কিল্ড বাই কাইন্ডনেস – নেডরা টায়ার

কিল্ড বাই কাইন্ডনেস – নেডরা টায়ার

জন জনসন ঠিক করেছে সে তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে হত্যা করবে। এছাড়া তার কোন উপায় নেই। আর একমাত্র এই কাজটাই সে খুব ভালভাবে করতে পারবে। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে জন।

ডির্ভোস দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ডির্ভোসের জন্য সে উপযুক্ত কারণও দাঁড় করাতে পারবে না। মেরী এত ভালো আর ভদ্র যে জীবনে কোনদিন কোনো পরপুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। এতদিনে একটিবারও সে জনের সঙ্গে ঝগড়া করেনি। মেরী যেমন সুন্দরী, রান্নার হাতটিও তেমনি চমৎকার। আর ওর মত দক্ষ ব্রিজ খেলোয়াড় এ শহরে আর কেউ আছে? মেরী সবার কাছেই খুব প্রিয়।

ভাবতেও কষ্টে বুক ফেটে যেতে চায় যে এমন সুশীলা, সুভদ্রা একটি নারীকে তার হত্যা করতে হবে। কিন্তু ওকে ডির্ভোস দেয়াও যাবে না। বিশেষ করে এই সময়, যখন মাত্র দুয়েক আগে তারা তাদের বিংশত বিবাহবার্ষিকী মহাসমারোহে পালন করেছে।

আমন্ত্রিত অতিথিদের সবাই বলেছিল, মেরী আর জন হচ্ছে শ্রেষ্ঠ এবং সুখী এক দম্পতি। শ্যাম্পেনের বোতল খুলতে খুলতে মেরী এবং জন সবার কাছে আশীর্বাদ চেয়েছিল, পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রগাঢ় ভালবাসায় উচ্চারণ করেছিল, আপনারা আশীর্বাদ করবেন আমরা যেন একসঙ্গে মরতে পারি। আর এরপর জন কি করে পারে মেরীকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে? এটা স্রেফ ছেলেমানুষী হবে।

তাকে ছাড়া মেরী একদন্ড বাঁচতে পারবে না, জানে জন। ডির্ভোস দিলেও দোকানঘরটা মেরীর নিজেরই থাকবে। কিন্তু তাতে কিছুই এসে যায় না। কারণ মেরী অর্থলিন্দু নয়। জন বাইরে গেলে সে ফার্নিচারের দোকানটাতে বসে সময় কাটায়। ব্যবসা বুদ্ধি যদিও ভালোই মেরীর, কিন্তু এসবের প্রতি তার তেমন আগ্রহ নেই। তার সকল আগ্রহ জনকে ঘিরে।

জন যদি মেরীকে ডির্ভোস দেয় তাহলে কে তাকে কনসার্টে নিয়ে যাবে, কে যাবে তার সঙ্গে নাটক দেখতে। তার সবচে প্রিয় জিনিস ডিনার পার্টি জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। স্বামী পরিত্যক্তা মেরীকে কুশল জিজ্ঞেস করতেও কেউ আসবে না। একা, ডির্ভোসি মেরী বদ্ধ হয়ে পড়বে চার দেয়ালের মাঝখানে, কাটাতে হবে দুর্বিষহ জীবন। না, না, মেরীর এমন ভয়ানক অবস্থার কথা কল্পনাও করতে পারে না জন। যদিও জানে মেরীকে যদি সে বলে, আমি তোমাকে ডির্ভোস দেব, তাহলেও মেরী কোন প্রতিবাদ করবে না। এমনই বাধ্য মেয়ে সে।

নাহ্, ডির্ভোসের কথা বলে মেরীকে অবর্ণনীয় মানসিক যন্ত্রণা দেয়ার কোন মানে নেই। এত কষ্ট পাবার জন্য জন্ম হয়নি ভাল মেয়েটির।

ইস, যদি গতবারের বিজনেস ট্রিপে লেটিসের সঙ্গে তার পরিচয় না হত! কিন্তু জন এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটাকে অস্বীকার করবে কীভাবে? লেটিসের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর, গত ছয়মাস থেকে মনে হচ্ছে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে সে। লেটিসের তুলনায় মেরী কিছুই না। লেটিসকে দেখার পর তার মনে হয়েছে সে যেন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে। সারাজীবন সে কালা ছিল, এখন শুনতে পাচ্ছে। আর অলৌকিক ব্যাপারটা হচ্ছে লেটিসও তাকে ভালবেসেছে এবং বিয়ে করতে চাইছে, তার কোন পিছুটান নেই।

লেটিস অপেক্ষা করছে।

আর জেদ ধরছে।

ভালবাসার এই দৃশ্যপট থেকে মেরীকে বাদ দিতেই হবে। ছোটখাট একটা দুর্ঘটনা ঘটলে ব্যাপারটা বেশ সহজ হয়ে উঠবে। আর দুর্ঘটনা ঘটা বা ঘটাবার জায়গা হিসেবে দোকানটা সর্বোৎকৃষ্ট স্থান। মেরীর মাথার ওপরের তাকে মার্বেল পাথরের যেসব ভারি আবক্ষ মূর্তি এবং ঝাড়বাতি রয়েছে তার দুএকটা যদি পিছলে মাথার ওপর পড়ে যায় তাহলেই কেল্লা ফতে।

.

ডার্লিং, তোমার বউকে কথাটা বলতেই হবে, লেক্সিংটনের হোটেল ঘরে লেটিস জনের গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলছিল। ওকে তোমার ডির্ভোস দিতেই হবে। আমাদের সম্পর্কের কথা তুমি এখনও মেরীকে জানাচ্ছ না কেন? লেটিসের কণ্ঠ এত নরম আর মিষ্টি যে জনের মনে হচ্ছিল সে সম্মোহিত হয়ে পড়ছে।

কিন্তু লেটিসের কথা সে কি করে মেরীকে জানাবে?

লেটিসের আবেদন জনের কাছে মোটেও যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয় না।

মেরীর চেহারা বা আচরণে স্বাভাবিক মাধুর্য লক্ষ্যণীয়, কিন্তু লেটিস বেশভূষায় আড়ম্বরপূর্ণ। লেটিস মেরীর মত সুন্দরী না হলেও বিছানায় ওর তুলনা মেলা ভার। লেটিসের উপস্থিতিতে অসাধারণ খেলুড়ে হয়ে ওঠে জন; কিন্তু মেরীর সঙ্গে তার আচরণ ব্যক্তিত্বপূর্ণ স্বামীর মত, রক্ষণশীলতা এখানে অনেকটাই ভূমিকা রাখে। লেটিস কামকলার যে ছলাকলা জানে মেরী হয়তো সেগুলোর নামও জীবনে শোনেনি। লেটিস মানে ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ প্রকৃতির চারটি উপাদান; মেরী মানে-থাক, সে এগুলোর সঙ্গে ওর তুলনা করতে চায় না। পরস্পরের সঙ্গে এত তুলনা করেই বা কী লাভ?

বিছানায় ঝড় তুলে পরিতৃপ্ত জন লেটিসকে নিয়ে নিচে এসেছে, বার-এ লেটিস যাবে কিনা জানার জন্যে প্রশ্ন করতে যাচ্ছে, এমন সময় চেট ফ্লেমিংকে হোটেলে ঢুকতে দেখল ও। লবি পার হয়ে সোজা ডেস্কের দিকে আসছে।

চেট ফ্লেমিং লেক্সিংটনে কি করছে? দরকারী কাজে যে কেউ এখানে আসতেই পারে। নাহ্, প্রকাশ্যে লেটিসকে নিয়ে ঘোরাঘুরি বড্ড ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে। যে কোন সময়, যে কোন জায়গায় ওরা ধরা খেতে পারে। কোন জায়গাই ওদের জন্য নিরাপদ নয়। আর চেট ফ্লেমিং ওদের দেখে ফেললে কম্ম সাবাড়। বাঁচালটা দুনিয়ার সব লোককে জানিয়ে দেবে জনের সঙ্গে এক সুন্দরীকে সে হোটেলে দেখেছে। আর মেরীর কানে তো সব কথা যাবেই। ওর অন্তরটা তখন টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কিন্তু অত বেদনা অবশ্যই মেরীর প্রাপ্য নয়।

জন চট করে লেটিসের পেছনে লুকাল। চেট খামোকা ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে রিসেপশনিস্টের সঙ্গে বকবক করতে লাগল। চোখ তুলে তাকালেই চেট তাদের দেখতে পাবে ভেবে জন পাশের নিউজস্ট্যান্ডের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। চট করে একটা পত্রিকা নিয়ে মুখ নিয়ে মুখ আড়াল করে পড়ার ভান করল। চেট রেজিষ্টারে সই করে লিফটে না ওঠা পর্যন্ত সে ওভাবেই থাকল। তারপর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক বাবা, বড় একটা ফাড়াকাটল।

জন আর ঝুঁকি নিতে চায় না। লেটিসের সঙ্গে তার সম্পর্কটাকে চিরস্থায়ী বন্ধনে না বাঁধা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। কিন্তু একই সাথে মেরীকেও যে তার আঘাত দিতে ইচ্ছে করছে না।

আমেরিকায় হাজার হাজার মানুষ ঘুমের মধ্যে মারা যায়। মেরী কেন তাদের একজন হয় না? কেন তাকে খুন হতে হবে?

জন তার আতঙ্কের কথা খুলে বলল লেটিসকে, আবার যখন লেক্সিংটনে গেল সে।

শুনে মাথা নাড়ল লেটিস। বলল : ডার্লিং, এই কাজ করলে আমিও ফেঁসে যাব। কারণ সবাই তখন আমাকেও সন্দেহ করবে। আমি বলি কী, তোমার বউকে আমার কথা এখুনি বলে ফেলো। আমি কিন্তু আর সহ্য করতে পারছি না। কিছু একটা করো।

হ্যাঁ, সোনা। ঠিক বলেছ তুমি। কিছু একটা করব আমি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

.

আশ্চর্য হলেও সত্যি মেরী জনসনও তার স্বামীর মতো অবস্থায় পড়েছে। প্রেমে পড়ার কথা কল্পনাও করেনি সে। তার বিশ্বাস ছিল সে শুধু জনকেই ভালবাসে। কিন্তু কেনেথকে দেখার পরেই মাথায় কেমন গোলমাল হয়ে গেল। সেদিন সকালে কেনেথ দোকানে এসে জিজ্ঞেস করছিল মেরীর কাছে মোসার্টের আবক্ষ মূর্তি আছে কিনা। হ্যাঁ, তা অবশ্য মেরীর কাছে ছিল; শুধু মোৎসার্ট কেন, বাখ, বিটোফোন, ভিক্টর হুগো, বালজাক, শেক্সপীয়র, জর্জ ওয়াশিংটন, গ্যেটে কার মূর্তি নেই তার কাছে?

নিজের পরিচয় দিল কেনেথ। যদিও খদ্দেররা সাধারণত নিজের পরিচয় দেয় না। আসে, দামদর করে জিনিসপত্র কিনে চলে যায়। মেরীও কেনেথকে তার নাম বলল। জানল কেনেথ এ শহরের একজন খ্যাতনামা ইনটেরিয়র ডিজাইনার।

সত্যি বলতে কী, বলল কেনেথ, মোসার্টের এই মূর্তিটি আমার খুব একটা পছন্দ হয়নি, বরং এটা ঘরের সৌন্দর্য নষ্ট করবে বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু তবুও এটাকেই আমার নিতে হবে। কারণ আমার ক্লায়েন্টের মোসার্টের মূর্তি চাই-ই। আচ্ছা, এছাড়া আপনার কাছে অন্য কি মূর্তি আছে দেখাবেন দয়া করে?

গোটা দোকান ঘুরিয়ে দেখাল মেরী কেনেথকে। তারপর কেটে গেছে বেশ কয়েক দিন। পরে মেরী চেষ্টা করেছে মনে করতে সে কবে কেনেথের প্রেমে পড়ল; কিন্তু মনে পড়েনি। ওইদিন সারাটা সকাল কেনেথ দোকানেই ছিল; দুপুরের দিকে পেছনের চেস্ট অভ ড্রয়ার রাখা ছোট ঘরটায় সে কি এক অজুহাতে ঢুকে পড়ে। একটা ড্রয়ার টান দিতেই ওটা তার হাতে খুলে আসে, তারপর তার আচরণ দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। মেরীকে জড়িয়ে ধরে কেনেথ।

আরে, একি করছেন আপনি? কৃত্রিম রাগে হিসহিস করে ওঠে মেরী। ঈশ্বর! যে কোনসময় কাস্টমার চলে আসবে।

গুল্লি মারো কাস্টমার, বলেছে কেনেথ।

মেরীর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল না এসব ঘটছে। কেনেথের পুরুষালী বন্ধনের মাঝে নিজেকে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিল সে। কিন্তু নিজেকে অনেক কষ্টে সেবার নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এরপর থেকে যখনই জন ব্যবসার কাছে শহরের বাইরে গেছে, প্রতিবারই কেনেথকে চুমু খেয়ে ঝিকমিকে চোখে জানিয়েছে আজকের রাতটা সে বাড়িতে একা।

চেস্ট অভ ড্রয়ারে গাদা করা পেছনের ঘরটা মেরী আর কেনেথের মিলনের গোপন স্থান হিসেবে চমৎকার ছিল। একদিন, জনের অনুপস্থিতিতে ওরা ওখানে বসে প্রেম করছে এই সময় একটা কণ্ঠ শুনতে পেল। ভালবাসায় এত মগ্ন ছিল দুজনে যে খেয়ালই করেনি কেউ এসেছে।

মিসেস জনসন, কোথায় গেলেন? আমার জিনিসটা নিতে এসেছি, বলল নারীকণ্ঠ।

হুড়মুড়িয়ে অন্ধকার ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল মেরী, মুখে চেষ্টাকৃত হাসি। এলোমেলো চুল দ্রুত হাতে ঠিক করল সে। জানে ওর লিপস্টিক ছেঁড়া থেবড়া হয়ে গেছে। খদ্দেরটি মিসেস ব্রায়ান, শহরের সবচে গল্পবাজ মহিলা। ভয় পেল মেরী। কোন সন্দেহ নেই মিসেস ব্রায়ান সবাইকে জানিয়ে দেবেন মেরীকে আজ তিনি আলুথালু অবস্থায় আবিষ্কার করেছেন। আর জনের কানে এই কথা যাবেই।

কিন্তু ভাগ্য ভাল মেরীর মিসেস ব্রায়ান আজ অন্য মুডে ছিলেন। মেরীর দিকে ভাল করে তাকালেন না পর্যন্ত। অর্ডার দেয়া ছিল আগেই, মেরীও প্যাক করে রেখেছিল ঝাড়বাতিটা, টাকা দিয়ে প্যাকেটটা নিয়ে হনহন করে চলে গেলেন ভদ্রমহিলা।

অল্পের জন্য রক্ষা পাওয়ার ঘটনাটা মেরী হাসিমুখে বললেও তার প্রেমিক অন্ধকার করে ফেলল মুখ।

তোমাকে আমি কত ভালবাসি তুমি জানো, সোনা, বলল কেনেথ। আর তুমিও আমাকে আমার মতোই ভালবাস। কিন্তু এভাবে লুকিয়ে প্রেম। করতে আমার জঘন্য লাগছে। এসব লুকোচুরি আমার পছন্দ নয়। বুঝতে পারছ কি বলতে চাইছি? আমরা বিয়ে করব। তোমার স্বামীকে বলল, তুমি ডির্ভোস চাও।

কেনেথ কথাটা এমনভাবে উচ্চারণ করল, যেন এটা কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু যে মানুষটি গত বিশ বছর ধরে তার প্রতি এত সদয় এবং বিশ্বস্ত থেকেছে তাকে কী করে ডির্ভোসের কথা বলবে মেরী? কি করে সে তার সকল সুখ কেড়ে নেবে?

হ্যাঁ, ব্যাপারটার একটা সমাধান হতে পারে যদি জন হুট করে মরে যায়। কেন, ওর কি হার্ট অ্যাটাক হতে পারে না? প্রতিদিন কত মানুষ হার্ট অ্যাটাকে মারা যাচ্ছে। জন কেন এভাবে মারা যায় না? তাহলেই আর কোন সমস্যা থাকে না।

সেদিন বিকেলে মেরী কেনেথকে ফোন করেছিল, বলল যে আজ রাতে জন বাড়ি ফিরবে না, কাজে শহরের বাইরে গেছে।

শুনে কেনেথ ঘেউ ঘেউ করে উঠল। বলল, ড্যাম ইট, মেরী! এভাবে লুকিয়ে বারবার দেখা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এটা আমার জন্য রীতিমত অপমানকর। তোমার সঙ্গে আমি অন্ধকার ঘরে প্রেম করব আর ওদিকে কাস্টমার এসে অমুক তমুক জিনিসের জন্য চিল্লাচিল্লি করতে থাকবে–ওহ, এ অসহ্য! আমাকে অবশ্যই তোমার বিয়ে করতে হবে।

করব তো, ডার্লিং, কিন্তু আরেকটু ধৈর্য ধরো প্লীজ!

অনেক ধৈৰ্য্য ধরেছি। আমার পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। ঘটাং করে ওপাশে ফোন রেখে দিল কেনেথ।

মেরী জানে কেনেথ যা বলেছে তা করবে। কিন্তু কেনেথকে ছাড়া সে। বাঁচবে কেমন করে? জনের প্রতি তো তার এত ব্যাকুলতা ছিল না!

প্রিয় জন। কেমন করে তাকে ছেড়ে আসবে? জীবনের অন্যতম সেরা দিনগুলো সে জনের সঙ্গে কাটিয়েছে, জনের সমস্ত উপস্থিতি ছিল তাকে ঘিরে। তার আনন্দ, সুখ আহ্লাদের প্রতি জনের সবসময় নজর ছিল। ওদের যেসব বন্ধু-বান্ধব আছে সবাই বিবাহিত। জনকে ডির্ভোস দিলে তার একাই দিন কাটাতে হবে। মেরীকে ছাড়া তার জীবন শূন্য হয়ে পড়বে; বন্ধুরা তাকে তখন করুণা করে তাদের বাসায় ডাকবে। সবাই তাকে বেচারী, দুঃখী জন বলে সম্বোধন করবে। এরচে মৃত্যুও অনেক ভাল ছিল, বলবে তারা। জীবন সম্পর্কে হতাশ জন তখন নিজেকে অবহেলা শুরু করবে; ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করবে না; সমস্ত সময় তাকে এই বাড়িতে একা থাকতে হবে। না, জনকে জেনেশুনে সে এমন নির্বাসন দিতে পারে না।

কিন্তু কেনেথের জন্য সে এমন পাগল হলো কেন? কেনেথের ক্লায়েন্টই বা কেন তখন মোৎসার্টের মূর্তির জন্য বায়না ধরেছিল? ব্রড স্ট্রীটের সেকেন্ডহ্যান্ড দোকানগুলোতে মোৎসার্টের মূর্তি কত সস্তায় পেত কেনেথ। কিন্তু সেখানে না গিয়ে সে মেরীর দোকানেই বা কেন সেদিন এসেছিল?

এখন আর এসব ভেবে কী লাভ? কেনেথের সঙ্গে সে এখন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে, এ থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই। দুজনের মিলনই এর অনিবার্য পরিণতি।

কিন্তু পরিণতিকে অনিবার্য করতে হলে তাকে এখন ভাবতে হবে কত দ্রুত, সুন্দর, সহজ এবং দক্ষভাবে জনের কাছে থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

আর খুব তাড়াতাড়ি।

.

ব্যবসার কাজে দিন তিনেকের জন্য বাইরে গিয়েছিল জন জনসন। লেটিসের সঙ্গে সুখসাগরে গা ভাসিয়েছে সে এই কটা দিন। কিন্তু বাড়ি ফিরে মেরীকে দেখে বিস্ময়ে হাঁ করে গেল সে। মেরীকে এত সুন্দরী মনে হয়নি তার জীবনেও। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো মেরী ছাড়া তার জীবন বৃথা। কিন্তু পরক্ষণে লেটিসের মুখ মনের আয়নায় ভেসে উঠল। সিদ্ধান্ত নিল কাজটা সে আজই করবে। আজকেই সে মেরীকে খুন করবে। তবে কাজটা করবে রাতে। মেরীর সঙ্গে খুশি মনে ডিনার খাবে। মেরী নিশ্চয়ই আজকেও ওর জন্য চমৎকার সব জিনিস রান্না করে রেখেছে। প্রতিবারই করে, বাইরে থেকে ফেরার পরেই। খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে সে মেরীকে চিরতরে বিদায় দেবে এই দুনিয়া থেকে।

কিন্তু মেরীকে কীভাবে হত্যা করবে সেটা এখনও ঠিক করতে পারেনি জন। সুযোগ মিললে দুএকটা মূর্তি ফেলে দেবে ওর মাথায়। নয়তো অন্য কোন উপায় পরে ভেবে বের করা যাবে।

মেরী ঠোঁটে মধুর হাসির রেখা টেনে জনের হাতে কফির কাপটা দিল।

নাও, কফি খাও, বলল সে। লম্বা ভ্রমণের ক্লান্তি কেটে যাবে।

ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞচিত্তে বলল জন। এই মুহূর্তে সত্যি তার এককাপ গরম কফির খুব দরকার ছিল।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে টেবিলের পাশে বসা মেরীর দিকে তাকাল জন। ওর চেহারায় অদ্ভুত একটা অভিব্যক্তি। অবাক হলো জন। গত বিশটা বছর ধরে ওরা পরস্পরের এত কাছে যে সহজেই একে অপরের মনের কথা পড়তে পারে। তাহলে কি মেরী বুঝে ফেলেছে জন তাকে নিয়ে কি ভাবছে? হাসল মেরী; হানিমুনের সেই প্রথম দিনগুলোর মন পাগলকরা নিষ্পাপ হাসি। নাহ্, মেরী কিছু টের পায়নি। অযথাই সে সন্দেহ করছিল ওকে।

ডার্লিং, এক মিনিট, বলল মেরী। দোকানে একটা জিনিস ফেলে এসেছি। ওটা এখুনি নিয়ে আসছি।

উঠে দাঁড়াল মেরী, দ্রুত বেরিয়ে ডাইনিং রুম থেকে, হলওয়ে দিয়ে ঢুকল দোকানে।

কিন্তু এক মিনিটের মধ্যে ফিরল না মেরী। কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে দেখে জন দ্রুত চুমুক দিল কাপে। তারপর সিধে হলো, মেরী দেরি করছে কেন দেখবে।

নিঃশব্দে দোকানে ঢুকল জন। মিডলরুমে, ঝাড়বাতি রাখার ঘরে, একটা সোফায় জনের দিকে পিছন ফিরে বসে আছে মেরী, হাত দুটো একটা মূর্তির ওপর।

ঈশ্বর, জন যা ভেবেছে তাই। মেরী ওর মনের কথা জেনে গেছে। ওর কাঁধ দুটো কাঁপছে। কাঁদছে মেরী। কাঁদছে স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার কথা জেনে। নাকি ও হাসছে? কাঁধ দুটো যেভাবে নড়ছে তাতে মেরী হাসতেও পারে। কিন্তু কাঁদুক আর হাসুক, যাই করুক, ওর অভিব্যক্তি দেখার সময় এখন জনের নেই। এরকম সুযোগ লাখে একটা মেলে। নিচু হয়ে আছে। মেরী। ওর ঠিক মাথার ওপরের তাকে ভিক্টর হুগো, ফ্রাঙ্কলিন এদের বড় বড় সব মূর্তি। যে কোন একটা মূর্তিকে সামান্য ধাক্কা দিলেই ওটা সরাসরি মেরীর মাথায় পড়বে, চৌচির করে দেবে খুলি। শুধু সামান্য একটু ধাক্কা।

ধাক্কা দিল জন।

কত সহজ কাজ!

মেরী! বেচারী মেরী!

যাক্, এটাই সবচে ভালো হলো। ডির্ভোসের জ্বালা আর সইতে হলো তার স্ত্রীকে। কাজটা এত সহজে হবে ভাবেনি জন। সময়ই তো লাগল না। এত অনায়াসে কাজটা যাবে জানলে সে আরও আগে সুযোগটা নিত।

জন খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর শেষবারের মতো মেরীর দিকে তাকিয়ে ডাইনিংরূমে চলে এল। কফিটা শেষ করে ডাক্তারের কাছে ফোন করবে। সন্দেহ নেই ডাক্তার পুলিশকে জানাবে মৃত্যুটা স্রেফ দুর্ঘটনা ছিল। জনকে একটু মিথ্যে বললেই হবে। বলবে মেরী মূর্তি নামাতে গিয়ে হাত পিছলে মাথা ফেটে মরেছে। বলবে মেরীকে সে এর আগেও সাবধান করে দিয়েছিল তাক থেকে ভারি মূর্তি নামানোর সময় যেন সতর্কতা অবলম্বন করে। কিন্তু আমার কিছু হবে না বলে মেরী তার কথার গুরুত্ব দেয়নি।

কফিটা এখনও গরম। তারিয়ে তারিয়ে ওটা পান করল জন। লেটিসের কথা ভাবছে সে। ওকে টেলিফোন করবে, জানাবে আর কোন সমস্যা নেই, এখন নিশ্চিন্তে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। কিন্তু পরক্ষণে নাকচ করে দিল চিন্তাটা। এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। লেটিসকে পরে জানালেও চলবে।

আনন্দিত হলেও উল্লসিত হলো না জন। শান্ত থাকল। নিজেকে খুব রিল্যাক্স লাগছে। কাজটা নির্বিঘ্নে করতে পারার আয়েশ আর কি। ঘুম পাচ্ছে ওর। ভীষণ ঘুম। লিভিংরুমের কাউচে গিয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। ডাক্তারের কাছে পরে ফোন করলেও চলবে। কিন্তু কাউচে গিয়ে শোয়া হলো না জনের। ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ল। হাত দুটো ঝুলতে থাকল টেবিলের পাশে।

.

করুণ ঘটনাটা কিভাবে ঘটল জন কিংবা মেরীর কোন বন্ধুই ঠাহর করতে পারল না। ওদের মনে সামান্য সন্দেহ পর্যন্ত জাগল না। সবাই ধরে নিল মেরী কোন কারণে ওই ভারী মূর্তিগুলো নামাতে গিয়েছিল। হাত ফস্কে মূর্তি পড়ে যায় তার মাথায়, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটে মেরীর। আর বাইরে থেকে জন এসে মৃতা মেরীকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে বেঁচে থাকার কোন মানে নেই। হয়তো জন ওইসময় সুস্থভাবে চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। সে তৎক্ষণাৎ কফিতে ঘুমের ট্যাবলেট গুলে ওই কফি পান করে আত্মহত্যা করে।

জন আর মেরীর সুখী দাম্পত্য জীবনের কথা স্মরণ করে সবাই আহা উঁহু করতে লাগল। ওদের মনে পড়ল বিংশত বিবাহবার্ষিকীতে এই সুখী দম্পতি তাদের মৃত্যু যেন একসঙ্গে হয় বলে সবার কাছে আশীর্বাদ চেয়েছিল। সত্যি, এযুগে এমন স্বামী-স্ত্রীর দেখা মেলা ভার। কি অসাধারণ ভালবাসা আর টান ছিল পরস্পরের প্রতি। আর এই তীব্র প্রেমই দুজনকে টেনে নিয়েছে অমোঘ নিয়তির দিকে, দুজনেই শেষযাত্রা করেছে অনন্তের উদ্দেশে একই রাতে, যেমনটি তারা চেয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *