জন্তুদের ভাষা

জন্তুদের ভাষা

বিরাট মাঠ। পশু চরবার সুন্দর জায়গা। এমনি এক মাঠে এক খড়ের গাদায় হঠাৎ আগুন লেগে গেল। খড়ের গাদা জ্বলছে। নীচে শুয়ে এক মস্ত সাপ। সাপ ভাবলে আর তো রক্ষে নেই, এখন পালাই কী করে? সাপ ভাবে আর হিস হিস শিস দেয়। মাঠের কাছেই চরছিল একপাল গোরু ভেড়া। রাখাল শোনে হিস হিস। কার শিস? ছুট ছুট ছুট রাখাল ছুটল। কে দেয় শিস? হিস হিস হিস।

রাখাল এসে দাঁড়াল খড়ের গাদার গা ঘেঁষে। সাপ রাখালকে দেখতে পেয়ে বলে, ‘রাখালভাই রাখালভাই তোমার লাঠিটা বাড়িয়ে দাও না। আমি জড়িয়ে ধরি আর তুমি মারো টান। নয়তো যে ভাই পুড়ে মরি।’ ‘সে কী কথা? অমন করে কি টেনে বের করা যায়? আমি বের করি আর তুমি আমাকে এক ছোবলে শেষ করে দাও আর কী।’ সাপ ভারী অনুনয় বিনয় করতে লাগল। ‘সত্যি ভাই বিশ্বাস করো কক্ষনও কামড়াব না। হলপ করে বলছি।’ রাখালের মন একটুও নরম হল না দেখে সাপ এবার লোভ দেখালে। বললে, ‘একবার রক্ষা করো ভাই আগুনের হাত থেকে, তোমাকে মস্ত উপহার দেব।’ রাখাল কথা কানেই তোলে না আর এদিকে সাপ বলেই চলে, ‘দোহাই দাদা, পায়ে পড়ি দাদা একবারটি বাঁচাও।’ সাপের কাকুতি-মিনতিতে রাখালের ভারী মায়া হল। আ— হা বেচারি সাপ। মস্ত লাঠিটা বাগিয়ে ধরে খুব জোরে দিলে খড়ের গাদার তলে ঢুকিয়ে। সাপ লাঠিটা জড়িয়ে ধরলে— হেঁইয়ো— এক টানে রাখাল সাপকে এক্কেবারে বের করে আনলে আগুনের বাইরে। আর সাপ করেছে কী তক্ষুনি সোজা রাখালের গলা বেড়ে ফণা উঁচিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল।

‘ও হরি, এই তোর প্রতিদান।’ রাখাল বলে, ‘তবে তো দেখছি বুড়িরা ঠিকই বলে। উপকার করতে চাও করো বাপু, কিন্তু উলটে কেউ তোমার উপকার করবে অমনটি আশাও কোরো না।’

সাপ উত্তরে বলে, ‘আমাকে নিয়ে চলো আমার বাবার কাছে। ভয় পেয়ো না। আরে আমার বাবা হলেন সাপেদের রাজা। তোমায় কিচ্ছুটি করবেন না।’ রাখাল বলে, ‘সে আমি পারব না বাপু। আমার একপাল পশু মাঠে চরছে। বাগালি করবে কে?’

‘আহা, তুমি ভয় পেয়ো না। তোমার পশুর দল ঠিকই থাকবে। কিচ্ছুটি হবে না। আমি কথা দিচ্ছি। এই আমাকে তুলবে, বাবার কাছে পৌঁছে দেবে আর ফিরে আসবে, ব্যস।’

কী আর করে রাখাল। রাজি হয়ে গেল। পথে পা বাড়াল। চলতে চলতে হাজির হল এক মস্ত প্রাসাদে। সে প্রাসাদে যে কত সাপ সে আর কী বলব? সাপ গিজগিজ। সাপ সড়সড়। সাপ হিস হিস। বড় সাপ, মেজ সাপ, হলহলে সাপ সনসনে সাপ, আরও কত যে সাপ তার ইয়ত্তা নেই।

রাখালের পিঠের সাপটা ফিসফিস করে কী যেন বললে। অমনি সাপের দল গেল সরে, রাখালকে দিল পথ করে। এবার সেই সাপটা রাখালকে বলল, ‘দাঁড়াও যা বলি মন দিয়ে শুনবে। আমার বাবা আমাকে দেখে এত খুশি হবেন যে তুমি যা চাইবে তাই উপহার দেবেন। সোনা চাও সোনা, রুপো চাও রুপো। কিন্তু দেখো ও সব কিছু চেয়ো না। তুমি বলবে আমাকে এমন বর দিন যাতে পশুপাখির ভাষা আমি বুঝতে পারি। প্রথমে কিন্তু বাবা রাজি হবেন না। কিন্তু ছেড়ো না। শেষ পর্যন্ত ঠিক রাজি হতেই হবে।’

নিজের মেয়েকে এতদিন পরে দেখে সাপেদের রাজা তো আনন্দে আত্মহারা। কেঁদেই ফেললেন সাপরাজা। তারপর চোখটোখ মুছে মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে বললেন, ‘ছিলি কোথায় মা এতদিন?’

সাপ সব খুলে বললে। কেমন করে ভাগ্যের ফেরে জ্বলন্ত খড়ের গাদা চাপা পড়েছিল। কেমন করে রাখাল তাকে বাঁচালে। সব শুনে সাপরাজা রাখালের দিকে ফিরে বললেন, ‘তুমিই আমার মেয়ের প্রাণ বাঁচিয়েছ। তোমাকে কিছু উপহার দিতে চাই। কী চাও বলো।’

রাখাল বললে, ‘আর কিছুই চাই না রাজামশাই, বর দিন যেন পশুপাখির ভাষা আমি বুঝতে পারি।’

‘না, না, না ও বর আমি দিতে পারব না।’ সাপরাজা আপত্তি জানান। ‘ও ভারী সাংঘাতিক বর। আমি তো বর দিয়ে খালাস। আর যদি তুমি ভুল করেও ওই বরের কথা কারও কাছে উচ্চারণ করেছ, বা তা নিয়ে কারও কাছে গর্ব করেছ— ব্যস আর দেখতে হবে না। তৎক্ষণাৎ নির্ঘাত মৃত্যু। অন্য কিছু চাও বাছা, ওই বরটি চেয়ো না।’

‘আর কিছুই আমার চাই না’ রাখাল বলে ‘এই সামান্য বর, তা দিতেও যখন আপনি গররাজি, ঠিক আছে, চললেম, কিছুই দিতে হবে না। বিদায় দিন।’

রাজামশাই আর কী করেন। অবশেষে বললেন, ‘তোমার কথাই রইল। যে বর চেয়েছ তাই দিচ্ছি। হাঁ করো।’ রাখাল হাঁ করল। সাপরাজা মুখে মুখ দিয়ে মস্ত ফুঁ দিলেন। তারপর মস্ত শ্বাস টেনে বললেন, ‘ব্যস এবার থেকে তুমি সব পশুপাখির ভাষা বুঝতে পারবে, কিন্তু সাবধান একথা কাউকে বলেছ কী মরেছ। নির্ঘাত মৃত্যু।’ সবার কাছে বিদায় নিয়ে রাখাল বাড়ির দিকে পা বাড়ালে। পথে যেতে সামনে এল এক প্রকাণ্ড বন। রাখাল বনের পথ ধরলে।

গাছ আর পাখি মনের কথা কয় রাখাল সব বোঝে। ঘাসের সঙ্গে কানাকানি কীট-পতঙ্গের। রাখাল তাও বোঝে। রাখাল হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এল সেই মাঠে যেখানে তার গোরু, ভেড়া, ছাগল, মোষ চরছিল। ভাবল একটু জিরিয়ে নিই। একটা গাছে ঠেসান দিয়ে বসেছে— অমনি কোথা থেকে দুটো দাঁড়কাক উড়ে এসে জুড়ে বসল ঠিক ওই গাছটারই ডালে। একটা অন্যটাকে বলল, ‘হায় রে রাখাল যদি জানত—

ওই যেখানে কালো ভেড়ার চামড়া পাতা

তারই তলে রাজার ধন আছে পোঁতা।’

কথাটা কানে যাওয়ামাত্র রাখাল ভেড়ার চামড়াটা সরিয়ে খুঁড়ে বের করলে গুপ্তধন। ঘড়া ঘড়া মোহর। রাখাল তো ভারী খুশি। সব নিয়ে চলল বাড়ি। মস্ত দালান বানাল। বিয়ে-শাদি করে মনের সুখে মহা আরামে থাকতে লাগল।

কিছুদিনের মধ্যেই রাজ্যে সবচেয়ে ধনী হয়ে উঠল সেই রাখাল। একদিন রাখাল তার বউকে ডেকে বললে— ‘যত রান্না জানিস কর। চল্লিশ ব্যঞ্জন চাই। কিচ্ছু যেন বাদ না যায়।’ বউ রাখালের কথামতো রেঁধেবেড়ে তৈরি। রাখাল তার যত বন্ধু ছিল সবাইকে নেমন্তন্ন করল। সবাই এল। আয়োজন দেখে সবাই অবাক। রাখাল বলে,

‘খাবার দাবার, আবার আবার

ফুর্তি মজায় রাতটি কাবার,

রঙিন হেন দিনটি যেন

থাকেই মনে গাঁয়ের সবার।’

‘তোমরা চালাও ভোজ। আজ রাতে আমি একা সব পশুর পাল পাহারা দেব।’ নিমন্ত্রিতের দল ভূরিভোজে মত্ত। রাখাল চলল পশুর পাল সামলাতে।

বেশ রাত হয়েছে। পালে পড়ল বাঘ। নেকড়ে গুটিগুটি এগোয় আর নিজের ভাষায় বলে, ‘হৃষ্টপুষ্ট ভেড়াটি পেলে মন্দ হয় না।’ ‘তা আর মন্দ কী? আমরাও দলে আছি, তারপর বখেরা হবে।’ বলে কুকুরের দল। তাদের দলে একটা বুড়ো কুকুর। দুটি বড় দাঁত তার নাই রে। আর সেই কিনা বলে,

‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার

যতখন এই দুটি দাঁত মোর থাকবে

মনিবের পশু সব আগলিয়ে রাখবে।’

রাখালের কানে কথাটা পৌঁছোল। পরদিন সকাল হতে না হতে রাখাল সব বন্ধুদের ডেকে পাঠাল। বললে, ‘এই বুড়ো কুকুরটা ছাড়া সব ক’টাকে পিটিয়ে মারো।’ হায় হায় সব রাখাল পড়ল মিছিমিছি কুকুরগুলোর পিছে। ‘যা বলি তাই করো।’ রাখাল বলে। কী আর করে। ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছেয় হোক রাখালের কথা শুনতেই হল। সবাই মিলে লেগে গেল কুকুর মারতে। খবর কি আর চাপা থাকে। সারাগাঁয়ে রটে গেল কুকুর মারার কথা।

রাখালের বউ আবার চুপ করে থাকতে জানে না। ‘কী কাণ্ড দেখলে, বুড়ো কুকুরটা ছাড়া সব ক’টা কুকুরকে পিটিয়ে মেরে ফেললে গো।’ যার সঙ্গে দেখা হয় তাকেই বলে রাখালবউ।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই করেছি। আচ্ছা জব্দ। যেমন কর্ম তেমনি ফল।’ রাখাল মিটিমিটি হাসে আর কথাগুলো বলে।

‘হাসছ কেন?’ গিন্নি শুধোয়।

‘কথা একটা মনে হল। হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল।’ রাখাল জবাব দেয়।

কিন্তু কথার ঝুড়ি রাখালবউ মানবে কেন? জবাবটা তার পছন্দ হল না। বারবার পীড়াপীড়ি করতে লাগল।

‘বল বল বল বল না,

হাসলি কেন বল না।’

রাখাল জবাব দেয় না। এড়িয়ে যায়। একথা বলে, সে কথা বলে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। ভবি ভোলবার নয়। রাখাল বউয়ের সেই এক বুলি,

‘বল বল বল বল না,

হাসলি কেন বল না।’

শেষকালে রাখাল আর কী করে বলেই ফেলল। ‘হেসেছি কেন যদি বলি তা হলে এক্ষুনি তুই আমার মরা মুখ দেখবি।’ বউ তবু জেদ করে বলে,

‘না হয় বা তুই মরলি,

(তবু) বল না কেন ধরলি,

মুচকি হাসি ঠোঁটে?

গোপন ব্যাপারখানা

যদি না যায় জানা

স্বস্তি না পাই মোটে।’

রাখাল নাচার। বলে, ‘তবে একটা কবর খোঁড়।’ কবর খোড়া হল। রাখাল সেই কবরে শুল। ‘যদি গোপন কথা শুনতে চাস তো কাছে আয়। কিন্তু একথা জেনে রাখ গোপন কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু আমি মরে যাব।’ রাখাল চারিদিকটা একবার ভাল করে দেখে নিল। দেখে কাছেই সেই বুড়ো কুকুরটা দাঁড়িয়ে। কথাবার্তা শুনে সে এসেছে দেখতে ব্যাপারখানা কী? রাখাল বউকে বললে, ‘কুকুরটাকে একটু রুটি দেও তো।’ পাহারাদার বুড়ো কুকুরটা কিন্তু রুটির দিকে ফিরেও তাকাল না। কেবল করুণ দুটি চোখ তুলে প্রভুর দিকে চেয়ে রইল। কাছেই ছিল একটা মোরগ। রুটির টুকরো চোখে পড়তেই হেলেদুলে দৌড়ে এল রুটির লোভে। এসেই খুঁটে খেতে লাগল।

পাহারাদার কুকুরটা রেগে বললে, ‘নিলাজ বেহায়া মোরগ। হতভাগা দেখছিস না মনিব যে মরে যাচ্ছে।’ ‘মরুক গে, যেমন হাঁদা ঠিক হয়েছে। নিজের দোষে নিজেই মল। দেখ না আমার কত বউ। যেই আমি একটা কণা খাবার খুঁজে পাই অমনি সবাইকে ডাকি। যাতে নিজেরাই বুঝে নেয় কার ভাগে ক’টা পড়বে। একটাও যদি মুখ হাঁড়ি করে, অমনি আমি ঝুঁটি ধরে এমন উত্তম-মধ্যম লাগাই যে তক্ষুনি সব ঠান্ডা। আর মনিবের মোটে একটা বউ তাও সামলাতে পারছে না।’ মোরগের ভাষা রাখালের কানে পৌঁছোতেই সে তো সবই বুঝতে পারল। তক্ষুনি কবর থেকে উঠে ডান্ডা নিয়ে ছুটল বউ ঠ্যাঙাতে। তারপর আর কী? বউ আর কোনওদিন জিজ্ঞেস করেনি কেন রাখাল হেসেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *