশ্যম্ভাবী আসন্ন মৃত্যুর সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ যুক্তি এবং অকাট্য প্রমাণ দ্বারা পদে পদে বিপক্ষকে নিদারুণ বিড়ম্বিত করিলেন, তাঁহাকে তর্কে পরাস্ত করিবার আকাক্ষা পঙ্গুর গিরিলজ্ঞান, বামনের শশাঙ্ক-করতলকরণ ইত্যাদি যাবতীয় তুলনাকে হাস্যাস্পদ করিয়া ফেলে।
বুদ্ধিমানের সংখ্যা ইতরজনের তুলনায় কম হইলেও সেই সভাতে তাহাদের অনটন ছিল না। সহসা তাঁহারাই একজন উচ্চকণ্ঠে বলিলেন।
শবব্যবচ্ছেদ কর্মে কী মোক্ষলাভ? ভারতবর্ষ দরিদ্র দেশ; তাহার সম্মুখে লক্ষ লক্ষ সমস্যা। বরঞ্চ যদি শাখট মহাশয় সেইসব ব্যাপারে আমাদিগকে জ্ঞানদান করেন, তবেই আমাদের সার্থক উপকার হয়।
সোল্লাসে সকলেই সম্মতি জানাইলাম।
পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনা সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠিল। শাখট বলিলেন, আমি পরিকল্পনাটি পড়িবার জন্য সময় করিয়া উঠিতে পারি নাই। আগামীকল্য কাশ্মিরের পথে পাঠ করিবার বাসনা রাখি। কিন্তু কী প্রয়োজন এইসব বিশাল কলেবর পরিকল্পনা করিবার? তাহা হইতে অনেক শ্রেয়ঃ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অথচ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজ আরম্ভ করিয়া দিবার এবং আমার বিশ্বাস সেইসব কর্মই সর্বপ্রথম আরম্ভ করিয়া দেওয়া উচিত, যাহাতে বিপুল বিত্তের প্রয়োজন হয় না এবং যে স্থলে এক, দুই কিংবা তিন বৎসরের ভিতরই ব্যয়িত অর্থ সুফল প্রদান করিয়া হস্তে পুনরাগমন করিতে থাকে। তাহাতে রাজকোষের অর্থ সঞ্চয় হইবে, সেই অর্থ তৎক্ষণাৎ অন্য কর্মে নিয়োজিত করিয়া দেশ দ্রুতগতিতে অগ্রসর হইবে। জনগণের মনে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা দৃঢ়তর হইবে এবং এই পন্থাতেই আশু সুফল লাভের সম্ভাবনা।
ভারতবর্ষে বহু বিত্ত সঞ্চিত আছে, সেকথা কাহারও অজ্ঞাত নয়। এই অর্থ প্রধানত যুদ্ধের সময় উপার্জিত হয় ও বণিকগণ সে বিত্তের রাজকর বা ইনকামট্যাক্স দেন নাই বলিয়া এক্ষণে সে অর্থ কোনওপ্রকারের পরিকল্পনায় নিয়োজিত করিতে পারিতেছেন না। রাষ্ট্র শ্যেন দৃষ্টিতে বিত্তশালীদের প্রতি কর্ম পর্যবেক্ষণ করিতেছেন এবং আপনার ন্যায্য রাজকর উদ্ধারের জন্য সর্বস্ব পণ করিয়া বসিয়াছেন এবং ধনিকগণও রাজদ্বারে দণ্ডিত হইবার ভয়ে সেই অর্থ গোপন রাখিতেছেন।
ড. শাখটের বিশ্বাস, দেশের উন্নতির জন্য যখন এই অর্থের একান্ত প্রয়োজন এবং অন্য কোনও সূত্র হইতে কোনওপ্রকারের অর্থ লাভের আশাও নাই, তখন অতীতে কে কোন উপায়ে বিত্তশালী হইয়াছে, তাহার আলোচনা না করিয়া এবং ধনিকগণকে লাভের প্রলোভন দেখাইয়া অর্থ বাহির করিয়া দেশ নির্মাণকর্মে নিয়োজিত করাই ভারতের পক্ষে প্রশস্ততম পন্থা।
ড. শাখৎ পুনঃপুন বলিলেন, ভদ্রমহোদয়গণ, যখন একথা স্থিরনিশ্চিয় হইয়া গিয়াছে। যে দেশ-নির্মাণকর্ম আরম্ভ করিতেই হইবে, তখন আর এ প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবান্তর অর্থ কোথা হইতে আসিবে। যেকোনো কৌশলেই হউক অর্থ একত্র করিতে হইবে এং কর্ম আরম্ভ করিয়া দিতেই হইবে।
আমি ভাবিয়াছিলাম, ডা. শাখট অর্থনৈতিক পণ্ডিত; তাহার কণ্ঠে শুনিব শান্ত সমাহিত উপদেশ। বিস্মিত হইলাম যে, তিনি তাহার বক্তব্য অতিশয় উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে প্রকাশ করিলেন এবং দেশ-নির্মাণ সম্বন্ধে আপনার মতামত আমাদিগকে বুঝাইবার জন্য শুধু যুক্তিতর্ক নয়, স্থির বিশ্বাসের গভীর অনুভূতিও নিয়োগ করিলেন। স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম ভারতের প্রতি তাঁহার প্রেম অকৃত্রিম ও তিনি আমাদের মঙ্গল কামনা করেন।
***
প্রায়ই দেখিতে পাই, ইংরেজ এবং মার্কিন এতদ্দেশীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত আমাদের কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার বিজ্ঞাপন কিংবা বরপক্ষের স্বগুণ কীর্তন লইয়া ব্যঙ্গবিদ্রূপ করিয়া থাকেন। তাহারা করুন, আমাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই।
কিন্তু প্রশ্ন, তাহারা ভারতীয় বিজ্ঞাপনের দিকেই কটাক্ষ হানেন কেন?
সুইজারল্যান্ড হইতে জর্মন ভাষায় প্রকাশিত একখানি বিশ্ববিখ্যাত সাপ্তাহিকে নিম্নলিখিত বিজ্ঞাপনটি পড়িলাম। আমার সঙ্কীর্ণ জ্ঞান এবং বুদ্ধি অনুযায়ী তাহার অনুবাদ নিবেদন করিলাম।
আমি আমার এক ত্রিংশতি বর্ষীয়া সুন্দরী বান্ধবীর জন্য একজন জীবনসঙ্গী অনুসন্ধান করিতেছি। আমার আশা, সেই জীবনসঙ্গী যেন আমার বান্ধবীর পঞ্চবর্ষীয় পুত্রের স্নেহময় পিতার আসন গ্রহণ করেন। আমার বান্ধবী উত্তম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি তন্বঙ্গী, ১৭৫ সেন্টিমিটার দীর্ঘ (প্রায় পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি অনুবাদক), ক্যাথলিক, গৃহকর্মে সুনিপুণা এবং বহু রমণীসুলভ মোহিনী গুণ ধরেন। উচ্চশিক্ষা ও দৃঢ় চরিত্রবল ছিল বলিয়া জীবনে বহু দুর্যোগ সত্ত্বেও তিনি তাঁহার রসবোধ হইতে বঞ্চিত হন নাই। পাঠক, তুমি যদি এই জাতীয় অমূল্য সম্পদের গুণগ্রাহী হও এবং প্রেমময়ী জীবনসঙ্গিনী আকাক্ষা কর, তবে সম্পূর্ণ বিশ্বাসের সহিত ফটোগ্রাফসহ নিম্নে উদ্ধৃত পোস্টবক্সে পত্র লেখ। বিষয়টি গোপনীয়ভাবে আলোচিত হইবে বলিয়া উভয় পক্ষ প্রতিজ্ঞা করিতেছেন।
বিস্তর মস্তক কণ্ডুয়ন করিয়াও হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইলাম না, এই কাতররোদন এবং ভারতীয় অরক্ষণীয়ার মধ্যে মূলত পার্থক্য কোথায়? এস্থলে বর্ণিত হইয়াছে, রমণী ভদ্রবংশোদ্ভবা, আমরা বলি মুখোপাধ্যায়, কুলীন, খড়দা মেল। এস্থলে বলা হইয়াছে, তিনি ক্যাথলিক, আমরা বলি তিনি ব্রাহ্মণ, বৈদ্য কিংবা কায়স্থ। গৃহকর্মে সুনিপুণার প্রতি লোভ হটেনটট হইতে প্যারিসের বিদগ্ধজন সকলেরই আছে এবং আমরা সুন্দরী বলিয়াই ক্ষান্ত দিই, এস্থলে কিন্তু দৈর্ঘ্যের উল্লেখ পর্যন্ত রহিয়াছে। অবশ্য আমরা জীবনের ঝঞ্ঝাবার্তার বিষয় উল্লেখ করি না, কারণ আমাদের বিজ্ঞাপন সচরাচর বিধবা রমণীর জন্য নহে। সুতরাং পঞ্চবর্ষীয় পুত্রের উল্লেখও আমাদের পক্ষে অপ্রয়োজন।
শুধু তাই নয়, বরপণ বস্তুটিও ইয়োরোপে অবিদিত নয়। নিম্নলিখিত বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখা যায়।
শিক্ষিত স্বাস্থ্যবান যুবা বিবাহ ও বাণিজ্য করিতে ইচ্ছুক। বিশ হাজার ফ্রাঙ্কের প্রয়োজন।
স্পষ্টই বুঝা গেল, এস্থলে অর্থ অনর্থ নয়। যে কুমারীকে যুবা বিবাহ করিতে ইচ্ছুক, তাহার কুল-গোত্র-রূপ-লাবণ্য সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ উদাসীন। বিশ হাজার ফ্রাঙ্ক হইলেই হইল।
কিন্তু ইহাকেও পরাজিত করিতে পারে এমন বিজ্ঞাপনও দেখিয়াছি।
নিজস্ব বাড়ি আছে এমন রমণীকে স্বাস্থ্যবান সুশিক্ষিত যুবক বিবাহ করিতে ইচ্ছুক। বাড়ির ফটোগ্রাফ পাঠান।
.
০৮.
বিবেচনা করি এই শীতকালেও বহু শত বাঙালি দিল্লি আসিবেন। যাহারা নিছক পারমিটের জন্য এখানে আসিবেন ভগবান তাহাদিগকে মঙ্গল করুন। আমাদের সঙ্গে তাঁহাদিগের কোনওপ্রকারের যোগাযোগের আশঙ্কা নাই।
কিন্তু যাহারা নিতান্ত মহানগরী দিল্লি দেখিবার জন্যই আগমন করিবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে কদলী বিক্রয় করিবার দুষ্টবুদ্ধি যাহাদের নাই তাহাদের উদ্দেশে দুই-একটি নিবেদন আছে।
প্রথমত পাড়ার পাঁচজনের কাছে বড়াই করিবার জন্য অনর্থক পঞ্চাশটা কবর মসজিদ দুর্গ মন্দির দেখিয়া কোনও লাভ নাই। সবকিছু আখেরে ঘুলাইয়া যাইবে– লোদিদের বাগানে কুতুবমিনার চাপাইয়া বসিবেন, লালকিল্লার মাঝখানে শের শাহের মসজিদ দেখিয়া কী আনন্দ লাভ করিয়াছিলেন তাহার স্বপ্ন দেখিবেন, বিড়লা মন্দিরের সঙ্গে কুতুবের যোগমায়া মন্দির মিশাইয়া লইয়া অতিশয় অদ্ভুত স্থাপত্য নির্মাণ করিয়া বসিবেন। অতএব নিবেদন, অল্প দেখিবেন কিন্তু অতি উত্তমরূপে দেখিবেন। একটি ক্যামেরা– তা সে বক্স কিংবা বেবিই হউক– সঙ্গে আনিবেন এবং যদিও ভালো ভালো দালান ইমারতের উত্তম উত্তম ফটো সর্বত্রই কিনিতে পাওয়া যায় তবুও আপন রুচি অনুযায়ী ছবি তোলাতে যে বিশেষ আনন্দ আছে, সেই তত্ত্ব সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইবেন।
দ্বিতীয়ত ভারতের একখানা ইতিহাস সঙ্গে আনিবেন।
ভালো বায়োস্কোপ দেখিবার পর হৃদয়ে স্বতই বাসনা জাগে পুস্তকখানি পড়িবার। ঐতিহাসিক স্থাপত্য দর্শনের পর ওই একই অভিলাষ জন্মে। যখন শুনিবেন, এই ত্রিপোলিয়া তোরণের উপরেই বাদশা ফররুখসিয়ার তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী জাহানদার শাহকে বন্দি করিয়া প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন এবং আট বৎসর যাইতে না যাইতেই সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় সেই ফররুখসিয়ারকে অন্ধ করিয়া ওই ত্রিপোলিয়া তোরণের উপরেই বন্দি করেন ও পরে তাহাদের আদেশেই তিন নরপিশাচ তাহাকে ঠগীদের পদ্ধতিতে ফাঁসি লাগাইয়া খুন করে, তখন আপনার মনে কৌতূহলের সঞ্চার হইবে তাবৎ ইতিহাস অদ্যোপান্ত পাঠ করিবার। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন গাইড মাত্রই বিশুদ্ধ গঞ্জিকা না হউক কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জনের পক্ষপাতী। গাইড হিসাবে আমারও ন্যূনাধিক সে দুর্বলতা আছে; কিন্তু ইতিহাসের অত্যাচারে সেই দুর্বলতা সম্যক প্রস্ফুটিত হইবার অবকাশ পায় না।
তৃতীয় স্থাপত্য দর্শনকর্ম আরম্ভ করার পূর্বেই স্মরণ রাখিবেন দিল্লিতে হিন্দু স্থাপত্যের বিশেষ কিছু নাই। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিস্তর পরিশ্রম করিয়াও দিল্লিতে প্রাক কুশান যুগের কোনও কিছু আবিষ্কার করিতে সক্ষম হন নাই। অতএব হস্তিনাপুর, ইন্দ্রপ্রস্থ জাতীয় কোনও বস্তু দেখিবার আশা পোষণ না করাই প্রশস্ততর।
একেবারে যে কিছুই নাই তাহাও নয়। কুতুবমিনারের কাছেই রাজা চন্দ্রের(এই চন্দ্রটি কে তাহা ঐতিহাসিকেরা এখনও বলিতে পারেন না।) একটি মনোহর লৌহস্তম্ভ আছে; ফিরোজ তুগলুক নির্মিত ফিরোজ শাহ কোটলাতে একটি অশোক স্তম্ভ এবং উত্তর দিল্লিতে আর একটি; গিয়াসউদ্দিন তুগলুক নির্মিত তুগলুকাবাদের প্রায় ক্রোশ পরিমাণ দূরে সূর্যকুণ্ড (এই কুণ্ডটি সত্যই হিন্দু না মুসলমান সে বিষয়ে মুনিদের ভিতর এখনও মতভেদ আছে), এবং কুতুবমিনারের কাছে যে কুওওৎ উল-ইসলাম মসজিদ আছে তাহার স্তম্ভগুলি– এই স্তম্ভগুলি হিন্দু এবং বৌদ্ধ মন্দির হইতে নেওয়া হইয়াছিল এই বিষয়ে সন্দেহ নাই।
***
সংবাদ শুনিলাম, যে স্থলে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সেই স্থলে রাষ্ট্রপতি বৌদ্ধ শাস্ত্র ও পালি ভাষার চর্চার নিমিত্ত এক প্রতিষ্ঠানের দ্বারোদঘাটন করিয়াছেন। ক্রমে ক্রমে সেখানে নাকি তিব্বত, চীন, বর্মা, শ্যাম এবং সিংহলের ভাষা শিখাইবার ব্যবস্থা করা হইবে।
সংস্কৃতের কোনও উল্লেখ নাই!
হায়, আমি মূর্খ, আমার ধারণা ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বৌদ্ধধর্ম ও শাস্ত্রচর্চা হইত তাহা মহাযান বৌদ্ধধর্মের এবং মহাযানের অধিকাংশ এবং হীনযানের বহুলাংশ শাস্ত্র পালিতে নয়, সংস্কৃতে লিখিত। আমি মূর্খ, আমি তো জানিতাম, হিউয়েং সাঙ এই মহাযান শাস্ত্রই সংস্কৃতের মাধ্যমে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। আমি নিতান্ত জড়ভরত, আমি তো জানিতাম নালন্দাতে শিক্ষাদান প্রদানের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত। আমি অতিশয় নির্বোধ, আমার কুসংস্কার ছিল সংস্কৃতের সাহায্য ভিন্ন বৌদ্ধধর্মের উচ্চতম বিকাশ, অর্থাৎ বৌদ্ধদর্শন ও তর্ক কণামাত্র আয়ত্ত করা যায় না।
কিন্তু সার্থক জনম আমার জনেছি এই দেশে। নবনির্মিত সংস্কৃত বিবর্জিত নালন্দার নব-বিদ্যায়তনের মোহমুদার আমার মোহ চূর্ণ চূর্ণ করিল, সদগুরুর ন্যায় অজ্ঞান তিমির অন্ধকারে জ্ঞানাঞ্জন শলাকার ন্যায় চক্ষু উন্মীলন করিয়া দিল।
এখন শুনিব, গ্রিক ভাষা শিখা থাকিলেই ইয়োরোপীয়ন দর্শন করায়ত্ত হয়। ফরাসি জর্মন (কিংবা কেবল মাত্র ইংরেজির মাধ্যমে) শিখিয়া দেকার্ত, কান্ট, হেগেল পড়িবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। প্লাতো, এরিসততেল অধ্যয়ন করা থাকিলেই তাবৎ ইয়োরোপীয় দর্শন হস্ততলগত।
***
কোন রাজাকে নাকি এক বুদ্ধিমান বিশেষ একপ্রস্থ পোশাক নির্মাণ করিয়া দিয়াছিল। সে পোশাক নাকি অসাধু জনের চক্ষুগোচর হইত না। রাজা একদিন সেই পোশাক পরিধান করিয়া শোভাযাত্রায় বাহির হইলে পাত্র অমাত্য অসাধুরূপে সন্দিহান হইবার ভয়ে করতালি ধ্বনি করতঃ পোশাকের ভূয়সী প্রশংসা করিলেন।
হঠাৎ একটি ক্ষুদ্র বালক চিৎকার করিয়া বলিল, কিন্তু পোশাক কোথায়, মহারাজ তো কিছুই পরেন নাই।
চীন হইতে প্রত্যাগত ভারতীয় অমাত্য ও অন্যান্য গুণীজন বারম্বার চিৎকার করিয়া বলিতেছেন চীন দেশ কম্যুনিস্ট নয়। ইঁহাদের কোনও অসাধু অভিসন্ধি নাই সে সম্বন্ধে আমি স্থিরনিশ্চয়, কিন্তু আমি প্রত্যাশা করিতেছি সেই বালকের। কখন না চিৎকার করিয়া বলে চীন তো কম্যুনিস্ট এবং সঙ্গে সঙ্গে সকলের সুখস্বপ্ন ভঙ্গ হয়।
***
আমি এই তত্ত্বটি এখনও হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইলাম না। ইংরেজ যখন বলে জানো, লোকটি ভারতীয়, কিন্তু একদম আমাদের মতো; ভারতীয়দের সঙ্গে তাহার কোনও সামঞ্জস্য নাই কিংবা যখন কোনও বাঙালি বলে জানো, লোকটা আসলে ছাতুশোর কিন্তু আচার ব্যবহারে ঠিক বাঙালির মতো, তখন আমি আশ্চর্য হই। ছাতুষোর থাকিয়াও কি বাঙালির প্রশংসা অর্জন করতে পারে না?
অর্থাৎ চীনকে কম্যুনিস্টরূপে স্বীকার করিয়াও কি তাহার প্রশংসা করা যায় না কিংবা তাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায় না? তারস্বরে চিৎকার করিয়া বলিতে হইবে চীন কম্যুনিস্ট নয়, সে আমাদের মতো তবেই বন্ধুত্ব সম্ভবে? এবং চীন কি আমাদের এই চিৎকার শুনিয়া উল্লসিত হইবে?।
ইংরেজ যখন বলে এই ভারতীয় মোটেই ভারতীয়ের মতো নয়, একদম আমাদের মতো তখন কি আমরা উল্লাস বোধ করি?
***
মনু-নিষিদ্ধ পক্ষী ভক্ষণকরতঃ হিন্দু-সন্তান ইহলোক-পরলোক নষ্ট করুক এ অভিসন্ধি আমি কিছুতেই করিতে পারি না; তৎপূর্বে যেন আমার মস্তকে বজ্রাঘাত হয়।
কিন্তু আমার বহু পারসিক, মুসলমান, খ্রিস্টানি বন্ধু আছেন, তাঁহাদের কল্যাণার্থে নিবেদন করি তাহারা যদি কখনও দিল্লি আসেন তবে যেন একবার আফগানি নান (তন্দুরপকু রুটিবিশেষ) এবং তন্দুরি মুর্গি ভক্ষণ করিয়া দেহলি বাস সার্থক করেন।
এই দুই বস্তু বস্তুত গান্ধার দেশীয় অর্থাৎ পেশাওয়ার হইতে কাবুল পর্যন্ত এই দুই বস্তু সানন্দে ভক্ষণ করা হয়। কিন্তু বিচলিত হইবেন না, ইহাদিগকে ভক্ষণ করিবার জন্য পাঠান। দন্ত কিংবা উদরের প্রয়োজন নাই। ঈষৎ অবান্তর, তবুও নিবেদন করি পাঠানের দন্ত বাঙালি অপেক্ষা বহু নিকৃষ্ট। বড়ই কোমল জিনিস এবং তন্দুরের অভ্যন্তরে সুপক্ক করা হয় বলিয়া সর্বাঙ্গসুন্দর মাধুর্য ধারণ করে। গান্ধার দেশে লঙ্কার প্রচলন সংকীর্ণ বলিয়া তন্দুরিতে কোনওপ্রকারের তীব্র আস্বাদ নাই।
একদা এই দুই বস্তু দেহলি প্রান্তে প্রচলিত ছিল না। দেশবিভক্তির ফলে এক পেশাওয়ারি শিখ মহোদয় এই দুই মহাশয়কে দিল্লিতে প্রচলন করিয়াছেন। ভগবান তাহার মঙ্গল করুন।
কিন্তু সাধু ভক্ষক, সাবধান। মস্তক কর্তন করিবার ভীতি প্রদর্শন করিলেও তন্দুরি ছুরি কাঁটা দিয়া খাইবে না। উভয় হস্ত সঞ্চালন দ্বারা তন্দুরিকে খণ্ড বিখণ্ড করতঃ সোল্লাসে সশব্দে হোটেল রেস্তোরাঁ সচকিত করিয়া নির্লজ্জভাবে কড়কড়ায়েত মড়মড়ায়েত করিবে। যদি সাহস না থাকে আমাকে নিমন্ত্রণ করিও।
***
স্বর্গীয় পরিমল রায়ের শোকসন্তপ্ত বন্ধুবর্গ এই সংবাদ শুনিয়া কথঞ্চিৎ সান্ত্বনা পাইবেন।
ইউ.এন.ও. রায়ের বিধবাকে সারাজীবনের জন্য মাসিক চারি শত টাকার ভাতা এবং তদুপরি রায়ের পুত্র ও কন্যার শিক্ষাব্যয় আপন স্কন্ধে তুলিয়া লইয়াছেন!
ইউ.এন.ও.-র জয় হউক।
.
০৯.
এক ইংরেজ সংবাদপত্র পড়িতে পড়িতে বাষ্পকুলকণ্ঠ অশ্রুমোচন করিয়া বলিল, হায় হায়, কোটিপতি স্মিথ ইহলোক ত্যাগ করিয়াছেন।
সখা সান্ত্বনা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কি আপনার নিকট-আত্মীয় ছিলেন?
প্রথম ইংরেজ বলিল, না, আমার দুঃখ তো সেই জন্যই।
ডক্টর মুখোপাধ্যায় বাংলা দেশের ছোটলাট হওয়াতে আমার শোক বহুলাংশে সেই জাতীয়ই। বরঞ্চ বলিব, অনেক বেশি; কারণ মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে আমি বিলক্ষণ চিনিতাম কিন্তু হায়, তখন কি জানিতাম যে তিনি একদিন লাট সাহেবের গদিতে আরোহণ করিবেন! এই সরল শান্ত অমায়িক লোককে কি কখনও রাজ্যপালরূপে কল্পনা করিতে পারিয়াছি? তাহা হইলে কি তাহার এইরকম অবহেলা করিতাম? তিনি যখন সাদর আমন্ত্রণ করিয়া বলিতেন, আসুন, আসুন : বঙ্গদেশ হইতে কতিপয় সুপক্ক আম্র আগমন করিয়াছে; ভক্ষণ করিয়া আপনি তপ্ত হউন, আমিও আনন্দ লাভ করি, হায়, তখন জানিলে কি আমি ক্ষিপ্রগতিতে তাঁহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিতাম না, অতিশয় সবিনয় তাহার কুশল সন্দেশ জিজ্ঞাসা করিয়া তাঁহার চিত্তজয় করিবার জন্য সচেষ্ট হইতাম না? হায়, কী মূর্খ আমি, ধিক্ আমাকে!
কিন্তু প্রলাপ বকিতেছি। রে রসনে, তুমি সংযত হও।
আমি বড়ই আনন্দিত হইয়াছি। মুখোপাধ্যায় অসাধারণ সজ্জন ব্যক্তি। যদিস্যাৎ সাক্ষাৎ হয় তবে তিনি নিশ্চয়ই আমাকে রসাল ভক্ষণে পুনরপি সাদর আমন্ত্রণ জানাইবেন।
সত্যই বলিতেছি, আমি ও আমার প্রতিবেশীগণ সকলেই মুখোপাধ্যায়ের রাজ্যপালত্ব প্রাপ্তিতে অবিমিশ্র উল্লাস উপভোগ করিয়াছি। একে অন্যকে আনন্দ অভিনন্দন জানাইয়াছি এবং বলিয়াছি, কলিকাতায় আর বাসস্থানের দুর্ভাবনা রহিল না।
মুখোপাধ্যায় মহাশয় আজীবন আর্তসেবা, জ্ঞানসার এবং সত্যের অনুসন্ধান করিয়াছেন। ভগবানের সাহায্য ও গুরুজনের আশীর্বাদ তাহার উপরে নিশ্চয়ই ছিল; কিন্তু দৃষ্টত সর্বপ্রকার সঙ্কর্ম তিনি স্বীয় পুরুষকারের দ্বারাই সম্পন্ন করিয়াছেন। এক্ষণে তিনি যে পদমর্যাদা ও তৎসংযুক্ত রাজদণ্ড হস্তে পাইলেন তাহার সাহায্যে প্রচুরতর সঙ্কর্ম সাধন করিতে পারিবেন এমত আশা নিশ্চয়ই দুরাশা নয়। আর যদি না করিতে পারেন তবে বুঝিব ফিরিঙ্গি-প্রবর্তিত এ পদ এখনও স্বদেশী হয় নাই। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস মুখোপাধ্যায় মহাশয়ও যদি এ পদের রূপ পরিবর্তন না করিতে পারেন তবে আর কেহই পারিবে না।
মুখোপাধ্যায় মহাশয় নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান, অগণিত মুসলমান তাঁহাকে অন্নদাতা বস্ত্রদাতারূপে ভক্তি করে আর হিন্দু সমাজের তিনি স্বজন ছিলেন তো বটেই। তিন সম্প্রদায়ই মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে সানন্দ অভিনন্দন জানাইবেন।
মুখোপাধ্যায় দীর্ঘজীবন লাভ করতঃ দেশের দশের মঙ্গল সাধন করুন।
শতং জীব, সহস্রং জীব।
***
শ্ৰীযুত কাটজুর বঙ্গত্যাগে বহু লোক তাহার অভাব অনুভব করিবেন। তিনি অমায়িক, নিরহঙ্কারী ও সুপণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি ধীরে ধীরে বঙ্গভূমির প্রতি বিলক্ষণ অনুরক্তও হইয়াছিলেন।
দিল্লিবাসী বাঙালিরা শ্ৰীযুত কাটজুর দিল্লি আগমনে উল্লসিত হইলেন। ধর্ম জানেন, আজ বাঙালির বেদনা বুঝিবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও মুরুব্বি নাই। বঙ্গদেশাগত বাঙালি প্রয়োজনবশত দিল্লিতে আগমন করিলে এক্ষণে অন্তত শ্ৰীযুত কাটজুর দ্বারস্থ হইতে পারিবে; দিল্লিবাসী বাঙালিও মনে মনে সে আশা পোষণ করে।
শ্ৰীযুত কাটজু নিশ্চয়ই তাহাদিগকে হতাশ করিবেন না।
***
সাংস্কৃতিক যোগসূত্র দৃঢ়তর এবং নবীন যোগসূত্র স্থাপনা করিবার জন্য কতিপয় চৈনিক বিদগ্ধ পুরুষরমণী মহানগরীতে পদার্পণ করিয়াছেন। ইঁহাদের শুভাগমনে সর্বসম্প্রদায়ের লোককে এক হইয়া ইহাদিগকে স্বাগত অভিবাদন জানাইতে দেখিলাম। কংগ্রেস সরকার যদিও প্রধান অতিথিসেবক, তবু দেখিয়াছি কম্যুনিস্ট ভ্রাতাদের আনন্দোল্লাস কিছুমাত্র কম নহে এবং অন্যান্য শ্রেণিও বিস্মৃতির ভয়ে যত্রতত্র ঘনঘন পদচারণা করিতেছেন।
চৈনিকমণ্ডলী উদয়াস্ত যেসব অভিনন্দন সভায় উপস্থিত হইতেছেন তাহার নির্ঘণ্ট দিতে গেলেই এ পত্রের অধিকাংশ ব্যয় হইয়া যাইবে। এই রবিবারেই দেখিতেছি তিনটি পর্বে এই অভাজনকেই উপস্থিত থাকিতে হইবে। অভিজাত প্রতিষ্ঠান অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস্ সোসাইটি, ব্রাত্য শিল্পীচক্র ওই দিন ইহাদিগকে সম্মান দেখাইবেন ও সন্ধ্যায় চৈনিক রাজদূত বিদেশাগত বিদগ্ধমণ্ডলী এবং দিল্লি নাগরিকদিগকে পানাহারে তৃপ্ত করিবেন। চৈনিকদের অতিথিবাৎসল্য তাহাদিগকে কতদূর মুক্তহস্ত করিতে পারে তাহার ভূরি ভূরি অভিজ্ঞতা আমার আছে– এই পর্বেও তাহার ব্যত্যয় হইবে না। তাহার বর্ণনা একদিন সুযোগ সুবিধামতো নিবেদন করিব।
বিদগ্ধমণ্ডলীকে অভর্থনা করিবার সময় নানা মহাজন নানা জ্ঞানগর্ভ বাণী উচ্চারণ করিয়াছেন; কিন্তু একটি বিষয়ের উল্লেখ কেহই করেন নাই বলিয়া অতিশয় সভয়ে তাহা নিবেদন করি।
সকলেই জানেন বৌদ্ধশাস্ত্রের বহু মূল সংস্কৃত এবং পালি গ্রন্থ চিরতরে লোপ পাইয়াছে; কিন্তু এইসব গ্রন্থের চীনা (এবং তিব্বতীয়) অনুবাদ এখনও চীন দেশে পাওয়া যায়। এইসব গ্রন্থ পুনরায় ভারতীয় ভাষাতে (কিংবা ইংরেজিতে) অনুবাদ না করিলে বৌদ্ধধর্মের সর্বাঙ্গসুন্দর স্বরূপ আমাদের সম্মুখে বিকশিত হইবে না এবং এই সুবৃহকর্ম ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানবিশেষের পক্ষে সম্ভবপর নহে।
এই চৈনিক বিদগ্ধমণ্ডলীর সঙ্গে সংযুক্ত হইয়া যদি সরকার এই সুবর্ণ সুযোগে একটা সুব্যবস্থা করিয়া লইতেন তবে আমরা উচ্চকণ্ঠে সাধুবাদ জানাইতাম।
যে দুইটি ভারতীয় উপযুক্ত বিষয়ে আজীবন পরিশ্রম করিয়াছেন, কই, তাঁহাদের কাহাকেও তো এই উপলক্ষে দিল্লিতে দেখিলাম না।
***
ইন্দ্রলুপ্তজন বিল্ববৃক্ষতলে একাধিক বার যায় না–ইহা আপ্তবাক্য।
ক্রিকেট খেলা দেখিতে গিয়াছিলাম। আর যাই না।
রে রে পাষণ্ড শব্দোচ্চারণ করিয়া উভয় পক্ষ যুদ্ধে অবতরণ করিলেন না। মল্লপক্ষদ্বয়। একে অন্যকে ভীতনেত্রে পর্যবেক্ষণকরতঃ অতিশয় সন্তর্পণে ক্রীড়া আরম্ভ করিলেন। দর্শকমণ্ডলী ততোধিক সন্তর্পণে করতালিধ্বনি করিলেন। দশ মিনিট যাইতে না যাইতে যখন প্রথম মল্ল গতাসু হইলেন তখন যে হর্ষধ্বনি উত্থিত হইল সে ধ্বনি রক্তদুর্গ মস্তকে থাকুন দেহলি-তোরণ পর্যন্ত পৌঁছিল না। ক্রীড়ারম্ভেই অন্যতম মরে পরলোকগমন যে কী গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিস্থিতি তাহা কি দর্শকমণ্ডলী সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইলেন না? তবে কি মুহুর্মুহু মলুপতন না হইলে দর্শকজনমধ্যে আনন্দোল্লাসের সঞ্চার হয় না? বহ্বান্ন ভক্ষণই কি সুরুচির লক্ষণ? ভূমাতে সুখ তাহা জানি, কিন্তু অল্পেই বা কি কম? ঋষিবাক্য আছে, যাহা অল্প তাহাই মিষ্ট।
চক্রবর্তী রাজগোপালাচারী মহানগরী ত্যাগ করার পূর্বে বক্তৃতা-ভাষণে বিপুল শ্লেষ বর্ষণ করিয়া যান। প্রতি আমন্ত্রণে প্রত্যেকটি নিমন্ত্রণে তিনি সাতিশয় প্রাঞ্জল ভাষায় সর্ববিধ বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ উপদেশ বিতরণ করিয়া গিয়াছেন। তাহারই একটিতে তিনি জনগণকে উদ্দেশ করিয়া বলেন, হে দিল্লি যুবক সম্প্রদায়, যখনই দেখি তোমরা মাতা, কন্যা কিংবা প্রিয়াকে দ্বিচক্রযানের পশ্চাদ্দেশে বসাইয়া তাঁহাদের ভার আপন স্কন্ধে তুলিয়া লইয়াছ তখন আমি উল্লাস বোধ করি।
মল্লভূমির তোরণপ্রান্তে দণ্ডায়মান হইয়া দেখিলাম, অসংখ্য যুবক উপযুক্ত পদ্ধতিতে বহু বালাকে আনয়ন করিলেন।
এই দৃশ্য কলিকাতায় বিরল।
এক ইংরেজই বলিয়াছেন, দ্বাবিংশাধিক লোমাবৃত মূর্খ (টুয়েনটি টু ফ্ল্যানেলড় ফুলস) একটি চর্মাবৃত গোলক লইয়া জীবনমরণ পণ করিয়াছে, দেখিবার জন্য আসে আরও বিংশতি সহস্র মূর্খ! ইহারই নামান্তর ক্রিকেট।
ভদ্রলোক ক্রিকেটের মূল তত্ত্বটাই হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হন নাই। রথদর্শন এস্থলে অবান্তর।
এই যে কপোত-কপোতী তরুণ-তরুণী নানা ভঙ্গি নানা অঙ্গ সঞ্চালনের মাধ্যমে আপন আপন আনন্দ প্রকাশ করিতেছে, তন্বঙ্গী কোমলাঙ্গীগণ অঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন অংশ– অধুনা উদরও অঙ্গ-স্বরূপ গণ্য করিতে হইবে– প্রদর্শনকরতঃ বিমলানন্দ উপভোগ করিতেছেন, উচ্চ হাস্যে প্রতিবেশীর দৃষ্টি আকর্ষণকরতঃ তাহাদের চিত্তে উৎসুক্য লহরির সঞ্চার করিতেছেন, তদ্বিনিময়ে তরুণগণ ক্রিকেট শাস্ত্রে তাঁহাদের গভীর জ্ঞানের পরিচয় দিতেছেন যেন এক স্বয়ম্বরসভায় আপন গুণস্বরূপ সালঙ্কার বর্ণনা করিতেছেন, ইহাই তো মুখ্য, ইহাই তো তত্ত্ব, এষাস্য পরমাগতি।
.
১০.
ইউফ্রেতিস তাইগ্রিসের পারে আসিরীয় বাবিলনীয় সভ্যতা বেরোল, নীল নদের পারে মিশরীয়, পীতনদের পারে চৈনিক। গঙ্গাপারের আর্যসভ্যতা এদের চেয়ে কয়েক হাজার বছরের ছোট। তাই প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বহুকাল ধরে মনে মনে আশা পোষণ করছিলেন যে গঙ্গা কিংবা সিন্ধুপারে হয়তো-বা একদিন কোনও এক প্রাক-আর্য এবং আসিরীয় বাবিলনীয় মিশরীয় সভ্যতার সমসাময়িক ওই জাতীয় প্রাচীন সভ্যতা বেরুবে।
তাঁদের সে আশা পূর্ণ করলেন স্বর্গীয় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশ্ব-জগৎ একদিন বিস্ময় মেনে শুনল সিন্ধু নদের পারে মোন-জো-দড়া নামক স্থানে রাখালদাস এক প্রাক আর্যসভ্যতা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। এ সভ্যতা সম্বন্ধে এস্থলে সবিস্তর বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। শিক্ষিত ভারতীয় মাত্রই এ সভ্যতার উৎপত্তি বিকাশ পতন সম্বন্ধে কিছু না কিছু খবর রাখেন।
গোড়ার দিকে পণ্ডিতেরা মনে করেছিলেন এ সভ্যতা কেবলমাত্র সিন্ধু পারে-পারেই বিকশিত হয়েছিল। তাই তারা এর নামকরণ করেছিলেন সিন্ধ উপত্যকা সভ্যতা। কিছুদিন পরে ক্রমে ক্রমে সে ভুল ভাঙল–দেখা গেল, এ সভ্যতা সিন্ধু পেরিয়ে এবং ছাড়িয়ে সুদূর অবধি বিস্তৃত ছিল।
তারই সন্ধানে অরেলস্টাইন ভাওয়ালপুর স্টেট (পাকিস্তান) ও তারই সীমান্তে বিকানির রাজ্যে ১৯৪১ সালে খোঁড়াখুঁড়ি করেন। তারই প্রতিবেদন অরেলস্টাইন অত্যন্ত চিত্তাকর্ষকরূপে বর্ণনা করেছেন তার কিছুটা প্রকাশিত হয়েছে, কিছুটা পরে প্রকাশিত হবে।
নানা কথার ভিতর অরেলস্টাইন একথাও বলেন যে, ভাওয়ালপুর স্টেটের ফোর্ট আব্বাসের পূর্ব দিকে আর কোনও জায়গায় মোন-জো-দড়ো সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়নি। অরেলস্টাইন এ মন্তব্যটি করেন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে। আজকের ভাষায় বলা হবে, পাকিস্তানেই মোন-জো-দড়ের শেষ নিদর্শন পাওয়া যায়– পূর্বদিকে অর্থাৎ ভারতে পাওয়া যায় না।
কেন্দ্রীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সহ-অধ্যক্ষ শ্ৰীযুত অমলানন্দ ঘোষ এ বছরে শীতকালটা বিকানির স্টেটে খোঁড়াখুঁড়ি করে ফিরে এসেছেন।
তাঁর প্রধান কর্মস্থল ছিল সরস্বতী নদীর মধ্যভূমি–মনু এ ভূমিকে পুণ্যভূমি ব্ৰহ্মাবর্ত নামে উল্লেখ করেছেন। দৃষদ্বতীর উত্তরে এবং সরস্বতীর দক্ষিণে ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র– মহাভারতকার বলছেন, কুরুক্ষেত্রে বাস স্বর্গলোকে বাস করার ন্যায়।
শ্ৰীযুত অমলানন্দ ঠিক কোন কোন জায়গায় তার অনুসন্ধানকর্ম সমাধান করেছেন তার সবিস্তর বর্ণনা খবরের কাগজের মারফতে পেশ করা কঠিন– এখন অসুবিধা এই যে তার জন্য ম্যাপের প্রয়োজন; মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে তিনি সরস্বতী এবং দৃষদ্বতী দুই নদীর পারে পারে অনুসন্ধান করতে করতে তাদের সঙ্গমভূমি এবং তারও পশ্চিমে অনূপগঢ় পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। অনুপগঢ় থেকে প্রায় ছ মাইল দূরে ভাওয়ালপুর রাজ্যের সীমানা। শ্ৰীযুত ঘোষ ভাওয়ালপুর যাননি। ভাওয়ালপুর যাওয়ার উপায় নেই– সে জায়গা পাকিস্তানে সবাই জানে।
অরেলস্টাইনের মতো গুণী বলে গেলেন এ তল্লাটে কিছু পাবে না– এমনকি শ্ৰীযুত ঘোষ যেসব জায়গা খুঁজেছেন তারও দু একটা স্টাইন খুঁড়ে নাকচ করে দিয়ে গিয়েছিলেন আর তখন যদি ঘোষ সেখানে গিয়ে দুম করে হারাপ্পা মোন-জো-দভোর খোঁজ পান তখন ব্যাপারটা কীরকম হয় বলুন তো?
এই বেলা পাঠককে একটু সাবধান করে দিই।
যারা মোন-জো-দড়ো সভ্যতা খুঁটিয়ে আলোচনা করেছেন, তাঁরা জিগ্যেস করবেন, তবে কি ঘোষ মোন-জো-দড়া সভ্যতার নরনারীর জাত-গোত্র ঠিক করে ফেলেছেন তারা আর্য দ্ৰবিড় না অন্য কোনও জাত– তবে কি ঘোষ হারাপ্পা-লিপির পাঠোদ্ধার করতে পেরেছেন, তবে কি তিনি সপ্রমাণ করতে পেরেছেন যে, আর্য এবং হারাপ্পা সভ্যতাতে সঙ্ঘর্ষ বেধেছিল, তবে কি তিনি বলতে পারেন হারাপ্পা সভ্যতা হঠাৎ কর্পূরের মতো উবে গেল কী প্রকারে?
ঘোষ এসব প্রশ্নের একটারও উত্তর দেননি। তবুও আমি ঘোষের প্রত্নতাত্ত্বিকতায় এত উল্লাস বোধ করছি কেন?
প্রথমত, দৃঢ়নিশ্চয় সপ্রমাণ হয়ে গেল যে, মোন-জো-দড়ো হারাপ্পা সভ্যতা শুধু সিন্ধু দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না, পূর্বদিকে উজিয়ে উজিয়ে বিকানির পেরিয়ে পূর্ব পাঞ্জাব অবধি এসে ঠেকেছিল অর্থাৎ আগে যে বলা হয়েছিল মোন-জো-দড়ো হারাপ্পা সভ্যতা গুটিকয়েক জায়গাতে (শহরে) সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। সপ্রমাণ হল বেলুচিস্তান থেকে পূর্ব পাঞ্জাব এই সাত শো মাইল এক বিরাট সভ্যতার লীলাভূমি ছিল এবং এই বিস্তৃতি সে যুগের পৃথিবীর যে কোনও সভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে।
দ্বিতীয়, এ সভ্যতা লোপ পাওয়ার পর এক দ্বিতীয় সভ্যতার সন্ধান ঘোষ পেয়েছেন। তার বৈশিষ্ট্য যে সে হারাপ্পার রঙ ও নকশার হাঁড়ি কলসি বানায়নি তার রঙ গ্রে (মেটে) এবং একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে এ সভ্যতা হারাপ্পার পরের সভ্যতা। এই মেটে সভ্যতার (গ্রে ওয়েসার) নরনারী কারা সে সম্বন্ধেও এখনও কিছু বলা যায় না, তাদের যুগনির্ণয়ও সুকঠিন, তবে মোটামুটি আন্দাজে বলা যেতে পারে যে, এদের সভ্যতার কেন্দ্রক্ষণ খ্রি. পূ. ৬০০। তা হলে নিচের দিকে হয়তো মৌর্যদের সঙ্গে এদের পরিচয় হয়েছিল, কিন্তু উপরের দিকে হারাপ্পার সঙ্গে এর সংযোগ হয়নি। কারণ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, হারাপ্পা সভ্যতা যেসব আবাসভূমি পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিল (কিংবা নৈসর্গিক কোনও কারণে নির্মূল হয়ে গিয়েছিল) সেগুলোতে এরা আপন বাসভূমি নির্মাণ করেনি। (মুসলমানরা রায় পিথৌরা, অর্থাৎ পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করে তাঁরই রাজধানীতে আসন গেড়েছিল; সাত শো বছর পরে আজও রায় পির্থেীরার দুর্গের দেয়াল কুতুবমিনারের চতুর্দিকে দেখতে পাওয়া যায়। তা যাই হোক না কেন, এদেরই খেই ধরে ভবিষ্যতে মেলা আবিষ্কার হতে পারে সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই।
তৃতীয়ত, যে আরেক সভ্যতার সন্ধান ঘোষ পেয়েছেন তার নাম দিয়েছেন, রঙ্গমহল সভ্যতা, কারণ বিকানিরের আধুনিক রঙ্গমহল অঞ্চলে এ সভ্যতার বিস্তর উদাহরণ তিনি পেয়েছেন। রঙ্গমহল মুসলমানি যুগের শব্দ– অর্থাৎ এ সভ্যতার অন্তত হাজার বছর পরেকার, কিন্তু রঙ্গমহল জায়গাটি বিকানিরে সুপরিচিত বলে এ নামকরণ করা হয়েছে।
এ সভ্যতা মেটে সভ্যতার পরবর্তী এবং নিঃসন্দেহ কুশান যুগ পর্যন্ত পৌঁছেছিল, এমনকি গুপ্ত যুগ পর্যন্ত, কারণ, গুপ্ত যুগের গান্ধার শিল্পের নিদর্শনও এতে রয়েছে।
এ তিন সভ্যতার নির্মাতা কারা, ঠিক ঠিক কোন যুগে এরা ভারতবর্ষে বসবাস করেছিল, একে অন্যের সঙ্গে এদের দ্বন্দ্ব হয়েছিল কি না, এসব তত্ত্ব এবং তথ্য জোর গলায় আজ বলা অসম্ভব।
শ্রীঅমলানন্দ ঘোষ বিকানিরে যে অদ্ভুত অধ্যবসায়ের সঙ্গে অনুসন্ধান করেছেন তাতে মেলা প্রশ্ন মাথা তুলেছে।
যেসব প্রশ্নের তিনি উত্তর দিয়েছেন সেগুলো পূর্বেই নিবেদন করেছি, কিন্তু নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করাও প্রত্নতাত্ত্বিকের কর্ম। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, সুযোগ এবং সুবিধা পেলে– ঘোষ এখনও যুবক– তিনি অনেক কাজ করে বহু প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ হবেন।
গত বৃহস্পতিবার আমাদের এক ঘরোয়া বৈঠকে ঘোষ আমাদের এ বাবদে বক্তৃতা দিয়ে তালিম দেন। সব জিনিস ঠিক ঠিক বুঝতে পারিনি বলে হয়তো ঘোষের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। ঘোষ সহৃদয় লোক, এ লেখা যদি তার হাতে পৌঁছয় তিনি মাপ করে দেবেন এ আশা মনে পোষণ করি। আমার উদ্দেশ্য, গুণীরা যেন এ বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে শ্রীমান ঘোষকে উৎসাহিত করেন।
.
১১.
একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে মিস মেয়ে কিংবা বেভারলি নিকলস যে উদ্দেশ্য আর যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এদেশে এসেছিলেন শ্রীমতী রজোভেল্ট আদপেই সে রূপ নিয়ে আসেননি। ভারতবর্ষের ভালো-মন্দ পাপ-পুণ্য নিয়ে তিনি যেমন কড়া কড়া কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেন না ঠিক তেমনি তিনি অকারণ অসময়ে আমাদের পিঠ চাপড়ে আমরা যে বড় সুবোধ ছেলে সেকথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চান না।
তাঁর দৃষ্টি আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যার দিকে। আজকের দিনে আমেরিকারই অঢেল রেস্ত আছে; ভারতের উন্নতির জন্য এদেশীয় বহুলোক খাটবার জন্যও তৈরি আছেন। এ দুয়ে মিলে যে অনেক সকর্ম সমাধান হতে পারে সে বিষয়ে কারও মনে কোনও দ্বিধা নেই। শ্ৰীমতী রজোভেল্ট ঠিক এই জিনিসটিই মনে রেখে এ দেশে বহু পর্যবেক্ষণ করেছেন ও দিল্লির তাবৎ সভা এবং পার্টিতে এ সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন– অতিশয় সহিষ্ণুতার সঙ্গে সর্ব প্রশ্নের যথাসাধ্য উত্তর দিয়েছেন।
এদেশের অনেকেরই মনে ভয় শুধু কম্যুনিস্ট না, অন্য পাঁচজনেরও আমরা যদি একবার মার্কিন টোপ গিলি তা হলে আর মার্কিন রাজনৈতিক বঁড়শি থেকে কস্মিনকালেও ছাড়া পাব না। এর উত্তরে প্রথম বক্তব্য ইংরেজি প্রবাদ, নো রিস্ক, নো গেন সম্পূর্ণ মিথ্যে নয়। দেশীয় প্রবাদের ভাষায় বলি, সাপ মারতে গেলে লাঠি ভাঙবেই ভাঙবে একথা হলফ করে বলা যায় না, মাঝে মাঝে না-ও ভাঙতে পারে।
দ্বিতীয়ত আমার বিশ্বাস পৃথিবীর বুদ্ধিমান জাত এখন আর ডাণ্ডা বুলিয়ে অন্য দেশের ওপর রাজত্ব করতে চায় না। এখন সে চায় অর্থনৈতিক রাজত্ব– অর্থাৎ পৃথিবীর আর পাঁচটা জাতের কাছে নিজের সুবিধেয় মাল বেচতে। তবে যদি বলেন, আমেরিকার কাছ থেকে রেস্ত নিলে আমরা তাদের অর্থনৈতিক আওতায় এসে যাব তা হলে নিবেদন, রুশ ভিন্ন পৃথিবীতে আজ কোন জাত মার্কিনি আওতার বাইরে? এই যে মহামান্য ইংরেজ মহাপ্রভুরা দুনিয়ার সর্বত্র দাবড়ে বেড়ান তেনাদের অবস্থাটা কী? আজ যদি তারা মার্কিনের সঙ্গে বড্ড বেশি তেড়িমড়ি করে তবে কাল কাক-কোকিল ডাকবার আগেই মাংসটা আণ্ডাটার দাম চড়চড় করে আসমানে চড়ে ডালটার উপর বসে ঠ্যাং দুলাবে। বাজার করতে গিয়ে তার চরণের ধুলোটি স্পর্শ করা যাবে না।
তবে হ্যাঁ, আলবৎ, স্বেচ্ছায় আমরা এরকম অবস্থা বরণ করে নেব কেন?
আমার অন্ধ বিশ্বাস ভারত বিরাট দেশ তাই সে কারও ধামাধরা না হলেও বেঁচে থাকতে পারবে। তার পূর্বে অবশ্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন কৃষির সুব্যবস্থা করা। তার জন্যে প্রয়োজন জলের বাঁধ, বিজলির আলো। আরও দরকার কৃষির জন্য উন্নত কলকবজা, সার। এসবের জন্য উপস্থিত রেস্তর প্রয়োজন। ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ, একবার তার কৃষি আপন পায়ে দাঁড়াতে পারলে তখন আর কোনও ভাবনা থাকবে না।
আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, রায় পিথৌরা অতিশয় অমায়িক লোক। তিনি কারও কাছে অঋণী হয়ে মরতে চান না, তাই যদি এসব বাবদে রুশরা সাহায্য করতে চান, তবে তিনি তাদেরও সাহায্য নিয়ে রুশ জাতটাকে কৃতার্থম্মন্য করতে প্রস্তুত আছেন।
রুশের আওতায় পড়ে যাব? তার ভয় আরও কম। পূর্বে বলেছি, বুদ্ধিমান জাত অন্য দেশের ওপর রাজত্ব করতে চায় না। তাই ইন্দোচীনে ফ্রান্সের কাণ্ডকারখানা দেখে কী বলব ভেবে পাইনে।
গোড়ায় আমেরিকা ইন্দোচীনের ঝামেলায় নামতে চায়নি। ওদিকে ফ্রান্সের গাঁটে এত কড়ি নেই যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে একখানা আস্ত লড়াই চালাবার মতো বিলাস উপভোগ করতে পারে। তাই ফরাসিরা মেলা কায়দাকেতা করে, মেলা নল চালিয়ে মার্কিনকে নামাল তার দয়ে।
ওদিকে মার্কিন নামা সত্ত্বেও রাধা-নাচের নমণ তেল জ্বালাতে গিয়ে ফ্রান্সের আপন দেশে লাল বাতি জ্বলে আর কি। ফ্রান্সে এখন বহু বিচক্ষণ লোক দটা থেকে কোনও গতিকে বেরুতে পারলে বাঁচেন কিন্তু হায় ইতোমধ্যে মার্কিন চটে গিয়ে বলছে, ইয়ার্কি পেয়েছ? আমাকে নামিয়ে দিয়ে এখন কেটে পড়তে চাও? সেটি হচ্ছে না যে জল ঘোলা করেছ সেটা তোমাকেও খেতে হবে। মার্কিনি ভাষায়, ইন ইয়োর ওন জুস–আপন রসে সিদ্ধ হও।
ফ্রান্সের লোক বেহুলার ভাসান শোনেনি– তা হলে ইন্দোচীনের ঘাটের দিকে যেত না–
ও ঘাটে যেয়ো না বেউলো
বেভলো আমার মা
চাঁদের ব্যাটা দুশমন নখা
দেখলে ছাড়বে না।
শ্ৰীযুত সুবিমল দত্ত আমাদের ভারতের রাজদূত হয়ে জর্মনি যাচ্ছেন। উপস্থিত জর্মনির রাজধানী বন শহরে তাই বলে কেউ যেন না ভাবেন মহাশয় বনবাসে চললেন।
বন জর্মনির সেরা সুন্দর শহর। সামনে রাইন নদী, পিছনে ভিনাস পাহাড়, রাইনের ওপারে সিবেন গেবির্গে বা সুপ্ত পর্বত। চতুর্দিকে বাগান, চতুর্দিকে সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি। শহরের ভিতরেও বিস্তর কাঁচা সবুজ পার্ক।
আর লোকগুলো ভারি চমৎকার। বন শহরটা জর্মনের সীমান্তে, বেলজিয়ামের গা ঘেঁষে। ফ্রান্সের সঙ্গেও তার বিস্তর দহরম মহরম। বন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর বিদেশি ছাত্র পড়াশোনা করে, ততোধিক টুরিস্ট বনে প্রতিবছর বেড়াতে আসে তাই বন-বাসিন্দা চিরকালই একটুখানি আন্তর্জাতিক বিশ্বনাগরিক প্রকৃতির খাঁটি প্রাশানদের মতো কুনো আর দাম্ভিক নয়।
স্বাধীনতা লাভের পূর্বে ইংরেজের তাড়া খেয়ে খেয়ে বহু ভারতীয় শেষ আশ্রয় নিত জর্মনিতে। জর্মনরা কোনও কালেই ভারতীয়দের আশ্রয় দিতে কার্পণ্য করেনি। তাই যখন যুদ্ধের পর অনেক জাত কে কত ক্ষতিপূরণ পাবে তার আলোচনা করছিল তখন ভারতীয় সরকার স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন যে, জর্মনদের ওপর আমাদের কোনও দাবি-দাওয়া নেই। যেসব ভারতীয়দের জর্মনির সঙ্গে কোনওপ্রকারের যোগাযোগ ছিল তারাই এ সংবাদ শুনে উল্লাস বোধ করেছিলেন।
যৌবনে বন শহরে রায় পিথৌরা জর্মন সতীর্থদের সঙ্গে বসে বসে স্বাধীন ভারতের সুখস্বপ্ন দেখতেন। সেসব সতীর্থেরা সংস্কৃত ও ভারতীয় ঐতিহ্যের আলোচনা করতেন বলে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারতেন না ভারতবর্ষ তার স্বাধীনতা হারাল কী করে। এবং তাই বোধহয় তারা জোর গলায় বারবার বলতেন, ভারতবর্ষ খুব শীঘ্রই পুনরায় তার স্বাধীনতা ফিরে পাবে। কিংবা হয়তো আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যই বলতেন, কে জানে?
স্বাধীনতা লাভের পরই আমি এঁদের কাছ থেকে বহু আনন্দ অভিনন্দন পাই। একজন লিখলেন, তুমি তোমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট দেখাতে সবসময়ই লজ্জা অনুভব করতে। এইবার ভারতীয় পাসপোর্ট বুকে দুলিয়ে সোজা জর্মনি চলে এস।
ভারতের স্বাধীনতা লাভে এঁরা কতখানি উল্লাস বোধ করেছেন সেকথা আমি জানি, কিন্তু প্রকাশ করার মতো ভাষার দখল আমার নেই।
দত্ত মহাশয়কে জর্মনরা সাদরে গ্রহণ করে নেবে সেকথা আমি নিশ্চয় জানি, তার প্রধান কারণ দত্ত মহাশয় অতিশয় অনাড়ম্বর লোক! জর্মনির প্রতি তাঁর প্রীতি আছে– কিছুদিন পূর্বে ডা. শাখট যখন ভারতে আগমন করেন তখন উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ হয়েছিল।
যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তাঁরা বলতে পারবেন জর্মনির সঙ্গে সাক্ষাৎ যোগসূত্রের ফলে আমাদের কী কী লাভ হবে। আমি বলতে চাই, তার চেয়েও আমাদের বেশি লাভ হবে যদি আমাদের মধ্যে বৈদগ্ধ্যগত আদান-প্রদান নিবিড়তর হয়। জর্মনিতে সর্বপ্রথম সংস্কৃত চর্চা আরম্ভ হয় বন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখনও সে চর্চা জোর এগিয়ে চলছে। বনের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র উত্তমরূপে স্থাপিত হলে এদেশের সংস্কৃত-চর্চা অনেকখানি উৎসাহ পাবে।
রাজদূতের মেলা কর্ম, অনেক ঝামেলা। কিন্তু দত্ত উচ্চশিক্ষিত লোক; তিনি কৃষ্টিগত যোগসূত্র স্থাপনে উৎসাহিত হবেন এ বিশ্বাস আমার আছে।
রুশদের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। তাদের পর্যবেক্ষণ শক্তি আছে।
একদা মিশনারিরা এদেশে অকাতরে বিনামূল্যে লক্ষ লক্ষ বাইবেল বিতরণ করেছিলেন। ফ্রি বলে সেগুলো লোকে পড়ত না। তখন মিশনারিরা বাইবেল বিতরণ একদম বন্ধ করে দিলেন। ফলে আজ যদি আপনি বাইবেল পড়তে চান, তবে গাঁট থেকে অন্তত টাকা দশেক না খসালে একখানা ভালো বাইবেল পাবেন না। কাজেই অবস্থা পূর্ববৎ বাইবেল এখনও কেউ পড়ে না।
রাশানরা দিল্লির বাজারে ছেড়েছে এন্তার মার্কস, লেনিন, স্টালিন, লের্মেন্টফ, চেখক, কিন্তু একদম ফ্রি নয়, আবার ন্যায্যমূল্য থেকে অনেক সস্তা। দেড় টাকায় লের্মেন্ট পেয়ে যাচ্ছেন– ভালো কাগজ উত্তম ছাপা। আপনাকে ঠেকায় কে? এবং যেহেতু কাঁচা পয়সা ফেলে তেল কিনছেন তখন সে তেল আজ না হোক কাল মাখবেনই।
এসব বইয়ের চাপে পড়ে মার্কিন মুলুকের সস্তা কেতাব ছাড়া ইংরেজি আর কোনও কেতাব আমার বাড়ির সামনের স্টলে পাওয়া যাচ্ছে না। স্টলওলা বলল, রাশায় ছাপা ইংরেজি বই বিক্রি করলে কমিশনও নাকি বেশি পাওয়া যায়।
আমার শুধু দুঃখ রাশানরা যত না মার্কস-এঙ্গেলস্ লেনিন-স্টালিন ছাড়ছে তার শতাংশের এক অংশও টলস্টয়, পুসকিন, দস্তায়স্কি, তুর্গেনিয়ে দিচ্ছে না।
.
১২.
ভূতনাথ এবং তস্য বন্ধু মদনগোপাল কী করিয়া যে গঞ্জিকাসক্ত হইল তাহার সঠিক সন্ধান মেলে না। পরোপকারার্থে তাহারা প্রায়ই নিমতলা, কেওড়াতলা গমনাগমন করে; হয়তোবা সেই উপলক্ষে বন্ধুদ্বয় এই ধূম্ৰাত্মক রসে নিমজ্জিত হইয়াছিল।
গুরুজনরা এই সংবাদ শুনিয়া বিচলিত হইলেন। তাহারা ভূতনাথ ও মদনগোপালকে আহ্বান করিয়া বলিলেন, দ্রসন্তানের এ কী আচরণ! আমরা বড়ই মর্মাহত হইয়াছি।
ভূতনাথ মদনগোপাল অতিশয় নম্র স্বভাব ধারণ করে; নতমস্তকে গুরুজনদের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া রহিল।
কোনওপ্রকারের আপত্তি অনুযোগ কিংবা উচ্চবাচ্য করিল না বলিয়া গুরুজনদের হৃদয় ঈষৎ দ্রবীভূত হইল। একজন বলিলেন, পালা-পার্বণে, অবরে-সরে না হয় কিঞ্চিত সন্মার্গভ্রষ্ট হইলে; কিন্তু নিত্য নিত্য– এইমাত্র বলিয়া সহৃদয় গুরুজন তৃষ্ণীভাব অবলম্বন করিলেন।
ভূতনাথ এবং মদনগোপাল ওই পন্থাই অবলম্বন করিবে মৌনভাবে এইরকম একটা প্রতিশ্রুতি দিয়া গৃহে প্রত্যাগমন করিল।
গৃহের দেহলি প্রান্তে গোধূলি লগ্নে ভূতনাথ ও মদনগোপাল নির্জীবের মতো পড়িয়া আছে। গঞ্জিকালগ্ন গতপ্রায়– ধূম্ররস না পাইয়া উভয়ই অতিশয় বিরস বদন। কিন্তু উপায়ান্তরই-বা কী? গুরুজনকে প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হইয়াছে, পালা-পার্বণ ব্যতীত গঞ্জিকারসে নিমজ্জিত হইবে না।
হঠাৎ রোদনধ্বনি শোনা গেল। মদনগোপাল তৎক্ষণাৎ সংবাদ নিতে প্রস্থান করিল। মুহূর্তেক মধ্যেই দ্রুতগতিতে প্রত্যাগমন করিয়া চিৎকার করিল ওরে ভূতো, ঝপ করিয়া একটা চিলিম সাজো। চুনীর মাতা গত হইয়াছেন।
ভগবান দয়াময়। পালা-পার্বনের সন্ধানে থাকিলে চুনীর মাতার মৃত্যুও পালারূপেই গণ্য করা যাইতে পারে।
রায় পিথোরা ভূতনাথ গোত্রীয়।
হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান আমার সম্মুখে স্ব স্ব পালা-পার্বণে আনন্দে নিমজ্জিত হইবেন এবং আমি দাঁড়িয়ে বাহিরে দ্বারে মোরা নরনারীর একজন হইয়া সেই রসস্রোতে নিমজ্জিত হইতে পারিব না, এই কুব্যবস্থার কল্পনামাত্র করিতেই আমি শিহরিয়া উঠি। তাহা হইলে আমি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অধিবাসী হইলাম কোন দুঃখে? অম্মদেশীয় মহাপুরুষগণ হিন্দুর মন্দিরদ্বার উন্মোচন করেন, ঈদোৎসবে মুসলমান সখাগণ দ্বারা নিমন্ত্রিত হয়েন, এই তাবৎ অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ সম্মুখে বিদ্যমান থাকিতে আমিই-বা কোন সম্প্রদায়-বিশেষের পালা-পার্বণে নিজেকে কূপমকের ন্যায় সীমাবদ্ধ করিব।
বড়দিন আসিল কিন্তু হায় কোথায় সেই ইংরেজ সম্প্রদায় যাহাদের প্রসাদাৎ গুরুভোজন এবং গুরুতর পানের সুব্যবস্থা হইত। খ্রিস্ট জন্মদিনের পূর্ব সন্ধ্যায় দেহলি প্রান্তে তাই অতিশয় বিরস বদনে মনে মনে ইংরেজকে অভিসম্পাত দিয়েছিলাম, স্বরাজ প্রদান করিলে তো করিলে (সে তো অস্থিমজ্জায় বারম্বার অনুভব করিতেছি) কিন্তু এই দেশ ত্যাগ না করিলে কি তোমাদের বাইবেল অশুদ্ধ হইয়া যাইত? অন্ততপক্ষে খ্রিস্টদিগকে খ্রিস্টধর্মে বাপ্তিস্ম করিবার সর্ববাসনা কি তোমাদিগের চিরতরে লোপ পাইয়াছে।
দেহলি প্রান্তে বিশ্বেশ্বর বলুন, কাবা বলুন, এখানকার চক্রবর্তী কনট (পাঞ্জাবি উচ্চারণ ক্লাট সার্কল) সার্কল। সুসজ্জিত বিপণিমণ্ডলী চক্রাকারে এক সুরম্য উদ্যানকে পরিবেষ্টন করিয়া রহিয়াছে এবং অপূর্বদর্শন কামিনীগণ সুরম্য বেশভূষায় সুসজ্জিত হইয়া এই আপন চক্রে ঘূর্ণায়মান হইতেছেন। কোনও ললনা পাদুকা ক্রয় করিতে উপবেশন করিয়াছেন– রাতুল নোগ্র (চরণ বর্বর-যুগে প্রচলিত ছিল) সম্প্রসারিত করিয়া মধুর কণ্ঠে কাম্য পাদুকার নখ-শির বর্ণনা করিতেছেন। তাঁহার সম্মুখের পাদুকা-স্তূপ হিমাচলকে অনায়াসে লজ্জা দিতে পারে, সেই গগনচুম্বী স্কুপের পশ্চাতে আপণ-স্বামী কিংবা আপন স্বামী কাহাকেও আর দেখা যাইতেছে না। আহা কী মধুর দৃশ্য!
কোনও নাগরী কঞ্জুলিকার জন্য গলবস্ত্র হইয়াছেন– অর্থাৎ ময়ূরকণ্ঠী চীনাংশুক খণ্ড অমলধবল গলে জড়িত করিয়া পুনঃপুন নিরীক্ষণ করিতেছেন বর্ণসামঞ্জস্য শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে সুবিন্যস্ত হইতেছে কি না। সখীগণ নানাপ্রকারের সদুপদেশ দিতেছেন, পরমগুরু পতিদেব বস্ত্রমূল্য শ্রবণকরত পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করিয়াছেন, ক্ষীণকণ্ঠে প্রতিবাদকল্পে ওষ্ঠাধর উন্মোচন করিবার পূর্বেই নাগরীর নাসিকা স্ফীত হইতে লাগিল।
রায় পিথৌরা দ্রুতগতিতে বিপণি ত্যাগ করিলেন।
হায় খ্রিস্ট জন্মোৎসব! বিপণি-আপণ প্রদর্শন করিয়াই আমার উৎসব সমাধান হইবে?
অকস্মাৎ স্কন্ধোপরি চপেটাঘাত। দেখি, পারসি মিত্র, রুস্তম ভাই মিনুচিহর নাদির শাহ! তুমি মোহময়ী (বোম্বাই) ত্যাগ করিয়া দেহলি প্রান্তে কেন?
কর্মোপলক্ষে।
উত্তম উত্তম।
খ্রিস্ট জন্মোৎসব পালন করিতেছ না?
দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলাম, খ্রিস্টান বন্ধু কেহই নাই।
নাদির শাহ স্কন্ধোপরি পুনরায় চপেটাঘাত করিয়া বলিল, এইমাত্র অনটন, তুমি কি বিস্মৃত হইয়াছ যে আমার পিতামহ জরথুস্ত্র ধর্ম ত্যাগকরতঃ খ্রিস্টের স্মরণ লইয়াছিলেন। আইস বত্স, এই নির্বান্ধব পুরীতে কোনও ভোজন এবং পানশালাকে আমাদিগের পৃষ্ঠপোষকতা দান করিয়া তাহাদিগকে কৃতার্থম্মন্য করি।
নাদির শাহ অতিশয় গুণী ব্যক্তি। ভোজনগৃহে প্রবেশকরতঃ সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করিল, শিশির ঋতুতে ব্র্যান্ডিই প্রশস্ত। তৎপর অন্য বস্তু সম্বন্ধে আলোচনা হইবে।
আমি বলিলাম, আমার দুর্বলতা আহারাদির প্রতি।
নাদির শাহ বলিল, ভ্রাতঃ, আমার মাতামহী বিশুদ্ধ ইরানবাসিনী, বাল্যকাল হইতে আমি ইরানি খাদ্য ভূরি ভূরি আহার করিয়াছি। প্রথম যৌবন দিল্লিতে কর্তন করি– মোগলাই খাদ্য আমার অপরিচিত নহে। গৃহিণী ফরাসিনী; অতএব ভ্রাতঃ, বিবেচনা কর এই সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা কিছু বেশি।
প্রথম আসিল ফরাসিস পদ্ধতিতে অরদ (hors-d’oeuvre)। নানা অংশে বিভক্ত যে বিরাট খুঞ্জা আসিয়া উপস্থিত হইল তাহাতে অন্তত দশাধিক রকমের খাদ্য। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জর্মন (ফ্রাঙ্কফুটার) সসিজ, ভর্জিত এবং অভর্জিত বেকন এবং হ্যাম, জলপাই তৈলসিক্ত টোস্টাসিন রৌপ্যবর্ণের সার্দিন মৎস্য, অতিশয় নমনীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অমলেট খণ্ড, সিরকা-নিমজ্জিত পলা-ত্রপুষী-কোষা (প্যাঁজ-কাঁকুড়-জলপাই), রুশদেশ হইতে সদ্যাগত কাভিয়ার বা মৎস্য-ডিম্বের স্যান্ডউইচ, সেই রুশ পদ্ধতিতে মাইয়নেজ মধ্যে সুপ কুকুটু-ডিম্ব। অন্য খাদ্যবস্তুগুলির গোত্রবর্ণ অনুমান করিতে পারিলাম না।
নাদির শাহ বলিল, ক্ষুধাকে তীক্ষ্ণতর করিবার উপাদান। স্পর্শ করিবে মাত্র– অনাহারের জন্য ব্যাপকতর ব্যবস্থা।
ধন্য নাদির শাহ।
বলিল, সুপ খাইলে অনর্থক উদর পূর্ণ হইয়া যায়। অতএব সুপ সর্বথা বর্জনীয়। ডাচেস অব উইনজার নিমন্ত্রণে কদাচ সুপ পরিবেশন করেন না। অতএব এক্ষণে আসিবে তন্দুর-মৎস্য।
আমি বলিলাম, তন্দুর-মুরগি খাইয়াছি কিন্তু তন্দুর-মৎস্য?
অর্থাৎ তন্দুরে প্রস্তুত মৎস্য– ওভেন-বেকড ফিশ!
সে মৎস্য দেখিয়া মনে হইল অপকূ বস্তু। যেন মৃত মৎস্য খাইতে দিয়াছে। অথচ স্পর্শ করিবামাত্রই তিনি নমনীয় কমনীয় খণ্ডে খণ্ডে বিচ্ছিন্ন হইলেন। তন্দুরের উষ্ণতা চতুর্দিক হইতে সমভাবে মৎস্যের সংলগ্ন হইয়াছে বলিয়া তিনি অপূর্ব রসনাভিরাম রবস্তু হইতে সক্ষম হইয়াছেন।
নাদির শাহ আদেশ দিল, ইহার সঙ্গে কিঞ্চিৎ ভিয়েনিজ ক্রোয়ার্স ভক্ষণ কর।
তুর্করা যখন ভিয়েনার নগরদ্বারে পরাজিত হইয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হয় তখন সেই ঘটনার স্মরণার্থে ভিয়েনা-বাসীরা অর্ধচন্দ্রের (ক্রোয়ার্স-ক্রিসেন্ট) আকারে এক কোমল অথচ মর্মরিত রুটি নির্মাণ করে। অতিশয় উপাদেয় লঘু খাদ্য।
অতঃপর তন্দুরি-মুরগি এবং আফগানি নান-রুটি। তাহার বর্ণনা আমার সুরসিক পাঠকদিগকে পূর্বেই নিবেদন করিয়াছি।
নাদির শাহ একাধাধিক নিষিদ্ধ পক্ষী ভক্ষণকরতঃ বলিল, এইবারে সত্য আহার আরম্ভ হউক। ওয়েটারকে বলিল, মটর-কোপ্তা-বিরিয়ানি, আলু-মটরশুটি মুরগি কারি, কিঞ্চিৎ কোপ্তা নরগিস্ (কলিকাতার ডেভিল) এবং অত্যল্প শূল্যপক মিশরি কাবাব (কলিকাতার শিক কাবাব)। আর দেখ, মুরগি-কারিতে যদি যথেষ্ট ঝোল না থাকে তবে এক পাত্র রৌগন-জুশ এবং কিঞ্চিৎ ক্রিম-লেটিস সালাড। উপস্থিত (এবং এই শব্দটি নাদির যথেষ্ট দঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করিল) ইহাই যথেষ্ট।
আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, বলিতে পারো, মূর্খেরা সালাড় কেন জলপাই (অলিভ) তৈল দিয়া প্রস্তুত করে? সেই তৈলে না আছে গন্ধ না আছে কোনওপ্রকারের তীব্রতা। সালাডের পক্ষে বঙ্গদেশে প্রচলিত সরিষার তৈলই প্রশস্ততম। তুমি এক কাজ কর। কিঞ্চিৎ মাস্টার্ড জলে তরল করতঃ সালাডের সঙ্গে সংমিশ্রণ করিয়া দাও।
ধন্য ধন্য নাদির শাহ; তুমি বঙ্গভূমিতে পদার্পণ না করিয়াও কী প্রকারে অবগত হইলে আমরা স্ফীততণ্ডুল সরিষার তৈল সহযোগে ভক্ষণ করি।
আহারে ক্ষান্ত দিয়া নাদির বলিল, ইহারা ঘৃতসিক্ত উত্তম পরোটা নির্মাণ করিতে জানে না। নতুবা পোলাও-কারির অন্তরালে মধ্যে মধ্যে সেই বস্তু চর্বণ রসনাকে বহ্বান্ন ভক্ষণে উৎসাহিত করে।
অতঃপর নাদির শাহ বলিল, মিষ্টান্ত সম্বন্ধে অহেতুক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইয়ো না। আমি তাহার সুব্যবস্থা করিয়াছি।
রসগোল্লা লেডিকিনি এবং সন্দেশ!!
নাদির বলিল, শুনিয়াছি, কলিকাতার তুলনায় নিকৃষ্ট। তুমি অপরাধ নিয়ো না।
ধন্য নাদির। নাদির ভারত জয় করিয়াছিল; তুমি খাদ্যব্রহ্মাণ্ড জয় করিয়াছ।
আশা করি, এই খাদ্যনির্ঘণ্ট দেহলি প্রান্তাগত বঙ্গবাসী স্মরণ রাখিবেন। আমাকেও।
.
১৩.
ভারতীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের বহু বহু পুস্তক এদেশে লোপ পেয়েছে, কিন্তু অনুবাদ তিব্বত, চীন, মধ্য এশিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং পূর্ব তুর্কিস্থানের নানা ভাষাতে এখনও পাওয়া যায়। শুধু বৌদ্ধ মঠেই যে এদের সন্ধান মেলে তা নয়, মধ্য এশিয়ার বালির নিচ থেকেও এসব অনুবাদের বই এখন বেরুচ্ছে।
ভারতবর্ষীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ এবং তার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নির্মাণের জন্য এসব অনুবাদ গ্রন্থ অবর্জনীয়। কিন্তু প্রশ্ন এই বিরাট কর্মভার গ্রহণ করতে যাবে কে?
কিছুকাল পূর্বে নাগপুরে শ্রীযুক্ত রঘুবীর ভারতীয় সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক পরিষদ (ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি অব্ ইন্ডিয়ান কালচার) প্রতিষ্ঠা করেন। এ পরিষদের কাজ যাতে করে দেশ-বিদেশের গুণী-জ্ঞানীদের সাহায্যে ভালো করে গড়ে ওঠে, তার জন্য পরিষদ জাপান, ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়া, বৰ্মা, সিংহল, ভারতবর্ষ, ফ্রান্স, ইতালি, জর্মনি, ইংলন্ড, হল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যের পণ্ডিতদের সহায়তা চেয়ে আহ্বান জানান এবং ইতোমধ্যেই সহৃদয় উত্তর পেয়েছেন।
দিল্লিতে এসে শ্রীযুক্ত রঘুবীর বললেন, পশ্চিম জার্মানির মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্ৰীযুত নোবেল মহাযান বৌদ্ধধর্মের সুবর্ণ প্রভাসসূত্র পুস্তকখানা সর্বপ্রথম প্রকাশ করবেন। পরিষদ ক্রমশ কী কী পুস্তক বের করবেন তার একটি খসড়াও অধ্যাপক নোবেল তৈরি করেছেন।
এ অতি উত্তম প্রস্তাব কোনও সন্দেহ নেই। ভারতের বৈদগ্ধ্যগত ইতিহাসের প্রতি যাঁরই কণামাত্র মমতা আছে, তিনিই এ কর্মে সহায়তা করবেন এ বিশ্বাস আমাদের মনে আছে। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, একমাত্র ভারতীয় পণ্ডিতেরাই যদি একাজে সহায়তা করেন, তা হলেই অল্পদিনের ভিতর বিস্তর উন্নতি দেখানো সম্ভবপর হবে।
এ কাজের জন্য টাকা কোথা থেকে আসবে সে প্রশ্ন অবান্তর।
এ কাজ যখন সম্পূর্ণ করতেই হবে, তখন টাকা যোগাড় করতেই হবে।
কিন্তু প্রধান প্রশ্ন এসব বই পড়বে কে?
সংস্কৃত ভাষার (পালি ও প্রাকৃতের কথা থাক) চর্চা বাংলা দেশে এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেকথা যারা আনন্দবাজারে চিঠিপত্রে জনমত পড়ে থাকেন তারাই জানেন। কেউ কেউ স্কুল-কলেজে সংস্কৃত চর্চার জন্য যে ব্যবস্থা করতে চান, সেটা বাচ্চাকে ক্রমে ক্রমে মায়ের দুধ ছাড়ানোর মতনই। অন্যেরা বাচ্চাটাকে বাকি জীবন আধমরার মতো করে রাখতে চান। যারা ভালো করে সংস্কৃত পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে চান, তারা যেন কল্কে পাচ্ছেন না বলে মনে হচ্ছে। বাংলার বাইরেও অবস্থা প্রায় একই। টোল-পাঠশালা বাঁচিয়ে রাখবার জন্য পণ্ডিতদের দু মুঠো অন্ন দেবার প্রস্তাব কেউ করেছেন বলে জানিনে।
শেষটায় কী হবে বলা শক্ত। তবে আশা করি, পাঠক আমার ওপর চটে যাবেন না, যদি নিবেদন করি যে, এ দেশে সংস্কৃতচর্চা ব্যাপকভাবে হওয়ার আশা দুরাশা। অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজ, যেখানে ক্লাসিস্ পড়ানোর জন্য গণ্ডা গণ্ডা জলপানি রয়েছে, সেখানেই যখন বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতির মোহে পড়ে ছাত্রেরা ক্লাসিক বর্জন করেছে, তখন এ গরিব দেশ সংস্কৃতের জন্য কাকে কী প্রলোভন দেখাতে পারে?
অথচ স্বরাজ পাওয়ার পরও ভারতীয় তরুণ যদি আপন সংস্কৃতিচর্চা না করে, তবে সে এদেশে গড়ে তুলবে কী বস্তু? জলের বাঁধ, বিজলির প্রসার, কারখানার ছয়লাপ করে করেই তো একটা জাত বেঁচে থাকতে পারে না। আত্মার ক্ষুধাও তো রয়েছে– আজ না হয় পেটের ক্ষুধায় সেটাকে অস্বীকার কিংবা অবহেলা করে যাচ্ছি।
অতএব আমি মনে করি, ভারতীয় সংস্কৃতি সহজবোধ্য করে তুলতে হবে।
অর্থাৎ তিব্বতি চীনা থেকে যেসব বই অনুবাদ করা হবে, সেগুলো যেন হিন্দি, বাংলা ইত্যাদি ভাষাতে সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করার ব্যবস্থা করা হয়। ইংরেজিতে অনুবাদ না করলেও ক্ষতি নেই আজকের দিনের ছেলে-ছোকরারা যখন দাশগুপ্তের ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস ইংরেজিতে পড়ে না, কিংবা পড়তে পারে না, তখন আর চীনা বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ করে কী লাভ।
আমার মতো পাঁচজন বুড়ো মাথা চাপড়ে হয়তো জিগ্যেস করবেন, আমাদের এ অবস্থা হল কেন? সংস্কৃত কি তবে এদেশ থেকে লোপ পেয়ে যাবে? উত্তরে বলি, কালধর্ম।
.
১৪.
এই খোলা মাঠের সিনেমা বানাতে আমাদের এতদিন লাগল কেন? ইয়োরোপে ঠাণ্ডা, কুয়াশা, গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যা হতে হতে দশটা বেজে যায়– তা-ও ভালো করে অন্ধকার হয় না। সেখানে আকাশের তলায় সিনেমা বানানোর কথাই ওঠে না। আবার কাইরো শহরে বছরে আড়াই ইঞ্চি বৃষ্টি হয় কি না হয়, কুয়াশা সেখানে অজানা, আবহাওয়া না-গরম-না-ঠাণ্ডা, সেখানে তাই ভোলা সিনেমার খোলতাই। দিল্লি এ দুটোর মধ্যিখানে, বরঞ্চ বলব কাইরোর গাঁ ঘেঁষে, তবু ভোলা সিনেমা খোলা হল মাত্র গত সপ্তাহে।
ব্যবস্থা কিন্তু উত্তমই হয়েছে। যে জায়গাটি বেছে নেওয়া হয়েছে, সেটিও পুরনো দিল্লি আর নয়াদিল্লির মাঝখানে ফিরোজ শাহ কোটলার পিঠে পিঠ লাগিয়ে। সিনেমার পর্দাখানা বানানো হয়েছে মামুলি পর্দার ডবল সাইজে বেশ শক্ত করে বাঁধা হয়েছে, যাতে করে হাওয়ায় না দোলে, তবে চতুর্দিকে কালো বর্ডার লাগানো হয়নি বলে চোখ অস্বস্তি অস্বস্তি বোধ করে।
বিরাট ব্যবস্থা, তাই টিকিটের জন্য মারামারি কাটাকাটি করতে হয় না। ভিতরে গিয়ে যে কোনও এক কোণে আপন আসন বেছে নিয়ে দিব্য বায়স্কোপ দেখা যায়, কেউ এসে ধাক্কা লাগায় না, মশাই আমার সিটে বসেছেন যে মাইরি, সিগারেটের ধুয়োর উৎপাত নেই। মোলায়েম ঠাণ্ডায় অনায়াসে দু দণ্ড ঘুমিয়ে নেওয়া যায়।
এখনও অবশ্য তাবৎ কাইরোর মতো সর্বাঙ্গসুন্দর হয়নি। সেখানে ভালো টিকিট কাটলে একখানি ছোট টেবিল পাওয়া যায়, পছন্দমতো কটলিস-সসেজ, কব-কোপ্তা খেতে খেতে ইয়ার-বক্সিদের সঙ্গে শুষ্টিসুখ অনুভব করতে করতে বায়স্কোপ দেখা যায়।
হবে, হবে, সে-ও হবে।
এক নরওয়েবাসী তার বন্ধুকে বলল, এই গরমিকালে আফ্রিকায় বেড়াতে যাচ্ছি।
বন্ধু তাজ্জব মেনে বলেন, গরমিকালটাই বাছলে। সেখানে যে ও সময়ে শেড-টেম্পারেচার ১১২ ডিগ্রি।
প্রথম বন্ধু ভুরু কুঁচকে বলল, তা আমাকে ছায়ায় বসতে বাধ্য করবে কে?
ওপন অ্যার সিনেমাতেও তাই। টিকিটের দাম যখন কুল্লে এক টাকা, তখন ছবি ভালো না লাগলে সেখানে আপনাকে বসতে বাধ্য করবে কে?
বিশ্বাস করবেন না এই কদিনে নখানা ছবি দেখেছি। বাঙ্গালায় যাকে বলে গোগ্রাসে গোস্ত গিলেছি। এখনও ঢেকুর উঠছে।
দু একখানার পরিচয় ইতোমধ্যেই আনন্দবাজার এবং হিন্দুস্থান স্টান্ডার্ড-এ নিবেদন করেছি। যেগুলো দেখেছি তার মধ্যে মিরা ই মিলান সবচেয়ে উত্তম, আর যেসব ছবি দেখার সুযোগ হয়নি, তার মধ্যে গুণীদের মতে, বাইসাইল থিফ ইউঁকিয়ারিসু নাকি একেবারে রঙের টেক্কা।
***
মিশরি ছবি ছিল ইবন উন-নীল (অর্থাৎ নীলনদসম্ভান)। এ ছবি দেখে সত্যি মনে হয়, একদম ভারতীয় ছবি, শুধু তারকারা কুর্তা-পাজামা, ধুতি-পাঞ্জাবি না পরে আলখাল্লা আর জাব্বাজোব্বা পরেছে। নায়িকা ভিমরি গিয়েছেন, তার মাথা রেললাইনের উপরে পড়ে আছে, দূর থেকে পাঞ্জাব মেল (থুড়ি, আলেকজেন্ড্রিয়া মেল) গুম গুম করে ছুটে আসছে, নায়ক তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন— এই গেল এই গেল অবস্থায় শেষ মুহূর্তে নায়িকার উদ্ধার।
ফারাক এইটুকু, বাঙলা ছবিতে তখন ডুয়েট গান আরম্ভ হয়ে যায়, কেন গো বাঁচালে মোরে নিঠুর বঁধুয়া, এখানে তা হয়নি। (চীনা ছবি হোয়াইট হেয়ার্ড গার্ল কিন্তু গান বাবদে বাঙলা ছবিকেই ছক্কা-পাঞ্জা-বোম্ দিতে পারে)।
নীলনদসন্তান নিরেস ছবি বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। এ ছবি উন্নাসিকের (অর্থাৎ আপনার-আমার) জন্য বানানো হয়নি। সদর এবং মহকুমা শহরে এ ছবি বিস্তর কদর পাবে। তাই আমি হন্টরওয়ালি, মিস্ ফ্রন্টিয়ার মেল, ডাকু কি দিলরুবা, জাম্বু কা বেটার নিন্দেও কস্মিনকালে করিনি।
বুদ্ধের জীবনী জাপানি ছবি। অতি নবীন কায়দায় কার্টুন দিয়ে সিলুয়েট দিয়ে ছবিখানা তৈরি। তা-ও আবার স্টিলিসাইজড—তাই ভারতীয় নারকোল অশথ গাছ ঠিক ওত্রালো কি না, তাই নিয়ে কোনও শিরঃপীড়া হয় না। সঙ্গীত অত্যুত্তম, সবকিছু নিয়ে ছবিখানা সত্যই উপাদেয়।
***
বুদ্ধের জীবনের সবচেয়ে যে জিনিস চীনা-জাপানিদের আকৃষ্ট করে, সে হচ্ছে মারের বিভীষিকা এবং প্রলোভন! চীন দেশের গুহাতে বুদ্ধ-জীবনীর এ অধ্যায়টি বিস্তর রঙ ফলিয়ে বহু প্রকারে আঁকা হয়েছে। জাপানি বুদ্ধের জীবনী ছবিতেও দর্শক মারপর্ব অনেকক্ষণ ধরে দেখতে পাবেন। সেখানে নাচগানও চমৎকার।
আমাদের বিশ্বাস কার্টুনে ছবি বানালে ডিসৃনিকে নকল না করে উপায় নেই। ফরাসি ছবি সাহসী জন দেখে সে বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়। যেখানেই চিত্রকার নতুন কিছু করতে গিয়েছেন, সেখানেই তিনি মার খেয়েছেন বেধড়ক, আর যেখানে ডিসৃনিকে নকল করেছেন, সেখানে তিনি পানসে– নকল করলে যা হয়।
বুদ্ধের জীবনী ডিসনিকে নকল না করে সার্থক সৃষ্টি।
মিসেস ডেরি সম্বন্ধে হিন্দুস্থানে আলোচনা করেছি। ভাষা এবং তার চতুর্দিকে গড়ে ওঠা বৈদগ্ধ্য যে জোর করে কোনও জাতের ঘাড়ে চাপানো যায় না, তার অত্যুত্তম প্রমাণ পাওয়া যায় মিস ডেরিতে। গান, অভিনয়, সবকিছুই এ ছবিতে ভালো হয়েছে।
***
আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে মিরাকল ইন মিলান। অলৌকিক ঘটনা নিয়ে যে সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ এ ছবিতে করা হয়েছে, সেটি ধরা পড়ে শেষমুহূর্তে। এ ছবি দেখলে বিরিঞ্চি বাবাদের প্রতি ভক্তি একটুখানি কমতে পারে।
***
জনৈক লেখক এক খ্যাতনামা কাগজে রবীন্দ্রনাথ যে দ্বিতীয় শ্রেণির কবি, ঔপন্যাসিক এবং দার্শনিক সেকথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। লেখক স্বীকার করেছেন, তিনি বাঙলায় রবীন্দ্রনাথ পড়েননি।
বিভারলি নিকলসও এই ধরনের বই লিখেছিল। মিস মেয়ের কথা আর বললুম না, কারণ দু একজনকে বলতে শুনেছি, মেয়োর উদ্দেশ্য হয়তো খারাপ ছিল না কিন্তু রবীন্দ্র-সমালোচকটার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তাদের মনে প্রচুর সন্দেহ রয়ে গিয়েছে।
নিকলসের বই যখন হুশ হুশ করে বিক্রি হচ্ছে তখন খ্যাতনামা প্রকাশক আমাকে বইখানার উত্তর লিখতে অনুরোধ করেন। বেশ দু পয়সা যে পাব সে লোভটাও দেখালেন।
আমি উত্তরে সবিনয়ে বললুম, মনে করুন এক হটেনটট লন্ডনে তিন মাস থাকার পর যদি শেক্সপিয়র, রাফায়েল, এঞ্জেলো, বেটোফেন, পাভলোভাকে কটুকাটব্য করে বই লেখে তবে কি কোনও সুস্থ ইয়োরোপীয় তার উত্তর লিখবে?
প্রশ্ন হচ্ছে নিকলস্ এবং আমাদের রবীন্দ্র-সমালোচক এ ধরনের বই বা প্রবন্ধ লেখে কেন?
এরা চায় পয়সা, কিন্তু জানে ভারতবর্ষ তথা রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে প্রামাণিক রচনা লেখবার মতো মুরোদ এদের নেই। এদের বই কেউ কিনবে না। কিন্তু যদি গালাগাল দিয়ে লেখে তবে বহু লোক সেসব বইয়ের তীব্র প্রতিবাদ করবে, ফলে হট্টগোলের সৃষ্টি হবে এবং সেই ডামাডোলে বিস্তর বই বিক্রি হবে। অশ্লীল বইও এই পদ্ধতিতে বাজারে কাটে।
অতএব আমাদের উচিত কী?
চুপ করে থাকা।
তবে আমি আলোচনাটা উত্থাপন করলুম কেন? তার কারণ বহু সরল পাঠক এই দুচোমিটা না ধরতে পেরে হট্টগোলের সৃষ্টি করে বই বিক্রির সহায়তা করেন। আমার বক্তব্য, সবাই যেন এ বাবদে একদম নিপ ডেড় সাইলিন্ট পন্থা অবলম্বন করেন। আলোচনা উত্থাপিত হলেই নাক সিঁটকে বলবেন, মাপ করবেন, স্যার, এ বিষয়ে আমার কণামাত্র উৎসাহ নেই। বলেই অন্য কথা পাড়বেন। বলবেন, দেখো দিকিনি, রায় পিথৌরা কী চমৎকার লেখে কিংবা উল্টোটা। যাই করুন না কেন, রায় পিথৌরার তাতে করে দু পয়সা আমদানি বাড়বে না।
***
ইংরেজ বড় হুঁশিয়ার জাত। তারা এই পদ্ধতিতে ভালো বইও খুন করতে জানে।
লায়োনেল ফিলডেন নামক এক ব্যক্তি এদেশে কয়েক বৎসর অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর বড় কর্তা ছিলেন। এদেশে ইংরেজের কীর্তিকারখানা দেখে ভদ্রলোক বিলেত গিয়ে সে সম্বন্ধে একখানা চটি বই লেখেন– একদা ডিগবি যেরকম এসপারাস ব্রিটিশ ইন্ডিয়া লিখেছিলেন।
ইংরেজ বইখানা সম্বন্ধে এমনি ঠোঁট সেলাই করল যে বইখানা অতি অল্প লোকই পড়েছেন।
ঋষিরা তাই বলেছেন, নীরবতা হিরণয়, সাইলিনস্ ইজ গোল্ডেন!
***
দিল্লির ওপর দিয়ে বড় গর্দিশ গেল। বিস্তর ফিল্ম দেখানো হল, তারকাদের মিছিল হল, হাইফেল্স বেয়ালা বাজালেন, পণ্ডিতজি নেশনাল ট্রেজার্স ফান্ড খুললেন, সবচেয়ে বড় পোলো ফাইনাল হল, এলেনর রুজভেল্ট এলেন, তার ওপর গোটা তিনেক চিত্রপ্রদর্শনী। মানুষ কদিক সামলায়? সব সামলাতে গেলে রায় পিথৌরার কুইনটুপ্লেটের প্রয়োজন।
বাসু ঠাকুর যে বাড়ির খুশ-নাম ষোল আনা রাখতে পেরেছেন তা নয়। অবশ্য তিনি অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, দু জনার কাছ থেকে যা শিখেছেন তার অনেকখানি কাজে লাগাতে পেরেছেন।
বাসু ঠাকুরের ছবিতে প্রচেষ্টা আছে। ভদ্রলোক অনেক কিছু দেখছেন এবং ভেবেছেন তার চেয়েও বেশি। তুলির জোর তো আছেই, তার চেয়েও বেশি মূর্তি গড়ার হাত। বাসু ঠাকুরের সৃষ্টি তাই যে শুধু আনন্দ দেয় তা নয়, ছবিগুলোর সামনে অনেকক্ষণ ধরে অনেক কিছু ভাবা যায়। প্রদর্শনী বহুদিন ধরে খোলা থাকবে।
***
ক্রিকেট ম্যাচে যখন পাশের বে-রসিক নানারকম উদ্ভট প্রশ্ন শুধায় তখন উদ্ভট উত্তরও পায়।
ওগুলো কী?
বিরক্তির সঙ্গে, উইকেট।
ওগুলো দিয়ে কী হয়?
ততোধিক বিরক্তির সঙ্গে, ক্লান্ত হলে খেলোয়াড়দের বসবার জন্য।
পোলো খেলা দেখতে গিয়ে আমার সেই অবস্থা; চক্কর কী, হাফ গোল কারে কয়, ফাউল কখন হয় আর কখন হয় না তাই বুঝবার পূর্বে খেলা শেষ হয়ে গেল।
তবু, আহা, দেখবার জিনিস! এক গোল থেকে আরেক গোল অবধি (ফুটবল তিন সাইজ) ঘোড়াগুলো যা ছুট দেখাল তার জন্যই ও খেলা দেখার প্রয়োজন। রাজা-রাজড়াদের গদি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ খেলাও ঝিমিয়ে আসছে। মরে গিয়ে ঠাণ্ডা হওয়ার পূর্বে এক দফা দেখে নেবেন।
.
১৫.
খ্রিস্টের ছ শ বছর আগে বৈশালীতে গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল। বলা হয়, বুদ্ধদেব এই বৈশালী রাজ্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হন এবং আপন সদ্য নির্মাণের সময় তার অনেকখানি অনুকরণ করেন। এই বৈশালীতেই মহাবীর জীনের জন্ম।
বৈশালীর স্মরণে এখনও সেখানে প্রতি বৎসর উৎসব হয়। এবারকার উৎসবে শ্ৰীযুত কানহাইয়ালাল মুন্সী সভাপতিত্ব করেন।
শ্ৰীযুত মুন্সী বলেন, আমরা যদি ভারতের ভিতর দিয়ে বিশ্ব-ঐক্য এবং বিশ্ব-ঐক্যের ভিতর দিয়ে ভারতকে অখণ্ড রূপে চেনার চৈতন্য না জাগিয়ে তুলতে পারি তবে আমাদের স্বাধীনতা লোপ পাবে, স্বাধীনতা গেলে আমাদের আত্মার মৃত্যু হবে, আত্মার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভারতের মহতী বিনষ্টি।
এ উক্তির সত্যতা সম্বন্ধে কারও মনে কোনওপ্রকারের সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন, ভারতীয় কিংবা বিশ্ব-ঐক্যের সাধনার সঙ্গে প্রাদেশিক বৈদগ্ধ্যের সংঘাত আছে কি নেই? আমরা যখন বাঙলা ভাষা এবং সাহিত্যের চর্চা করি, আমি যখন বৃদ্ধ বয়সে উত্তমরূপে হিন্দি শিখতে এবং লিখতে নারাজ তখন আমাকে বাঙালি কূপমণ্ডুক এবং ভারতীয় ঐক্যের পয়লা নম্বরের দুশমন বলা হবে কি না?
বাঙলার তরুণ সম্প্রদায় যদি আজ আদাজল খেয়ে (আর অন্য বস্তু আছেই বা কী যে খাবে?) হিন্দি চর্চায় বসে যায়, বাঙলা বর্জন করে হিন্দিতে উত্তম উত্তম কাব্য কথাসাহিত্য রচনা করে তামাম ভারতকে ভেল্কিবাজি দেখিয়ে দেয়, প্রবীণ হয়েও সুনীতি চট্টো নাকি দেখাতে পেরেছেন তা হলে আমার কণামাত্র– আপত্তি নেই (যদিও একথা বলব যে কেউ যদি হিন্দি শিখে কোনও ভালো বই বাঙলায় অনুবাদ করে তবে আমি খুশি হই বেশি। কিন্তু দয়া করে আমার মতো প্রবীণদের আর এ গর্দিশে ফেলবেন না।
একটা গল্প মনে পড়ে গেল।
গৃহিণী শুনে স্তম্ভিত যে বড়বাবুকে মাসের কুড়ি তারিখে হাওলাত দেয় তারই আপিসের এক বেনে কেরানি। বড়বাবুর মাইনে সাতশ, আর কেরানির ত্রিশ। গৃহিণী চেপে ধরলেন, তাঁকে গিয়ে দেখে আসতে হবে সে কী করে বাড়ি চালায়। কর্তা বহুবার গাইগুই করে শেষটায় না পেরে গেলেন একদিন সন্ধের পর তারাপদর বাড়িতে।
বাড়ি অন্ধকার। ডাকাডাকিতে আলো জ্বলল। তারাপদ নেবে এল হাতে পিদিম, পরনে এইটুকুন গামছা। বড়বাবুকেও ঘেঁড়া চ্যাটাইয়ে বসিয়ে শুধাল, কোনও লেখা-পড়ার কর্ম আছে কি?
না। কেন?
তা হলে পিদিমটা নিবিয়ে ফেলতে পারি আর গামছাখানা খুলে রাখতে পারি। বড়বাবু যা দেখবার জন্য এসেছিলেন তা দেখা হয়ে গেল। খানিকক্ষণ পরে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। পাড়ার মুখে পৌঁছতে না পৌঁছতেই চিৎকার করে বলতে লাগলেন, গিন্নি, শিখে এসেছি, শিখে এসেছি কিন্তু আমার দ্বারা হবে না।
বড়বাবুর মতো আমারও জানা হয়ে গিয়েছে, হিন্দি শিখলে আমার বহুৎ ফায়দা হবে, কিন্তু ওই যে বড়বাবু বললেন, আমা দ্বারা হবে না সেই মোক্ষম কথা!
উর্দুতেও এই মর্মে একটি উত্তম কবিতা আছে। মোমিন নামক কবিকে বলা হয়েছিল, আর কেন? সমস্ত জীবন তো কাটালে পাপ কর্ম করে করে; এইবার একটু ধর্মে মন দাও!
মোমিন বললেন,
উম্র সারী তো কটী ইশকে বুতা মে
মুমিন!
আখরী ওজমে ক্যা থাক্ মুসলমাঁ
হোঙগে?
সমস্ত জীবন তো কাটল প্রেম-প্রতিমাদের
মহব্বতে, রে মুমিন,
এখন এই আখেরি সময়ে কী ছাই
মুসলমান হব।
তাই হিন্দি-উর্দু মাথায় থাকুন। যেটুকু টুটিফুটি শেখা আছে সেই করেঙ্গা, খায়েঙ্গা, হাই, হুই করে জীবনের বাকি কটা দিন প্রেমসে চালিয়ে নেব।
কিন্তু যদি বলি, বাঙলার চর্চা যে আমি আমার কট্টর বাঙালিত্বের জন্য করছি তা নয়– বাঙলার সেবার ভিতর দিয়েই আমি ভারতীয় ঐক্যের সেবা করছি; তা হলে হিন্দিপ্রেমী বাঙালিরা হয়তো আমাকে তাড়া লাগাবেন। তবু সেইটেই হক কথা, এইখানেই আঁটি জাতীয়তাবাদ।
আমাকে বিশ্বনাগরিক হতে হলে তো আর বিশ্বসংসারের ভাষা শিখতে হয় না, কিংবা এসপেরান্টোও কপচাতে হয় না। আমি মালাবারের ভাষা জানিনে তবু মালাবারের লোককে আমার বড় ভালো লাগে। আমি কিঞ্চিৎ ইংরেজি জানি এবং তার অনুপাতে ইংরেজকে অপছন্দ করি অনেক বেশি।
অতএব ভারতকে ভালোবাসা যায় হিন্দি না শিখেও। রোমাঁ রোলা হিন্দি জানতেন না তবু তিনি ভারতবর্ষকে চিনতেন ও ভালোবাসতেন অনেক দুবেজি পাড়েজির চেয়ে ঢের ঢের বেশি।
সুইটজারল্যান্ডের নিজস্ব সুইস বলে কোনও ভাষা নেই। সুইসরা ফরাসি, জর্মন, ইতালীয় ও রোমানি ভাষায় কথা কয়। এবং শতকরা নব্বইজন একাধিক ভাষা বলতে পারে না। ফরাসি-সুইটজারল্যান্ডে অতি অল্প লোকই জর্মন জানে, ইতালীয়-সুইটজারল্যান্ডেও তাই। অথচ এই চার ভাষায় গড়ে ওঠা সুইটজারল্যান্ড একতায় জর্মনি-ইতালিকে অনায়াসে হার মানাতে পারে।
আরবদেশের ভাষা আরবি, ধর্ম ইসলাম, জাতে তারা সেমিটি। আরব মাত্রেরই এই তিন-তিনটে ঐক্যসূত্র আছে– পৃথিবীতে এরকম উদাহরণ বিরল। তবু দেখুন তারা কটা রাষ্ট্রে বিভক্ত তাদের ভিতর রেষারেষি কীরকম মারাত্মক! সউদি আরব, ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডন, মিশর, কুওয়াইত, বাহরেন। আলজিরিয়া, তুনিসিয়া, মরক্কোর কথা আর তুললুম না– সেখানে মূররক্ত কী মেকদারে আছে জানিনে। তাই যখন করাচি বিশ্ব-মুসলিম সজ্জ গড়ার খেয়ালি-পোলাও খায় তখন হাসি পায়। আরবদের এতগুলো ঐক্যসূত্র থাকতেও তারা সম্মিলিত হতে পারছে না, তার ওপর তুর্ক, ইরানি, পাকিস্তানি, জাভার মুসলমানকে ডেকে এনে একতা স্থাপন করা!
আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, যে ভারতীয় বৈদগ্ধ্য ভবিষ্যতে গড়ে উঠবে তার বুনিয়াদ প্রদেশে প্রদেশে। প্রত্যেক প্রদেশ আপন নিজস্ব ভাষা এবং সাহিত্য, আপন জনপদসুলভ আচার-ব্যবহার চারুশিল্প, আপন প্রদেশপ্রসূত ধর্ম এবং সম্প্রদায় এসব তাবৎ বস্তুর চর্চা করে যে ফললাভ করবে তারই ওপর একদিন দাঁড়াবে বিরাট কলেবর, বৈচিত্র্যসুশোভিত, সর্বজনগ্রাহ্য ভারতীয় বৈদগ্ধ্য।
আমার এক কাণ্ঠরসিক বাঙালি বন্ধু এই দেহলি-প্রান্তেই বিন্দ্ৰিযামিনী যাপন করছেন হিন্দি চর্চায়– ইনি সেই ব্যক্তি যিনি কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে দোস্তি জমান।
তিনি বিস্তর হিন্দি পড়েছেন। ব্যাকরণ কণ্ঠস্থ করেছেন, হিন্দির, পুলিঙ-স্ত্রীলিঙ তাঁকে কণামাত্র বেকাবু করতে পারে না, হিন্দির ফাউলার শ্রীবর্মার অচ্ছি হিন্দি তাঁর নখাঘ-দর্পণে।
তিনি বলেন– আমি বলছিনে, কারণ আমার শাস্ত্রাধিকার নেই হিন্দি ভাষা বাঙলার তুলনায় এখনও এত কাঁচা এত লিউয়িড় যে, এ ভাষাতে যে কোনও উত্তর-ভারতীয় অনায়াসে উত্তম হিন্দি লিখতে পারবে। তিনি বিশ্বাস করেন, ভালো বাঙলা লিখতে হলে যে মেহনত যে খাটুনির প্রয়োজন তার অর্ধেক পরিশ্রমে অত্যুত্তম হিন্দি লেখা যায়।
তাই তিনি বলেন, বাঙালির তো সব আছে। এখন তার একমাত্র পন্থা, হিন্দি মার্কেট ক্যাপচার করা– সুহৃদ ব্যবসায়ী তাই হামেশাই কারবারি ইডিয়াম ব্যবহার করেন– অর্থাৎ অচ্ছি হিন্দি শিখে, রবীন্দ্রনাথ-শরচ্চন্দ্রের কাছ থেকে নেওয়া শৈলী এবং ভাষা হিন্দির ওপর চালিয়ে দিয়ে হিন্দি সাহিত্যে রাজত্ব করা।
হয়তো হক কথাই কয়েছেন কিন্তু আমার মন সাড়া দেয় না।
প্রথমত এই প্রস্তাবে কেমন যেন একটা উৎকট প্রাদেশিকতা রয়ে গিয়েছে, কেমন যেন একটা একদা যাহার বিজয়-সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয় গোছ ইম্পিরিয়ালিজম রয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যই-বা এমন কোন গৌরীশঙ্করের চূড়োয় পৌঁছে গিয়েছে যে তার সেবকদের হিন্দি জয় করবার জন্য ছুটি দিতে পারি?
.
১৬.
এককালে এদেশে বিস্তর ফারসি চর্চা হত। সরকার, মুন্সি, বখশি, কানুনগো, এসব যাদের পদবি তাদের বাপ-পিতেমো উমদাসে উমদা ফারসি শিখে এককালে মোগল রাজত্ব চালিয়েছেন। সরকার তো চিফ সেক্রেটারি, বখশি মানে চিফ পে মাস্টার অর্থাৎ একাউন্টেন্ট জেনারেল! বাপ– এসব আপিসারদের সঙ্গে দেখা হওয়া মানে তো বাঘের সামনে দাঁড়ানো। কান দিয়ে ধুয়ে বেরুতে থাকে। আর ওনারা রেগে গেলে তো হাড্ডি বিলকুল পিলপিলিয়ে যায়।
যাক্ মোদ্দা কথায় ফিরে আসি। এইসব বখশি-মুন্সিরা কিন্তু আজকের দিনের সেক্রেটারি-একাউন্টেন্টের মতো ছিলেন না– অর্থাৎ ফারসি সাহিত্যেরও চর্চা করতেন, মুশায়েরায় (কবি-সম্মেলন) কবিতা পড়তেন, বয়াজিতে (কবির লড়াই) মাথায় গামছা বেঁধে নেমে যেতেন।
স্বৰ্গত কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার এই ঐতিহ্যের ভিতর আপন কবিতৃপ্রতিভার বিকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার আসল দরদ ছিল বাঙলা সাহিত্যের প্রতি। তাই তিনি হাফিজ-সাদির উত্তম উত্তম কবিতা অতি সরল বাঙলায় অনুবাদ করেন। এ কবিতাগুলো পড়ে হিন্দুরাই যে শুধু গুলিস্তানের শুলের খুশবো আর বুলবুলের মিঠি বোলি শুনতে পেতেন তাই নয়, উনবিংশ শতকের শেষের দিকের বাঙালি মুসলমান যখন বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের জোর চর্চা আরম্ভ করলেন, তখন তারা কৃষ্ণচন্দ্রের সম্ভাবশতক অতিশয় ভক্তি ও ভালোবাসার সঙ্গে মুখস্থ করলেন। আমার বাল্য বয়সে আমি বৃদ্ধদের (হিন্দু- মুসলমান উভয় শ্রেণিরই) গদগদ হয়ে আবৃত্তি করতে শুনেছি–
নেত্র নাই বাঞ্ছা হেরি বিধুর বদন
কর্ণ নাই চাই শুনি ভ্রমর গুঞ্জন।
এবং সর্বশেষে
প্রেম নাই প্রিয়লাভ আশা করি মনে।
হাফেজের মতো ভ্রান্ত কে ভব-ভবনে?
কিন্তু এসব গাজন আজ কেন?
গেল সপ্তায় বারোটি ইরানি দিল্লি এসেছিলেন, তার মধ্যে আটজন ছাত্র, দু জন শিক্ষক। এরা এসেছেন পশুচিকিৎসার শিক্ষাদান এবং গবেষণা দেখতে। এদের ভেতর দেড়জন জানেন ইংরেজি আর একজন ফরাসি।
কাজেই ফরেন-আপিসের দাওয়াতে গিয়ে দেখি ছেলেরা নিজেদের ভিতর গুজুর গুজুর করছে। কী আর করি আমার মুরুব্বি ফারসির বাঘা মৌলবি স্বৰ্গত জয়রাম মুন্সির নাম স্মরণ করে চালালুম হাস্ত হুস্ত। ফারসি ভাষাটা কঠিন নয় আর ইরানিরা ভদ্রতোয় লক্ষৌ কিংবা চীনদেশীয়কে হার মানাতে পারে। সুতরাং তারা আমার ফারসি শুনে মার তো লাগালেনই না বরঞ্চ উৎসাহের সঙ্গে গাল-গল্প জুড়ে দিলেন।
মুরুব্বি জয়রাম মুন্সি সদ্ভাবশতক পড়ে পড়ে আমাকে তার মূল কী, কোন কবি সেটি রচনা করেছেন এসব হদিস দিতেন– গুলস্তান বোস্তান তার কণ্ঠস্থ ছিল। কিন্তু হায়, আমাকে শেষ-শিক্ষা দেবার পূর্বেই খুদাতালার আপন গুলস্তানে তার নিমন্ত্রণ এসে গেল, এখানকার পাট তুলে দিয়ে সেখানে গজলকসিদা গাইবার জন্য।
আমি সে রাতের খানাতে কৃষ্ণচন্দ্রের বাঙলা অনুবাদের টুটিফুটি ফারসি অনুবাদ করতে লাগলুম, আর ছেলেটা টক্ টক্ করে তার মূল ফারসি বলে যেতে লাগল। আমার ভারি আনন্দ হল যে, পশুচিকিৎসা যাদের পেশা তারা যে এতখানি সাহিত্যচর্চা করে!
আর তারা খুশি যে, ভারতের শেষ প্রান্ত বাঙলা দেশের লোক তার আপন ভাষায় হাফিজ-সাদি গেয়েছে দেখে।
***
বাঙালিদের কাছে আমার একটি নিবেদন আছে।
সুভাষচন্দ্র বসু বার্লিনে যে বাড়িতে বাস করতেন সে বাড়িটির প্রতি বাঙালি মাত্রের কিঞ্চিৎ দরদ থাকা দরকার। অনেক ভারতীয়েরও আছে, একথা আমি নিশ্চয় জানি। বিশেষত ৪৬-৪৭ সালে দাক্ষিণাত্যে তার যে কী প্রতিপত্তি ছিল তা-ও আমি দেখেছি।
কেন্দ্রীয় সরকার কি এ বাড়িটি কিনে নিতে পারেন না? বার্লিনে আমাদের যে রাজদূতাবাস বসবে তারা ভাড়াটে বাড়িতে থাকবেন এবং সস্তায় থাকতে হলে আখেরে ভারতীয় সরকারকে বার্লিনে বাড়ি কিনতে হবে। কাজেই এই বাড়িটি কিনলে ভারতীয় সরকার কিছু অপকর্ম করবেন না।
আর যদি ভারতীয় সরকার এ বাড়িটি কিনতে রাজি না হন, তবে বাঙালি কি এ বাড়িটি কিনতে পারে না? তুমি-আমি গরিব সে আমি জানি, কিন্তু সবাই মিলে যদি একটা চেষ্টা দেওয়া যায়, তবে কি কর্মটা একেবারেই অসম্ভব?
এ নিয়ে একটা ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত।
আমরা বাড়িটি সম্বন্ধে অন্যসব খবরের তত্ত্বতাবাস করছি। ইতোমধ্যে কিন্তু আন্দোলনটা আরম্ভ করে দেওয়া উচিত।
***
শ্রীমতী রজোভেল্ট আমেরিকা ফিরে গিয়ে বলেছেন, ভারতীয়রা আধ্যাত্মিক এবং তারা সেই আধ্যাত্মিকতা পেয়েছে তাদের ধর্ম থেকে।
এ তো বাঙলা কথা। আধ্যাত্মিকতা আসে তো ধর্ম থেকেই–এতে আর নতুন কী বলা হল?
উঁহু। ইংরেজিতে কথাটা অন্যরকম শোনায়। শ্রীমতী বলেছেন, ভারতীয়রা স্পিরিচুয়াল এবং তাদের স্পিরিচুয়ালিটি এসেছে তাদের রিলিজিয়ান থেকে।
অর্থাৎ স্পিরিচুয়ালিটি এবং রিলিজিয়ান সচরাচর এক জিনিস নহে। ইয়োরোপ এবং আমেরিকায় বহু লোক স্পিরিট (আত্মার) সাধনা করে, কিন্তু অনেকে রিলিজিয়ান জানে না।
তাই সপ্রমাণ হল রিলিজিয়ান এবং ধর্ম এক জিনিস নহে। এবং সেই কারণেই হিন্দু ধর্ম বলে কোনও জিনিস থাকতে পারে না। ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি তার অর্থ সনাতন ধর্ম। এ ধর্মের আগে হিন্দু শব্দ লাগানো যায় না। ঠিক যে রকম হিন্দু ভগবান মুসলমান ভগবান কিংবা খ্রিস্টান ভগবান হতে পারে না ঠিক তেমনি হিন্দু ধর্ম আমার কানে অদ্ভুত শোনায়।
শুধু হিন্দুরাই নয়, বৌদ্ধরাও যখন ত্রিশরণ মন্ত্রে ধর্মাং শরণং গচ্ছামি বলেন তখন তো ধর্মের পূর্বে বৌদ্ধ শব্দ লাগান না। কুরানে ধর্ম শব্দের জন্য পাই দীন কিংবা দীনুল্লা অর্থাৎ যে দীন আল্লার দিকে নিয়ে যায়। অন্য শব্দ ইসলাম। ইসলাম শব্দের ধাতু, ভগবানের ইচ্ছার সম্মুখে নিজেকে আত্মসমর্পণ করা।
তাই ধর্ম শব্দের আগে হিন্দু কিংবা মুসলমান শব্দের প্রয়োগ আমি বুঝে উঠতে পারিনে। ধর্ম সর্বমানবের জন্য তার আবার হিন্দু-মুসলমান কী?
গত বৎসর এই সময়ে রমণ মহর্ষি দেহত্যাগ করেন। ইসলাম শব্দের স্মরণে মহর্ষির কথা মনে পড়ল।
দাক্ষিণাত্যের তিরু-আন্নামলাই গ্রামের রমণাশ্রমে কয়েক মাস থাকার সৌভাগ্য আমার জীবনে একবার হয়েছিল। শ্রীঅরবিন্দ সচরাচর কাউকে দর্শন দিতেন না আর রমণ মহর্ষিকে উদয়াস্ত একই ঘরে পাওয়া যেত। নানা লোক নানা প্রশ্ন করত, মহর্ষি উত্তর দিতেন। অবশ্য রেসে কোন ঘোড়া জিতবে জিগ্যেস করলে চুপ করে থাকতেন, এমনকি ভগবান কেন সংসারটা তৈরি করলেন, তার উত্তরও দিতেন না। বড্ড বেশি খোঁচাখুঁচি করলে বলতেন, তোমার তা জেনে কী দরকার।
একদিন আরেকটুখানি বাড়িয়ে উত্তর দিলেন। বললেন, তুমি যে প্রশ্নটা করলে সেটার উত্তর আমি যদি দিই, তবে সে উত্তর তুমি বুঝবে কী দিয়ে? অবশ্য তোমার মন দিয়ে। এখন তবে প্রশ্ন, তুমি তোমার মনটাকে বুঝতে পেরেছ কি? যে ফিতেটা দিয়ে তুমি জমি মাপতে যাচ্ছ তারই যদি দৈর্ঘ্য না জানো, তবে মেপে লাভ কী? তাই সক্কলের পয়লা মনটাকে চিনতে হয়।
একদিন দেখি জনাচারেক বয়স্ক তামিল মুসলমান মহর্ষিকে প্রণাম করে সামনের মেঝেতে বসল। দেখে মনে হল চাষাভূষা শ্রেণির কিংবা কোচম্যান হ্যাঁন্ডিম্যানও হতে পারে।
অনেকক্ষণ মহর্ষির দিকে তাকিয়ে থেকে শেষটায় একজন অতিশয় বিনয়ের সঙ্গে তামিল ভাষায় বলল, আমরা আপনাকে অনেক প্রশ্ন জিগ্যেস করে বিরক্ত করতে চাইনে বলে বাড়ি থেকে সবাই মিলে একটিমাত্র প্রশ্ন ঠিক করে নিয়ে এসেছি। আপনি যদি উত্তর না-ও দেন, তাতেও আমাদের আক্ষেপ নেই, কারণ আপনার দর্শন আমরা পেয়েছি সেই যথেষ্ট।
শিশুর মতো মহর্ষি সরল হাসি হাসলেন। বললেন, বলো।
প্রবীণটি বলল, মানুষের জীবনে সবচেয়ে কাম্য ধন কী?
তৎক্ষণাৎ মহর্ষি উত্তর দিলেন, ইসলাম।
চারজনই অনেকক্ষণ ধরে মহর্ষির দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর প্রণাম করে সন্তুষ্টচিত্তে বেরিয়ে গেল।
আমি জানি, মহর্ষি কোন অর্থে ইসলাম বলেছিলেন। এ চারজন বাড়ি ঘরে গিয়ে নিশ্চয়ই ইসলাম শব্দের তত্ত্বানুসন্ধান করবে এবং আল্লার কৃপা থাকলে সত্য ধর্মে পৌঁছবে।
.
১৭.
ভারতীয় পার্লামেন্টের বাঙালি সদস্যগণকে নয়াদিল্লির কালীবাড়ি গত শুক্রবার সন্ধ্যায় এক বিশেষ সভায় আমন্ত্রণ করে অভিনন্দিত করেন। উল্লেখ প্রয়োজন নিমন্ত্রিত বাঙালিগণ সকলেই বঙ্গবাসী নন, এদের কেউ কেউ বাঙলা দেশের বাইরে থেকে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে আসন পেয়েছেন। তাছাড়া বাঙলা ভাষাভাষী উড়িয়া বিহারি আসামি সভ্যদেরও আমন্ত্রণ করা হয়েছিল এবং তাদের কেউ কেউ সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
শ্ৰীযুত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সভাপতির আসন গ্রহণ করেন এবং নিমন্ত্রিত সদস্যগণকে মাল্যদান করত একে একে সভার সঙ্গে পরিচিত করান।
এই উপলক্ষে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা কালীবাড়ির নতুন পুস্তকালয় এবং পঠনগৃহের দ্বার উন্মোচন করেন।
শ্ৰীযুত শ্যামাপ্রসাদ বলেন, বাঙালির আজ দুর্দিন বাঙলার সামনে আজ নানা কঠিন। সমস্যার উদ্ভব হয়েছে এবং সেগুলো সমাধান করতে হলে আমাদের ব্যক্তিগত কিংবা দলগত দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে সুদ্ধমাত্র খাঁটি বাঙালিরূপে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে হবে। এবং এ কর্মে যে শুধু বাঙালিই যোগ দেবেন তাই নয়; বিহার, উত্তর প্রদেশের বাঙালিরাও তাদের সহযোগিতা দেবেন।
শ্ৰীযুত শ্যামাপ্রসাদ আরও বলেন, ভারতের ইতিহাস এবং ভাগ্য নির্মাণে বাঙালির দান নগণ্য নয়; আজ যদি বাঙালি তার দুরূহ সমস্যাগুলোর সমাধান না করতে পারে তবে যে শুধু বাঙালিই লোপ পাবে তা নয়, তাতে করে সমস্ত ভারতবর্ষ দুর্বল হয়ে পড়বে। (বাঙলা শর্টহ্যান্ড জানিনে, কাজেই প্রতিবেদনে ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলে আশাকরি বক্তা অপরাধ নেবেন না।)
এ তো অতি খাঁটি কথা– একথা অস্বীকার করবে কে?
কিন্তু প্রশ্ন আমাদের সমস্যাগুলো কী, এবং তার সমাধানই-বা কী? ডা. শ্যামাপ্রসাদ যদি সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন তবে আমরা উপকৃত হতুম। তবে হয়তো প্রীতিসম্মেলন দীর্ঘ ভাষণের উপযুক্ত স্থান নয় বলেই তিনি এ নিয়ে সবিস্তর আলোচনা করেননি। কিন্তু তবু অধমের বক্তব্য, অন্যত্র শ্ৰীযুত শ্যামাপ্রসাদ যেসব ভাষণ দেন সেগুলো তিনি তার দলের মতবাদের দৃষ্টিবিন্দু থেকেই দিয়ে থাকেন। তারই কথামতো তিনি যদি খাঁটি বাঙালি হিসেবে নিরপেক্ষ বক্তৃতা দিতেন তবে আমরা অর্থাৎ যারা কোনও দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নই– উপকৃত হতুম। শ্ৰীযুত শ্যামাপ্রসাদ নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে দিল্লিবাসী বাঙালিগণকে নিরাশ করবেন না।
রায় পিথৌরার কথায় কেউ বড় একটা কান দেয় না– আর দেবেই-বা কেন, সে তো আর কেষ্ট-বিটু কেউ-কেডা নয়– এবং তাই সে বড় খুশি। সব দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে সে তাই তখন পরমানন্দে যাচ্ছেতাই (হায়, যদি ঠিক যা ইচ্ছা তাই ঠিক ঠিক ভাষায় প্রকাশ করতে পারতুম তবে তো এতদিনে দেশবিদেশে কবি, সাহিত্যিক হিসেবে নাম করে ফেলতে পারতুম– দু পয়সা ভি আসত) বলে যায় এবং তারই মতো আরও কয়েকজন দায়িত্বহীন পাঠক সেগুলো পড়ে বলে, ঠিক বলেছ। এদেরই জন্য আমি কলম ধরি; তাই আমার মনে হয় স্বাধীনতার পর বাঙলার আকার ছোট হয়ে যাওয়াতে আমাদের নতুন সমস্যার অন্ত নেই।
তাই দেখতে হবে বাঙলার আয়তন কী প্রকারে বাড়ানো যায়।
ভাষার ভিত্তিতে ভারতীয় প্রদেশগুলোকে যদি নতুন করে গড়ে তোলা হয় তবে বাঙলার আয়তন বাড়বে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু তার বিরুদ্ধেও যুক্তি আছে।
বাঙলার বাইরেও বাঙালি সংস্কৃতির স্থান আছে। একথা কে না জানে, উড়িষ্যা, আসাম ও পূর্ব বিহারের শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই উত্তম বাঙলা জানেন, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির সঙ্গে তাঁরা সুপরিচিত, তাঁদের বাড়ির মেয়েরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গান এবং এসব প্রদেশের অশিক্ষিত জনও বাঙলা ফিল্ম দেখে।
আজ যদি এইসব প্রদেশের বাঙলাভাষী অঞ্চলগুলো বাঙলাকে দিয়ে দেওয়া হয় তবে বহু বাঙলাপ্রেমী বিহারি, আসামি এবং উড়িষ্যাবাসী আমাদের ওপর বিলক্ষণ রেগে যাবেন এবং ক্রমে ক্রমে সেই রাগের বশে বাঙালি সংস্কৃতি বর্জন করতে আরম্ভ করবেন।
এই পরিস্থিতির কথা ভাবলেই আমি বড্ড ভয় এবং ক্লেশ পাই।
কারণ বাঙলা দেশের পরিমাণের চেয়েও আমি বহু বহু গুণে বেশি মূল্য দিই বাঙালি সংস্কৃতির পরিব্যাপ্তিকে। আমার ধ্যানের বাঙলা বাঙলা দেশে সীমাবদ্ধ নয়– পশ্চিমবাঙলার গুটিকয়েক জেলাই তার বিহার-ভূমি নয়— আমার ধ্যানের বাঙলা আসাম, বিহার, উড়িষ্যার সুদূরতম প্রান্ত অবধি– না, কম বলা হল, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, দিল্লি, জয়পুর যেখানেই বাঙলা সংস্কৃতির ছাপ পড়েছে, ছায়া পড়েছে, সেখানেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাঙলা। পূর্ব-বাংলাও তাই এ ধ্যানের বাঙলার ভিতরে।
টমাস মান যখন যুদ্ধের পর বিভক্ত জৰ্মনির পশ্চিমাঞ্চলে নিমন্ত্রিত হন তখন তাঁকে জিগ্যেস করা হয়েছিল তিনি পূর্বাঞ্চলেও যাবেন কি না? উত্তরে মা বলেছিলেন, যেখানেই জর্মন সংস্কৃতি সম্মান পায় সেখানেই আমার মাতৃভূমি।
এই ধ্যানের বাঙলা যেন বিনষ্ট হয়।
জমিদারি বাড়ানো ভালো কিন্তু জমিদারি বাড়াতে গিয়ে যদি হাজার হাজার মিত্রকে শত্রু করতে হয়, তাঁদের সঙ্গে যদি আমার আহার-বিহার বন্ধ হয়ে যায়, তারা যদি আমার সভ্যতা সংস্কৃতির চর্চা বর্জন করেন তবে দেখতে হবে, ভাবতে হবে, আমার কর্তব্য কী?
ওদিকে মানভূমি, সিংভূমের বাঙালির প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধ ধর্মবোধও আছে। কোনও কোনও অদূরদর্শী বিহারিরা নাকি ওইসব অঞ্চল থেকে বাঙলা চর্চা তুলে দিতে চান– আমি হলফ করে কিছু বলতে পারব না, কারণ ওসব অঞ্চলে গিয়ে উকট সব সমস্যার সম্মুখীন হবার দায় থেকে শ্রীগুরু আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন; তাই যদি হয় তবে সেই-বা চোখ কান বন্ধ করে সয়ে নেব কী প্রকারে?
এই পিনসার মুভমেন্টের সামনে আমি হিমশিম খেয়ে গিয়েছি।
কিন্তু ঠিক এইখানেই তো পিথৌরাতে-শ্যামাপ্রসাদে তফাত। এ সমস্যার সমাধান পিথৌরা জানে না, দায়ও তার নয়; শ্যামাপ্রসাদ যদি শ্যামার প্রসাদ পান তবে সমস্যা-সমাধান করতে পারবেন বলে আশাকরি। না হলে নেতা হলেন কেন?
তবে শেষ কথা এই : তিনি নিজেই যা বলেছেন সেইটাই সত্যি। এ সমস্যার সমাধান তাঁকে করতে হবে তাঁর পার্টিগত দৃষ্টিবিন্দু বর্জন করে, একদম হানড্রেড অ্যান্ড টেন পার্সেন্ট নির্জলা, নির্ভেজাল খাঁটি বাঙালিরূপে।
এবং শ্যামাপ্রসাদের বাঙালিত্ব সন্দেহ করবে কে? যদি কেউ করে, তবে বিদ্যেসাগর মহাশয়ের ভাষাতে বলি (সাবধান, চ্যালেঞ্জ করবেন না, আমি গেল কয়েক মাস ধরে শুধু বিদ্যাসাগরই পড়েছি), তার বাপ নির্বংশ হোক!
বাঙালিকে একথা ভুললে চলবে না, সে বাঙালি। সে হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, খ্রিশ্চান নয়– সে বাঙালি।
আমার পরম শুভানুধ্যায়ী, বিদ্রোহী বীর, পরলোকগত উপীনদা এ সম্বন্ধে নির্বাসিতের আত্মকথাতে যা লিখেছেন সেটা বাঙালি যেন বারবার পড়ে, উদয়াস্ত সেই মন্ত্র জপ করে।
একবার বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়লেই একথা সবাইকে মেনে নিতে হয়।
বাঙলা-সাহিত্যের আঁতুড়ঘর বৌদ্ধ-মন্দিরে–চর্যাপদ নিয়ে, বেদবেদান্ত নিয়ে নয়। তার পর তার বৈষ্ণব রূপ। আজ বৈষ্ণবধর্ম হিন্দু ধর্মের অঙ্গ, কিন্তু যে যুগে সে জন্মগ্রহণ করে সে যুগে সে ব্রাত্য–ব্রাহ্মণ চণ্ডীদাস ধোপানি রামীকে বলেছেন,
তুমি বেদ-বাদিনী হরের রমণী
তুমি হও মাতৃপিতৃ
ত্রিসন্ধ্যা যাজন তোমারে ভজন
তুমি বেদ মাতা গায়ত্রী।
এ যদি বিদ্রোহ না হয়, এ যদি স্বাধীন চিন্তাপদ্ধতি না হয়, তবে স্বাধীনতা কী? তার পর বাঙলা গদ্যের সূত্রপাত রামমোহন। তিনিও বিদ্রোহী— প্রচলিত হিন্দুধর্মের কতই না জঞ্জাল তিনি লৌহ-সম্মার্জনী দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে গেলেন। তার পর বাঙলার শ্রেষ্ঠতম সন্তান বিদ্যাসাগর মহাশয়–তাকে বর্ণনা করার ভাষা আমার আয়ত্তের বাইরে–তিনিও সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন কর্মের বিজয়পতাকা তুলেছেন। তার পর মাইকেল–রাম রাম! তিনি তো কেরেস্তান; কিন্তু শুধাই, আজ এবং সে যুগেও কেউ তাঁকে তাই নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছে? ওদিকে পূর্ব-বাঙলায় মুসলমানরা কেচ্ছা-সাহিত্য, মুর্শিদিয়া, জারি, দৰ্বেশি রচনা আরম্ভ করেছেন- হিন্দু দীনেশচন্দ্র তো সেগুলো অবহেলা করলেন না! আজ মৈমনসিংহী গীতকবিতা বাংলার অলঙ্কার। তার পর বঙ্কিম; তিনি তো বৃন্দাবনের রসরাজকে সর্বজনসমক্ষে খুন করলেন এবং আশ্চর্য, যে ব্রাহ্মসমাজ বৈষ্ণবধর্মকে তাচ্ছিল্য করে কদম্ববৃক্ষকে অশ্লীল বৃক্ষ বলেন আমার শোনা কথা– সেই সমাজের মহাপুরুষ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই থেকে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছিলেন, রসরাজ চলে গেলে আমাদের থাকবে কী?)। এবং পশ্য, পশ্য, যে বাঙালি বঙ্কিমকে ঋষি উপাধি দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সে-ও রসরাজকে বর্জন করেনি। ঠিক ওই সময়ে কি না বলতে পারব না, কাঙাল হরিনাথের (কাঙাল যদি ছেলের মতো ছেলে হত তবে তুমি জানতে। কাঙাল জোর করে কোল কেড়ে নিত, তুমি পারতে না মা ছাড়তে) সখা মীর মশাররফ হোসেন বিষাদসিন্ধুতে মুসলমানের কারবালার কাহিনী লিখলেন; এ বই হৃদয়তাপের ভাপে-ভরা ফানুস, তত্ত্ব এতে নেই, তবু বাঙালি আজও সে বই কেনে। তার পর রবীন্দ্রনাথ তিনি কতখানি স্বাধীন চিন্তার প্রতীক ছিলেন সেকথা আপনারা আমার চেয়ে ঢের বেশি জানেন; তিনি হিন্দু নন, ব্রাহ্ম নন তিনি বাঙালি। তার পর সুকবি নজরুল ইসলাম। মুসলমান। তাঁর তখলুস্ (পেননেম) বিদ্রোহী কবি। একে মুসলমান, তায় বিদ্রোহী। অথচ বাঙালি হিন্দু তাকে কী শ্রদ্ধাই না দেখিয়েছে–আজও তাঁর জন্মদিনে তার রোগশয্যার চতুর্দিকে বহু বাঙালি জড় হয়। ক্ষীণ আশা নিয়ে যদি তিনি ক্ষণেকের তরে চৈতন্য পেয়ে আরও কিছু দেন (টুকরো খবর দ্রষ্টব্য)। সর্বশেষ পরশুরাম। তিনি আমাদের প্রচলিত ধর্ম নিয়ে যে উল্কট মশকরা করেন সে তো অবিশ্বাস্য। অন্য কোনও দেশ হলে বহু পূর্বেই তিনি লিচ, বার্নট এট দি স্টেক, কাফিররূপে কতলিত হতেন।
বাঙালি বাঙালি। হিন্দুধর্মের প্রতি তার সোহাগ নেই, মুসলমানকে সে অবহেলা করেনি, কেরেস্তানও তার ভাই। এরকম উদারতা কটা জাত, কটা সাহিত্য দেখিয়েছে?
আমি তো বিশ্বসাহিত্য জানিনে। অগ্রজপ্রতিম সখা শ্ৰীযুত সুনীতিকুমার জানেন। তিনিই বলুন না? ভুল প্রমাণ হলে দেহলিপ্রান্ত থেকে কলকাতা অবধি নাকে খৎ দেব।
অথচ কী আশ্চর্য! হিন্দুধর্ম বাঁচিয়ে রেখেছে বাঙালিই। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ এঁরা বাঙালি। আপনারা যদি সাহস দেন, তবে সে প্রলাপও একদিন নিবেদন করব।
উদ্ধৃতিতে ভুল থাকলে অপরাধ নেবেন না। এই পাণ্ডববর্জিত ইন্দ্রপ্রন্থে চণ্ডীদাস পাই কোথায়?
.
১৮.
বিদেশ থেকে মহামেহন্নত করে বিরাট বিরাট ছবি এদেশে এনে কেউ যদি প্রদর্শনী খোলে, তবে সে সম্বন্ধে সামান্যতম অপ্রিয় বাক্য বলতেও দ্রজনের বাধো বাধো ঠেকে। অথচ মৌনতা দ্বারা সম্মতি অর্থাৎ সন্তুষ্টি প্রকাশ করলে যে-ভদ্র-মহোদয়গণ সোভিয়েট চিত্রপ্রদর্শনী খুলেছেন তাদের প্রতি অন্যায় করা হয়। আমরা যদি চুপ করে থাকি, তবে তারা ভাববেন এ ছবিগুলো আমাদের পছন্দ হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এ ধরনের ছবিই পাঠাবেন। আর আমরা যদি বলি, না, আমাদের প্রাণে এ ছবিগুলো কোনও স্পন্দন জাগাতে পারেনি, তবে হয়তো ভবিষ্যতে তাঁরা তাঁদের বিশাল ভাণ্ডার থেকে অন্য ধরনের ছবি পাঠাবেন।
***
স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে ছবিগুলো ঘোর বস্তৃতান্ত্রিক বা রিয়ালিস্টিক। মুলত এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। রুশ বস্তৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রসঙ্, তার ছবি যে একদম বস্তুরূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে সেই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু প্রশ্ন বস্তৃতান্ত্রিক ছবি হলেই তাকে কি রঙিন ফটোগ্রাফি হতে হবে? প্রদর্শনীর অধিকাংশ ছবি তাই; এক শ বৎসর আগে, ইম্প্রেশনিজম আরম্ভ হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে অর্থাৎ ইয়োরোপীয় চিত্রকলার অবনতির যুগে, এরকম ছবি আঁকা হয়েছিল। ভারতবর্ষে রবি বর্মা এ ধরনের ছবি এঁকেই এদেশে নাম করেছিলেন। এসব ছবিতে মুন্সিয়ানা বিস্তর, খাটুনি এন্তার, কিন্তু এরা ছবির পর্যায়ে ওঠে না।
***
তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, রুশরা ভালো আঁকবার চেষ্টায় যে কাঠ-খড় পোড়াচ্ছে তার তুলনায় আমাদের অধিকাংশ চিত্রকররা কোনও মেহনতই করছেন না। ভালো করে লাইন টানার কিংবা তুলি ধরার পূর্বেই এঁরা সব সেজান গর্গা মাতিসের অতিশয় দুর্বল অনুকরণ করে অরিজিনাল ছবি আঁকতে আরম্ভ করে দেন। প্রকৃতি বা জীবজন্তু পর্যবেক্ষণ না করে, আপন হৃদয়ের জারক রসে সেটা না জারিয়ে নিয়ে তারা আকাশকুসুমবৎ কাল্পনিক অদ্ভুত অদ্ভূত জ্যুজানোয়ার বানাতে আরম্ভ করে দেন। সব ফাঁকি, সব ফকিকারি– পিছনে কোনও মেহন্নত নেই, কোনও সাধনা নেই।
রাশাতে ফাঁকি দেওয়া কঠিন। মেহন্নত এবং উৎপাদনের মাপকাঠি দিয়ে সেখানে অর্থ এবং সম্মানের ওজন করা হয়।
রাশানরা খেটেছে, তাই ভবিষ্যতে এরা ভালো ছবি আঁকতে পারলে বিস্মিত হব না।
সর্বশেষ বক্তব্য, প্রদর্শনীতে উত্তম ছবিও কয়েকখানা আছে– জারের পূর্বেরও, পরেরও। তবে সেগুলো খুঁজে বের করতে হয়।
***
ইতোমধ্যে দিল্লিতে আর্ট নিয়ে গুটিকয়েক সম্মেলন হয়ে গেল। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, আমাদের জীবনের সঙ্গে আর্টের সম্পর্ক ক্রমেই ছিন্ন হয়ে আসছে এবং আমাদের উচিত আমাদের শিক্ষায়তনগুলোতে আর্ট শেখাবার সুব্যবস্থা করা।
***
আর্ট শেখানো উচিত–এ কথা বলতে গিয়ে কিন্তু অনেকেই দুটো জিনিস মিশিয়ে ফেলেন।
দেশসুদ্ধ লোককে ছবি আঁকতে কিংবা গান গাইতে (স্থাপত্য অর্থাৎ বিরাট বিরাট এমারৎ তৈরি করা শেখানোর কথাই ওঠে না) শেখানোর চেষ্টা করা ভুল- কোনও দেশ করেও না। কিন্তু এসব কলারস আস্বাদন করার শক্তি ও রুচি জন্মানো প্রত্যেক শিক্ষায়তনেরই কর্তব্য। এবং তার ব্যবস্থা আমাদের স্কুল-কলেজের কোথাও নেই। আমাদের স্কুল-কলেজের দেয়ালে অজন্তা, রাজপুত, মুগল কলা, ত্রিমূর্তি, নটরাজ, কনারক খাজুরাহো, কুত্ত্ব তাজের ফটোগ্রাফ টাঙানো থাকে না; কাজেই সেগুলোতে কী কলারস রয়েছে সেকথা মাস্টার-অধ্যাপক কাউকেই বুঝিয়ে বলতে হয় না।
আমাদের তাবৎ ঝোঁক সাহিত্যের দিকে। গদ্য এবং পদ্যে কী রস কোথায় লুকোনো আছে, আমাদের শিক্ষকরা সেটা পই পই করে বোঝান, শুকনো চসার পর্যন্ত আমাদের বাধ্য হয়ে চিবোতে হয়, এসব বিষয়ে রচনা লিখতে হয় ও সাহিত্যের ইতিহাস কণ্ঠস্থ করতে হয় (কবিতা কী করে লিখতে হয় তার তালিম অবশ্য দেওয়া হয় না– লাতিন স্কুলে যেরকম লাতিন পদ্য এবং টোলে যেরকম সংস্কৃত পদ্য রচনা করতে শেখানো হয়)। বহু বৎসর ধরে এই কর্ম চলে এবং শেষটায় কেউ কেউ সাহিত্যানুরাগী হন। যারা স্কুল-কলেজে থাকাকালীন, কিংবা ছাড়ার পর, কবিতা লেখেন সেটা প্রধানত নিজের চেষ্টার ফলে– স্কুল-কলেজের তালিম দেওয়ার ফলে নয়।
কিন্তু প্রশ্ন, সাহিত্য ভিন্ন অন্য বস্তুতে শিক্ষা দেবে কে?
***
কালই একজন খ্যাতনামা ভারতীয় ঐতিহাসিকের লেখা একখানা ভারতের ইতিহাস পড়ছিলুম। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বে অসাধারণ পণ্ডিত; কাজেই ভারতের প্রতি যুগের এই তিন বস্তু তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আলোচনা করেছেন। কোন ভ্রাম্যমাণের রোজনামচা কতখানি বিশ্বাস করা যায়, কোন মুদ্রা থেকে কতখানি ইতিহাস নিংড়ে বের করা যায়, পূর্বাচার্য ঐতিহাসিকগণের মধ্যে কে কতখানি বিশ্বাস্য কতখানি অবিশ্বাস্য এসব তত্ত্ব তিনি সূক্ষ্ম চালনির ভিতর দিয়ে বারবার চালিয়ে নিয়ে খাঁটি মাল পরিবেশন করেছেন।
কিন্তু প্রতি অধ্যায়ের পর যখন ওই যুগের শিল্পকলা নিয়ে তিনি আলোচনা আরম্ভ করেন তিনি আর পূর্ববর্ণিত অতি সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে আলোচনা ফাঁদেন না। তখন শুধু অ্যাজ ফাসন সেজ কিংবা একর্ডিং টু কানিঙহাম অথবা কার স্টিফেন ইজ রাইট হুয়েন হি সেনটেনস। তার নিজের কিছু বক্তব্য নেই।
আমি একথা বলব না, আমাদের ঐতিহাসিকের কোনওপ্রকার আপন রসবোধ নেই। সাহিত্যরস তার দিব্য আছে, ভাস-কালিদাস সম্বন্ধে তিনি সূক্ষ্ম পদ্ধতিতেই আলোচনা করেছেন; অর্থাৎ তিনি যৌবনের যে শিক্ষা ও রুচির তালিম পেয়েছিলেন তার বিকাশ করে উত্তম ইতিহাস লিখেছেন। কিন্তু চারুশিল্প বাবদে তিনি কখনও কোনও তালিম পাননি বলে ভারত-ইতিহাসের সেই সুবৃহৎ–হয়তো সর্বোত্তম অধ্যায় তিনি লিখতে পারেননি।
তাই প্রশ্ন, চারুকলার ইতিহাস (হিস্ট্রি) পাব কবে?
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্রাজুয়েট বিভাগে আর্ট হিস্ট্রি পড়াবার সুব্যবস্থা আছে। প্রতি বৎসর কয়েকটি ছেলেমেয়ে এ বিষয় অধ্যয়ন করে ডিগ্রি নেন একটি মিশরি ছেলে সরকারি বৃত্তি পেয়ে এ বিষয়ে পড়তে কলকাতা এসেছে এবং খুব সম্ভব পরে বেকার থাকে।
আমার মনে হয় আর্ট হিস্ট্রি ফার্স্ট ইয়ার থেকেই পড়ানো উচিত। লজিক, সংস্কৃতের ন্যায় যে কোনও ছেলে যেন বিষয়টি বেছে নিতে পারে। যারা এতে অনার্স নেবে তারা যেন জেনারেল আর্ট হিস্ট্রির কোনও বিশেষ অংশ– সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রভাস্কর্য, স্থাপত্য ইত্যাদি যে কোনও একটি বিষয় নিয়ে গভীরতার চর্চা করে।
এইসব গ্রাজুয়েট পরবর্তীকালে স্কুল-শিক্ষকের কর্ম নিলে সেখানে অনায়াসে কলাচর্চার গোড়াপত্তন করতে পারবেন।
***
দিল্লি সম্মেলনে স্কুলের ড্রইংমাস্টারদের নিন্দে করা হয়েছে। জানি, সম্মেলন যা বলেছেন সেসব অতি খাঁটি কথা কিন্তু তবু আমার বেদনা বোধ হল।
ছেলেবেলায় যে দুটি ড্রইংমাস্টার আমাদের ছবি আঁকা শেখাতেন তারা রাফায়েল-টিশিয়ান ছিলেন না; এমনকি আজ বুঝতে পারি, তারা উত্তম ছবির আদর্শ বলতে রঙিন ফটোগ্রাফই বুঝতেন– তখনও অজন্তা-মুগল আমাদের ক্ষুদ্র মহকুমা শহরে এসে পৌঁছয়নি।
সেজান চিত্রকর, জোলা সাহিত্যিক। এঁর ছবি ওঁর চিন্তাধারাকে, ওঁর চিন্তাধারা এঁর ছবির ওপর প্রভাব বিস্তার করে অপূর্ব সৃষ্টির সহায়তা করেছিল।
আমার ড্রইংমাস্টাররা সংস্কৃত এবং ফারসির শিক্ষকদের মতো অবহেলিত, অনাদৃত ছিলেন।
এঁরা যদি কোনও কলা-ঐতিহাসিক শিক্ষকের দিগদর্শন পেতেন, তবে ভ্রান্তপথ বর্জন করে আমাদের ঐতিহ্যগত কলা-সৃষ্টির নির্মাণে নিজেকে অতি সহজে নিয়োজিত করতে পারতেন এবং তাতে করে এঁদের জীবন সার্থক হত।
সবাই অবহেলা করে এদের বলত পটুয়া– এমনকি সহকর্মীগণও এদের সঙ্গে ব্যবহার করতেন এমনভাবে যেন এঁরা ব্রাত্য, অপাঙক্তেয়– যোগাযোগের ফলে জাতে উঠেছেন। ডাঙায় নগণ্য মাইনে, জলে অবহেলা– শেষটায় একজন ঢাকার থিয়েটারের সিন এঁকে আর সব মাস্টারদের পয়সার দিক দিয়ে কানা করে দিলেন। কিন্তু আমি জানি, তিনি সুখী হননি। আমাকে তিনি স্নেহ করতেন; নিজে সেকথা বলেছেন। আজ বুঝতে পারি, কেন তিনি সুখী হননি।
রঙিন ফটোগ্রাফ হোক কিংবা আর যাই হোক, যখন তিনি মাস্টার ছিলেন, তখন তার একটা আদর্শ ছিল, স্টেজের সিন আঁকতে সে আদর্শটি লোপ পেল পেলেন তিনি টাকা।
***
বহু বহু বৎসর পরে আমি বার্লিন শহরে কয়েক মাস বাস করেছিলাম। সেখানে কয়েকজন মেধাবী চিত্রকরের সঙ্গে হৃদ্যতা হয়। এদের একজন আমার ঘরে এ-বই ও-বই নাড়াচাড়া করছেন। তার ভিতর ছিল চয়নিকা– ওই একখানা বই আমি সবসময়ই বিদেশে সঙ্গে নিয়ে যেতুম, বিস্তর বই নিয়ে যাবার উপায় নেই বলে।
সে বইয়ের প্রথম সাদা পাতায় আঁকা ছিল আমার ড্রইংমাস্টারের আপন তুলিতে আঁকা সূর্যোদয়।
আমার জার্মান আর্টিস্ট বন্ধু হতবুদ্ধি হয়ে সে ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, হোয়াট এ রটন পেন্টিং– বাট হোয়াট মাস্টারি অভার টেকনিক!
.
১৯.
পূর্ব-পশ্চিমের বহু গুণী-জ্ঞানী দার্শনিক-পণ্ডিতজন দেহলি-প্রান্তে সমবেত হইয়া সপ্তাহাধিককাল মানবের মূল্য ও শিক্ষা-দর্শন সম্বন্ধে বহুমুখী আলোচনাকরতঃ স্ব স্ব দেশে প্রত্যাগমন করিয়াছেন– কেহ কেহ ভারতভ্রমণে বহির্গত হইয়াছেন।
চরম সত্য ভঙ্গের প্রাক্কালে সমবেত দার্শনিকমণ্ডলী একবাক্যে স্বীকার করেন, পূর্ব ও পশ্চিমের চিন্তাধারা এবং জীবনদর্শনে কোনওপ্রকারের দ্বন্দ্ব কিংবা অন্তর্নিহিত পার্থক্য নাই।
তৎসত্ত্বেও আমার মনে সে সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ দ্বিধা রহিয়া গিয়াছে। কিন্তু সে তত্ত্ব এস্থলে সবিশদ আলোচনা না করিয়া অন্য একটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
পূর্ব-পশ্চিমের স্ব স্ব বৈশিষ্ট্য আছে সেকথা স্বীকার করিয়া লইলেও তো কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। আমরা ইউনিটি বা ঐক্যের সন্ধান করিতেছি– সমতা বা ইউনিফর্মিটি আমাদের কাম্য নহে। বঙ্গবাসী পাঞ্জাববাসীর ন্যায় রুটি এবং মাংস না খাইলে কি উভয়ের ঐক্য অসম্ভব? বরঞ্চ বলিব, পাঞ্জাবি এবং বাঙালি উভয়েই আপন আপন বৈশিষ্ট্য স্বীকার করিয়া আপন মনীষার নব নব বিকাশ নব নব উন্মেষণ করিয়া যদি বৃহত্তর ঐক্যে সম্মিলিত হয়, তবে সেই ঐক্যই হইবে সত্য ঐক্য।
প্রাচ্য-প্রতীচ্য সেইরূপ যদি আপন আপন বৈশিষ্ট্য রক্ষা করিয়া সহযোগিতা করে, তাহাতেই তো বৃহত্তর মঙ্গল; বরঞ্চ বলিব, একে অন্যের অণুকরণ করিয়া করিয়া ক্ষুদ্র সমতার সন্ধান করিলে উভয়ই আপন আপন ঐতিহ্যভ্রষ্ট হইয়া আড়ষ্ট এবং ক্লীব দর্শনের পীড়াদায়ক পুনরাবৃত্তি করিবে মাত্র।
***
জনৈক ফরাসিস দার্শনিক বলিলেন, প্রাচী বরঞ্চ প্রতীচী সম্বন্ধে বহু জ্ঞান ধারণ করে, কিন্তু প্রতীচী সেই অনুপাতে প্রাচীর অল্প পরিচয় লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছে।
আপাতদৃষ্টিতে তাহার মনে হয়। কারণ যেসব ভারতীয় পণ্ডিত এই দার্শনিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন তাহাদের অনেকেই বহু বৎসর ইয়োরোপে বিদ্যাভ্যাস করিয়াছেন এবং সেই সূত্রে ওই মহাদেশ সম্বন্ধে নানাপ্রকারের তত্ত্ব এবং তথ্য সঞ্চয় করিয়া স্বদেশপ্রত্যাগমন করিয়াছেন। কিন্তু প্রশ্ন, মাক্স মুলার, যাকোবি, লেভি, উইন্টারসিস, গেল্ডনার এবং পূর্ববর্তী যুগে যেসব ইয়োরোপীয় পণ্ডিত ভারতবর্ষে বাস করিয়া বহু সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করিয়া উত্তম উত্তম সংস্করণে প্রকাশ করিলেন; কানিংহাম, ফাগুসন, স্টিফেন, হেভেল ভারতীয় কলা সম্বন্ধে যে প্রকারের গবেষণা করিলেন, সেই তুলনায় কয়জন প্রাচ্য দেশবাসী গ্রিক কিংবা লাতিন পুস্তকের চর্চা করিয়া ইয়োরোপীয়দিগকে জ্ঞান দান করিয়াছেন? কয়জন ভারতীয় কিংবা চৈনিক বিদগ্ধ ব্যক্তি ইয়োরোপীয় কলার ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে প্রামাণিক এবং সর্বাঙ্গসুন্দর পুস্তক লিখিতে সক্ষম হইয়াছেন? ব্যোটলিঙ্ক-রোই যে বিরাট সংস্কৃত অভিধান প্রণয়ন করিয়া গিয়াছেন, সেই জাতীয় গ্রিক অভিধান যখন ভারতে রচিত হইবে বুঝিব আমরা সত্যই প্রতীচ্য বৈদগ্ধ্যের কিঞ্চিৎ সন্ধান পাইয়াছি।
***
এই হেমন্ত শিশিরে দেহলি-প্রান্তে যেসব কলা প্রদর্শনী দেখিলাম, তাহার মধ্যে দুইজন চিত্রকরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য– শ্ৰীযুত বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ও শ্ৰীযুত অবনী সেন।
শ্ৰীযুত অবনী সেন গত সপ্তাহে তাঁহার বিগত কয়েক বৎসরের চিত্রকলা দেহলি-প্রান্তে উপস্থিত করিয়াছেন এবং সেইগুলি দেখিয়া বহু গুণী মুগ্ধ হইয়াছেন।
অবনী সেন সরল এবং অনাড়ম্বর চিত্রকার। তিনি জীবজন্তু, প্রকৃতি, পুরুষ-নারী দেখিয়াছেন অতিশয় সযত্নে এবং সেইগুলির প্রকাশ দিয়াছেন নিজস্ব সরল পদ্ধতিতে। সুদ্ধমাত্র মনোরঞ্জন করিবার জন্য কিংবা আর্টিস্টিক হইবার জন্য তাঁহার চিত্রে কোনওপ্রকারের ছলনা নাই। দিল্পি নগরীতে এ বড় বিস্ময়কর বস্তু। সামান্য দুই-তিনটি প্রদর্শনী ব্যত্যয়রূপে বিচারাধীন না করিলে অধিকাংশ স্থলেই দেখিয়াছি কেহ করিতেছেন মাতিসের নকল, কেহবা সেজানের, কেহবা ভানগগের। তবুও ঈষৎ সান্ত্বনা পাইতাম যদি ইহারা সত্যই পূর্বোল্লিখিত কৃতী পূরুষগণের অনুকরণ করিতেন। আমার মনে হয় ইহারা তাঁহাদিগের সত্য বৈশিষ্ট্য সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হন নাই, ইহারা অনুকরণ করিয়াছেন এইসব গুণীদের অবান্তর অংশগুলিকে। শুনিয়াছি শিলার নাকি ডেস্কে গলিত আপেল না রাখিলে কবিতা রচনা করিতে পারিতেন না। দিল্লিতে প্রদর্শিত অধিকাংশ চিত্রকারের চিত্রে গলিত আপেলের দুর্গন্ধ পাইয়া সন্দেহ হইল উঁহারা শিলারের অনুকরণ করিয়াছে– শিলারের প্রতিভার সন্ধান ইঁহারা পান নাই, কিংবা বলিব, অশ্বত্থামার ন্যায় পিষ্টতণ্ডুল দর্শনে উদ্বাহু হইয়া নৃত্য করিয়াছেন।
সাহিত্যে এই কর্ম অহরহ হইতেছে– তাহার সন্ধান সকলেই রাখেন, কিন্তু চিত্রে এই দুষ্কর্ম মর্মান্তিকরূপে শশিকলার ন্যায় বৃদ্ধি পাইতেছে।
তাই নিবেদন করিতেছিলাম, অবনী সেন কোনও গলিত আপেলের সন্ধানে কালক্ষয় করেন নাই। বিচিত্র পৃথিবীকে তিনি স্বচক্ষে দেখিয়াছেন, সেই দর্শন তাঁহার হৃদয়ের যে অনুভূতি যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করিয়াছে, তিনি তাহারই প্রকাশ দিয়াছেন কোনও প্রকারের ছলনা না করিয়া।
এই প্রশস্তিই যথেষ্ট।
***
কলিকাতা মহানগরী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছেন বৈদেশিকদের যেসব প্রতিমূর্তি আমাদিগের নগরে নগরে বিরাজ করিতেছে ইহাদিগকে লইয়া আমাদের কর্তব্য কী? এই প্রশ্ন দিল্লিতেও উপস্থিত হইয়াছে।
কেহ বলিতেছেন, এইগুলোকে কোনও যাদুঘরে রাখিয়া দেওয়াই প্রশস্ততম পন্থা।
কেহ বলিতেছেন, তাহা হইলে ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকগণের মূল্যবান তথ্য আহরণের সূত্র বিনষ্ট করা হইবে।
কেহ বলিতেছেন, এইগুলি স্থানান্তর করিতে যথেষ্ট অর্থব্যয় হইবে এবং যে বিরাট ভাণ্ডার ইহাদিগের জন্য নির্মাণ করিতে হইবে তাহার জন্য অর্থব্যয় এক গৌরী সেনেই সম্ভবে।
কেহ বলিতেছেন, এইগুলিকে ইংলন্ডে পাঠাইয়া দাও। ইহারা ইংলন্ডের কৃতী সন্তান; স্ব স্ব নগরে ইঁহারা প্রাতঃস্মরণীয় এবং প্রাতর্দর্শনীয় হইয়া বিরাজ করুন।
এই ইন্দোনেশিয়ান বান্ধব আমাকে একাধিকবার জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, আপনারা বৈদেশিকদের এই প্রতিমূর্তিগুলি সহ্য করিতেছেন কেন?
আমি প্রশ্ন করিলাম, আপনারা ওলন্দাজ প্রতিমূর্তিগুলির কী ব্যবস্থা করিয়াছেন?
মৃদু হাস্য করিয়া বলিলেন, দণ্ডাধিককাল মধ্যেই চূর্ণবিচূর্ণ করিয়াছি।
***
স্বীকার করি বৈদেশিকের প্রতি কিংবা তাহাদের প্রতিমূর্তির প্রতি আমার এইরূপ জাতক্রোধ সহজে উপজাত হয় না। ভিনাস কিম্বা মজেসের প্রতিমূর্তি দেখিয়া আনন্দ পাই, কোনওপ্রকারের ক্রোধ চিত্তকোণ স্পর্শ করে না।
কিন্তু এই প্রতিমূর্তিগুলি যে অত্যন্ত কুৎসিত। যত দিন পর্যন্ত এই প্রতিমূর্তিগুলি নগরে নগরে বিরাজমান থাকিবে ততদিন আমাদের ভবিষ্যৎ ভাস্করদের সুরুচি নির্মাণের পক্ষে ইহারা নিদারুণ অন্তরায়– ফিল্মি গানা যেরূপ ইয়োরোপীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গ্রহণের পক্ষে অন্তরায় হইয়া রহিয়াছে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল যেরূপ ভারতীয় স্থপতির রুচি-বিকার ঘটাইতেছে। কিন্তু হায়, ফিল্মি গানা বন্ধ করিবার উপায় নাই, মেমোরিয়াল ধূলিসাৎ করিই-বা কী প্রকারে।
ঐতিহাসিকেরা যে এই প্রতিমূর্তিগুলি হইতে বহুতর গবেষণার উপাদান পাইবেন সেকথা অস্বীকার করি না, কিন্তু এ তথ্য অনস্বীকার্য যে, ইহাদের জন্য ভাণ্ডার নির্মাণ করা অর্থের অতিশয় অন্যায় অপব্যয়।
***
ইঁহারা স্বদেশে প্রত্যাগমন করিতে পারেন কি না সে সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা, ইংলন্ডমাতা ইঁহাদিগকে আপন বক্ষে স্থান দিবেন কি?
কারণ একদা একখানা বিরাট ইংলভীয় কামান– সেই কামান এই দেশে নাকি বহু শৌর্যবীর্য দেখাইয়াছিল– কোনও এক ইংরেজ মহাপ্রভুর উৎসাহে স্বনগরে প্রেরিত হয় এবং নগরের মধ্যবর্তী উদ্যানে প্রতিষ্ঠিত হয়। নগরবাসীগণ সেই বিকটদর্শন কামান দেখিয়া তদ্দণ্ডেই সে চক্ষুশূলকে অপসারণ করিবার জন্য তারস্বরে চিৎকার করে। বহু প্রকারে তাহাদিগকে বলা হইল, এই ভুবনবিখ্যাত কামান ভারতের অমুক দুর্গের প্রাচীর ভগ্ন করিতে সহায় হইয়াছে, অমুক নগরে শত শত ইংরেজের প্রাণরক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছে; এই কামানের জন্মস্থল এই নগর, অতএব এই নগর ইহাকে সম্মান না করিলে ইহার উপযুক্ত সম্মান করিবে কে?
কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। নাগরিকগণ দুর্যোধনের ন্যায় সূচ্যগ্র পরিমাণ ভূমি দানে অনিচ্ছুক এবং কতিপয় পাষণ্ড বলিল, এই কামানের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে তাহারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং এই কামান কোথায় কোন অপকর্ম করিয়াছে তাহার লুপ্ত ইতিহাস জানিবার জন্য তাহারা কিছুমাত্র ব্যগ্র নহে।
অতএব আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা যদি এই প্রতিমর্তিগুলিকে ইংলন্ডকে সহৃদয়তার সঙ্গে দান করি তবে তাহারা সেগুলি স্বব্যয়ে লইয়া তো যাইবেই না, পরন্তু করুণকণ্ঠে বারম্বার নিবেদন করিবে, আপনারা না মহাত্মাজির শিষ্য; আমাদিগের গত অপরাধের জন্য কি এই প্রকারের নৃশংস প্রতিহিংসা লইতে হয়?
অতএব সেই শর্করায়ও মৃত্তিকা।
.
২০.
যারা ভালো করে পৃথিবীর ইতিহাস পড়েছেন তারা খাঁটি খবর দিতে পারবেন, আমি সামান্য যেটুকু পড়েছি, তার থেকে আমার দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছে মহাত্মাজির মতো মহাপুরুষ এ পৃথিবীতে দ্বিতীয় জন্মাননি।
বুদ্ধদেবকে কোনও ব্যাপক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়নি, খ্রিস্টের সামনে যে রাজনৈতিক সমস্যা এসে পড়েছিল (ইহুদিদের পরাধীনতা) তিনি তার সম্পূর্ণ সমাধান করেননি, শ্রীকৃষ্ণ এবং মুহম্মদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র গ্রহণ করার আদেশ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এই চার মহাপুরুষকেই কোটি কোটি লোক শত শত বৎসর ধরে স্বীকার করে নিয়ে জীবনযাত্রার পথ খুঁজে পেয়েছে কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস মহাত্মাজি যে বুদ্ধ এবং খ্রিস্টের অহিংস পন্থা নিয়ে যে রাজনৈতিক সফলতা লাভ করেছিলেন এ জিনিস পৃথিবীতে পূর্বে কখনও হয়নি। প্রেম দিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে হিংসার ওপর জয়ী হওয়া যায় একথা পৃথিবী বহু পূর্বেই মেনে নিয়েছিল কিন্তু অস্ত্রধারণ না করে রাজনীতির ক্ষেত্রেও যে জয়ী হওয়া যায় সেই অবিশ্বাস্য সত্য প্রমাণ করে গিয়েছেন মহাত্মাজি। আমার ভয় হয়, একদিন হয়তো পৃথিবী বিশ্বাস করতে রাজি হবে না যে মহাত্মাজির প্রেম ইংরেজের বর্বর সৈন্যবলকে পরাজয় করতে সক্ষম হয়েছিল। অবিশ্বাসী মানুষ আজ স্বীকার করে না যিশু মৃতকে প্রাণ দিয়েছিলেন; পাঁচশ বছর পরের অবিশ্বাসী দুটোকেই হয়তো এক পর্যায়ে ফেলবে।
***
পাঠক হয়তো জিগ্যেস করবেন, মহাত্মাজি রাজনৈতিক ছিলেন; তিনি কোনও নবীন ধর্ম প্রচার করে যাননি। তবে কেন তাঁকে ধর্মগুরুদের সঙ্গে তুলনা করি।
নবীন ধর্ম কেন সৃষ্টি হয় তার সবকটা কারণ বের করা শক্ত কিন্তু একটি জিনিস আমি লক্ষ করেছি। কি বুদ্ধ কি খ্রিস্ট সকলকেই তাদের আপন আপন যুগের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করে নিতে হয়েছিল। এ বিষয়ে পিথৌরার চর্চা বড়ই অগভীর সেকথা পাঠককে আবার জানিয়ে রাখছি।
বুদ্ধদেবের সময় উত্তর ভারতবর্ষের বনবাদাড় প্রায় সাফ হয়ে গিয়েছে এবং ফলে আশ্রমবাসীগণ নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছিলেন। সজ্ঞ নির্মাণ করে তাঁদের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা বুদ্ধদেবকে করে দিতে হয়েছিল। আমার ভাণ্ডার আছে ভরে, তোমা সবাকার ঘরে ঘরে–অর্থাৎ যৌথ পদ্ধতিতে বিরাট প্রতিষ্ঠান (স) নির্মাণ ভারতে এই প্রথম। দ্বিতীয়ত তখন প্রদেশে প্রদেশে এত মারামারি হানাহানি যে, ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো করে প্রসার পাচ্ছিল না। শ্ৰমণগণ এসব উপেক্ষা করে শান্তির বাণী নিয়ে সর্বত্র গমনাগমন করার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক অন্তরায় দূর হয়। তাই শ্ৰেষ্ঠীরা সবসময়ই সঙ্রে সাহায্যের জন্য অকাতরে অর্থ দিয়েছেন।
খ্রিস্ট ইহুদিদের স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁর পন্থা ছিল ইহুদিদের নৈতিকবলে এতখানি বলীয়ান করে দেওয়া, যাতে করে পরাধীনতার নাগপাশ নিজের থেকে ছিন্ন হয়ে যায়– অরবিন্দ ঘোষও পণ্ডিচেরিতে এই মার্গেরই অনুসন্ধান করেছিলেন।
কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণ যে শুধু কুরুপাণ্ডবের যোগসূত্র স্থাপন করার জন্য কূটনৈতিক দূত তাই নন, শেষ পর্যন্ত তিনি পাণ্ডববাহিনীর প্রধান সেনাপতির পদও গ্রহণ করেছিলেন।
মুহম্মদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আরবের যুযুধান, ছিন্নবিছিন্ন বেদুইন উপজাতিগুলোকে এক করে শক্তিশালী জাতি গঠন করা।
মহাত্মাজিকে সবাই রাজনৈতিক হিসেবে মেনে নিয়েছেন কিন্তু পৃথিবীর মহাপুরুষদের সঙ্গে তুলনা করলে তাকে ধর্মগুরু বলে স্বীকার করে নিলেই ঠিক হবে।
***
প্রশ্ন উঠতে পারে তাই যদি হয়, তবে মহাত্মাজি কোনও নবীন ধর্ম প্রবর্তন করে গেলেন না কেন?
সে তো খ্রিস্টও করে যাননি। খ্রিস্ট তিরোধানের বহু বৎসর পর পর্যন্তও তাঁর অনুচরগণ বুঝতে পারেননি যে তারা এক নবীন ধর্মের প্রদীপ হাতে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। রামমোহন, নানকও দেখা দিয়েছেন ধর্মসংস্কারক রূপে– তাঁরা বীজ রোপণ করে গিয়েছিলেন– শাখাপ্রশাখায় পল্লবিত হল নবীন ধর্ম পরবর্তী যুগে।
মহাত্মাজির নবীন– অথচ সনাতন ধর্ম প্রবর্তিত হতে সময় লাগবে।
সেই ধর্মং শরণং গচ্ছামি!
***
গল্প শুনেছি এক গুরু যখন বুঝতে পারলেন তাঁর এক নতুন শিষ্য একদম গবেট তখন তাকে উপদেশ দিলেন বিদ্যাচর্চা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনও পন্থা অবলম্বন করতে। শিষ্য প্রণাম করে বিদায় নিল।
বহু বৎসর পরে গুরু যাচ্ছিলেন ভিন গাঁর ভিতর দিয়ে। একটি আধাচেনা লোক এসে নিজের পরিচয় দিয়ে শুরুকে আপন বাড়িতে নিয়ে গেল। সেই গবেট শিষ্য। শুরু তার যত্ন-পরিচর্যায় খুশি হয়ে শুধালেন, তা বাবাজি আজকাল কী কর?
শিষ্য সবিনয়ে বলল, টোল খুলেছি।
গুরুর মস্তকে এটম বোমাঘাত! খানিকক্ষণ পরে সামলে নিয়ে শুধালেন, তা কী পড়াও?
শিষ্য বলল, আজ্ঞে সবকিছুই, তবে ব্যাকরণটা পড়াইনে।
গুরু আরও আশ্চর্য হয়ে বললেন, সে কী কথা? আমার যতদূর মনে পড়ছে তুমি তো ব্যাকরণটাই একটুখানি বুঝতে।
শিষ্য বলল, আজ্ঞে, তাই এটা পড়াতে একটুখানি বাধো বাধো ঠেকে।
***
রায় পিথৌরা যে সর্বাবদে এই শিষ্যটির মতো সেকথা আর লুকিয়ে রেখে লাভ কী? এই দেখুন না, দিনের পর দিন সে সম্ভব অসম্ভব কত বিষয়ে কত তত্ত্ব কথাই না বেহায়া বেশরমের মতো লিখে যাচ্ছে। কারণ? কারণ আর কী? সর্ববিষয়ে যার চৌকস অজ্ঞতা তার আর ভাবনা কী?
কিন্তু প্রশ্ন গবেট শিষ্য কিঞ্চিৎ ব্যাকরণ জানত বলে ওই বিষয়ে পড়াতে তার বাধো বাধো ঠেকত। পিথৌরার কি সেরকম কোনও কিছু আছে?
সেই তো বেদনা, সুশীল পাঠক, সেই তো ব্যথা।
মা সরস্বতী সম্বন্ধে কোনও কিছু লিখতে বড় বাধো বাধো ঠেকে। চতুর্দিকে গণ্ডা গণ্ডা সরস্বতী পুজো হয়ে গেল। আমি গা-ঢাকা দিয়ে, কিংবা পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি।
আর কোনও দেবতার সেবা করার মতো সুবুদ্ধি আমার হয়নি প্রথম জীবনে মা সরস্বতীই আমার স্কন্ধে ভর করেছিলেন আর আমি হতভাগ্য তাঁর সেবাটা কায়মনোবাক্যে করিনি বলে আজ আমার সবকিছু ভণ্ডুল বরবাদ হয়ে গিয়েছে। এখন মা সরস্বতীর দিকে মুখ তুলে তাকাতেও ভয় করে। হায়, দেবীর দয়া পিথৌরার প্রতি হয়েছিল, কিন্তু মুখ তাঁকে অবহেলা করে আজ এই নিদারুণ অবস্থায় পড়েছে।
হায়, আমি যদি আজ আমার এক বন্ধুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে পারতুম,
নিতান্ত বালক যবে পুরাণের দেব-সভাস্থলে
চুপে চুপে দেখিয়াছি ইন্দ্র যম বরুণের গলে
মন্দারের মালা আর হস্তে নানা রতন সম্পদ
বৈভব সৌন্দর্য কত। অপরূপ নর্ম লঘুপদ
উর্বশীর সম্মোহনী ইন্দ্রজাল নৃত্যচ্ছন্দময়
শুনেছি সুরের কণ্ঠে হর্ষধ্বনি আর জয় জয়।
লক্ষ্মীর বৈভব হেরি নিষ্কম্প তরুণ আঁখি মম,
মহেন্দ্র-অঞ্চলার পশ্চাতে ফিরিছে ছায়াসম।
হে পিথৌরা, আজি আমি লজ্জা নাহি মানি,
মুগ্ধ মোরে করেছিল সর্বাধিক শ্বেত বীণাপাণি।
কী মন্ত্রে সে ভানুমতী বালকের চিত্তাসনখানি
জয় করে নিয়েছিল; মর্ম তার আজও নাহি জানি।
ঊনবিংশ শতকের বাংলা দেশের প্রধান দার্শনিক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, পূজনীয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কত যে এবং কী অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল তার সন্ধান বাঙলা দেশ আজ আর রাখে না। অথচ সমসাময়িক যুগে বাঙলার জ্ঞান দর্শনশাস্ত্র চর্চার ওপর তিনি যে গভীর প্রভাব রেখে গিয়েছেন তা সে সময়ের যেকোনও লেখকের রচনা থেকে বোঝা যায়।
সেই দার্শনিককে এক ব্যক্তি বলেন, আপনার মতো পাণ্ডিত্য বাঙলা দেশের কারও নেই- একমাত্র আপনিই বাঙলায় মন্দাক্রান্তা ছন্দে কবিতা লিখতে সক্ষম।
দ্বিজেন্দ্রনাথ আপন পাণ্ডিত্যের প্রতি ইঙ্গিত করে একখানি চতুষ্পদী মন্দাক্রান্তায় লেখেন।
ইচ্ছা সম্যক জগ দরশনে
কিন্তু পাথেয় নাস্তি
পায়ে শিকলি মন উড়ু উড়
এ কি দৈবের শাস্তি
টক্কা দেবী করে যদি কৃপা
না রহে কোনও জ্বালা
বিদ্যাবুদ্ধি কিছু না কিছু না।
শুধু ভস্মে ঘি চালা।
দ্বিজেন্দ্রনাথেরই যখন এই অবস্থা তখন আর আমাদের ভাবনা কী?
জয় মা বীণাপাণি!
.
২১.
স্বরাজ পাওয়ার পর একটা পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু সেটা কেউই লক্ষ করছেন না কারণ জিনিসটা চট করে চোখে পড়ে না।
স্বরাজ লাভের পূর্বে খুব কম বিদেশি ছেলেই ভারতে পড়াশোনা করতে আসত। পাঠক হয়তো আশ্চর্য হয়ে বলবেন, সেই তো স্বাভাবিক; আমাদের যে শিক্ষা-ব্যবস্থা তার থেকে তো সুস্থ মানুষ দূরে থাকতেই চাইবে। এদেশে আবার পড়াশোনা করতে আসবে কে? টাকা থাকলে আমরাই আমাদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়াশোনা করতে পাঠাই।
কথাটা খুব ঠিক। বাঘা বাঘা যে সব ন্যাশনালিস্টরা ভারতীয় ঐতিহ্য ভারতীয় কৃষ্টির জিগির গেয়ে সভাস্থল গরম করে তোলেন তারা পর্যন্ত ছেলেমেয়েকে বিদেশি ঐতিহ্যের স্কুল-কলেজে পড়াবার জন্য তাদের অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজ পাঠান।
কিন্তু তৎসত্ত্বেও বিদেশি ছেলেরা ভারতে পড়তে আসে। তার প্রধান কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং পদ্ধতি যতই খারাপ হোক না কেন, আমাদেরই মতো কু-ব্যবস্থা মেলা প্রাচ্য দেশে এখনও মজুদ এবং আমাদের চেয়েও অধম ব্যবস্থা কোনও কোনও দেশে আছে।
***
মিশরের শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় এদেশেরই মতো। তাই মিশরের লোক যদি এদেশে কালেভদ্রে আসে, তবে খুব বেশি আশ্চর্য হওয়ার কথা নয়। অবশ্যই মিশরীয়রা এদেশে আরবি পড়তে আসবে না– আমরা যেরকম সংস্কৃত পড়ার জন্য মক্কা কিংবা মদিনায় যাইনে। তাই যে মিশরি ছেলেটি এসেছে সে শিখতে চায় মোগল-চিত্রকলার ইতিহাস।
উপযুক্ত গুরুর হাতে পড়েছে; কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারলুম, ইতোমধ্যেই বেশ খানিকটা উন্নতি করতে পেরেছে।
***
আমার বিশ্বাস আমাদের চেয়েও অনুন্নত কিংবা আমাদের মতো দুর্ভাগা দেশের ছেলেরা প্রধানত আসবে ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি ইত্যাদি শিখতে কিছুদিন পূর্বে শুনতে পাই, ইরান থেকে নাকি কিছু ছেলে আসবে কৃষি-বিদ্যা শিখতে। এবং তার পর আসবে আমাদের চারুকলার নিদর্শন দেখতে এবং তার ইতিহাস শিখতে। সাহিত্য বা দর্শন শিখতে যে বেশি ছেলে আসবে না সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ কারণ সংস্কৃত শেখার ব্যবস্থা ভারতের বাইরে প্রাচ্য দেশে নেই বললেও চলে, তাই তারা সে বাবদে প্রাথমিক উৎসাহ পাবে না এবং দর্শনের চর্চা আজ পৃথিবীর সর্বত্রই কমে আসছে।
কিন্তু চারুকলা সম্বন্ধে সকলেরই কৌতূহল ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পূর্বে কাইরো-আনকারায় যে ভারতীয় চিত্র প্রদর্শনী খোলা হয় সেগুলোতে বিস্তর লোক এসেছিল এবং প্রেস সেগুলোর প্রচুর সুখ্যাতি করেছে। (কাইরোতে গত বৎসর ভারতীয় নর্তক-নর্তকীরা রাজার মতো সম্মান এবং রাজ-সম্মানও পেয়েছিলেন)।
শুধু তাই নয়, ওরাও আমাদের দেখাতে চায়। কিছুদিন পূর্বে ইন্দোনেশি চারুকলা প্রদর্শনী দিল্লিতে হয়ে গেল সেকথা সকলেই জানেন। আর রুশকে যদি আধা-প্রাচ্য জাত বলা হয়, তবে রুশ কলা-প্রদর্শনীর কথাও স্মরণ করতে হয়।
এই যে মিশরি ছেলেটি এসেছে মোগল চিত্রকলার ক্রমবিকাশের ইতিহাস শিখতে, এরপর আসবে আরও ছাত্র আমাদের প্রাচীনতর চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য শিখতে।
কিন্তু এসব পড়াবার ব্যবস্থা আমাদের কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে? এই যেসব ছেলেরা আসছে এবং আসবে তারা যখন দেখবে আমাদের সাধারণ শিক্ষিত লোক আমাদের চারুকলার কোনও মর্মই বোঝে না, কোনও তত্ত্ব রাখে না তখন তারা ভাববেই-বা কী?
এদিকে নিমন্ত্রিতেরা এসে পড়েছেন ওদিকে রান্নার কোনওপ্রকার আয়োজন নেই। আরেক ছিলিম তামাক ইচ্ছে করুন–অর্থাৎ টালবাহানা দিয়ে আর কতক্ষণ এদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে?
***
এই সম্পর্কে পণ্ডিতবর আবু রয়হান মুহম্মদ বিন্ আহম্মদ আল বিরুনির নাম মনে পড়ল।
কয়েকদিন পূর্বে কলকাতায় তাঁর সহস্রতম জন্মোৎসব হয়ে গেল। ইরান-আফগানিস্তান আরও নানাদেশে এ উৎসব সমাধা হচ্ছে।
অল বিরুনি ছিলেন ফিরদৌসির মতো গজনীর মাহমুদের সভাপণ্ডিত। ফিরদৌসির নাম অনেক বাঙালি শুনেছেন- যখন বাঙলা দেশে ফারসি চর্চা ছিল তখন এক বাঙালি কবি ফিরদৌসি মাহমুদকে গালাগাল দিয়ে যে কবিতা লিখেছিলেন তার অনুবাদ পর্যন্ত করেন :
রাজা যদি হইতেন রানির কুমার
মণিময় তাজ শিরে দিতেন আমার।
অল বিরুনি সম্বন্ধে এক বাঙালি লেখক লিখেছেন :
মাহমুদের ইতিহাস নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাঁর সভাপণ্ডিত অল বিরুনির কথা বাদ দেবার উপায় নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে ছয়জন পণ্ডিতের নাম করলে অল বিরুনির নাম করতে হয়। সংস্কৃতি-আরবি অভিধান-ব্যাকরণ সে যুগে ছিল না (এখনও নেই), অল বিরুনি ও ভারতীয় ব্রাহ্মণগণের মধ্যে কোনও মাধ্যম ভাষা ছিল না। তৎসত্ত্বেও এই মহাপুরুষ কী করে সংস্কৃত শিখে, হিন্দুর জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, জ্যোতিষ, কাব্য, অলঙ্কার, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন সম্বন্ধে তহকিক-ই-হিন্দ নামক বিরাট গ্রন্থ লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন সে এক অবিশ্বাস্য প্রহেলিকা।
একাদশ শতাব্দীতে অল-বিরুনি ভারতের সংক্ষিপ্ত বিশ্বকোষ লিখেছিলেন– প্রত্যুত্তরে আজ পর্যন্ত কোনও ভারতীয় আফগানিস্তান (ইরান) সম্বন্ধে পুস্তক লেখেননি। এক দারাশিকুহ ছাড়া আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কেউ আরবি ও সংস্কৃতে এরকম অসাধারণ পাণ্ডিত্য দেখাতে পারেননি।
এতে কিছুই বলা হল না।
ভালো করে বলবার জন্য যে জায়গা প্রয়োজন তা-ও এখানে নেই। তাই শুধু অলবিরুনি যেসব সংস্কৃত বই পড়ে তার কেতাব লিখেছিলেন তার কয়েকটির নাম দেওয়া হল :
সাংখ্য, পাতঞ্জল, গীতা, বিষ্ণুপুরাণ, মৎস্য পুরাণ, বায়ু পুরাণ, আদিত্য পুরাণ,পুলিসসিদ্ধান্ত, ব্রহ্মসিদ্ধান্ত, খণ্ডখাদ্যক, উত্তর খণ্ডখাদ্যক, বৃহৎ সংহিতা সিদ্ধান্তিকা, বৃহৎ জাতকং, লঘু জাতকং, করণসার, করণতিলক।
অনেকের মনে হতে পারে অল-বিরুনি হয়তো ক্রিশ্চান মিশনারিদের মতো হিন্দু সভ্যতা ও হিন্দুধর্মকে নিন্দা করার জন্য তার বই লিখেছিলেন। তাই তাঁর ভাষাতেই বলি।
এ বই তর্কাতর্কির বই নয়। হিন্দুদের কাছ থেকে শুধু সেসব সিদ্ধান্তই আমি তুলিনি যেগুলো যুক্তি দিয়ে ভুল প্রমাণ করা যায়। বরঞ্চ বলি, আমার পুস্তকখানিতে সুদ্ধমাত্র তাদের তত্ত্ব ও তথ্যের ঐতিহাসিক বর্ণনা দেওয়া হল। হিন্দুদের বিশ্বাস ও চিন্তার আমি হুবহু বর্ণনা দেব এবং পরে গ্রিকদের বিশ্বাস ও চিন্তার উল্লেখ করে দেখাব এই দুই জাতের মধ্যে মিল রয়েছে।
আশ্চর্য! ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে লোকটি গ্রিক ও ভারতীয় দর্শনের মিল দেখতে পেয়েছিলেন।
***
রায় পিথৌরা ভয়ঙ্কর বেরসিক লোক আমি ঠিক বুঝে গিয়েছি। মিস কলকাতা অর্থাৎ শ্ৰীমতী ইন্দ্রাণী রহমানকে রায় পিথৌরা চেনে তার বিয়ের পর থেকেই অথচ তার মনে কখনও সন্দেহ জাগেনি যে এর সৌন্দর্য এমনই মারাত্মক রকমের যে ইনি একদিন সুন্দরীদের মধ্যে কুতুব মিনার হয়ে উঠবেন।
তবে হ্যাঁ, ইন্দ্রাণীকে নিয়ে রাস্তায় বেরুলেই লক্ষ করতুম পথচারীরা আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। একদিন ইন্দ্রাণীকে বললুম, তোমাকে নিয়ে রাস্তায় বেরুনো মুশকিল। সবাই কীরকম প্যাট প্যাট করে তাকায়। অস্বস্তি বোধ হয়।
ইন্দ্রাণী বলল, ছোঃ! আমার দিকে তাকাবে কেন? তাকাচ্ছে তোমার দিকে।
!!! বলে কী! তবে হ্যাঁ, ইন্দ্রাণীর সৌন্দর্যের পরই কলকাতায় সে যুগে দ্রষ্টব্য বস্তু ছিল রায় পিথৌরার গগনচুম্বী পাতালস্পর্শী টাক।
এর থেকে বোঝা গেল, ইন্দ্রাণীর বুদ্ধি আছে। ক্যাসা কায়দায় আপন বিনয় আর ভদ্রতা দেখিয়ে দিল।
কিন্তু আমার বিশ্বাস ইন্দ্রাণীর রূপের চেয়ে গুণ অনেক বেশি।
ইন্দ্রাণী বহু পরিশ্রম আর অনেক সাধনা করে উত্তম ভরত নাট্য শিখেছে। আসছে বার নাচ দেখালে মিস্ কলকাতাকে মিস করবেন না।
সেদিন এক অবাঙালি পিথৌরাকে ধাতিয়ে গেলেন। পিথৌরা নাকি বড্ড বেশি বাঙালি বাঙালি বলে চ্যাঁচাচ্ছে।
আরে বাপু, রায় পিথৌরা কে এমন কেষ্ট-বিধু যে তার চিৎকারে কারও কোনও ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে?
একটা গল্প মনে পড়ল।
পূর্ব বাঙলার গয়না নৌকো ঘাটে ভিড়তেই ভাড়াটেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সব জায়গা দখল করে নিল। একটা চাষা ধরনের লোক কিছুতেই ঢুকতে না পেরে ছইয়ের বাইরে সেই হিমে বসে রইল।
জায়গা দখলপর্ব শেষ হতে ভিতরে আলাপচারি আরম্ভ হয়েছে।
আপনার নাম?
আজ্ঞে, তারাপদ হালদার। আপনার?
আজ্ঞে কেষ্টবিহারী পাল।
তৃতীয় ব্যক্তিকে, আর আপনার?
আজ্ঞে শশধরচন্দ্র গুণ।
করে করে নৌকোর ভিতরকার সকলের চেনাশোনা শেষ হল। তখন এক মুরুব্বি বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নামটা তো জানা হল না, বাবাজীবন।
লোকটি অতিশয় সবিনয় বলল, আজ্ঞে আমার নাম পাঁচকড়ি বৈঠা।
বৈঠা! এ আবার কী বিদঘুঁটে পদবি রে বাবা! বাপের জন্মে শুনিনি।
লোকটি আবার বৈষ্ণবতর বিনয়ে বলল, আজ্ঞে, আপনারা, হালদার, পাল, গুণ সব নৌকোর ভিতরে বসে আছেন। নৌকো চালাবে কে? তাই আমি বৈঠা একা নৌকা চালাচ্ছি।
বাঙালি কেষ্ট্রবিষ্টরা নৌকোর ভিতরে বসে আপন ধান্দায় মশগুল। তাই রায় পিথৌরা বৈঠা হরবকৎ চেল্লাচেল্লি করে।
.
২২.
পিথৌরাকে ধমক দেওয়া হয়েছে, তিনি কেন মাঝে মাঝে হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় একই মাল পরিবেশন করেন।
উত্তরে নিবেদন, আগাগোড়া একই বস্তু পিথৌরা দুই কাগজে কখনও লেখেন না। তবে মাঝে মাঝে দু একটি বিষয় এমনই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় যে, তখন সেগুলো উভয় কাগজে উল্লেখ না করে থাকা যায় না।
এই ধরুন, কাল যদি ওখলায় বেড়াতে গিয়ে দেখি, যমুনার জল উজান বইছেন– পদাবলিতে এরকম অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ আছে, কিন্তু স্বচক্ষে কখনও দেখিনি আর আনন্দবাজার হিন্দুস্থান দুটোই পড়েন যে, এরকম একটা ঘটনা একদলকে বিলকুল জানাব না?
যারা বাঙলায় রায় পিথৌরা পড়তে পারেন, তারা যে কোন দুঃখে ইংরেজিতে পড়েন, তা ও তো বুঝতে পারিনে। রস আর আড্ডা জমাবার জন্য ইংরেজি কি একটা ভাষা!
***
এই ধরুন, গেল সপ্তায় এখানে যা হল সে অভূতপূর্ব।
রাষ্ট্রপতি ভবনে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চারজন একনিষ্ঠ সাধককে স্বহস্তে চারখানা শাল গলায় পরিয়ে দিলেন। দিল্লি শহরের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের ওস্তাদ ইহুদি মেনুহিনও আনন্দের আতিশয্যে ঘন ঘন করতালি দিচ্ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি ভবন বলাতে ঘটনার পরিবেশ ঠিক ঠিক ওত্রালো না। যদি বলতুম, ভাইসরিগেল লজে কাণ্ডটা ঘটল তা হলে পাঠক খানিকটা আমেজ করতে পারতেন। কারণ বড়লাট আদরকদর করতেন, তাঁরই জাতভাই সায়েব-সুবোদের কিংবা রাজা-রাজড়াদের।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খার পরনে ছিল কুর্তা আর পাজামা– মাথায়ও কাপড়ের টুপি। এ বেশ পরে ভাইসদের আমলে ওস্তাদজি নিশ্চয়ই সেখানে আমল পেতেন না, সম্মান পাওয়ার কথা দূরে থাকে– সে খেয়ালি পোলাও খেতে যাবেন না।
সাদাসিধে কাপড়-জামা-পরা ওস্তাদ আলাউদ্দিন সাহেব যখন শান্ত মুখচ্ছবি নিয়ে রাষ্ট্রপতির সামনে দাঁড়ালেন, আর তিনি সহাস্যবদনে ওস্তাদের কাঁধে শাল রাখলেন, তখন আমার ইচ্ছে হচ্ছিল, চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে বলি, সাধু, সাধু, সাধু!
সাধু, সাধু বলার রেওয়াজ এখনও এদেশে ফের চালু হয়নি, কিন্তু সে নিয়ে আমার মনে কোনও আক্ষেপ নেই। সভাস্থলে যা করতালি-ধ্বনি উঠল, তার থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, দেশের লোক ভারি খুশি আমাদের অনাদৃত অবহেলিত গুণীরা যে রাজ-সম্মান পেলেন। রাষ্ট্রপতিকে আমি বহু জায়গায় বহু সার্টিফিকেট-সনদ দিতে দেখেছি, কিন্তু এই চারজন ওস্তাদকে সম্মান দেখাবার সময় তার মুখে যে আনন্দ ফুটে উঠেছিল, তার থেকে বোঝা গেল, তিনিও ওস্তাদদের সম্মান দেখাতে পেরে খুশি হয়েছেন। এবং সত্যই তো, শুধু যে ওস্তাদরা সম্মানিত হলেন তাই নয়, এদের সম্মান দেখিয়ে রাষ্ট্রও তো সম্মানিত হল।
***
আলাউদ্দিন সাহেব অতিশয় নিরভিমান ও ধর্মভীরু লোক। তিনি শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু তার মনে কি কোনও তোলপাড় চলছিল না? প্রথম যৌবনে যেদিন তিনি মা সরস্বতাঁকে বরণ করে নিয়েছিলেন, সেদিন কি তিনি আশা করতে পেরেছিলেন যে, এমন দিনও আসবে, যখন তিনি রাষ্ট্রপতির স্বহস্তে সম্মানিত হবেন? আজীবন তো তিনি দেখলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের লাঞ্ছনা অবমাননা। বরঞ্চ তাঁর বাল্যকালে সে সঙ্গীতের অনেকখানি কদর ছিল, তার পর ষাট-সত্তর বৎসর ধরে তিনি তার চোখের সামনে দেখলেন, কত ওস্তাদ না খেয়ে মারা গেলেন, কত মেধাবী তরুণ উৎসাহের অভাবে আপন প্রতিভার বিকাশ করতে পারল না। ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে সর্বস্বান্ত হওয়ার নিদারুণ বেদনা অনেক সাংসারিক লোকই জানেন, কিন্তু এখানে তার চোখের সামনে যা গেল, সে তো তার আপন বিত্ত নয়– যুগ-যুগ সঞ্চিত তাবৎ দেশের সঞ্চিত সঙ্গীত-সম্পদ যে তার চোখের সামনে ভেসে গেল।
না, তা তো নয়। আলাউদ্দীন সাহেবের আজ বড় আনন্দ, ভারতীয় সঙ্গীত আর লোপ পাবে না। রাষ্ট্রের, দেশের, দশের সকলেরই সস্নেহ দৃষ্টি পড়েছে ওস্তাদের ওপর, অর্থাৎ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওপর।
***
ওস্তাদ মুশতাক হুসেন খানও অতিশয় বিনয়ী লোক কিন্তু তিনি অত্যন্ত প্রাণবন্তও বটেন। রাজ-সম্মান পেয়ে তার মুখে দম্ভ ফুটে ওঠেনি, তিনি হলেন উল্লসিত এবং অভিভূত।
তাই তিনি যখন গান গাইতে আরম্ভ করলেন, তখন তাঁর গলা দিয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। আর সে কী গলা– ওঠানো-নামানোর কায়দা! উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম, আকাশ-পাতাল সবদিক থেকে তিনি যেন টেনে এনে নয়া নয়া ধ্বনি নয়া নয়া সুর আপন গলার ভিতর দিয়ে বের করতে লাগলেন। কখনও গম্ভীর উচ্চকণ্ঠে– সে কণ্ঠ নিষ্কম্প প্রদীপশিখার মতো যেন স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পেলুম আর কখনও যেন নিঝরিণীর গতিবেগের মতো, কখনও আবার তার গলা থেকে মারবেলের গুলির মতো গোল গোল তানের সারি পিল পিল করে বেরুতে লাগল।
আর কী উৎসাহ, কী উদ্দীপনা! ঘন ঘন শাকরেদদের দিকে তাকান, ভাবখানা এই, পছন্দ হচ্ছে তো? সমের সময় তবলচির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি, ইশারা মারেন, আদর দেখিয়ে তাম্বুলাওলার কাঁধে কাঁধ রেখে স্বর যাচাই করে নেন, আর মাঝে মাঝে দু হাত দিয়ে কানের ডগা ছুঁয়ে আপন অশরীরী ওস্তাদের সামনে যেন নিজের অপূর্ণতার জন্য ভিক্ষা করছেন।
বহু বাঘা ওস্তাদের মজলিসে শাকরেদদের বিবর্ণমুখে বসে থাকতে দেখেছি। মেহেরবান মুশতাকের সামনে তারা আনন্দে ফেটে পড়ার উপক্রম। শুরুর দিকে তারা তাকাচ্ছিল যেন শ্রীরাধা গোপীজনবল্লভের দিকে তাকাচ্ছেন।
ওস্তাদ মুশতাকের চেয়েও ভালো ওস্তাদের গান আমি শুনেছি, কিন্তু ওরকম প্রাণবন্ত, সচল রঙ্গে রঙ্গে রঙ্গিমা সঙ্গীত আমি পূর্বে কখনও শুনিনি।
***
দাক্ষিণাত্যের আইয়ার ও আয়াঙ্গারকে দেখেই মনে হল, এরা দু জনই অতিশয় ধর্মভীরু সজ্জন। দক্ষিণের ব্রাহ্মণবাড়িতে থাকার সুযোগ আমার জীবনে বহুবার হয়েছে। সঙ্গীতের প্রতি তাদের অনুরাগ গৃহদেবতার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।
বিশ্বাস করবেন না, দক্ষিণের এক আইয়ার ব্রাহ্মণের বাড়িতে সঙ্গীতোৎসবের শেষে পাঁচটি (একটি নয়, দুটি নয়, পাঁচটি) তামিল কন্যাকে আগাগোড়া জনগণমন অধিনায়ক গাইতে শুনলুম। হাতে তাদের গানের বই ছিল না; তবু রাত্রি প্রভাতিল শেষ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত তারা একবার মাত্র না থেমে গড় গড় করে গেয়ে গেল– অবশ্য দক্ষিণি কায়দায়।
শুধাই, এই বাংলা দেশেরই কটি ছেলেমেয়ে তাবৎ জনগণমন অধিনায়ক কণ্ঠস্থ বলতে পারে?
আসল কথায় ফিরে যাই।
দক্ষিণি গুরুরা দুই সম্মান পেলেন। রাজ-সম্মান এবং উত্তর ভারতের সম্মান। উত্তর ভারত দক্ষিণি গানের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়, সেকথা আপনি-আমি বিলক্ষণ জানি, কিন্তু শুরুদের পয়লা সা আর পয়লা পিড়িঙের সঙ্গে সঙ্গেই সভাস্থ তামাম উত্তর ভারত বে-এক্তেয়ার। দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি সঙ্গীত-রসজ্ঞাকে আমি এখানে চিনি। দেখি, তাঁরা চোখ বন্ধ করে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়েছেন। একেবারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য।
কণ্ঠে এবং যন্ত্রে যে এত গোপনবাণী লুকানো আছে, কে জানত? রায় পিথৌরা মূর্খ এবং অরসিক সঙ্গীতের সে কিছুই বোঝে না, তাই সব জিনিসই তার ভালো লাগে। তাই যদি নিবেদন করি, দক্ষিণি সঙ্গীতের তত্ত্ব না বুঝেও যদি তার মর্মে সাড়া জেগে উঠে, তবে কি স্বীকার করবেন না গুরুদেবের সঙ্গীত পশুর প্রাণেও মানবতা জাগাতে পারে। কিন্তু রায় পিথৌরা চুলোয় যাক; দেখি, উত্তর ভারতীয় উন্নাসিকেরাও মুগ্ধ হয়ে দক্ষিণ ভারতের কৃতিত্বকে যেন উদ্বাহু হয়ে অভ্যর্থনা করছেন।
উত্তর-দক্ষিণের এরকম মিলন আমি এর আগে কখনও দেখিনি।
***
আলাউদ্দীন সাহেব আমার দ্যাশের লোক। ভেবেছিলুম তাঁকে কত কথা বলব। গলা ভেঙে গেল, কিছুই বলতে পারলুম না। রবীন্দ্রনাথের নাতনি নন্দিতাও সঙ্গে ছিল। ওস্তাদকে সেলাম করল। ওস্তাদ বললেন, মা, কত দিন পরে দেখা!
ওস্তাদ মুশতাক হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে বেরুচ্ছিলেন তাঁর বন্ধু কাশ্মিরী পণ্ডিত হাকসার। আমি লখনওয়ি কায়দায় ঝুঁকে ঝুঁকে তাকে তিনবার কুর্নিশ করলুম। ওস্তাদ সদয় হাসি হেসে (এবং সবিনয়ে) আমার কুর্নিশ নিলেন দেখে আমার আর সেদিন মাটিতে পা পড়েনি।
***
ততক্ষণে দক্ষিণি গুরুরা চলে গিয়েছেন।
তাদের প্রণাম করতে পারলুম না বলে মনে আক্ষেপ নেই। ভক্তি থাকলে অদৃশ্য প্রণামও যথাস্থানে পৌঁছয়।
***
নিরপেক্ষ পাঠক, এইবার বল তো হিন্দুস্থানে এ-বয়ানে ইংরেজিতে লিখেছি বলে বাঙলায় যদি আনন্দবাজারে না লিখতুম তা হলে তোমার প্রতি অবিচার করা হত না?
.
২৩.
খবর এসেছে নাগপুরে জাপানি ভাষা শেখাবার ব্যবস্থা হয়েছে। অতি উত্তম প্রস্তাব।
ভারতবর্ষ আজব দেশ। কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজের মতো বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানি ভাষা পড়াবার ব্যবস্থা নেই– ওদিকে এদের তুলনায় ক্ষুদ্র নাগপুরে জাপানি পড়াবার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
ঠিক তেমনি আজ যদি আপনি উত্তম চীনা ভাষা শিখতে চান তবে আপনাকে যেতে হয় শান্তিনিকেতন নয়, পুণায়। অন্য জায়গায় বিশেষ কোনও বন্দোবস্ত নেই।
(এই দিল্লি শহরে বহুভাষা শেখাবার কিঞ্চিৎ ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু সেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার নেই।)
নাগপুরে পুণায় জাপানি চীনা শেখাবার বন্দোবস্ত, অথচ বড় বড় শহরে নেই। এ যেন সেই মাকড় সম্বন্ধে পূর্ববঙ্গের ধাঁধা, কোথায় জাল আর কোথায় জেলে–
আট পা আঠারো হাটু,
জাল ফালাইতা গেল ঘাটু।
শুকনায় ফালাইয়া জাল
মাছে উঠি দিলা ফাল!
— কোথায় ভাষা শেখার ব্যবস্থা, আর কোথায় ভাষা-শিখনেওলা!
***
ওদিকে আজ্জম পাশা বলছেন ভারত এবং আরব মুলুক এক হয়ে প্রাচ্যের প্রধান শক্তি তৈরি হবে, এদিকে আমরা ভারতবর্ষে বলছি, আলবৎ, আমরা জগৎকে জীবননীতির তৃতীয় পন্থা বাতলাব ইত্যাদি কতই না বাক্যাড়ম্বর।
যেসব ঐক্যের স্বপ্ন আমরা দেখছি সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভাষা না শিখে কী করে বাস্তবে পরিণত হবে আমায় বুঝিয়ে বলতে পারেন?
লন্ডনে প্রাচ্য এবং আফ্রিকার নানা ভাষা শেখার জন্য বিরাট প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্যারিসেও তাই। জর্মনির ছোট ছোট বিশ্ববিদ্যালয়েও বহুতর ভাষা শেখা যায় (এক সংস্কৃতের জন্যই জর্মনির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচজন সংস্কৃত অধ্যাপক ছিলেন সংস্কৃত শিখত মাত্র একটি ছেলে ও তা-ও এডিশনাল হিসেবে), ইটালিতে প্রাচ্য ভাষা শেখাবার ব্যবস্থা বহু দিনের অথচ এই বিরাট ভূমি ভারতে যেটুকু ব্যবস্থা আর সেকথা নিজেদের ভিতর তুলতেও লজ্জা বোধ করে।
শুনেছি, আমাদের ফরেন আপিসের একদা তিন-চারশ লোকের প্রয়োজন হয়েছিল এবং ভাষা জাননেওলা উপযুক্ত ব্যক্তি পাওয়া গিয়েছিল মাত্র আট না দশজন!
তবুও ভাষা শেখাবার কোনও ব্যাপক ব্যবস্থা কোথাও হচ্ছে না।
মাদ্রাসাগুলো মরে যাচ্ছে– আরবি-ফারসির চর্চা কমে আসছে।
আর সংস্কৃত তো ডেড ল্যানগুইজ। তাই টোলগুলো মরুক– আপত্তি নেই!!
কী দেশ!
***
দিল্লির বিখ্যাত সাধু নিজামউদ্দিন আওলিয়ার প্রখ্যাত সখা এবং শিষ্য কবি আমির খুসরৌর জন্মোৎসব কয়েক দিন হল আরম্ভ হয়েছে। আমির খুসরৌর কবর নিজামউদ্দিনের দরগার ভিতরেই এবং সে দরগা হুমায়ুনের কবরের ঠিক সামনেই। (এ দর্গায় আরও বহু বিখ্যাত ব্যক্তির কবর আছে।)।
খুসরৌর পিতা ইরানের বল্খ (সংস্কৃত বহিকম– ভারতীয় কোনও কোনও নৃপতি বখ পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করেছিলেন বলে কিংবদন্তি আছে) থেকে ভারতবর্ষে আসেন। পুত্র খুসরৌ কবিরূপে দিল্লির বাদশাহদের কাছে প্রচুর সম্মান পান।
ফারসি তখন বহু দেশের রাষ্ট্রভাষা। উত্তর ভারতবর্ষ (ফারসি এদেশের ভাষা নয়) আফগানিস্তান (সে দেশেরও দেশজ ভাষা পুশতু) তুর্কিস্থান (তারও ভাষা চুগতাই) এবং খাস ইরানে তখন ফারসির জয়-জয়কার। এমনকি বাঙলা দেশের এক স্বাধীন নৃপতি কবি হাফিজকে বাঙলা দেশে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
খুসরৌ ফারসিতে অত্যুত্তম কাব্য সৃষ্টি করে গিয়েছেন। ভারতের বাইরে বিশেষ করে কাবুল-কান্দাহার এবং সমরকন্দ-বোখারা খুসরৌকে এখনও মাথার মণি করে রেখেছে।
আলাউদ্দিন খিলজি, তার ছেলে খিজর খান, বাদশা গিয়াসউদ্দিন তুগলুক, তার ছেলে বাদশা মুহম্মদ তুগলুক (ইংরেজ ঐতিহাসিকদের পাগলা রাজা)। এঁরা সবাই খুসরৌকে খিলাত-ইনাম দিয়ে বিস্তর সম্মান দেখিয়েছেন।
গুজরাতের রাজা কর্ণের মেয়ে যখন দিল্লি এলেন তখন তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রাজকুমার খিজর খান তাঁকে বিয়ে করেন। ইংরেজের মুখে শুনেছি, বিয়ে নাকি প্রেমের গোরস্তান, অর্থাৎ বিয়ে হওয়ার পরই নাকি সর্বপ্রকারের রোমান হাওয়া হয়ে যায়। এখানে হল ঠিক তার উল্টো। এঁদের ভিতর যে প্রেম হল সে প্রেম পাঠান-মোগল হারেমের গতানুগতিক বস্তু নয়– তাই অনুপ্রাণিত হয়ে খুসরৌ তাঁদের প্রেমকাহিনী কাব্যে অজর অমর করে দিলেন। সেই কাব্যের নাম ইশকিয়া- বাঙলা ভ্রমণের সময় সম্রাট আকবর সেই কাব্য শুনে বারম্বার প্রশংসা করেছিলেন। কর্ণের মেয়ের নাম দেবলা দেবী। শুনেছি, বাঙলায় নাকি দেবলা দেবী নাটক বহুবার অভিনীত হয়েছে।
গিয়াসউদ্দিন তুগলুক নিজামউদ্দিনকে দু চোখে দেখতে পারতেন না। সে কাহিনী দৃষ্টিপাতে সালঙ্কার বর্ণিত হয়েছে দিল্লি দূর অস্ত! কিন্তু গিয়াস নিজামের মিত্র খুসরৌকে রাজসম্মান দিয়েছিলেন। খুসরৌ বড় বিপদে পড়েছিলেন– একদিকে সখার ওপর বাদশাহি জুলুম, অন্যদিকে তিনি পাচ্ছেন রাজসম্মান।
মুহম্মদ তুগলুক রাজা হওয়ার পর তাবৎ মুশকিল আসান হয়ে গেল। ঠিক মনে নেই (পোড়ার শহর দিল্লি একখানা বই পাইনে যে অর্ধবিস্মৃত সামান্য জ্ঞানটুকু ঝালিয়ে নেব), বোধ হয় খুসরৌ বাদশা মুহম্মদের লাইব্রেরিয়ান ছিলেন।
সে এক অপূর্ব যুগ গেছে। সাধক নিজামউদ্দিন, সুপণ্ডিত বাদশা মুহম্মদ তুগলুক, ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরণী এবং সভাকবি আমির খুসরৌ।
প্রথম দেহত্যাগ করলেন শেখ-উল-মশাইথ নিজামউদ্দিন আওলিয়া, তার পর তার প্রিয়সখা আমির খুসরৌ, তার পর বাদশা মুহম্মদ শাহ তুগলুক এবং সর্বশেষে জিয়া বরণী।
ইংরেজ আমাদের কত ভুল শিখিয়েছে। তার-ই একটা– এসব গুণীরা ফারসিতে লিখতেন বলে এরা এদেশকে ভালোবাসতেন না। বটে? সরোজিনী নাইড় ইংরেজিতে লিখতেন, তাই তিনি ভারতবর্ষকে ভালোবাসতেন না!
খুসরৌ মাতৃভূমি ভারতবর্ষকে ভালোবাসতেন এবং সে ভূমির অশেষ গুণকীর্তন করে গিয়েছেন।
এবং দূরদৃষ্টি ছিল বলে তিনি যেটুকু দেশজ হিন্দি জানতেন (হিন্দিরও তখন শৈশবাবস্থা) তাই দিয়ে হিন্দিতে কবিতা লিখে গিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, ফারসি এবং হিন্দি মিলিয়ে তিনি উর্দুর গোড়াপত্তন করে গিয়েছেন জানতেন একদিন সে ভাষা রূপ নেবেই নেবে।
আবার বিপদে পড়লুম; হাতের কাছে বই নেই তাই চেক-আপ করতে পারছিনে– পণ্ডিত পাঠক অপরাধ নেবেন না– যেটুকু মনে আছে নিবেদন করছি–
হিন্দু বাচ্চেরা ব নিগর আজব হসন্ ধরত হৈ
দর ওকতে সুখ জদন মুহ ফুল ঝরত হৈ
গুম কে বি আর আজ লবেৎ বোসে বিগরিম–
গুফৎ আরে রাম! ধরম নষ্ট করত হৈ!
*
হিন্দু বাচ্চা কী অপূর্ব সৌন্দর্যই না ধারণ করে,
কথা বলার সময় মুখ থেকে যেন ফুল ঝরে।
বললুম, আয়, তোর ঠোঁটে চুমো খাব–
বললে, আরে রাম! ধর্ম নষ্ট করত হৈ!
Leave a Reply