ডেথ বেট – হাল এলসন

ডেথ বেট – হাল এলসন

বেলা আড়াইটা বাজে। খুব গরম পড়েছে। ব্যুরোর দিকে তাকাল রজার্স। ব্র্যান্ডির বোতলে খানিকক্ষণ চোখ রেখে ডানে-বামে মাথা নাড়ল। মদ খেয়ে কোনও লাভ হবে না। ঘড়ি দেখল সে। মাদক ব্যবসায়ী মোরেনোর ফোন করার কথা ছিল। করেনি এখনও।

এদেশে কোনও কিছুই সময় মেনে চলে না, ক্রুদ্ধ হয়ে ভাবছিল রজার্স এমন সময় বেজে উঠল ফোন। নাইট-টেবিলে রাখা ফোনটি খপ করে তুলে নিল সে।

রজার্স? জানতে চাইল অপরপ্রান্তের কণ্ঠ।

হু, বাটলার।

খবর কী?

কোনও খবর নাই।

ফোন করেনি?

এখনও করেনি। এখন আমাদের করণীয় কী?

অপেক্ষা করো। এ মুহূর্তে এটাই করণীয়।

গত দুইদিন ধরে এই হতচ্ছাড়া ঘরে আমি অপেক্ষা করেই আছি, বাটলার।

হেসে উঠল বাটলার। বার-এ গিয়েও ফোন ধরা যায়, তুমি জানো।

তা যায় বটে।

তবে বেশি মদ গিলো না যেন। তা হলে সামাল দিতে পারবে না।

বুঝতে পারছি কী বলতে চাইছ।

আরেকটা কথা, রজার্স।

বলো?

মোরেননা তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে, ওর সঙ্গে তোমার দেখা। করার জন্য উতলা হবার দরকার নেই।

তা হলে মাল বিনিময় হবে কী করে?

ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। কেউ ওর হয়ে কাজটা করবে। এমনকী যদি কোনও অন্ধ ভিক্ষুকও আসে মাল নিয়ে, অবাক হয়ো না।

তুমি মশকরা করছ।

না। মোরেনোর কাজের ধরনই ওরকম। খুব অভাবগ্রস্ত কাউকে সামান্য কিছু পেসো ধরিয়ে দিয়ে তাকে দিয়ে কাজ উদ্ধার করিয়ে নেয় সে। সস্তা, তবে চতুর পদ্ধতি।

হয়তো বা, বলল রজার্স। কিন্তু মোরেনো ফোন করছে না কেন? আমরা কোথায় আছি জানে না সে?

জানে, তবে সে খুব সাবধানে নড়াচড়া করে। হতে পারে তোমার ওখানে উল্টোপাল্টা লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে আর পরিস্থিতিও হয়তো খুব বেশি উত্তপ্ত। কাজেই শক্ত হয়ে বসে থাকো।

হুম।

ওকে, টেক ইট ইজি। বলে লাইন ছেড়ে দিল বাটলার।

রিসিভার নামিয়ে রাখল রজার্স। হুঁ, টেক ইট ইজি বললেই হলো, মনে মনে ভাবছে সে। সব ভোগান্তি তো আমাকেই পোহাতে হবে। বাটলার চার ব্লক দূরে একটা হোটেলে আরামে এবং নিরাপদে আছে। তাকে কোনও ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যেতে হবে না। যদিও কাজটা তার, অর্থও তার।

বোতল মনোযোগ ফেরাল রজার্স। ছিপি খুলে লম্বা এক ঢোক মদ গিলল। আরেক চুমুক দিয়ে তাকাল বোতলের দিকে। প্রায় সিকিভাগ খালি

করে ফেলেছে।

টেক ইট ইজি, মনে মনে শব্দটা আওড়াল সে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে হাসল। খিচড়ানো মেজাজ একটু শান্ত হয়েছে।

রিসিভার তুলে হোটেলের রিসেপশনিস্টকে জানিয়ে দিল তার কোনও ফোন এলে যেন বার-এ কলটা রিলে করে দেয়া হয়। রিসিভার রেখে দিয়ে দরজায় পা বাড়াল রজার্স।

হলওয়ে ছায়াময়। টাইলসে ওর জুতোর হিলের খটমট আওয়াজ উঠল। ব্র্যান্ডিটা কাজ শুরু করে দিয়েছে, শরীরটা আর আগের মতো ভারী লাগছে না।

ভিভা, মেক্সিকো! এলিভেটরের সুইচে হাত রেখে বলল রজার্স।

এলিভেটরের দরজা খুলে যখন বেরিয়ে এল সে, শরীর আশ্চর্য হালকা লাগছিল উঁচু ছাতের প্রকাণ্ড লবি, ওপরে ছায়াঘেরা বাতির ভেসে আসা স্নান আলো, হঠাৎই যেন কাঁপতে শুরু করল। তরল এবং দুর্বোধ্য স্প্যানিশ কণ্ঠের শব্দরাজি তাকে ঘিরে ধরল চারপাশ থেকে। শুনতে ভালই লাগছে, অপরিচিত ঠেকছে না মোটেই। সাদা জ্যাকেট পরা এক বেলবয়ের গায়ে ধাক্কা খেল রজার্স। সে বাউ করে ক্ষমা চাইল।

দোষ আমার, দ্রুত বলল রজার্স। বারটা কোনদিকে?

ঘষা কাঁচের একটি দরজা দেখিয়ে দিল বেলবয়, রজার্স কদম বাড়াল ওদিকে। হালকা শরীর এবং অপেক্ষার যন্ত্রণা সইবার পরে এ মুহূর্তে অনুত্তেজিত।

তবে এটা একটা বিপদ-সংকেত। বার-এ চলে এল সে। টেক ইট। ইজি, মনে মনে বলল রজার্স। আর ব্র্যান্ডি পান করা চলবে না।

মাথা ঝাঁকাল বারম্যান। সিনর?

একটা বিয়ার।

এক-দুই-তিন বোতল। আস্তে ধীরে ধীরে ড্রিংক করবে ভেবেছিল রাজর্স, কিন্তু একটা বিয়ার পান করার পরে শরীর ভালো লাগছিল বলে

পরপর চারটে বোতল সাবাড় করল।

আজ আর মোরেনো ফোন করবে না, মনে মনে বলল ও। বেরিয়ে এল বার থেকে।

পেভমেন্টে ছুরির ফলার মত সাদা রোদ ঝকমক করছে, ধাধিয়ে দেয় চোখ। রাস্তার ওপাশে ছোট্ট প্লাজার দিকে চোখ কুঁচকে তাকাল রজার্স। জনশূন্য প্লাজা। প্রচন্ড উত্তাপে ঝিমোচ্ছে। ভারী আওয়াজ তুলে বেজে উঠল গির্জার ঘণ্টা।

শরীরটা কেমন দুলছে রজার্সের। চোখ বুজল। চোখ মেলে চাইতেই দেখল তামাটে একটি মুখ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে হাসল লোকটা।

গাড়ি চড়ে কোথাও যাবেন, সিনর?

গাড়ি চড়ে কোথায় যাব? জিজ্ঞেস করল রজার্স।

ঝট করে একটি তালিকা মেলে ধরল লোকটা, যাতে একজন ট্যুরিস্ট আকর্ষণ করার মত নানান ট্যুরের কথা লেখা আছে। মাথা নাড়ল রজার্স।

কোনও ট্যুরে যাবেন না, সিনর?

না।

তা হলে অন্য কিছু?

ইতস্তত করছে রজার্স, এক লোক এগিয়ে এল ওদের দিকে।

সিনর, আমি একজন অফিশিয়াল গাইড, দ্রুত বলল সে।

আমি সস্তায় আপনাকে সেবা দিতে পারব, কাজেই এ লোকটাকে ভাড়া করার জন্য আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি।

হা, এ লোকের কোটের ল্যাপেলে একটা বাটন আছে আর তাতেই সে অফিশিয়াল হয়ে গেল! বলল প্রথম লোকটা। ও আর ওর বন্ধুরা একাই সব কিছু ভোগ করতে চায়।

ওর কথায় কান দেবেন না, সিনর। ওকে ভাড়া করলে পস্তাবেন। ও রেজিস্টার্ড নয়।

কেন নই? ক্রুদ্ধ গলায় প্রশ্ন করল প্রথম লোকটা। কারণ তুমি আর তোমার বন্ধুরা আগেই সব দখল করে রেখেছ।

অফিশিয়াল গাইডের দিকে তাকাল রজার্স। ধোপদুরস্ত সাজে সজ্জিত সে, বোঝাই যায় ভালোই কামায় এবং যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসীও। আমি এ লোককে আগেই ভাড়া করেছি, বলল সে প্রথমজনের দিকে ইঙ্গিত করে।

বাউ করল অফিশিয়াল গাইড তারপর বিনাবাক্যব্যয়ে চলে গেল।

এখন বলো, বলল রজার্স, ট্যুর ছাড়া আর কী জিনিস তুমি আমাকে দেখাতে পার।

অনেক কিছুই সিনর।

জুয়া খেলার আসরে নিয়ে যেতে পারবে?

আপনি যেতে চাইলে নিশ্চয় নিয়ে যেতে পারব। আমার চেনা এরকম একটি মর্যাদাসম্পন্ন জায়গা আছে।

মর্যাদাসম্পন্ন? হেসে উঠল রজার্স, গাইডকে ভুরু কোচকাতে দেখে তার পিঠে চাপড় মারল।

ঠিক আছে, চলো তোমার মর্যাদাসম্পন্ন জায়গাটি একটু দেখে আসি।

বাদামী মুখে আবার ঝিলিক দিল ধপধপে সাদা দাঁত। বাউ করল গাইড, ত্রিশ ফুট দূরে রাখা একটি গাড়ি দেখাল হাত তুলে।

ওদিকে হাঁটা দিয়েছে রজার্স, রাস্তাটা যেন দুলে উঠল, সাদা আলোর বিচ্ছুরণ চোখে কেমন ঝাপসা ঠেকল। একপাশে কাত হয়ে গেল দেহ, হুমড়ি খেল। শক্তিশালী একটি হাত ওকে খপ করে ধরে ফেলল, সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল।

আপনি ঠিক আছেন তো, সিনর?

হুঁ।

হাসল গাইড, এক ছুটে গাড়ির সামনে গিয়ে দরজা খুলে ধরল। রজার্স ভেতরে বসলে বন্ধ করে দিল দরজা। তারপর ঘুরে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল।

গরম, জনশূন্য রাস্তা দিয়ে দশ মিনিট গাড়ি চলার পরে গন্তব্যে পৌঁছে গেল ওরা। রোদে পোেড়ানো ইট দিয়ে তৈরি পুরানো একটি বাড়ির সামনে এসে থামল গাড়ি। বাড়িটির দেয়াল নীলচে, গরাদঅলা জানালাগুলো বন্ধ।

শূন্য রাস্তায় চমকাচ্ছে রোদ। রজার্স চোখ কুঁচকে জানতে চাইল, এই সেই জায়গা?

জি, সিনর।

দেখে তো মনে হয় না ওখানে কোনও জনপ্রাণী আছে।

ওখানে কেউ না কেউ সবসময়ই থাকে। আপনি ভেতরে গিয়ে ওদের শুধু এই জিনিসটা দেবেন। একটা কার্ড বাড়িয়ে দিল গাইড।

ওটা নিল রজার্স। তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে?

জি, সিনর।

আমার ফিরতে দেরি হতে পারে।

তাতে কোনও সমস্যা নেই।

গাড়ি থেকে নামল রজার্স। বাড়িটির দরজা খুলতেই শীতল হাওয়া মোলায়েম পরশ বুলাল মুখে। চোখ মিটমিট করল সে। ঘরটি দেখে ঠিক জুয়াড়িদের আস্তানা বলে মনে হয় না। মৃদু স্বরে বাজছে যন্ত্রসঙ্গীত। একটি লম্বা টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে জনাআষ্টেক ডাইস-প্লেয়ার। ছোট একটি বার-এর পেছনে বসা লালমুখো এক মোটকু রজার্সের দিকে তাকিয়ে মাথা। দোলাল। গাইডের কার্ডখানা তার হাতে দিল রজার্স। মোটু ওকে নিয়ে লম্বা টেবিলটার দিকে এগোল যেখানে গড়াতে শুরু করেছে ডাইস।

.

ঘণ্টা তিনেক পরে বাড়িটি থেকে বেরিয়ে এল রজার্স। গাইড তখনও তার জন্য অপেক্ষা করছে। রজার্সকে দেখামাত্র সে গাড়ি থেকে নেমে খুলে ধরল দরজা। রজার্স ভেতরে ঢুকল।

আপনি ঠিক আছেন তো? হুইলের পেছনে বসে জিজ্ঞেস করল গাইড।

হু, জবাব দিল রজার্স। তবে সে মোটেই ঠিক নেই। মাতাল হয়ে আছে সে। তারচেয়েও খারাপ খবর হলো জুয়োয় পাই-পয়সাটি পর্যন্ত হারিয়েছে। কেমন খেললেন? জানতে চাইল গাইড।

খুব খারাপ।

ওহ্, তা হলে তো দুঃসংবাদ।

মস্ত দুঃসংবাদ, ভাবছে রজার্স। জুয়া খেলতে গিয়ে নিজের যে সর্বনাশ করেছে ভাবতেই অসুস্থ বোধ করল।

আর কোথাও যাবেন? বলল গাইড। নাকি হোটেলে ফিরবেন?

এখনই না।

আপনি যা বলেন। সোজা সামনের দিকে দৃষ্টি মেলে রইল গাইড, অপেক্ষা করছে। তারপর বলল, কোনও ভালো রেস্টুরেন্টে যাব?

কোনও রেস্টুরেন্টে যাব না।

শ্রাগ করল গাইড। তা হলে আপনিই বলুন কোথায় যেতে চান?

হোটেলেই চলে।

গাইড কোনও মন্তব্য না করে ছেড়ে দিল গাড়ি। বাহন চলতে শুরু করেছে, চোখ বুজল রজার্স।

এ আমি কী করলাম? ভাবছে সে। জুয়ার আস্তানার কথা মনে পড়তেই আবারও অসুস্থ বোধ করল। সে হেরেছে। শুধু নিজের অর্থই নয়, মোরেনোর কাছ থেকে মাল কেনার জন্য বাটলার যে টাকাটা দিয়েছিল সে টাকাটাও জুয়ায় খুইয়েছে রজার্স।

মাই গড, মনে মনে বলল সে। তবে সবকিছু এখনও শেষ হয়ে যায়নি। মোরেনো ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। হয়তো সে আর ফোন করবে না। হয়তো…

নিজের সঙ্গেই সে প্রতারণা করার চেষ্টা করছে, জানে রজার্স। মোরেননা তার সঙ্গে যদি যোগাযোগ না-ও করে, বাটলারের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। কারণ টাকাটা বাটলারের।

কাজেই মোরোনোর সঙ্গে কথা বলাই ভাল। ওর সঙ্গে যেভাবেই হোক যোগাযোগ করতে হবে তারপর যদি কথা বলে বুঝিয়ে সুজিয়ে…

এ অসম্ভব। মাদক ব্যবসায়ীদের কথার জাদুতে ভোলানো যায় না। তারা মাল দেবে, টাকা নেবে। বাকির কারবারে তারা নেই। তাদের ক্ষেত্রে শুধু টাকা কথা বলে। নতুবা অস্ত্র।

অস্ত্র! শব্দটা যেন রজার্সের মস্তিষ্কে, বিস্ফোরণ ঘটাল। থেমে গেল গাড়ি।

সিনর?

চোখ মেলল রজার্স। হোটেলের সামনে চলে এসেছে ওরা। রাস্তার চোখ ধাঁধানো অত্যুজ্জ্বল আলোটা নেই তবে রাস্তাটা এখনও কাঁপছে ওর চোখের সামনে।

আপনি কি অসুস্থবোধ করছেন? জিজ্ঞেস করল গাইড।

না, আমি ঠিক আছি। তবে এখানে বড্ড গরম। চলো ভেতরে গিয়ে একটু গলা ভেজাই।

কপালে ভাঁজ পড়ল গাইডের।

কী হলো?

আমাকে গাড়িটা চালাতে হবে, সিনর।

গাড়ি নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আসলে গাড়ির কথা তুমি ভাবছও না। তুমি ভাবছ আমি মাতাল হয়ে গেছি, না?

না। তবে আপনাকে খুব অস্থির ও চিন্তিত লাগছে।

মন্তব্যটা ধাই করে আঘাত করল রজার্সকে তবু চেষ্টাকৃত হাসি ফোঁটাল মুখে।

পৃথিবীর কোনও কিছু নিয়েই আমার দুশ্চিন্তা নেই। চলো, গলা ভেজাই। আমার গলা শুকিয়ে মরুভূমি।

আপনি যা বলেন।

গাইডের গলার স্বরে কোনও উত্তাপ নেই। তার আচরণ হঠাৎই কেমন অস্বস্তিকর ঠেকল রজার্সের কাছে। তবে সে জানে আসলে টাকা খোয়ানোর শোকটাই তাকে বিব্রত করছে।

গাইড দরজা খুলে দেয়ার আগেই নিজে দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রজার্স। নিজেই কাজটা করতে পেরেছে বলে খুশি লাগল। একটু হাসার ইচ্ছে জাগলেও হাসল না।

হোটেলের কাঁচের দরজা খুলে গেল। ঢোলা ইউনিফর্ম পরা ধূসর চুলো এক লোক গোমড়া মুখে বাউ করল রজার্সকে। লবিটি বেশ ঠাণ্ডা। বার-এ পা বাড়াল রজার্স। বিয়ার দিতে বলল বারম্যানকে। ফিরল গাইডের দিকে। সে-ও বিয়ার নেবে জানাল।

ওরা দুজন একটা টেবিলে বসে বিয়ার পান করছে, কিছুক্ষণ পরে বারম্যান হাঁক ছাড়ল, সিনর রজার্স?

এই যে এখানে।

আপনার ফোন। কোনও একটা বুদে ঢুকে কথা বলুন, প্লীজ।

ঘরের শেষ প্রান্তের একটি খালি বুদে ফোনের প্লাগ লাগিয়ে দিল সাদা জ্যাকেট পরা এক ছোকরা। এটুকু সময় অস্থিরতা নিয়ে অপেক্ষা করল রজার্স। মোরেনো ফোন করলে সর্বনাশ।

হ্যালো।

বাটলার বলছি। খবর কী?

কোনও খবর নাই।

ভেরী ব্যাড।

হুঁ।

আমাদের বোধহয় অন্য চিন্তা করা উচিত।

মানে?

আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আমি একজনকে চিনি। তার কাছ থেকে মাল কিনব।

স্তম্ভিত রজার্স চেপে ধরল রিসিভার। আবার পুরোটা নতুন করে শুরু করতে চাইছ?

অপেক্ষা করার চাইতে সেটাই করা ভাল নয় কি?

অপেক্ষাটা কে করছে, তুমি নাকি আমি? গত দুদিন ধরে শরীরের ঘাম ঝরিয়ে আমি অপেক্ষার প্রহর গুণে চলেছি। মোরোনোকে একটা সুযোগ তো দিতেই হবে।

আচ্ছা। কাল সকাল পর্যন্ত ওর জন্য অপেক্ষা করব। ঠিক আছে?

আচ্ছা। জবাব দিল রজার্স। জানে এর বেশি সময় সে চাইতে পারবে না।

ওকে। টেক ইট ইজি।

কেটে গেল লাইন। রজার্স ফোন রেখে ফিরে এল বার-এ। ফোনটা ওর মনে সাময়িক স্বস্তির বৃষ্টি ঝরালেও দুশ্চিন্তার মেঘ পুরোপুরি কাটেনি। কারণ বাটলার মানুষ হিসেবে খুবই নির্দয় এবং নিষ্ঠুর।

গাইড লক্ষ করছিল ওকে। ওর চেহারায় উৎকণ্ঠা এবং উদ্বেগের ছাপ দেখে ওকে খুশি করার চেষ্টা করল।

কিন্তু তুমি আমাকে খুশি করতে পারবে না, মনে মনে বলল রজার্স। আমার টেনশন কেউই দূর করতে পারবে না। সে বিয়ার শেষ করল।

আরেকটা নেবে?

আপনি যা বলেন, সিনর।

বারম্যান আরও দুটো বোতল এনে ভরে দিল গ্লাস। তাকে লক্ষ করতে করতে রজার্সের মনে পড়ল মদের দাম তো সে দিতে পারবে না। সে তো ফতুর।

শুঙিয়ে উঠল রজার্স। তার গোঙানি শুনতে পেল গাইড। পকেটে হাত। ঢোকাল রজার্স। একটি মাত্র পেসো আছে। আমার কাছে আর পয়সা নেই, বলল সে। তুমি কি একটু…

নিশ্চয়, হাসল গাইড। মদের দাম চুকিয়ে দিয়ে বকশিসও দিল।

ধন্যবাদ।

ধন্যবাদের কিছু নেই।

মদ্যপান শেষে ওরা বার থেকে বেরিয়ে এল। এখন, ভাবছে রজার্স। আর ফেরার উপায় নেই। ওকে আবার চেষ্টা করতে হবে।

ব্যাপারটা ফয়সালা করে ফেলি, বলল সে গাইডকে। আমার কাছে তোমার কত পাওনা হয়েছে?

একটু ভেবে নিয়ে জবাব দিল গাইড। একশো পেসো।

ও, আচ্ছা। টাকাটা পরে নিলে চলবে তো? তোমার সঙ্গে আমার কাজ এখনও শেষ হয়নি।

নিশ্চয়, সিনর। আমার কোনও তাড়া নেই।

হাসল রজার্স। একশো পেসো তার জন্য কোনও টাকাই নয়। কিন্তু গাইডের কাছে-এক হাজার পেসো পেলে সে কী না করতে পারবে? যদি…

নিজের চিন্তার গাড়ির ব্রেকটা থামিয়ে দিল রজার্স। সে আর কিছু ভাবতে চাইছে না। কিছু ভাবতে পারছেও না।

আবার ডাকব তোমাকে। তখন টাকা পয়সার হিসেবটা বুঝিয়ে দেব।

আপনি যা বলেন।

তোমাকে কোথায় পাব?

হোটেলের সামনে। কিংবা রাস্তার ওপাশের বার-এ।

ঠিক আছে।

এলিভেটরে পা বাড়াল রজার্স। লবিটি আগের চেয়েও অন্ধকার লাগছে। খুলে গেল এলিভেটরের দরজা। ভেতরে ঢুকল রজার্স। লিফটম্যানকে বলল, চালতলা, প্লীজ।

কখন এলিভেটর থেকে নেমেছে আর কখন লম্বা হলওয়ে ধরে হাঁটা দিয়েছে কিছুই মনে নেই রজার্সের। সে নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তালায় ঢোকাল চাবি, খুলতে এত বেশি সময় লাগল যে দরজার ওপরের রুম নম্বরে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে লিন সঠিক ঘরটিতেই সে এসেছে কিনা।

খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকল রজার্স। জানালা দিয়ে ঠিকরে আসা সাদা আলো তার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। জানালা বন্ধ করে দিতে চাইল রজার্স কিন্তু বিছানার ওপরে একটা কাঠের গুঁড়ির মতো দড়াম করে পড়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। ঘুম ভাঙল ফোনের ঝনঝনানিতে। ততক্ষণে সাঁঝের আঁধার ঘনিয়েছে ঘরে। ফোনেস হাত বাড়াল রজার্স।

হ্যালো?

আবার বটলার। জানতে চাইল মোরেনো ফোন করেছিল কিনা।

এখনও করেনি, জবাব দিল রজার্স।

লাইন ছেড়ে দিল বাটলার। বিছানা ছাড়ল রজার্স। সুইচ টিপে বাদি জ্বালল। তাকাল আয়নায় নিজের ভীত, বিবর্ণ প্রতিবিম্ব অচেনা লাগল।

দ্রুত বাথরুমে ঢুকল রজার্স। মুখে ঠান্ডা পানি ছিটাতে লাগল। এমন সময় আবার বেজে উঠল ফোন। ফোনের শব্দ ওকে চমকে দিল ভীষণ। যেতে পা সরছে না। আবার নিশ্চয় বাটলার। বাতিল করে দিতে চাইছে চুক্তি।

আরও একবার বাজল ফোন। শেষে ফোন ধরল রজার্স।

সিনর রজাস?

বলছি।

মোরোনো।

ঈশ্বর, অবশেষে ফোন করলেন আপনি।

দুঃখিত, তবে এ ব্যবসায়ে তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে নেই।

জানি আমি। আপনি রেডি তো? কোথায়…?

গুয়াডেলুপ গ্রামে। আমার লোক আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।

গুয়াডেলুপ কোথায়?

১১৮

আপনার হোটেল থেকে গাড়িতে আধঘণ্টার রাস্তা। যে কোনও গাইড আপনাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে আসতে পারবে।

ওখানে পৌঁছাবার পরে কী করব?

চার্চ থেকে সোজা প্লাজা অভিমুখে একটা রাস্তা দেখতে পাবেন। ওই রাস্তার শেষ মাথার বাড়িটা। ওখানে কেউ থাকে না। বলে লাইন কেটে দিল মোরেননা।

রিসিভার নামিয়ে রাখল রজার্স। ঘুম মদ্যপানের ঝিমানি কাটিয়ে দিয়েছে। পরিষ্কার হয়ে গেছে মাথা, সবকিছু ঠিকঠাক চিন্তা করতে পারছে ও। জানে কী করতে হবে। অবশ্য জুয়ার আস্তানায় টাকা খোয়ানোর পরেই সে তার পরবর্তী করণীয় সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল।

আগ্নেয়াস্ত্রটি একবার পরীক্ষা করে দেখল রজার্স, তারপর ওটা সরিয়ে রেখে দরজা অভিমুখে হাঁটা দিল। একটা অস্বস্তিবোধ ওকে থামিয়ে দিল মাঝপথে।

আবার ও রওনা হলো দরজায়, তারপর ফিরে এল, ফোন তুলে কথা বলল বাটলারের সঙ্গে।

সব ঠিক হয়ে গেছে, জানাল সে বাটলারকে। যোগাযোগ হয়েছে।

গুড। আমি তোমার তরফ থেকে খবর শোনার অপেক্ষায় থাকব। টেক ইট ইজি।

আচ্ছা, গুয়াডেলুপ সম্পর্কে কী জানো?

ওটা কুড়ি মাইল দূরে মরুভূমির মধ্যে একটি গ্রাম। ওখানে যেতে বলেছে?

হ্যাঁ।

তো?

জায়গাটা নিরাপদ তো?

নিশ্চয়। কেন, কী হয়েছে?

কিছু না। ডেলিভারিটা তো এখানেও হতে পারত। হচ্ছে না বলে একটু অদ্ভুত লাগছে।

শহরের পরিবেশ গরম তোমাকে তো বলেইছি। মোরেনো খুব সতর্ক মানুষ। সে কোনও ঝুঁকি নেয় না। তোমার প্রশ্নের জবাব পেলে?

হুঁ।

গুড। তোমার খবরের অপেক্ষায় রইলাম। কথা শেষ করল বাটলার। হোটেলের সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে গাইড। রজার্স তাকে দেখে হাত নাড়ল।

শুভ সন্ধ্যা, সিনর। কোথাও যাবেন?

হ্যাঁ। গুয়াডেলুপ নামের কোনও জায়গা চেন?

অবশ্যই চিনি।

আমাকে ওখানে নিয়ে চলো।

নিশ্চয়। হেসে গাড়ির দিতে ইঙ্গিত করল গাইড। ওটা আপনার সেবায় নিয়োজিত।

মিনিট পনেরো বাদে ওরা শহরতলী ছেড়ে অন্ধকার গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করল। দুজনেই নিশ্চুপ। শেষে নীরবতা ভঙ্গ করল রজার্স।

আমার কাছে তোমার পাওনা একশো পেসো, না?

জি, সিনর।

আর মদের দাম দিয়েছ কত?

বারো পেসো।

খুবই কম।

আমার জন্য এ টাকাটাই বিরাট কিছু।

কত বিরাট?

অনেক। এ ব্যবসায় হপ্তায় প্রতিদিন কেউ ট্যুরিস্ট ধরতে পারে না। বিশ্বাস করুন, এখানে জীবন ধারণ খুব কঠিন।

কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল রজার্স। আরও এক হাজার পেসো আয়ের সুযোগ পেলে কেমন হয়?

গাড়ির গতি মন্থর হয়ে এল, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল গাইড। হাসল। সে অনেক টাকা, সিনর। কিন্তু আমাকে কী করতে হবে?

আমাকে গুয়াডেলুপে নিয়ে যাবে এবং মুখখানা বন্ধ রাখবে।

আরও কমে এল গাড়ির গতি। এখন আর হাসছে না গাইড। শুধু এ জন্য হাজার পেসো?

রজার্স জানে এসে গেছে মাহেন্দ্রক্ষণ। সে আগ্নেয়াস্ত্রটি বের করে বলল, সম্ভবত এটা ব্যবহার করতে হবে আমাকে। তবে প্রশ্ন কোরো না কেন। কী, কাজটা করবে?

পিস্তলের দিকে আড়চোখে তাকাল গাইড তারপর সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল। এক হাজার পেসো পেলে আমি ভুলে যাব যে আমার জিভ, কান এবং চোখ বলে কোনও অঙ্গ আছে।

গুড, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পিস্তলটি পকেটে পুরল রজার্স। গাড়িটি অন্ধকারে ঢাকা, এবড়োখেবড়ো একটি রাস্তায় মোড় নিল। গুয়াডেলুপের প্রাজায় না পৌঁছা পর্যন্ত আরোহীদের দুজনের কেউই কোনও কথা বলল না। একটি বেঞ্চিতে বসে আছে এক বুড়ো। আর কাউকে চোখে পড়ল না।

মরা গ্রাম, মন্তব্য করল রজার্স।

হ্যাঁ। এখানকার বাসিন্দারা একটু তাড়াতাড়িই ঘুমাতে যায়। বলল গাইড। প্লাজার বিপরীত দিকের রাস্তায় হাত তুলে দেখাল রজার্স।

ওদিকে চলল। রাস্তার মাথার শেষ বাড়িটিতে যাব। তুমি গাড়িতে বসে থাকবে।

জি, সিনর।

প্লাজা ঘুরে রজার্সের নির্দেশিত রাস্তায় ঢুকল গাড়ি। এ রাস্তাটিও বড্ড অমসৃণ এবং কাঁচা। বাড়িগুলো অন্ধকার এবং নীরব। গাইড ধীরস্থিরভাবে গাড়ি চালিয়ে রাস্তার মাথার শেষ বাড়িটির সামনে চলে এল।

এখানে? সন্দেহের স্বরে প্রশ্ন করল গাইড। তার অবশ্য কারণ ছিল। কারণ বাড়িটি ভাঙাচোরা, বিধ্বস্ত দেয়াল, ছাদ অদৃশ্য, দরজারও বালাই নেই। বাড়িটির দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল রজার্স। ওখানে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না মোটেই কিন্তু উপায়ও তো নেই। সে পকেট থেকে বের করল পিস্তল। গাড়ি থেকে নামল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করছে।

নির্জন রাত তবে পরিত্যক্ত বাড়িটি বড় বেশি নীরব লাগছে। গা কেমন ছমছম করে উঠল রজার্সের। সামনে কদম বাড়াল সে।

দোরগোড়ায় পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ল রজার্স। মুখ হাঁ করে শ্বাস টানল। তারপর গৃহ প্রবেশ করল।

যেমনটা আশংকা করেছিল অতটা অন্ধকার নয় ঘর। আকাশ থেকে ভেসে আসা আলোয় দেখা গেল এটি প্রকান্ড একটি কক্ষ। খালি। ঘরের পেছনদিকে আরেকটি কপাট বিহীন দরজা।

ওদিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রজার্স। অপেক্ষা করছে। অকস্মাৎ শিরশির করে উঠল শরীর। ভাবছিল ও এখানে এসে কোনও ভুল করে ফেলল কিনা। মনে হচ্ছে মোরেনোর সঙ্গে বহুদিন আগে সে ফোনে কথা বলেছে। তাদের কথোপকথন এখন একটা স্বপ্নের মতই ঠেকছে। সবকিছু কেমন অবাস্তব লাগছে।

আমি একটা স্বপ্ন দেখছি এবং আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব, মনে মনে। বলল রজার্স। হঠাৎ ক্ষীণ একটা শব্দ হতেই পাঁই করে ঘুরল। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে গাইড, হাতে পিস্তল।

তুমি এখানে কী করছ? গর্জন ছাড়ল রজার্স। হাসল গাইড।

আপনার পকেট থেকে অস্ত্রটি বের করে মেঝের ওপর ফেলে দিন, সিনর, এবং পিছু হঠুন। বলল সে। হুকুম পালিত হলে সে আগে বাড়ল।

মেঝে থেকে রজার্সের পিস্তল তুলে নিয়ে কোমরের বেল্টের ফাঁকে জল।

এসবের মানে কী? জানতে চাইল রজার্স।

মানে আপনি বুঝতে পারছেন না, সিনর?

মাই গড, তুমি মোরেনো!

মাথা নাড়ল গাইড। না, তবে আমি মোরেনোর লোক। আমার সঙ্গেই আপনার এখানে সাক্ষাৎ হবার কথা ছিল।

ভয়ে কাঠ হয়ে গেল রজার্স, ইচ্ছা করল জোরে চিৎকার করে কাঁদে, কিন্তু গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরুল না। আবার মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নের মধ্যেই সে যেন সামনে দাঁড়ানো লোকটিকে লক্ষ্য করে লাফ দিল, হাত বাড়িয়ে দিয়েছে গলা টিপে ধরতে।

আর সে মুহূর্তে মোরেনোর চ্যালা টিপে দিল পিস্তলের ট্রিগার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *