বিচিত্রা
মধুহীন করিনি তো মোরা মনঃ কোকনদে
রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে পাঁচজনের সামনে কিছু বলতে গেলে আমি দিশেহারা হয়ে যাই। সমস্যা তখন : কোনটা ছাড়ি, কোনটা বলি? প্রবাদে কয়, বাঁশবনে ডোম কানা। যে বাঁশটা দেখে, আহাম্মুখ ডোম সেইটেই কাটতে চায়। আখেরে আকছারই যা হয়, তাই ঘটে। একটা নিরেস বাঁশ কেটে বাড়ি ফেরে! রবীন্দ্রনাথের বেলা তবু খানিকটে বাঁচাও আছে, যে বাঁশই পেশ করিনে কেন, কেউ না কেউ সেটা পড়েছেন। তিনি বুড়া রাজা প্রতাপ রায়ের মতো আহাহা বাহাবাহা রবে সাধু! সাধু! রব ছাড়বেন।
মাইকেল শ্রীমধুসূদনকে নিয়ে সংকট উত্তটতর। আজ কেন, পঞ্চাশ বৎসর পূর্বেই মাইকেল-কাব্য-নাট্য-পত্রাবলি বাবদে ওয়াকিফহাল ছিলেন অঙ্কুজনই, যারা মাইকেল নির্মিত মধুচক্র থেকে গৌড়জন যারা আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি রসাস্বাদ করতেন। পঞ্চাশ বছর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বাঙলা ক্লাস নেবার সময় কেউ যদি বলাকার কোনও অপেক্ষাকৃত বিরল শব্দের অর্থ বলতে না পারত তিনি তখন হরহামেশা শাসাতেন, দাঁড়া! তোদের তা হলে “মেঘনাদ” পড়াব, তখন বুঝবি কঠিন শব্দ কাকে বলে? আমরা আতঙ্কে কুঁকড়ি সুকড়ি মেরে যেতুম।… আর আজ!! তবে একটি আশার বাণী আছে। বছর তিরিশেক পূর্বে মডার্ন কবিরা যখন বাঙলা শব্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আরম্ভ করলেন তখন একাধিক জন সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন যে অনাদৃত শ্রীমধু শতাধিক বৎসর পূর্বে ওই কর্মটি করেছিলেন তাঁর সর্বপ্রতিভা নিয়োগ করে অসীম উৎসাহে। এবং বিশেষ করে শ্রীমধু উল্লাসবোধ করতেন, আলঙ্কারিক অর্থাৎ যারা কাব্যরস কী, সে রসের উত্তম-অধম বিচার, উত্তম রসসৃষ্টির সময় কোন কোন বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি এদের সেসব আইন লঙ্ঘন করতে পারলে।
মাইকেলের আমলে ঈশ্বরচন্দ্র বিধবা-বিবাহের জাতশত্রু জনৈক মহেশচন্দ্রকে অপদস্থ করার জন্য প্রতি সপ্তাহে একটি বুলেটিন প্রকাশ করতেন। ব্যঙ্গ, পি, কটুবাক্য সর্বঅস্ত্র ঈশ্বরচন্দ্র এস্তেমাল তো করতেনই, মাঝে মধ্যে অশ্লীলতার গা যে ছুঁয়ে যেতেন না সেকথাও বলা যায় না। ওই সময় গোড়ার দল মহেশকে কবিরত্ব উপাধি দেয়। ঈশ্বর প্রতিবাদ করে লিখলেন, না, তাকে দেওয়া হয়েছে “কপি-রত্ন” খেতাব। তার পর ঈশ্বর স্মৃতি, ন্যায়শাস্ত্রাদি থেকে তাঁর কপি-রত্ন সপ্রমাণ করার পর নিলেন অলঙ্কার। লিখলেন, সর্ব আলঙ্কারিক এক বাক্যে বলেন, ব অক্ষরটি কর্কশ, প অক্ষরটি মোলায়েম। উপাধি দেবার বেলা অবশ্যই মোলায়েম অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। অতএব কপিরত্ন। কাকতালীয় কি না, বলা সুকঠিন, কারণ শ্রীমধু ইতোপূর্বে অলঙ্কার শাস্ত্র গুলে খেয়ে পেটতল করে তৈরি ছিলেন। মনে মনে বললেন, বইট্টে! “ব” বুঝি কর্কশ। আমি নাগাড়ে “ব” এস্তেমাল করব। সামলাও দেখি ঠ্যালাডা।” সীতা-সরমায় সদম্ভে লিখলেন,
শুনিয়াছি বীণাধ্বনি দাসী
পিকবর-রব নব পল্লব মাঝারে—
পরপর চারটে শব্দে চারটে ব-এর অনুপ্রাস! এ অধম বহু বৎসর ধরে ত্রিযামা যামিনী যাপন করেছে অলঙ্কার অধ্যয়নে। সে চিল্কারিল উচ্চৈঃস্বরে,
ভো ভো গৌড়জন
সবে। কী মধু নিমিল মধু অবহেলে
বারম্বার ব অক্ষর বিভাসিয়া। বলো
কবে কবি কেবা, বর্ণিল বরদা বরে
বঙ্গভূমে পিকবর-রব নব?
(ব এবং ভ অনুপ্রাস সমধ্বনিসূচক)
এ তো অতি সামান্য একটি উদাহরণ মাত্র। শ্রীমধুর কাব্য-নাট্যাদি যেকোনো সৃষ্টিকর্মের যেখানে খুশি হাত দাও, পাবে তার সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টি, পূর্বসূরিদের স্মরণান্তে (নমি আমি কবিগুরু… বাল্মীকি/হে ভারতের শিরচূড়ামণি, কৃত্তিবাস কবি, এ বঙ্গের অলঙ্কার) তাঁদের ছাড়িয়ে যাবার সফল প্রচেষ্টা, অলঙ্কার নন্দনশাস্ত্র তুড়ি মেরে, সম্পূর্ণ বিপরীত পদ্ধতিতে নব নব সংকটের পথে নব নব অভিযানে নিষ্ক্রমণ, সৃষ্টির পর সৃষ্টি, অভূতপূর্ব সৃজন, যার থেকে অনাগত যুগের নবীন আলঙ্কারিক অভিনব নব নব সূত্র নির্মাণ করে গোড়াপত্তন করবেন নবীন নন্দনশাস্ত্রের সর্বোপরি বঙ্গভাষার প্রতি তাঁর ঐকান্তিক অনুরাগ, বঙ্গসাহিত্যের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তাঁর অচল অটল বিশ্বাস, সে ভবিষ্যৎকে সফল করার জন্যে তাঁর সর্বব্যাপী প্রত্যাশা– এমনকি, কোনও সার্থক মুসলমান কবি কারবালা নিয়ে একদিন রচনা করবেন অনবদ্য সমুজ্জ্বল (magnificient) এপিক* এবং এসব আশা-আকাঙ্ক্ষায় শত্রুদের বিরুদ্ধে তাঁর অক্লান্ত বিদ্রোহ, দুর্বার সংগ্রাম।
[*“মেঘনাধ রচনার সময় শ্রীমধু সুপণ্ডিত রাজনারায়ণ বসুকে লিখছেন, I must tell you, my dear fellow, that though, as a jolly Christian youth, I dont care a pins head for Hinduism, I love the grand mythology of ancestors. It is full of poetry. A fellow with an inventive head can manufacture the most beautiful things out of it. (…..) What a vast field does our country now present for literary enterprise! I wish to God, I had time. Poetry, Drama, Criticism. Romance a man would bare a name behind him, above all Greek, above all Roman fame. শুধু হিন্দু পুরাণাদিই না। অন্যত্র শ্রীমধু লিখছেন, “We have just got over the noise of Mohurrum. I tell you what, if a great Poet were to rise among the Mussulmans of India, he could write a mangnificient Epic on the death of Hossain and his brother. He could enlist the feelings of the whole race on his behalf. We have no such Suject. (অর্থাৎ হিন্দু পুরাণাদিতে নেই। ড. মনিরুজ্জামান, নাট্যগ্রন্থাবলি, পৃ. ৭৯৩, ৮১৬।]
আশ্চর্য! মাইকেল খ্রিস্টান। তিনি বাঙলা ভাষার বৈরীদের সঙ্গে করলেন আমৃত্যু সংগ্রাম। তিনি আহরণ করতেন অসংখ্য রতনরাজি বহুতর ভাষা থেকে কিন্তু কি ইংরেজি, কি সংস্কৃত তাঁর মাতৃভাষা বাঙলার আসন দখল করে সেটা তিনি এক লহমার তরে বরদাস্ত করতে পারতেন না। তার তিনশত বৎসর পূর্বে আরেক অহিন্দু-মুসলমান, তারই মতো বাঙাল সৈয়দ সুলতান বহুবিচিত্র সম্পদ আহরণ করতেন আরবি-ফারসি থেকে, কিন্তু তাঁর সাধনার ধন বাঙলাকে যারা স্থানচ্যুত করতে চায় তাদের স্মরণে এনে দিচ্ছেন অপূর্ব সুভাষিত,
যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন।
সে-ই তার মাতৃভাষা, অমূল্য সে ধন ॥
অথচ শ্রীমধু স্কুলে পাঠ্যাবস্থায় স্বপ্ন দেখতেন ইংলন্ডের। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার হাতের কাছে অল-ওস্তাদ ড. মনিরুজ্জামান সাহেব কর্তৃক সম্পাদিত মধুসূদনের নাট্যগ্রন্থাবলিখানি আছে মাত্র। অর্থাৎ ব্রজাঙ্গনা, মেঘনাদ, গয়রহ একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ নেই। অতএব তাবৎকাব্য-উদ্ধৃতি আমার জরাজীর্ণ স্মৃতিদৌর্বল্যের ওপর নির্ভ করে এস্থলে লিখতে হচ্ছে–মায় সুলতানের সুভাষিত।
বিলেতের স্বপ্নে বিভোর শ্রীমধু তখন আকুল হৃদয়ে ইংরেজিতে কবিতা লিখছেন (বয়স চোদ্দ/পনেরো, পৃথিবী, না প্রথিবী কোনটা শুদ্ধ জানেন না; পরবর্তীকালে নিজেই বলছেন সে সময় কেউ শিব না লিখে যীব লিখলে সেটাকে তিনি উদ্ভট মনে করতেন না)
I sing for the distant Albion shore
Its valley green its mountains high,
Though friends none reliations have I nor
In that far clime, yet oh! I sigh
To cross the vast Atlantic wave,
For glory or a nameless grave!
(উদ্ধৃতি নিশ্চয়ই ভুল আছে)
অনেক বৎসর পরে কবিগুরু রবির অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এর অনুবাদ করেন :
দূর শ্বেতদ্বীপ তরে পড়ে মোর
আকুল নিঃশ্বাস,
যেথা শ্যামা উপত্যকা, উঠে গিরি
ভেদিয়া আকাশ।
নাহি সেখা আত্মজন, তবু লঙ্ঘি গ
অপার জলধি,
সাধ যায় লভিবারে যশ, কিংবা
অ-নামা সমাধি ॥
গিয়েছিলেন মধু। গিয়েছিলেন বলেই বিদেশি ভাষার প্রতি সমসাময়িক সর্বজনীন চিত্ত-দৌর্বল্যজনিত মোহ থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন অতি সত্বর। বিদেশের প্রতি তাঁর কুহেলিকাচ্ছন্ন চক্ষুঃজ্যোতিও নিরাবিল হয়ে যায় যুগপৎ।
বস্তৃত কলকাতায় ফিরে এসেও মধু সেই পরবাসীই থেকে গেলেন। শ্রীমধু চিরকালই খাঁটি যশোরে বাঙাল। কলকাতার ঘটি-রাজরা যখন তাকে তার সরস তথা দার্টগুণসম্পন্ন, সরল অপিচ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভব প্রকাশে পটিয়ান, মধুর অপরঞ্চ গুরুগম্ভীর, অকৃত্রিম বিদগ্ধ বঙ্গভাষার সর্বাধিকারাধার প্রতিভূরূপে নতমস্তকে স্বীকার করে নিয়েছেন তখন অকস্মাৎ নয়া এক ভেল্কিবাজি দেখিয়েছিলেন যশোরের খাঁটি বাঙাল। পশ্চিমবঙ্গের অকৃত্রিম ঘটির ভাষা পেরিয়ে মধু ছাড়লেন বাঙাল ভাষার রঙ বেরঙের আতশবাজি।
শ্রীমধু মাতৃভূমি সাগরদাড়ি ছাড়েন বাল্যে। কিন্তু এ কী তিলিস্মাৎ, কী অলৌকিক কাণ্ড! শুধু যে যশোরের হিন্দু ভদ্রলোকের ভাষা (ভক্তপ্রসাদের ভাষা) স্মরণে রেখেছেন তাই নয়, হিন্দু চাকরের ভাষা (রাম), বামুন পণ্ডিতের সংস্কৃতে ভেজা সপসপে ভাষা (বাচস্পতি), মুসলমান চাষার ভাষা (হানিফ), তার বউয়ের ভাষা (ফতেমার ভাষাতে বিদেশি-শব্দ হানিফের তুলনায় কম)- কে কতখানি সংস্কৃতে ভরা ভাষায় কথা বলবে, কে কোন পরিমাণে আরবি-ফারসি এস্তেমাল করবে তার ওজন করে শ্রীমধু চালাচ্ছেন একসঙ্গে গোটা পাঁচ-ছয় মূলত যশোরি ভাষার ভিন্ন ভিন্ন আড় বা ঢং যাদুকর যেরকম ছ টা বল নিয়ে খনে এক হাতে খনে দু হাতে নাচায়। এমনকি সদ্য কলকেতা ফেৰ্তা কলেজের ছোকরাকেও দিব্য চেনা যাচ্ছে। বলছে, এমন ক্লেবর ছোকরা দুটি নেই। ওদিকে ভক্তপ্ৰসাদ জমিদারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে বরঞ্চ যাবনিক শব্দ দিব্য চেনেন। তাই ক্লেভার শব্দের দু দুটি প্রতিশব্দ সুচতুর মেধাবীও তার পছন্দ হল না। বললেন, “জহীন” কিংবা “চালাক” বললে বুঝতে পারি।- আজ আর জহীন শব্দ কোনও বাঙলার লোকই বোঝে না। আরবি জেহন দু একখানা কোষে পাওয়া যায়। বলা নিতান্তই বাহুল্য চালাক ফারসি।
একাধিক লেখক ইয়োরোপীয় সাহিত্যে একাধিক ভাষা নিয়ে কারচুপি দেখিয়েছেন কিন্তু শ্রীমধুর ন্যায় এরকম ভেল্কিবাজি, কেউই দেখাতে পারেননি।
কলকাতার বুকের উপর বসে তিনি নির্ভয়ে বাংলা দেশের বাঙাল ভাষার ভিন্ন ভিন্ন রূপ শুধু যে পাক্তেয় করে তুললেন তাই নয়, তারা সেদিন যেসব উচ্চাসনে বসেছিল সেসব আসন নিয়ে খাস কলকেত্তাই বা অন্য কোনও আঞ্চলিক ভাষা-উপভাষা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি।
যদ্যপি শান্তিনিকেতনের গীতিরস-পরিবেশে আমার কৈশোর কেটেছে, তবু শ্রীমধু আমার বড়ই প্রিয় কবি। তাই এতখানি লেখার পরও দেখি কই, কিছুই তো বলা হল না? মনস্তাপ রয়ে গেল।
সেটা হালকা করার জন্য অবনী ঠাকুরের অনুকরণে গান জুড়ি
শ্রীমধুরে ঠ্যাকায় কেডা
খুনে যশোর কইলকেতা!
বেতার বাংলা, জুন ১৯৭৩
.
অশ্রুসিক্ত সিন্ধুবারি
এই ক্ষুদ্র রচনাটির অবতরণিকাতেই আমার একটি সামান্য কৈফিয়ত নিবেদন করার আছে। যদিও বহু বৎসর ধরে আমার লেখা কেউ বড় একটা পড়ে না, তবুও বেতার বাংলার সম্পাদকমণ্ডলীতে দু একজন নিতান্তই অকালবৃদ্ধ সজ্জন, তথা তাদের বড় কর্তা আমার প্রতি নিতান্ত অকারণ সদয়। বেতার বাংলাই স্বাধীনতার পর এই অনারারি পেনশনপ্রাপ্ত অস্তমিত লেখকের কাছ থেকে সসম্মানে দাক্ষিণ্যসহ একটি রচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমারও স্পর্ধা বেড়ে গেল। জীবনে যা কখনও করিনি, সেই নিবেদন জানালুম; আসছে শ্রাবণের ১০ তারিখ (২৯ জুলাই) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুদিবস। তার সম্বন্ধে সামান্য কিছু নিবেদন করতে চাই। তারা সম্মত হয়েছেন।
নিঃসঙ্কোচে বলব, চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর হিন্দু সমাজের ইনিই সর্বোত্তম মহাপুরুষ। রবীন্দ্রনাথ যেসব মহাত্মাদের জীবনী লিখেছেন তার মধ্যে সর্বাধিক বিস্তীর্ণ স্থান দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্রকে। তিনি বলেছেন, বিদ্যাসাগর নিজের চরিত্রকে মনুষ্যত্বের আদর্শরূপে। প্রস্ফুট করিয়া যে এক অসামান্য অনন্যতন্ত্রত্ব প্রকাশ করিয়াছেন তাহা বাংলার ইতিহাসে অতিশয় বিরল; এত বিরল যে, এক শতাব্দীর মধ্যে কেবল আর দুই-একজনের নাম মনে পড়ে এবং তাহাদের মধ্যে রামমোহন রায় সর্বশ্রেষ্ঠ।
আমার সবিনয় নিবেদন, আমি গুরুর সঙ্গে একমত নই। অবশ্য আর দুই একজন বলতে গিয়ে গুরু যদি ঈশ্বরচন্দ্রকে বাদ দিয়ে রামমোহনকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে থাকেন তা হলে সে অভিমত সম্বন্ধে আমার কোনও বক্তব্য নেই।
গত দুই শতাব্দীতে যেসব মহাপুরুষ বঙ্গদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন রামমোহন থেকে বিবেকানন্দ– তাঁরা সকলেই হিন্দুধর্মের মূর্তমান প্রতীক। ঈশ্বরচন্দ্র তা নন। হিন্দুশাস্ত্রে ঈশ্বরচন্দ্রের জ্ঞান গত আড়াই শতাব্দীর কারও চাইতে কণামাত্র কম ছিল না। বরঞ্চ হিন্দুশাস্ত্রে আমার যে নগণ্য যৎসামান্য জ্ঞান আছে তার পথপ্রদর্শক ঈশ্বরচন্দ্র। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, শাস্ত্রাধ্যয়ন-লব্ধ পাণ্ডিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র অতুলনীয়। বঙ্গদেশ বাদ দিন, সব ভারতের হিন্দু শাস্ত্রাধ্যয়নের কেন্দ্রভূমি কাশীর শাস্ত্রীরা তাঁকে সমীহ করে চলতেন; ঈশ্বর যখন বিধবা-বিবাহ হিন্দুশাস্ত্রসম্মত বলে বিধান দিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন, কাশীর শাস্ত্রীরা মল্লভূমিতে নামতে সাহস পাননি।
অথচ, পাঠক বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন ঈশ্বরচন্দ্র শাস্ত্র মানতেন না। তার ঋজু, সত্যশীল, দৈনন্দিন আচার-আচরণ সর্বধর্ম, বিশ্ব ধর্মসম্মত ছিল হিন্দু শাস্ত্রের বিধান তিনি সর্বজন সমক্ষে পুনঃ পুনঃ লঙ্ঘন করেছেন– অথচ সে যুগের হিন্দু সমাজপতিরা হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞ বিধবা-বিবাহ বিরোধী সমাজপতিগণ তাঁকে সমাজচ্যুত করার দুরাশা স্বপ্নেও স্থান দেবার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারেননি। তিনি তাঁর অন্নত্রে ভোজনকারিণী মুচি হাড়ি ডোম প্রভৃতি অপকৃষ্ট ও অস্পৃশ্য স্ত্রীলোকদের মাথায় তৈলাভাবে বিরূপ কেশগুলিতে স্বহস্তে তৈল মাখাইয়া দিতেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখছেন বর্ধমান-বাস-কালে তিনি তাহার প্রতিবেশী দরিদ্র মুসলমানগণকে আত্মীয়-নির্বিশেষে যত্ন করিয়াছিলেন। এস্থলে রবীন্দ্রনাথ ভাবোচ্ছাসে আত্মহারা হয়ে আত্মীয়-নির্বিশেষে বাক্য প্রয়োগ করেননি করেছেন সজ্ঞানে সসম্মানে শব্দার্থে। বঙ্কিমচন্দ্র বিধবা-বিবাহ বিরোধী ছিলেন। তার এক উপন্যাসে তিনি ওই নিয়ে কিঞ্চিৎ কৌতুক করেছেন। অথচ ঠিক ওই সময়ই বঙ্কিমের অগ্রজ সদানন্দ, সাম্প্রদায়িক হীনমন্যতামুক্ত সঞ্জীবচন্দ্র অনুজ বঙ্কিমকে নিয়ে বর্ধমানে ঈশ্বর সকাশে উপস্থিত হয়ে কুশলাদির পর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ভোজনেচ্ছু হন। ঈশ্বরচন্দ্র মোগলাই পদ্ধতিতে উত্তম মাংসরন্ধনে সুপটু ছিলেন। সঞ্জীব আহারের সময় বিদ্যাসাগরের রন্ধননৈপুণ্যের প্রশংসা করে বলেন, তিনি যে বহুগুণধারী, সে তথ্য সঞ্জীব জানতেন, কিন্তু রন্ধনেও যে তিনি সুপটু সে তত্ত্ব তাকে বিস্মিত করেছে। বার্ধক্যে স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত ছলনাময়ী। তারই ওপর নির্ভ করে সঠিক বলতে পারছি না, বিদ্যাসাগর কিন্তু আপনার ভায়া তো ভাবেন, আমি– বলার পর মূর্খ না ঠিক ঠিক কোন বিশেষণটি প্রয়োগ করেছিলেন। এর কিছুদিন পূর্বে বঙ্কিম ঈশ্বরচন্দ্রকে যে পত্র লেখেন তার সারমর্ম এই যে, আপনি শাস্ত্র-দ্বারা কেন প্রমাণ করতে গেলেন, বিধবা-বিবাহ প্রবর্তন করা উচিত! ঈশ্বরচন্দ্র আত্মম্ভরী বা স্ত্রী ছিলেন না, কিন্তু তিনি আত্মদ্রষ্টা ছিলেন, তাই বিলক্ষণ অবগত ছিলেন, বঙ্কিম প্রভৃতি নব হিন্দুধর্মের প্রবর্তকগণ কি ব্যক্তিগত জীবন যাপন পদ্ধতিতে, কি শাস্ত্রজ্ঞানে, কি প্রকৃত ধর্মতত্ত্বানুশীলনে তাঁর বহু বহু পশ্চাতে। ঈশ্বরচন্দ্র সে পত্রের উত্তর দিয়ে বঙ্কিমকে অহেতুক সম্মান দেখাবার প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু এর প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পর ঈশ্বর ও বঙ্কিম উভয়ই যখন পরলোকে তখন রবীন্দ্রনাথ মল্লভূমিতে অবতীর্ণ হয়ে লিখেছিলেন, “অনেকে বলেন, তিনি (ঈশ্বরচন্দ্র) শাস্ত্র দিয়েই শাস্ত্রকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু শাস্ত্র উপলক্ষ মাত্র ছিল; তিনি অন্যায়ের বেদনায় যে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সে তো শাস্ত্রবচনের প্রভাব নয়। এ যে কী মোক্ষম সত্য আমার গুরু আপ্তবাক্যপ্রায় বলেছেন, সে আমার অক্ষম লেখনী কী করে প্রকাশ করবে! প্রকৃত গুণী, মোহমুক্ত সত্যদ্রষ্টাই শাস্ত্রের এই জটিল তর্কজাল ছিন্ন করে মানুষকে ইঙ্গিত দেন, শেষ সত্যের উত্সস্থল কোথায়? কবি বলছেন, তিনি (ঈশ্বরচন্দ্র) তাঁর করুণার ঔদার্যে মানুষকে মানুষরূপে অনুভব করতে পেরেছিলেন, তাকে কেবল শাস্ত্রবচনের বাহকরূপে দেখেননি। শাস্ত্র মানুষকে সত্যের দিকে পথনির্দেশ করে, হয়তো-বা অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে উপদেশ দেয়, কিন্তু শাস্ত্র কবে কোন মানুষের পাষাণ-হৃদয়কে করুণা ধারায় প্লাবিত করতে পেরেছে?
***
এতক্ষণ অবধি যারা আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন তারা হয়তো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। শাস্ত্র, তা-ও হিন্দুশাস্ত্র, সে-ও গত শতাব্দীর পুরনো এক সমস্যা নিয়ে এত কচকচানি শুনে কীই-বা এমন চরম মাক্ষ লাভ হবে? কিচ্ছুটি না। তবে শুধু স্মরণে এনে দিতে চাই, মাত্র দুটি বত্সর আগে স্বৈরাচারী নরঘাতক সম্প্রদায় আমাদের মুসলিম শাস্ত্র নিয়ে পেশাওয়ার থেকে সিলেট অবধি কী প্রতারণাই না করেছিল। আমাদের জনপ্রিয় নেতা, মুক্তি ফৌজের আত্মোৎসর্গ, জনপদবাসীর বিদ্রোহ এর সবই নাকি ছিল ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ! আমরা ইংরেজি পঞ্জিকার ওপর নির্ভর করে দিবারাত্রির নামকরণ করাতে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে এখনও বলি ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার রাত্রি এগারোটার সময় অভূতপূর্ব তাণ্ডবনৃত্য আরম্ভ হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম পঞ্জিকানুযায়ী বৃহস্পতিবারের সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হয়েছিল পবিত্র জুম্মাবার, শুক্রবারের রাত্রি। তার পর এল শুক্রবারের দিন। আল্লাতালার আদেশ :
ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানু, ইজা নুদিয়া লিস্সলাতি মিনি-ইয়োমিল জুমুয়া (তি), ফাস্ আও ইলা জিরিপ্লাহ (ই)
হে ইমানদারগণ, যখন জুমার (সম্মিলন দিবসের) নমাজের জন্য তোমাদের প্রতি আহ্বান (আজান) ধ্বনিত হয় তখন আল্লাকে স্মরণ করার জন্য ধাবমান হও।
শব্দার্থে ধাবমান হয়েছিলেন আমার এক বন্ধুর পরহেজগার প্রতিবেশী ২৬ মার্চ জুমার নমাজের দিনে। তিনি জানতেন যে পুরোদিনের তরে কারফু। তাঁর স্ত্রী তাকে বারবার মানা করেছিলেন। বাড়ির সামনের রাস্তা জনশূন্য। অপর ফুটের হাত পাঁচেক ডাইনে মসজিদ। তিনি বিবিকে বললেন, আমি এক দৌড়ে মসজিদে পৌঁছে যাব। রাস্তা যখন প্রায় ক্রস করে ফেলেছেন তখন তীর বেগে এল মিলিটারি গাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে গুলির শব্দ। আরেকটি শহীদ। ইনি অতিশয় উচ্চপর্যায়ের শহীদ। কারণ আল্লার আদেশ অনুযায়ী শব্দে শব্দে ধাবমান হয়েছিলেন তিনি আল্লার নাম জির করতে। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে করে, আল্লার আদেশ পালন করতে যে বাধা দেয় (কারফু জারি করে), যে মানুষের আদেশে আল্লার আদেশ লজ্ঞান করে তাকে খুন করে সে মানুষ শহীদহন্তারূপে কী খেতাব পায়! এবং এই ইয়াহিয়াই ডিসেম্বর মাসে পরাজয় আসন্ন জেনে আপন শিয়া ধর্মকে জলাঞ্জলি দিয়ে সুন্নিদের মসজিদে গেলেন জুম্মার নমাজ পড়তে। সুন্নিদের ভিতর তখন গুঞ্জরণ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে, এই শিয়াটাই যত নষ্টের গোড়া যেন হুজুররা অ্যাদিন ধরে জানতেন না ইয়াহিয়া খান পুরো পাক্কা কিজিল পাশ শিয়া।
বিশ্বধর্মে দীক্ষিত ঈশ্বরচন্দ্র আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি উদাসীন ছিলেন কিন্তু ধর্ম নিয়ে প্রতারণার প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম ঘৃণা। তাই একদা তিক্ত কণ্ঠে তিনি ব্যঙ্গ করেছিলেন,
প্রতারণাসমৰ্থে বিদ্যয়া কিং প্রয়োজন?
প্রতারণাসমৰ্থে বিদ্যমা কিং প্রয়োজন?
পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, দুটি ছত্রই হুবহু একই বানানে লেখা, কিন্তু অর্থে আসমান-জমিন ফারাক, এবং দুই ছত্রে মিলে একই সত্য নির্ধারণ করে।
প্রতারণা-সমর্থ জনে, যে প্রতারণা করতে সমর্থ তার (শাস্ত্র) বিদ্যার কী প্রয়োজন? প্রতারণা দ্বারাই সে সবকিছু গুছিয়ে নেবে। দ্বিতীয় ছত্রে কিন্তু পড়তে হবে প্রতারণা অসমর্থ। এখানে সন্ধি করলে পূর্ব ছত্রের মতোই প্রতারণাসমর্থ রূপ নেয়। অর্থ : প্রতারণা করতে যে জন অসমর্থ কোনও বিদ্যাই তার কোনও কাজে লাগবে না। অর্থাৎ বিদ্যা কোনও অবস্থাতেই কারও কোনও কাজেই লাগে না। কাজ হাসিল হবে প্রতারণা মারফত। বড্ড সিনি-এর মতো তত্ত্বটি প্রকাশ করলেন বিদ্যাসাগর। বিশেষ করে বোধহয় এই কারণে যে তাকে বিদ্যার সাগর উপাধি দেওয়া হয়েছিল। এবং হয়তো-বা ওই সময়েই মাইকেল তার প্রশস্তি আরম্ভ করেন। বিদ্যার সাগর তুমি, বিখ্যাত ভারতে শ্রীমধুর মধুময় ছত্রটি বিদ্যার সাগর দিয়ে আরম্ভ হয়। সর্বশেষে এ তথ্যটিও প্রাতঃস্মরণীয় যে, বহুলোক বহু উপাধি পায় কিন্তু সেগুলো এ রকম টায় টায় খাপ খায় না বলে লোকে উপাধিধারী কাউকে কখনও তার পদবি যেমন বাড়য্যে কখনও কালীকৃষ্ণ কখনও ন্যায়রত্ন বলে উল্লেখ করে। কিন্তু বিদ্যাসাগরকে কখনও বড়য্যে মশাই (যতদূর মনে পড়ে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ দু জনাই বন্দ্যোপাধ্যায়, সংক্ষেপে বাড়য্যে, হয়তোবা রামমোহনও) বা ঈশ্বরচন্দ্র বলে উল্লেখ করেনি। প্রবন্ধ লেখার সময় আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ বলে উল্লেখ করি ভাষার অনুপ্রাস, কবিতার ছন্দ শ্রুতিমাধুর্য বা অর্থগৌরব অনুযায়ী যখন যেরকম মণিকাঞ্চন্ন সংযোগ হয়–হয়তো-বা কিঞ্চিৎ হার্দিক নৈকট্যের ইঙ্গিতসহ। কিন্তু বিদ্যাসাগর নিত্যদিনের চিরন্তন বিদ্যাসাগর। শুনেছি বিধবা-বিবাহ আইন পাস হবার পর ফরেসডাঙ্গার (চন্দননগর) তাঁতিরা কাপড়ের পাড়ে বোনে বেঁচে থাকো বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে তুমি। এবং এ উপাধি যে কত সত্য কত গভীর তার চরম স্বীকৃতি দিয়েছেন সে-যুগের অন্যতম ধর্মগুরু রামকৃষ্ণ পরমহংস। তিনি স্বয়ং এসেছিলেন বিদ্যেসাগরের দর্শন লাভার্থে তার ভবনে। উভয়ের পন্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। রামকৃষ্ণ সাধক, আর বিদ্যাসাগর ছিলেন মোক্ষ, মুক্তি, বৈকুণ্ঠলাভ বা শিবত্ব প্রাপ্তি বাবদে নিরঙ্কুশ উদাসীন। বিদ্যাসাগর অতিশয় সযত্নে রামকৃষ্ণকে সম্মুখের আসনে বসালেন। রামকৃষ্ণ মুগ্ধ নয়নে এক দৃষ্টিতে দীর্ঘকাল তার দিকে
তাকিয়ে শেষটায় ভাবোদ্বেল কণ্ঠে বললেন, এতদিন দেখেছি শুধু খাল বিল ডোবা; এইবারে সত্যই সাগর দর্শন হল। রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর না দয়ার সাগর–শ্রীমধুর মধুর ভাষায় করুণার সিন্ধু তুমি!–বা উভয়ার্থে বলেছিলেন সেটা পরিষ্কার হয়নি; আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস উভয়ার্থে। বলা নিতান্তই অনাবশ্যক যে, রামকৃষ্ণ স্পষ্টভাষী ছিলেন। সে যুগের বহুজন সম্মানিত বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণচরিত্র তথা নব-হিন্দু ধর্মব্যাখ্যান মাসের পর মাস লিখে যাচ্ছেন তখন তিনি প্রায়ই রামকৃষ্ণের সঙ্গে তত্ত্বালোচনা বা যাই হোক, সে সন্ধানে যেতেন তার আশ্রয়স্থলে বিদ্যাসাগর কখনও যাননি। একদিন রামকৃষ্ণ হঠাৎ বঙ্কিমচন্দ্রকে বললেন, আপনার নাম যেরকম বঙ্কিম, আপনি ভিতরেও বাঁকা বটে। সম্পূর্ণ মন্তব্যটি আমার মনে নেই। তবে সেটা যে অতিশয় শ্রুতিমধুর ছিল না তা আমার স্পষ্ট মনে আছে।
বিদ্যেসাগর অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্রকণ্ঠে ব্যত্যয়হীন বিরোধিতা প্রকাশ করতেন বলে তাকে অজ্ঞজন রূঢ়স্বভাবের লোক বলে কখনও কখনও মনে মনে সন্দেহ করেছে। এ স্থলে কবি ভর্তৃহরির দুটি ছত্র তুলে দিলেই বিষয় সরল হবে :
আচারনিষ্ঠ ভণ্ড বলেছে,
ধীরজনে ভীরু, সরলে মূঢ়
প্রিয়ভাষীজনে ধনহীন গোণে,
বীরেরে নির্দয়, তেজীরে রূঢ়।
(সত্যেন দত্তের অনুবাদ)
এই ব্যর্থশক্তি নিরানন্দ জীবনধনদীন যুগে একথা স্মরণে এনে বড় আনন্দ পাই যে বিদ্যাসাগরের মতো রূঢ়তাবর্জিত তেজিজন এদেশে জন্ম নিয়েছিলেন। আমি বিদ্যাসাগরচরিত্র যদি কণামাত্র চিনে থাকি তবে রূঢ়তম কণ্ঠে রূঢ়তার প্রতিবাদ জানিয়ে বলব, তার মতো বিনয়ী লোক ইহসংসারে হয় না।
রামকৃষ্ণের মুগ্ধ মন্তব্যের উত্তরে বিদ্যাসাগর হেসে বলেছিলেন, সাগরেই যখন এসেছেন তখন খানিকটে লোনা জল নিয়ে যান। রামকৃষ্ণ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সুস্পষ্টভাষায় প্রতিবাদ করেছিলেন।
পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বৎসর ধরে দেশে-বিদেশে যখনই আমি কাউকে চোখের জল ফেলতে দেখেছি তখনই আমার মনে জেগেছে প্রথম দিনের প্রশ্নটা, করুণাসাগর লোনা জল বলতে সেদিন কী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন?
তবে কি বলতে চেয়েছিলেন, তার সর্বসত্তাতে আছে শুধু চোখের জল, অশ্রুধারা লোনাজল?
বেতার বাংলা, জুলাই ১৯৭৩
ছবি। পেজ ১৯-২৪
.
বিচিত্র ছলনাজাল
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে বলতে শুনেছি, স্বকর্ণে একাধিকবার, তাঁর মৃত্যুদিন যেন পালন না করা হয়। করতে হয় তো করি যেন তার জন্মদিন।
স্বভাবতই আমাদের সকলের মনে প্রশ্ন জাগবে, কেন?
রবীন্দ্রনাথ তো চার্বাকপন্থি ছিলেন না। চার্বাক বলতেন, দেহ ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ার পর পুনরাগমন কোথায়? এ স্থলে পুনরাগমন সমাসটি পুনর্জন্ম বা শেষ বিচারের দিন, যেকোনো অর্থে নেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ তো এতখানি জড়বাদী ছিলেন না।
বরঞ্চ তিনি বারবার কতবার যে বলেছেন, মৃত্যতে একদিকে আছে পরিসমাপ্তি অন্যদিকে আছে নব-অভ্যুদয়। তার অতিশয় অন্তরঙ্গ সখা ও শিষ্য, কবি সত্যেন্দ্রনাথের তিরোধানে তিনি যেন, যে অমর্ত্যলোকে তার প্রিয় কবি নতুন আনন্দ গান ধরেছেন তার সুর শুনতে পাচ্ছেন :
— সে গানের সুর
লাগিছে আমার কানে অশ্রুসাথে
মিলিত মধুর
প্রভাত আলোকে আজি;
আছে তাহে সমাপ্তের ব্যথা,
আছে তাহে নবতম আরম্ভের
মঙ্গল-বারতা;
আছে তাহে ভৈরবীতে
বিদায়ের বিষণ্ণ মূর্ছনা,
আছে ভৈরবের সুরে
মিলনের আসন্ন অর্চনা।
শুধু কি তাই? যারা এ জীবনে কৃপণ ভাগ্য বশে বিড়ম্বিত হয়েছে, কবি তাদের মৃত্যুতে তাদের জন্য বিরাট একটা অপ্রত্যাশিত বৈভব গৌরব দেখতে পাচ্ছেন। আল্লাহতালা রবীন্দ্রনাথকে তার অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে বহু বিচিত্র অমূল্য সম্পদ দিয়েছিলেন কিন্তু একটি অতি সাধারণ ব্যাপারে তাঁর প্রতি বিমুখ। তাঁর পত্নী, দুই কন্যা, এক পুত্র (অন্য পুত্র রথীন্দ্রনাথ নিঃসন্তান, এক কন্যা মীরা দেবী)- এই চারজন পরপর মারা যান। এঁদের বয়স যথাক্রমে, স্ত্রী উনত্রিশ, কন্যা-তেরো (নিঃসন্তান), পুত্র- এগারো, কন্যা-বত্রিশ (নিঃসন্তান)। এরপরও রবীন্দ্রনাথ রেহাই পাননি। পুত্র রথীন্দ্রনাথ তো নিঃসন্তান–রবীন্দ্রনাথ জানতেন তার পুত্রবধূর কোনও সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অন্য পুত্র এগারো বৎসর বয়সে গত হয়েছে কলেরায়। পুত্রের দিক দিয়ে তার কোনও সন্তান-সন্ততি নেই। আছে কেবল কন্যা মীরার একটি পুত্র ও কন্যা। রবীন্দ্রনাথের আশা ছিল এই মেয়ের দিক দিয়ে তার বংশ রক্ষা হবে। আমাদের হজরতের বেলা যা হয়েছে। ছেলেটির নাম নীতীন্দ্রনাথ, ডাক নাম নীতু। মীরা দেবী দাম্পত্যজীবনে সুখী হতে পারেননি বলে পুত্রকন্যা নিয়ে পিতার কাছে চলে আসেন ১৯১৯/২০-তে। বলা বাহুল্য ২৭ বছর বয়সে কোনও কন্যা যদি চিরতরে পিত্রালয়ে চলে আসে তবে পিতার মনের অবস্থা কী হয়; মীরা দেবীর বিবাহিত জীবনের কঠোর দ্বন্দ্বের অনেকখানি সন্ধান পাঠক পাবেন যোগাযোগ উপন্যাসে। কিন্তু সেখানে কুমুদিনীর পিতার মৃত্যু তার বিবাহের পূর্বেই হয়ে গিয়েছিল বলে, রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে কন্যা মীরার প্রত্যাবর্তন কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, সেটা উপন্যাস থেকে জানবার উপায় নেই। পাছে কেউ ভুল বোঝেন, তাই বলে রাখা ভালো, কুমুদিনীর পিতা এবং মীরা দেবীর পিতা রবীন্দ্রনাথের চরিত্রে বিন্দু-বিসর্গের মিল নেই।
এতদিন এসব বিষয়ে আমি সবিস্তর আলোচনা করাটা যতখানি পারি এড়িয়ে গিয়েছি কারণ মীরাদির স্নেহ আমি বাল্যবয়সে পেয়েছি। তাঁর মেয়ে নন্দিতা, ডাকনাম বুড়ি-কে আমি তার পাঁচ বৎসর বয়স থেকে চিনি। আমার বয়স তখন ষোলো (নীতুর বয়স নয়); পাঁচ বৎসর ধরে নানা মান-অভিমানের ভিতর দিয়ে আমাদের প্রতি সম্পর্ক নিবিড়তর হয়। এর প্রায় ত্রিশ বৎসর পর দিল্লিতে আমরা যখন প্রতিবেশী তখন তো আর কথাই নেই। এর দশ বৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ গত হয়েছেন। বুড়ির সঙ্গে শেষ দেখা হয় বছর-চারেক পূর্বে। বুড়ি নিঃসন্তান বলে কথাবার্তার সময় আমি কাচ্চাবাচ্চাদের প্রসঙ্গ কখনও তুলতুম না। এখন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ, তার স্ত্রী প্রতিমা দেবী, মীরা দেবী, তাঁর সন্তানদ্বয় কেউ আর এ-লোকে নেই; আমার অক্ষম লেখা কারও পীড়ার কারণ হবে না।
এক যে ছিল চাঁদের কোণায়
চরকা-কাটা বুড়ি,
পুরাণে তার বয়স লেখে
সাতশ হাজার কুড়ি।
রবীন্দ্রনাথ ১৯২১-এ যখন এ-কবিতাটি লেখার পরদিন আমাদের পড়ে শোনান, তখন বুড়ি সেখানে উপস্থিত ছিল। পাঁচবছর বয়সের বুড়ি কবিতাটির আর কতখানি বুঝবে। তবে তার দাদা নীতুর বয়স নয়। সে নিশ্চয়ই অনেকখানি বুঝেছিল। মাঝেমধ্যে বুড়িকে বুড়ি বুড়ি বলে ক্ষ্যাপাত বলে ওই কবিতার শেষের দিকে আছে :
বয়সখানার খ্যাতি তবু
রইল জগৎ জুড়ি
পাড়ার লোকে যে দেখে সেই
ডাকে, বুড়ি বুড়ি।
নীতুর মতো সুন্দর প্রিয়দর্শন ছেলে আমি জীবনে কমই দেখেছি। তার বিশেষ বন্ধু ছিল, আমার রুমমেট চাটগাঁয়ের (বোধহয় পাহাড়তলী অঞ্চলের) জিতেন হোড়। নীতু প্রায়ই আমাদের রুমে এসে গালগল্প জমাত। সে ছিল স্বল্পভাষী, আর জিতেন কথা কম বললেও ছিল বাক-চতুর। রবীন্দ্রনাথ তার আপন পুত্র-কন্যাকে কতখানি ভালোবেসেছিলেন সে আমার জানার কথা নয়, কিন্তু নীতুকে তিনি তার সমস্ত হৃদয় উজাড় করে যে কতখানি ভালোবেসেছিলেন তার সাক্ষ্য দেবে সে যুগের দু পাঁচজন যারা এখনও এপারে আছেন।
পাঠকের মনে থাকতে পারে কবির ঠাকুরদা গল্পে নয়নজোড়ের বাবুদের কাহিনী। সে বাবুদের শেষ বংশধর পাড়ার ঠাকুরদা অর্থাভাবে ভৃত্যাভাবে অনেক সময় ঘরের দ্বার বন্ধ করিয়া তিনি নিজের হস্তে অতি পরিপাটি করিয়া ধুতি কেঁচাইতেন এবং চাদর ও জামার অস্তিন বহু যত্নে ও পরিশ্রমে গিলে করিয়া রাখিতেন–।
রবীন্দ্রনাথের ভত্যাভাব ছিল না এবং তার উড়িয়া সেবক বনমালী যে পাঞ্জাবির আস্তিন ও ধুতির কোচা খুব একটা সাধারণভাবে গিলে করত তা নয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নিপুণ হাতের সুচিকুণ গিলে করার পদ্ধতির সঙ্গে সে পাল্লা দিতে পারবে কেন? একদিন নীতু এসেছে আমাদের রুমে। পরনে গিলে করা অতি পরিপাটি সিল্কের ধুতি পাঞ্জাবি, কাঁধে সিঙ্কের উড়ুনি। আমাদের জানাল সে দিনটা তার জন্মদিন। শেষটায় ধরা পড়ল, স্বয়ং দাদামশাই স্বহস্তে কাপড়-জামা গিলে করে তাকে সাজিয়ে দিয়েছেন।
১৯৩১-৩২-এ নীতু জর্মনিতে গেল পড়াশুনো করতে। কয়েক মাসের ভিতরই হল ক্ষয়-রোগ। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর সখা সি এফ এনড্রজ বিলেত থেকে জর্মনি গেলেন তার দেখভাল করতে। অবস্থা খারাপের দিকে খবর পেয়ে মীরা দেবীও গেলেন জর্মনি। ওই সময় বরানগরে রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন কাটাতে এসেছেন প্রশান্ত-রাণী মহলানবিশের সঙ্গে। ৭ অগস্ট (আমি প্রচলিত বইপত্রে সঠিক তারিখ বের করতে পারিনি। নীতু মারা গেল।
রাণী মহলানবিশ লিখছেন, পরদিন রয়টারের টেলিগ্রামে দেখলাম জার্মানিতে নীতুর মৃত্যু হয়েছে। এ খবরটা রবীন্দ্রনাথের কাছে ভাঙা যায় কী প্রকারে?
শেষে স্থির হল খড়দায় কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীকে ফোন করে আনিয়ে আমরা চারজন একসঙ্গে কবির কাছে গেলে কথাটা বলা হবে। প্রতিমাদিরা এলে সবাই মিলে কবির ঘরে গিয়ে বসা হল। রথীন্দ্রনাথকে কবি প্রশ্ন করলেন, “নীতুর খবর পেয়েছিস? সে এখন ভালো আছে, না?” (এর কারণ কবি তার আগের দিন, এনড্রজের কাছ থেকে চিঠি পান– তখনও আর মেল চালু হয়নি– যে, নীতু তখন একটু ভালোর দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে– লেখক) রথীবাবু বললেন, “না, খবর ভালো না।” কবি প্রথমটা ঠিক বুঝতে পারলেন না। (ওই সময় থেকেই কবি কানে একটু খাটো হয়ে গিয়েছিলেন– লেখক)। বললেন, “ভালো? কাল এনড্রজও আমাকে লিখেছেন যে নীতু অনেকটা ভালো আছে। হয়তো কিছুদিন পরেই ওকে দেশে নিয়ে আসতে পারা যাবে।” রথীবাবু এবার চেষ্টা করে গলা চড়িয়ে বললেন, “না, খবর ভালো নয়। আজকের কাগজে বেরিয়েছে।” কবি শুনেই একেবারে স্তব্ধ হয়ে রথীবাবুর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। একটু পরেই শান্তভাবে সহজ গলায় বললেন, “বউমা আজই শান্তিনিকেতনে চলে যান, সেখানে বুড়ি একা রয়েছে।”
এটা যে কত বড় শোক তার জন্যে কোনও মন্তব্য বা টীকার প্রয়োজন হয় না। ওই সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর মেয়ে মীরার জন্য যে দুটি কবিতা লেখেন, তিনি বা মীরাদি তখন কোনও পত্রিকায় সে দুটি প্রকাশ করেননি। প্রকাশিত হয় তিন বৎসর পরে বীথিকা কাব্যগ্রন্থে; তাই অনেকেরই দৃষ্টি এ কবিতা দুটির প্রতি আকৃষ্ট হয়নি।… সকলেই জানেন, ঈশ্বরে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ছিল অতিশয় গভীর। দুর্ভাগিনী কবিতায় স্তম্ভিত হয়ে দেখি, সে বিশ্বাসে চিড় লেগেছে।
–চিরচেনা ছিল চোখে চোখে
অকস্মাৎ মিলালো অপরিচিত লোকে।
তখন দুর্ভাগিনী মাতা যখন সান্ত্বনার জন্য ইষ্টদেবতার সম্মুখীন হল তখন কী পেল সে।
–দেবতা যেখানে ছিল সেথা জ্বালাইতে গেলে ধূপ, সেখানে বিদ্রূপ।
ঈশ্বর-বিশ্বাসীজন এর চেয়ে নির্মম নিষ্ঠুর কী বলতে পারে! ঈশ্বর স্ক্রিপ করেন।
এখানেই কি শেষ? প্রায় তাই। কিন্তু দীর্ঘ পরমায়ু লাভ করলে তার মূল্যও দিতে হয়। একে একে অনেক বন্ধু চলে গেলেন ওপারে। এদিকে তার শরীরও ভেঙে পড়েছে। মৃত্যুর ষোলো মাস পূর্বে খবর এল কলকাতায় এনড্রজ গত হয়েছেন। বন্ধুত্ব তো ছিলই কবে, সেই নোবেল প্রাইজ পাওয়ার আগের থেকে, তদুপরি বিশ্বভারতীর বছরের পর বছর ব্যাপী অর্থকষ্ট কঠিন সঙ্কটে পৌঁছলেই কবিকে না বলে, এনড্রজ তার মিত্র মহাত্মা গান্ধীর মাধ্যমে অহমদবাদের কোটিপতিদের কাছ থেকে বিপদতারণ অর্থ সংগ্রহ করতেন। এনড্রজের স্বাস্থ্য ছিল কবির চেয়ে অনেক ভালো। কবির মানসপুত্র, বিশ্বভারতীর খুল্লতাত চলে গেলেন জনকের আগে। আমি অতি ক্ষুদ্র প্রাণী, কিন্তু পাঁচটি বৎসর তিনি আমাদের সেই গ্রিক-লাতিন থেকে আরম্ভ করে বর্তমান ইংরেজি সাহিত্য পড়িয়েছেন। আরও কত কী! সে তো ভোলা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ তার যে-ভাইপোকে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, তার চেয়ে মাত্র এগারো বছরের ছোট সুরেন্দ্রনাথ গত হলেন ঠিক তার এক মাস পরে, কবির জন্মদিনের মাত্র চারদিন পূর্বে :
আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি
প্রিয়-মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ
সর্বশেষে লিখছেন, শেষ জীবনে সুরেন্দ্রনাথের ভাগ্য বিপর্যয়ের স্মরণে, যেটি পূর্বেই উল্লেখ করেছি,
তাঁর মৃত্যুর জ্বলন্ত শিখার
আলোকে তাহার দেখা দিল
অখণ্ড জীবন, যাহে জন্ম মৃত্যু এক
হয়ে আছে;
সে মহিমা উদবারিল যাহার উজ্জ্বল
অমরতা
কৃপণ ভাগ্যের দৈন্যে দিনে দিনে রেখেছিল ঢেকে।
শোকের পর শোক, প্রতি শোকে কবি উদ্ভ্রান্ত হয়ে বারবার অনুসন্ধান করছেন– এ কি সব অর্থহীন? এর চরম মূল্য কি কোনওখানেই নেই?
অথচ তিনি অতি উত্তমরূপেই জানতেন, এ সংসারে এমন কোনও মহা সুপারম্যান অবতীর্ণ হননি যার তিরোধানবশত তাবল্লেক গভীর শোকসাগরে নিমজ্জিত হবে, কিম্বা আপন আপন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দের দ্বার খুলে তার থেকে নিষ্কৃতির পথ খুঁজে নেবে না। তাই তার শেষ জন্মদিনের প্রাক্কালে বলছেন :
জানি জন্মদিন
এক অবিচিত্র দিনে ঠেকিবে এখনি,
মিলে যাবে অচিহ্নিত কালের পর্যায়ে
পুষ্পবীথিকার ছায়া এ বিষাদে করে না করুণ,
বাজে না স্মৃতির কথা অরণ্যের মর্মরে গুঞ্জনে
নির্মম আনন্দ এই উৎসবের বাজাইবে বাঁশি
বিচ্ছেদের বেদনারে পথপার্শ্বে ঠেলিয়া ফেলিয়া।
অতি সত্য কথা। কিন্তু যে লোকটা আমাদের এত কিছু দিয়ে গেল, অনাগত যুগের তরেও তুলনাহীন বৈভব রেখে গেল, তাঁকে স্মরণ করব না এই দিনে? এই দ্বন্দর কি কোনও সমাধান নেই? যে এত দিল তাকে স্মরণে না-আনা সে তো ছলনা।
কবিগুরুর সর্বশেষ কবিতা স্মরণে আনিঃ
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা জালে,
হে ছলনাময়ী!
একদিকে বিচ্ছেদ বেদনা, অন্যদিকে নির্মম আনন্দ এ তো ছলনা। তাই
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার ॥
‘পূর্বদেশ’ ৫.৮.১৯৭৩
.
রামানন্দ-তর্পণ
স্বর্গত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তার প্রাপ্য সম্মানের শতাংশের একাংশও পাবেন বলে আমি আর আশা করি না।
এই যে আজ আমরা অজন্তা বাঘ গুহার ছবি নিয়ে এত দাপাদাপি করি, অবনীন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথ নন্দলাল বসুর কীর্তিকলাপ নিয়ে গর্ব অনুভব করি আমাদের চোখের সামনে এদের তুলে ধরল কে? এবং তখন তাকে কী অন্যায় প্রতিবাদের সামনে না দাঁড়াতে হয়েছিল! শুধু প্রতিবাদ নয়, নীচ আক্রমণ।
আজ আর তাই নিয়ে ক্ষোভ করি না। তার কারণ, প্রতিবাদ এবং ভিন্নমত (অপজিশন) থাকলে অসৎ মানুষ যে আরও কতখানি অসতোর দিকে এগিয়ে যায় সে তো আজ চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পারছি। রামানন্দের শতদোষ থাকতে পারে কিন্তু তিনি অসৎ একথা বললে আমাদের মতো লোক মানবজাতির ওপর শ্রদ্ধা হারাবে। তিনি সৎ ছিলেন তৎসত্ত্বেও তার অপজিশনের দরকার ছিল। পেয়েছিলেন পূর্ণমাত্রার চেয়েও বেশি।
এই বক্তব্যটি আবার উল্টো করেও দেখা যায়।
আশুতোষ কৃতী পুরুষ। রামানন্দ ও আশুতোষের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন। কিন্তু একটি বিষয়ে দু জনাতে বড়ই মিল। দু জনাই জহুরি। ভারতের সুদূরতম প্রান্তের কোন এক নিভৃত কোণে কে কোন গবেষণা নিয়ে পড়ে আছে, আশুতোষ ঠিক জানতেন। তাকে কী করে ধরে নিয়ে আসা যায় সেই সন্ধানে লেগে যেতেন। রামানন্দের বেলাতেও ঠিক তাই। কোথায় কোন এক অখ্যাতনামা কাগজে তার চেয়েও অখ্যাতনামা এক পণ্ডিত তিন পৃষ্ঠার একটি রচনা প্রকাশ করেছে ঠিক ধরে ফেলতেন রামানন্দ! আপন হাতে চিঠি লিখে তাঁকে সবিনয় অনুরোধ জানাতেন তার কাগজে লেখবার জন্য। শুধু তাই নয়, এ পণ্ডিত কোন বিষয়ে হাত দিলে তার পাণ্ডিত্যের পরিপূর্ণ জ্যোতি বিকশিত হবে সেটি ঠিক বুঝতে পারতেন– সেদিকে ইঙ্গিতও দিতেন কোনও কোনও স্থলে।
তাই রামানন্দ ছিলেন আশুতোষের অপজিশন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তখন কৈশোরে পা দিয়েছে। ত্রুটি-বিচ্যুতি অতিশয় স্বাভাবিক। আশুতোষ তার গুরু, রামানন্দ তার গার্জেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় সৌভাগ্য যে সে এই মণিকাঞ্চন সংযোজিত বিজয়মাল্য একদিন পরতে পেরেছিল।
***
সে যুগের প্রবাসীতে এক মাসে যা নিরেট সরেস বস্তু বেরুত, এ যুগের কোনও মাসিক কোনও সাপ্তাহিক পত্রিকা পূর্ণ এক বছরেও তা দেখাতে পারবে না। অবশ্য একথাও স্বীকার করি–ঈশান ঘোষ জাতক অনুবাদ করলেন বাঙলায় (জর্মন, হিন্দি বা অন্য কোনও অনুবাদ তার শত যোজন কাছেও আসতে পারে না) এবং তার সমালোচনা করলেন বিধুশেখর। এ যুগে কই ঈশান, কোথায় বিধুশেখর? এ সুবাদে আরেকটি কথার উল্লেখ করি। রামানন্দের উৎসাহ না পেলে বহু পণ্ডিতই হয়তো তাদের গবেষণা ইংরেজিতে প্রকাশ করতেন; বাঙলা সাহিত্যের বড় ক্ষতি হত।
***
রামানন্দ ছিলেন চ্যাম্পিয়ন অব লস্ট কজেস তাবৎ বাঙলা দেশে দু জন কিংবা তিনজন হয়তো লেখাটি পড়বে, তিনি দিতেন ছাপিয়ে, কারণ দার্শনিক রামানন্দ জানতেন কান্টীয় দর্শন ও পতঞ্জলির পথমধ্যে কোলাকুলি* জাতীয় প্রবন্ধ লিখতে পারে এমন লোক দ্বিজেন্দ্রনাথের মতো আর কেউ নেই। আমাদের বড় সৌভাগ্য যে রামানন্দ মাসের পর মাস দ্বিজেন্দ্রনাথের অপাঠ্য প্রবন্ধরাজি প্রকাশ করেছিলেন, কারণ দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রায়ই কোনও প্রবন্ধ লেখার কিছুদিন পরেই সেটি ছিঁড়ে ফেলতেন। (ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে আমার যেটুকু সামান্য জ্ঞান সে দ্বিজেন্দ্রনাথের কাছ থেকে। বাকিটুকু রমন মহর্ষির কাছ থেকে ও বিবেকানন্দ পড়ে। হিন্দু দ্বিজেন্দ্রনাথ আমাকে সুফিতত্ত্বের মূল মর্মকথা বুঝিয়ে দেন। সুফিতত্ত্বে তার হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে)।
[*হুবহু শিরোনামাটি আমার মনে নেই বলে দুঃখিত।]
এই দ্বিজেন্দ্রনাথ বাঙলায় শর্টহ্যান্ড বই ছাপিয়েছিলেন। তার ১২-১৪ বছর পর রামানন্দের অনুরোধে বৃদ্ধ দ্বিজেন্দ্রনাথ সেটি আবার নতুন করে লেখেন। রামানন্দ তাবৎ বইখানা নিজের খর্চায় ব্লক করে ছাপান (কারণ এতে প্রতি লাইনে এত সব সিম্বল বা সাঙ্কেতিক চিহ্ন ছিল যে এছাড়া গত্যন্তর ছিল না)। এটা আরেকটা লস্ট ক। এরকম বই কেউ পড়েও না। কিন্তু রামানন্দ ঘন ঘন তাড়া না লাগালে এই অতুলনীয় পুস্তক সৃষ্ট হত না।
আবার অন্যদিকটা দেখুন। পাবলিসিটি কারে কয় সেটা মার্কিনদের পূর্বেই রামানন্দ জেনে গিয়েছিলেন। সে যুগের যেকোনো প্রবাসী সংখ্যা নিলেই পাঠক তত্ত্বকথাটি বুঝে যাবেন।
রামানন্দ কোহিনূর বেচতেন আবার সঙ্গে সঙ্গে মুড়িও বেচতেন। কিন্তু কখনও ভেজাল বেচেননি।
এই পাবলিসিটি ব্যাপারে স্বর্গত চারু বাড়ুয্যেকে স্মরণে এনে সশ্রদ্ধ নমস্কার জানানো উচিত।
প্রবাসীর কথা (এবং সুদ্ধমাত্র যেকথা লিখতে গেলেই পুরোপুরি একখানি ভলুম লিখতে হয়; আমার মনে হয় প্রবাসীর কর্মকর্তারা যদি প্রবাসী সঞ্চয়ন জাতীয় একটি ভলুম বের করেন তবে বড় ভালো হয়। এতে থাকবে প্রবাসী থেকে বাছাই বাছাই জিনিস) বাদ দিলেই আসে মডার্ন রিভুর কথা। তখনকার দিনে মডার্ন রিভ খাস লন্ডনে প্রচারিত যেকোনো কাগজের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত। আজও প্রাচ্যভূমিতে এর চেয়ে সেরা ইংরেজি মাসিক বেরোয়নি।
প্রবাসী ও মডার্ন রিভ্যু (বিশাল ভারতের সঙ্গে আমি পরিচিত নই; পণ্ডিত হাজারীপ্রসাদ নিশ্চয়ই এ সম্বন্ধে হিন্দির পৃষ্ঠপোষক রামানন্দ–লিখবেন) এই একাধিক পত্রিকার মাধ্যমে রামানন্দ ভারতের রাজনৈতিক চিন্তায় এনে দেন স্পষ্ট চিন্তন, স্পষ্টভাষণ ও সর্বোপরি নির্ভীকতম সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার প্রচার। আমার মতো বহু মুসলমান তখন রামানন্দকে চিন্তার জগতে নেতা বলে মেনে নিয়েছিলেন।
তার পর এমন একদিন এল যখন তাকে অনুসরণ করা আমার পক্ষে আর সম্ভবপর হল না। কিন্তু একশবার বলব, তিনি তাঁর বিবেকবুদ্ধিতে যেটি সত্য পথ বলে ধরে নিয়েছিলেন সেই পথেই এগোলেন। কোনও সস্তা রাজনীতির চাল তাতে এক কানাকড়িও ছিল না।
বিশ্বভারতীতে আমি ছাত্র থাকার সময় পরম শ্রদ্ধেয় স্বর্গত রামানন্দ কিছুদিনের জন্য অধ্যক্ষ ছিলেন। সে সময়ে তাঁর সাক্ষাৎ শিষ্য না হলেও তাঁর সংস্পর্শে এসে ধন্য হয়েছি। অন্য সব কথা বাদ দিন, আমাকে স্তম্ভিত করেছিল তার চরিত্রবল। এবং সঙ্গে সাতিশয় মৃদুকণ্ঠে কঠোরতম, অকুণ্ঠ সত্যপ্রচার।
***
এদেশে এরকম একটি লোক আজ চাই। কর্তাদের কানে জল ঢেলে দেওয়ার জন্য।
***
ওঁ শান্তি; শান্তি; শান্তি।
‘কথাসাহিত্য’ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭২
.
অনাদিদেব! অনন্ত ভব!
শতং জীব! সহস্রং জীব!!
একদা শান্তিনিকেতন আশ্রমে সঙ্গীতের কর্ণধার ছিলেন– অবশ্য কবিগুরুকে বাদ দিয়ে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী। পরম শ্রদ্ধেয় সমাজসম শ্ৰীযুত অনাদিকুমার দস্তিদার (শতং জীব, সহস্রং জীব!) তখন ছাত্র। কিন্তু আমি তাঁকে কখনও ছাত্র বলে ভাবতেই পারিনি। তার আসন কার্যত এই দুই গুরুর পদপ্রান্তে ছিল বটে, কিন্তু অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় ফরাসি-ইংরেজি-বাংলা ক্লাসে আমার সতীর্থা, সুকণ্ঠী, সুবিনয়ী অনন্ত সুরলোকবাসিনী শ্রদ্ধেয়া রমা মজুমদার যার অকাল মৃত্যুতে কবিগুরুর শোক তার পরমাত্মীয়া-বিয়োগ শোককেও প্রায় অতিক্রম করেছিল একমাত্র ইনি ছাড়া শ্ৰীঅনাদি ছিলেন অনেক উচ্ছে; দুই গুরুর আদেশনির্দেশ শিক্ষাদান ব্যবস্থা প্রভৃতি সর্বকর্মের অব্যবহিত প্রধান। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি রচনায় মনোনিবেশ করলেন। অভিজ্ঞজনমাত্রই জানেন, এক সঙ্গীতসাধনাই মানুষকে অজগরের মতো আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে, তদুপরি তার স্কন্ধে চাপানো হল বিশ্বভারতীর সাহিত্য সভার সম্পূর্ণ কর্মভার। ওইটিই ছিল সেকালে বিশ্বভারতীর মায় কলাভবনাদির বয়স্ক ছাত্রছাত্রী তথা শিক্ষকদের সাহিত্যচর্চার একমাত্র মুক্ত, পাঞ্চজন্য প্রতিষ্ঠান। গুরুদেব শান্তিনিকেতনে থাকলে সর্বদাই এর অনুষ্ঠানাদির সভাপতিত্ব করতেন। একে তো অধিকাংশ আশ্রমবাসী, সহজেই অনুমেয় কারণে, শুরুদেবের সম্মুখে প্রবন্ধ পাঠ করতে সংকোচ এমনকি কিঞ্চিৎ শঙ্কা অনুভব করতেন, তদুপরি গুরুদেবের নিয়মনিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, রুচিসম্মত পদ্ধতিতে সভার আয়োজন করা, পরবর্তী সভায় পূর্ব সভার সুষ্ঠু প্রতিবেদন রচনা করা যেকোনো আর্টস্ বিভাগের ছাত্রদের পক্ষেই নিঃসন্দেহে সুকঠিন কর্মরূপে বিবেচিত হত; এবং অনাদিদা ওই সময়ে যুগপৎ অভ্যাস করছেন শাস্ত্রীয় ও রবীন্দ্রসঙ্গীত, তদুপরি নবাগতদের সঙ্গীতে শিক্ষাদান, এবং স্বরলিপি রচনায় প্রচুর কালক্ষেপণ। ইতোমধ্যে যদি বাইরের কোনও কলেজ থেকে ক্রিকেট বা ফুটবল টিম খেলার নাম করে শান্তিনিকেতনের চিড়িয়াখানা দেখতে আসত তখন অনাদিদার ওপরেই ভার পড়ত সন্ধ্যাবেলায় তাদের জন্য সঙ্গীতামোদের ব্যবস্থা করা।
অজাতশত্রু নিরীহ, স্বল্পভাষী এই লোকটির স্কন্ধে যে কতপ্রকারের গুরুভার বে-দরদ চাপানো হয়েছিল তার ফিরিস্তি তিনি, স্বয়ং, আজ আর দিতে পারবেন না।
হয়তো-বা আমিই সেই লাস্ট স্ট্র দ্যাট ব্রোক দি ক্যাসেলস্ ব্যাক!
তাই যদি হয়, তবে সে অপরাধের জন্য অংশত দায়ী শ্ৰীযুত অনাদি।
অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই এস্থলে বলে রাখি, অনাদিদার রবীন্দ্রসঙ্গীতানুভূতি ও জ্ঞান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পটভূমিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ, সে সঙ্গীতের ক্রমবিকাশ বিবর্তন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচলিত স্বরলিপির মূল্যায়ন, সে-যুগে দিবা কলকাতাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রবর্তন–এর কোনওটা সম্বন্ধেই আমার মতামত প্রকাশ করাটা হবে অমার্জনীয় অপরাধ। বাইরের থেকে শুধু এইটুকু বলতে পারি, সর্বশেষের কর্মটি করতে গিয়ে তাঁকে বিস্তর তিক্ততা, অর্থকৃচ্ছতা, রুচিহীনের সদম্ভ প্রলাপ এবং উপদেশ, একাধিক স্থলে বাধ্য হয়ে ভঁয়সকে সামনে বীণ বাজানো অর্থাৎ সুর-কালা প্যাচাগলা মুর্গি-মগজ কলচর-লোভিনী বিত্তবান-নন্দিনীকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাবার বন্ধ্যাগমন (শেষোক্তটি অনাদিদার জনৈক শুভাকাক্ষীর মুখে শোনা) ইত্যাদি নানাপ্রকারের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয়েছিল। যে নম্রস্বভাব স্বল্পভাষী তরুণকে প্রায় মুখচোরা বলা যেতে পারে, তার ছিল, সুপ্রতিষ্ঠিত জনের পক্ষে প্রশংসনীয়, নবীন পন্থা নির্মাণকারীর পক্ষে নিন্দনীয় একটি অপরিবর্তনীয় স্বভাব– তর্কাতর্কির প্রতি প্রকৃতিগত সহজ অনীহা, কিন্তু প্রচুরতম সহিষ্ণুতা মিশ্রিত। সহিষ্ণুতা মিশ্রিত ধৈর্যকে কুরান শরিফ এক শব্দে বলেন সর যার থেকে বাংলা সবুর সুদ্ধমাত্র অপেক্ষা করা, স্থল-বিশেষ ধৈর্য ধারণ করা অর্থে ব্যবহার হয়। আল্লাতালা অগণিতবার তাঁর প্রেরিত পুরুষকে অবিশ্বাসীদিগের প্রতি সবর করতে আদেশ দিয়েছেন। অনাদিদেব অকৃপণ হস্তে এই মহৎ গুণটি অনাদিদার ওপর বর্ষণ করেছিলেন।
এসব গুণ নির্ণয় আমার পক্ষে ধৃষ্টতা–কিন্তু অনাদিদার অফুরন্ত সবই আমার ভরসা। কারণ তিনি শব্দার্থে, ভাবার্থে, সর্বার্থে ছিলেন আমার গার্জেন, এখনও তাঁকে গার্জেনরূপেই মানি। আমি স্থির প্রত্যয়, তিনি আমাকে কখনও বর্জন করতে পারবেন না। আমি পাষণ্ডতর আচরণ করলেও তার স্নেহ আমার নিকৃষ্ট রচনাকে আদরের চোখে দেখে।
একে বাঙাল– খাজা বাঙাল– তদুপরি বাঁচাল, সর্বোপরি সহজ মেলামেশায় অভ্যস্ত মহিলা মিশ্রিত ব্রাহ্মসমাজ ঘেঁষা তৎকালীন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আবহাওয়া বাবদে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, বয়স ষোলো বছর হয়-কি-না-হয়, চঞ্চল প্রকৃতির মুসলমান ছেলের পক্ষে সে বাতাবরণে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার উকট সংকট, বিভীষিকাময় খণ্ড প্রলয় থেকে তাকে উদ্ধার করেন, আশ্রয় দেন, প্রথম দিন থেকেই; স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে, সম্ভ্রান্তবংশজাত অতি সহজ আড়ম্বরহীন আচরণ দ্বারা, পথ-নির্দেশ করেন সামান্যতম নিতান্তই অবর্জনীয় দু চারটি শব্দ দ্বারা অনাদিদা। শান্তিনিকেতন আশ্রমে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমার গার্জেন। তাঁর শান্ত সমাহিত আচরণ সংযতবা দিকনির্দেশ আমাকে প্রথমদিনই মুগ্ধ করেছিল, তিনি তাবৎ ছাত্রদের মধ্যমণিরূপে কতখানি সম্মানিত সে সত্য নির্ধারণ করতে আমাকে আশ্রম পরিক্রমা করতে হয়নি– এদের মধ্যে আছেন আশ্রমপালিত লেখকদের সর্বশ্রেষ্ঠ শ্ৰীযুত প্রমথনাথ, পাণ্ডিত্য তথা রসময় সর্বরচনপদ্ধতিতে সিদ্ধহস্ত বাগবিদগ্ধ গোস্বামীগৌরব শ্ৰীযুত পরিমল, অহরহ চটুল হাস্যরসে উচ্ছ্বসিত শ্ৰীযুত অনিলকুমার, প্রসিদ্ধ চিত্রকর সত্যেনদা, বিনোদবিহারী, সিংহলাগত কিশোর শ্রমণ শরণাঙ্কর সাধু, একাধিক ভাষায় অগ্রগামিনী এবং স্বল্পকাল মধ্যেই নৃত্যকুশলীরূপে সুপরিচিতা শ্রীমতী হটসিং (ঠাকুর), সর্বসঙ্গীত প্রচেষ্টায় অনাদিদার প্রীতিময়ী সহচারিণী রমা মজুমদার… কিন্তু এ নির্ঘণ্ট অফুরন্ত। স্বয়ং গুরুদেব, দিনেন্দ্রনাথ, পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী তাকে শুধু যে অশেষ মেহের চোখে দেখতেন তাই নয়, ছাত্রদের মধ্যে তিনি যে রবিসঙ্গীতের ভাণ্ডারী, কার্যত সেটা বারবার স্বীকার করেছেন তাই নয় আমার মনে হয়, শিষ্যকে গুরু যে স্বীকতি যে সম্মান দিতে পারেন অনাদিকুমার পেয়েছিলেন সেটি পরিপূর্ণমাত্রায়। তার পূর্বে বা পরে কোনও শিষ্য গুরুপদপ্রান্ত থেকে এতখানি সম্মান আহরণ করতে পারেননি।
কিন্তু আজ যতই প্রাচীন দিনের ছবি চোখের সামনে তুলে ধরি ততই মনে হয়, এসব কারণ তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রতিদিন গভীরতর করেছে বটে কিন্তু তিনি আমার গার্জেন ছিলেন একেবারে অকারণে, আমি তাঁর প্রথম আদেশই দ্বিধাহীন চিত্তে কেন পালন করেছিলুম তার কারণ অনুসন্ধান করার কোনও প্রয়োজন আমি কম্মিনকালেও অনুভব করিনি। বাহান্ন বৎসর পর আজও তিনি আমার গার্জেন। কারণ অনুসন্ধান করে আমার কোন মোক্ষলাভ হবে? এই বৃদ্ধ বয়সে আমি গার্জেনহীন হতে চাইনে।
[ইন্দিরা সঙ্গীত শিক্ষায়তন স্মারক গ্রন্থে প্রকাশিত।]
.
মরহুম শেখ মুহম্মদ মুস্তাফা অল-মরাগি
অজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য ওস্তাদ আল-মরাগি দেহত্যাগ করিয়াছেন। চীন, মালয়, ভারতবর্ষ, তুর্কিস্থান হইতে আরম্ভ করিয়া মধ্যপ্রাচ্য লইয়া একদিকে জিব্রাল্টার পর্যন্ত, অন্যদিকে তুর্কি হইতে আরম্ভ করিয়া গ্রিস, আলবেনিয়া, যুগোশ্লাভিয়া ইত্যাদি বল্কানদেশ ও রুশ, আফ্রিকার নানা প্রদেশ এমনকি আরব সাগরের মালদ্বীপ, লাক্ষা দ্বীপ হইতে বহু মুসলমান ছাত্র অজহর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িতে যায়। তাহাদের জন্য ছাত্রাবাস আছে; ভারতবাসীদের জন্য বিশেষ বাসস্থান ও অন্যান্য বন্দোবস্ত আছে।
অজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিঞ্চিৎ বর্ণনা এখানে সম্পূর্ণ অবান্তর হইবে না। পৃথিবীর যেকোনো বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষা ইহার বয়স অন্তত তিনশত চারিশত বৎসর বেশি। ইয়োরোপে যখন বর্বর, অন্ধকার মধ্যযুগ তখন অজহরের বিদ্যায়তন গ্রিক দর্শনের আরবি তর্জমা বাঁচাইয়া রাখিয়া তাহাকে বিলুপ্তির হাত হইতে রক্ষা করিয়াছিল। ভারতবর্ষ ও চীন বাদ দিলে সে যুগে অজহরই ছিল মধ্য ও পশ্চিম ভূ-ভাগের শিক্ষাকেন্দ্র। দমকস ও বাগদাদে পণ্ডিতরা যে জ্ঞান-চৰ্চা করিয়াছিলেন, তাহা কেন্দ্রীভূত হয় কাইরোর অজহর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পরবর্তী যুগে সেই অজহরের প্রচলিত ইবনে রুশদের (লাতিন ও বর্তমান ইয়োরোপীয় ভাষায় আভেরস নামে খ্যাত) দর্শন লাতিন তর্জমাযোগে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। ইয়োরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের তৃষ্ণার সৃষ্টি করেন ইবনে রুশদ ও ইবনে সিনা (আভিচেন্না বা আভিসেনা)। ইহাদের দৌত্যে ইয়োরোপ আপনার গ্রিক-দর্শন আবার ফিরিয়া পায়। তখনই প্রথম লাতিনে গ্রিক দর্শন, আয়ুর্বেদের অনুবাদ হইল। অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজে ছেলেরা যে গাউন পরে, তাহা অজহরের নকলে। মধ্যযুগে নিঃস্ব বিদ্যার্থীরা এই বিরাট গাউন বা আবার দ্বারা ছিন্নবস্ত্র ঢাকিয়া বিদ্যায়তনে উপস্থিত হইত।
এক হাজার বৎসর ধরিয়া ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা ফি-সবিলিল্লা (অর্থাৎ আল্লার পথে, দান-খয়রাতের ধর্মপথে) হিসাবে অজহরকে জমিজমা অর্থদান করিয়া গিয়াছেন। সে সম্পত্তির আয় এখন প্রচুর, কিন্তু অধ্যাপক ও ছাত্রসংখ্যা তদপেক্ষা প্রচুর। তবু অজহর কোনও ছাত্রের নিকট হইতে অর্থ (ফিজ) গ্রহণ করে না, প্রত্যেক ছাত্রের জন্য বাসস্থান দেয় ও প্রত্যেক ছাত্রকে মাসিক তিন হইতে পাঁচ টাকা দক্ষিণা দেয়। তাহারই জোরে নিতান্ত কপর্দকহীন ছাত্র দুই-তিনজনে মিলিয়া ক্ষুদ্র মেস করিয়া ও গ্রাম হইতে কিঞ্চিৎ আটা-আলু আলাইয়া দিন গুজরান করিতে পারে।
বিংশ শতাব্দীর সভ্যজগতে যখন বিদ্যা ক্রয়-বিক্রয়ের পণ্যদ্রব্য বলিয়া স্বীকৃত হইয়া গিয়াছে, যখন ধন না থাকিলে তোমার বিদ্যায় অধিকার নাই, যখন ধন থাকিলে তুমি হেলাফেলায় বিদ্যায়তনের আবহাওয়া মর্জিমাফিক বিষাক্ত করিতে পার, তখনও অজহর বিশ্বাস করে যে, বিদ্যায় সকলের সমান অধিকার! যেকোনো ছাত্র, যে কোনও দেশ হইতেই হউক অজহরে উপস্থিত হইয়া তাহার অতি অল্প আরবি জ্ঞান দেখাইতে পারিলেই বিদ্যায়তনে ভর্তি হইতে পারে ও বরাদ্দ দক্ষিণা পায়। পূর্বে অ-মুসলমান ছেলেদেরও লওয়া হইত, কিন্তু শুনিয়াছি, কয়েকটি ক্রিশ্চান পাদ্রি ছাত্র ধর্মশিক্ষার ভান করিয়া নানা অপ্রিয় বাক্য বলিয়া এমন কাণ্ড করিলেন যে ভবিষ্যতের ভয়ে ভীত অজহর তাহাদিগকে দেশে ফিরিয়া যাইতে বলিল, কে জানে, কোনদিন তাঁহাদের প্রটেকশনের প্রয়োজন হইবে। এই আফ্রিকার আরেক অংশেই তো সেদিন এক নিগ্রোকে বলিতে শুনিলাম, ইয়োরোপীয়রা যখন প্রথম আমাদের দেশে আসিল, তখন তাহাদের হাতে ছিল বাইবেল, আমাদের ছিল জমি। এখন অজহরের তুলনা করা ভুল হইবে।
অজহরের ছাত্ররা ধর্মশাস্ত্র পড়ে। সম্প্রতি ইংরেজি ফরাসি ইতিহাস, ভূগোল ও অন্যান্য বিষয়ও পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। কিন্তু তাহাদের সর্বাপেক্ষা অভ্রভেদী নেশা খবরের কাগজ পড়ার। সকালে যে কোনও ক্লাসে প্রবেশ করুন না কেন, দেখিবেন শতকরা ত্রিশটি ছেলে আপন আপন খবরের কাগজ নিবিষ্ট মনে পড়িতেছে। এদিকে পড়িতেছে তেরোশত বৎসরের পুরনো শাস্ত্র ওদিকে দুনিয়ার হালচালের প্রতি চড়া নজর। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে তাহাদের জ্ঞান দেখিয়া আমি স্তম্ভিত হইয়াছি। আমাদের টোল বা মাদ্রাসার নিরীহ শান্ত ছাত্রদের সঙ্গে অজহরের তুলনা করা ভুল হইবে।
কাইরোতে আরও দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে; একটি মিশর সরকার চালান (অজহর নিজের সম্পত্তিতে চলে) ও অন্যটি মার্কিনরা। এই দুইটি আমাদের কলিকাতা-ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হরেকরকস্থা করে।
কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনে অজহর পয়লা নম্বর।
সাইবেরিয়া হইতে জিব্রাল্টার পর্যন্ত শেখ অল-মরাগির শিষ্যেরা শোকাতুর হইবেন। অনুমান করি, অন্তত ছয় মাস ধরিয়া তার-চিঠি, সংবাদপত্রের বিশেষ সংখ্যা, শেখের জীবনী ইত্যাদি পৃথিবীর নানা দেশ-বিদেশে হইতে নানা ভাষায় কাইরোর দিকে প্রবাহিত হইবে ও শেখের পূতজীবন ও অপূর্ব প্রতিভা বিশ্ব-মুসলিমকে কী প্রচুর পরিমাণে অনুপ্রাণিত করিয়াছিল, তাহা সপ্রমাণ করিবে।
অজহরের নিয়ম যে, যিনি প্রধান শেখ বা রেক্টর হইবেন, তাঁহার শুধু পণ্ডিত হইলেই চলিবে না, তাহার চরিত্র যেন অকলঙ্ক হয়। অগাধ পাণ্ডিত্য ও অনাড়ম্বর ধর্মপরায়ণতার সম্মেলন শেখ অল-মরাগিতে ছিল বলিয়াই তাহার হাজার হাজার শিষ্যের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা তিনি অর্জন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
শেখের পাণ্ডিত্যের বিচার আজ করিব না। ধর্মভীরু বলিয়া তাঁহাকে অনিচ্ছায় রাজনীতিক্ষেত্রে নামিতে হইয়াছিল। শেখ বিশ্বাস করিতেন যে, দেশে যখন অত্যাচার অবিচার চলে, তখন তাহারই একপার্শ্বে সঙ্গোপনে ধর্মচর্চা করিয়া অনাচারকে নীরবে স্বীকার করিয়া লওয়া অধর্ম, পাপ। তাই যখন বিদেশি শক্তির চাপে পড়িয়া মিশরের রাজা ফুয়াদ ওয়াদ দলকে তাড়াইয়া প্রচলিত শাসনবিধি উপেক্ষা করিয়া স্বিদকি পাশাকে চোটা মুসোলিনি কায়দায় (তখনও হিটলার আসর জমাইতে পারেন নাই) ডিক্টেটর বানাইলেন ও স্বিদকি সদম্ভে প্রচার করিলেন যে তিনি বর্জ-বাহু দ্বারা মিশর শাসন করিবেন, তখন শেখ অল-রাগি নির্ভীক বলদৃপ্ত কণ্ঠে প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। স্বিদকির প্ররোচনায় রাজা শেখকে হুকুম দিলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য আশিজন ওয়াফদহিতৈষী অধ্যাপককে যেন বরখাস্ত করা হয়। শেখ উত্তর দিলেন যে, অধ্যাপকেরা ওয়াফদের পৃষ্ঠপোষকতা করিয়া ধর্মাচরণ করিয়াছেন মাত্র। ইহাদিগকে শাস্তি দেবার কোনও কথাই উঠিতে পারে না। স্বিদকির প্ররোচনার রাজা অটল; বিদেশি শক্তিও অজহরের মেরুদণ্ড ভাঙিতে পণ করিয়াছে।
শেখ পদত্যাগ করিলেন। তামাম মধ্যপ্রাচ্যে হুলস্থুল পড়িয়া গেল। সকলের মুখে এক প্রশ্ন, রাজা শেখের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করিলেন কী করিয়া।
স্বিদকি তাহারই এক ক্রীড়নককে অজহরের শেখ নিযুক্ত করিলেন– কোনও ধর্মভীরু পণ্ডিতই তখন স্বিদকির পদলেহন করিতে সম্মত হন নাই। নতুন শেখ আশিজন দেশমান্য অধ্যাপককে পদচ্যুত করিলেন। অজহরের হাজার বৎসরের ইতিহাসে ওই একমাত্র মর্কট সিংহাসনে বসিয়াছিল।
তার পর অজহরের ছাত্রেরা যে কাণ্ড করিল, তাহা স্বিদকি সম্প্রদায়ের চিরকাল মনে থাকিবে। ট্রাম জ্বালাইয়া, বাস পোড়াইয়া, বোমা ফাটাইয়া স্বিদকির স্বাধিকার প্রমত্ততাকে বেত্রাঘাতে জর্জরিত করিল। বাঙালি পাঠকবর্গের অবগতির জন্য এস্থলে উল্লেখ প্রয়োজন যে, সাদ জগলুল পাশার আমলে হইতে আজ পর্যন্ত মিশরে যত রাজনৈতিক আন্দোলন হইয়াছে, তাহাতে নেতা ও কর্মীর অধিকাংশ অজহরি। তাহাদের জাল মিশরের সর্বত্র ছড়ানো। তুলনাস্থলে ১৯২০-এর খেলাফত আন্দোলনের একাগ্রতা পাঠককে স্মরণ করাইয়া দেই।
স্বিদকির মেরুদণ্ড ভাঙিল। আন্দোলনের শেষদিকে তাহার দক্ষিণহস্তে সেই দম্ভকর বজ্ৰবাহুতে পক্ষাঘাত হইল। মিশরি পরম সন্তোষের সঙ্গে বলিল- “আল্লা-হু-আকবর। বিদেশি শক্তি মিয়মাণ। রাজার চেতনা হইল। ওয়াদকে আবার ডাকা হইল।
অজহরের ছাত্রেরা পরমানন্দে শেখ অল-রাগিকে অজহরে ফিরাইয়া আনিতে গেল। শেখ প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিলেন, যে দেশের রাজা বিদেশির ক্রীড়নক হইয়া গণ্যমান্য দেশপ্রিয় অধ্যাপকদের লাঞ্ছনা করে, তাহার অধীনে কর্ম করার মতো বিড়ম্বনা আর কিছু নাই। ছাত্রেরা অনেক অনুনয় বিনয় করিল; কিন্তু শেখ অটল। তখন তাহারা শেখের অন্ধ বৃদ্ধ গুরুর দ্বারস্থ হইল। তিনি বলিলেন, শেখকে গিয়া বল আমি বৃদ্ধ, মৃত্যুর সম্মুখীন, কিন্তু এমন কোনও পুণ্য করিতে পারি নাই যে, জিন্নতের (স্বর্গের) আশা করিতে পারি। আমার একমাত্র ভরসা যে, মরাগির মতো শিষ্য আমার কাছে অধ্যয়ন করিয়াছেন। কিন্তু তিনিও যদি কর্তব্যপথ হইতে বিচ্যুত হন, তবে জিন্নতে যাইবার আমার শেষ আশা বিলীন হইবে।
শেখ অল-রাগি তৎক্ষণাৎ গুরুবাক্য শিরোধার্য করিয়াছিলেন।
শেখের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সমস্যা ছিল ইয়োরোপীয় সভ্যতার কতটুকু গ্রহণ করা যায়। বিংশ শতাব্দীর ইয়োরোপীয় জগৎকে উপেক্ষা করিয়া স্বাধীনতা অর্জন ও রক্ষণ অসম্ভব অথচ ইয়োরোপের জড়বাদের তাণ্ডবলীলা তাহার শিক্ষাদীক্ষার সঙ্গে দেশে প্রবর্তন করার অর্থ দীন-দুনিয়ার সর্বনাশ।
মনে পড়িতেছে, প্রশ্ন উঠিয়াছিল রেডিয়োতে কুরানপাঠ শাস্ত্রসম্মত কি না। উগ্রপন্থিরা বলিলেন, রেডিয়োর প্রচুর চলতি শুড়িখানা ও বেশ্যালয়ে। সেই উচ্ছল উন্মত্ততার আবহাওয়ায় কুরানপাঠ কুরানের অবমাননা! শেষ ফতোয়া দিয়াছিলেন, শেখ অল-মরাগি। তিনি বলিলেন, ধার্মিকের গৃহে কুরানপাঠ অহরহ হইতেছে। কিন্তু আমি চাই কুরান যেন সর্বত্র পৌঁছে। আকণ্ঠ নিমজ্জিত পাপী তো কুরান শুনিতে ধার্মিকের দ্বারস্থ হয় না। সুরাসক্ত যদি অনিচ্ছায়ও একদিন রেডিয়োতে কুরান পাঠ শুনিয়া বিচলিত হয়, ধর্মপথে চলিবার তাহার বাসনা হয়, তবে বেতার ধন্য হইবে।
এই হিমালয়ের ন্যায় বিরাট পণ্ডিতের কথা যখন ভাবি, তখন মনে পড়ে তাহার ব্যবহারের জন্য শেখ সেই গাড়ি চড়িয়া দূর আবদিন প্রাসাদে যাইতেন রাজার সঙ্গে দেখা করিতে। সেই সময়ে মোটর ভ্রমণেচ্ছুক ছেলেরা, বিশেষত গ্রাম্যরা শেখের অফিসের সামনে ঝামেলা লাগাইত। শেখ গাড়িতে উঠিয়া ছেলেদের ডাকিয়া যেন নৌকাতে কাঁঠাল বোঝাই করিতেন। কাহাকেও বাদ দিবার ইচ্ছা শেখের নাই অথচ গাড়ি যত বিরাটই হউক, সে তো গাড়ি। দামি রোলস বটে (এক ধর্মপ্রাণ শেখের ব্যবহারার্থ অজহরকে ভেট দিয়েছিলেন। কিন্তু শেখের আপসোসের অন্ত নাই যে, যথেষ্ট পরিমাণে প্রশস্ত নহে।
আবদিন প্রাসাদের সম্মুখে ছেলেরা নামিয়া যাইত। শেখ পই পই করিয়া আদেশ করিতেন, কেউ যেন ছিটকাইয়া না পড়ে; তিনি যাইবেন আর আসিবেন। তার পর দশবার করিয়া শুনিতেন কয়টি ছেলে আসিয়াছে ও দশবার করিয়া সে আদমশুমারি ভুলিয়া যাইতেন।
রাজাকে সৎপথে চলিবার উপদেশান্তে শেখ বাহির হইয়া সেই একপাল ব্যাঙকে এক ঝুড়িতে পুরিবার চেষ্টা করিতেন। কেউ এ কাফেতে ঢুকিয়াছে, কেউ ওই দোকানে গুম হইয়া গিয়াছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরিবার পথে শেখের দুর্ভাবনার অন্ত নাই। কেউ বাদ পড়িয়া যায় নাই তো, ড্রাইভারের আশ্বাসবাক্য কিছুতেই বিশ্বাস করিতেন না। বারে বারে বলিতেন, গাড়ি যেন ফাঁকা ফাঁকা মনে হইতেছে।
সেই শেখ জিন্নতবাসী হইলেন। আল্লাতালা তাহার আত্মাকে নিজের কাছে ফিরাইয়া লইয়াছেন। নিশ্চয়ই আমরা তাঁহার নিকট হইতে আসিয়াছি ও অবশ্যই আমরা তাহারই নিকটে ফিরিয়া যাইব।
[আনন্দবাজার পত্রিকা ২.৯.১৯৪৫]
.
পলডি
আমাদের দেশে কালিদাস সম্বন্ধে যেসব গল্প চলতি আছে, তার অনেকগুলোই তার প্রথম যৌবনের হাবামি নিয়ে। উত্তর ভারতেও নিরেট হাবামির গল্প বানানো হলে সেগুলো সাধারণত শেখ চিল্লির ঘাড়ে চাপানো হয়। (এর উল্টো দিকও আছে– চালাকির গল্প বলতে হলে আমরা সেটা গোপালভাড়ের কাঁধে চাপাই)। এই করে করে কোনও কোনও দেশে অজ মূর্খামি অথবা মারাত্মক ফন্দিবাজির গল্পগুলো কোনও এক বিশেষ কল্পনামূলক বা সত্যিকার চরিত্রের চতুর্দিকে জড়ো হয়।
জৰ্মনিতে নিরেট হাবামির গল্পগুলো জমেছে পড়ি নামক মাহাখানদানি, পয়সাওয়ালা এক হস্তিমুখের চতুর্দিকে। পলডির সবিশেষ পরিচয় দেবার দরকার নেই। শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে লোকটি অষ্টপ্রহর ফিট-ফট্টিনাইন, দুনিয়ার তাবৎ লোকের সঙ্গে তার দহরম-মহরম এবং তার ব্রেন-বক্সে কিছু আছে কি না সে সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ অচেতন। গুণের মধ্যে দেখা যায়, পলডি অত্যন্ত সহৃদয় এবং খাঁটি খানদানি মনিষ্যির মতো পাঁচজনকে আপ্যায়িত করবার জন্য তার চেষ্টা-ত্রুটির অন্ত নেই।
পলডির বাকি পরিচয় পাঠক নিচের লেখাগুলো থেকে পাবেন।
.
সে কী পলডি, আমাকে এখনও চিনতে পারছিসনে? স্কুলে তোরই পাশে এক বেঞ্চিতে বসতুম যে!
মাফ করবেন। আপনি নিশ্চয়ই ভুল করেছেন। স্কুলে আমার পাশে ওরকম লম্বা দাড়িওয়ালা কেউ বসত না।
*
সে কী পলডি, আপনি দাঁড়কাক পুষেছেন কেন?
সত্যি বলব? আমি হাতেনাতে দেখতে চাই, এই যে লোকে বলে দাঁড়কাক তিনশ বছর বাঁচে কথাটা সত্যি কি না।
*
হাঁ হাঁ, ঠিক বুঝেছি কাপ্তেন সায়েব। আপনার কম্পাস সবসময় উত্তর দিক দেখিয়ে দেয়। কিন্তু মনে করুন আপনি যদি আর কোনও দিকে যেতে চান, তা হলে কী করেন?
*
অধ্যাপক– এখন আপনাদের যে তারাগুলো দেখাব তাদের আলো পৃথিবীতে আসতে পাঁচ ঘণ্টা লাগে।
পলডি (নেপথ্যে)–আমি অতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব না? আমরা আটটার সময় খানা খাই।
*
আমার রিটর্ন টিকিট চাই।
কোথাকার?
কী মুশকিল! এখানে ফেরবার।
*
এই যে পলডি, সুখবর শুনুন, আজ সকালে আমি ঠাকুরমা হলুম।
কী যে বলেন। আর এরি মধ্যে দিব্যি চলাফেরা করতে আরম্ভ করেছেন?
*
পলডি–ওই যে দুর্গ দেখতে পাচ্ছেন, ওইখানে আমার জন্ম হয়। আপনি কোথায় জন্মেছিলেন?
টুরিস্ট– হাসপাতালে।
পলডি–কী ভয়ানক। কেন, আপনার কী হয়েছিল?
[আনন্দবাজার পত্রিকা]
.
উমেদারি
জনাব সহযোগী সম্পাদক মহাশয়,
কদম-মবারকেষু,
মহাত্মন!
আমি বিলক্ষণ অবগত আছি, সম্পাদক মহাশয়ের পরিবর্তে এ পত্র তস্য সহযোগীর উদ্দেশে প্রেরণ করা সখৎ বে-আদবি। কিন্তু আপনি স্বয়ং বিসমিল্লাতেই গলদ করে বসে আছেন বলে আমাকেও বাধ্য হয়ে এই পোতকল-বিরুদ্ধ অনাচার করতে হল।
আপনি উত্তমরূপেই জানেন, আমাদের প্রথম পরিচয়ের দিন থেকে জানেন, আমার জীবনের সর্বোচ্চাশা, কোনও একটি পত্রিকার সম্পাদক হওয়া– তা সে আজেবাজে মার্কা লন্ডন-টাইমস-ই হোক, কিংবা তখৎ-ই-তাউস-কম্ কুত্ত্বমিনাররূপী কালি ও কলমই হোক। অতএব আমার জিগর-কলিজার চিল-চেল্লানির ফরিয়াদ, আমাকে সম্পাদক পদটি দিলেন না কেন?
প্রত্যহ ক্রমিক বেকারির দাওয়াই কর্মখালির বিজ্ঞাপন চা-পানান্তে রকে বসে সেবন করি- সে-ও আপনার মতো হর-ফন-মৌলা হুনুরি জনের অজানা নয়। কই, কোনও কাগজে তো আপনার কাগজের জন্য সম্পাদক প্রয়োজন এমত বিজ্ঞাপন দেখিনি। আপনি আরও জানেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক ভ্যাকেসির জন্য বিজ্ঞাপন দিতে হয় তা সে কেরানির চাকরিই হোক আর লক্ষ লক্ষ চাকরি যে মহারাজ দেন তার চাকরিই হোক!
বলতে হবে না, বলতে হবে না! আমি জানি, আপনি বলবেন, কিন্তু আখেরে চাকরিটি পায় কে? আপনি পান? আমি পাই? স্বপনকুমার পায়? আসলে কর্তৃপক্ষ মাত্র একটি ব্যাপারে গাফিলি করেন; বিজ্ঞাপন দেবার সময় চাকরিটা যাকে দেবেন তার ফটোগ্রাফ সঙ্গে ছপিয়ে যদি ঘোষণা করেন, None need apply whose photograph does not resemble this! তা হলেই সর্ব ঝামেলা চুকে যায়।
বুঝেছি, বুঝেছি, সব বুঝেছি। ক-সের ধানে ক-সের চাল– সরি, বলা উচিত ক-সের গম নিলে ক-সের চাল পাবে, কিংবা কটা লুপ নিলে কটা বউ পাবে– এসব কাশীমিত্তির নিমতলা আমি চিনি, মুসলমানের ব্যাটা হয়েও। মামদোর উপর ব্রহ্মদত্যি!
আমি আপনাকে সোজাসুজি বাড়িতে না থাকলে লটকাইয়া লটকাইয়া নোটিস দিলুম, আমি অডিটারজেনরেল, এনফরসূমেন্ট ব্রাঞ্চ, ইনকাম ট্র্যাক্স সব্বাইকে আপনার কীর্তি জানিয়ে উড়ো চিঠি লিখব; তখন বুঝবেন ঠ্যালা কারে কয়। ভালো করে বুঝিয়ে বলি।
মস্তান মস্তানি মস্তানগিরি শব্দগুলো চেনেন? ওই যে সিদিনা ছুঁচলো গোপ, ছুঁচলো জুতো, চুঁচলো পাতলুন গয়রহ সমন্বিত গোটাকয়েক ছোঁড়া এসে পুজোর চাঁদা চাইলে যেভাবে আপনার দিকে চেয়ে চাইলে, তাতে আপনি বাগে বাস্লো করে টাকা দিতে দিতে ইষ্টনাম স্মরণ করলেন না (কত খসল?)? মনে মনে আন্দেশা করলেন না, বড় আহামুখী হয়ে গিয়েছে ঢাকা বারান্দায় টুব লম্পটি লাগিয়ে। ওটা গেল। ওরা যদি সন্তুষ্ট না হয়।… কালই দেখতে হবে, বাজারে গডরেজ ইস্পাতের বাল হয় কি না!
এই হল গে মস্তানি–বাঙলা ভাষায় বাঙলা কথা।
কিন্তু শব্দটা যাবনিক। অর্থাৎ এর ওপর আপনার চেয়ে আমার হক ঢের ঢের বেশি। তদুপরি আপনি বর্ণশ্রেষ্ঠ, আমার ‘বননো’টি আর না বললুম, ওই সামনে শ্রীশ্রীশ্যামাপূজা– মা-আমার অধমের বননো পেলে জেল্লাই টেকরাতেন।
শব্দটির বহর দেখুন! Drunk, intoxicated, libidinous= কামোন্মাদ; Iustful, wanton, furious; an animal in rut = ভাদ্রমাসীয় সারমেয়, excessively drunk and polluted with neat wine = দ্বন্দ্বটা লক্ষ করুন! মদটা উত্তম শ্রেণির (বা নির্জলা) কিন্তু অস্থলে পড়ে বেবাক নোংরা করল (গোমূত্র পবিত্র, কিন্তু দুধে পড়লে তুলনীয়), intoxicated with the wine of rashness = কাচের দোকানে পাগলা ষাড়, ইত্যাদি ইত্যাদি আরও বিস্তর আছে।
ধন্য, ধন্য যিনি এই শব্দটি বাঙলায় চালিয়েছেন। পাড়ার মস্তানদের কোনও গুণ এতে অবহেলিত হয়নি, বড় তামাকের কলকে পেয়েছে। ভূমা খন্বিদং ইত্যাদি উট উঁট শব্দ এঁয়ার কাছেই আসতে পারে না।
তারই দোহাই কেড়ে আপনাকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি :
আমাকে পত্রপাঠ সহযোগী অসহযোগী– অনারারি হলেও কণামাত্র আপত্তি নেই, কিন্তু খবরদার, সেস্থলে সেটা যেন পারমেনেন্ট হয়– কোনও একটা সম্পাদক যদি না করেন তবে ওই কথাই রইল! আপনার টুব লম্পোটির প্রতি আমার কিঞ্চিত্মাত্র জুগুপ্সা নেই। আমি দেখে নেব, আপনি কী করে যজমান বাড়িতে আতপ চাল আর কাঁচকলা পান– যার ওপরে ভরোসা করকে কারওয়ার বৈঠিয়েছেন অর্থাৎ কালি ও কলম যোগাড় করেছেন। পয়সায় তিনটে বাগচীর কালি বড়ি আর খাগড়ার কলম তো।
তা বেশ করেছেন।
কিন্তু মনে রাখবেন, ওই কালি ও কলমের হাফ হিস্যেদার আমি। কালি না হয় আশু-প্রত্যাশিত মা কালীর চর্মনির্যাস হতে পারে কিন্তু কলম* শব্দটি আরবি, যাবনিক। আরব নবী হজরত ছিলেন সম্পূর্ণ নিরক্ষর। তাই বোধহয় আল্লাপাক কুরান শরিফে বাণী দিয়েছেন তাঁকে (আল্লাকে) স্মরণ করে আবৃত্তি কর, তিনি কলমের মাধ্যমে জ্ঞান দান করেছেন।… আপনার পত্রিকার নামকরণের ওতে কলমকে স্মরণ করে আপনি আল্লা নির্দেশিত পথেই যাত্রারম্ভ করেছেন।
[* যদ্যপি কেউ কেউ বলেন ওটা নাকি মূলে গ্রিক।]
এ দৃশ্য দেখে গুণীজ্ঞানীরা বিস্মিত হবেন না। ভবিষ্য পুরাণের প্রক্ষিপ্তাংশে নাকি স্পষ্টাক্ষরে লিখিত আছে, কলিযুগস্য লক্ষণম্ কিং? থাক্ সংস্কৃত। মোদ্দা : কলিযুগে ব্রাহ্মণে যবনাচরণ করবে, আর যবন আর্যশাস্ত্র রচনা করবে।
আপনার পথ আপনি বেছে নিয়েছেন; আম্মে অধুনা গৌড়ভূমে যে নব্যন্যায় সৃষ্ট হয় তারই অনুকরণে একখণ্ড উপাদেয় নব্যস্মৃতি লিখেছি। আপনার শুভবুদ্ধি যদি আমাকে সম্পাদকমণ্ডলীতে ভূম্যাসনও দেয় তবে মল্লিখিত সেই স্মৃতিশাস্ত্র কালি ও কলম মারফত তাবল্লোকে শনৈঃ শনৈঃ প্রচারিত হবে। এই সুবাদে কিঞ্চিৎ পূর্বাস্বাদ সারভ করছি (ফরাসি মেনু-তে যে আইটি অর দ্য ভ hors d-oeuvre নামে সুপরিচিত); যেহেতু অর্বাচীন গৌড়সন্তান যাবনিক উপাহারলয়ে তথা ভোজন হর্মে পূৰ্বাভিজ্ঞতানটনবশত বংশারণ্যে ডোম্বাহ্মের ন্যায় আচরণ করত হাস্যাস্পদ হয়, সেহেতু মদ্গ্রন্থে ফিরপোতে হবিষ্যান্ন। নামক একটি বিশেষ উল্লাস আছে, তৃতীয় অধ্যায়ের চতুর্থ কল্লোলে। কোন কোন তিথিনক্ষত্রে ফিরপো গমনে যাত্রা শুভ তথা যাত্রা নাস্তি একাদশীতে তথায় ষণ্ডপুচ্ছযশ সেবন অবিধেয় কি না ইত্যাদি ইত্যাদি তাবৎ জটিল জটিল সমস্যার নিঘণ্ট তথা দফে দুফে সবিস্তর বর্ণন অধমাধমের নব্যস্মৃতিতে যাবনিক সংস্কৃতে আলেকজানদ্রিয়ান ছন্দে গ্রন্থিত আছে। একাধিক আই সি এস কর্তৃক উচ্চ প্রশংসিত। তারা অবশ্য তাঁদের যবন পূর্বসূরিগণ কর্তৃক স্থাপিত প্রথা অনুযায়ী যথারীতি পুস্তক না পড়েই প্রশংসাপত্র দিয়েছেন কিন্তু এস্থলে পাণ্ডুলিপি পূর্বাহে অনধীত থাকাতে ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি– দি ক্যারাভান (চালিয়াতি উচ্চারণ কারাভ) পাসেজ কাফেলা অগ্রগামী। ইতোমধ্যে আমেরিকা-প্রত্যাগত স্বামী বিটলানন্দ (বিটেল নয়, Beatle) ও শ্রীদিদি স্বপ্নযোগে পাণ্ডুলিপি অধ্যয়ন করত আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মার্কিন বিটল সম্প্রদায়ের জন্য মারিযোয়ানা হশিশ-ভাঙ-চণ্ড ইত্যাদি মিশ্রিত পঞ্চরঙ (এটিই প্রকৃত অকৃত্রিম বস্তু- পঞ্চরসের অনুকরণে নির্মিত Punch নিরেস, নীরস ভেজাল) এবং বিশেষ করে মার্তণ্ড-তাপিত-বকযন্ত্ৰোগীৰ্ণ-ঋজুর-নির্যাস– শাহ-ইন-শাহ জহাঁগিরের সুপ্রিয় পেয় ডবল ডেটিলড়-এরে এই মহা-কারণবারিরই শ্বেতাঙ্গ দত্ত অভিধা– কী প্রকারে কোন শুভলগ্নে পান বিধেয় সবিস্তারে এ তাবৎ শ্লোকবদ্ধরূপে গ্রথিত আছে। সহজে প্রত্যয় যাবেন না, কিন্তু তৎসত্ত্বেও ঘোর সত্য যে যুক্তফ্রন্টের কমন-ইস্ট তথা প্রতিপক্ষ উভয় সম্প্রদায়ই এ স্মৃতি সোল্লাসে কামনা করেছেন। বাসনা ধরেন, খবরই প্রসাদাৎ বিধান, ফতোয়া, ফরতা প্রয়োগ করত একে অন্যকে স্মৃতিভ্রষ্ট জাতিচ্যুত করতে সক্ষম হবেন। আমেন– যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ!
সম্পাদকতার পরিবর্তে এই দেবদুর্লভ গ্রন্থের কপিরাইট অতীব সুলভ। দ্যাখতোনাদ্যাখ আপনাদের বাক্-সাহিত্য তামাম বেঙ্গলকে তাক লাগিয়ে অবাক সাহিত্যে পরিণত হবে! বাঙলা কোন ছার, আপনি হেলায় লঙ্কা করিবা জয়।
এইবারে বলুন, শুধু মস্তানিই করি? উদারার খাদেও চড়াকসে নামতে জানি।
***
কিন্তু, যাই-বলি-যাই-কই, কিন্তু ব্যাকরণে একটা বিভীষণ ভুল করে বসে আছি আমি। সেটাকে আমার ওয়াটারলু পানিপথ গালিপলি আপনার প্রাণ যা চায় তাই তুলে বেইজ্জত করতে পারেন। আমার মন নির্ঘ ছিল, আপনি আপনার পেটুয়া কাকা মামা শালাদের কাউকে দুম্ করে সম্পাদকের দিওয়ান-ই-খাস-এর সগ-ই-মমর তখতে বসিয়ে দেবেন। ও হরি! কোথায় কী? বসিয়ে দিয়েছেন বিদগ্ধ দ্ৰ কুলীন সন্তান মিত্রজ শ্ৰীযুত বিমল মহোদয়কে। সর্বনাশ! আমার। আপনার তো সর্বরক্ষা! এ যে আমার কুল্লে ফরিয়াদের কী বেহ মুখ-তোড় জবাব তার জবাব কড়ি দিয়ে কেনা যায় না। কালির উপর বিমল! সোনার পাথর বাটি আপনিই সব্বপয়লা গড়লেন। কালি সরোবরে বিমল হংসকে ছেড়ে দিয়েছেন। কবীর (বেজোড়ের) বলেছেন, বিরল হংস। ম স্থলে র। তা ওই ম র ম র ম রা করে করেই শ্রীবাল্মীকি রামচন্দ্র পেয়েছিলেন।
কহাঁ আসমান কা সিতারা, ঔর কহাঁ——! কোথায় আসমানের তারা আর কোথায় পাছার পাঁচড়া! কোথায় শ্রীবিমল আর কোথায় আমি!
সাহিত্যিক রূপে খ্যাতি জমানো সর্বভূমিতেই সুকঠিন। কঠিনতম গুজরাত মারওয়াড়ে। ঝাড়া দশটি বছর আমি তৎ তৎ অঞ্চলে বসবাস করেছি এবং লক্ষ করেছি ওইসব ভূমিতে সাহিত্যিক নামক বস্তুটি কালোবাজারেও পাওয়া যায় না। অবশ্য শুনে তাক লেগে যাবে ওইসব অঞ্চলে কালোবাজার হেথাকার তুলনায় ঢের ঢের কম। সো কৈসন? উত্তরে সেই উর্দু প্রবাদটি স্মরণ করিয়ে দিই– মহল্লেকি রেণ্ডি মা বরাবর= আপন মহল্লার বেশ্যা মায়ের মতো, অর্থাৎ, ঢলাঢলি করবি তো কর, কিন্তু আপন মহল্লাতে নয়। তাই এদেশের মহাজনরা উভয়ার্থে– আপন আপন জন্মভূমিকে কর্মভূমিতে পরিণত করেননি। ঐসি গতি সনসারমে। তা সে যাক। বলছিলুম কী, ওদেশে সাহিত্যিক বস্তুটি ডুমুরের ঠ্যাং। যদিস্যাৎ সেই ব্রহ্মাণ্ডদুর্লভ প্রাণীটি এদেশে দেখা দেয় তবে তাকে কারও সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার সময় বলে সাহিত্যিক ছে অর্থাৎ ইনি সাহিত্যিক। অন্য পক্ষ তখন মনে মনে বলছে বেচারা! না জানি, বউ বাচ্চা ক মাস ধরে অনাহারে আছে! এপক্ষ তখন গম্ভীরতম কণ্ঠে সুবে অহমদাবাদ-গুজরাত-সৌরাষ্ট্র কচ্ছকে বিস্ময়ে নির্বাক করে দিয়ে বলে গের বাঁধছে! অর্থাৎ ঘর বেঁধেছে? কী বললে? কী কইলে? সুঁ ব্যোলা? বরঞ্চ চিংড়ি মাছ হিমালয়ের চুড়োয় চড়ে আপস-চূড়া-প্রবাসিনী চিংড়িনীকে ডেকে তার সঙ্গে রসালাপ করতে পারে–সরু গলির এপার ওপার যেরকম নিত্যি নিত্যি হয় কিন্তু সাহিত্যিক আপন কামানো কড়ি দিয়ে বাড়ি বেঁধেছে! জয় প্রভু পরস্নাথ!
বিমলবাবু কড়ি দিয়ে কী কী কিনেছেন বলেননি। দাদখানি বেল মশুরির তেল থেকে শুরু করে নিশ্চয়ই গের= ঘর = বাড়ি!
এদিকে দেখুন, পাঠান মোগল ইংরেজকে তিনি কীরকম গুলে খেয়েছেন শ্রীমিত্র হয়তো বঙ্কিমচন্দ্রকে হারাতে পারেননি– কে-ই বা পারে– কিন্তু তাঁরা ইতিহাস চর্চা বঙ্কিমের চেয়ে কম নয়। সে যুগের তুলনায় আজ লাইব্রেরিতে ফারসি ইতিহাস ঢের ঢের বেশি। এবং সব চেয়ে বড় কথা, অর্বাচীনরা যখন ভেবেছিল, ঐতিহাসিক উপন্যাসের জমানা খতম, সাত হাত মিট্টিকে নিচে তখন শ্রীবিমল দেখিয়ে দিলেন, কোনও বিষয়বস্তু কোনও যুগ, কোনও আঁর = genre-ই চিরতরে লোপ পায় না। ঐতিহাসিক উপন্যাস আজও লেখা যায়– ঈশপের গল্প পাঁচ হাজার বছর পরেও লেখা চলবে, কলমের জোর থাকলে।
ওই কলমের জোরটাই আমাকে নিধন করেছে, সহযোগী মশাই, ওই পোড়া কলমের জোর।
নইলে, স্মরণ করুন, কুবুদ্ধির তাড়নায় একদা আপনি স্বয়ং পঞ্চতন্ত্র ছাপাননি? মহাত্মা বিষ্ণুশর্মার জার পৃথিবীর কোন দেশে অপরিচিত? এই শৰ্মাই বা তাকে গুরু বলে স্বীকার করবে না কেন? কিন্তু আপনার-আমার জোড়া কপাল–দৈবের লিখন, আহা, খাইতে সাধ্য কার– গর্দিশের গেরোতে গেরনে গেরাস করলে।… শুনলুম, বইখানা আপনার হাতছাড়া হয়েছে। তা হলে মৌলা আলির উদ্দেশে ব্রতোপবাস করে, সেখানে আচারাত চতুর্দশ শাক নিবেদন করত চলে যান সোজা কালীঘাটে। সেখানে কালী কেলকেত্তাওয়ালীর পদপঙ্কজে বিবি শিরনি ছড়িয়ে– এর সমূহ বিধি বিধান নব্যস্মৃতিতে পাবেন–ব্রহ্মময়ী মা, ব্ৰজযোগিনী মা স্মরণ করতে করতে বাড়ি ফিরে পুজোপাটার বিশেষ বেশ গরদের ইজের-পাজামা ফের শিকের হাঁড়িতে রাখবেন। কারণ অধুনা তোমার বাহন যেটা, দুই সেই ইঁদুর ব্যাটা–
সোঁদর বনের বড়-মোর মুরশিদ, দক্ষিণ রায়ের ভ্রাতা গাজীপিরের ফিরলো প্রবেশ ছাড়পত্র ইভনিং-জ্যাকেটটির নিকুচি করেছে!
***
কিন্তু এই ওয়াটারলুর সামনেও আমার একটি বক্তব্য আছে।
শ্রীবিমল কখানা বই লিখেছেন আমি জানিনে বলে লজ্জিত। কিন্তু তার প্রত্যেক বই যেন অনার্জ সহ পাস সে তথ্য অজানা নয়। পক্ষান্তরে আমার চোদ্দটি সন্তান আপনাদের প্রদত্ত গ্রেস সত্ত্বেও হারাধনের দশটি ছেলের রাজেন্দ্রসঙ্গমে কপপুর! সবকটা বিলকুল না-পাস।
তাই শ্রীবিমল better কোআলিফাইড!
এই তো আপনার বুদ্ধি!
চৌদ্দ ব্যাঙ্ক যে ডকে তুলেছে সে সন্ধি সুড়ক বেশি জানে, না যে সগৌরবে বেশুমার ব্যাঙ্কের উন্নতি করেছে সে বেশি জানে? কালোবাজার, ট্রিপল একাউন্ট রাখা, ব্যাঙ্কের টাকায় তেজিমন্দি খেলা, ইনকমট্যাক্স দেওয়া দূরের কথা তাদের কাছে রিলিফ রূপে দাদন চাওয়া এসব না করতে পারলে আপনার সদ্য ভরা কালি সাহারা হয়ে যাবে না, আপনার কলম মুষলে পরিণত হয়ে যদুবংশ ধ্বংস করবে না। ঈশ্বর রক্ষতু!
তবু গাঁইগুঁই করছেন? অর্থাৎ, এটা বোঝার মতো এলেমও আপনার পেটে নেই। তা হলে মারি সেখানে বোমা!
এক বিশেষ সম্প্রদায়ের তালেবর ব্যবসায়ী ভাবী জামাতার সঙ্গে ব্যবসাতে বাবাজির তজরুবাহ-অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে মাত্র একটি প্রশ্ন শুধোন। উত্তর শুনে সোল্লাসে বললেন, ওয়াহ্, ওয়াহ্ বেটা জিতে রহো! ঔর ক্যা পঁছু? (আর কী শুধবো!) সাত দফে গণেশ উল্টায়া! কামাল কিয়া, কামাল কিয়া! বহিয়া দামাদ (জামাতা), উদা দামাদ!
এই কামাল্ কিয়া শুনেই কাজী-কবি মুস্তফা কামালের উদ্দেশে গেয়েছিলেন, কামাল। তুনে কামাল কিয়া, ভাই!
আমার নাম মুস্তফা নয়– বঙ্গসন্তান তবু আকছারই আমাকে ওই নামে চিঠি লেখেন, আমিও ওই নামের ধোকার টাটির পিছনে আশ্রয় নিই, পাওনাদারের হুনো খেয়ে
আমার চ্যান্স দিন, স্যার, আমি আপনার কাগজের তরে কামালের আমল করে ছাড়ব। ও! আপনি বুঝি আরবি ভাষা আমার চেয়েও বেশি মিসান্ডারস্টেন্ড করেন। কামালের স্যুপারলেটিভ আমল- যেমন কবীর-এর অবর, হামিদ-এর আহমদ! বাঁদরের বোধহয় আবৃদ নইলে হারাম ব্র্যান্ডি-পানি দেবে কেন?
***
শ্রীবিমলকে না নিলেও আপনি যে মিত্তির একটি নিতেনই– সে আমি জানি। মুখুয্যে “কুটিল” অতি বন্দ্যো বটে সাদা, অপিচ ঘোষ বংশ মহাবংশ, বোস বটে সাদা, মিত্তির “কুটিল” অতি দত্ত মহারাজা।
এ কম্মটি ভালোই করেছেন। সর্বশেষে দেখছি নমস্য বদ্যিও জুটিয়েছেন। কবিগুরুর দক্ষিণ-হস্তের সাক্ষাৎ প্রতীক আপনাদের কাগজের মেরুদণ্ড গড়ে দিচ্ছেন।… হা হা পাবলিসিটি করতে জানতেন না, বদ্যি সন্তান শ্ৰীম।
***
তবু বলছি, আমাকে নিলে ভালো করতেন!
‘কালি ও কলম’ ফাল্গুন ১৩৭৫
.
এষাস্য পরমা গতি?
সত্যেরে দেখিব আমি জ্যোতির্ময় রূপে;
আমার চরম মোক্ষ, আমি গন্ধ ধূপে
ভস্ম হব পরি লয়ে সে দীপ্ত তিলক
অগ্নিতে আছেন যিনি, জলে বিশ্বলোক–
অন্তস্তলে, ওষধিতে, বনস্পতি মাঝে
মম সত্তাবীণা যেন তারি স্পর্শে বাজে ॥
সে যুগ অতীত হল। তার পর ঋষি
কহিলেন, এ জীবন অন্ধ অমানিশি।
সত্য বাক্য, সত্য চিন্তা, তথা সত্য কর্ম
ত্রিরত্ন তোমার হোক– সঙ্, বুদ্ধ ধর্ম
দীপ্যমান সর্বলোকে অন্ধ তমোনাশা
ঈশ্বরের দাস্য ত্যজ, ত্যজ শূন্যে আশা।
বুদ্ধ-জীন ক্ষত্রিয়ের অমিতাভ ভাষা।
তাপিত শূদ্রের বুকে এনেছিল আশা ॥
অতিক্রমি আরবের দুস্তর মরুরে
ভারতে শ্যাম-সুধা-পঞ্চনদ ক্রোড়ে
আশ্রয় লভিল যবে নব সত্যদূত
বক্ষেতে বাহুতে তার এক ধর্ম পূত
একেশ্বর। প্রণমিয়া এ ভূমিরে।
–যে দেশ ত্যজিয়া এল নাহি চাহি ফিরে–
কহিল, “সত্যেরে আমি যে সুন্দর রূপে
লভিয়াছি, তবু শুভ্র পাষাণের স্তূপে
করিব প্রকাশ আমি। এস সর্বজন,
জাতিবর্ণ নাহি হেথা। মুক্ত এ প্রাঙ্গণ
আচণ্ডাল তরে। শুনি সে উদাত্ত বাণী
শান্ত হল অভিযান, যুদ্ধে হানাহানি ॥
তার পর? তার পর লজ্জা, ঘৃণা, পাপ,
অপমান; প্রকাশিল অন্তহীন শাপ ॥
যুগক্ষাত্র তেজে তার পাপ-প্রক্ষালন
চেষ্টা হল ব্যর্থ যবে। করিল বরণ
ভেদ-মন্ত্র ছিদ্রান্বেষী, পরম্পরাঘাত,
হইল বিজয়টিকা– সে অভিসম্পাত ॥
দীর্ঘ রাত্রি অবসানে অরুণ আলোতে
মেলি সুপ্ত আঁখি দেখি চলে মুক্তস্রোতে
নাগরিক বৃদ্ধ ক্ষুদ্র; জনপদে জাগে
দীন-দুঃখী, পাপী-তাপী। তারি পুরোভাগে
মোহনের সাথে চলে যে ছিল নির্ভয়
মহাপুরুষের নামে দিতে পরিচয়,
আজাদি মোতিরমালা চিত্ত কেড়ে লয়
সরোজিনী পঙ্কে ফোটে– জয় জয় জয়!
চক্রনেমি আবর্তন পূর্ণ হল ভেবে
কৃতজ্ঞ হৃদয় নিয়ে প্রণমিনু দেবে।
হায়রে বিদীর্ণ ভাল, হারে অর্বাচীন
চক্রনেমি আবর্তিল; কিন্তু হল লীন
সম্মুখের সুখস্বর্গ। কি অভিসম্পাতে
ভাগ্যচক্র প্রবেশিল সেই অন্ধরাতে ॥
ভূতনাথ গিরিশৃঙ্গে উভয়ে প্রয়াণ
নববীজমন্ত্র লাগি। নাহি অসম্মান!
নাহি অসম্মান তাহে। হেথা নাগরিক
দ্বি-ধা হয়ে তর্ক করে দীর্ণে দিগ্বিদিক!
কৌলীন্য বিচারের তাই কী জাত্যাভিমান!
দম্ভ কিবা?– কে পড়িছে বেশি স্টেটসম্যান।
[আনন্দবাজার পত্রিকা ২৮.৭.১৯৪৫]
.
গাঁধী-ঘাট
আজ যদি রাষ্ট্রসংঘ ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতে চান, তা হলে আমাদের কোনও দুর্ভাবনা নেই। আমাদের উচ্চাঙ্গ সংগীত কী সে বিষয়ে আমাদের মনে কোনও সন্দেহ নেই, এবং সে সংগীত, সর্বাঙ্গসুন্দর করে কে কে গাইতে পারবেন সে বিষয়েও আমাদের মনে অত্যধিক দ্বিধা নেই। তার কারণ আমাদের সংগীত এখনও জীবন্ত– তার ঐতিহ্য কখনও ছিন্নসূত্র হয়নি।
কিন্তু স্থাপত্যের বেলা আমাদের মস্তকে বজ্রাঘাত হয়। এককালে ভারতবর্ষে যে অত্যন্ত নয়নাভিরাম ভবন অট্টালিকা ছিল সে বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ– সংস্কৃত কাব্য নাটক শিল্প-শাস্ত্রে তার ভূরিভূরি বর্ণনা পাওয়া যায় কিন্তু ঠিক কী করে সেগুলো আবার নির্মাণ করা যায়, সে সম্বন্ধে আমাদের কারও মনে কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। মোগল-পাঠান বাদশারা ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে বুখারাস-মরকন্দ ইরানের শিল্পকলা মিশিয়ে এদেশে বিস্তর ইমারত গড়েছিলেন, কিন্তু তার প্রধান নিদর্শন পাওয়া যায় মসজিদ, কবর ও দুর্গ নির্মাণে। আজকের দিনে এসব ইমারতের আমাদের প্রয়োজন নেই, কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৃহনির্মাণ করতে গিয়ে আমরা তাজমহল বা জুমা-মসজিদের দ্বারস্থ হতে পারিনে।
ইংরেজ যখন নয়াদিল্লি গড়তে বসল তখন যে এ সমস্যা তার সামনে একেবারেই উপস্থিত হয়নি তা নয়। ঠিক সেই সময়েই রসজ্ঞ হ্যাভেল সায়েব ভারতীয় শিল্পকলা সম্বন্ধে একখানা প্রামাণিক পুস্তক প্রকাশিত করেন। তার শেষ পরিচ্ছেদে তিনি ভারতীয় ইংরেজ বড়কর্তাদের সাবধান করে দেন, তারা যেন নয়াদিল্লিতে শিব দিয়ে বাঁদর না গড়েন। হ্যাভেল স্পষ্ট ভাষায় ইংরেজ স্থপতি-ইঞ্জিনিয়ারদের বলে দেন, ভারতবর্ষের স্থাপত্য-ঐতিহ্যের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তোমাদের কর্ম নয়। যে শহরে দিওয়ান-ই-খাস, জুমা মসজিদ, কুতবৃমিনার রয়েছে, সেখানে ভারতীয় স্থপতিকে বাদ দিয়ে কোনও কিছু সৃষ্টিকার্য করার দম্ভ কর না।
কিন্তু হ্যাভেল যখন দেখতে পেলেন যে ইংরেজের স্বাধিকার-প্রমত্ততা তাকে সম্পূর্ণ বধির করে ফেলেছে, তখন তিনি ইংল্যান্ডের গণমান্য ইংরেজদের তরফ থেকে একখানা স্মারকলিপি তখনকার দিনে সেক্রেটারি অব স্টেটকে পাঠান। যতদূর মনে পড়ছে, সে স্মারকলিপিতে বার্নার্ড শ এবং এচ. জি. ওয়েলসের নামও ছিল।
চোরা ধর্মের কাহিনী শোনে না, কিন্তু ধর্মের কাহিনী না শুনলেই যে মানুষ চোর হবে তার কোনও মানে নেই। সে মূর্খ হতে পারে, শিশু হতে পারে অথবা ইংরেজ বড়কর্তাও হতে পারে। এস্থলে দেখা গেল, ইংরেজ বড়কর্তারা দিল্লিতে বসে শ” সায়েবকে সরাজ্ঞান করলেন– কথাবার্তা থেকে ধরা পড়ল লন্ডনি শর তুলনায় তারা নিজেদের এক একজনকে একশ মনে করেছেন। তার পর দিল্লিতে তারা চিজ প্রসব করলেন পণ্ডিতি ভাষায় তাকে বলে গর্ভস্রাব, ইংরেজিতে Muck, trash বললে তার খানিকটে অর্থ ধরা যায়– শিব গড়তে বাঁদর গড়ার জন্য কোনও জুৎসই কথা ইংরেজিতে নেই, পর্বতের মূষিকপ্রসবও অন্য জিনিস।
তারি অন্য নিদর্শন কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ল। এ জিনিসটি ক্রিসমাস কে না শ্বেতহস্তী, এখনও ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারিনি। এটা নাকি বানানো হয়েছিল তাজমহলের সঙ্গে টক্কর দেবার জন্য। হবেও বা। শূর্পনখাও তো সীতার সৌন্দর্য দেখে হার মেনে নেয়নি। সেকথা থাক, তবে এইটুকু না বলে থাকা যায় না- তাজ দেখে মনে হয়, চেঁচিয়ে বলি, ধরু, ধর, এক্ষুনি ডানা মেলে আকাশে উড়ে যাবে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ল দেখে চেঁচিয়ে বলি, বধূ বাঁধূ এক্ষুনি ডুবে যাবে।
***
গাঁধীঘাট নির্মাণ করতে গিয়ে তাই স্থপতিকে কোন সমস্যার সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল স্পষ্ট বুঝতে পারি। অজন্তাযুগে ফিরে যাবার উপায় নেই, মোগল স্থাপত্যে ঘাট নির্মাণের উদাহরণ নেই। আর ইউরোপীয় স্থাপত্যের বহু জিনিস আমাদের কাজে লাগে বটে, কিন্তু তা দিয়ে রসসৃষ্টি হয় না, আর হলেও আমাদের ভারতীয় মন চট করে তা দেখে সাড়া দেবে কি না সে বিষয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। (ইউরোপীয় সবকিছু বর্জনীয় সেকথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়– তা হলে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের নভেল বাদ দিতে হয়)।
তা হলে এক হতে পারে–সবকিছু বাদ দিয়ে নিছক কল্পনার হাতে লাগাম ছেড়ে দেওয়া। তাতে মন সাড়া দেয় না। আমরা কি তবে হটেনটট? আমাদের ভাণ্ডারের কি কোনও ঐশ্বর্য নেই যে আমরা শুধু দু খানা হাত দিয়ে ব্যবসা ফাঁদব?
আর হতে পারে প্রয়োজনমতো হিন্দু, পাঠান, মোগল ইংরেজ সকলের কাছ থেকে রসবস্তু ধার নেওয়া। যেখানে নিতান্তই অনটন, সেখানে স্থপতি চালাবেন তার কল্পনা। তার নৈপুণ্য তাকে শিখিয়ে দেবে কী করে ভিন্ন ভিন্ন রসবস্তুর সংমিশ্রণে এমন জিনিস নির্মিত হয়, যা রসস্বরূপ এবং শুধু তাই নয়– অখণ্ড রসম্বরূপ।
আমার মনে হয়, গাঁধীঘাট অখণ্ড এবং সার্থক রসসৃষ্টি হয়েছে। তার সম্পূর্ণতাটাই আমার চোখে পড়েছে প্রথম এবং আমি তাকে সম্পূর্ণভাবেই রসবস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছি। দেখে মুগ্ধ হয়ে যখন মনস্থির করলুম যে এ সম্বন্ধে আর পাঁচজনকে বলতে হবে, তখনই বিশ্লেষণ কর্ম আরম্ভ করতে হল এবং তাতেও স্থপতির পরিমাণ-জ্ঞান দেখে আশ্চর্য হয়েছি। পাটটা মসলা একত্র করা কঠিন কর্ম নয়– হোটেলের পাঁচকেরা নিত্য নিত্য করে; কিন্তু সার্থক রান্না মা মাসিরই হাতে ফুটে ওঠে। জগাখিচুড়ি ও মধুপর্ক ভিন্ন জিনিস।
স্মৃতিসৌধ দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, তাই তাকে উচ্চ হতে হয়। স্থপতি সেখানে ঐতিহ্যগত মন্দিরের শরণাপন্ন হয়েছেন। ঘাটে মেয়েদের জন্য কাপড় ছাড়ার ভালো ব্যবস্থা করতে হয় এবং পর্দার কড়াক্কড়ি মোগল-পাঠানরাই করেছে বেশি। তাই পাষাণ-যবনিকা দিয়ে যে গর্ভগৃহ নির্মাণ করা হয়েছে তার অনুপ্রেরণা এসেছে দিল্লি-আগ্রা থেকে। আর সর্বশেষে ঘাটে আশ্রয় পাবে বহু লোক; তাদের জন্য স্থপতি সৌধবক্ষ হতে যে পক্ষ সম্প্রসারিত করেছেন তার শৈলী ইয়োরোপীয় (এবং ইয়োরোপীয়ের আবিষ্কৃত কংক্রিটেই এ বস্তু সম্ভবপর)। আজকালকার দিনে কে না জানে প্রতীক্ষমাণ নরনারী সবচেয়ে বেশি দেখা যায় প্লাটফর্মে এবং প্লাটফর্ম জিনিসটা যখন বিলিতি, তখন তার বেদনা-বোধটা কোথা থেকে আসবে তার জন্য বড় বেশি কল্পনাও খাটাতে হয় না।
কিন্তু প্লাটফর্ম দেখে মনে যদি কোনও রসের সৃষ্টি হয়, তবে সে তো বীভৎস রস। আমার মনে হয়, স্থপতি এখানে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। এই পক্ষ সম্প্রসারণে এমন একটা সরল স্বচ্ছন্দ গতিভঙ্গি বা sweep আছে। বামদিকের গর্ভগৃহ ও সৌধ-শিখরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই গতিভঙ্গি এতই সুষ্ঠু হয়েছে যে, সমস্ত স্মৃতিসৌধটি স্থাণুবৎ না হয়ে গতিবেগ পেয়েছে। মন্দিরটির খণ্ড গম্ভীর পাষাণ যবনিকা কারুকার্যময় পক্ষ সম্প্রসারণ পূর্বক আপন বৃক্ষলতা দিয়ে সম্পূর্ণ সৌধের ভারকেন্দ্র রক্ষা করেছে।
তাই মনে হয়, আড়ম্বরহীনতাই এ সৌধের প্রধান ধর্ম। আমার বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে, গাঁধীঘাটে যে আড়ম্বরহীনতার গোড়াপত্তন করা হয়েছে তার সঙ্গে মিল রেখে আমাদের ভবিষ্যতের সব স্থাপত্য প্রচেষ্টা আড়ম্বরহীনতায়ই আপন প্রধান সতর্কতা খুঁজে পাবে। শুধু বলতে চাই, মহাত্মাজির জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোনও স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতেই হয় তবে তাকে আড়ম্বরহীন হতেই হবে।
কিন্তু আমাদের এসব বিশ্লেষণ হয়তো প্রয়োজন নেই। আমরা শহরে থাকি, গঙ্গাবক্ষের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র ক্ষীণ। মা গঙ্গার বুক বেয়ে যে জনপদবাসী উজান-ভাটা করে, তারা কী বলে সেই কথা জানবার জন্য আমরা উত্তষ্ঠিত হয়ে রইলাম।
শৈলীর প্রভাব এ স্মৃতিসৌধ কতটা বহন করছে বিশ্লেষণ তারা করবে না। তাদের শেষ কথা, ভালো-লাগা মন্দ-লাগা এবং কলা-বিচারে সেই শেষ কথা। তবে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, সম্পূর্ণ বিদেশি বন্ধু আমাদের জনসাধারণকে বেশিদিন রস দিতে পারে না। এ সৌধ আমাদের ঐতিহ্যের ওপর নির্ভর করে যখন শিরোত্তোলন করেছে তখন আর যা হয় হোক, এ বস্তু নিন্দাভাজন হবে না।
অবিমিশ্র আনন্দের বিষয়, এ ঘাটের পরিকল্পনা করেছেন এক বাঙালি যুবক। তার নাম হবিবুর রহমান। ইনি শিবপুরের কৃতী ছাত্র ও পরে আমেরিকায় গিয়ে অনেক বিদ্যাভ্যাস, অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। এই পুণ্যকর্মের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে শ্রীমান দেশবাসীর আশীর্বাদ লাভ করবেন।
এ ঘাটে গঙ্গাবক্ষে স্নান করে দেশবাসীর দেহ পবিত্র হোক, মহাত্মার জীবন স্মরণে তাদের আত্মা মহান হোক।
ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।
[আনন্দবাজার পত্রিকা]
.
হজরত সৈয়দ নিজাম উদ-দীন চিশতি
সুলতান উল্-মশায়িখ (গুরু-সম্রাট), মহবুব-ই-ইলাহি (খুদার দোস্ত), হজরত সৈয়দ নিজাম উদ-দীন চিশতি, শেখ উল্-আওলিয়ার (গুরুপতি) ৬৪৬ পরলোকগমনোসব (উ) নিজাম উদ্-দীন দর্গায় মহা সমারোহের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ মহাশয় অনুষ্ঠানে সভাপতি হবেন বলে কথা ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ায় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি স্বহস্তে উর্দুভাষায় একখানি চিঠি লিখে তার অনুপস্থিতির জন্য দুঃখ জানান এবং শেখ নিজাম উদ-দীনের জীবনী সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করেন। রাষ্ট্রপতি সচরাচর হিন্দিতে চিঠিপত্র লিখে থাকেন বলে উর্দু-প্রেমী সভাস্থ হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খ্রিস্টানগণ উর্দুর প্রতি তার এই সহৃদয়তা দেখে ঘন ঘন উল্লাস প্রকাশ করেন।
***
আফগান রাজদূত বলেন, শেখ নিজাম উদ-দীন আফগান এবং ভারতের সম্মিলিত আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতীক। খুরাসান-হিরাতে একদা সুফিতত্ত্বের যে চিশতি-সম্প্রদায় সৃষ্ট হয় নিজাম উদ-দীন সেই সম্প্রদায়ের অসাম্প্রদায়িক বাণী এদেশে প্রচারিত করেন। আফগান রাষ্ট্রদূত প্রদত্ত নিজাম উদ-দীনের পটভূমি এবং ইতিহাস বর্ণন পাণ্ডিত্যপূর্ণ এবং অতিশয় মনোরম হয়েছিল।
মিশরের রাজদূত বলেন, নিজাম উদ-দীনের বাণী সর্বসম্প্রদায়ের ভেদের অতীত ছিল বলেই তাঁর চতুর্দিকে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সমবেত হয়েছিলেন।
আজকের দিনের ভারতীয় রাষ্ট্রও সেই ধর্ম-নিরপেক্ষ ভিত্তিতে গড়া বলে সে রাষ্ট্র ভারতের ভেতরে-বাইরে বিশেষ করে মিশরে এতখানি আদৃত হয়েছে। নানা সম্প্রদায়ের লোক সভাতে উপস্থিত ছিলেন বলে তারা মিশর-রাষ্ট্রদূতের এই উক্তিতে ঘন ঘন করতালি দেন।
ইরাকের রাজদূত বলেন, আজ পৃথিবী আরেক বিশ্বযুদ্ধের সামনে এসে পড়েছে। আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি দরকার শান্তির বাণী প্রচার করা। খাজা নিজাম উদ-দীন ইসলামের শান্তির বাণী প্রচার করেছিলেন বলেই তিনি সব সমাজের এতখানি শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন।
ইরাকি এবং মিশরি রাষ্ট্রদূত দুজনেরই মাতৃভাষা আরবি। তারা ইংরেজি ভাষণের ফাঁকে ফাঁকে বিশুদ্ধ উচ্চারণে কুরান থেকে কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করেন। দিল্লির হিন্দু-মুসলমান শিখ অনেকেই আরবি জানেন, অন্তপক্ষে কুরান-তিলাওত (কুরান-পাঠ) শুনতে অভ্যস্ত। এদের কুরান উদ্ধৃতি ও মধুর আরবি উচ্চারণ শুনে সকলেই বড় আনন্দ লাভ করেন।
পাকিস্তানের রাজদূত যুক্তপ্রদেশবাসী- তাই তাঁর উর্দু উচ্চাঙ্গের। তিনি উর্দুতে বক্তৃতা দিলেন বলে জনসাধারণের সুবিধে হল। আর উর্দু সাহিত্যিক যারা ছিলেন, তাদের তো কথাই নেই। পাকিস্তানের রাজদূত বলেন, আমরা নিজাম উদ-দীনের বাণী জীবনে মেনে নিলে সাম্প্রদায়িক দ্বেষ-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হতে পারব।
সর্বশেষে মৌলানা সাহেব বক্তৃতা দেন। মৌলানা সাহেবের উর্দু ভাষার ওপর যা দখল তার সঙ্গে আর কারও তুলনা হয় না। বক্তা হিসেবেও তার জুড়ি এ দুনিয়ায় আমি দু একজনের বেশি দেখিনি। উচ্চারণ, বলার ধরন, শব্দের বাছাই, গলা ওঠানো-নামানো, যুক্তিতর্ক উপমার সিঁড়ি তৈরি করে করে ধাপে ধাপে প্রতিপাদ্য বিষয়ের দিকে গুরুচণ্ডাল সবাইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এসব তাবৎ বাবদে তিনি ভারতবর্ষের যেকোনো বক্তার সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারেন।
মৌলানা সাহেব বললেন, নিজাম উদ-দীনের বাণী যে কতখানি সফল হয়েছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ চোখের সামনেই। এই যে হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খ্রিস্টান এখানে আজ ভক্তিভরে সমবেত হয়েছে তার থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, তাঁর বাণী সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিল– তিনি ইসলামের সেই শিক্ষাই নিয়েছিলেন, যে শিক্ষা কোনও বিশেষ ব্যক্তি, সমাজ বা ধর্মের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট নয়, সে শিক্ষা সর্বধর্মের প্রতি সমান ঔদার্য দেখায়, তার নীতি এবং দণ্ড হিন্দু-মুসলমান-শিখ সকলের ওপর সমভাবে প্রযোজ্য।
***
অনুষ্ঠানটি হয়েছিল নিজাম সাহিত্যসভার আমন্ত্রণে। এক কাশ্মিরি ব্রাহ্মণ (পণ্ডিত) যুবক সভার সম্পাদক। তিনি বিশুদ্ধ উর্দুতে যে একখানা আমন্ত্রণরচনা পাঠ করলেন, তা শুনে মনে হল অতখানি বাংলা জানলে রায় পিথৌরা বাংলা দেশে নাম করে ফেলতে পারতেন।
***
নিজাম উদ-দীন বাঙলা দেশে বিখ্যাত হয়েছেন দৃষ্টিপাতের মারফতে। গিয়াস উদ-দীন তুগলুক শার সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য আর দিল্লি দূর অস্ত গল্প এখন সকলেই জানেন।
৬৩৪ হিজরার (ইং ১২৩৬) সফর মাসে নিজাম উদ-দীন বুদায়ুনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম মুহম্মদ, পিতার নাম আহমদ। তার পাঁচ বছর বয়সে বাপ মারা যান, মা তাকে মানুষ করেন। পঁচিশ বছর বয়সে তিনি দিল্লিতে এসে গিয়াসপুর গ্রামে আস্তানা গাড়েন (হুমায়ুনের কবরের পুব-উত্তর কোণে এখনও সে ঘরটি আছে: এবং পাক-পট্টনের সিদ্ধ-পুরুষ বাবা ফরিদ শকর-গঞ্জের কাছে দীক্ষা নিয়ে আবার দিল্লিতে ফিরে আসেন।
চিশতি সম্প্রদায়ের তিন মহাপুরুষ ভারতবর্ষে সুপরিচিত। আজমির শরিফের খাজা মুইন উদ-দীন চিশতি ভারতে চিশতি সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। ভারতীয় মুসলমানের কাছে মক্কা-মদিনার পরই আজমির তৃতীয় তীর্থ, বহু হিন্দুর কাছে কাশী-বৃন্দাবনের পরই আজমির শরিফ।
মুইন উদ-দীনের পরেই তাঁর সখা কুত্ত্ব উদ-দীন বস্তৃতিয়ার কাকি। ইনি ম্রাট ইলতুৎমিসের (অলতমাশ) গুরু ছিলেন এবং দিল্লির অধিকাংশ পণ্ডিতের বিশ্বাস কুতুব মিনার দাসবংশের প্রতিষ্ঠাতা কুত্ত্ব উদ-দীন আইবকের নামে বানানো হয়নি বানানো হয়েছিল পীর কুত্ত্ব উদ-দীন বখতিয়ার কাকির নামে। এঁর দরগাহ কুতুবমিনারের কাছেই। সেখানে শেষ মুগল বাদশার অনেকেই দেহরক্ষা করেছেন। প্রতি বৎসর সেখানে দরগার চতুর্দিকে। ফুলের মেলা বসে।
তার পরই বাবা ফরিদ উদ-দীন শকর-গঞ্জ।
***
সুলতানা রিজিয়ার ভগ্নীপতি গিয়াস উদ-দীন বলবন থেকে আরম্ভ করে মুহম্মদ তুগলুক পর্যন্ত বহু বাদশাই নিজাম উদ-দীনের শিষ্য ছিলেন। রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হৃদ্যতা তাঁর ছিল আলাউদ্দীন খিলজি, খিজুর খান (এই খিজর খান এবং দেবলা দেবীর প্রেমের কাহিনী সম-সাময়িক কবি আমির খুসরৌ ফারসি ভাষায় লেখেন একথা বাঙালির কাছে অজানা নয়– আকবর বাদশাহ প্রায় তিন শতাব্দী পরে বাঙলা দেশে জলবিহারের সময় এই কাব্য শুনে মুগ্ধ হন) এবং মুহম্মদ তুগলুকের সঙ্গে আলাউদ্দীন খিলজিকে পীর নিজাম উদ-দীন মঙ্গোল আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে দেন- মুহম্মদ তুগলুকের সঙ্গে তার হৃদ্যতার প্রধান কারণ ধর্মশাস্ত্রে উভয়ের গভীর পাণ্ডিত্য। মুহম্মদ তুগলুককে সাধারণত পাগলা রাজা বলা হয়, কিন্তু তার আর যে দোষই থাকুক তিনি সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত ছিলেন। মোল্লারা তাকে জেহাদের জন্য ওসকাতে চাইলে তিনি শাস্ত্ৰবিচারে তাদের ঘায়েল করে ঠাণ্ডা করে দিতেন।
কিন্তু পীরের সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল তার মিত্র এবং শিষ্য কবি আমির খুসরৌর সঙ্গে। খুসরৌর পরিচয় এখানে ভালো করে দেবার প্রয়োজন নেই। ভারত-আফগানিস্তানের সুরসিক জনমাত্রই তাকে প্রাতঃস্মরণীয় কবিরূপে স্বীকার করে থাকেন।
পীর নিজাম উদ-দীনের সঙ্গে বরঞ্চ জলাল উদ-দীন খিলজি এবং গিয়াসউদ-দীন তুগলুকের প্রচুর মনোমালিন্য ছিল কিন্তু খুসরৌকে সম্মান এবং আদর করেছেন বব থেকে আরম্ভ করে মুহম্মদ তুগলক পর্যন্ত সব রাজাই। এমনকি যে গিয়াস উদ-দীন তুগলুক নিজাম উদ-দীনের কুয়োর কাজ বন্ধ করে দেবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিলেন তিনি পর্যন্ত খুসরৌকে সভাস্থলে বিস্তর ইনাম-খিলাত দেন।
মুহম্মদ তুগলুক পণ্ডিত ছিলেন, তাই তার লাইব্রেরিখানা ছিল বিশাল– মুহম্মদ সেই লাইব্রেরি দেখাশোনার ভার দেন খুসরৌকে। ঐতিহাসিক জিয়া উদ-দীন বরণী আর খুসরৌ সঙ্গে না থাকলে মুহম্মদ হাঁপিয়ে উঠতেন। বাঙলা দেশ যাবার সময় মুহম্মদ মিত্র খুসরৌকে সঙ্গে নিয়ে যান এবং সেখানে লেখনাবতীতে থাকাকালীন খবর পৌঁছল নিজাম উদ-দীন দেহরক্ষা করেছেন।
***
বজ্রাঘাত বললে কম বলা হয়। খুসরৌকে কোনওপ্রকারেই সান্ত্বনা দেওয়া গেল না। সর্ব বেচে দিয়ে উন্মাদের মতো দিল্লির দিকে রওনা হলেন। সেখানে তাঁর পৌঁছনোর খবর পেয়ে তাঁর অসংখ্য মিত্র ছুটে গেলেন তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য। নিজাম উদ-দীনের পরেই পীর হিসেবে দিল্লির আসন তখন নিয়েছেন খাজা নসির উদ-দীন চিরাগ দিল্লি অর্থাৎ দিল্লির প্রদীপ-কুত সাহেব আর নিজাম উদ-দীনের পরেই তার দর্গা দিল্লিতে প্রসিদ্ধ এবং ইনি ছিলেন খুসরৌর পরম মিত্র। তিনি পর্যন্ত খুসরৌকে তাঁর শোক ভুলিয়ে সংসারে আবার ফিরে নিয়ে যেতে পারলেন না।
আচ্ছন্নের মতো খুসরৌ দিবারাত্রি নিজাম উদ-দীনের কবরের পাশে বসে সেদিকে তাকিয়ে থাকতেন। দীর্ঘ ছয় মাস কাটানোর পর তাঁর প্রতি খুদার দয়া হল। ২৯ জুল কিদা ৭২৫ হিজরিতে (ইংরেজি ১৩২৫) মৃত্যু তাঁকে তাঁর গুরু এবং সখার কাছে নিয়ে গেল।
খুসরৌ বাণীর একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন বলে হিন্দুর বসন্ত পঞ্চমী উৎসবে প্রতি বৎসর যোগ দিতেন।
এখনও প্রতি বৎসর দিল্লির হিন্দু-মুসলমান বসন্ত পঞ্চমী দিনে নিজাম উদ-দীনের দর্গায় সমবেত হয়ে খুসরৌকে স্মরণ করে।
***
দিল্লির বাদশা মুহম্মদ শা, দ্বিতীয় আকবরের (ইনিই রামমোহনকে বিলেত পাঠান) পুত্র মিরজা জাহাঙ্গির, ঐতিহাসিক বরণী, আকবরের প্রধানমন্ত্রী আগা খান (হুমায়ুন কৃতজ্ঞ হয়ে এঁর স্ত্রীকে আকবরের দুধ-মা নিযুক্ত করেছিলেন), আকবরের দুধ-ভাই আজিজ কোকতাশ, নাদির শার এক পুত্রবধূ যিনি দিল্লিতে মারা যান, এরকম বহু লোক তাদের দেহরক্ষা করেছেন পীর নিজাম উদ-দীনের গোরের আশেপাশে। স্থাপত্যের দিক দিয়ে এঁদের অনেকেরই কবর তুলনীয় সেকথা আরেকদিন হবে।
***
নিজাম উদ-দীনের দরগায় গোরের জায়গা যোগাড় করা সহজ নয়। সম্রাটনন্দিনী জাহানারার গোর এখানেই। দৈর্ঘ্যে ১৩ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রন্থে ১১ ফুট ৬ ইঞ্চি। এইটুকু জায়গায় জন্য তিনি তিন কোটি টাকা দাম হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করে প্রমাণ করলেন, ভ্রাতার হক দুই-তৃতীয়াংশ টাকার ওপর। তাই তিনি দাম দিলেন এক কোটি।
কবরের কাছে ফারসিতে লেখা :
বগৈরে সবজে ন পুশদ কসি মজার মরা,
কে কর-পুশে গরিবা হমি গিয়া বস্ অন্তু।
বহুমূল্য আভরণে করিয়ো না সুসজ্জিত
কবর আমার
তৃণ শ্রেষ্ঠ আভরণ দীনা আত্মা জাহানারা
সম্রাট-কন্যার।
[আনন্দবাজার পত্রিকা ২৩.০১.১৯৫২]
.
হ য ব র ল
০১.
সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদের পক্ষ হইতে অর্থসাহায্য চাওয়া হইয়াছে।
সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদের সহকারী সভাপতি শ্ৰীযুত জানকীনাথ শাস্ত্রী লিখিতেছেন–
পূর্বে পরিষদে উপযুক্ত মেধাবী ছাত্রদিগকে আহার ও বাসস্থান দিয়া অধ্যয়নের সুযোগ দেওয়া হইত। কিন্তু বর্তমানে জরুরি অবস্থায় আর্থিক অসুবিধার জন্য সে ব্যবস্থা রহিত করিবার উপক্রম হইয়াছে। যদি তাহাই করিতে হয় ও মেধাবী ছাত্রেরা সংস্কৃত অধ্যয়ন ত্যাগ করে, তবে পরিষদ চলিবে কাহাদের লইয়া? ধনী মেধাবী ছাত্র তো বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। দেশের বিত্তশালীদের বিবেচনা করিতে অনুরোধ করি যে, আজও বাজারে যে সমস্ত সংস্কৃত পুস্তকরাজি পাওয়া যায়, তাহা কাহার অধ্যবসায়ের ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সংস্কৃতের জন্য কতটুকু করিয়াছেন ও এইসব চতুম্পাঠী, টোল পরিষদ কতটুকু করিয়াছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা তো দুইখানা কাব্য তিনখানা নাটক লইয়া নাড়াচাড়া করেন, ভারতীয় দর্শনের জন্য তো রহিয়াছেন ইংরেজিতে রাধাকৃষ্ণণ ও দাশগুপ্ত। সরকার সাহায্যবর্জিত দেশীয় এই প্রতিষ্ঠানগুলি ও ইয়োরোপের, বিশেষত জর্মন পণ্ডিতমণ্ডলীই তো সংস্কৃতের শতকরা ৯৫ খানি পুস্তক বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও যাহারা দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত হিসাবে গণ্য হইয়াছেন, তাহাদের মধ্যে কয়জন টুলো আর কয়জন নির্জলা মেড ইন বিশ্ববিদ্যালয়? উইনটারনিক্স-লেভিকে যেসব হিন্দু ও জৈন পণ্ডিতের দ্বারস্থ হইতে দেখিয়াছি, তাহারা তো খাঁটি টুলো। অনেকে ইংরেজি পর্যন্ত জানিতেন না। এ যুগের জ্ঞানীদের শিরোমণি প্রাতঃস্মরণীয় দ্বিজেন্দ্রনাথও তো টুলো।
আশ্চর্য যে, পাঠান-মুঘল যুগের ভিতর দিয়া চতুম্পাঠী, টোল সুস্থ শরীরে বাহির হইয়া আসিল। পণ্ডিতেরা অধ্যয়ন অধ্যাপনা করিলেন, পাণ্ডুলিপি বাঁচাইয়া রাখিলেন, নতুন টীকা-টিপ্পনী লিখলেন আর আজ ধর্মগন্ধ-বিহীন সদাশয় ইংরেজের আমলে, দেশে যখন জাত্যাভিমান বাড়িয়াছে, জাতীয়তাবাদের জয়পতাকা উড্ডীয়মান, দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হইবার জন্য হার্দিক প্রচেষ্টা সর্বত্র জাজ্বল্যমান, তখন অর্থাভাবে আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলি লোপ পাইতে বসিয়াছে। যদি লোপ পায়, তবে এ-ও বলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সংস্কৃতের বৈদগ্ধ্য বাঁচাইয়া রাখিতে সম্পূর্ণ অক্ষম।
***
এই সম্পর্কে আরেকটি কথা মনে পড়িল। কুলোকের বসায় পড়িয়া সেদিন বায়স্কোপে গিয়াছিলাম একখানা পৌরাণিক ছবি দেখিতে। যাহা দেখিলাম, সে সম্বন্ধে মন্তব্য না করাই প্রশস্ত। কিন্তু একটি জিনিস লক্ষ করিলাম। হিন্দিতে যে সংস্কৃত শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ হয় তাহা বাঙালি শ্রোতা দিব্য বুঝিতেছেন ও অর্ধশিক্ষিতা বাঙালি অভিনেত্রীরাও দিব্য শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে মন্ত্র পড়িতেছেন। তাহা হইলে কি বাঙলা দেশের স্কুল-কলেজে এখনও শুধু সংস্কৃত উচ্চারণ শিখাইবার সময় হয় নাই? মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কাশী হইতে পণ্ডিত আনাইয়া বাঙালিকে বেদমন্ত্র শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করিতে শিখাইয়াছিলেন। সে ঐতিহ্য আজ ক্ষীণ। মফঃস্বলের ব্ৰহ্মমন্দিরে সংস্কৃত উচ্চারণে বাঙলা পদ্ধতি আবার আসর জমাইয়াছে। বোম্বাইয়ের স্টুডিয়োর আবহাওয়া যদি বাঙালি অভিনেত্রীকে সংস্কৃত উচ্চারণ শিখাইতে পারে, তবে বাংলা দেশের স্কুল-কলেজ তাহা পারে না, সে কি বিশ্বাসযোগ্য?
গুরুজনদের মুখে শুনিয়াছি, গিরিশবাবুর কোরানের তর্জমা এককালে নাকি বহু হিন্দু পড়িতেন এবং তখন নাকি সে তর্জমার কদর হিন্দুদের মধ্যে বেশি ছিল; কারণ মুসলমানেরা তখনও মনস্থির করতে পারেন নাই যে, কোরানের বাংলা অনুবাদ করা শাস্ত্রসম্মত কি না।
পরবর্তী যুগে মীর মশাররফ হোসেন সাহেবের বিষাদ-সিন্ধু বহু হিন্দু পড়িয়া চোখের জল ফেলিয়াছেন (পুস্তকখানা প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থ নহে; অনেকটা পুরাণ জাতীয়, বিস্তর অবিশ্বাস্য অলৌকিক ঘটনায় পরিপূর্ণ)। ইতোমধ্যে রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিলেন। পরবর্তী যুগে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন দত্ত, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, মণি গঙ্গোপাধ্যায় আরবি-ফারসি শব্দযোগে তাদের লেখায় কিঞ্চিৎ মুসলমানি আবহাওয়ার সৃষ্টি করিয়াছেন। শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ইহারা লোকপ্রিয়তা হারাইলেন। তার পর আসিলেন নজরুল ইসলাম। সাধারণ বাঙালি হিন্দু তখন প্রথম জানিতে পারিলেন যে, মুসলমানও কবিতা লিখিতে পারেন; এমনকি, উক্তৃষ্ট কবিতাও লিখিতে পারেন। কাজী সাহেবের কবিতার ব্যঞ্জনা বুঝিবার জন্য প্রচুর হিন্দু তখন মুসলমান বন্ধুদের শহিদ কথার অর্থ, ইউসুফ কে, কানান কোথায় জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কাজী সাহেব তাহার ধূমকেতু কাগজে মুসলমান সমাজের পঙ্কিল দিকটা যত না আক্রমণ করিলেন, তাহার অপেক্ষা বহু কম করিলেন ইসলামের সুন্দর ও মঙ্গলের দিকের বর্ণনা। ইতোমধ্যে মৌলানা আকরম খান প্রমুখ মুসলমান লেখকেরা ইসলাম ও তত্সম্বন্ধীয় নানা পুস্তক লিখিলেন। খুব কম হিন্দুই সেগুলি পড়িয়াছেন। তখনও মাসিক মোহাম্মদীতে ভালো ভালো প্রবন্ধ বাহির হয়, কিন্তু সাধারণ হিন্দু মোহাম্মদী কিনেন না; বিশেষত পদ্মার এপারে। সুখের বিষয়, মৌলবি মনসুরউদ-দীনের হারামণিতে সংগৃহীত মুসলমানি আউল-বাউল-মুরশিদিয়া গীত হিন্দু-মুসলমান গুণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ লইয়া সঞ্চয়নখানি প্রকাশিত হয়।
বাঙালি-হিন্দু মুসলমানদের দ্বারা লিখিত পুস্তক যে পড়েন না বা কম পড়েন, তাহার জন্য তাঁহাদের সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না। কারণ মুসলমানদের ভিতর শক্তিমান লেখক বড় কম। একবার ভাবিয়া দেখিলেই হয় যে, আজ যদি কোনও মুসলমান শরাবুর মতো সরল ভাষার মুসলমান চাষি ও মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি আঁকেন, তবে কোন হিন্দু না পড়িয়া থাকিতে পারিবেন। আরব্যোপন্যাসের বাংলা তর্জমা এখন হাজার হাজার বিক্রয় হয়– যদিও তর্জমাগুলি অতি জঘন্য ও মূল আরবি হইতে একখানাও এযাবৎ হয় নাই, আর সয়ীদ আইয়ুবের লেখা কোন বিদগ্ধ বাঙালি অবহেলা করেন? কিন্তু তিনি সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্বন্ধে প্রবন্ধ লেখেন; মুসলমান জীবন অঙ্কিত করা বা মুসলমানি কৃষ্টি বা সভ্যতার আলোচনা তিনি করেন না। বাঙালি কবীরকে কে না চিনে?
মুসলমানদের উচিত কোরান, হদিস, ফিকাহ, মহাপুরুষ মুহম্মদের জীবনী (ইবনে হিসামের উপর প্রতিষ্ঠিত) মুসলিম স্থাপত্য শিল্পকলা ইতিহাস (বিশেষ করিয়া ইবনে খলদুন), দর্শন, কালাম ইত্যাদি ইত্যাদি–কত বলিব সম্বন্ধে প্রামাণিক, উকৃষ্ট সরল সস্তা কেতাব লেখা। লজ্জার বিষয় যে, ফারসিতে লেখা বাঙলার ভূগোল-ইতিহাস বাহার-ই-স্তানে গাইবির বাঙলা তর্জমা এখনও কেহ করেন নাই।
শুনিতে পাই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইসলামিক কালচার বিভাগ আছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু অধ্যাপকেরা নানারকম পুস্তক প্রবন্ধ বাঙলায় লিখিয়া বিশ্ব বিদ্যালয় নাম সার্থক করেন। মুসলমান অধ্যাপকেরা কি লেখেন? লিখিলে কি উজবেকিস্থানের ভাষায় লেখেন?
মুসলমানদের গাফিলি ও হিন্দুদের উপেক্ষা আমাদের সম্মিলিত সাহিত্য-সৃষ্টির অন্তরায় হইয়াছে। দুইজন একই ভাষা বলেন; কিন্তু একই বই পড়েন না? কিমাশ্চর্যমতঃপর!
[আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫.৮.১৯৪৫]
.
০২.
এক ইন্দো-আমেরিকান আড্ডায় ছিটকাইয়া গিয়া পড়িয়াছিলাম। আড্ডাধারীরা এ-কোণে ও-কোণে তিন-চার জনায় মিলিয়া ঘোট ঘোট দয়ের সৃষ্টি করিয়া হরেকরকম বিষয়ে আলাপচারী করিতেছিলেন। আর যে কোণে গিয়া পড়িয়াছিলাম সেখানে একজন মার্কিন দুঃখ করিয়া সেই সনাতন কাহিনী বলিতেছিলেন, গাড়িওয়ালারা বিদেশিদের কীরকম ধাপ্পা দেয়, দোকানিরা কীরকম পয়সা মারে, টিকিট কাটিতে হইলে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষটায় বলিলেন, অদ্ভুত দেশ, ফার্স্ট ক্লাস গাড়িতে পর্যন্ত মুখ ধুইবার জন্য সাবান-ভোয়ালে থাকে না; জিজ্ঞাসা করিলে রেল কর্মচারী বলে, যদি রাখা হয় আধঘণ্টার ভিতর সাবান-তোয়ালে কর্পূর হইয়া যাইবে। আমি উষ্মর সহিত একটা ঝাঁজালো উত্তর দিব দিব করিতেছি এমন সময় একটি জর্মন মহিলা বলিলেন, জর্মনিতে থার্ড ক্লাসেও সাবান-তোয়ালে থাকে ও সেগুলি চুরি যায় না। কিন্তু দুরবস্থার সময় এই নিয়ম খাটে না। ১৯১৮ সনে জর্মনির দৈন্য এমন চরমে পৌঁছিয়াছিল যে, সাবান-তোয়ালে মাথায় থাকুক গাড়ির সর্বপ্রকার ধাতুর তৈয়ারি রড, হ্যান্ডল, হক, কব্জা পর্যন্ত উপিয়া গিয়াছিল। জর্মনি হুনরি-কারিগরদের সকলেই ড্রাইভার-স্প্যানার চালাইতে ওস্তাদ। শেষ পর্যন্ত কার অভাবে গাড়িগুলির দরজা পর্যন্ত ছিল না। অথচ সেই জর্মনিতেই ১৯২৯ সালে কেউ যদি ভুলে বাথরুমে হাতঘড়ি ফেলিয়া আসিত তবে নির্ঘাৎ ফেরত পাইত। উত্তর শুনিয়া মার্কিনের চোখের উলটা দিক বাহির হইয়া আসিল। বলিলেন, কই, আমাদের দেশে তো এমনটা এখনও হয় নাই। আমি বলিলাম ব্রাদার, তোমরা আর দৈন্য দেখিলে কোথায়? মনে পড়িল হেম বাড়য্যের শেক্সপিয়ারের তর্জমা,
অঙ্গে যার অস্ত্রাঘাত হয়নি কখন,
হাসে সেই ক্ষতচিহ্ন করি দরশন।
***
বাড়ি ফিরবার সময় ওই খেই ধরিয়া অনেক কিছু ভাবিলাম। যান্ত্রিক সভ্যতা তো আমাদের হয় নাই। আমাদের যা কিছু বৈদগ্ধ্য-ঐতিহ্য-সভ্যতা এককালে ছিল তাহা বিরাজ করিত গ্রামের সরল অনাড়ম্বর জীবনকে জড়াইয়া। কৃষ্টির দিক দিয়া গ্রামগুলি তো উজাড় হইয়াছে কারণ গ্রামের কোনও মেধাবী ছেলে যদি কোনও গতিকে বিএ পাস করিতে পারে, তবে সে তো আর গ্রামে ফিরিয়া যায় না। গ্রাম তাহাকে কী চাকরি দিবে? ১২ টাকার স্কুলমাস্টারি, না ১৫ টাকার পোস্টমাস্টারি? এত কাঠখড় পোড়াইয়া, বুকের রক্ত জল করিয়া, স্বাস্থ্য বরবাদ করিয়া বিএ পাস করিল কি কুল্লে ১৫ টাকার জন্য? সে আর গ্রামে ফিরে না। সার শহরে চলিয়া যায়, তুষ ধামে পড়িয়া থাকে। অথচ একশত বৎসর পূর্বেও গ্রামের হিন্দু ছেলে নবদ্বীপ ভট্টপল্লি, কাশীতে অধ্যয়ন করিয়া দিগগজ পণ্ডিত হইয়া গ্রামেই ফিরিত; সেইখানেই বাস করিত। মুসলমান ছেলে দেওবন্দ, রামপুর পাস করিয়া ওস্তাদ-দত্ত মস্ত পাগড়ি পরিয়া সেই গ্রামেই ফিরিয়া আসিত, সেই গ্রামেই বাস করিত। তাঁহারাই গ্রামের চাষি-মজুরকে ধর্মপথে চলিবার অনুপ্রেরণা দিতেন।
গ্রামে শিক্ষাদীক্ষা আজ নাই, তবু তো চাষা-মজুর পশু হইয়া যায় নাই। আমি বহু কর্মীকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি, কিন্তু কেহই একথা বলেন নাই যে, দুর্ভিক্ষের সময় আমাদের চাষারা কুকুর-বিড়াল খাইয়াছে। কুকুরের সঙ্গে খাদ্য লইয়া কাড়াকাড়ি করিয়াছে কিন্তু এ সমাধান তাহার মাথায় আসে নাই যে, কুকুরটাকে মারিয়া তো জঠরানল নিবানো যায়! আরও শুনিয়াছি যে, গোরা সিপাহি টিনের খাদ্য ছুড়িয়া দিলে হিন্দু-মুসলমান স্পর্শ করে নাই; পাছে গরু বা শুয়োর খাইতে হয়।
অথচ সভ্যতার শিখরে উপবিষ্ট প্যারিস শহরের বাসিন্দারা নাকি দুর্দিনে কুকুর-বিড়াল। ইস্তক চড়ইপাখি পর্যন্ত সাফ হজম করিয়া ফেলিলেন।
ধর্মের গতি সূক্ষ্ম; কে সভ্য কে অসভ্য কে জানে?
[আনন্দবাজার পত্রিকা ১.৯.১৯৪৫]
.
০৩.
সেই ইন্দো-মার্কিন মজলিসের আরেক কোণে যখন ঘুরিতে ঘুরিতে পৌঁছিলাম, তখন শুনি এক মার্কিন বলিতেছেন, যাকে জিগ্যেস কর সেই বলে “টেগোর পড়–গিট্যাঞ্জলি, গাড়না, চিন্তা”; পড়েছি, সুখ পেয়েছি। কিন্তু আমি চিত্রকর, তোমাদের দেশে কেউ ছবি-টবি আঁকে না? আমি বলিলাম, কী অদ্ভুত প্রশ্ন, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, অসিত হালদার ও নন্দলালের চেলা রমেন্দ্র চক্রবর্তী, বিনোদ মুখোপাধ্যায়, বিনায়ক শিবরাম মশোজি, রামকিঙ্কর বহিজ– এঁদের নাম শোনোনি? মার্কিন বলল, “ওই তো বিপদ, সকলেই বলে “নাম শোনোনি?” নাম তো বিস্তর শুনেছি। কিন্তু এদের ছবির অ্যালবাম কই– এক চক্রবর্তী ছাড়া! ১৫ থেকে ২০ টাকার ভিতর তুমি আমাদের যে কোনও গুণীর– দা-ভিঞ্চি, রেমব্রান্ত, সেজান্– যারি চাও উৎকৃষ্ট অ্যালবাম পাবে। ইস্তেক তোমাদের দেশের বাজার এগুলোতে ছয়লাপ করে রেখেছিল, যখন লড়াইয়ের গোড়ার দিকে এদেশে আসি। এই যে এঁদের নাম করলে, দাও না কারু “কমপ্লিট ওয়ার্কস”? বেশি দরকসর করব না– আমরা কারবারি, আদ্ধেকেই দাও না?
নতমস্তকে ঘাড় চুলকাইয়া টালবাহানা দিলাম, লড়াইয়ের বাজার; জাপানি-জর্মন প্রিন্টিং বন্ধ; লড়াইয়ের পরে। আমেরিকানটি ভদ্রলোক। লড়াইয়ের পূর্বে অ্যালবাম ছিল কি না সে বিষয়ে অতিরিক্ত অন্যায় কৌতূহল দেখাইয়া আমাকে বিপদগ্রস্ত করিলেন না।
শুনিতে পাই, সেই একমাত্র চিত্রকর যাহার অ্যালবাম পাওয়া যায়, সরকারের ব্যবহারে ত্যক্ত হইয়া অধ্যাপকের কর্ম ছাড়ি-ছাড়ি করিতেছেন। কারবারি মার্কিন চিত্রকর চিনে, কলচরড বাঙলা সরকার চিনে না।
***
যুদ্ধের ফলে নানা অপকার, নানা উপকার হইয়াছে। তাহার খতিয়ান করিবার সময় এখনও আসে নাই। তবু একটি জিনিসের কথা ভাবিলেই মন উৎফুল্ল হইয়া উঠে। আসাম হইতে চীনে মোটরে যাইতে পারিব।
হিউয়েন সাং মঙ্গোলিয়া, তুর্কিস্থান, কাবুল হইয়া ভারতবর্ষ আসেন। অসহ্য কষ্ট তাহাকে সহিতে হইয়াছিল, ত্রিশরণ তাঁহার সহায় না হইলে সে অসম্ভব দুস্তর মরুভূমি, সঙ্কটময় হিন্দুকুশ উত্তীর্ণ হইয়া তিনি তথাগতের পুণ্যভূমিতে পৌঁছিতে পারিতেন না। ভারতবর্ষে তিনি কাশ্মির, তক্ষশিলা, বিহার হইয়া বারেন্দ্রভূমি পর্যন্ত আসেন। সেখানে কামরূপের হিন্দুরাজার নিমন্ত্রণ পান। প্রথমে কিঞ্চিৎ সন্দিগ্ধচিত্তে যাওয়া না-যাওয়া সম্বন্ধে মনে মনে বিচার করিয়া শেষ পর্যন্ত লোভ সম্বররণ করিতে পারিলেন না।
কামরূপের রাজা তাহাকে উচ্চ পাহাড়ে তুলিয়া পূর্বদিকে হস্তপ্রসারণ করিয়া বলিলেন, ওই তো আপনার দেশ। আমার কতবার মনে হয়, আপনার দেশ একবার দেখিয়া আসি কিন্তু এদিকে কোনও পথ এখন নির্মিত নাই।
দেশের দিকে তাকাইয়া ভিক্ষু হিউয়েন সাংয়ের হৃদয় বিকল হইয়া গিয়াছিল। এত কাছে, অথচ এত দূরে! দুঃখ করিয়া ভাবিয়াছিলেন পথটি যদি থাকিত, তবে কত শীঘ্র কত অল্প কষ্টে তিনি আত্মজনের কাছে উপস্থিত হইতে পারিতেন।
বর্ষার নির্মম বৃষ্টির অবিশ্রান্ত আঘাতে এই রাস্তার মেরুদণ্ড ভাঙিয়া দেয়। তৈয়ারি হইয়াছে বটে, কিন্তু সরকার সেটিকে চালু রাখিবেন কি না বলিতে পারি না। যদি থাকে, নানা সুবিধার মধ্যে ভারত-চীনে মধ্যস্থতাবিহীন সরল (পথ কুটিল হওয়া সত্ত্বেও) যোগসূত্র অবিচ্ছিন্ন রহিবে। আমরা মনের আনন্দে চীন ঘুরিয়া আসিব। হিউয়েন সাংয়ের আত্মা সন্তোষ লাভ করিবে।
***
স্থলপথ দিয়া বন্ধ ভারত হইতে আরেকটি জায়গায় অল্পায়াসে যাওয়া যায়– সে কাবুল। শরৎকাল আসিয়াছে, তাই মনে পড়িল। এখন সেখানে ফল পচিতেছে, খাইবার লোক নাই।
ধনীরা শিলং যান, মুসৌরি-সিমলা যান, কাশির পর্যন্ত অনেকে ধাওয়া করেন, কিন্তু কাহাকেও কাবুল যাইতে দেখি না। অথচ যাওয়া যে খুব কষ্টকর তাহা নহে। পেশাওয়ার হইতে কাবুল মাত্র দুই শত মাইল মোটরপথ। প্রথম কুড়ি মাইল, খাইবার পাশের ভিতর দিয়া– সে কী অপূর্ব, রুদ্র দৃশ্য! দুই দিকে হাজার ফুট উচ্চ প্রস্তর গিরি দুশমনের মতো দাঁড়াইয়া নিচে সরু আঁকাবাঁকা রাস্তার উপর দিয়া কত চিত্র-বিচিত্র পোশাক, পাগড়ি পরিয়া কাফেলা-ক্যারেভান কাবুল চলিয়াছে, মাজার-ই-শরিফ চলিয়াছে, আমুদরিয়া পার হইয়া বোখারা যাইবে-আসিবে। এদিকে গজনি-কান্দাহার হইয়া হয়তো হিরাত পর্যন্ত যাইবে আসিবে। ঘোড়া-গাধা-উটের পিঠে কত রঙয়ের কার্পেট, কত ঝকঝকে সামোভার, কত কারাকুলি পশম। সন্ধ্যায় নিমলা পৌঁছিবেন সেখানে শাহজাহান বাদশার তৈয়ারি চিনার (সাইপ্রেস জাতীয়) বাগানের মাঝখানে নয়ানজুলির পাশে চারপাইর উপর না-গরম-না-ঠাণ্ডায় রাত কাটাইবেন– জলের কুলকুল শুনিয়া। ব্রাহ্মমুহূর্তে হাজার হাজার নরগিস (নারসিসস) ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে সুগন্ধে সঞ্জীবিত হইয়া চেতনালোকে ফিরিয়া আসিবেন।
সেইদিন বিকালে কাবুল। পথের বর্ণনাটা আর দিলাম না। যে একবার দেখিয়াছে ভুলিবে না। শরতের কাবুল কোনও হিল স্টেশনের নূন তো নহেই– অনেকাংশে উত্তম। প্রচুর ফল, উক্তৃষ্ট দুম্বার মাংস, হজমি পানীয় জল, রুদ্র-মধুর দৃশ্য ও কাবুলির সরল সহৃদয় বন্ধুত্ব। ঐতিহাসিক চিন্তার খোরাক পাইবেন বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী মোগল রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, বাবুর বাদশাহের দীন স্নান কবর কাবুলের পর্বতগাত্রে দেখিয়া।
***
অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু না বলিয়া থাকিতে পারিতেছি না। ট্রামে প্রায়ই দেখি অসম্ভব ভিড়, অথচ চারিটি মহিলা চারিটি লেডিজ-বেঞ্চে আরামে বসিয়া আছেন। বসুন, আপত্তি নাই। কিন্তু যদি চারিটি মহিলা দুইখান বেঞ্চিতে বসিতেন, তবে অন্তত মহিলা না আসা পর্যন্ত চারিজন বৃদ্ধ বা ক্ষুদ্র ওই খালি দুই বেঞ্চিতে বসিতে পারেন বা পারে। কোনও কোনও মেয়ে বলেন, ট্রামে-বাসে ছেলেরা অভদ্র; ছেলেরা বলিবে মেয়েরা নির্মম।
লক্ষ করিয়াছেন যে, আজকাল ট্রামে-বাসে ছেলে-বুড়ো কমিয়া গিয়াছেন। ইহারা কলিকাতার এক স্থান হইতে অন্য স্থানে যান কী প্রকারে, এখনও বুঝিয়া উঠিতে পারি না।
[আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫.৯.১৯৪৫]
.
০৪.
মহাত্মা গান্ধী কয়েকদিন হইল কস্তুরবা স্মৃতিরক্ষা কমিটিতে বলেন, গ্রামের কুটিরগুলিতে আলোক স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা আনিবার জন্যই কস্তুরবা স্মৃতি ভাণ্ডারের উৎপত্তি। গ্রামের স্ত্রীলোকদিগকে মানসিক, দৈহিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেওয়া কর্তব্য। বনিয়াদি শিক্ষা বলিতে ইহাই বুঝায়। মহাত্মাজির প্রত্যেকটি কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।
এই উপলক্ষে আমরা একটি বিষয়ের দিকে সকলের দৃষ্টি সবিনয় আকর্ষণ করি। যদি গ্রামে উপযুক্ত শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কোনওপ্রকার কুটিরশিল্পও প্রর্বতন করা যায় তবে গ্রামের উৎপাদনী শক্তি ও সঙ্গে সঙ্গে ক্রয় করিবার ক্ষমতা বাড়িবে। তবে প্রশ্ন এই যে, শহরের উন্নত কলকজা দিয়া যেসব জিনিস প্রস্তুত হইবে তাহার সঙ্গে কুটিরশিল্প প্রতিযোগিতা করিতে পারিবে না। জাপান এই সমস্যার সমাধান করিয়াছিল গ্রামের কুটিরশিল্পের সঙ্গে শহরের কারখানার ঘনিষ্ঠ যোগস্থাপন করিয়া। অর্থাৎ যন্ত্ৰজাত মালের অনেক ছোট ছোট অংশ এমন আছে সেগুলি গ্রামে বসিয়া অবসর সময়ে হাত দিয়া তৈয়ারি করা যায় বিশেষ বিচক্ষণতা বা অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। শহরের কারখানাই কুটিরকে কাঁচামাল ও টুকিটাকি যন্ত্রপাতি দেয় ও কারখানাই কুটিরে তৈয়ারি মাল সংগ্রহ করিবার ভার নেয়। কাজেই কুটিরশিল্পী এই ধান্দা হইতেও রক্ষা পায় যে গ্রামের বাজারে তাহার তৈয়ারি মাল কিনিবে কে? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব ডাইরেক্টার শ্রীযুক্ত মণিলাল নানাবটী এককালে জাপানে এই সমস্যা সমাধানটি বিশেষ করিয়া পরীক্ষা করিয়া এদেশে ফিরিয়া এ সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন। বাংলা দেশের কয়েকজন যুবাকেও আমরা চিনি যাহারা বহু কলা শিখিয়া আসিয়াছেন। হয়তো তাঁহারাও এই বিষয়টি আলোচনা করিয়াছেন।
কস্তুরবা ফাণ্ডের অর্থ ব্যয় করিয়া শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে যদি কোনও কুটিরশিল্প প্রবর্তন করা হয় তবে তাহার জন্য আলাদা খবচ করিতে হইবে না। এইটি বিশেষ সুবিধা।
[আনন্দবাজার পত্রিকা ২২.৯.১৯৪৫]
.
০৫.
ছেলেবেলার একটি কবিতা মনে পড়িল, প্রাকশরতের বর্ণনা–
অনিচ্ছায় ভিক্ষা দেয় কৃপণ যেমতি
পড়ে জল সুবিরল সূক্ষ্মধার অতি।
সদাশয় সরকার যে কায়দায় রাজবন্দিদিগকে মুক্তি দিতেছেন, তাহাতেই কবিতাটি মনে পড়িল। সেদিন একজন অধুনা-নিষ্কৃতিপ্রাপ্ত রাজনৈতিক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, জেলে কীরকম দিন কাটিল? বলিলেন, প্রথম তিন বৎসর ভালই, কারণ মন স্থির করিয়া লইয়াছিলাম যে, সরকার যখন আর কখনও ছাড়িবেই না, তখন দুঃখে সুখে এইখানেই বাকি জীবনটা কাটাই। হঠাৎ দেখি সরকার ইহাকে ছাড়ে, উঁহাকে ছাড়ে। বন্ধু-বান্ধবীদিগের সঙ্গসুখ হইতে বঞ্চিত করিয়া সরকার একবার জেলে পুরিল, তার পর জেলের ভিতরে যাহাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হইল (তাহারাই তো প্রকৃত বন্ধু চাণক্য বলিয়াছেন, রাজদ্বারে যে সঙ্গে তিষ্ঠে সে বান্ধব, এ তো তারও বাড়া একেবারে ভিতরে, কারাগারে) তাহারাও একে একে চলিয়া যাইতে লাগিলেন। তখন দ্বিতীয়বার বন্ধুবিচ্ছেদ– ডবল জেল। খালাস পাইবার সময় আবার অনেক বন্ধুকে ফেলিয়া আসিয়াছি। এখন তেহারা জেলের সুখ পাইতেছি।
সরকারের অবৈতনিক মুখপাত্র হিসাবে বলিলাম, মেলা বন্ধুত্ব করা ভালো নয়। তোমাদের শঙ্কারাচার্যই বলিয়াছেন।
বন্ধু বলিলেন, বাড়ি গিয়া দেখি, মা একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছেন। শয্যাগ্রহণ করিয়াছেন। শুনিলাম, প্রথম তিন বৎসর ঠিক পাড়া ছিলেন, কিন্তু শেষের একমাস আশা-নিরাশায় দুলিয়া, অপেক্ষা করার ক্লান্তিতে, কে কে খালাস পাইয়াছে, কে কে পায় নাই, তাহাদের সঙ্গে মিলাইয়া আমার মুক্তির সম্ভাবনা কতটুকু হিসাব করিতে করিতে একদিন শয্যাগ্রহণ করিলেন। সংস্কৃত প্রবাদটি বুঝিলাম যে, অধমের নিকট হইতে নিষ্কৃতি পাইয়াও সুখ নাই।
শুনিতে পাই বড় কর্তাদের কেহ কেহ নাকি বলিয়াছেন। পূজার পূর্বে অথবা পরে সকলেই খালাস পাইবেন। পূজার বিশেষ করিয়া পূজার পূর্বে ও পরে নিষ্কৃতিতে যে কী নিদারুণ পার্থক্য তাহা বুঝিবার মতো বাঙালি কি বড় দপ্তরে কেহই নাই।
***
মৌলানা আকরম খাঁ সাহেব সরকারকে হজযাত্রীদের সুবিধা করিয়া দিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছেন।
মোগল বাদশাহ আকবর গুজরাট জয় করিলে পর মোগলরা প্রথম সন্দ্র দর্শন করে, প্রথম সমুদ্রবন্দর তাহাদের হাতে আসে। সেই বৎসরই হুমায়ুনের বিধবা মহিষী ও হারেম মহিলারা সুরট বন্দর হইতে নৌকাযোগে মক্কা যান। স্থলপথে যাওয়া বিপদসঙ্কুল ছিল বলিয়া ইতোপূর্বে মোগল মহিলারা কখনও হজ যাইতে পারেন নাই। কিছুদিন পরেই আকবর একজন মির উল হাজ অর্থাৎ হজ অফিসার (ইংরেজ সরকার যেন না ভাবেন যে তাহারাই সর্বপ্রথম এই সকর্মটি করিয়াছেন) নিযুক্ত করেন। আহমদাবাদবাসী সম্ভ্রান্ত পীর বংশীয় মির আবু তুরাব বহু হজযাত্রী ও ভারত সরকারের তরফ হইতে দশ লক্ষ টাকা সঙ্গে লইয়া সুরটের বন্দর-ই-হজ (তাপ্তি নদীতে একটা ঘাট এখনও এই নামে গুজরাতে সুপরিচিত) হইতে পাল তুলিয়া মক্কা পৌঁছোন। ভারত সরকারের পক্ষ হইতে ওই অর্থ মক্কার শরিফ (গভর্নর), আলিম উলেমা (পণ্ডিত-শাস্ত্রী) ও দীনদুঃখীদিগকে অতি আড়ম্বরে ও বদান্যতার সহিত বন্টন করা হয়। মক্কায় ভারতের জয়ধ্বনি উঠে; ভারতের হাজিরা সর্বত্র রাজার আদর পান। ফিরিবার সময় আবু তুরা পয়গম্বরের পদচিহ্নিত একখানা পবিত্র প্রস্তর আনয়ন করেন। আকবর নামায় বর্ণিত আছে বাদশাহ আকবর সেই প্রস্তরকে সম্মান প্রদর্শন করিবার জন্য আপন স্কন্ধে বহন করিয়াছিলেন। প্রস্তরখানি অদ্যাপি আহমদাবাদে আছে।
যতদূর মনে পড়িতেছে, হৃতগর্ব মোগল সম্রাট রফি-উদ্-দরজাতের সময় পর্যন্ত বৎসর বৎসর মির উল হাজ সরকারের পক্ষ হইতে অর্থ লইয়া মক্কা যাইতেছেন। মিরাত-ই-অহমদি নামক ফারসিতে লিখিত গুজরাতের ইতিহাসে এই সম্বন্ধে অতি চিত্তাকর্ষক বর্ণনা আছে। পুস্তকখানির লেখক আলি মহম্মদ খান গুজরাত সুবার দেওয়ান বা রাজস্বসচিব ছিলেন। তখনকার দিনে রাজনীতি ও ধর্মনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত ছিল বলিয়া এই অর্থব্যয়কে অপব্যয় মনে করা হইত না। আজও পৃথিবীর যেকোনো এম্বেসি বিদেশে ইহা অপেক্ষা বেশি অর্থের অপব্যয় করেন।
ভারত যদি আজ স্বাধীন হইত তবে আকরম খাঁ সাহেবের মতো মৌলানার ধর্মেচ্ছা সরকার সানন্দে পূর্ণ করিতেন। মৌলানা সাহেবকে মুখ খুলিয়া বলিবার প্রয়োজনই হইত না।
[আনন্দবাজার পত্রিকা ৬.১.১৯৪৫]
.
০৬.
লিখিতে মন চায় না। যেসব বন্ধুরা জেল হইতে খালাস পাইয়া আসিয়াছেন, তাঁহাদের অবস্থা দেখিয়া ও তাহাদের কারাকাহিনী শুনিয়া নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মে, মনে হয় এই অর্থহীন প্রলাপের কী প্রয়োজন? জানি, সহৃদয় পাঠকবৃন্দ অধমের লেখা সহ্য করেন, কেহ কেহ পত্র লিখিয়া তাহাকে উৎসাহিত করেন, কিন্তু যেসব কাহিনী শুনি, নিষ্কৃতদের যে ভগ্নস্বাস্থ্য দেখি তখন সে কাহিনী, সে অবস্থা সত্যের লেখনী সংযোগে পাঠকের হৃদয়মনে সঞ্চারিত করিতে পারি না বলিয়া বহু বত্সরে যে সামান্য সাধনা-অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছি, তাহা পণ্ডশ্রম বলিয়া ধিক্কার দিই।
নিষ্কতদের অভিজ্ঞতা এতই সহজ, এতই সরল যে, তাহা প্রকাশ করিতে গিয়া বাক্যালঙ্কার বিড়ম্বিত, মার্জিত লিখনশৈলী অপমানিত।
সহৃদয় পাঠক এই ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য মার্জনা করিবেন।
***
আমার এক বন্ধু যাহাকে বলে উন্নাসিক। অতি সদর্থে। তাঁহার জ্ঞানপিপাসা এতই প্রবল, দেশের মঙ্গলেচ্ছা এতই অনাবিল যে, বিদেশীয় কয়েকটি সাহিত্যসম্পদে গৌরবান্বিত ভাষা জানা সত্ত্বেও সেসব সাহিত্যের উত্তম উত্তম কাব্য-দর্শন পড়িবার তাঁহার সময় হইত না– নাটক-নভেল মাথায় থাকুন। তুলনামূলক রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি– তাহাদের ইতিহাস ইত্যাদি পড়িতে পড়িতে তাঁহার সময় ফুরাইয়া যাইত।
কারাপীড়নে অধুনা তিনি আর কিছুতেই চিত্তসংযোগ করিতে পরিতেছিলেন না বলিয়া (সেতারখানাও ফেরত পাঠাইয়াছিলেন) আমার কাছে True Story, Detective Story জাতীয় তরল বস্তু চাহিয়া পাঠাইয়াছিলেন। দুঃখে-সুখে মিশ্রিত হৃদয় লইয়া পাঠাই। খবর পাইলাম সদাশয়, I. B, সেগুলি এ যাবৎ তাঁহাকে দেন নাই। সরকারের এই কি ভয় যে, তিনি ডিকেটটিভ গল্প হইতে আণবিক বোমা বানাইবার কায়দা রপ্ত করিয়া সর্বজনীন দাঁতব্য কারাগার প্রতিষ্ঠান লণ্ডভণ্ড করিয়া দিবেন–না টু স্টরি হইতে আদিরসাত্মক গল্প পড়িয়া তাহার চরিত্রদোষ হইবে। সরকারের হেফাজতে যখন আছেন, তখন তাঁহার চরিত্র রক্ষা করা তো সরকার-গার্জেনেরই কর্ম!
***
আরেক বন্দি ছিলেন অরসিক। তিনি একখানা biology-র প্রামাণিক পাঠ্যপুস্তক চাহিয়া পাঠান। নামঞ্জুর। কয়েকজন রাজবন্দি একযোগে কারণটি অতি বিনয় সহযোগে জানিতে চাহিলেন। উত্তরটি অক্ষরে অক্ষরে তুলিয়া দিতেছি।
মশাই, আপনারা যে কখন কী চেয়ে বসেন, তার তো ঠিক-ঠিকানা নেই। আজ এ biology, কাল ও biology পরশু সে biology!
রাজবন্দিদের কেহ দার্শনিক, কেহ ঐতিহাসিক, কেহ নৃতত্ত্ববিদ। সকলেই হতবুদ্ধি; ব্যাপারটা না বুঝিতে পারিয়া একে অন্যের মুখের দিকে তাকান। Biology যে আবার পঁচিশ কেতার হয় তাহা তো তাঁহারা কখনও শুনেন নাই!
রহস্য সমাধান হইল; I. B. নৈরাশ্যের দরদীয়া সুরে বলিলেন, কোনদিন যে শেষটার গান্ধীর biology চেয়ে বসবেন না তারই বা ভরসা কোথায়? তখন আমি কোথায় যাই বলুন তো?
I. B. বিদ্যাসাগর biology ও biography-তে মিশাইয়া ফেলিয়াছেন।
গুরু সাক্ষী, ধর্ম সাক্ষী, দোষ দিতেছি না। অত পাণ্ডিত্য না ধরিলে বড়কর্তা I. B.-র সেনসর হইবেন কেন? ইহার চেয়ে অল্প বিদ্যায়ও আইনস্টাইনকে রিলেটিভিটি শিখানো যায়, অফিসারটিকে আমরা সবিনয় সাবধান করিয়া দিতেছি। তিনি যদি হুঁশিয়ার হইয়া না চলেন, তবে একদিন দেখিবেন যে, তাহার গভীর পাণ্ডিত্যের সম্মান রক্ষার্থে অক্সফোর্ডের বড়কর্তারা তাহাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরের তখতে বসাইয়া দিয়াছেন।
আরেক বন্দি অতি সুপুরুষ। কাঁচা সোনার বর্ণ, ঢেউ খেলানো বড় বড় কালো চুল, খগের মতো নাক, আর দরাজি কপাল। যতদিন বাহিরে ছিলেন মাতা ও স্ত্রীর উৎপাতে মাঝে মাঝে দাড়ি কামাইতেন– অর্থাৎ মুখমণ্ডল ঘন-বর্ষার কদম্ব-পুষ্পের সৌন্দর্য ধারণ করিলে পর। জেলে গিয়া পরমানন্দে তিনি দাড়ি গজাইতে আরম্ভ করিলেন। সময় বিস্তর বাঁচিল, রাগ করিলে উৎপাটন করিবার সুলভ সহজ বস্তু জুটি–আর চিন্তা-বিক্ষোভের কারণ তো হামেশাই উপস্থিত হইবে।
জেলে যে অতি আরামে আছেন এই বুঝাইবার জন্য তিনি সর্বদাই পত্নীকে রসে টইটম্বুর পত্র লিখিতেন। তাহারই একখানাতে নিজের তরুণ দাড়ির বর্ণনা দিয়া বলিলেন, চেহারাটা এখন অনেকটা ক্রাইস্টের মতো হইয়াছে।
মহারানি ভিক্টোরিয়ার ইস্তেহারের কথা আমরা আর পাঁচজন প্রায় ভুলিয়া গিয়াছিলাম। সর্ব ধর্মে সকলের সমান অধিকার অথবা এইরকম কিছু একটা ঠিক মনে নাই।
I. B.-র স্মরণশক্তি পৃথিবীর ইতিহাসে বিস্ময়জনক ও হৃদিত্রাস-সঞ্চারক। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। পাছে ক্রাইস্টপন্থি কাহারও মনঃপীড়ার সঞ্চার হয়, এই ভয়ে সেনসার এন্তার দুশ্চিন্তার ভার নামাইলেন ছত্রটি গিলোটিন করিয়া।
সহৃদয় পাঠক গীতা অথবা ওই জাতীয় কোনও পুণ্যগ্রন্থে আছে না, ধর্মসংস্থাপনার্থে শ্রীকৃষ্ণ যুগে যুগে অবতীর্ণ হন?
হে biology Biography অকিরণকারী নটবর সেনসর, তোমাকে বারবার নমস্কার—
নমঃ পুরস্তাদথ পৃষ্ঠতস্তে নমোহস্তু তে সর্বত অব সর্ব
তোমাকে সম্মুখ হইতে নমস্কার, তোমার পশ্চাৎ দিকে নমস্কার তুমি যে অনন্তবীর্য অনন্তবিক্ৰম ধরো তাহাকে সন্দেহ করিবার মতো যুগ্ম-মস্তক কার স্কন্ধে?
খ্রিস্টধর্ম ওয়াজ ইন ডেঞ্জার– তুমি তারে করিলে উদ্ধার।
***
বৃথা বাক্যব্যয়। বর্তমান যুগ সাংখ্যের– অর্থাৎ Statistics-এর। তাই শুদ্ধ স্টাটিসৃটি নিবেদন করি।
১৯২০-এ অসহযোগ আন্দোলনে ভদ্রলোক যোগ দেন। ১৯২৭-এ নানাপ্রকারে প্রপীড়িত হইয়া মস্কো চলিয়া যান। ১৯২৮-এ অসুস্থ শরীর লইয়া বার্লিন। ১৯৩৩-এর কয়েক দিবস জর্মন জেল। ১৯৩৪-এ দেশে প্রত্যাবর্তন।
১৯৩৫ এখানে বৌন্ড ডাউন। ১৯৩৬-এর গ্রীষ্মে গ্রেফতার ও সাত মাসের জেল। ৩৭-৩৮ বাহিরে। সেপ্টেম্বর ৩৯-৪১ জেলে প্রায় এক বছর। ৪১-৪২ এক বৎসর বাহিরে। ৪২-এর এপ্রিল পুনরায় লক্ষ্ণৌয়ে গ্রেফতার ও বলি– তার পর ফতেহগড়– তার পর বাঙলা . দেশের জেল– সর্বকারাগারতীর্থ পরিক্রমা করিয়া এখন তিনি তথাগত- আজও তিনি জেলে। একটানা তিন বৎসর আট মাস। কত রোগশয্যা মৃত্যুদৰ্শন কত হাসপাতাল, আত্মীয়স্বজনের কত আকুলি বিকুলি কত কর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ কত প্রতিশ্রুতি কত আশানৈরাশ্যের সুখস্পর্শে পদাঘাত।
ইতোমধ্যে পত্নীর ছয় মাস কারাবাস, ভগ্নীৰ্শনাগতা শ্যালিকার তিন মাস ও নিরীহ পাঁচকের নয় মাস!
ভদ্রলোকের নাম শ্রীসৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভগ্নস্বাস্থ্যবশত ওজন কমায় তিনি এখন ছোটলোক এবং ছোট-লোকের সঙ্গই বাঞ্ছা করেন।
[আনন্দবাজার পত্রিকা, ১.১২.১৯৪৫]
.
০৭.
সহৃদয় পত্রলেখকগণের প্রতি আমার সকরুণ নিবেদন এই যে, আমি অতি অনিচ্ছায় অনেক সময় তাহাদের পত্রের উত্তর দিতে অক্ষম হই। তাহারা যেসব বিষয় লইয়া আলোচনা চাহেন সেগুলিও সবসময় করিতে সক্ষম হই না। তাহার প্রধান কারণ আনন্দবাজার বাংলা পত্রিকা অধিকাংশ পাঠক ইংরেজি জানেন না। কাজেই তাহারা বহু বিষয়ের রস গ্রহণ করিতে পারেন না। আমি প্রধানত তাঁহাদিগের সেবা করিতে চাহি বলিয়াই আনন্দবাজারে লিখি। গুণীরা হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে লেখেন। আবার কোনও কোনও পাঠক শাসাইয়া বলিয়াছেন, সত্যপীর সাবান ইত্যাদি সামান্য বিষয় লইয়া আলোচনা করে কেন, সাবানের আলোচনাও তাহার নিকট হইতে শুনিতে হইবে নাকি?
আমার বক্তব্য, আমি অত্যন্ত সাধারণ রাস্তার লোক, ম্যান ইন দি স্ট্রিট। দুর্বলতাবশত মাঝে মাঝে পণ্ডিতি করিবার বাসনার উদ্রেক হয়। এবং করিতে গিয়া ধরা পড়িয়া লাঞ্ছিত হই। সহৃদয় পাঠক, আপনার কি সত্য সত্যই এই অভিলাষ যে, অধম প্রতি শুক্র শনি সিন্নি (শিরনি) ও পূজার পরিবর্তে বিদ্বজ্জনমণ্ডলী কর্তৃক তিরস্কৃত হউক?
অতঃপর বক্তব্য সাবান বস্তুটি বুদ্বুদসমষ্টি বলিয়া কি সে সম্বন্ধে আলোচনা বুদ্বুদেরই ন্যায় অসার? গুরুজন, জর্মন পণ্ডিত ও যোগীকে এক সাবানে সম্মিলিত করিতে সমর্থ হইলাম সে কি কম কেরানি? হায় পাণ্ডিত্য করিতে গিয়া বিড়ম্বিত হই, সাবানের মতো নশ্বর বস্তু লইয়া আলোচনা করিতে গিয়াও পণ্ডিতের যষ্টিতাড়না হইতে নিষ্কৃতি নাই। উপায় কী?
ভাবিয়াছিলাম অদ্য ইলিশ মাছ কী প্রকারে দম পোত রান্না করিতে হয় তাহা সবিশদ বর্ণনা করিব। সে অতি অদ্ভুত রান্না। আস্ত মাছখানা হাঁড়িতে রাখিবেন, আস্ত মাছখানা রান্না হইয়া বাহির হইবে। অনভিজ্ঞের কণ্ঠত্রাসসঞ্চারক ক্ষুদ্র কাঁটাগুলি গলিয়া গিয়াছে, বৃহৎ কাঁটাগুলোর তীক্ষ্ণতা লোপ পাইয়াছে।
পূর্ববঙ্গে কোনও কোনও অঞ্চলে এইপ্রকার রান্নার কায়দা এত গোপন রাখা হয় যে, মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি যাইবার সময় শপথ করিয়া যাইতে হয় যে, সে শ্বশুরবাড়ির কাহাকেও পঞ্চম মকারের বাঙালি বল্লভ এই ম কারটার গভীর গুহ্য তত্ত্বটি শিখাইবেন না।
সেই গোপন তত্ত্বটি আজ যবনিকান্তরাল হইতে প্রকাশ্য দিবালোকে বাহির করিব মনস্থির করিয়াছিলাম। সর্বরহস্য সর্বকালের জন্য সমাধান করিয়া বহু মধুর নির্যাতন, পরিবারে পরিবারে দ্বন্দ্ব-কলহের অবসান করিব ভাবিয়াছিলাম কিন্তু গম্ভীর পাঠকের তাড়নায় মনস্কামনা পূর্ণ হইল না।
ফলে ইলিশের কাঁটা আরও এক শত বৎসর বহু অনভিজ্ঞের গলায় বিধিবে–কিন্তু আমার তাহাতে পাপ নাই।
বাঙালদের কথাই হউক।
এক বাঙাল বেগুন চাহিতে গিয়া বাইগন বলিয়াছিল; তাহাতে ঘটির রসোদ্রেক হয় ও বারবার ব্যঙ্গ করিয়া জিজ্ঞাসা করিতে থাকে, কী বলিলে হে? কী কথা বলিলে? বাঙাল লজ্জিত হইয়া কিছুক্ষণ নিজের উচ্চারণ লুকাইবার চেষ্টা করিয়া শেষে বিরক্ত হইয়া বলিল, বেশ কইছি, বাইগন কইছি, দোষ কী হইল? ঘটি আত্মপ্রসাদজাত মৃদুহাস্য করিয়া বলিল, “বাইগন”! ছোঃ! কী অদ্ভুত উচ্চারণ। আর শোনো তো আমরা কীরকম মিষ্টি উচ্চারণ করি, “বেগুন”! বাঙাল চটিয়া বলিল, মিষ্টি নামই যদি রাখবা তবে “প্রাণনাথ” নাম দেও না ক্যান? চাইর পইসার প্রাণনাথ” দেও। একসের “প্রাণনাথ” দেও। হইল?
উচ্চারণ সম্বন্ধে আলোচনা করিবার আদেশ উপস্থিত। পত্রলেখক বলিয়াছেন যে সংস্কৃত উচ্চারণ লইয়া যখন আমি এত মাথা ফাটাফাটি করিতে প্রস্তুত তখন বাঙলাকে অবহেলা করিবার কী কারণ থাকিতে পারে? বাঙলা উচ্চারণ কি সংস্কৃত উচ্চারণ অপেক্ষাও অধিক জরুরি নহে?
নিশ্চয়ই! কিন্তু মুশকিল এই যে, বাঙলা উচ্চারণ এখন অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তনশীল অবস্থার ভিতর দিয়া যাইতেছে। প্রধানত রেডিয়োর কল্যাণে। পূর্ববঙ্গে এক ব্যাপক চেষ্টা দেখা যাইতেছে, মোটামুটি যাহাকে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চারণ বলা হয় তাহার অনুকরণ করিবার।
অথচ বেগুন অপেক্ষা বাইগনই আমার কানে মধুর শোনায়। কিন্তু মাধুর্যই তো শেষ কথা নয়। পশ্চিমবাংলা চ ও জ অপেক্ষা পূর্ববঙ্গের যে মোলায়েম চ জয়ের গার্হস্থ্য সংস্করণ আছে তাহা অনেক পশ্চিমবঙ্গবাসীরও ভালো লাগে, কিন্তু উচ্চারণ দুইটি যে ঈষৎ অনার্যোচিত তাহাতে সন্দেহ নাই। ভুল বলিলে ভুল বলা হয় না।
কিন্তু তর্ক ও আলোচনা করিবার পূর্বে প্রথম প্রশ্ন আমাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য কী? বাঙলা প্রাণবন্ত, বর্ধনশীল ভাষা। তাহার নানা উচ্চারণ, নানা বর্ণ, নানা গন্ধ থাকিবে। থাকা উচিত। অথচ চট্টগ্রাম বাঁকুড়াকে বুঝিবে না। মেদিনীপুর শ্রীহট্টকে বুঝিবে না– সেকথাও ভালো নহে।
অধম যখন যেখানে যায় সেখানকার উচ্চারণ শিখিবার চেষ্টা করিয়া হাস্যাস্পদ হয়। ইহা ছাড়া যে অন্য কোনও সমাধান আছে ভাবিয়া দেখে নাই। পাঠক কী বলেন?
পূর্ববঙ্গের কথা উঠিলেই মনে হয় যে, তাহার লোক-সাহিত্যের প্রতি কী অবিচারই না করা হইয়াছে। এ যাবৎ, সেই অফুরন্ত সাহিত্য হইতে কতটুকু প্রকাশিত হইয়াছে? গীত, বারমাস্যা ছাড়াও আমির হামজা শুলে বাকওয়ালি প্রভৃতি বিদেশি কেচ্ছার পূর্ববঙ্গীয় রূপান্তর যে কী আনন্দদায়ক তাহা সুরসিক মাত্রই জানেন। লয়লা-মজনু শুষ্ক মধ্য আরবের নায়ক-নায়িকা, যেখানকার কবি গাহিয়াছেন– হে প্রিয়া, প্রার্থনা করি পরজন্মে যেন তুমি এমন দেশে জন্মও যে দেশের লোক জলে ডুবিয়া আত্মহত্যা করিবার মতো বিলাস উপভোগ করিতে পারে।
সেই শুষ্ক আরবের নায়িকা লায়লি পূর্ববঙ্গের কেচ্ছায় অন্য রূপ গ্রহণ করিয়াছেন। নৌকায় চড়িয়া– উটে নহে, প্রিয়সন্দর্শনে যাইতেছেন। ছৈয়ের ভিতর হইতে হাত বাড়াইয়া কমল তুলিতেছেন, সিঙ্গাড়া তুলিতেছেন। পদ্ম খোঁপায় খুঁজিতেছেন।
পূর্ববঙ্গের কবির সাহস অসীম যে রসসৃষ্টি করিয়াছেন তাহা অপূর্ব।
[আনন্দবাজার পত্রিকা ১২.১.১৯৪৬]
.
ঘরে-বাইরে
প্রতি সোমবার তোমাদের আনন্দমেলার জানালার বাইরে বসে তোমাদের কথাবার্তা শুনি আর ভাবি হায়, আমাকে কেউ ভেতরে ডেকে নেয় না কেন? জোর করে সবাই আমাকে বসিয়ে রেখেছে গুরুজনদের সঙ্গে, বয়স আমার বেশি বলে। কেউ জানে না, আমার বয়স কমতির দিকে; বয়স কমতির দিকে কী তার মানে জানো না? কেন সুকুমার রায়ের হ য ব র ল পড়নি? ওরকম বই দু খানা হয়নি। তাতে টেকো বুড়ো জিগ্যেস করছে, বয়স কত? ছেলেটি বলল, আট। টেকো জিগ্যেস করল, বাড়তি না কমতি ছেলেটি বলল, সে আবার কী? টেকো বলল, তা-ও জানো না? এই মনে কর আমার বয়স চল্লিশ, একচল্লিশ, বিয়াল্লিশ হচ্ছে, তখন “বাড়তি”। বিয়াল্লিশে পৌঁছতেই ঘুরিয়ে দিলুম, তখন ফের একচল্লিশ, চল্লিশ, উনচল্লিশ হয়ে কমতিতে চলল। তা না হলে বুড়ো হয়ে মরি আর কি? এখন আমার বয়স চোদ্দ। “কমতি” চলছে! শুনে ছেলেটি হেসেই খুন– টেকো বুড়োর বয়স নাকি চোদ্দ।
হেসো না, সত্যি বলছি আমার বয়স কমতির দিকে। সেদিন দেখি চিঠির থলিতে তোমাদেরই এক বন্ধু নদীয়ার সভ্য (১৪৪১৬) সত্যপীরের লেখা নিয়ে মৌমাছির সঙ্গে আলোচনা করেছে। জানালার পাশে বসেছিলুম, তখুনি ডিঙিয়ে এসে আনন্দ-মেলার খেলাঘরে ঢুকে পড়লুম। ভাবলুম অসভ্য থেকে সভ্য হয়ে গিয়েছি; এইবার দুনিয়ার নানাদেশ ঘুরে যে নানাগল্প যোগাড় করে রেখেছি তারই এক একখানা ছাড়ব আর তোমরা বুঝে নেবে আমার বয়স কমতির দিকে কি না।
.
পয়লা নম্বর এই বেলা শুনে নাও।
স্বর্গীয় জগদানন্দ রায় শান্তিনিকেতনে স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। জগদানন্দ রায়ের নাম শোনোনি, বই পড়নি? তবে ভুল করেছ। তিনি একদিন ক্লাসের একটি ছেলের কান মলে দিচ্ছিলেন। শান্তিনিকেতনের ভেতরে অবশ্যি মারধোর করা বারণ, কিন্তু একদম কেউ যদি সে আইন না ভাঙে তবে লোকে জানবে কী করে যে আইনটা আদপেই আছে। তাছাড়া তিনি তাকে কানে ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে নিয়েছিলেন সে তো তখন আর আশ্রমের ভেতর নয়- উপরে। আশ্রমের ভেতরেই তো মারধোর বারণ। তা সে আইনের কথা থাক—-জগদানন্দবাবু ছেলেদের এত প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন যে কেউ কখনও ওসব জিনিসে খেয়াল করত না।
কিন্তু ঠিক ওই সময় বড়বাবু বেড়াতে বেরিয়েছেন, আর দূর থেকে দেখতে পেয়েছেন। বড়বাবু কে জানো? তিনি রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড়দাদা। শুরুদেব, গান্ধীজি ওঁকে বড়দাদা বলে ডাকতেন। গেল শতক আর এই শতক নিয়ে হিসাব করলে আমাদের দেশে দু জন সত্যিকার দার্শনিক জন্মেছেন– একজন বড়দাদা, আরেকজন স্বর্গীয় ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। ব্যাপারটা দেখে বড়বাবু বাড়ি গিয়ে জগদানন্দবাবুকে একটা দোহা লিখে পাঠালেন,
শোনো হে জগদানন্দ দাদা,
গাধারে পিটিলে হয় না অশ্ব, অশ্বেরে পিটিলে হয় সে গাধা!
আমরা তো হেসেই খুন। গাধাকে পিটলে ঘোড়া হয় না, সেকথা তো সবাই জানতুম, কিন্তু ঘোড়াকে পিটলে যে সে গাধা হয়ে যায় এটা বড়বাবুর আবিষ্কার! আর জগদানন্দ দাদার সঙ্গে গাধা শব্দের মিল শুনে আমাদের খুশি দেখে কে?
জগদানন্দবাবু মনের দুঃখে সেদিন থেকে কানমলা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
[আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪.৯.১৯৪৫]
Leave a Reply